ভূতুড়ে টেলিফোন – ১০
দশম পরিচ্ছেদ
(১)
‘একেবারে গোড়া থেকে বল। আমরা তো কিছুই জানি না।’ রত্নাবলী বলল। তাদের বাড়িতে সন্ধেবেলা একটা বড় জমায়েত হয়েছে। সেখানে অমিতাভ-রত্না ছাড়াও রয়েছে গৌতম, গৌতমের কথায় কটা দিনের জন্য দিল্লী ফিরে যাওয়া পিছিয়ে দিয়ে রয়েছে গৌতমের স্ত্রী মালিনী, মন্টুবাবুর পড়শি রামানুজ চট্টোপাধ্যায় এবং অবশ্যই আদিত্য। আদিত্যর পেড়াপেড়িতে বিমলও এসেছে। খুব সংকোচের সঙ্গে ঘরের এক কোণে বসে আছে সে। কিন্তু মন্টুবাবু কিছুতেই এলেন না। বকুল গ্রেফতার হওয়ার পর থেকে একটা আশ্চর্য নীরবতা গ্রাস করেছে তাঁকে। প্রেসেও যাচ্ছেন না, সারাদিন বাড়িতেই থাকছেন। আদিত্য মূল বক্তা। সে বলতে শুরু করল,
‘গোড়া থেকেই বলছি। মাঝে মাঝে একটু অনুমানের মিশেল থাকবে, কিন্তু সেই অনুমানের বাস্তব ভিত্তি আছে। এই সহরের পুবদিকে, পার্ক সার্কাস ও শেয়ালদা স্টেশনের মধ্যবর্তী অঞ্চলে, রেল লাইন ঘেঁসে, বেশ কয়েক বছর ধরে ড্রাগ ডিলারদের একটা বড় চক্র গড়ে উঠেছিল। ঠিক কতদিন ধরে, সেটা পুলিশ একটু চেষ্টা করলেই বার করতে পারবে। কিন্তু আমাদের গল্পের জন্য সেটা খুব একটা প্রাসঙ্গিক নয়। সে যাই হোক, এই ড্রাগ ডিলারদের মাথা ছিল মহম্মদ আসলাম নামে এক ব্যক্তি। তার ব্যবসা ভালোই চলছিল। বিশেষ করে এই শতাব্দীর গোড়ার দিকে সে স্থানীয় একটা কলেজ থেকে কিছু একেবারে অল্পবয়স্ক ছাত্রকে কাজে লাগিয়েছিল যারা তার ব্যবসার প্রসারে দু’ভাবে সাহায্য করত। এক, এই অল্পবয়সী মধ্যবিত্ত বাঙালি ছেলেমেয়েগুলোকে পুলিশ চট করে সন্দেহ করতে পারেনি। দুই, ড্রাগের ব্যবসায় এলেও এরা কেউই নিজেরা ড্রাগ অ্যাডিক্ট ছিল না। ফলে অনেক বেশি ঠাণ্ডা মাথায় এরা কাজ করতে পারত। এই ছেলেমেয়েদের লিডার ছিল সুশান্ত হালদার, তার মাসলম্যান ছিল দেবীরঞ্জন। দেবীর বোন বকুলের সঙ্গে সুশান্ত হালদারের প্রণয়ের সম্পর্ক গড়ে ওঠে এবং বকুলও কিছুদিন পরে এই ব্যবসায় যোগ দেয়। এখানে বলে রাখি, এই ছেলেমেয়েদের মধ্যে সব থেকে মেধাবী ছিল বকুল। না, না, পড়াশোনায় নয়, নিছক বুদ্ধিতে, কল্পনাশক্তিতে, দূরদৃষ্টিতে। আর মাথা ঠাণ্ডা রাখার ব্যাপারে। পড়াশোনা করলে হয়ত বকুল অনেকদূর পৌঁছতে পারত, কিন্তু সেটা হবার নয়, তার মধ্যে যে প্রবল একটা ক্রিমিনাল সত্ত্বা ছিল সেই সত্ত্বাটাই তাকে বক্রপথে চালিত করেছে। ফলে যা অবধারিত তাই ঘটল। ধীরে ধীরে এই পথভ্রষ্ট ছেলেমেয়েগুলোর চালিকাশক্তি হয়ে উঠল বকুল। সুশান্ত হালদার নামেই দলের মাথা, আসলে দলটাকে চালায় বকুল।
‘ইতিমধ্যে মাফিয়া ডন মহম্মদ আসলাম নানা রকমের অসুবিধেয় পড়ল। একদিকে পুলিশের উৎপাত, অন্যদিকে আর একটা রাইভাল গ্যাং-এর সঙ্গে এলাকা দখল নিয়ে লাগাতার ঝামেলা। মাঝে মাঝেই তার দলের লোকেদের লাস ট্রেন লাইনের ধারে পড়ে থাকতে দেখা যায়, তার দলের লোকেরাও যে দুচারটে লাস ফেলে আসে না, এমন নয়। কিন্তু এই অশান্তির আবহাওয়ায় ব্যবসা করা যায় না।
‘আসলামের ব্যবসার দু’টো দিক ছিল। সে নেপাল থেকে মাল এনে তার একটা অংশ রিটেলে কলকাতায় পাতাখোরদের কাছে বিক্রি করত। এর জন্য তার একটা নেটওয়ার্ক ছিল যেখানে সে এই ছেলেমেয়েগুলোকে কাজে লাগিয়েছিল। সে এদের ধরে রাখার জন্য খুব ভাল টাকা দিত। সাধারণত ড্রাগ অ্যাডিক্টরাই নেশার লোভে ড্রাগ পেডলারের কাজ করে। অর্থাৎ ড্রাগের নেশা ধরিয়ে দিয়েই ড্রাগ পেডলারদের ধরে রাখা হয়। এক্ষেত্রে কিন্তু টাকার নেশা ধরিয়ে ছেলেমেয়েগুলোকে বশে রাখা হত। দেখা যাচ্ছে, ড্রাগের নেশার থেকে টাকার নেশা কোনওভাবেই কম মারাত্মক নয়।
‘আসলামের দ্বিতীয় কাজ ছিল নেপাল থেকে মাল এনে মধ্যপ্রাচ্য দিয়ে ইয়োরোপে পাচার করা। এই কাজে দুবাইতে তার এক সহযোগী ছিল। দেশে থাকাটা ধীরে ধীরে অসম্ভব হয়ে পড়ায় আসলাম ঠিক করল সে পাকাপাকিভাবে দুবাই চলে যাবে। কিন্তু সে দুবাই চলে গেলে তার দেশের ব্যবসাটা কে দেখাশোনা করবে? কলকাতায় আসলামের ডানহাত ছিল আব্দুল। প্রভুভক্তিতে আব্দুলের জুড়ি ছিল না, সে আসলামের জন্য হাসতে হাসতে জীবন দিয়ে দিতে পারত। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত একটা অর্গানাইজেশন চালানোর মতো মাথা আব্দুলের ছিল না। এই সময় সুশান্ত হালদার পুরো অর্গানাইজেশনের মাথায় উঠে বসে। এর জন্য যে শঠ বুদ্ধির প্রয়োজন ছিল সেটা বলাই বাহুল্য যুগিয়েছিল বকুল। এককথায় বলতে গেলে বকুলই কার্যত দলের মাথা হয়ে দাঁড়াল।
‘দলের কর্তৃত্ব পাবার পর বকুল দু’টো কাজ করল, একটা স্বেচ্ছায়, আরেকটা বাধ্য হয়ে। যেহেতু আসলাম তখন দুবাইতে, দুবাই হয়ে ইয়োরোপে কোকেন পাচার করার সম্ভাবনা তখন অনেক বেড়ে গেছে। সমস্যা হল, সেই সময় দুবাইতে মাল নিয়ে যাবার কোনও স্থায়ী বন্দোবস্ত ছিল না। এখানে আমাদের বকুলের বড়দা রজনীরঞ্জনের দিকে চোখ ফেরাতে হবে। রজনীবাবু মানুষটা গোড়ায় অসৎ ছিলেন না, কিন্তু বিদেশ ভ্রমণ এবং ট্র্যাভেল এজেন্সি চালানোর পাগলামিটা তখন তার মাথায় ভাল মতন চেপে বসেছে। চাকরি থেকে তাড়াতাড়ি অবসর নিয়ে একটা ট্র্যাভেল এজেন্সি খুলে বসেছেন, স্বপ্ন দেখছেন, বাঙালিকে কম খরচে বিশ্বদর্শন করাবেন। কিন্তু কোম্পানি একেবারেই চলছে না। রিটায়ারমেন্টের পুরো টাকাটাও কোম্পানির গর্ভে চলে গেছে। রজনীবাবুর যখন প্রায় পথে বসার অবস্থা সেই সময় দলের কর্তৃত্ব সুশান্তর বকলমে বকুলের হাতে চলে আসে।
‘সুশান্তর মাধ্যমে বকুল তার দাদাকে একটা প্রস্তাব পাঠাল। রজনীবাবুর কোম্পানিকে সুশান্ত অনেক টাকা দিয়ে সাহায্য করতে প্রস্তুত, কিন্তু সুশান্তর কিছু কিছু কাজ কোম্পানিকে করে দিতে হবে। মূল কাজ কিছু জিনিস নিয়মিত দুবাইতে পৌঁছে দেওয়া। ঠিক কী জিনিস পৌঁছতে হবে সে ব্যাপারে সুশান্ত নিরুত্তর রইল, তবে এই মাল পৌঁছে দেবার কাজটা যে খুব একটা আইনসম্মত নয়, সেটা রজনীবাবুর পক্ষে আন্দাজ করা কঠিন ছিল না। রজনীবাবু লোভে পড়ে গেলেন। শুধু স্বপ্নপূরণের লোভ নয়, মোটা টাকার হাতছানিও বটে। সব মিলিয়ে তাঁর পদস্খলন হল। ক্রমে তিনি সুশান্তর টাকায় দুবাই ও লন্ডনে আপিস খুললেন। তাঁর ব্যবসার প্রভূত উন্নতি ঘটল। আর তাঁর কোম্পানির মাধ্যমে সুশান্ত-বকুলের মধ্যপ্রাচ্য এবং ইয়োরোপের ব্যবসা দিনে দিনে বাড়তে লাগল। রজনীবাবু অবশ্য ঘুণাক্ষরেও জানতে পারলেন না এই সব কিছুর পেছনে তাঁর সহোদরাও আছেন। রজনীবাবুর ট্র্যাভেল এজেন্সির সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করাটা বকুলের প্রথম কাজ।
‘এই সময় এমন একটা ঘটনা ঘটল যার জন্য ড্যামেজ কন্ট্রোল করাটা একেবারে অতি আবশ্যক হয়ে দাঁড়িয়েছিল। মন্টুবাবুর বাড়ির পেছনে যে গলিটা আছে, যার পাশ দিয়ে চলে গেছে রেল লাইন, সেখানেই মূলত কোকেন বা কোকেনজাত অন্যান্য নেশার জিনিসের কেনাবেচা চলত। যোগান আসত রেলগাড়ি করে, লেভেল ক্রসিং-এ রাত্তিরে মালগাড়ি থামিয়ে নিষিদ্ধ বস্তুগুলো নামানো হত। ওই লাইনটা শেয়ালদা স্টেশনে না ছুঁয়ে স্টেশনের পেছন দিয়ে চলে গেছে, তাই এর ওপর দিয়ে খুব বেশি ট্রেন যায় না। ড্রাগ পাচার করার জন্য এটাই আদর্শ রেলরাস্তা। এসব আমরা এখন সুশান্তর কাছ থেকে একটু একটু করে জানতে পারছি।
‘আমার বিশ্বাস মন্টুবাবুর প্রথম স্ত্রী কল্পনা দত্ত তাঁর বাড়ির পেছনের গলিতে কিছু একটা ঘটতে দেখেছিলেন। তিনি চিররুগ্না, সারাদিন বাড়িতে থাকেন, তাঁর পক্ষে কিছু একটা দেখে ফেলাটা মোটেই আশ্চর্যের নয়। অচেনা কাউকে যদি তিনি ড্রাগ কেনাবেচা করতে দেখতেন তাহলে কিছু এসে যেত না। তিনি নিশ্চয় চেনা কাউকে কোন গুরুতর অপকর্ম করতে দেখেছিলেন।
‘কল্পনা দত্ত একটু পুরোনো ধ্যান-ধারণার মানুষ ছিলেন, ফলে স্বামীর সঙ্গে তাঁর একটা স্বাভাবিক দূরত্ব ছিল। চিররুগ্ন হওয়ার ফলে সেই দূরত্ব আরও বেড়েছিল। তাই তিনি যেটা দেখেছেন সেটা সরাসরি স্বামীকে বলতে তাঁর সংকোচ হল। তাছাড়া নিজের ওপর তাঁর আস্থাও তেমন ছিল না। এটাও দীর্ঘদিন রোগ ভোগের ফল। ফলে তিনি যেটা দেখেছেন সেটা ঠিক দেখেছেন কিনা তা নিয়েও তাঁর সংশয় ছিল। বকুল মাঝেমাঝেই তাঁকে দেখতে আসত। অবশ্য ঠিক তাঁকে দেখতে নয়। মন্টুবাবুর বাড়ির পেছনের গলিতে যে ব্যবসা চলছে তার রক্ষণাবেক্ষণ করতে আসত বকুল। যাইহোক এই আসা-যাওয়ার ফলে বকুলের সঙ্গে কল্পনা দত্তর একটা সহজ সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল। ফলে কল্পনা দত্ত যা দেখেছেন সেটা বকুলকেই প্রথমে বললেন। বকুল, বলাই বাহুল্য, কথাটা হেসে উড়িয়ে দিল। বলল, শরীর রুগ্ন হলে মানুষ এইরকম হ্যালুসিনেশন দেখে। কিন্তু একই সঙ্গে সে মনে মনে ঠিক করল কল্পনা দত্তকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতে হবে। বলা তো যায় না, উনি কার কাছে আবার এই সব কথা গল্প করে বসবেন।
‘রজনীকে দার্জিলিং ভ্রমণের আয়োজন করতে বলা হল। রজনীবাবুর পরিবার, ভাই বোন ছাড়াও পারিবারিক বন্ধু হিসেবে সুশান্ত বেড়াতে যাবে। রজনীবাবুকে বলা হল দার্জিলিং ভ্রমণে মন্টুবাবুদেরও রাজি করাতে হবে। মন্টুবাবু ঘরকুনো লোক, তাঁর স্ত্রী অসুস্থ। দার্জিলিং ভ্রমণে তাঁদের রাজি করানো সহজ কাজ নয়। এই কাজটা রজনীবাবুই একমাত্র করতে পারেন। রজনীবাবু বন্ধুকে বললেন আমাদের সঙ্গে চলো, বৌদিরও একটা হাওয়া বদল হবে। মন্টুবাবু গাঁইগুঁই করে শেষ পর্যন্ত রাজিও হয়ে গেলেন। আমার বিশ্বাস, রজনীবাবু জানতেন না কল্পনা দত্তকে দার্জিলিং-এ নিয়ে গিয়ে খুন করার চক্রান্ত হচ্ছে।
‘পিকনিক করতে গিয়ে কল্পনা দত্ত একা ঘুরতে ঘুরতে আলাদা হয়ে পড়েছিলেন। তাঁর অসুস্থ শরীর, তবু কলকাতার বাইরে গিয়ে, বিশেষ করে হিমালয়-টিমালয় দেখে, তাঁর মনে একটা জোর এসে গিয়েছিল। সেই মনের জোরে তিনি একা একা খানিকটা হাঁটতে সাহস পাচ্ছিলেন। তিনি কোথায় যাচ্ছেন তার খেয়াল রাখছিল দেবী। হয়তো দেবীই তাকে সঙ্গ দিয়ে আরও দূরে নিয়ে যায়। তারপর কল্পনাকে নির্জনে পেয়ে তাঁকে শ্বাসরোধ করে খুন করে। খুন করার পর দেবী মৃতদেহটা ফেলে দেয় একটা খাদে। পুলিশ পরে ঘটনার তদন্ত করতে গিয়ে এই সত্যটাই আবিষ্কার করেছিল। ইনভেস্টিগেটিং অফিসার ছিলেন বাসুদেব কানুনগো। পুলিশ ফোর্সে এত সৎ এবং দক্ষ অফিসার সচরাচর দেখা যায় না। ইন্সপেক্টার কানুনগো আরও কী কী সত্য আবিষ্কার করেছিলেন আমাদের পক্ষে জানা এখন আর সম্ভব নয়। কিন্তু পুলিশের ওপর মহলে সুশান্তদের লোক ছিল। সেই লোক, যার নামটাও আমরা সম্প্রতি জানতে পেরেছি, সুকৌশলে কানুনগোকে বদলি করে দিলেন। একই সঙ্গে কল্পনা দত্ত হত্যা মামলার কিছু অতি দরকারি নথিও লোপাট করে দেওয়া হল। কল্পনা দত্তকে যে হত্যা করা হয়েছে সেই সত্যটাই প্রকাশ্যে এল না। ফলে কল্পনা দত্তর মামলা সম্পূর্ণ চাপা পড়ে গেল। এর জন্য অবশ্য উক্ত পুলিশকর্তাটিকে একটা অবিশ্বাস্য রকম ঘুষ দিতে হয়েছিল, কিন্তু সুশান্তদের আর যাই হোক টাকার অভাব কোনও দিনই ছিল না। কল্পনা দত্তকে খুন করানোটা বকুলের দ্বিতীয় কাজ। এই কাজটা তাকে খানিকটা বাধ্য হয়েই করতে হয়েছিল।
‘মন্টুবাবুর বাড়ির পেছনের গলিটাতে অবশ্য আগের মতোই কেনাবেচা চলছিল। সুশান্ত-বকুলের মনে হল, ওই গলিটার ওপর একটা ভাল মতো নজরদারি দরকার। নজরদারিটা সব থেকে ভাল করে করা যায় মন্টুবাবুর বাড়ি থেকে। সুশান্ত-বকুলদের দলে শ্রীলেখা বলে একটি মেয়ে ছিল। কলেজ থেকেই শ্রীলেখা বকুলের অভিন্নহৃদয় বন্ধু। বকুল জানত জয়পুরে কল্পনা দত্তর এক খুড়তুতো বোন থাকে। সম্ভবত কল্পনাই বকুলকে গল্প করেছিল। বকুল এটাও বুঝেছিল যে কল্পনার বোনকে মন্টু দত্তর মনে থাকার কথা নয়। ব্যাপারটা সে কথায় কথায় মন্টু দত্তর কাছ থেকে যাচাইও করে নিয়েছিল। কল্পনা দত্তর বোনকে চিনত একমাত্র কল্পনা দত্ত নিজে, কিন্তু সে-ই তো আর নেই। তাই সুশান্ত এবং বকুল শ্রীলেখাকে আলপনা সামন্ত অর্থাৎ কল্পনা দত্তর খুড়তুতো বোন সাজিয়ে মন্টু দত্তর সামনে হাজির করল।
‘শ্রীলেখা কলেজে ভাল অভিনয় করত। সে খানিকটা মেক আপ নিয়ে চেহারায় একটা গ্রাম্যতা আনল। সামনে দুটো নকল দাঁত লাগাল। তারপর সুলতার মাসি সেজে মন্টু দত্তর বাড়িতে পাকাপাকি জায়গা করে নিল। সে ওপর ওপর সুলতার দেখাশোনা করত আর তলায় তলায় মন্টুবাবুর বাড়ির পেছনের গলিতে মাদক কিনতে আসা খদ্দেরদের তদারকি করত। মন্টুবাবু তাকে পাইকপাড়ার বাড়িতে থাকতে দিলেন। শ্রীলেখার টাকা-পয়সার কোনও প্রয়োজন ছিল না। বেআইনি রাস্তায় তার প্রচুর রোজগার ছিল। তবু লোককে দেখানোর জন্য সে নিয়মিত ব্যাঙ্কে গিয়ে টাকা তুলত। যে টাকাটা সে প্রত্যেক সপ্তাহে তুলত তাই দিয়ে তার একদিনের খরচটাও চলত কিনা সন্দেহ। ফলে তার টাকা তোলার সঙ্গে তার মাসিক বা সাপ্তাহিক খরচের কোনও সম্পর্কই ছিল না। আসলে, ব্যাঙ্কে যাবার পিছনে তার অন্য একটা উদ্দেশ্য ছিল। সে তার পড়শিদের দেখাতে চাইত সে স্বাভাবিক একজন মহিলা। তার জীবনে কোনও রহস্য নেই, লুকোছাপা নেই। সে চাইত সবাই তাকে বারবার দেখুক। একদিন যে তাকে হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে যেতে হবে সেটা তার মাথায় ছিল না। আমরা খোঁজ নিয়ে জেনেছি, মাসে মাসে ‘পান্থজনের সখা’র লন্ডন আপিস থেকে কুড়ি হাজার টাকা তার ব্যাঙ্কে জমা পড়ত।
‘সুলতার নকল মাসির ছবি রত্নাদের কলেজে কেউ চিনতে পারেনি। কিন্তু ওই ছবিটাতে পুলিশের আর্টিস্ট খানিকটা রদবদল ঘটিয়ে যেটা দাঁড় করিয়েছিল, সেটা ‘পান্থজনের সখা’র শ্রীলেখা ভট্টাচার্য বলে সঙ্গে সঙ্গে আইডেন্টিফায়েড হয়ে গেল।
‘বছর পাঁচেক সুশান্তদের নিরুপদ্রবে কাটল। তারপর, তাদের দুর্ভাগ্য, ইন্সপেক্টার কানুনগো গোবরায় বদলি হয়ে এলেন। এমন হতেই পারে যে এটা নিছক কাকতালীয়। কিন্তু আমার স্থির বিশ্বাস ব্যাপারটা এরকম নয়। ইন্সপেক্টার কানুনগো নিজেই খানিকটা চেষ্টা করে ওই অঞ্চলে বদলি নিয়ে এসেছিলেন, এমনটা হবার সম্ভাবনাই ষোলোআনা। হয়তো, কল্পনা দত্ত হত্যা মামলার তদন্ত করতে গিয়ে তিনি সুশান্ত-দেবীদের কার্যকলাপের কোনও সূত্র পেয়েছিলেন, হয়ত তিনি টের পেয়েছিলেন গোবরা অঞ্চলের একটি ড্রাগ ডিলারদের গ্যাং এই হত্যার পেছনে আছে। ওপরওলার অঙ্গুলিহেলনে যে কল্পনা দত্ত হত্যা মামলাটা পুরোপুরি চাপা পড়ে গেল, বলাই বাহুল্য, এটা তাঁর মত সৎ এবং কর্তব্যনিষ্ঠ অফিসারের ভাল লাগেনি। তাই অনুসন্ধানটা আবার নতুন করে শুরু করার একটা সুযোগ তিনি খুঁজছিলেন। এবং সেই কারণেই তাঁর গোবরায় আসতে চাওয়া। তবে এসবই আমার অনুমান।
আদিত্য একটু থামল। একঢোঁক জল খেল। চা এসেছে। চায়ের কাপে একটা লম্বা চুমুক দিয়ে আদিত্য আবার শুরু করল।
‘বদলি হয়ে আসার পরেই ইন্সপেক্টার কানুনগো কাজে লেগে গেলেন। তাঁর মনে হল, মন্টুবাবুর বাড়ির পেছনের গলিটার মধ্যে কোনও একটা রহস্য আছে। দেবীরঞ্জন বসাক, সুশান্ত হালদার, আব্দুল আজিজ এদের সকলের সম্বন্ধেই তিনি একটু একটু করে জানতে পারলেন। তিনি কল্পনা দত্তর সূত্র ধরে একদিন মন্টু দত্তর বাড়িতে হাজির হলেন। দেখলেন সেখানে কল্পনা দত্তর এক বোন রয়েছেন। সেই বোনের সঙ্গে কথা বলে কিন্তু তাঁর বেজায় খটকা লাগল। অনুসন্ধান করতে গিয়ে কল্পনা দত্তর অতীত সম্বন্ধে তিনি যতটা জেনেছিলেন, তাঁর মনে হল, এই মহিলা তার কিছুই জানে না। এই মহিলা তাহলে কে? প্রশ্নটা তাঁর মনে ঘুরতে লাগল।’
‘শ্রীলেখা বকুলকে ঘটনাটা জানাল। বলল, কানুনগো তাকে সন্দেহ করছে। বকুল শ্রীলেখাকে উধাও হয়ে যেতে বলল। ফলে ইন্সপেক্টার কানুনগো ওই অঞ্চলে বদলি হয়ে আসার দু’মাসের মধ্যেই সুলতার মাসি চিরতরে উধাও হয়ে গেলেন। আমরা অবশ্য তার খোঁজ পেয়েছি। আমরা জানতে পেরেছি তিনি গত কয়েক বছর যাবত ‘পান্থজনের সখা’র লন্ডন অফিসটা দেখাশোনা করেন। প্রসঙ্গত জানাই, ইন্সপেক্টার কানুনগো, আসল আলপনা সামন্তের একটা ছবি জোগাড় করেছিলেন, যে ছবিটা আমরা তাঁর ডায়েরির ভেতরে পেয়েছিলাম। রামানুজবাবু কনফার্ম করেছেন এটা তাঁর বহুদিন আগে চেনা আলপনা দত্তরই ছবি। ছবিটা দেখে আমারও একটা খটকা লেগেছিল, কিন্তু কেন খটকা লাগছে সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারিনি। পরে বুঝতে পারলাম, ছবির মেয়েটির সঙ্গে মন্টুবাবুর মেয়ে সুলতার একটা অতি সূক্ষ্ম মিল আছে। মাসি-বোনঝির চেহারার মধ্যে ওইটুকু মিল তো থাকতেই পারে। আর আসল আলপনা দত্তর অন্য যে ছবিটা, যেটা রামানুজবাবুর কাছে ছিল, সেটা যে বকুলই কোনও এক ফাঁকে সরিয়ে ছিল এবিষয়ে আমি নিশ্চিত।
‘ওই বছরেই সুলতার বিয়ে হয়ে গেল। তাড়াতাড়ি সুলতার বিয়ে দিয়ে দেবার পরামর্শটা আমার অনুমান রজনীবাবুই দিয়েছিলেন। মন্টুবাবু এখানে থাকলে কনফার্ম করতে পারতেন। সবকিছুর আড়ালে অবশ্যই বকুল। মন্টুবাবুর বাড়িটা ফাঁকা হয়ে গেলে তাদের কাজ করতে সুবিধে হবে।’ আদিত্য থামল। রত্নাবলীর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘দাঁড়া, বারান্দা থেকে একটা সিগারেট খেয়ে আসি।’
‘এখানেই খা। পারমিশন দিলাম। তবে একটা। আর নয়।’ রত্না বলল, ‘জমাটি গল্পের মাঝখানে উঠতে পারবি না।’
আদিত্য সিগারেট ধরাল, গৌতমের ইশারায় সাড়া দিয়ে তাকেও একটা ধরিয়ে দিল। মালিনী কটমট করে দুজনের দিকে তাকাল। রত্না উঠে গিয়ে বারান্দার দরজাটা খুলে দিতে আদিত্য আবার বলতে লাগল,
‘সুলতার বিয়ে হয়ে যাবার পর মন্টুবাবুর বাড়ি ফাঁকা হয়ে গেল। মন্টুবাবু সারাদিন বাড়ি থাকেন না, অনেক রাত্তিরে ফেরেন। বাড়িতে তো কেউ নেই, কার কাছেই বা ফিরবেন? ফলে সুশান্তদের খুব সুবিধে হয়ে গেল। পেছনের গলিটা তারা অবাধে তাদের কুকাজের জন্য ব্যবহার করতে লাগল। কিন্তু ইতিমধ্যে কানুনগোও একটু একটু করে এগোচ্ছেন। গৌতম তাকে পুরো সাপোর্ট দিচ্ছে। বছর দু’য়েকের মধ্যে এমন অবস্থা হল যে ইন্সপেক্টার কানুনগো গ্যাংটাকে প্রায় ধরে ফেলেন আর কি। এই সময় সুশান্ত আর বকুল মিলে একটা প্ল্যান করল।
‘বলছি বটে সুশান্ত আর বকুল মিলে, কিন্তু আমার বিশ্বাস প্ল্যানটা বকুলের মস্তিষ্কপ্রসূত একটা মাস্টারস্ট্রোক। অন্য কেউ হলে তদন্তটাকে ভুল পথে চালিত করার জন্য দলের চুনোপুঁটি দু’একটাকে ধরিয়ে দিয়ে ভান করত এরাই যেন রাঘব বোয়াল। বকুল ঠিক উল্টোটা প্ল্যান করল। দলের একেবারে মাথা সুশান্ত হালদার তার সাগরেদ দেবীকে নিয়ে পুলিশের কাছে ধরা দেবে। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে যে প্রমাণগুলো পুলিশের হাতে কৌশলে তুলে দেওয়া হবে তা দিয়ে তাদের বেশিদিন ধরে রাখা যাবে না। সব মিলিয়ে পুলিশের ধারণা হবে তারা যাদের ধরেছে সেই সুশান্ত এবং দেবী নেহাতই চুনোপঁটি। ফলে পুলিস একজন কাল্পনিক রহস্যের মেঘনাদের খোঁজে ছুটে বেড়াবে। আর পাকাপাকিভাবে পুলিশের নজর সুশান্তর ওপর থেকে সরে যাবে। এই টোপটা কানুনগোর মতো অভিজ্ঞ পুলিস অফিসারও সাময়িকভাবে গিলে ফেললেন।
‘সুশান্ত-দেবী জেলে যাবার পর বাইরে থেকে আব্দুল ব্যবসা চালাতে লাগল আর অন্তরালে রইল বকুল। বকুল আগে থেকেই বুঝতে পেরেছিল মন্টুবাবুর বাড়িটার ওপর পাকাপাকিভাবে কব্জা না করতে পারলে বেশিদিন ওই গলিটায় ব্যবসা চালানো যাবে না। সে সুশান্তর সঙ্গে আলোচনা করে রেখেছিল, সুশান্তরা জেলে যাবার পরেই সে মন্টুবাবুকে বিয়ে করে পাকাপাকিভাবে ওই বাড়িতে বাস করতে শুরু করবে। নিজের শরীর ব্যবহার করা নিয়ে বকুলের কোনও বাতিক ছিল না। সুশান্তর একটু আপত্তি ছিল বটে, কিন্তু বকুলের ঠাণ্ডা যুক্তির কাছে তাকে হার মানতে হল। প্রসঙ্গত, বকুল-সুশান্তর শারীরিক সম্পর্ক বহুদিনের, একথা সুশান্তই আমাদের বলেছে। তাছাড়া কলেজের ছাদে সুশান্তর সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করতে গিয়ে জানাজানি হয়ে যায়। এবং এই কারণে কলেজ থেকে বকুলকে রাস্টিকেট করা হয়।
‘বকুল নিশ্চিত ছিল একাকী মন্টুবাবু এক কথায় তাকে বিয়ে করতে রাজি হয়ে যাবেন। পুরুষের চোরা-চাহনির অর্থ তার থেকে ভাল কে বুঝবে? অতএব রজনীকে দিয়ে বিবাহের প্রস্তাব পাঠানো হল। বকুল এটাও জানত যে একবার বিয়ে হয়ে গেলে সে মন্টুবাবুকে পুরোপুরি বশে রাখতে পারবে। সেটা যে কতটা সত্য সেটা মন্টুবাবুর কথা শুনে প্রথম দিনেই বুঝতে পেরেছিলাম। বকুল মন্টুবাবুকে বিয়ে করার বছর দেড়েক পরে সুশান্ত এবং দেবী জেল থেকে বেরোল।
‘আগে থেকেই ঠিক ছিল জেল থেকে বেরোনোর পরে রজনীবাবুর সঙ্গে দেবী-সুশান্ত প্রকাশ্যে সমস্ত সম্পর্ক ছেদ করে দেবে। নাটকের ব্লুপ্রিন্ট আগেই তৈরি ছিল, নাটক মঞ্চস্থ হল, দেবীরঞ্জন সুশান্ত সমভিব্যহারে সর্বসমক্ষে দাদার বাড়ি থেকে বিতাড়িত হলেন। তারপর তারা দুজন মিলে সাইবার কাফে শুরু করল, পাড়ার সবাই ভাবল ছেলে দুটো ভাল হয়ে গেছে। এর কিছুদিন পর থেকে ভূতুড়ে টেলিফোনের উপদ্রব শুরু হয়।
‘মণ্টুবাবু যেদিন ভূতুড়ে টেলিফোনের সমস্যা নিয়ে প্রথম আমার কাছে এলেন, আমার মনে হয়েছিল তিনি যে সমস্যাটা নিয়ে এসেছেন আসল সমস্যা সেটা নয়। যেন নকল একটা সমস্যা নিয়ে কেউ তাকে আমার কাছে পাঠিয়েছে। কেন আমার এরকম মনে হল এককথায় বলতে পারব না, হয়ত একটা ইন্টুইশন কাজ করছিল। হয়তো মনে হয়েছিল এত সামান্য কারণে কেউ এতগুলো টাকা খরচ করে না। তাই প্রথম প্রথম আমার মন্টুবাবুকেই সন্দেহ হচ্ছিল। তারপর একদিন আমি আমাদের মেসের চাকর বলরামের একটা কথায় হঠাৎ ভূতুড়ে টেলিফোনের আসল অর্থ বুঝতে পারলাম। বলরাম বলছিল, রোজ সকালে একজন বোর্ডারের ঘর থেকে ভেসে আসা অ্যালার্ম ঘড়ির শব্দে তার ঘুম ভেঙে যায়। সামান্যই কথা। কিন্তু আমার মনে হল এমনও তো হতে পারে, টেলিফোনটা বাজে অন্য কাউকে শোনানোর জন্য। মন্টুবাবুর বাড়ির কেউ ফোনটা ধরল কি ধরল না সেটা অপ্রাসঙ্গিক।
‘আমি মনে মনে একটা থিয়োরি খাড়া করলাম। মন্টুবাবুর বাড়ির পেছনে একটা নির্জন গলি আছে। গলিটাতে এমনিতে লোক যাতায়াত নেই। কানা গলি, একদিক বন্ধ। গলিতে ঢোকার মুখে এক গাদা আবর্জনা পড়ে থাকে। তাই গলিটাকে কেউ ব্যবহার করে না। বস্তুত, ড্রাগ-ডিলাররাই নিয়মিত গলির মুখে আবর্জনা ফেলে যায়, যাতে গলিটাতে কেউ না ঢোকে। এবার ধরা যাক কোনও নেশাড়ুর নেশার বস্তু কেনা দরকার। তার কাছে একটা টেলিফোন নম্বর আছে। সে জানে একটা বিশেষ টেলিফোন বুথ থেকে তাকে এই নম্বরে ফোন করতে হবে। ওপারে কেউ হ্যালো হ্যালো বললেও উত্তর দেওয়া চলবে না। তারপর তাকে দশ মিনিটের মধ্যে মন্টুবাবুর বাড়ির পেছনের গলিতে পৌঁছে যেতে হবে। একটু পা চালিয়ে হাঁটলে সেটা অসম্ভব নয়। সেখানে পৌঁছলে নগদ টাকার বিনিময়ে সে হাতে হাতে নেশার বস্তু পেয়ে যাবে। কেমন করে এটা সম্ভব হচ্ছে?
‘খেয়াল করতে হবে, মন্টুবাবুর টেলিফোনটা যখন বাজছে তখন সুশান্তর সাইবার কাফে থেকে সেটা পরিষ্কার শোনা যাচ্ছে। সাইবার কাফের কোথাও নেশার বস্তু মজুত করা আছে। টেলিফোনের আওয়াজ শুনে সুশান্ত একজন সাগরেদকে মাল সুদ্ধু পাঠিয়ে দিচ্ছে। সে সাইবার কাফের পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে গলির মধ্যে খদ্দেরের জন্য অপেক্ষা করছে। একদিন মন্টুবাবুর ছাদে দাঁড়িয়ে সিগারেট খেতে খেতে যখন বকুলের সঙ্গে কথা বলছিলাম তখন এই ব্যাপারটাই ঘটেছিল, কিন্তু সেই মুহূর্তে ঠিক খেয়াল করতে পারিনি। পরে ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছিলাম। অর্থাৎ ভূতুড়ে টেলিফোনের একটা উদ্দেশ্য আছে। তার উদ্দেশ্য খদ্দের যে আসছে এই বার্তা বিক্রেতার কাছে পৌঁছে দেওয়া। আইডিয়াটা বকুলের মাথা থেকেই বেরিয়েছিল।’
‘আমার থিয়োরিটা যাচাই করার জন্য গৌতমের কাছে খোঁজ নিয়ে জানাতে বললাম, মন্টুবাবুর টেলিফোনটা গত দু’বছরে কতবার খারাপ হয়েছে। গৌতম খোঁজ নিয়ে জানাল, একবারও হয়নি। এটা অস্বাভাবিক। আগে কিন্তু টেলিফোনটা মাঝে মাঝে খারাপ হত। যেমন সব টেলিফোন হয়। বুঝলাম, কেউ টেলিফোন কোম্পানির লোকেদের টাকা-পয়সা খাইয়ে টেলিফোনটা যাতে ঠিক থাকে সেই ব্যবস্থা করে রেখেছে। বলাই বাহুল্য, কোটি টাকার ব্যবসা যে টেলিফোনের ওপর নির্ভর করছে তাকে কখনই খারাপ হতে দেওয়া যায় না। নিশ্চিন্ত হলাম, আমার ভাবনাটা ঠিক পথেই চলছে।
‘সুশান্তর সাইবার কাফে অবশ্য মাঝে মাঝে পুলিশ রেড করত। কিন্তু রেড হবার আগাম খবর উক্ত পুলিশকর্তা মারফত আগেই সুশান্তদের কাছে পৌঁছে যেত। তারা তখন তাদের স্টক সবসুদ্ধু মন্টুবাবুর বাড়িতে বকুলের জিম্মায় চালান করে দিত। রেড শেষ হয়ে গেলে আবার মালপত্র ফিরে আসত সাইবার কাফেতে। আমরা শেষ যেদিন সাইবার কাফে রেড করলাম, সেদিনও আগে থেকে খবরটা পৌঁছে গিয়েছিল, ফলে সাইবার কাফের পুরো স্টকটাই মন্টুবাবুর বাড়িতে পাচার করা হয়েছিল। আমরা অবশ্য এরকমই আশা করছিলাম। এতে আমাদের এটাই সুবিধে হল যে পুরো স্টকটাই আমরা এক সঙ্গে একটা জায়গায় পেয়ে গেলাম। ‘পান্থজনের সখা’র আপিসও যে রেড করা হবে সেটা অবশ্য গৌতম আর আমি ছাড়া আর কেউ জানত না। সেখান থেকেও আমরা কিছু মাল উদ্ধার করেছি।
‘যাই হোক, ভূতুড়ে টেলিফোনের মাধ্যমে ড্রাগ বিক্রির কাজে বাধা পড়ল যখন ইন্সপেক্টার কানুনগো এই রহস্যটা ধরতে পারলেন। পুরো রহস্যটা তিনি ধরতে পেরেছিলেন কিনা জানি না, তবে এই ভূতুড়ে টেলিফোন নম্বরটি তিনি জোগাড় করতে পেরেছিলেন। আমরা এই নম্বরটা তাঁর ডায়েরির মধ্যে পেয়েছিলাম। বলাই বাহুল্য, টেলিফোন নম্বরটি খুব নিয়মিত খদ্দের ছাড়া কাউকে দেওয়া হত না। দুর্ভাগ্যবশত সুশান্তরাও তাদের বেতনভুক পুলিশকর্তাটির কাছ থেকে জানতে পারল কানুনগো টেলিফোন নম্বরটি পেয়ে গেছেন। ফলে কানুনগোকেও মরতে হল।
‘মন্টুবাবু আমার কাছে টেলিফোন রহস্য সমাধানের জন্য এলেন কেন? কেউ কি তাঁকে পাঠিয়েছিল? নাকি তিনি নিজে নিজেই আমার কাছে এসেছিলেন? প্রথম প্রশ্নের উত্তরটা আগে দিই। আগেই বলেছি, সুশান্তরা জানত পুলিশের কাছে ভূতুড়ে টেলিফোন নম্বরটা পৌঁছে গেছে। যে পুলিশকর্তাটি সুশান্তদের কাছ থেকে নিয়মিত টাকা পেতেন তিনিই এই খবরটা সুশান্তদের জানিয়ে দিয়েছিলেন। এটা জানার পর দুটো পথ খোলা ছিল। এক, ভূতুড়ে টেলিফোন নম্বরটা পুরোপুরি বাতিল করে দিয়ে মাল বিক্রির সম্পূর্ণ নতুন কোনও উপায় বার করা। দুই, কোনোভাবে পুলিশকে বোঝানো যে ভূতুড়ে টেলিফোনের পেছনে খুব সাধারণ কোনও গল্প আছে। অতএব নম্বরটা নিয়ে আর তদন্তের দরকার নেই। ভূতুড়ে টেলিফোনের সাহায্যে ব্যবসাটা এতটাই ভাল চলছিল এবং এতগুলো নিয়মিত খদ্দের এইভাবে মাল কেনার ব্যাপারে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল যে সুশান্ত-বকুলরা ভাবল ভূতুড়ে টেলিফোন একেবারে বাতিল করে দেবার আগে দ্বিতীয় রাস্তাটা চেষ্টা করা যাক। যদি সেটা কাজ না করে তখন না হয় ভূতুড়ে টেলিফোনের মধ্য দিয়ে মাল বিক্রি পুরো বন্ধ করে দেওয়া যাবে। কিন্তু পুলিশকে কি করে বোঝানো যায় যে আসলে ভূতুড়ে টেলিফোনের পেছনে খুব সাদামাটা কোনও কাহিনি আছে?
‘সুশান্তরা তাদের বেতনভুক পুলিশকর্তাটির মাধ্যমে জানতে পেরেছিল যে আদিত্য মজুমদার বলে একটি বেসরকারি গোয়েন্দা আছে যার সঙ্গে জয়েন্ট কমিশনার ক্রাইম গৌতম দাশগুপ্তর গলায় গলায় ভাব। আদিত্য মজুমদারকে যদি ভূতুড়ে টেলিফোনের কোনও আষাঢ়ে গল্প বিশ্বাস করানো যায় তাহলে সেটা গৌতম দাশগুপ্ত পর্যন্ত পৌঁছে যাবার ষোলোআনা সম্ভাবনা। এই বিশ্বাস করানোর কাজটা সম্পন্ন করার জন্যই আমার কাছে মন্টুবাবুর আগমন। অর্থাৎ যাকে ইংরেজিতে বলে ‘ফিডিং মিস-ইনফরমেশন’ সেই উদ্দেশ্য নিয়েই মন্টুবাবু আমার কাছে এসেছিলেন।
‘এবার দ্বিতীয় প্রশ্ন, মন্টুবাবু কি স্বেচ্ছায় এই কাজে এসেছিলেন নাকি তাঁর অজান্তেই কেউ তাঁকে ব্যবহার করেছিল? আমার প্রথমে মনে হয়েছিল যে আমার কাছে আসার পেছনে মন্টুবাবুর অন্য কোনও উদ্দেশ্য আছে। মন্টুবাবু সাবধানী ব্যবসাদার, তিনি তেমন কারণ ছাড়া পঞ্চাশ হাজার টাকা খরচ করবেন কেন? পরে তাঁর আসার কারণটা বুঝতে পারলাম। দ্বিতীয়বার বিয়ে করার পর থেকে মন্টুবাবু এক মুহূর্তের জন্য সুখ পাননি। বকুল তাঁকে মন কোনোদিনই দেয়নি, কিছুদিন পর থেকে, বিশেষ করে সুশান্ত হালদার জেল থেকে বেরোনোর পর থেকে, নানা অছিলায় শরীর দেওয়াও বন্ধ করে দিয়েছিল। আমার বিশ্বাস, প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে কল্পনা দত্তর মতো মন্টু দত্তকেও সরিয়ে দেওয়া হত।
‘বকুলের ওপর জোর খাটানো মন্টুবাবুর পক্ষে সম্ভব ছিল না। অথচ বকুলের শরীর ও ব্যক্তিত্ব তাঁকে দিনরাত্রি আকর্ষণ করত, আগুন যেমন পতঙ্গকে টানে। তাঁর মনে হচ্ছিল সুশান্তর সঙ্গে বকুলের একটা গভীর সম্পর্ক আছে, কিন্তু তাঁর কাছে কোনও প্রমাণ ছিল না। প্রমাণ পেলেই বা তিনি কী করতেন তা অবশ্য আমার জানা নেই। যাই হোক, রজনীবাবু যখন তাঁকে আমার বন্ধু সুনন্দর কাছে যেতে পরামর্শ দিলেন এবং সুশান্তদের বেতনভুক পুলিশকর্তাটির সাহায্যে একটা অ্যাপয়েন্টমেন্টও করিয়ে দিলেন, তখন মন্টুবাবু রাজি হয়ে গেলেন। ভাবলেন, হয়তো সুশান্ত-বকুলের সম্পর্কে কিছু দরকারি কথা জানা যাবে। সুনন্দ মন্টুবাবুকে আমার কাছে পাঠাল। সুশান্তরা ঠিক এটাই আশা করেছিল।
‘সুশান্তর গল্প মন্টুবাবুকে যখন বললাম, তিনি ভেতরে ভেতরে ছেলেমানুষের মত খুশি হয়ে উঠলেন। যদিও ওপর ওপর চিন্তিত হওয়ার ভান বজায় রাখলেন। তিনি ভাবলেন, বকুল এবার পুরোপুরি তাঁর হয়ে যাবে। তিনি যে খুশি হয়েছেন সেটা বুঝলাম যখন তিনি চলে আসার সময় আমার হাতে নগদ চল্লিশ হাজার টাকা গুঁজে দিলেন। কোনও ঝানু ব্যবসাদার এত সহজে টাকা খরচ করে না।
আদিত্য থামল। রামানুজ চট্টোপাধ্যায়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘রামানুজবাবুও সেদিন অনেক সাহায্য করেছেন। তিনি পেছন দিক থেকে মন্টুবাবুর বাড়ির ওপর নজর রাখছিলেন। আমরা যখন লালবাজারের ভেতরে রটিয়ে দিলাম যে সুশান্তদের সাইবার কাফে, আব্দুলের আড্ডা এবং পরিত্যক্ত কারখানা রেড করা হবে, আমরা জানতাম এই খবর অচিরেই সুশান্তদের কাছে পৌঁছে যাবে, ঠিক যেমন আগেও কয়েকবার গিয়েছিল। ফলে, অনুমান করেছিলাম, সুশান্তরা সাময়িকভাবে সমস্ত মাল মন্টুবাবুর বাড়িতে বকুলের জিম্মায় সরিয়ে দেবে। রামানুজবাবু গভীর রাত্তিরে ফোন করে জানালেন, মন্টুবাবুর বাড়ির পেছনের দরজা দিয়ে মাল ভেতরে ঢুকেছে। আমরা নিশ্চিন্ত হলাম।’
‘আমার একটা প্রশ্ন আছে’ রামানুজবাবু মিহি গলায় বললেন। ‘ধরুন আপনি বকুল-সুশান্তদের আসল প্ল্যানটা ধরতে পারলেন না। আর আপনার কথা শুনে মিস্টার দাশগুপ্তও ওই ভূতুড়ে নম্বরটা নিয়ে ইনভেস্টিগেশন বন্ধ করে দিলেন। তাহলে মন্টুবাবুকে নিয়ে বকুল-সুশান্ত কী করত? সুশান্ত কি মন্টুবাবুর কাছে ব্ল্যাকমেলের টাকা চাইত? তাহলে তাকে কিছু ইনক্রিমিনেটিং ডকুমেন্টও তো তৈরি করতে হত।’
‘এই প্রশ্নটা নিয়ে আমিও ভেবেছি। হয়তো কিছু চিঠি এবং ছবি তৈরি করে মন্টুবাবুর কাছ থেকে ওরা কিছু টাকা আদায় করে নিত। কিংবা হয়তো কিছুই না করে কিছুদিন ওরা মন্টুবাবুকে লেজে খেলাত। ঠিক কোনটা করত সেটা অনুমানসাপেক্ষ। হয়ত প্রথমটাই করত যাতে আমি মন্টুবাবুর কাছ থেকে খবর পেয়ে গৌতমকে জানিয়ে দিই এবং ভূতুড়ে টেলিফোনের আসল গল্পটা ব্ল্যাকমেলের গল্পের আড়ালে চাপা পড়ে যায়। কিন্তু একবারে ব্ল্যাকমেলের পুরো টাকাটা ওরা নিত না। ভূতুড়ে টেলিফোন কল জিইয়ে রাখার একটা উপায় ওরা ঠিকই বের করত। তবে একটা ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। ভূতুড়ে টেলিফোন নম্বর নিয়ে পুলিশ ইনভেস্টিগেশন বন্ধ করে দিলে মন্টুবাবুর জীবনের দাম এক কানা কড়িও থাকত না। তাঁর প্রথম স্ত্রীর মতো তাঁকেও সরিয়ে দেওয়া হতো। ভূতুড়ে টেলিফোন নম্বর নিয়ে পুলিশ ইনভেস্টিগেশন বন্ধ হয়েছে কিনা সেই খবর সুশান্ত-বকুলরা তাদের বেতনভুক পুলিশকর্তাটির কাছ থেকেই পেয়ে যেত।’
‘বকুল দত্তকে আপনি কীভাবে সন্দেহ করলেন?’ আবার রামানুজবাবুর প্রশ্ন।
‘বকুল-সুশান্তর বেতনভোগী পুলিশ কর্তাটিকে আমরা আইডেনটিফাই করতে পেরেছি। যদিও প্রমাণের অভাবে আমরা তাঁর কিছুই করতে পারতাম না, আমরা ব্লাফ দিলাম। বললাম, তাঁর বিরুদ্ধে যথেষ্ট প্রমাণ আমাদের হাতে আছে। তিনি ভয় পেয়ে গেলেন। আমরা তাঁকে ছেড়ে দেব এই শর্তে তিনি বকুল-সুশান্তদের অর্গানাইজেশনটা সম্বন্ধে বেশ কিছু তথ্য আমাদের জানালেন। বলাই বাহুল্য, তাঁকে আমরা ছাড়ছি না। বকুলের পুরো স্টেটমেন্টটা পেলে হয়ত ওই পুলিশ কর্তাটিকে ইনক্রিমিনেট করতে পারব।’
‘আমার একটা কথা শোন। তুই যে সেদিন বকুলের সঙ্গে লাঞ্চ খেতে বেরিয়েছিলি সেটা আমরা জানতে পেরেছে। গৌতম আমাদের বলেছে। আমার কথা হল, তুই বকুলের সঙ্গে লাঞ্চ খেতে গিয়েছিলি কেন?’ রত্না আদিত্যকে চেপে ধরেছে।
‘বলতে পারিস ওটা একটা শো ডাউন। পরস্পর পরস্পরকে যাচাই করে নেওয়ার একটা ঠাণ্ডা যুদ্ধ। আমার একটা সুবিধে ছিল। বকুল জানত আমি কে এবং আমি জানতাম যে বকুল আমার আসল পরিচয় জানে। কিন্তু বকুল জানত না যে আমিও বকুলের আসল পরিচয় জানি। বোধহয় ভেবেছিল আমি ওর প্রেমে পড়ে গেছি। খেতে খেতে লক্ষ করলাম বকুলের দু’জন বডিগার্ড বাইরে গাড়িতে অপেক্ষা করছে। আশ্বস্ত হলাম, বকুলই দলের মাথা।’
‘শো ডাউন না ছাই। গৌতম বলছিল, আদিত্য মেয়েটার বেধড়ক প্রেমে পড়ে গেছে। নাহলে ওর বুদ্ধির এত প্রশংসা করে। বলছিল, এবার আদিত্যটার একটা বিয়ে দিতে হবে। নয়ত কোন ক্রিমিনালের সঙ্গে কবে ভিড়ে যাবে কে জানে।’ রত্না আদিত্যকে ছাড়বে না।
আদিত্য একটা উত্তর দিতে গিয়েও চুপ করে গেল। তার মনে পড়ে গেল গতকাল রাত্তিরেও সে বকুলকে স্বপ্নে দেখেছে।
(২)
বলরাম ঘরে ঢুকে দেখল আদিত্য একমনে কাজ করছে। বলরামকে দেখে বলল,
‘এটা কী জানিস? এটাকে বলে ল্যাপটপ।’
‘কী নাম বললেন? এটা তো কম্পিউটার। বসিরহাট থেকে এক বাবু হোটেলে আসেন, তাঁর কাছে দেখেছি।’
‘ঠিকই বলেছিস। এটা একটা ছোট কম্পিউটার। সঙ্গে নিয়ে ঘোরা যায়।’
‘কিনলেন, নাকি কারো কাছ থেকে নিয়ে এলেন? এসব জিনিসের তো দাম খুব।’
আদিত্যর সামর্থের ওপর বলরামের খুব একটা ভরসা নেই।
‘কিনলাম রে। নগদ পঞ্চান্ন হাজার দিয়ে কিনলাম।’
‘প-ঞ্চা-ন্ন হা-জা-র?’ বলরামের গলায় স্পষ্ট অবিশ্বাস।
‘পুরো পঞ্চান্ন হাজার। পুলিশের কাছ থেকে একটা পাঁচ লাখ টাকার অ্যাওয়ার্ড পেয়েছি জানিস। মানে পাঁচ লাখ টাকার পুরস্কার। আমি এখন বড়লোক।’
বলরাম কিছু বলতে পারল না। তার চোখদুটো ছানাবড়া হয়ে গেছে। আদিত্য বলল,
‘তোকেও একটা পুরস্কার দিতে হবে। তুই অ্যালার্ম ঘড়ির কথাটা না বললে ভূতুড়ে টেলিফোনের আসল রহস্যটা আমার মাথাতেই আসত না। ভাবছি তোকে একটা ভাল অ্যালার্ম ঘড়ি কিনে দেব।’ আদিত্য জুত করে একটা সিগারেট ধরাল।
—