চৌধুরি বাড়ির রহস্য – ১০
দশম পরিচ্ছেদ
(১)
চৌধুরি বাড়ির রহস্য ভেদ হয়ে যাবার অনেকদিন পরেও মাঝে মাঝে আদিত্য নিজেকে প্রশ্ন করত এই রহস্য ভেদের পেছনে তার নিজের কতটুকু অবদান ছিল? তার বারবার মনে হয়েছে, অপরাধীদের শাস্তি হবার পেছনে তার যত না কৃতিত্ব ছিল, তার চেয়ে অনেক বেশি কৃতিত্ব ছিল ভাগ্যদেবতার, ভবিতব্যের। এই ভবিতব্যই যেন খুব তাড়াহুড়ো করে একটা কাহিনির অবসান ঘটিয়ে দিল, যে কাহিনিটা আরও অনেকদিন চলতে পারত।
মন্দাকিনী চৌধুরির দ্বিতীয় খুনের খবর নিয়ে কয়েকটা দিন মিডিয়ায় অভূতপূর্ব তোলপাড় হল, ঠিক যেরকম আদিত্য আশঙ্কা করেছিল। পুলিশের সমালোচনা, সরকারের মুণ্ডপাত, মাতব্বরদের বিশ্লেষণ কিছুই বাদ গেল না। এই ক’দিন আদিত্যর বাড়িতে বসে বসে ভাবা ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না। বসে বসে চিন্তা করা আর গৌতম এবং বিমলের রিপোর্টের জন্য অপেক্ষা করা।
এর মধ্যে গৌতমের সঙ্গে কয়েকবার লালবাজারে মিটিং হয়েছে। বিমল ফোন করল দুদিন পরে।
‘জনাই, বাগবাজার দুটো জায়গাতেই গিয়েছিলাম স্যার।’
‘কী জানতে পারলে?’
‘স্যার, জনাইতে যে বাড়িটায় যেতে বলেছিলেন সেখানে গিয়ে দেখি একতলাটা অনেকদিন তালা বন্ধ পড়ে রয়েছে। বাড়িওলা বলল, ভাড়াটে ছ’মাসের ভাড়া দিয়ে বলে গেছে কিছুদিনের জন্য সে বাইরে যাচ্ছে। বাড়ি তালাবন্ধ পড়ে থাকবে, বাড়িওলা যেন একটু নজর রাখে।’
‘আর বাগবাজার?’
‘সেখানে গিয়ে ওই কাজের মাসির খবর পেতে পেতেই দুটো দিন লেগে গেল। মাসি এখন আর রাজবল্লভ পাড়ায় কাজ করে না। খোঁজ-খবর নিয়ে জানতে পারলাম মাসি এখন বাগবাজার স্ট্রিটের একটা বাড়িতে রাতদিনের কাজ করছে। ঠিকানা খুঁজে সেখানে একটা দুপুরবেলা পৌঁছে গেলাম। রাজবল্লভ পাড়ার বৌদির কথা মাসির ভালই মনে আছে। বলল, বৌদি সিরিয়ালে করত। দাদা সারাদিন বাড়ি থাকত। সন্ধেবেলা নাটকের রিহার্সাল হত। দাদা-বৌদির প্রচণ্ড ভালবাসা ছিল। ওদের একটা ফুলের মতো সুন্দর মেয়ে ছিল। তবে মাঝে মাঝে টাকাপয়সার বেশ টানাটানি যেত। কিন্তু তাতে ভালবাসা কমেনি। পরে দাদা-বৌদির ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে শুনে মাসি একটু অবাকই হয়েছিল।’
‘তার মানে দাদা-বৌদির ছাড়াছাড়ির সময় মাসি ওদের কাজ করত না?’
‘না। মাসি তার আগেই বাচ্চা হবার জন্য কাজ ছেড়ে দেশে চলে গিয়েছিল। দুবছর কাজ করেনি।’
‘তোমাকে যেটা জিজ্ঞেস করতে বললাম, জিজ্ঞেস করেছিলে?’
‘করেছিলাম স্যার। মাসি নিজে ওই ওষুধটা ব্যবহার করে ফল পেয়েছিল। তাই ওষুধ এবং কবিরাজ মশায়ের কথা বলতেই বুঝতে পারল। এসব নিয়ে প্রশ্ন করছি বলে বেশ চটেও গেল। আমি বললাম, মাসি ওই ওষুধটার খোঁজেই তো তোমার কাছে এসেছি। আমার নিজের দরকার। তুমি নাকি এই ওষুধটার কথা অনেককে বলেছ। তখন মাসি একটু নরম হল। বলল, হ্যাঁ, উপকার পেয়েছি বলেই তো অনেককে বলেছি। তবে বৌদিকে বলেছিলাম কিনা মনে করতে পারছি না। মাসির কাছ থেকে এইটুকুই জানতে পেরেছি স্যার।’
‘যা জানতে পেরেছ, তাই আমার পক্ষে যথেষ্ট। সময় পেলে একদিন চলে এস।’
এর একদিন পরে সকালে আপিস গিয়ে আদিত্য দেখল গৌতম একটা খাম পাঠিয়েছে। একজন পুলিশ এসে খামটা শ্যামলের হাতে দিয়ে গেছে। খাম খুলে দেখে এক তাড়া কাগজ কী কী জিনিস মন্দাকিনী ও তার ড্রাইভারের কাছ থেকে পাওয়া গেছে তার লম্বা তালিকা। তালিকাটায় একবার চোখ বোলাতে না বোলাতে গৌতমের ফোন।
‘লিস্টটা দেখলি?’
‘দেখলাম। বড় মানুষদের বাঁচার জন্য কত কী লাগে দেখলে অবাক হতে হয়। তবে সব থেকে আশ্চর্য হলাম মন্দাকিনীর হুইগের কালেকশন দেখে। দু’একটা ব্লন্ড পরচুলাও রয়েছে দেখলাম। মন্দাকিনী পরচুলা পরত নাকি?’
‘হয়তো এমনিতে পরত না, কিন্তু আত্মগোপন করার জন্য পরচুলা পরার দরকার পড়েছিল।’ গৌতম ভেবেচিন্তে বলল।
‘আর একটা জিনিস লক্ষ করেছিস? মেয়েদের উইগগুলোর সঙ্গে একটা ছেলেদের নকল গোঁপ-দাড়ি এবং চুল রয়েছে। সেটা কার জন্যে?’
‘আমার মনে হয়, ওটা ড্রাইভারের জন্যে। সেলব্রিটিদের ড্রাইভাররাও তো অনেকের পরিচিত। তাছাড়া এই লোকটাও তো অ্যাবস্কন্ড করে ছিল। তার হয়ত মাঝে মাঝে নকল চুল এবং গোঁপ-দাড়ির দরকার পড়ত।’
‘সেটা হতে পারে। তবে মালকিনের দামি উইগগুলোর সঙ্গে ড্রাইভারের নকল গোঁপ-দাড়ি-চুল থাকাটা একটু অড। ওটা ড্রাইভারের ঘরে পাওয়া গেলে আরও স্বাভাবিক হত। যাই হোক, যেখানে রেড করতে বলেছিলাম সেখানে রেড করে কিছু পেলি?’
‘সার্চ-টার্চ কিছু করতে হয়নি। জিনিসটা চাইতেই ভদ্রমহিলা দিয়ে দিলেন। খুব স্বাভাবিকভাবেই দিলেন। আমরাও ওটা নিয়ে সুড়সুড় করে ফিরে এলাম।’
‘খুবই সেন্সেবল মহিলা।’
‘তাহলে এবার কী করণীয়?’ গৌতম জিজ্ঞেস করল।
‘রহস্যের জাল গুটিয়ে এসেছে। তুই পরশুদিন সন্ধে সাতটায় মরগ্যান ব্যানার্জির আপিসে একটা মিটিং অরগানাইজ কর। রত্নাবলী, সুব্রত এবং সোহিনী এদের আসতে বল। সোহিনীর বয়ফ্রেন্ড নন্দন চক্রবর্তীও থাকলে ভাল হয়। আর হ্যাঁ, শিশির চ্যাটার্জি এবং শৈলেন ড্রাইভার দুজনকেই থাকতে বলিস। শুদ্ধশীল ব্যানার্জিকে তো থাকতেই হবে। মার্থাকেও আসতে বলিস। পিস ইন্টারন্যাশানালের সেই ছেলেটি, নাম বোধহয় সৌরাশিস ঘোষ, তার থাকাটাও বিশেষ জরুরি। তুই তো অবশ্যই থাকবি। কয়েকজন আরমড পুলিশ সঙ্গে রাখিস। বোথ পুরুষ এবং মহিলা পুলিশ। বলা যায় না কে কীভাবে রিঅ্যাক্ট করবে। সেদিন যবনিকা উদ্ঘাটিত হবে।’
বিকেলে একটা মিনিবাস ধরে অমিতাভদের বাড়িতে পৌঁছল আদিত্য। রত্না তখনও ফেরেনি। টুবলু নীচের কম্পাউন্ডে খেলতে গেছে। অমিতাভ একা একা বসে কম্পিউটারে কী একটা লিখছিল।
‘তারপর, তোর চৌধুরি প্যালেস রহস্য কত দূর এগোল?’ অমিতাভ সহজ ভাবে জিজ্ঞেস করল।
‘প্রায় সলভ করে এনেছি। পরশু মনে হচ্ছে পর্দা উঠবে। তোকে একটা জিনিস জিজ্ঞেস করতে এসেছি। শুনলাম নন্দন চক্রবর্তী পুনায় চলে যাচ্ছে। এটা কি ওর পক্ষে ভাল হবে?’
অমিতাভকে রীতিমত উত্তেজিত দেখাল।
‘নন্দন চলে যাচ্ছে তুই জানিস তাহলে। আমি বলব, পুনায় গেলে ওর সর্বনাশ হবে। শুধু যে ওর গানের ক্ষতি হবে তাই নয়, ব্যক্তিগতভাবে ও নেশাভাঙ করে একেবারে শেষ হয়ে যাবে। দ্যাখ, নন্দনের তালিম যা হবার হয়ে গেছে। নতুন করে ওর আর কিছু শেখার নেই। ও এখন যেটুকু শিখেছে সেটা অ্যাসিমিলেট করছে। নিজস্ব একটা স্টাইল তৈরি করছে। এটা না করতে পারলে কেউই সত্যিকারের বড় শিল্পী হতে পারে না। এই অ্যাসিমিলেশনের জন্য ওর নির্জনতা দরকার। সারাদিন যদি গান শেখাতে হয় তাহলে নিজে রেওয়াজ করবে কখন? চিন্তা করবে কখন?’
‘তাহলে ও যাচ্ছে কেন?’
‘এখানে কে ওকে দেখবে? সোহিনী তো কলম্বিয়া যাচ্ছে। নন্দন চায় সোহিনী বিদেশে গিয়ে একটা ভাল পিএইচডি করুক। সে সোহিনীর কেরিয়ারে কোনও বাধা হতে চায় না। তাই পুনের অফারটা নন্দন নিয়ে নিয়েছে।’
‘পুনেতে গেলে ও তো নতুন কিছু শিখতেও পারবে।’
‘সেটা আর একটা সমস্যা। পুনেতে যে ওস্তাদের সঙ্গে ওকে ফিট করা হচ্ছে তিনি আগ্রা ঘরানার পুরোনো ওস্তাদ। ভীষণ অর্থোডক্স। ফৈয়জ খাঁর গানের বাইরে আর কিচ্ছু বোঝেন না। নন্দনকে দিয়ে ফৈয়জ খাঁর মতো করে গাওয়াতে গেলে নন্দনের বারোটা বেজে যাবে।’
‘তোরা নন্দনের জন্য কিছু করতে পারিস না?’
‘অবশ্যই পারি। কয়েকজন মিলে কন্ট্রিবিউট করে নন্দনের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিতে পারি। কিন্তু সোহিনী যেভাবে ওকে আগলে রাখে, একটু একটু করে নেশা ছাড়াবার চেষ্টা করে, ওর নানারকম বায়ানাক্কা সহ্য করে, আমরা সেরকম কিছু পারব না। নন্দনও আমাদের কাছ থেকে সাহায্য নেবার বদলে একটা ইন্সটিটিউশনের টাকা নেওয়াটা প্রেফার করবে।
‘সোহিনী কি এসব বোঝে না?’
‘কিছুটা হয়ত বোঝে। কিন্তু তারই বা উপায় কী? এখানে থাকলে তার নিজেরটাই তো চলবে না। তার মা তো তাকে কিছুই দিয়ে যায়নি। তবে সোহিনী বিশ্বাস করে পুনেতে গেলে নন্দনের ভালই হবে। নাহলে সে নন্দনকে ছেড়ে অ্যামেরিকা যেত না।’
‘শোন। নন্দনকে নিয়ে চিন্তা করিস না। পরশু দিন রহস্য উদ্ঘাটনের পর হয়ত অনেক কিছুই বদলে যাবে।’ আদিত্য আস্তে আস্তে বলল।
(২)
সারাদুপুর বৃষ্টি পড়েছে। রাস্তায় জল জমার মতো নয়, কিন্তু ছাতা ছাড়া বেরোলে ভিজে যেতে হবে। বৃষ্টি ধরল সন্ধের মুখে। একে শনিবার, তার ওপর বৃষ্টি, আপিস পাড়ার রাস্তাঘাট প্রায় ফাঁকা। রাস্তায় বেরিয়ে আদিত্যর মনে হল, চারদিকে একটা বিষণ্ণতা ছড়িয়ে রয়েছে। হয়ত বাইরে নয়, বিষণ্ণতা তার ভেতরে। চৌধুরি বাড়ির রহস্যটা আর তার কাছে রহস্য নেই। সব কিছু জলের মতো পরিষ্কার। মানুষের লোভ, ঘৃণা, নীচতা আরও একবার নগ্নভাবে তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। হয়ত বিষণ্ণতা সেই জন্য। যতই সে নিজেকে জীবনযুদ্ধে পোড়-খাওয়া একজন অবিশ্বাসী, সন্দেহপ্রবণ, সদাসতর্ক ভাড়াটে সৈনিক হিসেবে কল্পনা করুক না কেন, তার ভেতরে এখনও এমন একটা ছেলেমানুষি সত্তা লুকিয়ে আছে যে বিধাতার মঙ্গলসাধনে বিশ্বাস রাখে। মানুষের মধ্যে অশুভ কিছু দেখলে যার বিষণ্ণ লাগে।
মর্গ্যান ব্যানার্জির মিটিং রুমে ঢুকে আদিত্য দেখল কয়েকজন ইতিমধ্যেই এসে গেছে। আগের বার যে ঘরটায় মিটিং হয়েছিল এটা তার থেকে আরও বড় একটা মিটিং রুম। তারা বসে থাকতে থাকতে বেয়ারা চা দিয়ে গেল। চা খেতে খেতে আদিত্য লক্ষ করল কেউই আজ বিশেষ কথা বলছে না। কিছুক্ষণের মধ্যে সকলেই চলে এল, এমনকি মার্থাও। দু-একজন মার্থার দিকে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকাল বটে, কিন্তু সেটা মার্থা খুব একটা গা করল বলে মনে হলো না। অবশেষে গৌতম তার দলবল নিয়ে ঢুকল, পেছনে পেছনে তাঁর জুনিয়রের সঙ্গে শুদ্ধশীল ব্যানার্জি।
ঘরে একটাই দরজা। পুলিশ অফিসারেরা সেই দরজা আগলে দাঁড়িয়ে আছে। যেন কেউ বাইরে যেতে গেলেই পথ আটকাবে। শুদ্ধশীল ব্যানার্জি বললেন, ‘লেডিজ অ্যান্ড জেন্টলমেন, থ্যাঙ্কস ফর কামিং। আজকের এই মিটিংটা আমি ডাকিনি, ডেকেছেন জয়েন্ট কমিশনার ক্রাইম, গৌতম দাশগুপ্ত।’
গৌতম সকলকে হাত তুলে নমস্কার করল। বলল, ‘আপনারা শুনে খুশি হবেন, আমরা মন্দাকিনী চৌধুরির অন্তর্ধান এবং হত্যা রহস্য সলভ করে ফেলেছি। মন্দাকিনীর অন্তর্ধান এবং মৃত্যুর সঙ্গে আপনাদের সকলের ভাগ্যই জড়িত বলে আজ আপনাদের এখানে ডাকা হয়েছে। এই রহস্য সমাধানের একটা গুরুত্বপূর্ণ আইনি তাৎপর্যও আছে। তাই এই মিটিংটা শুদ্ধশীল ব্যানার্জির উপস্থিতিতে মর্গ্যান ব্যানার্জির অফিসে করা হচ্ছে। আপনাদের কোনও প্রশ্ন আছে?’
‘হ্যাঁ আছে। ইনি কে? ইনি এখানে কী করছেন?’ সুব্রত সেন মার্থার দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল।
‘ইনি মার্থা স্যাভিও। শঙ্খদীপ চৌধুরি তাঁর সমস্ত সম্পত্তি একে উইল করে দিয়ে গেছেন। যদি কোনও কারণে মন্দাকিনী চৌধুরির শেষ উইলটি বাতিল হয়ে যায় তাহলে ইনি চৌধুরি এন্টারপ্রাইজেসের এক তৃতীয়াংশ মালিক হবেন। তাই মার্থাকে এখানে আসতে বলা হয়েছে।’ গৌতম ঠান্ডা গলায় বলল।
গৌতমের কথা শুনে একটা চাপা গুঞ্জন উঠল। সেই গুঞ্জন থিতিয়ে যাবার পর গৌতম আবার শুরু করল, ‘চৌধুরি বাড়ির রহস্য ভেদ করতে পুলিশকে বিশেষভাবে সাহায্য করেছেন আদিত্য মজুমদার, যাকে বেসরকারি গোয়েন্দা হিসেবে প্রথমে মন্দাকিনী চৌধুরি এবং পরে সোহিনী মৈত্র নিয়োগ করেছিলেন। আমি আদিত্যকে এখান থেকে টেক আপ করতে অনুরোধ করব। তবে আগেই বলে রাখি, আদিত্য যা বলবে তার পেছনে পুলিশের অনুমোদন আছে।’
খানিকক্ষণ চুপ করে থাকার পর আদিত্য বলতে শুরু করল, ‘মাস ছয়েক আগে মন্দাকিনী চৌধুরি তাঁর মেয়ে সোহিনীর মাধ্যমে আমাকে নিয়োগ করেন। তাঁর ধারণা হয়েছিল কেউ তাঁকে খুন করার চেষ্টা করছে। এবং তাঁর ধারণা একেবারে ভিত্তিহীন বলে উড়িয়ে দেওয়া যায়নি কারণ তার আগে তাঁর তিন-তিনটে অ্যাকসিডেন্ট হয়ে গিয়েছিল। অবশ্য আশ্চর্যভাবে তিনটে ক্ষেত্রেই তিনি শারীরিক ভাবে অক্ষত ছিলেন। পরপর তিনটে অ্যাকসিডেন্ট কাকতালীয় হতে পারে না, তাই তাঁর মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক ছিল যে, কেউ তাঁকে খুন করার চেষ্টা করছে। আমার কাজ ছিল তদন্ত করে দেখা তাঁর ধারণাটা কতদূর ঠিক।
‘আমি সাংবাদিকের ভেক ধরে আপনাদের অনেকের সঙ্গে কথা বললাম। দেখলাম মন্দাকিনী চৌধুরিকে কেউই পছন্দ করে না, কেউ কেউ তাঁকে রীতিমতো ঘৃণা করে, এমনকি সোহিনীও তার মাকে ইদানীং অপছন্দ করতে শুরু করেছে, কারণ তার মা তার বয়ফ্রেন্ডকে অনুমোদন করেননি। তাই এটা মোটেই অসম্ভব নয় যে, কেউ মন্দাকিনীকে খুন করতে চাইছে। যখন তদন্ত করছি তখন আমার ওপর দুজন গুণ্ডা হামলা করল, আমাকে বলল আমি যদি আমার তদন্ত না থামাই তাহলে আমাকে জানে মেরে দেবে। সোজাসুজি থ্রেট। গুণ্ডাগুলো পরে ধরা পড়েছিল। তাদের চাপ দিয়ে জানা গেল একজন বাবরি চুলওলা কালো চশমা পরা লোক ওদের নিয়োগ করেছিল। তারও আগে এক বাবরি চুলওলা কালো চশমা আমার আপিসে খোঁজ নিতে এসেছিল আমি কেমন গোয়েন্দা।’
‘যাই হোক আমি মৌখিক ভাবে আমার রিপোর্ট দিয়ে দিলাম যার সারমর্ম মন্দাকিনীকে কেউ খুন করতে চাইছে এই সম্ভাবনা মোটেই উড়িয়ে দেওয়া যায় না। মন্দাকিনী উইল না করে মারা গেলে অনেকেরই লাভ। মন্দাকিনী বললেন, শুধু মুখে বললে হবে না, বিস্তারিত রিপোর্ট লিখিতভাবে দিতে হবে। কিছুদিন পরে আমি সেটাও দিলাম, মন্দাকিনী অতি সত্ত্বর আমার পাওনা-গণ্ডা মিটিয়ে দিলেন, চৌধুরি প্যালেসের সঙ্গে আমার আর কোনও সম্পর্ক রইল না। আমার কিন্তু কয়েকটা খটকা রয়ে গেল।’
‘আর এক রাউণ্ড চা হলে মন্দ হতো না।’ গৌতম শুদ্ধশীল ব্যানার্জির দিকে তাকিয়ে বলল। শুদ্ধশীল বেল বাজিয়ে বেয়ারাকে ডেকে চা আনতে বললেন, চা এল, সঙ্গে প্লাম কেক, কিছুক্ষণ খাওয়া-দাওয়া চলল এবং এইসব করতে মিনিট দশেক ব্যয় হল। আদিত্য এই সময়টা চুপ করেই ছিল।
চা পর্ব শেষ হবার পর আদিত্য আবার বলতে শুরু করল। ‘আমার প্রথম খটকা, পরপর তিনবার অ্যাকসিডেন্ট যেমন কাকতালীয় হতে পারে না, তেমনি পরপর তিনবার অ্যাকসিডেন্ট থেকে অক্ষত দেহে বেরিয়ে আসাটাও কি কাকতালীয় হতে পারে? যে মন্দাকিনীকে খুন করতে চাইছে সে কি এতটাই অপদার্থ? অর্থাৎ প্রশ্ন উঠছে, অ্যাকসিডেন্টগুলো সাজানো নয় তো?
‘দ্বিতীয় খটকা, সোহিনীর কাছে জানলাম মন্দাকিনীর বাঁ পায়ের হাঁটুতে বাত ছিল বলে তিনি বাঁ হাঁটুটা বেশিক্ষণ ভাঁজ করে থাকতে পারতেন না। তাই গাড়িতে উঠলে সব সময় তিনি পেছনের আসনে বসে বাঁ পাটা বাঁ দিকে ছড়িয়ে দিতেন। সোহিনী গাড়ি চালালে অবশ্য সামনে বসতেন। সামনে বসলে পা-টা ছড়িয়ে দেবার সব থেকে বেশি সুবিধে। কিন্তু ড্রাইভার গাড়ি চালালে তার পাশে বসতে মন্দাকিনীর অস্বস্তি হত। তখন তিনি পেছনেই বসতেন। বলাই বাহুল্য, বাঁ পাটা ছড়াতে গেলে ড্রাইভারের ঠিক পেছন দিকে বসতে হয় যাতে বাঁ দিকে পা ছড়ানোর মতো জায়গা থাকে। কিন্তু শৈলেন ড্রাইভারের কাছে জানতে পারলাম ডায়মন্ডহারবার রোডের ওপর অ্যাকসিডেন্টের দিন তিনি ড্রাইভারের ঠিক পেছনে না বসে বাঁ দিকের জানলার ধারে বসেছিলেন। শৈলেন বলল, উনি সেদিন ড্রাইভারের ঠিক পেছনের সিটে অর্থাৎ ডানদিকের জানলার ধারে বসলে গুরুতর জখম হতেন। উনি সেদিন বাঁ দিকের জানলার ধারে বসলেন কেন? উনি কি আগে থেকেই জানতেন সেদিন একটা অ্যাকসিডেন্ট হতে চলেছে? এর সঙ্গে আরেকটা জিনিস যোগ করা যায়। ডায়মন্ডহারবার রোডে অ্যাক্সিডেন্টের দিন মন্দাকিনী তাঁর পুরোনো হন্ডা অ্যাকর্ড নিয়ে বেরিয়েছিলেন, নতুন কেনা মার্সিডিজটা নেননি। এর থেকেও মনে হতে পারে তিনি আগে থেকে জানতেন গাড়িটা ক্ষতিগ্রস্ত হতে চলেছে।’
‘আমার তৃতীয় খটকা, লিখিত রিপোর্ট জমা দেওয়া নিয়ে মন্দাকিনীর দিক থেকে একটা অহেতুক চাপ ছিল। যতদিন রিপোর্টটা জমা দিইনি ততদিন তাগাদা দিয়ে মন্দাকিনীর সেক্রেটারি আমাকে ক্রমাগত ফোন করে যাচ্ছিল, বলাই বাহুল্য, মন্দাকিনীর নির্দেশে। আমার মনে হচ্ছিল, একজন পেশাদার গোয়েন্দার লিখিত একটা রিপোর্ট মন্দাকিনীর দরকার ছিল যেখানে লেখা থাকবে সম্ভবত মন্দাকিনীকে কেউ খুন করার চেষ্টা করছে। অর্থাৎ তদন্তের থেকেও যেন লিখিত রিপোর্টটা মন্দাকিনীর দরকার ছিল বেশি, যেটা পরে আমরা দেখেছি কীভাবে উইল তৈরি করার সময় ব্যবহার করা হয়েছে।’
‘আমার চতুর্থ খটকা, আমি রিপোর্ট দেওয়া সত্ত্বেও মন্দাকিনী সাবধান হলো না কেন? কেন সে শুধুমাত্র ড্রাইভারের ওপর ভরসা করে দুর্গম রাস্তায় যেতে গেল? যদিও তার ড্রাইভারের সঙ্গে আগ্নেয়াস্ত্র থাকত, তবু আমি বলব এ তো যেচে বিপদকে ডেকে আনা।’
‘মন্দাকিনীর শেষ উইলে বলা হল, যেহেতু তার নিকট আত্মীয়দের কেউ তাকে খুন করার চেষ্টা করছে তাই তার অপঘাত মৃত্যু হলে সমস্ত সম্পত্তি পিস ইন্টারন্যাশানাল বলে একটা অজানা, অনামা সংস্থার হাতে চলে যাবে। এবং কেউ যে তাকে সত্যিই খুন করার চেষ্টা করছে তার সমর্থনে আমার রিপোর্টটা পেশ করা হল। আমার রিপোর্টটা যাতে জোরদার হয় তার জন্য গুন্ডা লাগিয়ে আমাকে ভয় দেখানোর চেষ্টা হল। সুবিধেমতো উইলটা মন্দাকিনী অন্তর্ধানের আগে গোপন রাখা হল, আগে জানাজানি হয়ে গেলে মন্দাকিনীর নিকট আত্মীয়দের ওপর খুনের সন্দেহ চাপানো যেত না। অর্থাৎ মন্দাকিনীর মূল উদ্দেশ্য ছিল উধাও হয়ে যাওয়া, উধাও হয়ে যাবার আগে চৌধুরিদের যথাসর্বস্ব পিস ইন্টারন্যাশানাল নামক একটি অজানা সংস্থাকে দিয়ে যাওয়া এবং পৃথিবীকে বিশ্বাস করানো যে সে সত্যিই খুন হয়ে গেছে। তার জন্য বানানো অ্যাকসিডেন্ট, গোয়েন্দা-নিয়োগ, ভাড়াটে গুন্ডা দিয়ে গোয়েন্দাকে ভয় দেখানো যাতে গোয়েন্দার মনে হয় সত্যি সত্যি কেউ মন্দাকিনীকে খুন করার চেষ্টা করছে, এবং সব শেষে গোয়েন্দার কাছ থেকে লিখিত রিপোর্ট নেওয়া, সবটাই পূর্ব পরিকল্পিত ছিল। অবশ্য পিস ইন্টারন্যাশানালের মাধ্যমে বেশ কিছুদিন ধরেই মন্দাকিনী কোম্পানির টাকা সাইফন অফ করছিলেন। ফলে কোম্পানির স্বাস্থ্য উত্তরোত্তর খারাপ হচ্ছিল।’
আদিত্য কিছুক্ষণের জন্য থামল। ঘরে অখণ্ড নীরবতা। একটা সিগারেট ধরাতে খুব ইচ্ছে করছে। কিন্তু এখানে তার উপায় নেই। পিস ইন্টারন্যাশানালের সৌরাশিস ঘোষ হঠাৎ বলে উঠল, ‘আপনি কিন্তু ভুল করছেন আদিত্যবাবু। পিস ইন্টারন্যাশানাল কোনও হেঁজিপেঁজি সংস্থা নয়, বিদেশে আমাদের রেজিস্ট্রেশন, আমরা সারা পৃথিবী জুড়ে কাজ করি।’
‘আপনাদের প্রসঙ্গে পরে বিস্তারিতভাবে আসা হবে। এখন দয়া করে আদিত্যকে বলতে দিন।’ গৌতম কড়া গলায় বলল। সৌরাশিস কী একটা বলতে গিয়ে নিজেকে সামলে নিল।
আদিত্য আবার বলতে লাগল। ‘একটা প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবে উঠে আসছে কেন মন্দাকিনী উধাও হয়ে যেতে চাইলেন? বেশ তো চলছিল। চৌধুরিদের বিশাল ঐশ্বর্য তাঁর দখলে। যা চাইছেন তাই পাচ্ছেন। হঠাৎ তাঁর অসুবিধেটা কী হল? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে আমাদের সুবীর চৌধুরির মৃত্যুর ঠিক পরে একটা ছোট্ট ঘটনার দিকে তাকাতে হবে। আপাতদৃষ্টিতে ঘটনাটা তুচ্ছ, কিন্তু মন্দাকিনীর নির্ঝঞ্ঝাট জীবনকে এই একটা ঘটনা আমূল নাড়িয়ে দিল।
‘সুবীর চৌধুরির মৃত্যুর কিছুদিন পরে একটা সকালে চৌধুরি প্যালেসে এসে শঙ্খমালা তাঁর বাবার পড়ার ঘরের একটা ক্লজেটে একটা পুরোনো স্যুটকেস দেখতে পান। স্যুটকেসে শঙ্খমালার মায়ের কিছু পুরোনো জিনিসপত্র ছিল। শঙ্খমালা স্যুটকেসটা নিয়ে যেতে চাইলে মন্দাকিনী রাজি হয়ে যান। শঙ্খমালা তার মায়ের পুরোনো জিনিস নিয়ে যাবে এটা তো স্বাভাবিক, রাজি না হবার কোনও কারণ মন্দাকিনীর ছিল না। স্যুটকেসটা ওপর ওপর তিনি দেখলেন, কিছু পুরোনো শাড়ি-ব্লাউজ, কার্পেটের আসনে শঙ্খমালার মায়ের কিছু হাতের কাজ, সুবীর চৌধুরির প্রথম বিয়ের অ্যালবাম, একটা পুরোনো খাতায় শঙ্খমালার মায়ের হাতের লেখায় কিছু রান্নার রেসিপি, এইসব টুকিটাকি। স্যুটকেসে কী কী ছিল আমরা পরে শঙ্খমালার কাছ থেকেই জানতে পেরেছি। কিন্তু এইসব টুকিটাকি ছাড়াও স্যুটকেসের তলায় সুবীর চৌধুরির একটা ডায়েরি ছিল যেটা দেখতে পেলে মন্দাকিনী কখনই সেটা কারোর হাতে পড়তে দিতেন না। ডায়েরিটা লিখে সুবীর চৌধুরিই সম্ভবত সেটা তাঁর প্রথম স্ত্রীর জিনিসপত্রের মধ্যে লুকিয়ে রাখতেন। জিনিসপত্রের ভেতর থেকে শঙ্খমালা সেই ডায়েরিটা আবিষ্কার করেন।’
‘আমি এখানে একটা কথা বলতে চাই।’ গৌতম পুলিশি গাম্ভীর্য নিয়ে বলে উঠল, ‘সুবীর চৌধুরির ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে দু’একটা অপ্রিয় কথা আমাদের বলতে হবে। এটা বলতে হবে সত্য উদ্ঘাটনের স্বার্থে, আইনের স্বার্থে। আমরা এর জন্য ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।’
উত্তরে কেউ কোনও কথা বলল না।
আদিত্য আবার বলতে লাগল। ‘সুবীর চৌধুরির ডায়েরি থেকে এটা স্পষ্ট যে, দ্বিতীয়বার বিয়ে করে তিনি সুখী হননি। এর বড় কারণ বিয়ের পর তিনি টের পান তিনি আর যথেষ্ট পুরুষ নন। দ্বিতীয়বার বিয়ে করার সময় তাঁর বয়েস ছিল তেষট্টি, তিনি তার আগে দীর্ঘদিন হার্টের অসুখে ভুগছিলেন, তাছাড়া ব্যবসা নিয়ে উৎকণ্ঠা তো তাঁর চিরসঙ্গী ছিল। অনুমান করা যায়, সব মিলিয়ে তাঁর এই অক্ষমতা। তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী মন্দাকিনীর কিন্তু এই অক্ষমতা নিয়ে কোনও মাথাব্যথা ছিল না। মন্দাকিনী সুবীর চৌধুরিকে তাঁর বিত্তের জন্য বিয়ে করেছিলেন, ভালবেসে নয়। তাই সুবীর চৌধুরি পুরুষ না কিম্পুরুষ তা নিয়ে মন্দাকিনীর কেন মাথা ব্যথা থাকবে? মন্দাকিনীর অন্য এক ভালবাসার মানুষ ছিল, কিন্তু সে প্রসঙ্গে পরে আসব।’
‘মন্দাকিনী অবশ্য সুবীর চৌধুরির অক্ষমতাকে অন্যভাবে কাজে লাগিয়েছিলেন। তিনি নানাভাবে সুবীর চৌধুরিকে বিশ্বাস করাতে সক্ষম হয়েছিলেন যে, লালসার বশবর্তী হয়ে দ্বিতীয়বার বিয়ে করাটা সুবীর চৌধুরির ঠিক হয়নি। চৌধুরি বংশে একটা পুরোনো অভিশাপের গল্প ছিল। অভিশাপটা এই যে, চৌধুরিদের কোনও পুরুষ লালসার বশবর্তী হয়ে কিছু করলে তার পৌরুষ চলে যাবে। ইতিহাসটা মন্দাকিনী পড়েছিলেন। এবং এই বংশে যে একটা পুরোনো অভিশাপ আছে সেটার কথা তিনি তাঁর স্বামীকে মনে করিয়ে দিয়েছিলেন। অর্থাৎ পুরোনো অভিশাপের গল্পটা মন্দাকিনী নিপুণভাবে নিজের কাজে লাগিয়েছিলেন। সুবীর চৌধুরি এমনিতে যুক্তিবাদী মানুষ ছিলেন, কিন্তু অবস্থার চাপে পড়ে তিনিও ওই পুরোনো অভিশাপের ব্যাপারটা বিশ্বাস করতে শুরু করেন।’
‘সুবীর চৌধুরির মনে করতেন মন্দাকিনী এক অসহায় দুর্ভাগিনী যাকে তিনি টাকার জোরে তার প্রথম স্বামীর হাত থেকে ছিনিয়ে এনেছেন। যার জীবনটা তিনি নষ্ট করে দিয়েছেন। এই নিয়ে সুবীর চৌধুরি তীব্র পাপবোধে ভুগতেন। সুবীর চৌধুরির মধ্যে এই পাপবোধ সৃষ্টি করার পেছনে মন্দাকিনীর অভিনয় প্রতিভার একটা বিরাট ভূমিকা ছিল। পাপের প্রায়শ্চিত্য করতে গিয়ে তাঁর সমস্ত সম্পত্তি তিনি দ্বিতীয় স্ত্রীকে দিয়ে যান। এর ফলে অবশ্য তাঁর প্রথম পক্ষের সন্তানদের তিনি সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করলেন, কিন্তু প্রথম পক্ষের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে তাঁর সদ্ভাব ছিল না।’
‘স্বাভাবিক দাম্পত্য ছাড়াও সুবীর চৌধুরি একটা পুত্রসন্তান চেয়েছিলেন যে তাঁর অবর্তমানে চৌধুরি এন্টারপ্রাইজেস-এর হাল ধরতে পারবে। শঙ্খদীপ তাঁকে হতাশ করেছিল। মন্দাকিনীর তখন যা বয়েস আর আজকাল চিকিৎসা শাস্ত্র যতটা এগিয়েছে তাতে মনে হয় তাঁর পক্ষে সন্তানধারণ অসম্ভব ছিল না। সমস্যাটা ছিল সুবীর চৌধুরির দিক থেকে। আমার ধারণা, সুবীর চৌধুরি নিজের পুরুষত্বহীনতার কিছু কিছু চিকিৎসা করাতে শুরু করেছিলেন। কিছু মেডিকাল টেস্টও করিয়েছিলেন। ঠিক এই সময়ে মন্দাকিনী তাঁর স্বামীকে একটা আয়ুর্বেদিক ওষুধের কথা বলেন যেটা নাকি অব্যর্থ। ওষুধের কথা মন্দাকিনী তার একদা পরিচারিকা লীলারানির কাছ থেকে জানতে পেরেছিলেন। তিনি এটাও জানতেন হার্টের অসুখ থাকলে এই ওষুধ খাওয়া আত্মহত্যার সমান। অবশ্য সুবীর চৌধুরিকে তিনি বললেন, এই ওষুধের কোনও পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া নেই। সুবীর চৌধুরিকে মন্দাকিনী খুনই করতে চেয়েছিলেন। আমার বিশ্বাস, কবিরাজি ওষুধ কাজ না করলে অন্য কোনও উপায়ে তাঁকে খুন করা হতো।’
‘ওষুধটা জোগাড় করার জন্য আগে চিঠি লিখতে হয়েছিল এবং পরে অবিনাশ কবিরাজের কাছে স্বামী-স্ত্রী হিসেবে দুজনকে যেতে হয়েছিল। স্বামীকে ভালভাবে পরীক্ষা না করে কবিরাজ মশাই ওষুধ দিতেন না। মন্দাকিনী এবং তার ভালবাসার মানুষ গ্রাম্য স্বামী-স্ত্রী সেজে কবিরাজ মশায়ের কাছে যান। দুজনেই পাকা অভিনেতা, তাই কবিরাজ মশায় তাদের ছদ্মবেশ টের পাননি। মন্দাকিনীদের সঙ্গে ছিল সুবীর চৌধুরির কিছু রিপোর্ট, যার ওপর নাম-ঠিকানা-বয়েস পাল্টানোর জন্য কিছু জালিয়াতি করতে হয়েছিল। মন্দাকিনীর ভালবাসার মানুষটির হার্ট অত্যন্ত শক্তপোক্ত তাই তাকে পরীক্ষা করে ওষুধ দিতে কবিরাজ মশায়ের বিন্দুমাত্র দ্বিধা হয়নি। ওষুধ পাবার পর মন্দাকিনী সেটা সুবীর চৌধুরিকে খেতে দেন। কিছুদিন ধরে এই ওষুধ খাবার পর সুবীর চৌধুরির ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক হয় এবং তিনি মারা যান। এটা স্বাভাবিক মৃত্যু নয়, পরিষ্কার খুন। মন্দাকিনী ও তার দোসর মিলে সুবীর চৌধুরিকে খুন করে।’
(৩)
সোহিনী দুহাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। নন্দন তার মাথায় হাত দিয়ে সান্ত্বনা দিচ্ছে। এই ভুমিকায় নন্দনকে আদিত্য আগে দেখেনি। দেখে ভাল লাগল। আদিত্য লক্ষ করল শঙ্খমালা উত্তেজনায় হাতের মুঠি বন্ধ করে রেখেছে। শুদ্ধশীল ব্যানার্জি হতবাক। পিস ইন্টারন্যাশানালের সৌরাশিস ঘোষ মাথা নিচু করে গভীর চিন্তামগ্ন।
আদিত্য আবার শুরু করল। ‘শঙ্খমালা ওই ডায়েরিটা পড়ে কিন্তু এত কিছু বুঝতে পারেনি। সে শুধু এইটুকু বুঝেছিল যে মন্দাকিনী সুবীর চৌধুরিকে তার টাকার জন্য বিয়ে করেছিল, কিন্তু তাকে এক দিনের জন্যেও ভালবাসেনি। তার মনে হয়েছিল, দীর্ঘদিনের হার্ট পেশেন্ট সুবীর চৌধুরি আত্মগ্লানিতে ভুগতে ভুগতেই মারা যান। মন্দাকিনী তাঁকে এক ফোঁটা মানসিক শান্তি দিতে পারেনি বা দেবার চেষ্টাও করেনি। বরং ঠান্ডাভাবে একটু একটু করে মরতে দিয়েছে।’
‘ডায়েরিটা পড়ে আমি এতটাই উত্তেজিত হয়ে উঠেছিলাম যে সোজা গিয়ে মামকে চার্জ করি।’ শঙ্খমালা বলে উঠল। ‘মাম প্রথমে সব ডিনাই করে। আমি এর জন্য প্রিপেয়ার্ড ছিলাম। আই হ্যাড টেকেন আ ফটোকপি অফ দ্য ডায়েরি উইথ মি। আমি মামকে ফটোকপিটা দেখালাম। বললাম অরিজিনালটা একটা সেফ কাস্টডিতে আছে যেটা মামের রিচের বাইরে। সো গ্র্যাজুয়ালি শি অ্যাডমিটেড এভরিথিং। শি ডিডন্ট হ্যাভ এনি চয়েস। আমার এত রাগ হয়েছিল যে আমি মামকে বলেছিলাম আই উইল মেক দিস পাবলিক। মাম খুব কান্নাকাটি করল। বলল, এটা করলে বিরাট স্ক্যান্ডেল হবে। চৌধুরি বাড়ির সুনাম উইল গো দাউন দ্য ড্রেন। আমি শেষ পর্যন্ত মামের কথা শুনে আর কিছু করিনি। তবে ডায়েরিটা নিয়ে মাঝে মাঝে ভাবতাম। সুব্রতকে দিয়ে উপাধ্যায়ের লেখা বইটা আনিয়ে পড়লাম। জানতে পারলাম চৌধুরিদের ওপর একটা পুরোনো কার্স আছে। মনে হল মাম সেটা ইউজ করেছে। ডায়েরিটা নিয়ে যত ভেবেছি, তত মনে হয়েছে বাবার মৃত্যুর পেছনে মামের একটা ইন্ডিরেক্ট রোল আছে। তবে আয়ুর্বেদিক ওষুধের ইমপ্লিকেশনটা আমি ধরতে পারিনি।’
‘ডায়েরিটা আপনি খুবই ইন্টেলিজেন্টলি লুকিয়ে রেখেছেলেন। মন্দাকিনী তার হদিশ পাননি। তাই মন্দাকিনী চিন্তায় ছিলেন আপনি হয়ত কোনদিন সত্যি সত্যি ডায়েরিটা পাবলিক করে দেবেন। তাছাড়া কবিরাজি ওষুধের তাৎপর্যটা তখন ধরতে পারেননি বলে কোনোদিন ধরতে পারবেন না, এমন তো নয়। মন্দাকিনী জানতেন, কবিরাজি ওষুধটার তাৎপর্য যেদিন আপনি বুঝতে পারবেন সেদিন থেকে মন্দাকিনীর জীবনের দাম কানাকড়িও থাকবে না। তাই মন্দাকিনী ঠিক করলেন উধাও হয়ে যেতে হবে। মন্দাকিনী তার ভালবাসার মানুষটির সঙ্গে অন্তর্ধানের প্ল্যান করতে শুরু করলেন। শঙ্খমালা অবশ্য ডায়েরিটার কথা সুব্রত ছাড়াও আর একজনকে বলেছিল।’ উত্তরের অপেক্ষায় আদিত্য শঙ্খমালার দিকে তাকিয়ে রইল।
‘হ্যাঁ, বলেছিলাম তো। অবশ্যই বলেছিলাম। আই হ্যাড টু শেয়ার ইট উইথ সামওয়ান।’ শঙ্খমালা কিছুটা আক্রমণাত্মক সুরে বলল। ‘কিছুদিন আগে আমার দাদা শঙ্খদীপ চৌধুরি আমাকে ফোন করে। দাদার হোয়্যার অ্যাবাউটস আমি কিছুই জানতাম না। দাদার সঙ্গে দীর্ঘদিন কোনও যোগাযোগও ছিল না। তাই দাদার ফোন পেয়ে আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিলাম। হি সাউন্ডেড মিসারেবল। দাদা বলল, ওর অনেক টাকার দরকার। বাজারে ধার হয়ে গেছে। পাওনাদার পেছনে লেগেছে। টাকা না দিতে পারলে প্রচণ্ড মারধর করবে। একবার মেরেওছে। আমি কি ওকে কিছু টাকা দিতে পারি? দাদার জন্য খুব খারাপ লাগল। আমি কিছু টাকা ওকে দিলাম। একবারে নয়, কয়েকবারে। তারপর একদিন একটু ইমোশানাল হয়ে গিয়ে ওকে ডায়েরিটা দেখালাম। ও ভাল করে পড়তে চায় বলে একটা কপি করে নিল। তারপর কী হলো আমি জানি না।’
‘শঙ্খদীপের অনেক টাকার প্রয়োজন ছিল। তাই শেষ অব্দি সে আর নিজেকে সামলাতে না পেরে মন্দাকিনীকে ব্ল্যাকমেল করতে যায়। ব্ল্যাকমেল করে বেশ কিছু টাকাও সে মন্দাকিনীর কাছ থেকে পায়।’ আদিত্য বলল। ‘শঙ্খদীপের কাছে ডায়েরির যে কপিটা ছিল সেটা পুলিশ ব্যাঙ্কের লকার থেকে উদ্ধার করেছে।’
‘কিন্তু শঙ্খদীপকে খুন হল কেন? মন্দাকিনী চৌধুরি তো তখন উধাও হয়ে গেছে। আর তো তাকে ব্ল্যাকমেল করা যাবে না। সে নিশ্চয় শঙ্খদীপকে মারেনি।’ সুব্রত প্রশ্ন করল।
‘শঙ্খদীপকে খুন করেছিল মাইকেল ও তার দলবল। তার জন্যে তারা মন্দাকিনীর দোসরের কাছ থেকে টাকা পেয়েছিল।’ আদিত্য বলল। ‘শঙ্খদীপকে খুন করা কেন দরকার হয়ে পড়েছিল, বলছি। মন্দাকিনীর উইল শুনে শঙ্খদীপ কী বলেছিল মনে আছে? বলেছিল, সব ফাঁস করে দেব। সে কী ফাঁস করে দেবার কথা বলেছিল? সম্ভবত সে ডায়েরিটা পাবলিক করে দিয়ে মন্দাকিনীর দুর্নাম করতে চেয়েছিল। কিন্তু ডায়েরিটা পাবলিক হয়ে গেলে কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে পড়ার সম্ভাবনা। জানাজানি হয়ে যেতে পারে মন্দাকিনী আর তার ভালবাসার মানুষ মিলে সুবীর চৌধুরিকে কবিরাজি ওষুধ খাইয়ে মেরেছে।’
‘তখন মরগ্যান ব্যানার্জীর মিটিং রুমে কেউ একজন উপস্থিত ছিল যে মন্দাকিনীর দোসরকে খবরটা দিয়েছিল। মরগ্যান ব্যানার্জীর আপিসে যা ঘটবে দোসরকে তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা দেবার দায়িত্ব ছিল তার। দোসর জানত শঙ্খদীপ কতটা ইমোশানালি আনস্টেবল। সে যদি ক্ষেপে গিয়ে সত্যি সত্যি ডায়েরিটা পাবলিক করে দেয় তাহলে মন্দাকিনীর উইলটাই যে বাতিল হয়ে যাবে। তাই দোসর আর রিস্কে যায়নি। সেই রাত্তিরেই লোক লাগিয়ে শঙ্খদীপকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিয়েছিল।’
‘তার মানে সেদিন এই অফিসে কেউ একজন ছিল যে জানত মাম মারা যায়নি?’ শঙ্খমালা জিজ্ঞেস করল।
‘না, মনে হয় না সে জানত মন্দাকিনী বেঁচে আছে। মন্দাকিনীর বেঁচে থাকাটা টপ সিক্রেট, সেটা যত কম লোককে জানানো যায় ততই ভাল। সেই ব্যক্তির কাজ ছিল মরগ্যান ব্যানার্জির আপিসে কী ঘটছে সেটা মন্দাকিনীর দোসরকে জানানো।’
‘কিন্তু কে সেই ব্যক্তি?’ শঙ্খমালা উদগ্রীব হয়ে জিজ্ঞেস করল।
‘তার প্রসঙ্গে একটু পরে আসছি’ আদিত্য বলল। ‘আগে পিস ইন্টারন্যাশানালের প্রসঙ্গে আসি, মন্দাকিনী যাদের সমস্ত টাকাপয়সা দান করে গিয়েছিলেন। পুলিশ খোঁজ নিয়ে দেখেছে এই সংস্থাটির হেড অফিস সুইৎজারল্যান্ডে হলেও এর রেজিস্ট্রেশন মরিশাসে। ক্রিস ও কেলভিনা যাদব বলে মরিশাসের এক দম্পতি এই এনজিওর মালিক। গত ছ’সাত বছর আফ্রিকা এবং এশিয়ার বেশ কিছু দেশে এরা সুনামের সঙ্গে কাজ করছে। অর্থাৎ আপাতদৃষ্টিতে এই সংস্থাটি সম্ভ্রান্ত, কোথাও এদের নামে আপত্তিকর কিছু শোনা যায়নি। আমাদের পুলিশ মরিশাসের পুলিশের কাছে ক্রিস ও কেলভিনা যাদব সম্পর্কে বিশদ জানতে চেয়েছিল। দুর্ভাগ্যবশত, এদের সম্বন্ধে আর বিশেষ কিছু মরিশাসের পুলিশ জানাতে পারেনি। শুধু মরিশাসের ন্যাশানাল আই ডি কার্ডে এই দম্পতির যে ছবি দুটো আছে তার প্রতিলিপি তারা পাঠিয়ে দিয়েছে। আমাদের অবশ্য তাতেই কাজ হয়ে গেছে। আমরা জানতে পেরেছি কেলভিনা যাদব এবং মন্দাকিনী চৌধুরি একই ব্যক্তি। ক্রিস যাদবকেও আমরা চিনতে পেরেছি, কিন্তু তার প্রসঙ্গে পরে আসব। আপাতত এইটুকু বলাই যথেষ্ট যে, মন্দাকিনী আর তার দোসর মরিশাসের জাল পাসপোর্ট জোগাড় করেছিল। কাজটা তেমন একটা কঠিন নয়। তারপর সেই জাল পরিচয় দিয়ে তারা মরিশাসে পিস ইন্টারন্যাশানাল প্রতিষ্ঠা করে।’
‘দিস ইস আ কন্সপিরেসি। আই প্রোটেস্ট।’ সৌরাশিস ঘোষ দাঁড়িয়ে উঠে বলল।
‘জাস্ট কিপ কোয়াএট। পরে আপনি কথা বলার অনেক সুযোগ পাবেন। আমরা জানি আপনি কখনও আপনার মরিশাসের বসদের দেখেননি, শুধু টেলিফোনে তাদের সঙ্গে কথা বলেছেন। কিন্তু সেদিন এখানে কী কী কথা হয়েছিল, বিশেষ করে শঙ্খদীপ এখানে কী বলেছিল তার বিশদ বর্ণনা আপনিই তো আপনার বস ক্রিস যাদবকে ফোনে জানিয়েছিলেন। বস্তুত আমাদের ধারণা সেদিন আপনি মোবাইলের অডিও রেকর্ডারটা পকেটের মধ্যে অন করে রেখে এখানকার পুরো কথাবার্তাটাই রেকর্ড করেছিলেন। পরে অডিও ক্লিপটাও ক্রিস যাদবের কাছে পাঠিয়ে দেন। ক্রিস যাদব অবশ্য তখন কলকাতাতেই ছিল, কিন্তু সেটা আপনার জানার কথা নয়। ক্রিস যাদবের হোয়াটসআপ নম্বরে আপনি ফোন করেন, যেটা ছিল তার মরিশাসের নম্বর। আপনার তাই ধারণা হয়েছিল সে মরিশাসেই আছে। মোবাইলটা দীননাথ যোশির জিনিসপত্র থেকে আমরা উদ্ধার করেছি। হোয়াটসআপের কল লিস্ট থেকে আপনার নামটাও পাওয়া গেছে। যাইহোক, সমাদ্দার, একে আপাতত অ্যারেস্ট করে নীচে পুলিশের গাড়িতে বসিয়ে রাখো। নইলে নুইসেন্স ক্রিয়েট করবে।’ গৌতম শেষের কথাগুলো একজন অফিসারের উদ্দেশে বলল।
সমাদ্দার ও দুজন কনস্টেবল সৌরাশিসকে নিয়ে চলে যাবার পর গৌতম শুদ্ধশীল ব্যানার্জির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি শুদ্ধশীলবাবু, মর্গ্যান ব্যানার্জি কিন্তু এক্ষেত্রে তার সুনাম অনুযায়ী কাজ করতে পারেনি। পিস ইন্টারন্যাশানালের ব্যাপারে আপনাদের আরও সতর্ক হওয়া উচিত ছিল।’
শুদ্ধশীল ব্যানার্জি মাথা নিচু করে নিরুত্তর রইলেন। গৌতম আবার বলল, ‘আপনার পারসোনাল ইন্টিগ্রিটি নিয়ে আমাদের কিছু বলার নেই, কিন্তু আপনার জুনিয়ার সাত্যকি রায়ের গতিবিধি নিয়ে কিছু সন্দেহ দেখা দিয়েছে। আপনি পিস ইন্টারন্যাশানাল সম্বন্ধে খোঁজখবর নেবার ভার পুরোপুরি সাত্যকিবাবুর ওপর ছেড়ে দিয়েছিলেন। সাত্যকিবাবু পিস ইন্টারন্যাশানালকে ক্লিন চিট দেবার পর আপনি আর ব্যাপারটা নিয়ে মাথা ঘামাননি। আপনি আপনার জুনিয়ারকে একটু বেশি বিশ্বাস করেছিলেন, এটাই আপনার দোষ। আপনি যদি আর একটু খতিয়ে দেখতেন তাহলে পিস ইন্টারন্যাশানালের মালিকদের সম্বন্ধে জানতে পারতেন। আর সেটা জানলেই ওদের আসল পরিচয়টা বেরিয়ে পড়ত।’
শুদ্ধশীল ব্যানার্জির চোখদু’টো ক্রমশই বিস্ফারিত হচ্ছিল। গৌতম বলল, ‘আমাদের সন্দেহ, মন্দাকিনী সাত্যকি রায়কে মোটা টাকা ঘুষ দিয়েছিল যাতে সে পিস ইন্টারন্যাশানালকে ক্লিন চিট দেয়। এটা আমরা এখনও সরাসরি প্রমাণ করতে পারিনি, তবে পুলিশ ইনভেস্টিগেট করে দেখেছে সাত্যকিবাবুর কয়েকটা ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট হঠাৎ অসম্ভব ফুলেফেঁপে উঠেছে, আপাতদৃষ্টিতে যার কোনও কারণ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আমরা ব্যাপারটা আরও ভাল করে খতিয়ে দেখছি।’
সাত্যকি রায় কী একটা বলতে গিয়েও চুপ করে গেল। আদিত্য বলল, ‘মন্দাকিনী জানত আসল ডায়েরিটা শঙ্খমালার কাছে রয়ে গেছে। কিন্তু শঙ্খমালা তার দাদার মতো মেনটালি আনস্টেবল নয়, হঠাৎ করে ডায়েরির কথা সে মিডিয়াকে বলবে না, পরিবারের সুনাম রক্ষা করাটা সে নিজের দায়িত্ব মনে করবে। তাই হাতে কিছুটা সময় আছে। কিন্তু ভবিষ্যতে সে যদি সুবীর চৌধুরির মৃত্যুর রহস্যটা আবিষ্কার করে ফেলে তাহলে কী হবে বলা যায় না। তাই আমার মনে হয়, মন্দাকিনী আর তার দোসর আসল ডায়েরিটা পাবার চেষ্টা করছিল। আর ঠিক এই কাজটা করার জন্যেই তারা কলকাতার কাছে কিছুদিন গা ঢাকা দিয়ে ছিল। সঙ্গে সঙ্গে বিদেশে পালিয়ে যায়নি। ডায়েরি পেয়ে গেলে তারা শঙ্খমালা আর সুব্রতকেও পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিত।’
‘একটা জিনিস বুঝতে পারছি না। যদি মাম আমাদের খুন করারই প্ল্যান করবে তাহলে নিজে খুন হবার ভান করে গা ঢাকা দিল কেন? আমাদের খুন করে দিব্যি এখানেই তো থাকতে পারত।’ শঙ্খমালা জিজ্ঞেস করল।
‘খুবই পারটিনেন্ট প্রশ্ন। উত্তরটা দিচ্ছি। ধরুন, মন্দাকিনীরা সেটাই করল। এমন তো হতেই পারত আপনি কাউকে ইন্সট্রাকশান দিয়ে গিয়েছেন আপনার কিছু হলে ডায়েরিটা যেন মিডিয়ার কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়। সেরকম ঘটলে মন্দাকিনীরা সরাসরি বিপদে পড়ে যেত। তাই ডায়েরি হাতে পাবার আগে আপনাদের খুন করার প্রশ্নই উঠছে না। তার থেকে পালিয়ে যাওয়া ভাল। এমনভাবে পালিয়ে যাওয়া যাতে মন্দাকিনীকে আর কেউ খুঁজবে না, কারণ সকলে জানবে সে মারা গেছে। অর্থাৎ ডায়েরির অস্তিত্বটা জানার পর থেকে মন্দাকিনী ও তার দোসর ঠিক করেছিল এবার তাদের পালাতেই হবে। নাহলে তারা খুনের দায়ে পড়ে যেতে পারে। আজ না হলেও হয়তো ভবিষ্যতে কখনও। তারা পালিয়ে যাবার পর যদি সব কথা জানাজানি হয়েও যায় তাহলে বড়জোর মন্দাকিনীর উইলটা বাতিল হয়ে গিয়ে তাদের একটা আর্থিক ক্ষতি হবে। কিন্তু পুলিশ তাদের ধরার চেষ্টাও করবে না, কারণ পুলিশের কাছে তারা মৃত। ইতিমধ্যে কোম্পানি থেকে মন্দাকিনী যে টাকা সরিয়ে ফেলেছে তা দিয়ে তাদের সারা জীবন বিদেশে হেসে খেলে কেটে যাবে। সব থেকে বড় কথা, এখানে থাকলে মন্দাকিনী আর তার ভালবাসার মানুষ একমাত্র লোকচক্ষুর আড়ালে লুকিয়ে চুরিয়ে পরস্পরের কাছে আসতে পারত। খোলাখুলিভাবে নয়। এইভাবে মেলামেশা করতে করতে তারা ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। একদিন না একদিন এখান থেকে তাদের পালিয়ে যেতেই হত। কিন্তু এমনভাবে পালাতে হত যাতে সম্পত্তিটা হাতছাড়া না হয়।’
‘মন্দাকিনী কীভাবে আসল ডায়েরিটা পাবার চেষ্টা করছিল?’ সুব্রত নিরীহভাবে জিজ্ঞেস করল।
‘সেটা তো আপনার থেকে ভালো আর কেউ জনে না, সুব্রতবাবু।’ আদিত্য বলল, ‘আমাদের কাছে খবর আছে, এক ব্যক্তি, সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে, আপনাকে অ্যাপ্রোচ করেছিল। বলেছিল, আসল ডায়েরিটা তার হাতে তুলে দিলে সে একটা বিপুল অঙ্কের টাকা আপনাকে দেবে। আপনি তার প্রস্তাবে রাজিও হয়েছিলেন। শুধু আপনার স্ত্রী ডায়েরিটা কোথায় লুকিয়ে রেখেছেন সেটা আপনি খুঁজে বার করতে পারেননি। আপনার স্ত্রী আপনাকে ভালই চিনতেন তাই ডায়েরিটা তিনি কোথায় রেখেছেন সেটা আপনাকে বলেননি। আপনি জানতেন না পুলিশ আপনার প্রত্যেকটি গতিবিধির ওপর নজর রাখছে। যাইহোক, সেই ভুয়ো সাংবাদিক পুলিশের হাতে ধরা পড়েছে। সে বলেছে, বাবরি চুল, কালো রোদ চশমা পরা একটি লোকের হয়ে সে কাজ করছিল। আপনি বুঝতে পারেননি, ডায়েরি একবার হাত থেকে বেরিয়ে গেলে আপনার এবং আপনার স্ত্রীর জীবনের আর কোনও দাম থাকত না।’
সুব্রত সেন কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর ধীরে ধীরে বলল, ‘হ্যাঁ, আমি লোভে পড়ে গিয়েছিলাম। টাকার অঙ্কটা অবিশ্বাস্য রকমের বেশি ছিল। পরে আমি সব কথা মালার কাছে স্বীকার করেছি। মালা আমাকে ক্ষমা করে দিয়েছে।’
কিছুক্ষণ থেমে আদিত্য বলতে লাগল, ‘মন্দাকিনীর ছকটা নিশ্চয় আপনাদের কাছে এখন পরিষ্কার হয়েছে। প্রথমে মন্দাকিনী দেখাল তাকে খুন করার চেষ্টা হচ্ছে। তারপর সেই অজুহাতে সে একটা উইল করল যাতে বলা হল তার যদি অপঘাতে মৃত্যু হয় তাহলে সব সম্পত্তি পিস ইন্টারন্যাশানালের হাতে চলে যাবে। এর কিছুদিন পরে একটা সাজানো অ্যাক্সিডেন্টে দেখানো হল মন্দাকিনী মারা গেছে। এর জন্য তার দোসর কাছাকাছি গ্রাম থেকে একটা মৃতদেহ যোগাড় করে সেই মৃতদেহ সুদ্ধু গাড়ি ধাক্কা দিয়ে পাহাড়ের খাদে ফেলে দিল এবং গ্রামের মোড়লকে কিছু টাকাপয়সা খাইয়ে পুলিশ আসার আগেই মৃতদেহ সৎকার করে ফেলল। মন্দাকিনীর ব্যবহার করা কিছু জিনিস বডি আইডেন্টিফিকেশনের জন্য রেখে দেওয়া হল। পিস ইন্টারন্যাশানালের হাতে চৌধুরিদের আয় চলে গেলে সেটা তো মন্দাকিনীর হাতেই আবার গিয়ে পড়া।’
‘মন্দাকিনীর সাজানো মৃত্যুর পর দুটো প্রশ্নের আমি উত্তর খুঁজছিলাম। এক, মন্দাকিনীর হাতের অত বড় হিরের আংটিটা গ্রামবাসীদের কেউ চুরি করে নেবার চেষ্টা করল না কেন? দুই, মন্দাকিনী না হয় তার সৎ ছেলেমেয়েদের উইলে বঞ্চিত করল। কিন্তু নিজের মেয়ের প্রতিও কি তার কোনও টান ছিল না? প্রথম প্রশ্নের উত্তরটা সহজেই পাওয়া যাবে যদি ধরে নিই মন্দাকিনীর অ্যাকসিডেন্টটা সাজানো। দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর পেলাম কিছুদিন পর। মন্দাকিনী নিজের মেয়ের জন্য অন্যরকম ব্যবস্থা করে গিয়েছিল। মরিশাসের আর একটি ট্রাস্টের মাধ্যমে সোহিনীকে একটা মোটা স্কলারশিপ পাইয়ে দিয়েছিল যাতে শুধু তার লেখাপড়া নয়, জীবনযাপনটাও আরামে চলে যায়। বস্তুত, বিদেশ যাবার আগের কয়েক মাসও যাতে মেয়ের কোনও অসুবিধে না হয় তার জন্য অন্তর্ধানের আগে মন্দাকিনী মেয়েকে একটা মোটা টাকা দিয়ে গিয়েছিল। মন্দাকিনী এটাও জানত, নন্দনের কোনও ব্যবস্থা না হলে সোহিনী কলকাতা ছেড়ে নড়বে না। তাই সে পুনের সঙ্গীতাশ্রমে একটা মোটা টাকা ডোনেশন দিয়ে নন্দনের জন্যেও একটা স্কলারশিপের ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। এর ফলে নন্দনের থেকে সোহিনীকে আলাদা করারও ব্যবস্থা হল। নন্দন চক্রবর্তীকে মন্দাকিনী দুচক্ষে দেখতে পারত না।’
‘এসবের কি কোনও প্রমাণ আছে?’ শুদ্ধশীল ব্যানার্জি জিজ্ঞেস করলেন।
‘কিছু সারকমস্টানশিয়াল এভিডেন্স পাওয়া গেছে। যেমন পুলিশ খোঁজ নিয়ে জেনেছে মন্দাকিনী পুনের ওই সঙ্গীত আশ্রমটিকে একটা মোটা টাকা ডোনেশন দিয়েছিলেন এই শর্তে যে তারা নন্দনকে ওই অফারটা দেবে। পুলিশ এটাও জানতে পেরেছে যে মরিশাসের সেই ট্রাস্টটি ম্যানেজ করে পিস ইন্টারন্যাশানাল। সব থেকে বড় কথা, কোনও চ্যারিটেবল ট্রাস্ট কাউকে পিএইচডি করার জন্য এত টাকা স্কলারশিপ দিচ্ছে এটা ভীষণ আনইউসুয়াল তাই সন্দেহজনক।’
আদিত্য থামল। নন্দন সোহিনীকে কী যেন ফিসফিস করে বলছে। শিশির চ্যাটার্জি ঘড়ি দেখছেন। একটানা বসে থাকার ফলে অনেকেই উসখুস করছে। শুধু মার্থা একেবারে স্থির হয়ে বসে আছে।
আদিত্য বলল, দু’একটা জিনিস পরে আমার কাছে পরিষ্কার হয়েছে। শঙ্খমালা মন্দাকিনী সম্পর্কে বলেছিল ‘কুল অ্যান্ড ক্যালকুলেটিং’ কারণ সে তার কিছুদিন আগে সুবীর চৌধুরির ডায়েরিটা দেখেছে। শঙ্খদীপ তার বাবার সম্বন্ধে বলেছিল ‘ঢ্যামনা’। এই অশ্লীল শব্দটা ব্যবহার করার জন্য আমাকে মাফ করবেন। আমি ডিক্সনারিতে দেখেছি শব্দটার একটা অর্থ ‘পুরুষত্বহীন’। তার মানে, শঙ্খদীপকে আমি যখন প্রথম দেখি, তখন সে ডায়েরিটা পড়েছে।’
আদিত্য বলে চলল, ‘এখনও গুরুত্বপূর্ণ কিছু প্রশ্নের উত্তর পাওয়া বাকি আছে। এক, মন্দাকিনীর ভালবাসার মানুষটির পরিচয় কী যার সঙ্গে বসে সে এত কিছু প্ল্যান করেছিল? তাকে কি আমরা চিনি? দুই, মন্দাকিনী এবং তার ড্রাইভার কাম বডিগার্ড দীননাথ যোশিকে কে খুন করল? কেন খুন করল? আমি প্রথম প্রশ্নের উত্তরটা আগে দিচ্ছি।’
ঘরের চারদিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে প্রায় ঘোষণা করার ভঙ্গিতে আদিত্য বলল, ‘মন্দাকিনীর ভালবাসার মানুষ ও পাপ কাজের দোসর ছিল তার প্রথম স্বামী নীলাঞ্জন মৈত্র। নীলাঞ্জনের সঙ্গে প্ল্যান করেই মন্দাকিনী সুবীর চৌধুরিকে প্রেমের জালে ফাঁসায় এবং পরে তাকে বিয়ে করে। আমার ধারণা, সব প্ল্যান নীলাঞ্জনের, মন্দাকিনী সেইসব প্ল্যান এক্সিকিউট করেছিল মাত্র। কবিরাজ অবিনাশ সেনের রেজিস্টারে বিজয় মাকাল সই করেছিল। আমাদের হ্যান্ডরাইটিং এক্সপার্ট মত দিয়েছেন সেই হাতের লেখা নীলাঞ্জন মৈত্রের।’
আদিত্য দেখল সোহিনী অবাক হতেও ভুলে গেছে। ঘরে অখণ্ড নিস্তব্ধতা।
আদিত্য বলতে লাগল, ‘নীলাঞ্জন-মন্দাকিনীর মধ্যে একটা আশ্চর্য রকমের প্রগাঢ় ভালবাসা ছিল, যে ভালবাসা শেষদিন পর্যন্ত একফোঁটাও টোল খায়নি। রান্নার মাসি যখন শুনেছিল নীলাঞ্জনের সঙ্গে মন্দাকিনীর ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে তখন সে সত্যিই অবাক হয়ে গিয়েছিল। অবাক হবারই কথা। এত গভীর প্রেম সচরাচর দেখা যায় না। সেই প্রেম ভেঙে গেল? সোহিনীও তার বাবা-মার বিচ্ছেদের ব্যাপারে কিছুই টের পায়নি। ঝগড়াঝাঁটি নয়, মনান্তর নয়, হঠাৎ যেন একদিন প্ল্যান করে তারা আলাদা হয়ে গেল।
‘মন্দাকিনীর দ্বিতীয় বিয়ের পর কিছুদিন নীলাঞ্জনকে একা একা থাকতে হয়েছিল। তারপর সুবীর চৌধুরি মারা যাবার পর নীলাঞ্জন দীননাথ ড্রাইভার সেজে মন্দাকিনীর সঙ্গে সঙ্গে থাকত। আবার মন্দাকিনী যখন কেলভিনা যাদব সেজে মরিশাসে কী অন্য কোথাও পিস ইন্টারন্যাশানালের কাজে যেত, তখন ক্রিস যাদব সেজে নীলাঞ্জন তার সঙ্গ নিত। মন্দাকিনীকে ছেড়ে বেশি দিন থাকা নীলাঞ্জনের পক্ষে সম্ভব ছিল না।’
‘দীননাথ যোশি বলে একজন সত্যিকারের লোক অবশ্য ছিল। চরিত্রহীনা স্ত্রীর ওপর অভিমান করে সে সম্ভবত পাহাড় থেকে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করে। তার বডি আর কখনও পাওয়া যায়নি। নীলাঞ্জন তাকে চিনত। কী করে আসল দীননাথের সঙ্গে নীলাঞ্জনের পরিচয় হয়েছিল সেটা অনুমানসাপেক্ষ, এবং জানাটা জরুরিও নয়। এমন হতেই পারে নীলাঞ্জনই দীননাথকে পাহাড় থেকে ঠেলে ফেলে দিয়েছিল। সে যাইহোক, নীলাঞ্জন মাথা কামিয়ে দীননাথের পরিচয় গ্রহণ করল। দীননাথ বেঁচে আছে প্রমাণ করার জন্য সে দীননাথের বউকে নিয়মিত টাকা পাঠাত। মাথা কামিয়ে টিকি রাখলে মানুষের চেহারা আশ্চর্য রকম পালটে যায়। নীলাঞ্জন তারই সুযোগ নিয়েছিল। তাছাড়া নাটকের লোক বলে ছদ্মবেশ ধরা তার সহজাত ছিল। মাথা কামিয়েও যে ছদ্মবেশ নেওয়া যায় সেটা গ্রেট ইস্টার্ন হোটেলের নিচে এক ইসকনের মাথা-কামানো সাহেবকে দেখে আমার প্রথম মনে হয়েছিল।’
‘একটা ব্যাপারে অবশ্য দীননাথবেশী নীলাঞ্জনকে সাবধান থাকতে হয়েছিল। যতই ছদ্মবেশ ধরুক, তাকে দেখলে তার মেয়ে সোহিনী ঠিকই চিনতে পারত। তাই সে কলকাতায় মন্দাকিনীর গাড়ি চালাত না। পাছে সোহিনীর সামনে পড়ে যায়। তাই সোহিনী বলেছিল, দীননাথকে সে কখনও দেখেনি। কলকাতায় এলে নীলাঞ্জন নীলাঞ্জন মৈত্র সেজেই থাকত। তার মধ্যে যে ক্রিমিনালটা বাস করত, তাকে লুকিয়ে রাখার জন্য নীলাঞ্জন রাগী-রাগী ভাব করে একটা অতি বাম ইন্টেলেকচুয়ালের খোলস গায়ে জড়িয়ে রাখত। তাকে আমি একবারই দেখেছিলাম। মনে হয়েছিল যেন ঠিক বাস্তব নয়, যেন ছাঁচে ফেলা কোনও নাটক, উপন্যাস বা সিনেমার চরিত্র।
‘মন্দাকিনী আর নীলাঞ্জন পরস্পরকে ভালবেসে যদি সাধারণ একটা জীবনে তুষ্ট থাকতে পারত, তাহলে তারা সত্যিই সুখী হতে পারত। বড়লোক হবার লোভ তাদের, এবং শুধু তাদের নয়, তাদের ছাড়াও আরও কয়েকটা জীবনকে অকালে ঝরিয়ে দিল। এটা একটা ভয়ানক ট্র্যাজেডি। কিন্তু বিধাতার ন্যায়দণ্ডও কখনো কখনো কাজ করে। নাহলে তারা হয়ত পৃথিবীর এমন কোথাও হারিয়ে যেত যেখান থেকে তাদের খুঁজে বার করাটা সম্ভব হত না।’ আদিত্য চুপ করল।
‘কিন্তু মন্দাকিনী আর নীলাঞ্জনকে খুন করল কে?’ শিশির চ্যাটার্জি একটু কুণ্ঠিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন।
‘ও হ্যাঁ, সেটাই তো বলা হয়নি। মন্দাকিনী আর নীলাঞ্জনকে যে খুন করেছে সে এই ঘরের মধ্যেই আছে।’ বলতে বলতে আদিত্য মার্থার দিকে তাকাল, ‘নীলাঞ্জন আর মন্দাকিনীকে খুন করেছে মার্থা স্যাভিও।’
‘হোয়াই শুড আই কিল দেম? আই ডিড নট ইভন নো দেম’। মার্থা তারস্বরে প্রতিবাদ করে উঠল।
‘ইউ কিলড দেম টু অ্যাভেঞ্জ ইয়োর সুইটহার্টস মার্ডার।’ আদিত্য ঠান্ডা গলায় বলল। ‘মার্থা জানত শঙ্খদীপ মন্দাকিনীকে ব্ল্যাকমেল করছে। যখন শঙ্খদীপ খুন হল মার্থার মনে হল এর পেছনে মন্দাকিনীর হাত আছে। তার মানে মন্দাকিনী মরেনি। এর পরের ঘটনাগুলো আমি অনুমান করছি, কিছু কিছু ভুল থাকতেই পারে। শঙ্খদীপ মার্থাকে একটা ফোন নম্বর দিয়েছিল, যে নম্বরে ফোন করলে মন্দাকিনীর সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়। মার্থা সেই নম্বরে ফোন করেছিল এবং খুব সম্ভবত নীলাঞ্জন ফোনটা ধরেছিল। মার্থা নীলাঞ্জনকে বলল তার কাছে ডায়েরির একটা কপি আছে যেটা তাকে শঙ্খদীপ দিয়ে গেছে। ভাল দাম পেলে সে সেটা মন্দাকিনীর হাতে তুলে দিতে রাজি আছে। মনের মতো দাম না পেলে অবশ্য সে ডায়েরিটা পাবলিক করে দেবে। বলাই বাহুল্য মার্থা মিথ্যে কথা বলেছিল। ডায়েরির কোনও কপি মার্থার কাছে ছিল না। কপি ছিল ব্যাঙ্কের লকারে, যার চাবি আমরা সিজ করে নিয়েছিলাম। আমার ধারণা সে ইনসিস্ট করেছিল মন্দাকিনীর হাতেই ডায়েরিটা তুলে দেবে। আসলে সে মন্দাকিনীকে সামনা সামনি দেখতে চেয়েছিল। যাইহোক, মন্দাকিনী মার্থাকে নরেন্দ্রপুরের রিসর্টে আসতে বলে। হয়ত নীলাঞ্জনও ঠিক করেছিল ডায়েরির কপিটা পেয়ে গেলে মার্থাকে মেরে ফেলবে, কিন্তু রিসর্টে নয়, নিজের হাতেও নয়। অন্য কোথাও অন্য কাউকে দিয়ে। যেমনভাবে শঙ্খদীপকে মারা হয়েছিল।’
‘এদিকে মার্থাও ঠিক করে গিয়েছিল সে মন্দাকিনীকে দেখতে পেলে একেবারে প্রাণে মেরে ফেলবে। নাহলে শঙ্খদীপের আত্মা শান্তি পাবে না। সে এই কাজের জন্য একটা পিস্তলও ভাড়া করেছিল। পিস্তলে সাইলেন্সার লাগানো ছিল। কারণ মার্থা তো আর আগে থেকে জানতো না সেই রাত্তিরে তুমুল বৃষ্টি নামবে।’
‘মার্থা কি পিস্তল ছুঁড়তে জানত?’ শঙ্খমালা জিজ্ঞেস করল।
‘জানত। মার্থার বাবা এক সময় পুলিশে কাজ করত। দুর্দান্ত শুটার ছিল। একেবারে যাকে বলে ক্র্যাকশট। পুলিশদের স্পোর্টস-এ অনেকবার প্রাইজ পেয়েছে। মার্থার বাবাই মার্থা আর তার বোনকে আগ্নেয়াস্ত্র চালাতে শিখিয়েছিল। পরে দুর্নীতির জন্য মার্থার বাবার চাকরি যায়। সে তখন অতিরিক্ত মদ্যপান শুরু করে। মার্থার মা তার বাবা এবং তাদের দু’বোনকে ছেড়ে আরেক জনের সঙ্গে চলে যায়। ফলে পরিবারটা একেবারে ভেসে গেল। মার্থার বোনের ভাগ্যটা অবশ্য ভাল, তার একটা ঠিকঠাক বিয়ে হয়েছে, একটা পরিবার আছে। কিন্তু মার্থার ভাগ্যটা ততটা ভাল নয়। তার একটা খারাপ বিয়ে হয়েছিল, বিয়েটা ভেঙে যায় এবং শেষ পর্যন্ত তাকে নাইটক্লাবে নর্তকীর কাজ নিতে হয়। পুলিস খোঁজখবর করে এসব জানতে পেরেছে।’ গৌতম বলল।
আদিত্য বলল, ‘মার্থার মধ্যে যে পর্তুগিজ রক্তটা আছে সেটা অতিশয় প্রতিশোধ প্রবণ। তাছাড়া শঙ্খদীপকে সে পাগলের মতো ভালবাসত। তাই শঙ্খদীপের হত্যাকারীকে সে ক্ষমা করতে পারেনি। আমি ঠিক বলছি মার্থা?’
মার্থা কোনও কথা বলল না। আদিত্য আবার বলতে শুরু করল। ‘রিসর্টের ভেতরে ঠিক কী হয়েছিল আমার পক্ষে বলা শক্ত। সবটাই অনুমান করছি। রিসর্টের মেন গেটে পৌঁছে মার্থা নীলাঞ্জনকে ফোন করে বলেছিল সে এসে গেছে। নীলাঞ্জন নিজে গিয়ে দরজা খুলে মার্থাকে রিসর্টের ভেতরে ঢুকিয়ে নিয়েছিল, তাকে মন্দাকিনীর ঘরে নিয়ে গিয়েছিল। ডায়েরি নিয়ে টাকা দেওয়ার ব্যাপারটা, বলাই বাহুল্য সে খোলা যায়গায় করতে চায়নি। সেই সময় প্রবল বৃষ্টি পড়ছিল, তাই গেটে কোনও সিকিউরিটি ছিল না। ফলে কেউ তাদের দেখতে পায়নি।’
‘মার্থা যে কতটা ক্ষিপ্র হতে পারে আমি সেটা নিজের চোখে দেখেছি। আমার সামনে শঙ্খদীপকে সে যখন আঘাত করেছিল, শঙ্খদীপ নড়ার সময় পায়নি। আমার মনে হয় নীলাঞ্জনকেও মার্থা নড়ার সুযোগ দেয়নি। তবে মার্থা যেগুলি করতে পারে এটা নীলাঞ্জনের কল্পনাতেও ছিল না। হি ওয়াজ টেকেন বাই সারপ্রাইজ। তাই সঙ্গে বন্দুক থাকা সত্ত্বেও সে সেটা বার করার সুযোগ পায়নি। মার্থা ধরে নিয়েছিল নীলাঞ্জন মন্দাকিনীর বডিগার্ড। তাই তাকে আগে মারতে হবে। মনে হয় নীলাঞ্জনের আর্তনাদ শুনে বেডরুম থেকে মন্দাকিনী বেরিয়ে আসে। মার্থা তাকেও তখন গুলি করে। বন্দুকে সাইলেন্সার লাগানো ছিল। তার ওপর বৃষ্টির শব্দ। তাই গুলির শব্দ বাইরের কেউ শুনতে পায়নি। অত বৃষ্টির মধ্যে তখনও সিকিউরিটি গার্ড মেন গেটে ছিল না। মার্থা সহজেই দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে গিয়েছিল।’
‘ইজ ইট অল ইয়োর ইম্যাজিনেশন অর ডু ইউ হ্যাভ এনি প্রুফ?’ মার্থা চিবিয়ে চিবিয়ে বলল।
‘আমার কাছে দুটো প্রমাণ আছে। এক, যার কাছ থেকে তুমি পিস্তলটা ভাড়া করেছিলে সে পুলিশের হাতে ধরা পড়ে স্বীকার করেছে যে সে তোমাকে একদিনের জন্য একটা সাইলেন্সার লাগানো পিস্তল ভাড়া দিয়েছিল। দুই, তোমার বাড়ি সার্চ করে একটা কালো ব্যাগ পাওয়া গেছে যার গায়ে কয়েকটা ফুটো রয়েছে। ব্যাগের ভেতরে তোমার বন্দুকটা ছিল। ডায়েরির কপি বার করছ এই অছিলায় তুমি ব্যাগের ভেতর হাত ঢোকাও এবং প্রথম কয়েকটা গুলি ব্যাগের ভেতর থেকেই কর। তাছাড়া মৃতদেহগুলোর শরীরে যে গুলিগুলো পাওয়া গেছে তার সঙ্গে তোমার ভাড়া নেওয়া বন্দুকের ক্যালিবার মিলে যাচ্ছে।’
মার্থা আর বলার মতো কথা খুঁজে পেল না। তিনজন মহিলা পুলিশ তাকে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। মার্থা বাধা দিল না।
শঙ্খমালা বলল, আচ্ছা, ড্রাইভার দীননাথ যোশিই যে নীলাঞ্জন মৈত্র এটা কী করে বোঝা গেল?’
আদিত্যই উত্তরটা দিল। ‘মন্দাকিনীর মৃতদেহের সঙ্গে কয়েকটা পরচুলা পাওয়া গেছিল। তার মধ্যে একটা পুরুষদের দাড়ি এবং পরচুলাও ছিল। ভাগ্যক্রমে বডি তখনও মর্গে। মিউটিলেটেড মুখটা আমাদের সার্জন একটু মেরামত করলেন। তারপর আমরা নেড়া মাথার ওপরে উইগটা আর গালে দাড়িটা চাপিয়ে দেখলাম। আমার মনে হল এটা নীলাঞ্জন। সেই পরচুলা ও দাড়িসুদ্ধু বডি আরও দুজনকে দিয়ে আইডেন্টিফাই করালাম। তার মধ্যে একজন আমার পুরোনো বন্ধু স্যমন্তক, আর একজন স্যমন্তকদের নাটকের দলের সুদীপ্ত। দুজনেই নীলাঞ্জনকে চিনত। দুজনেই বডিটা নীলাঞ্জনের বডি বলে আইডেন্টিফাই করল। তাছাড়া নীলাঞ্জন হাই পাওয়ারের চশমা পরত। আমরা দেখেছি, মৃত্যুর সময় দীননাথের চোখে হাই পাওয়ারের কনট্যাক্ট লেন্স লাগানো ছিল। সব থেকে বড় কথা, দীননাথের জিনিসপত্রের সঙ্গে নীলাঞ্জন মৈত্রের প্যান কার্ড, আধার কার্ড, ব্যাঙ্কের পাশবই সবই পাওয়া গেছে। একজোড়া চশমাও পাওয়া গেছে যেটা নীলাঞ্জন ব্যবহার করত।’
‘আর একটা একটা প্রশ্ন আছে। নীলাঞ্জন বাবরি চুল লাগিয়ে আপনার অফিসে আপনাকে খোঁজ করতে গিয়েছিল কেন?’ শঙ্খমালা জিজ্ঞেস করল।
‘এই প্রশ্নটা আমিও নিজেকে করেছি। আমার মনে হয় এর উত্তর পেতে গেলে আর একটু পিছিয়ে গিয়ে অন্য একটা প্রশ্ন করতে হবে। এত লোক থাকতে মন্দাকিনী তার গোয়েন্দা হিসেবে আমাকে কেন নিয়োগ করল? সে তো চাইলে দেশের শ্রেষ্ঠ ডিটেকটিভ এজেন্সি থেকে শ্রেষ্ঠতম কাউকে নিয়োগ করতে পারত। আসলে, মন্দাকিনী এমন একজনকে নিয়োগ করতে চেয়েছিল যে গোয়েন্দা হিসেবে অতি নিম্নমানের। তার ভয় ছিল, ভালো কেউ তার কেসটা নিলে কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে যেতে পারে। তার দরকার ছিল একজন হাবাগোবা গোয়েন্দার যে আর কিছু করবে না, শুধু তার মনের মতো একটা রিপোর্ট দেবে। আমার এবং আমার পরিবারের কথা মন্দাকিনী জানত। সে ধরে নিয়েছিল, জমিদারের ছেলে অবস্থা গতিকে গোয়েন্দা হয়েছে, এ কখনও ভাল গোয়েন্দা হতেই পারে না। অর্থাৎ মন্দাকিনীর বিবেচনায় আমি ছিলাম একজন অলস, হাঁদা গঙ্গারাম ডিটেকটিভ। তাই আমাকে নিয়োগ করা হল। কিন্তু আরও নিশ্চিত হবার জন্য নীলাঞ্জন আমার আপিসে দেখতে এল আমার আদৌ মক্কেল-টক্কেল হয় কিনা। সত্যিই আমার মক্কেল-টক্কেল কম, তার ওপর আমার প্রতিবেশি আগরওয়াল, যার সঙ্গে আমার কদিন আগেই কথা কাটাকাটি হয়ে গেছে, নীলাঞ্জনকে আশ্বস্ত করল, আমি একদম বেকার কা আদমি। আমার মক্কেল-টক্কেল কিছুই হয় না। নীলাঞ্জন যেন অন্য কারো কাছে যায়। নীলাঞ্জন খুশি হয়ে চলে গেল।’
‘মন্দাকিনীর মতো নীলাঞ্জনও ধরে নিয়েছিল তাদের নিয়োগ করা গোয়েন্দাটি একটি ঢ্যাঁড়স। তাই সে কল্পনাও করেনি তার গুন্ডারা আমার হাতে মার খেতে পারে এবং পরে পুলিশের হাতে ধরা পড়তে পারে। এই সম্ভবনাগুলো মাথায় থাকলে সে হয়ত যে ছদ্মবেশে আমার আপিসে এসেছিল সেই একই ছদ্মবেশে গুন্ডাদের সামনে আসত না। আর একটু কম কনফিডেন্ট হলে সে হয়তো সম্পূর্ণ অন্য একটা ছদ্মবেশে সুব্রতবাবুর সঙ্গে নেগোশিয়েট করার লোকটিকে নিয়োগ করত। যাই হোক সব মানুষই তো ভুল করে। আর কোনও প্রশ্ন আছে?’
‘একটা প্রশ্ন আছে, ‘ শঙ্খমালা বলল। ‘মন্দাকিনী চৌধুরি তো একজন সেলিব্রিটি। তার মুখটা অনেক বাঙালিরই পরিচিত। সেক্ষেত্রে সে মরিশাসে থাকুক আর যেখানেই থাকুক, কোনও না কোনও বাঙালির তাকে চিনে ফেলার একটা সম্ভাবনা কিন্তু থেকেই যাচ্ছিল।’
‘সেই সম্ভাবনাটা তো গত সাত বছর ধরে, অর্থাৎ যবে থেকে পিস ইন্টারন্যাশানাল তৈরি হয়েছে তবে থেকেই, ছিল। ফলে মন্দাকিনীকে তার আসল চেহারাটা খানিকটা বদলাতে হয়েছিল। এজন্য তাকে একটা উইগ পরতে হয়েছিল। নকল দাঁতেরও সাহায্য নিতে হয়েছিল। মরিশাসের পাশপোর্ট এবং ন্যাশানাল আই ডি কার্ডে সেই পরচুলা এবং নকল দাঁত পরা ছবিটাই আছে। ক্যাজুয়ালি দেখলে বোঝা যাবে না ওটা মন্দাকিনী। কিন্তু ভাল করে খুঁটিয়ে দেখলে অবশ্যই বোঝা যাবে। আর প্রশ্ন?’
‘আর প্রশ্ন নেই, তবে বক্তব্য আছে। ধন্য আদিত্য মজুমদার, ধন্য তোমার বুদ্ধি।’ গৌতম গলা তুলে বলল।
(৪)
সোহিনী তার বাড়িতে নেমন্তন্ন করেছে। প্রথমে নন্দন গান গাইবে, তারপর ডিনার। অমিতাভ-রত্না তো যাবেই, গৌতমদেরও নেমন্তন্ন। গৌতম অবশ্য বলেছে অ্যা অ্যা গান শেষ হলে তারপর যাবে। নন্দনের গানের ভক্ত আরো কয়েকজনের আসার কথা। সোহিনী আদিত্যকে একটু আগে আগে পৌঁছতে বলেছিল। আদিত্য যখন পৌঁছল তখনও কেউ আসেনি। সোহিনী একা বসার ঘরে বসে আছে। নন্দন পাশের ঘরে তানপুরা ছাড়ছে।
‘শুদ্ধশীল ব্যানার্জি বললেন, চৌধুরি এন্টারপ্রাইজেসের মালিকানা রত্নাবলী আর আমার মধ্যে সমান ভাগে ভাগ হয়ে যাবে। শঙ্খদীপ যে উইলটা করেছিল সেটা আইনসিদ্ধ নয়, কারণ তাতে দুজন সাক্ষীর সই নেই, মাত্র একজনের আছে। তার ওপর মার্থা এখন জেলে। শঙ্খদীপের অংশটা তাই বোধহয় আমরাই পাব। বিরাট দায়িত্ব। এত বড় একটা ব্যবসা আমাদের চালাতে হবে। আমার আর কলম্বিয়া যাওয়া হল না।’ সোহিনী বলল।
‘ভাল হল। সুবীর চৌধুরির পরে আবার কম্পানির দায়িত্ব যোগ্য হাতে পড়ল। দুই বোন মিলে কম্পানি চালাবেন। এর থেকে ভাল আর কী হতে পারে? তাছাড়া আপনি কলকাতায় থেকে যাওয়া মানে নন্দনও পুনে যাচ্ছে না। অমিতাভ বলছিল এটা নন্দনের গানের পক্ষে খুব ভাল হবে। অমিতাভর মতে পুনে গেলে নন্দনের গানের খুব ক্ষতি হয়ে যেত।’
সোহিনী আদিত্যকে একটা সিগারেট দিয়ে নিজে একটা সিগারেট ধরাল। কিছুটা ধোঁয়া ছেড়ে বলল, ‘আপনি নিশ্চয় বুঝতে পারবেন আমি এখনও একটা ট্রমার মধ্যে আছি। হাজার হলেও নীলাঞ্জন মৈত্র, মন্দাকিনী চৌধুরি তো আমার নিজের বাবা-মা। তাদের কুকীর্তির কথা সারা পৃথিবী জেনে গেছে। সাংবাদিকদের ফোনের জ্বালায় ফোনটা বন্ধ করে রেখেছি। ল্যাণ্ডলাইনের নম্বরটা ভাগ্যিস কেউ জানে না। সেসব নয় সাময়িক প্রবলেম। কিন্তু যতদিন বাঁচব ততদিন বাবা-মার এই কলঙ্কের ভার আমাকে বহন করতে হবে। লোকে আমার দিকে আঙুল তুলে দেখাবে। এই অবস্থায় নন্দনই আমার একমাত্র অবলম্বন। ভাল দিকটা হলো আমার এই অবস্থা দেখে নন্দন অনেকটা রেসপনসিবল হয়ে গেছে। আমাকে খুব সাপোর্ট দিচ্ছে। নেশা করাটাও প্রায় ছেড়ে দিয়েছে।’
সোহিনী খানিকক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর খুব আস্তে আস্তে বলল, ‘বাবার মধ্যে ছোটবেলা থেকেই একটা ভায়োলেন্স লক্ষ করেছিলাম। একবার একটা বেড়াল আমাদের খুব জ্বালাচ্ছিল। আজ মাছ খেয়ে নেয়, কাল দুধে মুখ দেয়, আমাদের নাজেহাল অবস্থা। বাবা একদিন বেড়ালটাকে ধরে একটা লাঠি দিয়ে এত জোরে মাথায় মারল যে সেটার একটা চোখ সঙ্গে সঙ্গে নষ্ট হয়ে গেল। কিন্তু বেড়ালটা সঙ্গে সঙ্গে মরেনি। প্রায় এক সপ্তাহ আমাদের বাড়ির বাইরে বসে করুণভাবে বেড়ালটা কাঁদত। তারপর একদিন দেখলাম ওটা মরে পড়ে আছে। আমি তখন খুবই ছোট। ঘটনাটা আমাকে গভীরভাবে নাড়া দিয়েছিল। তারপর যত দিন গেছে, বাবার ভেতর একটা চাপা রাগ দানা বেঁধেছে। আমার মনে হয়, ইচ ফেলিওর মেড হিম মোর অ্যান্ড মোর অ্যাংরি অ্যান্ড ভায়োলেন্ট।’
‘আর আপনার মা?’
‘মাকে কোনদিন বাবার কথার ওপর কথা বলতে দেখিনি। বাবা যা বলত মা সব মেনে নিত। যেমন একজন বাধ্য অভিনেত্রী ডিরেক্টরের সব কথা মেনে নেয়। সেই মা যখন বাবাকে ছেড়ে সুবীর চৌধুরিকে বিয়ে করল, আমি ভীষণ অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। তখন মনে হয়েছিল, ডমিনেটেড হতে হতে মা বোধহয় হাঁপিয়ে উঠেছে, তাই বাবার কর্তৃত্ব থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে। এখন বুঝতে পারছি মা ওই কাজটাও বাবার নির্দেশেই করেছিল। মা সারা জীবন ডমিনেটেড হতেই চেয়েছিল।’
আদিত্য কী বলবে ভেবে পেল না। খানিকক্ষণ নীরবতার পর সোহিনী বলল, ‘জানেন, আমার ছোটবেলার খুব সুন্দর কিছু স্মৃতিও আছে। যেমন সব বাচ্চারই থাকে। বাবা-মার সঙ্গে চিড়িয়াখানা বেড়াতে যাচ্ছি, পুরী গেছি, রবিবার বাড়িতে মা মাংস রান্না করেছে, এইসব। মা খুব ভাল রান্না করত। সেই মাংসের স্বাদ এখনও মুখে লেগে আছে। আমরা তো খুব সুখী একটা পরিবারই ছিলাম। কী যে হয়ে গেল।’
আদিত্য কথা বলছে না। ইচ্ছে করেই সোহিনীকে কথা বলতে দিচ্ছে। সোহিনীর হঠাৎ কী যেন মনে পড়ে গেল। সে বলল, ‘ওঃ হো, ভুলেই গেছিলাম। আপনাকে একটা জিনিস দেবার ছিল।’ তারপর উঠে গিয়ে সে ড্রয়ার থেকে একটা কাগজের টুকরো বার করে নিয়ে এল। আদিত্য দেখল একটা চেক।
চেকটা আদিত্যর হাতে দিয়ে সোহিনী বলল, এটা পারিশ্রমিক নয়, চৌধুরি এন্টারপ্রাইজেসের পক্ষ থেকে অতি সামান্য একটা টোকেন অফ অ্যাপ্রিসিয়েশন। আপনি আমাদের জন্য যা করেছেন তার তুলনায় কিছুই নয়। আপনি এটা নিলে আমরা বাধিত হব।’
টাকার অঙ্কটা দেখে আদিত্যর চোখ ঝলসে গেল। সে প্রসঙ্গ পালটে বলল, নন্দন আজ কী গাইছে?’
‘সম্ভবত মিয়াঁ মল্লার। কদিন ধরে ওটাই তো রেওয়াজ করছে।’
আদিত্যর মনে পড়ে গেল মিয়াঁ মল্লার সম্বন্ধে তার বাবা কী বলেছিল। বাবা বলেছিল, ধর, খুব ঝমঝম করে বৃষ্টি পড়ছে, মিয়াঁ মল্লারের মুড কিন্তু সেটা নয়। বরং কল্পনা কর, খুব জোরে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। খাল-বিল নদী-নালাগুলো সব জলে টইটুম্বুর। মাঠগুলো সবুজ হয়ে আছে। আর আকাশে প্রচুর মেঘ রয়েছে। একটু পরেই আবার বৃষ্টি নামবে। অর্থাৎ চারদিকে একটা শান্তি, একটা ফুলফিলমেন্ট। এটাই মিয়াঁ মল্লারের আসল মুড।
ভাবতে ভাবতে আদিত্য শুনতে পেল নন্দন সুর লাগিয়েছে। মিয়াঁ মল্লার। অতি ঢিমা বন্দিশ, করিম নাম তেরো। দয়াময় তোমার নাম। খাদের শুদ্ধ নিষাদ লেগেছে। তারপর ষড়জ ছুঁয়ে খাদের কোমল নিষাদটা একেবারে নাভির গভীর থেকে উঠে এল। সোফায় হেলান দিয়ে আদিত্য চোখ বন্ধ করে ফেলেছে।
রচনাকাল জানুয়ারি, ২০১৮ — জুলাই, ২০১৮