পরজন্ম চাই – ১০
।। ১০।।
আর কতকাল প্রতীক্ষা করবো বলতো ঈশা? আমার বাড়িতেও তো এবারে জানাতে হবে নাকি? অলরেডি খুড়তুতো দিদিরা আমার বিয়ের কথা বলছিল, আরে প্রবলেমটা কোথায়? তুমি যদি না বলতে পারো আমি গিয়ে তোমার বাড়িতে জানাচ্ছি। প্রবুদ্ধর গলায় অসহিষ্ণু ভাব স্পষ্ট। বিরক্ত লাগছে ঈশার, দিন দুই প্রবুদ্ধর সাথে খুব দায়সারা ভাবে কথা বলেছে ও। এমনকি ওর সাথে মিট করার ব্যাপারেও গড়িমসি করে শেষ পর্যন্ত কাটিয়ে দিয়েছে ঈশা। অর্কপ্রভর সাথে যেদিন থেকে ওর সামনা সামনি পরিচয় হয়েছে সেদিন থেকে সব কিছু ওলটপালট হয়ে গেছে ওর। প্রবুদ্ধর ফোন কলস, ওর সাথে গল্প করার ইচ্ছেটা যেন একেবারেই মরে গেছে।
আজকেও অর্কর সাথে মিটিং আছে ঈশার। না, স্টুডিওতে নয় অর্কর ফ্ল্যাটে। ওর পরের মুভিতে ঈশাকে কি ভাবে ব্রেক দেওয়া যায় সেটা নিয়ে আলোচনা করবে বিশিষ্ট ক্যামেরাম্যানের সাথে। সেই জন্যই অর্কর ফ্ল্যাটে যেতে বলেছে, বিষয়টা আপাতত সিক্রেট রাখতে বলেছে অর্ক। ইন্ডাস্ট্রিতে নাকি সারাবছর রেষারেষি চলে। কখন কে কাকে টেক্কা দিয়ে এগিয়ে যাবে কেউ জানে না। তাই নতুন মুখকে আনার সময় ভীষণ ভাবে গোপন রাখতে হয় পরিচালকদের। ঈশা সকাল থেকেই কোন পোশাকটা পরবে তাই নিয়ে মারাত্মক কনফিউজড, এর মধ্যে এবার বাড়তি ঝামেলা প্রবুদ্ধর ফোন। এই ছেলেটা এতটাই ইন্টিলিজেন্ট যে ওর গলার স্বর শুনেই বুঝে যায় সামথিং ইজ রং। এর আগে অবশ্য প্রবুদ্ধর এই গুণটার জন্যই ওকে এত ভালোলাগত ঈশার। ঈশার চোখের দৃষ্টি দেখে প্রবুদ্ধ বলে দিত ঈশা আনন্দে আছে না দুঃখে। কিন্তু এই মুহূর্তে এসব গুণ জাস্ট বিরক্তিকর লাগছে। তার মধ্যে প্রবুদ্ধর আরেকটা চূড়ান্ত বাজে স্বভাব আছে, ছেলেটা বেশ পজেসিভ টাইপ। ঈশা যেন শুধু ওর, এমন একটা ভাব করে প্রবুদ্ধ। এতদিন এসবকে ঈশার ভালোবাসার লক্ষণ বলে মনে হতো, এখন মনে হয় অত্যন্ত ব্যাকডেটেড একটা ছেলে। প্রেমিকাকে আগলে রাখার প্রচেষ্টা। আরে প্রেমিকা কি খেলনা নাকি যে নিজের আয়ত্তে রাখবে! এতদিন ভাল লেগেছে, ঈশা থেকেছে প্রবুদ্ধর সাথে। এখন ওকে ভালো লাগছে না তবুও বাকি জীবনটা ওর সাথেই চালাতে হবে এমন কোনো যুক্তি আছে নাকি!
প্রবুদ্ধর সাথে যখন ঈশার প্রেম হয়েছিল তখন ওর থেকে কোনো ভালো অপশন ছিল না ঈশার হাতে। অবস্থাপন্ন বাড়ির একমাত্র ছেলে, নিজের বিশাল বিজনেস। চাকরি পর্যন্ত ছেড়ে দিয়েছে ব্যবসার বিশালতার জন্য।
কথায় কথায় দামি গিফট, যেগুলো ঈশা কোনোদিনই ওর বাবার কাছ থেকে আশা করেনি, নামি রেস্টুরেন্টে বসে খাওয়া, দামি গাড়ি করে ঘোরার সময় মনে হয়েছিল প্রবুদ্ধই ওর জ্যাকপট। কিন্তু যবে থেকে অর্কপ্রভর সাথে ওর সাক্ষাৎ হয়েছে তবে থেকে মনে হচ্ছে, অর্থের সাথে সাথে এমন কিছু দরকার যাতে ঈশাও নিজের জীবনে প্রতিষ্ঠা পায়। প্রবুদ্ধকে বিয়ে করলে ও কোনোদিনই ঈশা সেন বলে পরিচিত হতে পারবে না। কিন্তু যদি অর্কর সাথে ওর সম্পর্কটা হয়ে যায় তাহলে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে ও হয়ে যাবে পরিচিত নাম। অস্বীকার করার জায়গা নেই যে প্রবুদ্ধ ওর জন্য অনেক করেছে, কিন্তু এই মুহূর্তে বিয়ে ঈশা ওকে করতে পারবে না। ইনফ্যাক্ট ওর আজকের এই পরিচিতির পিছনেও প্রবুদ্ধর অবদান আছে। ওই প্রথম বলেছিল, একটা ইউটিউব চ্যানেল খুলে দিই, আমিই সব ব্যবস্থা করবো, তুমি শুধু মন দিয়ে কবিতাটা বলবে। স্টুডিও ভাড়া করে রেকর্ডিং করানোর দায়িত্বও আমার।
ঈশা বলেছিল, কিন্তু এটা তো ব্যয় সাপেক্ষ প্রবুদ্ধ!
প্রবুদ্ধ হেসে বলেছিল, আমার হৃৎপিণ্ডের বুঝি মূল্য নেই? তার প্রতিটা শ্বাস প্রশ্বাস, তার প্রতিটা রক্তবাহী নালি আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ বুঝলে ঈশা। আমার সেই হৃৎপিণ্ডকে আনন্দে রাখতে এইটুকু খরচ আমি করতে পারবো না বুঝি?
ঈশা লজ্জায় আরক্ত হয়ে বলেছিল, তোমার সেই মূল্যবান হার্টটা বুঝি আমি?
প্রবুদ্ধ ঘাড় নেড়ে জোর গলায় বলেছিল অফকোর্স তুমি, তুমি ছাড়া আমি তো নিঃশ্বাস নিতেই পারি না এখন, তাই ভেবে ভেবে বার করলাম আসল সমস্যাটা কোথায়! বুঝলাম, আমার হৃদযন্ত্র বিকল হয়ে যাবে তোমায় ছাড়া। তাহলে এবারে বলো, আমার হৃৎপিণ্ডটা কে!
পোষা বেড়ালের মত আদুরে গলায় ঈশা বলেছিল, এত ভালোবাসো তুমি আমায়?
প্রবুদ্ধ এক নিঃশ্বাসে বলেছিল, তোমায় নয় নিজেকে বাসি, তুমি আমি কি আলাদা নাকি!
ঈশা জানে, শুধু জানে নয় অনুভব করে প্রবুদ্ধ ওকে ভীষণ রকমের ভালোবাসে, বড্ড বেশি খেয়াল রাখে, তবুও মনের ওপরে তো কারোর হাত নেই, তাই হয়তো প্রবুদ্ধর এমন নিঃস্বার্থ ভালোবাসাকেও পিছনে ফেলে এগিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে ঈশার। মোট কথা ও বেশ বুঝতে পারছে, অর্কর সাথে দেখা হওয়ার পর থেকে ভালোবাসা নামক ফোর ম্যাজিক্যাল ওয়ার্ডের মানে পরিবর্তিত হয়ে গেছে ওর কাছে।
আবারও একরাশ বিরক্তি উগলে দিয়ে ঈশা বললো, প্লিজ প্রবুদ্ধ বিরক্ত করো না, আমি অসুস্থ, প্রচণ্ড জ্বর, মাথা ব্যথায় কষ্ট পাচ্ছি আমি, আর তুমি এখন নানা রকম আর্গুমেন্ট শুরু কোরো না।
ঈশা বুঝতে পারলো ওর কথায় কাজ হয়েছে, থেমে গেলো প্রবুদ্ধ। তারপর চিন্তিত স্বরে বললো, ডক্টর দেখিয়েছো? এটা কিন্তু ভাইরাল ফিভার, খুব হচ্ছে এই সিজন চেঞ্জের সময়।
ঈশা একটু থেমে বললো, ডক্টর রেস্টে থাকতে বলেছেন, এখন রাখছি প্রবুদ্ধ, বাই…
প্রবুদ্ধকে কথা শেষ করতে না দিয়েই ফোনটা কেটে দিলো ঈশা। উফ, ইরিটেটিং। আবার নিজের আলমারির দিকে তাকালো ঈশা। কেমন পোশাক পছন্দ করে অর্কপ্রভ, সাহসী নাকি সনাতনী?
কোনো এক সাক্ষাৎকারে পড়েছিলো অর্কর পছন্দের রং চেরি রেড। রেড কালার নাকি স্পর্ধার প্রতীক। মেরুদণ্ড সোজা করে নিজেকে প্রমাণ করার লড়াইয়ে মায়াবী নীল বা আদুরে গোলাপিকে পিছনে ফেলে অবশ্যই দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে যাবে দুঃসাহসী লাল। এমনকি সমাজের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করতেও তার জুড়ি মেলা ভার। তাই ব্লাডরেড বা চেরি রেড অর্কর পছন্দের রং।
আর সময় না নিয়েই রেড টপ আর ব্ল্যাক রেডের কম্বিনেশনে শর্ট স্কার্ট বেছে নিলো ঈশা।
বাথরুমের দিকে যাবার পথেই মায়ের শীতল দৃষ্টির সম্মুখীন হলো ও। মা খুব ধীর অথচ দৃঢ় গলায় বলল, প্রবুদ্ধকে মিথ্যে বললে কেন? কে প্রবুদ্ধ?
ঈশা ছিটকে চড়া গলায় বলল, আড়ি পাতছিলে তুমি আমার রুমে? আমার ফোনের কথা শুনছিলে?
লজ্জা করে না তোমার? আমি বলছি পাপাকে যে তুমি আমার পারসোনাল বিষয়ে মন্তব্য করছ! আর শোনো মা, তুমি আমার গর্ভধারিণী হলেও আমি সেটা স্বীকার করতে লজ্জা পাই। একজন অশিক্ষিত আনকলাচার্ড মহিলাকে মা ভাবতেই জাস্ট ঘৃণা হয় আমার। ভাবতেও লজ্জা করে একদিন তোমার কাছে আমার কবিতার হাতেখড়ি হয়েছিল। যে মানুষটা কবিতার ক বোঝে না সেও নাকি কবিতা শেখাচ্ছে, ভাবা যায়! পিওর জেলাস বুঝলেন মিসেস রিনা সেন! নিজের মেয়েকে তুমি হিংসা করো। এই যে আমার এখন চারিদিকে এত পরিচিত অথচ আমায় কেউ জিজ্ঞেস করলে আমি কাউকেই বলি না যে আমার মায়ের কাছেই আমার কবিতার হাতেখড়ি, তাই বোধহয় হিংসেটা জ্বলুনিতে পরিণত হয়েছে তাই না! শোনো মা, আমি সারাজীবন আমার কবিতার এই সাফল্যের জন্য বাবার কাছে কৃতজ্ঞ থাকব। কারণ বাবা যদি সেদিন জেদ করে তোমার নাগাল থেকে আমায় সরিয়ে আম্রপালি রায়ের কাছে না নিয়ে যেত, তাহলে আজকের ঈশা সেনের পরিচয়টা তোমার ঐ সাজানো রান্নাঘরের মধ্যেই রয়ে যেত। তাই এই ক্রেডিটটা আমি বাবা আর আমার টিচার আম্রপালি রায়কেই দেব। নিজেকে ওনার ছাত্রী বলার সময় গর্বে আমার বুকটা ভরে যায়। হিংসা হয় তাই না মা! হিংসে না করে তাড়াতাড়ি যাও আমার খাবার রেডি করো, ওই দেখ রান্নাঘরটা তোমার বিরহে কাঁদছে তো। দাদাভাই বলছিলো, একটা রাঁধুনি রাখবে বাড়িতে, বুঝতেই পারছো রান্নাঘরের অধিকারটাও হারাবে তুমি। যাও সাবধানে নিজের জায়গায় ফিরে যাও। ঈশা সেনের অভিভাবক হবার চেষ্টা করো না।
কমলিকা আরও কঠিন গলায় বলল, প্রবুদ্ধ কে আমি জানি না, তবে তাকে ঠকিও না। ঠকানোটা তো তোমার ব্লাডে আছে তাই বললাম।
ঈশা ওই মহিলার আবোলতাবোল কথায় গুরুত্ব না দিয়ে চলে গেল বাথরুমে।
ওর হাতে সময় নেই, সকাল সাড়ে এগারোটায় অর্কর সম্মুখীন হবে ও। সব দিক থেকেই নিজের বেস্টটা দিতে চায় ঈশা অর্ককে। মাথায় শ্যাম্পু করতে করতে বাথরুমের আয়নায় নিজের দিকে একবার তাকালো ও। লোকে বলে ও নাকি মায়ের মত দেখতে হয়েছে। হয়তো তাই, বাবার মত শ্যামলা নয়, ঈশা বেশ ফর্সা, মায়ের মতো লম্বা হয়েছে ও। মায়ের অল্পবয়েসের কোনো ছবিই নেই এবাড়িতে। তবুও অ্যালবামে বিয়ের গোটা দুয়েক ছবি দেখেই ঈশা বুঝেছিলো মা এককালে রীতিমত সুন্দরী ছিল। দীর্ঘদিনের চূড়ান্ত অযত্নই আজ মাকে এমন করে দিয়েছে।
ঈশা জানে ও মনে মনে ওই মহিলাকে হিংসে করে। রিনা সেনের ধৈর্য, ওর হাতের নিখুঁত সব কাজ, এমন কি কবিতাটাও মা ওর থেকে ভালোই বলে। জানে বলেই দিনরাত অপমান করে করে মায়ের মেরুদণ্ডটা দুর্বল করে দিয়েছে ঈশা। যাতে কোনোদিন প্রিয় রান্নাঘরে দাঁড়িয়েও দুলাইন কবিতা বেরিয়ে না আসে রিনা সেনের মুখ থেকে।
বাবাই বলেছিল, খেয়াল রাখিস তোর মা যেন আবার কবিতা বলতে শুরু না করে, তাহলে কিন্তু তোকে প্রথম ঘরের কম্পিটিটরকে হারাতে হবে।
ঈশা ক্লাস এইট থেকেই বুঝেছিলো সব বিষয়ে ওই মহিলার বেশ দখল আছে। যদিও বাবা বলেছিল, তোর মা তেমন পাশটাশ করা নয়, ওই আরকি। তবুও ঈশা বুঝতো, মা প্রায় সবই পারে। তাই মাকে দমিয়ে রাখার জন্যই ও আর দাদাভাই ক্রমাগত আক্রমণ করে যেত ওই মহিলাকে। বাবা আর ঠাম্মার প্রশ্রয়ে এই কাজটা করতে বেশ মজাই লাগতো। কাজও হয়েছিল বেশ দ্রুতই। ধীরে ধীরে রিনা সেন নিশ্চুপ হয়ে গিয়েছিল। আর আগ বাড়িয়ে শাসন করতে আসতো না ওদের দুজনকেই। কিন্তু মাঝে মায়ের এই নিঃশব্দ কর্তব্যবোধ চুড়ান্ত বিরক্ত লাগতো ঈশার। খুব চাইতো, ঈশার কথায় প্রতিবাদ করে উঠুক ওই পাথর মূর্তি। তাহলে আরও অপমান করবে ঈশা। কিন্তু কিছুতেই জিততে পারতো না ঈশা, ওর হাজার ঝাঁজালো কথার উত্তরে রিনা সেন বলতো, তুই কি আজ টিফিনে পরোটা নিবি?
অপমানে কালো হয়ে যেত ঈশার মুখ। ওর কথাগুলোকে জাস্ট ইগনোর করতো মা, তাই রাগে গজগজ করতো ঈশা। নিউটনের তৃতীয় সূত্রও বোধহয় ওই মহিলার ক্ষেত্রে কার্যকরী নয়। এত আঘাতের পরেও নিশ্চুপ হয়ে থাকে কি করে মানুষ! ঈশা জানে দাদাভাই আর বাবারও একই প্রশ্ন, এবং ওরাও কোনো না কোনো ভাবে হেরে গেছে মায়ের কাছে।
এসব এলোমেলো ভাবনা ছেড়ে ওর মাথায় এলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়, প্রবুদ্ধকে ওর চারপাশ থেকে সম্পূর্ণ মুছে কি ভাবে ফেলবে সেটা ভাবতে ভাবতেই ভিজে চুলে পিঙ্ক কালারের টাওয়েলটা জড়িয়ে নিলো ঈশা। যেভাবেই হোক প্রবুদ্ধর অস্তিত্ব মুছে ফেলতে হবে নিজের জীবন থেকে। অর্কর ঘনিষ্ঠ হবার জন্য প্রথম কাজ হলো, প্রবুদ্ধর গার্লফ্রেন্ডের পরিচয় থেকে নিজেকে বের করে আনা। ব্লাড রেড টপটা পরে নিজেকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে দেখতেই ফোনটা বেজে উঠলো। অর্কর ফোন। একটা আনন্দের ঢেউ এসে ঈশার শরীরে ঝাপটা দিয়ে গেল যেন।
ফোনটা রিসিভ করেই ঈশা বললো, রেডি হচ্ছি, পাংচুয়ালিটি আমিও জানি মশাই। ওপ্রান্তে অর্কর হাসির শব্দে শিহরিত হলো ঈশা। গুন গুন করতে করতে খাবার টেবিলে এসে বসলো,
”প্রথমত আমি তোমাকে চাই
দ্বিতীয়ত আমি তোমাকে চাই
তৃতীয়ত আমি তোমাকে চাই
শেষ পর্যন্ত তোমাকে চাই।
।। ১১।।
শেষ পর্যন্ত মনীন্দ্রকেই চাই ভেবেই বয়েসের প্রমাণ পত্র, নিজের রেজাল্টের ফাইল, বইপত্র, আর অল্প কিছু পোশাক নিয়ে বাবা মা বোনের চোখের সামনে দিয়ে বেরিয়ে এসেছিল কমলিকা। বাবা বলতো, দাসগুপ্ত ফ্যামিলির অহংকার নাকি কমলিকা। সেই অহংকারের বেড়াজাল ডিঙিয়ে ও সেদিন পা রেখেছিলো রাজপথে। বাবা স্থবিরের মত দেখছিল কমলিকার ঔদ্ধত্য, মা কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল, ভুল করছিস কলি, তুই পারবি না অমন মধ্যবিত্ত পরিবারের বউ হয়ে বাঁচতে।
বোন ছুটে এসে সঞ্চয়িতাটা ওর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলেছিল, তুই না এর দিব্বি করে বলেছিলিস, তুই কখনো কবিতা বলা ছাড়বি না, কবিতার কালো অক্ষরগুলো যত দিন না তোকে ছেড়ে চলে যায় ততদিন পর্যন্ত। সব কেন মিথ্যে করে দিতে চাইছিস দিদিভাই!
কমলিকা দৃঢ় গলায় বলেছিল, মনীন্দ্র আমার স্বপ্নপূরণের দায়িত্ব নিয়েছে রে।
বাবা নির্বিকার গলায় বলেছিল, আর কখনো যেন এ বাড়ির চৌকাঠ ডিঙবে না, আমার এক সন্তান আজ থেকে মৃত। আমাদের মৃত্যু সংবাদেও এ বাড়িতে ফিরবে না তুমি, কথাটা মনে রেখো। আজ এবাড়ির সবটুকু সম্মান নিয়ে তুমি বেরিয়ে যাচ্ছ, কখনো যেন তোমার মুখ দেখতে না হয় আমায়। কমলিকা বলেছিল, তোমার দাম্ভিকতা আগলে তুমি থাকো বাবা। ভালোবাসা, স্বপ্ন দেখা, ইচ্ছে ঘুড়ির নানা রং তুমি দেখতে পাবে না ওই অহংকারী দৃষ্টি দিয়ে।
রাজপথে মনীন্দ্র দাঁড়িয়ে ছিল একা। ওর চোখে হতাশার চিহ্ন স্পষ্ট। দৃঢ় পায়ে দাসগুপ্ত পরিবারের গেট দিয়ে বেরিয়ে এসেছিল কমলিকা। ওকে দেখে মনীন্দ্র উচ্ছসিত হয়ে বলেছিল, কি গো রাজি করাতে পারলে বাবা, মাকে?
কমলিকার দুটো চোখ ছাপিয়ে জল নেমেছিল সেদিন। ওর চোখে যে এত নোনতা জলের উৎস আছে কোনোদিন জানতেই পারেনি ও। মা বলতো, কমলিকা নাকি কোনোদিন তেমন কাঁদুনে ছিল না। যেমন ছিল মালবিকা। কমলিকা নাকি ছোট থেকেই কেউ বকলে চুপ করে থাকতো। দাঁতে দাঁত চেপে দাঁড়িয়ে থাকতো স্থির হয়ে। মুখ চোখ লাল হয়ে যেত কিন্তু কিছুতেই নিজের দুর্বলতা প্রকাশ করতো না কারোর কাছে।
চিরকালই ও নিজের অবাধ্য কষ্টগুলোকে দমন করেছে কঠিন হাতে। কিছুতেই তাদের বাইরে আসতে দেয়নি। তাই নিজের নিশ্চিন্ত গৃহকোণ, পছন্দের ঘর, বিছানা ছেড়ে আসার সময় যন্ত্রণা হচ্ছিল কমলিকার বুকের বাম দিকে। তবুও ওই দুঃসহ যন্ত্রণাটার গলা টিপে কঠিন হাতে দমন করেছিল ও। মুখের রেখায় ফুটে উঠতে দেয়নি সব হারানোর দুঃখগুলোকে।
দাসগুপ্ত বাড়ির গেটের বাইরে পা দিতেই গেটটা বন্ধ করে দিলো বাসু জেঠু। এটাই নিয়ম এ বাড়ির। কেউ বেরোনোর আগে গেট খুলে দাঁড়ায় বাসু জেঠু, আবার বেরিয়ে গেলেও গেটটা বন্ধ করে দেয়। বাসু জেঠুকে জন্মে থেকে ওদের সিকিউরিটির কাজ করতে দেখছে কমলিকা। যেন ওদের পরিবারেরই একজন। আজ যখন বাসু জেঠু জিজ্ঞেস করলো, এখন আবার কোথায় বেরোচ্ছেন? ফিরবে কখন? গাড়ি নেবে না মামনি? তখনই বুকের ভিতরের জমা বরফটা উষ্ণতা পেয়ে গলতে শুরু করেছিল। অস্ফুট একটা কথাই বলেছিল কমলিকা, ভালো থেকো জেঠু।
বাসু জেঠু অবুঝের মত তাকিয়েছিল ওর দিকে। মালিকের মেয়ে বলেই হয়তো আর প্রশ্ন করতে সাহস পায়নি শুধু অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল কমলিকার দিকে। পিছন ফিরে তিনতলার দক্ষিণের ঘরটা দেখেছিলো আরেকবার। ঘরে এখনো লাইট জ্বলছে। তাড়াহুড়োয় ও নেভাতে ভুলে গেছে। ওর নিজের ঘর ছিল এতদিন পর্যন্ত ওই ঘরটা। ওই ঘরের প্রতিটা আনাচকানাচ কমলিকাকে চেনে। ডিভানের পিঙ্ক আর স্কাইব্লু মিকি মাউসের বেড কভারটা ও কিনেছিল পছন্দ করে। টেবিলের গোল্ডেন ল্যাম্পটা, যেটা জ্বালিয়ে ও পড়তো রাত পর্যন্ত সেটাও তো পড়ে রইলো ওই ঘরে। আর কাঠের আলমারি জোড়া ওর যত প্রাইজ সব ওর দিকে করুণ চোখে তাকিয়ে বলছিলো, আমাদেরও নিয়ে যাবে না তোমার সঙ্গে! বই, মেডেল, শোপিসগুলো জিতে এসে যখন বাবার হাতে দিত কমলিকা তখন বাবা ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বলতো, তুই হলি ডঃ কমলেশ দাসগুপ্তর অহংকার, সেই রাজার মুকুটে কোহিনুর হীরের মত।
সেই বাবাই আজ অভিমানে ওকে এতটা পর করে দিতে পারলো!
মনীন্দ্র আবারও উচ্ছসিত হয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, কি গো, ভিতরে যাবে না? যাক, শেষ পর্যন্ত তাহলে তোমাদের এই বিশাল লনেই আমাদের রিসেপশন হচ্ছে তাই তো?
কমলিকা ক্লান্ত অবসন্ন গলায় বলেছিল, মনীন্দ্র চল, এই বাড়ির গেট আমাদের জন্য বন্ধ হয়ে গেছে।
মনীন্দ্র এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলেছিল, মানে? কোথায় যাবে তুমি? ওই একটা ব্যাগে কিছুই তো নিতে পারো নি, চলবে কি করে তোমার? তুমি থাকবে কোথায়?
কমলিকা ছলছল চোখে তাকিয়ে বলেছিল, কেন তোমার কাছে থাকবো। এখন থেকে তুমিই তো আমার সবটুকু।
মনীন্দ্র একটু সামলে নিয়ে বলেছিল, এক কাজ করো, তুমি আজ রাতটুকু কোনো বান্ধবীর বাড়িতে থেকে যাও, কাল ভেবে চিন্তে একটা কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে। তাছাড়া আমি তো বাড়িতে কিছুই বলিনি সেভাবে, হঠাৎ বিয়ে করবো বললেই তো চলে না, বাবা, মাকে ভালোভাবে বোঝাতে তো হবে। তাদের রাজি করাতে হবে। তারাও যদি তোমার বাবা, মায়ের মত অস্বীকার করে বসে তখন তো গাছতলায় ঘর বাঁধতে হবে কমলিকা। অন্তত একটা রাত সময় দাও।
কমলিকার ভাবনাশক্তি কেমন যেন লোপ পেয়ে গিয়েছিল। কোনো মতে ট্যাক্সি করে শ্রাবণীর বাড়িতে গিয়ে উঠেছিলো ও। শ্রাবণী অবশ্য অনেকবার বলেছিল, ভুল করছিস কমলিকা, এভাবে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে আসাটা খুব বড় ভুল। কমলিকার চোখে তখন জেদ, অভিমান আর মনীন্দ্রর ওপরে চূড়ান্ত বিশ্বাস আর কিছু একান্তে দেখা স্বপ্নের হাতছানি। তাই শ্রাবণীর কথায় বিশেষ কিছু হেলদোল হয়নি কমলিকার।
কি ভাবে ব্যবস্থা করেছিল মনীন্দ্র সেটা অবশ্য কমলিকার কাছে অজানাই রয়ে গেছে। তবে ও এসে বলেছিল, কমলিকা দিন পনেরো পর আমাদের বিয়ে, এর আগে কোনো ডেট নেই, মা পুরোহিত ডেকে ডেট ফাইনাল করেছে। তুমি কি একবার তোমার বাড়িতে জানিয়ে দেবে ডেট টা, যদি ওনারা আসেন ওইদিন।
দেখো মেনে না নিয়ে যাবেই কোথায়, বাবা মা তো আফটার অল।
কমলিকা দৃঢ় গলায় বলেছিল, না, ওবাড়িতে আর কোনো খবর যাবে না। মনে পড়ে যাচ্ছিলো বেরোনোর আগের মুহূর্তে বাবার বলা কথাগুলো। শুকনো চোখে, তীক্ষ্ন গলায় বাবা বলেছিল, আর কখনো এসো না আমার সামনে।
কথাগুলো মনে পড়েই শক্ত হয়েছিল কমলিকার চোয়াল। হয়তো ওর অগ্নিদৃষ্টির দিকে তাকিয়েই সেই মুহূর্তে থেমে গিয়েছিল মনীন্দ্র। কিন্তু হিসেবে একটা বড় ভুল করেছিল ও। ভাবতেই পারেনি আর কোনোদিন ডক্টর কমলেশ দাসগুপ্তর সাথে যোগাযোগ হবে না কমলিকার। ওর বাবার অত সম্পত্তির ভাগ যে মনীন্দ্র পাবে না সেটা বোধহয় কল্পনাও করতে পারেনি ও।
বিয়ের দিন নাম পরিবর্তনের মাধ্যমে শুরু হয়েছিল কমলিকার সমস্ত ইচ্ছার মৃত্যু ঘটানো। সেন বাড়ির প্রতিটি মানুষকে যেন কেউ বিশেষভাবে নির্দেশ দিয়ে রেখেছে কমলিকাকে সব দিক থেকে হেনস্থা করার জন্য। মনীন্দ্রর মা দুদিন অন্তর বলতে শুরু করেছিল, এই যে শুনলাম মনি বললো, খুব বড়লোকের মেয়ে, প্রচুর টাকা পয়সা দেবে, সেসব কোথায় গেল, একটা নমস্কারীও তো পেলাম না।
মরমে মরে যেত কমলিকা। বিয়ের আগের পরিচিত মনীন্দ্রও যেন কেমন অচেনা হয়ে যেতে শুরু করলো।
চেনার ভিড়ে অচেনা কেউ যেন। ধীরে ধীরে কমলিকার কাছ থেকে কোনো এক বিশেষ কায়দায় কেড়ে নেওয়া হচ্ছিল ওর ইচ্ছে উড়ানটাকে। প্রথমেই মনীন্দ্র বলেছিল, আচমকা বিয়ে করে সংসারে মেম্বার বাড়ানোর প্ল্যান আমার ছিল না রিনা, তাই আপাতত খরচ অনেক বেড়েছে, এই মুহূর্তে তোমার ইউনিভার্সিটির পড়াশোনার খরচ চালানো আমার কম্ম নয়। এক কাজ করো, তুমি বরং একদিন দাসগুপ্ত বাড়িতে চলে যাও, গিয়ে বলো আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থার কথা, তাহলে হয়তো তোমার বাবা তোমার পড়াশোনার ব্যাপারে হেল্প করবেন।
অপলক তাকিয়ে ছিল কমলিকা মনীন্দ্রর মুখের দিকে। এই সেই মানুষটা, যে ওর হাত ধরে কথা দিয়েছিল, কমলিকার সব স্বপ্নপূরণ করবে! বড্ড অচেনা লাগছিলো মানুষটাকে। কমলিকা বলেছিল, তাহলে আমি টিউশনি শুরু করি মনীন্দ্র।
ওর বাবা গম্ভীর স্বরে বলেছিল, সেন বাড়ি মধ্যবিত্ত হতে পারে কিন্তু এ বাড়ির বউ সকালবেলা বেরিয়ে ছাত্র পড়াতে যাবে না। আমাদের একটা সম্মান আছে। মনীন্দ্রও বাবার সুরেই সুর মিলিয়ে বলেছিল, অনেক তো পড়লে রিনা, এবারে মন দিয়ে সংসার করো।
ছাপোষা বাড়ির রান্নাঘরে কমলিকা দাশগুপ্তের চারা মাছ বাছা, মোচা কাটার ট্রেনিং চলছে তখন। বহুবার কমলিকা ভেবেছিল, সব ছেড়ে দিয়ে চলে যাবে বাপের বাড়িতে। কিন্তু ইগো নামক বস্তুটি মাঝপথে এসে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তবুও চেষ্টা করেছে সেন বাড়িতে মানিয়ে নিতে। মনে মনে ভেবেছে মনীন্দ্র হয়তো একটু সামলে নিয়েই ওকে আবার সব কিছুর সুযোগ করে দেবে। আশায় আশায় রোজই সূর্যোদয় দেখছিল ও। দিনের শেষে সন্ধেটা ছিল ওর একান্ত নিজস্ব সময়। যখন ও কবিগুরু আর কাজী নজরুলের সাথে নির্জনে সময় কাটাতো। মাঝে মাঝে অবশ্য কবি সুকান্ত এসে স্বপ্ন ভঙ্গ করে যেতেন, পূর্ণিমার চাঁদকে ঝলসানো রুটির সাথে তুলনা করে ক্ষতবিক্ষত করে যেতেন, তবুও কবিগুরুর ”সাধারণ মেয়ে”র সাথে কমলিকাও পাড়ি দিতো সাত সমুদ্রের পাড়ে।
এ বাড়িতে বেশি বই নেই। হাতে গোনা কয়েকটা। হয়তো ওর সাথে প্রেমপর্ব চলার সময়েই মনীন্দ্র কবিতার বইগুলো কিনেছিল। বইগুলো বেশ নতুন, ঝকঝকে। একটা ছোট আলমারিতে গোছানো থাকতো বইগুলো। তবুও জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে ওদের গন্ধটা বুকের মধ্যে পর্যাপ্ত পরিমাণে ভরে নেবার চেষ্টা করতো কমলিকা। এমনই এক সন্ধেতে অনামি প্রবীর রায়চৌধুরী নামের একজনের একটি পাতলা চটি বই আচমকাই হাতে এসেছিল কমলিকার। পাতা উল্টেই চমকে উঠেছিলো ও। বুকের ভিতর শুরু হয়েছিল রক্তক্ষরণ। ও তাহলে একটা ফ্রডকে বিয়ে করেছে, আসলে মনীন্দ্র একটা মিথ্যেবাদী। এতদিন ধরে ভালোবাসার অভিনয় করেছে ওর সাথে, ওর সরল বিশ্বাসের সুযোগ নিয়েছে মনীন্দ্র!
এই কবি প্রবীর রায়চৌধুরীর কবিতাগুলোই মনীন্দ্র নিজের লেখা বলে চিঠিতে লিখতো কমলিকাকে।
কমলিকা ভাবত এমন যার ভাষায় দখল সে মানুষ তো নিজেই একজন কবি। তাই হয়তো ওর কবিতার অক্ষরদের এত ভালোবাসে মনীন্দ্র। পাতার পর পাতা উল্টে পড়ছিল কমলিকা, প্রতিটা কবিতা কবি মন প্রাণ ঢেলে লিখেছেন। উৎসর্গ করেছেন তাঁর স্ত্রীকে। যিনি ক্যান্সারে আক্রান্ত পেশেন্ট।
নিজের ওপরে অসম্ভব রাগ হচ্ছিল কমলিকার। ও জাস্ট বোকা বনে গেল! বাবা, মা, বোন, শ্রাবণী সবাই বলেছিল, ওর চয়েস চূড়ান্ত ভুল। তবুও বিশ্বাস করেছিল ও মনীন্দ্রকে। কিন্তু এভাবে মিথ্যাচার করেছিল ওর সাথে, ভেবেই ঘৃণায় মুখটা বিকৃত হয়ে গিয়েছিল ওর। দমবন্ধ হয়ে আসছিল কমলিকার। চারটে ম্যাজিক্যাল শব্দ তখন নেহাতই প্রহসন মনে হয়েছিল ওর।
এই মনীন্দ্রর জন্যই ও সব ছেড়েছে!
বাড়ি ফিরেই মনীন্দ্র ওর আরক্ত চোখ দেখে জিজ্ঞেস করেছিল, কি হয়েছে?
কমলিকা কবিতার বইটা ওর সামনে ফেলে দিতেই বেশ চিৎকার করে বলেছিল, হ্যাঁ ঠিকই দেখেছো, আমি কবিতা লিখতে পারিনা। ইনফ্যাক্ট আমি কবিতা ভালোও বাসি না তেমন। তোমাদের মত সুখী, বড়লোক বাড়ির ছেলে মেয়েদের আমি জাস্ট ঘৃণা করি, হিংসা করি আমি তোমাদের। না ভালোবাসিনি আমি তোমায়, শুধু তোমায় জয় করতে চেয়েছিলাম, চেয়েছিলাম আমার মত ব্যর্থ মানুষের পায়ের তলায় তোমার অবস্থান হোক, তাই হয়েছে। আমি জিতে গেছি। ভালোবাসা নামক মোহের জালে তুমি নিজেই এসে ধরা দিয়েছিলে। মাঝখান থেকে গণ্ডগোল পাকালো তোমার বাপটা। মেয়েকে ডিরেক্ট আমার ঘাড়ে চাপিয়ে দিলো, সম্পত্তির কানাকড়ি না দিয়ে। শোনো রিনা, তোমার ঐ কমলিকা নামটাতেই আমার আপত্তি। আটপৌরে হয়ে থাকো বুঝলে।
স্বপ্নপূরণ করো ভালো করে রান্না শিখে, সংসারের দায়িত্ব নিয়ে, ওসব অহংকারি বিলাসিতা এ বাড়িতে চলবে না বুঝেছো?
কমলিকা ধীর অস্পষ্ট গলায় বলেছিল, ভালোবাসনি তুমি আমায়? কোনোদিন বাসনি? সব প্রতিশ্রুতি মিথ্যে ছিল? একসাথে দেখা স্বপ্নগুলো বেরঙীন ছিল তাহলে?
মনীন্দ্র গলা চড়িয়ে বলেছিল, একদম পারফেক্ট চিনেছো তুমি আমায়। আর নিশ্চয়ই অসুবিধা নেই তোমার দাসগুপ্ত বাড়িতে ফিরে গিয়ে আমাদের জন্য টাকা চেয়ে আনতে, আর নিশ্চয়ই আমার সম্মানহানির ভয় নেই তোমার! তাহলে যাও রিনা ওবাড়িতে, নিয়ে এস নিজের ন্যায্য ভাগ। স্থবিরের মত বসেছিলো রিনা।
চোখের সামনে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো কি সত্যি! ভালোবাসা নয়, শুধুই প্রবঞ্চনা করেছিল মনীন্দ্র ওর সাথে। ওর মুখের উচ্ছল হাসি, ওর চোখের মায়াময় কাজল, ওর কপালের স্বপ্নদেখা টিপ, ওর কানের আত্মবিশ্বাসী কুন্দন, সব কিছুকে হিংসা করতো মনীন্দ্র! তাই ওকে এভাবে ঠকিয়ে বিয়ে করে, এ বাড়িতে এনে জব্দ করলো ও। মনে মনে শপথ করেছিল কমলিকা, শেষ করে দেবে নিজেকে মনীন্দ্রর চোখের সামনে। অসহ্য লাগবে মনীন্দ্রর কমলিকাকে কিন্তু নিরুপায় হয়ে সহ্য করবে ওকে।
সেদিন থেকেই কমলিকা এবাড়িতে রয়েছে, কর্তব্য করছে অথচ নিজের মনের কোনোরকম অনুভূতির প্রকাশ করেনি। মনীন্দ্র মাঝে মাঝেই বলে, অসহ্য, এমন রোবটের সাথে কেউ থাকতে পারেনা। স্বাভাবিক ভাবে কথা বলতেও কি কষ্ট হয় তোমার!
জিতে যায় কমলিকা, যতবার বিরক্ত হয় মনীন্দ্র ততবার জিতে যায় কমলিকা।
মধ্যরাতে বিছানায় মরার মত শুয়ে থাকে কমলিকা, মনীন্দ্র একটু তৃপ্তি পাবার আশায় পাগলের মত ছটফট করে ওর শরীরটার ওপরে। তারপর প্রায় কাঁদো কাঁদো গলায় বলে, আমি রেপিস্ট নই রিনা, প্লিজ, সাড়া দাও আমার ডাকে, তোমার শরীরের আকর্ষণে তৃপ্ত করো আমায়। কমলিকা মনে মনে হাসত, নাও মনীন্দ্র আমার গোটা শরীরটা নাও। নিখুঁত শরীরটাকে তুমি নিজে হাতে উলঙ্গ করো, তছনছ করে দাও আমার নারীত্বকে। ফলাও স্বামীর অধিকার, তুমি বারবার রিনা সেনকেই খুঁজে পাবে, কমলিকাকে নয়।
এভাবেই কমলিকার চূড়ান্ত অনিচ্ছা আর মনীন্দ্রর জোরের ফলেই জন্মেছিল দেবজিত, ঈশা।
কমলিকা সন্তানদের ঘিরে বাঁচতে চেয়েছিল। দেবজিত ছিল ভীষণ মা নেওটা, সেটাও সহ্য হলো না মনীন্দ্রর। দেবজিতকে ওর থেকে দূরে করে দেওয়ার সমস্ত ব্যবস্থা পাকা করে ফেললো ও আর ওর মা মিলে। ঈশার ক্ষেত্রেও তাই। ছোট থেকেই ওর ছেলে মেয়েরা জানে কমলিকা একজন অশিক্ষিত, আনকালচার্ড মেয়ে।
রান্নাঘরের গণ্ডির বাইরে যার কোনো পরিচয়ই নেই।
দিনগুলো কেটে গেছে কালের নিয়মে। ছেলে মেয়েদের কাছ থেকেও মনীন্দ্রর মতই অপমানিত হয়েছে কমলিকা। ধীরে ধীরে নিশ্চুপ হয়ে গেছে। কমলিকার থেকে অনেকটা দূরে চলে এসে রিনা হয়ে বেঁচে আছে ও। ইদানিং আবার একটা নতুন সমস্যা তৈরি হয়েছে ওর মধ্যে। মাঝে মাঝেই কমলিকা এসে সামনে দাঁড়িয়ে বলছে, এর নাম বুঝি জেতা? মনীন্দ্রকে জিতিয়ে দিয়েছো তুমি, নিজে হেরে গিয়ে। পুরোনো কমলিকা বড্ড লোভ ধরাচ্ছে রিনার মনে, আরেকবার কমলিকাকে ফিরে পাওয়ার ইচ্ছে হচ্ছে এই মধ্যবয়স পেরিয়ে যাওয়ার মুহূর্তে। ঝুলপির পাশের সিলভারলাইনগুলো বিদ্রূপ করে বলছে, অচেনার ভিড়ে চেনা কমলিকাকে হারিয়ে ফেলতে লজ্জা করলো না! নিজের নামটুকুর মূল্য পর্যন্ত না রাখতে পারা মেয়েটাও নাকি ভাবে সে জিতে গেছে। তিলতিল করে জীবনের সব ইচ্ছেগুলোর শ্বাস রোধ করে মেরে ফেলার নাম যদি জিতে যাওয়া হয়, তাহলে তুমি জিতে গেছো রিনা সেন, কমলিকাকে হারিয়ে জিতে গেছো।
নিজের কান চেপে ধরে আয়নার সামনে থেকে সরে আসে রিনা, কষ্টগুলো আবার হয়তো রক্ত ঝরাবে এই ভেবেই পালিয়ে বেড়ায়।
তবে ইদানিং ঈশার ব্যবহারে বড্ড কষ্ট হচ্ছে কমলিকার। মা হিসাবে ওকে স্বীকার করতেও যেন বড্ড বাধা মেয়েটার। মনীন্দ্র যে এভাবে ওর সন্তানদের ওর কাছ থেকে কেড়ে নেবে ভাবতেই পারেনি কমলিকা। মনে মনে ভাবছিলো কিছু একটা করতে হবে। পুরোনো কমলিকাকে এরা তো চেনেই না, এরা চেনে বড্ড আটপৌরে রিনা সেনকে। যে নুন তেলের কৌটো আর চামচ বাটির হিসেব করতেই ব্যস্ত থেকেছে গোটা জীবনটা। আচ্ছা, ছেলে মেয়েরা যদি কমলিকা দাসগুপ্তকে চিনতো তাহলে কি মা হিসাবে মিনিমাম সম্মানটুকু পেত ও। অন্তত অশিক্ষিত আনকালচার্ড বলে অশ্রদ্ধা হয়তো করতো না। মা ডাকে শুধুই প্রয়োজনের হাতছানি থাকতো না, হয়তো একটু হলেও ভালোবাসা থাকতো।
নিজের মনেই বিড়বিড় করে উঠলো, কমলিকা ডু সামথিং।
।। ১২।।
নিজের ঘরে রাত্রে শুয়ে শুয়ে ভাবছিলো দেবজিত, কবিতা সিলেকশনটা যে মা করে দিয়েছে সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। ঈশা বাড়িতে ছিল না। থাকলেও দিত না। বাবার পক্ষে সম্ভব নয়, তাই মা-ই ঠিক করে দিয়েছে ফেয়ারওয়েল অনুষ্ঠানে কোন কবিতাটা আবৃত্তি করা উচিত। নিজের মনেই হাসলো দেবজিত, মা তার মানে এখনো ওকে ভালোবাসে, একটু হলেও বাসে। বাবা, ঈশা আর দেবজিতের যৌথভাবে অপমানের পরেও কি করে যে ওদের এখনো খেয়াল রাখে মা, কে জানে! আচ্ছা ওই মহিলা সত্যিই কি ওদের কোনো ক্ষতি করেছিল কোনোদিন? তাহলে এতটা আক্রোশ কেন জন্মালো মায়ের প্রতি। কেন মা নামক মিষ্টি ডাকটা রিনা সেনের রূপ নিলো। এতদিন যাবৎ এই প্রশ্নগুলো মনের আনাচে কানাচে ঘুরলেও ও কখনো পাত্তা দেয়নি। আজ ‘বিদায়’ কবিতাটা পড়তে পড়তে বুকের মধ্যে কেমন যেন মুচড়ে উঠলো। বিচ্ছেদ তো হয় নি মায়ের সাথে, একই ছাদের তলায় থেকে সমাপন ঘটেছে ক্রমাগত। সুখগুলো কি করে যেন স্মৃতির পাতায় স্থান করে নিয়েছে। মাও একদিন চলে যাবে পৃথিবী ছেড়ে সেদিন কি দেবজিত আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে জোর গলায় বলতে পারবে, ও মায়ের সাথে জাস্টিস করেছিল! একটাই কথা দলছুটের মত ওর মনের দরজার সামনে ধাক্কা দেয় মাঝে মাঝে, বাবার কিসের এত আক্রোশ মায়ের প্রতি। কেন বাবা চেয়েছিল, ওরা দুই ভাইবোন মাকে আক্রমণ করুক, ক্ষত বিক্ষত হোক মা! থাক, কিছু প্রশ্নের উত্তর বোধহয় এভাবেই হারিয়ে যায় উত্তর না দিয়েই।
নিজের মনেই কবিতাটা আউড়াচ্ছিলো ও, কালকেই বলতে হবে অফিসে। দরজায় নক করলো কেউ। বইটা সরিয়ে রেখে দরজা খুলতেই ধীর পায়ে মা ঢুকলো ঘরে। ঢুকেই বিনা বাক্যব্যয়ে দরজাটা বন্ধ করে দিলো।
বিছানার এক কোণে বসে বললো, জিত আজ দু মিনিট আমার কথা শুনবি?
মায়ের এ হেন ব্যবহারে বড্ড চমকেছে ও। দীর্ঘবছর পর মা এভাবে কথা বলছে ওর সাথে। ইনফ্যাক্ট হাতে চায়ের ট্রে বা আয়রন করা জামা প্যান্ট ছাড়া মা কোনোদিনই ওর ঘরের চৌকাঠে পা দেয় না। যেন দেবজিতের প্রয়োজন মেটাতেই বাধ্য হয়ে এসে দাঁড়িয়েছে ওর ঘরের মেঝেতে, কোনো কথা ছাড়াই ওগুলো টেবিলে রেখে নিস্তব্দে চলে গেছে মা। কোনো কিছুর বিনিময়ে নয়, দিয়েই যেন আনন্দ। আজ হঠাৎ কি চাইছে মা?
দেবজিত বিছানায় উঠে বসে স্বাভাবিক গলায় বলল, বলো কি বলবে।
রিনা সেন একটু চুপ করে থেকে বললো, দময়ন্তী তোকে ভালোবাসে, বুঝিস নি কখনো? তোর অফিস যাওয়ার পথে সে দাঁড়িয়ে থাকে জানালায়, তুই বেরিয়ে গেলেই আমার আগেই সে বলে, দুর্গা দুর্গা। তুই ফিরবি বলেই হিম মাথায় অপেক্ষা করে ছাদের আলসেতে দেখিস নি কখনো? তোর প্রিয় রং বলেই বোধহয় ওর বেশির ভাগ ড্রেস বেবি পিঙ্ক।
দেবজিত অবাক হয়ে তাকিয়েছিল মায়ের দিকে। জীবনেও ওর সাথে কোনোদিন কথা না বলা মা কিভাবে বুঝে গেল ওর আর দময়ন্তীর সম্পর্কের কথা! দেবজিতও খুব ভালোবাসে দময়ন্তীকে, কিন্তু কোনোদিন রাস্তাঘাটে ওরা কথাই বলেনি সেভাবে। কারণ ও জানে ওদের বাড়ির সাথে দময়ন্তীদের বাড়ির কিছু একটা ঝামেলা আছে। তাই ফোনেই কথা বলেছে টুকটাক, অথবা যাওয়া আসার পথে হালকা চাউনি। কিন্তু এসবের খবর তো এই নিঃস্পৃহ মহিলার কাছে থাকার কথা নয়।
দেবজিত নিজেকে সামলে নিয়ে বললো, তুমি কি বলতে এসেছো সেটা বলো।
জোরে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মা বললো, ভেবেছিলাম থাকবো না এসব বিষয়ে, কিন্তু মনে পড়ে গেল, নার্সিংহোমে তোকে যখন আমার কোলে দিয়ে গিয়েছিল নার্স তখন তুই তোর ছোট্ট হাত দিয়ে আমার আঙুল ধরার চেষ্টা করেছিলিস। ছোটবেলায় রাতে ঘুমের ঘোরে মা যেন হারিয়ে না যায় তাই শক্ত করে ধরে রাখতিস মায়ের আঁচলটা। কবিতা কম্পিটিশন বা স্কুলের এক্সামের সময় বাড়ি থেকে বেরোনোর আগে দুবার প্রণাম করতিস আমাকে। একবার প্রথমে আরেকবার ঠাকুর দেবতা, ঠাম্মা-দাদু-বাবা সবাইকে করার পরে।
মুচকি হেসে বলতিস এটা হলো ফিনিসিং টাচ। এছাড়াও প্রথম মা ডাক শোনার কৃতজ্ঞতাবশেই বলতে এলাম, তোর বাবা আর তোর পিসি বোধহয় তোর বিয়ে ঠিক করছে। তোর পিসিই সম্বন্ধ এনেছে। শুনলাম নাকি অনেক টাকা পণ নেবে তোর বাবা। নিজের বিয়েতে পায়নি বলেই হয়তো ইচ্ছেপূরণ। দময়ন্তীর একনিষ্ঠ ভালোবাসাকে তুচ্ছ করে দিবি কয়েকটা টাকার জন্য? তাই বলতে এলাম তোকে, এটা করিস না জিত।
জিত অপলক তাকিয়ে আছে মায়ের মুখের দিকে। অন্য দিন প্রস্তর প্রতিমার মুখে কোনো বাহ্যিক অনুভূতির রেখা দেখতে পায়না ও, আজ দেখলো মায়ের চোখে কষ্ট, কপালে চিন্তার ভাঁজ।
দেবজিত অস্ফুটে বললো, কিন্তু ওদের ফ্যামিলির সাথে আমাদের যেন কিসের প্রবলেম আছে, কেউ তো মানবেই না।
মা চুপি চুপি বললো, তোর দাদু আর ওর দাদু একসাথে বিজনেস করতো, ব্যবসায় ক্ষতি হয়েছিল বলেই মনোমালিন্য হয়েছিল, দু দাদুই এখন অবর্তমান। তাই সেসব রাগ আর কেউ পুষে রাখেনি। চল, তুই আর আমি একদিন যাই দময়ন্তীদের বাড়িতে, বিয়ের কথা বলে আসি।
দেবজিত অবাক চোখে দেখেছিলো মাকে। ভীষণ চেনা, খুব ঘরোয়া মাও তার মানে পারে বাবার বিরুদ্ধে স্টেপ নিতে! উত্তেজনার বশে মায়ের হাতদুটো চেপে ধরে দেবজিত বললো, সত্যি? আমি কোনদিন দময়ন্তীকে ভরসার কথা শোনাতে পারিনি। বাবা যদি না মেনে নেয় সেই জন্য। মা ধীরে ধীরে বললো, আমি তো মেনে নেব, বাবার সাধ মেটাতে পণ নিয়ে বিয়ে করিস না জিত, আমার গর্ভের বদনাম করিস না। জিত অপলক চোখে তাকিয়ে বলল, এত কিছুর পরেও তুমি আমার ভালো চাও মা? কি ধাতু দিয়ে তৈরি গো তুমি!
মা আস্তে আস্তে বললো, কাল তুই অফিস থেকে একটু তাড়াতাড়ি ফিরে আসিস, আমি রেডি হয়ে থাকবো, কালই কথা বলে আসবো ওদের বাড়িতে।
গলা পাল্টে মা হঠাৎ জোরে জোরে আবৃত্তি করতে শুরু করলো বিদায় কবিতাটা।
”হে মহাসুন্দর শেষ,
হে বিদায় অনিমেষ,
হে সৌম্য বিষাদ,
ক্ষণেক দাঁড়াও স্থির,
মুছায়ে নয়ননীর
করো আশীর্বাদ।
ক্ষণেক দাঁড়াও স্থির,
পদতলে নমি শির
তব যাত্রাপথে,
নিষ্কম্প প্রদীপ ধরি
নিঃশব্দে আরতি করি
নিস্তব্ধ জগতে।”
মায়ের কবিতা শেষ হবার আগেই জিতের দরজায় টোকা পড়লো, ঈশা আর বাবার গলা।
দরজা খুলতেই ঈশা বললো, এই দাদাভাই কার ভয়েস চালিয়েছিস তোর ঘরে? এটা কার গলা রে?
বাবা একটু গম্ভীর গলায় বলল, তোর মায়ের মাথায় আবার ভূত চেপেছে বুঝি!
কিছু শেখার দরকার হলে ঈশা তো বাড়িতেই আছে শিখে নে, অন্তত ভুল শিখবি না।
ঈশা প্রতিবাদ করে বললো, আরে না বাবা, যার কবিতা দাদাভাই চালিয়েছে তিনি দুর্দান্ত বলেন, এই দাদাভাই আমায় সেন্ড কর ক্লিপিংটা প্লিজ।
কথাটা শেষ করেই ছিটকে উঠলো ঈশা ঘরের বিছানার কোণ মাকে দেখে।
বাবা আবারও বললো, বললাম না, এটা তোমার মা বলছিলো।
ঈশার শ্রদ্ধার হাসিটা ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হয়ে গেল কৌতুকে। এই দাদাভাই, আর ইউ ক্রেজি? তুই ওই অশিক্ষিত মহিলার কাছ থেকে রিসাইটেশন শিখছিস? কেন রে আমি কি মরে গিয়েছিলাম?
আরে ওই মহিলা দিনরাত আমার সাথে কম্পিটিশন করে যাচ্ছে রে। কবিতা সম্পর্কে মিনিমাম কনসেপ্ট নেই রিনা সেনের, আর তুই কিনা!
বাবা মায়ের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে বলল, তুমি আর তোমার কবিতা অনেকটা ফিনিক্স পাখির মত, বুঝলে রিনা, মরেও মরে না।
সবাইকে অবাক করে দিয়ে জিত বললো, তোমরা যাও, আমি মায়ের কাছ থেকে ভালো করে কবিতাটা শিখে নিতে চাই, কালকেই আমায় পারফর্ম করতে হবে।
ঈশা ঘৃণার চোখে দেবজিতের দিকে তাকিয়ে বলল, রুচিটাকে আগে উন্নত কর দাদাভাই, তারপর না হয় কবিতা বলবি। তুই যার কাছ থেকে শিখবি বলছিস, সে নিজের মেয়েকে হিংসা করে, বুঝলি। নেহাত উপায় নেই তাই কম্পিটিশনে নামে নি।
মা ধীর গলায় বলল, না ঈশা, তোমায় করুণা করি বলেই কম্পিটিশনে নামিনি। তোমার বাবা জানে, একসময় আমি প্রতিযোগিতায় নাম দিয়েছি শুনলে অনেক ভালো ভালো আর্টিস্ট ভয়ে নিজেদের নাম কাটিয়ে দিয়ে আসতো প্রতিযোগিতা থেকে। কারণ তারা নাকি স্থির ভাবে জানতো, যে ফার্স্ট প্রাইজটা তারা পাবে না।
ঈশা মুচকি হেসে বললো, ও রিয়েলি? বেশ ওপেন চ্যালেঞ্জ দিলাম তোমায় রিনা সেন, জিতে দেখাও।
আমারও জিততে জিততে অভ্যেসটা বড্ড খারাপ হয়ে গেছে। একবার অন্তত হারতে চাই, আর সেটা হোক তোমার কাছেই।
বাবা বললো, বাড়ির মধ্যে এসব কি হচ্ছে। তোর মা কেন তোর সাথে কম্পিটিশনে নামতে যাবে, তোর মা তো কবিতা বলা ছেড়েই দিয়েছে। আজ হয়তো একবার দেবজিতকে শিখিয়ে দিয়েছে, তোর মায়ের সময় কোথায়! সংসারের কাজের বাইরে এসব করার সময় নেই তোর মায়ের। তাই এসব ফালতু চ্যালেঞ্জের কি দরকার। বাবার চোখে একটু হলেও ভয়ের ছায়া দেখেছিলো দেবজিত। বাবা কি মায়ের ট্যালেন্টকে ভয় পায়? কিন্তু বাবাই তো বলেছে, তোর মা তেমন পড়াশোনাও জানে না। খুবই গরিব বাড়ির অসহায় মেয়ে, বাবা নাকি মাকে বিয়ে করে উদ্ধার করেছিল ওদের ফ্যামিলিকে। তাহলে আজ বাবার চোখের কোণে ভয় কেন? তবে কি কিছু লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করছে বাবা! কি সেটা?
ওরা বেরিয়ে যাওয়ার পরে মা খুব স্বাভাবিক গলায় বলল, নে প্র্যাকটিস কর। তোর তো আবার স্টেজে ওঠার আগে বড্ড টেনশন হয়। দেবজিতের মনে হচ্ছিল ও বোধহয় আবার সেই ছোটবেলার জীবনে ফিরে গেছে। মা আবার আগের মত বকবে, শেখাবে….কত বছর পর যে এভাবে কথা বললো মা। দোষ কি শুধুই মায়ের ছিল, দেবজিতের ছিল না? মাকে ক্রমাগত অপমান করে দূরে সরিয়ে তো ওই দিয়েছিল। তাই হয়তো মা অমন নির্লিপ্ত ভাবে কাটিয়ে দিলো জীবনটা।
দেবজিত আদুরে গলায় বলল, আমি বলছি, ভুল হলে ঠিক করে দাও।
কতদিন পরে মা দেবজিতের মাথার চুলে হাত ডুবিয়ে আদর করে বললো, বল বল, সময় নষ্ট করিস না।
।। ১৩।।
বহু বছর পরে দেবজিত মাকে প্রণাম করে অফিস বেরোলো। সকাল থেকে মনটা অন্যরকম প্রশান্তিতে ভরে আছে কমলিকার। মনীন্দ্রর চোখে আতঙ্ক দেখেছে কাল রাতেই। ঈশার দৃষ্টিতেও ছিল হেরে যাওয়ার ভয়।
মনীন্দ্রর চোখে এই আতঙ্কটাই দেখতে চেয়েছিল কমলিকা, শুধু উপায়টা খুঁজে বের করতে পারছিল না। হয়তো খুঁজতে চায়নি ও। নিঃস্পৃহতাকেই একমাত্র অস্ত্র করে হারাতে চেয়েছিল মনীন্দ্রকে। ওর নিঃস্বার্থ ভালোবাসাকে যে মানুষটা মূলধন করতে চেয়েছিল, ওকে দুমড়ে মুচড়ে ভেঙে যে মানুষটা জিততে চেয়েছিল তাকে হারিয়ে এবারে কমলিকা জিততে চায়।
বিশ্বাস শব্দটার অর্থ বদলে দিয়েছে মনীন্দ্র, ওকে ওর পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে, এমনকি নিজের সন্তানদের পর্যন্ত বুকে জড়িয়ে ধরে কোনোদিন আদর করতে পারেনি ও। তাদের মনেও মা সম্পর্কে বিষ ঢুকিয়ে দিয়েছে ওই মানুষটা। কমলিকার হেরে যাওয়াতেই নাকি ওর সুখ, ওর প্রাপ্তি। চোখ দুটো আবারও জ্বালা করে উঠলো কমলিকার। না, আর নোনতা জলেদের অযথা বেরোতে দেবে না ও। মোবাইল একটা আছে ওর কিন্তু কখনোই তার ব্যবহার করে না ও। ওই মনীন্দ্রকে ফোন করে সংসারের কিছু লাগবে কিনা জিজ্ঞেস করা ছাড়া আর কোনো যোগাযোগ নেই কারোর সাথে। অ্যান্ড্রয়েড ফোনটা পড়েই থাকে ঘরের এক কোণে। দেবজিত চাকরি পেয়ে সবাইকে কিছু না কিছু দিয়েছিল, তখনই ওকে এই ফোনটা গিফট করেছিল। ফোনটা নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতেই ঈশাকে দেখতে পেল। বেশ দামি একটা পোশাক পরে গুণগুণ করতে করতে কোথাও একটা বেরোচ্ছে ও।
ইচ্ছে করছিল জিজ্ঞেস করে, কোথায় যাচ্ছিস?
জোর করে নিজের ইচ্ছেটাকে দমন করলো কমলিকা। ঈশার ব্যঙ্গাত্মক কথা শোনার ইচ্ছে একেবারেই নেই আজ সকালে। কত বছর পরে আবার দেবজিত ওকে প্রণাম করে বাড়ি থেকে বেরিয়েছে, সেই খুশিটুকু কিছুতেই নষ্ট করতে চায় না কমলিকা। ফোনটা ঘেঁটে ঈশার ইউটিউভ চ্যানেলটা বের করলো ও।
হেডফোনটা কানে লাগিয়ে শুনছিলো কবিতাগুলো। ভালই বলেছে ঈশা তবে কয়েকটা একটু বেশিই নাটুকে করে ফেলেছে। কবিতা আবৃত্তি আর নাটকের মধ্যে ছোট্ট একটা পার্থক্য আছে, এটা অনেকেই মনে রাখে না।
কলিংবেলের আওয়াজে একটু চমকে উঠলো ও। এইসময় তো কারোর আসার কথা নয়, তাহলে হয়তো সেলসের কেউ। উঠে গিয়ে দরজাটা খুলতেই একটা বছর ছাব্বিশের ছেলে আর একজন প্রায় ওরই সমবয়সী মহিলা দাঁড়িয়ে আছে গেটের সামনে।
একটু অপ্রস্তুত গলায় কমলিকা বললো, আপনারা? চিনতে পারলাম না তো!
ছেলেটি বেশ সপ্রতিভ গলায় বলল, আমি প্রবুদ্ধ, ঈশার ফ্রেন্ড। এই নামটা কমলিকা বেশ কয়েকবার শুনেছে ঈশার ফোনে। সেদিন তো প্রশ্নও করেছিল ঈশাকে, প্রবুদ্ধ কে? উত্তর না দিয়ে অপমান করে বেরিয়ে গিয়েছিল ঈশা।
কমলিকা বললো, ভিতরে এস। ছেলেটি বেশ চিন্তিত গলায় বলল, ঈশা এখন কেমন আছে আন্টি। ওর তো তিনদিন ধরে জ্বর, ফোনটা পর্যন্ত রিসিভ করতে পারছে না। ডক্টর দেখিয়েছেন? একবার কি ওর সাথে দেখা করা যাবে!
কমলিকা একটু হকচকিয়ে বললো, কিন্তু ঈশা তো অসুস্থ নয় প্রবুদ্ধ। ও তো রেকর্ডিংয়ে বেরিয়ে গেছে।
অর্কপ্রভ বলে কোনো ডিরেক্টারের ফোন এসেছিল। কালকেও তো গিয়েছিল, আজও বেরিয়ে গেছে।
প্রবুদ্ধ ধপ করে ড্রয়িংয়ে সোফায় বসে পড়লো। সব হারানোর গলায় বলল, মিথ্যে বললো কেন আমায়!
কমলিকার মনে পড়ে গেলো নিজের কথা, প্রথম যেদিন মনীন্দ্রর মিথ্যেগুলো জানতে পেরেছিল ও সেদিন ঠিক এভাবেই ভেঙে পড়েছিলো ও।
প্রবুদ্ধ পাশের ভদ্রমহিলা হাত জোড় করে নমস্কার করে বললো, আমি প্রবুদ্ধর মা। বিনোদিনী স্কুলের ইংরেজির শিক্ষিকা।
কমলিকাও নমস্কারের ভঙ্গিমায় বললো, আমি রিনা সেন, ঈশার মা।
ভদ্রমহিলার দুই ভ্রুর মাঝে একটা চিন্তার ভাঁজ। একটু আমতা আমতা করেই বললেন, আপনার সাথে আমার একজন ক্লাসমেটের খুব মিল খুঁজে পাচ্ছি, আমরা একসাথে ইলেভেন টুয়েলভ পড়েছি, কিন্তু তার নাম ছিল কমলিকা দাসগুপ্ত, ভীষণ ভালো কবিতা বলতো, দুর্দান্ত স্টুডেন্টও ছিল। আচ্ছা ও কি আপনার কেউ হয়? মানে মুখের বেশ মিল রয়েছে। যদি সে বহুবছর আগে দেখা হয়েছিল ওর সাথে।
নিজের নামটা শুনে কেমন যেন হয়ে গেল কমলিকা। এখনও কেউ মনে রেখেছে ওকে। প্রবুদ্ধর মায়ের দিকে অপলক তাকিয়ে কমলিকা বলল, শ্রেয়সী, শ্রেয়সী বিশ্বাস, ঝর্ণাদির বাংলার পিরিয়ডে বকা খেতিস, ইংরেজিতে তুখোড় ছিলিস, হিস্ট্রির স্যার বলতেন, কমলিকা এই মেয়েটার সালগুলো যে কি করে এত নিখুঁত মনে থাকে সেটাই আশ্চর্য হয়ে যাই। কোনো কোশ্চেনের উত্তর ভুল লিখলেও সাল কিন্তু নিখুঁত।
শ্রেয়সী ওকে জড়িয়ে ধরে বলল, স্কুলের যে কোনো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে প্রথমেই ডাক পড়তো কমলিকা দাশগুপ্তের, আর সারাজীবন চেষ্টা করেও তোর থেকে রেজাল্টে দু থেকে তিন নম্বর কম পেয়ে সেকেন্ড হয়ে যেতাম। কিন্তু তুই এখানে, এভাবে? রিনা সেন কেন রে?
ঈশার কথা আমি শুনেছি প্রবুদ্ধর মুখে, ওরা দুজনে দুজনকে ভালোবাসে, আমার ইচ্ছে ছিল ছেলে যাকে জীবনসঙ্গী করতে চাইছে তাকে নিজের চোখে দেখতে, কিন্তু তুই যে ঈশার মা এটা তো ভাবতেই পারিনি।
এটা আমার উপরি পাওনা, তোর মেয়ে কোনোদিন খারাপ হতেই পারে না।
কমলিকা স্থির গলায় বলল, তুই কেন ভুলে যাচ্ছিস শ্রেয়সী ওর গায়ে ওর বাবার রক্তও বইছে। তাই কি করে এতটা নিশ্চিন্ত হচ্ছিস যে ও ভালো হবেই।
প্রবুদ্ধ স্খলিত গলায় বলল, আন্টি, আমায় একবার ওর ঘরে নিয়ে যাবেন?
কমলিকা ইতস্তত করে বললো, আসলে আমি ওর ঘরে সেভাবে ঢুকি না। ও একদম অপছন্দ করে, কাজের মাসিই পরিষ্কার করে দেয় ওর ঘর। তবুও তুমি যখন যেতে চাইছো চলো।
প্রবুদ্ধ কমলিকা আর শ্রেয়সী ঢুকলো ঈশার ঘরে।
কমলিকা দেখছিলো নিজের মেয়ের ঘরটা। মেয়েটা এত বড় হয়ে গেল কবে। ঘরটার মধ্যে কেমন যেন নিষিদ্ধ নিষিদ্ধ একটা গন্ধ রয়েছে। দমবন্ধ হয়ে আসছে ওর।
প্রবুদ্ধ ওর কম্পিউটার টেবিল থেকে একটা ফ্রেম তুলে বললো, এটা আমি ওকে গিফট করেছিলাম, আমাদের দুজনের ছবি রাখবো বলে। ঈশা তো দেখছি ফ্রেমটা অলরেডি ইউজ করে ফেলেছে, অর্কপ্রভর ছবি রেখে, এই তো সেদিন পরিচয় হলো ওর অর্কর সাথে, আমার মাধ্যমেই। কবে হলো ওরা এতটা ইন্টিমেট?
কমলিকা প্রবুদ্ধর কাঁধে আলতো করে একটা হাত রেখে বললো, জানি মেনে নেওয়া খুব কষ্টকর, তবুও বলছি, ঈশা বোধহয় কোনোদিনই তোমায় ভালবাসে নি। ঈশা, ঈশার বাবা এরা ভালোবাসতে জানে না, এরা সিঁড়ি বানায় ওদের প্রতি দুর্বল মানুষকে দিয়েই।
প্রবুদ্ধ ঈশার নম্বরে কল করলো, বার দুয়েক পরে ফোনটা রিসিভ করলো ঈশা। বিরক্ত গলায় বলল, প্রবুদ্ধ তোমায় আমি বলেছিলাম, আমি অসুস্থ। বাড়িতে শুয়ে আছি। মা দিনরাত নজরে রাখছে, ফোন ধরাটাও অসুবিধাজনক। প্লিজ আপাতত কল করো না আমায়। আমি সুস্থ হয়ে কল করবো তোমায়।
প্রবুদ্ধর চোখ থেকে দুফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল ওর অজান্তেই। পুরুষের চোখে জল সহজে আসে না। ছোট থেকেই ওরা কষ্টগুলো লুকতে শেখে, তাই প্রবুদ্ধর চোখের জল দেখে কমলিকারও মনটা কেমন করে উঠলো।
মনীন্দ্রর কুম্ভীরাশ্রু বোঝার বয়েস সেদিন ছিল না ঠিকই কিন্তু আজ অভিজ্ঞ চোখে বুঝতে পারলো ছেলেটা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে।
শ্রেয়সীর কাছে নিজের জীবনের সবটা বলে বহুদিন পরে হালকা লাগছে কমলিকার। পাশে চুপচাপ শুনছিলো প্রবুদ্ধ। আচমকা বলে উঠলো, আন্টি আমি তো আপনার ছেলের মত, আমায় একটু হেল্প করবেন?
একজনের অহংকারে আঘাত করতে চাই, করবেন হেল্প?
কমলিকা মাথা নেড়ে বললো, আমার মেয়ে দোষী, তোমার বিশ্বাস নিয়ে সে ছিনিমিনি খেলেছে, এর কিছুটা ভাগ যে আমাকেও নিতে হবে প্রবুদ্ধ। বলো, কি ভাবে হেল্প করবো তোমায়?
প্রবুদ্ধ বললো, আপনি বলুন, আপনি কোন সময়টা ফ্রি থাকেন, আমি নিজে আসবো গাড়ি নিয়ে আপনাকে নিয়ে যেতে, আমার একটা কাজ আপনাকে করে দিতে হবে।
শ্রেয়সী বললো, বাবুই, দেখিস আন্টি যেন আর কষ্ট না পায়, এটাই যে আমাদের স্কুলের সেই ট্যালেন্টেড কমলিকা দাসগুপ্ত সেটা বিশ্বাস করতেই যে কষ্ট হচ্ছে রে, একটা গোটা জীবনকে তুই এভাবে শেষ করে দিলি কলি? মানতে পারছি না বিশ্বাস কর, তোকে সারাজীবন জিততে দেখে দেখে ওটাই অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল রে, মঞ্চে উঠে সব বিষয়ে ফার্স্ট প্রাইজ তুই নিবি এটা বোধহয় আমাদের চোখ সওয়া হয়ে গিয়েছিল। তোকে এমন আটপৌরে দেখতে ইচ্ছে করে না কমলিকা। ঈশার মা হয়েও তুই নিজের মেয়ের দোষটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলি, ওকে গার্ড করার কোনো চেষ্টাই করলি না দেখেই বুঝতে পারলাম, রিনার মধ্যে আমার পরিচিত সেই প্রতিবাদী কলি এখনো বেঁচে আছে। বাবুই ঈশার সাথে তোর সম্পর্কটা নষ্ট হয়ে গেছে বলে যেন তুই আন্টির সাথে খারাপ কিছু করিস না।
প্রবুদ্ধ যন্ত্রণা মাখা গলায় বলল, মা সব শোনার পর আমি আন্টিকে শুধু শ্রদ্ধা নয়, ভালোও বেসে ফেলেছি, তাই কোনো ক্ষতি করবো না কারোর।
কমলিকা মুচকি হেসে বললো, ওরে শ্রেয়সী তুই কলিকে চিনতিস, রিনাকে নয়, রিনার সহ্য ক্ষমতা সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই তোর। তোর এই মিষ্টি ছেলে আমার মত মৃত মানুষের আর কি ক্ষতি করবে রে!
প্রবুদ্ধর মুখে হারিয়ে ফেলার যন্ত্রণা, চোখের দৃষ্টিতে বিশ্বাস করে প্রবঞ্চিত হওয়ার উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টি কমলিকাকে বারবার নিজের সর্বস্ব হারিয়ে হেরে যাওয়ার দিনটার কথা মনে করিয়ে দিচ্ছিল। এতদিন পর্যন্ত কমলিকার দৃঢ় ধারণা হয়েছিল, পুরুষ মানুষরাই বুঝি এভাবে ঠকাতে পারে। আজ প্রবুদ্ধর নিঃস্বার্থ ভালোবাসার বিনিময়ে ঈশার বেইমানি কমলিকার ধারণার পরিবর্তন করে দিলো। নিজের মেয়ে যে কাউকে এভাবে ইউজ করে দূরে ঠেলে দিতে পারে এমনটা কল্পনাও করতে পারেনি ও।
মনে মনে বললো, রক্ত বোধহয় এভাবেই কথা বলে। মনীন্দ্রর বেইমানের রক্ত ঈশার ধমনীতে বইছে, তাই তো এ ভাবে কষ্ট পাচ্ছে প্রবুদ্ধ।
কোনো কথা না বলে কমলিকা প্রবুদ্ধর কাঁধে একটা হাত রাখল। প্রবুদ্ধ অস্ফুটে বললো, বড্ড ভালোবেসেছিলাম আন্টি ঈশাকে, বুঝতেও পারিনি এভাবে ও আমাকে অন্ধকারে ঠেলে দিতে পারে।
কমলিকা দৃঢ় অথচ ধীর গলায় বলল, আর যদি বিয়ের পরে বুঝতে পারতে ঈশা তোমায় কোনোদিন ভালোই বাসেনি, তাহলে তো গোটা জীবনটা দিনগত পাপক্ষয়ের মত টেনে বেড়াতে হতো। তার থেকে তো এই ভালো হলো প্রবুদ্ধ, ভোলার সময় পাবে, নতুন জীবন গড়ে তোলার সুযোগ পাবে। আন্টিকে দেখে বুঝতে পারছ না, ভুলের মাশুল গুণছে আজও।
শ্রেয়সী বললো, আমি একটা ভালো মেয়ের সম্বন্ধ দেখেছি জানিস কলি, কিন্তু ছেলে যখন কিছুতেই রাজি হচ্ছে না, তখনই জানলাম ঈশার কথা।
কমলিকা স্থির বাষ্প শূন্য চোখে তাকিয়ে বললো, একটা অনুরোধ করবো প্রবুদ্ধ, ঈশা ফিরে এলেও ভেবে দেখো।
।। ১৪।।
এতকালের চেনা জীবনটা একটু একটু করে পাল্টে যাচ্ছে কমলিকার। আজ তাড়াতাড়ি অফিস থেকে ফিরে মনীন্দ্র দেখলো কমলিকা বহুদিন পরে খুব সুন্দর করে গুছিয়ে সেজেছে। এখনো সাজলে মনীন্দ্রর বুকের ভিতর কম্পন হয়। রাগে ফেটে পড়তে ইচ্ছে করে। সুন্দর কমলিকাকে যেন কিছুতেই সহ্য হয়না ওর। আটপৌরে, নিজের ব্যাপারে উদাসীন, কর্তব্যে ত্রুটিহীন কমলিকাই যেন ওর জয়ের মুকুট। কমলিকার চোখে হালকা কাজলের রেখায় আবারও যেন পুরোনো দম্ভকে দেখতে পেল মনীন্দ্র।
কৈফিয়ৎ নেবার উদ্দেশ্যেই জিজ্ঞেস করলো, বিকেলবেলা সেজেগুজে কোথায় চললে?
কমলিকা শান্ত গলায় বলল, জিতের জন্য পাত্রী ঠিক করতে।
মনীন্দ্র একটু থতমত খেয়ে বললো, মানে? আমি তো অলরেডি দেবজিতের পাত্রী ঠিক করছি রিনা। হঠাৎ তুমি কেন?
কমলিকা কাটা কাটা শব্দে বললো, তুমিও যেমন যাকে প্রাণ দিয়ে ভালোবেসেছিলে তাকেই বিয়ে করেছিলে, আমিও চাই তোমার ছেলেও যাকে ভালোবাসে তাকেই বিয়ে করুক। বাবার ট্র্যাডিশন বজায় রাখুক, তুমিও যেমন ভালোবাসার জন্য একসময় বাজি রেখেছিলে, সরল একটা মেয়ের বিশ্বাস, তার বাবার সম্পত্তি, মেয়েটির আত্মমর্যাদা, সর্বোপরি তার ভালোবাসার গভীরতা….তেমনি তোমার ছেলেও আজ বাজি রাখবে তোমার সম্মান। চিন্তা করো না, তোমাদের চিরশত্রু শংকর মিত্রের মেয়ে দময়ন্তীর সাথেই বিয়ে হবে দেবজিতের।
মনীন্দ্র চিৎকার করে বললো, প্রতিশোধ নিচ্ছ আমার সাথে? পারবে না, জিত তোমায় ঘৃণা করে, বুঝলে, ও আমার কথা শুনবে।
মনীন্দ্রর কথা শেষ হবার আগেই কলিংবেলের আওয়াজ।
দরজা খুলতেই দেবজিত বললো, মা তুমি রেডি, চলো, আমি মেসেজ করে দিয়েছি দময়ন্তীকে। ওর কাছে এখনও ব্যাপারটা স্বপ্ন জানো মা। আমি বলেছি, সবটা সম্ভব হচ্ছে আমার মায়ের জন্য।
মনীন্দ্র পিছন থেকে চিৎকার করে বললো, জিত তুমি কোথাও যাবে না। আমি তোমার জন্য অলরেডি পাত্রী নির্বাচন করে ফেলেছি।
দেবজিত বোধহয় এই প্রথম বাবার মুখের সামনে দাঁড়িয়ে বললো, না বাবা, আমি তোমার ছেলে হয়ে পণ নিয়ে বিয়ে করতে পারবো না। তুমি মাকে বিয়ে করে এক কন্যাদায়গ্রস্ত পিতার দায়িত্ব লাঘব করেছিলে, আমি তো তোমারই ছেলে। আর তুমি যেমন মাকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিলে, আমিও তেমন দময়ন্তীকে ভালবাসি।
কমলিকা স্মিত হেসে বললো, সেদিন যদি তোর বাবা আমায় বিয়ে না করতো তাহলে হয়তো গরিবের এই মেয়েটি লগ্নভ্রষ্টা হত, তাই না মনীন্দ্র?
মনীন্দ্র আর কথা না বলে জোরে জোরে পা ফেলে ঘরে চলে গেল।
ছেলে মেয়েদের কাছে নিজেকে হিরো বানানোর জন্য মনীন্দ্র কমলিকা আর ওর পরিবারের নামে কত যে মিথ্যে বলেছে এত বছর সেটা ও এখন জানতে পারছে।
দময়ন্তীর বাবা, মা সবাই রাজি দেবজিতের সাথে মেয়ের বিয়ে দিতে। ওরা শত্রুতা টিকিয়ে রাখতেই চায়না।
দময়ন্তীর বাবা তো পরিষ্কার বলেই দিলো, কবে কি হয়েছিল সেসব আমি ভুলেই গেছি। মেয়ে যাকে জীবনসঙ্গী করতে চায় সে যখন যোগ্য, তখন আপত্তি কিসের?
দময়ন্তী আর দেবজিতের আড়চোখের চাউনিটা দেখে কমলিকার মনে হলো, বহুবছর পরে সেন বাড়ির মুখে একটা জোরে থাপ্পড় মারতে পারলো ও। নিজের সন্তানকে চোখের সামনে পর হয়ে যেতে দেখলে কেমন অনুভূতি হয় কমলিকা বুঝেছে খুব ভালো করে। আর এর পিছনে যে মনীন্দ্র আর ওর পরিবারের নিখুঁত বুদ্ধি কাজ করেছে সেটা কমলিকা বুঝেও কিছু করতে পারেনি। ওদের মিথ্যাগুলো বুঝেও অসহায়ের মত তাকিয়ে থাকতে হয়েছিল ওকে।
রাস্তায় বেরিয়েই দেবজিত মাকে জড়িয়ে ধরে বলল, লাভ ইউ মা। আর এত বছরের আমার সব ব্যবহারের ক্ষমা বোধহয় হয় না, তাই আমিও চাইছি না ক্ষমা। শুধু একটুই বলবো, তুমি শুধু ঋণীই করে গেলে আমাকে।
কমলিকা পুত্রস্নেহের উষ্ণতায় নিজেকে ডুবিয়ে দিয়ে বললো, বললি না তো তোর কবিতা কেমন হলো?
দেবজিত উচ্ছসিত হয়ে বলল, ওরে বাপরে সবাই তো মারাত্মক হাততালি দিলো। বললো, এমন পারফেক্ট কবিতা আর এত সুন্দর আবৃত্তি যে প্রশংসা না করে পারা যায় না। তবে জানো মা, আজ আমি স্টেজে আমার সব ক্রেডিটটুকু তোমায় দিয়েছি। বলেছি, সবটাই হয়েছে আমার মায়ের জন্য। কলিগরা একদিন তোমার কবিতা শুনতে চেয়েছে জানো!
কমলিকা মুচকি হেসে বললো, তুই কত বড় হয়ে গেলি জিত।
জিত ঠোঁট উল্টে বললো, মা তুমি একটু আগে দময়ন্তীর সাথে আমার বিয়ের কথা ফাইনাল করতে গিয়েছিলে, আর এখনও আমি বড় হবো না!
কমলিকা আলগোছে বললো, আসলে বড্ড আফসোস হয় রে, তোদের বড় হওয়ার মুহূর্তগুলো একই ছাদের নিচে থেকেও আমি উপলব্ধি করতে পারলাম না।
দেবজিত অসহায় গলায় বলল, আচ্ছা মা, বাবা কেন তোমার বিরুদ্ধে আমাদের কাছে বলতো ছোট থেকে, কেন বলতো, মা কিছু জানে না, মা কিছু শেখাতে এলে যেন আমরা না শিখি, কেন মা?
কমলিকা অন্যমনস্কভাবে বললো, নিজের চরিত্রের কালো দিকটা ঢেকে রাখতে চেয়েছিল হয়তো।
কথাটা বোধহয় জিতের কান অবধি পৌঁছলো না। তার আগেই ও বাড়ির কলিংবেলটা টিপল। মনীন্দ্র দরজা খুলতেই ঈশা এসে বেশ বিরক্তির গলায় বলল, দাদাভাই তোর রুচিটা দিন দিন বড্ড চিপ হয়ে যাচ্ছে রে, দময়ন্তীর মত একটা সাদামাটা মেয়েকে তোর পছন্দ হলো কি করে রে!
ভাবতেই লজ্জা করছে, তুই ঈশা সেনের দাদাভাই। আরে তোর বোনের গলা হিট মুভিতে ব্যবহার করা হচ্ছে, তোর বোনের মুখও দেখবি দুদিন পরে রূপালী পর্দায়, আর তুই কিনা পাড়ার একটা অতি সাধারণ মেয়েকে বিয়ে করতে চাইছিস, আমায় দেখে তো শিখতে পারিস রে, আমি মিডিলক্লাস মেন্টালিটি ছেড়ে ওপরে ওঠার চেষ্টা করছি, আর তুই কিনা….
ঈশাকে মাঝপথে থামিয়ে কমলিকা বললো, দেখো ঈশা, এতটাও ওপরে উঠে যেও না যেখান থেকে মাটির দূরত্বটা বড্ড বেশি হয়ে যায়, আরও বেটার খুঁজতে গিয়ে অনেক সময় মানুষ কিন্তু বেস্টটাকেও ভুল করে হারিয়ে ফেলে, পাখিরাও কিন্তু দিনের শেষে আকাশ থেকে নেমে আসে নিজের বাড়ির সন্ধানে।
ঈশা ব্যঙ্গাত্মক স্বরে বললো, কি ব্যাপার পাপা, মিসেস রিনা সেনের মুখে আজ একটু বেশিই কথা শুনতে পাচ্ছি যে গো, প্লিজ পাপা, ওনাকে নিজের জায়গাটা বুঝিয়ে দিও এ সংসারে।
দেবজিত বিরক্ত স্বরে বললো, ঈশা, মায়ের সাথে ভদ্রভাবে কথা বল। এখনও তো তোর দিনটা শুরু হয় মায়ের করা চা খেয়েই।
ঈশা অবাক চোখে তাকিয়ে বলল, দাদাভাই তোর মাথার ঠিক আছে তো! তুই ওই মহিলাকে কবে থেকে মা বলে সম্মান করতে শুরু করলি রে, ওই দময়ন্তীর সাথে তোর বিয়ে ঠিক করে এলো বলেই আজ ওই মহিলা দ্য গ্রেট মাদার হয়ে গেল!
দেবজিত শান্ত স্বরে বললো, দময়ন্তী আর দুদিন পরেই এ বাড়ির বউ হবে, তাই আমি চাই তুই তার সম্পর্কে একটাও ফালতু কথা না বলিস। মনীন্দ্র হালছাড়া গলায় বলল, তার মানে সব জানা সত্ত্বেও তুমি ওই মিত্র বাড়ির মেয়েটাকেই বিয়ে করবে?
দেবজিত হেসে বললো, আমরা কি আদৌ সব সত্যি জানি বাবা! কেন তুমি দিনের পর দিন আমাদের দিয়ে মাকে অপমান করিয়েছ, সেটার হদিস কি আমার কাছে আছে?
ছেলের সামনে নিজের মুখোশ উন্মোচন হয়ে যাবে ভেবেই বোধহয় মনীন্দ্রর দৃষ্টিতে ভয়ের আভাস, মুখের রেখায় তীব্র অস্বস্তি। কমলিকা অপলক তাকিয়ে আছে মনীন্দ্রর দিকে। চোখাচোখি হতেই প্রায় দৌড়ে নিজের ঘরের ঢুকে গেলো ও। দেবজিত এখন বড় হয়েছে, বোঝার ক্ষমতা হয়েছে তাই তাকে আর ভুল বোঝাতে পারবে না মনীন্দ্র সেটা ভেবেই হয়তো হতাশার অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছে ও।
কমলিকা এতদিন মারাত্মক নিঃস্পৃহ ছিল বলেই জিতে যাচ্ছিল মনীন্দ্র। ছেলেমেয়ের সামনে হিরো সেজে ছিল। মাটিতে নামিয়ে দিয়েছিল কমলিকার সম্মান, কিন্তু যদি এত বছর পরে কমলিকা সত্যিই মুখ খোলে তাহলে তো জিত আর ঈশার চোখে ঘৃণার পাত্র হয়ে যাবে মনীন্দ্র। এই বয়েসে ছেলেমেয়ের চোখে অসম্মানের দৃষ্টি দেখার চেয়ে মৃত্যু শ্রেয়।
দেবজিত ভালো টাকা দেয় সংসারে, বড় চাকরি করে, তাই বোধহয় মনীন্দ্রর ওর মতের বিরুদ্ধে যেতে না পেরেই চুপ করে গেছে দময়ন্তীর সাথে ওর বিয়ের ব্যাপারে।
কমলিকা শুনতে পেল, ফোনে দিদিকে বলছে, জিতের বিয়ে অন্যত্র ঠিক হয়েছে, ওদের না বলে দিস।
ঠোঁটের এক কোণে তৃপ্তির হাসি নিয়ে বহু বছর পরে নিশ্চিন্তে ঘুমালো কমলিকা।
ঘড়ির কাঁটায় তখন সকাল এগারোটা। সেন বাড়ির দরজায় এসে থামলো প্রবুদ্ধর দামি গাড়িটা।
কমলিকা ওর খুব পছন্দের হালকা সবজে লক্ষ্নৌ চিকনের শাড়িটা পরে বেরিয়ে এলো বাড়িতে তালা দিয়ে।
আজ প্রবুদ্ধর চোখে মুখে একটা জেদের প্রতিচ্ছবি দেখলো কমলিকা। আগের দিনের কষ্ট ক্লান্ত মুখটা দেখে বড্ড কষ্ট হয়েছিল ওর।
গাড়িতে উঠতেই প্রবুদ্ধ বললো, আন্টি আপনাকে এরকম পর পর দিন পাঁচেক যেতে হবে আমার সাথে, আর আমি যেভাবে বলবো আপনি ভয় না খেয়ে সেভাবে করবেন কাজটা। ভয়! এককালে কমলিকা দাশগুপ্তের স্মার্টনেস নিয়ে লোকজন আলোচনা করতো, সেসব দিন অবশ্য রাতের তারার গভীরেও লুকিয়ে নেই, হারিয়ে গেছে চিরকালের মত।
প্রবুদ্ধ বললো, যা নিতে বলেছিলাম নিয়েছেন তো। কমলিকা হালকা হেসে বললো, না সেটা নিই নি, তবে নিয়েছি একটা অত্যন্ত কাজের জিনিস।
দিন পাঁচেক নয়, প্রায় দিন সাতেক প্রবুদ্ধর সাথে ওর কথা মত গিয়েছিল কমলিকা, ছেলেটা যেন পুরোনো কমলিকা দাসগুপ্তকে বাঁচাতে বদ্ধ পরিকর। এই সাতদিনেই ওর মনে হচ্ছে রিনা সেন বদ্ধ কুঠুরি থেকে বলছে, আমাকে মেরে ফেললে কমলিকা? আয়নার পারদ পর্যন্ত অবাক চোখে দেখছে ওকে, কমলিকা লজ্জা পেয়ে বলেছে, কি দেখছো? আয়নার পরিষ্কার উত্তর, মৃত মানুষকে জীবিত হতে দেখলাম যে।