ভূতুড়ে টেলিফোন – ৮
অষ্টম পরিচ্ছেদ
(১)
মেসবাড়িতে বলরামই আদিত্যর লোকাল গার্জেন। ঘরে ঢুকে বলল,
‘খেয়ে নিন, ঢের বেলা হয়েছে। এবার সকালের মিল বন্ধ হয়ে যাবে।’
আদিত্য ঘড়ি দেখল, একটা বাজে। আপিসের দিনে আর বেশিক্ষণ খাবার ঘর খোলা থাকবে না। অথচ তার খিদে নেই। সকাল থেকে অনেকবার চা খেয়েছে। অসংখ্য সিগারেট। খিদেটা মরে গেছে।
‘আজ আর খাব না রে। চান করাও হয়নি। একটু পরে চান করে বেরোব। বাইরে কিছু একটা খেয়ে নেব। রাত্তিরে নেমন্তন্ন আছে।’
‘একটু কিছু খেয়ে নিন। চান-টান পরে করবেন।’ আদিত্য জানে খেতে না উঠলে বলরাম নড়বে না। অগত্যা সে বাথরুমে হাত ধুয়ে খেতে চলল। সঙ্গে সঙ্গে বলরাম। সে যতক্ষণ খাবে, বলরাম ঠায় পাশে দাঁড়িয়ে থাকবে।
‘দেশে যাবি কবে?’ আদিত্য খেতে খেতে জিজ্ঞেস করল।
‘সামনের মাসে ছুটি চেয়েছি। মালিক এখনও হ্যাঁ-না কিছু বলেনি।’
‘তোর মা-এর জন্য শাড়ি আর বাবার জন্য জামা নিয়ে যাস। আমি টাকা দিয়ে দেব। তোকেই কিনে নিতে হবে।’
মন্টুবাবুদের বাড়ি থেকে চলে আসার সময় মন্টুবাবু নগদ পঁয়তাল্লিশ হাজার টাকা হাতে দিয়ে দিয়েছেন। চল্লিশ হাজার পারিশ্রমিক, আরও পাঁচ হাজার ইন্সিডেন্টাল এক্সপেন্স। আদিত্য পাঁচ হাজারটা ফেরত দিতে যাচ্ছিল। খরচ বলতে গেলে কিছুই তো হয়নি। পরে মনে পড়ল বিমলকে টাকা দিতে হবে। তাই পুরো টাকাটাই সে নিয়ে নিয়েছে। এখন কিছুদিনের জন্য সে বড়লোক। অবশ্য পুরোনো কিছু ধারদেনা মেটাতে হবে। যেকোনও কারণেই হোক বকুলের কথা সে কিছুতেই ভুলতে পারছে না। আসার সময় বকুল ট্রেনের জন্য কিছু রান্না করা খাবার দিয়ে দিয়েছিল। আর কিছু শুকনো কেক-বিস্কুট।
‘আর একটু ভাত দেবে?’
‘না না খাওয়া হয়ে গেছে। তুই আমার জন্য এক প্যাকেট সিগারেট নিয়ে আয় তো। একটু দাঁড়া, হাত ধুয়ে পয়সা দিচ্ছি।’
আদিত্য ঘরে ফিরে বলরামকে একটা পাঁচশ টাকার নোট দিয়ে বলল,
‘এটা ভাঙিয়ে দু’ প্যাকেট নিয়ে আসিস। তাড়াতাড়ি আসবি। তুই আবার নীচে গেলে কোথায় যেন হারিয়ে যাস।’
বলরাম সিগারেট নিয়ে ফিরে এসে দেখল আদিত্য ঘরের মধ্যে পাইচারি করছে। মনে হয় গভীরভাবে কিছু চিন্তা করছে। বলরামকে দেখে ইশারায় সিগারেট ও ফেরত পয়সা টেবিলে রাখতে বলল। বলরাম ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে যাবে এমন সময় আদিত্য বলল,
‘তোর খাওয়া হয়েছে?’
‘এখন খাব কি? অনেক কাজ বাকি। খেতে খেতে তিনটে বেজে যায়।’
‘এই কেকগুলো রাখ। আমি কয়েকটা খেয়েছি।’ আদিত্য বকুলের দেওয়া অর্ধসমাপ্ত কেকের প্যাকেটটা বলরামের হাতে তুলে দিল।
‘কটায় ঘুম থেকে উঠিস?’
‘সাড়ে চারটেয় উঠে পড়ি। নাহলে দেরি হয়ে যায়।’
‘তোর তো ঘড়ি নেই। বুঝিস কী করে কটা বেজেছে?’
‘তিন নম্বরের কাশীনাথবাবু সাড়ে চারটেয় উঠে হাঁটতে যান। বৃষ্টি পড়লে বারান্দায় পাইচারি করেন। সাধারণত নিয়মের হেরফের হয় না। ওঁর ঘরে এলার্ম ঘড়ি বাজে। আমি খাবার ঘর থেকে শুনতে পাই। আমার ঘুম ভেঙে যায়।’
‘বাহ ভাল মজা তো, তোর আর ঘড়ির কী দরকার?’ বলতে বলতে আদিত্য হঠাৎ খুব অন্যমনস্ক হয়ে গেল।
চিন্তা করতে করতে আদিত্যর একটু ঘুম এসে গিয়েছিল, ঘুম ভাঙল মোবাইলের আওয়াজে। গৌতম ফোন করছে।
‘কী ব্যাপার, তুই কোথায় উধাও হয়ে গেছিলি? আমি তোকে ফোন করতে গিয়েও করতে পারিনি। কে জানে কোথায় কীভাবে রয়েছিস।’
‘আমি তোকে দু’একবার ফোনে চেষ্টা করেছিলাম। বেজে গেল। বোধহয় মিটিং-এ ছিলি।’
‘হতে পারে। কোনও খবর আছে?’
‘অনেক খবর আছে, আলোচনা করার আছে। ভেবেছিলাম কাল রাত্তিরে অমিতাভদের বাড়িতে তোর সঙ্গে দেখা হলে কথা বলে নেব। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে ওখানে হবে না। আর অত দেরিও করা যাবে না।’
‘তুই চারটে নাগাদ লালবাজারে আসতে পারবি?’
‘নিশ্চয় পারব।’
‘তাহলে চলে আয়।’
(২)
‘তাহলে এই হল ইন্সপেক্টার কানুনগোর সেই রহস্যময় টেলিফোনের গল্প। এখন মনে হচ্ছে টেলিফোন নম্বরটা কানুনগো কোনোভাবে সুশান্ত হালদারের কাছ থেকেই পেয়েছিল। কিম্বা হয়ত লক্ষ করেছিল সুশান্তর চেলারা এই নম্বরে ফোন করে বকুলকে ভয় দেখায়। কিন্তু এটা জেনে আমাদের তো কোনও উপকার হল না।’ গৌতমের গলাটা খুব হতাশ শোনাল।
‘আপাতত ব্যাপারটা সেই রকমই দাঁড়াচ্ছে। তবু কিছু খটকা কিন্তু থেকে যাচ্ছে এখনও। তুই আমাকে কয়েকটা ব্যাপারে একটু সাহায্য করতে পারবি?’ আদিত্যর গলায় একটা চাপা উত্তেজনা রয়েছে।
‘বল।’
‘এক, মন্টুবাবুর প্রথম স্ত্রী, নামটা বোধহয় কল্পনা দত্ত, কীভাবে দার্জিলিং-এ মারা গিয়েছিলেন সেটা জানতে হবে। এ ব্যাপারে নিশ্চয় পুলিশ রেকর্ড রয়েছে। যদি একবার ইনভেস্টিগেটিং অফিসারের সঙ্গে কথা বলতে পারি তাহলে সব থেকে ভাল হয়। দুই, মন্টুবাবুর শালীর একটা খোঁজ লাগাতে হবে। একটা সোর্স বলছে তিনি মন্টুবাবুর পাইকপাড়ার বাড়িতে থাকতেন। সম্ভবত সেখান থেকেই উধাও হয়ে যান। তিনি কোথায় গেলেন? শুনেছি পুলিশে একটা ডায়েরি করা হয়েছিল। সেখান থেকে হয়ত কিছু হদিশ পাওয়া যেতে পারে। তিন, যে ছবিটা কানুনগোর ডায়েরির মধ্যে ছিল, তার একটা কপি আমার চাই। চার, পুলিশ ফাইল থেকে যদি পাওয়া যায়, সুলতার হারিয়ে যাওয়া মাসির একটা ছবি পেলে খুব সুবিধে হত। আর পাঁচ, একটা খবর নিতে পারবি, মন্টুবাবুর বাড়ির টেলিফোন, যেটাতে ভূতুড়ে কল আসে, গত দুই-আড়াই বছরে কখনও খারাপ হয়েছিল কিনা? এবং তার আগে কীরকম ফ্রিকোয়েন্সিতে খারাপ হত?’
‘আমি দেখছি কী করতে পারি।’
‘আর একটা কথা। তুই কি তোর টিমের লোকদের সঙ্গে আমার সম্বন্ধে কিছু আলোচনা করেছিলি?’
‘একটা খুব ছোট গ্রুপের মধ্যে করেছিলাম। কেন বলত?’
‘কী আলোচনা করেছিলি?’
‘তোর কাছে মন্টুবাবুর আসার কথা, মন্টুবাবুর বাড়িতে তার মেয়ের দেওর সেজে তোর যাবার কথা, সব কিছু নিয়েই কথা হয়েছিল।’
‘আমার মনে হয় তোদের দলের মধ্যে কেউ একজন আছেন যিনি শত্রুপক্ষের কাছে তোদের ভেতরের কথা ফাঁস করে দিচ্ছেন। ইংরেজি স্পাই থ্রিলারে যাকে বলে মোল।’
গৌতম কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর নীচু গলায় বলল,
‘কেন তোর এরকম মনে হচ্ছে?’
‘দ্যাখ, সুশান্ত যদিও বলছে ওর লোক আমার ছেলেটাকে ফলো করে আমার বিষয়ে সব জানতে পেরেছে, কথাটা আমার বিশ্বাস হয় না। আসলে ওর গল্পের মধ্যে একটা ফাঁক আছে। ওর লোক আমার বিষয়ে সব কিছু জেনে ফেলতেই পারে কিন্তু সে তো আমাকে কখনও দেখেনি। সুশান্তও আমাকে আগে কখনও দেখেনি। তাহলে সাইবার কাফেতে দেখামাত্র সে আমাকে চিনে ফেলল কী করে? ডিটেকটিভ লাইসেন্স পাবার জন্য আমাকে দু’টো ছবি সহ এই লালবাজারেই দরখাস্ত করতে হয়েছিল। একটা ছবি আমার লাইসেন্স-এ লাগানো আছে। অন্যটা নিশ্চয় এখানেই কোথাও আমার ফাইলে রাখা আছে। একজন ভেতরের লোকের পক্ষে সেটার নাগাল পাওয়া শক্ত নয়। আমার ছবি সুশান্তর হাতে আগেই পৌঁছে গেছিল।’
‘তোকে মন্টুবাবুর সঙ্গে ও পাড়ার কেউ দেখেনি?’
‘একবার রাত্তিরে মন্টুবাবুর সঙ্গে হাঁটতে বেরিয়েছিলাম। কিন্তু রাস্তার আলোগুলো সব কটা জ্বলছিল না। এত কম আলোয় কাউকে দেখে চিনে নেওয়া সহজ কাজ নয়।’
গৌতম অনেকক্ষণ ধরে ভাবল। তারপর বলল,
‘তুই যেটা বলছিস সেটা অসম্ভব নয়। অন্য নানা ব্যাপারেও এই ধরনের একটা সন্দেহ আমার মনে দানা বাঁধছিল। আমি সাবধান হব। তবে দু’একজনের ওপর তো নির্ভর করতেই হবে। মন্টুবাবুর প্রথম স্ত্রী ঠিক কতদিন আগে মারা গিয়েছিলেন বলতে পারবি?’
‘একেবারে সঠিক বলতে পারব না, তবে মন্টুবাবু বলেছিলেন তাঁর স্ত্রী গত হয়েছেন দশ বছরেরও বেশি হয়ে গেল।’
‘ওতেই হবে। আর সুলতার মাসির ব্যাপারটা আমি টালার পুলিশ স্টেশনে খোঁজ লাগাচ্ছি। পাইকপাড়ার ঘটনা হলে ওরাই বলতে পারবে। আর কিছু?’
‘আর একটা ছোট্ট ব্যাপার। হয়তো আদৌ গুরুত্বপূর্ণ নয়। তবু একটু জেনে রাখা ভাল। ‘পান্থজনের সখা’ বলে কোনও ট্র্যাভেল এজেন্সির নাম শুনেছিস? বিদেশের নানারকম এক্সটিক জায়গায় বেড়াতে নিয়ে যায়।’
‘পান্থজনের সখা? নামটা চেনা চেনা লাগছে। বোধহয় টেলিভিশনে বিজ্ঞাপন দেখেছি। খোঁজ নিতে অসুবিধে হবে না। কিন্তু তুই ঠিক কী জানতে চাস?’
‘যতটা জানা সম্ভব। কোম্পানি কেমন চলে, মালিক কেমন লোক, বিশেষ করে বিদেশে কোনও আপিস আছে কিনা।’
‘জানিয়ে দেব। আমাকে এখন একটা মিটিং-এ যেতে হবে রে। তোর সঙ্গে কাল সন্ধেবেলা তো দেখা হচ্ছেই।’
রাত্তিরের দিকে গৌতম আবার ফোন করল।
‘ভীষণ ইন্টারেস্টিং একটা খবর। এইমাত্র পেলাম। তোকে না জানিয়ে পারছি না। দার্জিলিং-এ কল্পনা দত্তর অপঘাত মৃত্যুর ইনভেস্টিগেটিং অফিসার ছিলেন সেই ইন্সপেক্টার কানুনগো যিনি পরে বদলি হয়ে গোবরায় আসেন এবং সুশান্ত হালদারদের জেলে পাঠান। কাল দুপুরের মধ্যে আরো কিছু তথ্য মেসেঞ্জার দিয়ে তোর আপিসে পাঠিয়ে দেব।’
(৩)
পরদিন বেলা তিনটে নাগাদ একজন সাদা পোশাকের পুলিশ আদিত্যর আপিসে একটা প্যাকেট পৌঁছে দিল। মোটা প্যাকেট। পুলিশ চাইলে কী না পারে। ঘণ্টা দু’য়েক সেই কাগজপত্র নিয়ে বুঁদ হয়ে রইল আদিত্য। একটা ছবি একটু একটু করে চোখের সামনে ফুটে উঠছে। সেটাকে ধরে রাখার জন্য ভেবেচিন্তে আদিত্য একটা কালপঞ্জী বানাল, তার কিছুটা আবশ্য কাল্পনিক। সে ডায়েরিতে লিখল
জুন, ২০০৪—কল্পনা দত্তর অপঘাত মৃত্যু, সুলতার বয়স তখন ১১ বছর, দেবী-সুশান্তর ৩১/৩২ বছর, বকুলের ২৯/৩০ বছর, রজনীবাবুর ৩৭/৩৮ বছর, মন্টুবাবুর ৪২ বছর
মাস দু’য়েক পরে সুলতার মাসির প্রবেশ
ফেব্রুয়ারি, ২০০৯ – ইন্সপেক্টার কানুনগোর ট্যাংরা থানায় পোস্টিং
এপ্রিল, ২০০৯ – মাসির অন্তর্ধান
জুলাই, ২০০৯ – রামানুজবাবুর আবির্ভাব
নভেম্বর, ২০০৯ – সুলতার বিয়ে
অগস্ট, ২০১১ – দেবী-সুশান্তর জেল
নভেম্বর, ২০১১ – মন্টুবাবুর সঙ্গে বকুলের বিয়ে
মার্চ-মে, ২০১৩ – দেবী-সুশান্ত জেল থেকে ছাড়া পেল, মার্চে সুশান্ত, জুন মাসে দেবী
কয়েক মাস পর থেকে ভূতুড়ে টেলিফোনের শুরু
মে, ২০১৪ – ইন্সপেক্টার কানুনগো খুন হলেন
জুলাই, ২০১৫ – মন্টুবাবু সাহায্য চাইতে এলেন
‘পান্থজনের সখা’ সম্বন্ধেও কিছু তথ্য পাওয়া গেছে। মালিকের নাম, কবে শুরু হয়েছে এসব ছাড়াও জানা গেল লন্ডন এবং দুবাইতে তাদের আপিস আছে। সংস্থাটির শুরু ২০০০ সালে। প্রথমে খুব ভালো চলত না। ২০০৪-০৫ থেকে একটু একটু করে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। এখন সংস্থাটির বেজায় সুনাম। ভোক্তা মূলত মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত বাঙালি। ‘পান্থজনের সখা’ ওয়েবসাইটে অনেক ভোক্তাই মুক্তকণ্ঠে তাঁদের তৃপ্তির কথা জানিয়েছেন। বিশেষ করে এটা অনেকেই বলেছেন যে এত অল্প খরচে এত আরামে যে বিদেশ ভ্রমণ করা যায় ‘পান্থজনের সখা’র মাধ্যমে না বেড়ালে তাঁরা জানতেই পারতেন না। রিপোর্টটা পড়তে পড়তে আদিত্যর মনে হচ্ছিল এবার ইন্টারনেট কানেকশন সহ একটা কম্পিউটার না কিনলেই নয়। এইসব তথ্য সে নিজেই তো ইন্টারনেট ঘেঁটে বার করতে পারত। এখনই অবশ্য কম্পিউটার কেনার পয়সা নেই।
গৌতমের পাঠানো কাগজপত্রের মধ্যে দুটো ছবিও আছে। একটা সুলতার হারিয়ে যাওয়া মাসির ছবি। কালার ছবি, ছবির ওপর নীল ফেল্টপেন দিয়ে লেখা আলপনা সামন্ত। আদিত্য অনেকক্ষণ ধরে ছবিটার দিকে তাকিয়ে রইল। বয়েস আন্দাজ তিরিশ-একত্রিশ, একটু গ্রাম্য চেহারা। তেল চুকচুকে পাতাকাটা চুল, সামনের দুটো দাঁত ঈষৎ উঁচু। আদিত্য ছবিটার দিকে তাকিয়ে একটু মুচকি হাসল। তার যে সন্দেহটা হচ্ছে সেটা যাচাই করে নেওয়া কঠিন হবে না। অন্য ছবিটা সাদা-কালো, কানুনগোর ডায়েরির মধ্যে যেটা ছিল। এই ছবিটা সে আগেই দেখেছে। এটাও যাচাই করে নিতে হবে।
আদিত্য ঘড়ি দেখল। ছ’টা বেজে গেছে। একটু পরেই অমিতাভদের বাড়িতে যেতে হবে। তার আগে কয়েকটা ফোন সেরে নেওয়া দরকার। প্রথম ফোন তার বন্ধু ক্রিমিনাল লয়ার সুনন্দ মিত্রকে যে মন্টুবাবুর কাছে তার খবর পৌঁছে দিয়েছিল।
‘আদিত্য, বল।’ ওপার থেকে সুনন্দর গমগমে গলা শোনা গেল।
‘দু’মিনিট কথা বলা যাবে?’
‘অবশ্যই। কোর্ট শেষ, চেম্বারে সাতটার আগে যাই না। তুই বল।’
‘প্রথমেই তোকে ধন্যবাদ জানাই, আমার কাছে ক্লায়েন্ট পাঠানোর জন্য। তুই কি মন্টুবাবুকে আগে থেকে চিনতিস?’
‘মন্টুবাবু? কে বলত? ঠিক বুঝতে পারছি না।’
‘মন্টুবাবু, পোশাকি নাম জিতেন্দ্রনাথ দত্ত, আমার কাছে একটা ব্যাপারে সাহায্য চাইতে এসেছিলেন। বললেন, তুই পাঠিয়েছিস।’
ওপারে কিছুক্ষণ নীরবতা। লাইনটা কেটে গেল নাকি? আদিত্য দু’বার ‘হ্যালো, হ্যালো’ বলল। লাইন কাটেনি। সুনন্দ ভাবছিল। এবার তার মনে পড়েছে,
‘ও হ্যাঁ হ্যাঁ, মনে পড়েছে। ভদ্রলোক কী একটা টেলিফোনে গোস্ট কলের সমস্যা নিয়ে আমার কাছে এসেছিলেন। আমি বললাম এটা আইনের সমস্যা নয়। আমি কিছু করতে পারব না। তোর কাছে যেতে বললাম।’
‘তোর কথা শুনে মনে হচ্ছে ভদ্রলোক তোর রেগুলার ক্লায়েন্ট নন। তোর কাছে সোজাসুজি অ্যাপয়েন্টমেন্ট পেতে নতুন লোকেদের তো তিন-চার মাস লেগে যায়। ভদ্রলোক কি কারও রেফারেন্স-এ এসেছিলেন?’
‘এক পুলিসকর্তার রেফারেন্সে অ্যাপয়েন্টমেন্ট হয়েছিল। বুঝতেই পারছিস আমাদের লাইনে করে কম্মে খেতে গেলে পুলিসের সঙ্গে ভাল সম্পর্ক রাখতেই হয়।’
‘আমাকে পুলিসকর্তাটির নামটা বলতে পারবি? অবশ্যই কনফিডেন্সিয়ালি।’
‘ও কে। বলছি। তবে জানিস তো এসব কথা পাঁচকান না হওয়াই ভাল।’
‘নিশ্চিন্ত থাক। আর কেউ জানতে পারবে না।’
আদিত্য নামটা লিখে নিল। পরের ফোন মন্টুবাবুকে।
‘হ্যালুউউউ?’
‘মণ্টুবাবু, আমি আদিত্য মজুমদার বলছি। কেমন আছেন?’
‘ভাল আছি আদিত্যবাবু, মানে এই অবস্থায় যতটা ভাল থাকা যায় আর কি। আপনার কি খবর?’
‘আমার নতুন কোনও খবর নেই। তবে আপনার ভূতুড়ে টেলিফোনের কেস এখনও আমাকে ভাবাচ্ছে। যদি আপনার আপত্তি না থাকে কয়েকটা প্রশ্ন করতে পারি?’
‘বলুন। তবে বলে রাখি, সুশান্তর সঙ্গে এখনও যোগাযোগ করা হয়ে ওঠেনি। ফলে ভূতুড়ে টেলিফোন আগের মতোই বেজে যাচ্ছে। বকুলকেও এখনও কিছু বলিনি। আদৌ বলব কিনা ভাবছি। একটা কিছু ঠিক করে আপনাকে জানাব।’
‘আমার মনে হয়, আর একটা সপ্তাহ যেতে দিন। তারপর না হয় কিছু একটা করবেন। দরকার পড়লে আমি তো আছিই।’
‘সে আমি জানি। আপনি কী জিজ্ঞেস করবেন বলছিলেন?’
‘হ্যাঁ, আমার প্রথম প্রশ্ন, আমার বন্ধু সুনন্দ মিত্রের কাছে আপনাকে কে পাঠাল?’
‘আমি তো উকিল-ব্যারিস্টারের তেমন খোঁজ রাখি না, আমার বন্ধু রজনী বলল সুনন্দবাবুর কাছে যেতে। ওর পুলিশে কে চেনাশোনা আছে, তাকে ধরে একটা অ্যাপয়েন্টমেন্টও করিয়ে দিল। সুনন্দবাবু বললেন এ ব্যাপারে ওঁর করনীয় কিছু নেই। উনি আপনার কাছে যেতে বললেন। আপনার ঠিকানা, টেলিফোন নম্বর সব দিয়ে দিলেন।’
‘বুঝলাম। আর একটা জিনিস জানার ছিল। আপনার মেয়ে সুলতার এক মাসি আপনার প্রথম স্ত্রীর মৃত্যুর পর কয়েক বছর সুলতার দেখাশোনা করতেন। তার সঙ্গে আগে, মানে আপনার স্ত্রী মারা যাবার আগে, আপনাদের যোগাযোগ ছিল?’
‘খুব একটা ছিল না। কল্পনার নিজের কোনও ভাইবোন ছিল না। ইনি কল্পনার খুড়তুতো বোন। কল্পনার কাকা দিল্লী না জয়পুর কোথায় যেন চাকরি করতেন। কল্পনার বোন আলপনা ওসব দেশেই বড় হয়েছে। আমাদের বিয়ের সময় ওরা নিশ্চয় এসেছিলেন। তবে আমার ঠিক মনে নেই। কল্পনার এই বোনের বিয়েও হয়েছিল ওসব জায়গায় কোথাও। মাঝখানে ওদের সঙ্গে দীর্ঘদিন কোনও যোগাযোগ ছিল না। আলপনার বিয়ের খবর পেয়েছিলাম, তবে দূরে বলে যাওয়া হয়নি। কল্পনা মারা যাবার কিছুদিন পরে আলপনা হঠাৎ একদিন আমাদের বাড়িতে এসে হাজির। এসে নিজের পরিচয় দিল, নাহলে তো আমি চিনতেই পারতাম না। ইতিমধ্যে সে বিধবা হয়েছে। ছেলেপুলেও নেই। শ্মশুরবাড়ির কোনও দূর সম্পর্কের আত্মীয়বাড়িতে অপমানে আছে। তারপর থেকে সে মাঝে মাঝেই আসত। সুলতা ওর খুব নেওটা হয়ে পড়ল। পাইকপাড়ায় আমার একটা বাড়ি খালি পড়ে ছিল। আমি ওখানে ওকে থাকতে দিলাম। মাঝে মাঝে সুলতার আবদারে আমাদের বাড়িতেও থেকে যেত। আমি ওর কাছে খুব কৃতজ্ঞ ছিলাম। সুলতাকে ও মায়ের যত্নে মানুষ করত।’
‘তারপর কি হল?’
‘আপনি নিশ্চয় জানতে পেরেছেন, আলপনা হঠাৎ একদিন উধাও হয়ে যায়। এটা আমাদের পরিবারের আরেকটা কলঙ্ক। শুনতে পেলাম ওর স্বামীর টাকাকড়ি ম্যানেজ করার জন্য ও যে মাঝে মাঝে ব্যাঙ্কে যেত সেখানেই এক বিবাহিত ভদ্রলোকের সঙ্গে ওর আলাপ হয়। পরে শুনলাম ভদ্রলোক নাকি মাঝে মাঝে পাইকপাড়ার বাড়িতেও আসতেন। তারপর একদিন দুজনে মিলে পালিয়ে যায়। আমরা পুলিশে ডায়েরি করেছিলাম। পুলিস কত দূর চেষ্টা করেছিল জানি না, তবে আলপনার সন্ধান কিছুই দিতে পারেনি। সুলতা খুব কষ্ট পেয়েছিল। ও তখন বড় হচ্ছে, বুঝতে শিখছে। মাসির কথা আর বলত না। মাসির ওপর ওর নিশ্চয় খুব অভিমান হয়েছিল।’
মন্টুবাবু থামলেন। আদিত্য বলল,
‘আজ রাখছি। আমি কয়েকদিন পরে ফোন করে খবর নেব। ভাল থাকবেন।’
‘আপনিও ভাল থাকবেন।’
তৃতীয় ফোনটা করার আগে আদিত্য অনেকক্ষণ ভাবল। একটা দ্বিধা, একটা দোটানা তাকে ফোন করতে বাধা দিচ্ছে। একবার কয়েকটা সংখ্যা ডায়াল করে মাঝপথে কেটে দিল। শেষে অনেক দোলাচলের পর পুরো নম্বরটা ডায়াল করল সে। ওপাশ থেকে বকুলের গলা শোনা গেল,
‘হ্যালো।’
‘আমি সূর্য বলছি। সুলতার দেওর। কেমন আছেন?’
‘ও সূর্যবাবু? আপনি কোথা থেকে বলছেন? ভিলাই থেকে?’ বকুলের গলাটা উষ্ণই শোনাল।
‘আমি কলকাতা থেকেই বলছি। সেদিন আমার যাওয়া হয়নি। আর এসি টিকিটটা কনফার্মড হল না। ভাবলাম অত দূর বসে বসে যেতে পারব না। শুক্রবারই যাব ঠিক করলাম। কাল রাত্তিরে আমার ট্রেন।
‘এই কদিন কোথায় রয়েছেন?’
‘এক পুরোনো কলিগের বাড়িতে। আমি জানতাম না ও এখন এখানে পোস্টেড। সেদিন আপনাদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে স্টেশন যাবার পথে ওর ফোন এল। ওদের বাড়িতে থাকিনি বলে খুব বকাবকি করল। হাওড়া থেকে ওদের বাড়িতে চলে গেলাম। মন্টুবাবু অবশ্য এসব কিছু জানেন না।’
‘ভালোই হল। আমাকে মনে করে তবু ফোন করলেন। ভিলাই পৌঁছে গেলে কি আর মনে থাকত?’
‘ভাবছিলাম, কাল রাত্তিরে তো চলে যাচ্ছি। আর কোনও দিন দেখা হবে কিনা কে জানে। আসার সময় ভাল করে গুডবাইটাও বলে আসতে পারলাম না। তাই ভাবছিলাম, কাল সকালে আপনার সঙ্গে কোথাও দেখা করা যেতে পারে কি? আমি ঢাকুরিয়ায় আছি। গড়িয়াহাটের কোথাও যদি এক সঙ্গে লাঞ্চ করা যায় খুব ভাল হয়। মন্টুবাবুকেও বলব ভাবছিলাম। কিন্তু উনি ব্যস্ত মানুষ, কাজের দিনে হয়ত আসতে পারবেন না। তাই ওঁকে আর বিব্রত করছি না। আসলে, ক’টা দিন আপনাদের ওখানে খুব অত্যাচার করলাম তো। একবার অন্তত আপনাকে কোথাও ট্রিট করতে পারলে খুব ভাল লাগবে।’
বকুল উত্তর দিচ্ছে না। আদিত্য ফোনটা ধরেই আছে। প্রায় একযুগ পরে চাপা গলায় বকুল বলল,
‘সাড়ে বারোটায় গড়িয়াহাটে ট্রেডার্স অ্যাসেম্বলির সামনে অপেক্ষা করব।’
(৪)
রত্নাবলী বলল তাদের কলেজের কয়েকজন অধ্যাপিকা সম্প্রতি ‘পান্থজনের সখা’ নামক ট্র্যাভেল এজেন্টদের মাধ্যমে ইটালি ঘুরে এসে খুব পরিতৃপ্ত। রত্নাবলী বলছিল,
‘এদের ট্রিপগুলো সাধারণত একটা দেশ বা একটা বড় দেশের একটা অংশতে কনফাইনড থাকে। অন্য এজেন্সিগুলো যেমন পাঁচদিনে সাতটা দেশ দেখিয়ে দেয়, যার ফলে ফিরে আসার পর হোটেলের ঘরগুলো ছাড়া আর কিছুই মনে থাকে না, শুধু পাড়ার লোককে বলা যায় সুইটজারল্যান্ড দেখেছি, ফ্রান্স দেখেছে, জার্মানি দেখেছি, হল্যান্ড দেখেছি, এই দেখেছি ওই দেখেছি, ‘পান্থজনের সখা’ সেরকম নয়।’
‘একটা পুরোনো হলিউডের ছবি ছিল, ইফ ইটস টিউসডে, দিস মাস্ট বি বেলজিয়াম। এইসব ঝটিকা সফর নিয়ে। বেশ মজার ছবি। অনেকদিন আগে দেখেছিলাম।’ অমিতাভ বলল।
‘আমিও দেখেছি।’ আদিত্যর মনে পড়ে গেল। ‘দাঁড়া, দাঁড়া, আমরা একসঙ্গেই তো দেখেছিলাম। ইউ এস আই এস-এ দেখিয়েছিল।’
‘হোয়্যার ডিড ইয়োর কলিগস ট্র্যাভেল ইন ইটালি?’ মালিনী জিজ্ঞেস করল।
‘বেশি জায়গা নয়। ভেনিস, ফ্লরেন্স, রোম আর নাপোলি মানে নেপলস। নেপলস থেকে পম্পেইতেও নিয়ে গিয়েছিল। লাস্ট সাপারটা দেখানোর জন্য মিলান-এও নিয়ে যাবার কথা ছিল, কিন্তু ওদেশে পৌঁছে শোনা গেল লাস্ট সাপার-এর রেনোভেশন চলছে। ওপরটা পুরো ঢাকা, দেখতে হলে শুধু পাগুলো দেখতে হবে। তাই ওরা আর যায়নি। কিন্তু যেখানে নিয়ে গেছে খুব ভাল করে ঘুরিয়ে দেখিয়েছে। তাছাড়া কী একটা গণ্ডগোলের ফলে ফেরার প্লেন ধরতে দুদিন দেরি হয়েছিল। ‘পান্থজনের সখা’ ওদের ভাল হোটেলে রেখেছিল অ্যাট নো এক্সট্রা কস্ট। আর ওদের খরচটাও আশ্চর্য রকমের কম। মালিনী ইউ ফলো মি, রাইট?’ শেষের প্রশ্নটা রত্না একটু কন্ট্রিতভাবে মালিনীকে করল।
‘জাস্ট ডোন্ট ওয়ারি, আই ফলো ইউ পারফেক্টলি। বিসাইডস আই অ্যাম গেটিং ট্রান্সফার্ড টু বেঙ্গল ভেরি সুন। আই হ্যাভ টু পিক আপ বাংলা।’
‘আমি ওকে দু’দিনে বাংলা শিখিয়ে দেব।’ গৌতম ভারিক্কি চালে বলল।
‘বুঝতেই পারছি রত্না, ‘পান্থজনের সখা’ তোকে এজেন্ট হিসেবে রেখেছে। তা রাখুক, আমার আপত্তি নেই। তুই শুধু বল, ওদের সঙ্গে কি কোনও ট্যুর গাইড থাকে? ইটালির মত জায়গায় একটা গাইড না থাকলে খুব অসুবিধে।’ আদিত্য রত্নার দিকে তাকিয়ে বলল।
‘থাকে তো। ওদের সঙ্গে একটি বাঙালি ছেলে সারাক্ষণ ছিল। তাছাড়া ওদের কোনও অসুবিধে হচ্ছে কিনা দেখার জন্য এক বাঙালি ভদ্রমহিলা, যিনি ওদের লন্ডন অফিসটা দেখাশোনা করেন, সেখান থেকে এসে কিছুদিন ওদের সঙ্গে কাটিয়ে গেছিলেন।’
‘যাঁরা ইটালি গেছিলেন তাঁদের মধ্যে কারোর সঙ্গে একটু কথা বলা যাবে?’
‘কেন? তুই ইটালি যাবি নাকি?’ রত্না একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল।
‘আমি না, আমার এক মক্কেল। ব্যাপারটা জরুরি। একটু তাড়াতাড়ি ব্যবস্থা করা যাবে?’
‘কাল সাড়ে দশটা নাগাদ কলেজে চলে আয়। সুনন্দাদির সঙ্গে কথা বলিয়ে দেব।’
‘একবার বারান্দায় আসবি, কথা আছে।’ আদিত্য উঠে দাঁড়িয়ে গৌতমকে বলল।
আদিত্য আর গৌতম উঠে বারান্দায় যাচ্ছে, শুনতে পেল রত্না পেছন থেকে বলছে,
‘কথা না কচু। দু’টোতে বিড়ি ফুঁকতে যাচ্ছে।’
বারান্দায় সিগারেট খেতে খেতে আদিত্য গৌতমের সঙ্গে তার ধারণাগুলো নিয়ে অনেকক্ষণ আলোচনা করল। ভবিষ্যতের করণীয় নিয়েও কথাবার্তা হল। জাল গুটিয়ে আসছে। কয়েক দিনের মধ্যেই ভূতুড়ে টেলিফোন রহস্যের সত্যিকারের সমাধান হয়ে যাবে মনে হচ্ছে।