Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    আসমানীরা তিন বোন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025

    ইস্টিশন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025

    উড়ালপঙ্খী – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    চৈত্রের দ্বিতীয় দিবস – হুমায়ূন আহমেদ

    হুমায়ূন আহমেদ এক পাতা গল্প238 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    ০৩. জোবেদ আলি রাতে ভাত খাননি

    জোবেদ আলি রাতে ভাত খাননি। রাগ করে ভাত খাননি। রাগের কারণ অতি তুচ্ছ। তাঁর একটা গাছ কে যেন পা দিয়ে মাড়িয়ে ভর্তা বানিয়ে ফেলেছে। গাছটা তিনি তাঁর পরিচিত নার্সারী থেকে অনেক দেন দরবার করে এনেছেন। চারশ টাকা দামের চারা তাকে দিয়েছে দুশতে সেই দুশ টাকাও তিনি দিতে পারেন নি। একশ টাকা দিয়েছেন। একশ বাকি রেখে এসেছেন। জাপানি ফুলের গাছ নাম এরিকা জাপানিকা। বিশেষত্ব হচ্ছে এই গাছে সবুজ রঙের ফুল ফুটে। সবুজ পাতার রঙ, ফুলের রঙ না। সেই কারণেই সবুজ ফুল—অসম্ভব সুন্দর হবার কথা। তিনি কল্পনায় ফুল দেখতেন। বাস্তবে আর দেখা হল না।

    তাঁর এই শখের চারাটার উপর কে যেন অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল। শুধু যে দাঁড়িয়ে ছিল তা-না দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সিগারেট খেয়েছে। সিগারেটের টুকরা তিনি কাছেই পেয়েছেন। কাজটা কে করেছে এখনো বুঝতে পারছেন না। তার সন্দেহ ছোট ছেলে মঞ্জুর উপর। তিনি প্রায়ই লক্ষ্য করেছেন মঞ্জু বাগানে হাঁটাহাঁটি করে সিগারেট খায়। এর আগেও সে একটা পাথরকুচি গাছের চারা মাড়িয়ে চ্যাপ্টা করেছিল। পাথরকুচির জীবনী শক্তি অনেক বেশী বলে গাছটা বেঁচে গেছে। জাপানী গাছের এত জীবনী শক্তি থাকার কথা না। বেচারা বিদেশী মাটিতে বড় হচ্ছে। তার মন পড়ে থাকে জাপানে, তার আসে পাশে সব অপরিচিত গাছ। জীবনী শক্তি বেশী থাকার কথাতো না।

    জোবেদ আলি ঠিক করে রেখেছেন—ছোট ছেলেকে আজ তিনি কিছু কঠিন কথা শুনাবেন। এমন কিছু কঠিন কথা যা এই ছেলে অনেকদিন শুনেনি। সিগারেট গাঁজা যা ইচ্ছা খাও—বিছানায় শুয়ে শুয়ে খাও। গাছের উপর দাঁড়িয়ে খাবে কেন?

    মঞ্জু রাত নটার মধ্যে বাসায় ফিরে। রেী করে বড় ছেলে ফরহাদ। আজ দুজনই দেরী করছে। করুক দেরী, তিনি অপেক্ষা করবেন। প্রয়োজন হলে সারারাত বারান্দায় বসে থাকবেন।

    রাত এগারোটা দশ। তিনি বারান্দার মোড়ায় বসে আছেন। তাঁর খুব ভাল সিধে পেয়েছে। খাওয়া দাওয়ার অনিয়ম এই বয়সে করা ঠিক না। কিন্তু রাগ কমাতে পারছেন না।

    রাহেলা বারান্দায় এসে বিরক্ত গলায় বললেন—তুমি সত্যি ভাত খাবে না?

    জোবেদ আলি বললেন, না। আমি ভাতের কাঁথা পুড়ি।

    যত বয়স হচ্ছে তুমি তত পুলাপান হয়ে যচ্ছ। ভাত খাবে না কেন?

    ক্ষিধা নাই।

    একটা গাছ মরে গেছে। তাতে কি হয়েছে। মানুষ মরে যায় আর গাছ। আস ভাত খাও।

    বললামতো খাব না।

    আমি কিন্তু ভাতে পানি দিয়ে ফেলব।

    যা ইচ্ছা দাও।

    লোকে বলে না—বুড়ো হলে মানুষের ভীতি হয়—তোমার ভীমরতি হচ্ছে।

    ভাল।

    আমি কিন্তু আর সাধাসাধি করতে আসব না।

    বললামতো আসার দরকার নাই।

    এই শেষ আসা।

    আচ্ছা।

    এই বৃক্ষপ্রীতি জোবেদ আলির আগে ছিল না। রিটায়ার করার পর হয়েছে। যত দিন যাচ্ছে ব্যাপারটা তত বাড়ছে। প্রতিদিন কিছু সময় তিনি সাত মসজিদ রোডের এক নার্সারিতে বসে থাকেন। নার্সারির লোকদের সাহায্য করেন। গোবর মাটি এবং ডাস্টবিনের আবর্জনা মাখিয়ে বৈ সার বানান। গায়ে পড়া কোন সাহায্যই মানুষ সহজ ভাবে নিতে পারে না। তার এই সাহায্যও কেউ সহজ ভাবে নেয় না। লোকটার আসল মতলব খুঁজে বের করার চেষ্টা করে।

    টেবিলে খাবার ঢাকা দিয়ে রাখলাম। যদি খেতে ইচ্ছা করে খেয়ে আমাকে মুক্তি দিও।

    আচ্ছা।

    টিফিন কেরিয়ারে দুজনের মত কাচ্চি বিরিয়ানী আছে। জাহানারা দিয়ে দিয়েছে।

    আচ্ছা।

    ফরহাদকে বলবে কষ্ট করে যেন গরম করে নেয়। আমি রাত জাগতে পারব ঘুমের অষুধ খেয়ে ফেলেছি।

    ভাল করেছ। আরো দুটা ঘুমের অষুধ খাও।

    এটা কি কথা বললে?

    জোবেদ আলি রাগী গলায় বললেন, বলে ফেলেছি বলে ফেলেছি। এখন আমাকে কি করবে? মারবে?

    রাহেলা হতভম্ব হয়ে গেলেন। কথাবার্তার একি নমুনা। সামান্য একটা গাছ মরে গেছে আর লোকটা মাথা খারাপের মত কথাবার্তা বলছে। রাহেলা খুব কঠিন কিছু বলার প্রস্তুতি নিয়েও নিজেকে সামলে ফেললেন। ঘুমের অষুধ খাবার পরে রাগারাগি চেঁচামেচি করলে অষুধের ধার কমে যায়। বিছানায় শুবেন ঘুম আসবে না। এরচে ঝগড়াটা কিছু সময়ের জন্যে মূলতুবী থাকুক। স্বামীকে তিনি এত সহজে ছেড়ে দেবার মত মানুষ না। তাছাড়া মেয়ের বাড়িতে যাবার কারণে আজ তার মেজাজ ভাল। আকিকা উপলক্ষে তিনি শেষ পর্যন্ত নাতনীকে একটা চেইন দিতে পেরেছেন। তাঁর গোপন সঞ্চয়ে হাত দিতে হয়েছে। তার জন্যে মেজাজ সামান্য খারাপ ছিল। কিন্তু চেইন দেখে জাহানারা এতই খুশি হল যে মেজাজ খারাপ ভাব সঙ্গে সঙ্গে চলে গেল। জাহানারা অবশ্যি বলেছে—ইশ মা তোমাকে গলার চেইন দিতে কে বলেছে? নাতনীকে দোয়া করবে—তা না।

    দোয়াতো সব সময়ই করি।

    এত টাকা খরচ করা তোমার ঠিক হয়নি মা।

    একটা লকেটও দেয়ার ইচ্ছা ছিল। হাত একেবারে খালি।

    এই রকম বাজে খরচ তুমি করো নাতো মা।

    রাহেলা মেয়ের খুশি দেখে খুবই তৃপ্তি পেলেন। ভাগ্যিস আংটি না কিনে শেষ মুহূর্তে সোনার চেইন কিনেছেন। না কিনলে খুব বোকামী হত।

    জাহানারা বলল, তোমার জামাই মেয়ের আকিকা উপলক্ষ্যে আমাকে কি দিয়েছ দেখ মা। দুটা বালা বানিয়ে দিয়েছে। একেকটা এক ভরি করে। ডিজাইন আমার পছন্দ হয় নি। কিন্তু আমি কিছু বলিনি বেচারা শখ করে কিনেছে।

    কই ডিজাইনতো আমার কাছে সুন্দর লাগছে।

    সবাই সুন্দর বলছে কিন্তু আমার কাছে ওল্ড ফ্যাশনড় মনে হচ্ছে। তাছাড়া বালা পরলে বয়স বেশি বেশি লাগে। আমি এগুলি ভাঙ্গিয়ে পাতলা করে চারটা চুড়ি বানাব। সব সময় পরা যায় এমন চুরি।

    ভুলেও এই কাজ করবি না। জামাই জানতে পারলে মনে কষ্ট পাবে।

    ও জানতেই পারবে না। একমাস পরে নিজেই ভুলে যাবে যে আমাকে বাবা দিয়েছিল।

    জামাইয়ের ব্যবসা কি ভাল যাচ্ছে না-কি।

    ওদেরতো মা অনেক রকম ব্যবসা। একটা খারাপ গেলে অন্যটা ভাল যায়। তুমি এসেছ খুব ভাল হয়েছে। তোমার সঙ্গে আমার খুবই জরুরী কিছু কথা আছে।

    কি কথা?

    এখন না। খাওয়া দাওয়া শেষ হোক তারপর বলব। মুখ এমন শুকনা করে ফেলেছ কেন? খারাপ কিছু না। খুবই ভাল একটা ব্যাপার আছে। তোমার জামাই আমাকে বলেছে তোমার সঙ্গে কথা বলতে। কাজেই আমি যা বলব সেটা হল অফিসিয়াল।

    এখনই বল। আমার হাত পা কাঁপছে।

    হাত পা কাপাতে হবে না। বললাম না, ভাল খবর।

    জাহানারা রহস্যময় ভঙ্গিতে হাসতে লাগল। রাহেলা মেয়ের হাসি দেখেও তেমন স্বস্তি পেলেন না। তাঁর জীবনে ভাল কিছু ঘটতে পারে এই বোধই নষ্ট হয়ে গেছে। তাঁর জীবনটা এমন এক পর্যায়ে গেছে যে এখন ঘটনা মানেই দুর্ঘটনা। স্বপ্ন মনেই দুঃস্বপ্ন। রাহেলা দুঃশ্চিন্তা নিয়ে সময় কাটাতে লাগলেন। নাতনীর আকীকা উপলক্ষ্যে তিন চারশ লোককে দাওয়াত দেয়া হয়েছে। প্যান্ডেল খাটানো হয়েছে বিয়ে বাড়ি বিয়ে বাড়ি ভাব। রাতে না-কি আবার কাওয়ালী হবে। বাচ্চু কাওয়ালকে খবর দেয়া হয়েছে। রাহেলার খুব ইচ্ছা কাওয়ালী দেখে যাওয়া। রাত বেশি হলেও সমস্যা হবে না। জামাইদের গাড়ি আছে। শাশুড়ীকে জামাই নিশ্চয়ই নামিয়ে দিয়ে যাবে।

    কাওয়ালীর আসর থেকে জাহানারা মাকে উঠিয়ে নিয়ে নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। রাহেলার বুক ধরাস ধরাস করতে লাগল। জাহানারা গলা নামিয়ে বলল, মা আমার ননদকে তুমি দেখেছ রাণী নাম। দেখেছ না?

    রাহেলা বললেন, হুঁ।

    খুব সুন্দর মেয়ে না?

    রাহেলা আবারো ক্ষীণ স্বরে বললেন, হুঁ।

    এমন মিহি করে হু বলছ কেন? সুন্দর মেয়েকে সুন্দর বলতে সমস্যা কোথায়?

    একটু মোটার ধাত আছে।

    তা আছে। সেটা এমন কিছু না। মেয়েটা ভাল। নিজের ননদ বলে বলছি না—আসলেই ভাল মেয়ে।

    রাহেলা মেয়ের কথার আগামাথা কিছুই ধরতে পারছেন না। মেয়ে ভাল হলে তার কি যায় আসে?

    জাহানারা বলল, আমার শ্বশুর বাড়ির সবার খুব ইচ্ছা রাণীর সঙ্গে ভাইয়ার বিয়ে হোক। ভাইয়াকে তাদের সবার খুবই পছন্দ।

    রাহেলা বললেন, ও এই ব্যাপার।

    জাহানারা বিরক্ত গলায় বলল, মা তুমি দেখি পুরো ব্যাপারটা ঝেড়ে ফেলে দিলে। এরা সাত ভাইয়ের মধ্যে একটা বোন। সবার চোখের মণি। মেয়ের নামে একটা বাড়ি ঢাকা শহরে আছে। তার বয়স যখন বার তখনি তার বিয়ের জন্যে তিন সেট গয়না বানিয়ে রাখা হয়েছে। বুঝতে পারছ কিছু?

    হুঁ।

    ভাইয়ার জন্যে এরচে ভাল বিয়ে হবার না। ওরা ভাইয়াকে যত পছন্দই করুক। আমিতো জানি ভাইয়া মোটামুটি অপদার্থ একজন মানুষ। এম,এসসি পাশ করে তিন বছর টিউশনি করেছ। একে অপদার্থ ছাড়া কি বলবে? এই ফ্যামিলির একটা মেয়েকে বিয়ে করলে ভাইয়ার ভাগ্য ফিরে যাবে।

    রাহেলা বললেন, ফরহাদের পছন্দের একটা মেয়ে মনে হয় আছে। কয়েকবার বাসায় এসেছে।

    জাহানারা বিরক্ত গলায় বলল, এইসব ফালতু প্রেম ভাইয়াকে হজম করে ফেলতে বল। প্রেম আবার কি? পেটে ভাত থাকলে তবেই না প্রেম। উপাস পেটে আবার প্রেম কি? মা শোন ভাইয়াকে তুমি অবশ্যই রাজি করাবে।

    দেখি।

    দেখাদেখি না মা। ভাইয়াকে রাজি না করাতে পারলে আমার মান-সম্মান থাকবে না।

    তোর মান-সম্মানের কথা আসছে কেন?

    কারণ আমার শাশুড়ি নিজে আমাকে ডেকে নিয়ে বলেছেন। আমি উনাকে বলেছি-আম্মা আপনি নিশ্চিত থাকেন। আমি ব্যবস্থা করছি।

    তুই আগবাড়িয়ে কথা বলতে গেলি কেন?

    আমি কেন বলব না?

    আত্মীয়ের সঙ্গে আত্মীয়তা ভাল না।

    জাহানারা বলল, মা শোন এই বিয়েটা শুধু ভাইয়া না তোমাদের সবার জন্যে দরকার। যেই আমি ভাল একটা বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছি ওমি তুমি ভাব ধরে ফেলছ। ঠাণ্ডা মাথায় বিবেচনা কর—ঢাকা শহরে যে বাস করছ তোমাদের পায়ের নিচে কি মাটি আছে? না মাটি নেই। আর রাণীর নামে ঢাকায় যে বাড়ি আছে সে বাড়ি থেকে মাসে ভাড়াই আসে আঠারো হাজার টাকা।

    বলিস কি? সাত কাঠা জমির উপর বাড়ি। দোতলা বাড়ি—তিন তলার ফাউন্ডেশন আছে।

    ও।

    আমার শাশুড়ির নিজস্ব সম্পত্তি আছে অনেক। মায়ের সম্পত্তিতে মেয়ের অংশ বেশি এটা নিশ্চয়ই তুমি জান। কি জান না?

    জানি।

    জাহানারা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আমি মেয়ে মানুষ। বাপ ভাইয়ের সংসারের জন্যে মেয়েরা কিছু করতে পারে না। তারপরেও আমি আমার সাধ্যমত চেষ্টা করলাম। বাকিটা তোমাদের বিবেচনা।

    রাহেলা তারপরেও অনেকক্ষণ মেয়ের বাড়িতে রইলেন। কাওয়ালী শুনলেন। মেয়ের শাশুড়ির সঙ্গে বসে চা খেলেন। জামাই টাটকা দুধ খাবার জন্যে একটা গাই কিনেছে। দুইবেলা দুধ দেয় ছ কেজি দুধ। সেই গাই দেখে তার গায়ে হাত বুলালেন এবং তার সমস্ত কর্মকান্ডের ফাঁকে ফাঁকে রাণী মেয়েটাকে লক্ষ্য করলেন। শুরুতে তাকে যতটা মোটা লাগছিল শেষের দিকে তা আর লাগল না। বরং তাঁর কাছে মনে হল মেয়েটা শুধু যে সুন্দর তাই না—অতিরিক্ত ভদ্র বিনয়ী। বৌ হিসেবে একশতে নব্বুই পঁচানব্বুই পাওয়ার কথা। বড়লোকের মেয়ে একটু দেমাগী হবেই। কি আর করা। দেমাগ করার সামর্থ যার আছে সে দেমাগ করলেও তেমন দোষের কিছু হয় না।

    রাহেলা বাসায় ফিরলেন আনন্দ নিয়ে। মেয়ে মাকে গাড়িতে তুলে দিতে এসে এক ফাঁকে একটা খাম হাতে দিয়ে বলল, ব্লাউজের ভেতর নিয়ে নাও তো মা। এটা মেয়ের পুরানো টেকনিক। খামে কিছু টাকা আছে। রাহেলা যতবারই মেয়ের কাছে এসেছেন এরকম একটা খাম পেয়েছেন। স্বামীর সংসার থেকে মাকে টাকা দেয়া খুব দূষনীয় ব্যাপার বলেই গোপনীয়তা। প্রথম দিকে রাহেলা ক্ষীণ আপত্তি করতেন। এখন করেন না। ছেলের হাতের টাকা যদি নেয়া যায় মেয়ের হাতের টাকাও নেয়া যায়।

    জাহানারা বলল, টিফিনকেরিয়ারে সামান্য খাবার দিয়ে দিলাম মা। খাওয়া সর্ট পরে গেছে বলে বেশি দিতে পারি নি। দুজনের হবে। টিফিনকেরিয়ারটা ফেরত পাঠিও। আর ভাইয়াকে যেভাবেই হোক রাজি করাবে। আমার কোন স্বার্থ নেই। মা। এটা মনে রেখে এগুবে।

    রাহেলা বললেন, আচ্ছা।

    আজ রাতে ভাইয়াকে কিছু বলার দরকার নেই। আজ রাতটা ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা কর। আর বাবাকে এই মুহূর্তে কিছু বলবে না।

    আচ্ছা।

    পুরোপুরি সবকিছু ফাইন্যাল না হওয়া পর্যন্ত বাবা যেন কিছুই না জানে। বাবা সবকিছু আউলা করে ফেলে। এখানেও আউলা করবে।

    রাহেলা হাসলেন। এই হাসিতে কিছু তৃপ্তিও আছে। মেয়ের সংসারী বুদ্ধি দেখে তৃপ্তির হাসি। বিয়ের আগে বোঝাই যায় নি—এই মেয়ে এত সংসারী হবে। এর সঙ্গে প্রেম, তার সঙ্গে প্রেম। ঘুমের অষুধ খাওয়া, স্টমাক ওয়াশ। কি বিশ্রী দিন কেটেছে। আজ মেয়ের স্বামী সংসার দেখে ঈর্ষা হয়। কি সুখেই না আছে। কে বলবে এই মেয়ে লোফার টাইপ একটা ছেলের জন্যে ঘুমের অষুধ টষুধ খেয়ে কত কাণ্ড করেছে। বিয়ে হল সব শেষ। এত বড় সংসার হাতের মুঠোয় নিয়ে মেয়ে সুখে আছে তার জন্যে এটাই বড় আনন্দ।

    খাম খুলে দুটা পাঁচশ টাকার নোট পেয়েছেন। চেইন কিনতে সতেরোশ টাকা লেগেছিল তার অনেকটাই উঠে এসেছে। তার গোপন সঞ্চয়ে টাকাটা চলে যাবে। আবার কোন দুর্যোগে কাজে লাগবে। ছেলেরা যে সারা জীবন তাঁকে দেখবে তাতো। তাদের সংসার হলেই তারা আস্তে আস্তে সরে পড়তে থাকবে। এটাও দোষের। এটাও সংসারের কঠিন নিয়মের এক নিয়ম। ফরহাদের বাবা সংসারী মানুষ হলে তিনি এত ভাবতেন না। লোকটা মোটেই সংসারী না। গাছ মরে গেলে যে ভাত খাওয়া বন্ধ করে দেয় তার উপর বিশ্বাস রাখা যায় না। তাকে খরচের খাতায় ধরতে হয়। তাছাড়া পুরুষ মানুষের হায়াত কম হয়। মেয়েরা হয় কচ্ছপের মত দীর্ঘদিন বেঁচে থাকে। ফরহাদের বাবা বেঁচে থাকবে না, তিনি অর্থ হয়ে বিছানায় শুয়ে থাকবেন তখন তার হবে কি? কার উপর ভরসা করবেন? কে দেখবে তাকে? তবে ফরহাদের বাবারা দীর্ঘজীবি গুষ্ঠি। ফরহাদের দাদার বয়স আশি দাঁড়িয়ে গেছে। দিব্যি বেঁচে আছেন। অসুখ বিসুখ হচ্ছে কিন্তু তেমন জটিল হবার আগে সেরেও যাচ্ছে। আরো কতদিন তিনি ঝুলে থাকবেন কে জানে? অচল একজন মানুষ সংসারে থাকলে সংসারটাও অচল হয়ে যায়। তার সংসার অচল হয়ে গেছে। এই দুঃখের কথা কাউকে বলা যায় না। বললে লোকে ছিঃ ছিঃ করবে।

    ঘুমের অষুধ খেয়ে সঙ্গে সঙ্গে বিছানায় যাবার নিয়ম নেই। আধ ঘন্টা ঠাণ্ডা মাথায় সময় কাটিয়ে ঘর অন্ধকার করে ঘুমুতে যেতে হয়। মাথা ঠাণ্ডা হবে কি ভাবে? ঘুমের অষুধ খাবার পর পর এমন সব ঘটনা ঘটতে থাকে যে মাথা গরম হতে শুরু করে। একজন ভাত খাবে না, গাছের শোকে পাথর। স্বামীকে অভুক্ত রেখে ঘুমুতে যাওয়া সংসারের জন্যে অমঙ্গলের।

    এই কাজটাই তাকে বাধ্য হয়ে করতে হচ্ছে। চুলা ধরিয়ে খাবার গরম করার কথা বলেছেন। এটা নিয়েও দুঃশ্চিন্তা হচ্ছে—চুলা ধরিয়ে ঠিকমত নিভাবেতো? গ্যাসের চুলার চাবিতে কিছু সমস্যা আছে। চাবি বন্ধ করলেও ঠিকমত বন্ধ হয় না। গ্যাস বের হতে থাকে। একবার খবরের কাগজে পড়েছিলেন—-গ্যাসের চুলা বন্ধ ঠিকমত করা হয়নি বাড়ি ভর্তি হয়ে গেল গ্যাসে। তখন বাড়ির কর্তা সিগারেট ধরাবার জন্যে ম্যাচ জ্বালিয়েছেন ওমি সারা বাড়িতে আগুন লেগে গেল। এক পরিবারে পাঁচজনের মৃত্যু। বেঁচে রইল শুধু বুড়ো নানী। এই অর্থব প্যারালিসিসের রোগী নড়তে পর্যন্ত পারে না। সে একা টিকে গেল। আল্লাহর বিচার বোঝা খুবই মুশকিল।

    রাহেলা ঘড়ি দেখলেন, আধ ঘন্টা পার হতে এখনো পাঁচ মিনিট বাকি আছে। তিনি শ্বশুরের ঘরে ঢুকলেন। জেগে থাকলে দু একটা ভাল কথা বলবেন। আজ দুপুরে বুড়োর সঙ্গে খুব চেঁচামেটি করেছেন। বুড়োর তেমন দোষ ছিল না। খুব যারা বুড়ো তাদের কিছু বুঝতেই পারে না। তাদের সঙ্গে ভাল ব্যবহার করলেও তারা বুঝে না। খারাপ ব্যবহার করলেও বুঝে না।

    রাহেলা ঘরে ঢোকা মাত্র মেম্বর আলি বললেন, কে বউমা। ভাল আছ?

    রাহেলা বললেন, জ্বি ভাল।

    খাওয়া দাওয়া করেছ?

    জ্বি।

    আলহামদুলিল্লাহ। আমারে খেতে দিবা না?

    সন্ধ্যার সময় না আপনারে খাওয়ায়ে গেলাম।

    নাশতা হিসাবে খেয়েছিলাম এখন আবার ভুখ চাপছে।

    এই বয়সে খাওয়া দাওয়ার অনিয়ম করা যাবে না। ডাক্তারের নিষেধ আছে। পেট ছেড়ে দিবে। এই বয়সে পেট ছেড়ে দিলে সর্বনাশ।

    ঘরে কি আজ পোলাও হয়েছে?

    পোলাও হবে কেন? এটা কি রাজবাড়ি যে প্রতিদিন পোলাও হবে।

    পোলাওয়ের গন্ধ পেয়েছি।

    জাহানারার বাসা থেকে সামান্য কাচ্চি বিরিয়ানী পাঠিয়েছে। আজ তার মেয়ের আকীকা ছিল।

    তস্তুরীতে করে একটু বিরিয়ানী দাও। খেয়ে দেখি।

    বিরিয়ানী আপনাকে দেওয়াই যাবে না। এই বয়সে বিরিয়ানী আপনার জন্যে বিষ। লোভ কমাতে হবে।

    গন্ধটা নাকে গেলতো…তারপর থেকে।

    এত গন্ধ নিতে হবে না। আপনি ঘুমান।

    নাম কি?

    কিসের নাম কি?

    জাহানারা মেয়ের নাম কি রেখেছে?

    হোসনে আরা খানম।

    আলহামদুলিল্লাহ্ সুন্দর নাম। জাহানারাকে বলবা আমি তার কন্যার জন্যে খাস দিলে দোয়া করেছি।

    আচ্ছা বলব। এখন আপনি ঘুমান।

    পেটে ভুখতো ঘুম আসতেছে না।

    পানি খাবেন? এক গ্লাস পানি খেয়ে শুয়ে থাকেন।

    খালি পেটে পানি খাওয়াও ঠিক না। পিত্তনাশ হয়। আচ্ছা মা যাও। তুমি ঘুমাতে যাও।

    রাহেলা ঘুমুতে গেলেন। এবারের ঘুমের অষুধগুলি ভাল—তার সঙ্গে সঙ্গে ঘুম এসে গেল।

     

    ফরহাদ ফিরল রাত সাড়ে দশটায়। আসমানীকে বাসায় নামাতে গিয়ে দেরী হল। আসমানীর মা তাকে খেয়ে যেতে বললেন। সে সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেল। আসমানী বলল, আমার শরীর এখন খুবই ভাল লাগছে। আমি রান্না করব।

    ফরহাদ বলল, তুমি ভয়ংকর অসুস্থ। রান্নার নামও মুখে আনবে না।

    আসমানী বলল, একবার যখন বলেছি রান্না করব, তখন রান্না করবই।

    ফরহাদ বলল, আমি একজন ডাক্তার নিয়ে আসি সে দেখুক তোমার প্রেসারের কোন সমস্যা আছে কি-না। তুমি অজ্ঞানের মত হয়ে গিয়েছিলে।

    আমি মোটেই অজ্ঞান হইনি। ভান করছিলাম। আমি অজ্ঞান হলে তুমি কি কর এটাই আমার দেখার ইচ্ছা ছিল।

    বাসায় পুরুষ মানুষ কেউ নেই। সবাই কার যেন জন্মদিনে গিয়েছে। ফরহাদকে একা একা বসে থাকতে হল। একটু পর পর আসমানী এসে খোঁজ নিয়ে যাচ্ছিল।

    এই যে বাবু সাহেব! খুব বোর হচ্ছ?

    না।

    তোমার জন্যে খুব কিছু রান্নার করার ইচ্ছা ছিল। ঘরে কিছু নেই। ডীপ ফ্রীজে সব সময় কিছু না কিছু থাকে। আজ ডীপ ফ্রীজ খালি। আমি তোমার জন্যে আলু ভাজি করছি। আলু ভাজি খাও?

    খাই।

    গাওয়া ঘি মাখিয়ে আলু ভাজি। দেখ খুব ভাল লাগবে। সঙ্গে থাকবে ভাজা শুকনা মরিচ।

    ভাল।

    শুধু একটাই সমস্যা ঘরে পাতে খাবার ঘি নেই।

    আসমানী তুমি আমার খাবার নিয়ে ব্যস্ত হয়ো না।

    তোমার খাবার নিয়ে ব্যস্ত হবোনাতো কার খাবার নিয়ে ব্যস্ত হব? এখন বল চা খাবে না, সরবত খাবে। মামা জাপান থেকে সবুজ রঙের কি একটা সিরাপ এনেছেন। সিরাপের সরবত খুব ভাল হয়। এক গ্লাস বানিয়ে দিই?

    দাও।

    আমার ইচ্ছা করছে রান্না ঘরে তোমার জন্যে মোড়া পেতে দেই। তুমি মোড়ায় বসে আমার রান্না দেখবে আর আমি রান্নার ফাঁকে ফাঁকে গুটুর গুটুর করে গল্প করব। মা খুবই রাগ করবে বলে বলতে পারছি না। আচ্ছা শোন, তুমি কি কোন গল্পের বই পড়বে। গল্পের বই এনে দেব?

    কিছু আনতে হবে না। তুমি রান্না শেষ কর।

    সবুজ রঙের সরবত এনে আসমানী উজ্জ্বল মুখে বলল, পাতে খাব ঘি সমস্যার সমাধান হয়েছে। ঘরে একটিন মাখন আছে-মাখন জ্বাল দিয়ে ঘি করব।

    ভাল। কর।

    যাই কেমন।

    রাত দশটায় আসমানীর মা এসে গম্ভীর গলায় বললেন, তুমি খেতে এসো। টেবিলে খাবার দেয়া হয়েছে। আসমানীর শরীর খুবই খারাপ। সে খাবে না শুয়ে পড়েছে।

    বেশী খারাপ?

    বেশী খারাপতো বটেই জোর করে আগুনের কাছে গিয়েছে।

    আমি ওকে একটু দেখে আসি।

    তোমাকে দেখতে হবে না। তুমি খেতে বোস।

    ফরহাদ খেতে বসল। আসমানীর মা কঠিন মুখ করে পাশে দাঁড়িয়ে রইলেন।

    এই অবস্থায় খাওয়া যায় না। গলায় ভাত আটকে যায়। ফরহাদের গলায় ভাত আটকে যেতে লাগল। আসমানীর মা বললেন, তুমি যাওয়ার পথে বড় রাস্তার পলাশ ফার্মেসী বলে একটা ফার্মেসী দেখবে। ফার্মেসীর যে কোন একজনকে বলবে আসমানীর শরীর খারাপ। তারা ডাক্তার পাঠাবে।

    আসমানীর নাম বললেই হবে?

    হ্যাঁ নাম বললেই হবে। ওর ছোট মামা ডাক্তার। সে ঐ ফার্মেসীতে বসে। ফার্মেসীর উপরের তলায় তার বাসা।

    জ্বি আচ্ছা বলব।

    তুমি ভালমত খাওয়া শেষ কর। আসমানীকে নিয়ে দুঃচিন্তা করার কিছু নেই—মাঝে মধ্যে ওর এ রকম শরীর খারাপ করে। ঘর বন্ধ করে কিছুক্ষণ শুয়ে থেকে রেস্ট নিলে শরীর সেরে যায়। আলু ভাজি নিচ্ছ না কেন? আলু ভাজি নাও—আসমানী তোমার জন্য করেছে। বাটিতে ঘি আছে ঘি নাও।

    ফরহাদ ভেবেছিল চলে আসার সময় আসমানীর সঙ্গে দেখা হবে তাও হল না। সে মন খারাপ করে পলাশ ফার্মেসীর দিকে রওনা হল। ডাক্তার সাহেবকে খবর দিয়ে বাসায় ফিরল হাঁটতে হাঁটতে। খুব যখন মন খারাপ থাকে তখন রিকসায় চড়তে ভাল লাগে না। হাঁটতে ইচ্ছা করে।

     

    জোবেদ আলি অন্ধকার বারান্দায় পা ঝুলিয়ে বসেছিলেন। ছোট ছেলের জন্যে অপেক্ষা। ফরহাদ বাসার গেটে হাত রাখা মাত্র জোবেদ আলি বললেন, কে মঞ্জু?

    ফরহাদ বলল, জ্বি না আমি। আপনি এখনো জেগে আছেন? ঘুম আসছে না?

    জোবেদ আলি রাগী গলায় বললেন—ঘুম আসবে কি ভাবে? বাগানের সব গাছ পাড়িয়ে মেরে ফেলেছে।

    কে মেরেছে?

    মঞ্জু মেরেছে। আর কে মারবে। এরিকা জাপানিকা গাছটার কি অবস্থা করেছে। আয় দেখে যা।

    অন্ধকারে দেখব কি ভাবে?

    আয় আমার হাতে টর্চ আছে।

    ফরহাদকে বাবার সঙ্গে বাগানে যেতে হল। জোবেদ আলি টর্চ ফেলে বললেন-ভাল করে দেখ। সুস্থ সবল একটা গাছের কি অবস্থা করেছে। মানুষকে মানুষ খুন করলে তার বিচার আছে। আইন আদালত আছে, শাস্তি আছে। অথচ গাছ হত্যা করলে তার শাস্তির বিধান নাই। গাছওতো জীবন। গাছ হত্যার শাস্তি আরো বেশী হওয়া উচিত কারণ গাছের জীবন থাকলেও সে প্রতিবাদ করতে পারে না, কেউ যখন তাকে হত্যা করতে আসে সে ছুটে পালিয়ে যেতে পারে না। ঠিক বলেছি কি-না বল।

    ফরহাদ বাবার প্রশ্নের জবাব দিল না কলঘরের দিকে রওনা হল। তার নিজের শরীরও খারাপ লাগছে। হাত মুখ ধুয়ে শুয়ে পড়বে। জোবেদ আলি ছেলের পেছনে পেছনে কলঘরে চলে এলেন।

    তোর খাবার টেবিলে টিফিন কেরিয়ারে রাখা আছে। খেয়ে নে—আজ তোর মা জাহানারার কাছে গিয়েছিল। সে কাচ্চি বিরিয়ানী দিয়ে দিয়েছে। ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। গরম করে নিতে হবে।

    জাহানারার কথা বলতেই ফরহাদের মনে পড়ল তার পকেটে আংটিটা রয়ে গেছে। দেয়া হয়নি। আজ আকীকা আজই দেয়া দরকার ছিল। আংটি ঠিকই কেনা হয়েছে। দেয়ার কথা মনে হয় নি। জোবেদ আলি বললেন, হাত ধুয়ে খেতে আয়।

    ফরহাদ বলল, আমি খেয়ে এসেছি।

    দাওয়াত ছিল?

    হ্যাঁ।

    দাওয়াত থাকলে আগে বলে যাবি। সবার জন্যে রান্না হয়। খাবার নষ্ট হয়। আজ তিনজনের ভাত নষ্ট হল। তোর আমার আর মঞ্জুর।

    তুমি খাও নি?

    খাও নি কেন?

    মঞ্জুর উপর রাগ করে খাই নি। কেমন বেয়াদপের মত চারাটা নষ্ট করল। রাগের চোটে ক্ষিধে নষ্ট হয়ে গেছে ভাত কি খাব।

    এসো খেতে এসো।

    জোবেদ আলি আপত্তি করলেন না ছেলের সঙ্গে খেতে গেলেন। টিফিনকেরিয়ারে কাচ্চিবিরিয়ানী ছাড়াও ঘরে ইলিশ মাছ রান্না হয়েছে। তিনজনের জন্যে তিনপিস ইলিশ মাছ ছিল। জোবেদ আলি তিন পিসই খেয়ে ফেললেন। আনন্দিত গলায় বললেন–সর্ষে ইলিশ রান্না খুবই জটিল। বাংলাদেশের খুব কম মেয়ে সর্ষে ইলিশ রাধতে পারে। তোর মা আগে পারত না। তোর দাদী হাতে ধরে রান্না শিখিয়েছে। এখন তোর মার কাছ থেকে ঐ বিদ্যা শিখে নেয়া দরকার। তোর বিয়ে হলে বৌমাকে প্রথম যে কাজটা করতে বলব সেটা হচ্ছে—শাশুড়ির কাছ থেকে সর্ষে বাটা রান্না শিখে নেয়া। বৌমা ঐ বিদ্যা শেখাবে তার ছেলের বৌকে…ঐ ভাবে চলতে থাকবে।

    ফরহাদ বাবার দিকে তাকিয়ে আছে। জোবেদ আলি এখন আংগুল চুষে চুষে সর্ষে ইলিশের ঝোল খাচ্ছেন। তিনি ছেলের দিকে মুখ ফিরিয়ে বললেন, তোর হাতে টাকা পয়সার অবস্থা কেমন?

    ভাল না। কেন?

    টাকা পয়সার অবস্থা ভাল থাকলে জাপানিকা গাছের একটা চারা কিনতাম! সবুজ ফুল হয়। ডেনজারাস না?

    চারা কিনতে কত লাগবে?

    আড়ইশ টাকা দাম। আমাকে অবশ্যি দেড়শতে দিয়ে দিবে।

    ফরহাদ পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে দুটা একশ টাকার নোট পানির গ্লাসের নিচে চাপা দিল। বাবাকে সরাসরি টাকা দিতে লজ্জা লাগছে। সব সময় লাগে। তাকে টাকা দিতে গেলেই ছেলেবেলার কথা মনে পড়ে। স্কুলে বনভোজন পনেরো টাকা চাঁদা। সেই চাঁদার জন্য এক সপ্তাহ ধরে বাবার পেছনে পেছনে ঘোরা। বাবার কত কঠিন কঠিন কথা।

    বনভোজন আবার কি? বন আছে না-কি যে বনভোজন? স্কুলের মাঠে আবার বনভোজন কি। মাঠ-ভোজন। দশ টাকা নিয়ে যা—ওদেরকে বল, আমার কাছে দশটাকাই আছে। নিলে নাও। না নিলে নাই। মাঠ ভোজনের জন্যে পনেরো টাকা এক আশ্চর্য ব্যাপার। ঘরে ঘরে যেন টাকশাল আছে। টাকা ছাপালেই হল।

    এখন চাকা ঘুরে গেছে। এখন জোবেদ আলি শুকনা মুখে ছেলের পেছনে পেছনে ঘুরেন।

    জোবেদ আলি ডালের বাটিতে লম্বা চুমুক দিয়ে বললেন দুইশ লাগবে না তুই পঞ্চাশ টাকা রেখে দে। সংসারের এই অবস্থা। এখন বাজে খরচ করা ঠিক না।

    কথা শেষ করার আগেই তিনি হাত বাড়িয়ে নোট দুটা নিয়ে নিলেন। ফরহাদ দি সত্যি সত্যি পঞ্চাশ টাকা রেখে দেয় তাহলে সমস্যা হবে। তিনি চন্দনগাছের একটা চারা কিনবেন বলে মনস্থির করে ফেলেছেন। চন্দন গাছের চারা আগে পাওয়া যেত না। এখন ইন্ডিয়া থেকে আসছে। শ্বেত চন্দন, রক্ত চন্দন দুরকম চারা আসছে—শ্বেত চন্দনটিই ভাল। তবে গাছ খুব নাজুক। শক্ত খুঁটির ব্যবস্থা করতে হবে।

    জোবেদ আলি তৃপ্ত গলায় বললেন—চা খাবি নাকি রে? খেলে বল আমি বানিয়ে দেব। সমস্যা নেই। হেভী খাবার পর চা হজমের সহায়ক এবং বলবর্ধক।

    না চা খাব না।

    তোর কাছে সিগারেট আছে? থাকলে একটা দে। চা খাওয়া হয়েছে একটা সিগারেট খেলে ভাল লাগবে। কে যেন বলেছিল ভরাপেট খাওয়ার একটা সিগারেট হজমের সহায়ক তবে আমার মনে হয় না। সিগারেট বিষবৎ পরিতাজ্য।

    ফরহাদ সিগারেট দিতে দিতে বলল, বাবা তোমাদের একটা খবর দিতে ভুলে গেছি।

    জোবেদ আলি বিস্মিত হয়ে বললেন, কি খবর?

    বিয়ে করব বলে ঠিক করেছি।

    জোবেদ আলি কিছুক্ষণ ছেলের দিকে তাকিয়ে থেকে হড়বড় করে বললেন, এটা ঠিক করাকরি কি আছে? বিয়েতো করতেই হবে। আমাদের ইসলাম ধর্মে সন্ন্যাসের কোন স্থান নেই। যত ইচ্ছা আল্লা বিল্লা করতে পার তবে সংসারে থেকে।

    ফরহাদ মাথা নিচু করে বলল, এমন কিছু বিয়ে না বাবা। কাগজে কলমে বিয়ে। কাজী সাহেবের সামনে কবুল কবুল বলা।

    বিয়েটা কবে?

    ডেট এখনো পুরোপুরি ফাইন্যাল হয়নি তবে শুক্রবারে হবার সম্ভাবনা।

    এই শুক্রবার?

    হ্যাঁ এই শুক্রবার।

    তোর মা জানে?

    না মা জানে না। তোমাকেই প্রথম বললাম। জোবেদ আলি সিগারেট হাতে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন। তিনি সিগারেট ধরাতে ভুলে গেছেন। তাকে দেখে মনে হচ্ছে তিনি নিজের ছেলেকে চিনতে পারছেন না।

    আজ কি বার?

    আজ মঙ্গলবার।

    তোর হাতে তো তাহলে একেবারেই সময় নাই।

    ফরহাদ চুপ করে রইল। জোবেদ আলি বললেন, বিয়ে যে করবি হাতে টাকা পয়সা আছে? অফিস থেকে লোন পাবি?

    অফিসের কথা ফরহাদ এতক্ষণ ভুলে ছিল। বাবার কথায় চট করে মনে হল। আজ রাতেই নান্টু ভাইয়ের কাছে যাওয়া দরকার। রাত অনেক হয়ে গেছে তাতে কি। নান্টু ভাইয়ের মেস সারারাতই ভোলা থাকে। হেঁটে যেতে আধঘন্টার মত লাগবে। রিক্সা করেও যাওয়া যায়। হেঁটে যাওয়া ভাল। আফটার ডিনার ওয়াক এ মাইল।

    জোবেদ আলি বললেন, মেয়েটাকে কিছু গয়না টয়না দিতে হবে। সুতা বেঁধে তো আর বিয়ে করতে পারবি না। তোর মাকে যখন বিয়ে করি তখন আমার তোর মতই খারাপ অবস্থা তার মধ্যেও তোর মাকে হাতের চুড়ি দিয়েছি, কানের দুল দিয়েছি, টিকলি দিয়েছি। শুধু গলায় কিছু দিতে পারি নি। ওরা গলারটা দিয়েছিল। মুখে বলেছে—তিন ভরি সোনার হার। স্যাকড়ার দোকানে ওজন নিয়ে দেখি দুই ভরি দুই আনা। কত বড় বদ চিন্তা করে দেখ। যাই হোক তুই একটা কাজ কর। তোর মার কাছ থেকে গলার হারটা নিয়ে পালিশ টালিশ করিয়ে মেয়েকে দে।

    ফরহাদ কিছু বলল না। জোবেদ আলি বললেন—বিয়ের শাড়ি কিনতে হবে। যাই হোক শাড়ি নিয়ে তুই চিন্তা করিস না। শাড়ির ব্যবস্থাটা তুই আমার হাতে ছেড়ে দে।

    শাড়ি তুমি কিনে দেবে?

    আরে দুর ব্যাটা। আমি শাড়ি কেনার টাকা পাব কোথায়? আমার এক ছাত্র মীরপুরে কাতান শাড়ির দোকান দিয়েছে। দোকানের নাম ক্যালকাটা শাড়ি হাউস। একদিন গিয়েছিলাম, খুব যত্ন করেছে। চা-সিংগারা মিষ্টি খাইয়েছে। ওর দোকান থেকে বাকিতে শাড়ি এনে দেব।

    আচ্ছা।

    জোবেদ আলি গলার স্বর নামিয়ে প্রায় ফিস ফিস করে বললেন, তোর মার হাতে ক্যাশ টাকা আছে। কত জানি না। তবে আছে। আপাতত তার কাছ থেকে নে। আমি যে তোকে বলেছি সেটা যেন আবার না জানে।

    ফরহাদ বাবার দিকে তাকিয়ে হাসল। তার হাতের সিগারেট নিভে গেছে দিকে লক্ষ্য নেই। নেভানো সিগারেটই তিনি টানছেন। এবং ধোয়া ছাড়ার ভঙ্গি করছেন।

    তোর মুখ দেখে মনে হচ্ছে খুব দুঃশ্চিন্তা করছিস। একেবারেই দুঃশ্চিন্তা করবি না। আল্লাহর হুকুম ছাড়া বিয়ে হয় না। আল্লাহ পাকের হুকুম হয়েছে বলেই বিয়ে হচ্ছে। আল্লাহ পাকের হুকুম যেন ঠিকমত পালন হয় সেই ব্যবস্থাও উনিই করেন। দেখবি বিয়ের টাকা ঠিকই জোগাড় হবে। ঐ যে কথায় আছে না সর্প হইয়া দংশন কর ওঝা হইয়া ঝাড়। ব্যাপার সে রকমই।

    আমি দুঃশ্চিন্তা করছি না—বাবা শোন আমি একটু বেরুব। তুমি দরজা বন্ধ করে দাও।

    এত রাতে কোথায় বের হবি?

    একটা কাজ আছে বাবা। না গেলেই না। রাতে ফিরব না। কাজেই দরজা খোলার জন্যে তোমাকে জেগে থাকতে হবে না।

    জোবেদ আলি চিন্তিত গলায় বললেন, বিয়ে ঠিক ঠাক হবার পর রাতে বিরাতে বের হতে হয় না। সাবধানে থাকতে হয়।

    কেন?

    কেন তা জানি না। পুরানা কালের মানুষরা নিয়ম করে গেছেন।

    আমার খুব দরকার বাবা। যেতেই হবে।

    যেতে হলে যা। তবে সাবধানে যাবি। তোকে তো আসল কথাই জিজ্ঞেস করা হয় নি- বৌমার নাম কি?

    ডাক নাম আসমানী।

    মাশাল্লাহ সুন্দর নাম। ভাল নাম কি?

    ভাল নাম জানি না বাবা।

    জোবেদ আলি বিস্মিত হয়ে বললেন, শুক্রবারে যার সঙ্গে বিয়ে হবে তার ভাল নাম জানিস না, বৌমা এই ঘটনা যদি জানে মনে খুবই কষ্ট পাবে।

    জানবে না।

    জানবে না কেন? অবশ্যই জানবে। আমি নিজেই বলে দেব। আমার খুবই রাগ লাগছে। আরেকটা কথা, শুক্রবারে তোর বিয়ে এই ঘটনা তুই আমাকে আগে বলেছিস এতেও তোর মা রাগ করবে। আমাকে যে আগে বলেছিস এটা তোর মাকে জানানোর দরকার নেই। পরে তোর মা যখন আমাকে বলবে তখন আমি খুবই অবাক হবার ভঙ্গি করব। তোর মা কিছু বুঝতে পারবে না।

    ফরহাদ উঠে পড়ল। বাবার সামনে বসে থাকলে তিনি ক্রমাগতই কথা বলতে থাকবেন। শুধু শুধু দেরী হবে।

    জোবেদ আলি বললেন, তোর দাদাজানকেও বিয়ের কথাটা নিজের মুখে বলিস। মুরুব্বী মানুষের দোয়া বিয়ে শাদীতে অত্যন্ত দরকার। তোর দাদাজান জেগে আছে—এখনি বলে যা।

    এত রাতে দাদাজান জেগে আছেন কেন?

    জানি না। সন্ধ্যা থেকে বিড়বিড় করছে।

    শরীর খারাপ না-কি?

    শরীর খারাপ হলেতো ঝিম মেরে থাকবে। বিড়বিড় বিড়বিড় করবে না। শরীর মনে হয় ভালই।

    ফরহাদ দাদাজানের ঘরে ঢুকল। ঘর অন্ধকার। দাদাজানের খাটে মশারী ফেলা। অন্ধকারেও দেখা যাচ্ছে তিনি মশারীর ভেতর বসে আছেন—দৃশ্যটাই অস্বাভাবিক। হঠাৎ বুকে ছোট্ট একটা ধাক্কা লাগে। ফরহাদ বলল, দাদাজান জেগে আছেন?

    মেম্বর আলি বললেন, হুঁ।

    শরীর খারাপ না-কি?

    শরীরটা আজ ভাল।

    জেগে আছেন কেন? ঘুম আসছে না?

    খুব ভুখ লেগেছে। এইজন্যে ঘুম আসছে না।

    রাতে খান নি?

    সন্ধ্যাবেলা বৌমা সাগু দিয়েছিল।

    এখন কিছু খেতে ইচ্ছা করছে?

    হুঁ।

    কি খাবেন?

    পোলাও খেতে ইচ্ছা করতেছে।

    এত রাতে পোলাও কোথায় পাব দাদাজান?

    জাহানারা পোলাও পাঠায়েছে।

    ও আচ্ছা। আপনি খাবেন? দেব গরম করে?

    দে।

    পেট খারাপ করবে নাতো?

    মেম্বর আলি হতাশ গলায় বললেন, খুব ভুখ লেগেছে রে ব্যাটা। পিরিচে করে সামান্য এনে দে খাই। কিচ্ছু হবে না।

    আচ্ছা আমি নিয়ে আসি।

    আমি তোর জন্যেই জেগে বসেছিলাম। আর কেউ খেতে দিক না দিক তুই যে দিবি এটা আমি জানি।

    ফরহাদ পোলাও গরম করল। লেবু কাটল, কাচামরিচ নিল, ঘরে আমের আচার ছিল, প্লেটের কোণায় সামান্য আচারও নিল। বুড়ো যখন কুপথ্য করবে ভালমতই করুক। সাগু খেলেও পেট খারাপ, পোলাও খেলেও পেট খারাপ। ভাল জিনিশ খেয়েই পেটটা খারাপ করুক।

    খাবার সাজিয়ে ঘরে ঢুকে ফরহাদ দেখল দাদাজান বিছানায় শুয়ে ঘুমুচ্ছেন। গাঢ় ঘুম। অনেক চেষ্টা করেও সেই ঘুম সে ভাঙ্গাতে পারল না। এম্নিতেই অনেক রাত হয়েছে। আর দেরী করা ঠিক হবে না। ফরহাদ বাতি নিভিয়ে দিল। আজ নান্টু ভাইয়ের কাছে না গিয়ে সকালে গেলে কেমন হয়? শরীর দুর্বল লাগছে। শেষ পর্যন্ত সে যাওয়াই ঠিক করল। তার মন বলছে যে উদ্বেগের ভেতর সে আছে—নান্টু ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হলে সেটা অনেকটা কমবে। বাগানে নেমেই ফরহাদ দেখল—গেটের কাছে গাড়ি এসে থেমেছে। গাড়ি থেকে নামছে মঞ্জু। মঞ্জুর হাতে সিগারেট। বড় ভাইকে দেখে সে সিগারেট ফেলে দিল। হাতের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, ভাইয়া তুমি কি বের হচ্ছ?

    হ্যাঁ।

    এত রাতে?

    জরুরী একটা কাজ পড়ে গেছে। যেতেই হবে।

    কোথায় যাবে?

    আগামাসিহ্ লেন।

    এক কাজ কর গাড়ি নিয়ে যাও।

    কার গাড়ি?

    ভাড়া গাড়ি। সারা দিনের জন্যে ভাড়া করেছিলাম। আমি ড্রাইভারকে বলে দিচ্ছি ও তোমাকে নামিয়ে দিয়ে যাবে।

    তাহলে তো ভালই হয়।

    ফরহাদ মঞ্জুর দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকার কারণ আছে। মঞ্জু খুব স্বাভাবিক অবস্থায় নেই। সে ঠিকমত দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না–সামান্য টলছে। মঞ্জুর মুখ ভর্তি জর্দা দেয়া পান। জর্দার কড়া গন্ধ মদের গন্ধ ঢাকতে পারছে না।

    মঞ্জু কি একা একা হেঁটে বাসায় ঢুকতে পারবে। গেটের কাছে হুমড়ি খেয়ে পড়ে যাবে নাতো? সবচে ভাল হয় তাকে ধরে ধরে বাসায় নিয়ে যাওয়া। সেটাও ঠিক হবে না। মঞ্জু লজ্জা পাবে। মানুষকে লজ্জা দিয়ে লাভ কি?

    একটা কাজ করলে কেমন হয়? গাড়ি যখন আছে তখন ড্রাইভারকে বললে হয় না—আগামসি লেনে যাব না। আমাকে উয়ারীতে নামিয়ে দিয়ে চলে যান। রাত খুব বেশি হয় নি। তাছাড়া ঐ বাড়িতে আজ উৎসব। উৎসবের বাড়ির লোকজন নিশ্চয়ই অনেক রাত পর্যন্ত জাগবে। একটাই সমস্যা জাহানারা নানান ধরনের আহ্লাদী করবে। এটা খাও, ওটা খাও। ওমা এত রোগা হয়েছ কেন? চোখের নিচে কালি কেন?

    সহজ স্বাভাবিক মেয়েরা বিয়ের পরে ন্যাকা ধরনের হয়ে যায়। বাপের বাড়ির কাউকে পেলে নানান ধরনের ন্যাকামী করে। যাকে নিয়ে ন্যাকামী করা হচ্ছে তার কাছে যে ব্যাপারটা অসহ্য লাগে তা বুঝতেই পারে না।

    শেষবার যখন ফরহাদ গিয়েছিল জাহানারা ধরা গলায় বলল, ভাইয়া আমি তোমার বোন না? ছমাস পর তুমি আমাকে দেখতে এলে? কেন এসেছ? না তুমি বসতে পারবে না। তুমি চলে যাও। বলতে বলতে কেঁদে কেটে বিশ্রী অবস্থা। ফরহাদের ধারণা জাহানারার ন্যাকামী বয়সের সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে।

    ফরহাদ ড্রাইভারকে বলল, ড্রাইভার সাহেব আমাকে আগামসি লেনে নামাতে হবে না। উয়ারীতে নামিয়ে দেন।

    ড্রাইভার বিরক্ত মুখে বলল, আগে কইবেন না?

    আগে না বলাটা খুবই অন্যায় হয়েছে ক্ষমা করে দিন।

    আকাশে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে মনে হয় বৃষ্টি হবে। জাহানারার বাড়িতে যাবার সিদ্ধান্ত ভুল হয়েছে। ফরহাদের মন বলছে সে বাড়িতে ঢুকবে এবং শুরু হবে বৃষ্টি। জাহানারা শুরু করবে ন্যাকামী। না ভাইয়া তুমি যেতে পারবে না। বৃষ্টির মধ্যে তুমি যদি যাও আমি কিন্তু ভয়ংকর কিছু করে বসব। তুমি আজ কতদিন পর এ বাড়িতে এসেছ ভেবে দেখ।

    বৃষ্টি নামল না কিন্তু জাহানারা ভাইকে দেখে ন্যাকামীর চূড়ান্ত করল। কিছু মুখে না দিয়ে সে ফরহাদকে যেতে দেবে না। সেই কিছু মানে পোলাও মুরগির রোস্ট। খাবার কম পড়েছিল বলে নতুন করে রান্না হয়েছে। নতুন রান্না মুখে দিতেই হবে। ফরহাদ যদি না পায় সে খাবে না। দুপুরেও সে ঝামেলার জন্যে খেতে পারে নি।

    ফরহাদ বিরক্ত মুখে বলল, কেন এত যন্ত্রণা করছিস?

    জাহানারা বলল, ভাইয়া তোমার দুর্ভাগ্য যে তোমার একটা বোন আছে। বোন যখন আছে সেতো যন্ত্রণা করবেই বোনকেতো আর ফেলে দিতে পারবে না? -কি ফেলে দেবে?

    ফরহাদকে ভরাপেটে আবারো খেতে বসতে হল। খাবার নিয়ে এল জাহানারার ননদ রাণী। ফরহাদ বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করল রাণী মেয়েটা তাকে দেখে লজ্জায় মরে যাচ্ছে। এই মেয়েকে সে অনেকবার দেখেছে কিন্তু এত লজ্জা পেতে কখনো দেখে নি। আজ এত লজ্জা পাচ্ছে কেন?

    ভাইয়া আমার ননদ রাণীকে চিনতে পারছতো?

    হ্যাঁ।

    দেখছ কি সুন্দর মেয়ে? সুন্দর না ভাইয়া?

    ফরহাদ বলল, অবশ্যই সুন্দর।

    জাহানারা হাসছে। ফরহাদ তার হাসির কারণ ধরতে না পেরে অবাক হয়ে তাকাল। রাণীর হাতে পোলাওয়ের ডিস, সে ডিস নামিয়ে প্রায় দৌড়ে পালিয়ে গেল। ফরহাদ বলল, ব্যাপার কি রে?

    জাহানারা হাসতে হাসতে বলল, ব্যাপার আবার কি? ব্যাপার কিছু না। মা তোমাকে কিছু বলে নি?

    না।

    মার সঙ্গে দেখা হয় নি?

    না মা ঘুমুচ্ছিলেন।

    ভাইয়া তুমি হাত গুটিয়ে বসে আছ কেন? না বললে হবে না, তোমাকে আরেকবার পোলাও নিতে হবে। রাণীর আক্কেলটা কেমন তোমাকে একবার পোলাও দিয়ে চলে গেল। সেকি চায় আমার ভাই খালে পড়ক। দাঁড়াও ওকে নিয়ে আসছি।

    ওকে আনার দরকার কি?

    দরকার আছে। আমি বিনা দরকারে কোন কাজ করি না।

    জাহানারা গর্বিত ভঙ্গিতে চলে যাচ্ছে। ফরহাদের মেজাজ খুবই খারাপ। আংটি নিয়ে আসা ঠিক হয় নি। মা সোনার চেইন দিয়েছেন এই খবরটা আগে জানতে

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleছায়াবীথি – হুমায়ূন আহমেদ
    Next Article চাঁদের আলোয় কয়েকজন যুবক – হুমায়ূন আহমেদ

    Related Articles

    হুমায়ূন আহমেদ

    আসমানীরা তিন বোন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    ইস্টিশন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    উড়ালপঙ্খী – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    এই বসন্তে – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    এই মেঘ, রৌদ্রছায়া – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    এইসব দিনরাত্রি – হুমায়ূন আহমেদ

    December 23, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    আসমানীরা তিন বোন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    আসমানীরা তিন বোন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    Our Picks

    আসমানীরা তিন বোন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025

    ইস্টিশন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025

    উড়ালপঙ্খী – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }