চৌধুরি বাড়ির রহস্য – ৮
অষ্টম পরিচ্ছেদ
(১)
আজকাল সকালে আদিত্যর ঘুম ভাঙতে একটু দেরি হচ্ছে। গরমকালে এমনিতে তাড়াতাড়ি ঘুম ভেঙে যাবার কথা। কিন্তু আদিত্যর গরমের মধ্যে ঘুমোনো অভ্যাস হয়ে গেছে। তার ঘুম ভাঙে রাস্তার উল্টোদিকে চায়ের দোকানটা খুললে মানুষজনের কথাবার্তায়। জানলাটা খোলা থাকে বলে কথাবার্তা সরাসরি আদিত্যর ঘরে ঢুকে তার ঘুম ভাঙিয়ে দেয়। এখন ফুটবল বিশ্বকাপ চলছে। অনেকেই নিশ্চয় রাত জেগে খেলা দেখছে, তাই পরদিন সকালে দেরি করে চায়ের দোকানে আসছে। ফলে একদম সকালের দিকে চায়ের দোকানটা ফাঁকাই থাকছে। আদিত্যর ফুটবল নিয়ে তেমন উৎসাহ নেই। তবে ফুটবলের কল্যাণে সে যে একটু বেশিক্ষণ ঘুমোতে পারছে এর জন্য সে ফুটবল-প্রেমীদের কাছে কৃতজ্ঞ।
বলরাম চা এনে দরজা ধাক্কা দিচ্ছিল। দরজা খুলে দিতে চা-বিস্কুট টেবিলে রাখল। আদিত্য বাথরুম থেকে মুখ ধুয়ে বেরিয়ে দেখে বলরাম তখনও দাঁড়িয়ে আছে।
‘কিছু বলবি?’
‘হ্যাঁ, বলছিলাম, আমার দাদার মেয়েটা এবার উচ্চ মাধ্যমিক পাস করল। বাহাত্তর পার্সেন্ট নম্বর পেয়েছে, অঙ্কতে চুরাশি। টানাটানির সংসারেও দাদা মেয়েকে কলকাতার কলেজে পড়াতে চায়। দাদার এক শালা ঠাকুরপুকুরের দিকে থাকে, তারা আমার ভাইজিকে রাখতে রাজি হয়েছে। এখন ওদিকেই কোনও কলেজে ভর্তি হওয়া দরকার। বেশি যাতায়াত করতে পারবে না। যাতায়াতের খরচও তো আছে। ওদিকটায় তোমার কোনও কলেজে চেনাশোনা আছে? আমাদের একটু দেরি হয়ে গেছে।’
‘কী নিয়ে পড়তে চায়?’
‘অঙ্ক। মেয়েটার আশ্চর্য অঙ্কের মাথা। যে অঙ্কই দাও ঠিক করে দেবে। ইংরিজির জন্যেই মোট নম্বরটা কমে গেল।’
‘দাঁড়া, একটু ভেবে দেখি। ঠাকুরপুকুরের দিকে কলেজ?’
হঠাৎ আদিত্যর মনে পড়ে গেল। ঠাকুরপুকুরের দিকে সুব্রত সেন পড়ায় না? অঙ্কই তো পড়ায়। তার সঙ্গে একবার দেখা করতে পারলে ভাল হত। এই ছুতোয় একবার দেখা তো করাই যায়। কলেজটার কী যেন নাম? কলেজের নামটা আদিত্যর কিছুতেই মনে পড়ল না। নোটবই খুলে দেখল নামটা অডিও থেকে নোট করা আছে। রামকৃষ্ণ কলেজ।
সে বলরামকে বলল, ‘বিকেলের দিকে আমার সঙ্গে যেতে পারবি? ঠাকুরপুকুরের দিকে রামকৃষ্ণ কলেজ আছে, সেখানে আমার চেনা একজন অঙ্ক পড়ায়। কিছু করবে কিনা জানি না, তবে একবার বলে দেখতে পারি। বলে দেখতে তো দোষ নেই।’
‘বিকেল হলে যেতে পারি। তবে সন্ধের আগেই চলে আসতে হবে। বাবুরা আপিস থেকে ফিরলেই আমার খোঁজ পড়বে। দুপুর হলে আর একটু ভাল হতো।’
‘দুপুরে হবে না। লোকটাকেই পাওয়া যাবে না। ওদের সন্ধের কলেজ। তুই একদিন ছুটি নে। ফিরতে ফিরতে রাত্তির হয়ে যাবে।’
‘দেখি ম্যানেজারবাবুকে বলে।’
‘যদি নেহাতই ছুটি না পাস, তাহলে আমি একাই চলে যাব। তোর কাছে তোর ভাইঝির মার্কশিটের জেরক্স আছে তো?’
‘আছে।’
ম্যানেজার লোকটা অতি জঘন্য, বলরামকে কিছুতেই ছুটি দিল না। শেষ পর্যন্ত আদিত্যকে একাই যেতে হল। ধর্মতলা থেকে পৈলানের বাস ধরে আদিত্য যখন ঠাকুরপুকুরে এসে নামল তখন বিকেল সাড়ে পাঁচটা বেজে গেছে। রামকৃষ্ণ কলেজটা ডায়মন্ডহারবার রোডের ওপরেই, প্রায় বাস স্টপের গায়ে। নতুন বিল্ডিং। একদিকে এখনও কনস্ট্রাকশন চলছে। ছাত্র-ছাত্রীদের ভিড় ঠেলে দোতলায় উঠল আদিত্য। গেটেই দারোয়ান বলে দিয়েছিল স্টাফরুমটা দোতলায়। একটা দরজার গায়ে লেখা রয়েছে স্টাফরুম, আদিত্য স্টাফরুমের সামনে দাঁড়ানো খাঁকি পোশাক পরা একজনকে জিজ্ঞেস করল, ‘প্রফেসর সুব্রত সেন এসেছেন?’
‘হ্যাঁ, এই একটু আগে এলেন। ভেতরে চলে যান, দেখতে পাবেন। বাঁ দিকের কোনায় উনি বসেন।’
আদিত্য ভেতরে ঢুকে দেখল, বেশ বড় একটা ঘর, মাঝে দু-তিনটে টেবিল জোড়া দিয়ে একটা মস্ত টেবিল বানানো হয়েছে। সেই টেবিলের দুদিকে চেয়ার। কিছু চেয়ারে মাস্টার-মশাইরা বসে আছেন, কিছু চেয়ার ফাঁকা। এছাড়াও ঘরের দুধারে কয়েকটা ইজি-চেয়ার রয়েছে। দু-একজন ইজি-চেয়ারে বসে বিশ্রাম করছেন বা কিছু একটা পড়ছেন। আদিত্য এদিক-ওদিক তাকিয়ে সুব্রত সেনকে একটা ইজি-চেয়ারের ওপর দেখতে পেল।
‘আমাকে চিনতে পারছেন? আমি আদিত্য মজুমদার। কাল মর্গ্যান ব্যানার্জির আপিসে আপনার সঙ্গে দেখা হয়েছিল।’ আদিত্য এগিয়ে গিয়ে বলল।
‘খুব মনে পড়ছে। সেদিন খুব ঠকিয়েছিলেন আমাকে। মালা অবশ্য প্রথম থেকেই বলছিল, লোকটা যা বলছে সেটা ও নয়। তা এখানে কী মনে করে? আমি কিন্তু আপনার কোনও প্রশ্নের উত্তর দিতে বাধ্য নই।’
‘না, না। আমি গোয়েন্দাগিরি করতে আসিনি। আমার এক পরিচিত মেয়ে, গ্রামে থাকে, সহরে এসে আপনাদের এখানে অঙ্ক অনার্স পড়তে চায়, আপনি কি তার ভর্তির ব্যাপারে কিছু সাহায্য করতে পারেন?’
‘অ, অ্যাডমিশন। মার্কশিট এনেছেন?’ সুব্রত সেনকে খানিকটা নিশ্চিন্ত দেখাল।
মার্কশিট ভাল করে দেখে সুব্রত সেন বলল, ‘নম্বর তো ভালই পেয়েছে। আমাদের এখানে যারা পড়তে আসছে তাদের অনেকের থেকেই ভাল। তা এখানে পড়তে চায় কেন? এ তো আরও ভাল জায়গায় পেয়ে যাবে। আমাদের এখানে একেবারে অগারা আসে।’
‘মেয়েটি যে আত্মীয়র বাড়িতে থেকে পড়বে তিনি ঠাকুরপুকুরে থাকেন। মেয়েটি বেশি দূরের কলেজে যেতে পারবে না।’
‘তাহলে তাকে বলুন অরিজিনাল মার্কশিট আর টাকা-পয়সা নিয়ে কালকেই চলে আসতে। কালই ভর্তি হয়ে যেতে পারবে। ভর্তি হতে কত লাগবে নিচের ক্যাশ অফিস থেকে জেনে নেবেন। ছটা অব্দি অফিস খোলা আছে। তবে ওকে ডে-তে ভর্তি হতে বলুন। ডে-টা নাইটের থেকে একটু ভাল।’
ঠিক এই সময় সুব্রত-র মোবাইলটা বেজে উঠল। সুব্রত ফোন ধরে বলল, ‘বলো।’
মনে হয় চেনা কেউ, হয়তো শঙ্খমালা। যিনি ফোন করেছেন তিনি নিশ্চয় ওদিক থেকে কিছু একটা বললেন, কী বললেন আদিত্যর পক্ষে বোঝা সম্ভব ছিল না, কিন্তু আদিত্য লক্ষ করল সুব্রতকে বেশ চিন্তিত দেখাচ্ছে। সে আদিত্যর দিকে একবার চকিতে তাকিয়ে নিয়ে ফোনে বলল, ‘আমি একটু বাদে কল করছি।’
‘কোনও খারাপ খবর?’ আদিত্য ভদ্রতাবশত জিজ্ঞেস করল।
‘হ্যাঁ, একটা খারাপ খবর। মালা ফোন করেছিল। বলল, ওর দাদা শঙ্খদীপের একটা অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। পুলিশ থেকে জানিয়েছে। কতটা সিরিয়াস অ্যাক্সিডেন্ট জানি না। মালাকে খুব আপসেট মনে হল। আপনি আজ আসুন, আমাকে একটু বাড়ি যেতে হবে।’ সুব্রত উঠে দাঁড়াল।
আদিত্যর আরও দু’একটা প্রশ্ন করার ছিল, কিন্তু এর পরে তো আর দাঁড়ানো যায় না। সে সুব্রতকে ধন্যবাদ জানিয়ে স্টাফরুম থেকে বেরিয়ে এল। শঙ্খদীপের অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে? কীভাবে হল? নেশাখোররা অবশ্য চিরকালই অ্যাক্সিডেন্ট-প্রোন। আদিত্য সিঁড়ি দিয়ে নামার আগে একবার পেছন ফিরে দেখল, সুব্রত স্টাফরুম থেকে বেরিয়ে এসে মোবাইলে কথা বলছে।
(২)
ঠাকুরপুকুর থেকে ফেরার পথে আদিত্যকে ল্যাপটপটা নেবার জন্য একবার আপিসে আসতেই হল।
ল্যাপটপটা নিয়ে আপিস থেকে বেরোতে যাবে এমন সময় গৌতমের ফোন এল।’ শোন, সাংঘাতিক ব্যাপার। কাল রাত্তিরে ব্যারাকপুরের কাছে সুবীর চৌধুরির কুলাঙ্গার পুত্র শঙ্খদীপ চৌধুরির লাস পাওয়া গেছে। মনে হচ্ছে খুন। একটা লরি চাপা দিয়ে চলে গেছে। হিট অ্যান্ড রান। মাথায় একটা বড় আঘাত লেগেছিল যেটা লরি চাপা দেবার আগেও হতে পারে আবার লরি চাপা দেবার ফলেও হতে পারে। চোখে দেখে মনে হচ্ছে প্রথমটা। ফরেন্সিক রিপোর্ট পেলে আরও ভাল করে বোঝা যাবে। উন্মত্ত অবস্থায় ছিল। পেটে অনেকটা মদ পাওয়া গেছে। বডি ক্ষতবিক্ষত তবে চেনা যাচ্ছে। তাছাড়া সঙ্গের কাগজপত্র থেকেও বডি আইডেনটিফাই করা গেছে। কাগজপত্রের মধ্যে একটা ভিজিটিং কার্ড ছিল যাতে তোর নাম লেখা। কার্ডে যে ফোন নাম্বারটা দেওয়া আছে সেটাও তোর। যদিও তোর পরিচয় লেখা আছে ফ্রি-লান্স জার্নালিস্ট। সেটা অবশ্য কেন, তুই আমাকে বলেছিস। তুই ইন্টারেস্টেড হবি বলে তোকে জানালাম। তাছাড়া ইনভেস্টিগেশনের সময়ও তোকে লাগবে।’
গৌতমের শেষের দিকের কথাগুলো আদিত্যর মাথায় ঢুকছিল না। শঙ্খদীপ মারা গেছে? খুন হয়েছে? কালই তো দেখা হল। কী আফশোস! তার বোঝা উচিত ছিল শঙ্খদীপের বিপদের সম্ভাবনা আছে। এখন আর কিছু করার নেই।
আদিত্যকে চুপচাপ দেখে গৌতম আবার বলল, ‘কী রে, ঘুমিয়ে পড়লি নাকি?’
‘না না ঘুমোইনি। শকটা হজম করার চেষ্টা করছিলাম। শঙ্খদীপ চৌধুরির সঙ্গে আমার দুবার দেখা হয়েছিল। একবার তার বান্ধবীর বাড়িতে, যে সাক্ষাৎকারের কথা তোকে আগেই বলেছি। গতকাল সন্ধেবেলা শেষ দেখা। মর্গ্যান ব্যানার্জির আপিসে। আমার বোঝা উচিত ছিল লোকটা ভালনারেবল অবস্থায় আছে। আমার গুন্ডা আক্রমণের বৃত্তান্ত, মন্দাকিনীর অ্যাক্সিডেন্ট এবং এই খুন একই সুতোয় জড়িত মনে হচ্ছে। শঙ্খদীপের খুনের ব্যাপারে কাউকে অ্যারেস্ট করা হয়েছে?’
‘অ্যারেস্ট এখনও করা হয়নি, তবে একজনকে সাসপেক্ট করা হচ্ছে। নাম মাইকেল ডিসুজা। ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের একটা অত্যন্ত শেডি বারে বাউন্সারের কাজ করে। কিছুদিন আগে শঙ্খদীপ চৌধুরির সঙ্গে ঝামেলা হয়েছিল। মাইকেল গা ঢাকা দিয়েছে। তবে পুলিশের চোখ এড়িয়ে বেশি দিন থাকতে পারবে না।’
‘মার্থা বলে একটি মেয়ের সঙ্গে শঙ্খদীপ থাকত। তার সঙ্গে কথা বলেছিস?’
‘কথা বলব কী, সে তো কেঁদেই আকুল। সত্যি বলছি ভাই, এমন সতীলক্ষ্মী বেশ্যা আমি আমার পুলিশ জীবনে দেখিনি। যাইহোক, অনেক ধমক-ধামকের পর তাকে দিয়ে কথা বলানো গেল। সে বলল, ইদানীং শঙ্খদীপের হাতে কিছু টাকা এসেছিল। কোথা থেকে এসেছিল মার্থা জানে না। সেই টাকা সৎকাজে ব্যয় করার জন্য খুন হওয়ার দিন রাত্তিরবেলা শঙ্খদীপ তার এক পুরোনো ইয়ারের সঙ্গে বারে যায়। এটা সেই বার যেখানে মাইকেল কাজ করে এবং যেখানে মাস খানেক আগে শঙ্খদীপের সঙ্গে মাইকেলের ঝামেলা হয়েছিল। ইয়ারের নাম দিলবর সিং। দিলবরের সেদিন কী একটা কাজ ছিল বলে সে তাড়াতাড়ি অর্থাৎ রাত্তির এগারোটা নাগাদ বার ছেড়ে চলে যায়। অনেকেই তাকে চলে যেতে দেখেছে। মার্থাও দেখেছে। সে ওই বারেই ছিল। শঙ্খদীপও বারে থেকে গিয়েছিল। এরপর শঙ্খদীপের টেবিলে মাইকেল এসে বসে এবং রাত্তির প্রায় একটা অব্দি তারা এক সঙ্গে মদ্যপান করে। এটারও মার্থা সহ অনেকে সাক্ষী। একটায় বার বন্ধ হয়ে যায়। শঙ্খদীপ সেদিনের সমস্ত খরচ মিটিয়ে দেয় এবং মার্থাকে বলে সে আর মাইকেল একটু হাঁটতে যাচ্ছে, আধঘণ্টার মধ্যে বাড়ি ফিরে আসবে। মার্থা ভেবেছিল মাইকেলের সঙ্গে শঙ্খদীপের ভাব হয়ে গেছে। মাইকেল আর শঙ্খদীপ পার্ক স্ট্রিটের দিকে হাঁটতে হাঁটতে চলে যায়, মার্থা বাড়ি ফিরে আসে। কিন্তু বলাই বাহুল্য শঙ্খদীপ আর ফেরে না। সংক্ষেপে এই হল মার্থার গল্প।
‘তোরা মার্থার বাড়িটা সার্চ করেছিস?’
‘বাড়ি তো নয়, শুধু একটা ঘর। তারই মধ্যে থাকা, রান্নাবান্না, ব্যবসা-বাণিজ্য। খুব ভাল করে সার্চ করিনি, ওপর ওপর দেখেছি। তুই বললে আর একবার নয় সার্চ করা যাবে।’
‘আমি সার্চের সময় থাকতে পারি?’
‘অবশ্যই পারিস।’
একটু পরেই বিমলের ফোন এল। আদিত্য তখন বাড়ি পৌঁছে গেছে।
‘তোমাকে তো ফোনে পাওয়াই যায় না। কোথায় থাক? আদিত্য একটু বিরক্ত হয়েছে।
‘একটু অসুবিধের মধ্যে ছিলুম স্যার। কাল আপিসে থাকবেন? একটু দেখা করতাম।’
‘চলে এস তাহলে।’
পরদিন বিমল এল প্রায় বারোটায়। যখন আসবে বলেছিল তার এক ঘণ্টা পরে।
‘ব্যাপার কি?’
‘খুব সরি স্যার। ট্রেন মাঝপথে প্রায় এক ঘণ্টা দাঁড়িয়ে রইল। আর চলেই না। একদিকে নাকি লাইন সারাই হচ্ছে। তাই সিঙ্গল লাইন করে দিয়েছে। এবার শিক্ষা হয়ে গেল। পরের বার আগের ট্রেনটা ধরব।’
‘ট্রেন কেন? কোথা থেকে আসছ?’
‘তাই তো স্যার বড় ভুল হয়ে গেছে। আসল কথাটাই বলা হয়নি। আমি ফেমিলি নিয়ে গড়িয়ায় যে বস্তিটায় থাকতাম সেখানে হাইরাইজ উঠছে। বস্তি তুলে দিল। আমাদের প্রত্যেককে কিছু টাকাও দিয়েছে। কোথায় যাই? আপাতত বউ ছেলেমেয়ে নিয়ে শশুরবাড়িতে উঠেছি। গোবরডাঙ্গায়। ওখান থেকেই রোজ যাতায়াত করছি। ঠিক গোবরডাঙ্গাও নয়। গোবরডাঙ্গা থেকে ভ্যানরিক্সায় আরও কুড়ি মিনিট। ওখানে মোবাইলের টাওয়ার পাওয়া যায় না স্যার। কলকাতায় একটা বাড়ি খুব খুঁজছি, কিন্তু কোথায় বাড়ি? ছেলেমেয়ের ইস্কুল যেতে খুব অসুবিধে হচ্ছে স্যার।’
‘তাহলে তো খুবই মুস্কিলে পড়লে দেখছি। আমার একটা ছোট কাজ ছিল। কাজটা রাত্তিরে করতে হবে। কিন্তু কাজটা করে গোবরডাঙ্গা ফিরতে পারবে কিনা জানি না। তোমার তো আবার নাইট ডিউটি। সেখান থেকেও ছুটি নিতে হবে। এত কিছু পারবে কি?’
‘আপনি কাজটা বলুন স্যার, আমি ঠিক ম্যানেজ করে নেব।’
‘শোনো, কিছুদিন আগে শঙ্খদীপ চৌধুরি বলে একজনের খবর এনে দিয়েছিলে, মনে আছে?’
‘নিশ্চয় মনে আছে স্যার, এই তো সেদিনের ঘটনা।’
‘লোকটা খুন হয়েছে। ব্যারাকপুরে লাস পাওয়া গেছে। খুন হবার আগে লোকটার হাতে কিছু টাকা এসেছিল। কোথা থেকে এল? এই খবরটা জোগাড় করতে হবে। এর জন্য সেই বারে আবার যেতে হবে। গিয়ে দেখতে হবে সেখানে কেউ কিছু জানে কিনা। পারবে?’
‘পারব স্যার। কাজের জায়গা থেকে না হয় এক রাত্তির ছুটি নিয়ে নেব। আগের বারও তাই নিয়েছিলাম। কিন্তু খবর জোগাড় করতে করতে যদি মাঝরাত্তির হয়ে যায় তাহলে ট্রেন বন্ধ হয়ে যাবে। তখনই মুস্কিল।’
‘তুমি এক কাজ কর। আমার এই আপিস ঘরের একটা ডুপ্লিকেট চাবি আছে সেটা তোমার কাছে রেখে দাও। খুব রাত্তির হয়ে গেলে এই আপিস ঘরে এসে শুয়ে পড়বে। আমি শ্যামলকে বলে রাখব। শ্যামলকে চেনো তো? আমাদের ম্যানেজার।’
‘মুখ চিনি স্যার। তবু আপনি বলে রাখলে ভাল হয়।’
‘আচ্ছা, আর এই দু-হাজার টাকা রাখো। ওখানে খরচা করতে হবে।’
আদিত্য মানিব্যাগ থেকে একটা দু-হাজারের নোট বার করে বিমলকে দিল। বলল,
‘আর কিছু জিজ্ঞেস করবে?’
‘শঙ্কুবাবুর খুন সম্বন্ধে যদি আর কিছু জানা যেত’
‘তার দরকার নেই। বলবে, তুমি কানাঘুষোয় শুনেছ শঙ্কুবাবু খুন হয়েছে। খবরটা সত্যি কিনা যাচাই করতে চাও। এটাও শুনেছ মরার আগে শঙ্কুবাবু কিছু টাকা পেয়েছিল। সেই টাকা কার কাছে আছে জানতে পারলে তুমি তার কাছে গিয়ে তোমার টাকা ফেরত চাইতে পার। শঙ্কুবাবু হ্যান্ডনোট কেটে তোমার কাছ থেকে টাকা নিয়েছিল। সেই হ্যান্ডনোট তোমার কাছে আছে। ব্যাস, এইটুকুই।’
বিমল চলে যাবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে গৌতম ফোন করল।
‘আমরা শঙ্খদীপের ফ্ল্যাটটা সার্চ করতে যাচ্ছি। আধঘণ্টার মধ্যে লালবাজার চলে আসতে পারবি?’
‘অবশ্যই পারব। আমার জন্য অপেক্ষা করিস।’ আদিত্যর আপিস থেকে লালবাজার হাঁটা পথে খুব বেশি হলে দশ মিনিট। এককাপ চা খাবার সময় আছে। আদিত্য মোবাইলে শ্যামলকে চা আনতে বলল।
(৩)
মার্থা আজ আর কান্নাকাটি করছে না। পুলিশের সঙ্গে আদিত্যকে দেখে একবার শুধু চমকে উঠেছিল। এখন একেবারে গুম মেরে বসে আছে। তার সামনে পুলিশের লোক তার এক চিলতে সংসার বেয়াব্রু করে দিচ্ছে। জাগতিক সম্পদ কী বা আছে তার সংসারে? একটু আগে স্টোভে সে ভাত রেঁধেছিল আর একটা চিকেনের তরকারি। ঠিক চিকেন নয়, চিকেনের ছাঁট, নাড়িভুঁড়ি, পাকস্থলী, যা আসলে কুকুর বেড়ালের খাদ্য, সেও হয়তো কুকুরকে খাওয়ানোর ওজুহাতেই সস্তায় বাজার থেকে কিনে এনেছে। কোনওটাই খাওয়া হয়নি এখনও। আদিত্য ভাবছিল, হাঁড়ির ঢাকা, ডেকচির ঢাকা সরে যাওয়া মানে পৃথিবীর কাছে যেন উলঙ্গ হয়ে যাওয়া। এটা একটা অপমান। প্রাইভেসিতে চরম আঘাত। একমাত্র আদিত্যই বোধহয় মার্থার অপমানটা বুঝতে পারছিল।
এছাড়া কিছু পুরোনো জামা-কাপড় ছিল আর পুরোনো হাতঘড়ি, বাসন-কোসন, ছুরি-কাঁচি, স্ক্রু-ড্রাইভার, চাবির গোছা, পাউডারের কৌটো, লিপস্টিক, ভুরু আঁকার পেনসিল, বিস্কুটের টিন, ফাঁকা হরলিক্স-এর শিশি, হাতল ভাঙা সুটকেস, তালা, ছুঁচ-সুতো ইত্যাদি টুকিটাকি, যা সংসারে বেঁচে থাকতে থাকতে মানুষের অজান্তেই জমে ওঠে। এসবের সঙ্গে একটা নতুন ভ্যানিটি ব্যাগ আর মেয়েদের কয়েক প্রস্থ নতুন পোশাক ও অন্তর্বাসও ছিল। নতুন ব্যাগ, পোশাক, অন্তর্বাস সবই বেশ দামি।
‘এখানে তো কিছুই নেই।’ গৌতম হতাশ গলায় বলল।
সেকথার উত্তর না দিয়ে আদিত্য মার্থার দিকে তাকিয়ে বলল,
‘শঙ্খদীপ মারা যাবার আগে কিছু টাকা পেয়েছিল। বারে প্রচুর টাকা ওড়াচ্ছিল। তোমাকেও নতুন জামা, ব্যাগ কিনে দিয়েছে। শঙ্খদীপ কোথায় টাকা পেল?’
‘আই ডোনট নো।’ মার্থা সংক্ষিপ্ত কিন্তু দৃঢ়ভাবে বলল।
‘পুলিশ ওকে বহুবার এই প্রশ্নটা করেছে। প্রত্যেকবার ওই একই উত্তর দিচ্ছে। কিন্তু আমার মনে হয় ও নিশ্চয় কিছু জানে।’ গৌতম বলল।
আদিত্য জিনিসপত্রের স্তূপের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইল। তারপর হঠাৎ টুক করে চাবির গোছাটা তুলে নিয়ে বেশ উৎফুল্ল গলায় বলল,
‘যা পাবার পেয়ে গেছি। এবার আমরা এখান থেকে চলে যেতে পারি।’
চাবির গোছাটা তুলে নেবার সঙ্গে সঙ্গে মার্থার মুখে একটা পরিবর্তন দেখা গিয়েছিল। সে মরিয়া গলায় বলল, ‘হোয়াট আর ইউ গোয়িং টু ডু উইথ দোজ কিস?’
‘আই থিঙ্ক ওয়ান অফ দেম ইজ আ কি টু আ ব্যাঙ্ক লকার। ইট উইল সেভ আস আ লট অফ ট্রাবল ইফ ইউ টেল আস হুইচ কি অ্যান্ড হুইচ ব্যাঙ্ক।’ আদিত্য ঠান্ডা গলায় বলল।
‘আই ডোনট নো। শ্যাঙ্কি নেভার ডিসকাসড হিজ ফিনানশিয়াল ম্যাটারস উইথ মি।’
‘দেন হোয়াই ডু ইউ লুক সো আপসেট?’
‘আই অ্যাম নট আপসেট।’
মার্থা আবার মৌন হয়ে বসে আছে। গৌতম চাবির গোছাটা সঙ্গে নিয়ে একটা রসিদ লিখে দিল। বলল, ‘আমাদের কাজ হয়ে গেলে এই চাবিগুলো ফিরিয়ে দেব।’
অনেক খুঁজেও কিন্তু মার্থার ঘর থেকে শঙ্খদীপ চৌধুরির কোনো ব্যাঙ্কের কাগজ বা পাশবই পাওয়া গেল না। ফেরার পথে গৌতম জিজ্ঞেস করল, ‘চাবির কথা তোর মনে হল কেন?’
‘দ্যাখ, খুন হওয়ার আগে শঙ্খদীপ চৌধুরির হাতে অনেক টাকা এসেছিল। কে টাকা দিল? এমনি এমনি তো কেউ টাকা দেবে না, আর শঙ্খদীপ চৌধুরি হঠাৎ অনেক টাকা রোজগার করে ফেলল, এটাও সম্ভব নয়। একমাত্র সম্ভাবনা, শঙ্খদীপ কাউকে ব্ল্যাকমেল করছিল। এবং যাকে ব্ল্যাকমেল করছিল সে-ই সম্ভবত শঙ্খদীপকে খুন করেছে। কিন্তু ব্ল্যাকমেল করার জন্য কিছু ইনক্রিমিনেটিং এভিডেন্স লাগে। সেটা শঙ্খদীপ নিশ্চয় কোথাও লুকিয়ে রেখেছিল। কোথায় রাখতে পারে? হয় মার্থার বাড়িতে কিংবা কোনও ব্যাঙ্কের লকারে। কিন্তু লকারে রাখলে লকারের তো একটা চাবি থাকবে। সেই চাবিটা আর পাঁচটা কেজো-অকেজো চাবির সঙ্গে লুকিয়ে রাখলে কেউ টেরও পাবে না। এখন কোন চাবিটা লকারের চাবি এবং চাবিটা দিয়ে কোন ব্যাঙ্কের লকার খুলবে সেটা তোদের বার করতে হবে।’
‘কোনও ব্যাপারই না। এটা কয়েক দিনের মধ্যেই বার করে ফেলা যাবে। কিছু জানতে পারলে আমি তোকে জানাব। কিন্তু মন্দাকিনী চৌধুরির কেসটার সঙ্গে এই কেসটার কি কোনও সম্পর্ক আছে?’
‘না থাকলে আমি খুবই অবাক হব। কিন্তু ঠিক কী সম্পর্ক সেটা এখনও ধরতে পারিনি।’
লালবাজারের মোড়ে আদিত্য নেমে পড়ল। বাকি রাস্তাটা হেঁটে যাবে। হাঁটতে হাঁটতে তার চিন্তা করা অভ্যাস।
(৪)
দু-দিন পরে দুপুরবেলা একটি প্লেন ধোসা ও নবীন একখানি শসা দিয়ে লাঞ্চ সমাপ্ত করে আদিত্য সবে সিগারেট ধরিয়েছে এমন সময় দরজায় টোকা পড়ল। আদিত্য ভাবল শ্যামল বুঝি খাবারের পয়সা নিতে এসেছে। ভাবতে ভাবতে দরজায় আবার টোকা পড়ল। শ্যামল তো এতবার টোকা দেয় না। দরজা খুলে নিজেই ঢুকে পড়ে। উঠে গিয়ে দরজা খুলে আদিত্য দেখে বিমল দাঁড়িয়ে আছে।
‘ব্যাপার কি তোমার? কোথায় বেপাত্তা হয়ে গেছিলে? যথারীতি ফোনেও পাওয়া যায় না।’ আদিত্য একটু কড়া গলাতেই বলল।
‘বলছি স্যার। সব বলছি। আগে একটু বসি।’
চেয়ারে বসে বিমল দু-মিনিট চুপ করে রইল। তারপর আস্তে আস্তে বলল, ‘এবার আর টাওয়ার পাবার সমস্যা নয় স্যার, মোবাইলটাই চুরি হয়ে গেছে। যেন শনির দশা চলছে স্যার। বনগাঁর ট্রেনে কখনও উঠেছেন? সে এক অমানুষিক ভিড়। ওখানেই কেউ পকেট থেকে তুলে নিয়েছে। এখনও গোবরডাঙা থেকে যাতায়াত করছি। সামনের মাসে টালিগঞ্জের দিকে একটা ঘর ভাড়া পাবার কথা আছে। দেখি কী হয়।’
‘আমার কাজটা কিছু এগিয়েছে?’
‘সেই কথাটাই তো বলতে আসা স্যার। বার তিনেক সেই বারটাতে গেছিলাম। যেটুকু জানতে পেরেছি, বলছি। মনে হয় আপাতত এর বেশি খবর আর বার করতে পারব না। জানলাম, ইদানীং শঙ্খদীপ চৌধুরির হাতে বেশ কিছু টাকা এসেছিল। এটা সকলেই বলল। ইয়ারবন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে সে মাঝেমাঝেই খানাপিনা করছিল। সব বিল নিজে মিটিয়ে দিত। ইয়ারবন্ধুদের মধ্যে মাইকেলও থাকত। লোকে বলছে, মাইকেল আর তার দলবল টাকার লোভে শঙ্খদীপ চৌধুরিকে নির্জন জায়গায় নিয়ে গিয়ে খুন করেছে। শঙ্খদীপের পকেটে তাড়াতাড়া নোট থাকত। অনেকেই দেখেছে।
‘টাকা কোথা থেকে আসত জানতে পেরেছ?’
‘ওটাই তো স্যার জানতে পারিনি। কেউ বলতে পারল না।’
‘পুলিশ মাইকেলকে ধরেছে?’
‘এখনও ধরেনি স্যার। সকলে বলছে ধরবেও না। পুলিশের ওপর মহলে নাকি মাইকেলের অনেক চেনাশোনা আছে।’
‘শঙ্খদীপ যে মেয়েটার সঙ্গে থাকত তার খবর কিছু জান?’
‘খবর নিয়েছি স্যার। মেয়েটা বার-এ আর আসে না। সারাদিন বাড়ির ভেতরেই থাকে। সন্ধেবেলা ওর এক মেয়ে বন্ধু আছে তার কাছে যায়। ও নাকি শরীরের ব্যবসা ছেড়ে দিয়েছে।
‘কিন্তু ব্যবসা ছেড়ে দিলে ওর পেট চলবে কী করে?’
‘ওর বন্ধু আর ও মিলে এলিয়ট রোডের মোড়ে একটা খাবারের রেস্টুরেন্ট চালাচ্ছে। চালাচ্ছে মানে দোকানটা আগে থেকেই ছিল, ওর বন্ধুই চালাত, লোকে বলছে মার্থা তাতে নতুন করে টাকা ঢেলেছে। হয়তো শঙ্খদীপ মারা যাবার আগে মার্থাকে কিছু টাকা দিয়ে গিয়েছিল।’
‘বন্ধুর নাম-ঠিকানা জোগাড় করেছ?’
‘হ্যাঁ স্যার। বন্ধুর নাম রোজ। রোজ লি। চিনে খ্রিস্টান। এলিয়ট রোডটা এঁকেবেঁকে গিয়ে যেখানে রিপন স্ট্রিটে পড়েছে সেই মোড়েই খাবারের দোকানটা। দোকানের নাম রিপন কাফে। চাইনিজ, সাহেবি সবরকম খাবার পাওয়া যায়।’
‘হুঁ, সে তো বুঝলাম। কিন্তু আসল কথাটাই তো জানা গেল না। শঙ্খদীপের কাছে এত টাকা কোথা থেকে এল?’
‘হ্যাঁ স্যার, আসল কথাটাই জানা গেল না।’ তারপর একটু থেমে বিমল বলল, ‘আপনার আপিসের এই ডুপ্লিকেট চাবিটা ফেরত দিয়ে যাচ্ছি স্যার। কদিন খুব কাজে লেগেছিল। রাত্তিরে এখানে এসে ঘুমিয়েছি। এখন আর দরকার হবে বলে মনে হচ্ছে না।’
বিমল চাবিটা পকেট থেকে বার করে টেবিলের ওপর রাখল। বলল, ‘একটা ছোট্ট খটকা আছে স্যার। হয়তো কিছুই নয়, তবু মনে হল আপনাকে বলা দরকার। কথাটা হচ্ছে, গত রবিবার মার্থা কোথাও একটা গিয়েছিল। কোথায় গিয়েছিল কেউ বলতে পারল না। ভোরবেলা বেরিয়ে গিয়েছিল, সন্ধে করে ফিরেছে। বন্ধুকে বলে গিয়েছিল, একটা কাজে যাচ্ছে। দোকানে আসতে দেরি হবে। দোকানের এক কর্মচারী আমাকে বলেছে। এখন কথা হচ্ছে, মার্থা কোথায় গিয়েছিল? কী কাজ? কবরডাঙার দিকে তার এক বোন থাকে, কিন্তু বোনের স্বামী-ছেলে মেয়ে আছে। মার্থার মতো মেয়েমানুষের সঙ্গে তার কোনও সম্পর্ক না থাকাটাই স্বাভাবিক। আপনাকে কথাটা বলে রাখলাম। হয়তো আপনার কাজে লাগতে পারে।’
‘তুমি অনেক খবর এনেছ। খবর আনতে খরচ হয়েছে নিশ্চয়। তাছাড়া তোমার নিজের পারিশ্রমিক তো আছেই। আপাতত হাজার দশেক রাখো। পরে আবার হয়তো তোমাকে কাজে লাগতে পারে। আর শোনো। যত তাড়াতাড়ি পার একটা মোবাইল কিনে নাও। মোবাইল না থাকলে তোমার সঙ্গে যোগাযোগ করব কীকরে?’
‘মোবাইল কিনেছি স্যার। তবে আপনার নম্বরটা মুখস্ত ছিল না তো, তাই আপনাকে ফোন করতে পারিনি। আপনার নম্বরটা একবার বলবেন স্যার, একটা মিসকল দেব। একটু যদি আমার নতুন নম্বরটা সেভ করে রাখেন।’
আদিত্য নিশ্চিত যে শঙ্খদীপ কাউকে ব্ল্যাকমেল করছিল। কাকে? নিশ্চয় টাকা আছে এমন কাউকে। চৌধুরি বাড়ির কাউকে কি? মন্দাকিনীকে? যদি তাই হয় তাহলে প্রশ্ন ওঠে মন্দাকিনীর কি এমন গোপন খবর থাকতে পারে? আর থাকলেও সেটা শঙ্খদীপ জানতে পারল কী করে? কিন্তু শঙ্খদীপকে খুন কে করল? মন্দাকিনীর পক্ষে লোক লাগিয়ে শঙ্খদীপকে খুন করা শক্ত ছিল না। কিন্তু মন্দাকিনী নিজেই তো খুন হয়ে গেছে। আবার এটাও ঠিক যে, যদি সম্পত্তি তিন ভাগ হবার প্রশ্ন ওঠে তাহলে শঙ্খদীপ না থাকলে অন্য দুজনের সুবিধে। কিন্তু সম্পত্তি তিন ভাগ হবে কেন? মন্দাকিনী তো অন্যরকম উইল করেই গেছে। অবশ্য সে উইল বাতিল হয়ে যাবে যদি কখনও প্রমাণিত হয় মন্দাকিনীর অন্য কোনও পুরুষের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল। সেদিন কী খবর পেয়ে সুব্রত সেনকে চিন্তিত দেখাল? শঙ্খদীপের মৃত্যু সংবাদ? কিন্তু শঙ্খদীপ মারা গেলে সুব্রত সেনের কী? শঙ্খদীপ কী জিনিস ফাঁস করে দেবার কথা বলেছিল? তারও আগে শঙ্খদীপ একটা পারিবারিক অভিশাপের কথা বলেছিল। সেটা কী উপাধ্যায়ের বইতে যে অভিশাপের কথা লেখা আছে, সেই অভিশাপ?
সব মিলিয়ে ভারি গোলমেলে ব্যাপার। গত কয়েকদিন ধরে আদিত্য বারবার অডিওগুলো শুনেছে। সেখানেও কোথাও কোথাও বিরাট অ্যানোম্যালি আছে। আদিত্য এখনও পুরোটা ধরতে পারেনি। তবে কিছু গরমিল একেবারে স্পষ্ট। সে গৌতমের নম্বরটা ডায়াল করল।
‘একটা কথা। আমার ধারণা শঙ্খদীপ চৌধুরি মন্দাকিনীকে কিছু একটা নিয়ে ব্ল্যাকমেল করছিল। যে ডকুমেন্টটার ওপর নির্ভর করে ব্ল্যাকমেল করছিল সেটা সম্ভবত মার্থার কাছে রয়ে গেছে। এলিয়ট রোড-রিপন স্ট্রিটের মোড়ে মার্থা রিপন কাফে বলে একটা খাবারের দোকানে পয়সা ঢেলেছে। ডকুমেন্টটা সেখানে থাকতে পারে। কিংবা কবরডাঙায় মার্থার এক বোন থাকে সেখানেও থাকতে পারে। একই দিনে দুটো জায়গাতেই সার্চ করতে হবে। এটা তোদের কাজ। যত তাড়াতাড়ি কাজটা করা যায় তত ভাল।’
‘হয়ে যাবে। তুই কাল সকাল এগারোটা নাগাদ একবার লালবাজারে চলে আয়। খুব দরকারি একটা আলোচনা আছে। তুই নিজে আমাকে ফোন না করলে আমিই তোকে করতাম।’
(৫)
‘তুই ঠিকই ধরেছিলি, মার্থার কাছ থেকে পাওয়া চাবির গোছাটার মধ্যে একটা ব্যাঙ্কের লকারের চাবি ছিল। কোন ব্যাঙ্ক, কোন ব্রাঞ্চ সেসব বার করতে অনেকটা ম্যান পাওয়ার খরচ করতে হল। কিন্তু অবশেষে বার করা গেছে। সেসব ডিটেলে আর যাচ্ছি না। লকার খুলে একটা জেরক্স করা ২০১০ সালের ডায়েরি পাওয়া গেল। তাতে নানা ধরনের জিনিস লেখা আছে। ডায়েরির লেখক সুবীর চৌধুরি। আমাদের বিশ্বাস এই ডায়েরিটা দিয়েই শঙ্খদীপ মন্দাকিনী চৌধুরিকে ব্ল্যাকমেল করছিল।’ গৌতম তার চায়ের কাপে একটা চুমুক দিল।
আদিত্য খুব মন দিয়ে শুনছিল। বলল, ‘ডায়েরিতে কী এমন আছে যা দিয়ে মন্দাকিনীকে ব্ল্যাকমেল করা যায়?’
‘ডায়েরিতে নানা ধরনের কথা আছে। কিছু বিজনেস নোটস। কিছু যা যা কাজ করতে হবে তার তালিকা। ডাক্তারের ঠিকানা ও ফোন নম্বর। কিছু ওষুধপত্রের লিস্টি এবং তাদের সেবন করার সময় ও ডোজ।। আমাদের মনে রাখতে হবে, সুবীর চৌধুরি অ্যাকিউট হার্ট পেশেন্ট ছিলেন। আর কিছু ব্যক্তিগত কথা আছে ডায়েরিতে। ব্যক্তিগত কথাগুলো খুব গুছিয়ে লেখা নয়। এখানে খানিকটা, ওখানে খানিকটা। কিন্তু সেগুলো সব কটা একসঙ্গে মেলালে মনে হয় মারা যাবার আগে বেশ কিছুদিন সুবীর চৌধুরি একটা তীব্র হীনমন্যতায় ভুগছিলেন। যৌন হীনমন্যতা। ডায়েরির লেখা থেকে এটা পরিষ্কার যে সুবীর চৌধুরি তাঁর সুন্দরী তরুণী ভার্যাকে শারীরিকভাবে তৃপ্ত করতে পারছিলেন না। তাছাড়া তিনি ওই বুড়ো বয়েসে একটি পুত্র সন্তানও চাইছিলেন যে তাঁর উত্তরাধিকারী হতে পারে। তাঁর ছেলে শঙ্খদীপ তাঁকে হতাশ করেছিল। ব্যাস, এর বেশি আর কিছু নেই ডায়েরিতে। প্রশ্ন হল, এটা নিয়ে কি কাউকে ব্ল্যাকমেল করা যায়?’
‘তোদের কী মনে হচ্ছে?’
‘আমার ব্যক্তিগতভাবে মনে হচ্ছে ব্ল্যাকমেলিং-এর জন্য দু’ভাবে ডায়েরিটা ব্যবহার করা সম্ভব। এক, চৌধুরিদের স্ক্যান্ডেল প্রকাশ করে দেব এই ভয় দেখিয়ে কেউ টাকা চাইতে পারে। দুই, যে বিজনেস নোটসগুলো ডায়েরিতে আছে তার মধ্যে চৌধুরিদের কিছু কিছু বিজনেস প্র্যাক্টিসের কথা লেখা আছে যেগুলো আইনত সিদ্ধ নয়। সব কোম্পানিরই এরকম কিছু কিছু থাকে। কিন্তু এগুলো প্রকাশ পেয়ে গেলে কোম্পানির সমূহ বিপদ। অতএব রাইভাল গ্রুপের হাতে ডায়েরিটা দিয়ে দেব এইরকম ভয় দেখিয়েও কেউ টাকা চাইতে পারে।
‘হুঁ, বুঝলাম। মার্থা কী বলছে?’
‘ডায়েরির পাতাগুলো লকার থেকে বেরোবার পর আমরা মার্থাকে কাস্টডিতে নিয়েছিলাম। ইন্টারোগেশনের সময় প্রথমে মার্থা মুখ টিপে ছিল। সে নাকি শঙ্খদীপের ব্যাপারে কিছুই জানে না। তার বক্তব্য, লকারে শঙ্খদীপ কী রাখছে না রাখছে সে জানবে কী করে? কিন্তু পুলিশি জেরা তো, খুব বেশিদিন কথা গোপন রাখা যায় না। তাছাড়া, আমাদের ভাগ্য ভাল লকারটা মার্থার নামে। অতএব সে তো দায়িত্ব এড়াতেই পারে না। মার্থা অবশেষে স্বীকার করেছে, এই ডায়েরিটা দেখিয়ে শঙ্খদীপ মন্দাকিনী চৌধুরিকে ব্ল্যাকমেল করছিল। সে মন্দাকিনীকে বলেছিল, টাকা না পেলে সে মিডিয়ার কাছে ডায়েরিটা ফাঁস করে দেবে। এরকম রসালো একটা স্ক্যান্ডেল পেলে মিডিয়া অবশ্যই লুফে নেবে। আর এই কেচ্ছা মিডিয়ায় বেরোলে চৌধুরি এন্টারপ্রাইজের ব্যবসা ও সুনামের রীতিমতো ক্ষতি হয়ে যাবে। এইসব বলে সে মন্দাকিনীর কাছ থেকে টাকা আদায় করেছিল। অনেকবার নয়, একবারই মন্দাকিনী চৌধুরি শঙ্খদীপকে টাকা দিয়েছিলেন। তবে সেটা বেশ মোটা একটা টাকা। কথা হয়ে ছিল আর এক কিস্তি টাকা পেলেই শঙ্খদীপ আসল ডায়েরিটা মন্দাকিনীর হাতে তুলে দেবে।’
‘আসল ডায়েরিটা কোথায়?’
‘এটা মার্থা বলতে পারল না। আমাদের মনে হয়েছে, ও সত্যিই জানে না।’
‘কিন্তু তার মানে দাঁড়াচ্ছে, শঙ্খদীপের একজন পার্টনার ছিল যার কাছে অরিজিনাল ডায়েরিটা রয়ে গেছে।’
‘সেটাই তো দাঁড়াচ্ছে।’
‘আচ্ছা, একটা কথা বল। মিডিয়া যদি ডায়েরিটা হাতে পায় তাহলেই কি সেটা ছাপিয়ে দিতে পারবে? চৌধুরি এন্টারপ্রাইজেস তো মামলা করে দেবে। দেশে একটা আইন-কানুন তো আছে।’
‘দ্যাখ, মিডিয়া সরাসরি হয়ত এটা এদেশে ছাপাতে পারবে না, কিন্তু অন্য অনেক দেশ আছে যেখানে আইন-কানুন শিথিল। সেখান থেকে ছাপিয়ে এনে চুপিচুপি বিক্রি করতে পারে, সোশাল সাইটে পোস্ট করতে পারে। তাতে বিক্রি আরও বাড়বে। তাছাড়া বিজনেস ম্যাল প্র্যাক্টিসের ব্যাপারটাও আছে। এটা চৌধুরি এন্টারপ্রাইজের রাইভাল কোনও গ্রুপের হাতে পড়লে তারা এটাকে তাদের কাজে লাগাতেই পারে।’
‘আমি কি ডায়েরিটা একবার দেখতে পারি?’
‘অবশ্যই। আমি চাই ডায়েরিটা তুই খুব ভাল করে দেখিস। তাই তোর জন্য একটা কপি করিয়ে রেখেছি। এমন কিছু ডায়েরিটাতে থাকতেই পারে যা আমার চোখ এড়িয়ে গেছে, কিন্তু তোর চোখে পড়ে গেল।’
‘মার্থা কি ছাড়া পেয়েছে?’
‘বেল পেয়েছে। কোর্ট থেকে বেল পেয়ে গেল।’
‘মার্থার দোকান এবং কবরডাঙায় ওর বোনের বাড়ি সার্চ করে হয়তো কিছু পাওয়া যেতে পারে?’
‘আজকেই জানলাম, তুই বলার আগেই আমার অফিসাররা ওই দুটো জায়গা সার্চ করেছিল। দোকানে কিছুই পাওয়া যায়নি, কবরডাঙাতেও না। তবে দুটো জায়গার লোকেরাই বলল, মার্থার হাতে বেশ কিছু টাকা এসেছে। দোকানে টাকা ইনভেস্ট করেছে, বোনের কাছে বেশ কিছু টাকা গচ্ছিত রেখেছে। আমরা মার্থাকে জিজ্ঞেস করলাম, এত টাকা কোথা থেকে পেলে। মার্থা বলল, এটা নাকি ওর নিজের হার্ড আর্নড মানি।’
‘মাইকেল ডিসুজাকে অ্যারেস্ট করেছিস? আমার মনে হয়, অ্যাকচুয়াল মার্ডারটা ও বা ওর লোকজন মিলে করেছে।’
‘সেটাই মোস্ট লাইকলি। তবে ওকে সম্ভবত কেউ কাজে লাগিয়েছে। নেপথ্যে থাকা সেই ব্যক্তিটির কাছে পৌঁছনো দরকার। তাই মাইকেলকে এখনও অ্যারেস্ট করিনি। ইচ্ছে করেই ছেড়ে রেখেছি। ওর ওপর কড়া নজর আছে। ও কোথায় যায়, কার কার সঙ্গে কথা বলে সবই নোট করা হচ্ছে।’
গৌতম তার টেবিলের ড্রয়ার থেকে একটা এ-ফোর সাইজের খাম বার করল। খামের মুখ বন্ধ। আদিত্যর হাতে দিয়ে বলল, এটাতে ডায়েরিটা জেরক্স করা আছে। তুই ভাল করে পড়ে দেখ।’
আদিত্য খামটা হাতে নিয়ে বলল, ‘আর একটা প্রশ্ন। মন্দাকিনী চৌধুরির ব্যাপারটায় আর কিছু জানা গেল?’
‘একটা ব্যাপার জানা গেছে। সুবীর চৌধুরি মারা যাবার পরথেকেই কম্পানির অবস্থা একটু একটু করে খারাপ হয়েছে। এই মুহূর্তে চৌধুরি এন্টারপ্রাইজের বাজার দর একেবারে তলানিতে। একটা অবভিয়াস এক্সপ্লানেশন হল সুবীর চৌধুরির মতো কোম্পানি চালানোর ক্ষমতা মন্দাকিনীর ছিল না। হয়তো তার অনভিজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে কিছু চুরি-টুরি হয়েছে। আসল চিত্রটা বোঝার জন্য কোম্পানির একটা ফরেনসিক অডিট দরকার। একটা অডিট ফার্মকে সেই দায়িত্বটা দেওয়া হয়েছে।’
‘মন্দাকিনী চৌধুরি তার সমস্ত সম্পত্তি যে এনজিও-টিকে দিয়ে গেছে, তার সম্বন্ধেও খোঁজ নেওয়া দরকার।’
‘এই এনজিও-র ব্যাপারটা আমরা সদ্য জানতে পেরেছি। এনজিওটা মরিশাসে রেজিস্টার্ড। একটু গোলমেলে। ওদের সম্বন্ধে খোঁজ-খবর নিতে একটু সময় লাগবে। কিছু ইন্টারন্যাশানাল ফর্ম্যালিটি আছে।’
বেয়ারা আর একবার চা নিয়ে এসেছে। সঙ্গে ক্রিমক্র্যাকার। গৌতম চায়ে চুমুক লাগিয়ে বলল, এবার তোর কথা বল। তুইতো কিছুদিন ধরেই ব্যাপারটা ইনভেস্টিগেট করছিস।’
‘হ্যাঁ করছি। বিভিন্নলোকের সঙ্গে কথা বলে আমার মনে একটা আবছা ধারণা তৈরি হয়েছে। বলতে পারিস সেটা একটা হাইপথিসিস, যা আমি এখখুনি প্রমাণ বা অপ্রমাণ কিছুই করতে পারব না। তাছাড়া তাতে এই মুহূর্তে কিছু গ্যাপও আছে। কিন্তু আমি আমার হাইপথিসিসটা তোর সঙ্গে শেয়ার করতে চাই। তোর সঙ্গে আলোচনা করলে আমার কাছেও জিনিসটা পরিষ্কার হবে।’
গৌতমের সঙ্গে কথা বলে আদিত্য যখন লাল বাজার থেকে বেরোল তখন তিনটে বেজে গেছে। আদিত্য টের পেল তার বেশ খিদে পেয়েছে।