চৌধুরি বাড়ির রহস্য – ৬
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
(১)
সকালে অমিতাভর গাড়িতে গিয়ে আদিত্য ল্যাপটপটা মেস থেকে নিয়ে এসেছে। মেসের ম্যানেজার কেবলে এসেছে সে আরও সপ্তাহ খানেক বাদে ফিরবে। কীভাবে কেজানে মেসে খবর রটে গিয়েছিল যে আদিত্যর একটা অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে, সে বন্ধুর বাড়িতে আছে। তাকে দেখে, বিশেষ করে তার মাথায় ব্যান্ডেজটা দেখে, ম্যানেজারের হাজার প্রশ্ন। আদিত্যর বিরক্ত লাগছিল। লোকটার এক ফোঁটা আন্তরিকতা নেই। শুধু কায়দা করে জানতে চাইছে আদিত্য মেসের টাকাটা কবে দেবে। চাইলে সেদিনই আদিত্য মেসের পাওনাটা চুকিয়ে দিতে পারত, কিন্তু লোকটার হাবভাব দেখে এত রাগ হয়ে গেল যে সে কাটা কাটা কয়েকটা উত্তর দিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ল। বেরিয়েই দেখে দরজার সামনে মুখ চুন করে বলরাম দাঁড়িয়ে আছে। মেসের মধ্যে এই একটা লোকই যা তার জন্য একটু ভাবে।
আদিত্যকে দেখে বলরাম এগিয়ে এল, ‘কী কাণ্ড বাঁধিয়েছো গো। আমি তো ভেবে মরি। সবাই বলল তোমাকে নাকি হাসপাতালে নিয়ে গেছে। লরি ধাক্কা মেরেছিল নাকি?’
‘লরি-টরি নয় রে, রাস্তায় হোঁচট খেয়ে পড়ে গিয়ে মাথা ফাটিয়েছি। এখন প্রায় সেরেই গেছি বলতে পারিস। মেসে আজই ফিরে আসতাম, বন্ধু আসতে দিচ্ছে না। সামনের সপ্তাহে চলে আসব।’
‘এত তাড়াতাড়ি আসার কী আছে? কদিন সেখানে থেকে শরীরটা সারিয়ে এস না হয়। এখানে খাবার-দাবারের যা ছিরি, এখানে এলে পথ্যি হবে কী করে?’
‘আমার বন্ধুও তাই বলছে। দেখি কী করা যায়। তুই শোন। এই টাকা কটা রাখ। এমাসে বাড়িতে এখনও টাকা পাঠানো হয়নি তো?’
‘টাকা পাঠানো পালিয়ে যাবেনি। তুমি এখন টাকা রাখ। তোমার দরকার হবে। ফিরে এসে দিও।’
বলরাম চলে যাচ্ছিল, কী মনে করে ফিরে এল। বলল, ‘তোমার সঙ্গে দেখা করতে একজন বাবু এসেছিল। বলল, তোমাকে কিছুতেই মোবাইলে পাচ্ছে না। খুব দরকার। একটা চিঠি দিয়ে গেছে।’
বলরাম শার্টের বুক পকেট থেকে একটা দোমড়ানো কাগজ বার করে আদিত্যর হাতে দিল। আদিত্য দেখল স্যমন্তকদের দলের সুদীপ্ত চিঠি লিখেছে। সুদীপ্ত লিখেছে,
আদিত্যবাবু, আপনাকে কিছুতেই ফোন করে পাচ্ছি না। তাই ঠিকানা খুঁজে মেসে চলে এলাম। এসে শুনলাম এখানেও আপনি নেই। আপনার নাকি একটা অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। বন্ধুর বাড়িতে আছেন। আমি নীলাঞ্জন মৈত্রর ডেরার সন্ধান পেয়েছি। সেটা জানাতেই এখানে আসা। সুস্থ হলে ফোন করবেন। ইতি সুদীপ্ত।
আদিত্যর মনটা হঠাৎ খুশিতে ভরে গেল। কেন, আদিত্য জানে। নীলাঞ্জন মৈত্রকে না দেখলে মন্দাকিনী চৌধুরির ছবিটা সম্পূর্ণ হবে না। বলরামের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আদিত্য গাড়িতে উঠে পড়ল।
বিকেলের দিকে সে বসে বসে ল্যাপটপে রিপোর্টটা টাইপ করছে এমন সময় মোবাইল বেজে উঠল। গৌতম ফোন করছে। গৌতম দাশগুপ্ত, আইপিএস, আদিত্যর সঙ্গে কলেজে পড়ত, এখন কলকাতা পুলিশের জয়েন্ট কমিশনার, ক্রাইম। হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে গৌতমের গমগমে গলা,
‘ব্যাপারটা কী? তোর তো পাত্তাই নেই। আছিস কেমন?’
‘ভাল নেই। কিছুদিন আগে গুন্ডারা ঠেঙিয়েছে। আপাতত মাথায় ব্যান্ডেজ বেঁধে অমিতাভদের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছি।’ আদিত্য নিরীহ গলায় বলল।
‘সে কী রে? তোকে গুন্ডারা ঠেঙিয়েছে? তুই তো আমাদের সময় বক্সিং-এ ইন্টারকলেজ চ্যাম্পিয়ান ছিলি। কুং ফু, তাই কোয়ান ডো এসবও শিখেছিলি তো। তোকে গুন্ডারা ঠেঙালো?’ গৌতমের গলায় অকৃত্রিম বিস্ময়।
‘বুড়ো হয়ে যাচ্ছি রে। রিফ্লেক্স চলে যাচ্ছে। মহাভারতের সেই জায়গাটা মনে নেই? যেখানে অর্জুন বুড়ো হয়ে গেছে। গাণ্ডীব তুলতে পারছে না। তার সামনে দিয়ে সাধারণ দস্যুরা সুভদ্রাকে হরণ করে নিয়ে যাচ্ছে।’
‘খুব মনে আছে। এটা নিয়ে বিষ্ণু দের একটা কবিতা ছিল, সেটাও মনে আছে।’ কলেজ জীবনে গৌতম খুব কবিতা পড়ত। লুকিয়ে লুকিয়ে লিখতও এক-আধটা। তখন কেউ ভাবতেই পারেনি সে ভবিষ্যতে পুলিশের বড় কর্তা হবে।
‘তোকে আমিই ফোন করতাম। ওই গুন্ডাগুলোর একটা হদিশ করা দরকার। জানা দরকার কে তাদের পাঠিয়েছিল। কিন্তু এই গুন্ডাদের পেছনে একটা ইতিহাস আছে। আগে সেটা তোকে বলতে চাই। তুই অমিতাভদের বাড়িতে একদিন সন্ধের দিকে আয় না। আমি আরও সপ্তাহ খানেক এখানে আছি। কাজের কথাও হবে, আড্ডাও মারা যাবে।’
‘যেতে হলে তো আজকেই যেতে হয়। মালিনী মেয়েকে নিয়ে ক’দিনের জন্য দিল্লি গেছে, কাল ফিরবে। মেয়ে-বউ ফিরে এলে সন্ধেবেলা বেরোনোটা শক্ত হয়ে যাবে। আমি বরং আজই যাব। তবে যেতে যেতে আটটা হয়ে যাবে।’
‘চলে আয় তাহলে। আমি অমিতাভ আর রত্নাকে বলে রাখব।’
(২)
আজ অনেকদিন পরে আদিত্য আপিসে এসেছে। আদিত্য যখন অমিতাভ-রত্নাদের বাড়িতে একটু একটু করে সেরে উঠছে তখন আপিস ঘরটা বন্ধই পড়েছিল। গতকাল সন্ধেবেলা মেসে ফিরে এসেছে আদিত্য। ফিরে বিমলকে ফোন করেছিল। বিমলকে বলেছে সে যেন আজ আদিত্যর সঙ্গে আপিসে এসে দেখা করে। এতদিন বন্ধ পড়েছিল বলে ঘরের ভেতরে একটা দম চাপা গন্ধ হয়েছে। আদিত্য রাস্তার দিকের জানলাগুলো খুলে দিল। আর অমনি বেলা এগারোটার কর্মচঞ্চল বউবাজার স্ট্রিটটা যেন ঘরের ভেতরে ঢুকে পড়ল।
টেবিলের ওপর বেশ ধুলো জমেছে। মেঝেতেও ধুলো। জমাদারটা ফাঁকি মেরেছে ক’দিন, বোঝাই যাচ্ছে। ওর কাছে চাবি দেওয়া আছে, চাবি খুলে ওর রোজ ঘর পরিষ্কার করার কথা। কাল তাড়াতাড়ি এসে ওকে ধরতে হবে। মন্দাকিনী চৌধুরির কেসটা তো শেষই হয়ে গেল। কিন্তু সত্যটা ঠিক জানা হল না। রিপোর্টটা অনেকখানি লেখা হয়ে গেছে। কিন্তু পুরো সত্যটা না জানলে সে রিপোর্টটা শেষ করবে কী করে? তাছাড়া সত্য জানার কিছু খরচ এখনও বাকি আছে। অর্থাৎ কিছু খরচসাপেক্ষ তদন্ত এখনও বাকি। তাই আদিত্য খরচের বিলটাও জমা দিতে পারছে না। এদিকে মন্দাকিনীর সেক্রেটারি ফোন করে রিপোর্টের জন্য তাগাদা দিয়েছে। রিপোর্টের জন্য এত তাড়া কীসের? এখনও অনেক কাজ বাকি আছে। তার মধ্যে একটা বড় কাজ নীলাঞ্জন মৈত্রর সঙ্গে দেখা করা।
গৌতমের ফোন এল বিকেলের দিকে।
‘তোর গুন্ডারা মনে হয় ধরা পড়েছে। দেখছি, একজনের হাতে প্লাস্টার, আর একজনের নাকে ব্যান্ডেজ। ভালোই প্যাঁদানি খেয়েছে তোর কাছে। তুই এদের দেখলে চিনতে পারবি?
‘মনে হয় পারব।’
‘তাহলে লালবাজার চলে আয়। কতক্ষণে আসতে পারবি?’
‘আপিসে আছি। মিনিট দশেকে পৌঁছে যাচ্ছি।’
মস্তান দুটি মানিকজোড়, নাম হীরা-মোতি। ছিঁচকে গুন্ডা, ইংরেজি করে বললে, স্মলটাইম ক্রুক। আদিত্য তাদের এক ঝলক দেখেই চিনতে পারল। গুন্ডা দুজন আদিত্যর দিকে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিল আবার।
আদিত্য গৌতমের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘এনারাই সেই দুই মহাত্মা। আমি একশ ভাগ নিশ্চিত ওরাই আমাকে গঙ্গার ধারে অ্যাটাক করেছিল। কে ওদের পাঠিয়েছিল কিছু বলেছে?’
‘বলছে, কালো চশমা পরা মাথায় ঢেউ খেলানো বাবরি চুলওলা একটা লোক ওদের হায়ার করেছিল। লোকটাকে ওরা চেনে না। লোকটা ওদের এক পরিচিতের নাম বলে ওদের সঙ্গে দেখা করে। সেই পরিচিতকে আমরা জিজ্ঞেস করেছিলাম। সে বলছে, ওরকম কোনও লোককে সে হীরা-মোতির কাছে পাঠায়নি। যাই হোক, কালো চশমা পরা বাবরি চুলের লোকটি হীরা-মোতিকে কাজটা করার জন্য কিছু অগ্রিম টাকা দিয়েছিল। বেশ ভাল টাকা। বলেছিল, কাজ শেষ হয়ে গেলে আরও দেবে। তবে সাবধান করে দিয়েছিল শুধু পেটাই করতে হবে। খুনোখুনি যেন কিছুতেই না হয়। আর বলেছিল যাকে পেটাই করতে হবে সে অতি নিরীহ একজন লোক, অতএব কাজটাতে ঝক্কি কিছু নেই। তাই ওরা যন্ত্র সঙ্গে রাখেনি। শুধু ছুরি আর ছোট লাঠি নিয়ে বেরিয়েছিল। হীরা বলছে, সে ছুরি বার করেছিল শুধু ভয় দেখাবার জন্য, মারার জন্য নয়। হীরাকে জখম দেখে মোতি লাঠি চালিয়েছে।’
আদিত্যর চকিতে মনে পড়ে গেল জনৈক কালো চশমা, ঘাড় পর্যন্ত চুলওলা লোক তার আপিসে এসে তার খোঁজ করছিল। আগরওয়াল যাকে ভাগিয়ে দিয়েছিল। এই বাবরি চুল কি সেই বাবরি চুল? সে মুখে বলল, ‘কালো চশমা বাবরি চুলের কোনও হদিশ পাওয়া যাচ্ছে?’
‘নাঃ। মনে হয় পাওয়াও যাবে না। বলাই বাহুল্য লোকটা ছদ্মবেশে ছিল।’
‘এদের থার্ড ডিগ্রি করে আর কিছু যদি বার করতে পারিস জানাস।’
(৩)
হাওড়া থেকে কর্ড লাইনে বর্ধমান যাবার ট্রেনে উঠে তিনটে স্টেশন পেরোলেই ডানকুনি। ডানকুনির পর গোবরা আর গোবরা এলেই সতর্ক হয়ে যেতে হবে। কারণ তার পরের স্টেশন জনাই রোডে নেমে পড়া দরকার। স্টেশনে নেমে সাইকেল রিক্সা ধরে চণ্ডীতলার জমিদার বাড়ি অব্দি যেতে বেশিক্ষণ লাগার কথা নয়। সেখানে পৌঁছে জিজ্ঞেস করতে হবে লক্ষ্মী সাঁতরার বাড়িটা কোথায়। বাড়িটা নীল রঙের, তিনতলা। সেই বাড়ির একতলায় নীলাঞ্জন মৈত্র ভাড়া থাকেন। সুদীপ্ত নীলাঞ্জনের ফোন নম্বরটা জোগাড় করে দিয়েছিল। বাড়ির হদিশটাও। কিন্তু ফোন না করে তো কারও বাড়ি যাওয়া যায় না, বিশেষ করে বাড়ির অধিবাসী যদি নীলাঞ্জন মৈত্রের মতো সমাজ-সংসার থেকে বিচ্ছিন্ন মানুষ হন।
ফোনে আদিত্য বলেছিল সে চৌধুরি পরিবারের ওপর একটা বই লিখছে, যে বই-এ মন্দাকিনী চৌধুরি একটি মুখ্য চরিত্র। নীলাঞ্জন মৈত্র যদি মন্দাকিনীর প্রথম বিবাহিত জীবন নিয়ে দু’চার কথা বলেন তাহলে আদিত্যর খুব উপকার হয়।
‘কিন্তু আমার তাতে কী উপকার হবে?’ নীলাঞ্জন খেঁকিয়ে উঠেছিল।
আদিত্য অবশ্য এই ধরনের প্রতিক্রিয়ার জন্য সম্পূর্ণ তৈরি ছিল। সে বিনীতভাবে বলেছিল, ‘যদি কিছু মনে না করেন তো বলি, আপনার সময়ের জন্য আমি কিছু টাকা দিতে রাজি আছি। দু’হাজার দিলে কি ঠিক হবে?’
‘শুনুন। আমি আপনাকে আধঘণ্টা সময় দেব। এবং তার জন্য আপনি আমাকে পাঁচ হাজার টাকা দেবেন। কিন্তু মনে রাখবেন, আপনার সব প্রশ্নের উত্তর দিতে আমি বাধ্য নই। যে প্রশ্নগুলো উত্তর দেবার যোগ্য মনে করব, শুধু সেই প্রশ্নগুলোরই উত্তর দেব। আমার এই শর্তে রাজি থাকলে আপনি সামনের রবিবার সকাল দশটায় আমার বাড়ি চলে আসতে পারেন।’
রাজি না হয়ে আদিত্যর উপায় কী?
আদিত্য এখন নীলরঙের তিনতলা বাড়িটার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ঠান্ডা মফস্বলে রবিবারের সকাল। রাস্তার ধার দিয়ে দু-একটা রিক্সা যাচ্ছে, মাঝে মাঝে লরি। এ-রাস্তায় মনে হয় বাস-টাস চলে না। বাড়িটার সামনে রাস্তার ওপর একটা নিমগাছ ডালপালা মেলে দিয়েছে। ডালপালার ভেতর দিয়ে ঝিরঝিরে হাওয়া দিচ্ছে। বাড়িটার পাশে একটা সাইকেল সারাই-এর দোকান, একটা ভাতের হোটেল, একটা ছাঁট লোহার আড়ত। আদিত্য ভাবছিল, কতদিন কলকাতার বাইরে আসা হয় না, তবু এই নীলাঞ্জন মৈত্রের সঙ্গে দেখা করার অজুহাতে একটু বেড়ানো হল। বস্তুত, কর্মসূত্রে এদিকটায় না এলে এমন নিরাভিমান জায়গাটা দেখাই হত না। একটা চায়ের দোকান থাকলে দাঁড়িয়ে এক কাপ চা খাওয়া যেত, কিন্তু ধারে কাছে কোথাও চায়ের দোকান চোখে পড়ল না।
আদিত্য যখন রাস্তায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এসব ভাবছে, হঠাৎ নীলবাড়ির একতলার একদিকে একটা দরজা খুলে গেল। পাজামা-পাঞ্জাবি পরা এক ভদ্রলোক বেরিয়ে এলেন। একটু দূর থেকে আদিত্যকে দেখে চেঁচিয়ে বললেন, ‘আপনিই আদিত্য মজুমদার? কলকাতা থেকে আপনারই আসার কথা ছিল?’
কথা বলতে বলতে ভদ্রলোক আদিত্যর কাছে এগিয়ে এসেছেন। ছিপছিপে মেদহীন দেহ, একমাথা উস্কোখুস্কো চুল, মাঝারি উচ্চতা, হাড়ালো লম্বাটে মুখ, গালে চাপ দাড়ি, চোখে পুরু কাচের চশমা।
‘হ্যাঁ আমিই আদিত্য মজুমদার। আপনি নিশ্চয় নীলাঞ্জনবাবু।’ আদিত্য হাত তুলে নমস্কার করল। উত্তরে নীলাঞ্জন মৈত্র নমস্কার করার সৌজন্যটুকুও দেখালেন না। শুধু সংক্ষিপ্তভাবে বললেন, ‘ভেতরে চলুন।’
নীলাঞ্জন মৈত্রর ঘরটা নেহাত ছোট নয়, কিন্তু ঘরের দৈর্ঘ্যের তুলনায় জিনিসপত্র অনেক বেশি। অবশ্য জিনিস বলতে মূলত বই। ছাদ পর্যন্ত বই-এর তাক, তাতে ভর্তি বই, এতেও সব বইকে জায়গা দেওয়া যায়নি। বাড়তি বইগুলো কেউ মেঝেতে, কেউ টেবিলের ওপর জায়গা পেয়েছে। এছাড়াও ঘরের একদিকে রয়েছে একটা রেকর্ড প্লেয়ার, যেরকমটা তিরিশ-চল্লিশ বছর আগে পাওয়া যেত। রেকর্ড প্লেয়ারের আশেপাশে অনেকগুলো রেকর্ড ছড়ানো, প্রতিবাদী সঙ্গীত, পল রোবসন, পীট সিগার্সের পাশে আইপিটিএ-র গান। তার সঙ্গে কিছু রবীন্দ্রসঙ্গীত, বেশিরভাগ দেবব্রত বিশ্বাসের গাওয়া। একদিকের দেওয়াল জুড়ে একটা পুরোনো ক্যানভাস, মনে হয় সেটা এক সময় কোনও নাটকের সেট ছিল। একটা লেখার টেবিল। তার ওপরেও উপুড়-চুপুড় বই। কার্ল মার্কসের ছবি। পাশেই রবীন্দ্রনাথের আবক্ষ মূর্তি। এই সবের মাঝে একটা তক্তপোশ, আদিত্য কোনওরকম অনুমতির তোয়াক্কা না করে তার ওপর বসে পড়ল। টাকা দিয়ে যখন সময় কিনছে তখন অকারণ বিনয়ী হবার মানে হয় না। আদিত্যকে নিজের থেকেই বসতে দেখে, নীলাঞ্জনও তক্তপোশের ওপর বসল।
আদিত্য লক্ষ করেছিল টেবিলের ওপর অ্যাস্ট্রেটা উপচে পড়ছে। সে পকেট থেকে সিগারেট বার করে নীলাঞ্জনকে বলল, ‘চলবে?’ পরে সে নীলাঞ্জনকে একটা সিগারেট দিয়ে নিজে একটা ধরালো।
খানিকক্ষণ নীরবে ধূমপান করার পর আদিত্য বলল, ‘আমাদের সময় যেহেতু খুব বেশি নেই, সরাসরি কাজের কথায় আসি। আপনার সঙ্গে মন্দাকিনী চৌধুরির পরিচয় কীভাবে হয়?’
নীলাঞ্জন মনে হয় তৈরি ছিল। বলল, ‘আমার সঙ্গে মন্দাকিনীর যখন পরিচয় হয় তখন সে চৌধুরিও ছিল না, মৈত্রও ছিল না। তখন সে ছিল মন্দাকিনী চক্রবর্তী। রিফিউজি বাড়ির মেয়ে, একাত্তরের যুদ্ধের পর পরিবারটা বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে হিলিবর্ডার দিয়ে ভারতে ঢোকে। মন্দাকিনীর বয়েস তখন বছর দেড়েক হবে। ওদের বাড়ি ছিল বাংলাদেশের হাকিমপুরে। সেখানে মন্দাকিনীর বাবা ইস্কুলে পড়াতেন। এপারে এসে কিছুদিন ওরা হিলির কাছেই চাপাহাট বলে একটা জায়গায় এক আত্মীয়ের বাড়িতে থাকত। তারপর মন্দাকিনীর বাবা বালুরঘাটে একটা ইস্কুলে চাকরি পেয়ে যান। মন্দাকিনী বালুরঘাটেই বড় হয়েছে, সেখান থেকেই ইস্কুল-কলেজ পাশ করেছিল।’
একটু থেমে নীলাঞ্জন আবার শুরু করল। ‘আপনার জানা আছে কিনা জানিনা, বালুরঘাটে থিয়েটরের একটা পুরোনো ট্র্যাডিশন আছে। নাট্যকার মন্মথ রায় বালুরঘাটেই থাকতেন, বালুরঘাটের কোর্টে ওকালতি করতেন। মন্দাকিনী বালুরঘাটে ইস্কুলে পড়ার সময় থেকেই অভিনয় শুরু করে। পরে কলেজে উঠে গ্রুপ থিয়েটারে নিয়মিত অভিনয় করত। আমাদের দল একবার বালুরঘাটে শো করতে গেল। যতদূর মনে পড়ছে, কোনও নাট্যোৎসব বা ওই রকম কিছু একটা ছিল। সেখানেই মন্দাকিনীর সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়।’
‘তারপর? মন্দাকিনী বালুরঘাট থেকে কলকাতায় এলেন কবে?’
‘মন্দাকিনী চক্রবর্তী ছিল অসম্ভব অ্যামবিশাস একটি ক্যারেকটার, সে বালুরঘাটে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেবার মতো মেয়ে ছিল না। জীবনের বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ব্যক্তিকে ধরে সে সিঁড়ি বেয়ে উঠেছে। আনফরচুনেটলি, তার প্রথম সোপান ছিলাম আমি। কলকাতায় ফিরে আসার কিছুদিন পরেই মন্দাকিনী আমার সঙ্গে যোগাযোগ করল। বলল, সে কলকাতার স্টেজে নাটক করতে চায়। স্বীকার করতেই হবে, মফস্বলের সেই অল্পবয়সি সুন্দরী মন্দাকিনীর প্রতি প্রথম দর্শনেই আমার একটা টান তৈরি হয়েছিল। আমার ভেতরের বোকা পুরুষটা ভাবল, এই অসহায় মেয়েটাকে প্রোটেকশন দেওয়া অতি পবিত্র একটা কর্তব্য। আমি তাকে আমাদের দলে নিয়ে নিলাম। মন্দাকিনী কলকাতায় এসে বাগবাজারের দিকে একটা মেয়েদের হস্টেলে উঠল। নিয়মিত আমাদের নাটকে অভিনয় করতে শুরু করল।’
‘সেই সময় মন্দাকিনীর চলত কী করে?’
‘খুব কষ্ট করে চলত। কয়েকটা টিউশনি আর ভোরবেলা একটা নার্সারি ইস্কুলে বাচ্চাদের পড়ানোর কাজ। আমি ভাবতাম, নাটকের প্রতি মেয়েটার ডেডিকেশন আছে বটে। শুধুমাত্র নাটক করবে বলে দাঁতে দাঁত চেপে কলকাতায় পড়ে আছে। আসলে, নাটকের জন্য নয়, দাঁতে দাঁত চেপে কলকাতায় পড়ে থেকে মন্দাকিনী তার পরবর্তী সুযোগটার জন্য অপেক্ষা করছিল।’
‘মন্দাকিনীর সঙ্গে আপনার বিয়েটা কবে হল?’
আদিত্য দ্রুত নোট নিচ্ছিল। তার মোবাইলের রেকর্ডারটা কয়েক দিন হল গন্ডগোল করছে। সস্তার জিনিস হলে যা হয়। ভাগ্যিস আগের রেকর্ডিংগুলো ল্যাপটপে তুলে রেখেছিল।
নীলাঞ্জন পকেট থেকে বিড়ির কৌটো বার করে একটা বিড়ি ধরাল। লম্বা টান দিয়ে বলল, ‘মন্দাকিনী কলকাতায় আসার কিছুদিন পর থেকেই আমি তার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছিলাম। বছর দেড়েকের মাথায় তাকে বিয়ে করে ফেললাম। রাজবল্লভ পাড়ায় একটা দু-কামরার ভাড়া করা ফ্ল্যাটে আমাদের দাম্পত্য শুরু হল। আমি তখন একটা ব্যাঙ্কে চাকরি করি। কিন্তু ধ্যান-জ্ঞান বেঁচে থাকার ধারণা সবই থিয়েটার ঘিরে। মন্দাকিনী সেই ধারণার মধ্যে চমৎকার ফিট করে গেল। অন্তত আমার মনে হল, ফিট করে গেল। আসলটা যাই হোক। একটা কথা মানতেই হবে। মন্দাকিনীর অভিনয় প্রতিভা ছিল অতুলনীয়। আমার নাটকগুলো বেশিরভাগ সময়েই পাবলিক নিত না। সমালোচকরাও আমার প্রতি খুব একটা সদয় ছিলেন না। কিন্তু প্রায় সমস্ত ক্ষেত্রেই মন্দাকিনীর অভিনয় অকুণ্ঠ প্রশংসা পেত।’
‘আপনাদের বিবাহিত জীবন কতদিন চলেছিল?’
‘প্রায় পনেরো বছর। প্রথম পাঁচ বছর স্বপ্নের মতো কেটে গিয়েছিল। থিয়েটার, থিয়েটার আর থিয়েটার। আর কিচ্ছু মাথায় ছিল না। ঝোঁকের মাথায় চাকরিটাও ছেড়ে দিলাম। ফুল টাইম থিয়েটার করব। মন্দাকিনী তখন কয়েকটা সিরিয়ালে কাজ করতে শুরু করেছে। বেশ নাম করছে। তার টাকাতেই সংসার চলত। ইতিমধ্যে আমাদের মেয়ের জন্ম হয়েছে। একটু একটু করে সংসারে টাকার চাহিদা বাড়ছে।’
‘আপনার কি কোনও রোজগারই ছিল না?’
‘প্রায় ছিল না বললেই হয়। কালেভদ্রে আমিও দু’একটা সিরিয়ালে কাজ করতাম। কিন্তু খুব একটা সুবিধে করতে পারিনি। আসলে ওই প্যানপ্যানে গল্প কিংবা চড়া দাগের মেলোড্রামা আমি ভেতর থেকে ঘৃণা করতাম। তাই কখনোই মন লাগিয়ে কাজ করতে পারিনি। এদিকে মন্দাকিনী সিরিয়ালের কাজে ব্যস্ত থাকার অছিলায় নাটকে অভিনয় করা একেবারে বন্ধ করে দিল। এই সময় থেকেই মন্দাকিনীর সঙ্গে আমার সম্পর্কটা খারাপ হতে শুরু করে।’
‘তারপর?’
‘এরপর মন্দাকিনী বড় পর্দায় কয়েকটা ব্রেক পায়। আরও আরও নাম করতে থাকে। এবং আমাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করতে শুরু করে। একটু নাম হবার পর মন্দাকিনী টালিগঞ্জ অঞ্চলে নতুন ফ্ল্যাট ভাড়া করে চলে গেল। আমি রাজবল্লভ পাড়ার বাড়িতেই রয়ে গেলাম। আমাদের মেয়ে শান্তিনিকেতনে থেকে লেখাপড়া করতে লাগল। আপ্রাণ চেষ্টা করতাম আমাদের খারাপ সম্পর্কের আঁচটা যেন তার গায়ে না লাগে।
‘সুবীর চৌধুরির সঙ্গে মন্দাকিনীর কবে পরিচয় হল?’
‘হয়ত আমরা যখন একসঙ্গে রাজবল্লভ পাড়ায় থাকতাম তখনই হয়েছিল। কিংবা আমরা তখন আলাদা বাড়িতে থাকছি তখনও হতে পারে। এ-ব্যাপারটা আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারব না।। মন্দাকিনী কীভাবে তার কেরিয়ার গুছিয়ে নিচ্ছে, আমার কোনও ধারণাই ছিল না। হঠাৎ একদিন খবর কাগজে দেখলাম ধনী ব্যবসায়ী সুবীর চৌধুরির সঙ্গে মন্দাকিনীর প্রবল ফষ্টিনষ্টি চলছে। আমরা তখন আলাদা বাড়িতে থাকতে শুরু করেছি।’
‘কিন্তু তখনও তো আপনাদের ফরমালি ডিভোর্স হয়নি?’
‘না, তখনও হয়নি। হঠাৎ একদিন মন্দাকিনীর ফোন। বলল, সে সুবীর চৌধুরিকে বিয়ে করতে চায়। তার জন্য আমার সঙ্গে বিবাহ-বিচ্ছেদ দরকার। আমার অবস্থা তখন একেবারে তলানিতে। আর্থিকভাবে, মানসিকভাবে। নাটক, যা নিয়ে এতদিন বেঁচে ছিলাম, পয়সার অভাবে তাও নামাতে পারছি না। দলটাও প্রায় ভেঙে যাবার মুখে। আমি মন্দাকিনীকে বললাম, ডিভোর্স দিতে পারি, কিন্তু তার জন্য এক লক্ষ টাকা লাগবে। মন্দাকিনী সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেল। এখন মনে হয়, এক লক্ষের বদলে দশ লক্ষ চাইলে ঠিক হত।’
‘এখন আপনার কীভাবে সময় কাটে?’
‘কীভাবে চলে জিজ্ঞেস করছেন? সুন্দরবনের দিকে একটা ইস্কুল চালাই। নাটকটাও পুরোপুরি ছাড়তে পারিনি। একটা পেট, কোনওরকমে চলে যায়। খুব ভাল চলে না। সব সময় টাকার দরকার। সেইজন্য আপনার সঙ্গে টাকার কথাটা সোজাসুজি বলে নিলাম।’
নীলাঞ্জন আর একটা বিড়ি ধরাল। নোটবইটা পকেটে পুরে উঠে দাঁড়াল আদিত্য। বুক-পকেট থেকে দশটা পাঁচশ টাকার নোট বার করে নীলাঞ্জনের হাতে দিয়ে বলল, ‘একটা অন্য কথা জিজ্ঞেস করছি। আপনার টেবিলে দেখছি মার্ক-এর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ সহাবস্থান করছেন। দুজনকে মেলাতে অসুবিধে হয় না?’
প্রশ্নটা শুনে নীলাঞ্জন কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। মনে হয় অবাক হয়েছে। মুখে বলল, ‘আপনার আবার এসব দিকেও মন আছে নাকি? ভাল, ভাল।’
তারপর একটু চুপ করে থেকে বলল, ‘মন দিয়ে রবীন্দ্রনাথের সামাজিক প্রবন্ধগুলো পড়বেন। পড়লে দেখবেন, পাতায় পাতায় সাম্যের কথা বলা হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ বলছেন, আমাদের গ্রামীণ সমাজে সাম্য আনাটাই সব থেকে জরুরি। মার্কের সঙ্গে এর তফাত কোথায়? অবশ্য রবীন্দ্রনাথ ব্যক্তিমানুষকে প্রাধান্য দিয়েছেন, মার্ক দেননি। যাগ্গে, আপনার সঙ্গে এসব জ্ঞানের কথা বলে সময় নষ্ট করার মানে হয় না। আপনার কাজ তো হয়ে গেছে। এবার আসুন। নমস্কার।’
নীলাঞ্জনের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আদিত্য ঘড়ি দেখল। দেড়টা বাজে। বেশ খিদে পেয়েছে। স্টেশন অব্দি যেতে পারলে একটা-দুটো ভাতের হোটেল নিশ্চয় পাওয়া যাবে। কিন্তু অত দূর যাবার দরকার কী? নীলাঞ্জনের বাড়ির পাশেই তো একটা হোটেল রয়েছে। মোটামুটি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। আদিত্য সেখানেই ঢুকে পড়ল। ব্ল্যাকবোর্ডে খড়ি দিয়ে লেখা লম্বা মেনু। দু’একটা আইটেমের পাশে ঢ্যাঁড়া পড়ে গেছে। আদিত্য ধরে নিল সেগুলো হয় ফুরিয়ে গেছে কিংবা সেদিন রান্নাই হয়নি। হোটেলে বেশ ভিড়। এটাই দুপুরে ভাত খাবার পিক আওয়ার। আদিত্য একটা টেবিলের এককোণে একটু জায়গা পেয়ে বসে পড়ল। যে লোকটার পাশে গিয়ে আদিত্য বসল তাকে তখনও খাবার দেওয়া হয়নি। সদ্য ধোয়া কলাপাতায় সবে নুন আর লেবু পড়েছে।
একটু পরে হোটেলের পরিচারক এসে আদিত্যর সামনেও নুন-লেবু-কলাপাতা সাজিয়ে দিয়ে অর্ডার নিয়ে চলে গেল। পাশের লোকটির মতো সে-ও অপেক্ষা করছে এমন সময় লোকটি বলল, ‘আপনাকে তো এদিকে আগে কখনও দেখিনি। নতুন এলেন নাকি?’
‘এই একটা কাজে এসেছিলাম।’ আদিত্য সংক্ষিপ্তভাবে বলল।
‘কী কাজ? কারও বাড়িতে এসেছিলেন?’ এই মফস্বলে বোধহয় প্রাইভেসি বলে কিছু নেই।
‘এখানে নীলাঞ্জন মৈত্র থাকেন, তাঁর সঙ্গে একটু দরকার ছিল।’
‘নীলাঞ্জন মৈত্র? ওই চশমা পরা দাড়িওলা ভদ্রলোক? লক্ষ্মী সাঁতরার বাড়ির একতলায় যিনি ভাড়া থাকেন? উনি তো বেশিরভাগ দিনই এখানে থাকেন না। কোথায় যে থাকেন, কে জানে। করেন কী ভদ্রলোক?’
‘আমি যতদূর জানি সুন্দরবনের দিকে একটা ইস্কুল চালান। আমি সেখানেই একটা চাকরির খোঁজে এসেছিলাম।’
‘অ, তাই বুঝি? তা অতদূরে গিয়ে চাকরি করা পোষাবে?’
ভাগ্যক্রমে আদিত্যকে আর উত্তরটা দিতে হল না, কারণ ইতিমধ্যে ভাত-ডাল-ভাজা এসে গেছে। ফেরার ট্রেনে জানলার ধারে বসে বসে আদিত্য নীলাঞ্জন মৈত্রর কথাই ভাবছিল। লোকটাকে দেখে খারাপ লাগে। ঠিক যেন সত্তর-আশি দশকের বামপন্থী সিনেমা-উপন্যাস থেকে উঠে আসা একটা ব্যর্থ আদর্শবাদী চরিত্র।
(৪)
রিপোর্টটা শেষ করতে করতে এর পরের তিনটে দিন লেগে গেল। মন্দাকিনীর সেক্রেটারি মেয়েটি তাগাদা দিয়ে আবার ফোন করেছিল। অতএব রিপোর্ট না শেষ করে উপায় কী? রিপোর্টটা জমা দেবার পর আদিত্যর হাতে আর কোনও কাজ রইল না। রিপোর্টের সঙ্গে সঙ্গে তার খরচ এবং পারিশ্রমিকের বিলটাও জমা দিয়ে এসেছে, যদিও আদিত্যর ধারণা কিছু খরচ এখনও বাকি আছে। টাকাটা পেয়ে গেলে কি তবে চৌধুরি বাড়ির সঙ্গে আর কোনও সংস্রব থাকবে না? আদিত্যর ইন্টুইশন বলছে এরকম হতেই পারে না। শিগগির কিছু একটা ঘটতে চলেছে।
তার ইন্টুইশনের মুখে ছাই দিয়ে ঘটনাবিহীন আরও দশটা দিন কেটে গেল। গতকাল চৌধুরি এন্টারপ্রাইজের থেকে কুরিয়ারে চেক এসে গেছে। আদিত্য যা বিল করেছিল পুরোটাই দিয়ে দিয়েছে। বিমলের কিছু টাকা পাওনা আছে তাই বিমলকে ফোন করার চেষ্টা করল আদিত্য। ফোন বন্ধ। রেকর্ডেড ম্যাসেজ বলছে, নম্বরটি উপলব্ধ নেই। বিমলের জন্য আদিত্যর একটু চিন্তা হচ্ছে। ফোন বন্ধ কেন? গেল কোথায় ছেলেটা?
ইতিমধ্যে একটা-দুটো নতুন কাজ হাতে এসেছিল। আদিত্য নেয়নি। মনটা অস্থির অস্থির লাগছে। চৌধুরি বাড়ির ব্যাপারটার একটা হেস্তনেস্ত না হলে আদিত্য কোনও কাজে মন দিতে পারছে না। এমনকি গান শুনতেও ভাল লাগছে না। যে টাকাটা পাওয়া গেছে তাতে আগামী তিন-চার মাস কোনও কাজ না করলেও আরামসে চলে যাবে।
বেশ গরম পড়ে গেছে। দুপুরে রাস্তায় বেরোতে কষ্ট হয়। আদিত্যর মেসের ঘরটার থেকে আপিস ঘরটা একটু ঠান্ডা। কাজ না থাকলেও তাই আদিত্য রোজ আপিসে গিয়ে বসে। দুপুরে চেয়ারে বসে বসেই একটু ঘুমিয়ে নেয়। বিকেলে ল্যাপটপে এটা-ওটা দেখে। মন ভাল নেই। একটা চাপা অতৃপ্তি।
সেদিন একটু বেলা করে আদিত্যর আপিসে স্যমন্তক এল। ফোন করেই এল। বলল, ‘তুই কেমন গোয়েন্দাগিরি করছিস সচক্ষে দেখতে এলাম।’
আসলে স্যমন্তক রাধাবাজারে একটা ঘড়ি সারাতে দিয়েছে। ঘড়িওলা বলেছে এক ঘণ্টা ঘুরে আসতে। এক ঘণ্টা কী করে কাটাবে, তাই আদিত্যর আপিস। স্যমন্তকের সঙ্গে ঘণ্টাখানেক গেঁজাতে মন্দ লাগল না।
স্যমন্তক চলে যাবার পর আদিত্য চেয়ারে বসে বসে একটু ঘুমিয়ে নেবার চেষ্টা করল। কিন্তু ঘুমোবে কী, যা গরম। পাখার হাওয়াটাও গরম হয়ে গেছে। তার ওপর অসহ্য হিউমিডিটি, দরদর ঘাম। আসলে চারতলা বলে গরমটা বেশি। মাথার ওপরেই ছাদ। তার মেসবাড়ির ঘরটাও ছাতের ঠিক নীচে তবে তার অবস্থা আরও খারাপ। আপিস বাড়িটা সেকালের বাড়ি বলে সিলিংটা অনেকটা উঁচুতে আর তাতেই খানিকটা রক্ষে।
বিকেল থেকে একটু একটু করে আকাশে মেঘ জমতে শুরু করল। আধঘণ্টার মধ্যে আকাশ একেবারে কালো। তাপমাত্রা কয়েক ডিগ্রি কমে গেছে। আদিত্যর মনে হল এবার ঝেঁপে বৃষ্টি আসবে। এক কাপ চা পেলে মন্দ হত না। সে মোবাইলটা বার করে শ্যামলকে চা আনতে বলবেভাবছে এমন সময় চারদিক কাঁপিয়ে একটা ভয়ানক ঝড় উঠল। আর ঠিক তখনই, চারুলতা সিনেমায় ঝড়ের মধ্যে অমল যেভাবে প্রথম প্রবেশ করেছিল অনেকটা সেভাবে, আদিত্যর মোবাইলটা বাজতে শুরু করল।
ওপারে গৌতমের গলা। বেশ উত্তেজিত। ‘শোন, খবর আছে। দার্জিলিং থেকে কিছু দূরে, ছংটংচা বাগানের কাছে, একটা হন্ডা অ্যাকর্ড গাড়ি পাহাড় থেকে পড়ে একেবারে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেছে। এটা ঘটেছে দিন চারেক আগে। গাড়িটাতে আগুন লেগে গিয়েছিল। গাড়ির ভেতর থেকে একটা একেবারে ঝলসে যাওয়া বডি পাওয়া গিয়েছিল। ঘটনাস্থলে পৌঁছতে স্থানীয় পুলিশের মনে হয়ে একটু দেরি হয়ে গেছিল। বডিটা পচে যাচ্ছিল। তাই পুলিশ পৌঁছনোর আগেই গ্রামের লোক বডি সৎকার করে দিয়েছে। অ্যাক্সিডেন্ট-এর জায়গাটা বেশ দুর্গম। সাধারণ গাড়ি চলাচলের রাস্তায় পড়ে না। শর্ট-কাটের জন্য কেউ কেউ ব্যবহার করে। তবু খোঁজ নিয়ে দেখতে হবে, পুলিশের যেতে অত দেরি হল কেন। এবার আসল কথাটা শোন। বডিটা একজন মহিলার। গাড়ির রেজিস্ট্রেশন নম্বর ধরে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে গাড়ির মালিকের নাম মন্দাকিনী চৌধুরি। বডিটাও সম্ভবত তাঁর। ওই অঞ্চলে চৌধুরিদের একটা চা-বাগান আছে। মন্দাকিনীর সেখানে যাবার কথা ছিল, কিন্তু গিয়ে উঠতে পারেননি। কলকাতার বাড়িতেও ফিরে আসেননি। এখন অবস্থা যা দাঁড়িয়েছে তাতে মৃতার জামাকাপড় আর জিনিসপত্র থেকে তাঁকে শনাক্ত করতে হবে।’
‘ড্রাইভারের খোঁজ পাওয়া গেছে?’
‘এটাও একটা রহস্য। ড্রাইভার বেপাত্তা। তার বডিটাও খুঁজে পাওয়া যায়নি। অবশ্য গাড়িটা ওপর থেকে নীচে পড়ার সময় গাড়ির দরজা খুলে গিয়ে ড্রাইভার ছিটকে বাইরে চলে যেতে পারে। আর অনেক নীচে পড়ে গেলে বডি খুঁজে পাওয়া শক্ত। বুনো জন্তু-জানোয়ারেও খেয়ে ফেলতে পারে। ড্রাইভারের সিট বেল্টটা খোলা ছিল।’
‘তোদের নেক্সট মুভ কী?’
‘আগামীকাল মৃতার জিনিসপত্র কলকাতায় এসে পৌঁছবে। আমরা মন্দাকিনী চৌধুরির মেয়ে সোহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ করছি। তাঁকেই জিনিসপত্র শনাক্ত করতে হবে।’
‘আমি কিন্তু আশঙ্কা করছিলাম এই ধরনের একটা কিছু ঘটতে চলেছে। কেন আশঙ্কা করছিলাম তোকে দেখা হলে বলব। মোদ্দা কথা, আমি খুব একটা অবাক হচ্ছি না। যাই হোক, কাল যখন সোহিনী জিনিসপত্রগুলো দেখতে আসবে আমি কি তখন থাকতে পারি? আমি সোহিনীর সঙ্গেই আসব। তার ভাড়া করা গোয়েন্দা হয়ে। আফটার অল সোহিনীর মায়ের কাছ থেকে আমি ফী নিয়েছি। তাই সোহিনীর ভাল-মন্দ দেখার একটা দায়িত্ব আমার আছে।’
‘তুই অবশ্যই থাকবি। আমাদের তরফ থেকে না হয় সোহিনীর তরফ থেকে। নো প্রবলেম। আমরা আলাদা করে সোহিনীর সঙ্গে কন্ট্যাক্ট করছি।’
মোবাইল নামিয়ে রেখে আদিত্য খানিকক্ষণ চুপ করে বসে রইল। মন্দাকিনী চৌধুরিকে তাহলে বাঁচানো গেল না। মন্দাকিনী নিজেও কি বাঁচতে চেয়েছিল? চাইলে আদিত্যকে সাত তাড়াতাড়ি ছেড়ে দেবে কেন? যেন আদিত্যর সাহায্যর চাইতে তার রিপোর্টটা মন্দাকিনীর বেশি প্রয়োজন ছিল। নাকি আদিত্যর ক্ষমতার ওপর মন্দাকিনী খুব একটা বিশ্বাস রাখতে পারেনি? আদিত্যর রিপোর্ট পাবার পর মন্দাকিনী কি অন্য কাউকে নিয়োগ করেছিল?
কিছুক্ষণ হল ঝড় থেমে গিয়ে মুষলধারায় বৃষ্টি নেমেছে। আদিত্য জানলার কাছে গিয়ে দেখে বৃষ্টির ধারায় বউবাজার স্ট্রিট ঝাপসা হয়ে গিয়েছে। রাস্তায় লোক প্রায় নেই, গাড়িবারান্দাগুলোর নীচে প্রচুর লোক দাঁড়িয়ে রয়েছে। এর মধেই দু-একজন ছাতা মাথায় দিয়ে প্রায় ছুটতে ছুটতে রাস্তা পার হয়ে গেল। আদিত্য একটা সিগারেট ধরাল, তারপর টেবিলের ওপর থেকে মোবাইলটা তুলে নিয়ে আবার জানলার সামনে দাঁড়াল। সোহিনীকে ফোন করতে হবে। কিন্তু নম্বরটা ডায়েল করতে গিয়ে আদিত্যর মনে হল আর একটু অপেক্ষা করা ভাল। পুলিশ আগে খবরটা দিক। খবরটা শোনার পর সোহিনী একটু সামলে নিক। বৃষ্টির মধ্যে ঘন্টি বাজিয়ে ট্রাম যাচ্ছে। আদিত্য ইউ টিউবে নিখিল ব্যানার্জির একটা পুরোনো সুরদাসী মল্লার চাপিয়ে আবার জানলার ধারে এসে দাঁড়াল।
সোহিনী নিজেই ফোন করল মিনিট পনের পরে।
‘আদিত্যবাবু’
তারপর কিছুক্ষণ নীরবতা। সোহিনী বোধহয় কান্না চাপার চেষ্টা করছে। এসব অবস্থায় আদিত্য অসহায় বোধ করে, কী বলবে বুঝে উঠতে পারে না, তার সাংসারিক অভিজ্ঞতা খুবই কম।
‘আদিত্যবাবু, যা ভয় পেয়েছিলাম সেটাই হল।’ আবার বেশ কিছুক্ষণ নীরবতা। ‘পুলিশ আপনাকে তো ফোন করেছিল।’ সোহিনী এবার কান্নায় ভেঙে পড়ল। আদিত্যর মনে হল তার এবার কিছু বলা উচিত। সে বলল, ‘কাল আইডেন্টিফিকেশনের সময়, আপনি যদি চান, আমি আপনার সঙ্গে যেতে পারি।’
‘আপনি অবশ্যই আমার সঙ্গে যাবেন। এটা বলতেই ফোন করেছিলাম।’ সোহিনী খানিকটা সামলে নিয়েছে। ‘আর একটা কথা। মার মৃত্যুর ব্যাপারটা আপনি ইনভেস্টিগেট করুন, এটা আমার একান্ত ইচ্ছে। চৌধুরি এন্টারপ্রাইজের তরফ থেকে আপনাকে নিয়োগ করছি।’
‘আমি আপনার অফার গ্রহণ করলাম। আমার বন্ধু গৌতম দাশগুপ্ত, জয়েন্ট কমিশানার ক্রাইম, কি আপনাকে ফোন করেছিল?’
‘হ্যাঁ, উনিই ফোন করেছিলেন। আপনাকে ঘটনাটা জানিয়েছেন বললেন। আর বললেন, বেলা দুটো নাগাদ লালবাজার পৌঁছতে হবে। আমি আপনাকে তাহলে দেড়টা নাগাদ তুলে নেব। কোথা থেকে তুলব?’
‘আমাকে তুলতে হবে না। আমি নিজেই চলে যাব। আমার আপিস থেকে লালবাজার কয়েক মিনিটের হাঁটা পথ। আমি গৌতমের ঘরেই থাকব। আপনি ওখানেই চলে আসবেন। আমি গৌতমকে বলব গেটে আপনার নামটা দিয়ে রাখতে। নইলে ঢুকতে দেবে না।’
‘ঠিক আছে। কাল দেখা হবে।’
(৫)
কালবৈশাখীর বৃষ্টি বেশিক্ষণ থাকার কথা নয়। অথচ আজ বিকেলের বৃষ্টিটা এখনও ধরল না। বিকেল গড়িয়ে সন্ধে হয়ে গেল, এখনও বৃষ্টি পড়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে রত্না ফোন করেছিল। বলল, ‘চলে আয়, অমিতাভ দুর্দান্ত ইলিশ এনেছে। খিচুড়ি হচ্ছে। রাত্তিরে থেকে যাবি। সুপর্ণ রায়কে মনে আছে? আমাদের সঙ্গে ইকনমিক্স পড়ত? সুপর্ণ ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিকাল ইন্সটিটিউটে চাকরি নিয়ে অ্যামেরিকা থেকে ফিরে এসেছে। ওরাও আসছে। সুপর্ণ তোর তো খুব বন্ধু ছিল।’
আদিত্য বলেছে যাবে। তবে বেরোতে হলে এখনই বেরোতে হয়। একে আপিস ভেঙেছে, তায় বৃষ্টি, এখন ট্যাক্সি পাওয়া অসম্ভব। লাইনে দাঁড়িয়ে মিনিবাস ধরতে হবে। ভাগ্যিস ছাতাটা সঙ্গে আছে।
আদিত্য যখন অমিতাভদের বাড়ি পৌঁছল তখন সোয়া আটটা বেজে গেছে। মিনিবাসের জন্য অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়েছিল, তার ওপর রাস্তায় জ্যাম। ছাতা থাকা সত্ত্বেও বেশ ভিজে গেছে। সুপর্ণরা পৌঁছে গিয়েছিল, বসার ঘরে ঢুকে সুপর্ণকে দেখে আদিত্য প্রথমে চিনতেই পারেনি। মাথা ভর্তি টাক, বেশ মুটিয়েছে। তবে কথাবার্তা সেই একইরকম আছে, খোলামেলা, সহজ-সরল, চাল-চালিয়াতি নেই। সুপর্ণর বউ-এর হাবভাব ঠিক এর উল্টো। কথায় কথায় জানিয়ে দিচ্ছে অ্যামেরিকায় তাদের কত বিত্ত আছে। দুটো গাড়ি আছে, একটা বিএমডাব্লু, একটা টয়োটা লেক্সাস। দ্বিতীয় গাড়িটা নাকি প্রথমটার থেকেও দামি। মস্ত বাড়ি আছে, দুটো বিরাট দামি কুকুর। ঠারেঠোরে বলল, তার নিজের একটুও ইন্ডিয়া আসার ইচ্ছে ছিল না। নেহাত সুপর্ণ আসতে চাইল, তাই আসা।
‘তুই পাকাপোক্তভাবে ফিরে এলি নাকি?’ আদিত্য সরলভাবে জিজ্ঞেস করল।
‘আরে না, না। সেরকম কিছু নয়। ওখানকার চাকরিটা আছে। চাকরি থেকে একবছর ছুটি নিয়ে এসেছি। ওদেশে মাস্টারি করলে চার বছরে এক বছর এই রকম ছুটি পাওয়া যায়। ওরা বলে স্যাবাটিকাল। এক বছরের জন্য এসেছি। তারপর আবার ফিরে যাব। আমরা সকলেই এখন মার্কিনি সিটিজেন। তবে আমার বউ-এর ইচ্ছে ছিল স্যাবাটিকালটা ইউরোপে কাটাতে। অফারও দু-একটা ছিল। সেগুলো না নিয়ে আই এস আই-তে একটা বছর কাটাবো ঠিক করলাম।’
সুপর্ণ খানিকক্ষণ থামল। তারপর একটু থেমে থেমে বলল, ‘দেখ, কাজ-টাজ তো ওখানে ভালই হয়, ঠিকসময় টেনিওরটাও পেয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু এদিকে মার অনেক বয়েস হয়েছে। আমি একমাত্র সন্তান। আমি না দেখলে কে দেখবে? তাই কদিন এখানে থেকে একটু মার দেখাশোনা করব ঠিক করেছি। তাছাড়া আমি চেয়েছিলাম আমার ছেলেমেয়েরা অন্তত কিছুদিন এখানে থেকে ওদের শিকড়টাকে জানুক।’
‘তোর মতো মাতৃভক্ত এবং দেশভক্ত আজকাল বড় একটা দেখা যায় না।’ অমিতাভর গলায় ঠাট্টা।
‘থাকচিস কোথায়?’ আদিত্য জিজ্ঞেস করল।
‘ভবানীপুরের পুরোনো বাড়িটা তো ফাঁকাই পড়ে আছে। মা একটা ঘরে থাকে। মার নার্স-আয়ারা আর একটা ঘর দখল করে রেখেছে। বাকি ঘরগুলো তো বন্ধই পড়ে থাকে।’
‘তোর বাচ্চারা কোথায়? কত বড় হল?’
‘আমার এক ছেলে এক মেয়ে। ছেলের দশ, মেয়ের আট। দুজনেই পাশের ঘরে, অমিতাভর ছেলের সঙ্গে।
রত্না রান্নাঘরে কিছু একটা করছে। সুপর্ণর বউ রত্নাকে সাহায্য করতে উঠে গেল। এটাই বোধহয় ভদ্রতা। অমিতাভ বলল, ‘হুইস্কি খাবি? গত বছর শিকাগো থেকে ফেরার পথে একটা জ্যাক ড্যানিয়েল’স এনেছিলাম। খোলাই হয়নি।’
আদিত্য মাথা ঝুঁকিয়ে হ্যাঁ বলল। সুপর্ণ বলল, ‘মহিলাদের জিজ্ঞেস কর ওরা কী খাবে।’
‘আমার কাছে ওয়াইন আছে, লাল সাদা দুটোই। আমি জিজ্ঞেস করছি।’ অমিতাভ উঠে দাঁড়াল।
সুপর্ণ আদিত্যকে বলল, ‘অমিতাভর সঙ্গে তো মাঝে মাঝে কথা হয়। ও কনফারেন্স-টনফারেন্স-এ আমেরিকা গেলে ফোন করে। একবার আমাদের বাড়িতেও এসেছিল। কিন্তু তোর খবর কিচ্ছু জানি না। এম এ পড়তে দিল্লি চলে গেলাম তারপর থেকে আর তোর সঙ্গে যোগাযোগ নেই। তুই করিস কী আজকাল?
এই ধরনের প্রশ্ন আদিত্যকে আর বিব্রত করে না। আগে খুব করত।
সে সহজভাবে বলল, ‘আমি কী করি শুনলে তুই ভিরমি খাবি। প্রথমেই বলে রাখি, তোর বা অমিতাভর মতো অধ্যাপনা করি না। কর্পোরেটেও কাজ করি না। ডাক্তার-উকিল নই। আমলা বা পুলিশও হতে পারিনি। পাটের দালালি করি না, ইন্সিয়োরেন্স-এর এজেন্সি নিইনি, শেয়ার বাজারের সঙ্গেও যোগাযোগ নেই। তাহলে আর কী বাকি রইল?’
‘রিকশা টানিস নাকি?’ সুপর্ণ সন্দেহের গলায় বলল, ‘দেখে তো মনে হচ্ছে না।’
‘বলছি কী করি। প্রাইভেট ডিটেকটিভ জানিস? বেসরকারি গোয়েন্দা? আমি একজন বেসরকারি গোয়েন্দা।’
‘বেসরকারি গোয়েন্দা? ঢপ মারার জায়গা পাস না?’
‘ঢপ নয় রে, একেবারে সত্যি। কিছুদিন আগে একটা গ্যাংকে ধরে দিয়ে আদিত্য একটা অ্যাওয়ার্ডও পেয়েছে।’ আমিতাভ ড্রিংক্স-এর ট্রে হাতে নিয়ে ফিরে এসেছে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই আড্ডা বেশ জমে উঠল। মহিলারাও আড্ডায় যোগ দিয়েছে। সুপর্ণর বউ মৃত্তিকাকে এখন আর অতটা অবনক্সাস মনে হচ্ছে না। ট্রাম্প, মোদি, এইচ ওয়ান বি ভিসা, পশ্চিমবঙ্গ ও বহির্বিশ্ব, ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া এইসব নানারকম কথার মাঝে আদিত্যর একটা কথা মনে পড়ে গেল।
সে আলাদা করে সুপর্ণকে বলল, তুই তো এখন আই এস আই যাস, আমাকে একটা তথ্য যোগাড় করে দিতে পারবি? একটা বই-এর নাম বলছি। সারা জীবনে বইটা সম্ভবত দুবার আই এস আই লাইব্রেরি থেকে ইস্যু করা হয়েছে। সেটাও আবার গত কয়েক মাসের মধ্যে। বইটা ইস্যু হয়েছে একবার আমার নামে, আর একবার ওখানকারই একজন সিনিয়র অধ্যাপক, লাইব্রেরিয়ান নাম বলল প্রফেসর সামন্ত, তাঁর নামে।
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ অঞ্জন সামন্ত। চিনি। বয়েস হয়েছে। শিগগির রিটায়ার করবে। বহুদিন রিসার্চ-টিসার্চ কিছু করে না। ফসিল হয়ে গেছে। বল কী করতে হবে।’
‘দুটো রিকোয়েস্ট। এক, অঞ্জন সামন্তকে জিজ্ঞেস করতে হবে বইটা তিনি নিজে পড়বেন বলে তুলেছিলেন নাকি অন্য কারোর জন্যে? অন্য কারো জন্যে হলে কার জন্যে? দুই, লাইব্রেরিতে গিয়ে জানতে হবে বইটা আমি নেবার পর আর কেউ নিয়েছে কিনা। আর নিলে কে নিয়েছে।’
‘এটা কি তোর গোয়েন্দাগিরির কাজে লাগবে?’
‘ইয়েস, ভেরি মাচ।’
‘তাহলে দাঁড়া। প্রথম প্রশ্নটার উত্তর একটা ফোন করে এখখুনি জেনে নিচ্ছি। দ্বিতীয়টা জানার জন্য অবশ্য ইন্সটিটিউট যেতে হবে। বইটার নাম লিখে দে।’
‘লিখতে হবে না, বলে দিচ্ছি। বইটার নাম দ্য এন্টারপ্রাইসিং চৌধুরিস অফ বেঙ্গল : ক্রনিকল অফ অ্যান আনইউসুয়াল জার্নি। লেখকের নাম অরুণকুমার উপাধ্যায়।’
মোবাইলে একটা নম্বর ডায়াল করতে করতে সুপর্ণ বারান্দায় বেরিয়ে গেল। ও এর মধ্যেই টের পেয়ে গেছে বারান্দা থেকে রিসেপশনটা একটু ভাল পাওয়া যায়।
একটু পরে সুপর্ণ ফিরে এসে বলল, ‘অতি কষ্টে জানা গেছে। অঞ্জন সামন্ত তো বুঝতেই পারে না কোন বই-এর কথা বলছি। শেষে বুঝল। বলল, বইটা তার এক নেবারের জন্য নিয়েছিল। নেবারের নাম সুব্রত সেন। বেহালার দিকে একটা কলেজে অঙ্ক পড়ায়।
আদিত্য শুনতে পেল রত্না বলছে, ‘বাচ্চাদের খাওয়া প্রায় শেষ। এবার বড়দের খাবার দেব। প্লিজ ফিনিস ইয়োর ড্রিঙ্কস।’
সে অমিতাভকে বলল, ‘তোর বাংলা ডিক্সনারিটা দে তো। একটা কথার মানে জানতে হবে।’