কাছের সঙ্গী – ১০
।। ১০।।
আমি জানি তুমি কষ্ট পাচ্ছ। মাকে পুজো করতে পারবে না কথাটা বলার সময়েও তোমার খুব কষ্ট হয়েছে।
আমি পড়েছি তোমার চোখের পাতার অব্যক্ত যন্ত্রণাদের। মাধবীর গভীর চোখের দিকে তাকিয়ে হালকা স্বরে শঙ্কর বললো, মাধবী তুমিও বড় হয়ে গেলে তাই না? সব জটিলতার মানে বুঝে গেলে! সংসারের জটিলতা, মানুষের মনের অন্ধকার রূপ, আভিজাত্যের অহংকার, সব কিছু বুঝে গেলে তাই না?
মাধবীলতা, তুমি অন্তত এসবের বাইরে থাকো, যেখানে গিয়ে বসলে আমি দুদণ্ড শান্তি পাবো। তুমিও যদি জটিল হয়ে যাও, তাহলে প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নেব কোথায়!
মাধবী একটু ক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলো চুপ করে, তারপর ছাদ থেকে নেমে এলো।
মাধবীর চলে যাওয়ার দিকে একমনে তাকিয়ে ছিল গৌরীশঙ্কর। দুশ্চিন্তার মধ্যেও এই একটা মুখ দেখলে মনখারাপি বাতাস মুহূর্তের জন্য পথ ভোলে, একমুঠো টাটকা বাতাস এসে বলে, এখনো বেঁচে আছো তুমি, এ পৃথিবীতে এখনো একটা মানুষ আছে, যে তোমায় ভালবাসে।
কলকাতা থেকে গৌরীশঙ্কর মহেশডাঙা এসেছে মাত্র দিন তিনেক আগে। এর মধ্যেই রায়চৌধুরী পরিবারের আভ্যন্তরীণ অসন্তোষে হাঁপিয়ে উঠেছে ও। সকলের অভিযোগ ওকে ঘিরে। স্কুল, কলেজে পড়ার সময় যখন কলকাতা থেকে ছুটিতে মহেশডাঙা আসতো তখন ওর মনে হতো বাতাসে ধূপের গন্ধ, মাটিতে প্রাণের সারা। সব কিছু কেমন বদলে গেল ধীরে ধীরে। চন্দ্রশঙ্কর রায়চৌধুরী মারা যাবার পরেই এবাড়ির সেই ঠাটবাট অর্ধেক হয়ে গিয়েছিল। নায়েবখানার ঝাড়লণ্ঠনের আলো তখন থেকেই ম্রিয়মাণ হয়ে গিয়েছিল। তবুও চন্দ্রশঙ্করের রেখে যাওয়া সম্পত্তির পরিমাণ নেহাত কম ছিল না। কিন্তু উমাশঙ্কর রায়চৌধুরীর বৈষয়িক বুদ্ধি তার বাবার মত না হওয়ায়, সম্পত্তির পরিমাণ কমছিলো দ্রুত। ড্রাইভার থেকে চাকর বাকরদের ভরণ পোষণ করতেই নাজেহাল হচ্ছিলেন উমাশঙ্কর। তারপরেও লোক-লৌকিকতা, পুজো-আর্চার খরচ তো ছিলই। দাদু যখন মারা যান তখন গৌরীশঙ্কর সবে মাধ্যমিক দিয়েছে। বয়েস নিতান্ত কম হলেও বুঝেছিলো, রায়চৌধুরী বাড়িতে এবারে আলোর রোশনাই কমে যাবার দিন উপস্থিত। সকলের আলোচনা শুনে এটুকু বুঝতো ওর বাবা দাদুর মত বিষয়ী মানুষ ছিলেন না। তবে বাবাকে ওর মন্দ লাগতো না। খেয়াল খুশি মত চলতে ভালোবাসতো। রক্তে আভিজাত্যের অহংকার থাকলেও মাটিতে মেশার চেষ্টাও ছিল আপ্রাণ। আর গৌরীশঙ্কর হয়েছিল এদের সকলের থেকে আলাদা। জমিদার শব্দটাতেই ওর মারাত্মক এলার্জি ছিল। বড়মামা প্রায়ই বলতো, বুঝলি গৌরী জমিদার শব্দটার মধ্যে ঐতিহ্য নেই রে বরং শোষণ লুকিয়ে আছে। তুই যদি জমিদারদের ইতিহাস পড়িস, তাহলেই বুঝতে পারবি দান ধ্যান করা জমিদাররাও প্রজাদের শোষণ করে খাজনা আদায় করেছে কোনো এক সময়। তুই ভেবে দেখ, একশ্রেণীর মানুষ নিয়ত পরিশ্রম করে যাচ্ছে একশ্রেণী তার ফল ভোগ করছে বিনা পরিশ্রমে শুধু সম্পত্তি বেশি থাকার কারণে। মামার কথাগুলো বেশ পছন্দ হয়েছিল অল্পবয়েসের আবেগপ্রবণ গৌরীশঙ্করের। তাই তো ক্লাস ইলেভেনে ভর্তির পরে যখন মাধবীলতা বলেছিল, কি গো জমিদারের ছেলে, এত ভালো রেজাল্ট করলে তারপরেও মিষ্টি খাওয়ালে না, এ কেমন বন্ধুত্ব!
গৌরীশঙ্কর বিরক্ত হয়ে বলেছিল, প্লিজ মাধবী, আমায় বন্ধু বলো বা শত্রু বলো, কখনো জমিদারের ছেলে বলো না। নিজেকে কেমন যেন অপরাধী মনে হয়। যবে থেকে এই শব্দটার সঠিক অর্থ বুঝতে পেরেছি, তবে থেকেই নিজেকে সাধারণ নাগরিক বলে বেশি খুশি হই, জমিদারের ছেলে বলার থেকে। মাধবীলতা হেসে বলেছিল, ওমা রাগ করছো কেন! জমিদার মানেই কি অত্যাচারী ছিল নাকি! কত জমিদার গ্রামে কুয়ো, পুকুর খনন করে দিয়েছে, স্কুল করে দিয়েছে, তারাও তো জমিদার নাকি!
গৌরী একটু স্বাভাবিক হয়ে বলেছিল, তা ঠিক। এই জন্যই তোমায় আমার এত ভালোলাগে। তুমি সব খারাপের মধ্যে থেকেও ভালো খুঁজে বের কর। মহেশডাঙায় একমাত্র তোমার সাথেই গল্প করে শান্তি পাই।
মাধবীলতা ঠোঙা থেকে আলুর চপ বের করে বলেছিল, এই নাও খাও। তোমার ভালো রেজাল্ট হয়েছে বলে আমিই খাওয়ালাম। গৌরীশঙ্কর একটু থমকে গিয়ে বলেছিল, তুমি যাকে ভালো রেজাল্ট বলে আনন্দ পাচ্ছ, সেটা আসলে ওই স্কুলের অ্যাভারেজ রেজাল্ট। মামা খুব রাগ করেছে। একেবারেই খুশি হয়নি। বলেছে উচ্চমাধ্যমিকে যদি খারাপ রেজাল্ট করি, তাহলে মহেশডাঙায় ফেরত দিয়ে যাবে।
মাধবীলতা হাততালি দিয়ে বলেছিল, খুব ভালো হবে। আবার আমি আর তুমি রোজ গল্প করতে পারবো।
মুচকি হেসে গৌরীশঙ্কর বলেছিল, কেন তোমার আর সব বন্ধুদের সাথে গল্প করে মন ভরে না বুঝি?
ওই যে পীযুষ, রিনি, পলি এরা তো চব্বিশ ঘন্টা ঘিরে থাকে তোমায়, তুমিই তো এদের দলের পাণ্ডা, আমায় আবার কি দরকার! মাধবী অবাক হয়ে বলেছিল, তুমি তো আচ্ছা বোকা ছেলে গো, মাথায় তো কিছুই নেই দেখছি। এরা তো আমার এমনি বন্ধু আর তুমি তো….
গৌরীশঙ্কর ওর কথার রেশ ধরেই বলেছিল, হ্যাঁ সেটাই তো জানতে চাইছি, আমি কি? এদের থেকে আলাদা কিছু?
মাধবী সরল গলায় বলেছিল, ওমা আলাদাই তো, তুমি তো আমার সব থেকে ভালো বন্ধু। ঝগড়া হলেও রাগ করো না, আবার ভাব করে নাও।
গৌরীশঙ্কর অন্য কিছু শোনার অপেক্ষায় ছিল। কিন্তু ক্লাস সিক্সের মহেশডাঙার সরল মেয়েটার কাছ থেকে অন্য কিছু শুনতে পায়নি। তবে ওর অভিব্যক্তি বুঝিয়ে দিয়েছিল, এদের সকলের থেকে শঙ্করকে ও আলাদা চোখে দেখে। শঙ্কর বহুবার বলতে চেয়েছে মাধুকে, নিজের অনুভূতির কথা, ভালোবাসার কথা কিন্তু কিছুতেই বলে উঠতে পারেনি। যদি বন্ধুত্ব হারিয়ে যায়। যদি মাধবীলতা ওকে খারাপ ভেবে দূরে ঠেলে দেয়। মুখচোরা ঘরকুনো বন্ধুবিহীন শঙ্করের বড্ড ভয় করে মাধুকে হারানোর, তাই অনেক চেষ্টা করেও মাধবীকে কখনো বলে উঠতে পারেনি যে ও মাধুকে ভালোবাসে। ভালোবাসে সেই সেদিন থেকে যেদিন জিভ ভ্যাঙানোর অপরাধ মাফ করে দিয়ে, কুমারী পুজোর পুতুল পুতুল ঠাকুরটা ওর দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়েছিল। ভালো তো সেদিন থেকে বেসেছিলো, যেদিন মাটির ছোট্ট উননে নারকেলের মালাই চাপিয়ে পাক্কা গিন্নীর মত মাধু বলেছিল, বলো তোমার পছন্দের খাবার কি, সেগুলোই আজ আমি রাঁধবো।
ভালো তো সেদিন বেসেছিলে যেদিন, কাঞ্চনদীঘিতে ওর হাত ধরে নেমে এসে মাধু বলেছিল, আমি কিন্তু সাঁতার জানিনা, শুধু তুমি সাঁতার জানো তাই ডুবে যাবার ভয় বাদ দিয়ে নেমেই পড়লাম। মাধবীর চোখে শঙ্করের জন্য আবেগ দেখেছিলো, বিশ্বাস দেখেছিলো, অধিকারবোধ দেখেছিলো, তাই তো মাধবীলতা নামক মেয়েটাকে বড্ড কাছের মনে হয় ওর। মনে হয় মাধু যেন ওরই শরীরের একটা অংশ। কিন্তু মাধুটা যে কেন বড্ড ছোট! কিছুতেই বড় হয় না, আর কিছুতেই বোঝে না গৌরীশঙ্করের এই অন্যরকম অনুভূতিগুলোর কথা।
গৌরীশঙ্কর আরেকটু সাহস করে বলেছিল, মাধবী তুমি কাকে বিয়ে করবে?
মাধবী বিরক্ত হয়ে বলেছিল, আমি বিয়ে থা করবো না বাপু। বিয়ে করলেই মায়ের মত অনেক কাজ করতে হবে। আমি বিয়ে করবো না। তবে যদি কখনো বিয়ে করি, তাহলে যে আমার থেকেও চড়চড় করে গাছে উঠতে পারে, তেমন ছেলেকেই করবো। গৌরীশঙ্কর গাছে উঠতে পারে না। তাই উঁচু গাছ থেকে কিছু পেড়ে দিতেও পারে না মাধুকে। সে আক্ষেপ মাধু অনেকবার করেছে।
বার দুই উঁচু কৃষ্ণচূড়া গাছটার দিকে তাকিয়ে শঙ্কর বিরক্ত হয়ে বলেছিল, তাহলে বরং তুমি আমাদের মালিকাকাকেই বিয়ে কর! ও সুপারি গাছেও উঠতে পারে। কথাটা মাধুর মনে ধরেছিল। পরদিন ভোরে উঠেই বাগানে ঘুরতে ঘুরতে শঙ্কর শুনেছিল, মালিকাকা নিজের মনে হাসছে আর বলছে, এক্কেবারে পাগলী মেয়ে আমাদের মাধবীলতা। বলে কিনা, মালিকাকা আমি তোমাকেই বিয়ে করবো।
শঙ্করের ভীষণ রাগ হয়েছিল। বিকেলে মাধু কাঞ্চনদীঘির ধারে বসে আছে দেখেও, ও যায়নি। মাধু বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে মুখ কালো করে চলে গিয়েছিল। নিজেও চোখ ছলছল করে দূরে থেকে মাধুর চলে যাওয়া দেখেছিলো শঙ্কর। এমন অভিমান মাধুর ওপরে ওর অনেকবার হয়েছে। তারপর আবার কি করে যেন সব ভুলে গিয়ে মাধুর সব থেকে ভাল বন্ধু হয়ে গেছে ও।
আজও এই দোটানায়, অর্থনৈতিক সংকটের মুহূর্তে একমাত্র মাধবীলতাই এসেছিল ওর হাতে হাত রাখতে।
কিন্তু কিছু কষ্ট থাকে যেগুলোকে কারোর কাছেই বলা যায় না। পুরুষ মানুষ হয়ে নিজের অসহায়ত্বের কথা কি করে ঢাক ঢোল পিটিয়ে বলবে! কি করে বলবে মাসের শেষে তার হাতে সেদিন বাজারের টাকাটুকুই অবশিষ্ট থাকে। জমিদার বংশের সন্তান হয়ে কেরানির চাকরি করে জীবন কাটাচ্ছে, এতেই নাকি রায়চৌধুরী বাড়ির অপমান। কেউ বুঝতেই পারছে না কলকাতার মত শহরে, একটা ছোট মাথা গোঁজার মত ফ্ল্যাট কিনে দিন কাটানোটাও কতটা কঠিন। এ বাড়ির সকলে ভাবে ও বোধহয় মস্ত বড় চাকরি করে, ইচ্ছে করেই নিজের টাকা পয়সা জমাচ্ছে ব্যাংকে। গৌরীশঙ্কর নিতান্ত নিরুপায় হয়েই এবারে মায়ের কাছে বলেছিল, দুর্গা পুজো করার বিশাল ব্যয় ভার সে সামলাতে পারবে না। তাতেই এ বাড়ির সকলে এক বাক্যে তাকে কুপুত্র আখ্যা দিয়েছে।
ক্যালকুলেটর আর নিজের সেভিংস খুলে আতিপাতি করে খুঁজছে গৌরী, কোথা থেকে কতটা লোন নেওয়া যেতে পারে। অলরেডি কলকাতার ফ্ল্যাটের লোনটা রানিং, এমন কোনো সম্পত্তি নেই যেটা দেখিয়ে এক চান্সে পাবে অনেকগুলো টাকা। নিজের চুলের মধ্যে আঙুল চালিয়ে অকারণেই এলোমেলো করছিল চুলগুলো। কোনো উপায় বের করতে পারছিলো না গৌরীশঙ্কর। নিজেই মনে মনে ভাবছিলো, পুরুষের অনেক কিছুতেই বারণ থাকে। তাদের চোখের জলে থাকে নিষেধাজ্ঞা, যখন তখন তার অবাধ্য হওয়া মানা। একমাত্র রাতের অন্ধকারে নোনতা জলে বালিশ ভেজানো ছাড়া, কেউ যেন তার অস্তিত্ব বুঝতে না পারে, সেদিকে কড়া নজর রাখতে হয় পুরুষদের। পুরুষদের বলতে নেই, আমি অপারগ, আমার পকেটে টাকা নেই। নেই শব্দটা বললেই সকলে অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে থাকে, তাদের দৃষ্টিতে থাকে ভর্ৎসনা। তারা বুঝিয়ে দিতে চায়, তুমি নামেই পুরুষ, আসলে তুমি ভীষণ বেকার। চাহিদার সাথে জোগান দিতে না পারলেই তুমি সংসারের এক কোণের অবহেলিত বাসিন্দা হয়ে যাবে নিমেষে। গৌরীশঙ্করের অবস্থাও এখন বিষ্ণুকাকার বলা নায়েবখানার দেওয়ালে সদ্য গজিয়ে ওঠা বটগাছটার মত। যে দেওয়ালটা ভাঙার আপ্রাণ চেষ্টা করে চলেছে তার পৌরুষত্ব প্রমাণের আশায় কিন্তু পুরোনো বাড়ির মজবুত ভিতে তেমন দখল জমাতে পারছে না। ও নিজেও নিজেকে সক্ষম রোজগেরে পুরুষ প্রমাণের চেষ্টায় মাথা খুঁড়ে মরছে, ক্লান্ত হচ্ছে ওর চিন্তা ভাবনারা, রক্তাক্ত হচ্ছে ওর ব্যর্থ চেষ্টারা, তবুও এ বাড়ির রাজকীয় দুর্গাপুজোর খরচ সামলাতে পারছে না কিছুতেই। একটা ঘন কালো ব্যর্থতা ক্রমশ গ্রাস করছে ওকে। একটু একটু করে এগিয়ে আসছে ঘন কালো রংটা। কালো রংটা এতটাই তীব্র, যে আর সব রঙকে ঢেকে দিতে চাইছে সে খুব দ্রুত।
।। ১১।।
ঘন কালোর ওপরে লালের ছোপ ছোপ চুড়িদারটা পরে সাইকেল চালিয়ে এগিয়ে আসছে মাধবীলতা। ক্লাস টুয়েলভের মাধবীলতা একটু যেন অন্যরকম। দামাল কিন্তু খরস্রোতা নয়, বাঁকের ধারে একটু থামে কখনো বা। এক মাথা ঘন কালো চুল শাসন না মেনেই কোমর ছাপিয়েছে, বড় বড় দুটো চোখে কৌতূহলী চাহনি, উজ্জ্বল গায়ের রঙে আকর্ষণীয়। সদ্য যৌবনে পা রাখা মাধবীর শরীরেও ঘটেছে পরিবর্তন। সেই রোগা পাতলা মেয়েটা আর নেই। উদ্ধত স্তনে আর কোমরের ভাঁজে সে এখন পরিপূর্ণ নারী। সরল হাসিতে এক টুকরো লজ্জা মিশেছে। তার শাসন না মানা অবাধ্য চুলের গোছা যখন অকারণেই মাধবীর কপালে, মুখে চুম্বন করে.. তখন জগৎ ভুলে হাঁ করে গৌরীশঙ্কর তাকিয়ে থাকে তার বাল্যসখীর দিকে।
কি হলো চুপ করে আছো কেন! সামনেই আমার উচ্চমাধ্যমিক, এখনও আমি জিওগ্রাফি প্র্যাকটিক্যাল কমপ্লিট করতে পারিনি, সেটা শুনেও তুমি চুপ করে মুখের দিকে তাকিয়ে আছো! আরে কিছু হেল্প করবে কিনা বলো!
তাড়াতাড়ি সাইকেল চালিয়ে আসার জন্যই হয়তো অথবা উত্তেজনায় মাধবীর নাকের ডগায় হীরক বিন্দুর মত ঘামের ফোঁটা জমেছিল। সেদিকে একমনে তাকিয়ে ছিল গৌরীশঙ্কর। দ্রুত কথা বলায় মাধবী একটু জোরেই শ্বাস নিচ্ছিল, সেদিকে তাকিয়ে ও বললো, বুঝলাম তোমার বিশাল প্রবলেম। কিন্তু আমি তো ইঞ্জিনিয়ারিং স্টুডেন্ট, আমি এ ব্যাপারে তোমায় কি সাহায্য করবো?
মাধু বেশ অবাক হয়ে তাকালো, যেন খুব গর্হিত কথা উচ্চারণ করে ফেলেছে গৌরীশঙ্কর। তারপর ওর নিজস্ব ভঙ্গিমায় কোমরে হাত দিয়ে বললো, ওহ, আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম তুমি ইঞ্জিনিয়ারিং স্টুডেন্ট। তাই তুমি জিওগ্রাফির কিছুই জানো না। তুমি তো কলকাতাবাসী তাই তোমার সাঁতার না জানার কথা, গাছে উঠতে না পারার কথা….
গৌরী ওর পূর্ব অভিজ্ঞতার দরুন জানে, যে মাধু কিছু অযৌক্তিক যুক্তি দিয়ে সুন্দর ভাবে বুঝিয়ে দেবে যে শঙ্কর নিতান্তই ভুলভাল কথা বলছে। আজও সেদিকেই এগোচ্ছে মাধু।
তাহলে বলো, কলকাতায় থেকেও তুমি কি করে এগুলো শিখলে?
গৌরী নিজেকে নিরাপদ দূরত্বে পৌঁছানোর আশায় বললো, আরে এগুলো তো আমি অনেক চেষ্টা করে শিখেছি। সাঁতার শিখেছিলাম কারণ তোমায় কথা দিয়ে গিয়েছিলাম—কাঞ্চনদীঘির জল থেকে পদ্ম তুলে দেব তাই। আর তুমিই শর্ত দিয়েছিলে, যে তোমার থেকেও তাড়াতাড়ি গাছে উঠতে পারবে, তাকেই নাকি তুমি বিয়ে করবে। তাই বাধ্য হয়ে নিজের হাঁটুর অর্ধেক মাংস গাছের কাণ্ডকে প্রদান করে, মালিকাকাকে ঘুষ খাইয়ে তারপর শিখেছিলাম গাছে ওঠা।
মাধবীলতার লালচে ঠোঁটে মুচকি হাসির রেখা, তবুও জোর করে হাসিটাকে শাসন করে রাগী গলায় বলল, এইটাই তো আমি বলতে চাইছিলাম। এগুলো যেমন কষ্ট করে শিখেছো আমার জন্য, তেমন জিওগ্রাফি প্র্যাকটিক্যালের লাইটট্রেস আর ম্যাপপয়েন্টিং দুটোই তাড়াতাড়ি শিখে নাও। তোমার হাতে মাত্র দুদিন টাইম।
আমাদের ক্লাসের অরুণাংশু ভীষণ ভালো প্র্যাকটিক্যাল করে, আমাকেও হেল্প করতে এসেছিল। আমিই রাজি হইনি। ভাবলাম আগে তোমায় বলি, তুমি তো দিন সাতেকের জন্য এসেছো এবারে। যদি তুমি একান্ত না পারো, তাহলে না হয়….মাধবীকে কথা শেষ করতে না দিয়েই ওর প্র্যাকটিক্যাল খাতা আর পেন্সিলবক্সটা হাতে নিয়ে গৌরীশঙ্কর বেশ দাপটের সাথে বলেছিল, আমিই করে দেব। আর শোনো স্কুলে গিয়ে পড়াশোনাটা মন দিয়ে কর, এত বন্ধু জোটানোর কি আছে!
মাধবীলতা সেই ছোটবেলার ভঙ্গিতেই মুখ বেঁকিয়ে বলেছিল, আর তুমি যে দুবছরের নাম করে সারাজীবনের জন্য কলকাতা চলে গেলে, তার কি হলো!
গৌরীশঙ্কর নিজের দিকে দড়ি টেনে বলেছিল, বাবা, মা, তুমি, মহেশডাঙা, ছেড়ে ওখানে থাকতে বুঝি আমার ভালো লাগে? কিন্তু কি করবো? পড়াশোনার জন্যই তো বাধ্য হয়ে থাকতে হয়। আমার মনখারাপের কষ্ট, তুমি আর কি করে বুঝবে!
মাধবীলতা সঙ্গে সঙ্গে নরম হয়ে ওর হাতটা নিজের হাতে নিয়ে বলেছিল, তা অবশ্য সত্যি। দাদু মারা যাবার পরে রায়চৌধুরী বাড়িটাও যেন কেমন একটা হয়ে গেল। আর যেতে ভালোই লাগে না। তারপর জানো শঙ্কর, তোমার কাকিমা সেদিন আমায় ডেকে বলেছিল, শোন মাধবী তুই এখন বড় হয়েছিস, বিয়ের যোগ্য হয়েছিস, এখন আর ধেই ধেই করে শঙ্করের সাথে ঘুরবি না।
বোঝো কাণ্ড, বড় হয়েছি বলেই নাকি তোমার সাথে ঘুরতে পারবো না! আমিও বললাম, এ কেমন কথা কাকিমা, শঙ্কর আমার সব থেকে ভালো বন্ধু, বড় হলে কি বন্ধু পাল্টে যায়! তুমিই বলো শঙ্কর, আমি কি অন্যায্য কিছু বললাম? তুমি তো আমার সব থেকে কাছের মানুষ, সব থেকে কাছের সঙ্গী।
মাধবীর মেয়েলি হাতের নরম মুঠোর মধ্যে শঙ্করের পুরুষালী হাতটা মুহূর্তের জন্য কেঁপে উঠছিল। মাধবীর মুখে ”কাছের মানুষ” কথাটা বহুবার শুনেছে গৌরীশঙ্কর, কখনো এমন অনুভূতি হয়নি। এ যেন অন্যরকম বলা, অন্যরকম প্রাপ্তির আনন্দে আত্মহারা হয়ে গিয়েছিল শঙ্কর। মাধবীলতা আর সেই ছোট মেয়েটি নেই। তার পুতুল পুতুল রান্নাঘর এখন বড় সড় সংসার গড়তে পারে!
বসন্তের মিঠে হাওয়ায় মাধবীকে নতুন করে ভালোবেসেছিলো শঙ্কর। এ ভালোবাসা বাল্যসখীকে নয়, এ ভালোবাসা কিশোরের খেলার সাথীকে নয়, এ ভালোবাসা শুধু মাত্র একজন পরিপূর্ণ নারীকে বাসতে পারে একজন পুরুষ। ছেলে থেকে পুরুষ হয়ে ওঠার সন্ধিক্ষণে গৌরীশঙ্কর বুঝেছিলো, মাধবীলতা ছাড়া তার জীবন ব্যর্থ। ওকে ছাড়া আকাশের বিশালতাও শূন্যতায় পরিণত হবে। কিন্তু সমস্যা তো একটাই, মাধবীলতা কিছুতেই এই ভালোবাসা শব্দের সঠিক মানে বোঝে না।
যা রাগী মেয়ে, এখন যদি শঙ্কর ওকে ভালোবাসা শব্দের প্রকৃত অর্থ বোঝানোর চেষ্টা করে তাহলে হয়তো ভুল বুঝে ওকে ছেড়ে চলেই যাবে। তার থেকে বরং মাধুর কাছের মানুষ, ভালো বন্ধু, এই সম্পর্কগুলোর মধ্যেই আবদ্ধ থাকুক ওর একনিষ্ঠ প্রেম।
মাধু তখন শঙ্করের দৃষ্টির ব্যকুলতাকে অগ্রাহ্য করেই হাতের ঠাকুর মূর্তিটির দিকে মনোনিবেশ করানোর আপ্রাণ চেষ্টা করে চলছে।
দেখো না শঙ্কর, আমার মুখের দিকে নয়, এই ঠাকুরকে দেখো। আমি কুমোরকাকার সাথে মাটি মেখে ঠাকুর গড়লাম। কুমোরকাকা বললো, আমি নাকি বড় হয়ে শিল্পী হবো। দেখো এটা হলো লক্ষ্মীঠাকুর। রোজ স্কুল থেকে ফিরে আমি কুমোরকাকার কাছে যাবো, কাকা আমাকে আরো অনেক কিছু শেখাবে বলেছে। ছাঁচের ঠাকুর গড়ার থেকেও শক্ত হলো নিজের ভাবনা থেকে সৃষ্টি করা। দেখো না শঙ্কর! তুমি যে কেন আমার মুখের দিকে অমন বোকার মত তাকিয়ে থাকো কে জানে! কলকাতা গিয়ে তোমার মাথাটা পুরো গেছে। নিজস্ব ঢঙে বক বক করছিল মাধবী।
শঙ্কর লজ্জা পেয়ে বলেছিল, বাহ, দারুণ গড়েছ তো! সেদিনও ওকে বলা হয়ে ওঠেনি, কেন শঙ্কর মৃন্ময়ীর নিখুঁত মুখের দিকে মনোনিবেশ না করে চিন্ময়ী মাধবীর দিকেই তাকিয়ে থাকে অপলক। মাধবীলতাকে দেখে দেখেও আশ মেটে না ওর। একে ঠিক কি বলে! নেশা, ঘোর নাকি ভালোবাসা! জানে না শঙ্কর। শুধু জানে মাধবীর সবটার ওপরে শুধুই ওর অধিকার। ওর কপালে দুই ভ্রুর মধ্যের অহংকারী টিপ থেকে শুরু করে পায়ের বুড়ো আঙুলের নখের অবশিষ্ট নেলপলিশে পর্যন্ত ওর আধিপত্য থাকবে।
ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ফাইনাল ইয়ারে গিয়ে এক বন্ধুকে বলেছিল, ওর আর মাধবীলতার সম্পর্কের কথা। বন্ধুটি সবটা শুনে বলেছিল, পারলে এখনই বোঝা ওকে, না হলে কিন্তু এই মেয়ে কোনদিন তোকে বিয়ের পিঁড়ি ধরার নিমন্ত্রণ করবে। বন্ধুর মুখে ”প্রোপোজ করে ফেল” শুনেই ওর হৃৎপিণ্ড থেমে গিয়েছিল। কলকাতার ছেলেরা ঠিক বুঝবেই না মহেশডাঙার ক্লাস টুয়েলভের মেয়ের বিয়ে দেওয়া যায় কিন্তু আচমকা প্রেম নিবেদন করা যায় না। মাধুর বন্ধুদের তো অর্ধেকের বিয়ে হয়ে গেল। নেহাত মাধবী একটু ডাকাবুকো আর রমেশ ঘোষাল তেমন সংসারী নয়, বলেই তার মেয়ে লোকলজ্জার মাথা খেয়ে সাইকেল নিয়ে কোয়েড স্কুলে যাচ্ছে। মাধবীলতা ছাড়াও বোধহয় আরও গোটা দশেক মেয়ে পড়ে ওই ক্লাসে। মহেশডাঙার মানুষদের সোজা হিসেব, মেয়েকে নাম সই করতে শেখাও, আসন বুনতে শেখাও, রান্নাবান্না শিখিয়ে বিয়ের পিঁড়িতে বসিয়ে দাও। পড়াশোনা, স্কুল, কলেজ এসব তো মোটেই নয়।
রায়চৌধুরী বাড়ির মেয়ে হয়েও গৌরীশঙ্করের দুই দিদির বিয়ে হয়ে গেছে মাধ্যমিক পাশের পরেই।
গৌরীশঙ্করের কলেজের মেয়েদের পোশাক আর কথাবার্তা শুনলে, গোটা মহেশডাঙার মানুষ যে এক দিনে হার্টফেল করবে সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। এমনিতেই গৌরীশঙ্করের পোশাক-আশাক কথা বলার ধরন, চুলের কাটিং দেখে ওর পরিবারের অনেকেই বলেছেন, উমাশঙ্কর তার ছেলেটাকে মানুষ করতে কলকাতায় পাঠিয়েছিল কিন্তু ছেলেটা লায়েক হয়ে ফিরল। জমিদার বাড়ির মান ডোবালো। এ বাড়ির ছেলে নাকি লোহালক্কড় নিয়ে পড়ে চাকরি করবে। এ লজ্জার কথা রায়চৌধুরী বাড়ির আনাচে কানাচে আলোচনা হয়, তা ও নিজেও জানে। বিষ্ণুকাকা একদিন কাঁচুমাচু মুখ করে এসে বলেছিল, দাদাবাবু, তুমি আর পুরুতমশাইয়ের মেয়ের সাথে দীঘির পাড়ে বসে থেকো না গো, লোকে পাঁচকথা বলে। পুরুতমশাই নিরীহ ব্রাহ্মণ, তাই মুখফুটে কিছু বলতে পারেন না, কিন্তু মেয়েটারও তো বিয়ে দিতে হবে নাকি! বিষ্ণুকাকার দিকে অবাক বিস্ময়ে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়েছিল গৌরীশঙ্কর। মাধবীলতার সাইকেল চালানো, কোয়েড স্কুলে পড়া, মাঝদুপুরে দীঘিতে সাঁতার কাটা, বকবক করা নিয়ে যদি ওর কোনো প্রবলেম না থাকে, তাহলে বিয়ের সমস্যা কোথায়?
বিয়েটা তো গৌরীশঙ্কর করবে মাধবীলতাকে। সেটা নিয়ে বিষ্ণুকাকার বা বিন্দুপিসির কিসের সমস্যা সেটাই মন দিয়ে বোঝার চেষ্টা করেছিল ও। অনেক ভেবে কারণটা বের করেছিল, গ্রামের অর্ধশিক্ষিত লোকজন এখনও মেয়েদের অন্যের মনমর্জির পুতুল মনে করে বলেই এইসব প্রবলেম খুঁজে বের করছে।
সেদিন সন্ধেতে মহেশডাঙায় রায়চৌধুরী বাড়িতে নিজের ঘরে বসে মাধবীর প্র্যাকটিক্যাল খাতাটা নিয়ে নাড়াচাড়া করছিল। মহেশডাঙা স্কুলে জিওগ্রাফি সদ্য চালু হয়েছে। এই স্কুলের হেডস্যার খুবই দায়িত্ববান মানুষ। শহরের অফিসে ধর্না দিয়ে দিয়ে স্কুলের জন্য অনেক কিছুই স্যাংশন করিয়েছেন। বায়োলজি প্র্যাকটিক্যালের ইন্সট্রুমেন্ট থেকে শুরু করে স্পোর্টসের সরঞ্জাম পর্যন্ত। কিন্তু আসল সমস্যা হলো এই গ্রামের মানুষজন নিজেরাই চায় না শিক্ষিত হতে। এরা এখনো মধ্যযুগের অন্ধকারাচ্ছন্ন সংস্কৃতির মধ্যেই নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখতে চায়। অথচ গ্রামটা কিন্তু বেশ বর্ধিষ্ণু, মানসিকতাটাই যা থমকে আছে পুরোনো দিনে।
মাধবীর পয়েন্টিং পেন্সিলটা নিয়ে ম্যাপটা আঁকছিলো শঙ্কর। সেইসময় বিন্দুপিসি হাঁপাতে হাঁপাতে এসে বললো, সর্বনাশ হয়ে গেছে দাদাবাবু! তুমি তাড়াতাড়ি চলো মাধবীদিদির বাড়িতে।
।। ১২।।
গয়নাগাটি ওর সামান্যই আছে, সেগুলো বের করে হিসেব করতে বসলো মাধবী। এগুলো দিয়ে কি এবারের মত পুজোটা করা যাবে! যদি যায় তাহলে শঙ্করের দুঃশ্চিন্তাটা একটু কমে। অফিসের ছুটিও তো মোটে পাঁচদিন। তার দিন তিনেক অলরেডি শেষ হয়ে গেছে। এখনো পর্যন্ত পুজো হবে কি হবে না তার সুরাহা করতে পারেনি গৌরীশঙ্কর। আজ বিকেলে লুকিয়ে গয়নাগুলো নিয়ে একবার স্যাকরার বাড়িতে হানা দিতে হবে। তবে লোক জানাজানি হলে কিছুতেই চলবে না। রায়চৌধুরী বাড়ির বউ গায়ের গয়না বেচতে স্যাকরা বাড়ি গেছে জানলে, এ বাড়ির লোকজন মাধবীকে হয়তো গুমঘরে গুম করেই দেবে। তবে এমনভাবে ভেঙে পড়তে গৌরীশঙ্করকে কখনো দেখেনি মাধবীলতা। বরং সমস্ত কঠিন পরিস্থিতিতেই ওকে বেশ শক্ত হয়ে দাঁড়াতে দেখেছে। সেই কোন ছোটবেলা থেকেই মাধবী দেখেছে, যে কোনো পরিস্থিতিতে মাথা ঠাণ্ডা করে কাজ করে শঙ্কর। সেই মানুষটাকে যখন ভেঙে পড়তে দেখে তখন বুঝতে অসুবিধা হয় না সমস্যার শিকড় অনেকটা গভীরে প্রবেশ করেছে। মাধবীর সব বিপদে গৌরীশঙ্করকে ও পাশে পেয়েছে বন্ধুর মত, আজ যদি ওর বিপদে মাধবী পাশে না থাকতে পারে, তবে কিসের বন্ধুত্বের অঙ্গীকার নিয়েছিল কাঞ্চনদীঘির ধারে? সেদিনও তো ভেঙেই পড়েছিলো মাধবীলতা। যেদিন স্কুল থেকে ফিরে, খেয়েদেয়ে নিজের পড়া নিয়ে বসেছিলো, আর কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘটেছিল ঘটনাটা। পরীক্ষার খুব বেশি দেরি নেই, টেস্ট হয়ে গেছে। শঙ্কর বলেছিল, এটা নাকি ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ সময়, এ সময় যদি মাধবী ফাঁকি দেয় তাহলে এতদিনের পরিশ্রম বিফলে যাবে। ও নাকি শহরের কোনো কলেজে চান্সই পাবে না। মাধবীলতারও ইচ্ছে ছিল শহরের কলেজে পড়তে যাবে শঙ্করের মত। এতদিন শঙ্করের চোখ দিয়ে ও কলকাতা দেখেছে, কল্পনায় এঁকেছে ওই শহরকে। আর মাঝে মধ্যে টিভির সাদাকালো স্ক্রিনে রং ধরার চেষ্টা করেছে। এবারে ভালো রেজাল্ট হলে মাধবীলতাও শঙ্করের মতই পড়তে যাবে শহরে। পৃথিবীটা নাকি অনেক বড়। শুধু মহেশডাঙা, পাটুলি, বেলতলা নয় আরও অনেক বড়। এমন কি মহেশডাঙার কাছের মফঃস্বল শহর কাটোয়ার থেকেও অনেক বড়। যদিও বাবার সাথে মাত্র বার দুয়েক কাটোয়ার গিয়েছিল মাধবী। কি সুন্দর সাজানো শহর, মাধবী হাঁ করে তাকিয়ে দেখেছিলো ওখানের চলনবলন। তখন থেকেই ওর ইচ্ছে মহেশডাঙার বাইরের পৃথিবীটাকে দুচোখ ভরে দেখবে। শঙ্কর যে কলেজে পড়ে সেটাও খুব দেখার ইচ্ছে মাধবীলতার। সব ইচ্ছেপূরণের চাবিকাঠি নাকি লুকিয়ে আছে ওর উচ্চমাধ্যমিকের রেজাল্টের ভিতরেই, শঙ্করের মুখে শুনে শুনে এমনই ধারণা হয়েছিল ওর। তাই তো পাড়ার সবার কটূক্তি সহ্য করেও পড়াশোনাটা মন দিয়ে চালিয়ে গেছে ও। কিন্তু যজমানদের বাড়ি থেকে বাবার যা আয় হয়, তাতে গ্রামের স্কুলে পড়াশোনা করতে পারলেও শহরে গিয়ে থাকার খরচ যে জুটবে না, সে ও ভালোই জানতো। শঙ্কর বলেছিল, আর একটা বছর সময় দাও, আমি তো চাকরি করবোই, তখন তোমার পড়ার খরচ আমিই চালাতে পারবো। স্বপ্নের কাজলটা নিখুঁত করে মাধবীর চোখে শঙ্করই পরিয়ে দিয়েছিল। সেই স্বপ্নীল দিনের আশায় মন দিয়ে পড়ছিল মাধবীলতা। তখনই পাশের বাড়ির কাকিমা চিৎকার করে ডাকছিল মাধবীকে।
ছুটে বাইরে বেরিয়েই দেখলো, মা মাটিতে পড়ে আছে। কি করবে বুঝতে না পেরে এদিক ওদিক তাকাচ্ছিলো। কাকিমা বললো, তোর মাকে সাপে কামড়েছে মাধু, বাবাকে খবর দে। হসপিটালে নিয়ে যেতে হবে।
বাবা মহেশডাঙার বাইরেও পুজো করতে যেত, তাই বাবা কোথায় গেছে তা মাধু জানতো না। ওর তখন একটাই মুখ মনে পড়েছিলো, তাই ছুটে গিয়ে বিন্দুপিসিকে বলেছিল, শিগগির ওপরে গিয়ে শঙ্করকে বলো, আমি ডেকেছি, মাকে সাপে কামড়েছে।
পাড়ার লোক জড়ো হচ্ছিল। সকলেই মতামত দিচ্ছিল। বাড়ির পিছনের পুকুর পাড়ে নাকি গোখরো দেখেছে লোকজন কদিন আগেই। গৌরীশঙ্কর একটা রিক্সা নিয়েই এসেছিল। মাধবীলতা আর গৌরীশঙ্কর দুজনে মাধুর মাকে নিয়ে ছুটেছিলো পাটুলীর হাসপাতালে। যখন পৌঁছেছিল, তখন ডক্টররা জানিয়ে দিয়েছিল মাধুর মা আর জীবিত নেই।
অবাক লেগেছিল মাধবীর। স্কুল থেকে ফেরার পর মা ভাত, তরকারি বেড়ে দিলো, গল্প করতে করতে মাধু খাওয়া দাওয়া শেষ করলো। মা বাসন দুটো নিয়ে পুকুরে গেল মেজে আনতে, এখন ডাক্তারবাবু বলছেন, মা নেই!
এটা হয় নাকি!
গৌরীশঙ্কর মাধবীলতার হাতটা চেপে ধরে বলেছিল, মাধু শোন এটা একটা অ্যাক্সিডেন্ট। দুর্ঘটনা এমন আচমকাই আসে। কি হলো, তুমি শুনেছ মাধবী! এমন স্থির হয়ে কেন দাঁড়িয়ে আছো? এই মাধু?
মাধবীকে জোরে জোরে ঝাঁকিয়ে কথাগুলো বলছিলো গৌরীশঙ্কর। তবুও মাধবী স্থির হয়ে তাকিয়েছিল মায়ের নিষ্প্রাণ শরীরের দিকে।
অপঘাতে মৃত্যু বলেই মাত্র তিনদিনে মায়ের স্মৃতিকে দূর করতে হয়েছিল মাধবীলতাকে। বাবাও কেমন যেন চুপ চাপ হয়ে গিয়েছিল মায়ের আকস্মিক মৃত্যুর পর।
গৌরীশঙ্কর মাধবীকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে বলেছিল, তোমাকে কিন্তু বাঁচতে হবে। ভালো করে পরীক্ষা দিতে হবে। আবার আগের মত হাসতে হবে, আমার পুরনো মাধবীকে ফেরত চাই। গৌরীর বুকের মধ্যে মুখ গুঁজে প্রথম বার হাউমাউ করে কেঁদে উঠেছিলো মাধবীলতা। ওর শরীরের কম্পনে আরো শক্ত করে আগলে ধরেছিল শঙ্কর। ফিসফিস করে বলেছিল, আমি তো আছি তোমার পাশে। আর মাত্র মাস খানেক পরে পরীক্ষা, মন দাও পড়ায় মাধু, আমার কথা ভেবে মন দাও।
কি ছিল সেদিন শঙ্করের কথায় মাধবী জানে না, তবে দিন দশেক পরে আবার নিজের বইখাতাগুলো ধুলো ঝেড়ে পড়তে বসেছিলো। উচ্চমাধ্যমিক পাশও করেছিল ভালোভাবেই। কিন্তু মায়ের অবর্তমানে ওদের ছোট্ট সংসারটা বড্ড এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল। পলকা হাওয়ায় ভেঙে গিয়েছিল ওদের এক চিলতে গোছানো সংসারটা। বাবাও দিনশেষে ঘরের কোণে মনমরা হয়ে বসে থাকতো। রেজাল্টটা হাতে নিয়ে বাবার সামনে দাঁড়িয়ে ধীর গলায় মাধবী বলেছিল, বাবা আমি কি কাটোয়া কলেজে ভর্তি হতে পারি? বি.এ পাশ করতে চাই। বাবা বেশ কিছুক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে বলেছিল, হ্যাঁ রে মা, পাড়ার সবাই বলছিলো বটে তোর বিয়ে দিতে হবে। এমনকি রায়চৌধুরী বাড়ির গিন্নীরাও সেদিন ডেকে বললো, বামুনঠাকুর এবারে মেয়েটার সদ্গতি করুন। আপনি একা মানুষ, পুজোআচ্চা করে বেড়ান। যজমানের বাড়িতেই দুটো খেয়ে নেন কিন্তু মেয়েটা বড় হয়েছে, একা একা বাড়িতে থাকে, দিনকাল ভালো নয়। বুঝলি মাধু ওরা ঠিকই বললো। বাবা হিসাবে এবারে আমারও উচিত তোর বিয়ে দেওয়া।
হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়েছিল মাধু। বাবাকে ছেড়ে এই অবস্থায় ওর বিয়ে হয়ে যাবে! ও এই বাড়ি, মহেশডাঙা ছেড়ে কোথায় যাবে!
ভাবনাগুলো এলোমেলো জট পাকিয়ে যাচ্ছিল ওর তিনদিন না আঁচড়ানো চুলের মত করে। কিছুতেই ছাড়াতে পারছিল না জটগুলো। এলোমেলো প্রশ্নগুলো মনের দরজায় এসে উঁকি মেরে বলে যাচ্ছিল, পড়াশোনাটাও হলো না তোমার মাধবীলতা!
পাড়ার লোকে বলছে, রমেশ ঘোষালের মেয়েটা এখন ঢেউহীন শান্ত নদী হয়ে গেছে। বাড়ির উঠানে পড়ে আছে ওর প্রিয় সাইকেল, চালাতেও ইচ্ছে করে না ইদানিং। স্কুলের হেডস্যার এসেছিলেন বাবাকে বোঝাতে। মেয়ের ভালো রেজাল্ট হয়েছে, ওকে কলেজে ভর্তি করে দিন, আমি সাহায্য করব। বাবা স্যারের হাতদুটো ধরে কাকুতি মিনতি করে বলছে, একটা ভালো পাত্র দেখে দিন, মেয়েটাকে পার করি। স্যার মাধবীর মাথায় হাত বুলিয়ে ফিরে গেছেন।
পাড়ার সবাই বলছে, এতদিনে নাকি মাধবীলতা বিয়ে দেবার যোগ্য হয়ে উঠেছে। আর গুন্ডাগিরি নেই, সাইকেল নিয়ে ঘোরা নেই, এমনকি কাঞ্চনদীঘির জলে সাঁতরে মাতানোও নেই। এই হলো বিয়ে দেবার সঠিক সময়।
মাধবীলতা মনে মনে তখন একজনকেই খুঁজছিল, সেটা হলো ওর সব থেকে কাছের মানুষ গৌরীশঙ্করকে। কিন্তু গত পরশু বিন্দুপিসিকে জিজ্ঞেস করলে সে বলেছিল, ছোটদাদাবাবু তো এখন খুব ব্যস্ত। কলকাতায় নাকি তার মস্ত পরীক্ষা চলছে, এই কমাস তো বাড়িও আসবে না। মা ঠাকরুন বলছিলেন, ওনার দাদা নাকি চিঠিতে বলেছেন, এটাই গৌরীর সব থেকে বড় পরীক্ষা। বিন্দুপিসি হনহন করে চলে গিয়েছিল।
একলা মনে বসে থাকতে থাকতেই শুনতে পেয়েছিল বাবার গলার স্বর। বহুদিন পরে বাবার এমন স্বতঃস্ফূর্ত গলা শুনে, কৌতূহলের বশেই বাইরে বেরিয়ে এসেছিল মাধবীলতা। তখনই দেখেছিলো, বাবা একজন বয়স্ক মানুষের হাত ধরে বিগলিত গলায় বলছে, এতো আমার পরম সৌভাগ্য বিনায়কবাবু। আপনাদের মত সম্ভ্রান্ত ঘরে আমার মেয়ের বিয়ে হবে, এ কখনো কল্পনাই করতে পারিনি। এ তো মাধুর সৌভাগ্য।
তাকে বাইরের চেয়ারে বসিয়েই মাধুকে ডেকেছিল বাবা। মাধবীও যন্ত্রচালিত পুতুলের মত বাবার ডাকে সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল। অপরিচিত ভদ্রলোক একমুখ হেসে বলেছিলেন, রমেশ ঘোষালের মেয়ে বলেই এক কথায় আমার ভাইপোর সাথে বিয়ে দিতে রাজি হলাম। তোমার বাবা আমাদের বাড়ির পুরোনো পরিচিত মানুষ। এমন সজ্জন মানুষের মেয়ে কি কখনো খারাপ হতে পারে!
মেয়ে আমার পছন্দ হয়েছে পুরোহিত মশাই। তবুও ভাইপো একবার এসে দেখে যাক। আজকালকার ছেলে তো, তার অমতে কিছুই হবার নয়। বাবা মাধবীকে চা করতে পাঠিয়েছিল। রান্নাঘরে ঢুকতেই একটা অদ্ভুত অনুভূতি ওকে গ্রাস করে নিচ্ছিলো। কিছু যেন হারিয়ে যাচ্ছে ওর। খুব কাছের পরিচিত কিছু একটা হারিয়ে ফেলার অনুভূতি ওকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছিল। মায়ের হঠাৎ মৃত্যুর কষ্টকে ছাপিয়ে একটা যন্ত্রণা হচ্ছিল বুকের বাম দিকে। যন্ত্রণার কারণটা খুঁজতে আপ্রাণ চেষ্টা করছিল মাধবীলতা। কয়েকদিনের মধ্যেই ওর বিয়ের ঠিক হয়ে গিয়েছিল। বাবাই বিধান দিয়েছিল, মায়ের কোনো একটা পরলৌকিক কাজ সেরে ফেলেই ওর বিয়েটা দেওয়া সম্ভব। লাল টুকটুকে একটা বেনারসী কেনা হয়েছিল। ছোট পিসিই মা মরা মেয়ের বিয়ের ভার নিয়েছিল।
যেদিন মাধবীলতাকে পাত্র দেখতে এসেছিল, সেদিন ও অবাক চোখে তাকিয়েছিল অপরিচিত ওই মানুষটার দিকে। এই মানুষটাকে তো ও চেনেও না, তাহলে এর সাথে বন্ধুত্ব করবে কি করে! বারবার চোখ ভিজে যাচ্ছিলো ওর। চোখের সামনে একটাই মুখ বারবার ভেসে উঠছিল। এলোমেলো কত কথা, কত প্রতিশ্রুতি, ছেলেবেলার খেলাঘরের বর বউ সাজা, তার সংসারের গৃহিণী হয়ে ধুলো বালি রান্না করার স্মৃতি চোখের সামনে ভাসছিল মাধবীর। আনমনা হয়েই শুনেছিল বিয়ের পাকা তারিখ। উদাস চোখে রাস্তার দিকে তাকিয়ে ভাবছিলো, এই পনেরো দিনের মধ্যেও কি সে ফিরবে না মহেশডাঙা? শঙ্কর ওর কলকাতার ঠিকানাও লিখে দিয়েছিল মাধবীর কোনো একটা খাতার পাতায়। যদিও মাধবী এসে বলেছিল, কি করবো তোমার ঠিকানা নিয়ে? আমি কি একা একা কলকাতা যাবো নাকি!
শঙ্কর অস্ফুট গলায় বলেছিল, যদি কখনো চিঠি লিখতে ইচ্ছে করে, তাহলে লিখ।
মাধবী আরও জোরে হেসে বলেছিল, প্রেমপত্র? আমাদের স্কুলের আশীষ দিয়েছে দেবিকাকে, দেবী টেনে একটা থাপ্পড় মেরেছে জানো তো। কিন্তু তুমি তো আমার বন্ধু, তোমায় কেন চিঠি লিখতে যাবো!
শঙ্কর বলেছিল, বন্ধুদের বুঝি খোঁজ নিতে নেই? চিঠি লিখতে নেই বুঝি? মাধবীলতা মুচকি হেসে বলেছিলো, কি লিখবো চিঠিতে? বিষ্ণুকাকা কাদায় আছাড় খেয়েছে! নাকি তোমার মেজ কাকিমা গদাধরকে এক ধামা মুড়ি দান করেছে! এগুলো লিখবো চিঠিতে?
শঙ্কর বিরক্ত হয়ে বড় বড় পা ফেলে চলে গিয়েছিল। মাধবীলতা চেঁচিয়ে বলেছিল, বেশ লিখবো চিঠি কোনো একদিন। গোটা রাস্তাটা ভাবতে ভাবতে ফিরে ছিল মাধবী, চিঠিতে কি লেখা যায় শঙ্করকে? শঙ্কর তো মাধবীর সবটুকু চেনে, হয়তো ওর নিজের থেকেও একটু বেশিই চেনে। ওর মনখারাপ, ওর খুশি এগুলো বোধহয় মাধবীর থেকেও শঙ্কর বুঝতে পারে বেশি দ্রুত। ওর প্রতিটা নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস বোঝা মানুষটাকে চিঠিতে কি লেখা যায় কে জানে!
।। ১৩।।
কাকে চিঠি লিখছ কর্তাবাবু? আমি কি তাহলে পাল বাড়িতে খবর দেব? আমাদের বাড়ির ঠাকুর যিনি গড়েছেন বরাবর তিনি তো দেহ রেখেছেন! তার ছেলের বড় বেশি দেমাক। পারিশ্রমিকও নেয় বেশি। তবুও মা ঠাকরুন চান, ওই পাল বাড়ি থেকেই রায়চৌধুরী বাড়ির ঠাকুর আসুক। অন্যমনস্ক হয়ে গৌরীশঙ্কর বললো, চিঠি নয় বিষ্ণুকাকা এটাকে বলে অ্যাপ্লিকেশন। অফিসে আর সাতদিন ছুটি বাড়ানোর জন্য অ্যাপ্লিকেশন করছি। এ গ্রামের নেটের যা অবস্থা তাতে তিনদিন ধরে চেষ্টা করেও মেল পাঠাতে পারলাম না। তাই অ্যাপ্লিকেশনই ভরসা। আমার বস আবার একটু সনাতনী ধারায় বিশ্বাসী, ফোনে ছুটি চাইলে প্রথমেই নট করে দেবেন, তাই চেষ্টা চালাচ্ছি। দক্ষিণের মাঠে তো কাশ ফুলের মেলা, পুজোর ঘন্টা তো বেজেই গেল, মায়ের আদেশও মাথার ওপরে অথচ এদিকে কোনো ব্যবস্থাই করে উঠতে পারলাম না। দাঁড়াও দাঁড়াও এখুনি পাল বাড়িতে ছুটো না, আগে টাকার জোগাড় করি তারপর দেখছি। বিষ্ণুকাকার মুখে শরতের রোদ অপসৃত হয়ে বর্ষার কালো মেঘের অনাগোনাকে উপেক্ষা করেই নিজের কাজে মন দিলো গৌরীশঙ্কর।
বিষ্ণুচরণের মুখের চামড়ায় বার্ধক্য ভাঁজের আধিক্য। সেদিকে আরেকবার তাকাতেই মনে পড়ে গেলো, মাধবীলতা একবার একটা বয়স্ক মানুষের মুখ এঁকেছিলো ওর খাতায়। নেহাতই মজার ছলে। ছবিটার নিচে লিখে দিয়েছিল, শঙ্কর যখন বুড়ো হবে।
ছবিটা বহুদিন পর্যন্ত ছিল ওর ফাইলে। মাধবীলতা সত্যিই বড় ভালো এঁকেছিলো। আচ্ছা, মাধবী আর আঁকে না কেন! মাধবী তো অনেক কিছুই পারতো কিন্তু বিয়ের পর এসব আর করেনা কেন? জিজ্ঞেস করতে হবে ওকে। অ্যাপ্লিকেশনটা খামে ভরতে ভরতে মনে পড়লো ওর জীবনের প্রথম পাওয়া চিঠিটার কথা।
মামার বড় ছেলের বিয়ের পর গৌরীশঙ্কর ইচ্ছে করেই কলেজের হোস্টেলে শিফট করেছিল। মামা অবশ্য বলেছিল, বাড়িতে কি ঘরের অভাব আছে নাকি? তোকে কেন শিফট করতে হবে?
কিন্তু মামিমার দু একটা কথায় ও বুঝেছিলো, নতুন অতিথি এসে ওকে হয়তো সহজভাবে নেবে না। তাই নিজেই বলেছিল, কলেজ হোস্টেলে থাকলে পড়াশোনার সুবিধা হয়, তাই…
মামাও রিটায়ার্ড ম্যান, অল্প বয়েসের সেই দম্ভ নিষ্প্রভ প্রায়। দুই ছেলেই প্রতিষ্ঠিত। মামার অমতেই বড়ছেলের বিয়ে হয়। তারপর মামা নিজের মধ্যেই নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিল। তাই শঙ্করের প্রস্তাবে নিমরাজি হয়ে গিয়েছিল। তবে সকলের আড়ালে শঙ্করকে বলেছিল, আমি প্রতি মাসে তোকে টাকা পাঠাবো, কাউকে বলবি না।
নিজের হোস্টেলের অ্যাড্রেসটা মাধবীকে দিয়ে ও বলেছিল, চিঠি লিখো।
সে মেয়ে চিঠিতে কি লিখবে সেটাই নাকি খুঁজে পায়নি। তাই হোস্টেলে থাকা কালীন চারবছরে একটাও চিঠি এসে পৌঁছায়নি ওর ঠিকানায়। ফাইনাল এক্সামের শেষ দিনে হোস্টেলে ঢুকতেই, সবাই ওকে দেখে মুচকি মুচকি হাসছিল। ব্যাপারটা ও কিছুতেই বুঝতে পারছিল না। শেষে হোস্টেল সুপার বিশ্বজিৎদা এসে বেশ গম্ভীর গলায় বলল, তোমার লাভারকে বলো, পরেরবার থেকে যেন এনভেলপের মুখ ভালো করে আঠা দিয়ে আটকে দেয়। আমি না পড়লেও তোমার রুমমেটরা অনেকেই তোমার চিঠি পড়েছে।
শঙ্কর আকাশ পাতাল ভাবতে ভাবতেই হাতটা পেতেছিলো। ওর লাভার! কে সে? কলেজের কোনো বিচ্চু মেয়ে বদমাইসি করে নি তো!
চিঠিটা হাতে নিয়েই নামটা দেখে বুকের মধ্যে হৃৎপিণ্ডটা আচমকা লাফিয়ে উঠেছিলো গৌরীশঙ্করের। লাবডুব শব্দটা ওর কানের কাছেই অনুরণিত হচ্ছিল যেন।
মাধবীলতার চিঠি! এ যে কল্পনার অতীত!
তবে কি মাধবী বড় হয়ে গেল!
একগুচ্ছ অচেনা অনুভূতিকে বুকের বামপাশে শান্ত করে, কাঁপা হাতে চিঠিটা খুলেছিল গৌরীশঙ্কর। কিছুক্ষণের জন্য স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল ও।
এটা মাধবীলতা কি করলো! কেন জানালো না ওকে। এতবড় একটা সিদ্ধান্ত নেবার আগে একবারও কি জানানোর প্রয়োজন ছিল না তার? এতটুকু অধিকারও নেই শঙ্করের ওর ওপরে! কষ্টে দুমড়ে মুচড়ে গিয়েছিল দ্রুতগামী হৃৎপিণ্ডের সব রক্তবাহী শিরা উপশিরারা।
থমকে গিয়েছিল ওর চলতি জীবনের বাতাস, মুহূর্তে ভারী হয়ে এসেছিল ওর নিঃশ্বাস। আরেকবার ঝাপসা হয়ে যাওয়া চিঠিটা পড়লো ও, বাঁ হাতের তালু দিয়ে মুছে নিলো চোখের জল।
মাধবী লিখেছে, শঙ্কর, বাবা আমার বিয়ের ঠিক করেছে। সামনের মাসের প্রথমেই আমার বিয়ে। তুমি একবার বলেছিলে, আমার বিয়েতে নাকি তুমি কব্জি ডুবিয়ে খাবে। তাই নিমন্ত্রণের কার্ড হয়তো তোমাকে পাঠাতাম কিন্তু শেষপর্যন্ত পাঠাতে পারলাম না। এসময় তোমাকে খুব প্রয়োজন ছিল। কিন্তু শুনলাম তোমার ফাইনাল পরীক্ষা চলছে, তাই তুমি আসবে না এখন। তবে জানো শঙ্কর, যবে থেকে আমার বিয়ের কথা হয়েছে আর পাত্রপক্ষ আমায় দেখতে এসেছে, তবে থেকে আমার মনের মধ্যে একটা অদ্ভুত রকমের অস্থিরতা কাজ করছে। মনে হচ্ছে এটা ঠিক হচ্ছে না। শেষ মুহূর্তে ট্রেন ফেল করার মত একটা অদ্ভুত অনুভূতি, আমিও জানি না কেন হচ্ছে।
তাই ভেবে চিন্তে সিদ্ধান্ত নিলাম আমি ঘর ছাড়বো। কোথায় যাবো জানি না। বিয়ে হলেও তো ঘর ছাড়তাম, না হয় বিয়ের আগেই ছাড়লাম। হয়তো তুমি যখন এ চিঠি পাবে তখন আমি মহেশডাঙা থেকে অনেক দূরে। জানি বাবার অপমান হবে গ্রামে। কিন্তু আমার বারবার মনে হচ্ছে খুব উঁচু জায়গা থেকে আমায় কেউ ঠেলে ফেলে দিচ্ছে, তাই বাধ্য হয়েই বিয়েটা ভেস্তে দিলাম। বাড়িতে থাকলে সবাই মিলে আমায় বিয়ে করতে বাধ্য করবে। তাই নিরুদ্দেশ হলাম। শঙ্কর, তুমি যখন মহেশডাঙা আসবে তখন দেখো, কাঞ্চনদীঘির ধারে ওই গাছের তলায় আমরা যে কাঠের ঘর বানিয়েছিলাম ওটা যেন ভেঙে না যায়। ওটাই আমার আসল সংসার। আমি ঐ সংসারেই থাকতে চেয়েছিলাম। চললাম তোমায় ছেড়ে, মহেশডাঙা ছেড়ে, বাবাকে ছেড়ে। আর হয়তো দেখা হবে না কোনদিন, ভালো থেকো আমার সব চেয়ে কাছের সঙ্গী।
স্থবির হয়ে দাঁড়িয়েছিল শঙ্কর। গোটা শরীর অবশ হয়ে আসছিল ওর। মাধবীলতা বাইরের পৃথিবী সম্পর্কে কিছুই জানে না। জানে না এখন যুবতী মেয়েদের জন্য কি ধরনের ভয়ঙ্কর বিপদ ওঁত পেতে বসে আছে! কোথায় যাবে মেয়েটা একা একা! ভয়ে শিউরে উঠেছিলো শঙ্কর। হয়তো জীবন যুদ্ধে হেরে গিয়ে নিজেকে শেষ করে দেবার সিদ্ধান্তই নিয়ে নিলো মাধবী! আর ভাবতে পারছে না ও।
চিঠির ভাষা আর এমন সিদ্ধান্ত দেখে বেশ বুঝতে পারছিল শঙ্কর, মাধবীলতা বড় হয়ে গেছে। মায়ের আকস্মিক মৃত্যুই ওকে বড় করে দিয়েছে।
কাল কলেজে যেতে হবে, পরশুর আগে পৌঁছাবে না মহেশডাঙা। দুশ্চিন্তায় অস্থির হয়ে কলকাতায় দুটো দিন কাটিয়েছিল শঙ্কর।
মহেশডাঙায় যখন পৌঁছেছিল তখন বিন্দুপিসির প্রথম কথাই ছিল, তোমার বন্ধু ওই মাধবীলতার কাণ্ড শুনেছ?
মা বলেছিল, ওসব চরিত্রহীন মেয়ের কথায় কি কাজ বিন্দু!
পাড়ার মেয়ে, একসাথে ছোট থেকে বড় হয়েছিল, খেলেছে ধুলেছে তারমানেই কি সমতুল্য হয়ে গেল? ছেলেটা সবে বাড়ি ঢুকলো, তুই আর ওসব নোংরা কথা নিয়ে আলোচনা করিস না দেখি।
যা শঙ্কর, বাবা নায়েবখানায় বসে আছে, একটু আগেই বলছিলো, তোর কথা। এ গ্রামে নাকি টেলিফোন আসবে। কি সব কাগজে সই করতে হবে। তুই গিয়ে কথা বল, আমি তোর খাবার পাঠাচ্ছি। আনমনা হয়ে নায়েবখানার দিকে হাঁটছিল গৌরীশঙ্কর। টানা বারান্দা দিয়ে দেখতে পেলো কাঞ্চনদীঘির একটা প্রান্ত। মনটা হু হু করে উঠলো। ওখানে গেলেও আর দেখতে পাবে না মাধবীকে, এই অনুভূতিটাই যন্ত্রণা দিচ্ছিল ওকে।
সত্যি ঘটনাটা জানার জন্য একবার অন্তত ওদের বাড়ি যেতেই হবে।
বাবার ঘরে ঢুকতেই বাবা হাসি মুখে বললো, তুই চলে এসেছিস, খুব ভালো হলো। বেশ কয়েকটা কাজ আছে। এসব ইংরেজী কাগজপত্রগুলো এসেছে আমাদের বাড়ির ঠিকানায়, দেখ তো এগুলো কি!
আর শোন, পঞ্চায়েত থেকে প্রতি বাড়িতে বলে যাচ্ছে যে গ্রামে নাকি টেলিফোন আসছে। যে যে টেলিফোনের লাইন নেবে তাদের দরখাস্ত জমা দিতে হবে। তোর মা তো শুনেই উতলা হয়ে উঠলো। বললো, টেলিফোন এলে রোজ তোর সাথে কথা বলতে পারবে।
মা বাবার সাথে কোনোদিনই খুব সহজ হতে পারেনি গৌরী। হয়তো আভিজাত্যের মোড়ক সহজ সম্পর্ক গড়তেই দেয়নি। বন্ধুরা নাকি মাকে জড়িয়ে ধরে, মায়ের কোলে মাথা দিয়ে ঘুমায়, মায়ের আঁচলে মুখ মোছে আর গৌরী মায়ের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করার সময় ছাড়া মায়ের ছোঁয়াও পায় না। তাই মায়ের এ হেন উদ্বেগ শুনে ভালোই লাগছিলো ওর। বাবার কাছ থেকে চিঠির গোছাটা নিয়ে নিজের ঘরের দিকে যাচ্ছিল ও। মাঝপথেই ওর রাজকীয় খাবারের থালা হাতে দাঁড়িয়ে ছিল বিন্দুপিসি। ইশারায় বিন্দুপিসিকে নিজের ঘরে ডেকে নিয়েছিল গৌরীশঙ্কর।
বিন্দুপিসিও উদগ্রীব হয়েছিল ওকে মাধবীর খবরটা দেবে বলে! শঙ্কর কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই বলতে শুরু করলো, আর বল কেন গো দাদাবাবু, সেকি ঘটনা। লজ্জার কথা আর কি বলি! মেয়েটাকে সেই এতটুকু বয়েস থেকে কোলে নিচ্ছি, চোখের সামনে বড় হয়ে উঠলো তোমার সাথেই। তার যে পেটে পেটে এমন ছিল একটুও টের পায়নি কেউ।
মা মরা বাপটার মুখ ডোবাতে লজ্জা করলো না রে তোর।
শঙ্কর বুঝতে পারছিল ওর ধৈর্য্যের পরীক্ষা চলছে। বিন্দুপিসি এত সহজে আসল ঘটনা বলবে না। ভূমিকা, গৌরচন্দ্রিকা না করে এগোবে না। শঙ্করের মন যতই উতলা হোক মাধবীর খবর জানার জন্য, আপাতত ওকে অপেক্ষা করতেই হবে। তবুও বললো, বিন্দুপিসি, মাধবীর কি হয়েছে!
বিন্দুপিসি এদিক ওদিক তাকিয়ে মুখে কাপড় ঢাকা দিয়ে চাপা স্বরে বললো, পালিয়েছে। বেনারসী অবধি কেনা হয়ে গিয়েছিলো। বলতে গেলে আশীর্বাদ অবধি করে গেছে ছেলের জেঠু। ভালো ঘর, ভালো বর তারপরেও কার সাথে যেন ভেগেছে। গোটা মহেশডাঙা তোলপাড় করেও তাকে পাওয়া যায়নি। পাত্রপক্ষ এসে রমেশ ঘোষালকে কি অপমানটাই না করে গেল। বেচারা মুখ কালো করে সব সহ্য করলো। তবে আমি বলি কি, মেয়েদের অত লেখাপড়া শেখানোর দরকার কি ছিল! ছেলেদের মত সাইকেল নিয়ে দিনরাত টংটং করে ঘুরে বেড়াচ্ছে, এখন রমেশ ঘোষাল মাথা ঠুকলে আর হবে কি! তাও তো এ গ্রামের লোকজন ভালো বলতে হবে, তাই পুরুত ঠাকুরকে দিয়েই গৃহলক্ষীর পুজো করাচ্ছে।
শঙ্কর অবশ শরীরে ভাঙা স্বরে বললো, কার সাথে পালিয়েছে বিন্দুপিসি!
বিন্দুপিসি মুখ বেঁকিয়ে বললো, কার সাথে সেটা তো কেউ জানে না গো। মহেশডাঙার কোনো ছেলে যে নয় সেটুকু জানি। তবে কোন পাড়ার ছেলে বলতে পারবো না। শুধু তিনি লম্বা চিঠিতে নাকি বলে গেছেন, আমায় খুঁজে লাভ নেই, আমি ফিরবো না। এ বিয়ে আমি করতে পারবো না, এ সংসার আমার জন্য নয়।
বোঝো! তার নাকি অন্য সংসারও আছে!
গলা দিয়ে লুচি, তরকারি, মোহনভোগ নামছিল না গৌরীশঙ্করের। বিন্দুপিসি আরও কি সব বলছিলো সেসব কানেও প্রবেশ করছিল না ওর।
মাধবীলতা তাহলে অন্য কাউকে ভালোবাসতো! ঐজন্যই কি শঙ্করকে কাছের মানুষ, ভালো বন্ধু বললেও কখনো প্রেমিক বলে স্বীকৃতি দিতে পারেনি? ওর গোটা মন জুড়ে তবে এতদিন অন্য কারোর বাস ছিল। শঙ্করের এত বছরের স্বপ্নগুলো তারমানে দিবা স্বপ্নের মতো মিথ্যে ছিল! কেন বললো না মাধবী ওকে! ভালো বন্ধুকে তো সব শেয়ার করা যায়, তাহলে! এলোমেলো হয়ে যাচ্ছিল ভাবনাগুলো।
বিন্দুপিসি চলে গেছে। শঙ্কর হাঁটতে হাঁটতে ওদের অতিপরিচিত পাটকাঠি আর কাঠ দিয়ে বানানো ছোট্ট সংসারের সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল। ওই তো মাধবীর পাতা মাটির উনুন। সেই কবে পেতেছিলো এ সংসার সেটা আর স্পষ্ট মনে নেই শঙ্করের। তবে এই ঘরটা যে মাধবীর বিশেষ পছন্দের ছিল তা বেশ বোঝা যায়। বড় বয়েসেও এর যত্ন করতো। মাধবীর ছোট্ট পুতুল খেলার ঘরের উঠোনে পড়েছিলো কিছু শুকনো পাতা, কাঠি। গৌরী সেগুলোকে যত্ন করে ফেলে দিলো। হু হু করে উঠলো বুকের ভিতরটা। আর এ পথ দিয়ে যাবে না কখনো ও। হাজার হাজার স্মৃতির ভিড়ে দমবন্ধ হয়ে যাচ্ছিল ওর।
রমেশকাকার বাড়ির উঠানে দাঁড়িয়ে মাধু বলেই ডেকে উঠতে যাচ্ছিল আগের মত। প্রিয় নামটাকে অতি কষ্টে গলার মধ্যে আটকে রেখে, ডাকলো রমেশকাকার নাম ধরে।
কয়েকদিনেই রমেশকাকার চেহারা ভেঙে গেছে। মানসিক আর শারীরিক অত্যাচার স্পষ্ট হয়েছে চেহারায়।
ওকে দেখে আলতো করে বললো, মাধবী মরে গেছে গৌরী। তোমার ছেলেবেলার খেলার সাথী মরে গেছে, আর এসো না এদিকে। আমি তার কোনো খোঁজ জানি না।
অবশ পায়ে বাড়ি ফিরে এসেছিল গৌরীশঙ্কর।
একটু একটু করে ভুলতে চেষ্টা করেছিল ওরই শরীরের একটা অঙ্গকে। মাধবীলতা ফুলের যে গাছটা মালিকাকা বসিয়েছিলো ওদের গেটের সামনে তাতে গোলাপি আর লালের মিশ্রণে ফুল ধরত। আগে কখনো গাছটার দিকে নজর পড়েনি, ইদানিং পড়ে। গাছ ভরে উঠেছে ফুলের ভারে, হয়তো মাধবীর ভালোবাসার সাজানো সংসারও ভরে উঠেছে এমনই সৌরভে।
গৌরীশঙ্কর চাকরি পেয়েছে কলকাতায়। বড়মামা হার্টের অসুখে মারা গেছে গতবছর। রায়চৌধুরী বাড়ির জমি জমা ভেস্টের মামলা চলছে সরকারের সাথে। উমাশঙ্কর নিজেকে চন্দ্রশঙ্করের যোগ্য সন্তান হিসাবে প্রতিষ্ঠিত না করতে পেরে ইদানিং মদ্যপান শুরু করেছে। জীবনের গতি এঁকে বেঁকে এগিয়ে চলেছে। আগের মত সুখকর নয় গৌরীশঙ্করের জীবন। তবুও চলছে টালমাটাল ভাবে। বাবার ইচ্ছে ছিল রায়চৌধুরী পরিবারের শেষ বংশধর এসে এ পরিবারের দায়িত্বভার বুঝে নিক। তার বদলে গৌরীর পাকাপাকি ভাবে কলকাতায় থাকতে চাওয়ার বাসনায় বেশ আঘাত পেয়েছেন উমাশঙ্কর রায়চৌধুরী। সেটা তার ব্যবহারে স্পষ্ট বুঝতে পেরেছে গৌরীশঙ্কর। দাদুর মৃত্যুর পরেই এ পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থার অবনতি হয়েছিল। গৌরীশঙ্করের এক কাকাও নিজের ভাগের জমি বেচে শহরে চলে গেছে। আরেক কাকার বিষয় সম্পত্তিতে অনীহা। উমাশঙ্করের একার পক্ষে সব দিক খেয়াল রাখা সম্ভব হচ্ছিল না বলেই ডাক পড়েছিলো গৌরীশঙ্করের। কিন্তু সবার আশায় জল ঢেলে দিয়ে এ বাড়ির শেষ বংশধর চাকুরে হয়ে চলে গেল কলকাতা। কালে ভদ্রে সে আসে মহেশডাঙায়। মহেশডাঙার বাতাসে নিঃশ্বাস নিতে নাকি তার কষ্ট হয়।
।। ১৪।।
কি হলো মাঠাকরুন, কষ্ট হচ্ছে তোমার? নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে? এমন করছো কেন, জল খাবে?
বিন্দু জলের গ্লাসটা সামনে ধরেছে নন্দিনীদেবীর। নন্দিনীদেবী জোরে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, আর বাঁচতে মন চায় না বিন্দু। বুকে যন্ত্রণা হয় সময় সময়। তোদের বড় কর্তাবাবু তো ওপরে গিয়ে বেঁচেছেন, আমায় রেখে গেলেন এসব অন্যায্য অনাচার দেখার জন্য! নিঃশ্বাস নিতে বেশ কষ্ট হচ্ছে নন্দিনীদেবীর। বয়েস যে খুব বেশি, তা নয়। তবুও নয় নয় করে পঁয়ষট্টি তো হলো। দুই মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন সেই কবেই। নাতি নাতনীরাও বড় হয়ে গেল। গৌরীশঙ্কর তো ওদের শেষ বয়সের সন্তান। তাই ওকে নিয়েই আশা ভরসা ছিল সব থেকে বেশি। ও যে এভাবে এ বংশের মুখে চুনকালি মাখাবে কে জানতো!
বিন্দু একটু অবাক হয়েই দেখছিল মা ঠাকরুনকে, ঝড় ঝাপটাতেও স্থির থেকেছেন তিনি, এমন কি জটিল পরামর্শও করতে দেখেছেন কর্তার সাথে। বড় পরিবারের মেয়ে আর সুন্দরী ছিলেন বলে অহংকারও নেহাত কম ছিল না এককালে! সেই মানুষটাই আজ বিন্দুর মত অতি নগণ্য মানুষের কাছে নিজের আক্ষেপের কথা বলছেন!
বিন্দুর জীবনের শখ আহ্লাদও এই মানুষটাই একসময় নিষ্ঠুর হাতে কেড়ে নিয়েছিলেন। ভালোবাসার মানুষটিকে ওর থেকে দূরে করে দিয়েছিলেন শুধুমাত্র ওকে নিজের দাসী করে রাখবেন বলে। মুখে বলেছিলেন, কলঙ্ক ডেকে অনিস না বিন্দু! এ বাড়ির আশ্রয় হারাবি।
মনে মনে একটু হাসলো বিন্দু। কাজের মেয়ে ড্রাইভারের সাথে পালালে হয়তো রায়চৌধুরী বাড়ির গায়ে তেমন কলঙ্কের দাগ লাগতো না, কিন্তু শঙ্কর যেটা করলো তাতে তো গোটা পরিবারের মুখে চুনকালি মাখিয়ে দিলো। বড়কর্তাবাবু তো পরিবারের অতিহ্য নষ্ট হয়েছে বলেই মনকষ্টে চলে গেলেন পৃথিবী ছেড়ে। বছর তিনেক আগেই এ বাড়ির মুখে কালি ঢেলে দিয়েছে এবাড়ির একমাত্র বংশধর।
নন্দিনীদেবী আবার বললেন, অভিশাপ, অভিশাপ লাগলো এ বাড়ির ওপরে। তাই ওই নষ্ট চরিত্রের মেয়েটা এবাড়ির আনাচে কানাচে ঘুরে বেড়াচ্ছে!
তা বিন্দু, সে মেয়ে এখন কি করছে রে!
বিন্দু ফিসফিস করে বললো, এই তো দশ মিনিট আগে দেখলাম, সেজেগুজে কোথায় যেন বেরিয়ে গেল। গাড়ি ছাড়াই হনহন করে বেরোলো।
নন্দিনীদেবী মুখ বেঁকিয়ে বললো, কোথায় কোন কালীমন্দিরের বিয়েকে নাকি মেনে নিতে হবে আমায়! লজ্জা লজ্জা সবই আমার কপাল। ওই মেয়ে কি ঘরে থাকার মেয়ে নাকি! ও তো চরেই বেড়াবে। শঙ্করের টাকা-পয়সা ধ্বংস করবে আর বেহায়ার মত ঘুরে বেড়াবে! আর আমার ছেলেটাও হয়েছে তেমনি। ওই মেয়ের মধ্যে যে কি রূপের মহিমা দেখলো কে জানে! কলকাতায় থেকেও এই মেয়ের প্রতি মোহ গেল না। দিনরাত ওই নষ্ট মেয়েটার পিছন পিছন ঘুরছে। হাঁ করে তাকিয়ে থাকে ওই মেয়ের মুখের দিকে। বুঝলি বিন্দু, বশ করেছে। ওসব মেয়েরা সব পারে। তোদের বড়কর্তা বাবু তো বলেই ছিল ওই মেয়ে যেন এবাড়ির চৌকাঠ না পেরোয়। তিনবছর আগেই তো বিয়ে করেছিল গৌরী, শুধু তোদের কর্তাবাবুর জেদে ওই মেয়েকে নিয়ে ঢুকতে পারেনি গৌরী। যেমনি বাবা মারা গেল অমনি ওই নষ্ট মেয়েটাকে নিয়েই এ বাড়ির চৌকাঠ পেরোলো ও। সুযোগের অপেক্ষায় ছিল, বাবা কবে মারা যাবে। নিজের পেটের ছেলেও পর হয়ে যায়! একমনে মনের সব রাগ দুঃখ উগরে দিচ্ছেন নন্দিনীদেবী। মাঝে মাঝে দেওয়ালে টাঙানো উমাশঙ্করের বিরাট ছবির দিকে তাকিয়ে বলছেন, তুমি পুণ্যবান, তাই নিজের জেদ নিয়ে স্বর্গে গেলে। আর আমি অভাগী বলেই এসব অন্যায় দেখতে হচ্ছে আমায়। এর থেকে অন্ধ হলেও ভালো হতো। আক্ষেপের সুরে কথা বলতে বলতেই গলার স্বরটা সরু করে নন্দিনীদেবী বললেন, খোঁজ নে বিন্দু ওই মেয়ে কোথায় যায়! বাবা তো ঢুকতেই দেয়নি শুনলাম বাড়িতে। তাহলে যায় কোথায়! বেরোলেই পিছন পিছন হাঁটবি। একবার যদি হাতে নাতে ধরতে পারিস, তাহলে শঙ্করের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেব, ওই মেয়ের চরিত্র কেমন! যে মেয়ে বিয়ের আগে নিরুদ্দেশ হয় আবার এত বছর পরে আরেকজনকে বিয়ে করে, তার স্বভাব জানতে আর কারোর বাকি নেই বুঝলি!
রহস্যের গন্ধ পেয়েই বিন্দু নড়েচড়ে বসেছিলো। বিখ্যাত বাড়ির কেচ্ছার কথা জানতে সবারই মন চায়। তাছাড়া ওই আবাগীর ওপরে বিন্দুর একটু হিংসেও আছে। পুরুতের ঘরের মেয়ে কিনা রায়চৌধুরী বাড়িতে বউ হয়ে এলো? তাও অমন কাণ্ড ঘটিয়ে! মাঝের চারবছর যে সে কোথায় ছিল, তার হদিস কেউ জানে না! তারপর বছর আড়াই তিন আগে আচমকা খবর পাওয়া গেলো, ছোটদাদাবাবু নাকি কোন কালীমন্দিরে গিয়ে ওই মেয়েকে বিয়ে করে এনেছে। বড়কর্তা তো কিছুতেই মেনে নেয়নি এই বিয়ে। বড়কর্তা বেঁচে থাকতে তো ওই মেয়ে এবাড়িতে ঢোকার সাহসও পায়নি। এখন নেহাত মাঠাকরুন অসহায় বিধবা মানুষ, তাই ছেলের খোঁজ করতে ওই মেয়েও এসে ঢুকেছে এ বাড়িতে।
আবার বিন্দুকে বলে কিনা, আমি তো এ বাড়ির সদস্য বিন্দুপিসি, এ বাড়ির অতিথি নয়। আমার খাওয়া দাওয়া নিয়ে চিন্তা করো না। বাড়ির বউ সকলকে খাইয়েই খাবো। গাঁয়ে মানে না আপনি মোড়ল। মরণ হয় না, অমন বউয়ের। ছোটদাদাবাবুকে ভালোমানুষ পেয়ে মাথাটা মুড়িয়ে খেয়েছে গো।
বুঝলেন মা ঠাকরুণ, আমার তো মনে হয় ওই মেয়ের আবার কারোর সাথে আশনাই চলছে। আমি খুঁজে বের করবোই।
ঘরের পাশ দিয়ে পেরোনোর সময় মা আর বিন্দুপিসির কথা শুনে একটু থমকে দাঁড়ালো গৌরীশঙ্কর। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে পায়ে পায়ে উঠোনের দিকে এগোলো ও। এরা মাধবীলতার সম্পর্কে এতটা খারাপ ভাবে! এতদিন গৌরী মনে করতো মাধবীলতা ওদের বাড়ির পুরোহিতের মেয়ে বলেই হয়তো বিয়েতে আপত্তি ছিল বাবা মায়ের। আজ যা শুনলো তাতে বেশ বুঝতে পারছে এরা মাধবীকে নোংরা চরিত্রের ভাবে। নোংরা শব্দটা বড্ড বেমানান মাধবীলতা নামটার সাথে। মাধবী যেন বহমান নদীর স্রোত। কোনো আবর্জনাই জমতে পারে না ওর মনে।
পুরোনো কিছু ঘটনা আজও চোখের সামনে ভাসে গৌরীশঙ্করের।
মাধবীলতা মহেশডাঙা ছাড়ার পরে আচমকাই এই গ্রামটা ওর কাছে বড্ড শূন্য হয়ে গিয়েছিলো। তাই কলকাতা থেকে গ্রামে ফেরার তাগিদটাও হারিয়েছিল।