চৌধুরি বাড়ির রহস্য – ২
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
(১)
আদিত্য ঝিমোচ্ছিল। ঠিক ঘুম নয়, আবার পুরোপুরি জাগরণের অবস্থাও নয়। আজ ছাব্বিশে জানুয়ারি। দুপুরে মেসে ফিস্ট ছিল। মাংস-ভাত। বলাই বাহুল্য, খাসির মাংস। আজকাল অনেকে আবার মাংস বলতে মুরগিকেও বোঝায়। যারা এইরকম বোঝায়, আদিত্য তাদের দলে নেই। আদিত্যর কাছে মুরগির মাংস শাঁকালুর সমগোত্রীয় ছাড়া আর কিছু নয়। মেসের পাচক ভানু ঠাকুর এক অলৌকিক শিল্পী। বিশেষ করে শিল্পের মাধ্যমটি যদি খাসির মাংস হয়, তাহলে এই পৃথিবীতে ভানু ঠাকুরের সমকক্ষ কেউ আছে বলে আদিত্য মনে করে না। আদিত্য ছোটবেলায় কলকাতার সমস্ত নাম করা ক্লাব-রেস্টুরান্ট-হোটেলে খেয়েছে। কিন্তু কই মাংসের এরকম আশ্চর্য স্বাদ কেউ কখনও আনতে পারেনি তো।
গুরুভোজন হয়ে গিয়েছিল। তারই জেরে ঝিমুনি। চোখের সামনে দিয়ে কয়েকটা ছবি চলে যাচ্ছে। সোহিনী মৈত্র, নিউটাউন ক্লাবের লন, সোহিনী মিত্রর সিগারেট, দার্জিলিং চা। চৌধুরিদের বাড়ি বলতে একটা হালকা ছবি ভেসে উঠছে। সোহিনীকে বলা হয়নি, অনেকদিন আগে বাবার সঙ্গে সে একবার চৌধুরি বাড়ি গিয়েছিল। খুব উঁচু সিলিংওলা একটা ঘরে তাদের পেস্ট্রি আর স্যান্ডউইচ খেতে দেওয়া হয়েছিল। মনে হয়, তখনও মন্দাকিনীর সঙ্গে সুবীর চৌধুরির বিয়ে হয়নি। সেদিন সোহিনী যা বলেছে তার মধ্যে খটকা আছে। এটা আদিত্যর ইন্টিউশন বা অবচেতন বলছে। তবে খটকাটা কোথায় এখনই বোঝা যাবে না, ভেবে বার করতে হবে।
‘আসতে পারি স্যার?’
দরজা ফাঁক করে বিমল গায়েন গলা বাড়িয়েছে। আদিত্যর চটকাটা ভেঙে গেল।
‘এসো, এসো। তোমার অপেক্ষাতেই বসে আছি।’
বিমল সংকুচিতভাবে বিছানার একপাশে বসল। বিছানা ছাড়া ঘরে বসার জায়গা বলতে একটা চেয়ার। তার ওপর আপতত আদিত্যর দুটো সোয়েটার, একটা আলোয়ান আর একটা আধময়লা প্যান্ট ডাঁই করা আছে। আদিত্য বলল, ‘তুমি বোসো, আমি বলরামকে একটু চা আনতে বলি। চায়ের সঙ্গে কী খাবে? ফুলকপির শিঙাড়া খাবে? এই সময় গরম গরম ভাজে।’
‘আপনি খেলে খাব।’ বিমল নিচু গলায় বলল।
‘আমার পেটে জায়গা নেই। দুপুরে ফিস্ট ছিল। মাংস-ভাত। বেশি খাওয়া হয়ে গেছে। শুধু তোমার জন্য আনতে বলছি।’
বিমল চুপ করে রইল। সেটাকেই তার সম্মতি ধরে নিয়ে আদিত্য দেয়ালের পেরেকে টাঙানো পাঞ্জাবির পকেট থেকে একটা পঞ্চাশ টাকার নোট বার করল। তারপর বাইরে বেরিয়ে বারান্দার রেলিং ধরে একটু ঝুঁকে হাঁক পাড়ল, ‘বলরাম, চা আনতে হবে, ওপরে এসে পয়সা নিয়ে যা।’
শীতের বিকেল দ্রুত পড়ে আসছে। উত্তরের হাওয়ায় দাঁত আছে। আদিত্য আলোয়ান জড়িয়ে খাটের ওপর বসল। বলল, ‘তারপর? কী খবর, বিমলবাবু?’
‘খবর তেমন নেই। মোটামুটি চলে যাচ্ছে স্যার। হালতুর ওদিকে একটা বাড়িতে নাইট গার্ডের কাজ করছি। রাত্তির আটটা থেকে সকাল আটটা ডিউটি।’
‘সারারাত্তির জেগে থাকতে হয়?’
‘না স্যার। বারোটা সাড়ে বারোটা অব্দি জাগি। বাবুরা অনেকে রাত্তির করে ফেরে কিনা। গেট খুলে দিতে হয়। তারপর গেটের কাছে বিছানা করে শুয়ে পড়ি। একটু সজাগ হয়ে ঘুমোই। ওব্যেস হয়ে গেছে। তবে এই ঠান্ডায় চোরেরাও বেরোবে না স্যার।’
‘শোনো, একটা কাজ আছে। করতে পারবে?’
‘আপনার জন্য সব কাজ পারব স্যার। তাছাড়া দিনের বেলায় তো বাড়িতেই বসে থাকি। দিনের বেলায় বাড়ি বসে থাকলে সারাক্ষণ বউ খিটখিট করে। এই নেই ওই নেই। ছেলে লেখাপড়া না শিখে শুধু বখামি করে বেড়াচ্ছে। মেয়ে কার সঙ্গে নাকি প্রেম করছে। আমি কিছুই দেখছি না। এইসব কথা। যাক সেসব। কাজটা কী স্যার?’
‘একজনের সম্বন্ধে খবর জোগাড় করতে হবে। তার ঠিকানা আমার কাছে নেই। তোমাকেই খুঁজে বার করতে হবে।’
আদিত্য বিমলের কাছে একটা কাগজ এগিয়ে দিল। বলল, ‘এতে লোকটার নামটা বাংলায় লেখা আছে। শঙ্খদীপ চৌধুরি। লোকটার সম্বন্ধে কিছু হদিশ দিচ্ছি। তুমি টেবিলের ওপর থেকে আমার ল্যাপটপটা এগিয়ে দাও তো।’
ল্যাপটপ কোলের ওপর নিয়ে আদিত্য ডালা খুলল। ফেসবুকে ঢুকে শঙ্খদীপ চৌধুরি সার্চ দিতে সাতজন শঙ্খদীপ চৌধুরিকে পাওয়া গেল। তার মধ্যে দুজন আমেরিকায় থাকে, একজন অস্ট্রেলিয়ায়। বাকি চারজনের একজন শিলিগুড়ির, একজন আসানসোলের। অর্থাৎ সাতজনের মধ্যে দুজন শঙ্খদীপ চৌধুরিকে পাওয়া গেল যারা কলকাতায় থাকে। এই দুজনের মধ্যে একজন আবার ইঞ্জিনিয়ারিং-এর ছাত্র, অতএব তাকেও বাদ দেওয়া যেতে পারে। যিনি পড়ে রইলেন, আদিত্যর মন বলছে, তিনিই সুবীর চৌধুরির গুণধর পুত্র।
দেখা যাচ্ছে, এই শঙ্খদীপ চৌধুরি ফেসবুকে খুব একটা অ্যাকটিভ নয়। নিজের সম্বন্ধে প্রায় কিছুই লেখেনি। বন্ধুর সংখ্যাও যৎসামান্য। শুধু টাইমলাইনে নিজের একটা ছবি পোস্ট করেছে। ছবির ওপরে লেখা ‘মাই ফেভারিট হোল’। ছবিতে দেখা যাচ্ছে, গলফ ক্যাপ পরা ধূমপানরত শঙ্খদীপ একটা বার কাউন্টারের সামনে উঁচু টুলে বসে আছে। সামনে পানীয়। ছবির নীচে লেখা, ‘ইফ ইউ লাইক আ জয়েন্ট, কাম টু দিস জয়েন্ট’। গতকাল থেকে অনেকবার ছবিটা দেখেছে আদিত্য। ছবির নীচে লেখা কথাগুলোর মানে কী? ইংরেজি ‘জয়েন্ট’ কথাটা একটা স্ল্যাং, তার অনেক রকম মানে হতে পারে। একটা মানে, ‘আড্ডা’, রকের ভাষায় যাকে বলে ‘ঠেক’। ছবির নীচে লেখা ক্যাপশনে দ্বিতীয় ‘জয়েন্ট’-এর মানে এটাই। প্রথম ‘জয়েন্ট’এর মানেটাও কি তাই? হতেও পারে আবার নাও হতে পারে। নেশাখোর রামারিজুয়ানা বা গাঁজা পোরা সিগারেটকে ‘জয়েন্ট’ বলে। আদিত্যর মনে হচ্ছে এই অর্থেই প্রথম ‘জয়েন্ট’ ব্যবহার করা হয়েছে। অর্থাৎ এমন একটা বার খুঁজতে হবে যেখানে বসে মারিজুয়ানাও সেবন করা যায়। এটাই শঙ্খদীপ চৌধুরির ‘ফেবারিট হোল’। এখানে খুঁজলে তার সন্ধান পাওয়া যেতে পারে। আদিত্যর মনে হল, সোশাল মিডিয়ায় মারিজুয়ানা খেতে আসার আহ্বান করার মধ্যে একটা নির্লজ্জতা যেমন আছে, তেমনি আহাম্মকিও আছে। সে বিমলকে শঙ্খদীপ চৌধুরির ছবিটা দেখিয়ে বলল, ‘ইনি-ই মনে হচ্ছে আমাদের শঙ্খদীপ চৌধুরি। এই বারটাই এর ঠেক। এখানে মনে হয় মদের সঙ্গে সঙ্গে গাঁজা বা মারিজুয়ানাও পাওয়া যায়। বারটা কলকাতারই কোথাও একটা হবে। খুঁজে বার করতে পারলে মনে হয় শঙ্খদীপকেও খুঁজে পাওয়া যাবে। ছবিটা ভাল করে দেখে নাও।’
‘দেখে নিয়েছি স্যার। আমার মাথায় একটা ক্যামেরা বসানো আছে। তাছাড়া মোবাইলেও ছবি তুলে নিচ্ছি। আর দেখতে লাগবে না।’
বলরাম চা-শিঙাড়া এনে দিয়েছে। কেটলিতে চা, সঙ্গে ভাঁড়। শিঙাড়া প্লাস্টিকের ক্যারি ব্যাগে।
‘চারটে শিঙাড়া পারব না স্যার, আপনি একটা নিন।’
‘আস্তে আস্তে খাও। ঠিক পারবে।’ আদিত্য সিগারেট ধরাল।
বলরাম ভাঁড়ে চা ঢেলে দিতে দিতে বলল, ‘কেটলিতে খানিকটা রয়ে গেল। কেটলিটা রেখে যাচ্ছি। পরে নিয়ে যাব।’
প্রায় এক ঢোঁকে চা-টা খেয়ে নিয়ে বিমল উঠে দাঁড়াল। ‘শিঙাড়াটা বাড়ি নিয়ে যাচ্ছি স্যার। বউ আর আমি দুজনে মিলে খাব।’
‘আগে বলবে তো। বাড়ির জন্য আর কয়েকটা দিয়ে দিতাম। ও আচ্ছা, একটু দাঁড়াও।’ আদিত্য উঠে গিয়ে ড্রয়ার থেকে কিছু টাকা বার করল।
‘এই নাও পাঁচ হাজার। এটা অ্যাডভান্স। এর থেকে এখন খরচ কোরো। পরে হিসেব নেব। আর একটু চা খেয়ে গেলে পারতে।’
‘আর একদিন খাব স্যার। এখন বাড়ি ফিরে কাজে বেরোতে হবে। চললাম স্যার।’
বিমল দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে চলে গেল।
(২)
বইটা অবশেষে পাওয়া গেল বরানগরে ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিকাল ইন্সটিটিউটের লাইব্রেরিতে। তার আগে ন্যাশানাল লাইব্রেরি, এশিয়াটিক সোসায়টি, কমার্শিয়াল লাইব্রেরি, এমনকী উত্তরপাড়ার জয়কৃষ্ণ লাইব্রেরি পর্যন্ত খোঁজা হয়ে গেছে। ন্যাশানাল লাইব্রেরির ক্যাটালগে অবশ্য বইটা রয়েছে। জনৈক অরুণকুমার উপাধ্যায়-এর লেখা ‘দ্য এন্টারপ্রাইসিং চৌধুরিস অফ বেঙ্গল : ক্রনিকল অফ অ্যান আনইউসুয়াল জার্নি’। কিন্তু ক্যাটালগে থাকলে কী হবে, শেলফে বইটা কিছুতেই পাওয়া গেল না। বইপাড়া থেকে এই বই বহুদিন আগেই উধাও হয়ে গেছে। পাবলিশারও লালবাতি জ্বেলেছে। বিভিন্ন লাইব্রেরিতে, দোকানে খুঁজে খুঁজে যখন আদিত্য প্রায় হাল ছেড়ে দিয়েছে তখন তার মনে পড়ল, ছাত্রজীবনে সে ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিকাল ইন্সটিটিউটের মেম্বার হয়েছিল, তারপর বছর বছর মেম্বারশিপটা রিনিউও করে গেছে। খুব বেশি যে সেখানে যাওয়া হয় তা নয়, তবে মাঝেমাঝে সে সেখানকার লাইব্রেরিটা ব্যবহার করে। আদিত্য ভাবল, একবার এখানেও খোঁজ করে দেখতে ক্ষতি কি, যদিও বইটা এখানে পাবার সম্ভাবনা প্রায় শূন্য। আর কী আশ্চর্য, দেখা গেল, বইটা স্ট্যাটিস্টিকাল ইন্সটিটিউটের লাইব্রেরিতে রয়েছে।
আদিত্যর দুর্ভোগ কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে মিটল না। খুঁজে পেতে দেখা গেল, বইটির অবস্থা অতিশয় সঙ্গীন, প্রায় প্রত্যেকটি পাতা আলগা হয়ে খুলে এসেছে। কাউন্টারের ভদ্রমহিলা জানালেন, বইটা বাঁধাই না করে ইস্যু করা যাবে না। বাড়িতে নিয়ে যাবার তো প্রশ্নই ওঠে না, রিডিং রুমে বসেও পড়তে দেওয়া যাবে না। বাঁধাই করতে পাঠানোর হ্যাপা আছে। বাঁধাই করে আসতে আসতে অন্তত মাস দুয়েক লাগবে। আদিত্য চাইলে চিফ লাইব্রেরিয়ানকে তার প্রয়োজনের কথা জানিয়ে একটা দরখাস্ত করতে পারে, তবে তাতে কতটা কাজ হবে ভদ্রমহিলা বলতে পারবেন না।
আদিত্যর কাঁদো-কাঁদো মুখ দেখে ভদ্রমহিলার বোধহয় একটু দয়া হল। বললেন, ‘দোতলায়চিফ লাইব্রেরিয়ান বসেন। তাঁর কাছ থেকে যদি অনুমতি করিয়ে আনতে পারেন, আমি বইটা ইসু করে দেব।’
আদিত্য দোতলায় উঠে দেখল চিফ লাইব্রেরিয়ান ঘরে নেই। জিজ্ঞেস করে জানল তিনি জরুরি মিটিং করতে অন্য কোথাও গেছেন। ঘণ্টাখানেকের আগে ফিরবেন না। আদিত্য ক্যাম্পাসের বাইরে বেরিয়ে ঘুগনি-পাঁউরুটি খেল, চা খেল, ফিরে এসে ক্যাম্পাসের মধ্যে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করল, তারপর লাইব্রেরির দোতলায় গিয়ে দেখল লাইব্রেরিয়ান সাহেব তখনও ঘরে ফেরেননি। আদিত্য ঠিক করেছে আজ শেষ দেখে ছাড়বে। যদি হাতের এতটা কাছে এসেও বইটা ফসকে যায় তাহলে সে নিজেকে ক্ষমা করতে পারবে না। সে লাইব্রেরিয়ানের ঘরের সামনে ঠায় দাঁড়িয়ে রইল।
মিনিট পঁচিশ পরে লাইব্রেরিয়ানঘরে এলেন। এসেই ফোন তুলে কথা বলতে শুরু করলেন। এইভাবে আরও পাঁচ মিনিট কাটল। ফোন নামাবার পর তিনি খেয়াল করলেন আদিত্য বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে।
‘কিছু বলবেন?’
অভয় পেয়ে আদিত্য গুটিগুটি লাইব্রেরিয়ানের ঘরের ভেতর ঢুকল।
‘একটা বই খুব দরকার ছিল। কিন্তু বইটার অবস্থা ভাল নয়। তাই কাউন্টার থেকে ইস্যু করতে চাইছে না। আপনি যদি একটা স্পেশাল পারমিশন দেন। কয়েক ঘণ্টার জন্য পেলেই আমার কাজ হয়ে যাবে।’
‘আপনি কি বাইরের মেম্বার না আমাদের নতুন ফ্যাকাল্টি?’
‘আমি বাইরের মেম্বার।’
‘একটু বসুন। আমি কাউন্টারে ফোন করে ব্যাপারটা জেনে নিই। বইটার কী নাম বললেন?’
‘দ্য এন্টারপ্রাইসিং চৌধুরিস অফ বেঙ্গল : ক্রনিকল অফ অ্যান আনইউসুয়াল জার্নি। লেখকের নাম অরুণকুমার উপাধ্যায়।’
কিছুক্ষণ ফোনে কথাবার্তা চলল। একটু পরে কাউন্টারের ভদ্রমহিলা বইটা হাতে নিয়ে ঘরে ঢুকলেন। বইটা নেড়ে চেড়ে দেখে লাইব্রেরিয়ান সাহেব বললেন, ‘একটা আশ্চর্য ব্যাপার লক্ষ করছি। এই বইটা একানব্বই সালে বেরিয়েছিল। লেখক নিজেই একটা কপি লাইব্রেরিকে সেই সময় উপহার দিয়েছিলেন। তারপর গত ছাব্বিশ বছর বইটা একবেলার জন্যেও কেউ পড়তে নেয়নি। পড়ে থেকে থেকে বইটা জরাজীর্ণ হয়ে গিয়েছিল। তারপর মাস দুয়েক আগে হঠাৎ একজন নতুন মেম্বার বইটা নিতে চাইলেন। একে বাইরের মেম্বার তায় নতুন, আর বইটার তো এই অবস্থা। সব দিক ভেবেচিন্তে ভদ্রলোককে বইটা আমরা দেব না ঠিক করলাম। তার কিছুদিন পরে ইকনমিক্স-এর প্রফেসর সামন্ত এসে বললেন ওই বইটাই তিনি বাড়ি নিয়ে যেতে চান। সিনিয়র ফ্যাকাল্টি, তাই বইটা তিন দিনের জন্য দিতেই হল। আপনার কি এখানে কোনও ফ্যাকাল্টি চেনা আছে?’
‘আমার তো এখানে তেমন কেউ চেনা নেই। তবে বইটা আমার সত্যিই খুব দরকার।’ আদিত্য মুখটাকে যথাসম্ভব করুণ করে বলল।
লাইব্রেরিয়ান সাহেব কিছুক্ষণ ভাবলেন। তারপর বললেন, ‘আপনার মেম্বারশিপ তো দেখছি অনেক দিনের। ঠিক আছে, আমি বইটা ইস্যু করে দিচ্ছি। তবে ঠিক একদিনের জন্য। কালই বইটা ফেরত দিতে হবে।’
‘অনেক অনেক ধন্যবাদ স্যর। আমি এক ঘণ্টার মধ্যে বইটা ফেরত দিয়ে যাচ্ছি।’ আদিত্যর গলায় অকৃত্রিম কৃতজ্ঞতা ঝরে পড়ল।
রুটি-ঘুগনি খেতে গিয়ে আদিত্য দেখেছিল পাশেই একটা জেরক্স-এর দোকান আছে। বইটা সেখানে জেরক্স করতে দিয়ে আদিত্য সিগারেট ধরাল। বইটা যে অবশেষে পাওয়া গেছে এই কথা ভেবে খুব তৃপ্তি হচ্ছে। কিন্তু এই অজানা অনামা বইটার চাহিদা হঠাৎ বেড়ে গেল কেন? সে ছাড়াও কি আর কেউ চৌধুরি বাড়ির ইতিহাস নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে?
(৩)
অরুণকুমার উপাধ্যায়ের বই পড়ে চৌধুরিদের সম্বন্ধে অনেক কিছু জানা গেল। আদিত্য তার নোট খাতায় বইটার একটা সারসংক্ষেপ লিখে রেখেছে। সতেরো শতকের শেষ দিকে চৌধুরিদের কোনও পূর্বপুরুষ গুজরাত-রাজস্থান সীমান্তবর্তী একটা ছোট্ট হিন্দু রাজ্য থেকে জীবিকার খোঁজে বঙ্গভূমিতে আসেন। তিনি ছিলেন জাতে রাজপুত ও পেশায় যোদ্ধা, সম্ভবত ওই হিন্দু রাজ্যটির অন্যতম সেনাপতি। তাঁর পদবি ছিল সিংহ। সম্রাট ঔরঙজেবের সৈন্যদের কাছে ওই হিন্দু রাজ্যের পরাজয় ঘটার পর চৌধুরিদের ওই পূর্বপুরুষ স্ত্রী এবং শিশুপুত্রকে নিয়ে চুপিচুপি রাজ্য ছেড়ে পালিয়ে যান এবং ভাগ্যান্বেষণে ঘুরতে ঘুরতে অবশেষে হুগলি জেলার এক বড় জমিদারের কাছে স্থায়ী আশ্রয় পান।
পরের একশো বছর চৌধুরিদের পূর্বপুরুষরা হুগলিতেই অধিষ্ঠিত ছিলেন। প্রথম কিছুদিন তাঁরা ছিলেন বংশ-পরম্পরায় জমিদারের বেতনভুক রক্ষক। আঠেরো শতকের মাঝামাঝি, তাঁদের কোনও একজন নিজের প্রাণ তুচ্ছ করে বর্গীদের হাত থেকে জমিদার ও তাঁর প্রজাদের রক্ষা করেন। এতে খুশি হয়ে জমিদার যে বিস্তীর্ণ ভূখণ্ড চৌধুরিদের দান করেন তার ওপরে গড়ে ওঠে চৌধুরিদের নিজস্ব জমিদারি। অনুমান করা হয়, এই সময়েই এই পরিবার চৌধুরি খেতাব পায়।
চৌধুরিদের জমিদারি ছিল হুগলি নদীর পাশে। হুগলি নদী দিয়ে ইংরেজ, ফরাসি, দিনেমার ও পোর্তুগিজদের প্রচুর বাণিজ্য তরণী যাতায়াত করত। তাই দেখে চৌধুরিদের এক পূর্বপুরুষ কৃষ্ণনারায়ণ চৌধুরির মনে ব্যবসার সম্ভাবনা উদয় হয়। তাঁর দূরদৃষ্টি ছিল। তাই ‘বাণিজ্যে বসতে লক্ষ্মী, তদর্ধং কৃষিকর্মনি’ এই প্রচলিত আপ্তবাক্যে তিনি বিশ্বাস করতেন। অর্থাৎ তিনি বিশ্বাস করতেন ব্যাবসা করে যতটা টাকাপয়সা রোজগার করা যায়, কৃষিকাজ বা জমিদারি করে তার অর্ধেকও করা যায় না। নিজের বিশ্বাস নিয়ে শুধু বাড়িতে বসে বসে উচ্চ চিন্তা করার লোক তিনি ছিলেন না। তিনি ছিলেন যাকে বলে হাড়ে-মজ্জায় কাজের লোক। বিদেশিদের সঙ্গে তিনি ভাব জমালেন। বিদেশি মাল হুগলি- চুঁচুড়া-চন্দননগর-বর্ধমানের বাজারে বিক্রির জন্য ব্যাপক নেটওয়ার্ক গড়ে তুললেন এবং মশলাপত্র, রেশমি কাপড় ইত্যাদি দিশি সামগ্রী বিদেশিদের মাধ্যমে ইউরোপের বাজারে রপ্তানির পাকাপাকি বন্দোবস্ত করলেন। চৌধুরি বাড়ির প্রকৃত লক্ষ্মীলাভের শুরু সেই সময় থেকে।
এর পরের একশো-দেড়শো বছরে চৌধুরিরা তাদের ব্যবসাকে অনেক গুণ বাড়িয়ে তুলতে পেরেছিল। বিদেশি জিনিসপত্র কেনাবেচা থেকে একটু একটু করে চা-বাগান, জুটমিল, ছোটখাটো যন্ত্রপাতি উৎপাদন, গাড়ির একচেটিয়া ডিলারশিপ সব কিছুর মধ্যেঢুকে পড়েছিল চৌধুরিরা। ক্রমে চৌধুরি এন্টারপ্রাইজের দখলে পূর্ব ভারতীয় অর্থনীতির অনেকটাই চলে এসেছিল। এই উত্থান যে নিরবচ্ছিন্নভাবে ঘটে গেছে তা নয়। ব্যবসার নিয়ম মেনে মাঝে মাঝে ছোটবড় নানারকম সঙ্কটের মধ্যে দিয়ে চৌধুরিদের যেতে হয়েছে। বিশেষ করে উত্তরাধিকারের নিয়ম মানলে চৌধুরিদের সম্পত্তি বারবার ভাগ হবার কথা ছিল এবং যাঁরা ব্যবসার ভাগ পেতেন তাঁদের প্রত্যেকে সমান ব্যবসাবুদ্ধিসম্পন্ন এমন বলা যাবে না। কিন্তু চৌধুরি বংশে একটা প্রথা ছিল। প্রত্যেক প্রজন্মের প্রধান পুরুষ তাঁর প্রায় পুরো ব্যাবসাটাই তাঁর সব থেকে উজ্জ্বল, বুদ্ধিমান, কর্মঠ এবং ব্যবসাবুদ্ধিসম্পন্ন ছেলেটিকে দিয়ে গেছেন, যাতে চৌধুরি সাম্রাজ্যের ভবিষ্যৎ বৃদ্ধিতে কোনও ভাটা না পড়ে। বাকিরা যা পেয়েছে তাতে তাঁরা বিলাসব্যসনেই দিন কাটাতে পেরেছেন কিন্তু ব্যবসা পরিচালনায় তাদের কোনও ভূমিকা থাকেনি। তাছাড়া ভাগ্যের দেবীও সহায় ছিলেন, তাই চৌধুরিদের উত্তরাধিকার নির্বাচন মোটের ওপর ভুল হয়নি। বিভিন্ন সময়ে যাদের হাতে ব্যবসা এসেছে তাঁরা তাঁদের বুদ্ধি, দূরদৃষ্টি, সাহস এবং সঠিক ঝুঁকি নেবার ক্ষমতা দিয়ে এখন পর্যন্ত পূর্ব ভারতের ব্যবসা জগতে চৌধুরি পরিবারের আধিপত্য এবং গৌরব বজায় রাখতে পেরেছেন।
তিরিশ দশকের পৃথিবীব্যাপী মন্দা চৌধুরিদের ব্যবসাকে ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে, বিশেষ করে এই কারণে যে, চৌধুরিদের বাজার অনেকটাই রপ্তানি নির্ভর ছিল। সেই ক্ষতি অবশ্য দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হবার পর পূরণ হয়ে যায়। চৌধুরিরা দ্রুত যুদ্ধকালীন উৎপাদনের মধ্যে ঢুকে পড়েন এবং প্রচুর লাভ করেন। স্বাধীনতার পরেও চৌধুরিদের শ্রীবৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে, যেহেতু চৌধুরিরা সর্বদা দিল্লিতে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক নেতাদের আশীর্বাদ পেয়ে এসেছেন। আশির দশক থেকে তাদের সাম্রাজ্য আফ্রিকার কোনও কোনও দেশেও বিস্তৃত হয়েছে। অর্থাৎ এক কথায় বলতে গেলে, পূর্ব ভারতের ব্যবসা জগতে চৌধুরিদের আধিপত্যকে এখনও পর্যন্ত কেউ তেমন ভাবে চ্যালেঞ্জ করতে পারেনি।
শুধুমাত্র উদ্যোগপতি হিসেবে নয়, সমাজসেবী হিসেবেও চৌধুরিদের বিলক্ষণ নামডাক। কৃষ্ণনারায়ণ চৌধুরির নামে একটি ট্রাস্ট গঠন করেন তাঁরই এক উত্তরপুরুষ কালীনারায়ণ চৌধুরি। এই ট্রাস্ট এখনও বিভিন্ন সমাজকল্যাণমূলক কর্মকাণ্ডে ব্যাপৃত আছে। বর্তমানে এই ট্রাস্ট বেশ কয়েকটা অনাথ আশ্রম চালায়, হাসপাতাল চালায়, গরিব ছাত্রদের বৃত্তির ব্যবস্থা করে, পশ্চিমবঙ্গের প্রথম সারির বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে গবেষণার জন্য অনুদান দেয়, এমনকী সাহিত্যেও কয়েকটা পুরস্কার দেয় বাজারে যার মর্যাদা আছে। কিন্তু আমজনতার সব থেকে প্রিয় চৌধুরিদের কালী মন্দির। বিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকে হুগলি নদীর ধারে তাঁদের আদি বাসস্থানের কাছে চৌধুরিরা তাঁদের কালী মন্দির তৈরি করেন। নামে কালী মন্দির হলেও আসলে দশ-বারো একর জায়গা জুড়ে এটি একটি মন্দিরের কমপ্লেক্স যার মধ্যে তেত্রিশ কোটি হিন্দু দেবতার অনেকেই অধিষ্ঠিত। তাছাড়া এর মধ্যে কয়েকটা চমৎকার পুষ্করিণী আছে, অতিথিশালা আছে, একটা বড় হল আছে যেখানে রোজ সন্ধেবেলা শ্যামাসঙ্গীত হয়, কাঙালি ভোজনের জন্য পেল্লায় দালান আছে যেখানে রোজ দুপুরবেলা পাঁচশো কাঙালি পাত পেড়ে খায়। শনি-মঙ্গলবার কিংবা ছুটির দিনে কাতারে কাতারে লোক পায়ে হেঁটে মন্দির দর্শনে আসে। অত বড় চত্বরটাতে তিল ধারণের জায়গা থাকে না।
এই মন্দির তৈরির পেছনে একটা গল্প চালু আছে। জনশ্রুতি যে, হরিনারায়ণ নামে বর্তমান চৌধুরিদের কোনও এক পূর্বপুরুষ বিশেষভাবে পানাসক্ত ও লম্পট ছিলেন। সে যুগে জমিদারদের একটু-আধটু লাম্পট্য লোকে মেনেই নিত কিন্তু হরিনারায়ণের লাম্পট্য সব সীমা অতিক্রম করে গিয়েছিল। শোনা যায়, কোনও এক অভিশপ্ত রাতে নেশার বশবর্তী হয়ে তিনি তাঁদের কুলপুরোহিতের সুন্দরী বিধবা মেয়েটিকে গায়ের জোরে তুলে নিয়ে গিয়ে ভোগ করেন এবং সেই ভোরেই ধর্ষিতা মেয়েটি গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করে। এই ঘটনার সময় কুলপুরোহিত বাড়ি ছিলেন না। ফিরে এসে তিনি প্রথমে শোকে পাথর হয়ে যান এবং পরে খানিকটা ধাতস্থ হলে হরিনারায়ণকে এই বলে অভিশাপ দেন যে এক সপ্তাহের মধ্যে তার মৃত্যু হবে এবং তার পুত্রেরা প্রত্যেকে পৌরুষহীন হয়ে যাবে, ফলে নির্বংশ হয়ে যাবে চৌধুরি পরিবার।
কাকতালীয় হতে পারে, এই অভিশাপের তিন দিনের মধ্যে নৌকাডুবি হয়ে হরিনারায়ণের মৃত্যু হয়। শোনা যায়, এর পরে হরিনারায়ণের সদ্য বিধবা স্ত্রী কুলপুরোহিতের রাগ প্রশমিত করার জন্য তাঁর বাড়ির সামনে আমরণ অনশনে বসেন। সপ্তাহ দুয়েক অনশন চলার পর কুলপুরোহিতের রাগ খানিকটা প্রশমিত হয় এবং তিনি জানান তাঁর অভিশাপের হাত থেকে চৌধুরি পরিবারকে এক মাত্র মা কালী রক্ষা করতে পারেন। যদি চৌধুরি পরিবার নদীর ধারে তাঁর পছন্দ মতো একটা বিরাট কালী মন্দির তৈরি করতে পারে তাহলে হয়তো তারা নির্বংশ হবার হাত থেকে রক্ষা পাবে। কালী মন্দির নির্মাণের সেই শুরু। পরে অবশ্য একটু একটু করে মন্দির চত্বরের বিস্তার ঘটেছে। ইতিহাস সাক্ষী, চৌধুরি পরিবার আদৌ নির্বংশ হয়নি। তবে সেটা কুলপুরোহিতের নির্দেশ মেনে মন্দির তৈরি করার জন্য কিনা বলা শক্ত।
(৪)
বেলা চারটে নাগাদ একটা ফোন এল। আদিত্য তখন তার আপিস ঘরে বসে বসে কড়িকাঠ গুনছে। টেলিফোনের ওপারে অমিতাভর গলা। ‘রোববার এলি নাকেন? তোর জন্য তিনটে অব্দি বসে রইলাম। একটা ফোন পর্যন্ত করলি না।’
‘হঠাৎ কাজে আটকে পড়েছিলাম। তোদের বাড়ি যে যেতে হবে সেটাই মাথা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। যখন মনে পড়ল তখন খুব দেরি হয়ে গেছে। তোরা একটা ফোন করলে মনে পড়ত, কিন্তু যেতে পারতাম বলে মনে হয় না। মক্কেলের সঙ্গে তারই গাড়িতে রাজারহাট গিয়েছিলাম। সেখান থেকে মক্কেল না পৌঁছে দিলে ফিরতেই পারতাম না। তাকে তো আর বলা যায় না তাড়াতাড়ি বালিগঞ্জ পৌঁছে দিন। বন্ধুর বাড়িতে নেমন্তন্ন আছে।’
‘আমি ফোন করতে যাচ্ছিলাম, রত্না করতে দিল না। বলল, নিজে থেকে এলে আসবে, খোসামোদ করে আনতে হবে না। তোর ওপর প্রচণ্ড রেগে আছে।’
‘ও আমি ম্যানেজ করে নেব।’
‘শোন, আজ সন্ধের মধ্যে চলে আয়। রাত্তিরে খেয়ে ফিরবি। খুব রাত্তির হয়ে গেলে থেকে যাবি। আজ বাজারে ভাল কই পেয়েছি। রত্না জমিয়ে তেল কই রাঁধছে। তাছাড়া আমার এক ছাত্র তার দেশের বাড়ি থেকে চমৎকার পয়রা গুড় দিয়ে গেছে। পায়েস হচ্ছে। রত্না তোকে ফোন করতে বলল। রেগে আছে বলে নিজে ফোন করছে না।’
‘আজ কোনও কাজ নেই। একটু পরেই পৌঁছে যাচ্ছি। তেল কই, নতুন গুড়ের পায়েস মিস করার প্রশ্নই ওঠে না।’
পাঁচটার একটু পরে আদিত্য আপিসে তালা বন্ধ করে বেরিয়ে পড়ল। শীতের বেলা পড়ে এসেছে। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে আদিত্য লক্ষ করল কয়েকটা ঘরে এর মধ্যেই আলো জ্বলে উঠেছে। একতলায় নেমে শ্যামলের সঙ্গে মুখোমুখি। শ্যামল এই পুরোনো আপিস বাড়িটার ম্যানেজার কাম দারোয়ান। দরকার মতো চা-টাও এনে দেয়। শ্যামল বলল, ‘আদিত্যবাবু আজ সকালে একজন আপনার খোঁজে এসেছিলেন। বোধহয় মক্কেল। আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনার এখানে ভিড় কেমন হয়? মনে হল বলতে চাইলেন, আপনার মক্কেল-টক্কেল হয়, নাকি বসে বসে মাছি তাড়ান?’
‘মক্কেল? কী রকম দেখতে বলত?’
‘মাথায় ঢেউ খেলানো চুল, কাঁধ অব্দি নেমে গেছে। চোখে কালো চশমা। মানে রোদ্দুর ঢাকার জন্যে লোকে যেরকম পরে।’
‘তারপর?’
‘আপনার পাশের আপিসের আগরওয়াল সাহেব তখন ঢুকছিলেন। আমি উত্তর দেবার আগেই বলে উঠলেন, আরে দাদা এর মক্কেল-টক্কেল কিচ্ছু হয় না। একদম বেকার কা আদমি। আপনার সাহায্য দরকার হলে অন্য জায়গায় যান। শুনে ভদ্রলোক ঘাবড়ে গিয়ে চলে গেলেন।’
আদিত্যর মনে পড়ে গেল আগরওয়ালের সঙ্গে কদিন আগেই দেয়ালে পানের পিক ফেলা নিয়ে খুব কথা কাটাকাটি হয়ে গেছে। লোকটা শুধু নোংরা নয়, এক নম্বরের বদমাস। কিছু একটা গন্ডগোলের ব্যবসা করে। তার আপিসে বেশ কয়েক বার পুলিশ রেড হয়ে গেছে। আর একটু ভদ্র জায়গায় একটা আপিস জোগাড় করতে না পারলে আদিত্যকে বোধহয় ডিটেকটিভগিরিটাই ছাড়তে হবে। সে কিছু না বলে রাস্তায় নামল।
আদিত্যর মিনিবাসটা যখন তাকে বালিগঞ্জ ফাঁড়িতে নামিয়ে দিল তখন ঘড়িতে সোয়া ছটা বেজে গেছে। রাস্তায় খুব জ্যাম ছিল। প্রত্যেক দিন শহরের রাস্তায় গাড়ির সংখ্যা বাড়ছে। এবছর শীতটা বেশ জাঁকিয়ে পড়েছে। মিনিবাসের ভিড়ে ঠান্ডাটা টের পাচ্ছিল না, বড় রাস্তা থেকে গলির ভেতর ঢুকতেই এক ঝলক উত্তরের হাওয়া আদিত্যর মুখে এসে ঝাপটা মারল। মাফলারটা ভালো করে গলায় পেঁচিয়ে নিতে নিতে আদিত্যর মনে পড়ে গেল প্রত্যেক শীতে সে বাবার সঙ্গে রাত জেগে গান শুনতে যেত। কত কনফারেন্স, কত বিনিদ্র রজনী। একবার, এই রকমই এক শীতের সন্ধেবেলা, একটা ঘরোয়া অনুষ্ঠানে পণ্ডিত রবিশঙ্কর হংসকিঙ্কিণী বলে একটা ভারি মিষ্টি রাগ বাজিয়ে ছিলেন। তার আগে এই রাগটা আদিত্য কখনও শোনেনি। সে ভেবেছিল ওটা বুঝি পণ্ডিতজির নিজের তৈরি করা রাগ। পরে বাবা বলেছিল, হংসকিঙ্কিণী খুব পুরোনো রাগ। জয়পুর বা গোয়ালিয়র ঘরানায় রাগটার রীতিমতো চল আছে। বাড়ি ফিরে বাবা স্পুল থেকে গোয়ালিয়রের পুরোনো ওস্তাদ কৃষ্ণরাও শঙ্কর পণ্ডিতের একটা হংসকিঙ্কিণীর বন্দিশ শুনিয়েছিল। কোথায় যে গেল সেই স্পুলগুলো।
রাত্তিরে বেশি খাওয়া হয়ে গেল। রত্নার রাগ বেশিক্ষণ টেকেনি। আসলে অমিতাভ-রত্না ওর সহপাঠী বা পুরোনো বন্ধু তো শুধু নয়। আদিত্যর পরিবার বলতে ওরাই। আর আদিত্যও ওদের পরিবারেরই একজন। খাবার পর আটতলার বারান্দায় সিগারেট ধরিয়ে আদিত্য ঠিক করতে পারছিল না আজ এখানে থেকে যাবে নাকি মেসে ফিরে যাবে। মেসে ফিরে যাবার একমাত্র কারণ হল, কাল থেকে চৌধুরি বাড়ির কেসটা নিয়ে পুরোদমে লেগে পড়তে হবে। অ্যাডভান্স নিয়ে ফেলেছে, এখনও তেমনভাবে কাজ শুরু করতে পারেনি। তাছাড়া কাল সকালে বিমলেরও আসার কথা আছে। হঠাৎ টের পেল, অমিতাভ পাশে এসে দাঁড়িয়েছে।
‘গান-টান শুনিস আজকাল নাকি শুধুই জেমস বণ্ডগিরি চলছে?’ অমিতাভ কথা বলতে বলতে একটা পান এগিয়ে দিল।
তার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে আদিত্য পালটা প্রশ্ন করল, ‘আচ্ছা, হংসকিঙ্কিণী রাগটা তোর মনে আছে?’
‘নিশ্চয় মনে আছে। কেন বলত?’
‘আজ বিকেল থেকে রাগটার কথা খুব মনে পড়ছে। ভারি মিষ্টি রাগ। দুটো গান্ধার লাগে। ওঠার সময় শুদ্ধ, নামার সময় কোমল। নামার সময় শুদ্ধ রেখাবও লাগে। বাবার খুব পছন্দের রাগ ছিল। আজকাল বোধহয় কেউ গায়-টায় না।’
‘কে বলল গায় না? এই তো সেদিন নন্দন চক্রবর্তী গাইল। নন্দনের গান শুনেছিস তো? আউটস্ট্যান্ডিং।’
‘আমাকে যদি হংসকিঙ্কিণী শোনাতে পারিস, আজ রাত্তিরটা তোদের বাড়ি থেকে যাব।’
‘অবশ্যই শোনাব। নন্দন চক্রবর্তীর হংসকিঙ্কিণীটাই শোন। কিন্তু তার আগে দাঁড়া রত্নাকে সুখবরটা দিয়ে আসি। গেস্ট রুমে তোর বিছানাটা করে রাখুক।’ অমিতাভর গলায় খুশি ঝরে পড়ছে।
নন্দন চক্রবর্তীর হংসকিঙ্কিণী শেষ হতে হতে রাত বারোটা বেজে গেল। অমিতাভ এক ফোঁটাও বাড়িয়ে বলেনি। সত্যিই আউটস্ট্যান্ডিং। ভাগ্যিস প্রোগ্রামটা অমিতাভ রেকর্ড করে রাখতে পেরেছিল। আদিত্য যখন শোবার তোড়জোড় করছে, মানে শোবার আগে দিনের শেষ সিগারেটটার সদ্ব্যবহার করতে যাচ্ছে, ঠিক সেই সময় দরজায় অমিতাভর টোকা পড়ল।
‘কেমন লাগল বল।’
‘সত্যিই অসাধারণ। আমি তো এর গান এই প্রথম শুনলাম। বয়েস কীরকম?’
‘চল্লিশের নীচে। সম্ভবত বছর পঁয়ত্রিশ। ভীষণ ট্যালেন্টেড, কিন্তু জীবনে ডিসিপ্লিন জিনিসটার একান্তই অভাব। তাই ভয় করে পুরো ফোটার আগেই না ঝরে যায়। এরকম আগেও দেখেছি।’
‘তুই একে চিনিস?’
‘চিনি তো বটেই। নিছক চেনার থেকে অনেক বেশি। বলতে পারিস, এই মুহূর্তে আমিই ওর মেন্টার ও প্রোমোটার।’
‘কলকাতার ছেলে?’
‘না, দিল্লির। ওখানেই তালিম পেয়েছে। তবে এখন কলকাতায় থাকে। ওর এক বান্ধবী আছে, সেতার বাজায়। তার সঙ্গেই থাকে। যাকে বলে লিভিং টুগেদার। বান্ধবীটি, বলাই বাহুল্য, ওর মতো ট্যালেন্টেড নয়। কিন্তু নন্দনকে অপার মমতায় আগলেরাখে। সোহিনী বিশ্বাস করে, একদিন নন্দন ফৈয়জ খাঁ আমীর খাঁর মতো মস্ত নাম করবে।’
‘বান্ধবীর কী নাম বললি?’
‘সোহিনী। সোহিনী মৈত্র।’