Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    আসমানীরা তিন বোন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025

    ইস্টিশন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025

    উড়ালপঙ্খী – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    চৈত্রের দ্বিতীয় দিবস – হুমায়ূন আহমেদ

    হুমায়ূন আহমেদ এক পাতা গল্প238 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    ০৭. মেম্বর আলি একটি ভয়াবহ সত্য আবিষ্কার করলেন

    মেম্বর আলি আজ সকালে একটি ভয়াবহ সত্য আবিষ্কার করলেন। তিনি চোখে একেবারেই দেখতে পারছেন না। একটা চোখ নষ্ট ছিল, সেই চোখে দিনেও দেখতে পেতেন না। অন্য চোখটা ভাল ছিল। ভাল চোখটায় দিনে দেখতে পেতেন। তিনি এদিক ওদিক তাকাচ্ছেন, ঘোলাটে ধরনের ঝাপসা হলুদ আলো ছাড়া কিছু দেখছেন না। পুরোপুরি অন্ধ তিনি নিশ্চয়ই হননি—অন্ধ মানুষ অন্ধকার ছাড়া কিছুই দেখে না। তিনি হলুদ ধরণের আলো দেখছেন। খুব চিন্তিত হবার মত কিছু নিশ্চয়ই ঘটে নি। চোখের ডাক্তারের কাছে গেলেই হবে। মলম টলম দিয়ে দেবে। চোখে ছানি পড়লে ছানি কাটাবার ব্যবস্থা করবে। মেম্বর আলি ক্ষীণ গলায় ডাকলেন ফরহাদ ফরহাদ।

    ফরহাদ ঘরে নেই মনে হয় উঠোনে। তাকে আরো শব্দ করে ডাকতে হবে। তিনি যে শব্দ করে ডাকতে পারেন না, তা না। ইচ্ছা করলেই একটা চিৎকারও দিতে পারেন। চিৎকার করতে ইচ্ছা করছে না। আজ ফরহাদের বিয়ে। তিনি চোখে দেখতে পাচ্ছেন না এমন একটা খবর দিয়ে বেচারার মন খারাপ করার দরকার কি? আজকের দিনটা পার হোক তারপর বললেই হবে। শুভ দিনে অশুভ সব দূরে রাখতে হয়। ফরহাদ নিজে অনেক কিছু নিয়ে খুব দুঃশ্চিন্তায় আছে। বেচারার দুঃশ্চিন্তা বাড়িয়ে লাভ কি? চোখে দেখতে না পেলেও তার তেমন অসুবিধাওতো হচ্ছে না। তার দিন কাটছে বিছানায় শুয়ে শুয়ে। এমনতো না যে তাকে লেখাপড়ার কাজ করতে হবে। কাঁথা সেলাইয়ের কাজ করতে হবে।

    তবে বাড়িতে নতুন বউ আসবে। নতুন বউ-এর মুখ দেখতে পারবেন না এটা খুব কষ্টের। দেখতে না পেলেও ভাব করতে হবে যেন দেখতে পাচ্ছেন।

    নতুন বউ আসা পর্যন্ত তিনি এই বাড়িতে থাকতে পারবেন কি-না তাও বুঝতে পারছেন না। মনে হচ্ছে তাকে আজ মেয়ের বাড়িতে চলে যেতে হবে। জাহেদা এসে তাকে নিয়ে যাবে। সে রকমই না-কি কথা হয়েছে।

    নানান রকম কথা গত কয়েকদিন ধরে এ বাড়িতে হচ্ছে। তিনি সব কথা ধরতে পারছেন না। এই বাড়ি ছেড়ে দিতে হবে এমন কথা তিনি অনেকবার শুনেছেন। কেন ছেড়ে দিতে হবে বুঝতে পারছেন না। কেউ তাকে কিছু বলছেও না। বাড়ি কে কিনে নিয়েছে বলে শুনেছেন। বাড়ি বিক্রি করা ঠিক না। দুটা জিনিস বিক্রি করা যায় না। যে বাড়িতে সাতদিন থাকা হয়েছে সেই বাড়ি এবং যে গয়না সাতদিন পরা হয়েছে সেই গয়না। তাঁর কাছে পরামর্শ চাইলে তিনি বলতে পারতেন। তাঁর কাছে কেউ পরামর্শ চাইতেও আসছে না।

    কালরাতে ফরহাদের সঙ্গে কিছু কথা হয়েছে। অনেক রাতে তার ঘুম ভেঙ্গে গিয়েছিল। তিনি অভ্যাসমত বললেন, ফরহাদ জেগে আছিস?

    ফরহাদ বলল, দাদাজান, বাথরুমে যাবেন?

    না।

    বিছানা নষ্ট হয়ে গেছে?

    হুঁ।

    দাঁড়ান চাদরটা বদলে দেই।

    ফরহাদ চাদর বদলে দিল। তিনি বললেন, তোর জন্যে আমি খাস দিলে দোয়া করলামরে ব্যাটা। আসল দোয়া।

    ফরহাদ বলল, ক্ষিধে লেগেছে। কিছু খাবেন?

    না।

    আমি আপনার জন্যে একটা বেদানা এনেছিলাম। ভেঙ্গে দেব?

    দে।

    ফরহাদ বেদানা ভেঙ্গে তাঁর হাতে দিচ্ছে। তিনি দুটা তিনটা করে দানা মুখে দিচ্ছেন। খুবই মিষ্টি বেদানা। ফল-ফ্রুট মানেই ভিটামিন। বুড়ো বয়সে ভিটামিন খুব কাজে আসে।

    ফরহাদ বলল, কাল যে আমার বিয়ে এটা কি আপনি জানেন দাদাজান?

    জানি। তুই বলেছিস।

    খুবই গরীবি হালতে বিয়ে, হাত একেবারে খালি।

    মেম্বর আলি শংকিত বোধ করলেন। ফরহাদ কি তার অভাব অনটনের কথা বলে তাঁর কাছে চন্দ্রহারটা চাচ্ছে? এত আদর করে বেদানা ভেঙ্গে খাওয়ানোর এটাই কি রহস্য? চন্দ্রহারটা দিয়ে দিলে তার থাকল কি? তার আজ যদি বড় কোন চিকিৎসার দরকার হয় টাকা পাবেন কোথায়?

    দাদাজান।

    হুঁ।

    আপনি কয়েকটা দিন ফুপুর বাসায় থাকতে পারবেন না?

    হুঁ।

    নানান ঝামেলায় পড়েছি। সামলাতে পারছি না।

    হুঁ।

    ফুপু আপনাকে নিয়ে যাবে। আমি রোজ একবার আপনাকে দেখে আসব।

    হুঁ।

    আচ্ছা।

    ফুপু আপনার জন্যে একটা ছেলে জোগাড় করেছেন যে সব সময় আপনার সঙ্গে থাকবে।

    আচ্ছা।

    বেদানাটা খেতে কেমন?

    মিষ্টি।

    আপনার যদি কখনো কিছু খেতে ইচ্ছা করে যে কাজের ছেলেটাকে ফুপু আপনার জন্যে ঠিক করেছে তাকে বলবেন। সে এনে দেবে। এর জন্যে ফুপুর কাছে টাকা চাওয়ার দরকার নেই। এই টাকাটা আপনার কাছে রাখেন। এখন বালিশের নিচে থাক। এক হাজার টাকা আছে। সব পঞ্চাশ টাকার নোট। দুইশ পঞ্চাশ টাকার নোট। ঠিক আছে দাদাজান?

    হুঁ ঠিক আছে।

    মেম্বর আলি মুখে ঠিক আছে বললেও হঠাৎ করে বুকে ধাক্কার মত বোধ করলেন। ফরহাদ কি তাকে জন্মের মত পাঠিয়ে দিচ্ছে। এ বাড়িতে আর কখনো ফিরিয়ে আনবে না? দু চারদিনের জন্যে পাঠালেতো এতগুলি টাকা দিত না।

     

    এটা একটা বিয়ে বাড়ি।

    বিয়ে বাড়ির কত রহস্য আছে। চারদিকে ব্যস্ততা থাকবে। ছোটাছুটি থাকবে। বাচ্চাদের কান্না থাকবে, হাসি থাকবে। মেয়েদের পরণের নতুন শাড়ির গন্ধ থাকবে, খিল খিল হাসি থাকবে। তার কিছুই নেই। সবাই মনে হয় নিঃশ্বাস বন্ধ করে আছে।

    মেম্বর আলি তার দীর্ঘজীবনে অনেক বিয়ে দেখেছেন। আজকের বিয়েটা হয়ত তার দেখা শেষ বিয়ে। আর দেখা হবে না। অবশ্যি এই বিয়েটাতে তিনি শেষ পর্যন্ত থাকতে পারবেন না। তার মেয়ে এসে তাকে নিয়ে যাবে। এছাড়া করার কিছু নেই। তিনি যে ঘরে থাকেন সেই ঘরে ফরহাদের বাসর হবে। ঘরটা ফুল টুল দিয়ে নিশ্চয়ই সাজানো হবে। আজকের দিনটা এ বাড়িতে থেকে যেতে পারলে ভাল হত। একটা রাত না হয় থাকলেন মঞ্জুর ঘরে। কিংবা বারান্দাতেও থাকতে পারেন। থাকার জন্যে বারান্দা খারাপ না। আলো বাতাস বেশী। এখনতো শীতকাল না, যে শীতে কষ্ট পাবেন।

    মেম্বর আলির গায়ে রোদ পড়েছে। তিনি হাত বাড়িয়ে রোদ স্পর্শ করলেন। বন্ধ চোখ মেললেন, না রোদ দেখতে পাচ্ছেন না। এই পৃথিবীর অপূর্ব সব দৃশ্য আর তাঁকে দেখতে দেয়া হবে না। এমন ভয়ংকর সিদ্ধান্তগুলি যিনি নেন, তিনি কেমন? মেম্বর আলির সামান্য শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। এটা নিয়ে চিন্তিত হবার কিছু নেই। ঘরে অক্সিজেনের যন্ত্রপাতি আছে। ফরহাদকে বললেই সে নাকে লাগিয়ে দেবে। এখনই বলতে হবে এমন কোন কথা নেই।

    এটা কি মাস? বাংলা মাসটা কি? বাংলা কোন মাসে ফরহাদের বিয়ে হচ্ছে তা জানা দরকার। তাঁর নিজের বিয়ে হয়েছিল আষাঢ় মাসে। কি বৃষ্টি কি বৃষ্টি। শত শত নাইয়রীতে বাড়ি ভর্তি হয়ে গিয়েছিল। বৃষ্টির মধ্যে শুরু হল প্যাক-খেলা। এ তাকে কাদায় ফেলে দিচ্ছে, ও একে ফেলছে। ধুন্দুমার কান্ড। তার বাবা খুবই রাগ। করলেন, চিঙ্কার দিয়ে বাড়ি মাথায় তুললেন-তোমরা করতাছ কি? তোমরার কি আক্কেল জ্ঞান নাই। মেয়েছেলে পুরুষ ছেলে সব প্যাক কাদায় গড়াগড়ি। মৌলভী বাড়ির ইজ্জত রাখবা না? তার কথা শেষ হবার আগেই তাঁর ছোটশালা পেছন থেকে তাঁকে ঝাপ্টে ধরে কাদায় ফেলে দিল। চারদিকে শুরু হল হাসি। এদিকে শুরু হয়েছে কাদার মধ্যে শালা-দুলাভাই যুদ্ধ। কাদা খেলা সারাগ্রামে। ছড়িয়ে পড়ল। কি অদ্ভুত পাগলামী। কনের বাড়িও গ্রামের মধ্যে। একজন কে বলে বসল, শইল্যে প্যাক-কেদা মাইখ্যা বরযাত্রী গেলে কেমুন হয়? কইন্যা পক্ষের উচিত শাস্তি হয়। আমরা গিয়া বলব—শইল্যে প্যাক-কেদা। প্যাক কাদা পরিষ্কারের জোগাড় কর। ভাল কাপড় দেও।

    যেই কথা সেই কাজ। বরযাত্রী যাচ্ছে কাদায় মাখামাখি হয়ে। আহারে কি দিন STRUCS1

    মেম্বর আলি ছটফট করছেন। তাঁর খুবই ইচ্ছা করছে তার বিয়ের দিনের গল্পটা কারো সঙ্গে করতে। ঘরে কেউ নেই। ফরহাদের বউ-এর সঙ্গে গল্পটা করতে পারলে ভাল হত। নয়া বউরা অন্য বউদের গল্প শুনতে ভালবাসে। শ্বাসকষ্টটা মনে হয় বাড়ছে।

    মেম্বর আলির প্রথম স্ত্রীর নাম ছিল অনুফা। বিয়ের পর তার নাম হল প্যাক-বউ। পাক কাদার বউ তাই প্যাক বউ। বড় সুন্দর ছিল মেয়েটা। গায়ের রঙ সামান্য কম ছিল। তাতে কি? গায়ের রঙই সব না। বিয়ের এক বছরের মাথায় তার মৃত্যু হয়। প্যাক বউ-এর চেহারা মেম্বর আলি ভুলে গেছেন। তার কোন ছবি নেই যে ছবি দেখে চেহারা মনে করবেন। শুধু মনে আছে তার খুব লম্বা চুল ছিল। চুল হাঁটু ছাড়িয়ে নেমে গিয়েছিল। একদিন সে রাগ করে সেই চুল কেটে ফেলল। তাকে দেখতে লাগল ছেলেদের মত। সে আরেক ইতিহাস। বড়ই মজার ইতিহাস। কেউ কি আছে যে এই ইতিহাসগুলি শুনবে? আচ্ছা এমন কড়া রসুনের গন্ধ আসছে কোত্থেকে? কেউ কি রসুন পুড়তে দিয়েছে। বিয়ে বাড়িতে কেউ রসুন পুড়ে? এদের কি কান্ডজ্ঞান নেই? রসুন পুড়ার গন্ধে তার নাক জ্বালা করছে। চোখ দিয়ে পানি পড়ছে।

     

    আজ আসমানীর বিয়ে।

    আর বেছে বেছে আজকের দিনেই সে অসুখে পড়ে গেছে। সকালবেলা ঘুম ভেঙ্গেছে। বিছানা থেকে নামতে গিয়ে দেখল—মাথা তুলতে পারছে না। কি আশ্চর্য তার জ্বর না-কি? সে কপালে হাত দিল, তেমন জ্বরতো বোঝা যাচ্ছে না, অথচ শরীর কেমন যেন করছে। হাত পা ভারী। খোলা জানালার দিকে তাকাতে পারছে না। চোখ জ্বালা করছে। আসমানী বালিশে মাথা রেখে আবার শরীর এলিয়ে দিল। নিজের উপর রাগ লাগছে। জ্বর হবার জন্যে তিনশ পঁয়ষট্টি দিন পড়ে আছে। আজ জ্বর হবে কেন?

    রান্নাঘর থেকে সাড়াশব্দ আসছে। চা নাশতা তৈরী হচ্ছে। গায়ে জ্বর না থাকলে সে অবশ্যিই রান্নাঘরের দরজা ধরে দাঁড়াত এবং লাজুক গলায় বলতো, মা এক কাপ চা খাব। লাজুক গলায়, বলার মত কোন ব্যাপার না কিন্তু বিয়ের দিন বলে আজ লজ্জা লজ্জা লাগবেই।

    আসমানীর পানির তৃষ্ণা হচ্ছে। সে প্রতিদিন ঘুমুতে যাবার আগে মাথার কাছে পানির জগ গ্লাস রাখে। কাল রাতেও রেখেছে অথচ এখন নেই। কেউ নিয়ে গেছে বোধ হয়। কে নিয়ে গেছে নিশা? কাল রাতে নিশা তার সঙ্গে ঘুমিয়েছে। নিশা কারো সঙ্গে ঘুমুতে পারে না। অন্য মানুষের গায়ের গন্ধে তার না-কি ঘুম আসে না। হঠাৎ হঠাৎ বাসায় মেহমান উপস্থিত হলে শোবার জায়গায় টানাটানি হয়, তখনো নিশা কারো সঙ্গে ঘুমুবে না। মেঝেতে কম্বল পেতে নিজের জন্যে আলাদা ছোট্ট বিছানা করবে। বিছানাটা ছোট্ট করবে এই জন্যে যেন কেউ মাঝরাতে এসে বড় বিছানার এক পাশে শুয়ে না পড়ে।

    কাল রাতে নিশা যখন বালিশ নিয়ে আসমানীর সঙ্গে ঘুমুতে এল তখন আসমানী অবাক হয়ে বলল, তুই আমার সঙ্গে ঘুমুবি?

    নিশা গম্ভীর গলায় বলল, হুঁ।

    আসমানী বলল, কেন?

    মা ঘুমুতে বলেছে। বিয়ের আগের রাতে নাকি মেয়েদের একা ঘুমুতে দেয়ার নিয়ম নেই।

    তোকে নিয়ম নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে না, তুই তোর মত আরাম করে ঘুমো।

    নিশা বিছানায় উঠতে উঠতে বলল, অসুবিধা নেই।

    তুই কষ্ট করে চোখ মুখ শক্ত বানিয়ে শুয়ে থাকবি, দেখেই আমার খারাপ লাগবে। আমার নিজের ঘুম হবে না।

    তোমার ঘুম এম্নিতেও হবে না, ওম্নিতেও হবে না।

    নিশা তার শোবার জায়গায় আলাদা করে চাদর পাতল। বড় খাটের একটা অংশ আলাদা করে ফেলল। আসমানী বোনের কাণ্ড কারখানা দেখছে। কত ধরনের বিচিত্র স্বভাব যে মানুষের মধ্যে দেখা যায়। মেয়েটা শুয়েছেও খুব অদ্ভুতভাবে। কাঠের টুকরার মত সোজা। হাতগুলি পর্যন্ত লম্বা করে রাখা। চোখের দৃষ্টি ছাদের দিকে। নিশা বলল, তুইতো শুয়েছিস অনেকটা দূরে। এখনো আমার গায়ের গন্ধ পাচ্ছিস?

    নিশা বলল, পাচ্ছি।

    আমার গায়ের গন্ধটা কেমন? খুব খারাপ?

    খুব খারাপ না। মোটামুটি খারাপ। সব মানুষের গায়ের গন্ধই খারাপ।

    তোর নিজের গায়ের গন্ধ কেমন?

    আমারটা ভাল। সাবান সাবান গন্ধ।

    দেখি তোর হাতটা আমার কাছে আন শুঁকে দেখি।

    শুঁকে দেখতে হবে না।

    তুই কি সব সময় এ রকম স্ট্রেট লাইন হয়ে ঘুমাস?

    ঘুমাবার আগে কিছুক্ষণ এ রকম শুয়ে থাকি-তারপর কাত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ি।

    তুই যে খুব অদ্ভুত ধরনের মেয়ে হয়ে যাচ্ছিস এটা কি তুই জানিস। বিচিত্র সব অভ্যাস করছিস। পরে এইসব অভ্যাসের জন্যে কষ্ট পাবি।

    কষ্ট পাব কেন?

    এক সময় তুই বিয়ে করবি। তোর স্বামী চাইবে তোকে জড়িয়ে ধরে ঘুমুতে। তোর যদি তখন সেই মানুষটার গায়ের গন্ধে বমি আসে তখন মানুষটা খুব কষ্ট পাবে না?

    কষ্ট পাবে না, কারণ আমি বিয়েই করব না।

    তোর জন্যে বিয়ে না করাটাই ভাল। তোর কি ঘুম পাচ্ছে?

    উঁহু। যখন দেখবে আমি কাত হয়ে শুয়েছি তখন বুঝবে আমার ঘুম পাচ্ছে।

    তুই শবাসনের মত শুয়ে আছিস। কথা বলে আরাম পাচ্ছি না। কাত হয়ে শুয়ে পড়–কিছুক্ষণ গল্প করি।

    নিশা কাত হতে হতে বলল, তুমি যে লোকটাকে বিয়ে করছ তাকে কিন্তু আপা আমার একেবারেই পছন্দ না।

    কেন? তার গায়ে খুব খারাপ গন্ধ?

    তার গা থেকে ফুলের গন্ধ বের হলেও আমার পছন্দ হত না।

    অপছন্দের কারণগুলি কি?

    নিশা হাই তুলতে তুলতে বলল, জানি না। তবে লোকটার জন্যে আমার সামান্য মায়া হয়।

    মায়া হয় কেন?

    খুবই গরীবতো এই জন্যে মায়া হয়। তাছাড়া তুমি ছাড়া তাকে কেউ দেখতে পারে না, এই জন্যেও মায়া হয়। বেচারাকে সবাই অপছন্দ করে। সবচে অপছন্দ করে মা।

    আসমানীর বুকে ধাক্কার মত লাগল। ফরহাদকে তার মা সবচে অপছন্দ করেন এই তথ্যটা জানা ছিল না। তার মা এই বিষয়ে তার সঙ্গে কখনো কোন কথা বলেননি। আসমানী বলল, মা ফরহাদকে অপছন্দ করেন এটা তোকে তিনি বলেছেন?

    হ্যাঁ বলেছেন।

    কেন অপছন্দ করেছেন সেটা বলেছেন?

    না। উনার প্রসঙ্গ উঠলেই মা বলেন—বাঁটু ছাগল।

    বাঁটু বলবেন কেন? ওতো বাঁটু না।

    মার কাছে বেঁটে লেগেছে বলে মা বলেছে। মার কথায় তুমি কি মন খারাপ করলে?

    একটু করেছি।

    তাহলে বাবার কথায় আরো মন খারাপ করবে।

    বাবাও কি তাকে বাঁটু ছাগল বলেন?

    বাবা আরো খারাপ কথা বলেন।

    নিশা খিলখিল করে হাসছে। আসমানী খুবই মন খারাপ করল। এমন কি খারাপ কথা বাবা বলেন যে সেই কথা মনে করে এভাবে খিল খিল করে কাউকে হাসতে হয়।

    নিশা হাসি থামিয়ে বলল, বাবা যা ইচ্ছা বলুক তুমি মন খারাপ করছ কেন? তোমার কাছেতো মানুষটা ভাল। ভাল না?

    হ্যাঁ।

    তাহলেই হয়েছে। আপা এখন আমার ঘুম পাচ্ছে। ঘুমিয়ে পড়ি?

    আসমানী ক্লান্ত গলায় বলল, বাবা ওর সম্পর্কে কি বলেন সেটা একটু বলবি?

    না বলব না। তোমার খুবই মন খারাপ হবে। আপা শোন মা বলেছে সারারাত বাতি জ্বালিয়ে রাখতে। বিয়ের আগের রাতে বাতি নেভানো না-কি অলক্ষণ।

    আলো চোখের উপর কটকট করছিল তারপরেও আসমানী বাতি নেভাল না। অলক্ষণ যখন বলা হয়েছে তখন থাকুক বাতি জ্বালানো। আসমানীর ঘুম আসছে না। অথচ নিশা কি আরাম করেই না ঘুমুচ্ছে। সে জেগে থাকলে ভাল হত। নিশার সঙ্গে গল্প করা যেত। কি গল্প করতো? ফরহাদ নামের মানুষটাকে তার হঠাৎ কেন এত পছন্দ হয়েছে সেই গল্প করতো। এতে দোষের কিছু নেই। নিশা শুধু মানুষটা কেন অপছন্দের তা জানবে, কেন পছন্দের তা জানবে না, তাতো হবে না। তাকে পছন্দের কথাটাও জানতে হবে।

    ফরহাদ অসাধারণ কেউ না। খুবই সাধারণ একজন মানুষ। আর আসমানী নিজেও খুব সাধারণ একটা মেয়ে। সাধারণ পছন্দ করবে সাধারণ কে। এটাইতো নিয়ম।

    ফরহাদের আশে পাশে আসমানী যখন থাকে তখন তার নিজের বয়স খুব কম মনে হয়। মনে হয় সে বুঝি স্কুলের এইট নাইনে পড়া কোন মেয়ে। তখন তার নানান ধরনের ফাজলামী করতে ইচ্ছা করে। যেমন দুজন হেঁটে হেঁটে যাচ্ছে রাস্তায় একটা আইসক্রীমওয়ালা দেখা গেল। আসমানী থমকে দাঁড়িয়ে বলবে, আইসক্রীম খাব। ললীপপ। আইসক্রীম কিনে দাও। ফরহাদ আইসক্রীম কিনবে। নিজের জন্যে না, শুধু তার জন্যে। আসমানী বাচ্চা মেয়েদের মত আইসক্রীম খেতে খেতে তার সঙ্গে হাঁটবে, আসমানীর এতটুকুও খারাপ লাগবে না।

    কোথাও ম্যাজিক দেখাতে দেখাতে এক লোক স্বপ্নে পাওয়া বাতের ওষুধ বিক্রি করছে। তাকে ঘিরে অনেক লোকজন। আসমানী বলবে, এই শোন, ম্যাজিক দেখব। অথচ এ ধরনের কাজ আসমানী যখন একা থাকবে বা অন্য কারো সঙ্গে থাকবে তখন কখনো করবে না।

    মানুষটা যখন পাশে থাকে, তখন মনে হয় আসমানীকে কোন কিছু নিয়েই আর কখনো দুঃশ্চিন্তা করতে হবে না। দুঃশ্চিন্তা করার সব দায় দায়িত্ব সঙ্গের মানুষটার, তার না। তার একমাত্র কাজ হচ্ছে মানুষটার সঙ্গে থাকা। আসমানীর প্রায়ই মনে হয় সে তার বাকি জীবন শুধু এই মানুষটার পাশে পাশে হেঁটে পার করে দিতে পারবে। তার আর কিছু লাগবে না। আসমানী ঠিক করে রেখেছে একটা কাজ সে অবশ্যই করবে—মানুষটাকে রাতে ঘুম পাড়িয়ে সে তার মাথার কাছে চুপচাপ বসে থাকবে। তাকিয়ে থাকবে মানুষটার মুখের দিকে। এই কাজটা সে রাতের পর রাত করবে কিন্তু মানুষটাকে কখনো জানতে দেবে না।

    আসমানীর ধারণা এই মানুষটার সঙ্গে তার দেখা হওয়াই হল তার জীবনের সবচে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এই গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাটা ঘটে ১৮ই মার্চ সকাল এগারোটায়। আসমানী ঠিক করে রেখেছে ১৮ই মার্চ সে সারাজীবন পালন করবে। ম্যারেজ এ্যানিভার্সারী, জন্মদিন এইসব কিছু না। সে পালন করবে ১৮ই মার্চ, ২৬শে জিলক্বদ, চৈত্রের দ্বিতীয় দিবস। ঐ দিন সে ফরহাদকে অফিসে যেতে দেবে না। তার বাচ্চারা কেউ স্কুলে যাবে না। ঈদে যেমন নতুন কাপড় দেয়া হয় সে ঐ দিন সব বাচ্চাকে নতুন কাপড় দেবে। ফরহাদকে পাঞ্জাবী পায়জামা কেনে দেবে। ঘরে যে কাজের মেয়ে থাকবে সেও লাল রঙের শাড়ি পাবে। সে নিজেও সেদিন খুব সাজবে। ফরহাদ বলবে-আচ্ছা আসমানী ঘটনাটা কি?

    আসমানী রহস্যময় হাসি হেসে বলবে, কোন ঘটনা নেই। সামান্য একটু সাজগোজও করতে পারব না? শুধু সুন্দরী মেয়েরা সাজবে আর আমার মত অসুন্দরী মেয়েরা সাজবে না এটা কেমন কথা?

    ফরহাদ ব্ৰিত ভঙ্গিতে বলবে, সবার নতুন জামা কাপড় এই জন্যে বলছি। আজ কি বিশেষ কোন দিন?

    আজ বিশেষ দিন না, অবিশেষ দিন সেটা তোমাকে বলব না। দেখি তোমায় বুদ্ধি, তুমি নিজে নিজে বের করতে পার কিনা।

    আমার বুদ্ধি খুবই কম। তুমি বলে দাও।

    আমি কোনদিনও বলব না। তুমি বের করবে—এটা তোমার জন্যে একটা ধাঁধা। তবে সহজ ধাঁধার রহস্য বের করাই সবচেয়ে কঠিন। দেখি তুমি পারো কি-না।

    একটু হিন্টস দাও।

    হিন্টস দিচ্ছি—আজ হচ্ছে চৈত্রের দ্বিতীয় দিবস।

    সেটা আবার কি?

    জিলক্বদ মাসের ২৬ তারিখ।

     

    আসমানীর মাথা দপদপ করছে, চোখ জ্বালা করছে। রান্নাঘরে মা মনে হয় ভাজি জাতীয় কিছু চড়িয়েছেন তার তীব্র গন্ধ নাকে এসে লাগছে। তার নিশ্চয়ই জ্বর বাড়ছে—তার জ্বরের থার্মোমিটার হল গন্ধ থার্মোমিটার। আশে পাশের গন্ধগুলি কত তীব্র হচ্ছে তার থেকে বোঝা যায় তার জ্বর কত বেশি। জ্বর নিশ্চয়ই একশ দুই ছাড়িয়ে গেছে। কেউ এসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলে বোধ হয় ভাল লাগত। সবাই ব্যস্ত। কেউ এখন আসবে না। আসমানীর কয়েকজন বান্ধবীর আসার কথা। তারা গায়ে হলুদে হৈ চৈ করবে। এদের একজন হল কণা—খুব আমুদে টাইপের মেয়ে। শুধু কণাকেই আসমানী টেলিফোনে তার বিয়ের কথা বলেছে। কণার উপরই দায়িত্ব আসমানীর অন্য বান্ধবীদের খবর দিয়ে আনা। কণা তার দায়িত্ব খুব ভালভাবে পালন করবে। হঠাৎ বিয়ের মজা থেকে কণা নিজেকে কিছুতেই বঞ্চিত করবে না। কণা এসে যখন দেখবে যে আসমানী জ্বরে প্রায় অচেতন তখন নানান হৈ চৈ শুরু হবে। সেই হৈ চৈও হবে মজার। কণা এমন মেয়ে যে সব কিছুতেই মজা খুঁজে পায়। কেউ মারা গিয়েছে কণা খবর পেয়ে গেল আর মরা বাড়িতেই কোন না কোন মজা না করে ফিরল না তা কখনো হবে না।

    কাল দুপুরে সে যখন কণাকে টেলিফোন করে বলল, এই কণা তুই আগামীকাল সকালে আমার বাসায় আসতে পারবি?

    কণা বলল, পারব।

    রাত পর্যন্ত থাকতে হবে কিন্তু।

    আচ্ছা থাকব।

    কি জন্যে আসতে বলছি বলতো?

    তোর বিয়ে এই জন্যে আসতে বলছিস।

    কি করে বুঝলি আমার বিয়ে?

    গলার স্বর থেকে বুঝলাম। কোন মেয়ে যখন বিয়ের দাওয়াত দেয় তখন তার গলা অন্য রকম হয়ে যায়।

    অন্য রকম মানে কি?

    পুরুষ পুরুষ গলা। আর যখন কোন ছেলে তার বিয়ের কথা বলে তখন তার গলা হয়ে যায় মেয়েলী। সে চিকন স্বরে কথা বলে।

    তুই কি সত্যি সত্যি আমার গলা শুনেই বুঝে ফেলেছিস আমার বিয়ে?

    হুঁ। আল্লাহর কসম গলা শুনেই টের পেয়েছি। বিয়ে কার সঙ্গে হচ্ছে? ফরহাদ নামের ঐ ভদ্রলোকের সঙ্গে?

    হুঁ।

    খুব ভাল। হাতের পাঁচ স্বামী।

    হাতের পাঁচ স্বামী মানে?

    হাতের পাঁচ স্বামী মানে এই স্বামী সব সময় হাতে থাকবে। হাত ছাড়া হবে। সব মিলিয়ে এই পৃথিবীতে ছয় রকম স্বামী আছেন মন দিয়ে শোন—

    হাতের শূন্য স্বামী, যে কখনো হাতে থাকবে না।

    হাতের এক স্বামী, হঠাৎ হঠাৎ হাতে থাকবে। বেশীর ভাগ সময় থাকবে না।

    হাতের দুই স্বামী, হাতের একের চেয়ে একটু বেশী থাকবে।

    হাতের পাঁচ হচ্ছে সারাক্ষণ হাতে থাকা স্বামী। তুই হাত ঝেড়ে ফেললেও দেখবি সে যাচ্ছে না, তোর কড়ে আংগুল ধরে ঝুলে আছে।

    তোর মাথায় কি সব সময় এ রকম মজার মজার কথা থাকে?

    হ্যাঁ থাকে। কারণ আমি হচ্ছি খুবই মজাদার একটা মেয়ে। ফানী লেডি। আচ্ছা শোন তোর বিয়েটা কি খুব শুকনা টাইপ হচ্ছে?

    শুকনা টাইপ মানে?

    শুকনা টাইপ মানে–ভেজা না। আগুন দিলে জ্বলবে না–শুধু ধোয়া বের হবে। যে সব বিয়ে হুট করে ঠিক হয় সে সব হয় শুকনা বিয়ে। এক টুকরা হলুদ মাথায় ঘষে আধ বালতি পানি দিয়ে গোসল। তারপরই কাজি সাহেবের পাঠানো খাতায় দুটা সিগনেচার। বিয়ে শেষ। রাত আটটায় স্বামীর কোন এক বন্ধুর কাছ থেকে চেয়ে আনা মাইক্রোবাসে করে স্বামীর বাড়ি যাত্রা। রাত এগারোটার দিকে বাসর ঘর। রাত সাড়ে এগারোটার দিকে বিয়ের শাড়ি খুলে নগ্ন হয়ে যাওয়া।

    কণা চুপ কর প্লীজ।

    নগ্ন হবার কথা শুনে লজ্জা লাগছে! তাহলে বিয়ে করিস না।

    তোর পায়ে পড়ি প্লীজ এই লাইনের কথা বন্ধ কর।

    আমি বিয়ে করছি না কেন জানিস? রাত সাড়ে এগারোটার কথা ভেবে বিয়ে করছি না–কথায় আছে না—

    টকের ভয়ে দেশ ছাড়লাম
    তেতুল তলায় বাসা।

    আমার হবে এই দশা। যে টকের ভয়ে সব ছাড়লাম দেখা যাবে আমার জীবন কাটবে টকের মধ্যে। শেষমেষ হয়ত একটা হাউস খুলে বসব। পুরুষরা আসবে, টাকা দেবে, আর আমি টাকা গুনতে গুনতে শাড়ি খুলব……

    প্লীজ কণা প্লীজ।

    আচ্ছা যা এবারকার মত চুপ করলাম। আমি কাল ঠিক কাঁটায় কাঁটায় দশটার, মধ্যে চলে আসব। তুই কি তোর আর কোন বান্ধবীকে বলেছিস?

    না।

    কাউকে বলার দরকার নেই। আমি দলবল নিয়ে উপস্থিত হব। বিয়েটা-কি তোর বাসাতেই হচ্ছে না-কি কোন কমিউনিটি সেন্টারে?

    আমাদের বাসাতেই। আমাদের এ্যাপার্টমেন্টে একটা হলরুম আছে সেখানে।

    মনে হয় অল্প খরচে সব ছেড়ে দিচ্ছিস।

    আমরা গরীব মানুষ না, বেশী খরচ করব এমন টাকা পয়সা কি আমাদের আছে?

    যাকে বিয়ে করছিস সেতো আরো গরীব।

    স্বামী গরীব হওয়া ভাল।

    কেন?

    গরীব স্বামীরা অর্থের অভাব ভালবাসা দিয়ে পুষিয়ে দিতে চেষ্টা করে।

    তোর চমৎকার কথাটা শুনে ভাল লাগল।

    তুই কথাটা যত চমৎকার ভাবছিস—তত চমৎকার কিন্তু না। এই ভালবাসা মনের ভালবাসা না, শরীরের ভালবাসা। এই ভালবাসা রাত সাড়ে এগারোটা থেকে শুরু হয়ে……

    প্লীজ কণা। প্লীজ।

    আচ্ছা যা তোকে এখনকার মত ক্ষমা করে দিলাম।

    আসমানীর জ্বর কি আরো বাড়ছে? এখন কেমন যেন শরীর কাঁপছে। ম্যালেরিয়া নাতো? ম্যালেরিয়াতেই শরীর কাঁপিয়ে জ্বর আসে। প্রতিবারই তার জ্বর শরীর কেঁপে আসূছে। ডাক্তারকে এই কথাটা কি বলা হয়েছে? ম্যালেরিয়ার জ্বরের রহস্য কে যেন বের করেন? রোনাল্ড রস। তিনি নোবেল পুরস্কার পান এই কারণে। আচ্ছা আলফ্রেড নোবেলের কি কখনো ম্যালেরিয়া হয়েছিল? রবীন্দ্রনাথ? রবীন্দ্রনাথের হয়েছিল? মনে হয় হয়নি। তার ম্যালেরিয়া হলে এই বিষয়ে কোন না কোন গান থাকতো। আচ্ছা তিনি কি প্রচণ্ড জ্বর নিয়ে কোন গান লিখেছিলেন? ঘোর লাগা মাথায় লেখা কোন গান? কাউকে জিজ্ঞেস করতে পারলে ভাল হত।

    আসমানী প্রাণপণে চেষ্টা করছে গানের কথা না ভাবতে। জ্বরের মধ্যে কোন একটা গানের সুর মাথায় চলে গেলে ভয়াবহ সমস্যা হবে। সেই সুর মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকবে। জাগ্রত অবস্থায় সেই গান বাজবে, ঘুমের মধ্যে বাজবে। প্রথমে বাজবে মাথায় তারপর সেই সুর সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়বে।

    ভক করে আসমানীর নাকে সিগারেটের কড়া গন্ধ ঢুকে পড়ল। আসমানী চোখ মেলে দেখল বড় মামা তার পাশে বসে আছেন। তিনি কখন ঘরে ঢুকেছেন। কখন বসেছেন সে কিছুই বুঝতে পারেনি। আসমানী ক্লান্ত গলায় বলল, কটা বাজে মামা?

    সাড়ে সাতটা।

    মাত্র সাড়ে সাতটা, আমি ভাবলাম দুপুর হয়ে গেছে।

    তোর জ্বরটা ভয়াবহ। মাথায় পানি ঢালতে হবে। বিয়ের দিনে কি অসুখ বাধালি বলতো।

    সেরে যাবে।

    খুব বেশী খারাপ লাগছে?

    না।

    তোর বাবাকে ডাক্তার আনতে পাঠিয়েছি। ডাক্তার এসে দেখুক।

    আচ্ছা।

    জ্বর কি রাতেই এসেছে?

    জানি না মামা।

    তোদের এ্যাপার্টমেন্ট হাউসে বাথটাব থাকলে ভাল হত। বাথটাব ভর্তি করে পানি দিয়ে তোকে তার মধ্যে ছেড়ে দিতাম।

    বাথটাবের বাংলা কি মামা?

    বাথটাবের বাংলা মানে? বাথটাবের বাংলা দিয়ে তুই কি করবি?

    জানতে ইচ্ছা করছে।

    এত জিনিস থাকতে বাথটাবের বাংলা জানতে ইচ্ছে করছে কেন?

    তাওতো জানি না।

    আমার মনে হয় জ্বরটা তোর মাথায় উঠে যাচ্ছে। জ্বর একবার মাথায় উঠলে আবোল তাবোল চিন্তা আসে।

    মামা!

    কি?

    তুমি কি সিগারেটটা ফেলে দেবে। সিগারেটের গন্ধ সহ্য করতে পারছি না। মনে হচ্ছে আমি সিগারেটের গন্ধে অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছি।

    সিগারেটতো খাচ্ছি না।

    ও আচ্ছা। মামা কটা বাজে?

    সাড়ে সাতটা।

    অনেকক্ষণ আগে একবার বললে সাড়ে সাতটা এখনো সাড়ে সাতটা?

    সাতটা সাইত্রিশ।

    এরমধ্যে মাত্র সাত মিনিট পরে হয়েছে?

    তুই চুপ করে থাকতো। দেখি আমি মাথায় পানি ঢালার ব্যবস্থা করছি। কোন কথা না। একেবারে চুপ।

    জ্বি আচ্ছা।

    চোখ বন্ধ করে রাখ তাকিয়ে থাকিস না। তোর লাল চোখ দেখে ভয় লাগছে।

    আসমানী চোখ বন্ধ করে আছে অথচ চোখ বন্ধ অবস্থায় সে সবাইকে দেখছে। এটা কি খুবই বিস্ময়কর ঘটনা না? মাথায় পানি ঢালছেন, মা। তিনি মাথার পেছনে, চোখ খোলা অবস্থায়ও তাঁকে দেখতে পাবার কথা না। মাছি হলে দেখতে পেত। মাছিদের মাথার পেছনেও চোখ থাকে। কিন্তু সে মাছি না হয়েও দেখতে পারছে। এটা কি একটা অদ্ভুত ঘটনা না? মা কি শাড়ি পরে আছেন তাও সে দেখতে পাচ্ছে। ব্লক প্রিন্টের শাড়ি। ডিজাইনটা চোখে লাগছে। আজ তাঁর মেয়ের বিয়ে তিনি এমন কুৎসিত ডিজাইনের শাড়ি পরেছেন কেন। তাঁকে বলতে হবে সুন্দর একটা শাড়ি পরতে। মেয়ের বিয়েতে সবচে বেশী সাজ করা উচিত মেয়ের মার।

    আসমানীর ঘুম ঘুম পাচ্ছে। পানির শীতল ধারা চুলের ভেতর দিয়ে গড়িয়ে পরছে-কি আরামই না লাগছে। ঘুমিয়ে পড়লে এই আরাম লাগবে না। জ্বরের ঘুম খুব কষ্টের ঘুম। ঘুমের মধ্যেও মাথার ভেতরটা জ্বালা করতে থাকে। আসমানীকে জেগে থাকতে হবে। আজ তার বিয়ে। কত কাজ পরে আছে। গোসল করে একটা হলুদ শাড়ি পরবে। হলুদ শাড়ি পরে ছবি তুলবে। অনেক অনেক দিন পর পুরানো এলবামে এই ছবি দেখে তার বড়মেয়ে বলবে—মা, গায়ে হলুদের দিন তোমাকে এত সুন্দর দেখাচ্ছিল? তোমার কি তখন এত চুল ছিল?

    হুঁ ছিল।

    তোমাকে হলুদ পরীর মত লাগছে মা।

    একদিন তোকেও এমন হলুদ পরীর মত লাগবে।

    মাগো কি যে সুন্দর তোমাকে লাগছে। তবে মুখটা খুব রোগা।

    তখন আমার খুব জ্বর ছিলরে মা।

    জ্বর ছিল?

    হ্যাঁ আকাশ পাতাল জ্বর। মাথায় পানি ঢালাঢালি। জ্বর নামানোর সবাই এত চেষ্টা করছে। কিন্তু জ্বর নামছে না।

    আহারে। আমি থাকলে চট করে জ্বর নামিয়ে দিতাম।

    কি ভাবে জ্বর নামাতি?

    চুমু দিয়ে দিয়ে জ্বর নামাতাম। চোখে চুমু দিলে জ্বর নেমে যায়।

    তোকে কে বলেছে।

    কেউ বলেনি। আমি জানি।

    আসমানী চোখ মেলল। তার মনে হল বাড়ি ভর্তি লোকজন। তাদের নিঃশ্বাসে ঘরের বাতাস পর্যন্ত ভারী হয়ে আছে। এত মানুষ কোত্থেকে এল? সে ভালমত দেখার চেষ্টা করল। না লোকতো বেশী না। এইত বড় মামা। বড়মামার পাশে নিশা। কাজের বুয়া একটু দূরে দাঁড়িয়ে। মাথার পেছনে মা। বাবা এখনো ডাক্তার নিয়ে ফেরেন নি। তাহলে বাড়ি ভর্তি লোক মনে হচ্ছে কেন? আসমানী আবারো চোখ বন্ধ করল। ফরহাদকে মনে মনে একটা চিঠি লিখলে কেমন হয়।

    এইযে বাবু সাহেব। আজ যে আপনার বিয়ে সেটা কি মনে আছে? না সব ভুল মেরে বসে আছেন? গায়ে হলুদের মাছ পাঠানোর কথা মনে আছে? দয়া করে কাতল মাছ পাঠাবেন না। আমি কাতল মাছ খাই না।

    শুনুন বাবু সাহেব আমার শরীর খুব খারাপ করেছে। এখন আমার মাথায় পানি এবং জলপট্টি দেয়া হচ্ছে। আমার জ্বর কত উঠেছে শুনতে চান? একশ পাঁচ। কি সর্বনাশ তাই না? একশ পাঁচ হোক বা দশ হোক বিয়ে কিন্তু হবে। আপনার বাসর রাতটা কাটবে স্ত্রীর সেবা করে। পারবেন না?

    আমাদের বাসরটা হাসপাতালে হলে কেমন হয়? হাসপাতালের ধবধবে শাদা বিছানায় আমি শুয়ে আছি। আমাকে স্যালাইন দেয়া হচ্ছে। আর আপনি আমার পায়ের কাছে মুখ শুকনো করে বসে আছেন। ঘর ভর্তি স্যাভলনের গন্ধ। সবার হয় ফুলশয্যা আমাদের হবে স্যাভলন শয্যা। মজা হবে না?

     

    আসমানী চোখ মেলল। সে অবাক হয়ে দেখল রাত হয়ে গেছে। ঘর অন্ধকার। দেয়ালে জিরো পাওয়ারের বাতি জ্বলছে। সেই বাতির আলো নরম। ঘরটা অতিরিক্ত ঠাণ্ডা। বিজবিজ বিজবিজ শব্দ হচ্ছে। এসি চলছে না-কি? শব্দটা এসির আওয়াজের মত লাগছে। তাদের বাড়িতেতো এসি নেই। তাকে কি কোন ক্লিনিকে ভর্তি করা হয়েছে?

    হ্যাঁ ক্লিনিক বলেইতো মনে হচ্ছে। এইতো স্ট্যাণ্ডের সঙ্গে স্যালাইনের ব্যাগ ঝুলছে। তাকে স্যালাইন দেয়া হচ্ছে। পায়ের কাছে একজন নার্স দাঁড়িয়ে আছে। নার্সটার চেহারা কোমল। নার্স এপ্রন পরে আছে। এনে তার নাম লেখা— রোকেয়া। এপ্রনের পকেটেই ষ্টেথিসকোপ। না তাহলে উনি নার্স না। নার্সরা এপ্রনের পকেটে স্টেথিসকোপ নিয়ে ঘুরেন না। ইনি ডাক্তার। ডাক্তার এগিয়ে আসছেন। তিনি আসমানীকে কি যেন বললেন। আসমানী পরিষ্কার শুনতে পেল না। এসির শব্দে ডাক্তার মেয়েটির কথা ঢাকা পরে গেছে। আসমানীর ইচ্ছা করছে তাকে জিজ্ঞেস করতে–আচ্ছা শুনুন, আজ আমার বিয়ে হবার কথা ছিল। বরযাত্রী এসেছে কি-না আপনি কি জানেন? যদি না জানেন একটু কি জেনে দেবেন? আমার আত্মীয় স্বজনরা নিশ্চয়ই আশে পাশেই আছেন। তাদের জিজ্ঞেস করলেই জানতে পারবেন।

    আসমানী কথা বলার চেষ্টা করছে। কিন্তু কথা বলতে পারছে না। ডাক্তার মেয়েটি এগিয়ে এসে স্যালাইনের ব্যাগ নাড়াচাড়া করছে। আসমানী স্যালাইনের ব্যাপের দিকে তাকিয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়ল।

    আসমানীর বিয়ে হয় নি। তার অসুখের কারণে যে হয় নি তা-না। বিয়ে হয়নি কারণ আজ সকাল এগারোটা দশ মিনিটে ফরহাদের দাদাজান মারা গেছেন। মরা বাড়িতে বিয়ে হয় না।

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleছায়াবীথি – হুমায়ূন আহমেদ
    Next Article চাঁদের আলোয় কয়েকজন যুবক – হুমায়ূন আহমেদ

    Related Articles

    হুমায়ূন আহমেদ

    আসমানীরা তিন বোন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    ইস্টিশন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    উড়ালপঙ্খী – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    এই বসন্তে – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    এই মেঘ, রৌদ্রছায়া – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    এইসব দিনরাত্রি – হুমায়ূন আহমেদ

    December 23, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    আসমানীরা তিন বোন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    আসমানীরা তিন বোন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    Our Picks

    আসমানীরা তিন বোন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025

    ইস্টিশন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025

    উড়ালপঙ্খী – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }