পরজন্ম চাই – ৫
।। ৫।।
ইশা একটু ভয়ে ভয়েই ফ্লোরে ঢুকলো, প্রবুদ্ধ বলেছিল মিস্টার অর্কপ্রভ ব্যানার্জী নাকি পরিচালক হিসেবে যতটা সাকসেসফুল মানুষ হিসাবে ততটাই মুডি। ইন্ডাস্ট্রিতে নাকি ওনার আড়ালে লোকজন বলে, আবহাওয়া দপ্তরও দামি দামি রাডার বসিয়েও ধরতে পারবেন না ওনার মনের পরিবর্তন। এই কোনো আর্টিস্টকে জড়িয়ে ধরে উৎসাহ দিচ্ছেন তার ভালো কাজের জন্য আবার কখনো কোনো আর্টিস্টকে দূর দূর করে বের করে দিচ্ছেন ফ্লোর থেকে। এতটাই খুঁতখুঁতে পরিচালক যে হঠাৎ পুরো টিমকে নিয়ে গিয়ে হাজির করেন কোনো পুরোনো বাড়ির সামনে। তারপর আচমকা সেই বাড়িতে ঢুকে তাদের ফ্যামিলির মেম্বারদের বলেন, মুভিতে অভিনয় করতে হবে। যে যেভাবে আছেন সেই ভাবেই কাজ করতে থাকুন, আমি শ্যুট করে নেব। একবারও ভাববেন না আপনাদের পিছনে ক্যামেরা চলছে। আপনারা স্বাভাবিক ভাবে দৈনন্দিন কাজকর্ম করুন। এভাবেই তিনি শ্যুট করেন মধ্যবিত্ত সংসারের খুঁটিনাটি।
ভরা কলেজের লাইব্রেরীতে নিয়ে গিয়ে বসিয়ে দেন ফিল্মের নায়িকাকে। পাশাপাশি সবাইকে বেশ জোর গলায় বলেন, প্লিজ নরম্যাল বিহেভ করুন। তাই হয়তো ওনার বানানো ফিল্মগুলো পুরস্কৃত হয়।
মেকআপ বিহীন, সাধারণ অভিনয়ের মধ্যেও ফুটিয়ে তোলেন অসাধারণ কিছু। এই সন্ধারাগ মুভিটাতেও ওনার নায়িকা বৃষ্টিমুখর সন্ধেতে একা একা আনমনে বলে যাবে বেশ কিছু কবিতা। হঠাৎই নায়কের প্রবেশ। সেই জন্যই ঈশার বলা কবিতাগুলো রেকর্ড করবেন উনি। ঈশা সবার কথা শুনে বেশ ভয়ে ভয়েই ঢুকেছিলো স্টুডিও ফ্লোরে। অলরেডি ওনার নায়িকা উপস্থিত। বোধহয় লিপ মেলানো অভ্যেস করাবেন বলেই নায়িকাকে নিয়ে এসেছেন।
ঈশাকে দেখেই অর্কপ্রভ বললেন, মিস ঈশা আপনি পাক্কা আটমিনিট লেট। আমার ফ্লোরে কেউ লেটে আসার সাহস পায়না। কারণ আমি তাকে বাতিল করি।
তবে আপনি প্রবুদ্ধবাবুর পরিচিতা বলেই সুযোগটা দিলাম। কেন জানিনা, প্রবুদ্ধবাবু মানুষটাকে আমার বেশ অন্যরকম লেগেছে। ধরা ছোঁয়ার মধ্যে থেকেও ভীষণ রকমের আলাদা।
যাইহোক, শুরু করা যাক।
রেকর্ডিং রুমে নিয়ে যাওয়া হলো ঈশাকে। কাঁচের ঘরের স্বচ্ছ দেওয়াল দিয়ে ঈশা দেখছিল অল্পবয়সী পরিচালককে। ওনার পার্সোনালিটি প্রত্যেকের নজর কেড়ে নিতে বাধ্য। সাথে ব্যারিটন ভয়েসের নির্দেশ না মেনে কারোর উপায় নেই। ঈশা প্রথম দর্শনেই ভদ্রলোকের প্রেমে পড়ে গেলো। বলতে গেলে লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট। প্রবুদ্ধর সাথে এতদিনের সম্পর্কে কখনো তো এমন অনুভূতি হয়নি। ওর দিকে তো কখনো এমন বিহ্বলের মত তাকিয়ে থাকে নি ঈশা। প্রবুদ্ধ ওকে ভীষণ ভালোবাসে, ঈশাও হয়তো বাসে কিন্তু অর্কপ্রভর উপস্থিতি ওর শরীরে অন্য একটা অনুভূতির জন্ম দিচ্ছে। এই অদ্ভুত উপলব্ধির সঙ্গে ও পরিচিত হয়নি এর আগে। মনের মধ্যে অজানা একটা সুরের অনুরণন। সেই সুরের তাল লয় হয়তো সঠিক নয়, তবুও সে বেজেই চলছে আপন মনে।
অর্কপ্রভ কাঁচের দেওয়ালের ওপ্রান্ত থেকে ইশারা করলো ঈশাকে, ঈশা যেন যন্ত্রচালিত পুতুল।
মন্ত্রমুগ্ধের মত বলতে শুরু করলো কবিতার লাইনগুলো। কবিতা দুটো অর্কই সিলেক্ট করে দিয়েছে।
হঠাৎ দেখার মুহূর্তদের
মুঠোবন্দি করে রাখতে চাই।
দিনলিপির খাতায় ওই দিনটাকে
লাল কালিতে চিহ্নিত করে রাখতে চাই।
হারিয়ে যাওয়ার আগে
আবার ফিরে পেতে চাই।
বৃষ্টিভেজা একটা সন্ধে
কাটাতে চাই তোমার সাথে।
ঈশার গালদুটো অকারণেই রক্তাভ হয়ে যাচ্ছিল। অর্কর নায়িকার বলা কবিতার লাইনগুলো যে ওর নিজের মনের কথা সেটা বেশ বুঝতে পারছিল ঈশা। আর সেই কারণেই মনের সবটুকু অনুভূতি নিঃশেষ করে, গলার সবটুকু আবেগে ভাসিয়ে ও বলছিলো অর্কর লেখা কবিতাগুলোর প্রতিটি কালো অক্ষর। ওর চোখের সামনের ওই কালো অক্ষরগুলো যেন আচমকা বসন্ত বাতাসের স্পর্শে রঙিন হয়ে উঠেছিল।
রেকর্ডিং শেষ হতেই অর্ক এসে ওকে প্রায় জড়িয়ে ধরে বলল, মাইন্ড ব্লোয়িং। ইউ আর জাস্ট গড গিফটেড। অর্কর ছোঁয়ায় আমূল কেঁপে উঠলো ঈশা। থরথর করে কাঁপছিল ওর গোলাপি ঠোঁট দুটো।
সেদিকে অপলক তাকিয়ে অর্ক বললো, হবে আমার নেক্সট ফিল্মের নায়িকা? যে নায়িকা কথাগুলো বলবে কবিতার ঢঙে, প্রতিটা শব্দে মিশিয়ে দেবে এক মুঠো আবেগ? হবে ঈশা আমার নেক্সট ফিল্মের নায়িকা?
ঈশার মনে হচ্ছিল ও বোধহয় স্বপ্ন দেখছে। কি সব বলছে অর্ক! ও নাকি নায়িকা হবে! কিছুতেই সুখী সুখী এই স্বপ্নটা থেকে বেরোতে ইচ্ছে করছিল না ঈশার। মনে হচ্ছিলো আরও কিছুক্ষণ অর্ক ছুঁয়ে থাকুক ওকে। আরো কিছু এলোমেলো কথা বলুক ওর সাথে। নরম উষ্ণতায় পুড়তে চাইছিলো ঈশার মন।
অর্ক বললো, ইন্টিরিয়ার ডেকোরেশনের শো রুমে গিয়ে দেখছি আমার লাভই হলো, প্রবুদ্ধ খাঁটি হীরা দিলো, এর জন্য অবশ্যই প্রবুদ্ধকে থ্যাংকস জানাতে হবে।
অর্কর মুখে প্রবুদ্ধর নামটা শুনেই সম্বিৎ ফিরল ঈশার, অর্ক ওকে বোধহয় প্রবুদ্ধর বাগদত্তা হিসেবেই জানে। প্রবুদ্ধ তো দেশশুদ্ধু লোকজনকে ঈশার পরিচয় দেয় ওর উডবি বলে। এতদিন পর্যন্ত ঈশার সেটা বেশ ভালোই লাগছিলো। কিন্তু এখন কেমন যেন বিরক্তিতে ভরে গেল মনটা। অর্কর কাছে ও প্রবুদ্ধর উডবির পরিচয়ে থাকতে চায় না। তাড়াতাড়ি সামলে নিয়ে ঈশা বললো, হ্যাঁ প্রবুদ্ধ আমার খুব ভালো বন্ধু, ওর জন্যই আপনার সাথে আমার আলাপ হলো, ইনফ্যাক্ট আপনার মত একজন গুণী মানুষের সান্নিধ্যে আসতে পারলাম।
অর্কর ভ্রুর মাঝে হালকা ভাঁজ, ঠোঁটের ফাঁকে বিস্ময় নিয়েই বললো, তবে যে প্রবুদ্ধ বলেছিল তুমি ওর উডবি!
ঈশা কাঁধের ব্যাগটা ঠিক করে নিয়ে বললো, সেটা তার ভাবনাচিন্তার দৈন্যতা। বন্ধুত্বটাকে যদি কেউ অন্য সম্পর্কে রূপান্তরিত করতে চায় তবে আমি তো বলবো, সেটা ধ্রুবতারার দোষ নয়, বরং নাবিকের ব্যর্থতা।
অর্ক হালকা হেসে বললো, বেশ বললে তো।
রাস্তায় বেরোতেই প্রবুদ্ধর ফোন। কি গো, এতক্ষণ চললো রেকর্ডিং, ফোনটা অফ ছিল বলে আরও টেনশন করছিলাম আমি, কাজে মন বসছিলো না, ভাবছিলাম, কি জানি পাগলীটা কি করছে?
ঈশা অর্কপ্রভ আর প্রবুদ্ধকে পাশাপাশি দাঁড়িপাল্লায় বসিয়ে তীক্ষ্ন নজরে দেখছিলো। চোখের সামনে দেখতে পেলো প্রবুদ্ধর পাল্লাটা নেমে গেছে বেশ কিছুটা নীচে। অর্ক কোনো চেষ্টা না করেই শুধু ওর পার্সোনালিটির জোরে ঈশার মনের গোপন কুঠুরির দরজায় করাঘাত করতে শুরু করেছে প্রথম দর্শনেই।
প্রবুদ্ধ বললো, আমি আসছি গাড়ি নিয়ে, তুমি একটু ওয়েট করো।
ঈশার একেবারেই ইচ্ছে করছিল না এখন প্রবুদ্ধর সাথে ফিরতে। বারবার মনে হচ্ছিল একটু একা থাকতে, একটু একটু করে উপভোগ করতে অর্কর সাথে দেখা হওয়ার মুহূর্তগুলোকে। তাই কোনোমতে নিজেকে সামলে ঈশা বললো, না না প্রবুদ্ধ, আমি আলরেডি উবের বুক করে ফেলেছি, একবার ইউনিভার্সিটি হয়ে ফিরবো।
ঈশার গলার স্বরে হয়তো উষ্ণতার ঘাটতি ছিল। তাই প্রবুদ্ধ বলে উঠল, কোনো প্রবলেম হয়েছে ঈশা?
তোমার গলাটা এরকম কেন লাগছে? অর্কপ্রভ কি কিছু বলেছে, শুনছিলাম নাকি মানুষটা ভীষণ মুডি?
তোমার কবিতা কি ওনার পছন্দ হয়নি?
এই ঈশা, প্লিজ টক টু মি!
না, ইচ্ছে করছে না ঈশার এই মুহূর্তে প্রবুদ্ধর অতিরিক্ত কেয়ারিং অ্যাটিটিউড। মনে হচ্ছে সব বন্ধন ছিঁড়ে অর্কর চোখের দিকে তাকিয়ে কোনো কথা না বলে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকতে।
সামলে নিয়ে ঈশা বললো, আরে না না সেসব নয় প্রবুদ্ধ। উনি ভীষণ ভালো বিহেভ করেছেন। আমার কাজও ওনার পছন্দ হয়েছে। তুমি টেনশন করো না। আমি পরে কল করবো।
উবের বুক করে ফেললো ঈশা। কয়েকঘন্টা আগের ঈশাকে আর চিনতে পারছে না ও। এই কয়েকঘন্টায় কি যে ঘটে গেল নিজেও বুঝতে পারছে না। সব কিছু ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়ে নতুন করে গড়তে ইচ্ছে করছে ওর। গাড়ির আয়নায় নিজের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠলো ও। এই কি সেই ঈশা, যে প্রবুদ্ধ ফোন করতে দেরি করলে মনখারাপ করে বসে থাকতো! এই কি সেই ঈশা, যে প্রবুদ্ধর একটা ফোনের জন্য এক সময় উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করতো!
কি এমন ঘটলো, যে নিজেকেই নিজের কাছে অপরিচিত লাগছিলো ওর।
।। ৬।।
কি যে হলো ঈশাটার, যেন অপরিচিত কেউ। প্রবুদ্ধ ঈশার গলা শুনেই বুঝতে পারে ওর এখন রাগ হয়েছে নাকি অভিমান। নাকি কেউ ওকে অপমানজনক কিছু বলেছে! এই প্রথম ঈশার গলার স্বরের সঙ্গে ওর কথার সামঞ্জস্য পেল না ও। মুখে তো বললো, সব ঠিক আছে, ওর কাজ নাকি দারুণ পছন্দ হয়েছে অর্কপ্রভর, তাহলে গলায় সেই উচ্ছ্বাস নেই কেন! ঈশার সাথে প্রথম আলাপের মুহূর্তের কথা মনে পড়ে গেলো প্রবুদ্ধর। সেদিনও ঈশার গলায় এমন দ্বিধার আনাগোনা ছিল।
প্রবুদ্ধ সেদিন ওর পিসির ছেলে অনিমেষের সাথে গিয়েছিল পিসির বাড়ির পাশের একটা ক্লাবে।
অনিমেষ ওই ক্লাবের সক্রিয় সদস্য। তাই ক্লাবের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে বিশেষ দায়িত্ব পালন করতে হয় ওকে। ক্লাবটা প্রায় পঞ্চাশ বছরের পুরোনো। তাই রবীন্দ্র-নজরুল সন্ধ্যা থেকে শুরু করে যে কোনো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে সাবেকিয়ানা বজায় রাখার একটা আপ্রাণ চেষ্টা ছিল ক্লাবের সেক্রেটারি থেকে ভলান্টিয়ারদের। বড়পিসির বাড়িতে ছুটির দিনে দুপুরে মাংস ভাত খেয়ে আরাম করছিল প্রবুদ্ধ। অনিমেষ পাঞ্জাবি পরে বেশ ধোপদুরস্ত হয়ে প্রবুদ্ধর সামনে এসে বলছিলো, চল যাবি? প্রবুদ্ধ পাশ ফিরে শুয়ে বলেছিল, মুভি?
অনিমেষ তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলেছিল, না রে মুভি নয়, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, আসলে বকলমে আমি হচ্ছি কিরণ সংঘ ক্লাবের কালচারাল সেক্রেটারি, তাই কিছু দায়িত্ব তো আমাকেও নিতে হয়, আজকের অনুষ্ঠানটার অনেকটা দায়িত্বও তাই আমার ওপরে, যাবি তো চল, তোরা তো নাকউঁচু পাবলিক, দেখবি চল এখনো কেমন গোছানো প্রোগ্রাম করি আমরা, গান, নাচ থেকে কবিতাবৃত্তি, নাটক থেকে মুকাভিনয় সব পাবি।
প্রবুদ্ধ সোজা হয়ে বসে বলছিলো, কবিতা বলতে, কুমোরপাড়ার গরুর গাড়ি টাইপ? সেদিন বাড়ি ফিরছিলাম কোনো একটা ক্লাবের বাৎসরিক অনুষ্ঠান হচ্ছিল, রাস্তায় জ্যাম হয়ে গিয়েছিল, স্বাভাবিক ভাবেই গাড়ি দাঁড় করিয়ে দিতে হয়েছিল, তখনই কানে এলো একটা আধবুড়ো পাবলিক স্টেজে উঠে নমস্কার টমস্কার করে কুমোর পাড়ার গরুর গাড়ি আবৃত্তি করতে লাগলো। লোকজন তো রবীন্দ্রনাথ মানেই ভগবান তুমি যুগে যুগে আর কুমোর পাড়া বোঝে রে। মানুষটা যে এত এত লিখে গেল, কেউ সাহস পেলো না সেসব বলতে।
অনিমেষ তুই কালচারাল সেক্রেটারি কি করে হলি ভাই, ছোটবেলায় তোর তবলার স্যার আসতেন আর তুই পিছনের দরজা দিয়ে দে ছুট দিতিস। পিসিমনি তোর তবলিয়া আসার দিনে পিছনের দরজায় রীতিমত পাহারা বসাত রে, সেই তুই কিনা কালচারাল সেক্রেটারি। কি দিনকাল এলো রে।
বড়পিসি মাঝ পথে বলে উঠলো, একি রে প্রবুদ্ধ তুই এখনও রেডি হোসনি? যাবি না অনুষ্ঠান দেখতে?
পিসির শাড়ি দেখেই প্রবুদ্ধ বুঝেছিলো, রীতিমত রেডি হয়ে হাতে বাড়ির গেটের চাবি নিয়ে বেরোবার জন্য তৈরি।
বাধ্য হয়েই প্রবুদ্ধ বলেছিল, তোমরা যখন সবাই যাচ্ছ, তখন আমি আর বাড়িতে বসে থেকে কি করবো?
চল, আয় তবে সহচরী, হাতে পায়ে ধরি ধরি শুনেই আসি।
তবে শোন অনিমেষ, কবিগুরুর গানকে কেউ বিকৃত করলে কিন্তু আমার সাথে হাতাহাতি লেগে যাবে। আমি গান না গাইতে পারি, কিন্তু শুনতে ভালোবাসি মারাত্মক। তাই বেসুরো বেতালা পাবলিক স্টেজে উঠে কেত মারছে দেখলেই ব্রহ্মতালু গরম হয়ে যায়। অনিমেষ হাসি মুখে বলেছিল, আর যদি আমাদের অনুষ্ঠান দেখে মনে শীতল বাতাস বয়ে যায়, তাহলে রাতে ট্রিট দিচ্ছিস তুই।
অনিমেষের সাথে কিছুটা চ্যালেঞ্জ করেই ও উপস্থিত হয়েছিল ওদের কিরণ সংঘের বিশাল হলঘরে।
ক্লাবের পরিপাটি ব্যাপারটা আকর্ষণ করছিল ওকে। বড়পিসি আর প্রবুদ্ধ বসেছিলো পাশাপাশি।
অনিমেষ চলে গেছে স্টেজের ব্যাকে। কালচারাল সেক্রেটারির নাকি কিছু দায়িত্ব থাকে বলে বেশ লেকচার দিয়েই গেছে। ক্লাবের বিশাল হলঘরটা ফুল দিয়ে নিখুঁত করে সাজানো। মঞ্চের দুপাশে মনীষীদের ছবি। কাঠের বার্নিশ করা টেবিলে সঞ্চিতা আর সঞ্চয়িতা, পাশে একগুচ্ছ রজনীগন্ধা নিজস্ব মহিমায় বিরাজমান। হাজার অর্কিডের ভিড়ে পুরাতনী গন্ধ বহন করতে সচেষ্ট হচ্ছে যেন।
পরিবেশটা বেশ ভালো লেগে গেলো প্রবুদ্ধর। প্রবুদ্ধর মা বলে, ছেলে আমার ভীষণ খুঁতখুঁতে, তবে কোনো কিছু যদি ভালো লেগে যায় তাহলে আর সেদিক থেকে মন সরে না।
প্রবুদ্ধ ছোট থেকেই নিজের পছন্দের ভালোবাসার মানুষগুলোকে আগলে রাখতে পছন্দ করে। সেই ছোট্ট বেলার পছন্দের পেন্সিলবক্স ওর আলমারিতে খুঁজলে এখনো পাওয়া যাবে। কিরণ সংঘের অনুষ্ঠানের পরিবেশ যখন পছন্দ হয়েই গেছে তখন আর না নড়ে চড়ে স্থির হয়ে বসে মনোযোগ দিলো মঞ্চের দিকে।
একটা বছর দশকের ছোট মেয়ে উদ্বোধনী সংগীত গাইল, বেশ তৈরি গলা। না, সন্ধেটা নষ্ট হলো না প্রবুদ্ধর। মনে মনে অনিমেষকে থ্যাংকস জানালো। ইদানিং কাজের চাপে এসব অনুষ্ঠানে আসাই হয় না ওর।
এমনিতেই ওদের ফ্যামিলির সকলেই ওকে দেখে নাক কুঁচকে বলে, ছি প্রবুদ্ধ, তুই আর্কিটেক্ট পাশ করে, এত ভালো রেজাল্ট করেও জব না করে বিজনেস করছিস! আমাদের ফ্যামিলির সকলে নিশ্চিন্ত চাকরি করে এসেছে এতকাল। তুই যেন কেমন দলছুট।
দলছুট হতেই ভালো লাগে প্রবুদ্ধর। তাই তো গোটা দুয়েক জব জয়েন করার পরেও নিস্কৃতি চেয়েছিল ছকে বাঁধা জীবন থেকে। ওই দশটা পাঁচটার জীবনে না আছে উত্থান না পতন। একটা কোম্পানির হয়ে চাকরগিরি করা। নিজের মতামতের কোনো মূল্য নেই যেখানে সেখানে ও সাচ্ছন্দ বোধ করে না কোনোদিনই। তাই মোটা মাইনের জবগুলো ছেড়ে দিয়ে নিজেই খুলে বসেছে ইন্টিরিয়ার ডেকোরেশনের অফিস প্লাস শো রুম। বাবার কাছে হাত পাতে নি। পুরোটাই লোন নিয়েছিল প্রবুদ্ধ। যে লোনের প্রায় আশি শতাংশ ও শোধ করে দিতে পেরেছে মাত্র তিন বছরে।
এখন অবশ্য ওদের ফ্যামিলির অনেকেই স্বীকার করে, জেদ আছে বটে ছেলেটার। গত তিনবছরে ওর স্নান খাওয়ার সময় ছিল না। নিজের সঙ্গে নিজের চ্যালেঞ্জ বিষয়টা বেশ গোলমেলে। চব্বিশ ঘন্টাই বিবেক নামক বস্তুটি ওকে ছুটিয়ে বেড়াত। জিততে না পারলেই আবার সেই ছকে বাঁধা জীবনে ফিরতে হবে ওকে। ভাগ্য সুপ্রসন্নই বলতে হবে। মাত্র তিনবছরেই ওর কোম্পানি বেশ নাম করে ফেলেছে। অনেকেই আড়ালে বলে, ইউনিক ভাবনা চিন্তায় নাকি প্রবুদ্ধ সকলকে টেক্কা দিয়েছে। এতদিনে ও নিজের দিকে তাকাতে সময় পেয়েছে। তাই তো ছুটির দিনে বড় পিসির বাড়িতে আড্ডা দিতে আসতে পেরেছে। গত তিনবছর আত্মীয়স্বজনদের সাথেও একপ্রকার বিচ্ছেদ ঘটেছিল ওর।
এবারে আপনাদের সামনে কবিতাবৃত্তি করবেন ঈশা সেন।
ভাবনার জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে মঞ্চের দিকে মন দিয়েছিল প্রবুদ্ধ। তখনই দেখেছিলো, চা পাতা আর মেঘলা আকাশ রঙের মিশেলে একটা চুড়িদার পরে স্টেজে এসে দাঁড়িয়েছিল ঈশা।
শুরু করেছিল কবিগুরুর কবিতা। প্রচলিত কবিতাগুলোর বাইরে কবিতা বেছেছিলো ঈশা। যেগুলো প্রায়ই রিসাইট করতে শোনা যায় সেগুলো নয়। অদ্ভুত মিষ্টি কণ্ঠস্বর ঈশার। তেমনি সুন্দর বাচনভঙ্গিমা।
রবীন্দ্র নজরুল সন্ধ্যা বলেই দুটো নজরুল দুটো রবীন্দ্র কবিতা বলে ঈশা যখন নামলো স্টেজ থেকে, তখন প্রবুদ্ধ আর স্থির হয়ে বসে থাকতে পারেনি চেয়ারে। মন্ত্রমুগ্ধের মত ছুটে গেছে স্টেজের পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা অনিমেষের কাছে। প্রায় আকুতি গলায় বলেছিল, অনি, প্লিজ একবার মেয়েটার সাথে কথা বলিয়ে দে।
অনিমেষ চোখের ইশারায় বলেছিল, রাতে ট্রিট দিবি তো।
নিজের ওয়ালেটটা অনির হাতে ধরিয়ে দিয়ে প্রবুদ্ধ বলেছিল, এই যে কার্ড, ক্যাশ সব আছে।
অনিমেষ মুচকি হেসে এগিয়ে গিয়েছিল ঈশার দিকে।
প্রবুদ্ধর হৃৎপিণ্ড দ্রুতগামী হয়েছিল। ঈশা সামনে এসে নমস্কারের ভঙ্গিমায় বলেছিল, আপনি অনিমেষদার দাদা? অনিমেষদা একদিন ক্লাবের লাইব্রেরিতে আপনার গল্পই করছিল। আপনি নাকি জেদ করে ভালো ভালো সব জব ছেড়ে দিয়ে বিজনেস করছেন এবং মারাত্মক সাকসেসফুলও হয়েছেন!
প্রবুদ্ধ মনে মনে অনিমেষকে অনেকটা আদর করে ঈশার দিকে তাকিয়ে বলেছিল, কবিতা কি ছোট থেকেই শেখেন? বড্ড ভালো বলেন আপনি।
ঈশা মুচকি হেসে বলেছিল, আমায় তুমি বলুন প্লিজ, আমি অনিমেষদার পরের ব্যাচ ছিলাম।
প্রবুদ্ধ আবার বলেছিল, বহুদিন পরে এত সুন্দর কবিতা শুনলাম।
ঈশা হেসে বলেছিল, এটা আমার প্যাশন, অনেকে অবশ্য দাবি করে ব্লাড, আমার মা, দিদাও নাকি ভালো কবিতা বলতো, হয়তো ওখান থেকেই জন্মেছে ভালোবাসাটা, আমি অবশ্য এসবে বিশ্বাসী নই, আমি মনে করি এটা আমার প্যাশন বলেই আমি নিজেকে প্রমাণ করতে পেরেছি। প্রবুদ্ধ অপলক তাকিয়ে ছিল ঈশার দিকে।
কি সুন্দর সাবলীল কথাবার্তা মেয়েটার। অপরিচিত একজনের সাথে কথা বলার সময়েও কোনো জড়তা নেই।
ছোট থেকে স্টেজ পারফর্ম করছে বলেই হয়তো এতটা স্মার্ট।
প্রবুদ্ধ হাসি মুখে বলেছিল, ফেসবুকে আছো? পাঠাতে পারি রিকোয়েস্ট?
ঈশা স্বাভাবিক গলায় বলেছিল, নিশ্চয়ই পারেন।
আমি অপরিচিত মানুষের রিকোয়েস্ট নিই না, মেসেঞ্জারে খেজুরে আলাপে আগ্রহী নই মোটেই।
একটু অস্বস্তির গলায় প্রবুদ্ধ বলেছিল, তবে থাক, তোমার কবিতা শুনলাম, এমন কণ্ঠের অধিকারীর সাথে পরিচয় হলো, এই তো ঢের প্রাপ্তি। আর বিরক্ত করাটা বোধহয় অন্যায় হবে।
ঈশা কিছু না বলে মুচকি হেসে চলে গিয়েছিল ওর পরিচিত কারোর ডাকে।
নির্নিমেষ তাকিয়ে ছিল প্রবুদ্ধ ওর চলে যাওয়ার দিকে।
পরক্ষণেই মনে হয়েছিল মেয়েটা বোধহয় এনগেজড। সেটাই স্বাভাবিক, এত সুন্দরী, শিক্ষিতা, দুর্দান্ত কণ্ঠের মালকিন এখনো সিঙ্গেল এটা তো ভাবাই দুস্কর।
তবে ওই প্রবুদ্ধর মায়ের কথায় ছেলে বড্ড খুঁতখুঁতে কিন্তু কোনো কিছু পছন্দ হয়ে গেলে সেটা আর মন থেকে সরে না সহজে।
রাতে বাড়ি ফিরে অনিমেষের কাছ থেকে জেনে নিয়েছিল ঈশার খুঁটিনাটি। অনিমেষ অবশ্য বলেছিল, ঈশার ক্লাস ইলেভেনে একটা পাড়াতুতো প্রেম ছিল বলে খবর আছে। তবে সে সম্পর্কের ব্রেকআপ হয়ে গেছে বহুদিন। এই মুহূর্তে ও নাকি সিঙ্গেল আছে।
সবটা শোনার পরেও প্রবুদ্ধর মনে হয়েছিল, ঈশার সাথে হ্যাংলার মত কথা বলতে যাওয়াটা নিজের পারসোনালিটির অবক্ষয় ছাড়া আর কিছুই নয়।
তাই ফেসবুকে ঈশা সেনের প্রোফাইলটা বারবার চেক করার পরেও ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠাতে পারেনি প্রবুদ্ধ।
ঈশার সাথে পরিচয় হবার পরে কেটে গিয়েছিলো বেশ কয়েকটা সপ্তাহ। নিজের কাজের জগতে প্রবেশ করেছিল প্রবুদ্ধ। যেখানে একবার ঢুকে গেলে সব কিছু ভুলে যায় ও। নিজেকে বারবার প্রমাণ করার লড়াইয়ে মেতে উঠেছিলো ও। প্রায় ভুলে গিয়েছিল সুকণ্ঠী ঈশাকে।
তখনই কাকতলীয় ভাবে ঈশা এসে উপস্থিত হয়েছিল ওর সামনে। ঈশা আর ওর বান্ধবী একসাথে ওর অফিসে প্রবেশ করেছিল। ঈশার বান্ধবী রচনা বলেছিল, আমাদের নতুন ফ্ল্যাটটা ডেকোরেট করতে চাই। আপনার কোম্পানির গুড উইলের কথা শুনেই এলাম।
প্রবুদ্ধ লক্ষ্য করেছিল, ঈশার ঠোঁটে আলগা হাসির ছোঁয়া।
রচনার সাথে কথাবার্তা ফাইনাল হবার পরে ঈশা নরম গলায় বলেছিল, দুবার দেখা হওয়ার পরে বোধহয় একটা মানুষ পরিচিত হয়ে যায়, তাই না? আমি কিন্তু পরিচিত মানুষদের ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট নিয়ে থাকি। আর দ্বিধা না করেই ফেসবুকে রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছিল প্রবুদ্ধ।
ঈশার সাথে ওর সম্পর্ক প্রায় বছর আড়াই হয়ে গেল। ওরা জানে ওরা দুজন দুজনকে ভীষণ ভালোবাসে। বলতে গেলে একে অপরের পরিপূরক। ঈশার সমস্ত ভালমন্দের দায় নিজের কাঁধে স্বেচ্ছায় তুলে নিয়েছিল প্রবুদ্ধ। এতদিনের সুরে বাঁধা ছন্দে চলা জীবনটায় একটু বেসুরো তাল বাজলেই বড্ড কানে লাগে। আজ তাই ঈশার গলার স্বরের ওঠানামাটাও কান এড়ালো না প্রবুদ্ধর।
যেন ভীষণ পরিচিত গীটারের তারটা হঠাৎই বেসুরো বেজেও বোঝানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছিল, সে ঠিকই আছে। প্রবুদ্ধর মনের মধ্যে একটা ছোট্ট জিজ্ঞাসা চিহ্ন তীরের মত বিঁধে রইলো। ভালোবাসার মানুষটাকে যে সবটুকু দিয়ে আগলে রাখতে চায় প্রবুদ্ধ।
।। ৭।।
ভালোবাসার মানুষটা যে ওকে ঘৃণা করে সেটা ঠিক কবে বুঝেছিলো আজ আর মনে নেই কমলিকার। ফাঁকা বাড়িতে যখন নিজের সাথে একান্তে চলে তার আলাপচারিতা তখন আপনমনে নিজের নামটুকুকে স্মরণে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করে ও। রিনা সেনের ভিতরের কমলিকা দাশগুপ্তের সাথে রোজই একটু আধটু কথা হয় ওর।
মনীন্দ্রর বাবা, মা বেঁচে থাকতে বাথরুমে শাওয়ারের জলের নীচে দাঁড়িয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে কথা বলতো কমলিকার সাথে। বেশির ভাগটাই ছিল অভিযোগ। কেন সে বুঝতে পারেনি মনীন্দ্রকে! মুখোশের ভিতরের মানুষটাকে কেন দেখতে পেল না কমলিকার কাজল কালো স্বপ্নীল চোখ দুটো! নিজের ওপরেই একরাশ অভিমান জমে জমে ক্রমে শুকিয়ে এসেছিল চোখের জল। আর ইদানিং তো হাজার চেষ্টা করেও নোনতা জলের দেখা মেলে না কমলিকার চোখে। চোখের ভিতরের সূক্ষ্ম শিরা উপশিরারা বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে বহুকাল আগে থেকেই। তারাও ক্লান্ত, তারাও বিষণ্ণ হয়ে মানিয়ে নিয়েছে রিনা সেনের জীবনটা। বিরক্ত হয়ে কমলিকা দাসগুপ্তকে ভুলে গেছে তারা। সবাই ভুলে গেছে কমলিকাকে। এমনকি আয়নায় থাকা পারদরা পর্যন্ত সেদিন ওর ঝুলপির পাশের রুপালি রেখার দিকে তাকিয়ে বলল, সেন বাড়ির বউ তো মধ্যবয়স্কা হয়েই গেলে, আর কটা দিন কাটিয়ে দাও এভাবেই।
সবাই মেনে নিয়েছে কমলিকার রিনা সেন হওয়াটাকে। শুধু একজনই কিছুতেই মেনে নিতে পারেনি, সে হলো কমলিকার মনের একটা গোপন কুঠুরি। যেখানে এককালে বাস করতো কবিতার আবেগময় কালো অক্ষররা। যে অক্ষরগুলোকে ও বুকে জড়িয়ে ধরে ফিসফিস করে বলতো, ভালোবাসি তোদের, তোরা থাকিস আমার সাথে।
মাঝে মাঝেই একলা বাড়িতে সেই অক্ষরগুলো ফিরে আসে ওর গলায়। তখন ও আচমকা রিনা সেন থেকে হয়ে যায় কমলিকা দাসগুপ্ত। এই এখন যেমন ওয়াসিং মেশিনে জামা কাপড় কাচতে দিয়ে আচমকা বলে উঠলো….
আমি বন্ধন-হারা কুমারীর বেণী,
তন্বী-নয়নে বহ্নি,
আমি ষোড়শীর হৃদি-সরসিজ প্রেম উদ্দাম,
আমি ধন্যি!
চিত-চুম্বন-চোর-কম্পন
আমি থর-থর-থর প্রথম পরশ কুমারীর….
হাজার বারণ, নিষেধ সত্ত্বেও মাঝে মাঝেই অবাধ্য হয়ে ওর কণ্ঠে বেরিয়ে আসতে চায় কবিতার শব্দগুলো।
যাদের ও প্রায় ত্রিশ বছর সযত্নে লুকিয়ে রেখেছে। লুকিয়ে নয়, বলতে গেলে পায়ে বেড়ি পরিয়ে বেঁধে রেখেছে।
কেন যে তারা আকস্মিক ভাবে এত বছর পরেও এসে ভিড় করে কমলিকার সামনে, কে জানে!
কমলিকার ঠোঁটের কোণে ব্যঙ্গাত্মক একটা হাসির রেখা এসেই মিলিয়ে গেল। কলেজ সোশ্যালে এই কবিতাটাই বলেছিল না কমলিকা! কাজী নজরুল ইসলামের বিদ্রোহী শুনেই মনীন্দ্র চেয়ার ছেড়ে উঠে এসেছিল ওর কাছে। কমলিকার কবিতা শুনে মুগ্ধ হয়েছিল মনীন্দ্র। বলেছিল, বাঁচিয়ে রেখো এদের, এরা অমূল্য সম্পদ। মনীন্দ্রকে প্রথম দেখেই ভাল লেগেছিলো ওর। সত্যি বলতে কি ওর কলেজের চটকদার ছেলেদের তুলনায় মনীন্দ্র বড্ড বেশি সাদামাটা ছিল। তবে কথা বলতো খুব সুন্দর করে। রোজ কলেজ আসার সময় কমলিকা দেখতে পেত দুটো চোখ অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে ওর আসার পথের দিকে তাকিয়ে। মনীন্দ্রর সাথে কলেজ সোশ্যালে পরিচয় হওয়ার পর থেকেই ওদের অফিসের ওই বিশেষ জানালাটার দিকে রোজ তাকিয়ে ফেলতো কমলিকা। কিছুতেই অবাধ্য চোখের দৃষ্টিকে শাসন করতে পারতো না। প্রতিদিন দৃষ্টি বিনিময় হতো ওর আর মনীন্দ্রর। কোনো কথা নয়, শুধুই অপলক কয়েক সেকেন্ড। তাতেই যেন ভালোলাগার আবেশ ছড়িয়ে যেত ওর গোটা শরীরে। না ছুঁয়েও যে এভাবে স্পর্শ করা যায় সেটা অনুভব করেছিল কমলিকা সেই প্রথম। কলেজ ছুটির দিন মনীন্দ্রর ওই অনুভূতি মাখানো কিছু বলতে চাওয়া চোখ দুটোকে খুব মিস করতো কমলিকা। সব কিছুর মাঝেও যেন কিছু না পাওয়া। গত একমাসে মনীন্দ্রকে ওই একই জানালায় একই ভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে কমলিকা বুঝেছিলো, ছেলেটা ওকে চায়, ভীষণ ভাবে চায়, কিন্তু কিছুতেই বলতে পারছে না। হয়তো ভাবছে কমলিকা রিজেক্ট করে দেবে, তাই বোধহয় সাহস করে এগিয়ে আসেনি কথা বলতে।
তবুও কথা হয়েছিল ওদের। একটা ঘু ঘু ডাকা গরমের দুপুরে, তীব্র রোদের মধ্যে কলেজ থেকে একলা ফিরছিল কমলিকা। কি একটা কারণে যেন ছুটি হয়ে গিয়েছিল সেদিন। বন্ধুরা ক্যান্টিনে আড্ডা দেবে বলে থেকে গিয়েছিল ক্যাম্পাসের ভিতরে। কমলিকার শরীরটা খারাপ লাগছিল গরমে, তাই ও বেরিয়ে এসেছিল বাড়ি ফিরবে বলে।
বাস ধরবে বলেই হাঁটছিল ছাতা মাথায় দিয়ে, আচমকা কেউ একজন পাশ থেকে বলেছিল, রূপকথার রাজকন্যা আজ একা কেন? সৈন্য সামন্তরা কোথায়?
কমলিকা পিছন ঘুরে দেখেছিলো, ফুটপাথের একটা চায়ের দোকানে দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছে মনীন্দ্র।
ও দাঁড়াতেই মাটির ভাঁড়টা ফেলে দিয়ে এগিয়ে এসেছিল ওর সামনে। মুচকি হেসে বলেছিল, কি ব্যাপার, মিস কমলিকা দাসগুপ্ত আজ একা একা রাজপথে? তার সৈন্য সামন্তরা সব কই? কমলিকা একটু লজ্জা পেয়ে বলেছিল, তাই তো আজ অফিসের জানালাটা ফাঁকা দেখলাম, অতন্দ্রপ্রহরীর নজর এড়িয়েই চলে এলাম এদিকে।
মনীন্দ্র একটু লজ্জা পেয়ে বলেছিল, প্রহরী আজ বেসামাল, হিসেবে চূড়ান্ত গণ্ডগোল, বিকেল পাঁচটার বদলে দুপুর দুটো হবে সে কি করে জানবে!
কমলিকা হেসে বলেছিল, সে তো না হয় বুঝলাম, কিন্তু এমন প্রখর রোদে গরম চা খেয়ে তৃপ্ত হওয়ার বিষয়টা পরিষ্কার হলো না, লস্যি কিংবা শরবত খেলে বরং শরীর মাথা দুই ঠাণ্ডা হবে এমন উষ্ণতায়।
মনীন্দ্র আড়চোখে চায়ের দোকানের দিকে তাকিয়ে বলল, সেটা নির্ভর করছে তার পছন্দের ওপরে। এই যে বিজয়বিহারী কলেজের এত শান্ত গাছতলা পছন্দ না করে আমি খুজেঁ খুঁজে ইউক্যালিপটাস গাছের মত দামি সুখী একটা গাছকে পছন্দ করলাম, এটারও তো যুৎসই ব্যাখ্যা নেই আমার কাছে। কেউ কেউ বরফ শীতল শান্তি পছন্দ করে, আবার কেউ কেউ উষ্ণতম দিনের তীব্র পারদে পুড়তে চায় একটু একটু করে, এরও কি কোনো ব্যাখ্যা আছে!
কমলিকার গাল চিবুক রক্তাভ হয়ে উঠেছিল। সেদিকে তাকিয়ে মনীন্দ্র বলেছিল, গাল দুটো এই যে আবির রাঙা হয়ে উঠেছে এ বোধহয় শহরের উষ্ণতম দিনের উষ্ণতার এফেক্ট, চলুন আপনাকে বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসি। কমলিকা ঘামছিলো, ভিজছিলো, ছটফট করছিল নতুন এক অনুভূতিতে। মনীন্দ্রর দিকে ছাতাটা বাড়িয়ে দিয়ে কমলিকা বলেছিল, ছাতার ভিতরে আসুন।
মনীন্দ্র নিজের দিকে তাকিয়ে বলেছিল, রং পুড়ে যাবার ভয় আছে বলছেন? বরং তাত লাগলে যে মোম গলে যাবার ভয় আছে তাকেই ভালো করে ঢাকুন। একই ছাতায় হাঁটতে হাঁটতে দুজনের আঙুলে আঙুলে ছোঁয়া লাগছিলো, অদ্ভুত অনুভূতির অনুভবে কমলিকা বিহ্বল হয়ে বলেছিল, আর কিছু বলবেন না আমায়?
মনীন্দ্র কানের কাছে ফিসফিস করে বলেছিল, কবিতার অক্ষরদের বাঁচিয়ে রেখো, একদিন একা বসে শুনবো, দর্শকাশনে সেদিন শুধু আমি, একাধিপত্য অধিকার করবো তোমার কবিতার প্রতিটা অক্ষরে।
কমলিকা বলেছিল, আর বক্তার ওপরে একাধিপত্য বজায় রাখার কোনো ইচ্ছেই নেই বুঝি?
মনীন্দ্র একটু করুণ হেসে বলেছিল, বক্তা যে আমার নাগালের বাইরের মানুষ, দূরের নীহারিকা।
তাই দু চোখ দিয়ে চেয়ে থাকি তার দিকে। কখনো মনে হয় ভোরের সদ্য ফোটা শিউলি, কখনো তীব্র গ্রীষ্মের উগ্র দাম্ভিক পলাশ, কখনো আনমনা বেলফুল, যে পথচলতি মানুষকে না জেনেই তার গন্ধ বিতরণ করে।
আবার কখনো মনে হয়, ধ্যানগম্ভীর পদ্ম, নিজের আসনে স্থির হয়ে বসে আছে, আশেপাশের সমস্ত কিছু সম্পর্কে সে মারাত্মক উদাসীন। তাই মালি নিজেই ভীষণ কনফিউজড। একবার ভাবে ওই আনমনা বেলফুলের সামনে দাঁড়িয়ে দু হাত জোড় করে বলা যায়, একটু সুবাস কি আমিও পেতে পারি?
মালি যখনই যাবার তোড়জোড় করে তখনই দেখে দাম্ভিক পলাশ চোখ রাঙিয়ে বলছে, সাহস তো বড় কম নয়! বামন হয়ে চাঁদের দিকে হাত বাড়ানো। বাড়িয়ে দেওয়া হাত মুহূর্তে ঢুকে যায় চোরা পকেটে। নিজের মনকে ধিক্কার দিয়ে বলে, এ তো দূরের চন্দ্রমল্লিকা, একে স্পর্শ করতে যেও না, বড্ড নাজুক, ভীষণ রাগী আর একটু খামখেয়ালি।
কমলিকা মনীন্দ্রর কথার স্রোতে ভাসতে ভাসতেই চলে এসেছিল বাসস্ট্যান্ডে। ভালোলাগা আর অজানা শিহরণ বুকে নিয়েই আলতো করে বলেছিল, যদি বেলফুল, পদ্ম আর রাগী পলাশ একসাথে রাজি হয় বন্ধুত্ব করতে তাহলেও কি ভয় থাকবে?
মনীন্দ্র বড় বড় চোখ করে বলেছিল, ঘুঘু ডাকা নিস্তব্ধ দুপুরের স্বপ্ন নয় তো? প্লিজ একটা চিমটি কাটো।
কমলিকা দুষ্টুমি করে বেশ জোরেই চিমটি কেটেছিল মনীন্দ্রর হাতে। তারপর ছুটে উঠে গিয়েছিল বাসে।
মনীন্দ্র জোরে বলেছিল, ফর্সা নই বলে কি দাগ হয়না? চামড়ায় দাগ সুস্পষ্ট নয় বলে কি মনের দাগও মুছে যাবে। কাল দেখো, এই চিমটির দাগ নিজের মহিমায় বর্তমান থাকবে।
ইস, লজ্জায় বাসের জানালা দিয়ে আরেকবার তাকিয়ে ছিল কমলিকা।
তারপর প্রতিদিনই কিভাবে যেন কমলিকা বন্ধুদের ছাড়াই দলছুট হয়ে বাড়ি ফিরতো, আর দুপুর দুটোর পরিবর্তে মনীন্দ্রর চা খাওয়ার সময় বদলে হয়েছিল বিকেল পাঁচটা। কয়েক পা একসাথে হাঁটা, রূপকথার রাজকন্যাও মনীন্দ্রর সাথে মাটির ভাঁড়ে চা খেয়েছিল দেখেই মনীন্দ্র বলেছিল, পারবে কমলিকা আমাদের সাদামাটা মধ্যবিত্ত জীবনটাকে মেনে নিতে? আমাদের গোটা সংসারটা আমার মাইনের ভরসায় দিন কাটায়, আমাদের ঘরের কোণে গ্রামফোনে বিসমিল্লাহ খানের সানাই বাজে নি কখনো, ছোট থেকেই দেখেছি সকাল শুরু হয়েছে মেরি বিস্কুট আর গুঁড়ো দুধের অপ্রতুলতা দিয়ে।
কমলিকা বলেছিল, প্রাচুর্যে আমার আসক্তি নেই মনীন্দ্র, শুধু একজন খাঁটি মনের মানুষ চাই, যার সাথে কাটাবো সুখ দুঃখের মুহূর্তগুলো! মনীন্দ্র আলতো করে ধরেছিল কমলিকার হাতটা। ফিসফিস করে বলেছিল, একটা কথা দিতে পারি কমলিকা, তোমার কবিতার অক্ষরদের নিজের বুক দিয়ে আগলে রাখবো, তোমার অনুভূতিগুলো রক্ষা করবো নিজের জীবন দিয়ে। কিছুতেই সেগুলোকে হারিয়ে যেতে দেব না কেজো জীবনের বাসন কোষণের শব্দে। তোমার সব কোমল অনুভূতিরা আমার মনের আঙিনায় টুংটাং শব্দে বাজবে আজীবন। কমলিকা বলেছিল, আমি এমন একজন মানুষকেই চাই মনীন্দ্র, যে আমার সাথে সাথে আমার কবিতাদের ভালোবাসবে, শ্রুতি নাটকের পাল্টে যাওয়া চরিত্রদের মধ্যেও খুঁজে পাবে কমলিকার শিল্পী সত্ত্বাকে। বাদ বাকি সবকিছু আমি মানিয়ে নিতে পারবো, কিন্তু এদের অবমাননা আমি সহ্য করতে পারবো না।
মনীন্দ্র মুচকি হেসে বলেছিল, বুঝেছি বুঝেছি, আমার থেকেও তোমার বেশি প্রিয় হলো মঞ্চ। তাই তো?
কমলিকাও উত্তর দিয়েছিল, তিনবছর থেকে যে মঞ্চটাকে আপন করে নিয়েছিলাম মনীন্দ্র, তাই একটু হলেও ওর প্রতি আমার ভালোবাসা বেশিই। মাইকটা হাতে ধরলেই গোটা শরীরটা শিহরিত হয় আমার, সামনের দর্শকের সারিতে কারা বসে আছে আর দেখতেই পাই না আমি। তখন আমি এক অন্য কমলিকা।
মনীন্দ্র একটু গম্ভীর স্বরে বলেছিল, কিন্তু তোমার বাবা ডক্টর কমলেশ দাসগুপ্ত কি মানবেন আমার মত অত্যন্ত সাধারণ একজন কেরানী জামাইকে?
কমলিকা ঘাড় নেড়ে বলেছিল, না মানবে না। বাবার অনেক স্বপ্ন আমায় ঘিরে, তাই হয়তো বাবার সেই স্বপ্ন ভেঙে গেলে আর কখনো মুখদর্শনই করবে না আমার। হয়তো সকলের কাছেই বলবে তার একটাই মেয়ে, বড় মেয়ে মারা গেছে কার দুর্ঘটনায়। হয়তো শুধু মালবিকাকে নিয়েই বাঁচবে দাসগুপ্ত ফ্যামিলি। কিন্তু মনীন্দ্র তোমায় ছাড়া যে আমি ভালো থাকবো না কিছুতেই।
আয়নার সামনে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সেন বাড়ির মধ্যবয়স্ক বউ রিনা সেন। ঝুলপির চুলে সিলভার লাইন, চোখের নিচে ডার্ক সার্কেলে এত বছরের গ্লানি সুস্পষ্ট। সিঁথির সিঁদুরের জায়গাটা চুল ফাঁকা হয়ে নিজের পথ চিরস্থায়ী করে রেখেছে। অনেক চেষ্টা করেও এই মুখে সেই কলেজ পড়ুয়া কমলিকাকে খুঁজে পেল না ও। অবশ্য কমলিকা যেন আর কখনোই রিনার মধ্যে ফিরে না আসে সে ব্যবস্থা পাকাপাকি করেছিল ঈশার যখন বয়েস মাত্র নয় বছর। যখন ও বুঝেছিলো ভালোবাসা, প্রতিশ্রুতি শব্দগুলো গল্প, উপন্যাসের একচেটিয়া রোম্যান্টিজিম। বাস্তব জীবনে একটাই শব্দের আধিপত্য, সেটা হলো কর্তব্য আর ভালো থাকার অভিনয়। যেটা একমনে অতগুলো বছর ধরে করে আসছে কমলিকা।
মনীন্দ্রকে মুখোশহীনভাবে প্রথম দেখেছিলো সেদিন। তার আগে পর্যন্ত তবুও ঝগড়া, অভিমান, দ্বন্দ্ব, মিলনে কাটছিল জীবন। কিন্তু যেদিন ভালোবাসা নামের সূক্ষ্ম পর্দাটা উন্মোচিত হয়ে গিয়েছিল কমলিকার সামনে সেদিন থেকেই জোর করে গলা টিপে নিজের হাতে খুন করেছিল ওই নামের মেয়েটাকে। ধীরে ধীরে বাঁচিয়ে তুলেছিল রিনাকে। যার নিজস্ব কোনো মতামত নেই। নাম, ধাম বদলে, এতবছরের পরিচয় বদলে যে একটা যন্ত্রে পরিণত হচ্ছিল ক্রমশ। কমলিকা বড্ড স্বাধীনচেতা, ভীষণ রোম্যান্টিক, রিনার সাথে তার বড়ই অমিল। এ বাড়ির সকলে রিনাকে পছন্দ করতো, এমন কি মনীন্দ্র পর্যন্ত বলেছিল, রিনা, থাক না ওসব কবিতা, নাটক। তুমি তো তিনবছর থেকে তেইশ বছর বয়েস পর্যন্ত মঞ্চ দাপালে, এবারে না হয় মন দিয়ে সংসার করো। আমারও কিন্তু বাড়ির এই সকলের মত ঘরোয়া সংসারী রিনাকেই বেশি পছন্দ, কমলিকাকে না হয় ত্যাগ করলে আমার জন্য! বিস্ময়ে হতবাক হয়ে তাকিয়েছিলো কমলিকা। মনে মনে একটাই কথা ভেবেছিল, মানুষটা কি এমনই ছিল, নাকি বদলে গেল এই কয়েকবছরে!
এলোমেলো প্রশ্ন এসে ওলটপালট করে দিচ্ছিল চার অক্ষরের শব্দটার মানে! ভালোবাসার অর্থ কি শুধুই এক তরফা স্যাক্রিফাইস? অ্যাডজাস্টমেন্ট শব্দের অর্থ কি কমলিকার সমস্ত ভালোলাগার জলাঞ্জলি দেওয়া? এমনকি নাম, পদবি পর্যন্ত। মনীন্দ্র তো কমলিকাকে ভালোবেসে এ বাড়ি ছাড়েনি, ছাড়েনি পরিবার, নিজের পরিচয়, নিজের ভালোলাগা কিছুই, তাহলে কমলিকাকে কেন বিসর্জন দিতে হচ্ছে ওর সব টুকু। কেন বদলে ফেলতে হচ্ছে আসল মানুষটাকে। তবে কি এই কমলিকাকে কোনোদিনই ভালোবাসেনি মনীন্দ্র? ভেবেছিল বিয়ের পর খোলনলচে পাল্টে ফেলে তৈরি করবে সম্পূর্ণ অন্য একটা মানুষ? ওর মনমত কথা বলা, যন্ত্রচালিত পুতুলের সৃষ্টি করবে ভেবেছিল কি! তাই কি কমলিকার নাম, পদবি, স্বভাব সব পরিবর্তন করতে উঠে পড়ে লেগেছে এ বাড়ির সকলে!
উঠে পড়ে তো কমলিকাও লেগেছিল, চূড়ান্ত অভিমানে স্থবির হয়ে গিয়েছিল ওর ভালোলাগা, চাওয়া পাওয়ার অনুভূতিগুলো। তাই নিজেকে যন্ত্রে পরিণত করেছিল ক্রমশ। বহুবছরের সাধনায় সেটা পেরেওছিল। কিছুতেই উঁকি মারতে দেয়নি কমলিকাকে, রিনার কর্তব্যে কখনো ত্রুটি হয়নি। মনীন্দ্র অবশ্য ইদানিং মাঝে মাঝেই বলে, তোমার সাথে দিনদিন থাকা জাস্ট অসহ্য হয়ে উঠছে। কেন এতটা বদলে গেলে তুমি! মনেহয় একটা রোবট দিনরাত ঘুরে বেড়াচ্ছে বাড়িতে!
জয়, এটাই কমলিকার জয়, ও জিতে গেছে। নিজেকে তিলতিল করে নিঃশেষ করেও ও জিতেছে।
রান্নাঘরটা অবশ্য ওকে খুব সাহায্য করেছে সব কিছু ভুলে থাকতে। নিজের পরিচয়টা ভুলতে সাহায্য করেছে নুন, হলুদের কৌটোগুলো। পেঁয়াজের রসে বেরোনো চোখের নোনতা জলের কষ্টগুলোর তফাৎ করতে পারেনি কেউ! গ্যাসের দপ করে জ্বলে ওঠা আগুনে ও নিজের রাগকে প্রশমিত করেছে। জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ধ্বংস করে দেওয়ার মানসিকতাকে একসময় নিয়ন্ত্রণ করেছে ওই আগুনের লেলিহান নীল শিখার দিকে তাকিয়েই।
একলা দুপুরে পুরোনো মনীন্দ্রকে মাঝে মাঝেই দেখতে পায় কমলিকা। মুচকি হেসে ওর দিকে তাকিয়ে যেন বলে, কি মিস কমলিকা দাসগুপ্ত? কেমন লাগছে সেন বাড়ির সংসার, পেরেছি না, তোমার স্বপ্নগুলোকে দুমড়ে মুচড়ে ভেঙে দিতে? দেখো দেখো একজন সাধারণ কেরানীও পেরেছে রাজকন্যাকে টেনে হিঁচড়ে মাটিতে নামিয়ে আনতে।
কমলিকার বুকের বাঁদিকে হালকা যন্ত্রণা হয় তখন। আবার ও ভারী পাথরটা জোর করে চাপিয়ে দেয় ওই যন্ত্রণার জায়গাটায়। উঠে পড়ে রিনা সেন, ওয়াইফ অফ মনীন্দ্র সেন…উঠে পড়ে ঈশা আর দেবজিতের মা, অনেক কাজ বাকি তার। সবাই ফিরবে, তার জন্য টিফিন রেডি করতে হবে। আবার ওর কেজো, কষ্ট ভোলানো রান্নাঘরের দিকে ছুটে যায় রিনা। বিদায় দেয় মুহূর্তের জন্য ওর মধ্যে ভর করা কমলিকাকে। আলতো করে বলে, তুমি ভালোবেসেছিলে কমলিকা, তাই এটুকু শাস্তি তো তোমায় পেতেই হবে। বিশ্বাসের মাশুল যে তোমায় গুনতেই হবে।
।। ৮।।
বাড়িতে ঢুকেই বাড়ির এক চিলতে লাইব্রেরির দিকে এগোলো দেবজিত। অফিস থেকে বাড়ি ফেরার পথেই ভাবছিলো কি কবিতা বলা যায়। এখনো কিছু সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। আসলে দীর্ঘ বছরের অনভ্যাসের ফলে কবিতার সাথে ওর আর সখ্যতা নেই। ঈশা যখন বলে, মাঝে মাঝে শুনতে পায় দেবজিত।
তবে ঈশা নিজের বোন হলেও বড্ড হিংসুটে টাইপ। ছোটবেলায় বার দুই দেবজিত কম্পিটিশনে ফার্স্ট হয়েছিল। সেজন্য ঈশা দুদিন কারোর সাথে কথা অবধি বলেনি। মোটামুটি বেশির ভাগ আবৃত্তি প্রতিযোগিতাতেই প্রথম হতে হতে ও অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল। তাই দ্বিতীয় স্থানটা ছিল ঈশার খুব অপছন্দের। বিশেষ করে দাদা ফার্স্ট ও সেকেন্ড হলে তো কথাই নেই। বাড়ি ফিরেই শুরু করত কান্না। তারপর দুদিন পুরো চুপচাপ। শেষে ওর পাওয়া সেকেন্ড প্রাইজটা টুকরো টুকরো করে ভেঙে ফেলে তবেই শান্ত হতো।
এমনকি একবার সুকুমার রায়ের বইটা অবধি কুচি কুচি করে ছিঁড়ে ছিল। মা ঈশাকে খুব বকেছিলো। যদিও বাবা মাকে রীতিমত অপমান করে বলেছিলো, এতে খারাপ কি দেখলে? ওর ফার্স্ট হবার মানসিকতাই ওকে একদিন অনেক এগিয়ে নিয়ে যাবে।
দেবজিত আর ঈশাকে মা যখনই কোনো অন্যায়ের জন্য শাসন করতে আসতো তখনই বাবা কোনো এক অদৃশ্য কারণে ওদের পক্ষ নিয়ে কথা বলতো। তাই খুব ছোট থেকেই ওরা বুঝেছিলো, মা এ সংসারের নিতান্ত অপ্রয়োজনীয় মানুষ। এমনকি ঠাম্মাও বলতো, তোর মায়ের ভুলভাল কথা শোনার দরকার নেই, বাবা যেটা বলবে শুনবি। বাবা অফিসে চাকরি করে, কত পড়াশোনা করেছে বলতো, বাবা সব জানে, মা তো রান্নাঘরে রান্না করে, মা কি করে এত বুঝবে!
দেবজিতও কথায় কথায় মাকে বলতো, তুমি নিজে কতদূর পড়েছো, যে আমাদের পড়াতে আসছ?
খুব ছোট থেকেই ও লক্ষ্য করেছিল, কোনো কারণে মাকে ওরা দুই ভাইবোন অপমান করলে সেদিন বাবার কাছে বেশি আদর পাওয়া যেত। বাবা সেদিন অফিস ফেরত চকলেট বা খেলনা কিনে আনতো। দেবজিত আর ঈশার কাছে ব্যাপারটা বেশ মজার ছিল। কথায় কথায় মাকে অপমান করলেই চকলেট পাওয়া যাবে গোছের একটা খেলা।
মাও ধীরে ধীরে কেমন যেন হয়ে গেল। ভীষণ অন্যমনস্ক, একটু উদাসীন, শুধু যন্ত্রের মত সংসারের কাজগুলো করতো। কর্তব্যে ত্রুটি করতো না ঠিকই কিন্তু মনে হত যেন একটা রোবট। ঈশা বলেছিল, ভালোই হয়েছে, ওই অশিক্ষিত মহিলার বকুনি খেতে আমার ভালো লাগে না। আমায় কবিতার ম্যাম বলেছেন, তোমার মা বেশিটাই ভুল শিখিয়েছেন। ভাগ্যিস সময় মত আমার কাছে এসেছো।
যদিও ঈশার কবিতা বলার স্টাইলে নতুন কিছু পার্থক্য বুঝতে পারেনি দেবজিত। মা যেমন করে বলতো, ঈশার দিদিমণিও তেমনই শেখান বলে মনে হয়েছে দেবজিতের। তবে বাবা ঈশাকে দিদিমণির কাছে পাঠিয়ে দেবার পরে মা আর কখনো কবিতা শেখাতে আসেনি ওদের কাউকে।
দেবজিত নিজেই বলেছিল, তুমি তো ঈশাকে বেশি ভালো করে শিখিয়ে দাও, ডুবলিসিটি করো, তাই তোমার কাছে আমি শিখবো না। ওই কথাটা শোনার পর মা খুব শান্ত গলায় বলেছিল, সে শিখিস না, তবে কবিতা বলা ছেড়ে দিস না। তোর হবে রে জিত।
মায়ের কথা শুনেও রাগে ফুসেছিলো ও। ছেড়ে দিয়েছিল প্রিয় জিনিসটাও।
আজ বহু বছর পরে আবার খোঁজ পড়লো কবিতার। ঈশার কাছে জিজ্ঞেস করতেই পারে কোন কবিতাটা এই রিটায়ারমেন্টের অনুষ্ঠানে করা উচিত, কিন্তু ও জানে ঈশা এমন একটা মুখ করে তাকাবে যেন ও পাকিস্তানে যাওয়ার জন্য ভিসা অ্যাপ্লাই করতে চাইছে! তারপর শুরু হবে ওর ব্যঙ্গাত্মক হাসি। তার থেকে থাক, নিজে যা বুঝবে তাই করবে। কিন্তু অফিসের ব্যাপার, মান সম্মান যাবে সেরকম পারফরমেন্স ও করতে পারবে না। জীবনে ছোট ছোট বিষয়েও দেবজিত ভীষণ সিরিয়াস। পারফেকশন শব্দটা ওর বড্ড পছন্দের শব্দ। একটু বেশি পরিশ্রম করতে হয় ঠিকই ওই শব্দটাকে আপন করতে হলে, কিন্তু পারফেকশনিস্টরা যে আলাদা রকমের তৃপ্তি পায় সেটার স্বাদ অগোছালো মানুষরা বুঝবে না।
এই আলমারির সামনে আগে মা এসে দাঁড়িয়ে থাকতো, অকারণে বইগুলোর গায়ে হাত বুলাত। দেবজিত অবাক হয়ে দেখতো তখন মাকে। দুটো গাল বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে আর রবিঠাকুরের সঞ্চয়িতা হাতে নিয়ে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে আছে রিনা সেন। মাকে তখন যেন কেমন অন্য গ্রহের বাসিন্দা মনে হতো। কাছে যেতে কেমন ভয় ভয় করতো দেবজিতের। আসলে ওদের মা টা যেন কেমন একটা। অন্যের মায়েদের মত হাসে না, গল্প করে না, অদ্ভুত রকমের চুপচাপ। মাকে বড্ড দূরের লাগতো জিতের। ছোটবেলায় তবুও মা গল্প বলতো, আদর করতো, কিন্তু যবে থেকে বাবার মত দেবজিতও কথায় কথায় মাকে অপমান করতে শুরু করলো তবে থেকেই মা আরও নিশ্চুপ হয়ে গেল। সঞ্চয়িতা আর সঞ্চিতার ওপরে যে মায়ের একটা আলাদা টান আছে সেটা জিত লক্ষ্য করেছিল আগেই। আজ আলমারি থেকে বই বের করতে গিয়ে দেখলো, দুটো বইয়ের ওপরেই ধুলোর স্তর। আগে তো দেখতো মা নিজের আঁচল দিয়ে পরম আদরে মুছছে এসব বই, এখন দেখছে ধুলো। বইগুলো যে বহু বছর কেউ হাত দেয়নি সেটা বেশ বুঝতে পারলো দেবজিত। সঞ্চয়িতাটা বের করে নিয়ে নিজের ঘরের দিকে এগোলো ও।
ঘরে ঢোকার মুখেই বাবার সাথে দেখা। হাতে চায়ের কাপ নিয়ে এগোচ্ছিল। হাতে সঞ্চয়িতা দেখে বললো, কি ব্যাপার, হঠাৎই কবিগুরুর স্মরণে!
দেবজিত একটু দায়সারা ভাবেই বললো, ওই অফিসে একজনের ফেয়ারওয়েল পার্টি আছে তাই ভাবছি একটা কিছু পাঠ করবো।
বাবা হেসে বললো, বেশ বেশ, ঈশাকে বলিস একটু দেখিয়ে দেবে।
বিরক্তিতে মুখটা তেতো হয়ে গেল দেবজিতের। বাবার এরকম কেন মনে হয় যে ঈশাই একমাত্র মেয়ে যে কবিতা বলে। ইউটিউবে সার্চ করলে হাজারটা চ্যানেল পাবে যেখানে কবিতা শুনতে পারবে।
সন্ধেবেলা বিতর্কে যাবে না ঠিক করেই কথা না বাড়িয়ে নিজের ঘরের দিকে এগোলো দেবজিত।
একটুখানি পরেই মা একটা ট্রে করে চা দিয়ে গেল টেবিলে। চা-টা খেয়েই দেবজিত বুঝলো মা চায়ে আদা দিয়েছে।
আগেও কোনো প্রোগ্রাম থাকলে মা আদা কুচি আর লবঙ্গ দিয়ে দিতো মুখে। বলতো মুখে রেখে দিবি, রসটা যেন গলা অবধি যায়। এতে গলা শার্প হয়। আজও চায়ে চুমুক দিয়েই জিত বুঝলো আদার টেস্টটা। জাস্ট বিরক্ত লাগছিলো ওর। সব ব্যাপারে নিঃস্পৃহ হয়েও নিখুঁত কর্তব্য পালন করার স্টাইলটা ভীষণ রকমের অস্বস্তিকর।
ওদের কারোর কাছে কিছুই চাহিদা নেই মহিলার, শুধু নিজেকে একটু একটু করে বিলিয়ে দিয়েই যেন শান্তি পায় রিনা সেন।
অসহ্য রকম রাগে প্রায় চিৎকার করে দেবজিত বললো, তোমায় বলেছিলাম চায়ে আদা দিতে? তাহলে কেন দিলে?
মা একটাও কথা না বলে আরেক কাপ আদা ছাড়া চা টেবিলে নামিয়ে দিয়ে গেল নিস্তব্ধে। দেবজিত ভীষণ ভাবে চায় মা চিৎকার করুক, ঝগড়া করুক, অশান্তি হোক তোলপাড়। এমন শীতল ব্যবহারটা আর সহ্য করতে পারে না ও। সকলের মায়েরা কত স্বাভাবিক, ওর মা টা যেন কেমন! এই তো সেদিন প্রীতম চায়ের দোকানে বসে বলছিলো, না ভাই রবিবার বলেই আড্ডা দিতে পারবো না। মাংস, মাছ নিয়ে দেরি করে বাড়ি ঢুকলে মা পেটাবে। এত বড় হয়ে গেলাম, চাকরি বাকরি করছি, দুদিন পরে হয়তো বিয়েও করবো, এখনো মায়ের হাতের কানমোলা খাই জানিস। চললাম রে, বলেই চায়ের ভাঁড়টা রেখে দিয়ে বাজারের ব্যাগ হাতে ছুটছিলো প্রীতম।
দেবজিতও এসেছিল বাজার করতে। রবিবারের মাংস কেনার দায়িত্বটা ও অনেকদিনই নিজের কাঁধে নিয়েছে। বাবা অন্য দিনে বাজার করলেও রবিবারের স্পেশাল বাজারটা দেবজিত নিজের হাতে করে।
প্রীতমের কথা শুনে মাথার মধ্যে অদ্ভুত একটা বুদ্ধি ভর করেছিল ওর। ইচ্ছে করে চারকাপ চা খেয়ে, এর ওর সঙ্গে গল্প করে সময় কাটাচ্ছিলো জিত। আজ দেরি করে ফিরবে মাংস নিয়ে। দেখা যাক ওদের বাড়ির রোবটরূপী মানুষটার মধ্যে কোনো হেলদোল হয় কিনা! রান্নাঘরটুকুর মধ্যে নিজেকে সীমাবদ্ধ করে রাখা চূড়ান্ত আনকালচার্ড মানসিকতার মানুষটার মধ্যে কোনো পরিবর্তন হয় কিনা পরীক্ষা করবে বলেই ইচ্ছে করে দেরি করছিল জিত।
বাজার সেরে যখন বাড়ি ঢুকলো ঘড়ির দুটো কাঁটা তখন তেঁতুল পাতায় নয়জন ধারণায় বিশ্বাসী হয়ে অত্যন্ত সুজনের মত বারোর ঘরে এসে একে অপরের গায়ের ওপরে উঠে লুটোপুটি খাচ্ছে।
বাবা পর্যন্ত বিরক্ত হয়ে তাকিয়ে বলেছিল, এত দেরী? কখন রান্না হবে, আর কখন খাওয়া হবে।
ছুটির দিনেও সেন বাড়িতে লাঞ্চ টাইম দুপুর একটা থেকে দেড়টা। ঠাকুমা বলেছিল, করছিলিস কি বাজারে এত বেলা পর্যন্ত। জানিস তো বাবা ছুটির দিনে তাড়াতাড়ি দুপুরে খায়!
একটা মানুষই শুধু কোনো কথা বলেনি। দেবজিত অপলক তাকিয়ে দেখেছিলো রিনা সেনের দিকে। না, তার চোখের দৃষ্টিতে কোনো রাগ, বিদ্বেষ কিছুই ছিল না। মাংসের প্যাকেটটা নিয়ে গিয়ে তড়িঘড়ি রান্নার আয়োজন শুরু করেছিল। দেবজিতকে আশ্বস্ত করে বলেছিল, খাওয়ার আগেই রান্না হয়ে যাবে।
আরও আরেকবার হেরে গিয়েছিল দেবজিত। ওই মহিলার অনন্ত ধৈর্য্যের পরীক্ষার কাছে হার স্বীকার করে নিয়েছিল ও। মনে স্থির বিশ্বাস জন্মেছিল মহিলার মন বা আবেগ বলে কোনো বস্তুই নেই, সেজন্যই এমন রাগ দ্বেষহীন জীবন কাটাতে পারে।
মা নামক মানুষটাকে বিভিন্ন প্রয়োজনে ব্যবহার করে নিতো বাড়ি শুদ্ধু লোক, কিন্তু কখনো ওরা কেউ জিজ্ঞেস করেনি, মায়ের কি প্রয়োজন। দেবজিত ছোট বেলায় বলতো, মা তুমি কিছু চাও না কেন পুজোর সময়?
মা হেসে বলতো, তুই বড় হয়ে চাকরি করে আমায় অনেক কিছু দিবি। বড় হওয়ার আগেই কি ভাবে যেন মা আর দেবজিতের মধ্যে সম্পর্কটা নষ্ট হয়ে গেল। মা যেন বহুদূরের কয়েক আলোকবর্ষ দূরের বাসিন্দা হয়ে গেল, আর দেবজিত নিজের জগৎ নিয়ে মেতে উঠলো। সেখানে বাবার সামান্য জায়গা থাকলেও রিনা সেনের প্রবেশাধিকার নেই। মায়ের এই পাথর কঠিন মুখ, নির্লিপ্ত চাহনি অসহ্য লাগে দেবজিতের। ও যতটা পারে ওই মহিলার থেকে দূরেই থাকে। প্রথম যেদিন কলেজে গিয়ে ড্রিংক করেছিল বন্ধুদের সাথে, সেদিনও বাড়ি ফেরার পরে ওই মহিলা নির্নিমেষ তাকিয়েছিল জিতের দিকে। যেন এক্সরে মেশিন দিয়ে ভিতর অবধি দেখে নিচ্ছে। অন্যদিন কিন্তু মা এভাবে তাকাত না ওর দিকে। সেদিনের চাউনি ছিল অন্যরকম। দেবজিত বুঝেছিলো, ও ধরা পড়ে গেছে মায়ের কাছে। চূড়ান্ত তিরস্কারের জন্য ও যখন মনে মনে রেডি হয়ে গেছে তখন মা ধীর গলায় বলেছিল, ভেজিটেবল চপ বানিয়েছি সন্ধের টিফিন, তুই কি খাবি? কি অদ্ভুত ঠাণ্ডা সে গলার স্বর। মেরুদণ্ডে কাঁপন ধরে গিয়েছিল দেবজিতের। কোনোমতে মায়ের চোখের আড়ালে পালিয়ে বেঁচেছিলো ও।
অমন নিঃস্পৃহ হিমশীতল চাউনির আড়ালে গিয়ে জোরে শ্বাস নিয়েছিল ও। এই মহিলাকে কথায় কথায় অপদস্ত করেও কি ভাবে যেন হেরে যায় ওরা। শুধু দেবজিত নয়, ঈশা থেকে বাবা পর্যন্ত আড়ালে বলে, ইগনোর করে বুঝলি, আমাদের রাগ আক্রোশগুলোকে রিনা সেন জাস্ট ইগনোর করে। নিজের খোলসের বাইরে বেরিয়ে কিছুতেই রিয়্যাক্ট করে না ঐজন্যই। ঈশা রেগে গিয়ে বলে ওই যন্ত্র মানবের পাথুরে শীতলতার কাছে বারবার হেরে যাই, প্লিজ বাবা কিছু একটা করো। বাবাও হালছাড়া গলায় বলে, একপেশে জব্দ করতে চেয়েছিলাম, অহংকারটুকুকে মাটিতে মিশিয়ে দিতে চেয়েছিলাম, কিন্তু এ ভাবে হেরে যেতে চাইনি। ব্যর্থ আক্রোশে দেওয়ালে ঘুষি মেরেছে বাবা। ঈশা নাকের পাটা ফুলিয়ে রাগ দেখিয়েছে, মুখে বলেছে, কিসের অহংকার ওই আনকালচার্ড মহিলার? কিন্তু শেষ পর্যন্ত ওরা তিনজনেই পরাস্ত হয়েছে ওই প্রস্তর মূর্তির কাছে। কোনো কিছুতেই তার ধৈর্য্যের বাঁধে সামান্য চিড় ধরেনি।
ওদের তিনজনের শূন্যে আস্ফালনকে চূড়ান্তভাবে পরাস্ত করে দিয়ে রিনা সেন খুব স্বাভাবিক গলায় জিজ্ঞেস করেছে, ডিনারে কি খাবে তোমরা?
বিস্মিত হয়েছে দেবজিত বারবার, বিরক্ত হয়েছে তার থেকেও বেশি। এখনও যেমন আদা চায়ের পরিবর্তে একটাও কথা না বলে আদা ছাড়া চা-টা রেখে গেল মা।
সঞ্চয়িতা তোলপাড় করে কোনো কবিতা খুঁজে পাচ্ছিলো না দেবজিত। ধুর, অফিসে বলেই দেবে ও পার্টিসিপেট করতে পারবে না।
বিরক্ত হয়েই ডাইনিংয়ে গিয়ে টিভির রিমোর্টটা হাতে নিলো ও।
মনটা অস্থির লাগছিল ওর। হেরে যাবে ও, অফিসে গিয়ে বলে দিতে হবে ও মাস্টার অফ নান। পড়াশোনা করে চাকরিটা জুটিয়েছে ঠিকই কিন্তু এক্সট্রা ক্যারিকুলার অ্যাকটিভিটিতে জিরো। অফিসের কণিকাদি আর দেবিকা আবার ঈশার পরিচয় জানে। ঈশা যে ওর বোন সেটাও জানে। ওর ইউটিউব চ্যানেলে প্রায়ই কবিতা শুনে অফিসে গিয়ে বলে, তোমার বোন কিন্তু সত্যিই দারুণ রিসাইট করে। আমরা তো তোমার বোন ঈশা সেনের রীতিমত ফ্যান বলতে পারো।
এত কিছুর পরে দেবজিত নিজে একটা বিগ জিরো এটাই জানাতে হবে ওদের! ধুত্তোর বলে টিভিটা বন্ধ করে আবার নিজের ঘরে গেল ও।
টেবিলে খোলা সঞ্চয়িতা।
একটা পেপার ওয়েট চাপানো রয়েছে একটা খোলা পৃষ্ঠার ওপরে।
জিত দেখলো কবিতার নাম ‘বিদায়’।
কে এটা খুলে পেপার ওয়েট চাপা দিলো, তাহলে কি ওই অসতর্ক মুহূর্তে খুলেছিল পাতাটা? পাশে রাখা পেপারওয়েটটা কি তবে নিজেই চাপিয়ে রেখেছিলো! একটু সংশয় নিয়েই পড়তে শুরু করলো কবিতাটা।
”ক্ষমা করো, ধৈর্য ধরো,
হউক সুন্দরতর বিদায়ের ক্ষণ।
মৃত্যু নয়, ধ্বংস নয়, নহে বিচ্ছেদের ভয়—
শুধু সমাপন।
শুধু সুখ হতে স্মৃতি, শুধু ব্যথা হতে গীতি,
তরী হতে তীর।”
চমকে উঠলো দেবজিত, এটা তো বিদায় সম্ভাষণ জানানোর জন্য দুর্দান্ত কবিতা। মনের মধ্যে একবার উঁকি দিলো ভাবনাটা, মা নয় তো!
মুহূর্তে ভাবনাটাকে উড়িয়ে দিয়ে পড়তে শুরু করলো কবিতাটা। কি সুন্দর শব্দবন্ধ। ছোটবেলায় মা বলতো, সব অনুষ্ঠান, সব মনখারাপের ওষুধ আছে কবিগুরুর বইয়ে। শুধু খুঁজে নেওয়ার চোখ চাই বুঝলি জিত। সত্যিই তাই, সব পরিস্থতির কথা ভেবেই যেন উনি লিখে গেছেন। যাক অবশেষে পাওয়া গেলো একটা কবিতা। এবারে শুধু প্র্যাকটিস করে নিখুঁত করার পালা।
দরজার দিকে আরেকবার তাকালো ও, পর্দার ফাঁকে কেউ দাঁড়িয়ে নেই তো? কেন যে বারবার মনে হচ্ছে আদা দেওয়া চা, কবিতা নির্বাচন এসবই ওই একজনকেই ইঙ্গিত করছে, যে অলক্ষ্যে থেকেও চাইছে ও আবার পারফর্ম করুক।
ধীর গলায় বলতে শুরু করলো দেবজিত। বহু বছরের অনভ্যাসের পরে, দীর্ঘ বিরতির পর আবার কালো অক্ষরের আবেগের কাছে ধরা দিতে চাইছে ওর কেজো মন। মনে মনে বললো, পারবো নিশ্চয়ই পারবো।
পরিচিত একটা কন্ঠস্বর বহু বছর আগে বলেছিল, পারবি না কেন, তুই যে আমার বীরপুরুষ।
।। ৯।।
রান্নাঘরে কাজ করছিল রিনা, চায়ের কাপ হাতে সেদিকে অপলক তাকিয়ে আছে মনীন্দ্র। এই মেয়েটাকে একদিন ভালোবাসার অভিনয় করে জয় করেছিল মনীন্দ্র। প্রায় ত্রিশ বছর একসাথে কাটিয়ে দিলো দুজনে। মধ্যরাতের বিছানায় বারবার পিষে দিয়েছে ওই নরম কোমল শরীরটাকে। জান্তব শক্তিতে সঙ্গমের সমস্ত মাধুর্যকে নষ্ট করে দিয়েছে বারবার। রাগে উন্মাদ হয় গিয়ে আদরের নামে রীতিমত অত্যাচার করেছে ওই শরীরটার ওপরে, তবুও একটুকু টুঁ শব্দ বের করেনি মেয়েটা। দুই সন্তানের মা হয়েছে, ছেলে মেয়েদের জন্য মাঝে মাঝে কথা কাটাকাটি হয়েছে মনীন্দ্রর সাথে, তারপর আচমকা নিজেই থেমে গেছে রিনা। আস্তে আস্তে একে বারে নিশ্চুপ হয়ে গেছে সেই প্রাণচঞ্চল মেয়েটা।
এরকম তো চায়নি মনীন্দ্র। চেয়েছিল মেয়েটা ওর সামনে বশ্যতা স্বীকার করুক। রূপ গুণের অহংকার ত্যাগ করে মনীন্দ্রর সামনে মাথা নিচু করে দাঁড়াক। মনীন্দ্র ছাড়া যেন ওর জীবনে আর কিছুই না থাকে। এত কিছু করেও কিছুতেই ওই মহিলাকে নিজের করতে পারলো না মনীন্দ্র। ওর ধীর পদক্ষেপে নিজের চূড়ান্ত ব্যর্থতা দেখতে পায়, ওর স্থির চাউনিটা ব্যঙ্গ করে মনীন্দ্রকে বলে, পারোনি তুমি আমায় হাতের মুঠোয় ভরতে। মেয়েটা যেন নিজের সব পুরোনো বিসর্জন দিয়েও অনন্যা।
ওর শরীরে নিজের পুরুষত্বের অধিকার স্থাপন করেছিল মনীন্দ্র, ওর মনে একাধিপত্য চেয়েছিল, এত কিছুর পরেও কমলিকা দাসগুপ্ত ওর অধরাই রয়ে গেল। সেই কমলিকা যার পাতলা শিফনের মত ওড়নার কোণটা ধরে মনীন্দ্র বলেছিলো, তুমি অনন্যা। কখনো ভাবিনি তোমার আঙুল ছোঁবার সৌভাগ্য আমার হবে। তোমায় ভালোবাসার, স্পর্শ করার সাহস তুমিই আমায় জুগিয়েছো কমলিকা, যদি কখনো আমার থেকে অনেক দূরে চলে যাও, যদি কখনো আর নাগাল না পাই তোমার সুখী সুখী সংসারের তবুও আজকের কমলা বিকেলটা কোনোদিন ফিকে হবে না আমার কাছে। কমলিকা আলতো স্বরে বলেছিল, আর যদি তোমাকে নিয়েই গড়ি একটা সুখী সুখী সংসার, যেখানে একদিকে থাকবে আমার চাকরি, অন্যদিকে কবিতা আর মাঝখানে তুমি, তাহলে কেমন হয়?
মনীন্দ্র মুচকি হেসে বলেছিল, কিসের চাকরি কমলিকা?
কমলিকা আকাশের দিকে দুহাত তুলে বলেছিল, আমার ড্রিম জব, শিক্ষকতা। ইংলিশে অনার্স কমপ্লিট করেই ট্রাই করবো, তারপর বি এড করবো বুঝলে। দূরের অস্তগামী সূর্যের দিকে আঙুল দেখিয়ে বলেছিল, দেখো ওই দিকে তাকাও, আমার স্বপ্নেরা উড়ছে ঘুড়ির মত নানা রঙে সেজে। মনীন্দ্র ওই স্বপ্নগুলো পূরণ করতে তুমি আমায় সাহায্য করবে তো।
শেষ বিকেলের আলোয় কমলিকার সরল বিশ্বাসে উদ্ভাসিত মুখের দিকে তাকিয়ে বুকটা কেঁপে উঠেছিলো। মনীন্দ্র কমলিকাকে ভালোবাসে না, অথচ ওর সবটুকু ভালোবাসা চায়। আসলে ও কমলিকার মত সুখস্বপ্ন দেখা ছেলেমেয়েদের হিংসা করে। যাদের অভাবের সংসারের দায়িত্ব নিতে হয়নি, যারা নিজেদের রামধনুর মত স্বপ্নগুলোকে সফল করতে পারে অনায়াসেই, তাদের সব ইচ্ছেগুলোকে গলা টিপে মেরে দিতে ইচ্ছে করে মনীন্দ্রর।
ওর নিজেরও খুব শখ ছিল ক্রিকেট ট্রেনিং-এ ভর্তি হবার। বাবাকে বারবার বলেও ছিল। প্রতি মাসে চারশো টাকা করে লাগবে শুনেই বাবা বলেছিল, গরিবের ঘোড়া রোগ না ধরাই ভালো। ক্রিকেটার তুমি হতে পারবে না মনীন্দ্র, তাই পড়াশোনাটা করো, যাতে ভাতের জন্য কারোর কাছে হাত না পাততে হয়।
মনীন্দ্র অবাক হয়ে দেখে, কমলিকা কি অবলীলায় চারশো টাকার ব্যাগ কিনে নেয়, পাঁচশো টাকার জুতো কিনে নেয়। মনীন্দ্রকে ওই পাঁচশো টাকা বাঁচাতে হয় বাবার ওষুধের জন্য। দামি জুতো, দামি বেল্ট, সানগ্লাস এসব জিনিস ওর অধরাই রয়ে যায়।
তাই কমলিকার গালের আবির রাঙা সুখ দেখে মনে মনে হিংসায় আক্রোশে জ্বলে ওঠে ও।
বন্ধুরা বলে, কেরানির চাকরি করিস, আর স্বপ্ন দেখিস সুন্দরী বউ হবে? কমলিকাকে ওর সাথে দেখে অফিসের দুজন কলিগ মুচকি হেসে বলেছিলো, ভায়া টাইম পাস বোঝো? তুমি হলে ওই সুন্দরী শিক্ষিতার টাইম পাস, হালকা আবেগ, দুদিন পরেই যখন বাবা বিয়ের জন্য পাত্র দেখবে তখন কিন্তু ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ারের গলায় মালা দেবে, তুমি রয়ে যাবে কবিতার খাতায় ব্যর্থ প্রেম হয়ে। কব্জি ডুবিয়ে প্রাক্তনীর বিয়েতে খাসির মাংস খেয়ে এসো ভায়া। প্রেমের মেয়াদ আঙুলে গুণে রাখো।
ভিতরে ভিতরে মনটা বিদ্রোহ করে উঠেছিলো মনীন্দ্রর। ও জানে কমলিকার পাশে ও বড্ড বেমানান, ভীষণ বেরঙীন, বলতে গেলে আনফোকাসড। মনীন্দ্র যখন কমলিকার সাথে পথ হাঁটে তখন ও খেয়াল করেছে লোকজন মনীন্দ্রর দিকে কেমন একটা অবিশ্বাসের চাউনিতে তাকায়। তাদের চোখে থাকে অবিশ্বাসী দৃষ্টি। মুখে যেন বলতে চায়, এই মেয়েটার বয়ফ্রেন্ড এটা?
প্রথম প্রথম মনীন্দ্রর রাগ হতো, লোকজনের প্রতি বিরক্তি উৎপাদন হতো, এখন অবশ্য গর্ব হয়। মনে মনে ভাবে, সবাই দেখুক ওর মত মধ্যমানের ছেলের গার্লফ্রেন্ড আরব্য রজনীর রাজকন্যা। দেখুক পথচলতি লোকজন, দেখুক পরিচিতরা, এতদিন যারা মনীন্দ্রর দিকে করুণার দৃষ্টিতে তাকাত তাদের চোখে ও ঈর্ষা দেখতে চায়, তবেই ও তৃপ্তি পাবে।
কমলিকার সুন্দর সরল মুখটার দিকে তাকিয়ে কখনো মনে হত বলে দিক নিজের আসল সত্যিটা। ও খুব নিডি ফ্যামিলির ছেলে। বাবার ব্যবসায় অনেক লোকসান, দিদির বিয়ের চাপে নিজের স্বপ্নগুলোর মৃত্যু প্রত্যক্ষ করা বাড়ির ছেলে। যারা স্ত্রীর স্বপ্নপূরণের সঙ্গী হয়না, যারা বিয়ে করার সময় ভাবতে থাকে কাল থেকে বিজয়ার মা কামাই করলেও আর অসুবিধা হবে না। যারা গার্লস কলেজের সামনে দিয়ে পেরোনোর সময় আড়চোখে দেখে নেয় বিলাসী মেয়েগুলোর মুখগুলো। তারপর ভাবে, এমন স্মার্ট সুন্দরী বউ চাই, কিন্তু তার যেন নিজস্ব জগৎ না থাকে। সে যেন দিনরাত সংসারের জন্য পরিশ্রম করতে করতে চুল আঁচড়ানো, মুখে ক্রিম মাখার মত বিলাসিতার সময় না পায়। আবার বিছানায় শুয়ে উফঃ কোমরে ব্যথা লাগছে বলে কঁকিয়ে না উঠে, সঙ্গমে লিপ্ত হয়ে পূর্ণ তৃপ্তি দিতে পারে স্বামীকে। মধ্যবিত্ত সুখ বলতে ওই মাঝে সাজে পুরী দিঘা, আর কখনো সখনো সিনেমা হলের অন্ধকারে পর্দায় কিছু কাল্পনিক চরিত্র দেখে আনন্দ পাওয়া। এমন একজন পারফেক্ট স্ত্রী চায় মনীন্দ্র। যার নিজস্ব কোনো মতামত থাকবে না, যে স্বামী শব্দের আগে পরে শ্রদ্ধা শব্দটা জুড়ে রাখবে।
মনীন্দ্র জানে কমলিকা এই গোত্রে পড়ে না। প্রতিমুহূর্তে অনুভব করে কমলিকার একটা আলাদা সত্ত্বা আছে। ও আর পাঁচটা ঘরোয়া মেয়ের মত পরাধীনতা স্বীকার করার মেয়ে নয়। আর সেই জন্যই ওকে কব্জা করার নেশাটা বেশ জাঁকিয়ে বসেছিলো মনীন্দ্রর মধ্যে।
কমলিকার চাঁপাকলির মত আঙুলগুলোর ওপরে হালকা চাপ দিয়ে মনীন্দ্র ফিসফিস করে বলেছিল, ওই যে দূরের দেবদারু গাছটা দেখছো, ওটাকে সাক্ষী করে কথা দিই তোমায়। নাকি ডুবন্ত সূর্যকে সাক্ষী করবো?
কমলিকার নিঃশ্বাস ঘন হয়ে এসেছিল, বলেছিল কাউকে সাক্ষী করতে হবে না মনীন্দ্র, আমি জানি যে আমার কবিতাকে আপন করে নিয়েছে, সে আমার স্বপ্নকেও আপন করে নেবে। তোমাদের বাড়ির ছাদে আমরা একদিন মাদুর বিছিয়ে বসবো, সেদিন আবৃত্তি করবো তোমার লেখা কবিতাগুলো।
মনীন্দ্র লজ্জা পেয়ে বলেছিল, ধুর, ওগুলো তো এলোমেলো শব্দবন্ধ, ওদের কবিতা বলো না প্লিজ।
কমলিকা আবেগী স্বরে উত্তর দিয়েছিল, বেশ করবো কবিতা বলবো। তোমার লেখা যে চারটে কবিতা তুমি আমায় উপহার দিয়েছো সেগুলো আমিও তোমায় উপহার দেব অন্যরকম করে। যেদিন আমি সম্পূর্ণ ভাবে তোমার হয়ে যাবো সেদিন তোমার কানে মুখ রেখে মুক্তি দেব তোমার আবেগদের।
মনীন্দ্র শিহরিত হয়েছিল, একটা অপরাধবোধ ওর শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে গিয়েছিল নিশ্চুপ ভাবে। কমলিকার চোখের স্বচ্ছ দৃষ্টি যেন তাড়িয়ে বেড়াচ্ছিল ওর বিবেককে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নিজের বিবেকের সাথে লড়াই করে জিতে গিয়েছিল মনীন্দ্র। তাই কমলিকার সাথে ভালোবাসার অভিনয় করতে আর ভাবতে হয়নি ওকে। পাক্কা অভিনেতার মতই কমলিকার প্রেমিক হয়ে উঠেছিল মনীন্দ্র। যত দিন যাচ্ছিল কমলিকা একটু একটু করে আকৃষ্ট হচ্ছিল মনীন্দ্রর লিবারাল মানসিকতার প্রতি। মাঝে মাঝেই গঙ্গার পাড়ে ওর কাঁধে মাথা রেখে কমলিকা বলতো, জানো মনীন্দ্র, আমার কেমন স্বপ্ন স্বপ্ন মনে হয়, মনে হয় এমন মানুষও আছে পৃথিবীতে যে আমার সব ইচ্ছেগুলোর মূল্য দেবে! মা বলে, মেয়েরা নাকি পরের বাড়ির সম্পদ, সেখানে গেলে অনেক কিছুই নিজের মনমত হয়না, অ্যাডজাস্ট করতে হয়। আমি তাতে রাজি আছি, অ্যাডজাস্ট তো করতেই হবে, ভিন্ন পরিবেশ, ভিন্ন মানুষ, সব কিছু কি মনের মত হবে নাকি! কিন্তু জানতো আমার দুজন বান্ধবীর বিয়ে হয়েছে, তারা এখন টিপিক্যাল হাউজ ওয়াইফ। পড়াশোনা বিসর্জন দিয়ে, গান, কবিতা ছেড়ে নিজেদের ইচ্ছেগুলোর মৃতদেহের ওপরে দাঁড়িয়ে ঘর সংসার করছে, স্বামীর কথায় ওঠে আর বসে, অদ্ভুত তাই না মনীন্দ্র! একজন মানুষ তার সমস্ত সত্ত্বাকে বিসর্জন দিয়ে হয়ে গেল অন্য একটা মানুষ, তার চাওয়া পাওয়াগুলো অবধি অর্থহীন হয়ে গেল ওই সংসারে। এর নাম আর যাইহোক ভালোবাসা নয়, অ্যাডজাস্টমেন্ট তো নয়ই, এর নাম স্যাক্রিফাইস।
একতরফা তিলে তিলে নিজেকে শেষ করার নাম কখনোই ভালোবাসা হতে পারে না। এদের কথা শুনে আর এদের পাল্টে যাওয়া দেখে আমার তো বিয়ে নামক বিষয়ে রীতিমত ভয় হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু যবে থেকে তুমি এসেছো আমার জীবনে তবে থেকে বদলে গেছে আমার দৃষ্টিভঙ্গি। আমি বুঝেছি, এমন কেউও পৃথিবীতে আছে যে অন্যের ইচ্ছেগুলোর গুরুত্ব দিতে জানে। জানো মনীন্দ্র, আমি শুধু এই জন্যই তোমাকে এত ভালোবাসি। তুমি সাধারণ চাকরি করো, হ্যান্ডসাম নও, মধ্যবিত্ত ফ্যামিলির ছেলে হবার পরেও তুমি আমার কাছে একশোতে একশো পেয়ে বসে আছো, বুঝলে। কারণ একটাই, তোমার উদার মানসিকতা, এমন বড় মন যে আকাশও লজ্জা পাবে। আর এমন উদার মনের অধিকারীকেই আমি পেতে চলেছি জীবনসঙ্গী হিসাবে, আমার বোধহয় আর কিছুই চাওয়ার নেই ভগবানের কাছে। তিনি তোমায় দিয়েছেন আমায়, আমার সব স্বপ্নপূরণ করার মানুষটাকে পেয়ে গেছি আমি, আর কি চাইবার আছে বলো!
মনীন্দ্র হাসিমুখে নিখুঁত ভাবে বলেছিল, ধুর পাগলী, তোমায় বদলাতে হবে না কিচ্ছু। গোটা কমলিকাটাকেই তো আমি ভালোবেসেছি। তার একটা অংশ যদি বদলে যায়, তাহলে আমার কমলিকার মিষ্টতা কমে যাবে একটু হলেও, এটা আমি আমার প্রাণ থাকতে হতে দেবো না। আমার গোটা কমলিকাকেই চাই, চাই তার উষ্ণতায় আমূল পুড়তে, চাই তার আদ্রতায় ভিজতে।
তাই কমলিকার সব ইচ্ছের, সব বেয়ারা আব্দারের দাবি মানার দায়িত্ব আজ থেকেই আমি নিলাম। অর্থ হয়তো আমার কম কিন্তু দুটো হাত দিয়ে আগলে রাখার ইচ্ছেটা রইলো অফুরান। মনীন্দ্রর কথার আবেশে ভেসে গিয়েছিল কমলিকা। নিজের দুই হাত আর একটা নিষ্পাপ মন দিয়ে আঁকড়ে ধরেছিল মনীন্দ্রকে। আর মনীন্দ্র তখন তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করছিল, হাই ক্লাস একটা মেয়ের অবুঝ ভালোবাসা। তৃপ্তি ..তৃপ্তিতে ভরে যাচ্ছিল ওর সব না পাওয়ার কষ্টগুলো। জয়ের আনন্দে ও তখন পরিপূর্ণ। প্রাপ্তির ভাণ্ডার পূর্ণ হয়ে উপচে পড়ছিল ওর।
কমলিকার মনের রাজ্যে একাধিপত্য বিস্তার করার পর মনে হয়েছিল, ও ময়ূর সিংহাসনের অধিকারী হয়ে গেছে। কমলিকার বাবার অঢেল সম্পত্তি, আর ভাগিদার মাত্র দুজন, কমলিকা আর মালবিকা। তারমানে একটা অংশের মালিক মনীন্দ্র। তাই দিনরাত নিজেকে গরিব ভাবার আর কোনো কারণ ও খুঁজে পায়নি। অফিসের কলিগরা বলতো, তুমি গত এক বছরে বেশ বদলে গেছো মনীন্দ্র। ঝকঝকে স্মার্ট হয়েছ। মনীন্দ্র হেসে বলেছে, আচমকা লটারি প্রাপ্তি হয়েছে যে। হ্যাঁ, কমলিকাকে মনে মনে মনীন্দ্র কোটি টাকার লটারিই ভাবত। যাকে নিয়ে রেস্টুরেন্টে ঢুকলে ক্যাশে বসে থাকা মালিক অবধি বেশ তৎপর হয়ে বলে, ওরে কে আছিস, ম্যাডামদের অর্ডারটা নিয়ে আয় জলদি। ভিড় রেস্টুরেন্টে কমলিকার পাশে থাকার জন্যই এক্সট্রা মনযোগ পেত মনীন্দ্র। কমলিকা না বুঝলেও এগুলো ছিল মনীন্দ্রর জয়। ভীষণভাবে এনজয় করতো সারাজীবন লাইনের শেষে কাঁচুমাচু করে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটা।
কমলিকার নীল রঙের শিফনের ওড়নায় লুকিয়ে থাকতো ওর নিখুঁত উদ্ধত শরীর। ওর ঠোঁটের কোণে লেগে থাকতো নরম অথচ সাবধানী হাসি, দুই ভ্রুর তিলের মাঝে দৃঢ় আত্মমর্যাদা। এসবের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকতে থাকতে মনীন্দ্র উত্তেজিত হয়ে পড়তো। মনে মনে ভাবত এই সবের মালিক ও। কমলিকার অহংকারের উষ্ণতা তখন ছুঁয়ে যেত মনীন্দ্রর মত অত্যন্ত সাধারণ মানুষকেও।
যবে থেকে মনীন্দ্র নিজের পজিশন ভুলে কমলিকার সাথে মিশে যেতে শুরু করেছিল তবে থেকেই পাল্টে যাচ্ছিল ওর বাহ্যিক আচার আচরণগুলো।
কমলিকা কলেজ শেষ করে ভর্তি হয়েছিল ইউনিভার্সিটিতে। ইংলিশ অনার্সে ফার্স্ট ক্লাস পাওয়া মেয়ে ও, তাই স্বাভাবিকভাবেই প্রফেসরদের কাছে পরিচিত নাম। আজ থেকে ত্রিশ বছর আগে এমন মুড়ি মুরকির মত ফার্স্ট ক্লাস পেত না স্টুডেন্টরা। তাই ব্যতিক্রমী ছাত্র ছাত্রীরা অবশ্যই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকতো।
বি এড নয় মাস্টার্স ভর্তি হয়েছিল কমলিকা। রোজকার দেখা সাক্ষাৎ একটু কমেই গিয়েছিল। মনীন্দ্রর তখন ভয় ভয় করতো, যদি ইউনিভার্সিটিতে গিয়ে কোনো ব্রিলিয়ান্ট ছাত্র বা প্রফেসরের প্রেমে পড়ে যায় কমলিকা, তাহলে তো চূড়ান্তভাবে হেরে যাবে ও। বারবার জীবনযুদ্ধে পরাস্ত হওয়া মনীন্দ্র আর হারতে রাজি নয়। তাই আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছিলো কিছুতেই যেন কমলিকার পলকা আবেগী মন থেকে ওর অস্তিত্ব ফিকে না হয়ে যায়। সপ্তাহে একদিন করে একটা কবিতা লিখে উপহার দিতো কমলিকাকে। কবিতার অক্ষরগুলোতে হাত বুলিয়ে ফিসফিস করে কমলিকা বলতো, ইউ আর রিয়েলি ট্যালেন্টেড, কিন্তু ভাগ্যটা বড্ড বিরূপ তোমার, তাই এমন প্রতিভা থাকতেও কাজে লাগলো না। কমলিকা একবার উঠে পড়ে লেগেছিল ওর কবিতাগুলো ম্যাগাজিনে ছাপাবে বলে। কিন্তু অভিমানে ঠোঁট ফুলিয়ে মনীন্দ্র বলেছিল, এসব আমার একান্ত ব্যক্তিগত অনুভূতি কমলিকা, শুধু তোমার জন্যই এসব অনুভূতিরা ভাষা পেয়েছে। প্লিজ এদের পাবলিক করো না, এগুলো রেখে দাও তোমার মনের গোপন কুঠুরীতে। কমলিকা লালচে আলোয় স্নান করতে করতে নিচু গলায় বলেছিল, বেশ, আগলে রাখলাম এদের আমার হৃদয়ের সিন্দুকে, কোনো একদিন কানে কানে বলবো তোমায়।
রোজকার দেখা হওয়ার বদলে সপ্তাহে একদিনে দাঁড়িয়ে ছিল ওদের সাক্ষাৎটা। ওই একটা দিন খুব যত্ন করে সাজিয়ে রাখতো মনীন্দ্র ঠিক কমলিকার পছন্দ মত। কমলিকা রাগ করে বলতো, একদিনও কি একটু খুঁত ধরার ঝগড়া করার সুযোগ দেবে না আমায়। একদিন অন্তত এলোমেলো প্ল্যানে ভেস্তে যাক আমাদের এই সময়টুকু, তারপর গভীর অভিমানে মুখ দেখা দেখি বন্ধ! আমিও দেখতে চাই মনীন্দ্র, তুমি কি ভাবে আমার মান ভাঙাও।
মনীন্দ্র হেসে বলতো, উঁহু অভিমান করার সুযোগই দেব না তোমায়, অভিমানদের দূরে তাড়িয়ে দেব, তারা যেন কিছুতেই স্পর্শ করতে না পারে আমার কমলিকাকে।
কমলিকা ফিসফিস করে বলতো, মনীন্দ্র এত ভালোবেসো না আমায়। অপূর্ণতা শব্দটাকে এভাবে বঞ্চিত করো না তুমি, ওকেও রাখতে দাও আমার মনের কোণে। মনীন্দ্র বলতো, পাল্টে দেব ডিকশনারির কিছু শব্দ শুধু তোমার জন্য।
মাস্টার্স তখনও কমপ্লিট হয়নি কমলিকার, পার্ট টু-এর পরীক্ষা বাকি। হঠাৎই একদিন মধ্য দুপুরে ওর অফিসে এসে দাঁড়িয়েছিল কমলিকা। থরথর করে কাঁপছিল ও। মনীন্দ্র দেখেছিলো অফিসের জোড়া জোড়া চোখ কৌতূহলে তাকিয়ে আছে কমলিকার দিকে। এমন সুন্দরী, বড়লোকের মেয়ে হঠাৎ ওর কাছে কেন! এই প্রশ্নটাই বেশির ভাগ মানুষের চোখে। চ্যাটার্জিদার ওপরে নিজের কাজের দায়িত্বটা দিয়ে কমলিকাকে নিয়ে অফিস থেকে বেরিয়ে এসেছিল মনীন্দ্র। এলোমেলো পা ফেলছিলো কমলিকা। চোখে কেমন একটা উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টি। এই দশদিনের মধ্যে কি এমন ঘটে গেল যে অসময়ে ওর অফিসে চলে এলো ও।
মনীন্দ্রর দুই ভ্রুর মাঝে দুশ্চিন্তার রেখারা প্রকোপ হলেও কোনো প্রশ্ন করছিল না ও কমলিকাকে। বরং ওর সাথে পায়ে পা মিলিয়ে হাঁটছিল। কমলিকার বোধহয় আরেকটু সময় দরকার নিজেকে প্রস্তুত করতে। সেটুকু সময় বিনা প্রশ্ন বাণেই হাঁটছিল মনীন্দ্র। একবার শুধু বলেছিল, জল খাবে? চোখের নিচে এই কয়েকদিনেই এমন গাঢ় ক্লান্তির চিহ্ন কেন? শরীর ঠিক আছে তো তোমার?
কমলিকা উত্তর দেয়নি, শুধু উদ্ভ্রান্তের মত একবার তাকিয়েছিল মনীন্দ্রর দিকে। আর যেন চলতে পারছে না, এমন ভাবেই ভারাক্রান্ত পা দুটোকে টেনে নিয়ে গিয়ে একটা পুরোনো বটের নিচের বাঁধানো বেদিতে বসে পড়েছিলো কমলিকা। মনীন্দ্রও বসেছিলো ওর পাশে।
মনের মধ্যে যতই দুশ্চিন্তারা এলোমেলো ঝড় তুলুক, কমলিকার সামনে মুখে কিছুতেই ওই উদ্বেগের প্রকাশ করেনি ও। চুপচাপ কিছুক্ষণ বসে থাকার পরে কমলিকা বলেছিলো, মনীন্দ্র তুমি আমায় সত্যিই ভালোবাসো? অদ্ভুত হেসেছিল মনীন্দ্র। কমলিকা নিশ্চয়ই রাতারাতি মনপড়ার যন্ত্র আবিষ্কার করে ফেলেনি। ওর নিখুঁত অভিনয়ের ওপরে মনীন্দ্রর নিজেরই মারাত্মক আস্থা আছে। কোনো কোনো সময় তো নিজেই বুঝতে পারে না কোনটা সত্যি কোনটা মিথ্যে। মুখোশ আর মনের মধ্যে পার্থক্য খুঁজতে হিমশিম খেতে হয় ওকেই। সেখানে কমলিকা রাতারাতি সব জেনে গেল এটা অবিশ্বাস্য। তাই অবলীলায় আরও একবার মিথ্যের আশ্রয় নিতেই পারে ও। বিশ্বাসে ভর করেই মনীন্দ্র বলেছিল, সন্দেহ হচ্ছে বুঝি আমার ভালোবাসার ওপরে! গত দুবছর আড়াই বছর হলো না, আজ হঠাৎ সন্দেহের কারণটা জানতে পারি কি? কমলিকা হঠাৎ মনীন্দ্রর বুকের মধ্যে মুখ গুঁজে ডুকরে কেঁদে উঠলো।
কমলিকার মত সাহসী প্রতিবাদী মেয়েরাও কাঁদে? এমন মেয়েরাও পুরুষের বুকে নিরাপত্তা খোঁজে তাহলে, ভেবেই মনের মধ্যে আনন্দের বুদবুদ উঠেছিলো মনীন্দ্রর। কমলিকার পিঠে আলতো হাত রেখে বলেছিল, আগে বলো সমস্যাটা কি হয়েছে?
কমলিকা ভাঙা গলায় বলেছিল, বাবার বন্ধু সুশোভন আঙ্কেলের ছেলে তমাল সেও ডক্টর, এই সপ্তাহেই আসছে আমাদের বাড়িতে। বাবা আমার সাথে তমালের বিয়ের কথা পাকা করতে চায়।
বেশ জোরেই দীর্ঘশ্বাসটা বেরিয়ে এলো মনীন্দ্রর বুক থেকে। এত কিছু করেও শেষ রক্ষা করতে পারলো না ও। হেরোর ট্যাগটা সেই কপালে চিপকেই গেল। কমলিকাকে ওদের সেন বাড়ির বারান্দায় কাপড় মেলতে, রান্নাঘরে সুক্ত রাঁধতে দেখার বড় শখ ছিল ওর। না সে শখ ওর মিটলো না। ভাগ্য কোনোদিনই মনীন্দ্রর সহায় হয়নি, আজও যে হবে না সে ব্যাপারে ও প্রায় নিশ্চিত ছিল। তবুও ভরসা ছিল কমলিকার নিঃস্বার্থ সরল ভালোবাসার ওপরে।
হারতে হারতেও শেষ চেষ্টা করলো মনীন্দ্র। কমলিকার হাতটা ধরে বলল, তুমি বাবার কথা মেনে নাও কমলিকা, আমি তোমায় সত্যিই অতটা সুখে রাখতে পারবো না যতটা তমাল রাখবে। ভিতরে ভিতরে হেরে যাওয়ার যন্ত্রণায় দগ্ধ হচ্ছিল মনীন্দ্র। খুব মনে হচ্ছিল কমলিকার সুন্দর মুখটা আগুনে পুড়িয়ে দিতে। ওর গোলাপি ঠোঁটটা ফালা ফালা করে দিতে। কমলিকা যদি ওর না হয় তাহলে যেন কারোর না হয়! অদ্ভুত ভাবে সেইসময় নিজের হারের যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে মনীন্দ্রর চোখ থেকে ঝরেছিলো দুফোঁটা জল। সেদিকে অপলক তাকিয়ে কমলিকা বলেছিল, তুমি কাঁদছো? পারবে আমায় অন্যের হয়ে যেতে দেখতে! আমরা যে একসাথে এত এত স্বপ্ন সাজিয়েছিলাম সেগুলোরই বা কি হবে! আর আমার ওই আকাশে দক্ষিণ কোণের উড়ন্ত ইচ্ছেগুলো যেগুলো শুধু তুমিই পারো পূরণ করতে তারাই বা কি বলবে! বলবে মনীন্দ্র সেন ভীষণ ভীতু, কমলিকার স্বপ্নপূরণ করতে হবে বলেই তাকে অন্যের হাতে তুলে দিয়েছিল। ইস, এ কথা তোমার সহ্য হলেও আমার হবে না গো।
কমলিকার ঝাপসা চোখে একটুকরো আলোর লুকোচুরির দিকে তাকিয়ে আবার জেতার আশায় বুক বেঁধেছিল মনীন্দ্র।
স্খলিত গলায় বলেছিল, কিন্তু তোমার বাবা যে কিছুতেই আমায় মেনে নেবেন না। কমলিকা ওর একটা হাতকে দৃঢ় ভাবে চেপে ধরে বলেছিল, বাবা যেমন তোমায় মেনে নেবেন না, তেমনি আমিও যে তমালকে মেনে নেব না মনীন্দ্র। আমি গত দুবছর প্রতি রাতে তোমায় ভেবেছি আমার জীবনসঙ্গী হিসাবে, আজ একটা ঝড় এসে সব এলোমেলো করে দিয়ে যাবে এটা কি করে হতে দিই বলো। তুমি শুধু একটাই কথা দাও মনীন্দ্র, এমন সমস্যার সময় আমায় একলা করে দেবে না। চলো আমাদের বাড়িতে চল, বাবার সামনে দাঁড়িয়ে আমাদের সম্পর্কের কথা বলে আসবে।
কমলিকার কথাটা শুনেই বুকটা কেঁপে উঠেছিলো মনীন্দ্রর। অমন একটা হাই স্ট্যান্ডার্ড ফ্যামিলিতে গিয়ে দাঁড়ানোটাই যথেষ্ট সাহসসাধ্য কাজ। তারপর তাদের বাড়ির মেয়েকেই বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে আসার মত দুঃসাহসিক কাজ তো আর হয়না। কমলিকা নির্নিমেষ তাকিয়ে ছিল ওর দিকে, একটু আগের নোনতা জলের ধারা এখনও গালে শুকিয়ে দাগ হয়ে রয়েছে। এই কোমল মুহূর্তে যদি মনীন্দ্র কমলিকার প্রস্তাবে রাজি না হয়, তাহলে হয়তো ও ফিরে যাবে, আর হয়তো কখনোই ভরসা করে আসবে না ওর কাছে। বাধ্য হয়েই সাহসে ভর করে ও বলেছিল চলো তোমার বাড়িতে। কিন্তু কমলিকা তোমার বাবা যদি মুখের ওপরে দরজা বন্ধ করে দেন তখন তুমি কি করবে?
ও মনীন্দ্রর হাতের ওপরে নরম হাতটা রেখে বলেছিল, তখন আমি ঐ বন্ধ দরজা খুলে বেরিয়ে আসবো।
মনীন্দ্রর হিসেব মতই এগোচ্ছে সব কিছু। ও নিজেও চায়না কমলিকা আরও পড়াশোনা করে এস্টাবলিসড হোক।
স্বাধীনচেতা মেয়েটা যদি নিজে রোজগার করতে শুরু করে, তাহলে হয়তো মনীন্দ্র আর ওকে মুঠোবন্ধ করে উঠতে পারবে না। সেন ফ্যামিলিকে দূর ছাই করতে ওর খুব বেশি দেরি হবে না।
সন্ধেবেলা যখন দাসগুপ্তদের বিশাল বাড়ির গেটের সামনে মনীন্দ্র পৌঁছেছিল তখন ওর সত্যিই নার্ভাস লাগছিলো। এই প্রথম ও কমলিকাদের বাড়িতে এলো। কমলিকার সাজপোশাক দেখে আন্দাজ করেছিল ওরা অবস্থাপন্ন ফ্যামিলি। কিন্তু সেটার পরিমাণটা যে এতটা মনীন্দ্র কোনোদিন আন্দাজ করতে পারেনি।
বিশাল গেটের প্রান্তে দুটো গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। সামনে বাহারি গাছের লন পেরিয়ে সাদা তিনতলা বাড়িটা যেন অহংকারের প্রতীক হয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। মনীন্দ্রর মেরুদণ্ড দিয়ে একটা ঠাণ্ডা স্রোত নেমে যাচ্ছিল ধীরে ধীরে, বেশ শীত শীত করছিল ওর।
ভাঙা গলায় বলেছিল, কমলিকা এটা তোমাদের বাড়ি? তুমি তো সত্যিই বাস্তবের রাজকন্যা। মনে মনে হিসেব করছিল মনীন্দ্র, এই সম্পত্তির অর্ধেকের বাজার মূল্য কত! সারাজীবন কেরানির চাকরির বেতন জমালেও এই রকম আরেকটা বাড়ি করা ওর পক্ষে সম্ভব নয়। চোখের সামনে ভেসে উঠলো ওদের একতলা চারটে ঘরের বাড়িটা। ছাদে ওঠার সিঁড়ির কাজটা পর্যন্ত কমপ্লিট করতে পারেনি ও। এখনো ট্যাঙ্কির পরিবর্তে বড় একটা নীল রঙের ড্রাম বসানো আছে ওদের জলের ব্যবস্থায়।
আপাতত হয়তো কমলিকার বাবা ওদের বিয়েটা মেনে নেবেন না, কিন্তু আদরের মেয়ে কষ্টে আছে দেখলে নিশ্চয়ই জামাইয়ের পাশে এসে দাঁড়াবেন। পালিয়ে বিয়ের ইতিহাস অন্তত তাই বলছে, প্রথমে অভিমানে দূরে সরিয়ে রাখা আর পরবর্তী সময়ে কাছে টেনে নেওয়া। সেই ভরসাতেই কমলিকাদের বিরাট ড্রয়িংরুমে পা দিয়েছিল মনীন্দ্র।
কিন্তু মনীন্দ্রর সব প্ল্যান ভেস্তে দিয়েছিলেন কমলিকার বাবা ডক্টর কমলেশ দাসগুপ্ত। তিনি মনীন্দ্রকে আর বাড়ির মালিকে সমতুল্য ভেবে সেরকমই ট্রিট করেছিলেন। মেহগনি কাঠের বার্নিশ করা সোফার নরম কুশনে শরীর ডুবিয়ে কমলেশ দাসগুপ্ত বলেছিলেন, বেরিয়ে যাও, ভবিষ্যতে যেন কখনো তোমায় এ বাড়ির আর কমলিকার ধারে কাছেও না দেখি। পুরোনো বাংলা সিনেমার ছবি বিশ্বাসকেও এতটা নিষ্ঠুর মনে হয়নি মনীন্দ্রর, কমলেশ দাসগুপ্তকে যেমন মনে হয়েছিল। এই ভদ্রলোক নাকি কার্ডিওলজিস্ট! নিজেরই হৃদয় বলতে কিছু নেই সে করে মানুষের হার্টের চিকিৎসা।
মনীন্দ্র বেশি কথা না বলে বেরিয়ে এসেছিল। সত্যি বলতে কি কমলিকার বাড়ির ড্রয়িংরুমে ও বড্ড বেমানান, সেটা বুঝেই ধীর পায়ে বেরিয়ে এসেছিল ওদের বাড়ি থেকে। গেটটা পেরোনোর আগেই কমলিকা ছুটে এসে হাতটা ধরেছিল মনীন্দ্রর। ফিসফিস করে বলেছিল, বাড়ির বাইরে অপেক্ষা করো, আমি আসছি।
কিছুই মাথায় ঢুকেছিলো না মনীন্দ্রর। ওর মত ঠাণ্ডা মাথার ছেলেরও সব গুলিয়ে গিয়েছিল। চোখের সামনে সব কেমন ঝাপসা লাগছিলো শীতের কুয়াশা ঢাকা সকালের মত। ভাবনাগুলো জট পাকিয়ে হাঁপিয়ে উঠেছিলো মাথার মধ্যে। সন্ধেতারার দিকে স্থির ভাবে তাকিয়ে মনীন্দ্র ভাবছিলো, কমলিকারা দূরের মেঘমালা, ওদের ছুঁতে নেই, হাত পুড়ে যায়। ব্যর্থতার একরাশ গ্লানি এসে ঘিরে ধরেছিল মনীন্দ্রকে। কাল থেকে ওর জীবনে কমলিকা নেই, আবার সেই একঘেয়ে ছাপোষা জীবনের চরকা কাটা। তবুও কমলিকা অপেক্ষা করতে বলেছিল বলেই রাস্তার ধারে পথ চলতি লোকজনের দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল মনীন্দ্র। এক একটা সেকেন্ড যেন কত দীর্ঘ প্রতীক্ষার কাল মনে হচ্ছিল মনীন্দ্রর।