ভূতুড়ে টেলিফোন – ৭
সপ্তম পরিচ্ছেদ
(১)
চুল কাটার সেলুনে পৌঁছে আদিত্য দেখল তাদের মেসের নিতাইবাবু কলপ করাচ্ছেন। সেলুনটা ছোট। কুল্লে দু’জন একসঙ্গে চুল কাটতে পারে। কিন্তু দুজন নাপিতের একজন এখনও আসেনি। অতএব একটা চেয়ার ফাঁকাই রয়েছে। অন্যজন ইশারায় আদিত্যকে বসতে বলল।
কাল সন্ধেবেলা আদিত্য মন্টুবাবুর বাড়ি থেকে ফিরে এসেছে। আজ তার হাতে অনেক কাজ।
‘কতক্ষণ লাগবে?’ আদিত্য জিজ্ঞেস করল।
‘বেশিক্ষণ লাগবে না। মিনিট দশের মধ্যে হয়ে যাবে। আপনি ঘুরে আসতে পারেন। তবে আজকে আমি একা। রঘুয়া দেশে গেছে।’
যে চুল কাটছে তার নাম রমেশ, রঘুয়া তার পার্টনার। এরা ঝাড়খণ্ডের লোক। তবে অনেকদিন কলকাতায় আছে বলে পরিষ্কার বাংলা বলতে পারে। আজ বছর পাঁচেক হল দু’জনে মিলে পাড়ায় এই সেলুনটা খুলেছে। এখান থেকে আদিত্যর মেস খুব দূরে নয়। আদিত্য একবার ভাবল বাড়ি থেকে ঘুরে আসে। কিন্তু তারপর মনে হল, লাভ কী? হঠাৎ বৃষ্টি আসতে পারে। তখন আবার এখানে ফেরা মুস্কিল হবে। তাছাড়া ইতিমধ্যে নিতাইবাবুর কলপ করা শেষ হয়ে গেলে অন্য কোনও খদ্দের এসে চেয়ারটা দখল করে ফেলতে পারে। তার চেয়ে এখানেই অপেক্ষা করা ভাল।
চুল কাটার চেয়ার দু’টোর পেছনে একটা কাঠের বেঞ্চি পাতা। আদিত্য সেখানে গিয়ে বসল। নিতাইবাবুর ওপর তার খুব রাগ হচ্ছে। কলপ-করা লোক এমনিতেই তার অপছন্দ, তার ওপর এই নিতাইবাবু লোকটা রোজ সন্ধেবেলা ঘাড়ে পাউডার লাগিয়ে কোথায় যেন যায়। অনেক রাত্তিরে বাড়ি ফেরে। আদিত্য মাঝেমাঝে দেখেছে, নিতাইবাবু পাড়ার রেস্টোরেন্টে একা-একা বসে বিপুল পরিমাণ মাংস-পরোটা সাবাড় করছে। ভাবতে ভাবতে আদিত্যর হঠাৎ হাসি পেয়ে গেল। নিতাইবাবু যদি রোজ সন্ধেবেলা সেজেগুজে কোনও কুস্থানেও যায়, নিতাইবাবু যদি রোজ-রোজ রেস্টোরেন্টে বসে কাঁড়ি কাঁড়ি মাংস-পরোটা খায়, তাতে আদিত্যর কী বলার থাকতে পারে? আদিত্যর পয়সায় তো কিছু করছে না। আসলে চুল কাটার জন্য অপেক্ষা করতে হচ্ছে বলে আদিত্য বেজায় চটে গেছে। চুলটা এত বড় হয়েছে যে আজ না কাটালেই নয়, অথচ এই সকালের মধ্যেই কয়েকটা কাজ সারতে হবে।
নিতাইবাবুর কলপ-পর্ব শেষ। এখন শ্যাম্পু চলছে। এরপর দাড়ি কামানো আছে, মাথা ও ঘাড়ের দলাই-মলাই আছে। তার মানে আরও ঝাড়া পনেরো-কুড়ি মিনিট। আদিত্য অসহিষ্ণুভাবে ঘড়ি দেখল। সাড়ে নটা বেজে গেছে। আদিত্যর পাশে বেঞ্চির ওপর কিছু পুরোনো পত্র-পত্রিকা রাখা আছে। প্রায় সবই হিন্দি ভাষায় সিনেমা পত্রিকা। তারই মধ্যে অনেক খুঁজে-পেতে একটা বাংলা সিনেমা পত্রিকা পাওয়া গেল। সংখ্যাটা প্রায় এক বছরের পুরোনো। আদিত্য সময় কাটানোর জন্য সেটাই হাতে তুলে নিল।
সিনেমায় আদিত্যর খুব একটা উৎসাহ নেই। বিশেষ করে বাজার চলতি বাংলা সিনেমায়। পুরোনো কিছু হলিউড অবশ্য এখনও বেশ লাগে। আদিত্য ম্যাগাজিনের পাতা ওলটাতে ওলটাতে নানা তথ্য জানতে পারল। জানতে পারল, কোন নায়কের সঙ্গে কোন নায়িকার এখন লটঘট চলছে। কার সঙ্গে কার আড়ি হয়ে গেছে। জানতে পারল, কোন কোন ছবি মুক্তির প্রতীক্ষায় দিন গুনছে। আদিত্য ভাবল, এতদিনে এদের অনেকেরই নিশ্চয় মুক্তি ঘটে গেছে। পাতা ওলটাতে ওলটাতে একটা জায়গায় আদিত্যর চোখ আটকে গেল। বাংলা সিনেমার ফাইন্যান্সিং-এর ওপর একটা লেখা। প্রতিবেদক লিখছেন, বলিউডের মতো টলিউডেও এখন একটু একটু করে অপরাধ জগতের টাকা ঢুকছে। এর মূল অসুবিধে হল, মাঝেমাঝে নানারকম আইনের ঝামেলায় এইসব টাকার স্রোত শুকিয়ে যায়, কখনও বা যিনি টাকা যোগাচ্ছিলেন তাঁকেই শ্রীঘরে ঢুকতে হয়, ফলে বহু সিনেমা শুরু হয়েও মাঝপথে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।
মাঝপথে আটকে যাওয়া এই রকম কয়েকটা সিনেমার কথা প্রতিবেদক লিখেছেন। তার মধ্যে একটি সিনেমা, নাম ‘লাভ ইন অকল্যান্ড’, যার নামটা ইংরেজিতে হলেও বাকি সব কিছু বাংলায়, অনেকদিন বন্ধ থাকার পর সম্প্রতি আবার শুরু হয়েছে। সিনেমাটি নতুন করে প্রযোজনা করছে ‘পান্থজনের সখা’ নামে একটি ভ্রমণ-সংস্থা। এই সংস্থাটি ভ্রমণ-পিপাসুদের একটি অভিনব প্যাকেজ দিচ্ছে। যেসব ভ্রমণকারী ‘পান্থজনের সখা’র মাধ্যমে নিউজিল্যান্ড বেড়াতে যাবেন তাঁদের অকল্যান্ড, হ্যামিলটন, ওয়েলিংটন, ক্রাইস্টচার্চ ইত্যাদি শহর ঘোরানো ছাড়াও অতি শীঘ্র নিউজিল্যান্ডে অনুষ্ঠিতব্য ‘লাভ ইন অকল্যান্ড’ ছবির শুটিংও দেখানো হবে।
‘খালি আছে নাকি?’ নতুন কোনও খদ্দের সেলুনে ঢুকেছে।
‘একটু সময় লাগবে’ রমেশ নিতাইবাবুর মাথা দলাই-মলাই করতে করতে বলল, ‘এটা হয়ে গেলে যে বাবু বসে আছেন তিনি চুল কাটবেন।’
আদিত্য বুঁদ হয়ে লেখাটা পড়ছে। ‘লাভ ইন অকল্যান্ড’ ছবির নায়ক-নায়িকার মুখ দুটো আদিত্যর পরিচিত। তাঁদের অনেকগুলো ছবি ছাপা হয়েছে। নায়িকা জানিয়েছেন, নিউজিল্যান্ডে শুটিং করতে যাবার ব্যাপারে তিনি খুবই উৎসাহী, যেহেতু তিনি আগে কখনও নিউজিল্যান্ড যাননি। নায়ক অবশ্য বলেছেন, গত বছরেই ছুটি কাটাতে তিনি নিউজিল্যান্ড গিয়েছিলেন। ‘পান্থজনের সখা’র তরফ থেকে শুটিং ও ভ্রমণের ব্যাপারটা দেখাশোনা করছেন কোম্পানির লন্ডন অফিসের কর্ত্রী শ্রীলেখা ভট্টাচার্য। প্রতিবেদনের সঙ্গে তাঁর ছবিসহ একটা সংক্ষিপ্ত বক্তব্যও ছাপা হয়েছে। তিনি বলেছেন, তাঁদের মত প্যাকেজ সারা বাংলায় কেন সারা পৃথিবীতে এই প্রথম। ছবিটা খানিকটা অস্পষ্ট। ভালভাবে খেয়াল করলে দেখা যাবে ছবিতে জনৈকা বয়কাট চুল কালো ফ্রেমের চশমা পরা ভদ্রমহিলা দর্শকের দিকে তাকিয়ে আছেন। ভদ্রমহিলা শুভ্রকেশ, কিন্তু তাঁর মুখচ্ছবিটি এখনও বেশ খুকি-খুকি রয়েছে। আদিত্য নিতাইবাবুর প্রতি কৃতজ্ঞতা বোধ করছে। তিনি অতক্ষণ চেয়ার দখল করে বসে না থাকলে, এই সিনেমা পত্রিকাটা দেখাই হত না। আদিত্য জাদুকরী ক্ষিপ্রতায় পত্রিকাটা তার গেঞ্জির ভেতরে চালান করে দিল। জাদুকরের সাগরেদি করাটা তার এই সময়ে খুব কাজে লাগল।
নিতাইবাবু উঠে পড়েছেন। ‘চলে আসুন বাবু, হয়ে গেছে’, রমেশ আদিত্যকে চুল কাটতে ডাকছে।
(২)
‘ভাস্কর, আমি আদিত্য বলছি, আদিত্য মজুমদার।’
‘আদিত্য? আরে কেমন আছিস? কতদিন তোর সঙ্গে দেখা হয় না, কথা হয় না।’
‘তুই তো মাঝেমাঝে ফোন করতিস। অনেকদিন করিসনি কেন ?’
‘আর বলিস না। আমার পুরোনো মোবাইলটা হারিয়ে গেছে। নতুন একটা কিনেছি, কিন্তু সব ফোন নম্বর পুরোনো মোবাইলে সেভ করা ছিল। এখন একটু একটু করে ফোন নম্বরগুলো উদ্ধার করার চেষ্টা করছি। তুই ফোন করে ভাল করলি। তোর নম্বরটা সেভ করে রাখব।’
‘শোন, একটা জরুরি দরকারে তোকে ফোন করেছিলাম। আমার যতদূর মনে পড়ছে, তুই এম এসসি-র পর কিছুদিন ট্যাংরার দিকে একটা মেয়েদের কলেজে পার্টটাইম পড়িয়েছিলি না?’
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ। ইস্ট মেট্রোপলিটান গার্লস কলেজে। আট মাস মতো পড়িয়েছিলাম। তারপর তো বিদেশ চলে গেলাম।’
‘সেই কলেজের কিছু পুরোনো খবর দরকার। এমন কেউ তোর চেনা আছে যে কলেজের পুরোনো খবর দিতে পারে?’
‘তোর গোয়েন্দাগিরির জন্য লাগবে?’
‘তাছাড়া আর কি?’
‘চেনা আছে। আমি যখন ওই কলেজে পড়াতাম, ওখানকার প্রিন্সিপাল ছিলেন মহিতোষবাবু, মহিতোষ ভাদুড়ি। তোদের সাবজেক্টের, মানে অঙ্কের লোক। পুরোনো প্রেসিডেন্সি। তবে আমাদের থেকে অন্তত পঁচিশ বছরের সিনিয়র। এখন রিটায়ার করেছেন। লেক মার্কেটের পেছন দিকে রাজা বসন্ত রায় রোডে থাকেন। ঠিকানাটা মনে আছে। পি ১৩২। একসময় খুব যেতাম তো। কিন্তু ফোন নম্বরটা পুরোনো মোবাইলে ছিল, হারিয়ে গেছে। নাহলে আমি একটা ফোন করে দিতাম।’
‘ফোন করার দরকার নেই। আমি ম্যানেজ করে নেব।’
‘আমারও তাই মনে হয়। এমনিতেই অমায়িক মানুষ। তার ওপর যদি গিয়ে বলিস তুইও প্রেসিডেন্সিতে পড়েছিস, খুব খুশি হবেন।’
‘শোন আজ রাখছি। খুব শিগগির একদিন আড্ডা দিতে হবে। পুরোনো বন্ধুরা সব স্মৃতির গম্বুজ হয়ে যাচ্ছে।’
‘যা বলেছিস।’ ভাস্কর রেফারেন্সটা ধরতে পারল না।
‘রাখছি তাহলে।’
‘ও-কে। পরে ফোন করব।’
মহীতোষবাবুর বাড়িটা পুরোনো, মনে হয় বাপ-ঠাকুরদাদার আমলের। একতলা বাড়ি, সামনে এক সময় বাগান ছিল, এখন আগাছার জঙ্গল। ভাবতে আশ্চর্য লাগে, এমন জায়গায় একটা পুরোনো বাড়ি পড়ে আছে অথচ এখনও প্রোমোটিং হয়নি। লোহার গেট আলগা করে লাগানো, আদিত্য গেট খুলে সদর দরজা অব্দি পৌঁছে বেল বাজাল। একটা পুরোনো ফিয়াট গাড়ি বাগানের এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে। গাড়িটা চলে তো? একটু পরে দরজার পেছনে চটির আওয়াজ। দরজা ফাঁক হয়ে এক সৌম্যদর্শন বৃদ্ধের জিজ্ঞাসু মুখ উঁকি মারল, ‘কাকে চাইছেন?’
‘মহীতোষ ভাদুড়ির সঙ্গে দেখা করতে পারি?’
‘আমিই মহীতোষ ভাদুড়ি। বলুন কী দরকার?’
‘আমি ভাস্কর ঘোষের বন্ধু। যে ভাস্কর কিছুদিন আপনাদের কলেজে কেমিস্ট্রি পড়িয়েছিল, এখন যাদবপুরে আছে। আমি আদিত্য মজুমদার। ভাস্করের সঙ্গে প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়তাম। যদি পাঁচ মিনিট আপনার সঙ্গে কথা বলতে পারতাম।’
‘ভেতরে আসুন।’ ভাস্কর ঠিক বলেছিল। প্রেসিডেন্সি শুনে বুড়োর মন গলেছে। ‘আপনারও কি কেমিস্ট্রি?’ মহীতোষবাবু বাড়ির ভেতর ঢুকতে ঢুকতে জিজ্ঞেস করলেন।
‘না, না, কলেজে আমার বিষয় ছিল অঙ্ক।’
‘অঙ্ক? স্ফেনডিড। আজকালকার ছেলেমেয়েরা তো ম্যাথেম্যাটিক্স পড়তেই চায় না। অথচ অঙ্ক ছাড়া সায়েন্স এক পা এগোতে পারে? এখন তো শুনি সোশাল সায়েন্স-এও বেশ অঙ্ক লাগছে।’
আদিত্য মহীতোষবাবুর পেছন পেছন একটা হল পেরিয়ে বৈঠকখানায় ঢুকেছে। একটা বেতের সোফা সেট, এক দিকে লেখার টেবিল, চেয়ার, দেয়াল আলমারি, সেখানে আদিত্য তার ছাত্রজীবনের কিছু পরিচিত বই দেখতে পেল।
‘এবার বলুন কী দরকার।’ মহীতোষবাবু সোফায় বসে বললেন।
উত্তরে কিছু বলবার আগে আদিত্য তার একটা ভিজিটিং কার্ড বার করে মহীতোষবাবুর হাতে দিল।
‘প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর? বেসরকারি গোয়েন্দা?’ মহীতোষবাবুর কপালে তিন থাক প্রশ্নের ভাঁজ। ‘হঠাৎ আমাকে আপনার দরকার পড়ল কেন?’
‘বলছি। আপনার কলেজের দুটি পুরোনো ছাত্রী সম্বন্ধে একটু জানতে চাই। বছর কুড়ি আগে তারা ইস্টার্ন মেট্রোপলিটান কলেজে পড়ত। আপনি তখন প্রিন্সিপাল ছিলেন। একজনের নাম ছিল বকুল বসাক, অন্যজন শ্রীলেখা ভট্টাচার্য। দ্বিতীয়জনের পদবীটা ভুলও বলতে পারি।’
‘দু’টো নামই ঠিক বলেছেন। দু’জনকেই আমার মনে আছে। তবে আলাদা আলাদা কারণে। বকুল বসাক একটা স্ক্যান্ডেলে জড়িয়ে পড়েছিল। তাকে কলেজ থেকে রাস্টিকেট করা হয়েছিল। পাশের কলেজের একটি ছোকরার সঙ্গে তাকে অত্যন্ত কম্প্রোমাইজিং অবস্থায় কলেজের ছাতে দেখতে পাওয়া যায়। সেই ছোকরা তো আমার কলেজের নয়। তাই তাকে কিছুই করতে পারিনি। কিন্তু বকুল বসাককে কলেজ থেকে বহিষ্কার করেছিলাম। আমার সময় আমি কলেজে স্ট্রিক্ট ডিসিপ্লিন রাখার চেষ্টা করতাম। মেয়েদের কলেজে এটার খুব দরকার।’
‘যে ছেলেটির সঙ্গে বকুল বসাককে অশালীনভাবে দেখা গিয়েছিল, তার নাম কি সুশান্ত হালদার?’
‘আমি নামটা সম্পূর্ণ ভুলে গিয়েছিলাম। আপনি বলতে মনে পড়ে গেল। নামটা ওটাই বটে।’
‘আর শ্রীলেখা ভট্টাচার্য?’
‘শ্রীলেখা ছিল আমাদের কলেজের গর্ব। ভীষণ ভাল অভিনয় করত। বার দুয়েক ইন্টার কলেজ ড্রামা কম্পিটিশনে শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর পুরস্কার এনেছিল। শ্রীলেখার সঙ্গে কিছুদিন আগেও একটা বিয়ে বাড়িতে আমার দেখা হয়েছে। বলল, অভিনয় একেবারেই ছেড়ে দিয়েছে। লন্ডনে একটা ট্র্যাভেল এজেন্সি চালায়। বিয়ে করেনি। মাথার চুল সব সাদা হয়ে গেছে। আমি প্রথমটা দেখে চিনতেই পারিনি।’ মহীতোষবাবু একটু থেমে বললেন, ‘আচ্ছা, আপনি আমাকে এতসব কথা কেন জিজ্ঞেস করছেন বলুন তো?’
‘বকুলের বর্তমান স্বামীর ধারণা বকুলকে সুশান্ত হালদার ব্ল্যাকমেল করছে। তাই বকুলের অতীত সম্বন্ধে একটু খোঁজ নিচ্ছিলাম। শুনলাম, শ্রীলেখা বকুলের খুব বন্ধু ছিল। তাই তার সম্বন্ধেও একটু জানতে ইচ্ছে করছিল। বকুলের স্বামী আমাকে হায়ার করেছেন।’
মহীতোষবাবু খানিকক্ষণ ভাবলেন। তারপর বললেন, ‘বকুলের সঙ্গে শ্রীলেখার একটা আশ্চর্য বন্ধুত্ব ছিল। দুজন দুজনকে ছেড়ে প্রায় থাকতেই পারত না। বকুল রাস্টিকেট হতে শ্রীলেখা খুব ভেঙে পড়েছিল। তার জন্যে আমার খারাপ লাগত। কিন্তু বকুল বসাকের জন্য আমার কোনও সিমপ্যাথি নেই। ওইসব মেয়ের কপালে ব্ল্যাকমেলই লেখা থাকে।’
(৩)
আধমরা রোদ। মেঘের ফাঁক দিয়ে মাঝেমাঝে সূর্য উঁকি মারছে। তবে মেঘ সরে গেলেই রোদ্দুর আবার নিজমূর্তি ধারণ করবে। আদিত্যকে ছোটবেলায় কে যেন শিখিয়েছিল, ভাদ্রমাসের অর্ধেক দিন মুচির, অর্ধেক দিন চাষার। কথাটা মিথ্যে নয়। আদিত্য বেলগাছিয়া মেট্রো স্টেশনে নেমে খানিকটা হেঁটে মিল্ক কলোনির মোড় থেকে একটা বাস ধরে নর্দার্ন এভিনিউ-এর মোড়ে গিয়ে নামল। তারপর নর্দার্ন এভিনিউ ধরে খানিকটা হেঁটে একটা দোতলা বাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়াল। এটা মন্টুবাবুর বাড়ি। এই বাড়ির দোতলায় সুলতার হারিয়ে যাওয়া মাসি থাকতেন। একতলাটা অবশ্য চিরকালই বন্ধ থাকে। তখনও থাকত। দোতলায় মন্টুবাবু কিছুদিন হল নতুন ভাড়াটে বসিয়েছেন। বাড়ির উল্টোদিকে ব্যাঙ্ক। এখানেই আদিত্যর দরকার।
এই অবেলায় ব্যাঙ্কে বিশেষ ভিড় নেই। আদিত্য ম্যানেজারের ঘরে গিয়ে নিজের পরিচয় দিতে ম্যানেজার খাতির করে বসালেন। থানা থেকে অনুরোধ এসেছে যেন আদিত্য মজুমদারকে সাহায্য করা হয়। ম্যানেজার আদিত্যকে বললেন, ‘আপনার জন্য আলপনা সামন্তর একাউন্টের একটা প্রিন্ট আউট নিয়ে রেখেছি। বড়বাবু সেই রকমই বলেছেন।’
ম্যানেজার বেল বাজিয়ে কী একটা নির্দেশ দিলেন। একটু পরে একজন মোটা একতাড়া কম্পিউটার প্রিন্ট আউট দিয়ে গেল।
‘সাধারণত ডরম্যান্ট অ্যাকাউন্টগুলো ট্রেস করতে একটু সময় লাগে। এই একাউন্টটাতে তো ছ’বছর আগে শেষ ট্রানজাকশন হয়েছে। যাইহোক বড়বাবু আগে থেকে বলে দিয়েছিলেন বলে প্রিন্ট আউটটা বার করতে কোনও অসুবিধে হয়নি। আপনি বরং এখানে বসে অ্যাকাউন্টটা স্টাডি করুন, আমি হাতের কাজগুলো সেরে নিই।’ ম্যানেজার নিজের কম্পিউটার স্ক্রিনে মন দিলেন।
অ্যাকাউন্ট-এর প্রত্যেকটা এন্ট্রি খুঁটিয়ে দেখা বেশ খাটনির কাজ। আদিত্য আর দেরি না করে কাজে লেগে পড়ল। ২০০৪-এর অগস্ট মাস থেকে ২০০৯-এর এপ্রিল মাস এই চার বছর আট মাস অ্যাকাউন্টটা চালু ছিল। উধাও হয়ে যাবার আগের দিন আলপনা সামন্ত প্রায় সমস্ত টাকা তুলে নিয়েছিল। এখন অ্যাকাউন্টে মাত্র চার হাজার টাকা পড়ে আছে।
আদিত্য লক্ষ্য করল, ২০০৪-এর পর থেকে প্রত্যেক সপ্তাহে নিয়ম করে চার হাজার টাকা তোলা হয়েছে। কখনও এর কোনও অন্যথা ঘটেনি। এটা নিশ্চয় আলপনা সামন্তের মাসিক সংসার খরচ। ব্যাপারটা আদিত্যর একটু অস্বাভাবিক মনে হল। তার অভিজ্ঞতা বলে, সাধারণভাবে মাসের গোড়ায় একটা বড় খরচ হয়ে যায়, মুদি, কাজের লোকের মাইনে, কেবল টিভির ভাড়া সবই মাসের গোড়ার খরচ। তারপর সারা মাস একটু একটু করে আরও খরচ হয়। কিন্তু তার পরিমাণটা অনেক কম। আলপনা সামন্তর টাকা তোলার ধরন দেখে মনে হয় সে সারা মাস ধরে সমানভাবে খরচা করত। কেন এমন হবে? আরেকটা জিনিসও অস্বাভাবিক। সাধারণত, যে-কোনোও পরিবারে মাসিক খরচের একটা কম-বেশি থাকে। কোনও মাসে কম খরচ হয়, কোনও মাসে কিছু বেশি। আলপনা সামন্তর ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে সব মাসে একই রকম খরচ।
প্রত্যেক মাসের শেষ দিন নিয়ম করে একটা টাকা অ্যাকাউন্টে জমা পড়েছে। এটা কী আলপনা সামন্তর বিধবা ভাতার টাকা? কিন্তু টাকাটা আসছে কোথা থেকে? আদিত্য খেয়াল করল, ভাতার টাকাটা কখনও বাড়েনি। চার বছর আট মাস ধরে প্রত্যেক মাসে ঠিক কুড়ি হাজার টাকা করে আলপনা সামন্তর একাউন্টে জমা পড়েছে। এটাও অস্বাভাবিক। প্রথমত, কোনও পেনশন হলে তার পরিমাণ একেবারে কাঁটায় কাঁটায় কুড়ি হাজার হতো না। একটু কম-বেশি হতোই। দ্বিতীয়ত, সেটা বছর বছর বাড়ত। তাহলে টাকাটা কী হিসেবে আসছে? আলপনা সামন্ত প্রত্যেক মাসে চার হাজার টাকা করে জমিয়েছে। এখানেও একটা আশ্চর্য ধারাবাহিকতা আছে। চার বছর আট মাসে তার জমেছিল দুই লাখ চব্বিশ হাজার টাকা। তার থেকে সে দু’লাখ কুড়ি হাজার তুলে নিয়ে নিরুদ্দেশ হয়ে যায়।
‘দুটো প্রশ্ন ছিল।’ আদিত্য ম্যানেজারের দিকে মুখ তুলে বলল।
‘বলুন।’
‘প্রথম প্রশ্ন, আলপনা সামন্তর কি কোনও ফিক্সড ডিপোজিট ছিল? দ্বিতীয় প্রশ্ন, আলপনা সামন্তর মাসিক চেকটা কোথা থেকে আসত?’
‘আপনার প্রথম প্রশ্নের উত্তর না, অন্তত আমাদের ব্যাঙ্কে আলপনা সামন্তর কোনও ফিক্সড ডিপোজিট ছিল না। দ্বিতীয় প্রশ্নটা উঠতে পারে ভেবে আমি আগে থেকেই খোঁজ নিয়ে রেখেছি। টাকাটা আসত লন্ডনের একটি ব্যাঙ্ক থেকে। কোনও একটি কোম্পানির অ্যাকাউন্ট থেকে টাকাটা ক্রেডিট করা হত। এর বেশি আমাদের পক্ষে জানা সম্ভব নয়।’
‘না, না, এতেই হবে। আর একটা কথা। আলপনা সামন্ত কি মাঝেমাঝেই ব্যাঙ্কে আসতেন? নাকি কালে ভদ্রে?’
‘মাঝেমাঝেই আসতেন। টাকা তুলতেন, পাশ বই আপডেট করাতেন, ফিক্সড ডিপোজিটে সুদের হার জানতে চাইতেন, যদিও ফিক্সড ডিপোজিট তিনি কখনও করেননি। বলা যায় কারণে-অকারণে তিনি ব্যাঙ্কে চলে আসতেন।
আদিত্য উঠে দাঁড়াল। তার যা জানার জানা হয়ে গেছে।
‘আমার কাজ হয়ে গেছে। আমি আসছি। আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। প্রিন্ট আউটটা আমার আর লাগবে না। আমি আমার দরকারি পয়েন্টগুলো নোট করে নিয়েছি।’
‘একটু চা খেয়ে যান। চা বলে দিয়েছি। এখনই আসছে।’
চায়ের কথা শুনে আদিত্য আবার বসে পড়ল।