Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    আসমানীরা তিন বোন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025

    ইস্টিশন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025

    উড়ালপঙ্খী – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    চৈত্রের দ্বিতীয় দিবস – হুমায়ূন আহমেদ

    হুমায়ূন আহমেদ এক পাতা গল্প238 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    ০৬. রাহেলা খুবই অবাক হয়েছেন

    রাহেলা খুবই অবাক হয়েছেন এই শুক্রবারে তাঁর ছেলের বিয়ে অথচ তিনি কিছু জানেন না। শুক্রবার মানেতো আগামী কাল। এমন একটা খবর তাঁকে অন্যের কাছ থেকে শুনতে হল? তিনি কি এতই তুচ্ছ, এতই নগন্য? রাহেলা খবরটা কিছুক্ষণ আগে শুনেছেন। চা খেতে খেতে জোবেদ আলি মনের ভুলে বলে ফেললেন, ঘর দোয়ার একটু গুছাতে হয়। নতুন বৌ আসছে। তোমার কাছে টাকা পয়সা কিছু আছে? টুকটাক কিছু ইলেকট্রিকের কাজ করা দরকার। বারান্দার বাতি জ্বলে না, বাথরুমের বাতি জ্বলে না। ভাবছি বাগানেও একটা একশ পাওয়ারের বাত্ব frie i

    রাহেলা বললেন, বিড়বিড় করে নিজের মনে কি বলছ?

    জোবেদ আলি শংকিত গলায় বললেন, কিছু বলছিনাতো।

    নতুন বৌ আসছে মানে কি?

    জোবেদ আলিকে মূল ঘটনা প্রকাশ করতে হল। সকাল বেলার চা-টা তিনি আগ্রহ করে খান। চা খাওয়ার মাঝখানে একি বিপত্তি? এরিকা জাপানিকার চারা কিনেছেন। চারা লাগাবার জন্যে জমি তৈরী করতে হবে। পঁচা গোবরের সন্ধানে যেতে হবে। রাহেলার প্যাচে পড়লে বের হওয়া যাবে না।

    রাহেলা বললেন, ফরহাদ বিয়ে করছে?

    জোবেদ আলি বললেন, হুঁ।

    সব ঠিকঠাক?

    ঠিকঠাক না হলে বিয়ে হবে কি ভাবে?

    আমি জানলাম না কেন?

    তোমাকে বলার সুযোগ পায় নি।

    তোমাকেতো ঠিকই বলার সুযোগ পেয়েছে, আমাকে পায় নি কেন?

    তোমার ঘুমের সমস্যা তুমি সকাল সকাল শুয়ে পড়—তারপর ধর ইয়ে…কি যেন বলে…

    বিড়বিড় করবে না। বিড়বিড় বন্ধ কর।

    জোবেদ আলি চায়ের কাপ নামিয়ে রাখতে রাখতে বললেন, রাহেলা তুমি স্বভাব চরিত্র বদলাও। নতুন একটা মেয়ে আসছে এসেই দেখবে তার শাশুড়ির প্রধান কাজ হচ্ছে তার শ্বশুরকে ধমকানো এটা তার ভাল লাগবে না। সব মেয়েরাই স্বামীকে ধমকাতে পছন্দ করে। কিন্তু যখন দেখে অন্য কোন মেয়ে তার স্বামীকে ধমকাচ্ছে তখন খুব রাগ করে।

    বিয়ের খবরটা তুমি কবে জেনেছ?

    পরশু রাতে।

    পরশু রাতে জেনেছ মাঝখানে পুরো একটা দিন গিয়েছে আর তুমি আমাকে কিছুই জানাও নি।

    আহারে যন্ত্রণা। বিয়েটা যদি আমার হত আমি বিয়ে ঠিক হওয়া মাত্র তোমাকে জানাতাম। বিয়ে ফরহাদের। সে তোমাকে না জানালে আমি কি করব?

    আমাকে জানাতে তার অসুবিধা কোথায়?

    আছে নিশ্চয়ই কোন অসুবিধা।

    রাহেলা স্বামীর সামনে থেকে উঠে গেলেন। ফরহাদ থাকলে সরাসরি তার কাছে যেতেন। ফরহাদ নেই, খুব ভোরে উঠেই চলে গেছে। নাসতা খায় নি। এক কাপ চা শুধু খেয়েছে। তাঁর সঙ্গে দেখা হয় নি। ঘুমের অষুধ খাওয়ার পরেও কাল রাতে তার এক ফোটা ঘুম হয়নি। ফজরের আজান শুনে ঘুমুতে গেছেন। ঘুম ভেঙ্গেছে সকাল দশটায়। ঘুম ভেঙ্গেই দুঃসংবাদ। ছেলের বিয়ে দুঃসংবাদতো বটেই। মার কাছে মেয়ের বিয়ে সুসংবাদ। ছেলের বিয়ে দুঃসংবাদ।

    মঞ্জু দাড়ি শেভ করছিল। ব্লেডে ধার না থাকায় তার গাল কেটে গেছে। রক্ত বের হয়ে শাদা ফেনায় লাল আভা। মঞ্জু বিরক্ত হয়ে আয়নার ভেতরের মঞ্জুকে দেখছে। যেন তার গাল কেটে ফেলায় সে আয়নার ভেতরের মঞ্জুকে দায়ী করছে। মাকে ঢুকতে দেখে সে তার বিরক্ত দৃষ্টি মার দিকে ফিরিয়ে দিল। এখন তাকে দেখে মনে হচ্ছে তার গাল কাটায় রাহেলারও কোন সূক্ষ্ণ ভূমিকা আছে।

    রাহেলা বললেন, কি করছিস?

    মঞ্জু বলল, কি করছি দেখতে পাচ্ছ না?

    গালতো কেটে ফেলেছিস?

    দরজা থেকে সরে যাওতো মা অন্ধকার করে রেখেছ। নিজের পেটের ছেলে এমন ভঙ্গিতে কথা বলছে ভাবাই যায় না। তাঁর হাতে ক্ষমতা থাকলে দারোয়ান দিয়ে কানে ধরিয়ে এই ছেলেকে বাসার চারপাশে কয়েকটা চক্কর দেয়াতেন। অক্ষম মারা ইচ্ছা থাকলেও কিছু করতে পারেন না। তিনি দরজা ছেড়ে সরে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললেন, তোর সঙ্গে ফরহাদের কথা হয়েছে?

    না।

    সে যে বিয়ে করছে জানিস?

    জানি।

    তোকে কে বলেছে?

    ভাইয়া।

    কখন বলেছে?

    দেখছ একটা কাজ করছি। কি ভ্যানভ্যান শুরু করলে? কখন বলেছে তা দিয়ে তোমার দরকারটা কি?

    তোর সঙ্গে কি কথা হয়েছে একটু বল, দরকার আছে।

    বিরক্ত করোনাতো মা, প্লীজ। ভাইয়ার সঙ্গে আমার এমন কোন কথা হয়নি। আজ বিকেলে মেয়ে পক্ষের লোকজন কথা বলতে আসবে। আমাকে থাকতে বলেছে।

    আজ বিকেলে আসবে?

    মঞ্জু জবাব দিল না। রাহেলা বললেন, চা খাবি? মঞ্জু এই প্রশ্নের ও জবাব দিল। রাহেলা বের হয়ে রান্নাঘরে গেলেন। কিছু কিছু সময়ে তাঁর ধৈর্য সীমাহীন। তিনি চা বানিয়ে আবার ছেলের কাছে আসবেন। তখন মঞ্জু তার সঙ্গে ভদ্র ভাবে, কথা বলবে তিনি এ ব্যাপারে নিশ্চিত। কারণ ছেলে মার সঙ্গে একটু আগে খুব খারাপ ব্যবহার করেছে। তার জন্যে সে কিছুটা হলেও অনুতপ্ত বোধ করবে। ছেলে যদি পুরোপুরি অমানুষ হয়ে গিয়ে থাকে তাহলে অবশ্যি ভিন্ন কথা। সেই সম্ভাবনা। তিনি উড়িয়ে দিচ্ছেন না। ছেলেবেলায় মঞ্জু অতি শান্ত ছিল। কোন অভিযোেগ নেই, কোন দুষ্টামী নেই, খাওয়া নিয়ে ঝামেলা নেই। সন্ধ্যা হলেই পড়তে বসছে। যতক্ষণ পর্যন্ত তিনি না বলছেন—অনেক হয়েছে বাপ ঘুমুতে যাও। ততক্ষণ পর্যন্ত মাথা ঝুলিয়ে পড়ছেই। তখনি বোঝা উচিত ছিল বড় হয়ে এই ছেলে হারামজাদা টাইপ হয়ে যাবে।

    রাহেলা চা নিয়ে মঞ্জুর ঘরে ঢুকে দেখেন তার শেভ করা হয়ে গেছে। সে সিগারেট ধরিয়েছে। মাকে দেখে সে বিরক্ত মুখে সিগারেট জানালা দিয়ে ফেলে দিল। রাহেলা ছেলের এই বিরক্তি ক্ষমা করে দিলেন। দামী একটা সিগারেট, দুটা টান দিয়ে ফেলে দিতে বিরক্তি লাগবেই। তিনি যদি সিগারেট খেতেন, তিনিও বিরক্ত হতেন। রাহেলা বললেন, মঞ্জু চা নে।

    চা-তো আমি চাই নি।

    মঞ্জু বিরক্ত মুখে চায়ের কাপ হাতে নিল। রাহেলা ছেলের সামনে বসতে বসতে বললেন, ফরহাদ বিয়ে করছে ভাল কথা। বিয়ের বয়স হয়েছে। পাত্রী ঠিক আছে। অসুবিধা কি? সে যদি ভেবে থাকে বিয়েটা সম্পূর্ণ তার নিজের ব্যাপার, কাউকে কিছু বলার দরকার নেই, তাহলেও ঠিক আছে।

    ঠিক থাকলে তোমার এত কথার দরকার কি?

    বিয়ে যে করছে, বউ নিয়ে সে থাকবে কোন ঘরে? তুই কি তোর দাদাজানকে তোর ঘরে রাখবি?

    না।

    তাহলে তোর দাদাজান থাকবে কোথায়?

    ভাইয়া নিশ্চয়ই কোন ব্যবস্থা করবে।

    কি ব্যবস্থা করবে?

    নতুন বাসা ভাড়া করে ভাবীকে নিয়ে উঠবে।

    তোকে বলেছে?

    না আমাকে কিছু বলে নি। তুমি ভাল করেই জান ভাইয়ার সঙ্গে বসে আমি খেজুরে আলাপ করি না।

    আজ সন্ধ্যায় তাহলে মেয়ে পক্ষের লোকজন আসবে?

    হ্যাঁ।

    তুই থাকবি বাসায়?

    আমি বলতে পারছি না। আমার কাজ আছে। কাজ শেষ করতে পারলে চলে আসব।

    কি কাজ?

    কি কাজ বললে তুমি বুঝবে?

    তুই কি চাকরি বাকরি কিছু পেয়েছিস?

    চাকরি পাব কোথায়? বাংলাদেশে চাকরি আছে? ব্যবসা করার চেষ্টা করছি।

    ব্যবসা করতেও তো টাকা লাগে। টাকা পাবি কোথায়?

    সব ব্যবসায় টাকা লাগে না। বাংলাদেশের বেশীর ভাগ ব্যবসাই বিনা টাকার ব্যবসা। এখনকার ব্যবসায় যে জিনিসটা লাগে তার নাম বুদ্ধি।

    তোর ধারণা তোর অনেক বুদ্ধি?

    হ্যাঁ আমার বুদ্ধি খারাপ না। এখন তুমি যাও আমি সিগারেট খাব।

    ব্যবসা ট্যাবসার ব্যাপারে জামাইয়ের সঙ্গে পরামর্শ করতে পারিস। ব্যবসার ব্যাপার ওরা ভাল বুঝে।

    মঞ্জু সিগারেটের প্যাকেটে হাত দিল। হাতে সিগারেটের প্যাকেট দেখে যদি রাহেলা তাকে মুক্তি দেন। রাহেলা ছেলেকে মুক্তি দিলেন। বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন। মেয়ের কাছে যাবেন কি-না বুঝতে পারছেন না। সংসারে সমস্যা হওয়া শুরু হয়েছে। এইসব সমস্যা নিয়ে মেয়ের সঙ্গে ঠাণ্ডা মাথায় আলাপ করতে হবে। সব শুনলে জাহানারা তাঁর উপর খুবই রাগ করবে। জাহানারা ধরেই নিবে মার কারণে সংসারে বিশৃঙ্খলা হচ্ছে। রাণীর সঙ্গে বিয়েটা হচ্ছে না কেন এই জবাবদিহিও রাহেলাকেই করতে হবে। অথচ তিনি ধরেই নিয়েছিলেন রাণীর সঙ্গে ফরহাদের বিয়েটা তিনি দিতে পারবেন। দিন রাত ভেবে সূক্ষ্ম কিছু পরিকল্পনাও তিনি করেছিলেন। এ জাতীয় পরিকল্পনা অতীতেও তিনি করেছেন। তখন কাজ করেছে। জাহানারার বিয়েতে তিনি এইভাবেই দিলেন। জাহানারা পালিয়ে গিয়ে যে ছেলেকে বিয়ে করবে বলে ঠিক করেছিল, সেই বিয়ে তিনি হতে দেননি। তার ফল শুভ হয়েছে।

    রাহেলা মনে হল আজই মেয়েকে কিছু জানানো ঠিক হবে না। বিয়ের কথা হলেই যে বিয়ে হয়ে যাবে এমনতো না। চল্লিশ জায়গায় বিয়ের কথা হয়, কিন্তু বিয়ে চল্লিশ জায়গায় হয় না। বিয়ে এক জায়গাতেই হয়। তাঁর মন বলছে ফরহাদের বিয়ে রাণীর সঙ্গে হবে। তিনি ভোর রাতে এরকম একটা স্বপ্ন দেখেছেন। বউ সেজে রাণী তাঁর ঘরে ঢুকেছে। তার গা ভর্তি গয়না, পরনে লাল টুকটুকু শাড়ি। তাকে সালাম করতে করতে বলেছে—আপনাকে এত দিন মাঐ মা ডেকেছি, আজ হঠাৎ মা ডাকতে পারব না। আপনি কিন্তু কিছু মনে করতে পারবেন না।

    ফজরের নামাজের স্বপ্ন ভুল হবার কথা না। চাঁদের হিসাবটা দেখতে হবে। শুক্লা পক্ষের চাঁদ হলে স্বপ্ন মিলে যাবে। কৃষ্ণপক্ষ হলে মিলতেও পারে আবার নাও মিলতে পারে।

    আজ সন্ধ্যাবেলায় মেয়ে পক্ষের লোকজন কথা বলতে আসবে। তাদের সঙ্গে মুরুব্বী মহিলাও নিশ্চয়ই থাকবেন। বিয়ের আলাপে পুরুষদের সঙ্গে মহিলারা সব সময় আসেন। মহিলারা আসেন ভেতরের খবর বের করার জন্যে। সেই মহিলাকে ভেতরের খবর তিনি সবই দেবেন। কিছুই লুকাবেন না। এক ছেলের হাতে পুরো সংসার। অসুস্থ বৃদ্ধ একজন মানুষ আছে। ঢাকা শহরে নিজেদের বাড়ি ঘর বলতে কিছু নেই। অন্যের বাড়িতে পাহারাদার হিসেবে থাকা। যে কোন সময় তারা বাড়ি থেকে বের করে দিতে পারে। তখন যেতে হবে গাছ তলায়। দেশের বাড়িতে গিয়ে যে থাকবে সেই উপায়ও নেই। দেশে ভিটা বাড়ি ছাড়া আর কিছু নেই। সেই বাড়িতে কেউ থাকে না। ঘর-দোয়ার ভেঙ্গে পড়েছে। চারদিকে জংলা, সাপ খোপের আচ্ছা।

    বৌমা আছ বৌমা।

    রাহেলা বিরক্ত মুখে ফরহাদের ঘরের দিকে তাকালেন। মেম্বর আলির আজ জ্বর এসেছে। কত জ্বর বোঝা যাচ্ছে না। থার্মোমিটার খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। কাউকে দিয়ে যে থার্মোমিটার কিনে আনাবেন তাও সম্ভব না। কাজের মেয়েটা ছুটিতে গিয়েছে। মঞ্জুকে বললে লাভ হবে না। তবু বলে দেখা যেতে পারে। নিজের বিবেকের কাছে পরিষ্কার থাকা। কেউ যেন বলতে না পারে—শ্বশুরের জ্বর হয়েছে একটা থার্মোমিটার আনিয়ে জ্বরটা যে মাপবে তাও করেনি। তবে এক্ষুণী মঞ্জুর ঘরে ঢুকে কিছু বলার দরকার নেই। তাঁকে ঘরে ঢুকতে দেখলেই মঞ্জু দপ করে জ্বলে উঠবে। তার দরকার কি। গাল বাড়ালেই যদি চড় খেতে হয় তাহলে গাল বাড়ানো কেন? একসময় না একসময় মঞ্জু ঘর থেকে বের হবে। বের হবার মুখে বললেই হবে।

    বৌমা ও বৌমা।

    রাহেলা মুখ অন্ধকার করে শ্বশুরের ঘরে ঢুকলেন। মেম্বর আলি বললেন, আমলকি খাব বৌমা।

    কি খাবেন?

    আমলকি।

    রাহেলা তিক্ত গলায় বললেন—আব্বা শুনুন আপনিতো বেহেশতে বাস করছেন যে কোন একটা ফল খেতে ইচ্ছা করল মুখ দিয়ে বললেন, অমি ফলটা এসে মুখের সামনে ঝুলতে থাকল। আমলকি এখন পাব কোথায়?

    লবণ দিয়ে একটা আমলকি খেলে মুখে স্বাদটা ফিরে।

    বুড়ো মানুষের মুখে এত স্বাদ হওয়া ভাল না। স্বাদ হলে দুনিয়ার কুপথ্য করবেন আর পেট নামবে।

    মঞ্জু বাসায় আছে না? তার কথা শুনলাম।

    হ্যাঁ আছে।

    মঞ্জুকে বলে দাও। এখন কার্তিক মাস, আমলকির সিজন।

    আব্বা শুনুন, আপনার বয়স হয়েছে, শরীর ভাল না। আপনি আল্লাহখোদার নাম নেন। তসবি পড়ার মত আমলকি আমলকি করছেন কেন? আমলকির মধ্যে আছে টা কি?

    আমলকি স্বাদ বর্ধক। আমলকি, জলপাই দুইটাই কার্তিকের ফল, দুইটাই স্বাদ বর্ধক। মা মঞ্জুকে জলপাইও আনতে বল। একটা কাগজে লিখে দাও। লিখে দিলে মনে থাকবে না।

    আচ্ছা যান বলব।

    লেবু চা একটু দিতে পারবে মা?

    ঘরে লেবু নাই।

    লেবু না থাকলে রং চা দাও। বৃদ্ধ মানুষের জন্যে রং চা মহৌষধ।

    রাহেলা বললেন, চা দিচ্ছি। আব্বা আপনাকে একটা কথা বলি একটু মন দিয়ে শুনুন।

    মা তোমার সব কথা আমি মন দিয়ে শুনি।

    এটা একটু বেশি মন দিয়ে শুনুন। আপনার বয়স হয়েছে। এই বয়সে খুব ভাল সেবা দরকার। আপনি আপনার মেয়ের কাছে কয়েকটা দিন থেকে আসেন।

    এইখানে আমার সেবা হচ্ছে না তোমাকে কে বলল? এরচে বেশি সেবা কে আমাকে করবে? রাতে যতবার ঘুম ভাঙ্গে, আমি বিছানায় নড়াচড়া করতেই তোমার ছেলে ফরহাদ লাফ দিয়ে উঠে পড়ে। মশারী তুলে জিজ্ঞেস করে, দাদাজান কি হয়েছে? এরচে বেশিতে ফেরশতাও করবে না।

    ফরহাদতো আর সারাজীবন আপনাকে সঙ্গে নিয়ে ঘুমাবেনা। ও বিয়ে করবে। সে তার সংসার দেখবে।

    মেম্বর আলি হাসি মুখে বললেন, সে সংসার দেখবে, সংসারের ফাঁকে ফাঁকে আমাকেও দেখবে। যে দেখতে পারে সে সংসারে থেকেও দেখতে পারে।

    রাহেলা চা বানাতে রান্নাঘরে ঢুকলেন। তাঁকে বিস্মিত করে দিয়ে মঞ্জুও প্রায় সঙ্গে সঙ্গে রান্নাঘরে ঢুকল। মঞ্জু তার নিজের ঘর আর এ বাড়ির বারান্দা ছাড়া কোথাও যায় না। রান্নাঘরে সে কখনো উঁকি দিয়েছে বলে তিনি মনে করতে পারছেন না। রাহেলা বললেন, কি আরেক কাপ চা খাবি?

    মঞ্জু বলল, চা খাব না। মা শোন এই পঞ্চাশটা টাকা রাখ, দাদাজান আমলকি খেতে চাচ্ছে তাকে আমলকি এনে খাইও। আর সাথে এই টাকাটা রাখ সংসারের খরচ। এখন থেকে মাসের এক দুই তারিখে আমি যা পারি দেব।

    রাহেলা আনন্দিত গলায় বললেন, এখানে কত টাকা?

    দুই হাজার।

    রাহেলা টাকাটা হাতে নিয়েই শুনতে শুরু করলেন। সব একশ টাকার নতুন নোট। একটার গায়ে একটা লেগে আছে। গুনতে কষ্ট হচ্ছে। পৃথিবীর সবচে আনন্দময় কষ্টের একটা কষ্ট হচ্ছে টাকা গোনার কষ্ট। একটু আগে মঞ্জু যে খারাপ ব্যবহার তাঁর সঙ্গে করেছে তার কিছুই এখন রাহেলার মনে নেই। ছেলের প্রতি মমতায় তাঁর হৃদয় এখন আদ্র। তার মন বলছে এই ছেলে ফরহাদের মত পুতু পুতু করে জীবন শুরু করবে না, সে মাথা শক্ত করে উঠে দাঁড়াবে। এই ছেলের টাকা পয়সা হবে। ঘর বাড়ি হবে। গাড়ি হবে। নুন আনতে পান্তা ফুরায় ব্যাপার এই ছেলের বেলা কখনো ঘটবে না। শক্ত ধরনের ছেলে। বর্তমান সময় হল কঠিন সময় এই কঠিন সময়ে শক্ত ধরনের ছেলেপুলে দরকার। মিনমিনে মেয়ে টাইপ ছেলেদের যোগ শেষ হয়েছে।

     

    গাছ লাগাবার জন্যে সবচে ভাল সময় হচ্ছে বিকাল। রোদ থাকে না। মাটি ভাল করে তৈরী করে চারা পুতে দিতে দিতেই সন্ধ্যা নামে, সন্ধ্যার পরই নামে রাত। রাতের ঠাণ্ডা হাওয়ায় নতুন লাগানো গাছে শান্তির পরশ পরে। রাতে শিশিরে মাটি ভিজে থাকে। গাছের গায়ে সেই শিশির জমে। গাছের জন্যে যা খুবই প্রয়োজন।

    জোবেদ আলি এমন এক মহেন্দ্রক্ষণে এরিকা জাপানিকা গাছের চারা লাগালেন। চল্লিশ টাকা দিয়ে তিনি একটা বাঁশ কিনে এনেছিলেন। বাঁশ কেটে গাছের চারদিকে বেড়া দিয়ে দিলেন। লোকজন ছাগলের হাত থেকে বাঁচানোর জন্যে গাছ বেড়া দেয়। তিনি দিচ্ছেন তার ছেলের হাত থেকে বাঁচানোর জন্যে। তাঁর মন বলছে মঞ্জু এই গাছটাও পাড়িয়ে মেরে ফেলবে।

    গাছটা মনে হচ্ছে বেঁচে যাবে। জোবেদ আলি গাছের জীবন রক্ষার জন্যে দীর্ঘ প্রার্থনা করলেন। প্রার্থনার মাঝখানে বাঁধা পড়ল, তিনি দেখলেন, গেট খুলে নান্টু ঢুকছে। যে কেউ বাগানে ঢুকলে তিনি কিছুটা শংকিত বোধ করেন, এই বুঝি সে কোন চারার উপর দাঁড়িয়ে পড়ল। এই বুঝি হাত বাড়িয়ে গাছের কোন পাতা ছিঁড়ল। মানুষের এই এক বিচিত্র অভ্যাস, গাছ দেখলেই পাতা ছিঁড়ে গন্ধ শোঁকা। গন্ধ যদি কতেই হয় পাতা না ছিঁড়েও তো শোকা যায়। এমনোতো হতে পারতো যে গাছরা মানুষের স্বভাব পেয়েছে। কোন মানুষ যাচ্ছে গাছের নিচ দিয়ে। গাছটা টান দিয়ে মানুষের একটা হাত ছিঁড়ে ফেলল গন্ধ শোঁকার জন্যে। তখন কেমন হত? মানুষ এমন অকৃতজ্ঞ। কোন মানুষকি পারে তার নিজের ছেলেমেয়ে অন্যকে বিলিয়ে দিতে। কিন্তু গাছতত পারছে। সে তার সব ফল দিয়ে দিচ্ছে। ফলগুলি গাছের সন্তান ছাড়া আর কি?

    চাচাজান কেমন আছেন?

    জোবেদ আলি বললেন, ভাল। তাঁর খুবই অস্বস্থি লাগছে কারণ নান্টু ছেলেটা হেলতে দুলতে বাগানের ভেতর দিয়ে তাঁর কাছে আসছে। মাটির দিকে তাকিয়ে হাঁটলেও একটা কথা ছিল তিনি বুঝতেন যে সে দেখেশুনে হাঁটবে। চাড়া মাড়িয়ে দেবে না।

    বাগানটাতো খুব সুন্দর করে ফেলেছেন। আমাকে চিনতে পেরেছেনতো আমি নান্টু।

    হ্যাঁ চিনেছি। ঘরে গিয়ে বোস। ফরহাদ অবশ্যি বাসায় নেই সকালে বের হয়েছে এখনো ফিরেনি।

    তার বিয়ের ব্যাপারে কথা বলার জন্যে আজ বাসায় লোকজন আসার কথা না?

    হুঁ।

    আমি এই জন্যেই এসেছি।

    ভাল করেছ। ঘরে গিয়ে বোস আমি আসছি। হাতের কাজটা শেষ করে আসি।

    গাছ লাগাচ্ছেন?

    হ্যাঁ।

    আপনার বাগানে কি মশলার গাছ আছে? দারুচিনি, লবঙ্গ?

    অবশ্যই আছে। দারুচিনি গাছ আছে দুটা। লবঙ্গ গাছ আছে চারটা। একটা এলাচ গাছ আছে। ছোট এলাচ না বড়টা।

    এলাচ হয়?

    এখনো জানি না। বাবা তুমি এভাবে বাগানে হাঁটাহাটি করবে না। গাছ মেরে ফেলবে। তুমি ঘরে গিয়ে বোস। চা খাও।

    আপনার সঙ্গে একটু গল্প করি।

    আমি কাজের সময় গল্প করি না। তুমি ঘরে গিয়ে বোস। আমি আসছি।

     

    নান্টু ইস্ত্রী করা পায়জামা পাঞ্জাবী পরে এসেছে। বিয়ের কথাবার্তা হবে পরনে ভাল কাপড় থাকা দরকার। নান্টুর মুখ হাসি হাসি হলেও তার মন সাংঘাতিক খারাপ। মন খারাপের দুটি বড় কারণের একটা হচ্ছে—অর্ণবের জ্বর। ময়মনসিংহ থেকে সে জ্বর নিয়ে ফিরেছে। শর্মিলার কাছ থেকে টেলিফোনে এর বেশী কিছু জানা যায় নি। কত জ্বর? ডাক্তার এসেছে কি-না এইসব কিছু জানার আগেই শর্মিলা বলল— টেলিফোন একবার ধরলেতো তুমি ছাড়তে চাও না। এখন তোমার সঙ্গে বকবক করতে পারব না। রাখি কেমন? বলেই সে টেলিফোন রেখে দিল। এরপরে নান্টু খুব কম হলেও একশবার টেলিফোন করেছে। কেউ রিসিভার তুলেনি। শুধুই এনগেজড টোন। নান্টুর ধারণা শর্মিলা লাইন খুলে রেখেছে।

    বিয়ের আলাপটা শেষ হলেই নান্টু ছেলেকে দেখতে যাবে। আলাপ কখন শেষ হয় সেটাই হল কথা। বিয়ের আলাপ হল রবারের মত শুধুই লম্বা হয়। রবার লম্বা হতে হতে এক সময় ছিঁড়ে যায়, বিয়ের আলাপ ছেড়ে না। লম্বা হতেই থাকে, হতেই থাকে।

    ছেলের অসুস্থতা ছাড়াও অন্য একটা ব্যাপারে নান্টুর মন খারাপ। সে ছশ টাকা এডভান্স দিয়েছিল এফডিসি গেট থেকে একজন চেহারার মহিলা এবং দুটা বাচ্চা ভাড়া করে আনতে। কথা পাকা হয়েছিল। সকাল আটটা থেকে তারা অফিসের সামনে চায়ের দোকানে বসে থাকবে। নান্টু অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা করবে। অন্যরাও তাদের পরিবার পরিজন নিয়ে চায়ের দোকানে আসবে। কেউই আসে নি। অন্যরা আসেনি তার যুক্তি আছে। চাকরি ফেরত পেয়েছে আন্দোলনের আর দরকার কি? কিন্তু তার কাছ থেকে যে এডভান্স ছয়শ টাকা নিয়ে গেছে সেই লোকজন কোথায়? ঠগবাজদের যন্ত্রণায় মনে হয় এই দেশে বাস করা যাবে না হারামজাদা দালালটার কত বড় বড় কথা—একদিনের বাচ্চা চাইলে একদিনের বাচ্চা পাবেন। নাড়ি কাটা হয় নাই এমন বাচ্চা চান? তাও পাবেন। ফিলমের লাইন বলে কথা। বাঘের দুধ অনেকেই জোগাড় করতে পারবে। ফিলমের লোক বাঘের দুধ থেকে সর তুলে সেই সরে ঘি বানিয়ে নিয়ে আসবে। বাঘের ঘি কোন ব্যাপার না। আপনি চাইলে তিনশ গ্রাম বাঘের ঘি দিয়ে যাব। খেয়ে দাম দিবেন।

    চাকরি চলে গেছে তাতে নান্টু যতটা মন খারাপ করেছে তারচে বেশী মন খারাপ করেছে একটা লোক তাকে বোকা বানিয়ে ছয়শ টাকা হাতিয়ে নিয়ে চলে গেছে এই দুঃখে।

    ঘরে কাজের লোক নেই। রাহেলা নিজেই চা বানিয়ে নিয়ে গেলেন। দু কাপ চা। তাঁর নিজের জন্যেও এক কাপ চা খেতে খেতে তিনি কিছুক্ষণ গল্প করবেন। ভেতরের কোন খবর বের করা যায় কি-না। নান্টু ছেলেটা ফরহাদের বেশ ভাল বন্ধু। ফরহাদ মাঝে মধ্যে তার সঙ্গে রাত কাটাতে যায়। বিয়ে টিয়ে নিয়ে ফরহাদ নিশ্চয়ই বন্ধুর সঙ্গে অনেক গল্প করেছে।

    কেমন আছ বাবা?

    নান্টু ওঠে এসে পা ছুঁয়ে সালাম করল। রাহেলা খুশি হলেন। এই ছেলের সঙ্গে তার যতবার দেখা হয়েছে সে পা ছুঁয়ে সালাম করেছে। তাঁর নিজের দুই ছেলে ঈদের দিনেও সালাম করে না। একজনতো ঈদের নামাজই পড়ে না।

    নান্টু বলল, ফরহাদ আজ বিকেলে আমাকে আসতে বলেছে। বিয়ের আলাপ হবে। ফরহাদ গেছে কোথায় জানেন?

    রাহেলা বললেন, বাবা আমি কিছুই জানি না। আমার ছেলে যে বিয়ে করছে এটাও জানতাম না। আজ সকালে জানলাম।

    আপনি কিছু জানতেন না?

    না। পছন্দের মেয়ে আছে, বিয়ে করবে খুব ভাল কথা। আমাকে বলতেতো অসুবিধা নেই। আমি কি বলব—এই মেয়ে বিয়ে করিস না। আমার হাতে ভাল মেয়ে আছে। বাপ মা যখন ছেলের দয়ার উপর বাস করে তখন ছেলের কথাই তাদের কথা। ছেলে যদি বলে, উত্তর তারাও বলবে, উত্তর। ছেলে যদি বলে দক্ষিণ, তারাও বলবে, দক্ষিণ।

    নান্টু চায়ের কাপ চুমুক দিতে দিতে বলল, ফরহাদের মন খুব খারাপ। বিরাট ঝামেলার মধ্যে পড়েছে। বয়স অল্প। মাথা ঠিক রাখতে পারছে না।

    রাহেলা অবাক হয়ে বললেন, কি ঝামেলা?

    চাকরির ঝামেলাটার কথা বলছি।

    চাকরির কি ঝামেলা?

    ঐ যে চাকরিটা চলে গেল।

    রাহেলা হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছেন। এই ছেলে কি বলছে। ফরহাদের চাকরি চলে গেছে মানে কি? চাকরি না থাকলে চলবে কি ভাবে। রাহেলার হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে আসছে।

    চাকরি কবে গেল?

    অর্ডার হয়েছে এই মাসের চার তারিখ।

    ও।

    রাহেলার মাথা ঝিমঝিম করছে, ছেলের চাকরি নেই, সে বিয়ে করছে। গায়ে ফুঁ দিয়ে বেড়াচ্ছে এর মানে কি?

    চাচী ফরহাদের যে চাকরি নেই আপনি জানতেন না?

    না বাবা জানতাম না। সে কাউকেই কিছু বলে নাই। তোমার কাছ থেকে প্রথম শুনলাম।

    চাচী আপনি এটা নিয়ে মোটেই দুঃশ্চিন্তা করবেন না। একটা কিছু ব্যবস্থা ইনশাল্লাহ হবেই।

    কি ব্যবস্থা হবে?

    নান্টু জবাব দিতে পারল না। কি ব্যবস্থা হবে তা সে নিজেও জানে না।

    চাকরি গেল কেন? সে কি করেছিল?

    কিছু করে নাই। জান দিয়ে খেটেছে। এই দেশে চাকরি হওয়ার জন্যে অনেক কারণ লাগে। চাকরি চলে যাবার জন্যে কোন কারণ লাগে না।

    রাহেলা বললেন, ছেলের চাকরি নেই, এর মধ্যে তাকে বিয়ে করতে হচ্ছে। আমি তো বাবা কিছুই বুঝতে পারছি না।

    বিয়ের তারিখ আগে থেকে ঠিক হয়েছিল, এর মধ্যে যে চাকরি চলে যাবে সে ভাবে নি।

    তোমার বন্ধু কোন দিনই কোন কিছু ভাবে নি। তুমি বোস আমি মাগরেবের নামাজ পড়ে আসি।

    নান্টু রাত আটটা পর্যন্ত অপেক্ষা করল। ফরহাদ ফিরল না। এর মধ্যে শুরু হল বড় বড় ফোটায় বৃষ্টি। যে হারে বৃষ্টি হচ্ছে সেই হারে হতে থাকলে রাস্তাঘাট ড়ুবে যেতে থাকবে। শর্মিলার বাড়ির সামনের রাস্তাটা তিন ফোটা বৃষ্টি হলেই ড়ুবে যায়। নান্টুকে এক্ষুণি বের হতে হবে। নয়ত অর্ণবের সঙ্গে দেখাই হবে না। কোন রিক্সা, কোন বেবীটেক্সি ঐদিকে যাবে না।

    চাচী আমি আজ উঠি। আমার ছেলেটা অসুস্থ তাকে দেখতে যেতে হবে। আপনি ফরহাদকে বলবেন আমি অর্ণবকে দেখে ফেরার পথে সম্ভব হলে আবার আসব।

    বৃষ্টির মধ্যে যাবে কি ভাবে?

    কোন অসুবিধা হবে না। বাসায় কি ছাতা আছে? ছাতা থাকলে নিয়ে যাই।

    ছাতা নেই। এই বাড়িতে এসে কখনো কিছু চেয়ো না। এটা হল নেই– বাড়ি। এই বাড়িতে কিছুই নেই।

    নান্টু চলে যাবার কিছুক্ষণের মধ্যেই ফরহাদ ভিজে ন্যাতা ন্যাতা হয়ে উপস্থিত হল। তার সঙ্গে অনেক জিনিসপত্র। বিছানার চাদর, মশারি, বালিশ সবই ভিজেছে। জোবেদ আলি চিন্তিত মুখে বারান্দায় দাঁড়িয়ে। হঠাৎ এই প্রবল বর্ষণ তাঁকে চিন্তায় ফেলেছে। জাপানী গাছটা আজ পুতেছেন আর আজই এমন বৃষ্টি। পানি জমে গেলে শিকর পঁচে যাবে তো।

    ঘরে ঢুকতে ঢুকতে ফরহাদ জিজ্ঞেস করল, বাবা আমার কাছে কেউ এসেছিল?

    জোবেদ আলি অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে বললেন, না। অথচ নান্টু তার সামনেই বাসায় এসেছে। বের হবার সময়ও তাঁর সঙ্গে কথা বলে বের হয়েছে। জোবেদ আলি ছেলের দিকে না তাকিয়েই বললেন, কি করা যায় বল দেখি?

    কোন প্রসঙ্গে কি করা যায়?

    বৃষ্টির কথা বলছি। তুই ঘরে যা ভিজে গেছিস।

    বৃষ্টির কথা কি?

    তুই যা ঘরে যা।

    রাহেলা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ছেলেকে লক্ষ্য করছেন। ছেলেকে চিন্তিত মনে হচ্ছে না। সে বেশ সহজ স্বাভাবিক। তাকে দেখে মনে হচ্ছে না তার কোন সমস্যা আছে। এইতো লুঙ্গি পরে কলতলায় চলে গেছে। বালতি ভর্তি করে পানি তুলছে।

    মা গায়ে মাখার সাবানটা দিয়ে যাও তো।

    রাহেলা সাবান নিয়ে গেলেন। গায়ে মাথায় সাবান মাখতে মাখতে ফরহাদ বলল, দাদাজান দুদিন ধরে আমলকি আমলকি করছেন। আজ আমলকি নিয়ে এসেছি। পলিথিনের একটা ব্যাগে আছে। কয়েকটা আমলকি লবণ দিয়ে দাদাজানকে দাও।

    রাহেলা বললেন, আজ কি তোর কাছে কারোর আসার কথা ছিল?

    ফরহাদ বলল, হ্যাঁ ছিল। আসমানীর মামা আসবেন বলেছিলেন। তিনি সিঁড়ি থেকে পরে পা মচকে ফেলেছেন। আসবেন না।

    রাহেলা বললেন, তোর বিয়ের ব্যাপারে কথা বলার জন্যে?

    ফরহাদ বলল, হ্যাঁ। মা তুমি ভিজছতো ঘরে চলে যাও। গোসল শেষ করেই আমি এক কাপ আদা চা খাব। মনে হচ্ছে আমার জ্বর আসছে।

    জ্বরের মধ্যে গোসল করছিস কেন?

    সারাদিন ঘুরেছি। গা ঘেমেছে। বিশ্রী লাগছে।

    নান্টু এসেছিল। পরে আবার আসবে বলেছে।

    ও আচ্ছা।

    নান্টু বলেছিল তোর চাকরি নিয়ে কি সমস্যা না-কি হয়েছে।

    ফরহাদ জবাব দিল না। মগের পর মগ পানি মাথায় ঢালতে লাগল। রাহেলা রান্নাঘরে চা বানাতে গেলেন। রান্নাঘরের খোলা দরজা দিয়ে কলঘর দেখা যায়। তিনি দেখতে পাচ্ছেন—ফরহাদ এক বালতি পানি শেষ করে আরেক বালতি পানি নিয়েছে। মগে করে পানি ঢালছে। অতি দ্রুত ঢালছে। সে আবারো পানি ভরছে। বৃষ্টির জোর আরো বেড়েছে।

     

    চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে ফরহাদ বলল, চা-টা খুব ভাল হয়েছে মা।

    রাহেলা বললেন, তোর কি জ্বর এসেছে?

    আসব আসব করছিল এমন গোসল দিয়েছি যে পানি দিয়ে জ্বর ধুয়ে ফেলেছি।

    ক্ষিধে লেগেছে, আজ রান্না কি?

    শিং মাছের ঝোল।

    ইলিশ মাছের ভাজা খেতে ইচ্ছা করছে। বৃষ্টিটা যদি কমে তাহলে একটা ইলিশ মাছ নিয়ে আসব।

    এত রাতে মাছ পাবি?

    ইলিশ মাছ রাত একটার সময় গেলেও পাওয়া যাবে। চা-টা সত্যি ভাল হয়েছে মা। দাদাজানকে এক কাপ বানিয়ে দাও।

    রাহেলা অবাক হয়ে ছেলেকে দেখছেন। ফুল হাতা শার্ট গায়ে দিয়ে ভেতরের বারান্দায় চা খেতে বসেছে। চুল আঁচড়েছে। আরাম করে চা খাচ্ছে। তাকে দেখে কে বলবে তার কোন রকম সমস্যা আছে। সুখী সুখী চেহারা। রাহেলা বললেন, তোর বাবার কাছে শুনলাম এই শুক্রবারে না-কি তোর বিয়ে।

    একটু পিছিয়েছে মা, রোববারে হবে। রোববার রাতে। বিয়ে মানে দুই তিনজনকে নিয়ে ওদের বাসায় যাব। কাজী সাহেব থাকবেন। কাগজে সই করে বাসায় চলে আসা।

    আমি আজ সকালেই জানলাম।

    তোমাকে বলা হয় নি। নানান ঝামেলার মধ্যে মাথা আউলা হয়ে আছে।

    তোর চাকরি চলে গেছে?

    হ্যাঁ। তবে এরচেয়েও বড় সমস্যা আছে।

    এরচে বড় সমস্যা আবার কি?

    ফরহাদ ছছাট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, রহমত উল্লাহ সাহেব সুইজারল্যান্ড থেকে একটা চিঠি পাঠিয়েছেন। চিঠিটা পড়ে দেখ। চিঠি পড়লেই বুঝবে সমস্যা কত প্রকার ও কি কি? চিঠিটা আমার টেবিলের উপর আছে। উনি এই বাড়ি জমি বিক্রি করে দিয়েছেন। যাদের কাছে বিক্রি করেছেন তারা দখল নিতে আসবে। যে কোনদিন সব খালি করে দিতে হবে। বাবার জন্যেই আমার কষ্টটা বেশি হচ্ছে। শখ করে এত গাছ লাগিয়েছেন।

    রাহেলা অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, আমরা থাকব কোথায়?

    ফরহাদ জবাব দিল না। সিগারেটের প্যাকেট থেকে সিগারেট বের করল। রাহেলা ছেলেকে সিগারেট ধরাবার সুযোগ দিলেন। চলে গেলেন বাইরের বারান্দায়। এই বৃষ্টির মধ্যে জোবেদ আলি কোদাল হাতে বাগানে কি যেন করছেন।

    রাহেলা শান্ত গলায় বললেন, তুমি কি করছ?

    জোবেদ আলি বললেন, জমিতে পানি জমে গেছে। নালা কেটে দিচ্ছি। পানি হচ্ছে গাছের জীবন। এই পানি যদি একটু বেশী হয় তাহলে পানিই গাছের বিষ। আল্লাহপাকের কি অদ্ভুত ব্যবস্থা, এই বিষ এই অমৃত।

     

    শর্মিলার বসার ঘরে ঢুকে নান্টু খুবই অবাক হল। শর্মিলা সেজেগুজে বসে আছে। তার কপালে লাল টিপ। পরনের সিল্কের শাড়িটা নতুন। শর্মিলার সামনে এক ভদ্রলোক বসে আছেন। মধ্যবয়স্ক মানুষ। মনে হয় ভদ্রলোক বেশ কিছু সময় ধরেই আছেন। তাঁর সামনের এসট্রেতে পাঁচটা সিগারেটের শেষ অংশ। পাঁচটা সিগারেট, একটার পর একটা খেতেও তো পাঁচ গুণন তিন-পনেরো মিনিট লাগার কথা। তিনি নিশ্চয়ই কোন হাসির কথা বলেছেন—শর্মিলা হাসছে। নান্টুর মনে হল হুট করে ঘরে ঢুকে পরাটা তার ঠিক হয় নি। দরজা বন্ধ থাকলে সে কলিং বেল টিপে ঘরে ঢুকতো। দরজা ছিল ভেজানো হাত দিতেই খুলে গেল।

    শর্মিলা হাসি বন্ধ করে নান্টুর দিকে তাকাল। তার ভুরু কুঁচকে আছে। চোখের দৃষ্টি তীক্ষ। শর্মিলার সামনে বসা ভদ্রলোকও যেন কেমন করে তাকাচ্ছেন। নান্টু বলল, অর্ণব কেমন আছে। ওকে দেখতে এসেছি।

    শর্মিলা উঠে দাঁড়াল। এগিয়ে এল নান্টুর দিকে। নান্টু বলল, অর্ণবের জ্বর কত?

    ওর জ্বর কমেছে। ঘুমুচ্ছে।

    দেখে যাই।

    বললাম না ঘুমুচ্ছে। দেখে যাবে কি? সকালে এসো। সকালে এসে দেখে যেও।

    জ্বর শুনে মনটা খুবই খারাপ হয়েছে।

    একটা কথা কতবার বলল, জ্বর এখন নেই। মার সঙ্গে ঘুমুচ্ছে।

    এসেছি যখন দেখে যাই।

    মার সঙ্গে ঘুমুচ্ছে। মাও ঘুমুচ্ছেন। বললাম না সকালে এসো।

    নান্টু অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। শর্মিলা বলতে গেলে তাকে প্রায় তাড়িয়ে দিচ্ছে। সে এরকম করছে কেন? শর্মিলার সামনে যে ভদ্রলোক বসে আছেন সেই দ্রলোকের কি কোন ভূমিকা আছে? এই ভদ্রলোকের সামনে নান্টু থাকুক শর্মিলা তা চাচ্ছে না। যার ছেলে অসুস্থ সেই বা কেন এত সেজেগুজে বসে থাকবে? বিয়ে বাড়িতে বা জন্মদিনের নিমন্ত্রণে যাবার সাজও এটা না। তাহলে গায়ে গয়না থাকত। শর্মিলার হাতে কয়েক গাছা চুড়ি ছাড়া আর কিছু নেই।

    নান্টু বলল, তোমার জন্যে রসমালাই এনেছিলাম।

    শর্মিলা হাত বাড়িয়ে রসমালাইয়ের হাড়ি নিতে নিতে বলল, কাল পরশু এক সময় এসে অর্ণবকে দেখে যেও।

    নান্টু দরজার দিকে এগুচ্ছে। পেছনে পেছনে আসছে শর্মিলা। মনে হচ্ছে নান্টুকে একেবারে ঘর থেকে বের করে, দরজা বন্ধ করে তারপর লোকের সঙ্গে গল্প করতে যাবে। নান্টুর মনে হল অর্ণবের জ্বর আসলে সারে নি। নান্টুকে তাড়াতাড়ি বিদেয় করার জন্যে জ্বর সেরে যাবার কথা বলেছে। নান্টু কি কোন একটা রেস্টুরেন্টে অপেক্ষা করবে? ভদ্রলোক চলে যাবার পর আবার গিয়ে খোঁজ নেবে?

    খুব বৃষ্টি হচ্ছে। শর্মিলাদের বাড়ির সামনের রাস্তায় প্রায় হাঁটু পানি। আশে পাশে কোন চায়ের দোকান দেখা যাচ্ছে না যেখানে বসে চা খেতে খেতে এই বাড়ির দিকে লক্ষ্য রাখা যায়। নান্টু পানি ভেঙ্গে এগুচ্ছে। যে ভদ্রলোক শর্মিলার সঙ্গে কথা বলছিলেন তাঁর কি আজ এ বাড়িতে নিমন্ত্রণ? তিনি ফুল নিয়ে এসেছেন। টেবিলে গোলাপ ফুলের তোড়া। অতিথিরা আজকাল নিমন্ত্রণে ফুল নিয়ে আসেন। তার মত বেকুবরা যায় রসমালাইয়ের হাড়ি হাতে।

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleছায়াবীথি – হুমায়ূন আহমেদ
    Next Article চাঁদের আলোয় কয়েকজন যুবক – হুমায়ূন আহমেদ

    Related Articles

    হুমায়ূন আহমেদ

    আসমানীরা তিন বোন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    ইস্টিশন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    উড়ালপঙ্খী – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    এই বসন্তে – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    এই মেঘ, রৌদ্রছায়া – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    এইসব দিনরাত্রি – হুমায়ূন আহমেদ

    December 23, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    আসমানীরা তিন বোন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    আসমানীরা তিন বোন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    Our Picks

    আসমানীরা তিন বোন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025

    ইস্টিশন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025

    উড়ালপঙ্খী – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }