Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    ছন্দ – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

    উপন্যাস রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এক পাতা গল্প159 Mins Read0
    ⤷

    ছন্দের অর্থ

    শুধু কথা যখন খাড়া দাঁড়িয়ে থাকে তখন কেবলমাত্র অর্থকে প্রকাশ করে। কিন্তু সেই কথাকে যখন তির্যক্‌ ভঙ্গি ও বিশেষ গতি দেওয়া যায় তখন সে আপন অর্থের চেয়ে আরও কিছু বেশি প্রকাশ করে। সেই বেশিটুকু যে কী তা বলাই শক্ত। কেননা তা কথার অতীত, সুতরাং অনির্বচনীয়। যা আমরা দেখছি শুনছি জানছি তার সঙ্গে যখন অনির্বচনীয়ের যোগ হয় তখন তাকেই আমরা বলি রস। অর্থাৎ সে-জিনিসটাকে অনুভব করা যায়, ব্যাখ্যা করা যায় না। সকলে জানেন, এই রসই হচ্ছে কাব্যের বিষয়।

    এইখানে একটা কথা মনে রাখা দরকার, অনির্বচনীয় শব্দটার মানে অভাবনীয় নয়। তা যদি হত তাহলে ওটা কাব্যে অকাব্যে কুকাব্যে কোথাও কোনো কাজে লাগত না। বস্তু-পদার্থের সংজ্ঞা নির্ণয় করা যায় কিন্তু রস-পদার্থের করা যায় না। অথচ রস আমাদের একান্ত অনুভূতির বিষয়। গোলাপকে আমরা বস্তুরূপে জানি, আর গোলাপকে আমরা রসরূপে পাই। এর মধ্যে বস্তু-জানাকে আমরা সাদা কথায় তার আকার আয়তন ভার কোমলতা প্রভৃতি বহুবিধ পরিচয়ের দ্বারা ব্যাখ্যা করতে পারি, কিন্তু রস-পাওয়া এমন একটি অখণ্ড ব্যাপার যে তাকে তেমন করে সাদা কথায় বর্ণনা করা যায় না; কিন্তু তাই বলেই সেটা অলৌকিক অদ্ভুত অসামান্য কিছুই নয়। বরঞ্চ রসের অনুভূতি বস্তুজ্ঞানের চেয়ে আরো নিকটতর প্রবলতর গভীরতর। এইজন্য গোলাপের আনন্দকে আমরা যখন অন্যের মনে সঞ্চার করতে চাই তখন একটা সাধারণ অভিজ্ঞতার রাস্তা দিয়েই করে থাকি। তফাত এই বস্তু-অভিজ্ঞতার ভাষা সাদা কথার বিশেষণ, কিন্তু রস-অভিজ্ঞতার ভাষা আকার ইঙ্গিত সুর এবং রূপক। পুরুষমানুষের যে পরিচয়ে তিনি আপিসের বড়োবাবু সেটা আপিসের খাতাপত্র দেখলেই জানা যায়, কিন্তু মেয়ের যে-পরিচয়ে তিনি গৃহলক্ষ্মী সেটা প্রকাশের জন্যে তাঁর সিঁথেয় সিঁদুর, তাঁর হাতে কঙ্কণ। অর্থাৎ, এটার মধ্যে রূপক চাই, অলংকার চাই, কেনা, কেবলমাত্র তথ্যের চেয়ে এ যে বেশি; এর পরিচয় শুধু জ্ঞানে নয়, হৃদয়ে। ঐ যে গৃহলক্ষ্মীকে লক্ষ্মী বলা গেলে এইটেই তো হল একটা কথার ইশারামাত্র; অথচ আপিসের বড়োবাবুকে তো আমাদের কেরানি-নারায়ণ বলবার ইচ্ছাও হয় না, যদিও ধর্মতত্ত্বে বলে থাকে সকল নরের মধ্যেই নারায়ণের আবির্ভাব আছে। তাহলেই বোঝা যাচ্ছে, আপিসের বড়োবাবুর মধ্যে অনির্বচনীয়তা নেই। কিন্তু যেখানে তাঁর গৃহিণী সাধ্বী সেখানে তাঁর মধ্যে আছে। তাই বলে এমন কথা বলা যায় না যে, ঐ বাবুটিকেই আমরা সম্পূর্ণ বুঝি আর মালক্ষ্মীকে বুঝি নে, বরঞ্চ উলটো। কেবল কথা এই যে, বোঝবার বেলায় মা-লক্ষ্মী যত সহজ বোঝাবার বেলায় তত নয়।

    “কেবা শুনাইল শ্যামনাম।’ ব্যাপারটা ঘটনা হিসাবে সহজ। কোনো এক ব্যক্তি দ্বিতীয় ব্যক্তির কাছে তৃতীয় ব্যক্তির নাম উচ্চারণ করেছে এমন কাণ্ড দিনের মধ্যে পঞ্চাশবার ঘটে। এইটুকু বলবার জন্যে কথাকে বেশি নাড়া দেবার দরকার হয় না। কিন্তু নাম কানের ভিতর দিয়ে যখন মরমে গিয়ে পশে, অর্থাৎ এমন জায়গায় কাজ করতে থাকে যে জায়গা দেখা-শোনার অতীত, এবং এমন কাজ করতে থাকে যাকে মাপা যায় না, ওজন করা যায় না, চোখের সামনে দাঁড় করিয়ে যার সাক্ষ্য নেওয়া যায় না, তখন কথাগুলোকে নাড়া দিয়ে তাদের পুরো অর্থের চেয়ে তাদের কাছ থেকে আরো অনেক বেশি আদায় করে নিতে হয়। অর্থাৎ, আবেগকে প্রকাশ করতে গেলে কথার মধ্যে সেই আবেগের ধর্ম সঞ্চার করতে হয়। আবেগের ধর্ম হচ্ছে বেগ। কথা যখন সেই বেগ গ্রহণ করে তখনই আমাদের হৃদয়ভাবের সঙ্গে তার মিল ঘটে।

    এই বেগের কত বৈচিত্র্যই যে আছে তার ঠিকানা নেই। এই বেগের বৈচিত্র্যেই তো আলোকের রঙ বদল হচ্ছে, শব্দের সুর বদল হচ্ছে, এবং লীলাময়ী সৃষ্টি রূপ থেকে রূপান্তর গ্রহণ করছে। এমন কি সৃষ্টির বাইরের পর্দা সরিয়ে ভিতরের রহস্যনিকেতনে যতই প্রবেশ করা যায় ততই বস্তুত্ব ঘুচে গিয়ে কেবল বেগই প্রকাশ পেতে থাকে। শেষকালে এই কথাই মনে হয়, প্রকাশবৈচিত্র্যের মূলে বুঝি এই বেগবৈচিত্র্য। যদিদং সর্বং প্রাণ এজতি নিঃসৃতম্‌।

    মানুষের সত্তার মধ্যে এই অনুভূতিলোকই হচ্ছে সেই রহস্যলোক যেখানে বাহিরের রূপজগতের সমস্ত বেগ অন্তরে আবেগ হয়ে উঠছে, এবং সেই অন্তরের আবেগ আবার বাহিরে রূপ গ্রহণ করবার জন্যে উৎসুক হচ্ছে। এইজন্যে বাক্য যখন আমাদের অনুভূতিলোকের বাহনের কাজে ভর্তি হয় তখন তার গতি না হলে চলে না। সে তার অর্থের দ্বারা বাহিরের ঘটনাকে ব্যক্ত করে, গতির দ্বারা অন্তরের গতিকে প্রকাশ করে।

    শ্যামের নাম রাধা শুনেছে। ঘটনাটা শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু যে-একটা অদৃশ্য বেগ জন্মালো তার আর শেষ নেই। আসল ব্যাপারটাই হল তাই। সেইজন্যে কবি ছন্দের ঝংকারের মধ্যে এই কথাটাকে দুলিয়ে দিলেন। যতক্ষণ ছন্দ থাকবে ততক্ষণ এই দোলা থামবে না। “সই, কেবা শুনাইল শ্যামনাম।’ কেবলই ঢেউ উঠতে লাগল। ঐ কটি ছাপার অক্ষরে যদিও ভালোমানুষের মতো দাঁড়িয়ে থাকার ভান করে, কিন্তু ওদের অন্তরের স্পন্দন আর কোনো দিনই শান্ত হবে না। ওরা অস্থির হয়েছে, এবং অস্থির করাই ওদের কাজ।

    আমাদের পুরাণে ছন্দের উৎপত্তির কথা যা বলেছে তা সবাই জানেন। দুটি পাখির মধ্যে একটিকে যখন ব্যাধ মারলে তখন বাল্মীকি মনে যে-ব্যথা পেলেন সেই ব্যথাকে শ্লোক দিয়ে না জানিয়ে তাঁর উপায় ছিল না। যে-পাখিটা মারা গেল এবং আর যে-একটি পাখি তার জন্যে কাঁদল তারা কোন্‌কালে লুপ্ত হয়ে গেছে। কিন্তু এই নিদারুণতার ব্যথাটিকে তো কেবল কালের মাপকাঠি দিয়ে মাপা যায় না। সে যে অনন্তের বুকে বেজে রইল। সেই জন্যে কবির শাপ ছন্দের বাহনকে নিয়ে কাল থেকে কালান্তরে ছুটতে চাইলে। হায় রে, আজও সেই ব্যাধ নানা অস্ত্র হাতে নানা বীভৎসতার মধ্যে নানা দেশে নানা আকারে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কিন্তু সেই আদিকবির শাপ শাশ্বতকালের কণ্ঠে ধ্বনিত হয়ে রইল। এই শাশ্বতকালের কথাকে প্রকাশ করবার জন্যেই তো ছন্দ।

    আমরা ভাষায় বলে থাকি, কথাকে ছন্দে বাঁধা। কিন্তু এ কেবল বাইরে বাঁধন, অন্তরে মুক্তি। কথাকে তার জড়ধর্ম থেকে মুক্তি দেবার জন্যেই ছন্দ। সেতারের তার বাঁধা থাকে বটে কিন্তু তার থেকে সুর পায় ছাড়া। ছন্দ হচ্ছে সেই তার-বাঁধা সেতার, কথার অন্তরের সুরকে সে ছাড়া দিতে থাকে। ধনুকের সে ছিলা, কথাকে সে তীরের মতো লক্ষ্যের মjর মধ্যে প্রক্ষেপ করে।

    গোড়াতেই ছন্দ সম্বন্ধে এতখানি ওকালতি করা হয়তো বাহুল্য বলে অনেকের মনে হতে পারে। কিন্তু আমি জানি, এমন লোক আছেন যাঁরা ছন্দকে সাহিত্যের একটা কৃত্রিম প্রথা বলে মনে করেন। তাই আমাকে এই গোড়ার কথাটা বুঝিয়ে বলতে হল যে, পৃথিবী ঠিক চব্বিশ ঘন্টার ঘূর্ণিলয়ে তিনশো পঁয়ষট্টি মাত্রার ছন্দে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে, সেও যেমন কৃত্রিম নয়, ভাবাবেগ তেমনি ছন্দকে আশ্রয় করে আপন গতিকে প্রকাশ করবার যে চেষ্টা করে সেও তেমনি কৃত্রিম নয়।

    এইখানে কাব্যের সঙ্গে গানের তুলনা করে আলোচ্য বিষয়টাকে পরিষ্কার করবার চেষ্টা করা যাক।

    সুর পদার্থটাই একটা বেগ। সে আপনার মধ্যে আপনি স্পন্দিত হচ্ছে। কথা যেমন অর্থের মোক্তারি করবার জন্যে, সুর তেমন নয়, সে আপনাকে আপনিই প্রকাশ করে। বিশেষ সুরের সঙ্গে বিশেষ সুরের সংযোগে ধ্বনিবেগের একটা সমবায় উৎপন্ন হয়। তাল সেই সমবেত বেগটাকে গতিদান করে। ধ্বনির এই গতিবেগে আমাদের হৃদয়ের মধ্যে যে গতি সঞ্চার করে সে একটা বিশুদ্ধ আবেগ মাত্র, তার যেন কোনো অবলম্বন নেই। সাধারণত সংসারে আমরা কতকগুলি বিশেষ ঘটনা আশ্রয় করে সুখে দুঃখে বিচলিত হই। সেই ঘটনা সত্যও হতে পারে, কাল্পনিকও হতে পারে অর্থাৎ আমাদের কাছে সত্যের মতো প্রতিভাত হতে পারে। তারই আঘাতে আমাদের চেতনা নানা রকমে নাড়া পায়, সেই নাড়ার প্রকারভেদে আমাদের আবেগের প্রকৃতি-ভেদ ঘটে। কিন্তু গানের সুরে আমাদের চেতনাকে যে নাড়া দেয় সে কোনো ঘটনার উপলক্ষ্য দিয়ে নয়, সে একেবারে অব্যবহিত ভাবে। সুতরাং তাতে যে আবেগ উৎপন্ন হয় সে অহৈতুক আবেগ। তাতে আমাদের চিত্ত নিজের স্পন্দনবেগেই নিজেকে জানে, বাইরের সঙ্গে কোনো ব্যবহারের যোগে নয়।

    সংসারে আমাদের জীবনে যে সব ঘটনা ঘটে তার সঙ্গে নানা দায় জড়ানো আছে। জৈবিক দায়, বৈষয়িক দায়, সামাজিক দায়, নৈতিক দায়। তার জন্যে নানা চিন্তায় নানা কাজে আমাদের চিত্তকে বাইরে বিক্ষিপ্ত করতে হয়। শিল্পকলায়, কাব্যে এবং রসসাহিত্যমাত্রেই আমাদের চিত্তকে সেই-সমস্ত দায় থেকে মুক্তি দেয়। তখন আমাদের চিত্ত সুখদুঃখের মধ্যে আপনারই বিশুদ্ধ প্রকাশ দেখতে পায়। সেই প্রকাশই আনন্দ। এই প্রকাশকে আমরা চিরন্তন বলি এই জন্যে যে, বাইরের ঘটনাগুলি সংসারের জাল বুনতে বুনতে, নানা প্রয়োজন সাধন করতে করতে, সরে যায়, চলে যায়– তাদের নিজের মধ্যে নিজের কোনো চরম মূল্য নেই। কিন্তু আমাদের চিত্তের যে আত্মপ্রকাশ তার আপনাতেই আপনার চরম, তার মূল্য তার আপনার মধ্যেই পর্যাপ্ত। তমসাতীরে ক্রৌঞ্চবিরহিণীর দুঃখ কোনোখানেই নেই, কিন্তু আমাদের চিত্তের আত্মানুভূতির মধ্যে সেই বেদনার তার বাঁধা হয়েই আছে। সে ঘটনা এখন ঘটছে না, বা সে ঘটনা কোনো কালেই ঘটে নি, এ কথা তার কাছে প্রমাণ করে কোনো লাভ নেই।

    যাহোক, দেখা যাচ্ছে গানের স্পন্দন আমাদের চিত্তের মধ্যে যে-আবেগ জন্মিয়ে দেয় সে কোনো সাংসারিক ঘটনামূলক আবেগ নয়। তাই মনে হয়, সৃষ্টির গভীরতার মধ্যে যে একটি বিশ্বব্যাপী প্রাণকম্পন চলছে, গান শুনে সেইটেরই বেদনাবেগ যেন আমরা চিত্তের মধ্যে অনুভব করি। ভৈরবী যেন সমস্ত সৃষ্টির অন্তরতম বিরহব্যাকুলতা,দেশমল্লার যেন অশ্রুগঙ্গোত্রীর কোন্‌ আদিনির্ঝরের কলকল্লোল। এতে করে আমাদের চেতনা দেশকালের সীমা পার হয়ে নিজের চঞ্চল প্রাণধারাকে বিরাটের মধ্যে উপলব্ধি করে।

    কাব্যেও আমরা আমাদের চিত্তের এই আত্মানুভূতিকে বিশুদ্ধ এবং মুক্তভাবে অথচ বিচিত্র আকারে পেতে চাই। কিন্তু কাব্যের প্রধান উপকরণ হল কথা। সে তো সুরের মতো স্বপ্রকাশ নয়। কথা অর্থকে জানাচ্ছে। অতএব কাব্যে এই অর্থকে নিয়ে কারবার করতেই হবে। তাই গোড়ায় দরকার, এই অর্থটা যেন রসমূলক হয়। অর্থাৎ, সেটা এমন কিছু হয় যা স্বতই আমাদের মনে স্পন্দন সঞ্চার করে, যাকে আমরা বলি আবেগ।

    কিন্তু যেহেতু কথা জিনিসটা স্বপ্রকাশ নয়, এই জন্যে সুরের মতো কথার সঙ্গে আমাদের চিত্তের সাধর্ম্য নেই। আমাদের চিত্ত বেগবান্‌, কিন্তু কথা স্থির। এ প্রবন্ধের আরম্ভেই আমরা এই বিষয়টার আলোচনা করেছি। বলেছি, কথাকে বেগ দিয়ে আমাদের চিত্তের সামগ্রী করে তোলবার জন্যে ছন্দের দরকার। এই ছন্দের বাহন-যোগে কথা কেবল যে দ্রুত আমাদের চিত্তে প্রবেশ করে তা নয়, তার স্পন্দনে নিজের স্পন্দন যোগ করে দেয়।

    এই স্পন্দনের যোগে শব্দের অর্থ যে কী অপরূপতা লাভ করে তা আগে থাকতে হিসাব করে বলা যায় না। সেইজন্যে কাব্যরচনা একটা বিস্ময়ের ব্যাপার। তার বিষয়টা কবির মনে বাঁধা, কিন্তু কাব্যের লক্ষ্য হচ্ছে বিষয়কে অতিক্রম করা; সেই বিষয়ের চেয়ে বেশিটুকুই হচ্ছে অনির্বচনীয়। ছন্দের গতি কথার মধ্য থেকে সেই অনির্বচনীয়কে জাগিয়ে তোলে।

    রজনী শাঙনঘন,                   ধন দেয়া-গরজন,
              রিমিঝিমি শবদে বরিষে।
    পালঙ্গে শয়ান রঙ্গে,                বিগলিত চীর অঙ্গে,
              নিন্দ যাই মনের হরিষে।

    বাদলার রাত্রে একটি মেয়ে বিছানায় শুয়ে ঘুমোচ্ছে, বিষয়টা এইমাত্র কিন্তু ছন্দ এই বিষয়টিকে আমাদের মনে কাঁপিয়ে তুলতেই এই মেয়ের ঘুমোনো ব্যাপারটি যেন নিত্যকালকে আশ্রয় করে একটি পরম ব্যাপার হয়ে উঠল– এমন কি, জর্মন কাইজার আজ যে চার বছর ধরে এমন দুর্দান্তপ্রতাপে লড়াই করছে সেও এর তুলনায় তুচ্ছ এবং অনিত্য। ঐ লড়াইয়ের তথ্যটাকে একদিন বহুকষ্টে ইতিহাসের বই থেকে মুখস্থ করে ছেলেদের এক্‌জামিন পাশ করতে হবে; কিন্তু “পালঙ্গে শয়ান রঙ্গে, বিগলিত চীর অঙ্গে, নিন্দ যাই মনের হরিষে’, এ পড়া-মুখস্থ করার জিনিস নয়। এ আমরা আপনার প্রাণের মধ্যে দেখতে পাব, এবং যা দেখব সেটা একটি মেয়ের বিছানায় শুয়ে ঘুমোনোর চেয়ে অনেক বেশি। এই কথাটাকেই আরেক ছন্দে লিখলে বিষয়টা ঠিকই থাকবে, কিন্তু বিষয়ের চেয়ে বেশি যেটা তার অনেকখানি বদল হবে।

    শ্রাবণমেঘে তিমিরঘন শর্বরী,
                       বরিষে জল কাননতল মর্মরি॥
    জলদরব-ঝংকারিত ঝঞ্ঝাতে
                       বিজন ঘরে ছিলাম সুখ-তন্দ্রাতে,
    অলস মম শিথিল তনু-বল্লরী।
                       মুখর শিখী শিখরে ফিরে সঞ্চরি॥

    এই ছন্দে হয়তো বাইরের ঝড়ের দোলা কিছু আছে কিন্তু মেয়েটির ভিতরের গভীর কথা ফুটল না। এ আরেক জিনিস হল।

    ছন্দ কবিতার বিষয়টির চারদিকে আবর্তন করছে। পাতা যেমন গাছের ডাঁটার চারদিকে ঘুরে ঘুরে তাল রেখে ওঠে এও সেইরকম। গাছের বস্তু-পদার্থ তার ডালের মধ্যে, গুঁড়ির মধ্যে, মজ্জাগত হয়ে রয়েছে; কিন্তু তার লাবণ্য, তার চাঞ্চল্য, বাতাসের সঙ্গে তার আলাপ, আকাশের সঙ্গে তার চাউনির বদল, এ সমস্ত প্রধানত তার পাতার ছন্দে।

    পৃথিবীর আহ্নিক এবং বার্ষিক গতির মতো কাব্যে ছন্দের আবর্তনের দুটি অঙ্গ আছে, একটি বড়ো গতি, আর একটি ছোটো গতি। অর্থাৎ চাল এবং চলন। প্রদক্ষিণ এবং পদক্ষেপ। দৃষ্টান্ত দেখাই।

    শারদ চন্দ্র        পবন মন্দ,       বিপিন ভরল              কুসুমগন্ধ।

    এরই প্রত্যেকটি হল চলন। এমন আটটি চলনে এই ছন্দের চাল সারা হচ্ছে। অর্থাৎ, ছয়ের মাত্রায় এ পা ফেলছে এবং আটের মাত্রায় ঘুরে আসছে। “শারদ চন্দ্র’ এই কথাটি ছয় মাত্রার,”শারদ’ তিন এবং “চন্দ্র’ও তিন। বলা বাহুল্য, যুক্ত অক্ষরে দুই অক্ষরের মাত্রা আছে, এই কারণে “শারদ চন্দ্র’ এবং “বিপিন ভরল’ ওজনে একই।

    ১                           ২                           ৩                                    ৪
    শারদ চন্দ্র                 পবন মন্দ,                 বিপিন ভরল                        কুসুমগন্ধ,
    ৫                           ৬                           ৭                                    ৮
    ফুল্ল মল্লি                  মালতি যুথি               মত্তমধুপ-                            ভোরনী।
    

    প্রদক্ষিণের মাত্রার চেয়ে পদক্ষেপের মাত্রার পরেই ছন্দের বিশেষত্ব বেশি নির্ভর করছে। কেননা এই আট পদক্ষেপের আবর্তন সকল ছন্দেই চলে। বস্তুত এইটেই হচ্ছে অধিকাংশ ছন্দের চলিত কায়দা। যথা–

    ১                           ২                           ৩                                    ৪
    মহাভার-                  তের কথা                 অমৃত স-                               মান,
    ৫                           ৬                           ৭                                    ৮
    কাশীরাম                  দাস কহে                  শুনে পুণ্য-                            বান্‌।

    এও আট পদক্ষেপ।

    এই জাত নির্ণয় করতে হলে চালের দিকে ততটা নয় কিন্তু চলনের দিকেই দৃষ্টি দিতে হবে। দিলে দেখা যাবে, ছন্দকে মোটের উপর তিন জাতে ভাগ করা যায়। সমচলনের ছন্দ, অসমচলনের ছন্দ এবং বিষমচলনের ছন্দ। দুই মাত্রার চলনকে বলি সমমাত্রার চলন, তিন মাত্রার চলনকে বলি অসমমাত্রার চলন এবং দুই-তিনের মিলিত মাত্রার চলনকে বলি বিষমমাত্রার ছন্দ।

    ফিরে   ফিরে   আঁখি-  নীরে    পিছু    পানে    চায়।
    পায়ে    পায়ে    বাধা     প'ড়ে    চলা     হল      দায়।

    এ হল দুই মাত্রার চলন। দুইয়ের গুণফল চার বা আটকেও আমরা এক জাতিরই গণ্য করি।

    নয়ন-     ধারায়     পথ সে      হারায়,     চায় সে      পিছন   পানে,
    চলিতে  চলিতে      চরণ       চলে না,    ব্যথার       বিষম    টানে।

    এ হল তিন মাত্রার চলন। আর–

    যতই চলে       চোখের জলে    নয়ন ভ'রে       ওঠে,
    চরণ বাধে,      পরান কাঁদে,    পিছনে মন       ছোটে।

    এ হল দুই-তিনের যোগে বিষমমাত্রার ছন্দ।

    তাহলেই দেখতে পাওয়া যাচ্ছে, চলনের ভেদেই ছন্দের প্রকৃতি-ভেদ।

    বৈষ্ণবপদাবলীতে বাংলাসাহিত্যে ছন্দের প্রথম ঢেউ ওঠে। কিন্তু দেখা যায়, তার লীলাবৈচিত্র্য সংস্কৃত ছন্দের দীর্ঘহ্রস্ব মাত্রা অবলম্বন করেই প্রধানত প্রকাশ পেয়েছে। প্রাকৃত বাংলায় যত কবিতা আছে তার ছন্দসংখ্যা বেশি নয়। সমমাত্রার ছন্দের দৃষ্টান্ত–

    কেন তোরে               আনমন                    দেখি।
    কাহে নখে                 ক্ষিতিতল                 লেখি।

    এ ছাড়া পয়ার এবং ত্রিপদী আছে, সেও সমমাত্রার ছন্দ। অসমমাত্রার অর্থাৎ তিনের ছন্দ চার রকমের পাওয়া যায়–

    মলিন বদন                  ভেল,
    ধীরে ধীরে চলি             গেল।
    আওল রাইর                পাশ।
    কি কহিব জ্ঞান-            দাস॥ ১॥
     
    জাগিয়া জাগিয়া             হইল খীন
    অসিত চাঁদের              উদয়দিন ॥ ২॥
     
    সদাই ধেয়ানে               চাহে মেঘপানে
    না চলে নয়ন-              তারা।
    বিরতি আহারে             রাঙা বাস পরে
    যেমত যোগিনী-            পারা॥ ৩॥
     
    বেলি অবসান-              কালে
    কবে গিয়াছিলা              জলে।
    তাহারে দেখিয়া             ইষত হাসিয়া
    ধরিলি সখীর                গলে॥ ৪॥

    বিষমমাত্রার দৃষ্টান্ত কেবল একটা চোখে পড়েছে, সেও কেবল গানের আরম্ভে– শেষ পর্যন্ত টেকেনি।

    চিকনকালা,                                       গলায় মালা,
    বাজন নূপুর পায়।
    চূড়ার ফুলে                                        ভ্রমর বুলে,
    তেরছ নয়ানে চায়॥

    বাংলায় সমমাত্রার ছন্দের মধ্যে পয়ার এবং ত্রিপদীই সবচেয়ে প্রচলিত। এই দুটি ছন্দের বিশেষত্ব হচ্ছে এই যে, এদের চলন খুব লম্বা। এদের প্রত্যেক পদক্ষেপে আট মাত্রা। এই আট মাত্রার মোট ওজন রেখে পাঠক এর মাত্রাগুলিকে অনেকটা ইচ্ছেমতো চালাচালি করতে পারেন।

    পাষাণ মিলায়ে যায় গায়ের বাতাসে।

    এর মধ্যে যে কতটা ফাঁক আছে তা যুক্তাক্ষর বসালেই টের পাওয়া যায়।

    পাষাণ মূর্ছিয়া যায় গায়ের বাতাসে।

    ভারি হল না।

    পাষাণ মূর্ছিয়া যায় অঙ্গের বাতাসে।

    এতেও বিশেষ ভিড় বাড়ল না।

    পাষাণ মূর্ছিয়া যায় অঙ্গের উচ্ছ্বাসে।

    এও বেশ সহ্য হয়।

    সংগীত তরঙ্গি উঠে অঙ্গের উচ্ছ্বাসে।

    এতেও অত্যন্ত ঠেসাঠেসি হল না।

    সংগীততরঙ্গরঙ্গ অঙ্গের উচ্ছ্বাস।

    অনুপ্রাসের ভিড় হল না বটে কিন্তু এখনো অন্ধকূপহত্যা হবার মতো হয় নি। কিন্তু এর বেশি আর সাহস হয় না। তবু যদি আরো প্যাসেঞ্জার নেওয়া যায় তাহলে যে একেবারে পয়ারের নৌকাডুবি হবে তা নয়, তবে কিনা হাঁপ ধরবে। যথা–

    দুর্দান্তপাণ্ডিত্যপূর্ণ দুঃসাধ্য সিদ্ধান্ত।

    কিন্তু দুই মাত্রার ছন্দ মাত্রেরই যে এই রকম অসাধারণ শোষণশক্তি তা বলতে পারি নে। যেখানে পদক্ষেপ ঘন ঘন সেখানে ঠিক উলটো। যথা–

    ২  ২             ২  ২                 ২  ২           ২
    ধরণীর          আঁখিনীর             মোচনের         ছলে
    ২  ২              ২  ২                 ২  ২           ২
    দেবতার           অবতার              বসুধার          তলে।

    এও পয়ার কিন্তু যেহেতু এর পদক্ষেপ আটে নয়, দুইয়ে, সেইজন্যে এর উপরে বোঝা সয় না। যে দ্রুত চলে তাকে হালকা হতে হয়। যদি লেখা যায়–

                               ধরিত্রীর চক্ষুনীর মুঞ্চনের ছলে
                               কংসারির শঙ্খরব সংসারের তলে।

    তাহলে ও একটা স্বতন্ত্র ছন্দ হয়ে যায়। সংস্কৃতেও দেখো, সমমাত্রার ছন্দ যেখানে দুয়ের লয়ে চলে সেখানে দৌড় বেশি। যেমন–

    ২       ২       ২    ২           ২   ২            ২    ২
    হরি     রিহ     বিহরতি           সরস              বসন্তে।

    অসম অর্থাৎ তিন মাত্রার চলনও দ্রুত।

    পাষাণ            মিলায়            গায়ের            বাতাসে।

    এর লয়টা দুরন্ত। পড়লেই বোঝা যায়, এর প্রত্যেক তিন মাত্রা পরবর্তী তিন মাত্রাকে চাচ্ছে, কিছুতে তর সচ্ছে না। তিনের মাত্রাটা টল্‌টলে, গড়িয়ে যাবার দিকে তার ঝোঁক। এইজন্যে তিনকে গুণ করে ছয় বা বারো করলেও তার চাপল্য ঘোচে না। দুই মাত্রার চলন ক্ষিপ্র, তিন মাত্রার চঞ্চল, চার মাত্রার মন্থর, আট মাত্রার গম্ভীর। তিন মাত্রার ছন্দে যে পয়ারের মতো ফাঁক নেই তা যুক্তাক্ষর জুড়তে গেলেই ধরা পড়বে। যথা–

    গিরির            গুহায়            ঝরিছে           নিঝর

    এই পদটিকে যদি লেখা যায়

    পর্বত-           কন্দরে            ঝরিছে           নির্ঝর

    তাহলে ছন্দের পক্ষে সাংঘাতিক হয়। অথচ পয়ারে

    গিরিগুহাতল বেয়ে                          ঝরিছে নিঝর

    এবং

    পর্বতকন্দরতলে                            ঝরিছে নির্ঝর

    ছন্দের পক্ষে দুইই সমান।

    বিষমমাত্রার ছন্দের স্বভাব হচ্ছে, তার প্রত্যেক পদে এক অংশে গতি, আর-এক অংশে বাধা। এই গতি এবং বাধার সম্মিলনে তার নৃত্য।

    অহহ কল-          য়ামি বল-                 য়াদিমণি-                  ভূষণং
    হরি্‌বিরহ-           দহনবহ-                   নেন বহু-                  দূষণং।

    তিন মাত্রার “অহহ’ যে ছাঁদে চলবার জন্যে বেগ সঞ্চয় করলে, দুই মাত্রার “কল’ তাকে হঠাৎ টেনে থামিয়ে দিলে, আবার পরক্ষণেই তিন যেই নিজমূর্তি ধরলে অমনি আবার দুই এসে তার লাগামে টান দিলে। এই বাধা যদি সত্যকার বাধা হত তাহলে ছন্দই হত না; এ কেবল বাধার ছল, এতে গতিকে আরো উস্‌কিয়ে দেয় এবং বিচিত্র করে তোলে। এইজন্যে অন্য ছন্দের চেয়ে বিষমমাত্রার ছন্দে গতিকে আরো যেন বেশি অনুভব করা যায়।

    যাই হোক আমার বক্তব্য এই, ছন্দের পরিচয়ের মূলে দুটি প্রশ্ন আছে। এক হচ্ছে, তার প্রত্যেক পদক্ষেপে ক’টি করে মাত্রা আছে। দুই হচ্ছে, সে মাত্রা সম, অসম, না বিষম অথবা সম-বিষমের যোগ। আমরা যখন মোটা করে বলে থাকি যে, এটা চোদ্দ মাত্রার ছন্দ, বা, ওটা দশ মাত্রার, তখন আসল কথাটাই বলা হয় না। তার কারণ পূর্বেই বলেছি, চাল অর্থাৎ প্রদক্ষিণের মাত্রায় ছন্দকে চেনা যায় না, চলন অর্থাৎ পদক্ষেপের মাত্রায় তার পরিচয়। চোদ্দ মাত্রায় শুধু যে পয়ার হয় না, আরো অনেক ছন্দ হয়, তার দৃষ্টান্ত দেওয়া যাক।

                                 বসন্ত পাঠায় দূত                   রহিয়া রহিয়া,
                                 যে কাল গিয়েছে তারি            নিশ্বাস বহিয়া।

    এই তো পয়ার, এর প্রত্যেক প্রদক্ষিণে দুটি পদক্ষেপ। প্রথম পদক্ষেপে আটটি উচ্চারিত মাত্রা, দ্বিতীয় পদক্ষেপে ছয়টি উচ্চারিত মাত্রা এবং দুটি অনুচ্চারিত অর্থাৎ যতির মাত্রা। অর্থাৎ, প্রত্যেক প্রদক্ষিণে মোটের উপর উচ্চারিত মাত্রা চোদ্দ । আমরা পয়ারের পরিচয় দেওয়ার কালে প্রত্যেক প্রদক্ষিণের উচ্চারিত মাত্রার সমষ্টি হিসাব দিয়ে থাকি। তার প্রধান কারণ, কিছুকাল পূর্বে পয়ার ছাড়া চোদ্দ মাত্রা-সমষ্টির ছন্দ আমাদের ব্যবহারে লাগত না। নিম্নলিখিত চোদ্দ মাত্রার ছন্দেও ঠিক পয়ারের মতোই প্রত্যেক প্রদক্ষিণে দুটি করে পদক্ষেপ।

                                 ফাগুন এল দ্বারে                   কেহ যে ঘরে নাই,
                                 পরান ডাকে কারে                 ভাবিয়া নাহি পাই।

    অথচ এটা মোটেই পয়ার নয়। তফাত হল কিসে যাচাই করে দেখলে দেখা যাবে যে, এর প্রতি পদক্ষেপে আটের বদলে সাত উচ্চারিত মাত্রা। আর অনুচ্চারিত মাত্রা প্রতি পদক্ষেপের শেষে একটি করে দেওয়া যেতে পারে। যেমন–

                                 ফাগুন এল দ্বারে-এ               কেহ যে ঘরে না-আ-ই।

    কিম্বা কেবল শেষ ছেদে একটি দেওয়া যেতে পারে। যেমন-

                                 ফাগুন এল দ্বারে                   কেহ যে ঘরে না-আ-ই।

    কিম্বা যতি একেবারেই না দেওয়া যেতে পারে।

    পুনশ্চ এই ছন্দেরই মাত্রাসমষ্টি সমান রেখে এরই পদক্ষেপমাত্রার পরিবর্তন করে যদি পড়া যায় তাহলে শ্লোকটি চোখে দেখতে একই রকম থাকবে কিন্তু কানে শুনতে অন্য রকম হবে। এইখানে বলে রাখি, ছন্দের প্রত্যেক ভাগে একটা করে তালি দিলে পড়বার সুবিধা হবে এবং এই তালি অনুসারে ভিন্ন ছন্দের ভিন্ন লয় ধরা পড়বে। প্রথমে সাত মাত্রাকে তিন এবং চারে স্বতন্ত্র ভাগ করে পড়া যাক। যেমন–

    তালি           তালি             তালি             তালি
    ফাগুন          এল দ্বারে        কেহ যে          ঘরে নাই,
    পরান           ডাকে কারে     ভাবিয়া           নাহি পাই।

    তারপরে পাঁচ-দুই ভাগ করা যাক। যেমন–

    তালি           তালি             তালি             তালি
    ফাগুন এল    দ্বারে              কেহ যে          ঘরে নাই,
    পরান ডাকে   কারে             ভাবিয়া নাহি     পাই।

    এই চোদ্দ মাত্রা-সমষ্টির ছন্দ আরো কত রকম হতে পারে তার কতকগুলি নমুনা দেওয়া যাক। দুই-পাঁচ দুই-পাঁচ ভাগের ছন্দ, যথা–

              ।                  ।                           ।                  ।
              সে যে            আপন মনে                শুধু              দিবস গণে,
              তার              চোখের বারি              কাঁপে            আঁখির কোণে।

    চার-তিন চার-তিন ভাগ–

              ।                ।                  ।                           ।
              নয়নের           সলিলে         যে কথাটি                 বলিলে
              রবে তাহা        স্মরণে           জীবনে ও                  মরণে।

    কিম্বা এক-ছয় এক-ছয় ভাগ–

              ।        ।                           ।                  ।
              যে      কথা নাহি শোনে         সে                থাক্‌ নিজমনে,
              কে      বৃথা নিবেদনে             রে                ফিরে তার সনে।

    সাত-চার-তিনের ভাগ–

              ।                           ।                           ।
              চাহিছ বারে বারে         আপনারে                  ঢাকিতে,
              মন না মানে মানা        মেলে ডানা                আঁখিতে।

    এই কবিতাটাকেই অন্য লয়ে পড়া যায়–

              ।                  ।                  ।                  ।
              চাহিছ            বারে বারে       আপনারে        ঢাকিতে,
              মন না            মানে মানা       মেলে ডানা      আঁখিতে।

    তিন-তিন-তিন-তিন-দুইয়ের ভাগ–

              ।                  ।                      ।               ।
              ব্যাকুল           বকুল   ঝরিল      পড়িল         ঘাসে,
              বাতাস            উদাস   আমের    বোলের        বাসে।

    একেই ছয়-আটের ভাগে পড়া যায়–

              ।                                     ।
              ব্যাকুল বকুল                       ঝরিল পড়িল ঘাসে,
              বাতাস উদাস                       আমের বোলের বাসে।

    পাঁচ-চার-পাঁচের ভাগ–

              ।                           ।                           ।
              নীরবে গেলে              ম্লানমুখে                 আঁচল টানি,
              কাঁদিছে দুখে              মোর বুকে                 না-বলা বাণী।

    এই শ্লোককেই তিন-ছয়-পাঁচ ভাগ করা যায়–

              ।                  ।                                  ।
              নীরবে            গেলে ম্লানমুখে                   আঁচল টানি,
              কাঁদিছে          দুখে মোর বুকে                   না-বলা বাণী।

    এর থেকে এই বোঝা যাচ্ছে, প্রদক্ষিণের সমষ্টিমাত্রা চোদ্দ হলেও সেই সমষ্টির অংশের হিসাব কে কী ভাবে নিকাশ করছে তারই উপর ছন্দের প্রভেদ ধরা পড়ে। কেবল ছন্দরসায়নে নয়,বস্তুরসায়নেও এইরকম উপাদানের মাত্রা-ভাগ নিয়েই বস্তুর প্রকৃতিভেদ ঘটে, রাসায়নিকেরা বোধ করি এই কথা বলেন।

    পয়ার-ছন্দের বিশেষত্ব হচ্ছে এই যে, তাকে প্রায় গাঁঠে গাঁঠে ভাগ করা চলে, এবং প্রত্যেক ভাগেই মূল ছন্দের একটা আংশিক রূপ দেখা যায়। যথা–

    ওহে পান্থ, চলো পথে, পথে বন্ধু আছে
    একা বসে ম্লানমুখে, সে যে সঙ্গ যাচে।

    “ওহে পান্থ’, এইখানে একটা থামবার স্টেশন মেলে। তার পরে যথাক্রমে, “ওহে পান্থ চলো’,”ওহে পান্থ চলো পথে’, “ওহে পান্থ চলো পথে পথে’। তার পরে “বন্ধু আছে’, এই ভগ্নাংশটার সঙ্গে পরের লাইন জোড়া যায়, যেমন– “বন্ধু আছে একা’, “বন্ধু আছে একা বসে’, “বন্ধু আছে একা বসে সে যে’। কিন্তু তিনের ছন্দকে তার ভাগে ভাগে পাওয়া যায় না, এইজন্যে তিনের ছন্দে ইচ্ছামতো থামা চলে না। যেমন, “নিশি দিল ডুব অরুণসাগরে’। “নিশি দিল’, এখানে থামা যায়, কিন্তু তাহলে তিনের ছন্দ ভেঙে যায়; “নিশি দিল ডুব’ পর্যন্ত এসে ছয় মাত্রা পুরিয়ে দিয়ে তবেই তিনের ছন্দ হাঁফ ছাড়তে পারে। কিন্তু আবার, “নিশি দিল ডুব অরুণ’ এখানেও থামা যায় না; কেননা তিন এমন একটি মাত্রা যা আর একটা তিনকে পেলে তবে দাঁড়াতে পারে, নইলে টলে পড়তে চায়; এইজন্য “অরুণসাগর’এর মাঝখানে থামতে গেলে রসনা কূল পায় না। তিনের ছন্দে গতির প্রাবল্যই বেশি, স্থিতি কম। সুতরাং তিনের ছন্দ চাঞ্চল্যপ্রকাশের পক্ষে ভালো কিন্তু তাতে গাম্ভীর্য এবং প্রসার অল্প। তিনের মাত্রার ছন্দে আমিত্রাক্ষর রচনা করতে গেলে বিপদে পড়তে হয়, সে যেন চাকা নিয়ে লাঠিখেলার চেষ্টা। পয়ার আট পায়ে চলে বলে তাকে যে কত রকমে চালানো যায় মেঘনাদবধকাব্যে তার প্রমাণ আছে। তার অবতারণাটি পরখ করে দেখা যাক। এর প্রত্যেক ভাগে কবি ইচ্ছামতো ছোটো বড়ো নানা ওজনের নানা সুর বাজিয়েছেন; কোনো জায়গাতেই পয়ারকে তার প্রচলিত আড্ডায় এসে থামতে দেন নি। প্রথম আরম্ভেই বীরবাহুর বীরমর্যাদা সুগম্ভীর হয়ে বাজল– “সম্মুখসমরে পড়ি বীরচূড়ামণি বীরবাহু’। তার পরে তার অকালমৃত্যুর সংবাদটি যেন ভাঙা রণপতাকার মতো ভাঙা ছন্দে ভেঙে পড়ল– “চলি যবে গেলা যমপুরে অকালে’। তার পরে ছন্দ নত হয়ে নমস্কার করলে– “কহ হে দেবি অমৃত-ভাষিণি’। তার পরে আসল কথাটা, যেটা সবচেয়ে বড়ো কথা, সমস্ত কাব্যের ঘোর পরিণামের যেটা সূচনা, সেটা যেন আসন্ন ঝটিকার সুদীর্ঘ মেঘগর্জনের মতো এক দিগন্ত থেকে আরেক দিগন্তে উদ্‌ঘোষিত হল– “কোন্‌ বীরবরে বরি সেনাপতিপদে পাঠাইলা রণে পুনঃ রক্ষঃকুলনিধি রাঘবারি’।

    বাংলাভাষায় অধিকাংশ শব্দই দুই মাত্রার এবং তিন মাত্রার, এবং ত্রৈমাত্রিক শব্দের উপর বিভক্তিযোগে চার মাত্রার। পয়ারের পদবিভাগটি এমন যে, দুই, তিন এবং চার মাত্রার শব্দ তাতে সহজেই জায়গা পায়।

    চৈত্রের সেতারে বাজে বসন্তবাহার,
    বাতাসে বাতাসে ওঠে তরঙ্গ তাহার।

    এ পয়ারে তিন অক্ষরের ভিড়। আবার–

    চক্‌মকি-ঠোকাঠুকি-আগুনের প্রায়
    চোখোচোখি ঘটিতেই হাসি ঠিকরায়।

    এই পয়ারে চারের প্রাধান্য।

    তারাগুলি সারারাতি কানে কানে কয়,
    সেই কথা ফুলে ফুলে ফুটে বনময়।
    এইখানে দুই মাত্রার আয়োজন।
    প্রেমের অমরাবতী প্রেয়সীর প্রাণে,
    কে সেথা দেবাধিপতি সে কথা কে জানে।

    এই পয়ারে এক থেকে পাঁচ পর্যন্ত সকল রকম মাত্রারই সমাবেশ। এর থেকে জানা যায় পয়ারের আতিথেয়তা খুব বেশি, আর সেই জন্যেই বাংলা কাব্যসাহিত্যে প্রথম থেকেই পয়ারের এত অধিক চলন।

    পয়ারের চেয়ে লম্বা দৌড়ের সমমাত্রার ছন্দ আজকাল বাংলাকাব্যে চলছে। স্বপ্নপ্রয়াণে এর প্রথম প্রবর্তন দেখা গেছে। স্বপ্নপ্রয়াণ থেকেই তার নমুনা তুলে দেখাই

    গম্ভীর পাতাল, যেথা-কালরাত্রি করালবদনা
    বিস্তারে একাধিপত্য। শ্বসয়ে অযুত ফণিফণা
    দিবানিশি ফাটি রোষে; ঘোর নীল বিবর্ণ অনল
    শিখাসংঘ আলোড়িয়া দাপাদাপি করে দেশময়
    তমোহস্ত এড়াইতে– প্রাণ যথা কালের কবল।

    উচ্চারিত এবং অনুচ্চারিত মাত্রা নিয়ে পয়ার যেমন আট পদমাত্রায় সমান দুই ভাগে বিভক্ত এ তা নয়। এর এক ভাগে উচ্চারিত মাত্রা আট, অন্য ভাগে উচ্চারিত মাত্রা দশ। এইরকম অসমান ভাগে ছন্দের গাম্ভীর্য বাড়ে। ছন্দে পদে পদে ঠিক সমান ওজন দাবি করা কানের যেন একটা বাঁধা মৌতাতের মতো দাঁড়ায়, সেইটি ভেঙে দিলে ছন্দের গৌরব আরো বাড়ে। সংস্কৃত মন্দাক্রান্তার অসমান ভাগের গাম্ভীর্য সবাই জানেন–

    কশ্চিৎকান্তা-           বিরহগুরুণা               স্বাধিকার-                 প্রমত্তঃ।

    এর প্রথম ভাগে আট, দ্বিতীয় ভাগে সাত, তৃতীয় ভাগে সাত, এবং চতুর্থ ভাগে চার মাত্রা। এমনতরো ভাগে কানের কোনো সংকীর্ণ অভ্যাস হবার জো নেই।

    সংস্কৃতের সঙ্গে সাধু বাংলা সাহিত্যের ছন্দের যে-একটি বিশেষ প্রভেদ আছে সেইটির কথা এখানে সংক্ষেপে আলোচনা করা যাক। সংস্কৃত-উচ্চারণের বিশেষত্ব হচ্ছে তার ধ্বনির দীর্ঘহ্রস্বতা। সেইজন্য সংস্কৃতছন্দ কেবলমাত্র পদক্ষেপের মাত্রা গণনা করেই নিশ্চিন্ত থাকে না, নির্দিষ্ট নিয়মে দীর্ঘহ্রস্ব মাত্রাকে সাজানো তার ছন্দের তার ছন্দের অঙ্গ। আমি একটি বাংলা বই থেকে এর দৃষ্টান্ত তুলছি। বইটির নাম “ছন্দঃকুসুম’। আজ চুয়ান্ন বছর পূর্বের এটি রচনা। লেখক ভুবনমোহন রায়চৌধুরী রাধাকৃষ্ণের লীলাচ্ছলে বাংলা-ভাষায় সংস্কৃতছন্দের দৃষ্টান্ত দিয়ে ছন্দ শিক্ষা দেবার চেষ্টা করেছেন। কৃষ্ণবিরহিণী রাধা কালো রঙটারই দূষণীয়তা প্রমাণ করবার জন্যে যখন কালো কোকিল, কালো ভ্রমর, কালো পাথর, কালো লোহার নিন্দা করলেন তখন অপর পক্ষের উকিল লোহার দোষ ক্ষালন করতে প্রবৃত্ত হলেন।

    ।।। ।     । ।।।      । ।।।        । ।।।     । ।।।         । ।।।       ।।। ।          । ।।।
    দেখহ     সুন্দর     লৌহর-     থে চড়ি   লৌহপ-       থে কত     লোক চ-      লে .. ,
    ষষ্ঠ মূ-  হূর্তক      মধ্য ক-    রে গতি   যোজন        পঞ্চ দ-     শের প-        থে ..।
    লৌহবি-  নির্মিত    তার ত-    রে বহু      দূর অ-       বস্থিত     লোক স-      বে .. ,
    দূর অ-   বস্থিত   বন্ধুস-       নে সুখ-    চিত্ত প-      রস্পর       বাক্য ক-       হে .. ।

    এই কবিতাটির যুক্তি ও আধ্যাত্মিক রসমাধুর্যের বিচারভার আধুনিককালের বস্তুতান্ত্রিক উকিল রসিকদের উপর অর্পণ করা গেল। তা ছাড়া লোকশিক্ষায় এর প্রয়োজনীয়তার তর্ক তোলবার অধিকারীও আমি নই। আমি ছন্দের দিক দিয়ে বলছি, এর প্রত্যেক পদভাগে একটি দীর্ঘ ও দুইটি হ্রস্ব মাত্রা, সেই দীর্ঘহ্রস্বের ওঠাপড়ার পর্যায়ই হচ্ছে এই ছন্দের প্রকৃতি। বাংলায় স্বরের দীর্ঘহ্রস্বতা নাই কিম্বা নাই বললেই হয়, এবং যুক্তব্যঞ্জনকে সাধু বাংলা কোনো গৌরব দেয় না, অযুক্তের সঙ্গে একই বাটখারায় তার ওজন চলে। অতএব মাত্রাসংখ্যা মিলিয়ে ঐ লোহার স্তব যদি বাংলা ছন্দে লেখা যায় তাহলে তার দশা হয় এই–

    দেখ দেখ         মনোহরলোহার গা-      ড়িতে চড়ি
                       লোহাপথে       কত শত         মানুষ চ-        লিছে
    দেখিতে দে-     খিতে তারা      যোজন যো-     জন পথ
                       অনায়াসে         তরে যায়        টিকিট কি-      নিয়া।
    যেসব মা-        নুষ আছে        অনেক দূ-       রের দেশে,
                      লোহা দিয়ে       গড়া তার        রয়েছে ব-       লিয়া,
    সুদূর বঁ-         ধূর সাথে        কত যে ম-      নের সুখে
                       কথা চালা-      চালি করে       নিমেষে নি-      মেষে॥

    বাংলায় আর সবই রইল– মাত্রাও রইল, আর সম্ভবত আধ্যাত্মিকতারও হানি হয় নি, কেননা ভক্তির টিকিট থাকলে লোহার গাড়ি যে কঠিন লোহার পথও তরিয়ে দেয় এবং বঁধুর সঙ্গে যতই দূরত্ব থাক্‌ স্বয়ং লোহার তারে তাদের কথা চালাচালি হতে পারে এ ভাবটা বাংলাতেও প্রকাশ পাচ্ছে– কিন্তু মূল ছন্দের প্রকৃতিটা বাংলায় রক্ষা পায় নি। এ কেমন, যেমন ঢেউ-খেলানো দেশের জমির পরিমাণ সমতল দেশে জরিপের দ্বারা মিলিয়ে নেওয়া। তাতে জমি পাওয়া গেল কিন্তু ঢেউ পাওয়া গেল না। অথচ ঢেউটা ছন্দের একটা প্রধান জিনিস। সমতল বাংলা আপন কাব্যের ভাষাকে সমতল করে দিয়েছে। এ হচ্ছে কাজকে সহজ করবার একটা কৃত্রিম বাঁধা নিয়ম। আমরা যখন বলি থার্ড ক্লাসের ছেলে, তখন মনে ধরে নিই যেন সব ছেলেই সমান মাত্রার। কিন্তু আসলে থার্ড্‌ক্লাসের আদর্শকে যদি একটা সরল রেখা বলে ধরে নিই তবে কোনো ছেলে সেই রেখার উপরে চড়ে কেউবা তার নিচে নামে। ভালো শিক্ষাপ্রণালী তাকেই বলে যাতে প্রত্যেক ছেলেকে তার নিজের স্বতন্ত্র বুদ্ধি ও শক্তির মাত্রা অনুসারে ব্যবহার করা যায়, থার্ড্‌ক্লাসের একটা কাল্পনিক মাত্রা ক্লাসের সকল ছেলের উপরে সমানভাবে আরোপ না করা যায়। কিন্তু কাজ সহজ করবার জন্য বহু অসমানকে এক সমান কাঠগড়ায় বন্দী করবার নিয়ম আছে। সাধু বাংলার ছন্দে তারই প্রমাণ পাই। হলন্তই হোক, হসন্তই হোক, আর যুক্তবর্ণই হোক, এই ছন্দে সকলেরই সমান মাত্রা।

    অথচ প্রাকৃত-বাংলার প্রকৃতি সমতল নয়। সংস্কৃতের নিয়মে না হোক, নিজের নিয়মে তার একটা ঢেউখেলা আছে। তার কথার সকল অংশ সমান ওজনের নয়, বস্তুত পদে পদেই তার শব্দ বন্ধুর হয়ে ওঠে। তার কারণ, প্রাকৃত-বাংলায় হসন্তের প্রাদুর্ভাব খুব বেশি। এই হসন্তের দ্বারা ব্যঞ্জনবর্ণের মধ্যে সংঘাত জন্মাতে থাকে, সেই সংঘাতে ধ্বনি গুরু হয়ে ওঠে। প্রাকৃত-বাংলার এই গুরুধ্বনির প্রতি যদি সদ্‌ব্যবহার করা যায় তাহলে ছন্দের সম্পদ বেড়ে যায়। প্রাকৃত-বাংলার দৃষ্টান্ত–

    বৃষ্টি পড়ে টাপুর্‌ টুপুর্‌ নদেয়্‌ এল বান্‌।
    শিব্‌ ঠাকুরের্‌ বিয়ে হবে তিন্‌ কন্যে দান্‌॥
    এক্‌ কন্যে রাঁধেন্‌ বাড়েন্‌ এক্‌ কন্যে খান্‌।
    এক্‌ কন্যে না পেয়ে বাপের্‌ বাড়ি যান্‌॥

    এই ছড়াটিতে দুটি জিনিস দেখবার আছে। এক হচ্ছে, বিসর্গের ঘটকালিতে ব্যঞ্জনের সঙ্গে ব্যঞ্জনের সম্মিলন, আর এক হচ্ছে “বৃষ্টি’ এবং “কন্যে’ কথার যুক্তবর্ণকে যথোচিত মর্যাদা দেওয়া। এই ছড়া সাধু বাংলার ছন্দে বাঁধলে পালিশ-করা আবলুস কাঠের মতো পিছল হয়ে ওঠে।

    বারি ঝরে ঝর ঝর নদিয়ায় বান।
    শিবঠাকুরের বিয়ে তিন মেয়ে দান॥
    এক মেয়ে রাঁধিছেন এক মেয়ে খান।
    এক মেয়ে ক্ষুধাভরে পিতৃঘরে যান॥

    এতে যুক্তবর্ণের সংযোগ হলেও ছন্দের উল্লাস তাতে বিশেষ বাড়ে না। যথা–

    মন্দ মন্দ বৃষ্টি পড়ে নবদ্বীপে বান।
    শিবঠাকুরের বিয়া তিন কন্যা দান॥
    এক কন্যা রান্ধিছেন এক কন্যা খান।
    এক কন্যা ঊর্ধ্বশ্বাসে পিতৃগৃহে যান॥

    এই-সব যুক্তবর্ণের যোগে এ ছন্দ বন্ধুর হয়ে উঠেছে বটে কিন্তু তরঙ্গিত হয় নি; কেননা যুক্তবর্ণ যথেচ্ছ ছড়ানো হয়েছে মাত্র, তাদের মর্যাদা অনুসারে জায়গা দেওয়া হয় নি। অর্থাৎ, হাটের মধ্যে ছোটোয় বড়োয় যেমন গায়ে গায়ে ভিড় করে তেমনি, সভার মধ্যে যেমন তারা যথাযোগ্য আসন পায় তেমন নয়।

    ছন্দঃকুসুম বইটির লেখক প্রাকৃত-বাংলার ছন্দ সম্বন্ধে অনুষ্টভ্‌ ছন্দে বিলাপ করে বলছেন–

    পাঁচালী নাম বিখ্যাতা সাধারণ-মনোরমা।
    পয়ার ত্রিপদী আদি প্রাকৃতে হয় চালনা॥
    দ্বিপাদে শ্লোক সংপূর্ণ তুল্যসংখ্যার অক্ষরে।
    পাঠে দুই পদে মাত্র শেষাক্ষর সদা মিলে॥
    পঠনে সে সব ছন্দঃ রাখিতে তালগৌরব।
    পঠিছে সর্বদা লোকে উচ্চারণ-বিপর্যয়ে॥
    লঘুকে গুরু সম্ভাষে দীর্ঘবর্ণে কহে লঘু।
    হ্রস্বে দীর্ঘে সমজ্ঞানে উচ্চারণ করে সবে॥

    কবির এই বিলাপের সঙ্গে আমিও যোগ দিচ্ছি। কেবল আমি এই বলতে চাই, প্রাকৃত বাংলার ছন্দে এমনতরো দুর্ঘটনা ঘটে না, এসব ঘটে সংস্কৃত-বাংলার ছন্দে। প্রাকৃত-বাংলার যে স্বকীয় দীর্ঘহ্রস্বতা আছে তার ছন্দে তার বিপর্যয় দেখি নে, কিন্তু সাধু ভাষায় দেখি।

    এই প্রাকৃত-বাংলা মেয়েদের ছড়ায়, বাউলের গানে, রামপ্রসাদের পদে আপন স্বভাবে প্রকাশ পেয়েছে। কিন্তু সাধুসভায় তার সমাদর হয় নি বলে সে মুখ ফুটে নিজের সব কথা বলতে পারে নি এবং তার শক্তি যে কত তারও সম্পূর্ণ পরিচয় হল না। আজকের দিনের ডিমোক্রেসির যুগেও সে ভয়ে-ভয়ে দ্বিধা করে চলেছে; কোথায় যে তার পংক্তি এবং কোথায় নয় তা স্থির হয় নি। এই সংকোচে তার আত্মপরিচয়ের খর্বতা হচ্ছে। আমরা একটা কথা ভুলে যাই প্রাকৃত-বাংলার লক্ষ্মীর পেট্‌রায় সংস্কৃত, পারসি, ইংরেজি প্রভৃতি নানা ভাষা থেকেই শব্দসঞ্চয় হচ্ছে, সেইজন্যে শব্দের দৈন্য প্রাকৃত-বাংলার স্বভাবগত বলে মনে করা উচিত নয়। প্রয়োজন হলেই আমরা প্রাকৃতভাণ্ডারে সংস্কৃত শব্দের আমদানি করতে পারব। কাজেই যেখানে অর্থের বা ধ্বনির প্রয়োজনবশত সংস্কৃত শব্দই সংগত সেখানে প্রাকৃত-বাংলায় তার বাধা নেই। আবার ফার্সি কথাও তার সঙ্গে সঙ্গেই আমরা একসারে বসিয়ে দিতে পারি। সাধুবাংলায় তার বিঘ্ন আছে, কেননা সেখানে জাতি রক্ষা করাকেই সাধুতা রক্ষা করা বলে। প্রাকৃত ভাষার এই ঔদার্য গদ্যে পদ্যে আমাদের সাহিত্যের একটি পরম সম্পদ্‌, এই কথা মনে রাখতে হবে।

    চৈত্র, ১৩২৪

    ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleজাপানযাত্রী – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
    Next Article চিঠিপত্র – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

    Related Articles

    উপন্যাস বুদ্ধদেব গুহ

    কোয়েলের কাছে – বুদ্ধদেব গুহ

    May 23, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    রবার্টসনের রুবি – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    বোম্বাইয়ের বোম্বেটে – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    রয়েল বেঙ্গল রহস্য – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    যত কাণ্ড কাঠমাণ্ডুতে – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    ফেলুদা এণ্ড কোং – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }