ভূতুড়ে টেলিফোন – ৪
চতুর্থ পরিচ্ছেদ
(১)
আমহার্স্ট স্ট্রীট, যার এখন নাম হয়েছে রামমোহন সরণি, যেখানে হ্যারিসন রোড অর্থাৎ অধুনা মহাত্মা গান্ধী রোড-এর সঙ্গে এসে মিশেছে তার খুব কাছে, একটা ছোট গলির মধ্যে শঙ্কর হোটেল। নামে হোটেল হলেও আসলে এটা আধা হোটেল, আধা মেসবাড়ি। তিনতলা বাড়িটার একতলায় বিচিত্র সব বিপণীর সমাহার—জামাকাপড়ের শোরুম, জুতোর আড়ত, ইলেকট্রিকাল গুডস-এর দোকান, সাবেকি মিষ্টান্ন ভাণ্ডার, এমনকি একটা জ্যোতিষীর আপিসও আছে। দোতলায় হোটেল। মূলত শেয়ালদা স্টেশন দিয়ে মফস্বল থেকে কলকাতায় কাজে আসা মানুষ, যাদের তেমন ট্যাঁকের জোর নেই, দু’চারদিনের জন্য এখানে থেকে যায়। হোটেলটা চলে ভালো, বিশেষ করে এই কারণে যে, হোটেলের পাচক ভানু ঠাকুরের রান্নার খ্যাতি আছে। অল্প তেল-মশলায় চমৎকার ডাল-তরকারি-মাছের ঝোল নাকি ভানু ঠাকুরের মতো কম লোকই রাঁধতে পারে।
তিনতলায় মেসবড়ি। থ্রি-সিটার, টু-সিটার এবং সিঙ্গল রুম তিন রকম ব্যবস্থাই আছে। আদিত্য তিনতলার এক কোনায় একা একটা ঘর নিয়ে থাকে, বাথরুমটাও তার নিজস্ব। এর জন্য তাকে মাসে মাসে কিছু বেশি টাকা গুনতে হয়, এবং সেই টাকা দিতে মাঝেমধ্যে অসুবিধেও হয়, কিন্তু তার খানদানি রক্ত এর নীচে নামতে নারাজ। বারান্দার একদিকে একটা এজমালি খাবার ঘর আছে, সকাল ও রাত্তিরের ভাত সেখানেই পরিবেশিত হয়। খাবার আসে দোতলায় ভানু ঠাকুরের হেঁসেল থেকে। সপ্তাহে একবার খাদ্যতালিকায় মুরগি দেখা যায়, মাসের শেষ রবিবার পাঁঠার মাংস। জলখাবারের ব্যবস্থা যে যার নিজের দায়িত্ব, তবে মেসের চাকর বলরামকে একটা সামান্য মাসোহারা দিলে সে রাস্তার উল্টোদিকের দোকান থেকে ভোরবেলার চা-বিস্কুট ঘরে পৌঁছে দেয় আর রোববারে টোস্ট-মামলেট কিংবা সিঙ্গাড়া-জিলিপি।
সকাল সাড়ে-নটায় বিমলের ফোন এল, ‘আপনি কি বাড়িতে আছেন স্যার? কিছু খবর দেবার ছিল। ফোনে অত কথা বলা যাবে না।’ আধঘণ্টার মধ্যে বিমল সশরীরে হাজির।
‘ব্যাপার কি? এত কাহিল দেখাচ্ছে কেন?’
‘সেই ভোরবেলা বেরিয়েছি স্যার। একটু চা খাওয়াবেন?’
আদিত্য ঘর থেকে বেরিয়ে বলরামকে চা-জলখাবারের কথা বলে এল। বাইরে চড়া রোদ্দুর উঠেছে। আদিত্যর ঘরটা তিনতলায় বলে ছাদের গরমে তাড়াতাড়ি তেতে ওঠে। তবু জানলা দু’টো বন্ধ করে দিলে খানিকটা ঠাণ্ডা। আদিত্য জানলা বন্ধ করতে গিয়ে একটু অন্যমনস্ক হয়ে গেল। আকাশে গোটা কয়েক ঘুড়ি উড়ছে। আজকাল শহরের দক্ষিণ বা পুবদিকে ঘুড়ি তো দেখাই যায় না। তবু এই উত্তর-মধ্য কলকাতায় দু’চারজন এখনও ঘুড়ি ওড়ায়। আদিত্য ছোটবেলায় বাবার সঙ্গে অনেক ঘুড়ি উড়িয়েছে, বাড়িতে মাঞ্জাও দিয়েছে। বিশ্বকর্মা পুজো কতদিন দেরি?
‘মন্টুবাবুর প্রেসে গিয়েছিলাম স্যার।’ চেয়ারে পা ছড়িয়ে বসে বিমল একটু ধাতস্থ হয়েছে। ঘরে একটাই চেয়ার। আদিত্য দেয়ালে ঠেশ দিয়ে খাটের ওপর আরাম করে বসল।
‘মন্টুবাবুর প্রেসে গিয়ে বললাম, একটা স্যুভেনির ছাপাতে চাই। ভাগিয়ে দিচ্ছিল স্যার। বলল, এখানে ওসব ছোটখাট কাজ হয় না। দেখলাম সত্যিই মোটা মোটা টেস্ট পেপার, নোটবই, গল্প-উপন্যাস এইসব ছাপা হচ্ছে। ভাবছি কী করব এমন সময়, কী বলব স্যার, আশ্চর্য কপাল, আমাদের পাড়ার গোপীনাথবাবুর শালার সঙ্গে দেখা। উনি ওই প্রেসেই অ্যাকাউন্টস-এ কাজ করেন। গোপীনাথবাবুর ছেলের বিয়ের সময় আমার সঙ্গে খুব আলাপ জমেছিল। আমাকে দেখে খুব খুশি। বললেন, দু’পা এগিয়ে মোড়ের কাছে একটা ছোট প্রেস আছে, ওরা স্যুভেনির-টুভেনির ছাপে। তারপর বললেন, চলুন চা খেয়ে আসি।’
‘শালাবাবু বেজায় গপ্পে লোক। চা খেতে খেতে অনেক কথা বলে গেলেন। সবটা আপনার কাজে লাগবে না। শুধু মন্টুবাবুর সম্বন্ধে যেটুকু বললেন সেটুকু বলছি। শালাবাবু আগেও দু’একটা প্রেসে কাজ করেছেন। কিন্তু তাদের তুলনায় মন্টুবাবুর প্রেসটা অনেক বড়। তাছাড়া, শালাবাবুর মতে মন্টুবাবুর মতো মালিক হয় না। এত বছর চাকরি হল, কখনও মাইনে পেতে দেরি হয়নি। প্রেসের লাইনে কটা প্রেস মন্টুবাবুর মতো নিয়মিত মাইনে দিতে পারে? আসলে, প্রেসের ব্যবসায় বড় বড় পেমেন্ট অনেক সময়েই আটকে যায়। আর পেমেন্ট আটকে গেলে কর্মচারীদের মাইনেও আটকে যায়। কখনও একমাস, কখনও বা তিনমাস। মালিক কি আর ঘরের টাকা থেকে ওয়ার্কারদের মাইনে দেবে? মন্টুবাবুরও যে মাঝেমধ্যে পাওনা টাকা আটকে যায় না তা নয়। অ্যাকাউন্টস-এর লোক হিসেবে শালাবাবু এটা ভালোই জানেন। কিন্তু মন্টুবাবু কখনও এর জন্য কর্মচারীদের মাইনের টাকা ফেলে রাখেন না। এই কারণে কেউ চট করে মন্টুবাবুর কাজ ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যায় না। শালাবাবুর মাঝে মাঝে মনে হয়, টাকাপয়সা ম্যানেজ করার ব্যাপারে মন্টুবাবু যেন যাদুকর। ব্যবসায় সাময়িকভাবে টাকার টানাটানি হলে পাকা যাদুকরের মতো কোনও যাদুর থলি থেকে টাকা বার করে সব সামলে দেন।
মন্টুবাবুর প্রেসে নিয়মিত নতুন যন্ত্রপাতি আসে। একেবারে আধুনিক যন্ত্রপাতি। ছাপার লাইনে আজকাল সর্বত্রই কম্পিউটার ঢুকেছে। কিন্তু মন্টুবাবু ছাপার কাজে কম্পিউটার এনেছেন অন্তত পনেরো বছর আগে। কারোর চাকরি যায়নি। যত্ন করে সকলকে কম্পিউটার ট্রেনিং করিয়েছেন। দু’একজন যারা নেহাতই শিখতে পারেনি তাদের প্রেসের মধ্যেই অন্য কাজ দিয়েছেন।
এককথায়, মন্টুবাবুকে তাঁর কর্মচারীরা দেবতার মতো ভক্তি করে, আবার ভালোও বাসে। মন্টুবাবুর প্রথম স্ত্রীকেও কর্মচারীরা খুব ভক্তি করত। তিনি অবশ্য মাত্রই কয়েকবার প্রেসে এসেছেন। তাঁর শরীর ভাল থাকত না। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি অপঘাত মৃত্যুতে তিনি চলে যাবেন কর্মচারীরা কেউ ভাবেনি।’
‘কী বললে? মন্টুবাবুর প্রথম স্ত্রীর অপঘাত মৃত্যু হয়েছিল?’ আদিত্য এতক্ষণ চুপ করে শুনছিল। মাঝে মাঝে নোটও নিচ্ছিল। প্রশ্নটা অজান্তেই তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল।
‘শালাবাবু তাই তো বললেন। মন্টুবাবু স্ত্রী-কন্যা নিয়ে দার্জিলিং বেড়াতে গিয়েছিলেন। সঙ্গে পাড়ারও কেউ কেউ ছিলেন। মন্টুবাবুর স্ত্রী পাহাড় থেকে পা পিছলে খাদে পড়ে যান এবং সেখানেই তাঁর মৃত্যু হয়। হাসপাতালেও নিয়ে যাওয়া যায়নি। এর কিছুদিন পরেই মন্টুবাবু আবার বিয়ে করেন।’
‘হুঁ, ইন্টারেস্টিং। তা মালিকের দ্বিতীয় পক্ষ নিয়ে কী শুনলে?’
‘দ্বিতীয় পক্ষকে কর্মচারীরা খুব বেশি চেনে না। একবার মাত্র দেখেছে। মনে হয়, দ্বিতীয় বিয়েটা মন্টুবাবু কিছুটা চুপিসাড়েই করেছিলেন। ফলে খবরটা প্রেসে পৌঁছতে খানিকটা সময় লেগেছিল। খবরটা পেয়ে সকলেই একটু অবাক হয়েছিল। একটু দুঃখও পেয়েছিল। মন্টুবাবুর প্রথম স্ত্রীকে সকলেই ভালবাসত। বুড়োবয়সে আবার বিয়ে করাটা সাহেবদের দেশে চললেও, আমাদের সমাজে এখনও তেমন চালু হয়নি। অন্য কারও সঙ্গে যাক বা না যাক, শালাবাবুর মতে, দ্বিতীয় বার বিয়ে করার ব্যাপারটা মন্টুবাবুর সঙ্গে ঠিক যায় না।’
‘বিয়ের পর মন্টুবাবুর কোনও পরিবর্তন দেখা গেছিল?’
‘আমি ঠিক এই প্রশ্নটাই শালাবাবুকে করেছিলাম। শালাবাবু বললেন, দ্বিতীয় বার বিয়ে করার পর মন্টুবাবু পোশাক-আসাকে ফিটফাট হয়েছেন, চুলে কলপ পড়েছে। তবে প্রেসের কাজ বা কর্মচারীদের প্রতি ব্যবহারে কোনও তফাত দেখা যায়নি। প্রেস আগের মতোই রমরম করে চলছে।’
বলরাম চা-জলখাবার দিয়ে গেল। বিমলের জন্য চা-জলখাবার, আদিত্যর জন্য শুধু চা। চায়ের কাপে একটা লম্বা চুমুক দিয়ে আদিত্য বলল, ‘সুশান্ত হালদার, দেবী বসাকের সঙ্গে দেখা হয়েছে? তারা কী করছে?’
‘এখনও দেখা হয়নি স্যার। গত কয়েকদিন সাইবার কাফে বন্ধ ছিল। আজ আর একবার দেখব। নইলে অন্য রাস্তা ভাবতে হবে। তবে একটা আশ্চর্য জিনিস লক্ষ্য করলাম। সাইবার কাফেটা মন্টুবাবুর বাড়ির ঠিক পেছন দিকে। মাঝখানে একটা দেয়াল আছে আর একটা সরু গলি। তাই সোজাসুজি যাওয়া যায় না। পুরোনো দেয়াল। পাড়ার লোকে বলল আগে ওখানে একটা ওষুধের কারখানা ছিল। তারা তুলেছিল। আমি সাইবার কাফের ধারে ঘোরাঘুরি করছিলাম, শুনতে পেলাম মন্টুবাবুর বাড়ি থেকে কথাবার্তা ভেসে আসছে, টেলিফোন বাজছে।’
‘শুনতে পেলে টেলিফোন বাজছে?’
‘হ্যাঁ স্যার, স্পষ্ট শুনতে পেলাম।’
‘শোনো, আজ বিকেল থেকে কয়েকদিন আমি মন্টুবাবুর বাড়িতে থাকব। অবশ্য অন্য নামে। ওই পাড়ায় আমার সঙ্গে দেখা হয়ে গেলে না চেনার ভান কোরো। ফোন খোলা থাকবে। খুব দরকার পড়লে ফোন করবে, নাহলে নয়।’
‘ঠিক আছে স্যার।’
(২)
অমিতাভ-রত্না দুপুরে খাওয়ার নেমন্তন্ন করেছিল। বলেছিল সকাল থেকে চলে আসিস। অনেকদিন ভাল আড্ডা হয় না। এখানে ব্রেকফাস্ট খাবি। বিমল এসে পড়ায় দেরি হয়ে গেল। আদিত্য অবশ্য ফোন করে ওর দেরি হবে জানিয়ে দিয়েছে।
দুপুর বারোটা নাগাদ একটা ছোট ব্যাগে কিছু জামাকাপড়, টুথপেস্ট-টুথব্রাস এবং আরও কিছু টুকিটাকি ভরে আদিত্য বেরিয়ে পড়ল। অমিতাভদের ওখান থেকে একেবারে মন্টুবাবুদের বাড়ি চলে যাবে। মন্টুবাবুকে বলা আছে। মেস থেকে বেরিয়ে মহাত্মা গান্ধী রোড অব্দি হেঁটে এসে মেট্রো ধরবে। যতীন দাস রোডে নেমে বালিগঞ্জ ফাঁড়ি অব্দি অটো, তারপর আবার মিনিট পাঁচেক হাঁটা। বেশ কিছু নতুন তথ্য পাওয়া গেছে। এলোমেলো অনেক তথ্য। তার মধ্যে কিছু প্রয়োজনীয়, কিছু ততটা নয়, আবার কিছু মারাত্মক রকমের দরকারি। মুস্কিল হচ্ছে, কোনটা দরকারি, কোনটা অদরকারি আগে থেকে বোঝা যায় না। তিনজনের কাছ থেকে তিন সেট ইনফরমেশন পাওয়া গেছে। এক, মন্টুবাবুর কাছ থেকে, দুই, পুলিশকর্তা গৌতম দাশগুপ্তর কাছ থেকে, এবং তিন, বিমলের মাধ্যমে জনৈক গোপীনাথবাবুর শ্যালকের কাছ থেকে যিনি মন্টুবাবুর প্রেসে বেশ কিছুদিন কাজ করছেন। এই তথ্যগুলোকে একে অপরের সঙ্গে ক্রস চেক করতে হবে।
আদিত্য যখন অমিতাভ-রত্নাদের বাড়ি পৌঁছল তখন ঘড়িতে প্রায় দেড়টা। বেল বাজাতে অমিতাভ নিজেই দরজা খুলে দিল।
‘আয়, আয়। এত দেরি করলি কেন?’
‘আরে আমি তো অনেক আগেই আসতে চেয়েছিলুম। সকালে বিমল এল। কথা বলতে বলতে দেরি হয়ে গেল। তারপর মেট্রোর জন্য আধঘণ্টা দাঁড়িয়ে। একে রবিবারে ট্রেন কম, তার ওপর আবার যান্ত্রিক গোলযোগ।’
‘রত্না তোর জন্য জম্পেশ ব্রেকফাস্ট বানিয়েছিল। তোর তো সকালে উঠে মুখ ধুয়েই চলে আসার কথা।’
‘আমার কপালটা জানিস তো কোনদিনই ভাল নয়। যাই হোক মধ্যাহ্নভোজনে উসুল করে নেব। মাটন হয়েছে মনে হয়। সারা বাড়িতে দারুণ গন্ধ ছড়াচ্ছে। টুপলু কোথায় রে?’
‘টুপলু ওপরের তলায় বন্ধুর বাড়িতে ভূগোলের নোট মেলাতে গেছে। একখুনি চলে আসবে। ভেবেছিলাম তুই এলে আজ একসঙ্গে শুধু ভীমপলাশি শুনব। সেই মত অনেকগুলো ভীমপলাশি বেছে রেখেছিলাম। সব শোনা হবে না। তবে এইটা শোন। সিক্সটিসে আলি আকবর খাঁ সাহেব কারো বাড়িতে বাজিয়েছিলেন। অনেক কষ্টে জোগাড় করেছি।’
‘এতক্ষণে আসার সময় হল?’ রত্না ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলল। কোমরে আঁচল গোঁজা, কপালে ঘাম।
‘উপায় ছিল না রে। লোক এসে গেছিল। তার ওপর মেট্রোতে দেরি। তুই খুব লেবার দিয়ে রান্না করেছিস দেখতে পাচ্ছি। যা গন্ধ ছাড়ছে না, মনে হচ্ছে একখুনি খেতে বসে যাই।’
‘শুধু আমি লেবার দেবো কেন? একটা মাছ তো অমিতাভ রেঁধেছে। স্যালাডটাও ও-ই বানিয়েছে।’ রত্না এবার স্বামীকে ধমক লাগাল,
‘অ্যাই, এখন ওসব গান-টান রাখো। আগে আমরা খেয়ে নিই। তারপর যত খুশি গান হবে। আদিত্যর নিশ্চয় নাড়িভুঁড়ি হজম হয়ে যাচ্ছে। তুমি ওপরের ফ্ল্যাটে ফোন করে টুপলুকে চলে আসতে বল। বল, আদিত্যকাকু এসে গেছে।’
‘আমি এখনও তো চানই করিনি।’
‘করবে কী করে? সকাল থেকেই যে কালোয়াতি গান চলছে। একখুনি চান করতে যাও।’
‘ঠিক আছে, তুমি টুপলুকে ডাক, আমি চানটা সেরে আসি। আদিত্য, তুই একা বসে বসে কী করবি? আলি আকবর খাঁ সাহেবের ভীমপলাশিটা শোন।’
রত্না টেবিল সাজাচ্ছে। আদিত্যর সত্যিই খিদে পেয়েছে। খাবার ঘর থেকে নানা সুগন্ধ ভেসে আসছে। আলি আকবর কোমল গান্ধার লাগালেন, একটু মোচড় দিয়ে কোমল নিষাদ হয়ে, ধৈবত হয়ে, খাদের পঞ্চমে থিতু হলেন। ছ’তলার এই ঘরটা থেকে পুবদিকে অনেক দূর অব্দি দেখা যায়। এদিকের আকাশটা নির্মেঘ হলেও পুবদিকের আকাশ কালো হয়ে এসেছে। ওদিকেই তো মন্টুবাবুর বাড়ি, তাকে একটু পরেই যেতে হবে। খাঁ সাহেব গান্ধার-মধ্যম-পঞ্চম নিয়ে খেলা করছেন। কালো মেঘের পোশাকে একটা অজানা অশুভ যেন পুবদিকটা জুড়ে রয়েছে। অমিতাভ-রত্নার এই শান্তির আলয়ের অনেক বাইরে। দু’টো নতুন খবর সে জানতে পেরেছে। এক, মন্টুবাবুর ভূতুড়ে টেলিফোন নম্বরটি পুলিশের খাতায় রয়েছে। পুলিশ মনে করছে নম্বরটার পেছনে কোনও রহস্য আছে। দুই, মন্টুবাবুর প্রথম স্ত্রীর অপঘাত মৃত্যু হয়েছিল। খবরটা মন্টুবাবু চেপে গেলেন কেন? কিন্তু এই দু’টো ছাড়াও আরও কিছু দরকারি খবর কেউ কেউ দিয়েছে। সেগুলো আদিত্যর সামনেই আছে। তার মন বলছে আছে। তবু সে ঠিক ধরতে পারছে না। বিশেষ করে কানুনগোর ডায়েরিতে সযত্নে রেখে দেওয়া ছবিটা তাকে খুব ভাবাচ্ছে। খাঁ সাহেব খাদের নিষাদ থেকে উঠতে উঠতে পঞ্চমে পৌঁছনোর বদলে মধ্যমে দাঁড়িয়ে গেলেন। আর অমনি সারা পৃথিবী জুড়ে একটা মস্ত হাহাকার তৈরি হল। এত দুঃখ কোথায় জমে ছিল এতদিন? আদিত্যর একেবারে ভেতর থেকে একটা ‘ও হো হো হো’ ধ্বনি বেরিয়ে এল।
‘খাবার তৈরি, চলে আয়।’ রত্না খেতে ডাকছে।
(৩)
শহরের এই অঞ্চলে এখনও সাইকেল রিক্সা চলে। একে রবিবারের বিকেল, তার ওপর আকাশ কালো করে এসেছে। রাস্তায় খুব বেশি লোকজন নেই। বৃষ্টির আশঙ্কায় আদিত্য একটা রিক্সাতে উঠে পড়ল। হাসপাতালের চৌহদ্দি পেরিয়ে কিছুটা ভেতরে ঢুকলেই মফস্বল। একতলা-দোতলা বাড়িগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে, মাঝে-মধ্যে মাঠ, পুকুর, খাপরার ছাউনি দেওয়া চা-বিস্কুটের দোকান। তবু তার মধ্যেই দু’একটা অর্বাচীন ছ’সাততলা বাড়ি এলোপাথাড়িভাবে হঠাৎ গজিয়ে উঠেছে। মনে করিয়ে দিচ্ছে, কিছুদিনের মধ্যেই মহানগর এসে এই নিরভিমান মফস্বলকে গিলে খাবে। কিছুক্ষণ চলার পর লেভেল ক্রসিং, ভাগ্য ভাল খোলা রয়েছে। লেভেল ক্রসিং পেরিয়ে কিছুক্ষণ চলার পর রিক্সা জরাজীর্ণ পাঁচিল-ঘেরা একটা বিস্তীর্ণ অঞ্চলের ধারে এসে পড়ল। জায়গায় জায়গায় ভেঙেও পড়েছে পাঁচিল। অনেকটা জমি ফাঁকা পড়ে রয়েছে। রিক্সাওলার কাছ থেকে জানা গেল এখানে আগে একটা ওষুধের কারখানা ছিল। ঘোড়ার রক্ত থেকে ধনুষ্টঙ্কারের ওষুধ তৈরি হত। ভেতরে ছিল ঘোড়ার আস্তাবল। অনেক ঘোড়া ছিল। ঘোড়াগুলো মরে গেছে। কারখানাও বন্ধ হয়ে গেছে বহুদিন। পরিত্যক্ত কারখানার পেছন দিয়ে চলে গেছে আরেকটা ট্রেনের লাইন।
রিক্সাওলা রাস্তা চেনে। দ্বিতীয় ট্রেন লাইনটা পেরোনোর আগেই আদিত্যকে নিয়ে সে একটা গলিতে ঢুকে পড়ল। দু’-তিনটে বাড়ির পরেই সাতাশ নম্বর। পুরোনো দোতলা বাড়ি, কিন্তু এক ঝলক দেখলেই বোঝা যায়, যত্নে আছে। একতলায় লাল সিমেন্টের বারান্দা। গাছ-গাছালি ঢাকা লাল সুরকির পথ দিয়ে বারান্দায় উঠে আদিত্য কলিংবেল বাজাল। কিছু পরে অন্তরীক্ষে পায়ের শব্দ, দরজা খুলে গেল। একজোড়া দীঘল জিজ্ঞাসু চোখ আদিত্যকে মাপছে।
‘নমস্কার। আমার নাম সূর্য, সূর্যশঙ্কর সাহা। আমি ভিলাই থেকে আসছি। এটা কি জিতেন্দ্রনাথ দত্তর বাড়ি?’
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, আসুন, আসুন। আমার স্বামী আপনার কথা বলেছেন। আপনি সুলতার দেওর তো? উনি একটু বাইরে গেছেন, আধঘণ্টার মধ্যেই ফিরে আসবেন।’
‘আমি আপনাদের খুব অসুবিধে করে দিচ্ছি।’ আদিত্য কুণ্ঠিতভাবে বলল।
‘অসুবিধে কীসের? আমাদের এখানে কেউ আসে না। ফাঁকা বাড়িটা পড়ে আছে। কেউ এসে থাকলে আমাদের খুব ভাল লাগবে। আপনার থাকার ঘরটা দেখিয়ে দিচ্ছি। আগে একটু চা খান। ও হ্যাঁ, বলতে ভুলে গেছি, আমার নাম বকুল।’
বাইরের বারান্দার মতো ভেতরের দালানটাও লাল সিমেন্টের, ধারে কালো বর্ডার। দালানের একপাশে বসার ঘর। বকুল আদিত্যকে নিয়ে বসার ঘরে ঢুকল। একটা পুরোনো সোফাসেট, গোল টেবিলে কয়েকটা সিনেমা পত্রিকা, মেয়েদের ম্যাগাজিন। ঘরের একদিকে একটা কাচের আলমারির ওপরের তাকে একসেট শরৎ গ্রন্থাবলী সমেত কিছু বাংলা উপন্যাস, একটা গীতবিতান। নীচের তলায় দু’একটা কেষ্টনগরের পুতুল, কিছু কাপ-প্লেট, যেগুলো দেখলেই বোঝা যায় তারা কালেভদ্রে ব্যবহৃত হয়। অন্যদিকে একটা ডিভান, তার ওপর শাড়ি জড়ানো একটা বাদ্যযন্ত্র শোয়ানো আছে। দেখে মনে হয় তানপুরা। আদিত্য সোফার এককোণে গুটিসুটি মেরে বসল। তাকে খুব একটা অভিনয় করতে হচ্ছে না। সে স্বভাবে ভীষণ মুখচোরা।
‘আসলে, আমার ট্রেনিংটা গতকাল শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু কিছুতেই আগামী শুক্রবারের আগে ট্রেনের টিকিট পেলাম না। গত তিন সপ্তাহ ব্যাঙ্কের গেস্ট হাউসেই ছিলাম। ট্রেনিং শেষ হয়ে গেলে তো আর থাকতে দেবে না। তাই ভাবছিলাম কোথায় যাই। তখন আপনাদের কথা মনে পড়ল। খুব সঙ্কোচ হচ্ছিল। খুব একটা সম্পর্ক তো আর রাখা হয় না।’
‘আপনি এত কিন্তু কিন্তু করছেন যে আমারই খারাপ লাগছে। আরাম করে ক’টা দিন থাকুন। কলকাতা দেখুন। মালতী, চা বসাও।’ শেষের কথাগুলো, বলাই বাহুল্য, নেপথ্যে থাকা কোনও পরিচারিকার উদ্দেশে।
‘আপনাদের পাড়াটা কিন্তু বেশ নিরিবিলি। আগেও কয়েকবার কলকাতায় এসেছি কিন্তু এদিকটা কখনও আসা হয়নি। আমরা ছোট শহরের লোক, একটু নিরিবিলি ভাল লাগে।’
‘আপনি ভিলাইতে কতদিন আছেন?’
‘তা প্রায় কুড়ি বছর। তার আগে রায়পুরে থাকতাম। মধ্যপ্রদেশেই আমাদের জন্ম-কম্ম। বাবা চাকরি করতে গিয়ে আর ফেরেননি। এখন অবশ্য ছত্তিসগড়।’
‘সে তুলনায় আপনার বাংলাটা কিন্তু একটুও টোল খায়নি।’
আদিত্য ভেতরে ভেতরে একটু থতমত খেল। পশ্চিমা বাঙালির বাংলা সে শুনেছে। কিন্তু সেটা নকল করা তার পক্ষে অসম্ভব।
‘আসলে কি জানেন আমরা দু’ভাই ঠাকুমার কাছে মানুষ। ঠাকুমার বাড়ি ছিল দর্জিপাড়া। সেই ভাষাটাই মুখে বসে গেছে। তাছাড়া বাড়িতেও খানিকটা বাংলার চর্চা ছিল। সব বাড়িতে তো থাকে না।’
মালতী টিপটে চা নিয়ে এসেছে। সঙ্গে ক্রিম ক্র্যাকার বিস্কুট।
‘আপনি চায়ে চিনি দুধ খান তো?’
‘না না চিনি দুধ নয়, শুধু লিকার। আগেই আমার বলা উচিত ছিল।’
‘কোনও অসুবিধে নেই তো। মালতী আলাদা করে লিকারই এনেছে। চিনি দুধ না মেশালেই হল। আমি আবার দুধ চিনি ছাড়া চা খেতে পারি না। নিন।’
বকুল চায়ের কাপ এগিয়ে দিল। আদিত্য বকুলকে যত দেখছে, তত অবাক হচ্ছে। আধুনিক, সপ্রতিভ, বুদ্ধিমতী। গায়ের রঙ কিছুটা চাপা, সুন্দরীও হয়তো ঠিক বলা যাবে না, কিন্তু চেহারার একটা আশ্চর্য আকর্ষণ আছে। ইংরেজি করে বললে, সেক্স অ্যাপিল। এরকম মেয়ের কপালে মন্টুবাবুর মতো দোজবর জুটল কেন?
‘ছত্তিসগড় শুনেছি খুব সুন্দর জায়গা। কখনও যাইনি। দেশের মধ্যে খুব বেশি ঘোরা হয়নি। একবার শুধু দার্জিলিং গিয়েছিলাম। সেখানেই তো সেই ভয়ঙ্কর ঘটনাটা ঘটল। নিশ্চয় সুলতা বলেছে। ও তখন ইস্কুলে পড়ে।’
আদিত্য খানিকটা আন্দাজ করতে পারছে কোন ঘটনার কথা বকুল বলছে। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে চুপ করে থাকাই ভাল। ভাগ্যবশত, বকুল কথা বলার মেজাজে আছে।
‘পাহাড় খুব সুন্দর লেগেছিল। কী বিশাল। হিমালয় বলে কথা। আচ্ছা, আপনাদের ভিলাইতে পাহাড় আছে?’
আদিত্য প্যাঁচে পড়েছে। প্রশ্নটার উত্তর সে সত্যিই জানে না। ভিলাইয়ের যে দু’একটা ছবি সে দেখে এসেছে তার একটাতেও পাহাড় নেই। কিন্তু বলা যায় না, শহরের বাইরে ছোটখাট টিলা থাকতেই পারে। বিন্ধ্যপাহাড়ের রেঞ্জটা তো ওইসব জায়গা দিয়েই গেছে। এত কম জেনারেল নলেজ নিয়ে গোয়েন্দাগিরিতে আসা উচিত নয়। আপিসে একটা ইন্টারনেট সহ কম্পিউটার থাকলে দেখে আসা যেত।
‘ঠিক পাহাড় নেই, আশেপাশে কিছু টিলা আছে।’ আদিত্য আন্দাজে ঢিল ছুঁড়ল।
আর ঠিক তখনই, যেন তাকে অস্বস্তির হাত থেকে রেহাই দেবার জন্য, ঘরের একটা অদৃশ্য কোণ থেকে তারস্বরে বেজে উঠল টেলিফোন। টেলিফোনটা যে ঘরের ভেতরেই ছিল আদিত্য এতক্ষণ খেয়ালই করেনি।
(৪)
‘এই পাড়ায় আমাদের প্রায় পঞ্চাশ বছর হয়ে গেল। একটা ওষুধের কারখানা ছিল এখানে। টিটেনাসের ওষুধ বানাত। কারখানাটা চলল না। হয়তো আরও আধুনিক ওষুধ বাজারে বেরিয়ে গিয়েছিল। সে যাই হোক, কারখানার কিছু জমি যখন বিক্রি হচ্ছিল আমার বাবা খানিকটা কিনে নেন। বাবারও একটা প্রেস ছিল, তবে আমার বর্তমান প্রেসটা নয়। বউবাজার অঞ্চলে আরও ছোট একটা প্রেস। এই অঞ্চলটা তখন প্রায় গ্রামই ছিল। বাবা জমিটা সস্তাতে পেয়েছিল। তারপর বাড়ি তৈরিটা নেশার মতো পেয়ে বসেছিল বাবাকে। সত্যি বলতে কি, এত বড় বাড়ি বানানোর সামর্থ্য বা প্রয়োজন কোনটাই বাবার ছিল না। শুধু এই বাড়িটা বানিয়েই ক্ষান্ত থাকেনি। পাশের বাড়িটাও বাবার বানানো। অনেকদিন ফাঁকা পড়েছিল। বছর পাঁচেক হল ভাড়াটে বসিয়েছি।
একটা ব্যাপার, কারখানার বাকি জমিগুলো এই পঞ্চাশ বছরেও বিক্রি হল না। দেখবেন, এখনও ওইভাবেই পড়ে আছে। কীসব মামলা মকদ্দমা এখনও নাকি চলছে শরিকদের মধ্যে। একদিক থেকে আমাদের ভালই হয়েছে, জায়গাটা ঘিঞ্জি হয়ে যায়নি। আবার উলটোদিকে ওই পোড়ো কারখানার ভেতর নানা ক্রিমিনাল অ্যাক্টিভিটি বাসা বেঁধেছে। লোকে বলে ড্রাগ পেডলারদের আখড়া। দিনের বেলাতেও পাড়ার ভদ্রলোক ওর ভেতরে ঢোকে না। মাঝে মাঝে দেখি পুলিশ আসে। তবে সকলেই জানে পুলিশের সঙ্গে ড্রাগ চালানকারীদের বিশেষ ভালবাসা আছে।’
মন্টুবাবু দম নেবার জন্য থামলেন। আদিত্য সিগারেট ধরাল। রাত্তিরে খাওয়া-দাওয়ার পর দুজনে হাঁটতে বেরিয়েছে। এপাড়ায় রাস্তার আলোগুলো কিছু জ্বলে, বেশিভাগই জ্বলে না। বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে আলো-আঁধারি। তার ওপর পরিত্যক্ত কারখানাটা যেন একটা কবরখানার মতো নীরবে দাঁড়িয়ে আছে। রাস্তায় গাড়ি খুব কম, শুধু মাঝেমধ্যে কলকাতার দিক থেকে দুএকটা গাড়ি হেডলাইট জ্বালিয়ে বাড়ি ফিরছে।
‘বকুলকে কেমন দেখলেন? স্বাভাবিক অবস্থায় আছে মনে হল?’
‘বকুলকে অসম্ভব বুদ্ধিমতী মনে হল। যদি অস্বাভাবিকত্ব কিছু থাকেও বাইরে থেকে বোঝা যাবে না।’
‘টেলিফোন বাজতে শুনলেন?’
‘বকুলের সঙ্গে কথা বলার সময় তিনবার টেলিফোন বেজেছে। বকুল উঠে ধরার আগেই প্রত্যেকবার কেটে গেল। টেলিফোন ধরার ব্যাপারে বকুলের খুব একটা তাড়াও দেখলাম না। আমি জিজ্ঞেস করতে বলল টেলিফোনে রোজই আট-দশটা রং নাম্বার আসে। বাড়ির সকলের গা সওয়া হয়ে গেছে।’
‘টেলিফোন বাজার সময় বকুল কি একটু ভয় পেয়েছে মনে হল?’
‘একটু সন্ত্রস্ত মনে হল। হয়তো বা একটু বিরক্তিও ছিল। বকুলকে কেউ ভয় দেখিয়ে টাকা আদায় করছে কিনা বার করতে আরও ক’টা দিন লাগবে। আগামী শুক্রবার অব্দি তো আছি। তার মধ্যে আশা করছি একটা কিছু জানতে পারব।’
‘আপনার আর কোনও সাহায্য লাগবে?’
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ বকুলের ব্যাকগ্রাউন্ডটা জানতে চাই। কতদূর লেখাপড়া করেছে, কোনও ঘনিষ্ঠ বন্ধু আছে কিনা, সারাদিন সময় কাটায় কীভাবে?’
‘বকুল পাড়ার ইস্কুলে পড়েছে। লেখাপড়ায় নেহাত মন্দ ছিল না। ইস্কুলের পর কাছেই একটা মেয়েদের কলেজে ভর্তি হয়েছিল। ইস্ট মেট্রোপোলিটান গার্লস কলেজ। বছর দু’য়েক পড়ে ছেড়ে দেয়। শেষ পর্যন্ত বিএ-টা পাশ করেনি। কেন, আমি জানি না। কখনও জিজ্ঞেস করা হয়নি। এক সময় বকুলের অনেক বন্ধুবান্ধব ছিল। বিয়ের পর মনে হয় তাদের সঙ্গে খুব একটা যোগাযোগ নেই। তবে শ্রীলেখা বলে একটা মেয়ে এখনও মাঝে মাঝে বকুলের মোবাইলে ফোন করে। বকুল তার সঙ্গে অনেকক্ষণ কথা বলে, দেখেছি। এই মেয়েটা রজনীর ট্র্যাভেল এজেন্সিতে কাজ করে। বোধহয় বকুলই কখনও যোগাযোগ করিয়ে দিয়েছিল। এক কথায়, আর পাঁচটা বাঙালি বউ যেভাবে সময় কাটায় বকুলও সেইভাবেই সময় কাটায়। সংসারটা নজরে রাখে, ব্যাঙ্ক-ট্যাঙ্কের কাজগুলো সামলায়, দুপুরবেলা ঘুমোয়, হয়তো সিরিয়ালও দেখে। ছাতে একটা বাগান করেছে।’
‘বকুলের মোবাইল নম্বরটা আমার দরকার।’
‘আমার তো নম্বর মনে থাকে না। নম্বরটা আমার মোবাইলে সেভ করা আছে। মোবাইলটা আবার বাড়িতে ফেলে এসেছি। বাড়ি ফিরে আপনাকে নম্বরটা দিয়ে দেব।’
‘আর একটা কথা। আপনার প্রথম স্ত্রীর অপঘাতে মৃত্যু হয়েছিল বলেননি কেন?’
প্রশ্নটা করে আদিত্য সরাসরি মন্টুবাবুর দিকে তাকাল। মন্টুবাবু দাঁড়িয়ে পড়লেন। রাস্তার আলোগুলো ঠিকমত জ্বলছে না। সেই আলো-আঁধারিতে দাঁড়িয়ে আদিত্যর মনে হল, নিমেষের মধ্যে একাধিক অভিব্যক্তি খেলে যাচ্ছে মন্টুবাবুর মুখের ওপর দিয়ে। ভয়, সংকোচ, লজ্জা, একটা বেপরোয়া ভাব। বেশ কিছুক্ষণ পরে মন্টুবাবু শান্ত গলায় বললেন,
‘আমার প্রথম স্ত্রী দার্জিলিং বেড়াতে গিয়ে পা স্লিপ করে পাহাড় থেকে পড়ে যান। একটা খাদে তাঁর মৃতদেহ পাওয়া যায়। পাহাড় থেকে পড়ে যাওয়ার ব্যাপারটা একটু অস্বাভাবিক। সচরাচর এরকম ঘটে না। এটা নিয়ে পুলিশও তদন্ত করেছিল। কিছু পাওয়া যায়নি। আপনাকে ঘটনাটা বলিনি কারণ মনে হয়েছিল টেলিফোন কাণ্ডের সঙ্গে এর কোনও যোগ নেই। তাছাড়া এটা একটা পারিবারিক লজ্জার ব্যাপারও বটে। তাই, স্বীকার করছি, নিজের থেকে বলতে সঙ্কোচ হয়েছিল।’
‘কারা কারা গিয়েছিলেন দার্জিলিং-এ?’
‘আমার পরিবার, মানে স্ত্রী কল্পনা, মেয়ে সুলতা এবং আমি, আমার বন্ধু রজনীর পুরো পরিবার, অর্থাৎ রজনী, রজনীর মেয়ে-বউ, রজনীর বোন বকুল, রজনীর ভাই দেবী আর তার বন্ধু সুশান্ত।’
‘তার মানে ঘটনার সময় দেবী বসাক এবং সুশান্ত হালদার আপনাদের সঙ্গেই ছিল।’
‘তা তো ছিলই। আসলে এটা ছিল রজনীদের পরিবারের হাওয়াবদল। আমরা ওদের সঙ্গে জুটে গিয়েছিলাম আর কি। যা কিছু ব্যবস্থা রজনীরাই করেছিল। তবে, অস্বীকার করব না, ওই বিপদের সময় দেবী-সুশান্ত খুব করেছিল। খাদে নেমে ওরাই প্রথম আবিষ্কার করে কল্পনা নীচে পড়ে গেছে। অ্যাম্বুলেন্স ওরাই নিয়ে আসে। পরে পুলিশকে ওরাই সামলেছিল।’
‘দুর্ঘটনাটা কেমন করে ঘটল?’
‘আমরা টাইগার হিলের কাছে একটা পিকনিক স্পটে চড়ুইভাতি করতে গিয়েছিলাম। দুপুরে খাওয়ার আগে গান-বাজনা হচ্ছিল। কেউ-কেউ তাস খেলছিল। কেউ একা একা ঘুরে বেড়াচ্ছিল। পিকনিকে যেমন হয়। খাওয়ার সময় দেখা গেল সবাই রয়েছে, কল্পনা নেই। কেউ কেউ কল্পনাকে একা-একা ঘুরতে দেখেছিল। অনেক খোঁজাখুঁজির পর দেবী-সুশান্ত একটা খাদের নীচে কল্পনার বডিটা দেখতে পায়। ওদের সঙ্গে একটা বাইনোকুলার ছিল, কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখবে বলে নিয়ে এসেছিল, তাই দিয়ে দেখতে পায়।’
কথা বলতে বলতে ওরা আবার মন্টুবাবুদের বাড়ির সামনে ফিরে এসেছে। বাড়ির মধ্যে সিগারেট খাওয়া যাবে না ধরে নিয়ে আদিত্য তাড়াতাড়ি আর একটা সিগারেট ধরাল।
‘আমি কাল সকালে সুশান্ত-দেবীরঞ্জনের দোকানে একবার ঢুঁ মারব। দেখি কিছু পাই কিনা।’
‘দেখুন। তবে একটু সাবধানে। ছেলে দু’টো একটু রাফ ধরনের। কথাবার্তাও ভাল নয়।’
ওদের গলার আওয়াজ পেয়ে বকুল বেরিয়ে এসেছে।
‘আপনার শোবার ঘর তৈরি। সকালে ক’টায় চা দেব?’
‘আমি খুব ভোরে উঠে পড়ি। ভোরে উঠে একটু হাঁটার অভ্যেস আছে।’
‘মালতী ছ’টায় আপনার ঘরে চা পৌঁছে দেবে। দুপুরে খাবেন তো?’
‘সকালে একটু বেরোব, ফিরতে ফিরতে বিকেল হয়ে যাবে। কাল দুপুরে বাইরেই খেয়ে নেব।’
আদিত্য বাড়িতে ঢোকার আগে মরিয়া হয়ে সিগারেটে শেষ কয়েকটা টান দিয়ে নিচ্ছে, এমন সময় পাশের বাড়ি থেকে বিশাল লম্বা-চওড়া এক মাঝবয়সি ভদ্রলোক বেরিয়ে এলেন। আদিত্যকে দেখে অত্যন্ত মিহি গলায় বললেন,
‘বাড়িতে নতুন অতিথি এল নাকি মন্টুবাবু? এঁকে তো আগে পাড়ায় দেখেছি বলে মনে পড়ছে না।’
আদিত্য চমকে উঠে তাকাল। ভাবা যায় না, এমন বিশাল চেহারা থেকে এত মিহি আওয়াজ বেরোতে পারে। মন্টুবাবু বললেন,
‘আমার মেয়ের দেওর। ভিলাই থেকে কলকাতায় কাজে এসেছে। ক’টা দিন এখানে থাকবে।’
‘তবু ভাল। আমি ভাবলাম, টেলিফোন রহস্য ভেদ করার জন্য বুঝি গোয়েন্দা এনেছেন। হাঃ, হাঃ হাঃ।’
ভদ্রলোক নিজের রসিকতায় নিজেই এত জোরে হেসে উঠলেন যে সামনের গাছটা থেকে কয়েকটা কাক উড়ে গেল। বকুলের মুখে পরিষ্কার বিরক্তি। মন্টুবাবু অপ্রতিভ। অস্বস্তি কাটাতে মন্টুবাবুই মুখ খুললেন,
‘আলাপ করিয়ে দিই, আমার মেয়ের দেওর সূর্যশঙ্কর সাহা, আর ইনি আমাদের পড়শি ও ভাড়াটে রামানুজ চট্টোপাধ্যায়।’
রাত্তিরে আদিত্য দু’বার বকুলকে স্বপ্নে দেখল। একবার দেখল দার্জিলিং-এ মস্ত পাহাড়ের তলায় বসে সে আর বকুল চা খাচ্ছে। অনেকটা চা-কোম্পানির বিজ্ঞাপনের মতো। সে চায়ের প্রশংসা করাতে বকুল বলছে, চা ভাল তো হবেই, খোদ ভিলাই-এর চা বলে কথা। আর একবার দেখল সে বকুলকে নিয়ে অমিতাভ-রত্নাদের বাড়ি গিয়েছে, গল্প-টল্প হচ্ছে। তবে সেই গল্পে বিমল, রামানুজ চট্টোপাধ্যায় সকলেই শামিল হয়েছে। দু’বারই তার ঘুম ভেঙে গেল টেলিফোনের শব্দে। ভূতুড়ে টেলিফোন তাহলে রাত্তিরেও বিশ্রাম নেয় না।