ভূতুড়ে টেলিফোন – ২
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
(১)
আপিস বন্ধ করে রাস্তায় এসে আদিত্য দেখল বৃষ্টি থেমে গেছে। বাড়ি ফেরার পথে যেসব আপিসযাত্রী বৃষ্টির জন্য আটকা পড়েছিল, তারা একটু একটু করে রাস্তায় নামছে। ফুটপাথে মানুষের ট্র্যাফিক জ্যাম। আদিত্য একবার ভাবল কোনও রেস্তোরাঁতে ঢুকে কিছু খেয়ে নেবে। পকেটে আজ টাকা আছে। কিন্তু সারাদিন কিছু না খেয়ে খিদেটা যেন মরে গেছে। তাছাড়া আপিস থেকে বেরোবার আগে শ্যামলের আনা চারটে বিস্কুট সে খেয়ে বেরিয়েছে। আদিত্য বউবাজার স্ট্রিটের ভিড় ঠেলে খানিকটা এগিয়ে গিয়ে বিবাদী বাগে মিনিবাসের লাইনে দাঁড়াল। একডালিয়া রোডের মিনিবাস। সর্পিল লাইন এঁকেবেঁকে বহুদূর অব্দি চলে গেছে। একঘন্টার আগে বাস পাবার আশা নেই। আদিত্যর মেস হ্যারিসন রোড আমহার্স্ট স্ট্রিট মোড় থেকে মিনিট দুয়েক। এখন সে উল্টোদিকে যাবে। কাজ সেরে ফিরতে ফিরতে দশটা তো বাজবেই। তার মানে রাত্তিরের মিল বন্ধ হয়ে যাবে। অতএব মেসে ঢোকার আগে বাইরে কিছু খেয়ে নিতে হবে। সারাদিন না খেয়ে থাকলে শরীর টিকবে না। অবশ্য যেখানে যাচ্ছে সেখানেও খাবার জুটে যেতে পারে।
আজ মনটা খুব হালকা লাগছে। মনে হচ্ছে কাজটা ইন্টারেস্টিং হবে। প্রথমে যখন এই লাইনে এল তখন পেটের তাগিদে যা করতে হত সেগুলো ছিল নেহাতই ছোটখাট কাজ। করতে ভালোও লাগত না। তারপর তার একটু নাম হল। কয়েকটা বড় কাজ জুটল। তবে এবারে অনেক দিন বসে থাকতে হয়েছিল তাকে। সেদিক থেকে দেখলে এখন কিছুদিনের জন্য নিশ্চিন্ত। আদিত্য ভাবল, বাবা বেঁচে থাকলে কী বলত। নিশ্চয় তার এই কাজকে খুব একটা ভালো চোখে দেখত না। গোয়েন্দাগিরি দূরে থাক তার সাতপুরুষে কেউ পুলিশেও চাকরি করেনি। শুধু পুলিশে কেন, কোনও চাকরিই তার সাতপুরুষ করেনি। হয়তো সেই জন্যই তার আজ এই অবস্থা। পুরোনো জমিদারির জমা টাকায় কতদিন চলবে?
মাকে আদিত্যর মনেই পড়ে না। কিন্তু মায়ের অভাব বাবা তাকে কোনোদিন বুঝতে দেয়নি। ছোটবেলায় তার জীবনের সবটুকু জুড়ে ছিল তার বাবা। আর তার বাবার জীবনেও সে ছাড়া আর কেউ ছিল না। ছোটবেলায় আদিত্য জানত তারা খুব বড়লোক। বাড়িতে ঠাকুর-চাকর-দরোয়ান গিজ গিজ করত। বাড়ির গ্যারেজে দু’দু’টো বিদেশি গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকত। ইস্কুলের ছুটি পড়লে ফার্স্টক্লাশ কামরা রিজার্ভ করে বেড়াতে যাওয়া হত। প্রত্যেকবার একই জায়গায়। মধুপুরে। মধুপুরে তখন তাদের একটা মস্ত বড় বাড়ি ছিল। বাইরের ঠাটবাট বজায় থাকলেও ভেতরটা যে ক্রমশ ঝাঁঝরা হয়ে আসছে সেটা সেই বয়সে তার বোঝার কথা নয়।
বাবা তাকে কলকাতার দামি সাহেবি ইস্কুলে পড়িয়েছিল। তবে ইস্কুলের থেকেও ইস্কুলের বাইরে অনেক বেশি শিখেছিল সে। গানবাজনা, সাঁতার, শরীরচর্চা, সাহিত্যপাঠ কিছুই বাদ যায়নি। দেশ স্বাধীন হবার আগে আলোকপ্রাপ্ত জমিদার-পুত্ররা যেভাবে বড় হত ঠিক সেভাবেই সে বড় হচ্ছিল। পড়াশোনায় সে কোনোদিনই খারাপ ছিল না। ইস্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে প্রেসিডেন্সি কলেজে অঙ্ক অনার্স পড়তে ঢুকেছিল। অঙ্ক নিয়ে কলেজে ভর্তি হবার পেছনেও বাবা। অঙ্কের বাজার খারাপ, অঙ্ক নিয়ে পাশ করলে চাকরি পাওয়া যায় না, এসব কথা তার বন্ধুরা বলাবলি করত। কিন্তু বাবা বলত, যেটা ভালো লাগে সেটাই পড়। আসলে বিদ্যে বেচে পেট চালানোর কথা তাদের পরিবারে কেউ কখনো ভাবেনি। আর ছোটবেলা থেকেই অঙ্ক জিনিসটা আদিত্যর বেশ ভালো লাগত। কলেজে পড়ার সময় সে স্বপ্ন দেখত বড় হয়ে গাউস বা অয়লারের মত মস্ত ম্যাথামেটিশিয়ান হবে।
বি এসসি পাশ করার পর যখন তার কেম্ব্রিজে পড়াশোনা করতে যাওয়া প্রায় পাকা তখন হঠাৎ বাবা মারা গেল। বাবার মৃত্যুর মাস খানেকের মধ্যেই আদিত্য তাদের আসল অবস্থাটা বুঝতে পারল। ধার, ধার, চারদিকে শুধু ধার। কলকাতার বাড়ি তিনটে, মধুপুরের বাড়িটা সবই দেনার দায়ে বাঁধা পড়েছে। বাড়িগুলো গেল, গাড়িদুটোও, স্থাবর অস্থাবর যা কিছু ছিল প্রায় সবই গেল। ছ’মাসের মধ্যে আদিত্য পথে বসল। ঈশ্বর জানেন, এ নিয়ে তার মনে বিন্দুমাত্র ক্ষোভ নেই। হয়ত ছোটবেলা থেকে প্রাচুর্যের মধ্যে বড় হয়েছিল বলে বিত্তের ব্যাপারে তার একটা নিরাসক্তি এসে গিয়েছিল। শুধু বিলেত যাওয়াটা হল না বলে তার মনের কোণে এখনও কিছুটা দুঃখ রয়ে গেছে।
দারিদ্রের সঙ্গে মানিয়ে নিতে তার যে প্রথম প্রথম একটু অসুবিধে হয়নি তা নয়। কিন্তু বাবার মৃত্যুর পর বছর দুয়েক বাবার অভাবটা এমন তীব্রভাবে তার মন জুড়ে থাকত যে শারীরিক কোনও অস্বাছন্দ সে তেমন টের পেত না। যখন বাবার মৃত্যুর আঘাতটা একটু একটু করে সয়ে এল ততদিনে দারিদ্রটাও মোটামুটি অভ্যেস হয়ে গেছে। তবে মেসবাড়ির বাথরুমটা অনেকদিন পর্যন্ত তার ভীষণ নোংরা লাগত। বহুদিন পর্যন্ত বন্ধুবান্ধবের বাড়ি গিয়ে বাথরুম সেরেছে সে। এখন অবশ্য সেটাও অভ্যেস হয়ে গেছে।
আদিত্য যে কী করে এই অদ্ভুত গোয়েন্দাগিরির লাইনে এল সেটা তার নিজেরও ভালো করে মনে পড়ে না। বাবার মৃত্যুর পর তার জীবনটা একেবারে ছন্নছাড়া হয়ে গিয়েছিল। গত দশ-পনেরো বছর সে নানা ঘাটের জল খেয়েছে। পয়সার অভাবে এম এসসি-টা পড়া হয়নি। পেট চালানোর জন্য বাড়ি-বাড়ি গিয়ে ছাত্র পড়িয়েছে, একটা ইস্কুলেও বদলি হিসেবে কাজ করেছে। কিছুদিন, তা প্রায় বছর দেড়েক হবে, এক জাদুকরের সাকরেদি করেছে, এক বছর ঝাড়গ্রামের কাছে এক জঙ্গলে ফরেস্ট গার্ডের কাজ করেছে। কয়েক বছর একটা বেসরকারি আপিসে কেরানিগিরিও করেছে। কোনও কাজই তার ভালো লাগেনি। আসলে দশটা-পাঁচটা চাকরির ব্যাপারটা তার রক্তে নেই। চাকরি-বাকরি ছেড়ে দিয়ে কলকাতায় বসে আছে, এমন সময় একদিন তার সঙ্গে সুনন্দ সরকারের দেখা। সুনন্দ সরকার আদিত্যর সঙ্গে ইস্কুলে পড়ত। ওরা তিন পুরুষের ক্রিমিনাল লইয়ার। সুনন্দই তাকে একটু একটু করে এই লাইনে নিয়ে এসেছে। প্রথমে ছোটখাট কাজ। বেশির ভাগই ডিভোর্স কেস সংক্রান্ত। স্বামীর বিরুদ্ধে স্ত্রীর জন্য, স্ত্রীর বিরুদ্ধে স্বামীর জন্য প্রমাণ সংগ্রহ করার কাজ। করতে যে খুব একটা ভালো লাগত তা নয়। কিন্তু টুকটাক রোজগার হত। পেট চলে যেত। ইদানীং কয়েকটা জটিল সমস্যার সমাধানে পুলিশকে সাহায্য করার পর তার কিছুটা সুনাম হয়েছে। তবে টাকাপয়সার সমস্যাটা রয়েই গেছে। সুনন্দর পরামর্শমতো বছরখানেক হল এই আপিসটা ভাড়া নিয়েছে আদিত্য। সুনন্দরই এক ক্লায়েন্ট পুরোনো ভাড়ায় ঘরটা সাবলেট করেছে আদিত্যকে। মোটে দু’হাজার টাকা ভাড়া। তাও সে মাঝে মাঝে সময়মতো দিয়ে উঠতে পারে না।
(২)
একডালিয়া রোডের মিনিবাসটা যখন আদিত্যকে বালিগঞ্জ ফাঁড়ির মোড়ে নামিয়ে দিয়ে চলে গেল তখন সোয়া আটটা বেজে গেছে। কোয়ালিটির পাশের গলিটা ধরে হাঁটতে হাঁটতে আদিত্য বালিগঞ্জ প্লেসে এসে পড়ল। বৃষ্টির জন্য রাস্তাঘাট ফাঁকা। শুধু একটা ক্যারি আউট চিনে খাবারের দোকানের সামনে দু-একজন অপেক্ষা করছে। আর একটু এগিয়ে একটা মনিহারি দোকান। আদিত্য সেখান থেকে একটা বড় চকোলেট বার কিনল। তারপর রাস্তা পেরিয়ে ঢুকে পড়ল উল্টোদিকে একটা সাততলা বাড়ির ভেতর। লিফটে উঠে ছ’নম্বর বোতামটা টিপতে যাবে তার আগেই ভীষণ মোটা একজন মহিলা অসম্ভব ছোট একটা কুকুর কোলে নিয়ে হাঁসফাঁস করতে করতে লিফটে এসে উঠলেন। তিনজন কিশোরীও কলকল করে কথা বলতে বলতে লিফটে উঠল। লিফটে এত কম জায়গা যে কুকুরের মুখটা আদিত্যের গায়ে ঠেকছে। কুকুর নিয়ে আদিখ্যেতা আদিত্য একদম পছন্দ করে না। পাঁচতলায় কুকুরসহ ভদ্রমহিলা নেমে যাওয়া অব্দি আদিত্য ভয়ে সিটিয়ে রইল। কুকুরটা যদি চেটে দেয়। ছ’তলায় আদিত্যর সঙ্গে সঙ্গে মেয়েগুলোও নামল। নেমে বাঁদিকে বেঁকে গেল। আদিত্য ডানদিকে বেঁকে করিডোর ধরে কিছুটা এগিয়ে গিয়ে ৬০২ নম্বর ফ্ল্যাটে বেল বাজাল।
যে দশ বছরের শ্যামলা ছেলেটা কিছুক্ষণ বাদে দরজা খুলে দিল তার হাতে একটা খোলা ডটপেন। বোঝা যায় লেখাপড়া করছিল। আদিত্যকে দেখে তার মুখ উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। সে হইহই করে উঠল,
‘আদিত্যকাকু এসেছে। বাবা আদিত্যকাকু এসেছে।’
আদিত্য চকোলেট বারটা ছেলেটার হাতে তুলে দিয়ে বলল,
‘টুপলুবাবু এটা তোমার। ইস্কুল-টিস্কুল সব ঠিকঠাক চলছে তো?’
চকোলেট পেয়ে টুপলুবাবুর মুখে একরাশ দাঁত বেরিয়ে পড়ল। ওপরের সারির দাঁতের দু’কোণে দু’টো গজদাঁত।
‘থ্যাংকিউ আদিত্যকাকু, তুমি এখন অনেকক্ষণ থাকবে তো?’
‘অনেকক্ষণ থাকব।’
বাড়ির ভেতর থেকে পুরুষকন্ঠ শোনা গেল,
‘আদিত্য বোস। আমি আসছি। টুপলু তুমি তোমার ঘরে গিয়ে কালকের হোম-ওয়ার্কটা করে নাও। হয়ে গেলে আদিত্যকাকুর সঙ্গে গল্প করবে।’
আদিত্য যে ঘরটায় দাঁড়িয়েছিল সেটা এই ফ্ল্যাটবাড়ির বসার ঘর। একদিকে কয়েকটা বেতের চেয়ার, টেবিল, উল্টোদিকে নিচু একটা ডিভান, তিনদিকের দেয়াল জুড়ে বইয়ের র্যাক ছাত পর্যন্ত উঠে গেছে। অসংখ্য বই, কিছু বইয়ের র্যাকে জায়গা হয়নি, তারা ডিভানের ওপরে স্থান পেয়েছে। মেঝেতে দাঁড় করানো দু’টো বাঁকুড়ার ঘোড়া, একপাশে একটা জাপানি সাউন্ড সিস্টেম, ক্যাবিনেটের ভেতর প্রচুর রেকর্ড, টেপ, সিডি। আদিত্য পায়ের কাবলি জুতোটা খুলে ডিভানের ওপর জায়গা করে নিয়ে পা তুলে আরাম করে বসল।
‘কী ব্যাপার, দশ-পনের দিন তোর খবর নেই, মোবাইল অফ করে রেখেছিলি কেন?’ এবার রান্নাঘরের অন্তরাল থেকে নারীকন্ঠ শোনা গেল।’
‘মোবাইলে পয়সা ফুরিয়ে গিয়েছিল। পকেটেও। আজ পয়সা ভরলাম।’
‘মক্কেল পেয়েছিস নাকি?’ বলতে বলতে যে মহিলা রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলেন তাঁকে সুন্দরী বলবার জন্য কষ্ট করতে হয় না। কিন্তু রূপ ছাড়াও তাঁর চেহারায় একটা সহজ ব্যাক্তিত্ব আছে। অচেনা আধচেনা লোক চট করে তার কাছে ঘেঁসতে সাহস পাবে না।
‘আজ তুই রান্নাঘরে কেন? বিশেষ কেউ খাবে নাকি? আমি কিন্তু তাহলে কাটব।’ আদিত্য শঙ্কিত গলায় বলল।
‘কেউ খাবে না। তুই বোস। আমাদের কলেজের শিপ্রাদির বাড়িতে চিকেন বাগদাদি খেয়েছিলাম। রেসিপি নিয়ে আজ রাঁধছি। তুই এসে খুব ভালো হল। রাত্তিরে খেয়ে যাবি।’
‘নিশ্চয় খাব। তবে এখন একটা ডিম-টিম কিছু ভেজে দে। ভয়ঙ্কর খিদে পেয়েছে। সারাদিন ভারচুয়ালি কিছু খাওয়াই হয়নি।’
‘রত্না বলছিল তুই নাকি সন্ন্যাসী হয়ে হিমালয়ে চলে গেছিস।’ বলতে বলতে এবার বাড়ির কর্তা ভেতর থেকে বেরিয়ে এলেন। ‘শুনে টুপলুর কী কান্না।’
কর্তা-গিন্নী দুজনেই আদিত্যর সহপাঠী। রত্না, পোশাকি নাম রত্নাবলী মিত্র, প্রেসিডেন্সিতে ইতিহাস পড়ত। গত এগারো বছর কলকাতার একটা নামজাদা মেয়েদের কলেজে মাস্টারি করছে। তার স্বামী অমিতাভ মিত্র, কলেজ থেকে আদিত্যর বুসুম বাডি, অধুনা দেশের প্রথিতযশা ঐতিহাসিকদের অন্যতম। বাংলা করে বলতে গেলে, অল্প বয়সেই বেজায় নাম করেছে। রত্না-অমিতাভ-টুপলুই আদিত্যর একমাত্র পরিবার, যদিও ভবঘুরে স্বভাবের জন্য সে সব সময় এবাড়িতে এসে উঠতে পারে না। রত্না উঠে পড়ল। আদিত্যর জন্য কিছু খাবারের ব্যবস্থা করতে গেল।
‘শোন একটা দরকার আছে। ভুলে যাবার আগে বলে রাখি। তোদের হাউসিং সোসাইটিতে কাজ করত, সেই যে ছেলেটা, নাম বোধহয় বিমল না কি যেন, একবার আমাকে খুব হেল্প করেছিল। সে কি এখনও আছে?’
‘কে? বিমল গায়েন? না সে আর নেই। নতুন কমিটি তাকে তাড়িয়ে দিয়েছে। তবে আমার কাছে মাঝে মাঝে আসে। পঞ্চাশ-একশো টাকা নিয়ে যায়। কষ্টে আছে।’
‘একটা মোবাইল নম্বর দিয়েছিল না?’ রান্নাঘর থেকে রত্নার গলা শোনা গেল।’
‘হ্যাঁ, দিয়েছিল বটে। কখনও ফোন করিনি। তুই করে দেখতে পারিস।’ অমিতাভ বলল।
‘ঠিক আছে।’
‘নতুন কাজ পেলি?’
‘একটা পেয়েছি। আজই পেলাম। বেশ ইন্টারেস্টিং। বিমলকে লাগবে। ভাবছি ক’টা দিন গা ঢাকা দেব।’
‘ছদ্মবেশি গোয়েন্দা? দু’হাতে দু’টি উদ্যত পিস্তল, অপর হাতে টর্চ?’
‘বলতে পারিস। তবে পিস্তল-টিস্তল নেই। একটা টর্চ খোঁজাখুঁজি করলে বেরোতেও পারে। নতুন গান-টান শুনলি?’
‘এবার বম্বে গিয়ে সায়নি মুধোলকর বলে একটা বাচ্চা মেয়ের গান শুনলাম। আমাদের এক বন্ধুর বাড়িতে গাইল। গোয়ালিয়র, জয়পুর দুটো ঘরেই শিখেছে। বড় করে শুদ্ধ সারং গাইল, তারপর ছোট করে গৌড় সারং, বৃন্দাবনী সারং। বেশ গায়। তুই কিছু শুনলি?’
‘আমি আর নতুন কী শুনব? সেই পুরোনো আমীর খাঁ, আলি আকবর, নিখিল। নতুন কিছু শোনার ইচ্ছে থাকলেও হয়ে ওঠে না। তুই বিমলের নম্বরটা দে।’
অমিতাভ নম্বর খুঁজতে ভেতরে গেল। রত্না প্লেটে একটা ডিমের পোচ, দুটো টোস্ট আর কিছু পটেটো চিপস নিয়ে এসেছে।
‘এটা খেয়ে নে। চা হচ্ছে। বেশি দিলাম না, তাহলে রাত্তিরে খেতে পারবি না। তুই খা, আমি রান্নাটা দেখে আসি।’
আদিত্য খেতে খেতে বাঁ হাতে পকেট থেকে একটা সস্তার মোবাইল বার করল। তারপর পকেট হাতড়ে মন্টুবাবুর কার্ডটা। মন্টুবাবুর নম্বরটা লাগানোর কিছুক্ষণ পরে ওপাশ থেকে শব্দ শোনা গেল, ‘হ্যালুউউউ’?
‘আমি আদিত্য মজুমদার বলছি। কথা বলা যাবে? আশেপাশে কেউ আছে?’
‘কেউ নেই। আমি আপিসে একা। বলুন।’
‘ভেবে দেখলাম আপনার টেলিফোন রহস্য ভেদ করতে গেলে কিছুদিন আপনার বাড়িতে থাকতে হবে। বলাই বাহুল্য, ছদ্ম-পরিচয়ে। আপনার দূর সম্পর্কের ভাই-টাই কেউ আছে? যাকে আপনার স্ত্রী কখনও দেখেননি?’
ওপারে বেশ কিছুক্ষণ স্তব্ধতা। লাইনটা কেটে গেল নাকি? আদিত্য গলা তুলে বলল,
‘হ্যালো?’
‘হ্যাঁ, একটু ভাবছিলাম। আমার দিকে তেমন কেউ নেই। তবে আমার মেয়ের এক দেওর আছে। ভিলাইতেই থাকে। আমরা কখনও দেখিনি। একবার বলেছিল কী একটা ট্রেনিং নিতে কলকাতায় আসবে। দিনকতক আমাদের বাড়িতে থাকবে। শেষ পর্যন্ত আর আসেনি।’
‘আপনার মেয়ের দেওর সাজতে গেলে মেয়ের শ্বশুরবাড়ি সম্বন্ধে একটু জানতে হবে। কোনও ছবির এলবাম থাকলে পাঠিয়ে দেবেন। লোকগুলোকে চিনে নিতে হবে। শুধু আপনার মেয়ের শ্বশুরবাড়ির লোকদের নয়। আপনার পাড়াপড়শিদের ছবিও দু’চারটে পাওয়া গেলে ভালো হয়।’
‘এলবামগুলো বকুলের জিম্মায় থাকে। বার করে আনা মুস্কিল। দেখি কী করা যায়। কবে থেকে থাকতে চান?’
‘সপ্তাহখানেক পর থেকে। হাতে দু’একটা কাজ আছে, সেরে আসতে হবে। আপনাকে দু’তিনদিন আগে জানাব। আপনি এখন থেকেই বাড়িতে একটু আভাস দিয়ে রাখুন।’
‘ঠিক আছে। আমি দেখছি ছবির কী করতে পারি।’
‘নমস্কার।’
‘নমস্কার।’