ভূতুড়ে টেলিফোন – ৯
নবম পরিচ্ছেদ
(১)
আদিত্যর ছোটবেলায় কলকাতা সহরের ভাল রেস্তোরাঁগুলো সবই ছিল পার্ক স্ট্রীটে। তার মধ্যে সাহেবি পার্ক স্ট্রীটের একেবারে শেষ প্রান্তের একটি রেস্তোরাঁ ছিল আদিত্যর বাবার সব থেকে পছন্দসই। পার্ক স্ট্রীটে খেতে যাওয়া হলে সেখানেই যাওয়া হত। অনেকদিন হল রেস্তোরাঁটি উঠে গেছে। তবে আদিত্যর বাবার আমলে সচরাচর বাইরে খেতে যাওয়া হত না। আদিত্যর বাবা কলকাতার অভিজাত ক্লাবগুলির সবকটিরই মেম্বার ছিলেন। রাত্তিরে মাঝে মাঝেই ক্লাব থেকে খাবার আসত। সেসব খাবারের স্বাদ এখনও আদিত্যর মুখে লেগে আছে। বিশেষ করে সনাতন রোস্ট, স্টেক, সুফ্লে বা পুডিং জাতীয় সাহেবি খাবার বানানোয় ক্লাবগুলোর জুড়ি ছিল না। বহু বছর হয়ে গেল আদিত্য কোনও ক্লাবে যায়নি।
আজকাল অবশ্য দক্ষিণ কলকাতায় বেশ ভাল ভাল রেস্তোরাঁ হয়েছে। অমিতাভ-রত্না-টুপলুর সঙ্গে অনেকবার আদিত্য সেসব রেস্তোরাঁতে খেয়েছে। তাদের কয়েকটাকে মন্দ লাগেনি। তবে আদিত্য অবাক হয়ে খেয়াল করেছে, যেসব রেস্তোরাঁর খাবার তার ভাল লেগেছিল তার কোনটাই খুব বেশি দিন চলেনি। নিশ্চয় তার যেটা পছন্দ সেটা আমজনতার পছন্দ নয়। আদিত্যর চিন্তাসূত্র ছিঁড়ে গেল, একটা লাল গাড়ির পেছনের সীট থেকে বকুল তাকে ডাকছে।
‘তাড়াতাড়ি উঠে পড়ুন, এখানে একেবারে দাঁড়াতে দেয় না, পার্কিংও নেই। তাড়াতাড়ি উঠুন।’
পেছনের দরজা খুলে আদিত্য বকুলের পাশে বসল। বলল,
‘কোথায় যাওয়া হবে আপনিই ঠিক করুন। আমি এসব পাড়ার কিছুই জানি না।’
‘লেকের কাছে একটা নতুন জাপানি রেস্টোরান্ট হয়েছে। খুব দূরে নয়। ওখানেই যাই। আপনার মাথায় ভাল মতন কাঁঠাল ভাঙা যাবে।’
‘আমার তাতে কোনই আপত্তি নেই।’
বকুল একটা হালকা ছাই রঙের কুর্তা-চুড়িদার পরেছে। চোখে মস্ত গোল গোল রোদ-চশমা। গাড়িতে উঠে আদিত্য আবার সেই হালকা পারফিউমটার গন্ধ পেল। বকুলই ড্রাইভারকে বলল কোথায় যেতে হবে। মিনিট দশেকের মধ্যে আদিত্য দেখতে পেল তারা টেম্পুরা গার্ডেন বলে ছিমছাম একটা রেস্তোরাঁর সামনে পৌঁছে গেছে। পাড়াটা নির্জন, বিশেষ করে এই কাজের দিনের দুপুরে রাস্তায় একটাও লোক নেই। আদিত্যর বেশ নার্ভাস লাগছে। কোনও মহিলাকে নিয়ে সে কখনো কোনও রেস্তোরাঁতে আসেনি। তার ওপর এই মহিলা বিবাহিত এবং তার মক্কেলের স্ত্রী।
‘সুসি দিয়ে শুরু করা যাক, না কি? তারপর না হয় এদের একটা প্রন টেম্পুরা মিল আছে সেটা নেওয়া যাবে। আপনার কাঁচা মাছ চলবে তো?’
‘কাঁচা মাছ? আপনার চললে আমারও চলবে। আপনিই মেনুটা ঠিক করুন। আমি জাপানি খাবারের কিছুই জানি না। আপনার হাতে নিজেকে সঁপে দিচ্ছি।’
আদিত্যর মনে পড়ল, কলকাতার যে অভিজাত ক্লাবটি থেকে তাদের বাড়িতে প্রায়শই খাবার আসত সেখানে বছরে অন্তত দুবার জাপানি ফেস্টিভাল পালন করা হত। সেই উপলক্ষে সুসি বা টেম্পুরা সে বহুবার খেয়েছে। কিন্তু এখানে সেসব কথা বলার উপায় নেই।
‘গতকাল আমার এক পরিচিত আপনার দাদার ট্র্যাভেল এজেন্সি ‘পান্থজনের সখা’র খুব প্রশংসা করছিল। ‘পান্থজনের সখা’র মাধ্যমে তারা সম্প্রতি ইটালি ঘুরে এসেছে। খুব স্যাটিসফায়েড। আপনি কখনও ওদের সঙ্গে বেড়াতে যাননি?’
‘গেছি তো। বলতে গেলে প্রত্যেক বছরেই যাই। কোনও কোনও বছরে একাধিকবারও গেছি। আমার কর্তামশাই অবশ্য কখনো যাননি। ভ্রমণে তাঁর কোনও উৎসাহ নেই, বিদেশ ভ্রমণে তো একেবারেই নেই। তবে আমার যাবার ব্যাপারে তিনি কখনও বাধা দেননি, বরং উৎসাহ দিয়েছেন। একবার ভেবেছিলাম দাদার এজেন্সিতে একটা চাকরি নেব। একা একা বাড়িতে ভাল লাগে না। দাদাকে বললেই রাজি হয়ে যেত। কিন্তু এই একটা ব্যাপারে আমার কর্তাটি ভীষণ কনজারভেটিভ। তাঁর ধারণা বাড়ির বউ-এর কখনও বাইরে চাকরি করতে যাওয়া উচিত নয়। সে যাক। আপনার কথা বলুন। আপনার সম্বন্ধে তো জিজ্ঞেসই করা হয়নি। আপনার বাড়িতে কে কে আছেন?’
‘বাড়িতে কেউ নেই। একা থাকি। মাঝে মাঝে সুলতা-বৌদিদের বাড়িতে যাই। তবে সেও ন-মাসে ছ-মাসে।’
আদিত্য নিজেই অবাক হয়ে গেল কী অনায়াসে সে মিথ্যে কাল্পনিক একটা জীবন বানিয়ে নিচ্ছে।
‘বিয়ে করেননি?’
প্রশ্নটা করতে গিয়ে বকুলের গলাটা একটু কেঁপে গেল কি? আদিত্যর মনের ভুল হতে পারে। সে বলল,
‘হয়ে উঠল কই?’ তারপর নিরীহভাবে বলল,
‘আমার কখনো বিদেশ যাওয়া হয়নি, জানেন। তবে যেতে খুব ইচ্ছে করে। ব্যাঙ্ক থেকে চার বছরে একবার বেড়াতে যাবার টাকা দেয়। তাতে বিদেশ যাওয়া যায় না, তবে দেশের মধ্যে দিন কতক বেশ ঘুরে আসা যায়।একবার গোয়া গেছি। একবার কেরালা। একাই।’
‘দেশের মধ্যে আমার কোথথাও যাওয়া হয়নি। মেয়েরা তো আর একা বেড়াতে যায় না। আমার কর্তা কিছুতেই কলকাতা ছেড়ে নড়বেন না। দাদার এজেন্সি ছাড়া আমার কোথাও যাবার উপায় নেই। ওরা দেশের মধ্যে ঘোরায় না।’
খাবার এসে গেছে। কিছুক্ষণ দুজনেই চুপ। বকুল জিজ্ঞেস করল,
‘কাঁচা মাছ কেমন লাগছে?’
‘বুঝতেই তো পারলাম না কাঁচা মাছ। তবে চিংড়িটা সত্যিই ভাল। এটাই বুঝি টেম্পুরা?’
‘এটাই টেম্পুরা। আর ওই ভাত দিয়ে মোড়া মাছের টুকরোগুলো সুসি।’
‘আপনি খুব রান্না করেন, না?’
‘রোজের রান্না মালতীই করে। আমি কখনও-সখনও সখ করে রান্না ঘরে ঢুকি। তবে আমার কর্তার পছন্দগুলো একেবারে সাবেকি। ডাল, ঝোল, তরকারি। এর অন্যথা হলে মুখ ভার। কার জন্য আর নতুন নতুন পদ রাঁধব?’
‘একটা চাদর ঢাকা তানপুরা দেখলাম আপনাদের বৈঠকখানায়। আপনার কি গান-বাজনার চর্চা আছে?’
‘তানপুরা আমার নয়, সুলতার। সুলতা খুব সুন্দর গান গাইত। ওর বিয়ে হয়ে যাবার পর থেকে তানপুরাটা ওইভাবেই পড়ে আছে। ভিলাইতে সুলতা গান করে না?’
‘কখনো শুনিনি। মনে হয় সংসারের চাপে বৌদি গান-টান একেবারে ছেড়ে দিয়েছে। ফিরে গিয়ে একবার জিজ্ঞেস করব।’
বকুলের রোদ চশমাটা কপালের ওপর তোলা। চশমার আয়নায় মেঘের ছায়া পড়েছে।
‘সময় কাটান কেমন করে? বই পড়েন? টিভি?’
‘সময় কাটতেই চায় না। বই পড়ার অভ্যেস নেই। টিভিও বেশিক্ষণ ভাল লাগে না। ছাদে একটা বাগান করেছি। সেদিন অন্ধকারে দেখানো হয়নি। বাগানের পেছনে খানিকটা সময় কাটে। মাটির টবে একটা জুঁই গাছ হয়েছে। খুব কুঁড়ি ধরেছে। এবার ফুল ফুটবে।’
আদিত্য জানলা দিয়ে দেখল একটা গাড়ি অনেকক্ষণ বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। দুটো লোক সামনের সীটে বসে অপেক্ষা করছে। একজন ড্রাইভারের সীটে, একজন তার পাশে। কার জন্য অপেক্ষা করছে? একটা বড় মেঘ এসে আস্তে আস্তে সূর্যটাকে ঢেকে দিচ্ছে। রাস্তাটা আঁধার হয়ে গেল। বকুলের মুখের ওপরেও কি অন্ধকারের ছায়া পড়ল? ভারি সুন্দর দেখাচ্ছে বকুলকে। আদিত্য অনেকক্ষণ বকুলের দিকে তাকিয়ে ছিল। বকুলের ভেতরে কী ঘটছে বোঝার চেষ্টা করছিল। ওয়েটার কফি দিয়ে গেছে।
(২)
সন্ধের দিকে গৌতমের ফোন এল। আদিত্য তখন আপিসে। গৌতম বলল,
‘কালকের আয়োজন মোটামুটি কমপ্লিট। কাল ভোর-রাত্তিরে সুশান্তর দোকান, আব্দুলের আড্ডা, মন্টুবাবুদের পাড়ার পরিত্যক্ত কারখানা সব এক সঙ্গে রেড হচ্ছে। আমি আমার টিমকে জানিয়ে দিয়েছি। যে নামটা তুই বললি তাকে বলেছি যেন পুরোটা কোঅরডিনেট করে। আমরা আর একটু পরে অপরেশনে যাব। এটা অবশ্য কেউ এখনও জানে না। আমরা যখন অপরেশনে যাব তখন সাইমাল্টেনিয়াসলি ‘পান্থজনের সখা’র অফিস রেড করা হবে। এটাও তুই আমি ছাড়া আর কেউ আগে থেকে জানছে না। তোর কী খবর?’
‘খবর ঠিকই আছে। সকালে রত্নাদের কলেজে গিয়েছিলাম। প্রথম ছবিটা কেউ চিনতে পারল না। কিন্তু দ্বিতীয় ছবিটা, যেটা তোদের আর্টিস্ট একটু মডিফাই করে দিয়েছেন, দেখানো মাত্রই আইডেন্টিফাইড হয়ে গেল। অর্থাৎ যা সন্দেহ করেছিলাম ঠিক তাই। নতুন কিছু ঘটলে তোকে সঙ্গে সঙ্গে জানাব।’
‘ও কে। কাল তাহলে তোকে সকাল সাড়ে পাঁচটা নাগাদ তুলে নিচ্ছি।’
‘ও কে।’
আদিত্য মোবাইল বন্ধ করে টেবিলে রাখল। আরও দুএকটা ফোন সেরে নিতে হবে। প্রথমে বিমল।
‘গুড ইভিনিং স্যার। প্ল্যান সব ঠিক আছে তো?’
‘সব ঠিক আছে। তুমি এখন কোথায়?’
‘ক্যামাক স্ট্রীটে, একটা রাস্তার চায়ের দোকানে বসে আছি স্যার। যে বিল্ডিং-এ পান্থজনের আপিস, তার ঠিক উলটো দিকে। রজনীবাবু এখনও বেরোননি। বেরোলে আপনাকে সঙ্গে সঙ্গে ফোন করে জানিয়ে দেব।’
‘ঠিক আছে, বসে থাক।’
আদিত্য ফোন ডিসকানেক্ট করে আরেকটা নম্বর লাগাল।
‘আদিত্যবাবু, বলুন।’ ওপার থেকে মিহি কণ্ঠ ভেসে এল।
‘চারদিকে নজর রাখছেন তো?’
‘আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। আমার দৃষ্টি এড়িয়ে একটা মাছিও গলতে পারবে না।’
‘সন্দেহজনক কিছু দেখলেই জানাবেন।’
‘সঙ্গে সঙ্গে জানাব। আপনার কোনও চিন্তা নেই।’
‘ঠিক আছে। হয়ত কালই দেখা হয়ে যেতে পারে।’
‘ঠিক আছে।’
এখন অপেক্ষা করা ছাড়া আর কিছু করার নেই। আদিত্য আপিস বন্ধ করে রাস্তায় নামল। বউবাজার স্ট্রীটে জনস্রোত চলছে। সে ভাবল, এখনো সে এই রাস্তাটাকে বউবাজার স্ট্রীটই বলে। এর আধুনিকতর নাম যে বিপিনবিহারি গাঙ্গুলি স্ট্রীট সেকথাটা মনেই থাকে না। কেন যে কর্পোরেশনের কর্তারা পুরোনো নামগুলো পালটে দেন। ইতিহাসের প্রতি কিছুমাত্র শ্রদ্ধা থাকলে এটা ঘটত না। অন্নদাশঙ্করের লাইন মনে পড়ল ”দ্বিধা হও দ্বিধা হও ওগো মা ধরণী/ চিতুরের নাম হল রবীন্দ্র সরণী”।
আদিত্য এখন কলেজ স্ট্রীট ধরে হাঁটছে। পুরোনো বইয়ের দোকানে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে বই দেখল। তারপর কফি হাউসে গিয়ে বসল। তার ভেতরে ভেতরে একটা দারুণ উত্তেজনা রয়েছে। এক কাপ কালো কফি নিয়ে আদিত্য অনেকক্ষণ বসে রইল। তারপর আরও এক কাপ। যখন বেয়ারারা ফাঁকা চেয়ারগুলোকে টেবিলের ওপর তুলে দিয়ে কফি হাউস বন্ধ করার ইঙ্গিত দিচ্ছে, আদিত্য উঠে পড়ে ঘরমুখো হল। সে মেসবাড়ির সিঁড়ি দিয়ে তিনতলায় উঠছে, তখন প্রথম ফোনটা এল। দ্বিতীয় ফোনটা এল তার অনেক পরে, প্রায় রাত একটায়। আজ রাত্তিরে আদিত্যর ঘুম হবে না।
(৩)
ঠিক সাড়ে পাঁচটাতেই গৌতমের ফোন এল, ‘নীচে নেমে আয়, আমরা এসে গেছি।’
পৌনে ছটার মধ্যে তারা চিত্তরঞ্জন হাসপাতালের সামনে। স্করপিও গাড়ির মাঝের সীটে গৌতম আর আদিত্য, পেছনের সীটে তিনজন আর্মড পুলিশ, সামনে ড্রাইভারের পাশে গৌতমের খাস বডিগার্ড। পিছনে আর একটা গাড়ি ভরতি পুলিশ। চিত্তরঞ্জন হাসপাতাল অব্দি যেতে হবে ড্রাইভার এইটুকুই জানত। জিজ্ঞেস করল, ‘এবার কোনদিকে স্যার?’
‘আদিত্য, রাস্তা বলে দে।’ গৌতম আদিত্যকে বলল।
কলকাতা সহর এখনও ঘুমের মোড়ক থেকে বেরোয়নি। শুধু রুগির বাড়ির দু’চারজন যারা কাল সারারাত হাসপাতালে রাত জেগেছিল, চায়ের দোকানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছে। আদিত্য লক্ষ করল সেই টেলিফোনের বুথটা খোলা রয়েছে, যদিও এই মুহূর্তে কেউ সেখান থেকে টেলিফোন করছে না। উলটো দিকের কচুরির দোকানটা এখনও খোলেনি। পুলিশের গাড়ি দুটো যখন মন্টুবাবুর বাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়াল তখন ঘড়িতে ছটা বেজে কয়েক মিনিট। আদিত্যরা গাড়ি থেকে নামতেই ভোজবাজির মতো হঠাৎ কোথা থেকে যেন একটা লোক আবির্ভূত হল।
‘কাল সাড়ে আটটা নাগাদ ম্যাডাম ফিরেছেন। ম্যাডামের স্বামী ফিরেছেন আরও আধঘণ্টা পরে। তারপর বাড়িতে আর কেউ আসেনি, বাড়ি থেকেও কেউ বেরোয়নি। আমি সারারাত্তির নজর রেখেছি স্যার।’
‘এটা কে?’ আদিত্য গৌতমের দিকে তাকাল।
‘এ আমাদের লোক। খুব হুশিয়ার ছেলে। সারা রাত্তির মন্টুবাবুর বাড়ির ওপর নজর রেখেছে।।’
‘ও, তাই বুঝি।’
গৌতম লোকটিকে বলল, ‘তুমি এখন বাইরেই থাক। ভেতরে যাবার দরকার নেই। আদিত্য, তুই অবশ্য উইটনেস হিসেবে আমার সঙ্গে যাচ্ছিস।’
বার তিনেক বেল বাজানোর পর চোখ মুছতে মুছতে মালতী এসে দরজা খুলে দিল। পুলিশ দেখে স্পষ্টতই আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে তার মুখে। তারপর আদিত্যকে চিনতে পেরে ব্যাকুল হয়ে বলল,
‘এসব কী হচ্ছে দাদাবাবু? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। পুলিশ কেন?’
‘তোমাকে বুঝতে হবে না। তুমি দাদা-বৌদিকে খবর দাও।’
খবর অবশ্য দিতে হল না। তার আগেই লুঙ্গি-গেঞ্জি পরে মন্টুবাবুকে দোতলার সিঁড়ি দিয়ে নামতে দেখা গেল, তাঁর পেছন পেছন রাত্রিবাসের ওপর একটা চাদর জড়িয়ে বকুল। মন্টুবাবুই প্রথম কথা বললেন,
‘কী ব্যাপার? আপনারা এত ভোরবেলা?’ তাঁর গলাটা কাঁপছে।
গৌতম এগিয়ে গেল, পুলিশি কায়দায় বলল,
‘আপনার নাম জিতেন্দ্রনাথ দত্ত?’
‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’
‘আমরা লালবাজার থেকে আসছি। আমি জয়েন্ট কমিশনার ক্রাইম, গৌতম দাশগুপ্ত। আর ইনি আদিত্য মজুমদার, সাক্ষী হিসেবে আমার সঙ্গে এসেছেন। আপনার বাড়ি সার্চ করা হবে। ওয়ারেন্ট আছে।’
‘সার্চ করা হবে? কেন? আদিত্যবাবু, আমি কী করেছি?’ মন্টু দত্তর গলার আওয়াজটা প্রায় আর্তনাদের মত শোনাল।
‘সেটা একটু পরেই বুঝতে পারবেন।’ গৌতমের বাহিনী ইতিমধ্যে বাড়ির ভিতর ঢুকে পড়েছে। এত কাণ্ডের মধ্যে বকুল কিন্তু প্রায় অবিচলিতই আছে।
খুব বেশি খুঁজতে হল না। মন্টু দত্তর আলমারির পেছন থেকে গোটা দশেক প্যাকেট বেরোল। একজন উর্দিপরা পুলিশ একটা প্যাকেট থেকে এক চিমটে গুঁড়ো জিভের ডগায় লাগাল, তারপর বলল, ‘খাঁটি কোকেন স্যার। সব মিলিয়ে পাঁচ কোটি টাকার কম হবে না।’
‘কোকেন!’ মনে হল মন্টু দত্ত এবার অজ্ঞান হয়ে যাবেন।
গৌতম এক পা এগিয়ে এল। গম্ভীর গলায় বলল,
‘মিসেস বকুল দত্ত, কোকেন ট্র্যাফিকিং-এর চার্জে আপনাকে গ্রেপ্তার করা হল। তাছাড়া ইন্সপেক্টার কানুনগোকে খুন করার চার্জও আপনার ওপর আছে। এই কাজে আপনার মূল সহযোগী সুশান্ত হালদারকে কিছুক্ষণ আগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আপনাকে সাবধান করে দিই, এখন থেকে আপনি যা কিছু বলবেন তা আপনার বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হতে পারে।’
ভোজবাজির মতো একজন উর্দিপরা মহিলা পুলিশ আবির্ভূত হয়েছে। আদিত্য লক্ষ করেনি, নিশ্চয় দ্বিতীয় পুলিশের গাড়িটাতে ছিল। মহিলা বকুলের কাঁধে হাত রাখল। বকুল এখনও নির্বিকার। শুধু খুব ঠাণ্ডা চোখে আদিত্যর দিকে তাকিয়ে রয়েছে।