ভূতুড়ে টেলিফোন – ৩
তৃতীয় পরিচ্ছেদ
(১)
কয়েক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেলেও গরমটা কাটছে না। আকাশ এখনও মেঘলা। যেকোনও সময় আবার বৃষ্টি আসতে পারে। আদিত্য চিত্তরঞ্জন হাসপাতালের সামনে বাস থেকে নেমে হাসপাতালের পাশের রাস্তায় ঢুকে পড়ল। সারি সারি ওষুধের দোকান, রুগিদের বাড়ির লোকজনের জটলা। একটু এগিয়ে একটা টেলিফোন বুথ। এই সাতসকালেই একজন ফোন করছে। আজকাল সকলেরই তো মোবাইল আছে, টেলিফোন বুথ থেকে ফোন করে কারা? বুথের উল্টোদিকের ফুটপাথে কচুরির দোকান। মস্ত কড়ায় কচুরি ভাজছে। পাশে রসের কড়ায় জিলিপি। দোকানে প্রচণ্ড ভিড়। শালপাতায় কচুরি-তরকারি নিয়ে আদিত্য রাস্তার একধারে দাঁড়াল। চমৎকার বানিয়েছে। তবে অম্বলের সম্ভাবনাও প্রবল। কচুরির পর জিলিপি। তারপর চা। পাশেই চায়ের দোকান। চায়ে চুমুক লাগাতে লাগাতে আদিত্য গুনে দেখল সে এখানে দাঁড়ানোর পর থেকে আরও চারজন লোক টেলিফোন বুথ ব্যবহার করেছে। তবে কেউই খুব বেশি সময়ের জন্য নয়। চা শেষ করে আদিত্য পুবদিকে হাঁটতে লাগল। ঘিঞ্জি রাস্তা সাপের মতো এঁকেবেঁকে রেল লাইন পর্যন্ত পৌঁছেছে। চারদিকে দিন শুরুর ব্যস্ততা। আদিত্যর মনে পড়ল জীবনানন্দের সেই পংক্তি, ‘মানুষের ঘন বসতির ভিড় নিরুত্তেজ রোদের ভিতরে/ ছড়ায়ে রয়েছে প্রাচী, অবাচীর, উদীচীর দিকে’। এখন অবশ্য নিরুত্তেজ বা তেজি কোনও রোদই নেই। বরং যেকোনও মুহূর্তে আবার বৃষ্টি নামার সম্ভাবনা।
আর একটু এগোতে সত্যি সত্যিই বৃষ্টি নামল। বেশ বড় বড় ফোঁটা। আদিত্যর সঙ্গে ছাতা নেই। সে দ্রুত পায়ে হেঁটে, খানিকটা দৌড়ে, একটা আধা তৈরি হওয়া বাড়ির ভেতর আশ্রয় নিল। বাড়ির বাইরের কাঠামোটা শুধু উঠেছে, ভেতরটা প্রায় ফাঁকা। মনে হয় বেশ কিছুদিন কাজকর্ম বন্ধ আছে। এখানে ওখানে রাবিশ, জঞ্জাল। একতলার এককোণে একটা ইঁট বার করা ঘর। বোধহয় একসময় ওভারশিয়ারবাবু এই ঘরে বসে কুলিদের মাইনেপত্র দিতেন, কাজের হিসেব রাখতেন। এখন ঘরটা ফাঁকা। বাইরে বৃষ্টিটা আরও জাঁকিয়ে এল। আদিত্য পায়ে পায়ে বাড়ির ভেতরে আর একটু এগিয়ে গিয়ে দেখল, দু’টো অল্পবয়সি ছেলে স্তূপীকৃত জঞ্জালের ওপর জবুথবু হয়ে বসে আছে। আদিত্যকে এগিয়ে আসতে দেখে তাদের একজন ঘোলাটে চোখ তুলে তাকাল। দৃষ্টিতে প্রাণ নেই। অন্যজনের মাথা এখনও নোয়ানো।
হঠাৎ তাদের পেছন থেকে আবির্ভূত হলেন এক বলিষ্ঠ চেহারার মহিলা যাকে মহিলা না বলে মেয়েমানুষ বলাটাই সমীচীন। নিকষ কালো রঙ, বেশ লম্বা-চওড়া, পরনে ক্যাটক্যাটে হলুদ রঙের স্লিভলেস চুড়িদার। বাহুতে শৈশবের টিকে ওঠা দাগের ওপর সোনার মাদুলি। পানের রস ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে গলে থুতনিতে নেমেছে।
‘ক্যা কাম হ্যায়? কী চাই?’ খ্যানখ্যানে গলায় মেয়েমানুষটি বলল।
‘কাম কুছ নেহি হ্যায়। বৃষ্টির জন্য আটকে গেছি।’ আদিত্য মিনমিনে গলায় বলল।
‘অন্দর কিঁউ ঘুসা? আপনা বাপকা মকান সমঝা ক্যা?’
অপমানে আদিত্যর কানদু’টো ঝাঁঝাঁ করে উঠল। কিন্তু উত্তর দেবার আগেই মেয়েমানুষটা চেঁচিয়ে উঠল, ‘আব্দুল, এ আব্দুল। এক সালা জাসুসকা বচ্চা অন্দর ঘুস আয়া। তু আকে দেখ।’
ডাক শুনে বাড়ির পেছন দিক থেকে মাঝারি উচ্চতার এক ব্যক্তি বেরিয়ে এল। সঙ্গে আর একজন। আদিত্য মনে মনে ঠিক করে নিল প্রথমজনই আব্দুল। আব্দুল আদিত্যকে অনেকক্ষণ জরিপ করল। তারপর ঠান্ডা গলায় বলল, ‘এখানে কী দরকার?’
‘বৃষ্টিতে আটকে পড়েছি ভাই।’ আদিত্য নিরীহ গলায় বলল।
‘আপনাকে আগে তো পাড়ায় দেখিনি। কোথায় যাবেন?’
‘হিঙ্গন জমাদার লেন। লাইনের ওপারে।’
‘কত নম্বরে যাবেন? কার বাড়ি?’
‘সাতাশ নম্বরে, মন্টুবাবুর বাড়ি। আমি ওর মেয়ের শ্বশুরবাড়ির লোক। ভিলাইতে থাকি।’
আব্দুল কিছুক্ষণ ভাবল। আরও একবার আদিত্যকে জরিপ করে নিল। তারপর বলল, ‘সোজা চলে যান। এ পাড়াটা ভালো নয়। যেখানে সেখানে ঢুকবেন না। একটা রেল লাইন পেরিয়ে আর একটা রেল লাইনের গায়েই হিঙ্গন জমাদার লেন।’ আব্দুলের গলাটা প্রায় ভদ্র শোনাল।
বৃষ্টি এখনও সমানভাবে ঝরে যাচ্ছে। এখন বেরোলে একেবারে ভিজে যেতে হবে। তবু এই ঝুট-ঝামেলার মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকার চেয়ে বেরিয়ে পড়াই ভালো। রাস্তার দিকে এগোতে এগোতে আদিত্য আড়চোখে দেখল, পাথরের মতো বসে থাকা ছেলে দু’টোর একজন মেঝেতে শুয়ে পড়েছে। তার মুখ দিয়ে গ্যাঁজলা বেরোচ্ছে। মরে-টরে যাবে না তো? আদিত্য একবার ভাবল দাঁড়িয়ে গিয়ে ছেলেটাকে সাহায্য করে। পরমুহূর্তেই তার মনে হল এখানে দাঁড়িয়ে গেলে বিপদ আছে। এ নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই যে ছেলে দু’টো ড্রাগ নিয়েছে। আর যে অর্ধনির্মিত বাড়িটাতে সে ঘটনাচক্রে ঢুকে পড়েছে সেটা ড্রাগ ব্যবসায়ীদের একটা গোপন আস্তানা। খুব গোপন অবশ্য নয়। প্রায় রাস্তার ওপরেই খোলাখুলি ড্রাগের ব্যাবসা চলছে। আশ্চর্য। আদিত্য বৃষ্টির মধ্যে বেরিয়ে পড়ল। খানিকটা এগিয়ে পিছন দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল আব্দুল ও তার সাথী সেই বাড়িটার ভেতর থেকে স্থির দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে।
(২)
একটু আগে মন্টুবাবুর লোক এসে একটা খাম দিয়ে গেছে। খামের ভেতর দু’টো পুরোনো ছবি আর একটা চিঠি। একটা ছবিতে শিশু কোলে একটি পৃথুলা যুবতী। অন্য ছবিতে জনা কয়েক পুরুষ ও মহিলা একটা নদীর ধারে সার বেঁধে খেতে বসেছে। চিঠিতে মন্টুবাবু লিখেছেন,
মাননীয় আদিত্যবাবু,
আপনার কথামতো দু’টি ছবি পাঠালাম। একটি ছবি চড়ুইভাতির। বিয়ের আগে বকুল পরিবারের সকলের সঙ্গে কোলাঘাটে পিকনিক করতে গেছিল, এটা সেই সময় তোলা। পিকনিকে পাড়ার কয়েকজনও ছিল। এটা একটা পুরোনো ব্যাগের মধ্যে অন্যান্য কাগজপত্রের সঙ্গে পেলাম। ছবিতে বাঁদিক থেকে তিন নম্বর ব্যক্তি আমার ছোট শ্যালক দেবীরঞ্জন, তার ডান পাশে সুশান্ত এবং সুশান্তর ডানপাশে বকুল। লাইনের একেবারে শেষে বকুলের বড়দা রজনীরঞ্জন। দ্বিতীয় ছবিটা আমার কন্যা সুলতার। কোলে আমার নাতি। ছবিটা নাতির অন্নপ্রাশনের সময় তোলা। আমি গিয়ে উঠতে পারিনি, তাই ছবি তুলে পাঠিয়ে দিয়েছিল। বকুলকে বলেছি আমার মেয়ের দেওর ভিলাই থেকে আসছে। ক’টা দিন থাকবে। বকুল সহজভাবেই নিয়েছে। কুশল জানবেন। কবে আসছেন কয়েকদিন আগে জানালে ভালো হয়।
ইতি
জিতেন্দ্রনাথ দত্ত (মন্টুবাবু)
(৩)
‘আমাকে ডেকেছিলেন স্যার?’ অফিসের দরজাটা ঈষৎ ফাঁক করে বিমল উঁকি মারল।
‘হ্যাঁ, তোমার বন্ধুর মোবাইলে ফোন করেছিলাম। বোসো।’
‘বন্ধু নয় স্যার, আমার ইস্ত্রির দাদা। ওকে ফোন করে দিলে আমি খবর পেয়ে যাই।’ বিমল বসতে বসতে বলল।
‘ইস্ত্রির দাদা? তোমার বিয়ে হয়ে গেছে নাকি?’
‘সে কি আজকে স্যার? গোঁফ ওঠার আগেই বাবা বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন।’
‘ছেলেপুলে? তাও আছে?’
‘তা স্যার বিয়ে হলে তো ছেলেপুলে হওয়াটাই দস্তুর। আমারও হয়েছে পছন্দসই দু’পিস। একটা ছেলে, একটা মেয়ে।’
‘তাহলে তো তোমার সুখের সংসার।’
‘তা আপনাদের আশীর্বাদে সংসারে সুখের অভাব নেই। তবে কিনা মাঝে মধ্যে ডাল-ভাতের অভাব হয়। এখন যেমন অভাব চলছে। মাস ছ’য়েক হয়ে গেল চাকরিটা চলে গেছে স্যার।’
‘চলছে কী করে?’
‘এই টুকটাক কাজ করে চালাচ্ছি স্যার। গিন্নিকেও একটু আধটু সেলাই-ফোঁড়াই-এর কাজ করতে হয়।’
‘শোনো, তোমার জন্য একটা কাজ আছে। টিকটিকির কাজ। আগে যেমন দু’একবার করে দিয়েছ। পারবে?’
‘নিশ্চয় পারব স্যার। ব্যাপারটা বলুন।’
আদিত্য পিকনিকের ছবিটা বিমলের হাতে দিল।
‘ছবির বাঁ দিক থেকে তিন এবং চার নম্বরের ওপর নজর রাখতে হবে। তিন নম্বরের নাম দেবীরঞ্জন বসাক, চার নম্বর সুশান্ত হালদার। তারা কোথায় যায়, কী করে সব জানাবে। তবে খুব সাবধানে কাজ করতে হবে। দুজনেই জেল-ফেরত দাগি আসামি। সঙ্গে অস্ত্র-টস্ত্র থাকাও বিচিত্র নয়।’
‘আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন স্যার। শুধু বলুন ওরা থাকে কোথায়।’
‘চিত্তরঞ্জন হাসপাতালের গা দিয়ে যে রাস্তাটা এঁকেবেঁকে রেল লাইন অব্দি চলে গেছে সেটা পেরিয়ে আর একটা রেল লাইন। এই দ্বিতীয় রেল লাইনটার ধারে এদের সাইবার কাফে। চেনা খুব সোজা। আমি একবার গিয়ে দেখে এসেছি। ও-চত্বরে আর কোনও সাইবার কাফে নেই। এই কাগজটা রাখ। এতে নাম ঠিকানা সব লেখা আছে।’
‘রাখছি স্যার, তবে ও আমার লাগবে না। একবার শুনলেই সব মনে থাকে।’
‘ছবিটার একটা কপি করবে। আজকাল ডিজিটাল ফটোর দোকান হয়েছে। বউবাজারেই দু’চারটে আছে। ওখানে গেলেই কপি করে দেবে। কপিটা নিজের কাছে রেখে আসলটা আমাকে ফেরত দিয়ে যাবে। আর একটা কথা। মেডিকেল কলেজের উল্টোদিকে আরপুলি লেনে মন্টুবাবুর প্রেস। মন্টুবাবু এবং তার প্রেস সম্বন্ধে যাবতীয় খবর জোগাড় করবে।’
‘ঠিক আছে স্যার। আজ উঠি?’
‘দাঁড়াও। এই টাকাটা নাও। দু’হাজার আছে। তোমার অ্যাডভান্স। আর এই নাও আরও একশো টাকা। ছবি কপি করার খরচ।’
‘থ্যাঙ্ক ইউ স্যার। খুব উপকার হল স্যার।’
বিমলের চোখ দু’টো কৃতজ্ঞতায় চিকচিক করে উঠল।
(৪)
আজকাল লালবাজারে ঢোকার নানান হ্যাপা। ঢোকার মুখে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আগে মোবাইল জমা রাখতে হবে। তারপর কম্পিউটারে নাম এন্ট্রি। বলতে হবে কোন ডিপার্টমেন্টে যেতে চাই। কেন যেতে চাই। যার কাছে যেতে চাই তার অনুমতি আছে কিনা। আগে কয়েকবার এইভাবেই আদিত্যকে ঢুকতে হয়েছে, তাই আদিত্য জানে। ইদানীং অবশ্য অত সব কিছু করতে হয় না। আদিত্যর কলেজের সহপাঠী গৌতম দাশগুপ্ত, জাঁদরেল আইপিএস অফিসার, কয়েক বছর হল জেলা থেকে বদলি হয়ে লালবাজারে এসেছে। আদিত্য মাঝে মাঝেই গৌতমের কাছে সাহায্যের জন্য আসে। গৌতম গেটে বলে রেখেছিল। আদিত্য নাম বলতেই গেটের পুলিশ মহা খাতির করে তাকে ভেতরে ঢুকিয়ে নিল। একজন সাদা পোশাকের পুলিশকে বলল, ‘স্যারকে দোতলায় পৌঁছে দিয়ে এস।’
দোতলায় ওয়েটিং রুম, এয়ার কন্ডিশন চলছে। কয়েকজন বসে রয়েছে, আদিত্য একপাশে গিয়ে বসল। সেন্টার টেবিলে কয়েকটা ম্যাগাজিন, খবর কাগজ। লালবাজারের ভেতরে এমন একটা ঘর আছে সে-ই কি আগে জানত? বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না। মিনিট দু’তিন পরেই একজন লম্বা-চওড়া অবাঙালি লোক, সে-ও নিশ্চয় পুলিশ, দরজার গোড়ায় এসে বলল, আদিত্য মজুমদার কে আছেন, স্যার ডাকছেন।
দরজার বাইরে পেতলের ফলকে লেখা গৌতম দাশগুপ্ত, আইপিএস, জয়েন্ট কমিশনার, ক্রাইম। দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতে না ঢুকতেই গৌতমের গমগমে গলা শোনা গেল, ‘আয়, আয়, কোথায় ডুব মেরেছিলি?’
কলেজে পড়ার সময় গৌতম চোখ বুজে খুব ভাব-টাব দিয়ে জর্জ বিশ্বাসের স্টাইলে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইত। তখন কে ভেবেছিল সে পুলিশ হবে?
মস্ত বড় ঘর। তার সঙ্গে মানানসই টেবিল। টেবিলে গোটা চারেক টেলিফোন। ডানদিকের দেয়ালে সাহেবি আমলের পুলিশ কর্তাদের ছবি। বাঁ দিকের দেয়ালে দিশি কর্তাদের। আদিত্য লক্ষ করেছে, ডানদিকে সাহেবদের ছবিগুলোর মধ্যে একজন দিশি লোকের ছবিও আছে।
‘তুই আমাকে না দেখলেও তোকে আমি মাঝেমাঝেই টিভিতে দেখি।’ আদিত্য বসতে বসতে বলল। ‘তোর চেহারাটা কিন্তু দিন দিন ভারিক্কি হচ্ছে।’
‘তুই আগের মতোই রয়ে গেলি। রোগা, টাফ। শরীরচর্চা করিস এখনও?’
‘খানিকটা করি। বাকিটা বাসে-ট্রামে যাতায়াত করলেই হয়ে যায়।’
‘তোর সমস্যাটা বল। টেলিফোনে বললি বলতে সময় লাগবে। তোর জন্য একঘণ্টা রেখেছি। সাড়ে চারটেয় মিটিং আছে। চা খাবি তো?’
গৌতম বেল বাজিয়ে বেয়ারাকে ডাকল। যখন টি ব্যাগ সহ দু’কাপ গরম জল এসে পৌঁছল, ততক্ষণে আদিত্য তার সমস্যার কথা বলতে শুরু করেছে।
গৌতম আদিত্যর কথাগুলো ভীষণ মন দিয়ে শুনছে। এত মন দিয়ে আগে কখনও শুনেছে কিনা আদিত্যর মনে পড়ছে না। চা ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে। দেখতে দেখতে ঘড়িতে সোয়া চারটে বেজে গেল।
আদিত্য বলছিল, ‘তুই দেবী বসাক আর সুশান্ত হালদারের পুলিশ রেকর্ডটা একটু বার করে দে। কবে জেলে গিয়েছিল, কী দুষ্কর্ম করেছিল সব জানতে হবে। আর ওই আধা তৈরি হওয়া বাড়িটার ওপর নজর রাখতে পারিস। আমি শিওর ওখানে ড্রাগের একটা ঠেক আছে। তবে এখখুনি কাউকে অ্যারেস্ট করলে আমি একটু ঝামেলায় পড়ব। আমাকে ওই পাড়ায় কিছুদিন কাটাতে হবে। আমার মুখ ওরা নিশ্চয় চিনে রেখেছে।’
এতক্ষণ পরে গৌতম মুখ খুলল, ‘তোর এই কেসটাতে আমাদের বিশেষ ইন্টারেস্ট আছে। সত্যি বলতে কি, তোর গল্পের অনেকটাই আমাদের আগে থেকে জানা। তবে অন্যদিক থেকে শোনারও একটা দাম আছে। দাঁড়া, আর একবার চা বলি। তারপর আমাদের দিকটা তোকে বলছি।’
গৌতম একটা লাল রঙের ফোন তুলে বলল, ‘উপাধ্যায় সাহেব, মিটিংটা আধঘণ্টা পেছাতে হবে। খুব জরুরি কাজে আটকে গেছি। বাইরের কেউ তো আসছে না। আপনি ইন্টারনাল সকলকে জানিয়ে দিন।’ বেয়ারা আবার চা দিয়ে গেল। এবার আর টি-ব্যাগ নয়। টিপটে চা, চিনি দুধ আলাদা। চায়ে একটা লম্বা চুমুক লাগিয়ে গৌতম বলতে শুরু করল :
‘গোবরার ওই অঞ্চলটার ওপর অনেকদিন পুলিশের নজর আছে। ওখানে যে ড্রাগ পাচারের একটা হাব আছে অনেকদিন ধরেই আমরা সেটা টের পাচ্ছিলাম। কিন্তু ওখানকার লোকাল থানার যিনি কর্তা ছিলেন, তিনি বিশেষ সুবিধের লোক ছিলেন না। আমাদের কাছে পরিষ্কার খবর ছিল ড্রাগ মাফিয়ারা তার জন্য একটা মোটা মাসোহারার ব্যবস্থা করে দিয়েছে, ফলে ড্রাগ ট্র্যাফিকিং আটকানোর ব্যাপারে দারোগা সাহেবের খুব একটা উৎসাহ নেই। আমাদের দু’-দু’জন ইনফরমার খুন হল। ওই অঞ্চলে যে ইন্টেলিজেন্স নেটওয়ার্কটা তৈরি হয়েছিল সেটাও সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ার উপক্রম হল। এটা বছর ছয়েক আগেকার কথা বলছি। আমি তখনও এই চেয়ারে আসিনি। দারোগা সাহেবের খুঁটির জোর ছিল তাই তাকে অন্য থানায় বদলি করাটা সহজ কাজ ছিল না। শেষ পর্যন্ত আমার পূর্বসূরি অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে একেবারে ওপরমহলে ধরাধরি করে সেই অতি কঠিন কাজটা সম্পন্ন করলেন।’
‘তারপর?’
‘থানার বড়বাবু হয়ে নতুন যিনি এলেন, সেই বাসুদেব কানুনগো, চমৎকার অফিসার। অ্যাওয়ার্ড পাওয়া। আসার বছরখানেকের মধ্যেই তিনি আবার একটা ইনফর্মেশন নেটওয়ার্ক গড়ে তুললেন, কয়েকটা চুনোপুঁটিকে জেলেও ভরা হল, তারপর রাঘব বোয়ালটিকে ধরার জন্য জাল পাতা হল। তখন আমি এখানে এসে গেছি। আমাদের সব থেকে বড় অসুবিধে ছিল এই যে, দলের পাণ্ডা কে বা কারা সে ব্যাপারে আমাদের কোনও ধারণাই ছিল না। অনেকটাই অন্ধকারে ঢিল ছোড়া। তবে আমরা জানতাম মেঘের আড়ালে মেঘনাদ যিনিই হোন, তিনি কাছেপিঠেই কোথাও থাকেন।’
‘ভেরি ইন্টারেস্টিং। তারপর কী হল?’
‘আমাদের পাতা জালে দেবী বসাক আর সুশান্ত ধরা পড়ল। আমরা ভাবলাম পেয়ে গেছি আমাদের আসল লোকদের। কিছুদিনের মধ্যেই আমাদের ভুল ভাঙল। যাদের ধরেছি তারা নেহাতই চুনোপুঁটি। আসল লোক বাইরে রয়ে গেছে। ফলে ড্রাগ পাচার আগের মতই চলছে। লাভের মধ্যে, আবার আমাদের একজন ইনফর্মার খুন হল। তাছাড়া বোঝার ওপর শাকের আঁটি, দেবী এবং সুশান্তর বিরুদ্ধে তেমন জোরাল প্রমাণ জোগাড় করা গেল না। নানান অছিলায় ওদের দু’বছর লক-আপে আটকে রাখলাম, কিন্তু তারপর তারা আদালতে বেল পেয়ে গেল। এখনও বেলেই আছে, কেস উঠলে কী হবে জানি না। আমাদের জুডিশিয়াল সিস্টেমের হাল জানিস তো।’
একটুক্ষণ চুপ করে রইল গৌতম। তারপর বলল, ‘দেবী আর সুশান্ত যখন জেলে অথচ ড্রাগের ব্যবসা পুরোদমেই চলছে, সেই সময় আব্দুল আজিজ বলে এক ব্যক্তির কথা আমরা জানতে পারলাম। খবর পেলাম, দেবী-সুশান্তর অনুপস্থিতিতে তার ওপরেই সাম্রাজ্য চালানোর ভার পড়েছে। তবে নানা ঘটনা থেকে এটা স্পষ্ট হল যে সে নিজে পালের গোদা নয়। অন্তরীক্ষ থেকে কেউ তাকে চালাচ্ছে। আব্দুলকে তুই দেখেছিস। যে বাড়িটায় তুই ঘটনাচক্রে ঢুকে পড়েছিলি আব্দুল সেটার কেয়ারটেকার। বাড়িটার ওপর পুলিশের নজর আছে। কিন্তু বার কয়েক রেড করেও তেমন ইনক্রিমিনেটিং কিছু পাওয়া যায়নি। শুধু দু’চারটে ড্রাগ অ্যাডিক্ট ছোকরা ধরা পড়েছে। বাড়ির ভেতরে নেশা করে বসেছিল, ঠিক তুই যেমন দেখেছিলি। বাড়ির মালিক মহম্মদ আসলাম দুবাইতে থাকে, আপাতত আমাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে। তবে তার সম্বন্ধে অনেক কথাই আমরা জানি। এক সময় সে ওই অঞ্চলের ড্রাগ ডিলারদের মাথা ছিল। তারপর চারদিকের হাওয়া খুব গরম হয়ে গেলে সে দুবাই পালিয়ে যায়। আর ফিরে আসেনি। অবশ্য কেন সে বাড়িটা আধখানা তৈরি করে ফেলে রেখেছে সেটা আমাদের জানা নেই। সে যাই হোক, এবার আসল কথায় আসি।’
গৌতম পকেট থেকে একটা কৌটো বার করে একটা লবঙ্গ মুখে ফেলল। আদিত্যকেও একটা দিল। আদিত্যর মনে পড়ল গৌতম সিগারেট ছাড়ার চেষ্টা করছে।
‘হ্যাঁ, যা বলছিলাম। দেবী-সুশান্ত লক-আপ থেকে বেরোনোর পর আমাদের স্ট্র্যাটেজি ছিল তাদের ওপর কড়া নজর রাখা। আশা, তাদের মধ্যে দিয়ে আসল লোকের কাছে পৌঁছে যেতে পারব। নজর রাখার কাজটা ইন্সপেক্টর কানুনগো ভালোই করছিলেন। মাঝে মাঝে তাদের এবং আব্দুলকে আলাদা আলাদা করে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদও করা হচ্ছিল। এই সময় একদিন ইন্সপেক্টর কানুনগো আমাকে ফোন করলেন। খুব উত্তেজিত। বললেন, ‘একটা খুব দরকারি লিড পেয়েছি স্যার। মনে হচ্ছে কিছুদিনের মধ্যেই পালের গোদাটাকে ধরে ফেলতে পারব। এখনই কিছু বলছি না, কারণ আমার ধারণাটা এখনও খানিকটা অনুমান-নির্ভর’।’
গৌতম খানিকক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর থেমে থেমে বলল,
‘এর কয়েকদিন পরে ট্রেন লাইনের ধারে ইন্সপেক্টর কানুনগোর গলা কাটা লাসটা পাওয়া যায়।’
ঘরে নিস্তব্ধতা। লালবাজারের এই ভেতর মহলে বহির্বিশ্বের কোলাহল খুব একটা পৌঁছয় না। শুধু একটা দেয়াল ঘড়ি টিকটিক করছে। কিছুটা জিরিয়ে নিয়ে গৌতম আবার বলতে শুরু করল,
‘কানুনগো ঠিক কী লিড পেয়েছিল, কতটা এগিয়েছিল, কিছুই আমাদের জানা নেই। তার বাড়ি থেকে একটা পকেট ডায়েরি পাওয়া গেছে। কিন্তু তাতে কাজের কিছু আছে বলে মনে হয় না। শুধু লাল দাগ দেওয়া একটা টেলিফোন নম্বর আছে। আর পুরোনো ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট একটা ছবি ডায়েরির মধ্যে ছিল। আমার মনে হচ্ছিল নম্বরটা থেকে হয়ত কোনও লিড পাওয়া গেলেও যেতে পারে।’
গৌতম ড্রয়ারের ভেতর থেকে একটা খাম নিয়ে তার থেকে একটা ছোট ছবি বার করে আদিত্যর হাতে দিল। বছর পঁচিশেকের এক অচেনা যুবতীর ছবি। একটু মোটার দিকে গড়ন। বারান্দার রেলিং-এ ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আদিত্য অনেকক্ষণ ধরে ছবিটার দিকে তাকিয়ে রইল। নিঃসন্দেহে একে আদিত্য কোনোদিন দেখেনি। তবু কোথাও একটা অস্বস্তি থেকে যাচ্ছে। ছবিটা কিছু একটা বার্তা দিচ্ছে যেটা সে ধরতে পারছে না।
‘কীরে, ছবি দেখে প্রেমে পড়ে গেলি নাকি?’ গৌতম খাম থেকে একটা চিরকুট বার করেছে। চিরকুটটা আদিত্যর হাতে দিয়ে গৌতম বলল, ‘এই নম্বরটাই কানুনগোর ডায়েরি থেকে পাওয়া গেছে। নম্বরটা লিখে রাখ। পরে কাজে লাগতে পারে।’
কাগজটার দিকে তাকিয়ে এবার আদিত্যর শিরদাঁড়া দিয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল। নম্বরটা মন্টুবাবুর বাড়ির। যে নম্বরে ভূতুড়ে টেলিফোন আসে।