সহযাত্রী – ১
।। ১।।
তুই বল স্বর্ণালী, ছেলেরা কবে ভালোবাসা শব্দের অর্থ বুঝেছে রে? আর দ্যাট বয়, এই সৃজন তো রীতিমত ইরিটেটিং হয়ে উঠেছিল রে। ওর কাছে মডার্ণ শব্দের অর্থ বারে বসে ড্রিং করা আর ওয়েস্টার্ন ড্রেস পরা। না রে অনেক চেষ্টা করেছিলাম মানিয়ে নেওয়ার, বাট আল্টিমেট রেজাল্ট ইস এ বিগ জিরো। তুই একটা কথা বল স্বর্ণালী, কেন আমাকে আমার প্রিয় চুড়িদার, জিন্স-টপ ছেড়ে শর্ট পোশাক পরতে হবে? কেন আমায় মাঝরাতে পার্টিতে গিয়ে উত্তাল নাচতে হবে? শুধু ভালোবাসতাম বলে? গো টু হেল। ওর জব, ওর ফ্যামিলি সবকিছু মারাত্মক গুরুত্বপূর্ণ আর আমি যেহেতু স্কুল টিচার, তাই আমার নাকি তেমন কোনো কাজই থাকে না স্কুলে। না রে, বিয়ের আগেই এত টালবাহানা, না জানি বিয়ের পরে কি করবে! দিন দিন আমিও ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছিলাম।
কি বলছিস? না ট্রেন এখনো ছাড়ে নি। মা, বাবা এখনো জানে না সৃজনের সাথে আমার ব্রেকআপ হয়েছে। আসলে কি বলতো, এতদিন ধরে ওরা জেনে এসেছে, সৃজনের সাথেই আমার বিয়ে হবে। তাই বাবা, মা মুখে কিছু না বললেও মোটামুটি স্যাঙ্গুইন ছিল। এখনই ব্রেকআপের খবরটাও দিতে পারিনি। তাছাড়া কি বলবো বলতো, মাস তিনেক ধরে আমি নিজেই কাজ নিয়ে একটু ব্যস্ত ছিলাম। সৃজন অলরেডি ওদের অফিসের একটা মেয়ে রাকার সাথে ডিস্কে গিয়েছিল বার চারেক জানিস? আমাকে ওরই বন্ধু অর্জুন ওদের দুজনের ঘনিষ্ঠ মুহূর্তের ছবি পাঠিয়েছে। এখন তো রাকাকে নিয়ে ঘুরেও বেড়াচ্ছে। আমি প্রশ্ন করায় ও পরিষ্কার বললো, প্রেম করলে বুঝি বান্ধবী থাকতে নেই?
না রে স্বর্ণালী, সৃজনের সাথে আমার মধ্যবিত্ত পজেসিভ মানসিকতার কোনো মিল নেই বুঝলি।
আসলে কি বলতো, ছেলেদের মন বলেই কিছু নেই। এখন ও চাইছিলো, ঘরে একটা বউ রেখে বাইরে অন্যদের নিয়ে ঘুরে বেড়াবে। এনাফ হয়ে গেছে রে। সেলফ রেসপেক্ট বলেও তো একটা কথা আছে। তাছাড়া আমি আপাতত দার্জিলিং যাচ্ছি, নিজের সাথে নিজে কিছুটা সময় কাটাবো বলে একান্তে। অনেকগুলো প্রশ্নের উত্তর পাইনি বুঝলি! তাই পাহাড়ের কোলে বসে ওদের সাদামাটা জীবনের সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে খুঁজবো নতুন করে। হয়তো বলবি, ব্রেকআপের পর সব মেয়েরাই লাভারের নামে দোষ দেয়, কিন্তু বিশ্বাস কর, আমি সৃজনের নামে দোষারোপ করছি না। তবে ওর মত অনুযায়ী চলতে চলতে আমি জাস্ট হাঁপিয়ে গেছি রে। সৃজনও ভীষণ ক্লান্ত আমাকে নিয়ে। ও নিজেই স্বীকার করলো সেটা। পরিষ্কার বললো, আমার মত ব্যাকডেটেড মেয়েকে নিয়ে নাকি ও হাঁপিয়ে উঠেছে। ও ফাস্ট লাইফ লিড করতে চায় রে। তাই আমি ওর জীবনে বড্ড বেমানান। দুজনেই যখন বুঝে গেছি আমরা মারাত্মক মিসম্যাচ তখন আর কেন টেনে বেড়ানো!
যাকগে, আপাতত রাখলাম। ডোন্ট ওরি, তুই তো আমায় চিনিস সেই ছোট থেকে, মনের ক্ষতটাকে রাখতে জানি মনের মধ্যেই। পরে কল করবো। দিন পাঁচেক পরে ব্যাক করছি, তারপর মিট করবো।
দেবলীনার কথা শেষ হবার আগেই দার্জিলিং মেল সামান্য নড়ে উঠে জানাল দিলো, এবারে চলো। পিছনে পড়ে রইলো শিয়ালদহর জনবহুল স্টেশন। জীবনে প্রথম বার বাবা, মাকে একটা বড় মিথ্যে বলেছে দেবলীনা। বলেছে স্কুল এক্সকারসনে যাচ্ছে। আসলে যাচ্ছে সম্পূর্ণ একা। একা যাবে শুনলে মা কিছুতেই যেতে দিত না, তাই বাধ্য হয়েই মিথ্যে বলতে হয়েছে।
এসি থ্রি টায়ারে বসে জানালার দিকে এক মনে তাকিয়ে থাকলো দেবলীনা। আগে ঘনঘন ফোন চেক করাটা একটা নেশা হয়ে গিয়েছিল, হয়তো সৃজন মেসেজ করেছে, তাই চেক করতো। কিন্তু গত দু তিনমাস ধরে অভ্যাসটা কমতে কমতে বাতিলের দলে চলে গেছে। পার্স থেকে হেডফোনটা কানে গুঁজে অরিজিৎ সিং কিংবা শ্রেয়া ঘোষালে মনোনিবেশ করার চেষ্টা করছিল দেবলীনা। ঠিক তখনই সামনের সিটের ছেলেটা ফোনে বেশ জোরে জোরে কথা বলতে শুরু করে দিলো। কেউ কেউ ভুলেই যায়, পাবলিক প্লেসে ফোনে কথা বলার সিস্টেমটা।
ছেলেটা বলছিলো, কেন যে তুমি এত চিন্তা করো রাই, আরে আমি তো ট্রেন ছাড়লেই মেসেজ করতাম। পাগলী, সোনা আমার। বিয়েটা হয়ে গেলে তো তোমাকে সঙ্গে করেই নিয়ে যেতাম। তারপর গলাটা একটু নামিয়ে বললো, সামনে একজন মেয়ে বসেছে। বয়েস আমার থেকে বছর দুয়েকের ছোটই হবে বুঝলে। ওই পাশে একটা ফ্যামিলি রয়েছে। নানা, সোনা, তুমি থাকতে আমি কি অন্যের দিকে তাকাতে পারি? তাছাড়া মেয়েটার সবে ব্রেকআপ হয়েছে, তাই নিজেকে একটু সামলেই রেখেছি।
কি বলছ, দেখতে? ওই আরকি সো সো, তোমার মত অত সুন্দরী নয় সোনা। আচ্ছা শোনো, সিগন্যাল চলে যাচ্ছে, আর মেয়েটা তোমার বেবির দিকে কটমট করে তাকাচ্ছে, তাই এখন রাখছি। তুমি ভাবলে কি করে কেউ আমায় মলেস্ট করবে আর আমি সহ্য করবো? নো ওয়ে সোনা, পুচু, তোমার দিগন্ত সব সামলে নেবে। গুড নাইট পুচু মনা।
সহ্যের একটা সীমা থাকে, দেবলীনা সামনের ছেলেটার স্পর্ধা দেখে অবাক হয়ে যাচ্ছিল। একে তো কান পেতে ওর আর স্বর্ণালীর কথা শুনেছে, তারপর আবার নিজের গার্লফ্রেন্ডের কাছে ফলাও করে সেসব কথা বলছিল। হাও ডেয়ার হিম! এতক্ষণে ছেলেটার দিকে সোজাসুজি তাকালো দেবলীনা। দেখতে শুনতে মন্দ নয়, ড্রেস সেন্সও ঠিক ঠাক, অথচ রুচিটা দেখো, মিনিমাম সৌজন্যতা নেই। দেবলীনার সব থেকে রাগ ধরেছে, ওকে দেখতে সো সো বলাটা। ওর বয়ফ্রেন্ড সৃজন ছিল মারাত্মক নাকউঁচু পাবলিক। সে পর্যন্ত স্বীকার করেছিল, হয়তো দেবলীনার থেকে মডার্ন মেয়ে ও পেয়ে যাবে জীবনসঙ্গী হিসাবে, কিন্তু সুন্দরী নয়। সেখানে অপরিচিত একটা ছেলে ওর ব্রেকআপের খবর শুনে আহ্লাদিত হয়ে উঠেছে ভাবলেই পায়ের বুড়ো আঙুলের রক্ত ডিরেক্ট মাথায় উঠে যাচ্ছে।
দেবলীনার মনটা এমনিই ভাল নেই। কলিগ থেকে আত্মীয়-স্বজনরা সবাই মোটামুটি জানে ও একজনকে ভালোবাসে, তার সাথেই ওর বিয়েটা হবে। হয়তো সবাই সৃজনের নাম জানতো না, বা ওকে চিনতো না, কিন্তু একজনের উপস্থিতি তো ছিল। তাদের কাছে এখন কি বলবে সেই ভাবনাটাই ঘুরে ফিরে আসছে। ও সৃজনের মত উচ্চবিত্ত ফ্যামিলিতে বিলং করে না। ওর বাবাও শিক্ষক, মা নেহাতই হাউজ ওয়াইফ, তাই ওরা মধ্যবিত্ত মানসিকতাতেই অভ্যস্ত। একজনের সাথে বিয়ে হবে প্রায় ঠিক অথচ হচ্ছে না, কথাটা বলা অতটাও সহজ নয়। হাজারখানেক প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে দেবলীনাকে। এরকম মনের অবস্থায় সামনের এই সুপুরুষ জোকারটারটা বসে বসে ওর নামে উল্টো পাল্টা বকেই চলেছে, অসহ্য হয়ে যাচ্ছে ব্যাপারটা।
দেবলীনা বিরক্ত হয়ে কটকট করে তাকালো ছেলেটার দিকে। স্কুলের স্টুডেন্টরা ওর আড়ালে বলে, দেবলীনা ম্যাম একবার তাকালেই ভয়ে কুপোকাত হই আমরা। তিনবছরের স্কুলের সেই ভরসাতেই ছেলেটিকে ভয় পাওয়াতে চাইলো দেবলীনা। হিতে বিপরীত হলো।
ছেলেটি কাঁচুমাচু মুখ করে বললো, সরি ম্যাম, আসলে আমার ফিঁয়াসে বড্ড কিউট আর একটু সন্দেহবাতিক, তাই আপনাকে কম সুন্দরী বলতে বাধ্য হয়েছিলাম। আসলে কিন্তু এটা সত্যি নয়।
রাগে গোটা শরীর জ্বলে গেল দেবলীনার, ভেবেছে কি ছেলেটা!
।। ২।।
ট্রেনের কামরার অনেক মানুষই লাইট নিভিয়ে শোওয়ার বন্দোবস্ত করছে দেখেই, ব্যাগ থেকে ডিনার বক্সটা বের করলো দেবলীনা। রাতের ট্রেনে ও বরাবরই খুব হালকা খাবার খেতে পছন্দ করে। বাবা, মায়ের সাথেও যখন ট্যুরে যায় তখনও মায়ের গরম গরম লুচি বা বাবার ত্রিকোণা পরোটার প্ল্যান ক্যানসেল করে ও বরাবর রুটি-আলুর তরকারির পক্ষে লড়াই করে। আজ যেহেতু সম্পূর্ণ একা যাচ্ছে, তাই আর লড়াই করতে হয়নি। মা বক্সে তিনটে রুটি আর অন্য কন্টেইনারে তরকারি ভরে দিয়েছে। মায়ের হাতের খাবার আর নরম যত্নের ছোঁয়াটুকুতেই মনটা অবসন্ন হয়ে গেল দেবলীনার। আজ অবধি কোনো ট্যুরে ও একা যায়নি। বাবা, মাকে ছাড়া বাইরে বেড়াতে যাওয়া এই প্রথম। ইউনিভার্সিটির হোস্টেলে থাকতে একবার বন্ধুরা মিলে ছোট ট্যুর করেছিল বটে, কিন্তু সেখানেও বাবা ট্রেনে তুলে দিতে এসেছিল। মনটা কেমন ফাঁকা হয়ে গেল ওর। একা থাকবে বলেই তো দার্জিলিং যাচ্ছে আর একা হওয়ার ভয়ে কাতর হচ্ছে ওর অবাধ্য শাসন না মানা মন।
নিজের মনটাকেই এখনো ঠিক মত চিনতে পারলো না দেবলীনা। স্বর্ণালীকে বলা ওর কথাগুলো যে কেউ শুনলে ভাববে, ও হয়তো ভীষণ ভাবে চাইছিলো সৃজনের সাথে ওর ব্রেকআপটা হয়ে যাক। আসলে কি তাই? যদি তাই হবে তাহলে এখনো কেন সৃজনের হোয়াটসআপের মেসেজগুলো ডিলিট করতে পারেনি ও! কেন এখনও ফটো গ্যালারিতে রাখা সৃজনের ছবিগুলো ওপেন করে অপলক তাকিয়ে থাকে!
এক্সকে খারাপ বলাটা বোধহয় হিউম্যান সাইকোলজির একটা পার্ট। প্রাক্তনকে খারাপ প্রতিপন্ন না করলে নিজেকে নিখুঁত মানুষ সাজানোর প্রচেষ্টাটা সফল হয় না।
তাই কি ও সৃজনকে অপরাধী তৈরি করছে!
হতেই তো পারে সৃজনের সাথে এতদিন পর্যন্ত ওর মতের মিল হতো, এখন হচ্ছে না। দুজন প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষ বুঝেছে যে তারা মিসম্যাচ, আর আবেগ দিয়ে জীবন চলে না। তাই তারা ব্রেকআপ করেছে, এতে এত সমস্যা কোথায়!
প্রাক্তন মানুষটার সবটা খারাপ তো নয়। সৃজন ভীষণ স্মার্ট, বেশ ম্যানলি একটা ব্যাপার আছে ওর মধ্যে। ওর কাছ থেকে অনেক কিছু শিখেওছে দেবলীনা। সৃজনই প্রথম ওকে বলেছিল, দেবলীনা, জীবনটা তোমার, তাই তুমিই সিদ্ধান্ত নেবে তুমি কি চাইছো। অন্যের প্রেশারে নিমরাজি হয়ে জীবন কাটাবে না, তাহলে মনে হবে বোঝা বয়ে বেড়াচ্ছ। আর লোকের কথায় প্রভাবিত হবার আগে নিজের মনে একবার ভাববে, তাহলেই কথাটার সত্য মিথ্যে প্রমাণিত হয়ে যাবে তোমার সামনে।
সৃজনের এই কথাকে গুরুত্ব দিয়েই ও ব্রেকআপ করেছে সম্পর্কটা থেকে। বুঝতে পারছিল, চুইংগামের মত টেনে ধরে রাখলে হয়তো থাকতো, কিন্তু মিষ্টতা নষ্ট হয়ে যেত। তবে গত তিন বছরে এটুকু বুঝেছে, সৃজনের সাথে ওর কোনো দিক দিয়েই মিল নেই। আসলে সৃজনের বন্য ফুলের উগ্র গন্ধটা বড্ড পছন্দের। জঙ্গলের আদিম গভীরতায় মেতে থাকতে চায় ও। অথবা শহরের আলো ঝলমলে মায়া নগরীর উদ্দামতায় মদির হতে চায়। ওর সাথে পাল্লা দিয়ে ছুটতে গিয়ে দেবলীনা সত্যিই খুব হাঁপিয়ে যায়। ক্লান্ত লাগে ওর। নিজের মনের প্রতিটা ঘরে উঁকি মেরে বুঝতে পেরেছে দেবলীনা, আদপে ও মধ্যবিত্ত। মুখে যতই আধুনিকতার বড়াই করুক, দিনশেষে একটা নিশ্চিন্ত গৃহকোণ ওর বড় পছন্দের। সেখানে মাটির দেওয়ালে নিকোনো আলপনা না থাক, একটা গোছানো ঘর থাকবে, তাতে ওর ফুলছাপ পরিচিত চাদর পাতা থাকবে, আর থাকবে জানালায় একটু ভারী পর্দা। যাতে বেডরুমের ভিতরের ওদের একান্ত মুহূর্তগুলো কিছুতেই পাবলিক না হয়। ডিস্কো ঠেকে পাবলিকলি লিপ লক করাতে ওর আপত্তি থাকলেও, নিজেদের ঘরে একান্ত মুহূর্তে ও নিশ্চয়ই শুষে নেবে একমাত্র মানুষটির ঠোঁটের আর্দ্রতা। এগুলোই পার্থক্য ওর আর সৃজনের। সৃজন জীবনে কোনো রকম আড়াল, আবডাল পছন্দ করে না। সবটাই বড্ড ওপেন। কিন্তু দেবলীনা পছন্দ করে আড়াল। সকলের সামনে নয়, সকলের চোখ বাঁচিয়ে প্রাণের মানুষটার হাত ধরতেই ও পছন্দ করে। মানুষ মাত্রই ভিন্ন, তাই তাদের পছন্দও ভিন্ন হবে সেটাই স্বাভাবিক। তবে দেবলীনা এতদিন সৃজনকে হারানোর ভয়ে ওর পছন্দগুলোর সাথেই নিজেকে অভ্যস্ত করার চেষ্টা করছিল। মনের সাথে যুদ্ধ করেও চেষ্টা করছিল, কিন্তু ইদানিং নিজের কাছের মানুষটার চারপাশে অন্যদের উপস্থিতি এতটাই বেশি হয়ে গেছে, যে ওই ভিড়ে নিজের অস্তিত্বটা কেমন হারিয়ে ফেলছিলো ও। রাকা, ডালিয়া, দেবযানী, সৃজনের এত এত বান্ধবীর ভিড়ে দেবলীনা নামটাকে খুঁজেই পাচ্ছিলো না যেন। ভিড়ে দমবন্ধ হয়ে যাবার ভয়েই বাধ্য হয়ে সরে আসছিল একটু একটু করে। তারপর বুঝলো, সৃজন ওর হাতের নাগালের বাইরে চলে গেছে। ইচ্ছেও করেনি, আবার নতুন করে এফোর্ট দিতে। বরং মুক্তির একটা নিঃশ্বাস নিয়েছিল ওর ফুসফুস।
উপলব্ধি করতে পারছিল, ”বোঝা”, ”বন্ধন” মনে হওয়া সম্পর্কে আর যাই থাকুক অনুভূতিগুলোর মৃত্যু হয় খুব তাড়াতাড়ি। হারিয়ে যায় ভালোবাসা নামক অতি আপেক্ষিক অনুভূতিটা।
এই যে ম্যাডাম, আপনি কি কবিনী?
নিজের ভাবনার জগৎ থেকে ছিটকে বেরিয়ে এলো দেবলীনা। সামনের অতি অসভ্য ন্যাকা ন্যাকা ছেলেটা ওর দিকে তাকিয়েই কিছু যেন বলছে।
ভ্রু তুলে তাকাতেই বললো, বলছি, আপনি কি কবিনী?
শব্দটা বড্ড আননোন তাই ঠিক বুঝতে পারলো না দেবলীনা। বিস্ময়ে জিজ্ঞেস করলো, মানে?
ছেলেটি অকারণে এক মুখ হেসে বললো, না মানে কবিতা লেখেন নাকি? মানে যেভাবে হাতে রুটি নিয়ে কাব্যিক ঢঙে কিছু ভাবছিলেন, তাই ভাবলাম আপনি হয়তো কবিনী।
সহ্যের একটা সীমা আছে, তিতিবিরক্ত হয়ে দেবলীনা বললো, আপনার এক্সাক্টলি প্রবলেমটা কি বলুন তো মিস্টার? সম্পূর্ণ অপরিচিত একজনের সঙ্গে কথাই বা বলতে আসছেন কেন?
ছেলেটি সপ্রতিভ ভাবে বললো, ওহ, দেখেছেন, আপনাকে নিয়ে আমার গার্লফ্রেন্ড সন্দেহ অবধি করে ফেললো, আর আমি এখনও আপনাকে আমার নামটাই বলিনি। দিগন্ত সাহা। আমার নাম দিগন্ত সাহা, আমি পেশায় ইঞ্জিনিয়ার, নেশায় ভ্রমণ পিপাসু বাঙালি। ভ্রমণ বলতে আপনারা যেটা বোঝেন সেটা নয়। দামি একটা হোটেলে উঠলাম, রুম সার্ভিসে খাবার অর্ডার করলাম, নানা রঙের ড্রেস পরে সেলফি তুলে ফেসবুকে পোস্ট করলাম আর হোটেলের ঘরে বসে বসে লাইক গুণলাম… ফেরার দিন গুচ্ছের শপিং করলাম, মাসতুতো ননদের শাশুড়ির জন্য। আরও দুখানা ব্যাগ কিনে কুলির মাথায় দরদাম করে চাপিয়ে দিয়ে পিছন পিছন ছুটে ভ্রমণ শেষ করলামের দলে আমি পড়ি না। আমি রীতিমত কোমরে দড়ি বেঁধে ট্রেকিং করি, টেন্ট ফেলে শুয়ে থাকি বিপদসঙ্কুল জায়গায়। অদ্ভুত একটা আনন্দ পাই এভাবে জীবনটাকে এনজয় করতে। আজ আছি মশাই কাল নেই, তাছাড়া বারো মাস তো অফিসের একঘেয়ে কাজ, বাকি সময়টুকু ঘরে বসে ল্যাদ খাচ্ছিই, আবার বেড়াতে এসেও ল্যাদখোর আমি নই।
দেবলীনা দিগন্তর কথার তোড়ে ভেসে যেতে যেতে কোনোমতে পাড় ধরে উঠে বললো, কিন্তু কবিনীটা কি পদার্থ?
জিভ কেটে দিগন্ত বললো, সরি ম্যাডাম, আপনি ফেমিনিজিনম অ্যান্ড কোম্পানির মেম্বার বুঝি? যারা কবি, লেখক, ডক্টর এসবের জেন্ডার চেঞ্জ করলে হেভি রেগে গিয়ে, পতাকা হাতে রাস্তায় নেমে বলে, আমাদের দাবি মানতে হবে। যেন মনে হচ্ছে শিক্ষিকাকে শিক্ষক বললেই, ওনারা সুরক্ষিত হয়ে যাবেন। মনে হয় যেন, এসব বলেই পাল্টে ফেলবেন সমাজটাকে। আরে বাবা, এতকালের পুরুষতান্ত্রিক সমাজের খোল নলছে বদলানো কি এতই সোজা নাকি হে। এসব শিক্ষক, শিক্ষিকা বলা, বা ভাবাতে বিশাল কিছু হয়না বুঝলেন, বরং আধুনিকতা রাখতে হয় নিজের মনে। যাইহোক, সরি কবিনী নয়, কবিই বলি তবে?
দেবলীনা অবাক হয়ে দেখছিল, একটা মানুষ কি পরিমাণে বকতে পারে, তা এই দিগন্ত সাহা লোকটিকে না দেখলে বিশ্বাসই করতে পারতো না দেবলীনা।
দেবলীনা বিরক্ত হয়ে বলল, না আমি কবি নই। আমি একজন শিক্ষিকা। আর অপরিচিত মহিলার সাথে কি ভাবে কথা বলতে হয় সেটা আপনার পুচুসোনা শেখায় নি আপনাকে?
এক মুখ হেসে দিগন্ত বললো, মোটামুটি নিশ্চিন্ত হলাম। এই যে নিজেকে শিক্ষিকা আর মহিলা বললেন এতেই আমি খুশি হলাম। অনেকে তো আবার আধুনিক হতে গিয়ে নিজের জেন্ডারকেই মানতে চায় না মশাই।
সে যাকগে, এবারে বলুন দেখি, আপনার লোয়ার না মিডিল? মানে আমার পুচুসোনা ট্রেনে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়তে বলে।
শরীরটা ভালো লাগছিলো না দেবলীনার। অদ্ভুত একটা একাকীত্ব কামরার এতজনের উপস্থিতিকে ছাপিয়ে ওকে ঘিরে ধরছিল যেন। খাবারটাও খেতে ইচ্ছে করছিল না। বাড়িতে বাবা-মা, রেগুলার স্কুল, নিজের গান শোনা, বই পড়া করে কেটে যায় দিনটা। সারাদিনের ক্লান্তি এসেই ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে যায় ওকে। কিন্তু এই কামরায় ও একেবারে একা, ওর নিজের কেউ নেই ভাবলেই কেমন মনখারাপ হয়ে যাচ্ছে যেন। এই আবোলতাবোল বকবক করা লোকটাও যদি ঘুমিয়ে যায় তখন নিশ্ছিদ্র একটা রাত্রি, ও কাটাবে কি করে? তবে এই লোকটার নিশ্চয়ই কোনো বদ মতলব আছে, তাই ওর সিট কোনটা জিজ্ঞেস করছে। সারারাত কি ওর সামনে শুয়ে অসভ্যের মত ওর দিকে তাকিয়ে থাকবে নাকি রে বাবা! আজকাল মানুষ চেনা বড় দায়। সৃজনকেই চিনতে পারলো না দেবলীনা, আর মুহূর্তের পরিচয়ে তো কথাই নেই। ওদিকে ফোনে পুচু সোনা হচ্ছে, এদিকে মেয়ে দেখলেই হাঁ করে গেলার মেন্টালিটি। দেখে দেখে ঘেন্না ধরে গেছে ওর।
তেমন ইচ্ছা না থাকলেও দেবলীনা বললো, আমার লোয়ার আছে।
দিগন্ত বলল, সম্ভবত আপনার ওপরের সিটটাতেও একজন মহিলা আছেন। আমারও লোয়ার, ওদিকে ওয়াশরুমে যাওয়ার সময় দেখলাম একটা ফ্যামিলির সবাই আপার আর মিডিল পেয়েছে। একটা লোয়ার খুঁজছিল বুঝলেন, বোধহয় বয়স্ক একজন ভদ্রমহিলার পায়ে প্রবলেম আছে, ওনার জন্যই।
একটা কাজ করি, আমি আমার সিটের মিডিলে চড়ে বসি, ওনাকে আপনার সামনের আমার সিটটা দিয়ে দিই বুঝলেন। তারপর চোখটা একটু টিপে মুচকি হেসে বললো, তাছাড়া এমন সুন্দরী সামনে থাকলে, সেদিকে বার দুই চোখ চলে যাবেই। আমার পুচু সব বুঝতে পারে, হয়তো মাঝরাতেই আমায় ফোন করবে।
দেবলীনা ওয়াশরুম থেকে ঘুরে এসে দেখলো, দিগন্ত বেড সিট পেতে বেশ ভালো করে গুছিয়ে তিনটে বিছানা করে রেখেছে।
আর পাশের কামরার ভদ্রমহিলার সাথে বকবক করছে।
ভদ্রমহিলা বললো, এই পা নিয়েই ঘুরতে বেরিয়েছি বুঝলে বাবা। কি করবো, বাইরের পৃথিবীটা যে বড্ড টানে। এখন আর দূরে দূরে যেতে পারি না।
দিগন্ত বিজ্ঞের মত বললো, আপনার পায়ে তেমন প্রবলেম নেই পিসিমণি, প্রবলেম মনে। এই যে মনটাকে ঠিক করে বশে এনে ফেলেছেন, তাই বেরিয়ে পড়তে পেরেছেন। অনেকে তো আবার মনকে বশে আনতেই বাইরে বেরোয়। ধরুন কষ্ট ভুলতে যায়। আসলে কি বলুন তো পিসিমণি, আপনি যখন নিজের থেকেও বেশি গুরুত্ব অন্য কাউকে দেবেন, তখনই আপনি নিজেকে কম ভালো বাসবেন, এই তার থেকে শুরু হবে নিজের প্রতি উদাসীনতা। এসব ভুলে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে, নিজেকে দেখুন অনেকক্ষণ ধরে। দেখবেন, আপনার চোখদুটো অপরিসীম গভীর, কত অব্যক্ত কথা লুকিয়ে রাখতে রাখতে ভারাক্রান্ত হয়ে গেছে। চোখের কোনের মিষ্টি হাসিটা ক্লান্ত হয়ে উধাও হয়ে গেছে। পারলে ওগুলোকে ফিরিয়ে আনুন।
দিগন্তর এখুনি পাতানো পিসিমণি সব কথা না বুঝেই বললো, তুমি বড্ড ভালো ছেলে গো।
দেবলীনাও নিজের গাম্ভীর্য ভেঙে ফিসফিস করে বললো, ওনার পুচুমনাও তাই বলে।
দিগন্ত মানুষটা যে অসভ্য গোছের নয় সেটা এই একঘন্টাতেই টের পেয়েছে দেবলীনা। তবে বড্ড টকেটিভ। ওর ক্লাস সিক্স, সেভেনের স্টুডেন্টদের মত। কথা আর তাদের শেষ হয় না। তবে গ্রীষ্মের ছুটি কিংবা পুজোর ছুটিতে দেবলীনা বেশ বুঝতে পারে, ওই বকবকম আওয়াজটা ওর জীবনী শক্তি। তাই ছুটিগুলোতে ভীষণ মিস করে ওদের।
ভদ্রমহিলা একমুখ হেসে বললেন, এই বুঝি তোমার স্ত্রী? বাহ, দুটিকে বেশ মানিয়েছে।
দেবলীনার ঠোঁটে অপ্রস্তুত চাউনি। বলতেই যাচ্ছিল, না উনি আমার কেউ হন না, শুধুই সহযাত্রী।
কিন্তু দেবলীনা কিছু বলার আগেই সর্ববিজ্ঞ দিগন্ত বলে উঠলো, আরে না না, পিসিমণি কি যে বলেন, আরে উনি আমার কেউ হন না। এই তো একঘন্টা আগে আমরা একতরফা বন্ধু হলাম মাত্র। তারপর লজ্জা লজ্জা ভাবে হেসে বললো, আসলে আমার মাও বলে, আমার চেহারাটাই এমন, সবাইকেই আমার পাশে মানিয়ে যায়। এমনকি ক্যাটরিনা কাইফকেও নাকি মানিয়ে যাবে। আমি আমার মায়ের মত দেখতে হয়েছি বুঝলেন কিনা।
দিগন্তর দুমিনিট আগে হওয়া পিসিমনি জিভ কেটে বললেন, ওহ সরি মেয়ে, কিছু মনে করো না।
তবে এই একতরফা বন্ধুত্ব বলতে কি বোঝাচ্ছ, বুঝলাম না তো?
দিগন্ত হেসে বললো, আমি ওনাকে বন্ধু ভাবছি, কিন্তু উনি ভাবছেন না, তাই আর কি! তাতে অবশ্য আমার কোনো অসুবিধা নেই, আমি একতরফা বন্ধুত্বেও কম্ফোর্টেবল।
দেবলীনা দাঁত চেপে বললো, আপনার একশো আঠাশ জিবির পেনড্রাইভ কি সারারাত একই মোশনে চলবে?
দিগন্ত জিভ কেটে বললো, সরি সরি। নিন আপনারা শুয়ে পড়ুন। আমার পুচু সোনা আবার রাত জাগলে খুব বকবে।
দেবলীনার এবারে হাসিই পেয়ে গেল দিগন্তর কথায়। বেশ মজারু টাইপ লোক। এর জীবনে আর যাইহোক কোনো সমস্যা নেই। বিন্দাস লাইফ কাটায়। এমন মানুষরা আশেপাশে থাকলে বাঁচার ইচ্ছেটাই যেন বেড়ে যায়। একটা অদ্ভুত পজেটিভ এনার্জি পাওয়া যায় এদের থেকে।
দিগন্তর দিকে তাকিয়ে ছোট্ট করে একটা থ্যাংক ইউ বললো, দেবলীনা।
দিগন্ত বললো, হঠাৎ থ্যাংক ইউ কেন? আমি বদমাশ টাইপ লোক নয়, বুঝে গেলেন?
দেবলীনা একটু গম্ভীর ভাবে বললো, না, বিছানা করে দেওয়ার জন্য।
দিগন্ত ফিসফিস করে বললো, হোস্টেলে থাকা ছেলে মশাই, আপনা হাত জগন্নাথ। আপনাদের মত আদুরে নয়। বাড়িতে গেলেই বাবা, মা পায়ে ফোস্কা পড়েছে কিনা অণুবীক্ষণ যন্ত্র নিয়ে দেখতে চলে আসবে। খেটে খাওয়া ইঞ্জিনিয়ার, বুঝলেন।
দেবলীনা বললো, একটু বেশিই বুঝলাম, পাহাড়ে যদি পায়ে ফোস্কা পড়ে বলে বাবা ব্যান্ডেড ভরে দিয়েছে একটা বক্সে। ভেবেছিলাম ডক্টরস শু পরে যাচ্ছি, ফোস্কার কোনো প্রশ্নই নেই। তাই ব্যান্ডেড কোনো কাজেই লাগবে না। এখন দেখছি অবশ্যই লাগবে, বুঝলেন?
দিগন্ত অবাক হয়ে বলল, ওমা, কোথায় কাটলো? ওয়াশরুমের দরজায় নয় তো? তাহলে কিন্তু নেমেই টিটেনাস? কই দেখি? আমার কাছে স্পিরিট আছে, লাগবে? ওয়াশ করে নিতে পারেন।
দেবলীনা মুচকি হেসে বললো, কাটেনি, সেলটেপের বদলে ব্যবহার করবো ব্যান্ডেডটা। একজনের অনর্গল কথা বন্ধ করার জন্য তার মুখে আটকে দেব।
দিগন্ত বেশ তটস্থ হয়ে বলল, সরি দিদিমণি। বড্ড কথা বলছি না? যদি আমার বেবি সোনা জানতে পারে, আমি একজন তার থেকেও সুন্দরী মেয়ের সাথে রাত সাড়ে এগারোটায় গল্প করছি, তাহলে আমার ব্রেকআপ নিশ্চিত বুঝলেন?
গুড নাইট ম্যাডাম। কথাটা বলেই দিগন্ত লাফিয়ে উঠে পড়ল মিডিলে। দিগন্তর পাতানো পিসিমণির ছেলে এসে একবার মায়ের খবর নিয়ে গিয়েছিল। এখন ভদ্রমহিলা ঘুমিয়ে পড়েছেন।
দেবলীনাও চেষ্টা করছে ঘুমাবার কিন্তু ওই যে স্মৃতি কিছুতেই পিছু ছাড়ে না। বারবার দৃষ্টি পথে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে সৃজনের সাথে কাটানো সময়গুলো।
কি ছিল ওগুলো ভালোবাসা না মোহ? মোহ নয়, তিনবছর পর্যন্ত মোহের মেয়াদ হতে পারে না। ওটাও ভালোবাসাই ছিল কিন্তু ধীরে ধীরে মনের বদল হয়েছে, পাল্টে গেছে ওরা। ওদের ভালোলাগা, খারাপলাগা গুলোর মধ্যে বড্ড বেশিই ফারাক হয়ে গেছে হয়তো। তাই কি, নাকি দূরত্ব তৈরি হয়ে গেছে মনের অলিন্দে! তাই ভালোবাসা নামক অনুভূতির সূক্ষ্ম তারে টান পড়তে পড়তে, ঘষা খেতে খেতে শেষ পর্যন্ত ছিঁড়ে গেল। ক্ষয় হতে হতে অবশিষ্টটুকুও শেষ হয়ে গেল। কেন এতটা বদলে গেল সৃজন। হতেই পারে দুজনের রুচির ফারাক আছে, কিন্তু তাই বলে কি একসাথে থাকা যেত না? হতো না হয় ঠোকাঠুকি, ঝগড়া ঝাঁটি, তবুও বেঁচে থাকতো সম্পর্কটা।
চোখ বন্ধ করে এলোমেলো ভেবেই যাচ্ছিল দেবলীনা।
ওদিকের ভদ্রমহিলার ঘন নিঃশ্বাসের আওয়াজ জানান দিচ্ছে নিশ্চিন্ত ঘুমের সুখ। দিগন্তও বোধহয় ঘুমিয়ে গেছে, শুধু জেগে আছে ও একা।
হঠাৎই দেখলো, দিগন্তর মোবাইলটা জ্বলে উঠলো। অন্ধকার কামরা বলেই অপজিট দিক থেকে চোখে আলোটা এসে পড়ল দেবলীনার। একটু সচেতন হয়েই তাকালো দিগন্তর মোবাইলের দিকে। গোটা স্ক্রিন জুড়ে একটা হলদে ওড়নার লুটপুটি। একটা মিষ্টি মেয়ের ছবি।
দিগন্ত ছবির দিকে কয়েক মিনিট তাকিয়ে ফিসফিস করে বললো, গুড নাইট সোনা।
মুচকি হেসে ফেলল দেবলীনা। ছেলেটা কিন্তু ভীষণ ভালোবাসে ওর বেবি সোনাকে। মাঝরাতেও ছবি দেখে গুড নাইট বলছে। যদিও দেবলীনার এগুলো জাস্ট ন্যাকামি মনে হয়। আচ্ছা, ন্যাকামি কেন মনে হয়?
ও কোনোদিন এত কেয়ারিং মানসিকতা পায়নি বলে, নাকি সৃজনের কাছ থেকে কখনোই এমন গুরুত্ব পায়নি বলেই ন্যাকামি মনে হয় এই অনর্থক আদরগুলোকে।
জোর করে ঘুমের চেষ্টা করলো ও। বাবা, মায়ের সাথে যখন বেড়াতে আসতো তখন তো ও বেশ নিশ্চিন্তেই ঘুমিয়ে পড়তো। মা বরং মজা করে বলতো, তোকে তো যেখানে ফেলবো সেখানেই ঘুমাবি। ট্রেনের এত দুলুনিতেও কি ঘুমটাই না ঘুমালি! কোথায় গেল সেসব নিশ্চিন্তের ঘুম? কেন ওর চোখ দুটো জ্বালা করছে, ভারী হয়ে আসছে অথচ ঘুম আসছে না! পাশ ফিরে শুয়ে আবারও চেষ্টা করলো সব ভুলে গিয়ে ঘুমিয়ে যাওয়ার।
।। ৩।।
পিছন থেকে স্বর্ণালীই ডেকেছিল ওকে। দেবলীনা ইনি তোর সাথে একটু পরিচয় করতে চান। পিছন ঘুরতেই অপ্রত্যাশিত ভাবে আকস্মিক প্রশ্নটা ছুটে এসেছিল ওর দিকে। মডেলিং করতে চান?
দুটো ভ্রূকে প্রায় ধনুকের অবস্থানে নিয়ে গিয়ে দেবলীনা বলেছিল, মানে?
তখন সদ্য স্কুল জয়েন করেছিল ও। প্রথম মাসের মাইনে পেয়েই ছোটবেলার বান্ধবী স্বর্ণালীকে নিয়ে গিয়েছিল একটা ঝাঁ চকচকে গোল্ড শো রুমে। উদ্দেশ্য একটাই, মায়ের জন্য একটা পেন্ডেন কিনবে। ওর আর বাবার জন্মদিন পালন করা হলেও মায়ের জন্মদিন সেভাবে মা কোনোদিন সেলিব্রেট করতে দেয়নি। বাবা, আর দেবলীনা বার দুয়েক চেষ্টা করেছিল, কিন্তু অস্বস্তিতেই হোক বা দীর্ঘদিনের অন্যভ্যাসেই হোক, মা ঠিক এনজয় করতে পারেনি। দেবলীনার কানে কানে বলেছিল, শোন না, এসব কেক টেক আনিস না আমার জন্মদিনে। তোর কাকিমারা হাসাহাসি করে। তার থেকে তুই যখন চাকরি পাবি, তখন আমার জন্মদিনে ছোট একটা করে গিফট কিনে দিবি। তাহলে আমারও মনে থাকবে আমি কবে এই পৃথিবীর আলো দেখেছিলাম।
দেবলীনাদের পাশেই ছোটকাকার বাড়ি। সম্পর্ক খারাপ নয়, তবে কাকিমা মাঝে মাঝেই দেবলীনার মেয়ে হওয়া নিয়ে বেশ আফসোস করে মায়ের কাছে। বিয়ে হয়ে চলে গেলে বুড়ো বয়েসে মাকে কে দেখবে নিয়ে বড়ই চিন্তা কাকিমার। দুই পুত্র সন্তানের জননীর অনর্থক গর্ব আর অহংকারের শিকার হয় দেবলীনার ভালোমানুষ মা-টা। দুই ভাইয়ের সাথে অবশ্য ওর সম্পর্ক ভীষণ মিষ্টি। ওরা দিদিভাই বলতে অজ্ঞান। কিন্তু কাকিমার দীর্ঘশ্বাসের ফলে মা মাঝে মাঝেই মনমরা হয়ে বলে, লীনা তো আমার মেয়ে, আমার কোনো সমস্যা নেই ও মেয়ে বলে, কেন যে পাড়ার লোকজনের, বুলটির এত সমস্যা কে জানে? বুলটি তো দিনরাত বলে যায়, মন খারাপ করো না বড়দি, আমার ছেলেরা কি তোমার ছেলে নয়? ওরাই দেখবে তোমায়। বাবা হেসে বলেছিল, কেন, বুলটিকে দেখলেই বুঝি তুমি মনখারাপ করো? মা রেগে গিয়ে বলে, তোমার শুধু সবেতেই রসিকতা। বাবা, বরাবরই প্রাণচঞ্চল মানুষ। মুখে সর্বদা হাসি। সব সমস্যার খুব সাধারণ সমাধান আছে বাবার কাছে। মনখারাপ করছে তো বই পড়, বাগানে গিয়ে ফুলেদের সাথে গল্প কর, এরাই তোর মন ভালো করে দেবে। বাবাকে কখনো কোনো কারণেই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হতে দেখেনি দেবলীনা। মাঝে মাঝে বাবাকে ওর খুব হিংসা হয়। কেন যে ও বাবার মত নিশ্চিন্ত মনে হাসতে পারে না। তবে বাবা ওর রোল মডেল। সর্বদা চেষ্টা করে বাবার মত হতে। হয়তো বিফলে যায় ওর চেষ্টা কিন্তু তবুও বাবা ওর প্রাণশক্তি। চাকরিতে ঢোকার পরেই বাবা বলেছিল, লীনার কাকিমাকে বলে এস, আমাদের মেয়ে শিক্ষিকা হয়েছে। বাবার গলার স্বরে সেদিন গর্বের সূক্ষ্ম আনাগোনা লক্ষ্য করেছিল লীনা। মায়ের মুখে প্রাপ্তির হাসি।
এ মাসের স্যালারিটা অ্যাকাউন্টে ঢুকতেই দেবলীনা স্থির করেছিল, বাবা আর মায়ের জন্য এক্সক্লুসিভ গিফট কিনবে। বাবার উপহার যে বই হবে, সে নিয়ে দ্বিমত ছিল না ওর। মায়ের গিফট নিয়েই চিন্তা করছিল। স্বর্ণালীই বললো, একটা লেটেস্ট পেন্ডেন দে, আন্টি মুক্তোর হার দিয়ে পরবে, দারুণ লাগবে। আইডিয়াটা বেশ পছন্দ হয়েছিল ওর। তাই দুই বন্ধু এসে পৌঁছেছিল গোল্ড এমপরিয়াম নামের এই ঝাঁ চকচকে শো রুমে।
দেবলীনা ফিসফিস করে বলেছিল, হ্যাঁরে এত বড় দোকানে কেন ঢুকলি? এখানে তো সব জিনিসের দাম বেশি হবে রে!
স্বর্ণালীই ওকে ভরসা দিয়ে বলেছে, হালকা ওজনের থেকে ভারী, সব রকম পাবি। আমরা অফিসের এক কলিগের বিয়েতে গিফট করলাম, এখান থেকেই কিনেছিলাম। কম বাজেটের ভালো জিনিস আছে।
দোকানে ঢুকে সবে পেন্ডেনের দিকে পা বাড়িয়েছে দেবলীনা, সেই সময় এমন অবাস্তব প্রস্তাব নিয়ে হাজির একজন সুদর্শন, অত্যন্ত স্মার্ট পুরুষ। বয়েস আন্দাজ সাতাশ। দেবলীনার থেকে বছর দুয়েকের বড়ই হবে বলে মনে হলো। পায়ের জুতো থেকে মাথার জেল ব্রাশ করা চুল, সবটাই বড্ড নিখুঁত। একনজরে দেবলীনার মনে হয়েছিল, একটু এলোমেলো হলেই বোধহয় ছেলেটাকে বেশি মানত। বড়লোক বাড়ির সাজানো লনের মত, একটাও শুকনো পাতা পড়ে থাকে না সবুজ ঘাসে। তাই কৃত্রিমতার মাঝে প্রাণের স্পন্দন একটু কম।
দেবলীনা নিজের অপ্রস্তুত ভাবটা সামলে নিয়ে বললো, আমি একজন কাস্টমার, মডেলিং করার জন্য তো আসি নি। ছেলেটা মুখে গোটা চারেক করুণ রেখা ফুটিয়ে বললো, বুঝলাম আপনি কাস্টমার, কিন্তু মডেলিংয়ে আপত্তি কোথায়? স্বর্ণালী ছেলেটিকে কথা শেষ না করতে দিয়েই বললো, ও একজন টিচার, জবও খুঁজছে না, সো…
ছেলেটি ভীষণ স্মার্টলি দেবলীনার দিকে হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বললো, সৃজন চৌধুরী। এটা আমাদের ফ্যামিলি বিজনেস। আমি একেবারেই ইনটারেস্টেড নই বিজনেসে। আমি নাম করা আই টি কোম্পানিতে গুরু দায়িত্বে আছি। কিন্তু আমার দাদুর একটা অদ্ভুত নিয়ম আছে। ফ্যামিলির প্রতিটা ছেলেকে প্রতি বছরে একমাসের জন্য হলেও ফ্যামিলি বিজনেস সামলাতেই হবে। এই মাসটা আমার দায়িত্বে। এটাই বাঙালির বিয়ের মাস। তাই বেশ কিছু ওয়েডিং কালেকশন রেডি করেছে শিল্পীরা। আমি চাই একটা বাঙালি লুকের, সুন্দরী মেয়ে সেগুলো পরে মডেলিং করুন। সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচারের সাথে সাথে বিভিন্ন ম্যাগাজিনেও ছাপা হবে তার ছবি। গহনার বিজ্ঞাপনও হলো, আবার বাঙালিয়ানাও হলো।
কি ম্যাডাম, ক্লিয়ার করতে পারলাম আমার আইডিয়াটা?
আমি বিজ্ঞাপনও দিয়েছিলাম, কিন্তু জাস্ট ফেডআপ হয়ে গেলাম। একটাও চেহারা পেলাম না, যার হাতে কৃষ্ণচূড়া, কব্জিতে মানতাসা, রতনচূড়ের মত সাবেকি গহনা মানাবে। মডেলিং করতে যারা এলো তারা তো সবাই দেখলাম ওয়েস্টার্ন ড্রেসের বিজ্ঞাপন দেবার জন্যই জন্মেছে। যদিও আমার ব্যক্তিগত পছন্দ ওয়েস্টার্ন লুক। কিন্তু এখন তো ষোলআনা বাঙালি লুক চাই আমার। সারাদিনের লড়াইয়ের পর, সন্ধেবেলা ব্যর্থ হয়ে ফিরে যাওয়ার সময়েই আপনার দিকে চোখ আটকে গেলো। আমার মনের ক্যানভাসে সাবেকি গহনা পরানোর জন্য, যে মডেলের ছবিটা এঁকেছিলাম, আপনি তো হুবহু তাই।
ওই জমিদার বাড়ির চণ্ডীমণ্ডপে, চাবির গোছা পিঠে ফেলে আটপৌরে শাড়িতে এক গা গহনা পরিহিত সেই নারী, যার প্রতিটা পদক্ষেপে আত্মমর্যাদা, অহংকার, ব্যক্তিত্ব সব কিছুর প্রতিফলন। প্রজারা শ্রদ্ধায় মাথা নিচু করে বলছেন, ওই যে আমাদের রানিমা এসে গেছেন।
চূড়ান্ত অস্বস্তিতে, গাঢ় লজ্জায় মাথা নিচু করলো দেবলীনা। রূপের প্রশংসা ও সেই ছোট থেকে পেয়ে আসছে। প্রোপোজও ওর কাছে নতুন নয়। স্কুল কলেজে এক সময় প্রোপোজালের জ্বালায় তিতিবিরক্ত লাগতো।
কিন্তু এমন একজন ব্যক্তিত্ব এভাবে প্রশংসা করতে শুরু করলে, ওর গালে কৃষ্ণচূড়ার রং ধরবে না এমন গ্যারেন্টি কোথায়? সেটা হবে আরও লজ্জার।
তার আগেই কথার স্রোতে নিজের দুর্বল হয়ে যাওয়া মনটাকে সামলে নিয়ে বললো, একটু বোধহয় বেশিই বলছেন মিস্টার চৌধুরী। আপনি চেষ্টা করুন, মডেল ঠিক পেয়ে যাবেন। তাছাড়া বাঙালি বেশিরভাগ মেয়েকেই শাড়ি, গহনা পরলে সুন্দরই লাগে।
দয়া করে এসব বলে আমায় বিব্রত করবেন না প্লিজ।
সৃজন নাছোড়বান্দার মত বললো, কিন্তু ম্যাডাম, আপনাকে পেয়েও হারিয়ে ফেলবো এমন হতভাগা আমি, এটা ভাবতেই তো কষ্ট হচ্ছে। বাড়ি ফিরে দাদুর চোখে তীব্র ভর্ৎসনার দৃষ্টিতে বিদ্ধ হবো। ভেতো বাঙালির সুখের চাকরিতে বেশি আনন্দ, ব্যবসার রিস্ক নিতে নাকি ভয় করে। এসব বলে প্রমাণ করে দেবে, আমি একটা ওয়ার্থলেস, গুড ফর নাথিং। অথচ একমাত্র আপনিই পারেন আমার সম্মান বাঁচাতে। অ্যামাউন্ট নিয়ে ভাববেন না, যেটা চাইবেন আমি পে করবো, প্লিজ রাজি হয়ে যান।
দেবলীনা গম্ভীর ভাবে বলেছিল, স্বর্ণালী চল অন্য কোনো শো রুমে গিয়ে মায়ের গয়নাটা কিনে নিই। এনারা বোধহয় কাস্টমারকে একটু বেশিই চিপ ভাবেন।
সৃজন হাত জোড় করে ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গিমায় বলেছিলো, সরি, আমি ভীষণ ভাবে দুঃখিত। আপনাকে জোর করা আমার উচিত হয়নি। আপনারা শপিং করুন প্লিজ। এভাবে ফিরে গেলে আমাদের কোম্পানির গুড উইল নষ্ট হবে।
কথাটা শেষ করেই একটু জোরেই বললো, এই বরুণ, ম্যাডামকে এক্সক্লুসিভ কালেকশন দেখাও।
সরি ম্যাডাম, এক্সট্রিমলি সরি, বলেই হন্তদন্ত হয়ে চলে গেল সৃজন।
ও যেতেই স্বর্ণালী বলতে শুরু করলো, আরে ইয়ার তোর প্রবলেমটা কোথায়? একটা দারুণ এক্সাইটিং ব্যাপার হতো। তুই গোল্ড এমপেরিয়ামের সাবেকি গয়নার মডেল হতিস। আরে পত্রিকায় তোর ছবি থাকতো। এদের শো রুমেও বড় বড় হোডিং-এ থাকতো ছবি, একদিনে সেলিব্রিটি ইয়ার! আর তোকে কে বলেছে রে, যে টিচার মানেই তাকে চশমা এঁটে বোরিং টাইপ হতে হবে?
মনে রাখবি, এটা একটা প্রফেশন। হ্যাঁ বলতে পারিস, নোবেল প্রফেশন। তা তুই স্কুলে তো আর ফিল্ম আর্টিস্টের মত সেজেগুজে ঢুকছিস না। এখানে মডেলিং করতে সমস্যা কোথায়? আর সৃজন চৌধুরী তো বললেন, ওনারা এক মুখ বারবার ব্যবহার করেন না। তারমানে একবারই তোকে করতে হবে। কর না, দেবলীনা, প্লিজ।
দেবলীনা বিরক্ত মুখে বলেছিল, অসম্ভব, ওরকম চড়া মেকআপ করে সং সেজে আমি দাঁড়াতে পারবো না ক্যামেরার সামনে। দেখ, স্বর্ণালী, সবার জন্য সব কিছু নয় রে। আমি ছাপোষা শিক্ষিকা, হয়তো মা, বাবা দেখতে ভালো বলে আমিও সুশ্রী হয়েছি। তারমানে এই নয়, যে একেবারে মডেলিং করতে হবে!
স্বর্ণালী বললো, তুই যেন কেমন একটা। জীবনে মাঝে মাঝে চেনা পথের উল্টো দিকে হেঁটে দেখবি, ওই অপরিচিত পথটাও তোকে অনেক কিছু দেবে বলে অপেক্ষা করছিল। শুধু তোর আসার প্রতীক্ষায় ছিল। তুই এক পা বাড়িয়ে দেখ, ওই অপরিচিত সম্পূর্ণ অচেনা রাস্তাটাও তোকে দুহাত ভরে দেবে।
মায়ের জন্য একটা খুব সুন্দর লকেট কিনে বিল মেটানোর জন্য ক্যাশ কাউন্টারের দিকে যাচ্ছিল ওরা। তখনই শুনতে পেল সৃজনের গলা। কাউকে একটা ফোনে বলছে, আরে ট্রাই করুন রঘুনাথ বাবু। পারবো না বললে তো চলে না। আমি অফিস কামাই করে আজ সারাটা দিন ওই সব মেয়েদের ইন্টারভিউ নিলাম, আর আপনি বলছেন সঠিক মডেল পাবেন না, ওদের মধ্যে থেকেই সাজিয়ে গুছিয়ে নিতে হবে? আরে মশাই, কোনোদিন দেখেছেন, কেশর লাগিয়ে ঘোড়াকে সিংহ বানাতে? আপনি তো জানেন, আমি মারাত্মক পারফেকশনিস্ট। হ্যাঁ, কাজ চালানোর মত হয়তো হতো, কিন্তু পারফেক্ট হতো না। আমার কাল দুপুর বারোটার মধ্যে নতুন মডেল চাই। যেমন বললাম, ওরকম। স্মার্ট লুকিং বাট চেহারার মধ্যে যেন একটা আভিজাত্য থাকে, ব্রেন উইথ বিউটি যাকে বলে তেমন।
আরে একজনকে পেয়েছিলাম, হ্যাঁ, কাস্টমার। কিছুতেই রাজি করাতে পারলাম না। আপনি ট্রাই করুন রঘুনাথ বাবু।
দেবলীনা হঠাৎই নিজের বাধ্য মনটাকে অবাধ্য হয়ে যেতে দেখলো নিজের চোখে। কঠিন হাতে শাসন করতে গেল শেষ মুহূর্তেও, তবুও অষ্টাদশীর মতই মনটা চঞ্চল হয়ে ছুটে গেল ওকে অমান্য করেই।
আচমকা ওকে চমকে দিয়েই ওর অবাধ্য মনটা বিদ্রোহী হয়ে উঠে নিয়ম ভাঙার খেলায় মেতে উঠলো যেন। বলে বসলো, আমায় কাল কখন আসতে হবে মিস্টার চৌধুরী?
ভাবছি দাদুর চোখে আপনাকে বেইজ্জত হওয়ার থেকে বাঁচিয়েই দেব এবারের মত।
সৃজন হকচকিয়ে বললো, সত্যি বলছেন? মানে আমি স্বপ্ন দেখছি না তো? সত্যি আপনি রাজি?
দ্বিধান্বিত মুখে ঘাড় নেড়ে দেবলীনা বলেছিল, রাজি। তবে বাড়ির পারমিশন নিয়ে আপনাকে রাতে কনফার্ম করছি।
নিজের ভিজিটিং কার্ডটা দেবলীনার হাতে ধরিয়ে দিয়ে কৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে সৃজন বলেছিল, ভাগ্যিস আপনারা মেয়ে আর গড আপনাদের মনে বেশ খানিকটা সহানুভূতি দিয়েই গড়েছেন, তাই এ যাত্রা বেঁচে গেলাম মনে হচ্ছে। ওর কথা বলার ঢঙে হেসে ফেলেছিলো দেবলীনা। পরক্ষণেই সৃজন ভীষণ সিরিয়াস ভাবে বলেছিল, ম্যাডাম, আপনার নাম, অ্যাড্রেস বলুন প্লিজ, আমি চেকটা লিখবো।
দেবলীনা শান্ত গলায় বলেছিল, কাজটা কমপ্লিট হলে আমি চেক নেব। ধীর পায়ে গোল্ড এমপরিয়াম থেকে বেরিয়ে এসেছিল ও।
বাড়ি ফিরে মায়ের হাতে পেন্ডেন আর বাবাকে বই গিফট দেওয়ার পর ভাবছিলো, কি ভাবে বাড়িতে এই একদিনের মডেল হওয়ার গল্পটা করবে! মধ্যবিত্ত পরিবারের আদর্শে বড় হয়ে ওঠা দেবলীনারও কোথাও যেন মনে হয়, এই লাইট, ক্যামেরা অ্যাকশন ব্যাপারটা ঠিক ওর জন্য নয়। হলেই বা একদিনের জন্য। পরক্ষণেই স্বর্ণালীর কথাটা মাথায় এসেছিল, একবার অন্তত চেনা পথ ছেড়ে ভিন্ন পথে হেঁটে দেখ লীনা, সে পথের শেষেও হয়তো এমন কিছু অপেক্ষা করছে তোর জন্য। কাঁপা গলায় বাবাকে বলেছিল, বাবা, এই গোল্ড এমপরিয়ামের মালিক আমায় ওদের মডেল হওয়ার অফার দিয়েছে। সাবেকি গহনা পরে কিছু ছবি তুলতে হবে ওদের কোম্পানির জন্য।
গয়নার বিজ্ঞাপন আর কি।
বাবা একটু ভেবে বলেছিল, একটা সময় পর্যন্ত আমি নিজের শাসনে রেখেছিলাম তোমাকে, তোমার রুচি আমি তৈরি করে দিয়েছি লীনা। আমি বিশ্বাস করি, তুই এমন কিছু করবি না, যাতে আমাদের সম্মানহানি হয়। তাই তুই যদি মনে করিস, কাজটা চ্যালেঞ্জিং, খারাপ কিছু নয়, তাহলে ট্রাই করতেই পারিস। নতুন কিছু মানেই খারাপ, এই ধারণায় আমি বিশ্বাসী নই।
মা বেশ উত্তেজিত ভাবে বলেছিল, হ্যাঁরে লীনা, টিভিতে দেখাবে তোর ছবি?
লীনা ছোট্ট করে উত্তর দিয়েছিল, হয়তো দেখাবে মা।
পরের দিন স্কুলে হাফ ছুটি নিয়ে পৌঁছেছিল গোল্ড এম্পরিয়ামে।
ওদের নিজস্ব মেকআপ আর্টিস্টরা দেবলীনাকে একটা ঘরে নিয়ে গিয়ে সাজাতে শুরু করলো। যতবারই ও তাকানোর চেষ্টা করছিল ততবারই মেকআপ আর্টিস্টের বকুনি শুনে আবার চোখ বন্ধ। মুখে হালকা পাফ, ভ্রূর মাঝে ছোট্ট টিপ, বিয়ে বাড়িতে লাইনার আর রোজকার রুটিনে চোখের নিচে হালকা কাজল, ঠোঁটের ভাঁজে নরম লিপস্টিকের উপস্থিতি ছাড়া আর কিছুই সাজে না ও।
চড়া মেকআপে নিজের মুখমণ্ডলকে বিকৃত করার কোনো সদিচ্ছা ওর কোনোদিনই তৈরি হয়নি। তাই চড়া মেকআপে ওকে জোকার টাইপ সাজাচ্ছে কিনা সেটা নিয়ে যথেস্ট চিন্তিত হয়ে বসেছিলো ও।
তখনই শুনতে পেল স্বল্প পরিচিত কন্ঠস্বরটা।
যদিও আমি মেকআপের কিছুই বুঝি না, তবে একটু খেয়াল রেখো, যেন রঙের আড়ালে ওনার স্বাভাবিক সৌন্দর্য নষ্ট না হয়ে যায়। কাজল কালো চোখ দুটো যেন ভারাক্রান্ত না হয় আইশ্যাডোর রঙিন রঙে। আর মুখের শিরা উপাশিরার নরম অথচ দৃঢ় ভঙ্গিমাটা যেন অক্ষুণ্ণ থাকে। চিবুকের ভাঁজের আত্মবিশ্বাস আর অহংকারের মিশেলটা যেন নিখুঁত থাকে, এটুকুই খেয়াল রেখো তোমরা। সৃজন বেরিয়ে যেতে যেতে ফিরে এসে বলেছিলো, আর ঠোঁটের নিচের ছোট্ট তিলটাকে আরেকটু হাইলাইট করে দিও। যেন সে উদ্ধত ভাবে বলতে পারে, আমি সাধারণ হয়েও অনন্যা।
সৃজন চলে যেতেই দুজন মেকআপ আর্টিস্ট ফিসফিস করে বললো, ছোট স্যার তো জীবনে ঢোকে না মেকআপ রুমে, আজ হঠাৎ যে এসব বলে গেলেন!
আরেকজন বললো, শোনো চন্দনদা, স্যার যখন নিজে এসব বলে গেলেন, তখন নিশ্চয়ই কাজটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। যেমন ভাবে বললেন, তেমন ভাবেই করো।
চন্দনদা নামক ব্যক্তিটা মুচকি হেসে বললো, স্যার তো আজ ইংরেজি ছেড়ে বাংলায় কথা বলছেন, এটা ফলো করেছো।
একজন বললো, ম্যাডাম, আপনি কি স্যারের বিশেষ পরিচিতা?
চোখ বন্ধ অবস্থায় দেবলীনা ঘাড় নেড়ে বললো, না, আমি আপনাদের স্যারকে চিনি না।
দেবলীনা তখনও ভাসছিল সৃজনের বলা কথাগুলোর মৃদু স্রোতে তুমুল ঢেউ নয়, স্নিগ্ধ ধীর গতিতে বওয়া ঢেউ, তবুও তার ক্ষমতা প্রবল। দেবলীনার মত চূড়ান্ত প্র্যাকটিক্যাল মেয়েকেও মুহূর্তের জন্য দুকূল প্লাবিত করে ভাসমান অবস্থায় নিয়ে চলে গিয়েছিলো জনমানবহীন কোনো একটা দ্বীপে। যেখানে কেউ নেই, শুধুই ঢেউয়ের ছলাৎ ছলাৎ শব্দে ধ্বনিত হচ্ছে। কে সৃজন? কেন একটা অর্ধপরিচিত ছেলের ডাকে ও আটপৌরে ঢঙে বেনারসী আর সাবেকি গয়না পরে জমিদার গিন্নী সাজতে রাজি হলো? শুধুই সৃজনের অনুরোধ? স্বর্ণালীর বায়না? নাকি মনের কোণে অন্য কোনো অশান্ত বসন্ত বাতাসের আনাগোনায় চঞ্চল হয়েছে দেবলীনার মনটা। জোর করে মন থেকে সৃজনের বলা কথাগুলোকে সরিয়ে রাখার চেষ্টা করছিল ও। ঠিক সেই মুহূর্তেই মেকআপ আর্টিস্ট ওর থুতনির একটু ওপরের তিলটাকে আরেকটু গাঢ় করার চেষ্টায় মগ্ন হয়ে গেল। কে জানে কেন লালচে আদুরে লজ্জাটা এসে দুহাত দিয়ে আঁকড়ে ধরতে চাইছিল ওকে। ওর শাসনের দৃষ্টিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়েই কেউ যেন ফিসফিস করে বললো, কখনো জানতে, তোমার ঐ ছোট্ট তিলটারও একটা উদ্ধত ভঙ্গিমা আছে!
নিজের দাঁত দিয়ে ঠোঁটটা কামড়াতেই চন্দনদা বললো, নিন ম্যাডাম, আমাদের কাজ কমপ্লিট। এবারে আপনি ফ্লোরে যান।
বিশাল আয়নার সামনে আগুন লাল বেনারসীতে নিজেকে দেখে একটু চমকেই গেল দেবলীনা।
গলায় গিনীর লম্বা হার, বাজুবন্দে কৃষ্ণচূড়া, হাতে রতনচূড়, মানতাসা, কোমরে কোমর বন্ধনী, নাকে বড় একটা নথ। বেনারসীর খুঁটে বাঁধা চাবির গোছায় নিজেকে নিজেই চিনতে পারছিল না দেবলীনা।
অবাক চোখে তাকিয়ে ছিল আয়নার দিকে।
অন্যমনস্ক হয়ে দেখেছিলো নিজেকে। তখনই কেউ একজন ডাকলো, ম্যাডাম, প্লিজ ফ্লোরে আসুন।
ফ্লোরে ঢুকে আরেক চমক। একটা পুরোনো বাড়ির সেট, পুরোনো পুজো মণ্ডপের সেট রেডি।
ফটোগ্রাফার বুঝিয়ে দিচ্ছিল, দেবলীনাকে কি কি করতে হবে। আনমনে বসে থাকতে হবে ওই সিঁড়িতে। কখনও ওই সিঁড়ি দিয়ে দর্পিত পায়ে নামতে হবে ….কেমন যেন নার্ভাস লাগছিলো ওর। দুচোখ খুঁজছিল সৃজনকে।
কিন্তু সৃজন কোথাও নেই।
সিঁড়িতে নামতে গিয়ে আরেকটু হলেই হোঁচট খাচ্ছিল দেবলীনা। ঠিক তখনই সিঁড়ির পাশের নকল দেওয়ালের পর্দার আড়াল থেকে একটা বলিষ্ঠ হাত এসে ওকে ধরে নিয়েছিল। নরম গলায় বলেছিল, সাবধানে।
আমি পাশেই আছি। কোনো ভয় নেই। ফ্রি ভাবে হাঁটুন।
লজ্জিত দেবলীনা বলেছিল, সরি।
সৃজন বেশ চেঁচিয়ে বলেছিল, এই সময় একটা শট নাও তো। চোখে লেগে থাকুক লজ্জার একটু রেশ।
সৃজনের কথাটা শোনার পর এক মুঠো আবীর এসে ছড়িয়ে পড়েছিল দেবলীনার গালে।
মুচকি হেসে সরে গিয়েছিল সৃজন। ছবির পর ছবি তুলে তুলে ও যখন প্রায় ক্লান্ত তখন সৃজন এসে বলছিলো, এবার ছাড়ো ওকে।
চলুন ম্যাডাম চেঞ্জ করে নেবেন। তারপর ডিনার করে আপনাকে বাড়ি পৌঁছে দেব আমি নিজে।
দেবলীনা মৃদুভাবে প্রত্যাখ্যান করতে যাচ্ছিল ওনার অফারটা কিন্তু ঘড়ির দিকে চোখ গেল, প্রায় নটা বেজে গেছে। যদি এসময় ট্যাক্সি না পায়, তাহলে মা চিন্তা করবে।
চেঞ্জ করে আসতেই সৃজন একটা খাম দিয়ে বললো, ম্যাডাম, সাবধানে রাখুন এটা ব্যাগে, দিয়ে তাড়াতাড়ি চলুন, আপনার বাড়িতে হয়তো টেনশন করবে। ডিনার সেরে পৌঁছে দিয়ে আসি।
দেবলীনা শান্ত গলায় বলল, আমি সোজা বাড়ি যাবো মিস্টার চৌধুরী, ডিনার করা সম্ভব নয়।
সৃজন একটু থমকে দাঁড়িয়ে বলেছিল, আমাকে কি সুযোগ সন্ধানী ছোকরা মনে হয় আপনার? তাই আমার সাথে ডিনারে যেতে চাইছেন না? আসলে কি বলুন তো, আমাদের ফ্যামিলি বিজনেসের একটা গুড উইল আছে। এখন যদি একজন গেস্টকে অতিথিয়েতা না করেই গোল্ড এমপরিয়াম থেকে ফিরিয়ে দিই, তাহলে আমার দাদু হয়তো চৌধুরী ম্যানশন থেকে আমায় তাড়িয়ে দেবেন। সে এই শহরে আমার নিজের উপার্জনে কেনা দুটো ফ্ল্যাট আছে, রাস্তায় হয়তো থাকতে হবে না। তবে পরিবারের বদনাম করে গৃহছাড়া হলে সম্মান বলে আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। বিশেষ করে কাল থেকে আমি আবার আমার নিজের কমফোর্ট জোন চাকরিতে ফেরত যাবো। তাই শেষ মুহূর্তে আর বদনামের ভাগীদার হতে চাইছি না আর কি! তবে যদি আপনি আমায় নেহাতই সুযোগসন্ধানী কলেজ পালানো ছেলের দলে ফেলেন, তাহলে একটাই কথা বলতে পারি, না ম্যাডাম, আপনি একটু ভুল করছেন, আমার নিজের ওপরে এনাফ কন্ট্রোল আছে। আরে আপনাকে দেখেই আমার লাভ অ্যাট ফার্স সাইট হয়েছিল। গত রাতটা না ঘুমিয়ে কফি খেয়ে কাটিয়েছি। সেই স্কুলের ছেলেদের প্রেমে পড়ার মত অভিজ্ঞতা নিয়ে দিন কাটালাম। তারপরেও আমি কিন্তু আপনাকে প্রোপোজ করবো না। নিশ্চিন্তে থাকুন আপনি, না পাবেন কোনো ফোন কল, না কোনো মেসেজ। আমার ভাললেগেছে মানেই আমি বিরক্ত করতে শুরু করবো এমন কিন্তু নয়। বাগানে একটা সুন্দর ফুল দেখলাম মানেই তাকে তুলতে ছুটবো, এমন কিন্তু নয়। তাই আপনি নিশ্চিত হয়ে টাইম স্পেন্ড করতেই পারেন আমার সাথে। আমার কলিগ থেকে বন্ধুবান্ধবরা বলে, আমি নাকি দুর্দান্ত টাইম পাশ হতেই পারি।
হ্যাঁ, আমি জীবনদর্শন নিয়ে তেমন সিরিয়াস টাইপ নই এই আর কি। বাদ বাকি আমি পারফেক্ট জেন্টেলম্যান।
দেবলীনা এমন সম্মুখ প্রশংসা শুনতে তেমন অভ্যস্ত নয়, বিশেষ করে এতটা পরিষ্কার ভাষায়। ওর ধারণা ছিল, ভালোলাগা, ভালোবাসার কথাগুলো একটু আধটু গোপনে রাখলেই তার মাধুর্য থাকে। কিন্তু সৃজন বড্ড ওপেনলি সব বলে, এতটা ডাইজেস্ট করা সত্যিই কষ্টকর। নিজের প্রশংসাও এভাবে শুনতে অভ্যস্ত নয় দেবলীনা। তাই অস্বস্তি নিয়েই বললো, আমি একবারও আপনাকে সুযোগসন্ধানী টাইপ ভাবিনি কিন্তু, ইনফ্যাক্ট কারণ ছাড়া আপনাকে খারাপ ভাবতেই বা যাবো কেন?
সৃজন নিজের শার্টের বটনটা অকারণেই একবার ঠিক করে নিয়ে আচমকা বলে বসলো, চলুন আপনাকে বাড়িতে ড্রপ করে দিয়ে আসি। আগে বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করি, তারপর না হয় বুক করবো ডিনার টেবিল।
দেবলীনা বলতেই যাচ্ছিল, চলুন খেয়েই ফিরবো কিন্তু তার আগেই গাড়ির পিছনের দরজা খুলে দিয়ে ও বললো, আপনি বরং পিছনে বসুন, পাশে বসলে হয়তো আমি দুর্বল হয়ে পড়তে পারি। নিজের ওপরে কন্ট্রোল আছে জানি, তবে আপনার ক্ষেত্রে সেটাকে পরীক্ষা করতে সাহস পাচ্ছি না।
দেবলীনার খুব ইচ্ছে করছিল বলতে, না আমি আপনার পাশের সিটেই বসব, আর ডিনার করেই ফিরবো বাড়ি। কিন্তু সৃজনের হঠাৎ বদলে কেমন ঘাবড়ে গিয়েছিল দেবলীনা। লজ্জা আর মানুষকে অবিশ্বাস করার অপরাধবোধ নিয়েই গাড়ির পিছনের সিটে বসলো ও।
গাড়ি স্টার্ট করেই সৃজন জিজ্ঞেস করলো, মিউজিক? আপনি মিউজিক শোনেন ম্যাডাম?
দেবলীনা বিরক্ত হয়ে বলল, আমায় ম্যাডাম না বলে দেবলীনা বললে খুশি হবো।
সৃজন ততোধিক গম্ভীর স্বরে বললো, আমি আবার নাম ধরে ডাকলেই তুমি বলে ফেলি, বড্ড বদভ্যাস। তার থেকে বরং ম্যাডামই ঠিক আছে। আপনার কাছে গোটা গোল্ড এমপরিয়াম কৃতজ্ঞ, আপনাকে সঠিক সম্মান দেওয়াটা আমার কর্তব্য ম্যাডাম। অকারণে বন্ধুত্ব করার আব্দার করে আপনাকে যদি একটুও অসম্মানিত করে থাকি তাহলে আমি দুঃখিত।
দেবলীনা ছটফট করে উঠেছিলো। লজ্জায় অধোঃবদন হয়ে বলেছিল, এভাবে লজ্জা দেবেন না প্লিজ। আমি অত্যন্ত সাধারণ একটা মেয়ে। নেহাতই মধ্যবিত্ত মেন্টালিটিতে বড় হওয়া, তাই রাত্রি নটার পরে সদ্য পরিচিত কারোর সাথে রেস্টুরেন্টে যাওয়া, ডিনার করার কথা ভাবতেই পারিনা। এটা আমার সমস্যা, এতে আপনার তো কোনো দোষ নেই! তাই বারবার ক্ষমা চেয়ে আমায় ছোট করবেন না।
।। ৪।।
দেবলীনা তো কোনোদিনই অস্বীকার করেনি যে ও মিডিলক্লাস মেন্টালিটির মেয়ে, তাহলে আজ প্রায় তিনবছর পরে কেন সৃজনের ওকে নিয়ে এত প্রবলেম হচ্ছে! নাকি রাকার উদার মানসিকতার সান্নিধ্যে এসেই দেবলীনা সম্পর্কে ওর দৃষ্টিভঙ্গিটা পরিবর্তিত হয়ে গেছে!
নিজের অফিসের কিউবে বসে একমনে বাইরের কৃত্রিম সবুজের দিকে তাকিয়ে আছে সৃজন। ওদের অফিসের লনের সবুজটাকে সৃজনের সাজানো মেকি মনে হয়। ঘন জঙ্গলের মত বন্য গন্ধ নেই এতে, যেন মনে হয় কৃত্রিমতার নিখুঁত আড়ালে ঢেকে যায় সবুজের স্বাভাবিক সরলতা।
নিজের মনেই হেসে উঠলো সৃজন। মানুষের মন বড় অদ্ভুত। দেবলীনার সরলতা, ঘরোয়া ব্যাপারটাই একদিন আকর্ষণ করেছিল ওকে। আর এখন ওদের ব্রেকআপ হলো ঠিক ওই কারণেই। ওয়েস্টার্ন ড্রেসে সাবলীল নয়, ডান্স, ওয়াইন, পার্টিতে স্বাচ্ছন্দ্য নয় বলেই ধীরে ধীরে সৃজনের মনে বিরক্তি উৎপাদন করছিল দেবলীনা। একই খাতে বয়ে যাওয়া শান্ত একটা নদী যেন। কোনো বাঁক নেই, সৌন্দর্য আছে অপার কিন্তু উষ্ণতা নেই। দেবলীনার রূপটা বড্ড স্নিগ্ধ, পুড়িয়ে ছারখার করে দেওয়ার ক্ষমতা নেই ওর। আগে ওই নরম শান্ত স্নিগ্ধ নদীর ধারে দুদণ্ড বসতে বড্ড ভালো লাগতো সৃজনের। কিন্তু বেশ কিছু দিন ধরে একটা অদ্ভুত জিনিস লক্ষ্য করছে সৃজন, দেবলীনাও যেন ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছে ওর আব্দার মানতে মানতে। যেদিনই ডিস্কো যাবো বলে বায়না করেছে সৃজন, সেদিনই কোনো না কোনো বাহানায় ও পাশ কাটিয়ে দিচ্ছে। এমনকি সৃজনের পছন্দের ওয়েস্টার্ন ড্রেস না পরে পরপর দুদিন পার্টিতে গিয়েছিল, ইন্ডিয়ান ড্রেস পরে। নজর এড়ায়নি ওর। দেবলীনার অবশ্য স্পষ্ট উত্তর ছিল, নিজেকে বদলাতে পারবো না সৃজন। এতদিন পর্যন্ত অনেক চেষ্টা করলাম তোমার মনের মত হয়ে ওঠার। কিন্তু আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে গেছি জানো, সেই দেবলীনাটা আস্তে আস্তে পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে। আসলে কি জানো সৃজন, আমি ঐ দেবলীনাটাকে বড্ড ভালোবাসি। কোনো কিছুর বিনিময়েই ওকে হারিয়ে ফেলতে পারবো না। সেই জন্ম থেকে তেইশ-চব্বিশ বছর পর্যন্ত ওই দেবলীনাটাইকেই একটু একটু করে গড়ে তুলেছিলাম নিজের মধ্যে। ইদানিং তোমার পছন্দের লীনা হতে গিয়ে রীতিমত আইডেন্টিটি ক্রাইসিস হয়ে যাচ্ছে আমার। তাই ওই পুরোনো আমিটাকেই ফিরিয়ে আনলাম, প্লিজ আমাকে যখন ভালোবাসো বলে দাবি করছো, তখন গোটা আমিটাকেই বাসো। তোমার তৈরি কৃত্রিম আমিটাকে এবারে বিদায় দেব আমি।
সৃজন বুঝেছিলো, দেবলীনা ওর পছন্দের সাথে পাল্লা দিতে দিতে ক্লান্ত। তাই সরে এসেছিল সম্পর্ক থেকে। সৃজন মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে, একটা সম্পর্কে সব সময় কৌতূহল, আগ্রহ থাকা খুব জরুরী, কিন্তু ইদানিং কেন যে দেবলীনার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে যাচ্ছিল সেটা ও নিজেও জানে না। তবে বারবার মনে হচ্ছিল, যদি জোর করে এই সম্পর্কটাকে টেনে নিয়ে যাওয়া হয়, তাহলে এর মাধুর্য হারিয়ে দাঁত নখ বের করে দুজনে দুজনকে দোষারোপ করবে সারাজীবন।
তবে দেবলীনাকে ভোলা বোধহয় কোনোদিনই সম্ভব নয় সৃজনের পক্ষে। মেয়েটার মধ্যে একটা অদ্ভুত ব্যক্তিত্ব আছে। স্নিগ্ধ অথচ দৃঢ় একটা ব্যক্তিত্ব।
সৃজন জানে ও দেবলীনাকে এখনো ভালোবাসে। হয়তো রাকাকে ও বেশি পছন্দ করে। রাকার সাথে ওর পছন্দের বড্ড মিল। দেবলীনা সৃজনের পছন্দের ঠিক যেগুলো করতে গিয়ে অবসন্ন হয়ে পড়তো, রাকার আবার সেগুলোই পছন্দের। তাই রাকাকে কোনোদিন বলতে হয় না, চলো লং ড্রাইভে যাবো। কিন্তু দেবলীনার ছিল হাজার বাহানা, বাবা বকবে, ফিরতে কত দেরি হবে? কাছে-পিঠে গেলে হয় না? এসব প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে লং ড্রাইভের এক্সাইটমেন্ট হারিয়ে ফেলত সৃজন। আর রাকা গাড়িতে উঠেই আদুরে গলায় বলে, সৃজন চলো না লং ড্রাইভে যাই, পিছনে পড়ে থাকুক শহুরে আভিজাত্যের ঘেরা টোপ। সমস্ত নিষেধাজ্ঞা ঝেড়ে ফেলে চলো, নিরুদ্দেশের পথে। রাকার অফুরন্ত এনার্জিই ইদানিং সৃজনকে নতুন করে উষ্ণতা দিচ্ছে। দামাল খরস্রোতা ঝর্ণার পাল্লায় পড়ে, প্রায় স্রোতহীন নদীও এখন তরতর করে বইছে। দেবলীনার সান্নিধ্যে থাকতে থাকতে কেমন যেন একঘেয়ে ডাল ভাতের মত হয়ে যাচ্ছিল জীবনটা। রাকা এসে বুনো গন্ধে ভরা মহুয়া অথবা তীব্র হুইস্কির ঝাঁঝে পুড়িয়ে দিচ্ছে ওকে। ও প্রাণভরে ওই আগুনে নিজেকে ঝলসে নিচ্ছে। না, দেবলীনা কিছুতেই ওর জীবনসঙ্গী হতে পারেনা। এই কথাটা ভালোভাবে রিয়ালাইজড করার পরে সৃজনের মনে হয়েছিল, কি ভাবে ফেস করবে দেবলীনাকে! হয়তো ব্রেকআপের দুঃখে কাঁদবে মেয়েটা, হয়তো খুব কষ্ট পাবে! কিন্তু ওর ধারণাকে সম্পূর্ণ মিথ্যে করে দিয়ে, দেবলীনা পরিষ্কার বললো, হ্যাঁ সৃজন আমারও মনে হয়েছে, আমাদের সম্পর্কটা বড্ড বোঝা হয়ে দাঁড়াচ্ছে দুজনের কাছে। তোমার মত আমিও মুক্তি চাই এই বন্ধন থেকে।
অনেক চেষ্টা করেছিল সৃজন দেবলীনার চোখে এক টুকরো কষ্ট দেখতে, কিন্তু দেখতে পায়নি। পরিষ্কার আবেগহীন গলাতেই দেবলীনা মেনে নিয়েছিল ওদের ব্রেকআপটা। বারবার নিজেকে প্রশ্ন করেছে সৃজন, দেবলীনার চোখে নিজেকে হারানোর কষ্ট দেখলে কি ও একটু শান্তি পেতো, একটু তৃপ্তি পেতো কি, যদি দেবলীনা বলতো, আমি তোমায় ছেড়ে থাকতে পারবো না সৃজন! ওর অন্তরাত্মা উত্তর দিয়েছে, দেবলীনার ওই ভাবলেশহীন দৃষ্টিটাই কিছুতেই ভুলতে দিচ্ছে না লীনাকে।
দেবলীনা বুঝিয়ে দিলো, সৃজন চলে যাওয়ায় ওর বিশেষ কিছু ক্ষতি হলো না। একটা চিনচিনে অপমানবোধ বারবার আঘাত করছে ওর পুরুষত্বকে।
দেবলীনার চোখের গভীর দৃষ্টি, ওর পলকবিহীন তাকিয়ে থাকার মুহূর্তগুলো বড্ড প্রিয় ছিল সৃজনের।
যেদিন মডেলিংয়ের পর ওকে বাড়ি পৌঁছাতে যাচ্ছিল, সেদিনই প্রেমে পড়েছিলো ওর কাজল কালো চোখের। কত কথা যেন বলতে চাইছিলো ওই চোখদুটো, কিন্তু গোলাপি ঠোঁটের নিষেধ মেনে কিছুই বলছিলো না আর।
সৃজন ড্রাইভ করতে করতে বারবার মিররে দেখছিল ওর মুখটা। বুকের মধ্যে সেই প্রথম অমন একটা অদ্ভুত অনুভূতির আনাগোনা হয়েছিল ওর।
স্কুল, কলেজেও দু একজনকে ভাললেগেছিলো ওর। কিন্তু চূড়ান্ত প্র্যাকটিক্যাল সৃজন ছোট থেকেই বুঝেছিলো, স্কুল, কলেজের পছন্দ হওয়া মেয়েগুলোর সাথে ওর ফ্যামিলি স্ট্যান্ডার্ডের অনেক ফারাক। তাই এরা ওর ক্লাসমেট হতে পারে, বন্ধুও হতে পারে কিন্তু লাভার নয়। একমাত্র দেবলীনাকে দেখেই ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড, স্ট্যাটাস এসব যুক্তি মুহূর্তে ভেসে গিয়েছিল।
যখন এক গা গহনা পরে, আটপৌরে শাড়ি পরে দেবলীনা নামছিল সিঁড়ি দিয়ে, তখন সৃজন কবিগুরুর একটা কবিতার লাইনের অর্থ বুঝেছিলো।
সেদিন চৈত্রমাস, তোমার চোখে দেখেছিলাম আমার সর্বনাশ।
লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইটের অর্থ পরিষ্কার হয়েছিল এই বয়েসে এসে। অচেনা সব অনুভূতির ভিড়ে দেবলীনার উদাসীন চাউনি ওকে আরো বেশি এলোমেলো করে দিয়েছিল। মেয়েটা কিছুতেই রাজি হয়নি ওর সাথে ডিনার করতে যেতে। চোখে কেমন যেন অবিশ্বাসীর দৃষ্টি ছিল। শেষে সৃজনের খারাপ লাগবে বলে যখন নিমরাজি হয়ে বলেছিল, বেশ চলুন, ডিনার করেই ফিরবো তখন সৃজনের মনে হয়েছিল, ওর ক্লিন সেভ গালে কেউ একটা থাপ্পড় মেরে দিলো। বাধ্য হয়ে ওর সাথে যেতে রাজি হয়েছে দেখেই ওর কেমন একটা অস্বস্তি হচ্ছিল। তাই বলেছিল, না আজ থাক।
মনের মধ্যে দোটানা চলছিল ওর, মেয়েটা কি এনগেজড! এই প্রশ্নটাই বারবার এসে উঁকি ঝুঁকি দিচ্ছিল। কিন্তু সৃজন এটাও বুঝতে পারছিল, প্রশ্নটা করা সভ্যতা নয়। যদি সাহস করে প্রশ্নটা করেও বসে, আর তারপর শোনে দেবলীনা এনগেজড, তাহলে ওর হৃৎপিণ্ডটা বোধহয় থমকে যাবে এই মুহূর্তে, তার থেকে বরং এমন উড়ো হাওয়ায় ভাসুক ওর ভালোবাসার প্রথম উপলব্ধিগুলো। এসব ভেবেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, কিছুতেই দেবলীনাকে জিজ্ঞেস করবে না, ও এনগেজড কিনা।
এলোমেলো দোলাচলে দোলা মন নিয়েই একমনে ড্রাইভ করার চেষ্টা করছিল ও।
তখনই কথা বলেছিল দেবলীনা। আচমকা বলেছিলো, আচ্ছা মিস্টার চৌধুরী, একটা কথা বলবেন, আপনাদের কোম্পানিতে যারাই মডেলিংয়ের জন্য আসে তাদেরকেই ভালোলাগে আপনার?
সৃজন বুঝেছিলো, দেবলীনা দ্বন্দ্বে ভুগছে, ওকে রীতিমত ফ্লার্ট করা ছেলে ভাবছে হয়তো। তাই বাধ্য হয়েই মুখ খুলেছিল। না ম্যাডাম, লাগে না। আর আপনাকে এভাবে হুট করে ভালো লেগে যাওয়ার জন্য আমি আন্তরিক ভাবে দুঃখিত। প্লিজ ফর গিভ মি। তবে আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন, কোনোরকম প্রপোজাল আপনি পাবেন না আমার কাছ থেকে। না কোনো বিরক্তি উৎপাদন করা মেসেজ ঢুকবে আপনার মুঠোফোনে। এই ভালোলাগাটুকুকে নিজের মধ্যে গোপন রেখে, না পাওয়ার কষ্টটুকুকে উপভোগ করতে আমার ভালোই লাগবে। অনেকটা কষ্ট কষ্ট সুখের মতই মহা মূল্যবান। উচ্চবিত্ত পরিবারের ছেলে হওয়ার সুযোগে হাত বাড়ালেই গোটা দুনিয়াকে মুঠোয় ভরার একটা প্রবণতা সেই ছোট থেকেই। তাই না শুনতে খুব একটা অভ্যস্ত নই আমি। ইনফ্যাক্ট আমি আমার এই সাতাশ- আঠাশটা বসন্ত পেরিয়ে বার দুয়েক না শুনেছি। এক নম্বর-ফ্যামিলি বিজনেসের দায়িত্ব নিইনি বলে আমায় বাড়ির গাড়ি ইউজ করতে দেওয়া হয়নি অফিস যাওয়ার সময়। এখন অবশ্য আমি নিজেই কিনেছি।
দুই নম্বর হলো, ক্লাস ইলেভেনে একজন ম্যাথের টিচারকে আমি আমার বাড়িতে এসে টিউশনি করার অফার করেছিলাম। স্যালারিও অনেক দিতে চেয়েছিল বাবা, কিন্তু স্যার পরিষ্কার বলে দিয়েছিলেন, মন্ত্রীর পুত্র হলেও উনি কারোর বাড়ি গিয়ে টিউশন করবেন না।
আর তিননম্বর না টা শুনলাম আপনার কাছ থেকে।
না খুব কম শুনেছি বলেই এগুলো মনে আছে এত বছর পরেও। আপনার ডিনারে যাবো না-টাও মনে থাকবে চিরকাল। সৃজনের দৃঢ় ধারণা ছিল এরপরে হয়তো দেবলীনা বলবে, তাহলে প্লিজ চলুন। ওই লিস্টে আমার নামটা না থাকুক। কিন্তু সৃজনের দৃঢ় বিশ্বাসকে মুহূর্তে নস্যাৎ করে দিয়ে দেবলীনা বলেছিল, আমি তো ভাবছিলাম, তাহলে যাই আপনার সাথে ডিনার করতে, কিন্তু এখন আর কোনোভাবেই ব্যতিক্রমী হওয়ার লোভ সম্বরণ করতে পারলাম না। আজ তবে তিননম্বর ”না”টাকেই মনে রাখুন আজীবন।
সৃজনের ডান গালে কেউ যেন আরেকটা সপাটে থাপ্পড় মেরেছিলো। নিজের মনেই গালটাতে হাত বুলিয়ে বলেছিল, কষ্ট কষ্ট সুখ। একটুকরো যন্ত্রণায় অন্যরকম প্রাপ্তি হয়েই থাক দেবলীনার এই প্রত্যাখ্যান।
ভেবেছিল দেবলীনাকে বাড়িতে ড্রপ করে আসার পরে ভুলে যাবে ওকে। এমনিতেই কাজের প্রেশারে উইকেন্ড ছাড়া কিছুই মনে করার সুযোগ থাকে না ওর, সেখানে মুহূর্তের এই ভালোলাগাটুকুকে ভুলতে খুব বেশি সময় লাগবে না সৃজনের।
ছোট্ট করে বলেছিল, বুঝেছি ম্যাডাম। আমার সাথে ডিনারে গেলে হয়তো আপনার ফিঁয়াসে রাগ করতো, আমি পৌঁছে দিয়ে আসছি বলেও কি তিনি রাগ করবেন?
একটু গম্ভীর স্বরেই দেবলীনা বলেছিল, আমার কোনো ফিঁয়াসে নেই মিস্টার সৃজন। আর যদি থাকতো, তাহলেও তার রাগ-অভিমানের ওপরে আমার দৈনন্দিন জীবন নির্ভর করতো না। স্বল্প পরিচিত মানুষের স্পনসরে ডিনার করতে যাবো, এমন ভাবনাতেই আমার আপত্তি। বন্ধুদের কাছ থেকে তাদের টিফিন কেড়েও খাওয়া যায়, কারণ সেখানে তৈরি হয় একটা অধিকারবোধ।
ওর কথার রেশ ধরেই সৃজন বলেছিল, তারমানে আপনি আমায় বন্ধু ভেবে মডেলিংয়ে রাজি হননি, নেহাতই করুণা করেছেন, তাই তো?
দেবলীনা উত্তর না দিয়ে বললো, বাঁ দিকে গাড়িটা রাখবেন প্লিজ। সামনেই আমার বাড়ি, নেমে যাবো।
সৃজন ভেবেছিল, বাড়িতে ড্রপ করে দিলে হয়তো এক কাপ গরম কফির আতিথেয়তা আর একমুঠো এক্সট্রা সময় পাবে সৃজন, কিন্তু সে আশায় এক বালতি জল ঢেলে দিল দেবলীনা। বাধ্য হয়ে গাড়ি পার্ক করিয়ে নিজের ভিজিটিং কার্ডটা বের করে ওর হাতে ধরিয়ে সৃজন বলেছিল, যদি বন্ধুত্ব চান, তাহলে হাত বাড়িয়েই রাখলাম, শুধু ধরার অপেক্ষা। যদি না চান, পুরোনো কাগজের ভিড়ে ফেলে দেবেন আমার ফোন নম্বর, আজকের তারা জ্বলা সন্ধেটা আমার থাকুক। আপনার ওই সাবেকি সাজের ছবিগুলোর মধ্যে একটা ছবি আমি কিছুতেই গোল্ড এমপরিয়ামকে দেব না, ওটা একান্তভাবেই আমার থাকবে। দেবলীনা কৌতূহলী চোখে তাকিয়ে বলেছিল, কোন ছবি?
নিজের মোবাইলের বড় স্ক্রিনটা দেখিয়ে বলেছিল, এটা প্রফেশনাল ফটোগ্রাফারের তোলা নয়, তবে বড্ড আপন।
দেবলীনা বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে বলেছিল, এটা কখন তুললেন?
যখন সিঁড়ি থেকে পড়ে যেতে যেতে বেঁচে যাবার পরে একটু ভয়ে ভয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন, আমি পারবো তো? ওই অভিব্যক্তিটুকুকে নিজের ক্যামেরাবন্দি করতে খুব ইচ্ছে হচ্ছিল। তাই পারমিশন ছাড়াই এলোমেলো, একটু ভীতু দেবলীনাকে ক্যামেরাবন্দি করেছিলাম। তখনই ভেবেছিলাম, এই ছবিটা গোল্ড এমপরিয়ামের নয়, চাকুরিজীবিরই থাকুক। এই ছবিটার জন্য কিন্তু কোনো পারিশ্রমিক দেব না আমি। এটা ভিক্ষা চাইলাম আমি, যদি একান্ত না দেন, তাহলে না হয় ডিলিট করে দেব আপনার সামনেই।
দেবলীনা লজ্জায় ছটফট করে বলেছিল, পারিশ্রমিক লাগবে না, ভিক্ষাও নয়, ওটা থাকুক আপনার কাছে।
আর একমুহূর্ত দাঁড়ালেও যেন ওর দুর্বলতা প্রকাশ পেয়ে যাবে, তেমন ভাবেই ছুটে পালিয়েছিল নিজের বাড়ির দিকে।
ওর ওই পালানোর তৎপরতাটুকু অপলক দেখার লোভ ত্যাগ করতে পারেনি সৃজন, নির্নিমেষ তাকিয়ে ছিল ওর চলে যাওয়ার দিকে।
নিজের কাজের চাপে যাকে ভুলে যাওয়া খুব সহজ হবে ভেবেছিল সৃজন, আদৌ সেটা হয়নি। ঐদিনের পর প্রায়ই মনে পড়তো দেবলীনাকে। ওর ফেসবুক অ্যাকাউন্ট ঘেঁটে ফেলেছিলো এই কদিনেই। তবুও ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠাতে পারেনি সৃজন। খুব আশা করেছিল দেবলীনা একটা অন্তত ফোন করবে। নিজের পারসোনালিটির ওপরে একটা তীব্র অহংকার জন্মেছিল সৃজনের। এতদিন পর্যন্ত যারাই ওর সাথে মিশেছে তারাই ওর ব্যক্তিত্বে আকর্ষিত হয়েছে। কলিগ থেকে বন্ধু বান্ধব সবাইকেই বলতে শুনেছে, সৃজন তুই সবার থেকে একটু আলাদা। শুনতে শুনতেই ধারণা হয়েছিল, ওর ব্যক্তিত্বে অল্প বিস্তর সবাই প্রভাবিত হয়। এই প্রথম নিজের কনফিডেন্স তলানিতে এসে ঠেকেছিলো। দেবলীনার কাছ থেকে না কোনো মেসেজ, না কোনো ফোন পেয়ে বেশ বুঝতে পেরেছিল, ও ছাড়াও আরও অনেকেই সবার থেকে বেশ কিছুটা আলাদা, যেমন দেবলীনা। ওর সব অঙ্ককে নিমেষে মিথ্যে করে দিলো মেয়েটা।
গোল্ড এমপরিয়ামের নতুন ক্যাডালকে মানতাসা আর রতনচূড়ের বিজ্ঞাপনে দেবীলনার ছবি, এছাড়াও ওদের শো রুমের রিসেপশনেও রয়েছে দেবলীনার বেশ বড় একটা ছবি, মেয়েটার চোখ দুটো যেন তাড়া করে নিয়ে বেড়াচ্ছে সৃজনকে, অথচ ও একান্ত নিরুপায়। সংকোচের বশেই দেবলীনাকে আর কল করতে পারেনি।
সেদিন ছিল গ্রীষ্মের সন্ধে, সারাদিন অফিসের সেন্ট্রাল এসি আর নিজস্ব গাড়ির এসির জন্য গরমটা ঠিক মত অনুভবই করতে হয়না সৃজনকে। তবে আশপাশ থেকে ভেসে আসছিল, উফ, কাল যা দাবদাহ গেল, আজই বা কম কিসে! এখন একটু বৃষ্টি দরকার বুঝলে! সকলের একান্ত কাম্য বৃষ্টি ওইদিন সন্ধেতে আসেনি ঠিকই, তবে সৃজনকে চমকে দিয়ে দেবলীনার কল এসেছিল ওর মুঠোফোনে। গোটা স্ক্রিন জুড়ে দেবলীনার এলো চুল আর লাল টিপের মুখটা উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছিল, সঙ্গে মুঠোফোন জানান দিচ্ছিল, দেবলীনা কলিং।
কাঁপা হাতেই ফোনটা রিসিভ করেছিল সৃজন। গলার স্বরটাকে শান্ত করেছিল শাসন করে, বুকের মধ্যের ঝড়ের পূর্বাভাস যেন কিছুতেই টের না পায় দেবলীনা, তাই অবাধ্য মনটার রাশ টেনেছিলো কঠোর হাতে।
হ্যালো বলতেই ওপ্রান্তে সুরেলা স্বরে পরিচিত কন্ঠস্বর বলেছিল, মিস্টার সৃজন চৌধুরী?
হাজার চেষ্টা করেও মুহূর্তের জন্য কেঁপে উঠেছিলো সৃজনের গলাটা। ওর সাড়া পেয়েই একটু থেমে দেবলীনা বলেছিল, কদিন ধরেই ভাবছি আপনাকে কল করবো, কিন্তু হয়ে উঠছিল না।
দেবলীনা ওকে নিয়ে ভেবেছে কথাটা শুনেই নতুন করে বুকের বাম দিকের যন্ত্রণাটা চিনচিন করে উঠেছিলো।
সৃজন হালকা স্বরে বলেছিল, বলেন কি, আমার কথাও আপনি ভেবেছেন? একে কি বলবো, সৌভাগ্য নাকি দুর্ভাগ্য?
সৌভাগ্য—কারণ আপনি ভেবেছেন, দুর্ভাগ্য—কারণ আমি জানতেও পারিনি আপনার ভাবনাটা।
দেবলীনা অল্প হেসে বললো, নেক্সট সানডে, একবার মিট করা যাবে?
সৃজন দীর্ঘশ্বাসটা গোপন না করেই বলেছিল, আপনার জন্য আমার সব ডে কে আমি সানডে বানিয়ে নেব।
ডোন্ট ওরি ম্যাডাম, এখন বলুন কোথায় হাজির হতে হবে?
দেবলীনা একটু ভেবে বললো, ওটা আপনিই বলুন। আমি পৌঁছে যাবো।
সৃজন টেবিল বুক করার কথা বলতে গিয়েও থমকে গিয়ে বলেছিল, একটা ক্যাফেতে আসুন। আপনার বাড়ির কাছাকাছি, আমি পৌঁছে যাবো।
বেশ, তাহলে নিরিবিলিতে আসুন।
সৃজন মুচকি হেসে বলেছিল, ম্যাডাম, এই তিলোত্তমায় নিরিবিলি কোথায় পাবো?
দেবলীনা অপ্রস্তুত গলায় বলেছিল, আরে না না, ক্যাফেটার নাম হলো ”নিরিবিলি”।
সৃজন ভুল শুধরে নিয়ে বলেছিল, আই অ্যাম জাস্ট জোকিং। তাহলে সানডে সন্ধে সাতটা নাগাদ পৌঁছে যাবো।
ফোনটা রাখার পরেই ছোটবেলার মত আঙুল গুণতে শুরু করেছিল। ধৈর্য হারিয়ে ফিসফিস করে বলেছিল, ধুর, এখনো মাঝে তিনটে দিন।
এর মধ্যে অবশ্য একটু হোমওয়ার্ক করে নিলে মন্দ হয় না। ওর ফ্রেন্ড স্বর্ণালীকে ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট পাঠিয়ে দেওয়াই যায়। তারপর জেনে নেওয়াই যায়, দেবলীনার পছন্দের রং বা আনুষাঙ্গিক। তাহলে নিজেকে প্রেজেন্ট করা যাবে সেই ভাবে।
আর ভাবনাচিন্তা না করেই ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়ে দিয়েছিল স্বর্ণালীকে। আরে ফ্রেন্ড হতে বাধা কোথায়!