ভূতুড়ে টেলিফোন – ৫
পঞ্চম পরিচ্ছেদ
(১)
সাইবার কাফেটা ছোট, সব মিলিয়ে তিনটে ডেস্কটপ, একটা প্রিন্টার-স্ক্যানার। তাছাড়া নিশ্চয় ওয়াই-ফাইও আছে। একদিকে সোফার ওপর বসে একটা ছেলে কানে হেডফোন লাগিয়ে মোবাইলে গান শুনছে। অন্যদিকে পার্টিশন দিয়ে মালিকের আপিসঘর। এখন তিনটে কম্পিউটারই ফাঁকা। মন্টুবাবু বলেছিলেন, দোকানটা চলে ভাল। এখন অন্তত তার কোনও প্রমাণ দেখা যাচ্ছে না। হয়তো বিকেলের দিকে ছাত্র-টাত্ররা গেম খেলতে আসে। আদিত্য ভেতরে ঢুকে দেখল আপিসঘরে বছর চল্লিশের একটি লোক বসে আছে। চেহারাটা আদিত্যর চেনা। ছবিতে দেখেছে। সুশান্ত হালদার।
‘আপনাদের এখানে ইন্টারনেট করতে গেলে রেট কত?’ আদিত্য জিজ্ঞেস করল।
‘ঘণ্টায় পঁচিশ টাকা। বাঁ দিকেরটা খারাপ আছে। অন্য যে কোনোটাতে বসতে পারেন।’ সুশান্ত হালদারের গলাটা বেশ ভদ্র শোনাল।
‘পাসওয়ার্ড আছে?’
‘না না সোজাসুজি লগ ইন করুন।’
আদিত্য ডানদিকের যন্ত্রটাতে গিয়ে বসল। প্রথমে ই-মেল খুলে দেখল, কিছু পুরোনো মেল এসে জমে আছে। উত্তর দেওয়া হয়নি। খুব দরকারি কিছু নয়। তবু সময় নিয়ে আদিত্য মেলগুলোর উত্তর দিল। কিছুটা ইনিয়ে বিনিয়ে। বন্ধুদের মেল। কেউ আমেরিকায় থাকে, কেউ বিলেতে। এখনও মেলে যোগাযোগ রাখে। শীতকালে কলকাতায় এলে দেখা হয়। আদিত্যর এখানে এখন ঘণ্টাখানেক বসে থাকা দরকার। ইমেল সেরে সে ফেসবুকে ঢুকল। দুটো ছেলে দোকানে ঢুকেছে। আদিত্যর পাশের যন্ত্রটায় বসল। নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলছে। মনে হল, কোথাও অনলাইনে অ্যাপ্লাই করবে। দূরে টেলিফোন বাজছে। আদিত্য শব্দটা চেনে। এটা মন্টুবাবুর টেলিফোন। বাজলে এখান থেকে হালকা শোনা যায়। যে ছেলেটা মোবাইলে গান শুনছিল সে বেরিয়ে যাচ্ছে। আর একজন ঢুকল। দুটো কম্পিউটারই আটকা দেখে সেও বেরিয়ে যাচ্ছিল, তাকে আপিস থেকে সুশান্ত হালদার বলল,
‘দুটোর পরে এস। ফাঁকা থাকবে।’
নিশ্চয় চেনা খদ্দের। আদিত্যর মনে হল জায়গাটা অনেকটা পাড়ার চুল কাটার সেলুনের মতো। ভিড় থাকলে খদ্দের আবার ঘুরে আসে। ফেসবুকে নানা লোক নানা কথা লিখছে। কথা বলতে পয়সা লাগে না। কারও কারও কাজ এত কম, সারাদিন ফেসবুক নিয়ে বসে থাকে। আদিত্যর এক বন্ধু, আমেরিকাবাসী, সপরিবারে মিশর বেড়াতে গিয়েছিল। অনেক ছবি পোস্ট করেছে। আবার ফোন বাজল? না না সেই ফোন নয়। কারও মোবাইল বাজছে। আদিত্য কতক্ষণ একমনে ফেসবুক দেখছিল সে নিজেই জানে না। সে খেয়ালও করেনি তার পাশের ছেলেদুটো কখন বেরিয়ে গেছে, সাইবার কাফেতে সে একা।
‘আদিত্যবাবু, একবার শুনবেন?’
আদিত্য চমকে উঠে পেছনে তাকাল। সুশান্ত হালদার কখন নিঃশব্দে পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। কী সর্বনাশ! সুশান্ত তার নাম জেনে গেছে! নাম যখন জেনেছে তখন এটাও নিশ্চয় জেনেছে যে আদিত্য এখানে আত্মীয়-বাড়ি বেড়াতে আসেনি।
‘আদিত্য মজুমদার, আপনার সঙ্গে আমার খুব দরকারি কথা আছে। আমি দোকানের দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে আসি। কথা বলার সময় কেউ এলে অসুবিধে হবে। এমনিতেই একটা থেকে দুটো দোকান বন্ধ থাকে। দু’চার মিনিট আগে বন্ধ হলে এমন কিছু ক্ষতি হবে না।’
সুশান্তর গলায় এমন একটা ঠাণ্ডা অমোঘ আত্মবিশ্বাস ছিল যে আদিত্যর মনে হল সুশান্তর কাছে পরিচয় নিয়ে মিথ্যে বলে কোনও লাভ নেই। সে চুপ করে রইল।
‘ভয় পাবেন না। দরজা বন্ধ করে আমি আপনার কোনও শারীরিক ক্ষতি করব না।’
ভয় অবশ্য আদিত্য পায়নি। বরং সুশান্ত কী বলে তা জানার জন্য আদিত্যর খুব কৌতূহল হচ্ছিল। সুশান্ত দোকানের ঝাঁপ বন্ধ করে একটা চেয়ার নিয়ে আদিত্যর সামনে এসে বসল।
‘আমি জানি আপনার নাম আদিত্য মজুমদার। আমি এও জানি, পেশায় আপনি একজন বেসরকারি গোয়েন্দা। আপনার অফিস, আপনার মেস সবই আমি চিনি। অতএব পরিচয় গোপন করলে মিছিমিছি সময় নষ্ট হবে।’
পকেট থেকে সুশান্ত একটা সিগারেটের প্যাকেট বার করে আদিত্যকে অফার করল। দামি বিদেশি সিগারেট। আদিত্য এবং তার নিজের সিগারেট ধরিয়ে সুশান্ত বলল,
‘আপনি নিশ্চয় ভাবছেন কী করে আপনার পরিচয় জানতে পারলাম। আপনার পাঠানো ছেলেটি আমার দোকানের সামনে দু’দিন আগে সন্দেহজনকভাবে ঘোরাফেরা করছিল। দেখে মনে হল ব্যাপারটা বোঝা দরকার। আমার একটা ছেলেকে ওর পেছনে লাগিয়ে দিলাম। সে খবর আনল গতকাল সকালে আপনার ছেলেটি আপনার বাড়ি গিয়েছিল। আপনাদের মেসের দরোয়ানের কাছ থেকে আপনার অফিসের ঠিকানা পাওয়া গেল। তারপর আপনাদের অফিস বিলডিং-এর সিকিউরিটির কাছ থেকে জানা গেল আপনার পরিচয়। এত কিছু জানার জন্য অবশ্য সামান্য টাকা-পয়সা খরচ করতে হয়েছে। কিন্তু সেটা নিয়ে আমার কোনও অভিযোগ নেই।’
আদিত্য একেবারে বোকা বনে গিয়েছে। এই অবস্থায় শুধু শুনে যাওয়া ছাড়া তার আর কিছু করণীয় নেই। সুশান্ত বলে চলেছে, ‘আমার ছেলেটি আপনাদের আপিসের সিকিউরিটির কাছ থেকে এটাও জানতে পেরেছে যে আপনার খুব একটা মক্কেল-টক্কেল হয় না। তবে কয়েকদিন আগে এক মাঝবয়সী ভদ্রলোক আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল। সম্ভবত মক্কেল। অনেকক্ষণ ছিল। মক্কেল মশায়ের চেহারার যা বর্ণনা শুনলাম তাতে আমি মোটামুটি নিশ্চিত হলাম যে তিনি আমাদের মন্টু দত্ত ছাড়া আর কেউ নন। কাল বিকেলে আমার ছেলেটি এসে খবর দিল আপনি সুলতার দেওর সেজে মন্টুবাবুর বাড়িতে থাকতে এসেছেন। শুনে যেটুকু বা সংশয় ছিল, সেটাও চলে গেল। আমি একশভাগ নিশ্চিন্ত হলাম মন্টুবাবুই আপনার মক্কেল। প্রশ্ন উঠবে, মন্টুবাবু কেন আপনার কাছে গিয়েছিলেন? কেন তাঁর মতো নিরীহ, নির্বিরোধ একজন লোকের গোয়েন্দার সাহায্য নেবার দরকার পড়ল?’
‘উত্তরটা অবশ্য আমার জানাই ছিল। মন্টুবাবুর বাড়িতে যে বেশ কিছুদিন ধরে ভূতুড়ে টেলিফোন আসছে সেটা তো আমার থেকে ভালো আর কেউ জানে না। এটা নিয়ে মন্টুবাবু যে বকুলকে সন্দেহ করছেন সেটাও আমার অজানা ছিল না। দুয়ে দুয়ে চার করে বুঝলাম ভূতুড়ে টেলিফোনের রহস্যভেদ করার জন্য মন্টুবাবু আপনাকে এখানে নিয়ে এসেছেন।’
‘কী করে জানলেন মন্টুবাবু বকুলকে সন্দেহ করছে?’ এতক্ষণ পরে মুখ খুলল আদিত্য।
‘সেটা জানার জন্য আর একটু আগে থেকে শুরু করতে হবে। বকুলকে আমি অনেকদিন ধরে চিনি। বকুলের ছোড়দা দেবী ইশকুলে আমার দু’ ক্লাস নীচে পড়ত। এক পাড়ার ছেলে। বলতে পারেন আমার চ্যালা ছিল। সেই সূত্রে ওদের বাড়িতে যাতায়াত। দেবী ইস্কুলের গণ্ডি পেরোতে পারেনি। আমি ইস্কুল পেরিয়ে কলেজে ঢুকলাম। কিন্তু আমাদের বন্ধুত্বটা রয়েই গেল। আমি লেখাপড়ায় খারাপ ছিলাম না। তাছাড়া খেলাধুলো করতাম, লোকের বিপদে-আপদে গিয়ে দাঁড়াতাম। তাই সেই বয়সে আমি ছিলাম পাড়ার হিরো। ওই সময় বকুল বড় হচ্ছিল। বকুল যখন ইস্কুলের গণ্ডি পেরোবে পেরোবে, আমি কলেজে ঢুকেছি, আমাদের মধ্যে একটা সম্পর্ক তৈরি হয়।’
‘কার সঙ্গে কথা বলছ ওস্তাদ?’ আপিসঘরের পিছনের একটা দরজা ঠেলে হোঁতকা চেহারার এক ব্যক্তি সাইবার কাফের মধ্যে ঢুকে পড়েছে। আপিসঘরের পেছনে যে বাইরে যাবার একটা দরজা আছে আদিত্য এতক্ষণ খেয়ালই করেনি।
তার কথার সরাসরি উত্তর না দিয়ে সুশান্ত আদিত্যর দিকে তাকিয়ে বলল,
‘ইনি হলেন দেবীরঞ্জন বসাক, বকুলের ছোড়দা।’ তারপর হোঁতকা লোকটির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ইনি সেই আদিত্য মজুমদার, মন্টুবাবুর ভাড়া করা টিকটিকি, আপাতত মন্টুবাবুর বাড়িতেই নাম ভাঁড়িয়ে রয়েছেন।’
‘কেলাতে হবে?’ দেবী আদিত্যর দিকে দু’পা এগিয়ে এল।
‘এখন দরকার নেই। তুই বাইরে থাক। দরকার পড়লে ডাকব।’
দেবী খানিকটা অনিচ্ছাসত্ত্বেও পিছনের দরজা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেল।
‘তারপর যা বলছিলাম’ সুশান্ত আবার শুরু করল, ‘বকুলের সঙ্গে আমার সম্পর্কটা যতদূর গড়ানো সম্ভব, ততদূরই গড়িয়েছিল। ইতিমধ্যে আমার জীবনে আরও কিছু পরিবর্তন আসে। আমি কিছুটা অভাবের চাপে কিছুটা স্বভাবের দোষে বিপথে চলে গেলাম। প্রথম প্রথম বেশ লাগত। হাতে প্রচুর কাঁচা টাকা, বকুলকে নিয়ে বেড়াতে যাচ্ছি, দামি হোটেলে খাওয়াচ্ছি। কিছুদিন পরে বুঝলাম পথটা পিচ্ছিল, এতটাই পিচ্ছিল যে একবার নামতে শুরু করলে আর সহজে ওঠা যায় না। পাড়ায় বদনাম হল। বকুল প্রথমে বকাবকি, পরে কান্নাকাটি শুরু করল। শেষে পুলিশের ফাঁদে পা দিয়ে দু’বছরের জন্য জেলে গেলাম।
‘জেলে বসে ঠিক করলাম, আর নয়। জেল থেকে বেরিয়ে ভাল হয়ে যাব। বকুলকে বিয়ে করব। সৎপথে থেকে ব্যবসা করব। চাকরি তো আর দাগি আসামীকে কেউ দেবে না। বকুলই ছিল আমার ভাল হবার ইচ্ছের পেছনে মূল শক্তি।’
‘অথচ জেল থেকে বেরিয়ে কী দেখলাম? দেখলাম বকুল মন্টুবাবুকে বিয়ে করেছে। বড়লোকের গৃহিণী হয়ে মহা আরামে আছে। মাথায় আগুন জ্বলে গেল। একদিন রাস্তায় ওকে ধরলাম। ও বলল, বাড়ির চাপে বিয়ে করতে বাধ্য হয়েছে। ওকে যেন আমি ক্ষমা করে দিই। অনেকক্ষণ কান্নাকাটি করল। আমি ভাবলাম যা বলছে সেটা সত্যি হতেও পারে। জেলে যাওয়া প্রেমিকের জন্য হিন্দি সিনেমায় ছাড়া আর কে কবে অপেক্ষা করেছে? কিছুদিন আর ওর সঙ্গে কথা হয়নি। ইতিমধ্যে দেবী আর আমি এই সাইবার কাফেটা শুরু করেছি। ব্যবসা একটু একটু করে জমেও উঠছে। ব্যস্ত হয়ে পড়ছি। তবু দূর থেকে বকুলকে লক্ষ করার অভ্যেসটা ছাড়তে পারিনি।
‘একসময় খেয়াল করলাম বকুল আসলে গোড়া থেকেই শুধু টাকাপয়সা চেয়েছিল। টাকাপয়সা ছাড়া আর কিছুই ভালবাসেনি। ওর সঙ্গে আমার সম্পর্কটা জমে ওঠার পেছনেও ওই টাকাপয়সাই ছিল। এখন বুঝতে পারি, আমার হাতে অত কাঁচা টাকা না থাকলে বকুল আমার দিকে ঘেঁষতই না। ভেবে দেখলাম, আমার কুপথে যাবার পেছনে বকুলের এই টাকাপয়সার প্রতি টানটা বিরাটভাবে কাজ করেছিল। বকুলকে পটাতে হবে তাই টাকা দরকার, তা সেই টাকা যেভাবেই আসুক, এটাই ছিল আমার বিপথে যাবার মন্ত্র। আমি নিশ্চিত হলাম যে বকুল মন্টুবাবুকে যতটা না বাড়ির চাপে বিয়ে করেছে, তার থেকে অনেক বেশি টাকার লোভে করেছে। দূর থেকে বকুলকে দেখতাম, আধবুড়ো স্বামীকে হাতের মুঠোয় রেখে সে দেদার টাকাপয়সা খরচ করছে। দামি গাড়ি, দামি শাড়ি-গয়না, ভালগারিটির চূড়ান্ত। আমার মাথায় আবার আগুন জ্বলতে শুরু করল। আমার জীবনটা ছারখার করে দিয়ে বকুল তো দিব্যি আছে। ঠিক করলাম এইভাবে তাকে থাকতে দেব না।
‘আমার কাছে বকুলের কিছু পুরোনো চিঠি এবং ছবি আছে যা তার বর্তমান বিয়েটা নষ্ট করে দেবার পক্ষে যথেষ্ট। একদিন ওকে রাস্তায় পাকড়াও করলাম। চিঠি এবং ছবিগুলোর কথা বললাম। বললাম আমাকে প্রতি সপ্তাহে পনেরো হাজার টাকা দিতে হবে। না দিলে চিঠি এবং ছবিগুলো মন্টুবাবুর কাছে পৌঁছে যাবে। সরাসরি ব্ল্যাকমেল। বকুল আবার কান্নাকাটি করল। আমি অটল রইলাম। সেই থেকে প্রতি সপ্তাহে পনেরো হাজার করে টাকা পেয়ে যাচ্ছি। টাকার কথা মনে করিয়ে দেবার জন্য প্রতি সপ্তাহে বকুলের বাড়ির টেলিফোনে মিসড কল দিই।
‘টাকা তো নিয়মিত পেয়ে যাচ্ছেন, তাহলে দিনে এতবার মিসড কল কেন? সপ্তাহে একবার মিসড কল দিলেই তো যথেষ্ট হত।’ আদিত্য জিজ্ঞেস করল।
‘আপনাকে বুঝতে হবে, বকুল আমার জীবনটা নষ্ট করে দিয়েছে, আমি তাকে সহজে ছাড়ব না।’ সুশান্তর গলাটা প্রায় হিস্টিরিক শোনাল। ‘আমি তাকে বলেছি এখন সপ্তাহে সপ্তাহে টাকা দিয়ে পার পেয়ে যাচ্ছ, কিন্তু কতদিন পাবে জানি না। আমি যেকোনও দিন মত বদলে চিঠি-ছবি মন্টুবাবুর হাতে তুলে দিতে পারি। সেই সম্ভাবনাটা মনে করিয়ে দেবার জন্য আমি দিনে বারবার মিসড কল করি। নিজে সব সময় করতে পারি না। আমার ছেলেরা করে। বকুলকে আমি এক মুহূর্তের জন্য শান্তিতে থাকতে দিতে চাইনি। এটা ইর্যাকশানাল বলবেন? তা কিন্তু নয়। এটা বকুলকে প্রবল মানসিক চাপে রাখা। তার অতীত পাপ সম্বন্ধে বারবার তাকে মনে করিয়ে দেওয়া। আমি জানি এই ভূতুড়ে টেলিফোন বকুলকে প্রতি মুহূর্তে কুরেকুরে খাচ্ছে। বকুল নিজেই আমাকে কাকুতি-মিনতি করে ভূতুড়ে টেলিফোন থামিয়ে দিতে বলেছে। বলেছে, ওই আওয়াজটা সে আর সহ্য করতে পারছে না। টাকা সে দিয়ে যেতে রাজি, কিন্তু টেলিফোন যেন আর না আসে।’
সুশান্ত কিছুক্ষণ চুপ করে ছিল। আদিত্যও কথা বলছে না। শেষে আদিত্য বলল,
‘আপনি বকুলের মোবাইলে ফোন না করে বাড়ির ফোনে করেন কেন?’
‘কেন করি জানেন? এটা করে আমি একটা মানসিক পরিতৃপ্তি পাই। বকুলের বাড়িতে ফোন বাজলে আমার এখান থেকে শোনা যায়। শুনে ভাল লাগে। মনে হয়, আরও সাতপাড়া জানুক বকুল আমার সঙ্গে কী অন্যায়টা করেছে।’
আরও কিছুক্ষণ স্তব্ধতা। সুশান্ত আদিত্যকে সিগারেট দিয়ে নিজেও একটা ধরাল। আদিত্য জানলা দিয়ে দেখল নির্মেঘ আকাশ। চড়া রোদ্দুরে গাছগুলো ঝলমল করছে। সে বলল, ‘এত কথা আপনি আমাকে কেন বলছেন?’
‘ঠিক প্রশ্নটাই করেছেন। কেন আপনাকে এত কথা বলছি। আপনাকে এত কথা বলার অবশ্যই একটা কারণ আছে। সম্প্রতি আমি আমার এই ব্যবসাটা বাড়ানোর একটা সুযোগ পেয়েছি। ব্যবসা বাড়াতে কিছু টাকা লাগবে। লাখ দশেক পেলেই আপাতত শুরু করা যাবে। অত টাকা আমার নেই। অত টাকা বকুলের পক্ষেও একসঙ্গে দেওয়া সম্ভব নয়। টাকাটা একমাত্র মন্টুবাবুই দিতে পারেন।’
‘কিন্তু মন্টুবাবু আপনাকে অত টাকা দেবেন কেন?’
‘আপনাকে আমি যে কথাগুলো বললাম, আপনি মন্টুবাবুকে ঠিক সেই কথাগুলোই বলবেন। এই কথাগুলো জানবার জন্যই তো মন্টুবাবু আপনাকে পয়সা দিচ্ছেন। আমার দশ লাখ টাকার প্রস্তাবের কথাটাও বলবেন। বলবেন, টাকাটা পেলে আমি চিঠি এবং ছবি তাঁর হাতে তুলে দিয়ে চিরতরে তাদের মুক্তি দেব। আর টাকাটা না পেলে চিঠি ও ছবির কথা পাড়ার লোকে সকলে জানতে পারবে। হয়তো তাঁর প্রেসেও জানাজানি হবে। চিঠি ও ছবিগুলো বেশ রগরগে। পাবলিক এনজয় করবে। এখানে একাধিক সম্ভাবনা আছে। একটা হতে পারে, মন্টুবাবু নিজের সম্মান বাঁচানোর জন্য আমাকে টাকাটা দিয়ে দিলেন, কিন্তু বকুলকে তিনি ক্ষমা করলেন না। তাঁদের সম্পর্কটা নষ্ট হয়ে গেল। এতে আমার ডবল লাভ। টাকাও পেলাম, বকুলের ওপর প্রতিশোধটাও নেওয়া গেল। আরেকটা সম্ভাবনা, পরিবারের সম্মান বাঁচানোর জন্য টাকাটা মন্টুবাবু দিয়ে দিলেন, কিন্তু তিনি বকুলে এতটাই মজে গেছেন যে বকুলকেও ছাড়তে পারলেন না। বকুলকে যদি মন্টুবাবু ক্ষমা করে দেন, আমার কিছু করার নেই। কিন্তু সেক্ষেত্রে অন্তত টাকাটা আমি পেয়ে যাচ্ছি। তৃতীয় সম্ভাবনা, মন্টুবাবু টাকাটা দিলেন না। তাহলে মন্টুবাবু বকুলকে ক্ষমা করুন বা না করুন, চিঠি এবং ছবি পাড়ার লোককে জানিয়ে বকুলকে যেটুকু হেনস্থা করা যাবে সেটুকুই আমার লাভ। ….. আমি ভেবেছিলাম কথাগুলো নিজেই মন্টুবাবুকে বলব। আপনাকে পেয়ে কাজটা সহজ হয়ে গেল। মন্টুবাবুকে বলবেন চটপট একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে সরাসরি আমার সঙ্গে কথা বলতে। দরকার পড়লে আমি নিজেও তাঁর সঙ্গে কথা বলতে পারি। তবে, আমি একটু তাড়ায় আছি। আর হ্যাঁ, পুলিশের কাছে গিয়ে খুব লাভ নেই। আমাকে পুলিশে ধরলে চিঠি-ছবির কথা সঙ্গে সঙ্গে পাড়ার লোক জেনে যাবে। আমি সে ব্যবস্থা করে রেখেছি। আপনাকে আর কিছু বলার নেই। আশা করি আমার সব কথা বুঝতে পেরেছেন। দেবী, ভেতরে আয়। দোকানের গেট খুলে দে। দু’টো বেজে গেছে।’
(২)
মন্টুবাবুর ফোনটা অনেকক্ষণ বেজে যাচ্ছে। হয়তো রাস্তায় আছেন তাই শুনতে পাচ্ছেন না। আদিত্য একটা মেসেজ করল, ‘আমি সন্ধে সাতটা অব্দি আমার আপিসে আছি। একবার আসুন। খুব জরুরি দরকার।’ তারপর মোবাইলে অমিতাভর নম্বরটা লাগাল। এই ফোনটা আবার সুইচড অফ। ক্লাসে আছে নাকি? আদিত্য ঘড়ি দেখল। বিকেল সাড়ে পাঁচটা। এতক্ষণ তো ক্লাস হবার কথা নয়। ফোনটা বেজে বেজে থেমে যাবার পর আদিত্য রত্নার নম্বরটা লাগাতেই ওপার থেকে কলকাকলি শোনা গেল, ‘একি টেলিপ্যাথি নাকি রে? এইমাত্র তোকে ফোন করতে যাচ্ছিলাম।’
‘আমাকে? কেন?’
‘বৃহস্পতিবার রাত্তিরে গৌতম আর ওর বউ মালিনীকে ডিনারে ডেকেছি। অমিতাভকে বললাম তোকে খবর দিতে। তুই না থাকলে ডিনার জমবেই না। তো আমার কর্তার সময়ই হচ্ছে না তোকে জানানোর। আজ সারাদিন ফোন বন্ধ করে গোলপার্ক রামকৃষ্ণ মিশনে মল্লার ফেস্টিভাল শুনছে।’
‘ও হ্যাঁ, কাল অমিতাভ বলছিল বটে গান শুনতে যাবে। তা তোদের সঙ্গে গতকাল দেখা হল তখন তো ডিনারের কথা কিছু বললি না?’
‘কী করে বলব? আজ সকালে শুনলাম মালিনী কলকাতায় এসেছে। দু’তিন দিন থাকবে। শুনে ওদের খেতে বললাম। অমিতাভ বলল, তোকে জানিয়ে দেবে। হয়ত রাত্তিরে ফোন করত। আমি তার আগেই জানিয়ে দিলাম। তুই আসতে পারবি তো?
‘অবশ্যই পারব। গৌতমের সঙ্গে আমার খুব দরকার। তোদের বাড়িতে গিয়ে রথ দেখা কলা বেচা দু’টোই সেরে নেব। তবে মালিনী থাকলে চোয়াল ব্যথা করে ইংরিজি বলতে হবে। একটু ভাল খাবার-দাবার রাখিস। নইলে পোষাবে না।’
‘খাবার ভালোই থাকবে। তবে আজকাল মালিনী বেশ বাংলা বুঝতে পারে। বলতেও পারে একটু একটু। তোর চোয়াল ব্যথা হবে না।’
‘দেখা যাক।’
ফোনটা পকেটে পুরে আদিত্য শ্যামলের খোঁজে আপিস ঘরের বাইরে এল। কোথায় শ্যামল? সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে দেখল গেটের সামনে টুলের ওপর শ্যামল বসে আছে।
‘তোমার সঙ্গে কথা ছিল, একবার ওপরে আসবে? আর হ্যাঁ, আসার সময় একটু চা এনো।’ আদিত্য শ্যামলকে একটা দশ টাকার নোট এগিয়ে দিল।
শ্যামল চা ঢালছিল। আদিত্য সিগারেট ধরিয়ে বলল,
‘গতকাল তোমার কাছে কি কেউ আমার খোঁজ করছিল?’
‘হ্যাঁ একজন ছোকরা মতো বাবু আপনার কথা জিজ্ঞেস করছিল। বলল, আদিত্যবাবুকে খুব দরকার। আমি ভাবলাম কোনও মক্কেল হবেন। আপনার আপিস ঘরটা দেখতে চাইলেন। আমি বললাম আজ রবিবার সব বন্ধ, তবু শুনল না। দোতলায় উঠে আপনার নেমপ্লেট দেখে জিজ্ঞেস করলেন আপনার মক্কেল-টক্কেল কেমন হয়।আগের দিন যে একজন বাবু এসেছিল আমি তেনার কথা বললাম। সেই মক্কেলের কথা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করল। তারপর চলে গেল।’
‘তোমায় কিছু বকশিস দিয়ে গেল নিশ্চয়।’
‘তা, হ্যাঁ, মানে ভালোই বকশিস দিল। সেদিন যে কার মুখ দেখে উঠেছিলুম।’
‘ঠিক আছে, তুমি এখন যেতে পার।’
আদিত্য ভাবছে। সকাল থেকে অনেক ঘটনা ঘটল। মনে হচ্ছে ভূতুড়ে টেলিফোন রহস্যের কিনারা হয়ে গেছে। আর কিছু বোঝবার নেই। সত্যিই কি আর কিছু বোঝবার নেই? হয়তো নেই, তবু কোথায় যেন একটা খটকা থেকে যাচ্ছে। অথচ খটকাটা যে কোথায় আদিত্য কিছুতেই ধরতে পারছে না। আদিত্যর মুস্কিল হল সে খুব তাড়াতাড়ি কিছু ভাবতে পারে না। তবে একটা ভাবনা নিয়ে অনেকদিন লেগে থাকতে পারে। তার বন্ধু অমিতাভ বলে এটা খাঁটি গবেষকের গুণ। ভাগ্যের দোষে আদিত্য গবেষণার বদলে গোয়েন্দাগিরিতে নেমেছে।
ফোনটা বেজেই থেমে গেল। বিমল মিসড কল দিয়েছে। মানে ফোন করতে বলছে। আদিত্য বিমলের নম্বরটা ডায়াল করল।
‘দু’টো জিনিস জানানোর ছিল স্যার। দরকারি কিনা বুঝতে পারছি না, তবু ভাবলাম জানিয়ে রাখি।’ বিমলের গলায় একটু কিন্তু কিন্তু ভাব।
‘বল।’
‘মন্টুবাবুর পাশের বাড়িতে এক ভদ্রলোক থাকেন। রামানুজ না কি যেন একটা নাম। ভদ্রলোক একটু অদ্ভুত আছেন। রাতবিরেতে পাড়া বেড়াতে বের হন। পোড়ো কারখানাটাতেও রাত্তির বেলা ঢুকতে দেখেছি। অত রাত্তিরে ওইসব জায়গায় কী করেন বলা মুস্কিল।’
‘আর কি জানলে?’
‘আজ আবার সেই শালাবাবুর সঙ্গে দেখা হয়েছিল। বোনের কাছে এসেছিলেন। রাস্তায় হঠাৎ দেখা। চা খাওয়ালাম। কথায় কথায় বললেন, মন্টুবাবুর আর একটা বাড়ি আছে। বাড়িটা ঠিক কোথায় শালাবাবু জানেন না। সম্ভবত পাইকপাড়ার দিকে কোথাও। মন্টুবাবুর এক বিধবা শালী একসময় সেখানে থাকতেন। শালাবাবু বলছিলেন, বড়লোকদের কত সুবিধে ভাবুন। একটা বাড়ি ফাঁকাই পড়ে আছে। ইচ্ছে হল, কিছুদিন শালীকে সেখানে থাকতে দিলেন। আবার ইচ্ছে হল কিছুদিন ফাঁকা ফেলে রাখলেন।’
‘সুশান্ত আর দেবীর গতিবিধি কেমন?’
‘ওরা তো দোকান থেকে বেরোয়ই না স্যার। আমি দোকানের উল্টোদিকে একটা গাছের আড়ালে টানা আট-নয় ঘণ্টা কাটালাম। ওদের তো একবারের জন্যেও বেরোতে দেখলাম না।’
‘শোনো, তোমার পেছনে টিকটিকি লেগেছিল। তুমি ধরা পড়ে গেছ। তোমার পেছন পেছন এসে সুশান্তর লোক আমারও বাড়ি, আপিস সব চিনে নিয়েছে। আর তোমার ওই পাড়ায় যাবার দরকার নেই।’
ওপারে কিছুক্ষণ নীরবতা। তারপর বিমলের গলাটা প্রায় হাহাকারের মতো শোনাল, ‘আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না স্যার। আমার পেছনে কী করে টিকটিকি লাগবে? আমি এই ধরনের কাজ আগেও তো করেছি। কখনও এরকম হয়নি। আমি আগাগোড়া ভীষণ সাবধান ছিলাম স্যার। আপনি তো সাবধান হতেই বলে দিয়েছিলেন। আমি আপনাকে খুব বিপদে ফেললাম। কী বলব বুঝতে পারছি না।’
‘কিছু বলতে হবে না। তেমন ক্ষতি কিছু হয়নি। এই কাজটা, ধরে নাও, শেষ হয়ে গেল। তোমার আরও কিছু টাকা পাওনা আছে। ক’দিন পরে যোগাযোগ কোরো।’
‘আমি আর টাকা নিতে পারব না স্যার। আমি তো আপনার কাজটা ঠিকমত করতেই পারলাম না।’
‘বললাম তো আমার কাজের কোনও ক্ষতি হয়নি। তুমি ক’দিন বাদে ফোন করে আমার বাড়ি বা অফিসে এস। আজ রাখলাম।’
আদিত্য প্রায় জোর করেই ফোনটা কেটে দিল। নাহলে বিমলের আত্মবিলাপ কখন থামত কে জানে।
সন্ধে সাড়ে ছটায় মন্টুবাবু এলেন। তাঁকে কিছুটা উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছিল। সুশান্তর পুরো গল্পটা তাঁর কাছে বলতে প্রায় আধঘণ্টা লেগে গেল। সুশান্ত যা যা বলেছে সবটাই মন্টুবাবুকে জানিয়ে দিল আদিত্য। যখন মন্টুবাবুর টাকা নিয়েছে তখন সব কথা জানানোটাই তার কর্তব্য। সে মন্টুবাবুর কাছ থেকে খানিকটা চরম প্রতিক্রিয়া আশা করছিল। কার্যত কিন্তু তেমন কিছু ঘটল না। সব শুনে মন্টুবাবু অনেকক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর ধরা-ধরা গলায় বললেন,
‘আমি এইরকমই একটা কিছু আশঙ্কা করছিলাম। আপনি খুব ভাল কাজ করেছেন আদিত্যবাবু। টেলিফোন রহস্য সমাধান করে দিয়েছেন। আর আপনাকে দরকার পড়বে না। সুশান্ত যখন বলেছে, সে নিশ্চয় আমার সঙ্গে বোঝাপড়া করে নেবে। আমি কী করব সেটা আমাকেই ভাবতে হবে। বকুলের সঙ্গেও খোলাখুলি আলোচনা করতে হবে। তবে একটা অনুরোধ। অন্তত আজকের রাত্তিরটা আপনি সুলতার দেওর হয়ে আমাদের বাড়িতে ফিরে চলুন। বকুল আজ রাত্তিরে ওর দাদা-বৌদি-ভাইজিকে খেতে বলেছে। তারা আপনার সঙ্গে আলাপ করতে আসছে। পাশের বাড়ির রামানুজবাবুও থাকবেন। আলাপ হলে দেখবেন আসলে লোকটা মোটেই খারাপ নয়। সুলতা ছোটবেলায় রজনীদের খুব নেওটা ছিল। ওরা সুলতার গল্প শুনতে চাইবে। ওদের সামনে একটা ধোঁকার টাটি খাড়া করে রাখা দরকার। অনেক কেচ্ছা হয়েছে, পাড়ায় আর নতুন করে কেচ্ছা চাই না।’
শেষের কথাগুলো বলতে গিয়ে মন্টুবাবুর গলাটা কান্নায় জড়িয়ে এল।
(৩)
বকুল বেশ সেজেছে। নীল পাড় দেওয়া কালো শাড়ি, চুল খোলা, ভুরুর ওপরে বড় টিপ। আদিত্যর মনে হল, মাজা রঙে কালো শাড়িটা বেশ মানায়। খানিক আগে সস্ত্রীক, সকন্যা রজনী বসাক এসে পৌঁছেচেন। আদিত্য অবশ্য আরও আগে পৌঁছে গিয়েছিল। বসার ঘরে গল্প-সল্প হচ্ছে। মালতী নানারকম ভাজাভুজি এনে টেবিলে রাখল। মন্টুবাবু ভাবনায় ডুবে আছেন, কথা প্রায় বলছেনই না। কথা বলার ব্যাপারে রজনী বসাক অবশ্য একাই একশো। তিনি আদিত্যর মতো অনুগত শ্রোতা মনে হয় বহুদিন পাননি। বাঙালি যে আজকাল আর আগের মতো ঘরকুনো নেই এই তাঁর প্রতিপাদ্য। তিনি বলছিলেন, ‘বুঝলেন ভাই, মধ্যবিত্ত বাঙালি যে আজকাল কোথায় কোথায় বেড়াতে যায় সে আপনি ভাবতেই পারবেন না। ইয়োরোপ-আমেরিকা তো আছেই, তাছাড়া মিশর, আফ্রিকান সাফারি, এমনকি মস্কো থেকে রিগা অব্দি সেই বিখ্যাত ট্রেন যাত্রা, কোনটাতেই আর বাঙালি পিছপা নয়। অনেক পরিশ্রম করে একটা ভ্রমণ-সংস্থা দাঁড় করিয়েছি, জানেন। বাঙালিকে সারা পৃথিবী দেখাব, এটাই ছিল স্বপ্ন। সেই স্বপ্নে এখনও মশগুল হয়ে আছি।’
বকুল তার বৌদির সঙ্গে গল্প করছে। সাদামাটা সাংসারিক কথোপকথন। বকুলের কিশোরী ভাইজি মোবাইলে নিজের মনে কী যেন দেখছে। বোধহয় ফেসবুক।
‘সুলতা খুব গিন্নিবান্নি হয়ে গেছে নিশ্চয়। ভীষণ দেখতে ইচ্ছে করে ওকে।’ বকুলের বৌদি আদিত্যর দিকে তাকিয়ে বললেন। ‘আমাদের কথা বলে সুলতা? মার কথা বলে? মাসির কথা বলে? মা মরে যাবার পর তো মাসির কাছেই মানুষ। মাসি চলে গেল, সেই থেকে বিয়ে হওয়া অব্দি আমার কাছেই সব আবদার।’
‘বৌদির মাসি ছিল জানতাম না তো।’ আদিত্য অবাক হবার ভান করল।
‘ছিল বৈকি।’
তাঁর কথা শেষ হবার আগেই বেল বাজল। পাশের বাড়ির রামানুজবাবু ঘরে ঢুকলেন। এদিক-ওদিক তাকিয়ে সোজা রজনীবাবুর পাশে গিয়ে বসলেন। তাঁর বিশাল শরীর থেকে অতি মিহি কণ্ঠস্বর শোনা গেল, ‘এই যে ভূপর্যটক সাহেব আবার কবে অজানার উদ্দেশে পাড়ি দিচ্ছেন? আমাকেও এবার সঙ্গে নিয়ে চলুন না।’
‘আমি আপনাকে নিয়ে যাবার কে? পয়সা খরচা করলেই যেতে পারবেন।’ রজনীবাবুর গলাটা একটু বিরক্ত শোনাল।
‘একটু কমসম করে দিন। পাসপোর্টটা কবে থেকে করে রেখেছি। পড়েই আছে। তা, এবার যাচ্ছেন কোথায়?’
‘স্ক্যান্ডিনেভিয়া যাচ্ছি। নরওয়ে, সুইডেন, ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ড। যেতে হলে দু’এক দিনের মধ্যেই জানিয়ে দিতে হবে।’
‘দক্ষিণা কত?’
‘আমার ঠিক মনে নেই। কাল আমাদের আপিসে এসে জেনে যাবেন।’ রজনীবাবু নির্লিপ্ত গলায় বললেন।
‘আমাদের রজনীবাবুর একটা ট্র্যাভেল এজেন্সি আছে। রজনীবাবু তার নাম দিয়েছেন ‘পান্থজনের সখা’। কী পোয়েটিক নাম বলুন তো।’ রামানুজ চাটুজ্জে আদিত্যর দিকে তাকিয়ে বললেন। ‘কিন্তু নাম পোয়েটিক হলে কী হবে, আকাল-চচ্চড়ে দাম। আমাদের মতো হ্যাভনটসদের জন্য নয়। বলি, পাড়ার লোকদের একটু ডিস্কাউন্ট দিতে হয় তো।’
‘আপনার সত্যি সত্যি যে কোথাও যাবার ইচ্ছে আছে এমন প্রমাণ তো কখনো পাইনি।’
রজনীবাবু টেবিল থেকে একটা মাসিকপত্র তুলে নিয়ে মুখ ঢাকলেন। রামানুজ চাটুজ্জে আসার পর থেকে তাঁর কথার খেই হারিয়ে গেছে। আদিত্যর সিগারেট খেতে ইচ্ছে করছিল। সে মন্টুবাবুর দিকে তাকিয়ে বলল,
‘একটু বাইরে থেকে আসছি।’
সে ঘর থেকে বেরিয়ে সদর দরজার দিকে এগোচ্ছে, খেয়াল করেনি কখন বকুল তার সঙ্গে সঙ্গে ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে।
‘ছাতে গিয়ে সিগারেট খেতে পারেন। চলুন ছাতটা দেখিয়ে দিই। আমাদের ছাতটা কিন্তু খুব সুন্দর।’
দোতলা পেরিয়ে তিনতলায় ছাত। অন্ধকার। বকুল আদিত্যর দিকে মুখ করে পাঁচিলে হেলান দিয়ে দাঁড়াল। সত্যিই চমৎকার ছাত। একটু দূরে ট্রেন লাইন দেখা যায়। লাইনটা খানিকটা গিয়ে বাঁক নিয়েছে। সুশান্ত আর দেবীর সাইবার কাফেটাও এখান থেকে স্পষ্ট দেখা যায়। বকুলের শরীর থেকে মৃদু পারফিউমের গন্ধ আসছে। খুব দামি বিদেশি পারফিউম। আদিত্যর একটু নার্ভাস লাগছিল। স্বাভাবিক হবার জন্য সে সিগারেট ধরাল।
‘আমারও সুলতাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করে জানেন। আরও ইচ্ছে করে ওর ছেলেকে দেখতে। এতদিনে অনেক বড় হয়ে গেছে নিশ্চয়। ওরা এদিকে একদম আসে না।’ বকুলকে কিছুটা বিষণ্ণ দেখাল।
‘বাবা বুড়োবয়সে বিয়ে করেছে বলে সুলতার প্রচণ্ড অভিমান। বাবার ওপর অভিমান করে কলকাতাকেই ভুলে গেছে। আমাদের সঙ্গেও আর যোগাযোগ নেই। সুলতা ছোটবেলায় আমাদের বাড়িতে খুব আসত। বলতে গেলে আমার বৌদিই ওকে মানুষ করেছে। বিশেষ করে ওর মাসি হারিয়ে যাবার পর থেকে।’
‘সুলতা বৌদি আপনার বৌদির কথা খুব বলে। বলে, ওর মাকে ও কখনই সুস্থ দেখেনি। আপনার বৌদিই ওর মায়ের মতো। কিন্তু মাসির কথা কখনো বলেনি তো।’
‘ওই দেখুন, আমি আবার আপনাকে এসব পুরোনো কথা বলতে শুরু করলাম। সুলতার মাসির কথা এই বাড়িতে কেউ বলে না। সুলতাকেও ছোট থেকে শেখানো হয়েছিল মাসির কথা না বলতে। অথচ সুলতার মাসিকে আমার খুব মনে আছে। মা মারা যাবার পর সুলতা মাসির কাছেই অনেকটা সময় মানুষ হয়েছে। মাসি অল্পবয়সে বিধবা হয়েছিলেন। প্রায়ই এবাড়িতে আসতেন। মাঝে মাঝে থেকেও যেতেন। সুলতা তার কাছেই বড় হচ্ছিল। তারপর হঠাৎ একদিন মাসি কোথায় যেন হারিয়ে গেলেন। আর কোনোদিন ফিরে এলেন না। পুলিশে খবর দেওয়া হয়েছিল। তারাও কিছু করতে পারল না। পরে শুনেছিলাম মাসি নাকি কোনও বিবাহিত পুরুষের সঙ্গে পালিয়ে গেছেন। পারিবারিক কলঙ্ক। সেই কলঙ্ক চাপা দেবার জন্য মাসির কথা এবাড়িতে আর কেউ মুখে আনত না। আমার খুব কষ্ট হত। সুলতা তখন এতটাই ছোট নয় যে এসব কিছু বুঝবে না। হয়তো ইচ্ছে করেই সুলতা তার মাসির কথা ভুলে গেছে। হয়ত মাসির ওপরেও একটা অভিমান জমে আছে।’
বকুল একটু চুপ করে রইল, তারপর খানিকটা ক্ষমা চাওয়ার মতো করে বলল, যাগ গে, অনেক অদরকারি কথা বলে ফেললাম, সুলতাকে যেন বলবেন না।’
আদিত্য অনেকক্ষণ চুপ করে আছে। বকুলও আর কথা বলছে না। নীচে টেলিফোনটা বেজে উঠেছে। একটু কি শিউরে উঠল বকুল? একটা ট্রেন আসছে। মালগাড়ি। শম্বুক গতিতে চলতে চলতে একসময় বাঁকের মুখে হারিয়ে গেল ট্রেন। সুশান্তর দোকানের পেছনের দরজা দিয়ে কে যেন বেরোল। গলিতে এসে দাঁড়াল। দূরে লেভেল ক্রসিং-এর দরজা ওপরে উঠে যাচ্ছে। সাইকেল, সাইকেল রিক্সা, ম্যাটাডোর ধীরে ধীরে লেভেল ক্রসিং পেরিয়ে যাচ্ছে। এখান থেকে সব দেখা যায়।
‘আমার কর্তা বললেন আপনি কাল চলে যাচ্ছেন। ট্রেনের টিকিট পেয়ে গেছেন শুনলাম।’ বকুল নিস্তব্ধতা ভাঙল।
‘কাল রাত্তিরে ট্রেন, বিকেল-বিকেল বেরিয়ে পড়তে হবে।’
‘দুটো দিন থাকলেন, আমাদের খুব ভাল লাগল।’
‘আমারও খুব ভাল লাগল। আজ শহরটা একটু ঘুরে দেখারও সুযোগ পেলাম। ভাগ্যিস বৃষ্টি ছিল না।’
আদিত্যর কথা শেষ হতে না হতে দু’একটা বৃষ্টির ফেঁটা ওদের গায়ে এসে পড়ল।
‘দেখেছেন, বৃষ্টির কথা বলতে না বলতেই বৃষ্টি এসে গেল। মানুষ হলে বলতাম অনেকদিন বাঁচবে। জোরে বৃষ্টি নামবে মনে হচ্ছে।’
‘সত্যি বলতে কি বৃষ্টি আমার বেশ ভালোই লাগে। ছোটবেলায় সুযোগ পেলেই বৃষ্টিতে ভিজতাম। আর ভিজলেই জ্বর।’ আদিত্য হাসল। বকুলের দিকে তাকাল। বকুল চোখ নামিয়ে নিয়েছে। একটু পরে বলল, ‘চলুন নীচে যাওয়া যাক।’ অন্ধকারে বকুলের শেষ কথাগুলো খানিকটা দীর্ঘশ্বাসের মতো শোনাল।