চৌধুরি বাড়ির রহস্য – ৯
নবম পরিচ্ছেদ
(১)
বাইন্ডার ক্লিপ আটকানো একতাড়া জেরক্স করা কাগজ। পুরো ডায়েরিটাই কপি করে দিয়েছে। লাইন টানা পাতা প্রায় চারশো। প্রত্যেক পাতার ওপরে তারিখ লেখা। তবে দেখে মনে হয় না, ডায়েরির এন্ট্রিগুলো তারিখ মেনে হয়েছে। বেশিরভাগ পাতাই ফাঁকা। কিছু কিছু পাতায় আবার এলোমেলো ভাবে দুটো তিনটে শব্দ, হয়তো শুধু একটা নাম, আবার কখনো-কখনো দু’চার লাইন লেখা নাম-ঠিকানা, তার নীচে কিছু কমেন্ট। অন্য কিছু কিছু পাতায় টানা লেখা এক-দুই প্যারাগ্রাফ। তবে তেমন পাতার সংখ্যা খুব বেশি নয়। অনুমান করা যেতে পারে, সুবীর চৌধুরির প্রত্যেক দিনের করনীয়গুলো তাঁর প্রাইভেট সেক্রেটারির কাছে লেখা থাকত। এই লেখাগুলো সেরকম নয়। শুধুমাত্র নিজের জন্য ডায়েরিতে দু’-চারটে কথা লিখে রাখা। কোনও কোনও ব্যক্তি সম্বন্ধে বেশ নিন্দাসূচক মন্তব্য আছে। কারো কারো সম্বন্ধে প্রশংসা। নিজের স্ত্রীকে নিয়েও অনেক কথা আছে যার সবটাই প্রশংসা নয়। ব্যবসা-সংক্রান্ত কথাও অনেক আছে। মনে হয়, সুবীর চৌধুরী কখনো চাননি এই ডায়েরি অন্য কেউ দেখুক। প্রায় সব লেখাই ইংরেজিতে, কালেভদ্রে দু’একটা বাংলা লেখাও আছে। একটা বড় সুবিধে, সুবীর চৌধুরির হাতের লেখা অত্যন্ত পরিষ্কার। পড়তে একটুও অসুবিধে হয় না। গৌতম বলেছিল, পুলিস যাচাই করে নিয়েছে এটা সুবীর চৌধুরিরই হাতের লেখা।
গত দুদিন আদিত্য পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে ডায়েরিটা পড়েছে। একটা ম্যাগ্নিফাইং গ্লাস কিনে নিয়েছে যাতে কিছু মিস না করে যায়। দু’একটা লেখা পেন্সিলে যেগুলো ম্যাগ্নিফায়িং গ্লাস ছাড়া পড়া সম্ভব ছিল না।
আদিত্য ডায়েরির এন্ট্রিগুলো দু’ভাগে ভাগ করে নিয়েছে। প্রথম ভাগে রেখেছে ব্যক্তিগত লেখাগুলোকে। দ্বিতীয় ভাগে ব্যবসা সংক্রান্ত নোটস। ব্যক্তিগত লেখাগুলো থেকে এটা স্পষ্ট যে সুবীর চৌধুরির দ্বিতীয় বিয়েটা সুখের হয়নি। লেখাগুলোর ছত্রে ছত্রে তার প্রমাণ রয়েছে। আদিত্য কিছু কিছু জায়গায় দাগ দিয়ে রেখেছে। দাগ দেওয়া জায়গাগুলো সে আলাদা একটা তালিকা করে তার নোট খাতায় লিখে রাখল যা বাংলা তর্জমা করলে এইরকম দাঁড়াবে :
১। ম-এর শরীরটা যতটা সুন্দর, মনটা ততটাই ঠান্ডা। তবে ওকে দোষ দিতে পারছি না। আমার শারীরিক অক্ষমতা ক্রমশ বাড়ছে। ম-এর কতই বা বয়েস? আমিই তো ওকে টাকার লোভ দেখিয়ে ছিনিয়ে এনেছি।
২। কাল রাতে আবার পারলাম না। না পারার থেকেও কষ্টকর ওর ঠান্ডা নিরাসক্তি।
৩। অভিশাপ, চৌধুরিদের ওপর সেই পুরোনো অভিশাপটা আবার ফিরে এসেছে। নিজেকে মহাভারতের পাণ্ডুর মতো মনে হয়। ম যেন মাদ্রী, আমাকে ভীষণ আকর্ষণ করে, কিন্তু ছোঁয়া যাবে না।
৪। ম-এর প্রথম স্বামীর জন্য দুঃখ হয়। লোকটা ছিল একটা আদর্শবাদী গাধা। কিন্তু আদর্শবাদী গাধাদেরও তো বাঁচার অধিকার আছে। আমি পয়সার জোরে ওর ভেতরের মানুষটাকে মেরে ফেলেছি। এটাই কি অভিশাপের কারণ?
৫। আবার কাল রাতে ব্যর্থ। কিছু একটা করতেই হবে। শরীরটাও ভাল নেই।
৬। আমার একজন পুত্র সন্তান দরকার যে আমার উত্তরাধিকারী হতে পারবে। আমাকে হতাশ করেছে। ম বলছে একটা আয়ুর্বেদিক ওষুধ চেষ্টা করতে। ও-ই জোগাড় করবে। এর নাকি কোনও পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া নেই। আমি রাজি হয়েছি।
৭। অনুরাধা, আমি তোমার দিকে যথেষ্ট নজর দিইনি। তাই কি তুমি এত তাড়াতাড়ি চলে গেলে? তুমি থাকলে ছেলেমেয়েগুলো এরকম কুপথে যেতো না। বিশেষ করে।
৮। প্যাকেটের গায়ে ওষুধের নাম লেখা আছে অশ্বগন্ধেশ্বরী। বলছে এতে অশ্বগন্ধা ছাড়াও আরও তিরিশ রকমের শেকড়-বাকড় আছে। কবিরাজের নাম অবিনাশ সেন। ঠিকানা ১৩/২ গৌর দে লেন। (সেটা আবার কোথায়?)। রোজ সকালে মধু দিয়ে খেতে হবে। দেখা যাক।
৯। শরীরের অবস্থা রোজ খারাপ হচ্ছে। পরিশ্রম কমাতে হবে। দুশ্চিন্তা কমাতে হবে।
১০। ডাক্তার বদল করতে বলছে। কিন্তু ডাঃ সেনগুপ্ত আমাকে অনেকদিন দেখছে। আমার নাড়ি নক্ষত্র জানে। তাকে বদলানো কি ঠিক হবে?
১১। মাঝে মাঝে মনে হয়, আর বেশি দিন নেই। একটা প্রায়শ্চিত্য করতে হবে। যদি আমাকে আর একটু ভালবাসত।
ব্যবসা সংক্রান্ত মন্তব্যগুলোতে আদিত্য তেমন কিছু পেল না। ব্যবসার কিছু কৌশলের কথা আছে। কয়েকজন প্রতিযোগীর নাম আছে। তাদের কী করে শায়েস্তা করা যায় তার নানারকম প্ল্যান আছে। যেমন কিছুটা বাঁকা পথে তাদের কাঁচা মালের জোগান বন্ধ করে দিলে কিংবা খুচরো দোকান যাতে তাদের মাল না নেয় তার ব্যবস্থা করলে তাদের বিক্রি কতটা মার খেতে পারে তার লম্বা আলোচনা আছে। কী করে ট্যাক্স বাঁচানো যায় সেই সম্বন্ধেও অনেক কথা আছে। আদিত্যর মনে হল এইসব পরিকল্পনার কোনওটাই ঠিক বেআইনি নয়। অনৈতিক হলেও হতে পারে। কিন্তু ব্যবসায় কে কবে নিয়ম-নীতি মেনে চলে? চৌধুরিদের প্রতিযোগীরাও কি চলে? যাই হোক, আদিত্য নিশ্চিত যে এসব দিয়ে মন্দাকিনীকে ব্ল্যাকমেল করা যায় না। গৌতম যাই বলুক।
কিন্তু ব্যক্তিগত যে কথাগুলো আছে তাই দিয়েও কি মন্দাকিনীকে ব্ল্যাকমেল করা চলে? সুবীর চৌধুরি শারীরিকভাবে অক্ষম হলে মন্দাকিনীর কি দোষ? তাকে বরং লোকে সহানুভূতির চোখেই দেখবে। এসব ব্যক্তিগত জিনিস বাজারে বেরোলে চৌধুরিদের ব্যবসার বিরাট ক্ষতি হয়ে যাবে এমনও মনে হয় না। তাহলে মন্দাকিনী শঙ্খদীপের মুখ বন্ধ করার জন্য টাকা দিল কেন? নিশ্চয় ডায়েরির মধ্যে এমন কিছু আছে যেটা মন্দাকিনীর পক্ষে মারাত্মক ছিল। আদিত্য এখনও সেটা ধরতে পারেনি। সেটা ঠিক কী শঙ্খদীপ কি বুঝতে পেরেছিল? তার তো অতটা বুঝতে পারার কথা নয়। শঙ্খদীপের একজন পার্টনার ছিল। সে-ই কি ব্যাপারটা বুঝে, নিজে আড়ালে থেকে শঙ্খদীপকে সামনে এগিয়ে দিয়েছিল? ডায়েরিটা কি সেই পার্টনার-এর কাছেই ছিল? কী করে গেল?
এইসব ভাবতে ভাবতে আদিত্যর মাথাটা গরম হয়ে গিয়েছিল। বাইরে রোদ্দুরের তেমন তেজ নেই, আকাশে ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘ। ঘড়িতে বিকেল চারটে পাঁচ। আদিত্য ভাবল একটু হেঁটে আসবে। বেরোনোর আগে সে গুগল ম্যাপে দেখল, গৌর দে লেনটা বউবাজারের খুব কাছে, তার আপিস থেকে হাঁটা পথ।
(২)
বউ বাজারের ছানাপট্টি থেকে বড় রাস্তা ধরে সুবোধ মল্লিক স্কোয়ারের দিকে কয়েক মিনিট হাঁটলেই হিদারাম ব্যানার্জি লেন বাঁ-হাতে ঢুকে গেছে। সেই রাস্তা ধরে কিছুটা এগিয়ে প্রথম বাঁ দিকের গলিটার নাম গৌর দে লেন। গলিটা এত সরু যে দিনের বেলাতেও সূর্যের আলো ঢোকে না, অতিবৃদ্ধ বাড়িগুলো পরস্পরের গায়ে গা লাগিয়ে কোনো রকমে দাঁড়িয়ে আছে। দু-একটা বাড়ির শরীর দিয়ে বট-অশথ ঝুরি নামিয়েছে, কোনও কোনও বাড়িতে জানলা-দরজার বালাই নেই, ভেতরে বাদুড়-চামচিকের সঙ্গে জবর দখল কারিরা খাটিয়া পেতে বাস করে। এক ঝলক তাকালেই বোঝা যায়, গত একশো-দেড়শো বছর এই রাস্তাটা পরিবর্তনের মুখ দেখেনি।
১৩/২ বাড়িটা খুঁজে পেতে অসুবিধে হল না। সদর দরজাটা হাট করে খোলা। সদর দরজার গায় ফাটল ধরা বাঁধানো বসার বেদী পেরিয়ে আদিত্য ভেতরে ঢুকল। সাবেকি উঠোন ঘিরে আট-দশটা ঘর। কোনও ঘরে গাড়ির ব্যাটারির দোকান, কোথাও পুরোনো খবর কাগজ, শিশি-বোতলের আড়ত, কয়লার ডিপো। তারই মধ্যে আবার দুটো ঘর জুড়ে একটা প্রেস চলছে। একটা ঘরে মেশিন, ঘটাং ঘটাং করে কী যেন ছাপা হচ্ছে সেখানে। অন্য ঘরে একজন অতি শীর্ণকায় কম্পোজিটার বসে বসে কম্পোজ করছেন। আদিত্য তাকে জিজ্ঞেস করল, ‘কবিরাজ অবিনাশ সেন কি এখানে থাকেন?’
একটা ‘গ’কে চিমটে দিয়ে তুলে ফ্রেমবদ্ধ করতে করতে কম্পোজিটর মশাই বললেন, ‘চিঠি লিখে আসছেন তো? না হলে কিন্তু কবিরাজ মশাই দেখা করেন না। তাছাড়া ওনার শরীরটাও ভাল নেই। বয়েস হচ্ছে তো।’
কম্পোজিটর মশাইকে কাজ করতে দেখে আদিত্যর মনে হল এই কায়দায় বোধহয় উইলিয়ম কেরির আমলে শ্রীরামপুরে বাইবেল ছাপা হত। সে মুখে বলল, ‘চিঠি তো লেখা হয়নি। আমি অনেক দূর থেকে আসছি বললে দেখা করবেন না?’
‘দেখুন চেষ্টা করে। দোতলায় উঠে কোনার ঘরটায় কবিরাজ মশাই থাকেন।’
কবিরাজ মশায়ের দরজাটা আধখোলা। আদিত্য একটু ধাক্কা দিতেই ক্যাঁঅ্যাঁঅ্যাঁচ করে একটা বিশ্রী শব্দ হল আর সঙ্গে সঙ্গে একটা কাঁপা কাঁপা গলায় কেউ বলে উঠল, ‘কেএএ?’
আদিত্য কী বলবে ভাবছে, এমন সময় সেই কাঁপা কাঁপা গলাটা আবার বলে উঠল, ‘কাঞ্জিলাল দ্যাখ তো কেউ এল নাকি।’
কাঞ্জিলাল নামক লোকটি এবার দরজার সামনে এসে দেখা দিল। আদিত্যকে দেখে বলল, ‘কবিরাজ মশায়ের সঙ্গে দেখা করবেন? চিঠি দিয়েছিলেন?’
‘চিঠি তো দেওয়া হয়নি। আসলে আমি রুগি নই। খবর কাগজের আপিস থেকে আসছি। কবিরাজ মশায়ের একটা ইন্টারভিউ নেব।’
কবিরাজ মশাই মনে হয় কথাগুলো শুনতে পেলেন। কারণ ঘরের ভেতর থেকে সেই কাঁপা কাঁপা গলাটা আবার শোনা গেল, ‘কাঞ্জিলাল ওঁকে ভেতরে আসতে বল।’
ঘরের ভেতরটা প্রায় অন্ধকার। প্রথম দু-মিনিট আদিত্য কিছুই দেখতে পাচ্ছিল না। শুধু ওষুধ, পুরোনো জামাকাপড় আর বদ্ধ ঘরের একটা সম্মিলিত দুর্গন্ধ তার ঘ্রাণেন্দ্রিয়কে পীড়া দিচ্ছিল। তারপর চোখটা একটু সয়ে আসতে আদিত্য দেখল ঘরের এক কোনে একটা চৌকির ওপর কেউ শুয়ে আছে। আর একটু ভাল করে দেখে আদিত্য বুঝল যিনি শুয়ে আছেন তাঁর বয়েস নব্বই বছরের কম হবে না।
নবতিপর বৃদ্ধটি কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন, ‘আমার শরীরটা ভাল নেই। বেশিক্ষণ বসে থাকতে পারি না। আপনার সঙ্গে শুয়ে শুয়ে কথা বলছি বলে মার্জনা করবেন।’
‘আপনি আমার সঙ্গে কথা বলতে রাজি হয়েছেন, সেটাই আমার পরম সৌভাগ্য। আপনাকে বেশিক্ষণ কষ্ট দেব না। আমি একজন ফ্রিলান্স সাংবাদিক। খবর কাগজে টুকটাক লিখি। এই আমার কার্ড।’
আদিত্য তার সাংবাদিক পরিচয়ের একটা ভিজিটিং কার্ড বৃদ্ধের হাতে দিল।
বৃদ্ধ বললেন, ‘আপনি এই চেয়ারটায় বসুন। আমি চোখে প্রায় দেখতেই পাই না, ভিজিটিং কার্ড পড়ব কী করে? কাঞ্জিলাল, এই কার্ডটা রেখে দে।’
আদিত্য বলল, ‘আমি ইনফারটিলিটি বা বন্ধ্যাত্ব নিয়ে একটা ফিচার লিখছি। ভারতে প্রথম টেস্ট টিউব বেবি জন্মেছিল চল্লিশ বছর আগে, যদিও সেই সময় সেই অসাধারণ কৃতিত্ব সরকারি স্বীকৃতি পায়নি। পরে পেয়েছে। তারপর কৃত্রিম উপায়ে আরও অনেক শিশুর জন্ম হয়েছে। কিন্তু এই কৃত্রিম উপায়ে প্রজনন যখন মানুষের আয়ত্বে আসেনি, তখনও বন্ধাত্বের চিকিৎসা হত। বস্তুত, প্রাচীন আয়ুর্বেদেই বন্ধাত্বের নানারকম চিকিৎসা আছে। একটা সময় ছিল যখন ছেলে এবং মেয়েদের বন্ধ্যাত্বের আপনি অসাধারণ চিকিৎসা করতেন। সেই চিকিৎসা সম্বন্ধে যদি কিছু বলেন।’
বৃদ্ধ একটু উঠে বসার চেষ্টা করলেন। তাঁকে খানিকটা উত্তেজিত মনে হল। উত্তেজনা এবং উঠে বসার পরিশ্রমে তিনি কিছুটা ক্লান্ত হয়ে পড়লেন। খানিকক্ষণ দম নিয়ে বৃদ্ধ বললেন, ‘বন্ধ্যাত্বের চিকিৎসা-পদ্ধতি আমি উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছিলাম। আমরা সাত পুরুষের কবিরাজ। কিন্তু আপনি হয়তো জানেন না আমি একজন এমবিবিএস পাশ করা অ্যালোপ্যাথ ডাক্তারও বটে। তবে নিজে কখনও অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসা করিনি। বংশ পরম্পরায় যে জ্ঞান আমি লাভ করেছি, সারাজীবন তারই চর্চা করে গেছি। অবশ্য অ্যালোপ্যাথিতে যে নানা রকম টেস্ট আছে আমি তা সব সময় ব্যবহার করেছি।’
বৃদ্ধ থামলেন। খানিকটা দম নিয়ে শুরু করলেন আবার। ‘মেয়েদের বন্ধ্যাত্বের কিছু কিছু চিকিৎসা আমি করেছি, কখনো কখনো সাফল্যও পেয়েছি। কিন্তু সেটা বলার মতো কিছু নয়। আমার আসল সাফল্য ছিল পুরুষদের বন্ধ্যাত্বের চিকিৎসায়। একটা ওষুধ তৈরি করেছিলাম যা পুরুষদের বন্ধ্যাত্বে বা পুরুষত্বহীনতায় খুব ভাল কাজ করত। তবে এই ওষুধটার একটা সমস্যা ছিল। যাদের হার্ট দুর্বল তাদের এই ওষুধটা দেওয়া যেত না। তাই নানারকম পরীক্ষা করে ভীষণ সাবধানে এই ওষুধটা দিতে হত।’
‘কতদিন অব্দি আপনি এই চিকিৎসাটা করেছেন?’
‘সঠিক বলতে পারব না, যতদূর মনে পড়ছে সাত-আট বছর আগেও এই ওষুধটা দিয়ে কাজ পেয়েছি। তারপর কী হল, নাড়ি দেখার জন্য যে প্রবল মনসংযোগটা লাগে সেটা আমি আস্তে আস্তে হারিয়ে ফেললাম। অথচ ভাল করে নাড়ি দেখে হার্টের অবস্থাটা বুঝতে না পারলে ওষুধটা দেব কী করে? তাই ওই চিকিৎসাটাই ছেড়ে দিলাম। কাঞ্জিলাল, আমার পুরোনো লাল খাতাটা বার কর তো।’
কাঞ্জিলাল খাতা নিয়ে আসার পর বৃদ্ধ বললেন, ‘শেষ এন্ট্রির তারিখটা দেখ তো কবে।’
কাঞ্জিলাল খাতার পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে একটা জায়গায় থামল। তারপর বলল, ‘শেষবার আপনি ওষুধটা দিয়েছিলেন আট বছর আগে, ২০১০ সালের জুন মাসে।’
একটু পরে রাস্তায় নেমে আদিত্য গৌতমকে ফোন করল।
‘শোন। একটা ঠিকানা লিখে নে, ১৩/২ গৌর দে লেন। রাস্তাটা বউবাজার মোড়ের খুব কাছে। দোতলায় থাকেন কবিরাজ অবিনাশ সেন। খুব বৃদ্ধ মানুষ। তিনি এক সময় পুরুষদের বন্ধ্যাত্ব কাটানোর একটা ওষুধ দিতেন, নাম অশ্বগন্ধেশ্বরী। যাদের দিতেন তাদের নাম ঠিকানা একটা লাল খাতায় লিখে রাখতেন। ওই খাতাটার একটা কপি চাই। পুলিশ চাইলে উনি নিশ্চয় দিয়ে দেবেন। হেঁয়ালি মনে হচ্ছে? দেখা হলে পুরোটা খুলে বলব। রাস্তায় রয়েছি। এখন রাখছি।’
রহস্যের জট ক্রমশ খুলছে। আদিত্য খুশি হয়ে একটা সিগারেট ধরিয়ে ফেলল। সিগারেটটা ধরিয়ে সবে দু-চার পা এগিয়েছে, সোহিনীর ফোন।
‘আদিত্যবাবু, ভাল আছেন?’
‘আমিতো ভালই আছি। আপনারা কেমন আছেন?’
‘আমাদের কিছু খবর আছে। আপনার সঙ্গে একটু কথা বলতে পারলে ভাল হতো। আপনি আমাদের বাড়িতে কি একবার আসতে পারবেন?’
‘কবে যাব?’
‘যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। আজ সন্ধেবেলা আসতে পারবেন?’
আদিত্য একটু ভাবল। আজ সন্ধেবেলা হাতে তেমন কাজ নেই। বলল, ‘ঠিক আছে। ঘণ্টা খানেক ঘণ্টাদেড়েকের মধ্যে পৌঁছে যাচ্ছি। আপনাদের বাড়ির ঠিকানাটা বলবেন?’
‘১৭৭ সানিপার্ক। একটা পুরোনো দোতলা বাড়ি। আমরা একতলায় থাকি। বালিগঞ্জ ফাঁড়ির কাছে। বিড়লা মন্দিরের দক্ষিণদিক দিয়ে রাস্তাটা বেরিয়েছে।’
বউবাজারের মোড় থেকে এসপ্লানেডের ট্র্যাম ধরল আদিত্য। ফাঁকা ট্রাম, উঠেই বসার জায়গা পেয়ে গেল। এসপ্লানেডে গাড়ি বদল। এবার ট্রাম গুমটির ঘড়ির নীচ থেকে বালিগঞ্জের ট্রাম ধরল। তার ভাগ্য ভাল এবারও বসার জায়গা পেয়ে গেল। ঘণ্টা বাজাতে বাজাতে ট্রাম চলেছে। রাস্তায় আপিস-ফেরত মানুষের ভিড়। একটু পরে সুবোধ মল্লিক স্কোয়ারের কাছে যখন ট্রাম থেমেছে তখন আদিত্যর মনে হল, আহা এখান থেকেই তো উঠলে পারতাম। খামোকা এসপ্লানেড অব্দি যেতে গেলাম কেন? তারপর ভাবল এখান থেকে উঠলে কি আর বসার জায়গা পেতাম? গাড়ি যখন রিপন স্ট্রিট পেরোচ্ছে, আদিত্য জানলা দিয়ে হঠাৎ রিপন কাফে দোকানটা দেখতে পেল। বেশ সাজানো দোকান, এতটাই সাজানো যে ওই অঞ্চলটার পক্ষে যেন একটু বেমানান। আধঘণ্টা বাদে আদিত্য যখন বালিগঞ্জ পোস্টাপিসের স্টপে গিয়ে নামল তখন সাড়ে ছটা বেজে গেছে।
ষাট-সত্তর দশকে অতি অবস্থাপন্নরা কীভাবে বসবাস করত সোহিনীর ফ্ল্যাটে ঢুকলে তার একটা আন্দাজ পাওয়া যাবে। সেই অতি অবস্থাপন্নদের উত্তরপুরুষরা অনেকেই এখন আধুনিকতর জীবনযাপনের উদ্দেশ্যে বহুতলের বাসিন্দা হয়ে গেছে। পুরোনো বাড়িগুলোও দ্রুত উধাও হয়ে গিয়ে আকাশচুম্বি আবাসনগুলোকে জায়গা করে দিচ্ছে। সেদিক থেকে ১৭৭ সানি পার্ক একটা ব্যতিক্রম। টাকাপয়সার অভাব নেই বলেই হোক বা অন্য যে-কোনও কারণেই হোক, চৌধুরি এন্টারপ্রাইজেস এখনও এই বাড়িটা প্রোমোটারদের হাতে তুলে দেয়নি। একতলায় সোহিনীকে তার মা থাকতে দিয়েছে, দোতলায় কোম্পানির চিফ ফিনান্স অফিসার সুব্রমনিয়ম পরিবার নিয়ে থাকেন।
বাড়ির ভেতরে ঢুকে আদিত্য দেখল বাঁদিকে লন, ডানদিকে দোতলা বাড়ি। একতলায় কলিং বেলের বদলে পেতলের চকচকে ঘণ্টা। ঘণ্টা থেকে সুদৃশ্য দড়ি ঝুলছে। আদিত্য দড়ি ধরে টান দিতে ঘণ্টা বাজল, দরজা খুলে গেল, বেয়ারা আদিত্যকে নিয়ে গিয়ে বসাল ঠান্ডা ড্রয়িংরুমে। মস্ত ড্রয়িংরুম, একদিকে সোফাসেট, বাড়তি দু’তিনটে আরাম-কেদারা, অন্যদিকে গ্র্যান্ড পিয়ানো। সোহিনী মৈত্রকে তার মা আরামেই রেখেছিল।
‘আপনাকে কী বলে ধন্যবাদ জানাব, এত অল্প নোটিসে আপনি এলেন।’ ভেতরের একটা দরজা দিয়ে সোহিনী ঘরে ঢুকল। আদিত্যর পাশে একটা কৌচে বসে বলল, ‘চা খাবেন তো?’
‘আপত্তি নেই।’
‘ফোনে বলেছিলাম, খবর আছে। খবরটা আগে দিয়ে নিই। একটা নয়, একসঙ্গে দুটো খবর। মা খুব জোর করেছিল বলে আমি পিএইচডি করার জন্য বিদেশের কয়েকটা ইউনিভার্সিটিতে অ্যাপ্লাই করেছিলাম। তার মধ্যে নিউ ইয়র্কের কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটি অ্যাডমিশন দিয়েছিল, কিন্তু কোনও ফিনানশিয়াল সাপোর্ট দেয়নি। মা অবশ্য পুরোটাই স্পনসর করবে বলেছিল, কিন্তু মার কাছ থেকে অতগুলো টাকা নিতে আমি রাজি হইনি। আমি তার বদলে কয়েকটা আউটসাইড এজেন্সিতে স্পনসরশিপ বা স্কলারশিপের জন্য অ্যাপ্লাই করেছিলাম, তার মধ্যে দু’একটা এজেন্সির নাম মা-ই সাজেস্ট করেছিল। গতকাল মরিশাসের একটা ট্রাস্ট জানিয়েছে তারা আমার পিএইচডি-র সমস্ত খরচ দিতে রাজি আছে। এটা তাদের পেরেন্ট কোম্পানির করপোরেট সোশাল রেসপন্সিবিলিটির একটা স্কীম। ট্যুইশন ছাড়াও একটা জেনরস ফেলোশিপ পাব যা দিয়ে নিউ ইয়র্কের মতো শহরেও ল্যাভিশলি চলে যাবে। আমি ভাবছিলাম, এত ভাল সুযোগ তো আর আসবে না, তাই এটা ছাড়া উচিত নয়। তাছাড়া মার নতুন উইলে যেটুকু পাব তা দিয়ে কলকাতায় চালানো শক্ত। এই বাড়িটাও তো ছেড়ে দিতে হবে।
বেয়ারা চা দিয়ে গেল। সোহিনী একটু থামল। আদিত্যর জন্যে এবং নিজের জন্যে চা ঢালল। চায়ে একটা চুমুক দিয়ে আবার শুরু করল।
‘শুধু চিন্তা ছিল নন্দনকে নিয়ে। আমি বিদেশ চলে গেলে নন্দনকে কে দেখবে? ও এখনও ঠিক নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারেনি। একটা ভালরকমের সাপোর্ট ওর দরকার হয়। অথচ দুর্দান্ত গাইছে। এই সময় গান থামিয়ে ওকে যদি পেটের চিন্তা করতে হয় তাহলে ওর গানটাই নষ্ট হয়ে যাবে। নন্দন অবশ্য মাঝে মাঝে বলে মুম্বাই গিয়ে কমার্শিয়াল লাইনে লাক ট্রাই করবে। আমার ওপর এভাবে নির্ভর করতে ওর ভাল লাগে না। কিন্তু সেসব কথার কথা। আমি জানি, ওকে যদি শাস্ত্রীয় সঙ্গীত ছেড়ে দিতে হয় তাহলে ও মরেই যাবে। এমনই ভাল কপাল, আজ সকালে পুনের একটা সঙ্গীত-আশ্রম নন্দনকে জানিয়েছে ওকে ওরা জুনিয়র ফ্যাকাল্টি হিসেবে নিয়োগ করতে চায়। সঙ্গীত আশ্রমটি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের জগতে খুবই বিখ্যাত। কিছুদিন আগে পুনেতে নন্দন প্রোগ্রাম করেছিল। ওদের কর্তারা নন্দনের গান শুনে খুশি হয়েছেন। জুনিয়র ফ্যাকাল্টি হিসেবে নন্দন যেমন তরুণ শিক্ষার্থীদের গান শেখাবে, তেমনি ওখানকার কোনও সিনিয়র ফ্যাকাল্টির কাছে নাড়া বেঁধে নিজে শিখতেও পারে। ওখানে নন্দনদের ঘরের একজন বৃদ্ধ ওস্তাদ আছেন যাঁর কাছে সঙ্গীতের অফুরন্ত ভাণ্ডার রয়েছে। সেসব শিখতে পারলে নন্দনের গান আরও অনেক ম্যাচিয়োর্ড হবে। নন্দন এই সুযোগ ছাড়তে চায় না।
‘তাহলে ব্যাপারটা এই দাঁড়াচ্ছে যে খুব শিগগির আপনারা দুজনেই উচ্চশিক্ষার জন্য কলকাতা ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। আপনাদের দুজনকেই আমার আন্তরিক অভিনন্দন।’ আদিত্য খুশি হয়ে বলল। তারপর একটু থেমে বলল, ‘তাহলে কি ধরে নেব মন্দাকিনী চৌধুরির কেসটা থেকে আমাকে অব্যাহতি দেওয়া হল? সেটা বলতেই কি আমাকে ডেকেছেন?’
‘ঠিক তা নয়। আমরা খুবই চাই মার মৃত্যুর ব্যাপারটার একটা কিনারা হোক। কিন্তু বুঝতেই তো পারছেন, এখন আর চৌধুরি এন্টারপ্রাইজেস-এর রিসোর্স-এর ওপর আমার কোনও কনট্রোল নেই। আমার পক্ষে আপনার পারিশ্রমিকটা দেওয়া আর সম্ভব নয়।’
‘ম্যাডাম, একটা কথা বলি। এটা ঠিকই যে আমার টাকার কিছু প্রয়োজন আছে। কিন্তু তাই বলে আমাকে একেবারে মার্সিনারি ভাববেন না। মন্দাকিনী চৌধুরির কেসটা সলভ করতে না পারলে আমার বিরাট পরাজয় হবে। নিজের কাছে নিজেই ছোট হয়ে যাব। তাই টাকাপয়সা বাদ দিলেও আলাদা করে কেসটা সলভ করার ব্যাপারে আমার একটা স্বার্থ আছে। ইট উইল বুস্ট মাই ইগো। আপনি টাকাপয়সা নিয়ে ভাববেন না। আপনি শুধু আপনার তরফ থেকে বলুন আপনার মা-র মৃত্যুরহস্যের কিনারা করার জন্য আপনি আমাকে বহাল রাখছেন। টাকাপয়সা কিচ্ছু লাগবে না। আপনি বললেই আমি কাজটা করে যেতে পারব। কিন্তু আপনি আমাকে ফরম্যালি নিয়োগ না করলে আমার এই কাজটা করতে কিছু টেকনিক্যাল অসুবিধে আছে।’
সোহিনী অনেকক্ষণ চুপ করে রইল। বোঝাই যায় আদিত্যকে বিনা পয়সায় কাজ করাতে তার আভিজাত্যে বাধছে। আবার আদিত্যর উৎসাহটাকেও সে উপেক্ষা করতে পারছে না।
শেষে সে বলল, ‘ঠিক আছে। আপনি কাজ করুন। আমার তো আগস্টের শেষে বিদেশ যাওয়া। আশা করি তার মধ্যে কেসটা আপনি সলভ করে ফেলবেন।’
‘অতদিন লাগবে না।’ আদিত্য বেশ জোর দিয়ে বলল। তারপর একটু থেমে বলল, ‘আপনি আমাকে দু-একটা প্রশ্নের উত্তর দিন।’
‘বলুন।’
‘সুবীর চৌধুরির মৃত্যুর পরে শঙ্খমালা সেন বা তার স্বামীর সঙ্গে চৌধুরি প্যালেসের কতটা যোগাযোগ ছিল?’
‘আমার ধারণা খুব বেশি ছিল না। তবে আমি খুব জোর দিয়ে বলতে পারব না। আমি তো আর রোজ রোজ চৌধুরি ম্যানসনে যেতাম না। অবশ্য মালা ওখানে গেলে মা নিশ্চয় গল্প করত। মা খুব বেশি বলত না মালার আসার কথা।’
‘কোনও বিশেষ দিন মনে আছে যখন শঙ্খমালা ওখানে গিয়েছিলেন? হয়তো চৌধুরি প্যালেস থেকে কিছু নিয়েও এসেছিলেন?’
‘ঠিক বুঝতে পারছি না আপনি কী বলছেন। তবে কাকুর মৃত্যুর কিছুদিন পরে মালা একদিন এসে মাকে বলল তার মায়ের যে গয়নাগুলো চৌধুরি প্যালেসে আছে সেগুলো সে নিয়ে যেতে চায়। সঙ্গে সুব্রতদাও ছিল। মা আপত্তি করেনি, গয়নাগুলো ব্যাঙ্কের লকারে ছিল। মা সেগুলো বার করে আনল। গয়না নিয়ে মালা খুশি হয়েই চলে যাচ্ছিল। সুব্রতদা কিন্তু নানারকম আপত্তি তুলল। তার বক্তব্য, এত কম গয়না তো ছিল না। আরও গয়না নিশ্চয় আছে। মা ভীষণ অপমানিত বোধ করেছিল। শেষে মালা ব্যাপারটাকে কোনো রকমে সামলে দেয়। এরপর ওরা অনেকদিন চৌধুরি বাড়িতে আসেনি। সুব্রতদা এমনিতে লোক খারাপ নয়, কিন্তু ওর মধ্যে একটা অনভিজাত লোভী মন আছে।’
‘চৌধুরি বাড়ি থেকে মালা আর কিছু নিয়ে যায়নি? একটু ভাল করে ভেবে দেখুন তো।’
সোহিনী কিছুক্ষণ ভাবল। তারপর বলল, ‘আপনি বলতে মনে পড়ছে। একটা সকালে মালা এসেছিল। গয়না নিয়ে যাবার বেশ কিছুদিন পরে। আমিও সেদিন ওখানে ছিলাম। ওর মার এক স্যুটকেস ভর্তি পুরোনো জিনিসপত্র কাকুর পড়ার ঘরের একটা ক্লজেটে পড়েছিল। মালা সেটা দেখতে পেয়ে বলল, সে ওই জিনিসগুলো নিয়ে যেতে চায়। ওগুলো তার মার স্মৃতিচিহ্ন। আমার মা আপত্তি করেনি।’
‘আর একটা খুব ব্যক্তিগত প্রশ্ন। ইচ্ছে না হলে আপনি উত্তর নাও দিতে পারেন। আপনার আর্থিক অবস্থা এই মুহূর্তে কেমন?’
প্রশ্নটা শুনে সোহিনীর একাধিক অভিব্যক্তি খেলে গেল। প্রথমটা বিস্ময়, তারপর বিরক্তি, তারপর রাগ।
সে বলল, ‘এরকম ব্যক্তিগত একটা প্রশ্ন কেউ করতে পারে আমার ধারণাই ছিল না। আমি আপনার প্রশ্নের উত্তর দেব না।’
‘ইচ্ছে না হলে কেন উত্তর দেবেন? আমি শুধু এইটুকুই বলতে চাই যে তদন্তের সঙ্গে সম্পর্ক না থাকলে আমি আপনাকে প্রশ্নটা করতাম না।’
‘ঠিক আছে, তাহলে শুনুন’ সোহিনী মরিয়া গলায় বলল, ‘মা চলে যাবার এক সপ্তাহ আগে আমাকে একটা মোটা টাকা দিয়েছিল। সেটা ব্যাঙ্কে পড়ে আছে। যদি এই বাড়িটা ছাড়তে না হয়, সেই টাকায় আমার আগামী আগস্ট অব্দি ভালোই চলে যাবে। তারপর তো বিদেশ চলে যাব। বিদেশ যাবার সমস্ত খরচ অবশ্য মরিশাসের ট্রাস্টটাই দিচ্ছে।’
‘এইটুকুই আমার জানবার ছিল। আমি আজ চলি। দরকার হলে ফোন করব।’
সোহিনী উত্তর দিল না। শেষ প্রশ্নটায় সে স্পষ্টতই বিরক্ত হয়েছে।
(৩)
পরের তিনটে দিন মোটের ওপর ঘটনাবিহীন কেটে গেল। এর মধ্যে দ্বিতীয় দিন গৌতম কবিরাজ মশাই-এর খাতার একটা কপি উদ্ধার করে পাঠিয়ে দিয়েছিল। আদিত্য দেখল ২০০৮ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে মাত্র পাঁচজনকে অশ্বগন্ধেশ্বরী নামক ওষুধটা দেওয়া হয়েছে। তাদের নাম-ঠিকানা রয়েছে। বলাই বাহুল্য, সুবীর চৌধুরির নাম কোথাও নেই। আদিত্য গৌতমকে বলেছে, এই পাঁচজনের হদিশ করতে হবে।
তৃতীয় দিন রাত্তির সাড়ে বারোটা নাগাদ আদিত্য যখন ঘুমোতে যাবার তোড়জোড় করছে, গৌতম ফোন করল।
‘পাঁচ মিনিটের মধ্যে তৈরি হয়ে বাড়ির সামনে দাঁড়া। আমি তোকে তুলে নেব। নরেন্দ্রপুরের দিকে যেতে হবে। বাকিটা যেতে যেতে গাড়িতে বলব।’
আদিত্যকে কোনও কথা বলার সুযোগ না দিয়েই গৌতম ফোনটা রেখে দিল। নিশ্চয় বড় কিছু ঘটেছে। নাহলে গৌতম এইভাবে এত রাত্তিরে ফোন করত না। আদিত্যর তৈরি হতে খুব বেশি সময় লাগল না। বাইরে অনেকক্ষণ বৃষ্টি পড়ছে। কখনও কম, কখনও বেশ জোরে। অভ্যাসবশত আদিত্য ছাতাটা সঙ্গে নিয়ে নিল। একবার অবশ্য মনে হল, পুলিশের গাড়িতেই তো যাচ্ছি, ছাতার কী দরকার। তারপর ভাবল, রাস্তায় বেরিয়ে কতক্ষণ দাঁড়াতে হয় কে জানে, ছাতাটা সঙ্গে থাকা ভাল।
সদর দরজায় তালা পড়ে গেছে। চাবিটা বলরামের কাছে থাকে। দরজার পাশেই যে ছোট ঘরটা আছে, যেখানে পুরোনো খবর কাগজ থেকে শুরু করে রান্নার গ্যাসের সিলিন্ডার, কয়লা, চেলা কাঠ সব কিছু মজুত করা থাকে, সেই ঘরেই বলরাম রাত্তিরে ঘুমোয়। আদিত্য দেখল বলরাম শুয়ে পড়েছে। সে বলরামকে জাগিয়ে দিয়ে বলল, ‘একটু দরজাটা খুলে দে। বেরোতে হবে।’
‘এখন বেরোচ্ছ? ফিরবে কখন?’ বলরাম অবাক।
‘কখন ফিরব জানি না। একটু সজাগ থাকিস। ফিরে দরজায় টোকা দেব। তখন খুলে দিস।’
‘এত রাত্তিরে যাচ্ছ কোথায়?’ বলরামকে চিন্তিত দেখাল, ‘একে রাত্তির তার ওপর এই বৃষ্টি, রাস্তায় শেয়াল-কুকুরও বেরোয়নি।’
‘চিন্তা করিস না। পুলিশের গাড়িতেই তো যাচ্ছি। একটা কাজ আছে।’
‘যত্ত সব উদ্ভট কাজ।’ বলরাম গজগজ করতে করতে সদর দরজাটা খুলে দিল।
আদিত্য ছাতা খুলে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে মিনিট দুয়েকও হয়নি, গৌতমের স্করপিওটা আদিত্যর সামনে এসে দাঁড়াল।
‘উঠে পড়।’ ভেতর থেকে গৌতমের গলা।
পেছনের সিটে আদিত্য আর গৌতম। সামনে ড্রাইভার ছাড়াও একজন পুলিশ, সম্ভবত গৌতমের দেহরক্ষী।
‘ব্যাপার কী? এত রাত্তিরে নরেন্দ্রপুর যাবার দরকার পড়ল কেন?’ গাড়ি চলতে শুরু করার পর আদিত্য জিজ্ঞেস করল।
‘দরকার পড়ল কারণ নরেন্দ্রপুরের কাছে একটা প্রাইভেট রিসর্টে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় একজোড়া লাশ পাওয়া গেছে। একটা বসার ঘরে, অন্যটা বেডরুম থেকে ড্রয়িংরুমে ঢোকার চৌকাঠে। লাশ দুটোর বিশদ পরিচয় দিলে তোর আর একটু বুঝতে সুবিধে হবে। চৌকাঠে যাঁকে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে তিনি মন্দাকিনী চৌধুরি। আর বসার ঘরে যাকে পাওয়া গেছে সে দীননাথ যোশি, মন্দাকিনীর ড্রাইভার কাম বডিগার্ড। বডি এখনও ওখানেই পড়ে আছে। আমি বলেছি, আমরা না দেখা অব্দি ওখানেই থাকবে। রাত্তিরেই বেরোতে হল কারণ কাল সকালে এলে বৃষ্টিতে এভিডেন্স ধুয়ে যেতে পারে।’
আদিত্য অনেকক্ষণ চুপ করে রইল। ব্যাপারটা হজম করতে তার সময় লাগছে। তারপর বলল, ‘কী করে ব্যাপারটা জানা গেল?’
‘রিসর্টের ম্যানেজার পুলিশে খবর দিয়েছে। তবে এখনও আমরা পুরো ব্যাপারটা জানি না। যেটুকু জানতে পেরেছি, বলছি। নরেন্দ্রপুরের ওই বিলাসবহুল রিসর্টটিতে সেলিব্রিটিরা নির্জনতা উপভোগ করার জন্য অজ্ঞাতবাস করেন। সেই সব সেলিব্রিটি যাঁদের রাস্তায় বেরলে মবড হয়ে যাবার সম্ভবনা। রিসর্টটি অত্যন্ত দামি। খুব বড়লোক ছাড়া এখানে কেউ আসে না। আর ভাড়া নিলে পুরো রিসর্টটাই ভাড়া নিতে হয়। রিসর্টের মালিকও বাসিন্দাদের সম্পর্কে চরম গোপনীয়তা পালন করে থাকেন। রিসর্টের ম্যানেজার জানিয়েছে কিছুদিন আগে একটা কালো কাঁচ ঢাকা গাড়িতে বোরখা পরা এক ভদ্রমহিলা বাগানবাড়িতে আসেন। এঁরা আগে থেকেই অন লাইনে এক মাসের জন্য বাড়িটা বুক করে রেখেছিলেন। কাগজপত্র যা কিছু ড্রাইভারের কাছেই ছিল, সে-ই ম্যানেজারের সঙ্গে কথাবার্তা বলে। বোরখা পরা মহিলা সোজা নিজের ঘরে চলে যান। ম্যানেজার ধরে নেয় ইনি একজন সেলিব্রিটি যিনি ম্যানেজারকেও নিজের পরিচয় জানাতে চান না। এরকম আগেও হয়েছে, তাই ম্যানেজার খুব একটা অবাক হয়নি। যাইহোক, এই ক’দিন ভদ্রমহিলা ঘর থেকে একবারের জন্যেও বেরোননি। তাঁর খাবার রিসর্টের প্যান্ট্রিতেই তৈরি হত, ড্রাইভারের মাধ্যমে তিনি জানাতেন কী খাবেন। আর সেই খাবার ড্রাইভার প্যানট্রি থেকে নিয়ে তাঁর ঘরে পৌঁছে দিত। অর্থাৎ বাড়ির স্টাফেরা কেউই তাঁকে কোনদিন দেখেনি। যখন হাউসকিপার ঘর পরিষ্কার করতে আসত, তিনি বোরখা পরে থাকতেন।
‘ঠিক কবে উনি এখানে এসেছিলেন?’
‘আমাদের ইনভেস্টিগেটিং অফিসার জানাচ্ছে, যেদিন থেকে মন্দাকিনী চৌধুরি নিখোঁজ তার দুদিন পর থেকে। অর্থাৎ ধরে নেওয়া যায়, চৌধুরি প্যালেস থেকে বেরিয়ে মন্দাকিনী দু’দিন কোথাও একটা কাটিয়েছিলেন, তারপর এখানে চলে এসেছিলেন। সেই থেকে এখানেই আছেন।’
‘যে গাড়িতে উনি এসেছিলেন সেটা কি চৌধুরিদের?’
‘বোধহয় না। ইনভেস্টিগেটিং অফিসার বলছে, নাম্বার প্লেটের রঙ দেখে মনে হয় গাড়িটা ভাড়া গাড়ি।’
‘ড্রাইভার কোথায় থাকত?’
‘এই রিসর্টেই ড্রাইভারদের জন্য থাকার ব্যবস্থা আছে। সে সেখানেই রাত্তিরে থাকত। এখানেই স্টাফেদের সঙ্গে খেত। তবে দিনের বেলায় মাঝে মাঝে তাকে বাড়িতে দেখা যেত না। হয়তো সে বাইরে কোথাও বেরোত, কখন বেরোত কখন ফিরত ম্যানেজার বা সিকিউরিটি ঠিক খেয়াল করতে পারছে না। তবে গাড়িটা চব্বিশ ঘণ্টাই বাগানবাড়ির চৌহদ্দির মধ্যে দাঁড় করানো থাকত।’
গভীর চিন্তায় ডুবে গেল আদিত্য। গৌতমও আর কথা বলছে না। তারা যখন পার্ক সার্কাস কানেক্টার থেকে ডানদিকে বাঁক নিয়ে বাইপাসে পড়ছে তখন আবার মুষলধারায় বৃষ্টি নামল। ওয়াইপার সব থেকে জোরে চালিয়েও প্রায় কিছুই দেখা যাচ্ছে না। আন্দাজে এগোতে হচ্ছে। একটাই সুবিধে। এই ভূতুড়ে সময়ে বাইপাসে অন্য গাড়ি প্রায় নেই। আরও মিনিট চল্লিশ পরে তারা নরেন্দ্রপুরের বাগানবাড়িটাতে পৌঁছল। বৃষ্টি ততক্ষণে খানিকটা ধরেছে।
লনের একধারে পুলিশের টিমটা অপেক্ষা করছিল। তাদের সঙ্গে রিসর্টের ম্যানেজার এবং অন্যান্য স্টাফ। গৌতম গাড়ি থেকে নেমেই বলল, ‘ভেতরে যাওয়া যাক।’
ভেতরে ঢুকে দেখা গেল বসার ঘরে দীননাথ যোশির লাশটা হাত-পা ছড়িয়ে পড়ে আছে। ছিপছিপে মজবুত শরীর, কামানো মাথার পিছনে মোটা টিকি। তিনটে গুলি লেগেছে। একটা বুকের বাঁ দিকে, একটা পেটে, একটা চোয়ালে। মনে হয় বুকে গুলি লাগার সঙ্গে সঙ্গে দীননাথের মৃত্যু হয়েছে। খুব কাছ থেকে গুলি ছোঁড়া হয়েছে। চোয়ালে গুলি লাগার ফলে মুখের একটা অংশ উড়ে গিয়ে বীভৎস একটা ক্ষতের সৃষ্টি করেছে। চোখ দুটো ঠেলে বেরিয়ে এসেছে। মৃতের চোখে মুখে যেন একটা বিষ্ময়। যেন সেমরার আগে অব্দি ভাবতেই পারেনি আততায়ী তাকে গুলি করতে পারে। কার্পেটের ওপরে রক্তের পুকুর।
একটু দূরে, বসার ঘর থেকে শোবার ঘরে ঢোকার দরজার গায়ে হেলান দিয়ে মন্দাকিনী চৌধুরির মৃতদেহ। শুভ্র রাত্রিবাসের ওপর থোকা থোকা রক্ত। চোখ খোলা ও বিস্ফারিত। আদিত্য ভাবছিল, মৃত্যু সুন্দরকেও কী ভীষণ কুৎসিত করে দিতে পারে। মন্দাকিনী চৌধুরি তাহলে সত্যি সত্যি মারা গেলেন।
গৌতম এবং আদিত্যর সঙ্গে সঙ্গে কয়েকজন পুলিশ অফিসার এবং রিসর্টের স্টাফ বাড়ির ভেতরে ঢুকেছিল। একজন পুলিশ বলল, ‘একটা বডি তো স্যার দেখাই যাচ্ছে মন্দাকিনী চৌধুরির। অন্যটাও আইডেন্টিফায়েড হয়ে গেছে স্যার। ওটা মন্দাকিনী চৌধুরির ড্রাইভার দীননাথ যোশির। চৌধুরিদের একজন স্টাফ আগে দার্জিলিং-এ চা-বাগানে কাজ করত। এখন কলকাতায় চলে এসেছে। সে দীননাথকে ভালই চিনতো। তাকে একটু আগে ধরে এনেছিলাম। মুখটা গুলি লেগে এমন মিউটিলেটেড হয়ে গেছে যে সেও প্রথমে দীননাথকে চিনতে পারেনি। পরে অবশ্য ভাল করে দেখে বলেছে বডি দীননাথেরই।’
‘বডিগুলো প্রথম কে দেখে?’ গৌতম অফিসারটিকে জিজ্ঞেস করল।
অফিসারটি একজন স্টাফকে দেখিয়ে দিয়ে বলল, ‘ইনি এখানকার ম্যানেজার। ইনি ভাল বলতে পারবেন।’
ম্যানেজার বলল, ‘রাত্তির নটা নাগাদ ম্যাডাম ডিনার খান। ডিনারটা ম্যাডামের ড্রাইভার প্যানট্রি থেকে নিয়ে যায়। আজ কেউ ডিনার নিতে আসেনি। বাইরে খুব বৃষ্টি পড়ছিল। ড্রাইভারের ঘরটা আউটহাউসে। লন পেরিয়ে যেতে হয়। প্যানট্রির ছেলেটা ভাবল ড্রাইভার বুঝি বৃষ্টির জন্য ঘর থেকে বেরোতে পারছে না। সে সাড়ে নটা নাগাদ ম্যাডামের ঘরের নম্বরে ফোন করে, কিন্তু কোনও উত্তর পায় না। তখন সে গেটের একজন সিকিউরিটিকে ব্যাপারটা বলে। তারা দুজনে ছাতা নিয়ে ড্রাইভারের ঘরে যায়, কিন্তু গিয়ে দেখে সেখানেও কেউ নেই। তখন ওরা আমার কাছে আসে।’
‘আপনি এখানে কতক্ষণ থাকেন?’ আদিত্য জিজ্ঞেস করল।
‘সাধারণত নটা সাড়ে নটার মধ্যে বেরিয়ে পড়ি। আমার বাড়ি এখান থেকে হেঁটে পনেরো-কুড়ি মিনিট।
‘বুঝেছি। তারপর বলুন।’
আমরা তিনজন, মানে আমি, প্যান্ট্রির ছেলেটি এবং গেটের সিকিউরিটি, তখন দরজার সামনে গিয়ে ম্যাডামকে ডাকি। যখন ডাকাডাকি করছি সেই সময় হঠাৎ সিকিউরিটি ছেলেটি লক্ষ করে আমাদের মেন গেটটা খোলা। অথচ বৃষ্টি আসার আগে গেটটা যে ও বন্ধ করেছিল সেটা ও হলফ করে বলছে। আমরা ম্যাডামের দরজার হ্যান্ডেল ঘুরিয়ে দেখি সেটাও লকড নয়। হ্যান্ডেল ঘুরিয়ে আমরা ভেতরে ঢুকি। ঘরে আলো জ্বলছিল, এসি চলছিল। ঢুকেই দুটো বডি চোখে পড়ে। আমি তখন পুলিশে খবর দিই।’
পুলিশদের দল থেকে প্লেন ড্রেস পরা একজন এগিয়ে এসে গৌতমকে বলল, একটা কথা ছিল স্যার।’
গৌতম বলল, ‘বলুন ডাঃ বরাট।’, তারপর আদিত্যর দিকে ফিরে বলল, ‘ইনি ডাঃ বরাট। আমাদের টিমের ডাক্তার।’
ডাক্তার বরাট বললেন, ‘আমি দুটো বডিই খানিকটা পরীক্ষা করেছি। আমার প্রাথমিকভাবে মনে হচ্ছে ঘণ্টা চারেক আগে, মানে নটা নাগাদ, দুটো মৃত্যু প্রায় একসঙ্গে হয়েছে। সম্ভবত আততায়ী প্রথমে দীননাথ যোশিকে গুলি করেছিল। সে তখন বসার ঘরে ছিল। গুলির শব্দ পেয়ে মন্দাকিনী বেডরুম থেকে বেরিয়ে আসে। আততায়ী তখন তাকেও গুলি করে।
‘কেউ কোনও গুলির শব্দ শুনতে পায়নি?’ আদিত্য ম্যানেজারকে জিজ্ঞেস করল।
‘খুব বৃষ্টি পড়ছিল। মনে হয় বৃষ্টির শব্দে গুলির আওয়াজটা ঢাকা পড়ে গিয়েছিল।’
‘দীননাথের সঙ্গে রিভলভর ছিল স্যার।’ প্রথম অফিসারটি বলল, ‘কিন্তু সে বন্দুক বার করার সময় পায়নি। বন্দুকটা তার বগলের নীচে হোলস্টারে ভরা ছিল। আমরা বার করে রেখেছি। মনে হয় খুনি দুজনকে মারার পর বসার ঘরের দরজাটা টেনে দিয়ে সদর দরজা খুলে বৃষ্টির মধ্যে বেরিয়ে গেছে। দরোয়ান গেটে ছিল না। বৃষ্টি পড়ছিল বলে ঘরে বসে ওয়ার্ল্ড কাপ দেখছিল। তাই খুনিকে কেউ দেখতে পায়নি।’
‘কোনও পায়ের ছাপ-টাপ পাওয়া গেছে?’ গৌতম জিজ্ঞেস করল।
‘বৃষ্টিতে প্রায় সব ধুয়ে গেছে স্যার, ‘ অফিসারটি জানাল।
বাড়িটা বিলাসবহুল। দুটো শোবার ঘর, একটা বসার ঘর, কিচেন, ডাইনিং রুম, দুটো বাথরুম, অ্যান্টিরুম, ব্যালকনি। ঘরগুলো মস্ত বড় বড়। সব মিলিয়ে অন্তত আড়াই হাজার স্কোয়ার ফিট। আদিত্য ঘুরে ঘুরে বাড়িটা দেখছিল। একটা বেডরুম ব্যবহৃতই হয়নি। অন্যটার বিছানা রাত্তিরে ঘুমোবার জন্য পরিপাটি করে তৈরি। নিশ্চয় এখানকার হাউসকিপিং স্টাফ রোজ বিছানা করে দিয়ে যায়। রাত্তিরের জন্য তৈরি বিছানাটিও অব্যবহৃত। অনুমান করা যায়, মন্দাকিনী ডিনার খাওয়া অব্দি শোবার ঘরের আরাম কেদারায় বসে টিভি দেখছিলেন কিংবা কোনও ম্যাগাজিনের পাতা ওল্টাচ্ছিলেন। ডিনার আনবে কিনা জিজ্ঞেস করতে দীননাথ বসার ঘরে ঢুকেছিল। ঠিক এমন সময় আততায়ী ঘরে ঢোকে। তখনই বেরিয়ে যাবে বলে দীননাথ দরজাটা ভেজিয়ে রেখেছিল। ফলে ঘরে ঢুকতে আততায়ীর কোনও অসুবিধে হয়নি।
ভাবতে ভাবতে আদিত্য মন্দাকিনীর বেডরুম সংলগ্ন বাথরুমটাতে ঢুকল। মেঝেতে পুরু কারপেট পাতা, একদিকে ম্যাগাজিন স্ট্যান্ড, অন্যদিকে সৌখিন লতার টব। প্রকাণ্ড আয়নার নিচে ক্যাবিনেট, সেখানে হরেক রকম প্রসাধনী, সবই বিদেশি, পারফিউমগুলো বেশিরভাগ ফরাসিদেশের। ধনীরা কীভাবে বাঁচে এসব দেখলে খানিকটা আন্দাজ পাওয়া যায়। আদিত্য লক্ষ করল, প্রসাধনীর সঙ্গে একটি জারে এক সেট নকল দাঁত ভেজানো আছে। মন্দাকিনী নকল দাঁত পরত নাকি? হতেও পারে। পর্দাভিনেত্রীদের শোনা যায় সবই নকল। হঠাৎ আদিত্য খেয়াল করল, ক্যাবিনেটের এক কোনে একটি সেফটিরেজারও একটি শেভিং ফোমের কৌটো। কোনও কোনও মহিলা সেফটিরেজার ব্যবহার করেন বটে, কিন্তু সেগুলো ঠিক এরকম নয়। এই সেফটিরেজারটি শুধুমাত্র পুরুষদের ব্যবহারেরই যোগ্য। এটা এখানে এল কেন? তার চিন্তায় ছেদ পড়ল, গৌতম ডাকছে, ‘বসার ঘরে চলে আয়, ইন্টারোগেশন শুরু হবে।’
ইন্টারোগেশন মানে রিসর্টের স্টাফেদের জেরা করা। যখন তার পর্ব চুকল তখন ভোর পাঁচটা বেজে গেছে।
(৪)
‘কোথাও বসে একটু চা খেলে মন্দ হত না।’ গাড়িতে উঠে আদিত্য বলল।
‘আমার বাড়ি আসতে পারিস, তবে মালিনী এখনও ওঠেনি, কাজের মাসিও আসেনি। আমি চা করে খাওয়াতে পারি। কিন্তু সেটা নিজের রিস্কে খেতে হবে।’
‘বুঝে গেছি। রাস্তার চায়ের দোকানগুলোও তো বন্ধ। তাহলে কোথায় যাই?’
‘একটা কাজ করা যায়। অমিতাভ-রত্নাদের বাড়ি যাওয়া যায়। রত্না বলেছিল ও নাকি রোজ ভোর পাঁচটায় উঠে আধঘণ্টা যোগ ব্যায়াম করে। গিয়ে দেখা যেতে পারে কথাটা সত্যি কিনা আর সেই সঙ্গে ওখানে এক কাপ চাও খাওয়া যেতে পারে।’
‘কথাটা মন্দ বলিসনি।’ আদিত্য একটু ঘুমিয়ে নেবার চেষ্টায় চোখ বুঝল।
ঘণ্টাখানেক পরে যখন আমিতাভর বসার ঘরে বসে আদিত্য, গৌতম এবং অমিতাভ চা খাচ্ছে আর রত্না পাশের ঘরে টুবলুর স্কুলের ইউনিফর্ম ইস্তিরি করছে, তখন গৌতম বলল, ‘আজ সারাদিন আমার ঘুম-টুম হবে না। মিডিয়া সামলাতেই দিনটা কেটে যাবে। আদিত্য, তুই এখন মেসে গিয়ে টানা ঘুম দিবি নিশ্চয়।’
আদিত্য প্রতিবাদ করল না। রাত্রি জাগরণের ফলে তার চোখ দুটো জ্বালা করছে। সে প্রসঙ্গ পালটে বলল, ‘তোরা কি কবিরাজ মশায়ের সেই পাঁচটা রুগির খোঁজ নিয়েছিলি যারা অশ্বগন্ধেশ্বরী বলে ওষুধটা কবিরাজ মশায়ের কাছ থেকে নিয়েছিল?’
‘করেছিলাম বৈকি। পাঁচজনের মধ্যে চারজনের হদিশ পাওয়া গেছে। একজনের পাওয়া যায়নি। তার নামটা ভুলে যাচ্ছি। দাঁড়া রিপোর্টটা আমার ব্যাগে আছে। ব্যাগটা গাড়িতে। আমার ড্রাইভারকে এনে দিতে বলছি।’
অমিতাভ মিউজিক প্লেয়ারে মিঞা কি তোড়ি লাগিয়েছে। কিশোরী আমোনকর। মুক্ত আকারের বিস্তার। আদিত্য ভাবল, কয়েক মিনিটে ঘরের আবহাওয়াটা কেমন বদলে গেল। ইনি মন দিয়ে গাইলে খুব কম গাইয়েই এঁর সামনে দাঁড়াতে পারত।
‘কী যে তোরা অ্যা অ্যা গান শুনে আনন্দ পাস। আমার বাবা রবীন্দ্রসঙ্গীত ছাড়া চলে না। বড় জোর দু’একটা অতুলপ্রসাদী।’ গৌতম হাই তুলতে তুলতে বলল।
ড্রাইভার ইতিমধ্যে ব্যাগটা এনে দিয়েছে। রত্নার কাজের মাসি আর এক প্রস্থ চা দিয়ে গেল।
‘এই যে নামটা বিজয় মাকাল, করবী মাকাল এদের কোনও অস্তিত্ব নেই।’ গৌতম একটা ফাইল দেখে বলল, ‘যাদের রেফারেন্সে এরা এসেছিল বলে খাতায় লেখা আছে চর মাদারিপাড়ার লীলারানি ও পরেশ হালদার তাদের কাছে পুলিশ গিয়েছিল। তারা বলছে, বিজয় মাকাল বা করবী মাকাল কাউকেই ওরা চেনে না। বস্তুত কারোর কাছেই ওরা কবিরাজ মশায়ের নাম রেফার করেনি। তবে ওষুধ খেয়ে ফল পাবার পর দুজনেই আলাদা করে অনেকের কাছে কবিরাজ মশায়ের সুখ্যাতি করেছিল।’
‘লীলারানি আর পরেশ কি চর মাদারিপাড়াতেই থাকে?’
‘দাঁড়া, দেখে বলতে হবে।’ গৌতম আবার ফাইলে চোখ রাখল, ‘পরেশ ওখানেই থাকে। লীলারানি অবশ্য কলকাতায় বাবু বাড়িতে থেকে রাঁধুনির কাজ করে।’
‘কলকাতার কোন অঞ্চলে লীলারানি থাকে?’
‘দাঁড়া, এটাও দেখে বলতে হবে। হ্যাঁ, লীলারানি থাকে বাগবাজার অঞ্চলে।’
গৌতম অমিতাভকে জোড়া লাসের গল্পটা বলছিল। ইতিমধ্যে কিশোরী আমোনকর তোড়িতে একটা অতিদ্রুত তরানা ধরেছেন। আদিত্য নিজের অজান্তেই সোফার হাতলে তাল দিচ্ছে। গৌতমকে আর কী কী যেন জিজ্ঞেস করার ছিল। সে গৌতমকে বলল, ‘মন্দাকিনী এবং তার ড্রাইভারের সঙ্গে কী কী জিনিস ছিল তার একটা লিস্ট নিশ্চয় তোরা করবি। করা হয়ে গেলে আমাকে একটা কপি পাঠাবি? আর দু’টো কথা। একটা রেড করতে হবে। এবং একজনকে চোখে চোখে রাখতে হবে। সে কোথায় যাচ্ছে কার সঙ্গে কথা বলছে সব জানতে হবে। ডিটেলটা বলছি।’
বাড়ি ফিরে মোবাইল অফ করে সারাদিন ঘুমোল আদিত্য। ঘুম না হলে সে বেজায় কাবু হয়ে পড়ে। ছাত্রজীবনেও কখনও রাত জেগে পড়তে পারত না। ঘুম ভাঙল সেই সন্ধের মুখে। কেউ দরজায় টোকা দিচ্ছে। খুলে দেখে বিমল।
‘আপনাকে মোবাইলে পাচ্ছিলাম না স্যার, তাই ভাবলাম একবার গিয়ে দেখি।’
‘বাড়িতে আছি জানলে কী করে?’
‘আন্দাজ করলাম স্যার। আপিসে থাকলে নিশ্চয় মোবাইলটা খোলা থাকত।’
আদিত্য যুক্তিটা ঠিক ধরতে পারল না। ওটা নিয়ে ভাবতেও খুব ইচ্ছে করল না। লাঞ্চ খাওয়া হয়নি। খিদে পেয়েছে। এখন খাবার আনার জন্য বলরামকেও পাওয়া যাবে না। সে বিমলকে বলল, ‘শোনো, আমাদের মেস থেকে বেরিয়ে ডানদিকে গেলে একটা গলি দেখবে। গলির মোড়ে এই সময় কচুরি ভাজে। তাই গোটা দশেক নিয়ে এস। সঙ্গে ছোলার ডাল দেবে। আমার আজ দুপুরে খাওয়া হয়নি। তুমিও আমার সঙ্গে একটু খেও। তোমার গিন্নির জন্যেও নিয়ে যেও। দশটায় হবে?’
‘আমি এখান থেকে কাজে যাব স্যার। গিন্নির জন্য কচুরি নিলে খারাপ হয়ে যাবে।’
‘তাহলে তুমি নিজেই পরে খেয়ে নিও। আর এই কেটলিটা নিয়ে যাও। একটু চা এনো।’
খাওয়াদাওয়া শেষ হওয়ার পর বিমল ভাঁড়ে চা ঢালল। বলল, ‘একটা ভাল খবর আছে স্যার। সেটা জানাতেই এলাম। কলকাতায় একটা ঘর পেয়ে গেছি। আর গোবরডাঙা থেকে যাতায়াত করতে হবে না।’
‘কোথায় ঘর পেলে? টালিগঞ্জে?’
‘টালিগঞ্জের ঘরটা শেষ অব্দি পাওয়া গেল না স্যার। অনেক টাকা অ্যাডভান্স চাইল। শেষে একটা ঘর পেলাম কৈলাশ বোস স্ট্রিটে, আপনার বাড়ির খুব কাছে। কাজের জায়গাটা অবশ্য একটু দূর হয়ে গেল।’
‘তোমার গোবরডাঙার থেকে তো কাছে হলো।’
‘তা তো হলোই স্যার।’
‘শোনো, এলেই যখন, তখন একটু কাজের কথা বলি। দুটো জায়গায় গিয়ে খোঁজ-খবর নিতে হবে। একটা বাগবাজারের কাছে, রাজবল্লভ পাড়ায়, অন্যটা জনাইতে।’
আদিত্য অনেকক্ষণ ধরে বিমলকে বোঝাল কী করতে হবে। যাবার সময় বিমলকে বলে দিল, ‘আমার খুব তাড়াতাড়ি রিপোর্ট চাই কিন্তু।’