ভূতুড়ে টেলিফোন – ৬
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
(১)
সকালটা ইচ্ছে করেই আদিত্য হাতে রেখেছিল। বকুলকে সে বলেছে রাত্তিরের ট্রেন, অতএব বিকেলে বেরোতেই হবে। তার আগে কয়েকটা কাজ সেরে নেওয়া দরকার। মন্টুবাবু আটটা বাজতে না বাজতেই বেরিয়ে গেছেন। আদিত্য যখন বেরোল তখন সাড়ে নটা। বকুলকে বলল, টুকিটাকি কিছু কেনাকাটা আছে। বকুল বলল, ‘তাড়াতাড়ি ফিরবেন, দুপুরে একসঙ্গে খাব।’
কিছুটা হেঁটে, কিছুটা অটোতে চড়ে আদিত্য থানায় পৌঁছল দশটা নাগাদ। দেখল, একজন দোহারা চেহারার অফিসার ডেস্কে বসে আছেন।
‘বড়বাবু, মানে বলাইবাবুর সঙ্গে দেখা করতে পারি?’ আদিত্য জিজ্ঞেস করল।
‘বড়বাবু সাড়ে এগারোটা বারোটার আগে আসেন না, দরকার থাকলে আমাকে বলতে পারেন।’
আদিত্য ইতস্তত করল। তারপর বলল, ‘বড়বাবুর ফোন নম্বরটা আমার সঙ্গে আছে। আমি ওঁকে একটা ফোন করে নিই?’
‘যাকে ইচ্ছে ফোন করুন। তবে এই জায়গাটা ছেড়ে ওই বেঞ্চিটাতে বসে ফোন করুন।’
আদিত্য বেঞ্চিতে বসে বড়বাবুর নম্বরটা লাগাল। একটা গম্ভীর পুলিশি গলায় ‘হ্যালো’ শুনতে পেয়ে বলল, ‘আমি আদিত্য মজুমদার বলছি। আমার কথা জয়েন্ট কমিশনার গৌতম দাশগুপ্ত মনে হয় আপনাকে বলেছে।’
কিছুক্ষণ স্তব্ধতা। আদিত্যর মনে হল ওপারে যিনি ফোন ধরে আছেন তিনি স্মৃতি হাতড়াচ্ছেন। আধ মিনিট পরে ভেসে এল,
‘নিশ্চয়, নিশ্চয়। আপনার কথা জয়েন্ট কমিশনার সাহেব অবশ্যই বলেছেন। সাহেব বলেছেন আপনাকে সব রকমের সাহায্য করতে। আপনি বলুন আমি আপনার জন্য কী করতে পারি?’ বড়বাবুর গলায় এখন মধু ঝরে পড়ছে।
‘আমি আপনার জন্য থানায় অপেক্ষা করছি। আপনি কখন আসবেন?’
‘এই মিনিট পনেরোর মধ্যে চলে আসছি স্যার।’
‘আসুন। এলে কথা হবে।’
ফোন রাখার কিছুক্ষণ পরেই আদিত্য লক্ষ করল ডেস্কের অফিসার বাবুটির কাছে একটা ফোন এসেছে। এবং তার খানিকটা পরে যখন থানার বাবুদের জন্য কেটলি করে চা এল, ডেস্কের বাবুটি আদিত্যর সামনে এক ভাঁড় চা নিয়ে এসে একগাল হেসে বললেন,
‘খেয়ে নিন স্যার। বড়বাবু এসে পড়লেন বলে।’
নিশ্চয় বড়বাবু ফোন করে আদিত্যকে আদর-আপ্যায়ন করার কথা বলে দিলেন। আদিত্যর মনটাও চা-চা করছিল। চা শেষ করে সে একটা সিগারেট খেতে সবে বাইরে বেরিয়েছে, দ্যাখে বড়বাবুর জিপ থানার সামনে এসে দাঁড়াল।
বড়বাবু মানুষটি নাতিদীর্ঘ, স্থূলকায়, কৃষ্ণবর্ণ ও বিরলকেশ। ভারসাম্য রাখার জন্যই বোধহয় নাকের নীচে প্রকাণ্ড গোঁফ রেখেছেন। মানুষটি প্রয়োজন বিশেষে বিনত বা উদ্ধত হতে পারেন। এককথায়, আদিত্যর মনে হল, বড়বাবু লোকটি অতিশয় ঘোড়েল। আবার চা এল, সঙ্গে সিঙ্গাড়া-মিষ্টি। আদিত্য একে সকালে কম খায় তার ওপর একটু আগে ভারি ব্রেকফাস্ট খেয়ে বেরিয়েছে, আর কিছু খাওয়া তার পক্ষে অসম্ভব। চায়ের ভাঁড়ে চুমুক দিয়ে সে কাজের কথায় এল,
‘গৌতম নিশ্চয় আপনাকে বলেছে কেন আমি এখানে এসেছি। তবু আর একবার বলছি, আপনার অঞ্চলে ড্রাগ পেডলারদের যে গ্যাংটা বেশ কিছুদিন ধরে দৌরাত্ম করে বেড়াচ্ছে তাদের ধরার জন্য গৌতমকে আমি সাহায্য করছি। এ-ব্যাপারে আপনারও আন্তরিক সাহায্য চাই।’
‘আমি তো স্যার একশ ভাগ সাহায্য করতে রাজি। দাশগুপ্ত সাহেব বললে আমি করতে পারি না এমন কাজ নেই। অমন সৎ দক্ষ অফিসার আর হয় না। তবে কিনা, যেটা আমি দাশগুপ্ত সাহেবকেও বারবার বলছি, এ তল্লাটে ড্রাগ পেডলারদের কোন গ্যাং আর নেই স্যার।’
‘গ্যাং-ই নেই?’
‘না স্যার। গ্যাং-ই নেই। আগে ছিল। সেই গ্যাংটা সুশান্ত হালদার বলে একজন চালাত। দেবীরঞ্জন বসাক ছিল তার ডানহাত। কিছুদিন আগে তাদের জেল হয়। জেলের ভাত খেয়ে ছেলে দুটো একেবারে বদলে গেছে। দেখবেন, দুজনে মিলে একটা সাইবার কাফে চালাচ্ছে। ভালোই চলছে। আমাদের তো স্যার এইসব দাগী আসামীদের ভালো হতে সাহায্য করা উচিত। তাই না স্যার?’
‘আপনাদের এখানে যদি ড্রাগ পেডলাররা না থাকে তাহলে দুমাস অন্তর রেললাইনের ধারে লাস পড়ে কেন? আব্দুলের ঠেকে পাতাখোররা ভিড় করে কেন?’
‘স্যার, আব্দুল কোথা থেকে তার মাল নিয়ে আসে আমরা এখনো ধরতে পারিনি। তবে আমি দায়িত্ব নিয়ে বলতে পারি এই অঞ্চলে এখন আর কোনও গ্যাং নেই স্যার। আর লাস পড়ার কথা যদি বলেন, এদিকটায় এখনও অনেক ওয়াগন ব্রেকার আছে। জায়গাটা রেল লাইনের ধারে তো। তাদের মধ্যে বখরা নিয়ে মারামারি লেগেই থাকে। এসব কথা কর্তারা লালবাজারে বসে ঠিক বুঝতে পারেন না স্যার। সমস্ত ঝামেলা, গণ্ডগোল ড্রাগওলাদের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া হয়।’
বড়বাবু চুপ করলেন। আদিত্য আর কী জিজ্ঞেস করবে ভেবে পেল না। লোকটা, সন্দেহ নেই, ড্রাগওয়ালাদের টাকায় আকণ্ঠ ডুবে আছে। খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে আদিত্য বলল,
‘আমাকে সাহায্য করার জন্য অনেক ধন্যবাদ।’
‘আপনাকে সব রকম সাহায্য করা তো আমার কর্তব্য স্যার। বিশেষ করে জয়েন্ট কমিশনার সাহেব যখন আপনার কথা এত করে বলেছেন।’
বড়বাবুর কণ্ঠে একটা প্রচ্ছন্ন শ্লেষ আছে। একটা চ্যালেঞ্জ। আদিত্য আর কথা না বাড়িয়ে থানা থেকে বেরিয়ে পড়ল।
(২)
ফেরার পথে মন্টুবাবুর পড়শি রামানুজ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা। ভদ্রলোকের হাতে বাজারের থলে। পুঁইশাক, কুমড়োর ফালি উঁকি মারছে।
‘আসুন না আমার বাড়িতে, এক কাপ চা খেয়ে যাবেন।’ ভদ্রলোক বললেন, ‘একাই থাকি, আসুন না কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলা যাবে।’
আদিত্য ঘড়ি দেখল, সাড়ে এগারোটা। বকুল একসঙ্গে খাবে বলেছিল। নিশ্চয় সেটা সাড়ে বারোটার আগে নয়। হাতে সময় আছে। কিছুক্ষণ রামানুজবাবুর সঙ্গে কাটালে মন্দ কী?
রামানুজবাবুর বাড়িটা ছোট, কিন্তু সাজানো। একদিকে রান্নাঘর। রামানুজবাবু বাজার নামিয়ে রেখে চায়ের জল চাপালেন।
‘আপনার মতো আমিও পশ্চিমের লোক। আমার ঠাকুরদাদা লাহোরে ওকালতি করতেন।’ রামানুজবাবু টি পটে দু চামচ চা পাতা দিতে দিতে বললেন, ‘দেশভাগের পর আমার বাবা আর পশ্চিমবঙ্গে ফেরেনি। তবে দুই কাকা এই কলকাতাতেই সেটল করেছিলেন। তাঁদের একজন এখনও বেঁচে আছেন। এই দুই কাকার পরিবারই এখন আমার আপনার জন।’
আদিত্য লক্ষ করল রামানুজবাবুর সেই কমিকাল ভঙ্গীটা আর নেই। গলার আওয়াজ যদিও সেইরকমই মিহি, কিন্তু তার মধ্যেই একটা সিরিয়াস ভাব রয়েছে।
‘আমি জয়পুরে বড় হয়েছি। বাবা-মায়ের এক সন্তান। কলেজ থেকে বেরিয়ে রাজস্থান পুলিশে চাকরি পেলাম। বছর দশেক সেখানেই চাকরি করলাম। তারপর একটা বেসরকারি কোম্পানির সিকিউরিটি অফিসার হয়ে আরও পঁচিশ বছর। সংসার করা হয়ে ওঠেনি। ভাবলাম শেষ জীবনটা শিকড়ে ফিরে যাব। কলকাতায় ফিরে এলাম। তাও ছয় বছর হল। এখানকার আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে মিলে-মিশে ভালই আছি। এই দেখেছেন, নিজের কথাই বলে যাচ্ছি। আপনার কথা বলুন। আপনার কথা শুনব।’
‘আমার তো বলার মতো তেমন কিছু নেই। মধ্যপ্রদেশে জন্ম-কম্ম। এখন সেখানেই একটা ব্যাঙ্কে চাকরি করি। আমার জীবনে উল্লেখযোগ্য কিছুই নেই যা বলা যায়।’ আদিত্য সাবধান হয়ে বলল।
‘সবার জীবনেই কিছু না কিছু থাকে। আপনারও নিশ্চয় আছে। তবে বলতে না চাইলে অন্য কথা।’ রামানুজবাবু একটু থামলেন, তারপর আস্তে আস্তে বললেন,
‘আপনি যদি আপনার কথাটা বলতেন তাহলে আমিও আমার কিছু কথা আপনাকে বলতে পারতাম।’
আদিত্য একটু ঘামছিল। খুব তাড়াতাড়ি একটা সিদ্ধান্ত নিতে হবে। রামানুজবাবুকে কি বিশ্বাস করা যায়? আদিত্য ভাবছে কী করবে। মনে পড়ল, কলেজে তার প্রিয় মাস্টারমশাই প্রফেসর শান্তনু মিত্র বলতেন, একজন চিন্তাশীল মানুষের সব থেকে বড় অস্ত্র তার ইন্টুইশন, এমন একটা অনুভূতি যেটা সাধারণ বুদ্ধি দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না। কথাটা যে কতটা দামী গোয়েন্দাগিরি করতে এসে আদিত্য পদে পদে টের পায়। এখানেও তার ইন্টুইশনকেই কাজে লাগাতে হবে। তার মন বলছে, রামানুজ চাটুজ্জেকে বিশ্বাস করা যায়। অনেকক্ষণ চুপ করে থাকার পর সে বলল,
‘আমিও আপনার সঙ্গে কিছু কিছু জিনিস আলোচনা করতে চাই। সময় নষ্ট করে লাভ নেই। আপনার সন্দেহটাই ঠিক। আমি একজন বেসরকারি গোয়েন্দা। মন্টুবাবু আমাকে ভূতুড়ে টেলিফোন রহস্য সমাধান করার জন্য নিয়োগ করেছেন। তবে আমার এখানে আসার আর একটা উদ্দেশ্য আছে। এই অঞ্চলে একটা ড্রাগ ডিলারদের গ্যাং বেশ কিছুদিন ধরে দৌরাত্ম্য করছে। পুলিশ হাজার চেষ্টা করেও তাদের মাথাটাকে ধরতে পারছে না। এই গ্যাংটাকে ধরার ব্যাপারে পুলিশকে আমি সাহায্য করছি। কিন্তু স্থানীয় থানা থেকে কোনও সহযোগিতা পাওয়া যাবে বলে মনে হচ্ছে না। একটু আগে ওসির সঙ্গে কথা বলে মনে হল তিনি ড্রাগ পেডলারদের থেকে নিয়মিত টাকা পেয়ে থাকেন। তিনি বলার চেষ্টা করলেন, এই অঞ্চলে ওই ধরনের গ্যাং-ট্যাং কিছু নেই। আপনি তো এখানে বেশ কিছুদিন আছেন আপনার কিছু চোখে পড়েছে? মানে অন্য কারো চোখে না পড়লেও আপনার ট্রেনড চোখে অনেক কিছু নজরে আসতে পারে।’
‘আপনি আমার সঙ্গে খোলাখুলি কথা বললেন, এতে আমার খুব ভাল লাগছে। আপনার মতো কারও সঙ্গে কথা বলার জন্য আমি দীর্ঘদিন অপেক্ষা করে আছি। আমি পুলিশকে সাহায্য করতে চাই। কিন্তু চেষ্টা করে দেখেছি সেটা সম্ভব নয়। আপনি একেবারে ঠিক কথাটা বলেছেন। এই অঞ্চলের পুলিশরা সব বিক্রি হয়ে গেছে। আমার কথা তারা শুনবে কেন?’ রামানুজবাবুকে বেশ উত্তেজিত মনে হল।
‘আপনি পুলিশকে কী বলতে গিয়েছিলেন?’ আদিত্য জিজ্ঞেস করল।
‘তিনটে জিনিস আমার বলার ছিল। আমার ধারণা মন্টুবাবুর বাড়ির পেছনের গলিটাতে কোনও রহস্য আছে। ঠিক কী বলতে পারব না, গলিটা আমার বাড়ি থেকে দেখাও যায় না, পুরোনো কারখানাটার ভাঙা একটা পাঁচিলে আড়াল পড়ে যায়। কিন্তু কয়েকবার ওখান দিয়ে আসার সময় দেখেছি কারা যেন রয়েছে। আমাকে দেখে যেন সরে গেল। সব মিলিয়ে আমার মনে হয়েছে গলিটার ওপরে পুলিশের নজর রাখা উচিত।’
‘এটা তো একটা জিনিস হল। আর কিছু?’
‘হ্যাঁ, দ্বিতীয়ত আমার মনে হয়েছে আমাকে এই বাড়ি থেকে কেউ তাড়াবার চেষ্টা করছে। রাত্তিরে নানারকম শব্দ শোনা যায়। দিন দুপুরেও ছোটখাট উৎপাত লেগে থাকে। জানলায় ঢিল পড়ে, কাচ ভাঙে, ছাতে কারা যেন পায়চারি করে। আমি এই বাড়িতে থাকলে যেন কাদের খুব অসুবিধে হচ্ছে। আমার বাড়িওলা স্বামী-স্ত্রী দুজনেই অবশ্য আমাকে বারবার অভয় দিয়েছেন। বলতে গেলে ওদের ভরসাতেই এখানে রয়ে গেছি। তাছাড়া একটা জেদও চেপে গেছে।’
‘আর কিছু?’
‘হ্যাঁ, তৃতীয় যেটা বলতে চাই সেটা বলার জন্য খানিকটা পিছিয়ে যেতে হবে। জয়পুরে থাকার সময় আমরা একটা বাঙালি পরিবারকে চিনতাম। খুব বেশিদিনের জন্য নয়। মাস আটেক ওরা আমাদের সামনের বাড়িতে ভাড়া ছিল। সেই পরিবারে একটি মেয়ে ছিল তার নাম ছিল আলপনা, আলপনা দত্ত। আমি যখন ওদের চিনতাম তখন আলপনা খুবই ছোট, ফ্রক পরে ইশকুলে যায়। ওই আটমাসের পর তাকে আর কোনোদিন দেখিনি। মন্টুবাবুর বাড়িতে আসার পরে শুনলাম সুলতার এক মাসি, তার নামও আলপনা, বিয়ের আগে আলপনা দত্তই নাম ছিল, এখানে আসত, কখনো কখনো থেকেও যেত, সুলতার দেখাশোনা করত, হঠাৎ সে উধাও হয়ে গেছে। আমার মনে হল এই আলপনা সেই জয়পুরের আলপনা নয়ত? তারপর যখন শুনলাম সুলতার মাসিও জয়পুর থেকে এসেছিল, তখন আমার কৌতূহল আরও বাড়ল। কিন্তু আমার কৌতূহল নিরসনের কোনও উপায় ছিল না। তারপর বছর দুয়েক আগে আমার এক খুড়তুতো ভাইয়ের পুরোনো অ্যালবাম থেকে একটা ছবি বেরিয়ে পড়ল। খুড়তুতো ভাইরা যখন জয়পুরে আমাদের কাছে বেড়াতে গিয়েছিল সেই সময়ের তোলা ছবি। দেখলাম সেই ছবিতে অনেকের সঙ্গে আলপনাও আছে। আমার কী মনে হল, ছবিটা আমি চেয়ে নিলাম। পুরোনো ছবি, কোনও নেগেটিভ নেই, ভেবেছিলাম ছবিটার একটা কপি করে নিয়ে আমার খুড়তুতো ভাইকে ফেরত দিয়ে দেব। করছি করব করে কপিটা আর করানো হয়নি। ছবিটা একদিন মন্টুবাবুদের দেখালাম। একটা রবিবারের দুপুরে ওদের বাড়িতে নেমন্তন্ন হয়েছিল, সেখানে তখন রজনীবাবুরাও ছিলেন। মন্টুবাবুর দ্বিতীয় স্ত্রী তো অবশ্যই ছিলেন। পুরোনো কথা হচ্ছিল। কথায় কথায় সুলতার মাসির প্রসঙ্গ উঠল। আমার তখন ছবিটার কথা মনে পড়ে গেল। ভাবলাম ছবিটা এনে দেখাই, যদি কেউ চিনতে পারে। বলাই বাহুল্য ছবিটা আমার সঙ্গে ছিল না। আমি বাড়ি থেকে ছবিটা নিয়ে এসে সকলকে দেখালাম। কেউই ছবিটাকে চিনতে পারল না। আমি নিশ্চিত হলাম, আমার দেখা আলপনা দত্ত আর সুলতার মাসি আলপনা দত্ত সম্পূর্ণ আলাদা লোক। তারপর, সত্যি বলতে কি, ব্যাপারটা ভুলেই গিয়েছিলাম। কিছুদিন আগে আবার ছবিটার কথা মনে পড়ল। মনে হল, একটা কপি করে নিয়ে ছবিটা ফেরত দেওয়া দরকার। একটা অ্যালবামের মধ্যে আলগাভাবে ছবিটা রাখা ছিল। কিন্তু অ্যালবামটা খুলে দেখি ছবিটা সেখানে আর নেই। তন্নতন্ন করে খুঁজলাম, ছবিটা কোথাও নেই। আমি কিন্তু ঠিক জিনিসপত্র হারিয়ে ফেলার লোক নই। গোছানো লোক বলে আমার একটু গর্বই আছে। তাই সমস্ত ব্যাপারটা বেশ অদ্ভুত।’
‘ছবিটা হারিয়ে যাবার কথা কাউকে বলেছিলেন?’
‘বোধহয় মন্টুবাবুকে বলেছিলাম। ঠিক মনে পড়ছে না।’
‘আপনার তিনটে জিনিসই বেশ ইন্টারেস্টিং। আমি মাথায় রাখব।’
আদিত্য ঘড়ি দেখল। সোয়া বারোটা। বকুলের সঙ্গে দুপুরে ভাত খেতে হলে এখনই উঠতে হবে।
(৩)
রাস্তায় নেমেই রজনী বসাকের সঙ্গে দেখা।
‘আপনার সঙ্গে তো ভাল করে আলাপই জমল না সেদিন।’ আদিত্যই এগিয়ে গিয়ে কথা বলল।
‘কে? ও সূর্যবাবু? কেমন আছেন? আমি এই একটু বকুলের সঙ্গে দেখা করে গেলাম। রোজই অফিস যাবার পথে একবার দেখা করে যাই। আসবেন নাকি একদিন আমাদের অফিসে? দেখাতাম, কত বিচিত্র জায়গায় আমরা বাঙালিকে বেড়াতে নিয়ে যাচ্ছি।’
‘আমি তো আজ রাত্তিরের ট্রেনেই ভিলাই ফিরে যাচ্ছি। যেতে হলে এখনই যেতে হয়। আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে আপনারা কোথায় কোথায় নিয়ে যান। ভিলাইতেও অনেকে ইন্টারেস্টেড হতে পারে। আপনাদের ব্রোশিয়র বা ফ্লায়ার গোছের কিছু পেলে নিয়ে যেতাম।’
‘এখনই চলুন না আমার সঙ্গে।’
আদিত্য একটু ভাবল। বকুল একসঙ্গে লাঞ্চ খাবে বলেছিল। এখন রজনীবাবুর সঙ্গে গেলে সেটা হবে না। সে ঠিক করল রজনীবাবুর সঙ্গেই যাবে। কিন্তু বকুলকে কথাটা জানানো দরকার। আদিত্য রজনীবাবুকে একটু দাঁড়াতে বলে মন্টুবাবুর বাড়িতে ঢুকল।
মালতী বলল, ‘বৌদি এইমাত্র চান করতে ঢুকেছে। আধঘণ্টার আগে বেরোবে না।’
‘বেরোলে বৌদিকে বলে দিও আমি বৌদির দাদার সঙ্গে ওঁদের আপিসে যাচ্ছি। দুপুরের খাওয়া বাইরে খেয়ে নেব। আমার জন্য অপেক্ষা না করে যেন খেয়ে নেন।’
‘পান্থজনের সখা’র আপিসটা ক্যামাক স্ট্রীটে। একটা দশতলা বাড়ির সাততলায়। রজনীবাবুর গাড়ি যখন বাড়িটার পার্কিং লটে দাঁড়াল তখন সোয়া একটা বেজে গেছে। ছিমছাম আপিস। কয়েকজন সুবেশ, সুদর্শন তরুণ-তরুণী ডেস্কে কাজ করছে। ভেতর আপিসে আরও অনেক কর্মচারী। ডেস্কের এপারে ভ্রমণপিপাসুদের ভিড় চোখে পড়ার মতো।
রজনীবাবুর নিজস্ব চেম্বারটি চমৎকার। একদিকে দেয়াল জুড়ে জানলা, ক্যামাক স্ট্রীট লোয়ার সার্কুলার রোডের মোড় পর্যন্ত দেখা যায়। অন্য দিকের দেয়ালে বরফের ওপর সটান দাঁড়ানো একটা মস্ত গ্রিজলি বেয়ারের ছবি, নীচে লেখা ইয়ালোস্টোন ন্যাশানাল পার্ক। রজনীবাবু নিজের চেয়ারে বসে বেল বাজালেন। বেয়ারাকে বললেন,
‘অশোককে আসতে বল, আর দু’কাপ কফি দাও। কফি খাবেন তো?’ শেষ প্রশ্নটা আদিত্যকে।
কফি এল। অশোককে ‘পান্থজনের সখা’র আগামী ট্যুরগুলির খবর-সম্বলিত প্রচারপত্র আনতে বলা হল। আদিত্য জানতে পারল, আগামী ছ’মাসে ‘পান্থজনের সখা’ ইয়োরোপ, ল্যাটিন আমেরিকা, আফ্রিকা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং মধ্যপ্রাচ্যে এগারোটি সফরের আয়োজন করেছে। মাথাপিছু খরচ দেড় থেকে দুলাখের মধ্যে। দামটা আদিত্যর বেশ কমই মনে হল।
‘এত কম খরচে নিয়ে যান কী করে?’ আদিত্য রজনীবাবুকে জিজ্ঞেস করল।
‘ইচ্ছে থাকলে, বুঝলেন, সবই হয়। এটা আমার ব্যবসা নয়, প্যাশান।’
‘আপনাদের সব ট্রিপগুলোই দেখছি দুবাই বা লন্ডন দিয়ে যাচ্ছে। ওখানে কি আপনাদের আপিস আছে?’
‘ঠিক ধরেছেন। দুটো জায়গাতেই আমাদের ব্রাঞ্চ আছে। তাই হয় দুবাই, না হয় লন্ডন দিয়ে রুটটা হলে আমাদের সুবিধে হয়। তাছাড়া এমিরেটস এবং ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ দুটো কোম্পানির সঙ্গেই আমাদের চুক্তি আছে। ওরা টিকিটের দামে আমাদের ভাল ছাড় দেয়।’
আরও কিছুক্ষণ কথাবার্তার পর আদিত্য উঠে দাঁড়াল।
‘আজ চলি। ভিলাই থেকে কয়েকজনকে জুটিয়ে নিয়ে আপনাদের সঙ্গে ঝুলে পড়ব। অনেক জায়গায় যেতে ইচ্ছে করে। তবে সবার আগে আফ্রিকা।’