Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    আসমানীরা তিন বোন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025

    ইস্টিশন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025

    উড়ালপঙ্খী – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    চৈত্রের দ্বিতীয় দিবস – হুমায়ূন আহমেদ

    হুমায়ূন আহমেদ এক পাতা গল্প238 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    ০৯. বাবু সাহেব কেমন আছেন

    বাবু সাহেব কেমন আছেন?

    হাসপাতালের বিছানায় বসে আসমানী চুল আঁচড়াচ্ছে। বেশ আয়োজন করেই আঁচড়াচ্ছে। বিছানার উপর স্ট্যান্ড লাগানো আয়না। নিজেকে দেখতে দেখতে চুল। আঁচড়ানো। আসমানী মনে হয় সাজগোজও করেছে। চোখে কাজল। কপালে টিপ। পরনের শাড়িটাও নতুন। মনে হচ্ছে না সে হাসপাতালে আছে। মনে হচ্ছে সে। নিজের বাড়িতেই বাস করছে। বিকেলে মহিলা সমিতিতে নাটক দেখতে যাবে। এটা তার প্রস্তুতি।

    বাবু সাহেব আমার কথার জবাব দিচ্ছেন না কেন? কেমন আছেন?

    ভাল।

    আপনি কি কখনো লক্ষ্য করেছেন আমার চুল কত লম্বা?

    এখন লক্ষ্য করছি।

    দাঁড়িয়ে আছেন কেন বসুন।

    ফরহাদ বসতে বসতে বলল, তুমি একা কেন?

    তুমি আমাকে দেখতে আসছ এই জন্যে ইচ্ছা করে একা হয়েছি। বাবা আর নিশা ছিলেন তাদের জোর করে করে বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছি। একজন আয়া ছিল বসিরের মা। তাকে বলেছি বিকেলে আসতে। আশা করি তুমি বিকেল পর্যন্ত থাকবে।

    হ্যাঁ থাকব। শুধু বিকাল পর্যন্ত না যতক্ষণ আমাকে থাকতে দেয় ততক্ষণ থাকব।

    রাতে চলে যাবে?

    রাতেও যেতে চাচ্ছি না। হাসপাতালের লোকজন যদি অনুমতি দেয় তাহলে তোমার ঘরের সামনের বারান্দায় যে টুলটা আছে সেই টুলে শুয়ে থাকব। তুমি যতবার আমাকে ডাকবে ততবার আমি বাইরে থেকে জবাব দেব।

    আসমানী হেসে ফেলল। হাসতে হাসতে বলল, তুমি যে ভাবে কথা বললে তাতে মনে হচ্ছে তুমি সুনীলের কোন রোমান্টিক উপন্যাস থেকে উঠে এসেছ। আমি হচ্ছি নীরা। আমার অসুখ হয়েছে। নীরার অসুখ।

    নীরা কে?

    নীরা হল সুনীলের চির প্রেমিকা। তোমার জন্যে সিগারেট আনিয়ে রেখেছি। আমার সামনে বসে আরাম করে একটা সিগারেট খাওতো।

    হাসপাতালে রোগীর ঘরে বসে সিগারেট খাবো?

    হ্যাঁ খাবে। কারণ আমি ছোট্ট একটা পরীক্ষা করতে চাই। আমার শরীরটা আজ কত ভাল সেই পরীক্ষা। যদি দেখি সিগারেটের গন্ধ সহ্য হচ্ছে—তাহলে বুঝব শরীর বেশ ভাল।

    শরীর ভাল লাগছে?

    হ্যাঁ ভাল লাগছে। আমি গান জানলে গুনগুন করে গান গাইতাম। আমি অবশ্যি গান না জানলেও গুনগুন করে গাই। সবচে বেশি কোন গানটা গাই জান? সবচে বেশী গাই–

    ভালবেসে যদি সুখ নাহি
    তবে কেন মিছে এ ভালবাসা।

    আচ্ছা আমি কি খুব বকবক করছি?

    ফরহাদ সিগারেট ধরাল। সে তাকিয়ে আছে আসমানীর দিকে। তাকে সামান্য রোগা লাগছে। চোখের কোণে কালি, সেই কালিও সামান্য। এছাড়া তার মধ্যে অসুস্থতার কোন চিহ্ন নেই। আসমানী বিছানার মাঝখন থেকে সরে এক পাশে চলে গেল। দেয়ালে হেলান দিয়ে বসল। হঠাৎ তাকে সামান্য ক্লান্ত মনে হচ্ছে। ফরহাদ বলল, সিগারেটের গন্ধটা কি সহ্য হচ্ছে?

    আসমানী বলল, না।

    ফেলে দি?

    না ফেলবে না। তুমি সিগারেট খাচ্ছ দেখতে ভাল লাগছে। আচ্ছা শোন আমার উচিত ছিল তোমার দাদাজান বিষয়ে কথা বলা। তোমাদের বাড়িতে একজন মানুষ মারা গেছে অথচ তা নিয়ে আমি কোন কথা বলিনি। আসলে ইচ্ছা করে বলি নি। তোমার সঙ্গে অপ্রিয় কোন প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলতে ইচ্ছা করে না। আমি সারা জীবণু তোমার সঙ্গে সুখ নিয়ে কথা বলতে চাই।

    ফরহাদ সিগারেট ফেলে দিল। আসমানী বলল, তোমাদের খুব দুঃসময় যাচ্ছে তাই না?

    ফরহাদ হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ল।

    আগের বাড়িটা কি তোমরা ছেড়ে দিয়েছ?

    আজ ছাড়ব।

    তোমরা উঠবে কোথায়?

    আমার একজন ছোটবোন আছে—-জাহানারা আপাতত তার বাড়িতে।

    তুমি কোন রকম দুঃশ্চিন্তা করবে না। তোমার সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।

    কি ভাবে? কি ভাবে তা জানি না। কিন্তু হবে।

    If winter comes can spring be far behind?

    ফরহাদ হাসতে হাসতে বলল, সাহিত্যে অনেক সুন্দর সুন্দর কোটেশন আছে। কিন্তু পৃথিবীটা কোটেশন মত চলে না। পৃথিবী চলে তার নিজের নিয়মে। সেই নিয়মটা কি তাও আমরা ভালমত জানি না।

    প্লীজ দার্শনিকের মত কথা বলবে না। অসহ্য লাগছে।

    আচ্ছা বলব না।

    আমার বড় মামা কি আমাদের বিয়ের ব্যাপারে তোমাকে কিছু বলেছেন?

    না।

    আমার মনে হয় বলেছেন। তিনি এখন চান না যে বিয়েটা হোক। তিনি এখন বলছেন—বিয়ে হবে আমার অসুখ সারলে।

    সেটাইতো ভাল।

    সেটা মোটেই ভাল না; অসুখ সারার জন্যে অপেক্ষা করলে আর আমার বিয়ে হবে না। কারণ আমার অসুখ সারবে না।

    সারবে না কেন?

    সারবে না কারণ, অসুখটা ভয়ংকর। যদিও সবাই আমাকে বলছে রিউম্যাটিক ফিভার। আমি জানি ব্যাপারটা কি? জেনেও ভাণ করছি জানি না। আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম তোমার সঙ্গে ভাণ করব না। কাজেই সত্যি কথা বললাম।

    ফরহাদ চুপ করে গেছে। সে এখন আর আসমানীর দিকে তাকাচ্ছে না। তাকিয়ে আছে খোলা দরজার দিকে। আসমানী বলল, এই তুমি অন্যদিকে তাকিয়ে আছ কেন? তুমি যতক্ষণ আমার সামনে থাকবে আমার দিকে তাকিয়ে থাকবে।

    ফরহাদ তাকাল। আসমানী বলল, এই তো ঠিক আছে। এখন মন দিয়ে আমার জরুরি কথাটা শোন—আমার অসুখ যত ভয়ংকরই হোক আমি একদিনের জন্যে হলেও তোমাকে বিয়ে করতে চাই। মামা এই বিয়ে হতে দেবে না। কাজেই তুমি যা করবে তা হচ্ছে কাজির অফিসে ব্যবস্থা করে রাখবে। আমি গোপনে উপস্থিত হব। বিয়ে শেষ হলে হাসপাতালে ফিরে এসে হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে থাকব। ঠিক আছে?

    হ্যাঁ ঠিক আছে।

    আচ্ছা শোন পৃথিবীর সমস্ত প্রেমিক তার প্রেমিকার চুল হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখতে চায়। তুমি কখনো আমার চুল ছুঁয়ে দেখনি। নাও চুলগুলি ছুঁয়ে দেখ। কারণ বেশিদিন আমার মাথায় চুল থাকবে না। যখন কেমোথেরাপি শুরু হবে সব চুল পড়ে যাবে। নাও চুলে হাত দাও।

    ফরহাদ ফুল স্পর্শ করল।

    আসমানী হোট্ট করে নিশ্বাস ফেলে বলল, এখন তুমি চলে যাও।

    চলে যাব।

    হ্যাঁ চলে যাবে। কারণ তোমাকে দেখে আমার খুব খারাপ লাগছে। কষ্ট হচ্ছে, এবং কান্না পাচ্ছে। তুমি সারা জীবন আমার পাশে থাকবে না, ভাবতেও পারছি না। সত্যি সত্যি হয়তো কেঁদে ফেলব। আমাকে কাঁদতে দেখে তুমি কাঁদবে। পুরুষ মানুষের কান্না খুব বিশ্রী। প্লিজ তুমি বিদেয় হও। ফরহাদ অবিশ্বাসী গলায় বলল, বিদেয় হব।

    হ্যাঁ বিদেয় হবে। আর শোন আমাকে বিয়ে করতে হবে না। এতক্ষণ তোমার সঙ্গে ঠাট্টা করছিলাম। যে মেয়ে কবরের উপর দাঁড়িয়ে আছে তার আবার বিয়ে কি? আচ্ছা বল তো আমাকে কি আজ সুন্দর লাগছে?

    হ্যাঁ।

    তোমার চোখে আমাকে যেন সুন্দর লাগে এই জন্যে সকাল থেকে সাজছি। কাজল দিয়েছি, মাশকারা দিয়েছি। গাল গোলাপী লাগছে না? রাসন দিয়েছি। আমার চেহারা অতি দ্রুত খারাপ হয়ে যাবে। আমি চাই না আমার সেই চেহারা তুমি দেখ। কাজেই এই তোমার আমাকে শেষ দেখা।

    ফরহাদ তাকিয়ে আছে। আসমানী হাসছে। কী সুন্দর হাসি। এত সুন্দর করে একটা মেয়ে হাসে কি করে? তাছাড়া এখন কি তার হাসির সময়

    আসমানী হাসি থামিয়ে বলল, আমার বাবা খুব দুঃশ্চিন্তায় পড়ে গেছেন। রাতে তার ঘুম হচ্ছে না। এই কদিনে তার ওজন এত কমেছে যে বলার না। কোনো প্যান্ট এখন পরতে পারেন না। ঢিলা হয়ে গেছে। বেল্ট লাগে। বাবাকে আজ দেখে খুবই মায়া লাগল। কথাবার্তাও এখন ঠিকমতো বলতে পারেন না। কথা আটকে যায়।

    তোমাকে নিয়ে খুব দুঃশ্চিন্তা করছেন।

    এই মুহূর্তে আমাকে নিয়ে দুঃশ্চিন্তা করছেন না। তার ফ্ল্যাট বাড়ি নিয়ে দুঃশ্চিন্তা করছেন। বাড়িটা বিক্রি করার চেষ্টা করছেন। আমাকে দেশের বাইরে নিতে হবে। টাকা কোথায়? বাবা তার সারা জীবনে টাকা-পয়সা যা পেয়েছেন সব ঐ ফ্ল্যাট কিনতে শেষ করছেন। যেই মুহূর্তে ফ্ল্যাট বিক্রি হবে, আমরা হয়ে যাব পথের মানুষ—জাগ্রত জনতা।

    আসমানী আবারো হাসছে। ফরহাদ মন খারাপ করে তাকিয়ে আছে। আসমানী আজ অন্য দিনের চেয়ে বেশি হাসছে। বেশি কথা বলছে। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে সে ক্লান্ত হয়ে পড়ছে। তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। ফরহাদের কি বলা উচিত—এত কথা বলার দরকার নেই। তুমি চুপ করে থাক।

    আসমানী শাড়ির আঁচলে মাথার ঘাম মুছতে মুছতে বলল–একজন ভালো মেয়ে হিসেবে আমার বাবাকে বলা উচিত ফ্ল্যাট বিক্রি করার কোন দরকার নেই। চিকিৎসা করে লাভ যা হবে তা হচ্ছে মনের সান্তনা। তোমরা বলতে পারবে মেয়ের চিকিৎসার জটি হয় নি। এই মনের সান্তনার জন্যে পথের ফকির হবে কেন? কিন্তু এরকম কোনো কথা আমি বলি নি। আমি খুব স্বার্থপর তো এই জন্যে বলিনি। এই শোন তোমাকে আজ কিন্তু খুব সুন্দর লাগছে। ছাই রঙা সার্টেও লাগছে। তোমাকে বলেছিলাম না ছাই রঙা সার্টটা পুড়িয়ে ফেলবে। পুড়াও নি কেন?

    গরিব মানুষ তো, সার্ট পুড়াতে মায়া লাগে।

    সার্ট গা থেকে খুলে দাও। আমি পুড়াব। আমিও গরিব তবে আমার এত মায়া নেই। কই খুলছ না কেন?

    সার্ট সত্যি খুলব?

    অবশ্যই খুলবে।

    আসমানী মিটি মিটি হাসছে। মনে হয় তার মনে কোনো দুষ্ট বুদ্ধি খেলা করছে।

    আমার সামনে সার্ট খুলতে লজ্জা লাগছে।

    হ্যাঁ।

    তাহলে একটা কাজ কর–টেবিলের উপর দেখ একটা প্যাকেট আছে। প্যাকেটটা নিয়ে বাথরুমে ঢুকে পড়। মনে নেই, তোমার জন্যে সাতটা সার্ট কিনে ছিলাম? কোন বারে কোন সার্ট পরবে কাগজে লিখে রেখেছি। আজ বুধবার। আজ তোমার কপালে হালকা সবুজ রঙের সার্ট। চিরুনীটা নিয়ে যাও। মাথা আঁচড়াবে। বাথরুম থেকে বের হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসবে। তারপর স্ট্রেইট দরজা দিয়ে চলে যাবে। তোমার সঙ্গে বক বক করে আমার মাথা ধরেছে এবং মাথা ঘুরছে। আমি শুয়ে থাকব।

    তোমাকে একা ফেলে চলে যাব?

    হ্যাঁ চলে যাবে। আমি একা থাকব না—বাবার আসার সময় হয়ে গেছে। ও আরেকটা কথা প্রতিটি সার্টের বুক পকেটে একটা করে চিঠি আছে। যে দিন যে সার্ট পরবে সেদিন চিঠিটাও পড়বে।

    আচ্ছা। আগামী সাতদিনে সাতটা চিঠি পড়া হয়ে যাবে। ইন্টারেস্টিং না।

    হুঁ।

    আমি কি ভেবে রেখেছিলাম জান—আমি ভেবে রেখেছিলাম সারা জীবন তোমাকে এরকম করে চিঠি লিখব। সার্ট গায়ে দিয়ে অফিসে যাচ্ছ। সার্টের বুক পকেটে একটা চিঠি। যত রাগ হোক, ঝগড়া হোক তুমি চিঠি পাবেই। আচ্ছা শোন তুমি এখনো দাঁড়িয়ে আছ কেন? বললাম না আমার মাথা ঘুরছে। আমি শুয়ে থাকব। আর শোন বাথরুম থেকে বের হয়ে যদি তুমি দেখ আমি ঘুমিয়ে পরেছি— খবরদার আমার ঘুম ভাঙ্গাবে না। রাতে ঘুমের অষুধ খেয়েও আমার ঘুম হচ্ছে না। ডাক্তাররা বলেছেন ঘুমটা আমার জন্যে খুবই দরকার।

    ফরহাদ সার্ট বদলে মাথার চুল আঁচড়ে বাথরুমের আয়নায় নিজেকে দেখার চেষ্টা করল। হাসপাতালের সব আয়না হাসপাতালের রুগীদের মতোই অসুস্থ। আয়নায় স্পষ্ট কিছু দেখা যায় না তারপরেও ফরহাদের মনে হলো সবুজ রঙের সার্টটায় তাকে খুব মানিয়েছে। বুধবারের সার্টের পকেটে শুধু যে চিঠি তাই না। একটা বলপয়েন্ট কলম। কলমটা কেন দিয়েছে কে জানে। চিঠিটা পড়তে ইচ্ছা করলেও এখন পড়া যাবে না। হাসপাতাল থেকে বের হয়ে পড়তে হবে। এখন পড়লে আসমানী বুঝে ফেলবে। এইসব ক্ষেত্রে আসমানীর সিক্সথ সেন্স অত্যন্ত প্রবল।

    ফরহাদ বাথরুম থেকে বের হয়ে দেখল আসমানী ঘুমিয়ে পড়েছে। গভীর ঘুম। বড় বড় নিশ্বাস ফেলছে। তার ঘুম ভাঙ্গানোর কোনো মানে হয় না। ফরহাদ হাসপাতালের বারান্দায় এসে দাঁড়াল। নিশা এবং তার বাবাকে আসতে দেখা যাচ্ছে। নিশার হাতে একটা প্যাকেট। নিশার বাবার হাতে কিছু বইপত্র। তিনি দূর থেকে ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে ফরহাদের দিকে একবার তাকিয়েই চোখ ফিরিয়ে নিলেন। এটা ফরহাদের কল্পনাও হতে পারে। তার দিকে ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকানোর এখন কিছু নেই। কেউ কাউকে দেখতে পায় নি এমন ভাব করলে কেমন হয়। ফরহাদ উল্টো দিকে হাঁটা শুরু করতে পারে। মনে হয় এটাই সবচে ভালো বুদ্ধি। তাছাড়া আসমানীর চিঠিটা পড়তে ইচ্ছা করছে। যত তাড়াতাড়ি হাসপাতালের বাইরে যাওয়া যাবে তত তাড়াতাড়ি চিঠিটা পড়া যাবে।

    ফরহাদ উল্টো দিকে হাঁটতে শুরু করল। বারান্দার শেষ মাথায় নিশ্চয়ই সিড়ি বা লিফট আছে। তার পুরানো ছাই রঙের সার্টটা হাসপাতালে রয়ে গেছে। সার্ট দেখে নিশা এবং তার বাবা নিশ্চয়ই ভ্রু কুঁচকাবেন। যার যা ইচ্ছা করুক। তাকে এই মুহূর্তে আসমানীর চিঠি পড়তে হবে।

    চিঠি ব্যাপারটা খুব অদ্ভুত—যতক্ষণ পড়া না হয় ততক্ষণ আঁকিবুকি টানা সামান্য এক টুকরা কাগজ। পড়তে শুরু করলেই সে একজন রক্ত মাংসের মানুষ। মানুষের মতোই সে রাগ করে। অভিমান করে।

    বাবু সাহেব, প্রচণ্ড মাথা ধরা নিয়ে আপনার জন্যে আজ চিঠি লিখলাম। সব মিলিয়ে সাতটা চিঠি লেখা সহজ ব্যাপার না। শুধু এই চিঠিটাই সামান্য বড়। বাকি সবগুলি এক লাইন দুলাইনের।

    এই চিঠি লিখতে লিখতে আমি মজার একটা জিনিস ঠিক করি। মজার জিনিসটা হচ্ছে তোমার জন্যে একটা পরিস্থিতি তৈরি করা। যাতে তুমি সার্ট গায়ে দিয়ে যখন বাথরুম থেকে বের হবে তখন দেখবে আমি ঘুমিয়ে। এই ঘুম আসল ঘুম নামকল যুম। অভিনয় ঘুম। আমাকে ঘুমন্ত দেখে তুমি কি কর তাই আমার দেখার ইচ্ছা। আমার ধারণা তুমি আমার পাশে বসবে এবং খুব সাবধানে (যাতে আমার ঘুম না ভাঙ্গে) কপালে হাত রাখবে। কিংবা মাথা নিচু করে ঝুঁকে এসে… থাক বাকিটা আর লিখলাম না, লজ্জা লাগছে। তুমি কি করবে তা নিয়ে আমি মনে মনে একটা বাজি ধরেছি। দেখি বাজিতে জিততে পারি কি-না। এই শোন আমি আর লিখতে পারছি

    —প্রচণ্ড মাথার যন্ত্রণা হচ্ছে। অনেক কিছু লেখার ইচ্ছা ছিল। ভুল বললাম, অনেক কিছু না একটা কথাই বারবার নানান ভঙ্গিতে লেখার ইচ্ছা, I Love You, তাও লিখতে পারছি না। শরীর বিদ্রোহ করেছে। ভালবাসাবাসির সঙ্গে শুধু মন না, এখন মনে হচ্ছে শরীরও জড়িত। তুমি ভালো থেকো।

    ইতি তোমার আসমানী।

    ফরহাদ আকাশের দিকে তাকালো।

    কী সুন্দর ঝকঝকে নীল আকাশ। সোহরাওয়ার্দীর সামনের গাছগুলিকেও কী সুন্দর লাগছে। ফরহাদের আবার হাসপাতালে যেতে ইচ্ছা করছে।

    আসমানীর বাবা যা ভাবার ভাবুক। সে আসমানীর হাত ধরে বসে থাকবে। উপায় নেই, আজ তাদের বাড়ি ছাড়তে হবে। রিয়েল এস্টেট কোম্পানির লোকজন অপেক্ষা করছে।

     

    জাহানারা মায়ের জন্যে দোতলার বড় একটা ঘর ছেড়ে দিয়েছে। ঘরে খাট আছে, ড্রেসিং টেবিল আছে। দুটা চেয়ার আছে। টেবিল আছে। মেঝেতে কার্পেটও আছে। কার্পেট পুরানো হলেও পরিষ্কার। ঘরের সঙ্গে এটাচড বাথরুম।

    জাহানারা বলল, এসি লাগানো ঘর তোমাকে দিতে পারতাম মা। একটা ছিল, কিন্তু এটাচড বাথরুম নেই। বাবা রাতে তিন চারবার বাথরুমে যায় এই জন্যে এই ঘর। ঘরের সঙ্গে বারান্দা আছে। বিকেলে বারান্দায় বসে চা খেতে পারবে। তোমার জামাইকে বলেছি সে তার অফিস থেকে একটা টিভি এনে লাগিয়ে দেবে।

    টিভির দরকার নেই।

    দরকার থাকবে না কেন? অবশ্যই দরকার আছে। মা শোন তুমি এমন মুখ কালো করে আছ কেন? ঘর পছন্দ হয় নি?

    ঘর খুব সুন্দর। বারান্দাটাও সুন্দর।

    তাহলে মুখটা কাল কেন?

    গুষ্ঠি শুদ্ধ তোর এখানে থাকতে এসেছি। ভাবতেই খারাপ লাগছে।

    মেয়ের বাড়িতে মা এসে থাকে না? তুমি তো আর সারা জীবনের জন্য থাকতে আসনি?

    তাও ঠিক। অল্প কিছু দিন থাকব তুই যা বাড়াবাড়ি করছিস এই জন্যেও খারাপ লাগছে। মঞ্জু বাড়ি ভাড়ার জন্যে যে রকম ছোটাছুটি করছে হয়তো আজ সন্ধ্যাবেলাতেই এসে বলবে—বাড়ি ঠিক হয়েছে চল। ছেলের যে স্বভাব যদি একবার বলে, আজ চল। আজই যেতে হবে।

    আগে বলুক তারপর দেখা যাবে। মা শোন-তোমার আর বাবার জন্যে ঘরে খাবার দিয়ে যাবে। খাবার ঘরে তোমাদের খেতে যাবার দরকার নেই। মজিদের মা বলে একটা কাজের মেয়ে আছে তোমার যখন যা দরকার তাকে বলবে। মজিদের মাকে চিনেছ তো ঐ যে উঁচু দাঁত। ঠিক আছে–মা?

    হ্যাঁ ঠিক আছে।

    তোমার তো আবার ঘন ঘন চা খাবার অভ্যাস। তোমাকে সকালবেলায় এক ফ্লাক্স গরম পানি দিয়ে যাব। ঘরে টি কাপ, চিনি, দুধ থাকবে। শুধু চা-টা বানিয়ে নেয়া।

    ফরহাদ কোথায় থাকবে?

    একতলায় ব্যবস্থা করেছি। বড় ভাইজান বলেছে, সে থাকবে না। সে নাকি কোনো এক বন্ধুর সঙ্গে থাকবে। মঞ্জু ভাইয়ার সঙ্গে তো আমার দেখাই হয়নি। সে এখানে থাকবে কি না, তাও জানি না। বড় ভাইজানের ঘরে দুটা খাট আছে তারা দুইজন থাকতে পারবে। কোনো সমস্যা হবে না।

    মেয়ে তাদের যত্ন করছে তাতে তার খুশি হওয়া উচিত। তিনি খুশি হতেন যদি জানতেন তার দুই ছেলে তার জন্যে বাসা ভাড়া করবে। তিনি ভাড়া বাসাতে উঠে যাবেন। মঞ্জু তাকে পরিষ্কার বলে দিয়েছে—পাগল হয়েছ মা। আমি বাড়ি ভাড়া করব কীভাবে? আমার আছে কি তোমাকে যে মাসে এক হাজার করে টাকা দিব বলেছি এটাই আমার ফাইন্যাল কথা। সেটা দিব। তোমাদের একটা সুবিধা করে দিচ্ছি। আমার থাকার ব্যবস্থা নিয়ে তোমাদের চিন্তা করতে হবে না। আমার ব্যবস্থা আমি করে নেব।

    ফরহাদের সঙ্গেও তিনি কথা বলেছেন। ফরহাদ মাথা নিচু করে বলেছে– দেখি একটা কিছু ব্যবস্থা করব। সেই ব্যবস্থাটা কী সে বলতে পারছে না। ব্যবস্থাটা কবে নাগাদ হবে সে সম্পর্কেও কিছু বলছে না। ফরহাদের দৃষ্টি ভরসা হারা দৃষ্টি।

    তিনি ফরহাদকে মোটামুটি কঠিন গলায় বলেছেন—আমরা জামাইয়ের বাড়িতে কত দিন পড়ে থাকব? সহজ প্রশ্নের সহজ উত্তর হওয়া উচিত। সেই সহজ উত্তরটা সে দিচ্ছে না। এমন ভাব করেছে যেন মায়ের কথা সে শুনতে পাচ্ছে না।

    তুই কি আমাদের সঙ্গে থাকবি?

    উঁহু। আমি নান্টু ভাইয়ের মেসে থাকব।

    না, তুই অবশ্যই আমাদের সঙ্গে থাকবি। আমাদের কখন কী দরকার হয়। এ বাড়িতে কাকে কি বলব?

    রাহেলা মনে প্রাণে চাচ্ছেন ছেলে তার সঙ্গে থাকুক। সঙ্গে থাকলেই অন্যের বাড়িতে থাকার অপমানটা গায়ে লাগবে। তখন একটা কিছু ব্যবস্থা করার জন্যে উঠে পরে লাগবে। রাহেলার মনে ক্ষীণ ভয় ঢুকে গেছে তার দুই ছেলে কোনো ব্যবস্থাই শেষ পর্যন্ত করবে না। বাকি জীবনটা তার কাটবে জামাইয়ের অন্ন খেয়ে। অতি দ্রুত তিনি কাজের বুয়ার স্তরে নেমে যাবেন। ফরহাদের বাবা হয়ে যাবে বিনা বেতনের মালি। বাড়ির সামনে মাটি কুপিয়ে গাছ পুতবে। ঝাঝরি দিয়ে সকাল বিকাল গাছে পানি দিবে। জামাইয়ের গাড়ি এসে থামলে দৌড়ে গিয়ে গাড়ির দরজা খুলে দিবে।

    নিজের অসহায় অবস্থা নিয়ে কারো সঙ্গে আলাপ করবেন সেই উপায় নেই। আগে যাবতীয় সমস্যা নিয়ে মেয়ের সঙ্গে কথা বলতেন। এখনকার সমস্যাটা তিনি কিছুতেই মেয়েকে জানাতে দিতে চান না। স্বামীর সঙ্গে আলাপ করার প্রশ্নই উঠে না। লোকটার মাথা পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেছে বলে তার ধারণা। কথাবার্তার কোনো ঠিক নেই। কখন কি বলছে—কেন বলছে তাও জানে না। জাহানারার শাশুড়ি যখন বললেন, বেয়াই সাহেব! কেমন আছেন?

    তার উত্তরে সে হড়বড় করে বলল, গাছের কথা বলছেন? সব তুলে ফেলেছে। জায়গা পরিষ্কার। কে বলবে দুদিন আগে কত গাছ ছিল, কত ধরনের গাছ ছিল। পাঁচটা লবঙ্গ চারা লাগিয়েছিলাম তার মধ্যে চারটা বেঁচেছে। আর একটা বছর পার করতে পারলে গাছের লবঙ্গ খাওয়াতাম।

    জাহানারার শাশুড়ি বললেন, গাছের কথা না বেয়াই সাহেব, আপনার কথা জানতে চাচ্ছি।

    ফরহাদের বাবা হতভম্ব হয়ে বলল, আমার কি কথা?

    আপনি আছেন কেমন? শরীরটা কেমন?

    ফরহাদের বাবা এমনভাবে চারদিক দেখতে লাগলো যেন এমন অদ্ভুত প্রশ্ন জীবনে কেউ তাকে করে নি।

    রাহেলা বললেন, বেয়ান সাহেব উনাকে কিছু জিজ্ঞেস করা না করা অর্থহীন। গাছ বিষয়ে কোনো প্রশ্ন থাকলে করেন—জবাব দিবে। অন্যকোনো প্রশ্নের জবাব দিবে না। আপনার বেয়াই সাহেবের আমার সঙ্গে বিয়ে না হয়ে একটা কাঁঠাল গাছের সঙ্গে বিয়ে হলে তার জীবনটা সুখে কাটত।

    এই কথায় জাহানারার শাশুড়ি খুবই আনন্দ পেলেন। হেসে ভেঙ্গে পড়ার মতো অবস্থা। হাসতে হাসতে বললেন, বেয়ান তো বড়ই রসিক। বেয়ান যে এত রসিক তা তো জানতাম না।

    রাহেলা মোটেই রসিক না। রস করার মতো মনের অবস্থা তাঁর না। এ বাড়িতে পা দেয়ার পর থেকে তাকে নানান ধরনের মিথ্যা কথা বলতে হচ্ছে। যেমন জাহানারার শাশুড়িকে বললেন–আমার দুই ছেলে বুঝলেন বিয়ান সাহেব। বাস্তববুদ্ধি বলে কিছু নাই। কতবার বললাম রহমত উল্লার জায়গাটা কিনে রাখ। দেশের বাড়ির জমিজমা তো কোনো কাজে আসবে না সাত ভূতে লুটেপুটে খাবে। সেই সব বিক্রি করে এই জায়গাটা কিনে ফেল। ঢাকায় বাস করছিস ঠিকানা বাগবে না? দুই ভাই-ই বলে, বাদ দাও। বাদ দিয়ে অবস্থাটা তো দেখেছেন? একেবারে রাস্তায়।

    জাহানারার শাশুড়ি বললেন, কি বলেন বেয়ান সাহেব রাস্তায় হবেন কেন? আমরা আছি কি জন্যে

    সেটা তো ঠিকই। ছোট ছেলে আমাকে কি বলে শুনুন। সে বলে—মা মাসের এই ভাংতি কিছুদিনের জন্যে তো আর বাড়ি খুঁজে পাওয়া যাবে না। আমি হোটেলের একটা ঘর ভাড়া করে দিচ্ছি। তোমরা দুই বুড়োবুড়ি হোটেলে থাক। ও আল্লা আমার বড় ছেলেরও দেখি তাতে সায় আছে। সেও বলল, এটাই ভালো। হোটলে থাকার অনেক মজা। চল আমরা বাকি জীবন হোটেলে কাটিয়ে দেই। আমি তখন দিলাম ধমক—বললাম, তোরা আমাকে আমার মেয়ের কাছে দিয়ে নিজেরা হোটেল ভাড়া করে থাক। সঙ্গে অবশ্যই তোর বাবাকেও নিবি। সে হোটেলের টবের গাছে পানি দিবে।

    জাহানারার শাশুড়ি বললেন—বেয়ান সাহেব! আপনি এত মজা করে কথা বলেন। আপনার এই গুণের কথা তো আগে জানতাম না। আপনার ছেলেরা বাড়ি ভাড়া করলেও আপনি থাকবেন আমার সঙ্গে। আমরা দুই বুড়ি পান জর্দা খাব। গল্প করব। টিভিতে হিন্দী ছবি দেখব। বেয়ান আপনি হিন্দী বুঝেন তো?

    রাহেলা জাহানারার শাশুড়ির কথায় স্বস্তি পেলেন। যাক বুড়ি তার মিথ্যা কথাগুলি বিশ্বাস করছে। এ জাতীয় মিথ্যা কথা জাহানারাকে বলা যাবে না। এই মেয়ের অনেক বুদ্ধি। মিথ্যা বললেই ধরা পড়তে হবে। তার ধারণা জাহানারাকে যখন বলেছেন ম বাড়ি ভাড়ার জন্যে ছোটাছুটি করছে—তখন মেয়ে বুঝে ফেলেছে মা মিথ্যা কথা বলছে। তবে তিনি তার মেয়ের উপর সন্তুষ্ট। খুবই সন্তুষ্ট।

    মেয়ে তাকে অনেক কিছু জিজ্ঞেস করতে পারত। কিছুই জিজ্ঞেস করে নি। সে বলতে পারত—ভাইয়ের বিয়ে দিচ্ছ কই আমি তো কিছু জানলাম না। আমি যখন রানীর সঙ্গে বিয়ের কথা বললাম, তখনো চুপ করে রইলে। মেয়েকে শুধু মনে পড়ে বিপদের সময়ে

    জাহানারা কিছু জানতে চায় নি। দাদাজানের মৃত্যুর কারণে বিয়ে ভেঙ্গে গেছে, সেই ভাঙ্গা বিয়ে আবার কবে জোড়া লাগবে সে ব্যাপারেও কোনো কৌতূহল দেখায় নি। এখন দেখায় নি বলে যে কোনদিন দেখাবে না তা না। এক সময় না এক সময় জানতে চাইবে। রাহেলা তখন কি বলবেন সব ঠিক করে রেখেছেন। তিনি বলবেন, ঐ বিয়ে হবে না। তোর ভাইয়ের বিয়ের দায়িত্ব আমি তোর হাতে দিলাম। মা তুই ব্যবস্থা কর। এটা বলতে তার কোনো অসুবিধা নেই কারণ তিনি জানেন বিয়ের দিন বিয়ে ভেঙ্গে গেলে সেই বিয়ে আর কখনো হয় না। এটা তিনি যে একা জানেন তা না। সবাই জানে।

    তার উপর খবর পাওয়া গেছে মেয়েটা ভয়ঙ্কর অসুস্থ। চিকিৎসার জন্যে হাসপাতালে আছে। এমন অবস্থা যে দেশে চিকিৎসা হচ্ছে না, বিদেশ যেতে হচ্ছে। তড়িঘড়ি করে যে বিয়ে দিতে চাচ্ছিল এই জন্যেই চাচ্ছিল। রোগ গোপন করে মেয়ে পার। ধর্মের কল বাতাসে নড়ে। বাতাস না থাকলেও আপনা আপনি নড়ে। আল্লাহর ইশারায় বিয়ে ভেঙ্গে গেল। কাউকে কিছু করতে হলো না, বলতে হলো না।

    রাহেলা ঠিক করে রেখেছেন রানীর সঙ্গে ফরহাদের বিয়ের ব্যাপার নিয়ে এখনো কোনো কথা বলবেন না। চুপচাপ অপেক্ষা করবেন। তার মন আগেও বলেছে বিয়েটা হবে, এখনো বলছে হবে। জাহানারা একটু সাহায্য করলেই হবে। সেই সাহায্য কি জাহানারা করবে? করবে তো বটেই বাপ-ভাই বলে কথা। তবে জাহানারা মনে কষ্ট পেয়েছে। পরে এক সময় মেয়ের সঙ্গে নিরিবিলিতে অনেক কথা বলবেন।

    রানী মেয়েটিকে আগে যেমন সুন্দর দেখেছিলেন, এবার তার কাছে আরো সুন্দর লাগছে। বিয়ের কথাবার্তা শুরু হলেই মেয়েরা সুন্দর হতে থাকে। সবচে বেশি সুন্দর হয় গায়ে হলুদের দিন। বিয়ের রাত থেকে তাদের সৌন্দর্য কমতে শুরু করে। এটা হলো সাধারণ কথা। রানীর বিয়ের কথা শুরু হয়েছে বলেই সে সুন্দর হচ্ছে, এ বিষয়ে তিনি নিশ্চিত। এ বাড়িতে এসেই রানীকে তিনি একটা শাড়ি দিয়েছেন। মুরুব্বিরা বেড়াতে এলে কাপড়চোপর, মিষ্টি নিয়ে আসে। সেইভাবে আনা, তবে শাড়িটা নিয়ে তার সামান্য মন খুঁত খুঁত করছে। কারণ এই শাড়ি ফরহাদ তার বউ-এর জন্যে কিনেছিল। সুন্দর করে প্যাকেট করা। ফরহাদকে জিজ্ঞেস না করেই দিয়েছেন। ফরহাদের এসব মনে থাকবে না। এখন তার হচ্ছে মাথার ঘায়ে কুত্তা পাগল অবস্থা।

    রানী শাড়ির প্যাকেট হাতে নিয়ে অবাক হয়ে বলল—শাড়ি কেন?

    তিনি মধুর ভঙ্গিতে বললেন, তোমাকে কখনো কিছু দেয়া হয় না। কিছু দিতে ইচ্ছা করে। ফরহাদকে বললাম একটা শাড়ি কিনে দিতে। সে নিজেই পছন্দ করে কিনে এনেছে। বুঝতে পারছি না তোমার পছন্দ হবে কি না।

    রানী লজ্জিত ভঙ্গিতে বলল, নতুন শাড়ি পরতে আমার সব সময় ভাললা লাগে।

    রাহেলা বললেন, শাড়ি হাতে নিয়ে বোঝা যায় না সুন্দর না অসুন্দর। শাড়ি সুন্দর শরীরে। শাড়িটা পরে আস মা। লাল ব্লাউজ আছে না? লাল ব্লাউজ যে কোনো শাড়ির সঙ্গে মানায়। লাল ব্লাউজ দিয়ে শাড়িটা পর। দেখি তোমাকে মানায় কি-না।

    রানী হ্যাঁ সুচক মাথা নেড়ে লজ্জিত এবং আনন্দিত ভঙ্গিতে বের হয়ে গেল।

    রাহেলা মেয়েটাকে শাড়ি পরে আসতে বলেছেন কারণ নতুন শাড়ি পরলেই সবাই জানতে চাইবে শাড়িটা কোত্থেকে এসেছে। এটা সবার জানা দরকার। কেউ যেন মনে না করে তিনি আশ্রিতা হিসেবে মেয়ের বাড়িতে উঠেছেন। এতে তার যেমন অপমান। তার মেয়েরও অপমান। তিনি যতদিন থাকবে। খরচাপাতি করে থাকবেন। এমনভাবে খরচ করবেন যেন সবার চোখে পড়ে। কাল পরশু বিশাল একটা কাতল মাছ কিনে আনাবেন।

    রানীকে শাড়ি তিনি অনেক বিচার বিবেচনা করেই দিয়েছেন। শুধু শাড়িটা কিনেছে ফরহাদ এই কথাটা না বললে ভালো হত। রানী যদি কোনোদিন ফরহাদকে কিছু জিজ্ঞেস করে তাহলে সমস্যা হবে। আজকালকার মেয়ে, অকারণে কথা বলা এদের স্বভাব। ফরহাদকে দেখে বলে বসতে পারে। আপনি তো ভালো শাড়ি চিনেন। রঙটা আমার খুব পছন্দ হয়েছে। আর ফরহাদ এমন গাধা। এ রকম কোনো কথা বললে, সে সঙ্গে সঙ্গে বলবে—কই আমি তো তোমার জন্যে শাড়ি কিনি নি!

    রাহেলা অনেকক্ষণ অপেক্ষা করলেন রানী শাড়ি পরে তাঁকে এসে সালাম করবে। তিনি বিস্মিত হয়ে লক্ষ্য করলেন মেয়েটা এল না। বাড়ির পেছনে কোর্ট কেটে ব্যাডমিন্টন খেলা হচ্ছে। তিনি বারান্দা থেকে দেখলেন রানী ব্যাডমিন্টন খেলছে। তাকে দেখে লজ্জা পাবার মতো ভাবও করল না। রানীর সঙ্গে লম্বামত যে মেয়েটি খেলছে তাকে তিনি চিনতে পারলেন না। এদের কোনো আত্মীয় স্বজন হবে। এখন থেকে এ বাড়ির সবাইকে চিনতে হবে। তাদের আচার আচরণ বিশ্লেষণ করতে হবে। সবার মন যুগিয়ে এমনভাবে চলতে হবে যেন কেউ বুঝতে না পারে তিনি সবার মন যুগিয়ে চলছেন। একবার বুঝে ফেললে–সর্বনাশ।

    আশ্রিতের জীবন ভয়াবহ জীবন। এই জীবন সহনীয় করার কোনো ব্যবস্থা নেই। নিজেকে এই পরিবারের কাছে অতি প্রয়োজনীয় করে তুলতে পারলে জীবনযাত্রা সহজ হবে, কিন্তু এমন সম্ভাবনা একেবারেই নেই। এদের বিরাট পরিবার। অনেক লোকজন। চার পাঁচটা কাজের মেয়ে। নদশ বছর বয়েসী দুটা ছেলে—যাদের একমাত্র কাজ একটু পর পর দোকানে যাওয়া এটা ওটা নিয়ে আসা। বাজার করার লোকও আলাদা। বিশাল বলশালী একজন মানুষ। মাথা কামানো। তাকে দেখলেই মনে হয় কিছুক্ষণ আগে একটা খুন করে এসেছে। পরিশ্রম হয়েছে বলে ক্লান্ত হয়ে চা খাচ্ছে। চা খেয়ে দ্বিতীয় খুনটা করতে যাবে।

    রাহেলা এই বাড়ির ভাব ধরার চেষ্টা করছেন। ধরতে পারছেন না। এত সহজে ধরা যাবে না। সময় লাগবে। জাহানারার কাছে শুনেছেন এরা একান্নবর্তি পরিবার। কিন্তু এখন দেখছেন—সবার জন্যে একসঙ্গে রান্না হয় এটা যেমন ঠিক আবার প্রত্যেক পরিবারের আলাদা রান্নাঘর আছে। সেখানেও রান্না হয়। এটাও ঠিক।

    রাতে জামাইয়ের সঙ্গে রাহেলার দেখা হলো। জামাই বিনয়ে কাচুমাচু হয়ে বলল, সাভারে গিয়েছিলাম। এই কিছুক্ষণ আগে ফিরেছি। আম্মা খাওয়া দাওয়া হয়েছে।

    রাহেলা বললেন, জি বাবা খেয়েছি।

    খাওয়া দাওয়ার কোনো অসুবিধা হলে আমাকে বলবেন।

    না বাবা অসুবিধা কি হবে।

    আমাদের মানুষ বেশি। অসুবিধা হবেই। সবার রুচির দিকে লক্ষ রেখে তো রান্না করা সম্ভব না। এই জন্যে বলে দেয়া আছে—দিনে মাছ, রাতে মাংস।

    বাবা আমার কোনোই অসুবিধা হচ্ছে না। আর কয়েকটা দিনের তো ব্যাপার। মঞ্জু একটা বাড়ি ঠিক করে ফেলেছে। বাথরুমের কিছু কাজ করাবার জন্যে তিন চার দিন নাকি লাগবে।

    তিন চার দিন লাগুক, বা তিন চার মাস লাগুক। আম্মা এটা আপনার নিজের বাড়ি। জাহানারা মোবাইলে বলেছিল অফিসের টিভিটা আনতে। সাভার থেকে এসেছি তো মা ভুলে গেছি। কাল সকালে অফিসে গিয়েই টিভি পাঠিয়ে দিব।

    বাবা তুমি ব্যস্ত হয়ো না। এটাকি আর টিভি দেখার বয়স? আল্লা আল্লা করে দিন পার করা। তুমি পরিশ্রম করে এসেছ যাও হাত মুখ ধুয়ে খাওয়া দাওয়া কর।

    জামাইয়ের কাছ থেকে এরচে ভালো ব্যবহার তিনি আশা করেন নি। ভবিষ্যতে তার জন্যে কি অপেক্ষা করছে তিনি জানেন না। ভবিষ্যৎ খুব সুখের তা মনে হয় না। স্ত্রীর ভবিষ্যৎ স্বামীর সঙ্গে যুক্ত। যেখানে স্বামী থেকেও নেই সেখানে আর ভবিষ্যৎ কি?

    রাত দশটার দিকে জাহানারা পানদান নিয়ে উপস্থিত হলো। রাহেলা বললেন, খাওয়া দাওয়া করেছিস?

    জাহানারা বসতে বসতে বলল, না। আমার খেতে বসতে বসতে রাত বারটা বাজবে।

    রাহেলা পান মুখে দিতে দিতে বললেন, দুপুরের পর থেকে তোর বাবার সঙ্গে দেখা হয় নি। সে আছে কোথায় জানিস।

    টিভি দেখছেন।

    জামাই-এর বাড়িতে এসে এত টিভি দেখাদেখি কি? ওকে এসে ঘুমুতে বল।

    একতলায় ভাইয়াদের জন্যে যে ঘর রেখেছি, বাবা বলেছেন সেখানে থাকবেন।

    রাহেলা আঁৎকে উঠে বললেন, কী সর্বনাশের কথা লোকজন কি বলবে? আমি এক ঘরে সে এক ঘরে। বুড়োকে এক্ষুনি আসতে বল। তোর বাবা বড় যন্ত্রণা করছে।

    জাহানারা শান্ত গলায় বলল, বাবা যেখানে থাকতে চাচ্ছেন সেখানে থাকুন। লোকজন কি বলবে এটা নিয়ে তোমাকে এত মাথা ঘামাতে হবে না। এ বাড়ির লোকজন এত মাথা ঘামায় না।

    তাই বলে স্বামী-স্ত্রী আলাদা ঘুমুচ্ছে এটা চোখে পড়বে না। সবার চোখে পড়বে।

    কার চোখে কি পড়ছে এটা নিয়ে এত মাথা ঘামাচ্ছ কেন? তুমি থাক তোমার মতো।

    রাহেলা বললেন, তুই এত রাগী রাগী গলায় কথা বলছিস কেন? ঘটনা কি?

    এ বাড়িতে পা দেয়ার পর থেকে তুমি ক্রমাগত মিথ্যা বলে যাচ্ছ। এই জন্যে রাগ লাগছে।

    কোন মিথ্যা বললাম?

    এই যে বলছ বাড়ি ভাড়া হয়েছে। বাথরুম ঠিক হয় নি বলে যেতে পারছ না। ভাইয়ারা তোমাদের হোটেলে রুম ভাড়া করে দিতে চাচ্ছিল। আসল ব্যাপার তো আমি জানি। ভাইয়ার সঙ্গে কথা হয়েছে। যেখানে তার চাকরি পর্যন্ত নেই সেখানে উদ্ভট কথাবার্তা বলার দরকার কি? তার উপর হুট করে তুমি রানীকে শাড়ি কিনে দিলে কেন? আমার তো মনে হয় এই শাড়িও তুমি নিজে কেন নি। ভাইয়া তার বিয়ের জন্যে যে কটা শাড়ি কিনেছিল তার একটা দিয়ে দিয়েছ।

    যদি দিয়েও থাকি তাতে দোষ কি?

    দোষ আছে। যখন তোমাকে বলেছিলাম রানীর সঙ্গে ভাইয়ার বিয়ের ব্যবস্থা করে দাও তখন পা ভারী হয়ে গিয়েছিল—এক পরিবারে বিয়ে, নতুন আত্মীয় হবে না। কত রকম কথা। আজ যখন দেখছ সাত হাত পানির নিচে চলে গেছে তখন রাতারাতি শাড়ি।

    শাড়িটা আমি আদর করে দিয়েছি। বিয়ের ব্যাপার আমার মাথার মধ্যে নেই।

    আদর করে তুমি কিছু দাও নি। এত আদর মা তোমার মধ্যে নেই। তোমার মাথায় সব সময় নানান রকম পরিকল্পনা থাকে। এখানে আমাকে না জানিয়ে কোনো পরিকল্পনা করবে না। রানীর সঙ্গে ভাইয়ার বিয়ে নিয়ে কোনো কথা বলবে না। তার বিয়ের মোটামুটি পাকা কথা হয়ে গেছে। এই বৃহস্পতিবারের পরের বৃহস্পতিবারে পানচিনি হবে। ছেলে ব্যাংকার। মেয়ে দেখে পছন্দ করে গেছে।

    রাহেলা ক্ষীণ স্বরে বললেন, ফরহাদের ব্যাপারে তাদের আর আগ্রহ নেই।

    জাহানারা বিরক্ত গলায় বলল, তোমার যত বয়স হচ্ছে ততই কি বুদ্ধিসুদ্ধি কমে যাচ্ছে যে ছেলে বিয়ে করতে যাচ্ছিল, কোনো একটা সমস্যায় হঠাৎ বিয়ের তারিখ পাল্টেছে তার ব্যাপারে আগ্রহ কেন থাকবে বাজারে কি ছেলে কম পড়েছে?

    ফরহাদের বিয়েটা তো আর হচ্ছে না।

    ঐ প্রসঙ্গ নিয়ে আমি তোমার সঙ্গে আর কথা বলতে চাচ্ছি না। তুমি এখন এসো আমার সঙ্গে।

    কোথায় যাব?

    আমার শাশুড়ি তোমাকে ডাকছেন?

    এত রাতে কি ব্যাপার?

    এ বাড়ির লোকজন কেউ রাত একটার আগে ঘুমুতে যায় না। কাজেই তাদের হিসেবে রাত বেশী হয় নি। আমার শাশুড়ির কাছে প্রতি বৃহস্পতিবার রাতে আক্তারী খানম নামের এক মহিলা আসেন। তিনি ধর্ম নিয়ে কথাটথা বলেন। জিগির করেন। আমার শাশুড়ি এই মহিলার খুব ভক্ত।

    আমি তো ঘুমের অষুধ খেয়ে ফেলেছি।

    বেশিক্ষণ থাকার দরকার নেই। উনার সঙ্গে দেখা করে চলে এসো।

    রাহেলা বিছানা থেকে উঠতে উঠতে কোমল গলায় বললেন, তুই আমার উপর এত রেগে আছিস কেন রে মা? ভুল ত্রুটি আমার আছে। বয়স হয়েছে ভুল ত্রুটি হবে না?

    জাহানারা ক্লান্ত গলায় বলল, আমি মোটেও রেগে নেই। তোমাদের অবস্থা দেখে খারাপ লাগছে। তোমরা কোন অবস্থায় পৌঁছেছ সেই সম্পর্কে তোমাদের কোনো ধারণাও নেই। দিব্যি বড় বড় কথা বলে বেড়াচ্ছ। বাবা মহাসুখে টিভিতে ছায়াছবির গানের অনুষ্ঠান দেখছেন।

    তোর বাবার কথা ভিন্ন। ওর মাথারই ঠিক নেই।

    মাথা তোমাদের কারোরই ঠিক নেই মা।

    জাহানারা মাকে তার শাশুড়ির ঘরে পৌঁছে দিয়ে বাবার সন্ধানে গেল। জোবেদ আলি টিভির অনুষ্ঠান শেষ করে ঘুমুতে এসেছেন। তাঁর মন আজ সামান্য ভালো। ঘুমুবার জন্যে একা একটা ঘর পেয়েছেন। নিশ্চিন্ত মনে বিছানায় শুয়ে শুয়ে সিগারেট খাওয়া যাবে। কারোর কিছু বলার থাকবে না। অনেক দিন পর টিভি দেখলেন। ভালো লাগল। এ বাড়ির লোকজনদেরও তার পছন্দ হয়েছে। সবাই বেশ হাসি খুশি। গাছপালা বিষয়ে যার সঙ্গেই তিনি কথা বলছেন সেই মন দিয়ে শুনেছে। একজন তো বলেই ফেলল—চাচা আপনি ঐ জাপানি গাছের একটা চারা এনে দিন তো টবে লাগাব। টবে হয়তো। কথাটা যে বলেছে তাকে তিনি চেনেন না। তবে যেই বলুক সে জাহানারার শ্বশুর বাড়ির। কাজেই তার কথার মর্যাদা রক্ষার জন্যে একটা চারা কাল সকালেই আনতে হবে। চারার দাম বাবত তার কাছ থেকে টাকা চাওয়া যায় না। কিন্তু তার নিজের হাত একেবারেই খালি। মঞ্জু বা ফরহাদের কাছে যে টাকা চাইবেন সে উপায় নেই। তারা কোথায় থাকে তিনি জানেন না। এটা একটা ভুল হয়েছে। এরা কে কোথায় থাকে তা জেনে আসা দরকার ছিল। কখন কী প্রয়োজন পড়ে। রাহেলার কাছে টাকা আছে তা তিনি জানেন। থাকলেও কোনো লাভ হবে না। তিনি যদি রাহেলার পা ধরেও বসে থাকেন তাতেও কিছু হবে না। জাহানারার কাছ থেকে ধার হিসেবে নিয়ে নেয়া যায়। বাবা তার মেয়ের কাছে ধার চাইতেই পারে। এতে লজ্জা বা অপমানের কিছু নেই। ধার নিয়ে ফেরত না দেয়াটা লজ্জার। তিনি ফেরত তো দেবেনই। ফরহাদের সঙ্গে যেদিন দেখা হবে তার পরদিনই ফেরত দেবেন।

    বাবা পান খাবে?

    জোবেদ আলি আনন্দিত চোখে মেয়েকে দেখলেন। তিনি পান খান না। তারপরেও আগ্রহের সঙ্গে পান নিতে নিতে বললেন মা শোন আমাকে সামান্য কিছু টাকা ধার দিতে পারবি?

    কত টাকা?

    আড়াইশ। চারা কিনব, দুশ টাকা দাম। টবের মাটি তৈরির কিছু খরচ আছে। কয়েক পদের সার দিতে হবে, পটাশ, ইউরিয়া। ক্যামিকেল পটাশ দিব না। হাড়ের গুড়া পাওয়া যায়। তাই দেব। নার্সারীতে আসা যাওয়ার রিকশা ভাড়া আছে। সেটা ধরছি না। কারণ আমি রিকশায় উঠি না বললেই হয়। হাঁটি, এতে টাকা বাঁচে আবার ব্যায়ামও হয়। আমার যে বয়স এতে ব্যায়ামটা খুবই দরকার। এই বয়সে কুন্তীর আখড়ায় ভর্তি হওয়াতে সম্ভব না। হাঁটাহাঁটিটা সম্ভব। সেটাই করি। হা হা হা।

    জাহানারা বিস্মিত হয়ে বাবাকে দেখছে। তার কাছে মনে হচ্ছে মা যে একটু আগে বলেছেন মানুষটার মাথা পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেছে সেটা খুবই সত্যি।

    বাবা টাকাটা কি তোমার এখনই দরকার?

    না এখন দরকার নেই। সকালে দিলেও হবে। আর মা শোন আরেকটা কথা। জামাইয়ের সঙ্গে আলাপ করে দেখিস তো—তাদের এত বড় বাড়ি, পেছনে এত জায়গা খামাখা পড়ে আছে।

    তুমি বাগান করবে?

    কোনো অসুবিধা নেই—আমার একটা কোদাল লাগবে, একটা খুরপাই, পানি দেয়ার জন্যে ঝাঝড়ি। দামটা হিসাব করি—একটা কোদাল একশ টাকা, খুরপাই পঁচিশ, ঝাঝড়ি একশ। মাত্র দুই আড়াইশ টাকার মামলা। চারা কিনতে হবে। সেটার খরচ আলাদা। নার্সারীওয়ালাদের সঙ্গে আমার পরিচয় আছে। নাম মাত্র মূল্যে চারা এনে দিব। বাড়ির সামনে ফুলের বাগান। পিছনে ফলের। তবে বাড়ির সামনে কিছু নারিকেল গাছ লাগিয়ে দেব। এই ধর পঞ্চাশটা নারিকেল গাছ। নিউনেশান নার্সারীতে কেরালা থেকে নারিকেল চারা এসেছে। গাছ বেশি বড় হয়

    তবে দুই বছরে ফল দিবে। বছরে একেকটা গাছ থেকে তুই খুব কম করে হলেও দুশ নারিকেল পাবি। একেকটা নারিকেল পঞ্চাশ টাকা করে ধরলে কত হয়? চট করে হিসাব করে বল তো- দুশ গুণন পঞ্চাশ। কত হয়? আজকাল আর বড় বড় হিসাব কাগজ কলম ছাড়া করতে পারি না।

    জোবেদ আলি উত্তরের জন্যে অপেক্ষা করছেন। জাহানারা ভাবছে আর দেরী করা ঠিক হবে না। তার বাবাকে অতি দ্রুত কোনো ভালো ডাক্তার দেখাতে হবে।

     

    রাহেলাকে দেখে মনে হবে তিনি গভীর আগ্রহে আক্তারী বেগমের কথা শুনছেন। আসলে তা না। ঘুমের অষুধ খাবার কারণে ঘুমে তার চোখ জড়িয়ে আসছে। তিনি চেষ্টা করছেন জেগে থাকতে। যে ঘরে বসেছেন—সেই ঘরের দরজা জানালা বন্ধ। আগরবাতি জ্বলছে। আগরবাতি ধোঁয়ায় দম বন্ধ হয়ে আসছে। জাহানারার শাশুড়ি আবার ঘরে ঢুকা মাত্র হাতের চেটোয় আতর ঘসে দিয়েছেন। আতরের কড়া গন্ধও শরীর যেন কেমন করছে। ঘরটা ছোট সেই তুলনায় অনেক মহিলা বসে আছেন। শুধু যে এ বাড়ির মহিলারাই আছেন তা না, মনে হয় বাইরে থেকেও কেউ কেউ এসেছেন।

    আক্তারী বেগম মহিলাদের মধ্যে বসে থাকলেও বোরকা পরে আছেন। কালো বোরকার ভেতর থেকে তার চোখ শুধু দেখা যাচ্ছে। চোখ দুটা বড় বড় এবং শান্ত। তিনি মিষ্টি গলায় কবরের আজাবের কথা বলছেন। বেনামাজীর কি শাস্তি কবরে হবে তার বর্ণনা।

    কবরে বেনামাজীর কি শাস্তি জানেন? সুজা আকরার সঙ্গে বেনামাজীর দেখা হবে কবরে। সুজা আকরা কে জানেন? সুজা আকরা একটা সাপের নাম। অজগর সাপ। সেই সাপ মানুষের মতো কথা বলবে। সাপটা পৃথিবীর সাপের মতো না। অন্য রকম। এই সাপের নখ আছে। কত বড় নখ শুনবেন? একজন মানুষ একদিনে যত পথে হাঁটতে পারে তত বড়। অর্থাৎ প্রায় চল্লিশ মাইল। এই সাপ বেনামাজীর গায়ে নখ দিয়ে আঘাত করবে। এক একটা আঘাতে বেনামাজী মাটির নিচে পঞ্চাশ গজ ডেবে যাবে। বুঝেন অবস্থা।

    শাস্তি আরো আছে—কবর আপনি যত বড় করেই বানান-বেনামাজীর কবর ছোট হতে থাকে। কবর শরীরের উপর চাপ দেয়। কেমন সেই চাপ? এমন চাপ যে পাজরের বাম দিকের হাড় চলে আসে ডানদিকে। আর ডানদিকের হাড় চলে যায় বাম দিকে।…

    রাহেলা বেগম ঘুম কাটানোর অনেক চেষ্টা করছেন। ধর্মীয় আসরের মাঝখানে ঘুমিয়ে পড়া খুবই অন্যায় হবে। এই আসর কখন ভাঙ্গবে কে জানে। সুজা আকরা নামের সাপটা নিয়ে তিনি এই মুহূর্তে কোনো চিন্তা করছে না। সময় আসুক তখন দেখা যাবে। আপাতত যে কাজটা করতে হবে তা হচ্ছে জেগে থাকা…।

    রানী মেয়েটাও সুজা আকরা সাপের কথা শুনছে। তবে মাঝেমধ্যে ফিক ফিক করে হাসছে। মেয়েটা তার দেয়া শাড়িটা পরল না কেন? রঙ পছন্দ হয়নি? না-কি মেয়েটা তাকে বুঝিয়ে দিতে চাচ্ছে—খাতির করতে এসো না।

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleছায়াবীথি – হুমায়ূন আহমেদ
    Next Article চাঁদের আলোয় কয়েকজন যুবক – হুমায়ূন আহমেদ

    Related Articles

    হুমায়ূন আহমেদ

    আসমানীরা তিন বোন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    ইস্টিশন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    উড়ালপঙ্খী – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    এই বসন্তে – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    এই মেঘ, রৌদ্রছায়া – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    এইসব দিনরাত্রি – হুমায়ূন আহমেদ

    December 23, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    আসমানীরা তিন বোন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    আসমানীরা তিন বোন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    Our Picks

    আসমানীরা তিন বোন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025

    ইস্টিশন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025

    উড়ালপঙ্খী – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }