চৌধুরি বাড়ির রহস্য – ৭
সপ্তম পরিচ্ছেদ
(১)
সহজেই হয়ে গেল আইডেন্টিফিকেশন। মৃতার হাতে একটা বেশ বড় আকারের হিরের আংটি ছিল, সেটা দেখা মাত্র তার মায়ের আংটি বলে সোহিনী চিনতে পারল। গাড়িতে একটা আধপোড়া ব্যাগ পাওয়া গিয়েছিল যার ভেতর থেকে মন্দাকিনীর আধপোড়া আধার কার্ড এবং ড্রাইভিং লাইসেন্স বেরিয়েছে। দুটোতেই মন্দাকিনীর ছবি আছে। ছবিগুলো পুড়ে খানিকটা অস্পষ্ট হয়ে গেলেও বুঝতে অসুবিধে হয় না এগুলো মন্দাকিনীরই ছবি। গৌতম বলছিল, সাধারণত এত নিশ্চিতভাবে আইডেন্টিফিকেশন হয় না। তারা তিনজন, আদিত্য, গৌতম আর সোহিনী, গৌতমের আপিসে বসে চা খাচ্ছিল।
আদিত্য বলল, ‘ড্রাইভারের অন্তর্ধান নিয়ে একটা রহস্য কিন্তু থেকেই গেল। এই ড্রাইভারটির সম্বন্ধে আমাদের কতটুকু জানা আছে?’ শেষের প্রশ্নটা সোহিনীর প্রতি।
‘আমি কোনও দিন লোকটাকে দেখিনি। তবে মার কাছে শুনেছি দীননাথ যোশি লোকটা খুব বিশ্বাসী। কাকু মারা যাবার পর থেকে মাকে দূরে দূরে, বিশেষ করে চা-বাগানগুলোতে, একা ট্র্যাভেল করতে হত। একটা বিশ্বাসী ড্রাইভারের দরকার ছিল। কারোর একটা রেফারেন্স-এ দীননাথ যোশি মার কাজে বহাল হয়। সেই থেকে দীননাথ মার গাড়ি চালাচ্ছে। তবে কলকাতায় চালাত না। মা যখন নর্থ বেঙ্গলে আসত তখন মার গাড়ি চালাত। নেপালি হিন্দু। সম্ভবত ব্রাহ্মণ। মা বলত খুব সাত্ত্বিক লোক। নেড়া মাথায় টিকি। ঘোর নিরামিশাষি। থাকত চৌধুরিদেরই কোনও একটা চা-বাগানে। লোকটার বন্দুকের লাইসেন্স ছিল। শুনেছি একটা পিস্তল ও সব সময় সঙ্গে রাখত। সেদিক থেকে দেখতে গেলে লোকটা শুধু মার ড্রাইভারই ছিল না, বডি গার্ডও ছিল।’
‘লোকটার বাড়ির লোকজন কেউ আছে? পুলিশ খোঁজ নিয়েছে?’ এবার আদিত্যর প্রশ্ন গৌতমকে।
‘দীননাথের পরিবার নেপালে থাকত। কিরীটপুর থেকে কিছু দূরে একটা গ্রামে। পুলিশ সেখানে গিয়েছিল। গ্রামের লোক বলছে, দীননাথের সঙ্গে ওর বউ-এর বনিবনা ছিল না। বউ-এর নাকি স্বভাব-চরিত্র ভাল নয়। তাই নিয়ে সম্পর্ক খারাপ। একটা ছেলে আছে ইস্কুলে পড়ে। ওর বউ বলছে, গত দশ বছর দীননাথ বাড়ি আসেনি। তবে প্রত্যেক মাসে ছেলের নামে টাকা পাঠায়। দীননাথের অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে শুনে বউ-এর খুব একটা হেলদোল দেখা যায়নি।’
‘মন্দাকিনী চৌধুরির মৃত্যুর খবরটা তোরা কবে অ্যানাউন্স করবি? এটা নিয়ে মিডিয়ায় তো বিশাল হইচই হবে।’
‘ওটা আমার কাজ নয়। কমিশানার সাহেব ঠিক করবেন কী করতে হবে। তবে আজকালের মধ্যেই মনে হয় খবরটা অফিশিয়াল হয়ে যাবে।’
এর পরের কয়েক সপ্তাহ মন্দাকিনী চৌধুরিকে নিয়ে মিডিয়ায় যে তুমুল তোলপাড়টা চলল তার সঙ্গে বছর দশেক আগে সুন্দরবন উপকূলে আছড়ে পড়া আইলার তুলনা করা যায়। দুর্ঘটনা নাকি খুন? সাবোটাজ? যৌন ঈর্ষা? সমাজ কি রসাতলে যেতে বসেছে? বাংলা কাগজ, ইংরেজি কাগজ, ফেসবুক, ট্রাম-বাস-ট্রেন সর্বত্র একটাই কথা, একই আলোচনা। যেন পৃথিবীতে আর কোনও খবর নেই। ঘটনা নেই। টেলিভিশনে রোজ সন্ধেবেলা মনস্তত্ত্ববিশারদ, অর্থনীতিবিদ, সমাজবিজ্ঞানী, প্রাক্তন পুলিশ-কর্তা, পলিটিকাল নেতা ইত্যাদি হোমরা-চোমরারা জমায়েত হয়ে নানা সম্ভব-অসম্ভব তত্ত্বের অবতারণা করেন, তাদের মধ্যে ঘোর ঝগড়া লাগে। আর বাঙালি দর্শক সান্ধ্য চা-মুড়ি-চানাচুর সহযোগে তাই গলাধঃকরণ করে। এরকম একটা রসদ বাঙালি বহুদিন পায়নি। কিছুদিন পরে, যখন হুজুগটা একটু থিতিয়ে এসেছে, আদিত্য সোহিনীর কাছ থেকে একটা টেলিফোন পেল।
‘আজ সন্ধেবেলা ফ্রি আছেন? একবার মর্গ্যান ব্যানার্জির আপিসে আসতে পারবেন?’
‘ফ্রি আছি। আসতে পারব। কিন্তু ব্যাপারটা কী?’
‘মর্গ্যান ব্যানার্জির শুদ্ধশীল ব্যানার্জি ফোন করেছিলেন। মা নাকি অ্যাক্সিডেন্টের কয়েকদিন আগে একটা উইল করেছিল। সেই উইলে কিছু চমক আছে। শুদ্ধশীল ব্যানার্জি উইলটা পড়ে শোনাতে চান। আমাকে আসতে বলেছেন। বোধহয় মালাদেরও আসতে বলেছেন। তাছাড়া আলাদা করে আপনাকেও থাকতে বলেছেন। আমিও চাই আমার পরামর্শদাতা হিসেবে আপনি আমার সঙ্গে থাকুন।’
‘অবশ্যই থাকব।’
‘শুদ্ধশীল ব্যানার্জি আপনার আসল পরিচয় জানেন। বললেন, আপনি ওঁর সঙ্গে দেখা করেছিলেন। আপনি মাকে যে রিপোর্টটা জমা দিয়েছিলেন সেটা নিয়েও কিছু আলোচনা আছে। মিঃ ব্যানার্জি আমাকে বললেন, আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করতে। আপনার ফোন নম্বরটা ওদের কাছে নেই। তাই সরাসরি আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছেন না।’
‘কটার সময় যেতে হবে?’
‘বলেছে সন্ধে সাড়ে ছ’টা।’
‘আমি ঠিক সময় পৌঁছে যাব।’
ফোনটা রেখে আদিত্য কাগজ কলম নিয়ে বসল। মোবাইলে বিভিন্ন লোকের কথোপকথন যা যা রেকর্ড করেছে তার সারাৎসার ডায়েরিতে লিখে রেখেছিল। তাছাড়া পুরোনো খবর কাগজ থেকেও কিছু কিছু নোট করা আছে। মূল ঘটনাগুলোর একটা কালানুক্রমিক সূচি তৈরি করা দরকার। আদিত্য লিখল,
১৯৯০ সুবীর চৌধুরির প্রথম স্ত্রীর মৃত্যু
২০০৮ মন্দাকিনীর সঙ্গে সুবীর চৌধুরির বিয়ে (এই সময় সুবীর চৌধুরির বয়েস ৬৩, মন্দাকিনীর ৩৫, শঙ্খমালার ২০, শঙ্খদীপের ৩৩, সোহিনীর ১৫)
২০১১ সুবীর চৌধুরির মৃত্যু
জুন, ২০১৭ মন্দাকিনীকে খুনের প্রথম চেষ্টা
জানুয়ারি, ২০১৮ সোহিনী মৈত্র আমার সঙ্গে যোগাযোগ করল
মে, ২০১৮ পাহাড় থেকে মন্দাকিনীর গাড়ির পতন
সারাদিন অসহ্য গরমের পর আজ আবার বিকেলে বৃষ্টি নেমেছে। খুব জোরে নয়, আবার খুব আস্তেও নয়। আদিত্য ছাতা নিয়ে বেরিয়েছে। এই ছাতাটা তার খুব পছন্দ। ইতালি থেকে অমিতাভ এনে দিয়েছে। এরকম লম্বা ছাতা আজকাল খুব বেশি লোক ব্যবহার করে না। ছাতাটা হাতে থাকলে কেমন একটা কনফিডেন্স পাওয়া যায়। মর্গ্যান ব্যানার্জির আপিসটা তার আপিস থেকে মোটেই দূরে নয়, তবে এই সময় রাস্তা পার হওয়াটা এক মহা সমস্যা। আদিত্য বউবাজার স্ট্রিট পেরিয়ে হেমন্ত বসু সরণি ধরে হাঁটতে হাঁটতে গ্রেট ইস্টার্ন হোটেল অব্দি পৌঁছল, আর একটু এগিয়ে রাস্তা পার হয়ে হাইকোর্টের দিকে যাবে।
সামনে একদল ইসকনের হরেকেষ্ট পার্টি খোল-কর্তাল বাজাতে বাজাতে চলেছে। কিছু ন্যাড়া মাথা সাহেব, আর তাদের শাড়ি পরা মেমসাহেব বোষ্টুমি। আদিত্যর মনে পড়ে গেল ছেলেবেলায় পড়া লাইন যত ছিল ন্যাড়া বেনে/ সব হল কীর্তুনে/ গাড়ু ভেঙে গড়াল কর্তাল। আদিত্যর মনে হল, আচ্ছা এই সামনের লম্বা ন্যাড়া মাথা সাহেবটা, যে ধুতি-পাঞ্জাবি পরে নাচতে নাচতে চলেছে, সে যদি জিন্স আর টি-শার্ট পরে একমাথা ব্লন্ড চুল নিয়ে সামনে এসে দাঁড়াত, তাহলে তাকে কেমন দেখাত? ভাবতে ভাবতে আদিত্য ভাবনায় ডুবে গেল, কখন দু-দুটো রাস্তা পেরিয়ে হাইকোর্ট পাড়ায় মর্গ্যান ব্যানার্জির আপিসের সামনে পৌঁছে গেছে, সে নিজেই টের পায়নি।
(২)
মর্গ্যান ব্যানার্জির মিটিং রুমে ঢুকে আদিত্য দেখল শঙ্খমালা-সুব্রত এবং সোহিনী এসে গেছে, শিশির চ্যাটার্জি রয়েছেন, এক কোনে ড্রাইভার শৈলেনবাবুও বসে আছেন। আর একটি ছেলে বসে আছে যাকে আদিত্য চেনে না। শুধু শঙ্খদীপ চৌধুরি নেই। শুদ্ধশীল ব্যানার্জি তখনও ঘরে ঢোকেননি। গোল টেবিল ঘিরে কয়েকটা চেয়ার ফাঁকা রয়েছে। আদিত্য সোহিনীর পাশে একটা ফাঁকা চেয়ারে গিয়ে বসল।
তাকে দেখে শিশির চ্যাটার্জি উঠে দাঁড়িয়ে বলে উঠলেন, ‘এ তো সেই সাংবাদিক। এ এখানে কী করছে?’
সুব্রতও দাঁড়িয়ে উঠল। আদিত্যকে উদ্দেশ্য করে বলল, আপনি তো চৌধুরিবাড়ির ইতিহাস লিখছিলেন। এখানে পৌঁছে গেলেন কী করে? এখানে আমাদের পারিবারিক কিছু বিষয় নিয়ে আলোচনা হবে। একান্তই গোপনীয় আলোচনা। আমার মনে হয় না এখানে আপনার বিন্দুমাত্র প্রবেশাধিকার আছে।’
আদিত্য সোহিনীর দিকে তাকাল। সোহিনী বলল, ‘আদিত্য মজুমদারকে শুদ্ধশীল ব্যানার্জিই এখানে আসতে বলেছেন। কেন বলেছেন, সেটা উনিই বলবেন। আপনারা একটু ধৈর্য ধরে বসুন।’
আদিত্য লক্ষ করল একমাত্র শঙ্খমালার কোনও হেলদোল নেই। সে মৃদুমৃদু হাসছে। যেন আদিত্যর ছদ্ম-পরিচয়টা আগেই ধরে ফেলেছিল। মেয়েটা অসাধারণ বুদ্ধিমতি। বুদ্ধিটা ঠিক কাজে লাগাতে পারলে অনেকদূর পৌঁছে যেত। ঠিক ছটা বেজে তেত্রিশ মিনিটে শুদ্ধশীল ব্যানার্জি ঘরে ঢুকলেন, সঙ্গে তাঁর জুনিয়র।
হাতের কাগজপত্র টেবিলের ওপর রেখে শুদ্ধশীল বললেন, আমার তিন মিনিট দেরি হয়ে গেল, তার জন্য ক্ষমা চাইছি।’
আদিত্যর মনে হল, তিন মিনিট পরে ঢুকেছে তো কী হয়েছে? যত সব সাহেবি আদিখ্যেতা।
শুদ্ধশীল বললেন, ‘আপনারা চা খেয়েছেন তো?’ দু’একজন সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়ল। আদিত্য স্থির হয়ে বসে রইল। সে পৌঁছনোর আগেই চা-পর্ব শেষ হয়ে গিয়েছিল।
শুদ্ধশীল বললেন, ‘দুজনকে বাদ দিয়ে আপনারা সকলেই সকলকে চেনেন। এই দুজনের একজন সৌরাশিস ঘোষ বাঁ দিকের কোনায় বসে আছেন। উনি পিস ইন্টারন্যাশানাল বলে একটি আন্তর্জাতিক এনজিও-র ভারত-প্রধান। আর সোহিনী মৈত্রর ডানদিকে বসে আছেন আদিত্য মজুমদার যিনি একজন বেসরকারি গোয়েন্দা। এঁরা দুজন কেন এখানে এসেছেন সেটা যথাসময় স্পষ্ট করা হবে। এবার তাহলে আমরা শুরু করতে পারি। আমি আজ আপনাদের সামনে সদ্য-প্রয়াত মন্দাকিনী চৌধুরির উইলটি পড়ে শোনাব। আপনারা সকলেই জানেন সুবীর চৌধুরি উইল করে পুরো সম্পত্তি তাঁর স্ত্রী মন্দাকিনী চৌধুরিকে দিয়ে গিয়েছিলেন। শঙ্খমালা সেন এবং সোহিনী মৈত্রর জন্যে শুধু একটা মাসোহারার ব্যবস্থা ছিল। শঙ্খদীপ চৌধুরির জন্য কিছুই ছিল না। মন্দাকিনী চৌধুরি যেরকম উইলই করুন না কেন, মন্দাকিনীর মৃত্যুর পরেও এই মাসোহারা শঙ্খমালা এবং সোহিনী পেয়ে যাবেন, যতদিন তাঁরা বেঁচে থাকবেন, যেহেতু এই মাসোহারা সুবীর চৌধুরি তাঁদের দিয়ে গিয়েছিলেন। এ-নিয়ে কারও কোনও প্রশ্ন আছে?’ শুদ্ধশীল ব্যানার্জি একটু থামলেন।
সকলকে নিশ্চুপ দেখে শুদ্ধশীল ব্যানার্জি আবার শুরু করলেন। ‘যেহেতু পুরো সম্পত্তি গিফট করে মন্দাকিনীকে দেওয়া হয়েছিল তাই মন্দাকিনী সেই সম্পত্তি যাকে খুশি তাকে দিয়ে যেতে পারতেন। তবে দীর্ঘদিন তিনি কোনও উইল করেননি। হয়তো তিনি ধরে নিয়েছিলেন উইল করার জন্য অনেকটা সময় তাঁর হাতে আছে। লক্ষণীয় যে, মারা যাবার সপ্তাহ খানেক আগে তিনি একটা উইল করেছিলেন। কেন উইল করছেন সেটা নিয়ে তিনি আমার সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করেছিলেন।’
অনেকক্ষণ আদিত্যর মনটা চা-চা করছিল, এবার সে উতুল্ল হয়ে দেখল, উর্দিপরা বেয়ারা আবার চা নিয়ে ঘরে ঢুকছে। চা পরিবেশন করতে কিছুটা সময় চলে গেল। বেয়ারা চা দিয়ে বেরিয়ে যাবার পর শুদ্ধশীল আবার বলতে লাগলেন। ‘কয়েকটি সাম্প্রতিক ঘটনার ফলে মন্দাকিনী চৌধুরির ধারণা হয়েছিল কেউ তাঁকে খুন করার চেষ্টা করছে। এগুলিকে ঘটনা না বলে অবশ্য দুর্ঘটনা বলাটাই ঠিক। এই দুর্ঘটনাগুলির কথা আপনারা সকলেই জানেন, তবু একবার সংক্ষেপে মনে করিয়ে দিচ্ছি। প্রথম দুর্ঘটনা ঘটে বছর খানেক আগে, তার ছিঁড়ে লিফট নীচে পড়ে যায়। এরপর আরও দুটো ঘটনা ঘটে। কিছুদিন পরে ডায়মন্ডহারবার রোডের ওপর মন্দাকিনীর গাড়ির অ্যাক্সিডেন্ট হয় এবং আরও কিছুদিন পরে দার্জিলিং যাবার পথে তাঁর গাড়ির ব্রেক ফেল করে। এই ঘটনাগুলির যে-কোনও একটিতেই তিনি মারা যেতে পারতেন। তাই তাঁর ভয় পাবার যথেষ্ট কারণ ছিল। তাঁর ভয় যে অমূলক নয় সেটার সব থেকে বড় প্রমাণ তাঁর অপঘাত মৃত্যু।’
শুদ্ধশীল ব্যানার্জি থামলেন। গেলাস থেকে এক ঢোঁক জল খেলেন। ঘরে অখণ্ড নিস্তব্ধতা। আবার বলতে শুরু করলেন শুদ্ধশীল।
‘সত্যিই কেউ তাকে খুন করার চেষ্টা করছে কিনা নিশ্চিত হবার জন্য মন্দাকিনী আদিত্য মজুমদার নামে একজন বেসরকারি গোয়েন্দাকে নিয়োগ করেন। আগেই বলেছি, আদিত্য মজুমদার আজ আমাদের মধ্যেই উপস্থিত আছেন, আমি সকলের সঙ্গে তাঁর পরিচয় করিয়ে দিয়েছি।’
আদিত্য লক্ষ রাখছিল তার আসল পরিচয় পেয়ে কার কী মুখের অবস্থা হয়। সুব্রতকে বিস্মিত দেখাল, শঙ্খমালা নির্বিকার, শিশির চ্যাটার্জি পরিষ্কার ক্রুদ্ধ। শৈলেন ড্রাইভারকে দেখে মনে হল, কী ঘটছে সে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। সৌরাশিস বলে এনজিও-র লোকটির মুখ দেখে মনে হল সে খুব মন দিয়ে সব কিছু শুনছে। শুদ্ধশীল আবার শুরু করলেন।
‘ছদ্ম-পরিচয়ে আদিত্য মজুমদার আপনাদের সকলের সঙ্গেই কথা বলেন, শঙ্খদীপের সঙ্গেও, যিনি এখানে আসবেন বলেছিলেন কিন্তু এখনও এসে পৌঁছতে পারেননি। আদিত্যবাবু তাঁর তদন্তের একটি রিপোর্ট মন্দাকিনী চৌধুরিকে জমা দেন। তাতে পরিষ্কার বলা আছে মন্দাকিনীর ভয় মোটেই অমূলক নয়। এই রিপোর্টটি নিয়ে মন্দাকিনী আমার কাছে আসেন এবং বলেন তিনি খুব তাড়াতাড়ি একটা উইল করতে চান। তাঁর উইলটি সংক্ষেপে এইরকম যদি তাঁর মৃত্যু স্বাভাবিক কারণে হয় তাহলে তাঁর সম্পত্তি সোহিনী, শঙ্খদীপ এবং শঙ্খমালার মধ্যে সমানভাবে ভাগ হয়ে যাবে। এছাড়া চৌধুরি বাড়ির বিশ্বস্ত কর্মচারী হিসেবে শিশিরবাবু এবং শৈলেনবাবুও একটা করে ভাল মাসোহারা পাবেন। কিন্তু যদি কোনও অস্বাভাবিক কারণে তাঁর মৃত্যু হয়, যার মধ্যে খুন এবং অ্যাক্সিডেন্ট দুটোই ধরা হচ্ছে, তাহলে তাঁর সম্পত্তির সিংহভাগ পাবে পিস ইন্টারন্যাশানাল বলে একটি আন্তর্জাতিক এনজিও, সুইজারল্যান্ডে যাদের হেড আপিস এবং যাদের ইন্ডিয়ান কান্ট্রি হেড সৌরাশিস ঘোষ আমাদের মধ্যে উপস্থিত আছেন। এই এনজিও-টির কাজকর্মের সঙ্গে মন্দাকিনী অনেক দিন ধরে পরিচিত। অতীতে এদের তিনি অনেক টাকাপয়সাও দিয়েছেন। শঙ্খমালা, শঙ্খদীপ, সোহিনী, শিশিরবাবু, শৈলেনবাবু সকলের জন্যই অবশ্য একটা করে মাসোহারা থাকছে, তবে তার কোনওটার পরিমাণই খুব বেশি নয়। আসলে, এটা আমি খোলাখুলিই বলছি, মন্দাকিনীর ধারণা হয়েছিল, তাঁর খুব চেনাশোনাদের মধ্যেই কেউ তাঁকে খুন করার চেষ্টা করছে। তিনি ধরে নিয়েছিলেন, তাঁর খারাপ কিছু ঘটলে টাকার লোভে তাঁর কোনও আত্মীয়ই সেটা ঘটাবে। তাই এই রকম একটা উইল করে তিনি বাঁচতে চেয়েছিলেন। তিনি ভেবেছিলেন, এই রকম একটা উইল আছে জানতে পারলে তাঁকে মারার কোনও মোটিভ কোনও নিকট আত্মীয়ের থাকবে না। তিনি ঠিক করেছিলেন, দার্জিলিং থেকে ফিরে উইলের কথা সবাইকে জানিয়ে দেবেন। দুর্ভাগ্যবশত, সেই সুযোগটা তিনি আর পেলেন না।’
ঘরের আবহাওয়া রীতিমত ভারী হয়ে উঠেছে। প্রত্যেকেরই চেহারায় হতাশার ছাপ যদিও মুখে কেউ কিছু বলছে না। শঙ্খমালা এতক্ষণ স্থির হয়ে বসেছিল, সেও এখন তার স্বামীকে ফিসফিস করে কিছু বলছে।
সুব্রত হঠাৎ দাঁড়িয়ে উঠে উত্তেজিতভাবে বলল, ‘মন্দাকিনী চৌধুরি যে মারা গেছেন তার প্রমাণ কী? বডিটাই তো পাওয়া যায়নি।’
‘এটা তো খুব সঙ্গত একটা প্রশ্ন। পুলিশ বলছে, মন্দাকিনী মারা গেছেন, কিন্তু আপনারা সেটা কোর্টে কনটেস্ট করতেই পারেন।’
‘কিন্তু কনটেস্ট করে লাভ কি?’ সোহিনী জিজ্ঞেস করল।
‘যদি কোর্ট মনে করে মন্দাকিনী মারা গেছেন এটা এখনও ঠিকমতো প্রমাণিত নয় তাহলে আইন অনুযায়ী সাত বছর তাঁর ফিরে আসার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। এটা নিয়ে ম্যাডরাস হাইকোর্টের ২০১৬ সালের একটা রায় আছে। মহামান্য ম্যাডরাস হাইকোর্ট বলছেন, যদি কোনও ব্যক্তি সাত বছর ধরে মিসিং থাকে, তাহলে তাকে মৃত বলে ধরে নিতে হবে। মৃত্যুর দিনটা কিন্তু ধার্য হবে যেদিন মিসিং থাকার সাত বছর কমপ্লিট হল সেই দিনটা থেকে। এবার আপনারাই ভেবে দেখুন মন্দাকিনী চৌধুরির মৃত্যুটা কনটেস্ট করবেন কিনা।’ শুদ্ধশীল বিলিতি কায়দায় শ্রাগ করলেন।
‘খুব লাভ হবে বলে মনে হচ্ছে না, ‘ সুব্রত সোহিনীর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘সাত বছরের মধ্যে যদি মাম ফিরে না আসে তাহলে সাত বছর পরে নিশ্চয় এই উইলটাই ইমপ্লিমেন্টেড হবে। আর এই সাত বছর নিশ্চয় এখনকার ব্যবস্থাটাই চলবে। আর যদি ফিরে আসে তাহলে তো এখনকার ব্যবস্থাটাই চালু থাকবে। ইন আইদার কেস আমরা কেউ বিরাট সম্পত্তির মালিক হচ্ছি না। কি, ঠিক বললাম, মিঃ ব্যানার্জি?’
‘পুরোটা ঠিক নয়, মিঃ সেন। যদি সাত বছরের মধ্যে মন্দাকিনী ফিরে না আসেন তাহলে তো যেটা বললাম সেটা হবে। কিন্তু যদি ফিরে আসেন এবং ইভেনচুয়ালি ওঁর স্বাভাবিক মৃত্যু হয়, তাহলে পিস ইন্টারন্যাশানাল কিছুই পাবে না। সেদিক থেকে দেখলে আপনারা মন্দাকিনীর মৃত্যুটা কোর্টে কনটেস্ট করতে পারেন। যতদিন না মন্দাকিনীর মৃত্যু প্রমাণিত হচ্ছে, ততদিন কোম্পানি চালাবে বোর্ড অফ ডিরেক্টারস। তাঁদেরই মধ্যে কাউকে মন্দাকিনীর বদলে চেয়ারম্যান নির্বাচন করা হবে। তখনও কিন্তু কোম্পানির মালিকানা পিস ইন্টারন্যাশানালের হাতে যাচ্ছে না। আর সুবীর চৌধুরির দিয়ে যাওয়া ভাতা যাঁরা পেতেন তাঁরা তো সেটা সব অবস্থাতেই পাচ্ছেন।’
‘একটা প্রশ্ন করতে পারি?’ আদিত্য জিজ্ঞেস করল। সকলের দৃষ্টি তার দিকে ফিরল। উত্তরের অপেক্ষা না করেই আদিত্য বলল, ‘ধরা যাক ভবিষ্যতে কখনও প্রমাণিত হল সুবীর চৌধুরি মারা যাবার পর মন্দাকিনী চৌধুরি কোনও পুরুষের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করেছিলেন, তাহলে মন্দাকিনী চৌধুরির বর্তমান উইলের কি হবে?’
‘ভেরি গুড কোয়েশ্চেন।’ শুদ্ধশীল চৌধুরি বললেন, ‘সুবীর চৌধুরির উইলে স্পষ্ট করে লেখা আছে, যদি কখনও প্রমাণিত হয় মন্দাকিনী কখনও, সুবীর চৌধুরির সঙ্গে বিয়ে হবার পর, কোনও পুরুষের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করেছিলেন, তাহলে মন্দাকিনীর করা উইল সম্পূর্ণ বাতিল হয়ে যাবে। বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে এর মানে হল, পিস ইন্টারন্যাশানাল সম্পত্তিটা এই শর্তে পাচ্ছে যে ভবিষ্যতে কখনও মন্দাকিনী চৌধুরি আনফেথফুল প্রমাণিত হলে সম্পত্তির মালিকানা তাদের ফিরিয়ে দিতে হবে। অর্থাৎ পিস ইন্টারন্যাশানাল কোম্পানির মূলধনে কখনোই হাত দিতে পারবে না, যেহেতু সেই মূলধন তাদের কখনও ফিরিয়ে দিতে হতেও পারে, তবে কোম্পানির আয়ে তাদের পূর্ণ অধিকার থাকবে। মালিকানা পাবার পর কোম্পানির বোর্ড অফ ডিরেক্টরও তারাই ঠিক করবে। আর কোনও প্রশ্ন আছে?’
আর কারও কোনও প্রশ্ন আছে বলে মনে হল না।
শুদ্ধশীল ব্যানার্জি বললেন, ‘লেডিজ অ্যান্ড জেন্টলমেন, আজ তাহলে আমাদের মিটিং শেষ করছি। আপনাদের সবার কাছেই আমার নম্বর দেওয়া আছে। দরকার হলে আমাকে ফোন করবেন। আই শ্যাল বি ডিলাইটেড টু হেল্প।’
আর ঠিক এই সময় লম্বা কোলকুঁজো একটা লোক ঘরে ঢুকল। আদিত্য প্রথমে তাকে চিনতেই পারেনি। তার দামি গ্রীষ্মকালীন স্যুট পরা গা থেকে মদ এবং ফরাসি পারফিউম মেশানো একটা গন্ধ বেরোচ্ছে। দাড়ি-গোঁফ পরিষ্কার করে কামানো। তারপর আদিত্য লোকটাকে চিনতে পারল। এ তো শঙ্খদীপ চৌধুরি! তাকে দেখে মনে হচ্ছে তার দারিদ্র ঘুচে গেছে।
শঙ্খদীপ চারদিকে তাকিয়ে বলল, ‘হ্যালো এভরিবডি, আমার একটু দেরি হয়ে গেল। আমাকে মাফ করবেন। আই ওয়াজ হেল্ড আপ উইথ ইম্পর্টেন্ট বিসনেস। হোপ দ্য পার্টি ইজ স্টিল অন।’
‘অন দ্য কন্ট্রারি উই আর থ্রু।’ শুদ্ধশীল শান্তভাবে বললেন, ‘আমি মন্দাকিনী চৌধুরির নতুন উইলটা সকলকে শোনালাম। মন্দাকিনী তাঁর সমস্ত সম্পত্তি পিস ইন্টারন্যাশানাল বলে একটা এনজিওকে দিয়ে গেছেন। আপনারা প্রায় কিছুই পাচ্ছেন না। আপনি ডিটেলটা আমার জুনিয়র সাত্যকি রায়ের কাছ থেকে শুনে নিতে পারেন।’
আদিত্য ভেবেছিল শঙ্খদীপ একটা অস্বস্তিকর নাটক শুরু করবে। কিন্তু সে আশ্চর্য হয়ে দেখল শঙ্খদীপ সেরকম কিছুই করল না। দুহাতে কপাল ঢেকে বসে পড়ল। তারপর বিড়বিড় করে বলল, ‘দ্যাট বিচ! দ্যাট বিচ! লেট হার সোলরটইন হেল। আমাদের খানদানটাকে শেষ করে দিল। আমিও ছাড়ব না। সব ফাঁস করে দেব। সব ফাঁস করে দেব।’