চৌধুরি বাড়ির রহস্য – ৩
তৃতীয় পরিচ্ছেদ
(১)
আদিত্য বেহালার এদিকটায় আগে কখনও আসেনি। শঙ্খমালা সেন ফোনে মোটামুটি একটা ডিরেকশন দিয়ে দিয়েছিলেন। ডায়মন্ডহারবার রোডের ওপর ম্যান্টন বাস স্টপে নেমে বাঁদিকে অর্থাৎ পুবদিকে হাঁটা লাগাতে হবে। একটু পরে জেমস লঙ পড়বে। সেটা পেরিয়ে আরও মিনিট তিন-চার হাঁটলে দেখা যাবে রাস্তাটা বাঁদিকে বেঁকে গেছে। সেই বাঁকের মুখে একটা পুকুর। পুকুরের উল্টোদিকে তিনতলা গোলাপি বাড়ি, একতলায় ছাত্রদের কোচিং সেন্টার, বাড়ির গায়ে সুব্রত সেন, শঙ্খমালা সেনের নাম লেখা আছে।
আপিসযাত্রীদের উল্টোমুখো বাস, তেমন ভিড় নেই। বাসে উঠে আদিত্য বসার জায়গা পেয়েছিল। কিন্তু বসে আছে তো বসেই আছে, বাস আর নড়ে না। মেট্রো রেল তৈরি হবার কারণে ডায়মন্ড হারবার রোডটা একেবারে বেহাল হয়ে গেছে। বাসটা ঢিকিয়ে ঢিকিয়ে ম্যান্টন পৌঁছল এগারোটা নাগাদ। ভাগ্যিস আদিত্য হাতে সময় নিয়ে বেরিয়েছিল। শঙ্খমালা সেন কিন্তু ডিরেকশনটা ভালোই দিয়েছিলেন। ডিরেকশন অনুযায়ী মিনিট সাত-আট হাঁটার পরেই পুকুরটা চোখে পড়ল। পুকুর নয়, বেশ বড় একটা দিঘি। হাঁস চরছে। বটগাছের ডাল নেমেছে জলের ওপর। পাঁজরা বার করা রোগা ডিগডিগে কয়েকটা ছেলে ডালের ওপর উঠে দিঘিতে ঝাঁপ দিচ্ছে, সাঁতরে পাড়ে এসে উঠছে আবার, ফের গাছে চড়ে জলে ঝাঁপাচ্ছে, এটাই তাদের খেলা। শঙ্খমালার সঙ্গে দেখা করার কথা সাড়ে এগারোটায়, এখনও খানিকটা সময় বাকি আছে। আদিত্য দিঘির পাড়ে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ ছেলেদের জলকেলি দেখল, একটা সিগারেট খেল, দিঘির চারদিকটা একবার পাক দিল, তারপর সাড়ে এগারোটা বাজার মিনিট পাঁচেক আগে গোলাপি বাড়িটার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। একতলায় অঙ্কের কোচিং ক্লাস চলছে। রাস্তা থেকেই একটা ঢাউস ব্ল্যাক বোর্ড চোখে পড়ে। আদিত্যর দিকে পিছন ফিরে লম্বা ছিপছিপে এক ব্যক্তি চিতা বাঘের ক্ষিপ্রতায় বোর্ডের এ-মুড়ো থেকে ও-মুড়ো অঙ্ক কষে যাচ্ছেন আর ঘরের জনা কুড়ি ছেলেমেয়ে রুদ্ধশ্বাসে সেসব খাতাবন্দি করে রাখছে। ছেলেমেয়েগুলোর কাহিল অবস্থা দেখে আদিত্যর কষ্ট হল। বিশেষ করে একটু দূরে যে ছেলেগুলো মহা আনন্দে জলে ঝাঁপ দিচ্ছে তাদের তুলনায় তো এদের রীতিমতো বন্দি দশা।
আদিত্য জানলার সামনে দাঁড়িয়ে কী করবে ভাবছে এমন সময় মাস্টারমশাই পেছন ফিরলেন। ফিরেই দেখতে পেলেন আদিত্য জানলার কাছে কাঁচুমাচু মুখে দাঁড়িয়ে আছে।
‘কাউকে খুঁজছেন?’
‘হ্যাঁ, শঙ্খমালা সেন কি এখানে থাকেন?’
‘পাশ দিয়ে চলে যান। দেখবেন দোতলায় ওঠার দরজা আছে। ওখানে বেল বাজান।’
সোহিনীর কথা শুনে শঙ্খমালা সম্বন্ধে আদিত্যর মনে একটা ছবি তৈরি হয়েছিল, দেখা গেল তার থেকে বাস্তবের শঙ্খমালা অনেকটাই আলাদা। আদিত্য ধরে নিয়েছিল, কেন ধরে নিয়েছিল সেটা অবশ্য তার নিজের কাছেই পরিষ্কার নয়, শঙ্খমালা হবে খর্বকায়, বলিষ্ঠ, ফরসা। বাস্তবে কিন্তু দেখা গেল যিনি দরজা খুললেন তাঁর উচ্চতা পাঁচ ফুট সাত ইঞ্চির কম হবে না, ছিপছিপে গড়ন, রঙ শ্যামলা। বড় বড় চোখে একটা সারল্য আছে, এক ঝলক দেখে মনে হয় মানুষটা সোজা-সাপটা।
‘নমস্কার। আমার নাম আদিত্য মজুমদার। আমিই আপনাকে ফোন করেছিলাম।’ আদিত্য দুই করতল বুকের ওপর জড়ো করে বলল।
‘বুঝতে পেরেছি। ওপরে আসুন।’
সিঁড়িটা পরিষ্কার, দেখে মনে হয় যত্ন পেয়েছে। কয়েক ধাপ উঠে বড় সিঁড়ি, তার সামনের দেয়ালে তাক, তাকে সৌখিন প্যাঁচা, গণেশ, সাময়িক পত্রপত্রিকা, দুয়েকটা ইংরেজি বেস্ট সেলার।
‘সোহিনী আমাকে আপনার কথা বলেছে। আপনি নাকি চৌধুরি বাড়ি নিয়ে বই লিখছেন।’ শঙ্খমালা সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে বলল।
‘আজ্ঞে হ্যাঁ। সেইজন্যই তো আপনার কাছে আসা।’
দোতলায় উঠেই বসার ঘর। সোফা-কৌচ-সেন্টার টেবিল, এক কোনে একটা টিভি। টিভির ওপর একটা সাত-আট বছরের ছেলের ফ্রেমে বাঁধানো ফটোগ্রাফ। সব মিলিয়ে স্বচ্ছল মধ্যবিত্ত বাড়ির মডেল চিত্র। আদিত্য একটা কৌচে বসল।
‘চা খাবেন তো।’ উল্টোদিকের সোফাটায় বসতে গিয়েও শঙ্খমালা উঠে দাঁড়াল, সম্ভবত আদিত্যর জন্য চায়ের জোগাড় করতে যাবে বলে।
‘একটু চা খেতে পারি, দুধ চিনি ছাড়া। কিন্তু আপনাকে অযথা ব্যস্ত করতে চাই না।’ আদিত্য কুণ্ঠিতভাবে বলল।
‘একটু চা খাবেন তাতে ব্যস্ত হবার কী আছে?’
কিছুক্ষণ পরে চায়ে প্রথম চুমুকটা দিয়ে আদিত্য বলল, ‘আমি যে বইটা লেখার কথা ভাবছি সেটা আসলে শিল্পপতি সুবীর চৌধুরির একটা বায়োগ্রাফি। বাংলায় লিখব। বাংলায় ভালো বায়োগ্রাফির বেশ অভাব। সেই ফাঁকটাতে ঢুকে কিছু কাজ করার সুযোগ আছে। আপনি তো জানেন, একটা ইন্টারেস্টিং বায়ো-র মধ্যে কিছু কিছু উপন্যাসের এলিমেন্ট থাকে। বিশেষ করে যাঁর জীবনী লিখছি তাঁর চরিত্রটা খুব সাবধানে ডেভেলপ করতে হয়। এখানে কিছুটা কল্পনার আশ্রয় তো নিতেই হবে, কিন্তু যতটা বাস্তবের কাছাকাছি থাকা যায় তত ভাল। সেই জন্যই আপনার কাছে আসা। আপনি নিশ্চয় আপনার বাবাকে খুব কাছ থেকে দেখেছিলেন। আপনার ইম্প্রেশনটা তাই খুব মূল্যবান। শুধু সুবীর চৌধুরি নন, বাড়ির অন্যান্যদের সম্বন্ধেও আপনার ধারণাগুলো আমার খুব কাজে লাগবে। তাছাড়া আপনি নিজেও তো আমার বই-এর একটা চরিত্র।
‘বইটা কি আপনি নিজের থেকেই লিখছেন, নাকি চৌধুরি এন্টারপ্রাইজ থেকে কমিশন করেছে?’
আদিত্য প্রশ্নটার জন্য প্রস্তুত ছিল, তবে ভাবেনি সেটা শঙ্খমালার কাছ থেকে আসবে। সোহিনী শঙ্খমালার যেরকম বর্ণনা দিয়েছিল তাতে একটা ফুর্তিবাজ, হালকা চরিত্রের মহিলার ছবি চোখের সামনে ভেসে ওঠে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে শঙ্খমালা সেন বেশ সজাগ মানুষ। আদিত্য মুখে বলল, ‘বইটা লেখার জন্য স্বয়ং মন্দাকিনী চৌধুরি আমাকে অনুরোধ করেছেন।’
‘তাই নাকি?’
আদিত্য লক্ষ করল এক মুহূর্তের জন্য একটা অকৃত্রিম বিস্ময় শঙ্খমালার মুখে খেলে গেল। আদিত্য নিজেকে আর একটু বিশ্বাসযোগ্য করবার জন্য বলল, ‘আমি বেশ কিছুদিন একটা বাংলা দৈনিকের বিজনেস ডেস্কে কাজ করেছি। হালে চাকরি ছেড়ে দিয়ে ফ্রিলান্স করছি। এটা আমার কার্ড।’
আদিত্য পকেট থেকে ভিজিটিং কার্ডের বান্ডিলটা বার করে শঙ্খমালার দিকে একটা এগিয়ে দিল। তারপর বলল, ‘আপনার আপত্তি না থাকলে আপনার ইন্টারভিউটা টেপ করব। লেখার সময় আমার খুব কাজে লাগবে।’
‘করুন। আপত্তি নেই।’
আদিত্য পকেট থেকে মোবাইল বার করল। মোবাইলে অডিও রেকর্ডারটা চালু করে টেবিলে রাখল। তারপর শঙ্খমালাকে তার প্রথম প্রশ্নটা করল, ‘আপনার বাবাকে আপনি কীভাবে ডেস্ক্রাইব করবেন? মানে, ঠিক মূল্যায়ন নয়, তাঁর চরিত্রের খুঁটিনাটি দিকগুলোর কথা জানতে চাইছি। বিশেষ করে যদি কোনও ইডিওসিনক্রেসিস থাকে সেগুলো জানতে চাই।’
শঙ্খমালা খানিক ভাবল। চায়ের কাপে শেষ চুমুকটা দিয়ে বলল,
‘জানি না কীভাবে শুরু করব। আমার বাবা সুবীর চৌধুরি খুবই ব্যস্ত মানুষ ছিলেন। আমার কাছে খানিকটা দূরের মানুষও ছিলেন। ব্যবসার কাজে বাবাকে মাসে অন্তত পনেরো দিন কলকাতার বাইরে থাকতে হত। যখন কলকাতায় থাকতেন তখনও বাড়িতে আর কতটুকু থাকতেন? আমার মা যখন মারা যান তখন আমার দু’বছর চার মাস বয়েস। কাজেই মাকে আমার মনে নেই বললেই চলে। চৌধুরি বাড়ির পুরোনো কর্মচারীরা বলে, মা বেঁচে থাকতে বাবা অনেক হাসিখুশি মানুষ ছিলেন। মার অকালমৃত্যু বাবার চরিত্রটাকেই পালটে দেয়।’
‘সুবীর চৌধুরি কি খুব গম্ভীর মানুষ ছিলেন?’
‘ঠিক গম্ভীর নয়, বাবা সর্বদা একটা বিষণ্ণতায় ভুগতেন। দেখুন, অ্যাজ এ বিজনেস পারসোন্যালিটি হি ওয়াজ এ গ্রেট সাকসেস। কিন্তু কেন জানি না, সব সময়েই তাঁকে অতৃপ্ত মনে হত। মনে হতো, হি ওয়াজ নেভার স্যাটিসফায়েড উইথ হিমসেলফ।’
‘এই বিষণ্ণতাটা কি তাঁর দ্বিতীয় বিবাহের পর কমেছিল?’
‘কমেনি, মোটেই কমেনি, বরং বেড়েছিল।’
‘সুবীর চৌধুরির কি একটু ভাবপ্রবণ ছিলেন? তাঁর কি মাঝে মাঝে ইমোশানাল আউটবার্স হত?’
‘ঠিক উল্টো। হি ওয়াজ পোকার-ফেসড। তাঁর মুখে সব সময় একটা বিষণ্ণতা লেগে থাকত বটে, কিন্তু তাঁর মুখ দেখে বোঝা যেত না তিনি রেগে আছেন না তুষ্ট আছেন, চিন্তায় আছেন না নিশ্চিন্ত আছেন, ক্লান্ত আছেন না চনমনে আছেন। তাছাড়া তিনি কথাও খুব বেশি বলতেন না।’
সিঁড়িতে পায়ের শব্দ শোনা গেল, কেউ উঠে আসছে। একটু পরেই যিনি ঘরে এসে ঢুকলেন তিনিই এতক্ষণ নীচে ছাত্র পড়াচ্ছিলেন। আদিত্য আন্দাজে বুঝে নিল ইনিই গৃহকর্তা।
‘আমার স্বামী সুব্রত, ‘ শঙ্খমালা আলাপ করিয়ে দিল, ‘সুব্রত ঠাকুরপুকুরের কাছে রামকৃষ্ণ কলেজে অঙ্ক পড়ায়। আর সুব্রত, ইনি আদিত্য মজুমদার, জার্নালিস্ট, বাবার ওপর একটা বই লিখছেন।’
সুব্রত স্ত্রীর পাশে, সোফায় বসল। বলল, ‘মালা বলছিল আপনি আসবেন। বোধহয় সোহিনী ফোন করেছিল। চা খেয়েছেন?’
‘খেয়েছি। আপনিও থাকুন না। আপনার কাছ থেকেও অনেক কথা জানার আছে।’
‘থাকছি তো। আর একটু চা খান। আমি এই সময় একটু খাই। ছাত্র ঠেঙিয়ে গলাটা একেবারে ধরে যায়। নিশ্চয় ভাবছেন, কলেজে না গিয়ে বাড়িতে টিউশানি করছে, এ কেমন লোক। তাই বলি, আমার হল ইভিনিং কলেজ। ছটা থেকে শুরু।’
একটু পরে আবার চা এল। সুব্রত সেন অনর্গল কথা বলে যাচ্ছে। তার কলেজের কথা, এই পাড়াটার কথা, রাজনীতি, ক্রিকেট, বাড়ি-জমির দাম। আদিত্য ক্রমশই অস্বস্তি বোধ করছিল। একসময় অডিও রেকর্ডারটাও বন্ধ করে দিল। আদিত্য খেয়াল করল, সুব্রত সেন লোকটা কিন্তু বেশ সুপুরুষ। চৌকো মুখ, তীক্ষ্ন নাক, লম্বা, ছিপছিপে, রগের চুলে পাক ধরেছে। শুধু বড্ড বেশি কথা বলে। তার মনে পড়ে গেল, সোহিনী সুব্রত সেন সম্বন্ধে বলেছিল ‘নিরীহ কিন্তু নির্লোভ নয়।’ কেন বলেছিল কে জানে। আদিত্য মরিয়া হয়ে পুরোনো প্রসঙ্গে ফিরতে চাইল, ‘আমি আপনাদের খুব বেশি সময় নেব না। আমার কয়েকটা মাত্র প্রশ্ন আছে। দুটো প্রশ্ন, দুটো বড় ঘটনা ঘিরে। প্রথম ঘটনা, সুবীর চৌধুরির দ্বিতীয় বিবাহ। প্রশ্ন, আপনার বাবার দ্বিতীয় বিয়েটা আপনারা, মানে আপনি এবং আপনার দাদা কীভাবে নিয়েছিলেন? প্রশ্নটা কি খুব ব্যক্তিগত হয়ে গেল?’
শঙ্খমালা কিছু বলার আগেই সুব্রত বলে উঠল, ‘না, না, ব্যক্তিগত কীসের। সুবীর চৌধুরিকে নিয়ে বই লিখতে গেলে এই প্রসঙ্গটা তো বাদ দিলে চলবে না। আমি মালার হয়ে উত্তরটা দিচ্ছি। মালার দাদার কথা জানি না, তার সঙ্গে আমার কোনও দিনই তেমন একটা পটেনি, কিন্তু বাবা দ্বিতীয়বার বিয়ে করার পর মালাকে একেবারে ভেঙে পড়তে দেখেছি।’
‘একটু খুলে বলবেন?’ অডিও রেকর্ডারটা ফের চালিয়ে দিয়ে আদিত্য বলল।
‘দেখুন, সুবীর চৌধুরি যখন দ্বিতীয়বার বিয়ে করলেন তখন বছর পাঁচেক হয়ে গেছে আমি মালাকে পড়াচ্ছি। মূলত অঙ্ক পড়াই, পাশাপাশি অন্য সায়েন্স সাবজেক্ট, মানে ফিজিক্স-কেমিস্ট্রিগুলোও একটু দেখিয়ে দিই। মালার পড়াশোনায় মন নেই, আমার কাছে নানারকম গল্প করে, সারাদিন বাড়িতে কী হল, ফিজিকাল ইন্সট্রাক্টার কী কী নতুন এক্সারসাইজ দিয়েছে, নতুন কী সিনেমা আসছে, এইসব। জানেন তো স্কুলে পড়ার সময় মালা খুব ভাল অ্যাথলিট ছিল। ব্যাডমিন্টন খেলত। বেশ কয়েকবার স্টেট খেলেছে।’
‘হ্যাঁ, শুনেছি।’
আদিত্য লক্ষ করল স্বামী কথা বলতে শুরু করার সঙ্গে সঙ্গে মালা একদম চুপ করে গেছে।
‘আমারও তখন বুঝলেন অল্প বয়েস, সদ্য এম এসসি পাশ করে একটা স্কুলে পড়াচ্ছি। একটু একটু করে মালার সঙ্গে ইমোশানালি জড়িয়ে পড়লাম। কী গো, ঠিক বলছি তো?’
শেষের প্রশ্নটা, বলাই বাহুল্য স্ত্রীর উদ্দেশে। শঙ্খমালা ক্রমশ রক্তিম হচ্ছে, অস্বস্তি কাটানোর জন্য প্রসঙ্গ পালটাতে চাইল,
‘বাবা দ্বিতীয়বার বিয়ে করবে আগে থেকেই টের পাচ্ছিলাম। দু’একবার মামকে নিয়ে বাড়িতে এল। আমার আর দাদার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল। মন্দাকিনী চৌধুরিকে, তখনও অবশ্য চৌধুরি হয়নি, ম্যাম বলতাম। ম্যাম থেকে মাম। কিছুদিন পর গসিপ কলমগুলো সুবীর চৌধুরির সম্ভাব্য অ্যাফেয়ারের কেচ্ছায় ভরে গেল। বাবার সঙ্গে মামের প্রচুর ছবি ছাপা হতে লাগল। স্কুলে মুখ দেখাতে পারি না। কী অপমান!’
শঙ্খমালার ঠোঁটদুটো থরথর করে কাঁপছে। ঘরের আবহাওয়া রীতিমতো ভারি হয়ে উঠেছে। এমনকি বাচাল সুব্রতও চুপ করে আছে। আদিত্য জিজ্ঞেস করল, ‘সুবীর চৌধুরির দ্বিতীয় বিয়েটা তো কলকাতাতেই হয়েছিল। আমি পুরোনো খবর কাগজের ক্লিপগুলো সংগ্রহ করেছি। দু’একটা ফটোগ্রাফও।’
‘হ্যাঁ। ব্যারাকপুরের কাছে গঙ্গার ধারে চৌধুরিদের একটা পুরোনো বাগানবাড়ি আছে। সেটা সারানো হল। সেখানেই এলাহি ব্যবস্থা। দেশ-বিদেশ থেকে অতিথি এসেছিল। তবে আমি আর দাদা যাইনি।’
‘সেদিন সারা সন্ধেটা মালা আমার সঙ্গে পড়ার ঘরে বসেছিল। সারা সন্ধেটা ধরে মালা শুধু কেঁদেই গেল। বলতে গেলে সেই সন্ধেবেলাতেই ঠিক করলাম মালাকে নিয়ে এই চৌধুরি বাড়ি থেকে পালাতে হবে।’ সুব্রত প্রায় ফিসফিস করে বলল।
দ্বিতীয় ঘটনা, বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে আপনাদের বিয়ে। আপনাদের বিয়েটা সুবীর চৌধুরি কীভাবে নিয়েছিলেন?’
‘ভালভাবে নেননি, মোটেই ভালভাবে নেননি।’ সুব্রত কিছু বলার আগেই শঙ্খমালা প্রায় চিৎকার করে উঠল, ‘অ্যান্ড আই থিঙ্ক ইট ওয়াজ ভেরি ভেরি আনফেয়ার। ওঁর টাকাপয়সা ছিল বলে উনি যাকে খুশি যখন খুশি বিয়ে করতে পারবেন, কিন্তু ছেলেমেয়েরা ওঁর ওপর ডিপেন্ডেন্ট তাই তাদের নিজস্ব পছন্দের কোনও দাম নেই। এটা তো আটারলি অটোক্র্যাটিক।’
সুব্রত শান্তস্বরে বলল, ‘আমাদের বিয়ে নিয়ে কোনও আইনি ঝামেলা ছিল না। বিয়ের সময় আমরা দুজনেই অ্যাডাল্ট হয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু বিয়েটা সুবীর চৌধুরির ইগোতে আঘাত করেছিল। ফলে বিয়ের পর বেশ কিছুদিন আমাদের চৌধুরি বাড়িতে ঢোকা নিষেধ হয়ে গেল। সত্যি কথা বলতে কি, আমরা ঢুকতেও চাইনি। প্রথমে কিছুদিন বেহালাতেই একটা ভাড়া বাড়িতে রইলাম। আপনাকে বলতে বাধা নেই, প্রথম কয়েক বছর একটু টানাটানিতেই কেটেছিল, কিন্তু মনে সুখের অভাব ছিল না। তারপর কলেজের চাকরিটা পেলাম। মাইনে-পত্তর বাড়ল। একটু একটু করে এই বাড়িটা করলাম। আরও অনেক পরে মাম-এর মধ্যস্থতায় এবং কিছুটা পীড়াপীড়িতে সুবীর চৌধুরির সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের খানিকটা উন্নতি হয়। আমরা আবার চৌধুরি বাড়িতে যেতে শুরু করি। এখনও যাই, তবে কালেভদ্রে।’
শঙ্খমালা নিজেকে খানিকটা সামলে নিয়েছে। বলল, ‘আমি বাবার ভীষণ ক্লোজ ছিলাম। কোনও দিন ভাবিনি বাবা আবার বিয়ে করতে পারে। বাবার দ্বিতীয় বিয়েটা আমার কাছে একটা বিরাট ডিসাপয়েন্টমেন্ট। ওই সময় সুব্রত না থাকলে আমি বোধহয় পাগল হয়ে যেতাম। এসব কথা আপনি আপনার বইতে পরিষ্কার করে লিখে দিতে পারেন।’
‘মন্দাকিনী চৌধুরির সঙ্গে আপনাদের সম্পর্কটা কেমন?’ আদিত্য জিজ্ঞেস করল।
‘ভাল সম্পর্ক। সোহিনীকেও আমাদের ভাল লাগে।’ সুব্রত সহজ স্বরে বলল। হয়তো সে আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল, তাকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে শঙ্খমালা বলে উঠল,
‘আমি কিন্তু মামকে পুরোপুরি বিশ্বাস করি না। শি ইজ টূকুল অ্যান্ড ক্যালকুলেটিং টু ট্রাস্ট। এনজয়েস পাওয়ার অ্যান্ড মানি। এটা অবশ্য অফ দ্য রেকর্ড বললাম। লিখবেন না।’
‘আমার শেষ প্রশ্ন। আপনার দাদার ব্যাপারে আপনার কী ধারণা?’
সুব্রত কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, তাকে ইশারায় চুপ করতে বলে শঙ্খমালা কিছুক্ষণ ভাবল। তারপর থেমে থেমে বলল, ‘দাদা ওয়াজ মামিজ পেট। মা মারা যাবার পর দাদা একেবারে শ্যাটারড হয়ে যায়। তখন ওর খুব সংবেদনশীল বয়েস। বাবা যদি ওকে আর একটু সময় দিত তাহলে হয়তো ও এতটা বিপথে যেত না।’
আদিত্য ঘড়ি দেখল। একটা বেজে গেছে। আর এখানে থাকাটা ঠিক নয়। এদের খাওয়া-দাওয়া আছে। তার নিজেরও খিদে পেয়েছে। আর দেরি করলে মেসে ফিরে খাবার পাবে না। সে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আপনাদের দুজনকেই অনেক অনেক ধন্যবাদ। আমার আর কিছু জানার হলে ফোন করব। আজ চলি।’
ফেরার পথে বাসে বসে আদিত্য ভাবছিল, শঙ্খমালা মন্দাকিনী চৌধুরিকে কুল অ্যান্ড ক্যালকুলেটিং বলল কেন? সোহিনীই বা সুব্রত সেনকে নির্লোভ নয় মনে করে কেন? সাধারণত এই ধরনের ইম্প্রেশনের পেছনে কোনও ঘটনা থাকে। ঘটনাগুলো জানা দরকার।
(২)
সাতসকালে বিমল এসে হাজির। আদিত্যর চোখে তখনও রাজ্যের ঘুম লেগে আছে।
‘শেয়ালদায় ট্রেন ধরতে যাচ্ছিলাম স্যার, ভাবলাম দেখা করে যাই। বনগা লাইনের গোবরডাঙায় বউ-এর বাপের বাড়ি। এক হপ্তা হল বউ রাগ করে বাপের বাড়ি গিয়ে বসে আছে। এখন রাগ পড়েছে, তাই আনতে যাচ্ছি।’
‘সে নয় হল। কিন্তু এই ক’দিনে কাজ কিছু এগিয়েছে? যার হদিশ করতে বলেছিলাম তার হদিশ করতে পেরেছ?’
‘পেরেছি বলেই তো দেখা করতে এলাম স্যার। ভাবলাম টেলিফোনে খবরটা না দিয়ে মুখোমুখি গিয়ে বলে আসি। এদিক দিয়ে তো যেতেই হচ্ছে।’
‘তুমি একটু বোসো, আমি মুখটা ধুয়ে আসি। আচ্ছা এক কাজ করো। দোতলায় খাবার ঘরে বলরাম আছে। ওকে এই টাকাটা দিয়ে চা আর গোটা চারেক বিস্কুট আনতে বলো।’
আদিত্য দেয়ালে ঝোলানো শার্টের পকেট থেকে একটা কুড়ি টাকার নোট বিমলের হাতে দিয়ে বাথরুমে ঢুকল। মিনিট পনেরো পরে চায়ে সশব্দে একটা চুমুক দিয়ে বিমল বলতে শুরু করল, ‘যার খোঁজে পাঠিয়েছিলেন স্যার সেই শঙ্খদীপ চৌধুরি একেবারে থার্ডক্লাশ একটা লোক। আপনি যে ছবিটা দেখিয়েছিলেন সেটা ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের একটা বারের ছবি। যেমন থার্ডক্লাশ লোক, তেমনি থার্ডক্লাশ জায়গা। হেন কুকাজ নেই সেখানে হয় না। রাত্তিরে খারাপ মেয়েদের নাচ হয়, দু’চার পয়সা খরচা করলেই সেইসব বস্তাপচা মেয়েদের সারা রাত্তিরের জন্য পাওয়া যায়। তাছাড়া গাঁজা, হেরোইন, ব্রাউন সুগার না কীসব যেন বলে, সমস্ত নেশার জিনিস পয়সা ফেললেই সেখানে সঙ্গে সঙ্গে হাজির হয়ে যাবে। এরকম নরক আগে কখনও দেখিনি স্যার। আমার ভয় করছিল, ওখান থেকে বেরুচ্ছি চেনাশোনা কেউ দেখে ফেললে আর ভদ্র সমাজে মুখ দেখানো যাবে না। শঙ্খদীপবাবুর খোঁজে তিন-চার বার ওখানে যেতে হয়েছিল।
‘মোবাইলে শঙ্খদীপবাবুর ছবিটা দেখাতে অনেকেই চিনতে পারল। বলল, এ তো শঙ্কুবাবু। জানতে পারলাম শঙ্কুবাবু এখানে রেগুলার আসতেন। কিন্তু মাসখানেক হল তিনি আর ওখানে আসছেন না। এক পুরোনো নেশাখোরের সঙ্গে ভাব জমালাম। নাম বলল পিটার, বাঙালি খ্রিস্টান। আপনি তো জানেন স্যার আমি নেশাভাঙ করি না। সারা দিনে শুধু ওই দশ-বারো কাপ চা। বউ বলাতে বিড়ির নেশাটাও ছেড়ে দিয়েছি। কিন্তু কথা বার করার জন্য ওই নেশুড়েটাকে কয়েক পাত্তর খাওয়াতেই হল। সে ব্যাটাচ্ছেলে কয়েক পাত্তর খাবার পর কীসব পাতা-টাতা গরম করে শুঁকলো। তারপর নেশা একটু চড়তে আমাকে বলল, শঙ্কুবাবুকে খুঁজছ কেন? বললাম, শঙ্কুবাবু আমার কাছে টাকা ধার করেছে, সেই টাকার তাগাদায় এসেছি। সে বলল, কত টাকা? আমি বললাম, সব মিলিয়ে তা প্রায় হাজার দশেক হবে। সে বলল, তোমার মতো আতা-ক্যালানে বাপের জন্মে দেখিনি। শঙ্কুবাবুকে অত টাকা দিয়েছ কেন? ও টাকা জীবনে ফেরত পাবে না। আমি বললাম,শঙ্কুবাবু আমার বাপ-মা মরা ভাইজিটাকে বিয়ে করবে বলেছিল। আর বলেছিল, ব্যবসার জন্য কিছু টাকা ধার চাই। আমার কথা শুনে নেশুড়েটার হাসতে হাসতে বিষম লাগার জোগাড়।’
বিমল একটু থামল। কেটলিতে কিছুটা চা অবশিষ্ট ছিল, উঠে গিয়ে দুটো ভাঁড়ে ঢালল। বলল, ‘একটু ঠান্ডা হয়ে গেছে স্যার।’
‘ও কিছু হবে না। তারপর কী হল বল।’ আদিত্য ঠান্ডা চা-টা এক ঢোঁকে গিলে নিয়ে সিগারেট ধরাল।
‘নেশুড়েটা জাতে মাতাল, তালে ঠিক। কিছুতেই বলবে না কোথায় গেলে শঙ্কুবাবুকে পাওয়া যাবে। আরও কয়েক পাত্তর খাওয়াতে হল। অনেক ধানাই-পানাই করে শেষে বলল, মাস খানেক আগে মাইকেলের সঙ্গে শঙ্কুবাবুর ঝামেলা হয়ে গেছে। জিজ্ঞেস করলাম, মাইকেল কে? সে বলল, মাইকেল কে জানো না? মাইকেল এই অঞ্চলের দাদা, এই বারটাকে সে-ই তো আগলে রাখে। কিছুদিন ধরেই বারে শঙ্কুবাবুর টাকা বাকি পড়ছিল। সেদিন মালিকের হয়ে মাইকেল এসে টাকা চাইল। শঙ্কুবাবু তখন নেশায় টং। মাইকেলকে বলল, এই কটা টাকার জন্য আমাকে সবার সামনে অপমান করছিস? জানিস আমি কত বড় বাড়ির ছেলে? মাইকেল বলল, বাতেলা অনেক হয়েছে, এবার টাকা ছাড়। শুনে শঙ্কুবাবুর কী দুর্মতি হল, মাইকেলের নাকে একটা ঘুষি বসিয়ে দিল। তারপর পুরো ঢিসুম ঢিসুম বলিউড। মাইকেল শঙ্কুবাবুকে ভাল করে পেটাই করল। পেটাই করতে গিয়ে কয়েকটা চেয়ার ভাঙল। কয়েকটা গেলাস আর বোতলও ভাঙল। ঠিক যেমন হিন্দি সিনেমায় হয় আর কি। আমরা তো একপাশে সরে গিয়ে সিনেমা দেখছি। হঠাৎ কোথা থেকে মার্থা ছুটে এসে শঙ্কুবাবুকে আড়াল করে দাঁড়াল। সেদিন মার্থা না থাকলে মাইকেল বোধহয় শঙ্কুবাবুকে মেরেই ফেলত। মার্থা মাইকেলকে অনেক কাকুতিমিনতি করল। বলল, শঙ্কুবাবুর সব টাকা সে নিজে মিটিয়ে দেবে। তারপর প্রায় অচৈতন্য শঙ্কুবাবুকে রিক্সায় তুলে নিয়ে বাড়ি চলে গেল। শুনেছি শঙ্কুবাবু সেই থেকে মার্থার বাড়িতেই আছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, মার্থাটা আবার কে? নেশুড়েটা বলল, মার্থা আগে এই বারে নাচত। এখন বুড়ি হয়ে গেছে বলে ওকে আর নাচতে ডাকে না। খদ্দেরের আশায় এখানে রোজ সন্ধেবেলা আসে। কিন্তু খদ্দেরও খুব একটা হয় না। শঙ্কুবাবুর সঙ্গে মার্থার জোরদার ইস্ক চলছে।’
‘মার্থার ঠিকানাটা জোগাড় করেছ?’
‘করেছি স্যার। এলিয়ট রোডের একটা ঠিকানা। বলল, বাড়ির নিচে বিরিয়ানির দোকান আছে। সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে ডানদিকের দ্বিতীয় দরজা।’ বিমল ঠিকানা লেখা একটা চিরকুট আদিত্যর হাতে দিল। তারপর কুণ্ঠিতভাবে বলল, ‘একটা কথা বলব স্যার?’
‘বল। কী কথা?’
‘নেশুড়ে পিটারকে মাল খাওয়াতে আমার ষোলোশো পঁচাত্তর টাকা খরচ হয়ে গেছে স্যার। টাকাটা কি পার্টির কাছ থেকে পাওয়া যাবে? আমি বিল করে এনেছি।’
‘কেন পাওয়া যাবে না? অবশ্যই পাওয়া যাবে। দাঁড়াও আজই টাকাটা নিয়ে যাও। আর বিলটা দিয়ে যাও।’
‘একটা সমস্যা আছে স্যার। বিল হয়েছিল সাড়ে ষোলোশো, সেটাই বিলে লেখা আছে। তার ওপর পঁচিশ টাকা বকশিস দিতে হল স্যার। ওটা কোথাও লেখা নেই।’
‘ওসব নিয়ে তোমায় ভাবতে হবে না। তুমি পুরো ষোলোশো পঁচাত্তরই নাও। আমি হিসেব দেবার সময় মক্কেলকে বুঝিয়ে বলে দেব।’
‘আপনি স্যার দেবতা। আমার ওপর আর কী হুকুম আছে স্যার?’
‘আপাতত কিছু নেই। তবে শিগগিরই তোমার দরকার পড়বে। তোমাকে তখন ফোন করব। এখন তুমি ট্রেন ধরার জন্য দৌড়োও।’
টাকাগুলো ভেতরের পকেটে পুরে নিয়ে বিমল উঠে দাঁড়াল।
(৩)
আদিত্যর একটু নার্ভাস লাগছিল। বিমল চলে যাবার পর সে ঠিক করল আজই শঙ্খদীপ চৌধুরির সঙ্গে দেখা করার ব্যাপারটা চুকিয়ে ফেলবে। এইটুকু কাজ করার জন্য নার্ভাস লাগার কথা নয়, কিন্তু এলিয়ট রোডে মার্থা নামক রমণীর ডেরায় যেতে হবে ভেবে তার সব উৎসাহ নিবে যাচ্ছিল। সে ভেবে দেখল, এই সব মহিলার কাছে দুপুর-দুপুর যাওয়াটাই ভালো। সন্ধের আগেই যাতে ওই সব পাড়া থেকে বেরিয়ে আসতে পারে।
কলেজ স্ট্রিট থেকে ট্রামে এসপ্ল্যানেড। এসপ্ল্যানেডের গুমটিতে নেমে আদিত্য দেখল ট্রাম কম্পানির ঘড়িতে একটা বেজে গেছে। কয়েকদিন আগেও বেশ ঠান্ডা ছিল। এখন একটু একটু করে গরম পড়তে শুরু করেছে। আদিত্য কিছুক্ষণ এলিয়ট রোড-গামী ট্রামের খোঁজে এদিক-ওদিক করল, তারপর হতাশ হয়ে ঠিক করল এটুকু পথ হেঁটেই মেরে দেবে।
রাস্তার ওপারে জনস্রোত। গ্র্যান্ড হোটেলের নীচে ফুটপাথের দোকানগুলোতে এখনও গরম জামার পসরা সাজানো রয়েছে। সোয়েটার, কোট, আলোয়ান, মেয়েদের গরম চাদর, এমনকি কয়েক জোড়া দস্তানাও চোখে পড়ল। লোকে তাই ভিড় করে কিনছে। এখন কেন কিনছে কে জানে? শীত তো শেষ হয়ে এল। হয়ত পরের বছর পরবে বলে কিনে রাখছে। কিংবা হয়ত এরা মফস্বল থেকে এসেছে, সেখানে শীত এখনও চলে যায়নি। এইসব আবোলতাবোল ভাবতে ভাবতে ভিড় ঠেলে লিন্ডসে স্ট্রিটের মোড় অব্দি এগিয়েছে এমন সময় পিঠে একটা স্পর্শ পেয়ে ঘুরে দাঁড়াল আদিত্য। এক ঝলক তাকিয়েই চমকে উঠল, ‘আরে, আরে, স্যমন্তক যে। কতদিন পরে।’
স্যমন্তক রুদ্র আদিত্যর সঙ্গে ইস্কুলে পড়ত। বেশ বন্ধু ছিল, ক্লাস এইট অব্দি দু’জন পাশাপাশি বসত। তারপর আদিত্য সায়েন্স আর স্যমন্তক কমার্স নেওয়ায় সেকশন আলাদা হয়ে গেল।
‘তোকে কতক্ষণ থেকে ডাকছি। শুনতেই পাস না। আমাকে পেরিয়ে চলে গেলি।’
‘যা ভিড় আর হট্টগোল, শুনব কী করে?’
তারা দুজন রাস্তার একপাশে এসে দাঁড়িয়েছে, কিন্তু চলমান ভিড়ের ঠেলায় এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকা অসম্ভব।
‘চল কোথাও গিয়ে বসি। এখানে দাঁড়ানো যাবে না।’ স্যমন্তক বলল।
তারা দু’জন লিন্ডসে স্ট্রিট ধরে কিছু দূর হেঁটে গ্লোব সিনেমার পাশের গলিটায় বাঁক নিল। ওখানে একটা পাঞ্জাবি ধাবা আছে। ভেবেছিল বসা যাবে। গিয়ে দেখে সেখানে মধ্যাহ্ন ভোজনের ভিড়। ভেতরটা ভর্তি। কিছু লোক বাইরের বেঞ্চিতে বসেও দুপুরের খাওয়া সারছে। আরও খানিকটা এগিয়ে একটা চায়ের দোকান চোখে পড়ল। ফাঁকাই রয়েছে। এখানে মনে হয় কিছুক্ষণ বসতে দেবে।
‘কতদিন পরে দেখা। বছর পঁচিশ হবে বোধহয়। কী করিস আজকাল?’ স্যমন্তক চায়ের কাপে চুমুক লাগিয়ে বলল।
আদিত্য সরাসরি উত্তর দিল না। বলল, ‘তোর কথা আগে বল। তুই তো শুনি এখন ফুল টাইম নাটকের লোক। মাঝে মাঝে সিরিয়ালেও নাকি তোকে দেখা যায়। আমার অবশ্য নাটকও দেখা হয় না টিভিও দেখা হয় না। লোকের মুখেই তোর কথা শুনি।’
স্যমন্তক সিগারেট বার করল। আদিত্যকে একটা দিয়ে নিজেরটা এবং আদিত্যরটা ধরাল। তারপর একটা সুখটান দিয়ে বলল,
‘আমি তো স্কুল ছাড়ার পরে সেন্ট জেভিয়ার্সে কমার্স পড়লাম। তারপর বাবার ইচ্ছে অনুযায়ী চাটার্ড পড়তে শুরু করলাম। আর্টিকল ক্লার্ক হয়ে বিবাদী বাগের একটা আপিসে ঢুকলাম। চাটার্ডের কয়েকটা গ্রুপ পাশও করে গেলাম। পাশাপাশি অবশ্য তখন পুরোদমে নাটক চলছে। বাবার খুব ইচ্ছে তাড়াতাড়ি চাটার্ড পাশ করে সংসারের হাল ধরি। আমার ইচ্ছে সব ছেড়ে দিয়ে ফুল টাইম নাটকে চলে যাই। একটা সময় মনে হল এবার ডিসিশন একটা নিতেই হবে। কী করব? দশটা পাঁচটা আপিস, নাকি গ্রুপ থিয়েটার? ঠিক করে ফেললাম নাটকই করব। জীবন একটা বই দুটো তো নয়। নাটক ছেড়ে দিলে পরে আফশোস করতে হবে। বাবাকে বললাম। বাবা দুবছর আমার সঙ্গে কথা বলেনি।’
‘তুই যেটা করেছিস সেটা করতে কলজের জোর লাগে। ক’জন পারে এরকম ডিসিশন নিতে?’
‘হ্যাঁ, মানছি ফুল টাইম নাটক করতে সাহস লাগে। তবে কী জানিস, ইকনমিক স্টেবিলিটি বলতে যেটা বোঝায় সেটা এখনও এল না। অথচ আজকাল আমাদের নাটক মোটের ওপর মন্দ চলে না। কিন্তু এটা চলছে বলেই যে পরেরটা চলবে তার তো কোনও স্থিরতা নেই। তাই মাঝে মাঝে সিরিয়ালও করতে হয়। সেটা একেবারে উঞ্ছবৃত্তি। কী করব? গত বছর বিয়ে করেছি। একটা দায়িত্ব তো আছে। আমার বউ অবশ্য আমাদের দলেরই মেয়ে। খুব সাপোর্টিভ। একদিন বাড়িতে আয় না।’
‘আবশ্যই যাব। তোর মোবাইল নম্বরটা দে।’
‘তোর নম্বরটা বল। আমি একটা মিসড কল দিচ্ছি। তুই সেভ করে নিস। কিন্তু আমি তো কেবল একতরফা আমার কথাই বলে গেলাম। এবার তোর কথা বল।’
দুজনে দুজনের নম্বর সেভ করার পর আদিত্য একটু বিষণ্ণ গলায় বলল,
‘তোর মতো আমার জীবনেও এখনও ইকনমিক স্টেবিলিটি আসেনি। তবে একটা বড় তফাত আছে। তুই একটা ক্রিয়েটিভ কিছু করবি বলে নিজের ইচ্ছায় ইকনমিক স্টেবিলিটি স্যাক্রিফাইস করেছিস। আর আমি এখন পর্যন্ত তেমন কিছুই করে উঠতে পারলাম না। কলেজ থেকে বেরোবার আগেই বাবা মারা গেল। মা তো আমার ছোটবেলাতেই চলে গিয়েছিল। বাবা মারা যাবার পর দেখলাম চারদিকে আমাদের প্রচুর ধার। সেই ধার শোধ করতেই যেটুকু বিষয় সম্পত্তি ছিল, বিক্রি হয়ে গেল। তারপর নানা কিছু চেষ্টা করেছি। যাদুকরের সাকরেদি থেকে প্রাইমারি ইস্কুলের মাস্টারি। কোনওটাতেই মন টিকল না। তবে গত কয়েক বছর ধরে যে কাজটা করছি তার প্রতি এখন পর্যন্ত বিতৃষ্ণা জন্মায়নি। বলতে কি, মাঝেমধ্যে এই কাজটাকে বেশ ভালই লাগে। অবশ্য কাজটা কী শুনলে তুই আঁতকে উঠবি।’
‘কী কাজ? পলিটিকাল নেতাগিরি?’
‘আরে না, না। নেতা হবার মতো এলেম আমার নেই। আমি গত কয়েক বছর ধরে প্রাইভেট ডিটেকটিভ-এর কাজ করছি।’
‘প্রাইভেট ডিটেকটিভ! বলিস কি! বেসরকারি গোয়েন্দা! তুই আমার সঙ্গে ইয়ার্কি মারছিস? ওরকম তো গল্পে হয়। বাস্তবে হয় নাকি?’ বিস্ময়ে স্যমন্তকের চোয়াল ঝুলে পড়েছে।
‘হয়, হয়। তোর বিশ্বাস না হলে বউবাজারে আমার আপিসে চলে আয় একদিন।’
স্যমন্তক খানিকক্ষণ চুপ করে রইল। বোধহয় খবরটা হজম করতে সময় লাগছে। তারপর গলা নামিয়ে বলল,
‘তোর কাজটা কী রে? কালো ওভারকোট পরে, চোখে কালো চশমা এঁটে, কালো পিস্তল হাতে আততায়ীর পেছন পেছন ছোটা?’
‘না, না সেরকম কিছু নয়। বেশিরভাগই রুটিন কাজ। খবর জোগাড় করে দেওয়া, তথ্য জোগাড় করে দেওয়া। কিন্তু মাঝেমধ্যে দু’একটা কাজ এসেছে যেগুলো করতে বেশ বুদ্ধি লাগে, ইম্যাজিনেশন লাগে। এই তো গত বছর একটা স্মাগলারদের দলকে ধরে একই সঙ্গে আত্মতৃপ্তি এবং পুলিশের কাছ থেকে পাঁচ লাখ টাকার একটা অ্যাওয়ার্ড দুটোই পেলাম। সেই কেসটা সলভ করে পুলিশ মহলে আমার বেশ খাতির বেড়েছে। তবে পিস্তল-টিস্তল রাখি না, এখন অব্দি তার দরকারও পড়েনি।’
‘তুই আমার বড়িতে কবে আসবি বল? সামনের রোববার আয়। সকালে চলে আয়, দুপুরের খাওয়া, বিকেলের চা-টা খেয়ে একেবারে সন্ধেবেলা বাড়ি যাবি। বউকে বলব, দ্যাখো, একজন জ্বলজ্যান্ত গোয়েন্দা আমার বন্ধু। আসছিস তো রোববার?’
‘ঠিক আছে যাব। তবে যেতে যেতে সাড়ে বারোটা-একটা হয়ে যাবে। সকালে একটা কাজ সেরে যেতে হবে।’
‘তাই আয়, তাই আয়।’ স্যমন্তক উঠতে যাচ্ছিল। তাকে বসতে বলে আদিত্য আরও দু’কাপ চায়ের অর্ডার দিল। চা আসার পর চায়ে চুমুক দিয়ে আদিত্য বলল, ‘শোন, আমাকে একটু সাহায্য করতে হবে। নীলাঞ্জন মৈত্র বলে তুই কাউকে চিনিস? গ্রুপ থিয়েটারেরই লোক।’
‘চিনি বইকি। অনেক দিন ধরেই চিনি। তবে ইদানীং আর দেখা হয় না। ওদের প্রান্তিক বলে একটা পুরোনো দল ছিল। এক সময় ওরা নিয়মিত নাটক নামাত। বছরে একটা নতুন প্রোডাকশান তো বটেই, কখনো কখনো দু’টো। সেসব পনেরো-কুড়ি বছর আগেকার কথা। এখন কালেভদ্রে প্রান্তিক-এর শো হয়। আসলে নীলাঞ্জনদার দলে মূল আকর্ষণ ছিল মন্দাকিনী মৈত্র, নীলাঞ্জনদার স্ত্রী। মন্দাকিনী নীলাঞ্জনদাকে ছেড়ে দিয়ে এক বড়লোক ব্যবসাদারকে বিয়ে করার পর প্রান্তিক দলটা একটা বিরাট ধাক্কা খেল। আর বিয়ে ভেঙে যাবার পরে নীলাঞ্জনদাও একেবারে শেষ হয়ে গেল। কারও সঙ্গে মেশে না, ভাল করে কথা পর্যন্ত বলে না। ওদের দলের পুরোনো দু’একটা ছেলেমেয়ে কোনও রকমে জোড়াতালি দিয়ে দলটাকে এখনও টিকিয়ে রেখেছে। তা তুই হঠাৎ এত লোক থাকতে নীলাঞ্জন মৈত্রর ব্যাপারে ইন্টারেস্টেড হয়ে পড়লি কেন?’
‘কেন হলাম বলছি। তার আগে তুই বল নীলাঞ্জন মৈত্রের থিয়েটার প্রতিভা কেমন ছিল?’
‘দ্যাখ, নীলাঞ্জন মৈত্র মোটেই জনপ্রিয় হতে পারেনি। অনেকেই বলে নীলাঞ্জনদা ওয়াজ বর্ন অ্যাহেড অফ হিস টাইম। অর্থাৎ যে এক্সপেরিমেন্টগুলো নীলাঞ্জনদা করত তার জন্য দর্শকদের মানসিক প্রস্তুতি ছিল না। আমি অতটা বলব না। আনসাকসেসফুলদের অকারণে গ্লোরিফাই করার একটা স্বভাব বাঙালির আছে। আরে বাবা, অসফল হলেই তো কেউ মহৎ শিল্পী হয়ে যায় না। সকলেই তো আর ভ্যান গগ নয়। তবে নীলাঞ্জনদার যে কিছু ট্যালেন্ট ছিল সেটা স্বীকার করতেই হবে। কিন্তু কিছুতেই দর্শকদের সঙ্গে কমিউনিকেট করতে পারত না। পারহ্যাপস হি ওয়াজ আ বিট টু থিওরেটিকাল। এবং ভয়ঙ্কর পলিটিসাইজড। উগ্র বাম রাজনৈতিক বিশ্বাসই ওকে শেষ করে দিল। তার থেকে আর বেরোতে পারল না।’
‘নীলাঞ্জন মৈত্র এখন কী করে জানিস?’
‘খুব ভাল জানি না। শুনেছি গ্রামের দিকে একটা ইস্কুল চালায় আর মাঝেসাঝে একটা-দুটো শো করে। তবে নতুন নাটক অনেকদিন নামায়নি।’
‘তুই আমাকে নীলাঞ্জন মৈত্রর সঙ্গে একবার দেখা করিয়ে দিতে পারিস?’
‘হয়তো খুব চেষ্টা করলে পারি। কিন্তু তার আগে তোকে বলতে হবে কেন নীলাঞ্জন মৈত্রর সঙ্গে দেখা করতে চাস।’
‘ঠিক আছে বলছি, তবে কথাটা কাউকে বলা চলবে না। তোর স্ত্রীকেও নয়। শোন, নীলাঞ্জন মৈত্রর প্রাক্তন স্ত্রী মন্দাকিনীকে সম্ভবত কেউ খুন করার চেষ্টা করছে।’
‘খুন?’ স্যমন্তকের মুখ শুকিয়ে গেছে।
‘হ্যাঁ, খুন। কয়েকবার চেষ্টা হয়েছে, কিন্তু কপাল জোরে মন্দাকিনী বেঁচে গেছেন। আবার চেষ্টা হতে পারে। সমস্ত সম্ভবনাগুলো খতিয়ে দেখার জন্য আমাকে ওরা নিয়োগ করেছে।’
‘তুই কি নীলাঞ্জন মৈত্রকে সন্দেহ করছিস নাকি?’
‘না না। এখন পর্যন্ত কাউকেই সন্দেহ করছি না, আবার কাউকে সন্দেহের তালিকা থেকে বাদও দিচ্ছি না। আগে সবার সঙ্গে কথা বলা দরকার।’
‘আমি তোকে যথাসম্ভব সাহায্য করব, কথা দিচ্ছি।’
‘আর দেখিস এই ব্যাপারটা যেন পাঁচকান না হয়।’
‘হবে না। তুই নিশ্চিন্ত থাক।’
(৪)
এলিয়ট রোডের বাড়িটা খুঁজে পেতে পেতে প্রায় তিনটে বেজে গেল। বাড়িটা প্রাচীন ও নড়বড়ে। যেন ভেঙে পড়তে গিয়ে নেহাতই অভ্যাসবশত কোনওক্রমে দাঁড়িয়ে আছে। একতলায় একটা বিরিয়ানির দোকান, তার পাশে বাড়িতে ঢোকার সদর দরজা। একেবারে বোতাম খোলা বাড়ি, সদর দরজাটা দেখে মনে হয় আজ অব্দি কোনও দিন বন্ধ করা হয়নি। দরজা দিয়ে ঢুকে একটা উঠোন, উঠোনে চৌবাচ্চা, বারোয়ারি কলঘর। জায়গাটা শেওলা জমে পিচ্ছিল হয়ে আছে। আদিত্য দেখল এক পাশ দিয়ে একটা নোংরা সিঁড়ি উঠে গেছে সটান চারতলা অব্দি। সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে লম্বা বারান্দা, বারান্দা সংলগ্ন সার সার দরজা। একটা দরজার সামনে দুটো চুড়িদার পরা কৃষ্ণাঙ্গ মেয়ে মুখে রং মেখে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নিজেদের মধ্যে কথা বলছে। তাদের রূপ নিয়ে যত কম বলা যায় ততই ভাল। আদিত্য সিঁড়ি দিয়ে উঠতেই তারা কথা থামিয়ে আদিত্যর দিকে ব্যগ্রভাবে তাকাল। মার্থার ঘর কোনটা জিজ্ঞেস করতে দৃশ্যতই হতাশ দেখাল তাদের। তারপর নেহাতই দায়সারাভাবে একটা দরজা দেখিয়ে দিয়ে তারা আবার নিজেদের মধ্যে কথা বলতে লাগল। দেখিয়ে দেওয়া দরজাটায় গিয়ে টোকা মারল আদিত্য।
কয়েকবার টোকা দেবার পর দরজা খুলে গেল। স্বল্প রাত্রিবাস পরিহিতা ফ্যাকাশে বর্ণের যে ফিরিঙ্গি মেয়েটি দরজা খুলল তাকে অনায়াসে বিগত যৌবনা বলা চলে। মনে হয় সে এতক্ষণ ঘুমোচ্ছিল, হলদে রঙ করা চুল আলুথালু, প্রসাধনহীন মুখে মেছেতা পড়েছে। আদিত্যকে দেখে সে কান এঁটো করে হাসল। আদিত্য লক্ষ করল ফিরিঙ্গিনির দাঁতগুলো ঝকঝকে, দাঁতের গঠনটাও মন্দ নয়। হয়ত চেহারাও তার একসময় ভালই ছিল, এখন ব্যবহারে ব্যবহারে দীর্ণ হয়ে গেছে। আদিত্য আন্দাজ করে নিল এই মার্থা।
‘আইয়ে, অন্দর আইয়ে। প্লিজ কাম ইন।’ মেয়েটি বলল।
আদিত্য ভেতরে ঢুকে দেখল একটা হতশ্রী ঘর, তার মাঝখান জুড়ে একটা বৃহৎ তক্তাপোষ, ইট দিয়ে উঁচু করা। নীচ থেকে বাক্স-প্যাঁটরা উঁকি মারছে। দেয়ালে ক্রুশবিদ্ধ যিশু। ঘরের এক ধারে স্টোভ, তাতে কিছুক্ষণ আগে রান্না করা একটা ভাতের হাঁড়ি বসানো। অন্য দিকে দড়িতে কাপড়-জামা টাঙানো রয়েছে, পেন্টুলুন, টি-শার্ট, মেয়েদের স্কার্ট-টপ, পুরুষ ও নারীর ময়লা অন্তর্বাস, ভিজে গামছা। ঘরের ভেতরে একটা পার্টিশান আছে, পার্টিশানের ওদিকটা দেখা যায় না। বিছানার পাশে একটা ফাঁকা চেয়ার ছিল, আদিত্য তার ওপর বসল।
‘ফাইভ হানড্রেড পার ট্রিপ।’ ফিরিঙ্গিনি সহজ গলায় বলল।
‘আই উইল গিভ ইউ ফাইভ হানড্রেড অ্যান্ড আ বিট মোর, বাট আই অ্যাম নট ইন্টারেস্টেড ইন এনি ট্রিপ।’ আদিত্য দৃঢ় গলায় বলল। ‘তোমার ঘরে শঙ্কুবাবু থাকে। আমি তার সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই।’
‘কে শঙ্কুবাবু? এখানে ওরকম কেউ থাকে না।’ মার্থার গলায় সন্দেহ। তার বাংলায় বেশ টান আছে।
আদিত্য এবার কড়া গলায় বলল, ‘দ্যাখো, নষ্ট করার মতো সময় আমার নেই। ইউ ডিসাইড ইফ ইউ ওয়ান্ট টু আর্ন সাম কুইক ডোউইদাউট মাচ সোয়েট।’
আদিত্য একটা পাঁচশো টাকার নোট বার করে মার্থার হাতে দিল। বলল, ‘এটা নাও। শঙ্কুবাবুর সঙ্গে কথা বলিয়ে দিতে পারলে আরও পনেরোশো পাবে।’ আদিত্য বুক পকেট থেকে আরও তিনটে পাঁচশো-র নোট বার করে মার্থাকে দেখাল। তারপর নোটগুলো পকেটেই ঢুকিয়ে রাখল আবার।
ফিরিঙ্গিনির মুখ দেখে মনে হল এত টাকা দেখে সে লোভে পড়ে গেছে। মনে হয় তার টাকার টানাটানি চলছে। সে বলল,
‘তুমি কোথা থেকে আসছ? মাইকেল পাঠিয়েছে?’
‘না। মাইকেল-টাইকেল কেউ আমাকে পাঠায়নি। আমি নিজের কাজে এসেছি। শঙ্কুবাবুর বাবা সুবীর চৌধুরিকে নিয়ে আমি একটা বই লিখছি। তাই শঙ্কুবাবুর সঙ্গে কথা বলা দরকার।’
আদিত্য টের পায়নি একজন কোল-কুঁজো লম্বা লোক কখন পার্টিশনের ওদিক থেকে এসে আদিত্যর পাশে দাঁড়িয়েছে। তার ফরসা রং বহু অত্যাচারে তামাটে হয়ে গেছে। তীক্ষ্ন নাক, পাতলা ঠোঁট, চওড়া কপাল দেখে মনে হয় এক সময় সে রীতিমতো সুপুরুষ ছিল। এখন অবশ্য তার চোখের নীচে গভীর কালি। ভুরুর ওপরে একটা বিশ্রী ক্ষত এখনও পুরো শুকোয়নি। ডান হাতটাও বোধহয় জখম, কারণ সেটা স্লিং দিয়ে গলার সঙ্গে ঝোলানো। লোকটা মার্থার দিকে তাকিয়ে রুক্ষ গলায় বলল, ‘হু ইজ দিস বাগার? এ এখানে কী করছে?’
‘হি ইস রাইটিং আ বুক অন ইয়োর ফাদার। ওয়ান্টস টু টক টুইউ। হি ইজ উইলিং টু পে গুড মানি ফর ইয়োর টাইম।’ মার্থা খুব শান্তভাবে বলল।
‘আমি ওর সঙ্গে কথা বলব কে বলেছে? আই ওয়ান্ট হিম আউট অফ দিস রুম ইমিডিয়েটলি।’ লোকটা ক্রমশই উত্তেজিত হয়ে উঠছে। গলাটা আরও একটু তুলে সে বলল, ‘আউট।’ তারপর আদিত্যর একেবারে গায়ের ওপর এসে বাঁ হাতে আদিত্যর কলারটা চেপে ধরে আওয়াজটা একেবারে সপ্তম পর্দায় চড়িয়ে আবার বলল, ‘গেট আউট।’
আদিত্য একইভাবে স্থির হয়ে বসে আছে।
‘বিহেভ ইয়োরসেলফ শ্যাঙ্কি।’ মার্থা এবার চাপা গলায় শাসানোর ভঙ্গিতে বলল।
উত্তরে শ্যাঙ্কি অর্থাৎ শঙ্খদীপের একটা বিস্ফোরণ হল। সে চিৎকার করে উঠল,
‘ইউ ব্লাডি হোর, ইউ ওয়ান্ট টু সেল মি অফ ফর টু থাউজেন্ট বাকস। আমি জানি তোদের মতো মেয়েদের কী করে শায়েস্তা করতে হয়।’
এবার যা ঘটল তার জন্য আদিত্য তৈরি ছিল না। ক্ষিপ্র গতিতে শঙ্খদীপের সামনে এসে দাঁড়াল মার্থা। তারপর তার জখম হাতটাকে নিজের দু’হাতে সর্ব শক্তি দিয়ে মোচড়াতে লাগল। যন্ত্রণায় ককিয়ে উঠল শঙ্খদীপ। ধপ করে তক্তপোশে বসে পড়ল। এবার মার্থা এগিয়ে এসে তার দুটো গালে দুটো বিরাশি সিক্কার চড় কষিয়ে দিল।
শঙ্খদীপ চৌধুরি বাঁ-হাতে চোখ ঢেকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। মার্থা দূরে দাঁড়িয়ে দেখছে। মিনিট তিন-চার এইভাবে চলল। তারপরের নাটক মিলনান্ত। মার্থা শঙ্খদীপের ক্রন্দনরত মুখটা দু’হাতে বুকে জড়িয়ে ধরে বলছে, ‘ডোন্ট ক্রাই বেবি, ডোন্ট ক্রাই মাই ডার্লিং। এভরিথিং উইল বি ওকে।’
কতক্ষণ এভাবে চলবে কে জানে, এ-নাটক আদিত্যর আর সহ্য হচ্ছে না। সে অসহায়ভাবে চুপ করে বসে আছে। সৌভাগ্যবশত এক সময় শঙ্খদীপের কান্না থামল। তার জখম হওয়া হাতে কী একটা তীব্রগন্ধী মলম লাগাতে লাগাতে মার্থা আদিত্যর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘টক টু হিম নাউ। হি ইজ অল ইয়োরস।’
শঙ্খদীপ তক্তপোশের ওপর বসে চোখ পিটপিট করছে। আদিত্য তার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমি আপনাকে সামান্য দুএকটা প্রশ্ন করব। তার আগে একটু বলে নিই, আমি একজন সাংবাদিক। ফ্রিলান্স করি। এটা আমার কার্ড।’
আদিত্য শঙ্খদীপের দিকে একটা ভিজিটিং কার্ড এগিয়ে দিল। কার্ডটাতে একবার চোখ বুলিয়ে নিজের পকেটে রেখে দিল শঙ্খদীপ। আদিত্য আবার বলতে শুরু করল, ‘চৌধুরি এন্টারপ্রাইজেস-এর মন্দাকিনী চৌধুরি আমাকে তাঁর স্বামী সুবীর চৌধুরির ওপর একটা বই লিখতে বলেছেন। আমি বিভিন্ন পারসপেক্টিভ থেকে সুবীর চৌধুরিকে বোঝবার চেষ্টা করছি। আপনার পারসপেক্টিভটাও আমার বই লেখার জন্য খুব জরুরি। আমি জানি আপনার সঙ্গে আপনার বাবার সম্পর্ক ভাল ছিল না। তবু ব্যাপারটা আপনার নিজের মুখ থেকে শুনতে চাই। আপনার কথাগুলো টেপ করলে আপত্তি নেই তো?’
শঙ্খদীপ চৌধুরি উত্তর দিচ্ছে না। শুধু চুপ করে বসে আছে আর মাঝে মাঝে চোখ পিটপিট করছে। হয়তো চোখ পিটপিট করাটা তার মুদ্রাদোষ, কিংবা কোনও নার্ভের অসুখ। তার মৌনতাকে সম্মতির লক্ষ্মণ ধরে নিয়ে আদিত্য মোবাইলের অডিও রেকর্ডারটা চালিয়ে দিল। শঙ্খদীপ এখনও কথা বলছে না। মার্থা একটু দূরে বসে সিগারেট ধরিয়েছে। এমনি করে কয়েক মিনিট কাটল। আদিত্য রেকর্ডারটা বন্ধ করে দেবে কিনা ভাবছে এমন সময় শঙ্খদীপ খুব নিচু গলায় বলতে শুরু করল, ‘দেখতেই তো পারছ আমি একেবারে শেষ হয়ে গেছি। একটা মানুষের পক্ষে যতটা নীচে নামা সম্ভব আমি ততটাই নেমেছি। আমার পক্ষে আর ভদ্র সমাজে ফিরে যাওয়ার কোনও রাস্তা নেই। আমার এই অবস্থার জন্য দায়ী কে জানো? আমার বাবা। দ্য গ্রেট এন্টারপ্রেনিয়র সুবীর চৌধুরি। আমার মা যখন মারা যান আমার বছর পনেরো-ষোলো বয়েস। মাকে আমি পাগলের মতো ভালবাসতাম। মার মৃত্যুটাই আমার জীবনের টার্নিং পয়েন্ট। পনেরো বছর বয়েস অব্দি আমি যে-কোনও সাধারণ ছেলের মতো বড় হচ্ছিলাম। খেলাধুলো করতাম, লেখাপড়াতেও খুব খারাপ ছিলাম না। মা হয়তো আমাকে একটু বেশিই আদর দিত। সামনে আইসিএসসি পরীক্ষা, তখন মা চলে গেল। আমার পক্ষে সে-বছর পরীক্ষা দেওয়া সম্ভব ছিল না। পরীক্ষা দিলাম না। সে বছর না, পরের বছরেও না। স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিলাম। কুসংসর্গে পড়লাম। কোনও দিনই আর আইসিএসসি পরীক্ষাটা দেওয়া হল না। নানারকমের নেশা ধরলাম, জুয়া ধরলাম। যাই হোক, আমার নরকে নেমে যাবার পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা দিয়ে লাভ নেই। এক কথায় যেটা বলা যায় সেটা হল, মা চলে যাবার পরে আমার বাবা যদি আমাকে একটু সময় দিত তাহলে আমার জীবনটা বেঁচে যেত। বাবা তখন দেশ-বিদেশে ব্যবসা বাড়ানোর কাজে ব্যস্ত। দিনের পর দিন বাড়িতে থাকে না। যখন থাকে তখনও বাবার দেখা পাই না। পনেরো বছর বয়েসটা খুব সংবেদনশীল একটা বয়েস, এটা মানবে তো?’
শঙ্খদীপ কিছুক্ষণের জন্য থামল। তাকে সিগারেট দিয়ে নিজে একটা ধরাল আদিত্য। সিগারেটে কয়েকটা টান দিয়ে শঙ্খদীপ আবার বলতে শুরু করল, ‘আমার নরকে নেমে যাওয়াটা আসলে বাবার প্রতি আমার প্রতিহিংসা। বাবা যত আমাকে উপেক্ষা করেছে আমি তত ইচ্ছে করে খারাপ হয়ে গেছি। যাতে সুবীর চৌধুরির গায়ে কলঙ্ক লাগে। যাতে পাঁচটা লোক চেঁচিয়ে বলে, ছি ছি সুবীর চৌধুরি, তোমার একমাত্র ছেলে এইভাবে গোল্লায় যাচ্ছে আর তুমি শুধু টাকা করে বেড়াচ্ছ। এখন বুঝতে পারি ভুল করেছি। আমি ক্রমশ অধঃপাতে গেলেও সুবীর চৌধুরির কোনও দিন কিছু এসে যায়নি, শুধু মাঝখান থেকে আমি নিজেই নিজের ক্ষতি করে গেছি।’
‘আর আপনার বাবার দ্বিতীয় বিয়ে? সেটার বিষয়ে আপনি কী বলবেন?’
‘দ্যাট ওয়াজ দ্য ফাইনাল নেল ইন মাই কফিন। ওই বয়সে বাবা আবার বিয়ে করতে পারে আমরা কল্পনাই করতে পারিনি। আমরা মানে আমি আর আমার বোন মালা। মালা বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করে বেঁচে গেল। আমি আর বাঁচতে পারলাম না।’
‘মন্দাকিনী চৌধুরির সঙ্গে আপনার সম্পর্ক কেমন ছিল?’
‘খুব খারাপ। যতটা খারাপ হতে পারে। মন্দাকিনী ওয়াজ আ বিচ। শি ওয়াজ ওনলি আফটার মাই ফাদারস মানি। আর আমার বাপটাও তো ঢ্যামনা, তাই শালা দ্বিতীয় বউ-এর কথায় উঠত বসত।’
আরও কিছু বলতে গিয়ে শঙ্খদীপ নিজেকে সামলে নিল। হয়তো আরও খারাপ কথা তার মুখে এসে গিয়েছিল। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে সে থেমে থেমে বলল, ‘এত সুন্দর শরীরের আড়ালে এত কুৎসিত মন আমি মন্দাকিনীর মতো আর দুটো দেখিনি। অথচ দ্যাখো, ওই যে মার্থা বসে আছে, সমাজে ওর জায়গা খুব উঁচুতে নয়, কিন্তু ওর হৃদয়টা সোনা দিয়ে মোড়া। তথাকথিত ভদ্র সমাজে এরকম বড় মন দেখতে পাবে না।’
আলোচনাটা শরৎচন্দ্রের লাইনে চলে যাচ্ছে দেখে আদিত্য তাড়াতাড়ি বলল, ‘আমি যতদূর জানি চৌধুরি এন্টারপ্রাইজ থেকে আপনি এক পয়সাও পান না। এ-ব্যাপারে আপনি কখনও আইনি সাহায্য নেবার কথা ভেবেছেন? চৌধুরি এন্টারপ্রাইজ তো একা সুবীর চৌধুরির চেষ্টায় তৈরি হয়নি, এর পেছনে চৌধুরিদের অনেক পুরুষের পরিশ্রম আছে। আপনার পূর্বপুরুষদের অর্জিত টাকায় আপনার কিছু অধিকার থাকাটাই তো স্বাভাবিক।’
কথাটা শুনে শঙ্খদীপ চৌধুরি একটু চমকে উঠল। খানিকক্ষণ ভেবে বলল, ‘তোমাকে ধন্যবাদ। এভাবে আমাকে কেউ ভাবতে বলেনি। কিন্তু মামলা করার মতো দম আমার আর নেই। টাকাপয়সার জোরও নেই।’
শঙ্খদীপ চৌধুরি আবার খানিকক্ষণ থামল। তারপর বিড়বিড় করে বলল,
‘আমি জীবনের যুদ্ধে একেবারে হেরে গেছি। শিরদাঁড়াটাও ভেঙে গেছে। আর উঠে দাঁড়াবার ক্ষমতা নেই। আসলে চৌধুরি পরিবারের সেই পুরোনো অভিশাপটা এখন আমার ওপর এসে পড়েছে। যেমন দ্বিতীয়বার বিয়ে করার পর সুবীর চৌধুরির ওপর পড়েছিল। দ্যাট বিচ হারসেলফ কেম অ্যাজ আ কার্স।’
‘পুরোনো অভিশাপ? আপনি কোন অভিশাপের কথা বলছেন?’ আদিত্য উদগ্রীব হয়ে বলল।
‘কিছু না। কিছু বলিনি। নিজের মনে বিড়বিড় করছিলাম।’ শঙ্খদীপ আবার নিজের খোলসের মধ্যে ঢুকে পড়েছে। ‘শোনো, আমার নেশার সময় হয়ে গেছে। আর আমার কথা বলতে ভাল লাগছে না। তুমি এখন যেতে পার। আই থিঙ্ক আই হ্যাভ টকড এনাফ টু আর্ন মাই মানি। নমস্কার।’
আদিত্য ভেবে দেখল এক দিনের আন্দাজে অনেক কাজ হয়েছে। মানসিক ধকলও কিছু কম হয়নি। সে রেকর্ডার বন্ধ করে উঠে দাঁড়াল। তারপর মার্থার হাতে বাকি তিনটে পাঁচশো টাকার নোট তুলে দিয়ে দরজা খুলে বারান্দায় বেরিয়ে দেখল, নানা রঙের ও আকারের অপেক্ষমাণ বারবধূরা ইতিমধ্যে বারান্দাটা ভরিয়ে ফেলেছে।