চৌধুরি বাড়ির রহস্য – ৫
পঞ্চম পরিচ্ছেদ
(১)
কলকাতায় বসন্তের আয়ু বড়জোর সপ্তাহ দুয়েক। যেমনি হঠাৎ আসে তেমনি হঠাৎ চলে যায়। আদিত্য বউবাজারে তার আপিস থেকে বেরিয়ে সবে রাস্তায় পা দিয়েছে এমন সময় বলা নেই কওয়া নেই দক্ষিণ দিক থেকে একটা ব্যস্তবাগীশ হাওয়া হন্তদন্ত হয়ে এসে জানাল বসন্ত এসে গেছে।
এখন সবে সোয়া পাঁচটা, বিকেলই বলা চলে। মন্দাকিনী চৌধুরির কোথায় যেন যাবার আছে, সন্ধে ছটায় আপিসে ফিরবে। আদিত্যকে ওই সময়েই আসতে বলেছে। মন্দাকিনীর আপিস লালদিঘির দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে, আদিত্যর আপিস থেকে হেঁটে বড়জোর দশ মিনিট। একটু আগে আগে বেরোনো হয়ে গেল। ছটা অব্দি কী করে সময় কাটানো যায়? আদিত্যর মনে পড়ল, লালদিঘির ওদিকটায় একটা চায়ের দোকান আছে, সেখানে এই সময় বেগুনি-ফুলুরি ভাজে। ফুটপাথের দোকান, কিন্তু ভিড় হয় খুব। কে যেন বলেছিল, হাইকোর্ট, ব্যাঙ্কশাল কোর্টের ভিড়। মনে হয় না। এতক্ষণ কোর্ট খোলা থাকে নাকি? আদিত্য ঠিক করল ওখানেই আধঘণ্টা কাটিয়ে দেবে। মনটা অকারণে খুশি খুশি লাগছে।বসন্ত এসে গেছে বলেই বোধহয়।
এবছর শীতটা ফেব্রুয়ারির শেষ অব্দি টেনেছিল। এখনও দখনে বাতাসে একটা ঠান্ডার আমেজ আছে। লালদিঘির ধারে একটা কৃষ্ণচূড়া গাছ খুব সাজগোজ করে হাওয়ায় মাথা ঝাঁকাচ্ছে। পাশে একটা রাধাচূড়াও আছে, কিন্তু তার প্রসাধন এখনও পুরো হয়নি। সবে দু’চারটে হলুদ ফুল ধরেছে তার শরীরে। লালদিঘির পুবদিকে মিনিবাসের গুমটিতে আপিস-ফেরতদের লাইন ক্রমশ লম্বা হচ্ছে। অন্যদিকে, আদিত্য যেখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চা-তেলেভাজা খাচ্ছে তার ঠিক সামনে, চৌধুরি এন্টারপ্রাইজেসের পাঁচতলা আপিস। বাড়িটা পুরোনো, কিন্তু দেখেই বোঝা যায় বেশ যত্নে আছে। দ্বিতীয় ভাঁড় চায়ে চুমুক দিতে দিতে আদিত্য সেদিকে মাঝে মাঝে নজর রাখছিল।
ছটা বাজতে তখনও সাত-আট মিনিট বাকি, আদিত্য হঠাৎ লক্ষ করল চৌধুরি এন্টারপ্রাইজের গেট দিয়ে একটা গাড়ি ঢুকছে। ফেরারি নাকি লম্বারগিনি? যেটাই হোক, সন্দেহ নেই দামি স্পোর্টস কার, সম্ভবত ইটালিয়ান। আদিত্য আরও খেয়াল করল, গাড়ি চালাচ্ছে সোহিনী মৈত্র আর তার পাশে যিনি বসে আছেন তাঁর ছবি আদিত্য অনেকবার খবর কাগজে, পত্র-পত্রিকায় দেখেছে। ইনি নিসন্দেহে মন্দাকিনী চৌধুরি। তাহলে মন্দাকিনী ফিরে এসেছে। আদিত্য কিছুক্ষণের মধ্যে চা-তেলেভাজার দাম মিটিয়ে চৌধুরি এন্টারপ্রাইজের বাড়িটার দিকে পা বাড়াল।
সিইও মন্দাকিনী চৌধুরির আপিস পাঁচতলায়। একতলার রিসেপশনে আদিত্যর নামটা জানানো ছিল। নিজের নাম বলতেই লিপ্সটিক-রঞ্জিত-ওষ্ঠ, উদ্ভিন্ন যৌবনা অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান রিসেপশনিস্ট আদিত্যকে লিফট-এ উঠে পাঁচতলায় চলে যেতে বলল। পাঁচতলায় উঠে আরেকটা ছোট রিসেপশন, মনেহয়, সিইও-র খাস অতিথিদের জন্য। এবারের রিসেপশনিস্ট মেয়েটির চেহারা ও সাজপোশাক তর্কাতীতভাবে বাঙালি, নীলশাড়ি-ব্লাউজের সঙ্গে রংমেলান্তি নীলটিপ, পিঠের ওপর এলিয়ে পড়া খোঁপা, কিন্তু কথা বলল ইংরেজিতে, মিশনারি ইস্কুলে শেখা উচ্চারণে। সামনের সোফায় আদিত্যকে বসতে বলে ইন্টারকমে দু’একটা কথা জিজ্ঞেস করল। তারপর আদিত্য কেবল, আর মিনিট পাঁচেকের মধ্যে ম্যাডাম আদিত্যকে ডেকে নেবেন। ইতিমধ্যে আদিত্য কি চা বা কফি কিছু খাবে? ঠিক আট মিনিট বাদে যখন মন্দাকিনী চৌধুরির ঘরে আদিত্যর ডাক পড়ল তখন তার একদফা কফি খাওয়া হয়ে গেছে।
মস্ত বড় ঘর, এপার-ওপার প্রায় দেখা যায় না, তার ওপর আধো-অন্ধকার। আদিত্য দেখল, একদিকে একটা পেল্লায় সেক্রেটারিয়েট টেবিল, তার ওপর টেবিল ল্যাম্প জ্বলছে, কিন্তু ম্যাডাম চেয়ারে নেই। আদিত্য কোনদিকে এগোবে বুঝতে না পেরে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে, এমন সময় একটু ভারী মেয়েলি গলায় কেউ বলল,
‘এদিকে চলে আসুন, আমি এখানে।’
আদিত্য এবার খেয়াল করল ঘরের অন্যদিকে একপ্রস্থ সোফা, কাউচ, সেন্টার টেবিল রয়েছে, সেদিকটাতেও একটা নরম আলো জ্বলছে। মন্দাকিনী একটা কাউচে বসে আছেন। আদিত্য উল্টোদিকের কাউচটাতে গিয়ে বসল। আদিত্য আন্দাজ করল মন্দাকিনীর বয়েস তার নিজের বয়েসের কাছাকাছিই হবে। সুন্দরী। গৌরী। তন্বী। যৌবন ধরে রেখেছেন। অথচ চেহারায় চটুলতা নেই বরং একটা স্বাভাবিক দৃঢ়তা আছে। এক মুহূর্ত দেখেই আদিত্য ভদ্রমহিলার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ল। মন্দাকিনী বললেন, ‘আপনি আমার কাজটা হাতে নিয়েছেন আমি এতে কৃতজ্ঞ। আপনার বাবার কথা আমার স্বামীর কাছে অনেক শুনেছি।’
উত্তরে আদিত্য কথা বলল না, শুধু মিষ্টি করে হাসল। মন্দাকিনী বললেন, ‘হয়ত আমি তিলকে তাল করছি। হয়তো নিছক কয়েকটা সমাপতনকে জোড়া লাগিয়ে একটা মিথ্যে গল্প তৈরি করার চেষ্টা করছি। আপনার কী মনে হয়?’
আদিত্য খানিকটা ভেবে নিল কী বলবে। তারপর ধীরে ধীরে বলল, ‘আমার মতে আপনি মোটেই তিলকে তাল করছেন না। ঘটনাগুলো নিছক সমাপতন হবার সম্ভাবনা খুবই কম। আমি যেটুকু ইনভেস্টিগেট করে দেখলাম তাতে এই মুহূর্তে আপনার জীবন সম্পূর্ণ নিরাপদ এটা জোর দিয়ে বলতে পারছি না। অর্থাৎ কেউ আপনাকে খুন করার চেষ্টা করছে না এই কথাটা জোর দিয়ে বলা যাচ্ছে না।’
আদিত্য লক্ষ করল মন্দাকিনীর মুখের অভিব্যক্তিটা ক্রমশ বদলাচ্ছে। খুব সংবেদনশীল মুখ। ভীষণ এক্সপ্রেসিভ। বোঝা যায় এক সময় ভাল অভিনয় করতেন। এখন মন্দাকিনীকে বেশ চিন্তিত দেখাচ্ছে। কিছুক্ষণ চিন্তা করে মন্দাকিনী বললেন,
‘আপনি কেন বলছেন আমি নিরাপদ নই?’
‘দেখুন, আমি যাদের সঙ্গে কথা বলেছি, আপনার বিরুদ্ধে তাদের প্রায় প্রত্যেকের কোনও না কোনও অভিযোগ আছে। কিছু অভিযোগ গুরুতর। আবার একটা অভিযোগ কতটা গুরুত্বপূর্ণ সেটা অনেক সময় নির্ভর করে অভিযোগকারী ব্যাপারটাকে কতটা গুরুত্ব দিচ্ছেন তার ওপর। অভিযোগকারীদের কেউ কেউ আবার আপনার মৃত্যুতে বিপুলভাবে লাভবান হবেন। তবে অভিযোগ থাকলেই বা আপনার মৃত্যুতে লাভবান হলেই যে সেই ব্যক্তি আপনাকে খুন করতে চাইবে, এটা মনে করার কোনও কারণ নেই। খুন করার জন্য এক ধরনের খুনি মানসিকতা লাগে। সেটা সৌভাগ্যবশত খুব বেশি মানুষের মধ্যে দেখা যায় না। কিন্তু এসবের পাশাপাশি যদি আপনার সাম্প্রতিক অ্যাক্সিডেন্টের ঘটনাগুলোকে রাখি, তাহলে বলব আপনার নিরাপত্তার প্রশ্নটা উপেক্ষা করাটা হঠকারিতা হয়ে যাবে।’
‘আপনি আমাকে কী করতে বলছেন?’
‘আপাতত সাবধান হওয়া ছাড়া খুব বেশি কিছু করার নেই। আমার পরামর্শ, আপনি নির্ভরযোগ্য সিকিউরিটি না নিয়ে বাইরে যাবেন না। বিশেষ করে কলকাতার বাইরে। লং ড্রাইভ পারলে অ্যাভয়েড করুন।’
‘সেটা তো সম্ভব নয়। ব্যাবসার কাজে আমাকে বিভিন্ন যায়গায় যেতেই হবে। বিশেষ করে দার্জিলিং-এ আমাদের কয়েকটা চা-বাগান আছে। সেখানে লেবার ট্রাবল চলছে। খুব শিগগির একবার সেখানে যাওয়া দরকার।’
‘বুঝতে পারছি। নেহাত যদি যেতেই হয়, আগে-পরে এসকর্ট গাড়ি নিয়ে নেবেন। যে-কোনও ভাল সিকিউরিটি এজেন্সি তার ব্যবস্থা করে দেবে।’
মন্দাকিনী টেবিলের ওপর পড়ে থাকা একটা পেনসিল হাতে তুলে নিয়ে খেলা করছেন। মানে, কিছু একটা ভাবছেন। বললেন, ‘আমার বিরুদ্ধে কীসের অভিযোগ? কার অভিযোগ?’
আদিত্য সতর্ক হল। বলল, ‘দেখুন, আপনি আমাকে আপনার নিরাপত্তার জন্য নিয়োগ করেছেন। তাই যেটুকু জানতে পেরেছি সেটা আপনাকে জানানো আমার কর্তব্য। সুবীর চৌধুরির প্রথম পক্ষের ছেলেমেয়েরা মনে করে বাবার সঙ্গে তাদের দূরত্বের জন্য আপনি দায়ী। তাছাড়া তারা এটাও মনে করে যে গোড়া থেকেই শুধুমাত্র সুবীর চৌধুরির বিপুল সম্পত্তির দিকেই আপনার নজর ছিল। শঙ্খদীপ একটা পুরোনো অভিশাপের কথা বলল। বলল, আপনিই নাকি সুবীর চৌধুরির জীবনে সেই অভিশাপ। আমি ব্যাপারটা খুব ভাল বুঝতে পারিনি। এছাড়া আপনাদের পুরোনো ম্যানেজার শিশিরবাবু কম্পানির সাম্প্রতিক অধঃপতনের জন্য আপনাকেই দায়ী করছেন। এমনকি, আপনার নিজের মেয়ে, যাঁর মাধ্যমে আপনি আমাকে নিয়োগ করেছেন, তাঁর সঙ্গে নন্দন চক্রবর্তীকে নিয়ে আপনার একটা মনোমালিন্য তৈরি হয়েছে। এছাড়া আপনার প্রথম স্বামীরও আপনার ওপর রাগ থাকতে পারে। তবে অনেক চেষ্টা করেও নীলাঞ্জন মৈত্রর সঙ্গে আজ অব্দি দেখা করতে পারিনি।’
আদিত্য থামল। একটু দম নিয়ে বলল, ‘এদের কেউ আপনাকে খুন করতে চাইছে, এমন প্রমাণ এখন অব্দি পাইনি। তবে সাবধানের মার নেই।’
দূরে, সেক্রেটারিয়েট টেবিলের ওপর টেলিফোন বাজছে। ‘এক্সকিউজ মি’ বলে মন্দাকিনী উঠে গিয়ে ফোন ধরলেন। নিচু গলায় কিছুক্ষণ কথা বললেন। কী বললেন আদিত্য শুনতে পেল না। ফিরে এসে আবার কাউচে বসলেন। বললেন,
‘আমাকে পনের মিনিটের মধ্যে বেরোতে হবে। একটা দরকারি অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে। তার মধ্যে আপনার সঙ্গে কথা সেরে ফেলব। দেখুন, আমি খুব ভালো করেই জানি আমাকে বহু লোক অপছন্দ করে। হয়তো তার কারণ আছে। যেমন শঙ্খদীপ এবং শঙ্খমালা মনে করে আমি তাদের বাবাকে ছিনিয়ে নিয়েছি। কিন্তু বিশ্বাস করুন আমি আমার মতো করে ওদের হেল্প করতে চেয়েছিলাম। মালা যে একটা মাসোহারা পায় সেটা তো আমিই সুবীরকে বলে রাজি করিয়েছিলাম। দীপের ব্যাপারটা অন্যরকম। যখন আমি এ-বাড়িতে এলাম তখন দীপ এতটাই নীচে নেমে গেছে যে আর তাকে শোধরানো সম্ভব নয়। তাই দীপের জন্য আমি সুবীরকে কখনও কোনও অনুরোধ করিনি। সুবীর উইল করে গেছে তার নিজের খেয়ালে। এ-ব্যাপারে আমার সঙ্গে সে কখনও আলোচনা করেনি। আর নীলাঞ্জন? তার মতো কষ্ট আমাকে কেউ দেয়নি। এই পৃথিবী সম্বন্ধে নীলাঞ্জনের কোনও ধারণা ছিল না। একটা বানানো ইউটোপিয়ায় নীলাঞ্জন বাস করত। সংসার চালানো, মেয়ে মানুষ করা সবটাই ছিল আমার দায়িত্ব। এইভাবে তো সারা জীবন চলতে পারে না। সুবীর আমাকে সেই ভয়ঙ্কর নরকের হাত থেকে বাঁচিয়েছিল। আমি তার কাছে কৃতজ্ঞ। সোহিনীও এখন আমাকে ভুল বুঝছে। ও যদি কোনো স্বাভাবিক ছেলেকে ভালবেসে বিয়ে করে বা আজকালকার রীতি অনুযায়ী বিয়ে না করে তার সঙ্গে বসবাস করে আমার কিচ্ছু বলার নেই। বরং আমি তার জন্য সমস্ত রকম সাহায্য করতে রাজি আছি। কিন্তু যদি দেখি সোহিনী ভুল করছে, একটা নেশাগ্রস্ত ছেলের সঙ্গে জীবনটা জড়িয়ে নিজের ভবিষ্যৎটা নষ্ট করে ফেলছে, তাহলে আমি আপত্তি করব না? আর শিশিরবাবুর কথা বাদ দিতে পারেন। বয়েস হয়ে গেছে বলে ওকে আমরা রিটায়ার করিয়ে দিচ্ছি। তাই আমার ওপর রাগ।’
আবার দূরে, টেবিলের ওপর ফোনটা বেজে উঠল। মন্দাকিনী স্পষ্টতই বিরক্ত হলেন। ফোনটা কিছুক্ষণ বেজে বেজে থেমে গেল। মন্দাকিনী উঠে গিয়ে একটু কড়া গলায় ইন্টারকমে বললেন, ‘দশ মিনিট কোনও ফোন যেন আমার কাছে না আসে।’
কাউচে ফিরে এসে মন্দাকিনী খানিক্ষণ চুপ করে বসে রইলেন। তারপর বিষণ্ণ গলায় বললেন, ‘আপনি নিশ্চয় ভাবছেন এত কথা আপনাকে কেন বলছি। সত্যি বলতে কি, আপনাকে এত কৈফিয়ত দেবার কোনও প্রয়োজন আমার নেই। কিন্তু কি জানেন, এত অর্থ, এত ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও মাঝে মাঝে মনে হয় আমার সত্যিই কোনও বন্ধু নেই যাকে আমি আমার দিকটাও খুলে বলতে পারি। আপনাকে দেখে হঠাৎ মনে হল কথাগুলো বলা যায়। বিশেষ করে আপনি যেহেতু অন্য দিকটা শুনে এসেছেন। আমাকে কেউ খুন করার চেষ্টা করছে এটা জেনে আমার যত না ভয় করে, দুঃখ হয় তার থেকে অনেক বেশি।’
মন্দাকিনী আবার থামলেন। আদিত্য কী বলবে ভেবে না পেয়ে চুপ করেই রইল। মন্দাকিনী এবার কেজো গলায় বললেন,
‘আপনার কাজ মোটামুটি শেষ হয়েছে। আমার যেটা জানার ছিল, জানতে পেরেছি। আপনার ফাইনাল বিলটা সরাসরি আমাকে পাঠিয়ে দেবেন। আর এটা যেহেতু কোম্পানি এক্সপেন্সে যাবে, আপনার ইনভেস্টিগেশনের একটা ফর্মাল রিপোর্ট আমার দরকার। আমি গত জানুয়ারির ডেটে কোম্পানির তরফ থেকে একটা নিয়োগপত্র আপনাকে পাঠিয়ে দেব।’ তারপর একটু হেসে বললেন, ‘আমার সত্যি যদি কিছু একটা হয়ে যায়, রিপোর্টটা পুলিশের কাজে লাগবে।’
আদিত্য এতক্ষণ পরে মুখ খুলল, ‘রিপোর্ট আপনাকে কিছু দিনের মধ্যেই দিয়ে দেব। কিন্তু তার আগে একটা ছোট্ট কাজ বাকি আছে। যে সলিসিটার ফার্ম সুবীর চৌধুরির উইলটা ড্রাফট করেছে একবার তাদের সঙ্গে কথা বলতে চাই। আপনি একটু ইন্ট্রোডিউস করে দেবেন?’
‘ঠিক আছে। আমাদের ব্যক্তিগত এবং কোম্পানিগত সমস্ত কাজ করে সলিসিটর ফার্ম মরগ্যান অ্যান্ড ব্যানার্জি। অনেক বছর ধরে ওদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক। আমি ওদের সিনিয়ার পার্টনার শুদ্ধশীল ব্যানার্জিকে ফোন করে একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট করিয়ে দেব। আমার সেক্রেটারি আপনাকে অ্যাপয়েন্টমেন্ট-এর ব্যাপারে জানিয়ে দেবে।’
‘মিস্টার ব্যানার্জির কাছে কি আমার নিজের পরিচয়ে যাব? ওঁকে কি বলব আপনার নিরাপত্তা নিয়ে আমার আশঙ্কার কথা?’
মন্দাকিনী কিছুক্ষণ ভাবলেন। তারপর বললেন, ‘আমার মনে হয় মিস্টার ব্যানার্জিকে সব কথা খুলে বলাই ভাল। ওঁর অন্তত আসল সত্যটা জানা দরকার। আর কিছু?’
‘না তেমন কিছু নয়, শুধু সামান্য একটা প্রশ্ন। শঙ্খদীপবাবু একটা অভিশাপের কথা বলছিলেন। এটা ঠিক কী হতে পারে আপনার কোনো ধারণা আছে?’
প্রশ্নটা শুনে মন্দাকিনীর মুখে কি একটা চকিত উদ্বেগ খেলে গেল? আদিত্যর মনের ভুলও হতে পারে। মন্দাকিনী শান্তভাবে বললেন,
‘একটা পুরোনো অভিশাপের গল্প শুনেছিলাম। সুবীরের কোনও পূর্বপুরুষকে তার পাপকাজের শাস্তি হিসেবে কোনও ব্রাহ্মণ অভিশাপ দিয়েছিলেন। সেই অভিশাপ স্খালনের জন্যই নাকি আমাদের হুগলির বড় কালী মন্দিরটা তৈরি করা হয়। এর বেশি আর কিছু জানি না। তবে সেসব তো কয়েকশো বছর আগেকার ব্যাপার। আজকের দিনে সেসবের আদৌ কোনও গুরুত্ব আছে বলে মনে হয় না। শঙ্খদীপ আপাদমস্তক নেশায় ডুবে থাকে। তাকে অত সিরিয়াসলি নেবার কোনও দরকার আছে কি? আচ্ছা, এবার আমাকে উঠতে হবে। নমস্কার।’
আদিত্যকে আর কথা বলার সুযোগ না দিয়ে মন্দাকিনী উঠে দাঁড়ালেন।
(২)
পরের দিন সন্ধে ছ’টা বাজার কিছু আগেই মরগ্যান ব্যানার্জির আপিসে পৌঁছল আদিত্য। তার অ্যাপয়েন্টমেন্ট সোয়া ছ’টায়, কিন্তু একটু আগে পৌঁছলে ক্ষতি নেই। মরগ্যান ব্যানার্জি কলকাতার প্রাচীনতম সলিসিটর ফার্মগুলোর অন্যতম। এত বছর ধরে কাজ করছে কিন্তু এখনও তাদের সুনামের কিছুমাত্র হানি ঘটেনি। আপিসটা হাইকোর্ট পাড়ায়। একটু গলির ভেতর ঢুকে পুরোনো একটা বাড়ির দোতলা তিনতলা নিয়ে মরগ্যান ব্যানার্জির আপিস। বাড়ির বাইরেটা পুরোনো হলে কী হবে, ভেতরটা একেবারে ঝকঝকে আধুনিক।
ঢুকেই একটা রিসেপশন। সেখানে আদিত্যকে নিজের নাম বলতে হল, আর বলতে হল কার সঙ্গে দেখা করতে চায়। রিসেপশনের মহিলা আদিত্যকে অপেক্ষা করতে বললেন। ঠিক সোয়া ছটাতেই ডাক পড়ল। মহিলা বললেন, ভেতরে ঢুকে ডানদিকে যে ছোট মিটিং রুমটা আছে সেখানেই মিস্টার ব্যানার্জি আপনার সঙ্গে দেখা করবেন। আদিত্য মিটিং রুমে গিয়ে দেখল সেখানে তখনও কেউ আসেনি। ঘর জুড়ে একটা মস্ত গোল টেবিল, তার চারদিকে চেয়ার। একদিকের দেয়াল জুড়ে একটা স্ক্রিনও আছে, গোল টেবিলের অন্যপ্রান্তে একটা ছোট্ট প্রজেক্টর। আদিত্য একটা চেয়ারে বসল।
মিনিট পাঁচেক অপেক্ষা করার পর শুদ্ধশীল ব্যানার্জি দরজা দিয়ে ঘরে ঢুকলেন। আদিত্য দাঁড়িয়ে উঠতে, বললেন, ‘বসুন, বসুন। আমি একটু দেরি করে ফেললুম। একটা ফোন এসে গিয়েছিল। বলুন আপনাকে কীভাবে সাহায্য করতে পারি।’
বিলিতি পোষাক পরা সৌম্যদর্শন বৃদ্ধ। নিখুঁত টাই-এর নট। কথা বলেন থেমে থেমে। উচ্চারণে পুরোনো কলকাতার টান।
‘আমার কথা আপনাকে মিসেস চৌধুরি বলেছেন কি?’
‘বিশেষ দরকারে আপনি আমার সঙ্গে দেখা করতে চান, শুধু এইটুকু বলেছেন। আর বলেছেন, আপনাকে যেন সব রকম সাহায্য করি। কেন দেখা করতে চান, কী সাহায্য চান সেসব ব্যাপারে কিছু বলেননি।’
‘তাহলে আমিই বলছি। আমি পেশায় একজন প্রাইভেট ডিটেকটিভ।’ আদিত্য নিজের একটা ভিজিটিং কার্ড এগিয়ে দিল। ‘সাম্প্রতিক কয়েকটা ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে মন্দাকিনী চৌধুরির সন্দেহ হয়েছে কেউ তাঁকে খুন করার চেষ্টা করছে। এই ব্যাপারে ইনভেস্টিগেশনের জন্য মিসেস চৌধুরি আমাকে নিয়োগ করেছেন। প্রাথমিক তদন্তের পর আমারও মনে হয়েছে মিসেস চৌধুরির সন্দেহটা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। আপনি তো জানেন, একজন বড় মানুষকে খুন করতে চাওয়ার পেছনে অর্থের লোভটা একটা বড় মোটিভ হতে পারে। তাই সুবীর চৌধুরির উইলটার সম্পর্কে একটু জানতে চাই।’
কথাগুলো শুনে শুদ্ধশীল ব্যানার্জির অভিব্যক্তিতে কোনও পরিবর্তন দেখা গেল না। এটাই বোধহয় বিলিতি ভব্যতা। বেয়ারা চা নিয়ে এসেছে। শুদ্ধশীল ব্যানার্জি বললেন, ‘এটা কিন্তু গ্রীন টি। আপনার চলে তো?’
‘চলে, নিশ্চয় চলে। এতো খুব স্বাস্থ্যকর জিনিস।’ আদিত্য ভদ্রতা করে বলল। আসলে গ্রীন টি তার দু-চক্ষের বিষ। চা বলতে সে বোঝে দার্জিলিং চা। আসাম চা নয়, মশলা চা নয়, আদা চা নয়, লেবু চা নয়। শুধু সনাতন দার্জিলিং চা। তবে সত্যিকারের ভাল দার্জিলিং চা সে পাচ্ছে কোথায়?
শুদ্ধশীল ব্যানার্জি চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বললেন, ‘সুবীর চৌধুরির শেষ উইলটা আমিই ড্রাফট করেছিলাম, তাই পুরোটাই মনে আছে। এই শেষ উইলটা মিস্টার চৌধুরি করেছিলেন মারা যাবার কয়েক মাস আগে। শেষ উইলটা একটু অদ্ভুত। উইলে আছে তিনি তাঁর যথাসর্বস্ব তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী মন্দাকিনীকে দিয়ে যাচ্ছেন। মন্দাকিনী যতদিন বেঁচে থাকবেন ততদিন এই সম্পত্তি ভোগ করতে পারবেন। তিনি যদি কোনও উইল না করে মারা যান তাহলে সম্পত্তি তাঁর ছেলে শঙ্খদীপ, মেয়ে শঙ্খমালা এবং মন্দাকিনীর আগের পক্ষের মেয়ে সোহিনী এদের মধ্যে সমান ভাগে ভাগ হয়ে যাবে। কিন্তু মন্দাকিনী যদি ইচ্ছে করেন তাহলে জীবদ্দশায় উইল করে তিনি তাঁর সম্পত্তি যাকে খুশি তাকে দিয়ে যেতে পারেন। মন্দাকিনী যতদিন বেঁচে থাকবেন ততদিন শঙ্খমালা এবং সোহিনীর জন্য একটা সামান্য মাসিক ভাতার ব্যবস্থা থাকবে। ছেলে শঙ্খদীপের জন্য কিছু না।’
‘আমার একটা প্রশ্ন আছে।’ আদিত্য বাধা দিয়ে বলল, ‘সুবীর চৌধুরির যা সম্পত্তি সেটা তো তিনি একা অর্জন করেননি। অনেক প্রজন্ম ধরে এই সম্পত্তি অর্জিত হয়েছে। উত্তরধিকার সূত্রে পাওয়া এই সম্পত্তি থেকে কি সুবীর চৌধুরি তাঁর ছেলেমেয়েদের বঞ্চিত করতে পারেন? শঙ্খদীপ বা শঙ্খমালা কি তাদের পূর্বপুরুষদের দ্বারা অর্জিত সম্পত্তির কোনও অংশই দাবি করতে পারে না?’
‘এটা একটা চমৎকার প্রশ্ন করেছেন। গভীর আইনের প্রশ্ন। উত্তরটা বুঝিয়ে বলছি। ধরুন তিনটে প্রজন্ম আছে। ঠাকুরদাদা, বাবা, বাবার দুই ছেলে। ঠাকুরদাদা ব্যবসা শুরু করেছিলেন, সেই ব্যবসা বাবা ঠাকুরদাদার কাছ থেকে পেয়েছিলেন। পেয়ে সেটাকে তিনি আরও বাড়িয়েছেন। প্রশ্ন, বাবা কি চাইলে সমস্ত ব্যবসা যে কোনও একজন ছেলেকে, কিংবা দুজনকেই বাদ দিয়ে তৃতীয় কোনও ব্যক্তিকে দিয়ে যেতে পারেন? ছেলেদের কি তাদের ঠাকুরদাদার সম্পত্তিতে কোনও অধিকারই নেই? এর উত্তর হল, বাবা, ঠাকুরদাদার অংশ সুদ্ধু সমস্ত ব্যবসা তাঁর যাকে ইচ্ছে তাকে দিয়ে যাতে পারেন যদি তিনি ঠাকুরদাদার কাছ থেকে ঠাকুরদাদার ব্যবসাটা গিফট হিসেবে পেয়ে থাকেন। কিন্তু যদি স্বাভাবিক উত্তরাধিকারী হিসেবে তিনি সেই ব্যবসার মালিক হন তাহলে সেই সম্পত্তিতে ছেলেদেরও অধিকার থাকবে। ব্যপারটা কি পরিষ্কার হল?’
‘জলের মতো পরিষ্কার। এবার বলুন, চৌধুরিদের ক্ষেত্রে কী হয়েছিল।’
‘চৌধুরিদের প্রত্যেকটি প্রধান পুরুষ তাঁর পরবর্তী প্রজন্মের সব থেকে উপযুক্ত ছেলেটিকে বেছে নিয়ে তাকে প্রায় পুরো ব্যবসাটাই গিফট করে এসেছেন। বাকি ছেলেরা অল্পস্বল্প টাকা পেয়েছে বা কখনো কখনো ছোটখাটো দুয়েকটা ব্যবসাও পেয়েছে। কিন্তু মূল ব্যবসা সব সময় সব থেকে উপযুক্ত চৌধুরিটির হাতে থেকে গেছে। ফলে চৌধুরিদের উত্তরোত্তর শ্রী বৃদ্ধি ঘটেছে। সুবীর চৌধুরিও তার বাবা সুবিমল চৌধুরির কাছ থেকে গিফট হিসেবে ব্যবসা পেয়েছিলেন। তাই সেই ব্যবসা যাকে ইচ্ছে তাকে দিয়ে যাবার পুরো অধিকার তাঁর ছিল।’
‘তাহলে মন্দাকিনীর পর সম্পত্তি কে পাবে সেটা মন্দাকিনী ঠিক করতে পারবেন?’
‘একদম তাই। আইনত সম্পত্তিটা যেহেতু মন্দাকিনীর তাই তিনি উইল করে যাকে ইচ্ছে তাকে সম্পত্তি দিয়ে যেতে পারেন। কিন্তু তিনি যদি উইল না করে মারা যান, সমস্ত সম্পত্তি শঙ্খমালা, শঙ্খদীপ এবং সোহিনীর মধ্যে সমানভাবে ভাগ হয়ে যাবে।’
‘তার মানে, মন্দাকিনী ইচ্ছে না করলে শঙ্খদীপ বা শঙ্খমালা সুবীর চৌধুরির সম্পত্তির কোনও অংশই পাবে না।’
‘কথাটা প্রায় ঠিক, পুরোটা নয়। যদি মন্দাকিনী আবার বিয়ে করেন বা কারও সঙ্গে কোনও ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন, তাহলে তিনি সমস্ত সম্পত্তির মালিকানা হারাবেন। এবং সেক্ষেত্রে সোহিনী, শঙ্খমালা আর শঙ্খদীপের মধ্যে সম্পত্তি সমান ভাগে ভাগ হয়ে যাবে।’
‘উইলের শর্তগুলো সঠিকভাবেসকলে জানে কি?’
‘কে কতটা সঠিকভাবে জানে বলতে পারব না। সুবীর চৌধুরি বারবার উইল বদলেছেন। সোহিনী পুরোনো উইলের শর্তগুলো জানত, নতুন উইলটা হয়তো ভাল করে জানে না। শঙ্খদীপ আমার কাছে কখনও আসেনি, তাই সে কতটা জানে বলতে পারব না। শঙ্খমালা কিছুদিন আগে এসেছিল, তাকে কিছুটা বুঝিয়ে বলেছি। আর মন্দাকিনী চৌধুরি, বলাই বাহুল্য, সবটাই জানেন।’
‘মন্দাকিনী কি কোনও উইল করেছেন?’
‘এখন অব্দি করেননি।’
‘শেষ প্রশ্ন। মন্দাকিনী কোনও পুরুষের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়লেন কিনা কে ঠিক করবে?’
‘এই দায়িত্বটা সুবীর চৌধুরি মরগ্যান অ্যান্ড ব্যানার্জির ওপরেই দিয়ে গেছেন।’
(৩)
মরগ্যান ব্যানার্জির আপিস থেকে বেরিয়ে আদিত্য হাতঘড়ির দিকে তাকাল। এখনও আটটা বাজেনি। এত তাড়াতাড়ি মেসে ফিরে লাভ নেই। তাহলে কোথায় যাবে? অমিতাভদের বাড়ি যাওয়া যেত, কিন্তু তার জন্য একটু দেরি হয়ে গেছে। বরং খানিকটা হাঁটা যাক। হাঁটতে হাঁটতে চিন্তা করা যাক। আদিত্য আকাশবাণী ভবনের দিকে হাঁটতে শুরু করল। বিবাদী বাগ অঞ্চলটা বেশ ফাঁকা হয়ে গেছে। আদিত্য আকাশবাণী ভবনে পৌঁছবার আগেই ডান দিকে বাঁক নিল, ইচ্ছে, গঙ্গার ধারে কিছুক্ষণ বসবে। যত গঙ্গার দিকে হাঁটছে তত দক্ষিণের হাওয়াটা জোরদার হচ্ছে। গঙ্গার ধারে পৌঁছে দেখল সেখানে এতহাওয়া, যে দাঁড়ানো যাচ্ছে না।
মন্দাকিনী চৌধুরির কেসটা তো শেষই হয়ে গেল। আদিত্য একটা মোটা বিল পাঠিয়ে দেবে, মনে হয় মঞ্জুরও হয়ে যাবে সেটা। পেট ভরল। কিন্তু মনটা ভরল না। আসল রহস্যটাই রহস্যই থেকে গেল। কে মন্দাকিনী চৌধুরিকে খুন করতে চাইছে? আদৌ কি কেউ চাইছে? দু’একটা খটকা আছে, যার উত্তর আদিত্য এখনও পায়নি। আদিত্যর সমস্যা হল তার ইন্টুইশন তাকে সতর্ক করে দেয় কোথাও একটা খটকা আছে। কিন্তু খটকাগুলো যে ঠিক কী, সেটা বোঝার জন্য অনেক পরিশ্রম করতে হয়। মন দিয়ে ভাবতে হয়। ঘটনাগুলো মনে করতে হয়। কে কী বলেছিল সেগুলোও মনে করতে হয়। ফলে অনেকটা সময় লেগে যায়।
আদিত্যর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় হঠাৎ সজাগ হয়ে উঠল। অনেকক্ষণ থেকে সে খেয়াল করছিল দুটো ছেলে তার পেছন পেছন আসছে। প্রথমে সে ততটা পাত্তা দেয়নি। তারপর রাস্তাটা যত নির্জন হয়ে এসেছে, ততই সে নিশ্চিত হয়েছে ছেলে দুটো তারই পিছু নিচ্ছে। এখন সে টের পেল ছেলে দুটো একেবারে তার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে, ঘাড়ের ওপর তাদের নিশ্বাস পড়ছে। রাস্তাটা একেবারে ফাঁকা। শুধু অনেক দূরে নদীর ওপর মাঝিদের নৌকোর আলোগুলো ঢেউএর তালে তালে দুলছে। আদিত্য ঘুরে দাঁড়াল। ছেলেদুটোর পরনে জিনস-টিশার্ট। কাপড় দিয়ে তারা তাদের মুখগুলো ঢেকে রেখেছে। আদিত্য বিপদের গন্ধ পেল। কিন্তু এখন আর দৌড়ে পালানো যাবে না। একজন বলল,
‘মন্দাকিনী চৌধুরির কেসটা ছেড়ে দে, নইলে জানে মেরে দেব।’ তার উচ্চারণে অবাঙালি টান। অন্যজন বলল,
‘অ্যায়সা নেহি ঘুসেগা খোপড়িমে, থোড়া সা সিখলানা পড়েগা।’ দ্বিতীয় জনের হাতে হঠাৎ একটা ছুরি ঝলসে উঠল।
আদিত্য চকিতে ছেলেটার ছুরিসুদ্ধু হাতের কবজিটা এক হাতে ধরে অন্য হাত দিয়ে উল্টোদিকে মোচড় দিল। মট করে একটা শব্দ হল। ছুরিটা মাটিতে পড়ে গেল। ছেলেটার মুখের কাপড়টা খসে পড়ল। একটা অশ্রাব্য গালাগাল দিয়ে ককিয়ে উঠল সে। আদিত্য বুঝল তার কব্জির হাড়টা নিশ্চিতভাবে ভেঙেছে। অন্য ছেলেটা ইতিমধ্যে তার হাতের ছোট লাঠিটা আদিত্যর মাথা লক্ষ করে সজোরে চালিয়েছে। আদিত্য যখন সেটা খেয়াল করল তখন একটু দেরি হয়ে গেছে। সে তার মাথাটা পুরোপুরি সরিয়ে নিতে পারল না। লাঠিটা তার কপালের একদিকে আঘাত করল। যন্ত্রণাটা কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ল আদিত্যর সারা শরীরে। সে মাটিতে উবু হয়ে বসে পড়ল। তারপর হঠাৎ স্প্রিং-এর মতো লাফিয়ে উঠে ছেলেটার তলপেটে একটা লাথি কষাল। লাথি খেয়ে ছেলেটা একটু কুঁজো হয়ে যেতেই তার মুখের ওপর থেকেও কাপড়টা সরে গেল। আদিত্য তার নাকের ওপর একটা ঘুষি মারল। ঘুষির জোরে নিজের হাতটাই ঝনঝন করে উঠল আদিত্যর। সে দেখল ছেলেটার নাক দিয়ে অঝোর ধারায় রক্ত ঝরছে।
ছেলে দুটো পালাচ্ছে। আদিত্য একবার ভাবল ওদের পিছু ধাওয়া করে। তারপর মনে হল সেটা করে লাভ নেই। যুদ্ধে তো তারই জয় হয়েছে। এখন তার নিজের ক্ষতস্থানের শুশ্রুষা করা দরকার। সে টের পেল তার কপাল দিয়ে গলগল করে রক্ত বেরোচ্ছে। রুমাল দিয়ে রক্তের ধারা আটকানো যাচ্ছে না। পা দুটো কাঁপছে। দাঁড়ানো যাচ্ছে না। মাথাটা দপদপ করছে। আদিত্য মাটিতে বসে পড়ে পকেট থেকে কোনও রকমে মোবাইলটা বার করল। অমিতাভর নম্বরটা ডায়াল করল। বলল, গঙ্গার ধারে তার একটা অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। এখানে ট্যাক্সি পাওয়া যাচ্ছে না। অমিতাভ যেন তাড়াতাড়ি এসে তাকে নিয়ে যায়। জায়গাটা ঠিক কোথায় সেটাও যতটা পারে বুঝিয়ে বলল। আধঘণ্টা পরে অমিতাভ আর রত্না যখন গাড়ি নিয়ে আদিত্যর কাছে পৌঁছল তখন সে রাস্তার ওপর নিথর হয়ে শুয়ে আছে। জ্ঞান নেই।
(৪)
মোটামুটি সুস্থ হতে আদিত্যর কয়েকটা দিন লেগে গেল। মাথায় একটা ছোট ব্যান্ডেজ অবশ্য রয়ে গেছে। অমিতাভ-রত্না তাকে এখনও মেসে ফেরত যেতে দেয়নি। আদিত্য ওদের প্রথমে গুল মেরেছিল হোঁচট খেয়ে পড়ে গিয়ে ফুটপাথে কপালটা ঠুকে গেছে। ওরা প্রায় বিশ্বাসও করে নিয়েছিল। কিন্তু স্টিচ কাটার সময় ডাক্তারবাবু যখন বললেন, ‘দেখে তো মনে হচ্ছে লাঠি বা ভোঁতা এবং ভারী কোনও জিনিস দিয়ে আপনার মাথায় আঘাত করা হয়েছিল, কী করে এসব বাঁধালেন?’ তখন দুজনেই, বিশেষ করে রত্না, আদিত্যকে প্রশ্নবাণে একেবারে পেড়ে ফেলল। সত্যি কথাটা না বলে আদিত্যর আর কোনও উপায় রইল না। রত্না তাকে বারবার বলল, দরকার হলে তুই ইস্কুল মাস্টারি কর আদিত্য। না জুটলে ভিক্ষে কর। এসব গুন্ডামি তোর পরিবারে কেউ কখনও করেনি। স্রেফ শুনে যাওয়া ছাড়া আদিত্য আর কী করবে? সে অবশ্য বলতে পারত তার পরিবারে ইস্কুল মাস্টারি কিংবা ভিক্ষেও কেউ কখনও করেনি।
পরদিন সকালে সোহিনীর ফোন। ‘অমিতাভদার কাছে শুনলাম আপনি অসুস্থ। ওদের বাড়িতেই আছেন। আজ একটু বেলায় গেলে দেখা পাব?’
‘ক’টায় আসবেন?’
‘ধরুন, এই বারোটা নাগাদ।’
‘চলে আসুন। বাড়িতেই থাকব।’
অমিতাভ, রত্না দুজনেই দশটা নাগাদ কাজে বেরিয়ে যায়। তাদের ছেলে টুপলু ইস্কুলে বেরোয় আরও ঘণ্টা খানেক আগে। সোহিনী যখন এল তখন বাড়িতে আদিত্য একাই রয়েছে।
‘অমিতাভদা বললেন আপনার একটা অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। কী করে হল?’ সোহিনী বসতে বসতে বলল।
‘আপনাকে বলতে বাধা নেই, অ্যাক্সিডেন্ট নয়, দুটি গুন্ডা আমার ওপর চড়াও হয়েছিল। মন্দাকিনী চৌধুরির কেসটা থেকে সরে না দাঁড়ালে পরিণাম আরও ভয়ঙ্কর হবে বলে শাসিয়ে গেছে। ওরা নিশ্চয় জানত না মন্দাকিনী নিজেই আমাকে কেসটা থেকে অব্যাহতি দিয়েছেন।’
‘দ্বিতীয় খবরটা জানতাম। মা নিজেই বলল যা জানার তা জানা হয়েছে। আর গোয়েন্দার দরকার নেই। আপনি মাকে বলেছেন মার নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তার কারণ আছে। মা আপনার কাছে নাকি একটা রিপোর্টও চেয়েছে। সেসব তো হল। কিন্তু গুন্ডা চড়াও হবার ব্যাপারটা তো সাংঘাতিক। আমি এটার কিছুই জানতাম না। মাও জানত না।’
‘এবার তো জানলেন। আপনি আপনার মাকেও প্লিজ একটু জানিয়ে দেবেন। এমনিতে ব্যাপারটা এমন কিছু নয়। বলতে পারেন প্রফেশানাল হ্যাজার্ড। কিন্তু গত কয়েকটা দিন একেবারে অকেজো হয়ে গিয়েছিলাম। তাই রিপোর্টটা তৈরি করে উঠতে পারিনি। এটা আপনার মাকে জানানো দরকার।’
‘আমি নিশ্চয় বলব। কিন্তু আপনি আগে সেরে উঠুন।’
‘বলতে পারেন নব্বই ভাগ সেরে উঠেছি। বাকিটা কাজ শুরু করলে আস্তে আস্তে হয়ে যাবে। মুস্কিল হচ্ছে, অমিতাভ-রত্না কিছুতেই ছাড়তে চাইছে না। বলছে, অন্তত এক মাস ওদের এখানে থেকে যেতে হবে। ল্যাপটপটাও সঙ্গে নেই। থাকলে রিপোর্ট লেখার কাজটা শুরু করে দিতে পারতাম। কফি খাবেন?’
‘আপনি করবেন?’
‘হ্যাঁ, আমিই করব। করছি আজকাল মাঝেমাঝে। তবে দুধ-চিনি ছাড়া ব্ল্যাক কফি। কলম্বিয়ান কফি। অমিতাভ কোথা থেকে যেন নিয়ে এসেছে। চমৎকার। খেয়ে দেখতে পারেন।’
আদিত্য খাবার টেবিলে দুটো ফাঁকা কফির কাপ রাখল। কফির কৌটো থেকে কাপে কফি দিল। গরম জল ঢালতে ঢালতে খেয়াল করল সোহিনী পাশে এসে দাঁড়িয়েছে।
‘আরও একটা কথা আপনার মাকে বলবেন। গুন্ডাদের আক্রমণে এটা আরও বেশি করে প্রমাণিত হচ্ছে যে আপনার মায়ের অ্যাক্সিডেন্টগুলো ঠিক অ্যাক্সিডেন্ট নয়। ওগুলো ঘটানো হয়েছে। এবং কেউ একজন চাইছে না আমি মন্দাকিনী চৌধুরির কেসটা ঘাঁটাঘাঁটি করি। আপনার মাকে সাবধানে থাকতে বলবেন।’
কথা বলতে বলতে ওরা কফির কাপ হাতে আবার বসার জায়গায় ফিরে এসেছে।
‘সত্যিই চমৎকার কফি।’ সোহিনী কাপে চুমুক দিয়ে বলল।
‘সেদিন যখন দেখলাম আপনিই গাড়ি চালিয়ে আপনার মাকে নিয়ে অফিসে ঢুকলেন, ভেবেছিলাম আপনার মার ঘরে আপনাকেও দেখতে পাব।’
‘আরে না না। মার ফেরারিটা আমি পারত পক্ষে চালাই না। এই শহরে ফেরারি চালাতে খুব ভয় করে। কখন কোথায় ধাক্কা লেগে যাবে। ওটা শৈলেনবাবুই চালান। কিন্তু সেদিন শৈলেনবাবু ছুটি নিলেন। মা তো ফেরারি আর কারও হাতে ছাড়বে না। অগত্যা আমাকেই আসতে হল। মাকে অফিসে নামিয়ে দিয়েই আমি চলে গেছি। একটা জরুরি কাজ ছিল। আবার সাতটার সময় ফিরে এসে মাকে নিয়ে ক্লাবে গেলাম। ততক্ষণে আপনি চলে গেছেন।’
‘আপনি চালালে আপনার মা নিরাপদ বোধ করেন?’ আদিত্য ঠাট্টার গলায় বলল।
‘নিরাপদ বোধ করে কিনা জানি না, তবে নিঃসন্দেহে আরাম বোধ করে।’
‘ঠিক বুঝতে পারলাম না।’ আদিত্যকে খানিকটা দ্বিধাগ্রস্ত গলায় বলল।
সোহিনী হাসল। বলল, ‘বোঝার কথা নয়। এর পেছনে একটা ইতিহাস আছে। আমি তখন খুব ছোট, মা ফুলটাইম আভিনয় করে, সুবীর চৌধুরি তখনও সিনে আসেননি। একবার স্টেজ রিহার্সালের সময় মা একটা উঁচু জায়গা থেকে পড়ে যায়। বাঁ হাঁটুতে আঘাত লাগে। তার থেকে আর্থারাইটিস দাঁড়িয়ে গেছে। মা বাঁ হাঁটুটা ভাল করে ভাঁজ করতে পারে না। তাই গাড়িতে উঠে বাঁ পা-টা ছড়িয়ে বসতে হয়। সামনে বসলে সেটা সব থেকে ভাল করে করা যায়। আমি গাড়ি চালালে মার সামনে বসতে আপত্তি নেই। পা-টা ছড়িয়ে দিয়ে বেশ আরাম করে সামনে বসে। কিন্তু ড্রাইভার গাড়ি চালালে তার পাশে বসতে মা রাজি নয়। তখন পেছনেই বসতে হয়। অনেকটা জায়গা নিয়ে বাঁ পা-টা ছড়িয়ে মা পেছনে বসে।’
‘বুঝলাম।’ একটু থেমে আদিত্য বলল, ‘নন্দনের গান কেমন চলছে? সেদিন কিন্তু যে বেহাগটা শুনলাম, গত দশ বছরে কলকাতার অডিয়ান্স ওরকম বেহাগ শুনেছে বলে মনে হয় না। আমি অন্তত শুনিনি।’
‘আপনাদের আশীর্বাদে নন্দন এখন দু-একটা প্রোগ্রাম পাচ্ছে। ভোপালে আগামী মাসে একটা প্রোগ্রাম আছে। হয়তো পুনেতেও একটা পেতে পারে, কথাবার্তা চলছে। নন্দনের গুরুজি বেঁচে থাকলে আর একটু সুবিধে হত, কিন্তু তিনি তো অকালে চলে গেলেন। কী আর করা যায়।’
সোহিনী উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘আজ উঠি। বেশি স্ট্রেন করবেন না। তাড়াতাড়ি ভাল হয়ে উঠুন। আমি মাকে সব বলে দেব। বাই।’
একটু পরে মন্দাকিনী চৌধুরি নিজে ফোন করলেন। গলায় উদ্বেগ। আদিত্যকে সাবধানে থাকতে বললেন। আদিত্য বলল তার আঘাত অতি সামান্য। চিন্তার কারণ নেই।