Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    আসমানীরা তিন বোন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025

    ইস্টিশন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025

    উড়ালপঙ্খী – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    ছায়াবীথি – হুমায়ূন আহমেদ

    হুমায়ূন আহমেদ এক পাতা গল্প156 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    ০৩. বেতনের দিনগুলি

    বেতনের দিনগুলি কি আলাদা?

    জামানের তাই মনে হয়। মাসের প্রথম দিন অফিসের সবার মুখ হাসি-হাসি থাকে। অফিস কেন্টিনে ভিড় বেশি হয়, গল্প-গুজব বেশি হয়। পান খাওয়া বেশি হয় জামান লক্ষ্য করেছে, ঐদিন সবাই অন্যদিনের চেয়েও ভাল কাপড় পরে আসে। শুধু ক্যাশিয়ার যার হাত দিয়ে টাকা বের হয় তার মুখটা খাকে গম্ভীর। মেজাজ থাকে খিটখিটে। ভাবটা এ রকম যেন তার পকেট থেকে টাকাগুলি যাচ্ছে। এটা কি শুধু তাদের অফিসের ক্যাশিয়ার আবদুল করিমের ক্ষেত্রেই ঘটে, না সব ক্যাশিয়ারের ক্ষেত্রেই কে জানে।

    জামান বেতন নিতে এসে দেখে করিম সাহেবের মুখ আজ অন্য দিনের চেয়েও একশ গুণ বেশি গম্ভীর। করিম সাহেব শুকনো গলায় বললেন, টাকা গুনে নিন।

    জামান লজ্জিত গলায় বলল, আপনি তো গুনলেন।

    কথা বাড়াবেন না। টাকা গুনুন, তারপর বিদায় হন।

    নতুন টাকা গুনতেও আনন্দ। এরা কি নতুন টাকায় নেশা ধরাবার মত কিছু দিয়ে দেয়? কিছুক্ষণ টাকাগুলি নাকের সামনে ধরে রাখলে ঝিমঝিম ভাব হয়।

    জামান বলল, এক শ টাকা বোধহয় বেশি দিয়েছেন। আবার গুনে দেখি।

    আমি কাউকে বেশি দেই না। নিজের সীটে গিয়ে গুনে দেখুন। যান।

    জমান টাকা নিয়ে তার ঘরে চলে গেল। তার ঘর ঠিক বলা চলে না। তারা তিনজন এই ঘরটায় বসে। তিনজনের দুজন এখন নেই। তবে জামানের চেয়ারের মুখোমুখি চেয়ারটায় নুরু বসে আছে। নুরু নায়লার ছোট ভাই। গত বছর বি কম দিয়েছিল, পাশ করতে পারেনি। এ বছর আবার দেবার কথা, দিচ্ছে না। প্রিপারেশন না-কি তেমন হয়নি। নুরু হাসিমুখে বলল, দুলাভাই, কি খবর?

    খবর ভাল। তুমি এই সকালে ক্ষি ব্যাপার?

    সকাল কোথায় দেখলেন? সাড়ে এগারোটা বাজে। দুলা ভাই, চা খাব, সিঙ্গারা খাব। আপনাদের এখানে সিঙ্গারা অসাধারণ বানায়।

    বেতনের দিন বেয়ার-টেয়ারা কাউকেই ডেকে পাওয়া যাবে না। জামান নিজেই চা-সিঙ্গারা আনতে উঠে গেল। সে শংকিত বোধ করছে। নুরুর সকালবেলা এসে হাসিমুখে বসে থাকা ভাল লাগছে না। টাকাপয়সার জন্যে এসেছে নাকি? হাক-ভাব। সে রকম। নুরু যতবারই টাকার জন্যে আসে সুন্দর একটা গল্প তৈরি করে আসে। গল্পটা যখন বলে তখন জামান বুঝতে পারে যে মিথ্যা গল্প! তারপরেও শুনতে ভাল লাগে।

    সিঙ্গারা অসাধারণ হয়েছে দুলাভাই। আপনাদের ক্যান্টিনের বাবুর্চি মারা গেলে আল্লাহ তাকে বেহেশতের ক্যান্টিনে ভাল বেতনে চাকরি দিয়ে দেবেন।

    জামান কিছু বলল না। অস্বস্তি নিয়ে বসে রইল। টাকাটা আবার গুনা দরকার। এক শ টাকা বেশি মনে হচ্ছে। আবার করিম সাহেব বলছেন, ঠিকই আছে। ক্যাশিয়াররা টাকা গুনতে কখনো ভুল করে না।

    নুরুর সামনে টাকা বের করা ঠিক হবে না। নুরু চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বলল, দুলাভাই, আপনাদের এই সিঙ্গারাওয়ালাকে কোন একটা টাইটেল দেয়া দরকার–যেমন ধরুন, সিঙ্গারা-সম্রাট বা এই জাতীয় কিছু। সিঙ্গারা-সম্রাট খলিল মিয়া বা এই জাতীয় কিছু শনুতেও ভাল লাগবে। দুলাভাই, লোকটার নাম কি?

    নাম জানি না।

    বলেন কি? এরকম বিখ্যাত একজন লোক অথচ নাম জানেন না?

    এসেছ কি জন্যে বল তো নুরু।

    আমার কিছু টাকার দরকার।

    কত?

    সামান্যই। আপনি যেমন মুখ কালো করে ফেলেছেন সে রকম মুখ কালো করার কিছু না।

    সামান্যটা কত?

    চল্লিশ হাজার।

    ঠাট্টা করছ না-কি নুরু?

    না দুলাভাই, ঠাট্টা করছি না। আপনি যেমন সিরিয়াস ধরনের মানুষ, আপনার সঙ্গে কি ঠাট্টা করা যায়? আমার চল্লিশ হাজার টাকাই দরকার। এর এক পয়সা কম হলে চলবে না।

    এটা সামান্য টাকা?

    আপনার আমার কাছে অনেক বেশি টাকা। কিন্তু এই শহরে কয়েক হাজার লোক আছে যাদের কাছে টাকাটা কিছুই না। লোকজন নাকের সর্দি যেমন ঝেড়ে ফেলে এরা চল্লিশ-পঞ্চাশ হাজার টাকাও সে রকম ঝেড়ে ফেলে।

    তুমি তো ওদের কাছে যাওনি নুরু। তুমি এসেছ আমার কাছে।

    আপনার চিন্তার কারণ নেই দুলাভাই। চল্লিশ হাজারের পুরোটা আপনাকে দিতে হবে না। আপনি দেকেন অংশবিশেষ। মেজ দুলাভাই দেবেন অংশবিশেষ আর বাকিটা আমি জোগাড় করব। আপনাকে খুব বেশি রকম লাইক করে আপনার ভাগে সামান্য রেখেছি। সেই সামান্যটা হচ্ছে পাঁচ শ। এই বার দয়া করে হাসুন। আপনি চোখ-মুখের যে অবস্থা করে রেখেছেন, মনে হচ্ছে হার্ট এ্যাটাক হচ্ছে। দিন দুলাভাই, পাঁচ শটা টাকা দিন, চলে যাই।

    জামান পাঁচ শ টাকা বের করে দিল। নুরু টাকাটা পকেটে রাখতে রাখতে বলল, টাকাটা দিয়ে কি করব জানতে চাইলেন না?

    কি করবে?

    ইন্দোনেশিয়ান এক জাহাজে চাকরি পেয়েছি। চিটাগাং-এর এক লোক আছে ঐ জাহাজে উঠব। সেই জাহাজ আমেরিকা হয়ে ইউরোপ যাবে। আমি আমেরিকার কাছাকাছি গিয়ে ঝাপ দিয়ে সমুদ্রে পড়ে যাব। সাঁতরে পাড়ে উঠব।

    ভাল কথা, উঠে পড়।

    সাঁতার জানি না, এইটাই হল সমস্যা। এক ফাকে সার্তারটা দ্রুত শিখে নিতে হবে। দুলাভাই উঠি?

    আচ্ছা উঠ।

    ভাংতি দশ-বিশটা টাকা দিন তো দুলাভাই। রিকশাভাড়া। পাঁচ শ টাকার নোট ভাঙিয়ে তো আর রিকশা ভাড়া দেয়া যাবে না।

    জামান আরো দশটা টাকা দিল। নুরু ফুর্তিবাজের ভঙ্গিতে বলল, দুলাভাই, কাইন্ডলি মুখ থেকে বিমর্ষ ভাবটা দূর করুন। নিজের শালাকে পাঁচ শটা টাকা দিয়েছেন। এমন বড় কিছু না। শালা-শালীদের জন্যে মানুষ অনেক টাকাপয়সা খরচ করে। শালা-শালীরা সাধারণত সিন্দাবাদের ভূতের মত হয়। দুলাভাইদের ঘাড় চেপে থাকে আর নামতে চায় না। সেই তুলনায় আমি বলতে গেলে কখনোই আপনার ঘাড়ে চড়ি না। আর শুনুন দুলাভাই, সিঙ্গারাওয়ালার নামটা জোগাড় করে রাখবেন–প্লীজ। আমি ওর নামটা দিয়ে ক্রেস্ট বানাব। নিচে লেখা থাকবে সিঙ্গাড়া সম্রাট।

    জামান মন-খারাপ ভাবটা দূর করার চেষ্টা করছে। পারছে না। পাঁচ শ টাকা অনেকগুলি টাকা। তাছাড়া ব্যাপার এমন না যে আই নুরুর উপদ্রব শেষ। এটা লেগেই থাকবে। যত দিন যাবে তত বাড়বে।

    জামান টাকাগুলি বের করে আবার গুনল। এক শ টাকা বেশিই আছে। করিম সাহেব ভুল করেছেন। জামান টাকা ফেরত দিতে গেল।

    করিম সাহেব নিতান্ত অবহেলায় এক শ টাকার নোট পকেটে রাখতে রাখতে ললেন, বসুন, চা খেয়ে যান।

    চা খাব না। একটু আগে খেয়েছি।

    আহা, বসুন না রে ভাই। আপনাকে একটা মজার কথা বলি, ভেবেছিলাম কাউকে কোনদিন বলব না। আপনাকে বলার লোভ সামলাতে পারছি না।

    বলুন।

    করিম সাহেবের ঘরে কেউ নেই। বেয়ারা ছিল, তাকে চা আনতে পাঠিয়েছেন। তারপরও তিনি গলা নিচু করে বললেন, মাঝে মাঝে এই কাণ্ডটা আমি করি ইচ্ছা করে। এক শ টাকা বেশি দিয়ে দি। দেখার জন্যে যে বাড়তি টাকাটা পেয়ে আপনারা কি করেন। আশ্চর্যের ব্যাপার কি জানেন? কেউ বলে না, টাকা বেশি হয়েছে। আপনি প্রথম বললেন।

    এরকম করার অর্থ কি?

    মানুষের অনেক রকম পাগলামি থাকে। এটাও একটা পাগলামি। আমার নিজের ভেতর তো অনেক মন্দ আছে, এই জন্যেই অন্যের মন্দটা দেখতে ভাল লাগে।

    এটা ঠিক না।

    আমিও জানি এটা ঠিক না। তারপরেও করি। ঠিক কাজের চেয়ে বেঠিক কাজ করতে মানুষের বেশি আনন্দ–এটাও জানেন না?

    চা চলে এসেছে। করিম সাহেব চায়ে চুমুক দিয়ে আরামের শব্দ করলেন। তাঁকে এখন অনেক প্রফুল্ল মনে হচ্ছে। তার মনের মেঘ কেটে গেছে।

    জামান সাহেব।

    জি।

    আপনার সঙ্গে এখন যে এক্সপেরিমেন্ট করলাম, সেই এক্সপেরিমেন্ট এখন কুদুস সাহেবের সঙ্গে করব। নিজের চোখে দেখে যান। ভাল লাগবে।

    না। খাক।

    আহা, দেখুন না রে ভাই। শুধু নিজে কেমন সেটা জানলে তো হবে না–চারপাশের মানুষগুলি কেমন সেটাও জানতে হবে।

    করিম সাহেব সিগারেট ধরাতে ধরাতে বেয়ারার দিকে তাকিয়ে বললেন, এই, যা ততা কুদ্দুস সাহেবকে বল, আমি সালাম দিয়েছি।

    কুদ্দুস সাহেব অত্যন্ত পরহেজগার মানুষ। নামাজ পড়ে পড়ে কপালে দাগ ফেলে। দিয়েছেন। আলহামদুলিল্লাহ, বিসমিল্লাহ এবং সোবাহানাল্লাহ এই তিনটি শব্দ ব্যবহার না করে কোন বাক্য বলেন না। অফিসে তার টেবিলে একটি কোরান শরীফ আছে। অফিসে ঢুকে মিনিট পাঁচেক কোরান পাঠ করেন। প্রতি চারমাস পর ঘোষণা দেন–আঙ্গ কোরান, মজিদ শেষ করেছি। আসুন দোয়ায় সামিল হন। দোয়া করা হয়। এটা অফিসের রুটিনের অঙ্গ।

    কুদ্দুস সাহেব ঘরে ঢুকে হাসিমুখে বললেন, করিম সাহেব, কি জন্যে ডেকেছেন ভাই?

    এম্নি ডেকেছি। আপনি সুফী মানুষ, আপনাকে দেখলে ভাল লাগে। আতর মেখেছেন নকি? সুন্দর গন্ধ দিচ্ছে।

    জ্বি, সামান্য দিয়েছি। নবীয়ে করিম দিতেন। আতরের যা দাম! রোজ দিন তো দেয়া সম্ভব না। আজ বেতনের দিন বলে দিলাম।

    বসুন ভাই। চা খান।

    শুকুর আলহামদুলিল্লাহ। চা খাব না, তবে বসলাম। বলুন কি ব্যাপার।

    সবার বেতন দিয়ে দেয়ার পর দেখি এক শ টাকা বাড়তি আছে। মনে হয় কাউকে কম দিয়েছি। সবাই আমার সামনে বসে গুনে নিয়েছে। আপনিই শুধু গুনে নেননি। দেখুন তো ভাই আপনাকে কম দিলাম কি না। একটু গুনে দেখুন। কষ্ট দিচ্ছি, কিছু মনে করবেন না।

    কুদুস সাহেব কিছুক্ষণ চুপ থেকে অস্বস্তির সঙ্গে বললেন, ঘরে গিয়ে গুনেছিলাম–এক শটা টাকা কম আছে।

    আগে বলেন নি কেন?

    লজ্জা লাগল। সামান্য কটা টাকা। ভাবলাম…

    এরকম কাজ আর কখনো করবেন না কুন্দুল সাহেব। এর পর থেকে সব সময় গুনে নিবেন।

    ইনশাআল্লাহ করব।

    কুদ্দুস সাহেব টাকা নিয়ে উঠে পড়লেন।

    করিম সাহেব দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললেন। জামান অস্বস্তি নিয়ে বসে রইল। সে নিতান্তই অস্বাভাবিক একটা ঘটনা ঘটতে দেখল।

    করিম সাহেব হাই তুলতে তুলতে বললেন, দেখলেন জামান সাহেব, এমন একজন ভাল মানুষ অথচ সামান্য এক শ টাকার লোভ সামলাতে পারলেন না। লোভ সামলানো কঠিন ব্যাপার। এভারেস্ট জয় করা যায় কিন্তু লোভ জয় করা যায় না। সাতাশ বছর ক্যাশ হেন্ডেল করে করে এই কঠিন সত্য শিখেছি।

    জামান উঠে পাঁড়াতে সঁড়াতে বলল, মানুষকে ছোট করার জন্য যে কাজটা আপনি করেন এই কাজটা করবেন না। এটা ঠিক না। মানুষকে আপনি লোভ দেখান। আদম এবং হাওয়াকে শয়তান লোভ দেখিয়েছিল।

    আপনি আমাকে শয়তান বলছেন?

    না, তা না।

    প্রকারম্ভিরে তাই বললেন, তবে ভুল বলেন নি। ঠিকই বলেছেন। করিম সাহেব আবার মুখ কালো করে ফেললেন। জামানের মন খারাপ হয়ে গেল। মানুষের ক্ষুদ্রতা দেখতে ভাল লাগে না।

     

    বেতন পেয়ে জামান কখনো খালি হাতে বাসায় ফেরে না। নায়লার রসমালাই খুব পছন্দ। আধা কেজি রসমালাই কেনে। কোন কোন দিন বগুড়ার মিষ্টি দৈ। আজ কিছুই কিনতে মন চাচ্ছে না। নুরুর জন্যে এতগুলি টাকা চলে গেল! এই টাকাটা সামাল কি ভাবে দেয়া হবে সে বুঝতে পারছে না। সংসারে প্রতিটা পয়সা হিসাবের পয়সা। ডালের দাম বেড়ে গেলে ভাল কেনার পরিমাণ কমিয়ে দিতে হয়। এই অবস্থায় পাঁচ শ টাকা সামলানো মুশকিল। ধার-টার করার উপায় নেই। কার কাছ থেকে ধার করবে? সবার অবস্থাই এক রকম। প্রাইজবন্ড ভাঙাতে হবে। হাজার দুই টাকার প্রাইজবন্ড কেনা আছে। সেগুলা ভাঙাতে হবে।

    রাস্তার পাশে গ্যাস বেলুন বিক্রি হচ্ছে। এক একটা বেলুন বিশাল আকৃতির। বাবুর জন্যে কিনতে ইচ্ছা করছে। পাঁচ টাকা দাম শুনে পিছিয়ে পড়ল। পাঁচ টাকা বেলুন কেনার বিলাসিতার সময় এখন না। থাক।

    জামান বাড়ি ফিরলো হেঁটে হেঁটে। বেতনের টাকা পকেটে নিয়ে সে বসে উঠে না। বিয়ের পর পর বেতনের টাকা সঙ্গে নিয়ে বাসে উঠেছিল। পকেটমার হয়ে গেল। কি নিদারুণ সমস্যা। ঘরে নতুন বৌ। হাতে নেই টাকা। এর থেকে জামানের একটা শিক্ষা হয়েছে। মাসের এক তারিখে বাসে চড়তে নেই।

    সিড়ি ভেঙে উপরে ওঠার সময় মনে হল, বাবুর জন্যে বেলুনটা কিনলেই হত। একেক বয়সের জন্যে একেক জিনিস। বেলুনের বয়স পার হয়ে গেলে বেলুন দিয়ে সে কি করবে? সিঁড়ি ভাঙতে কষ্ট হচ্ছে। বুকে হাঁপ ধরে যাচ্ছে। আজ লিফটে উঠে পরলে হত।

     

    ছাদে বাবু একা একা খেলছে। হাতে মশারির একটা স্ট্যাণ্ড। বাবুর মাথায় নীল রঙের হ্যাট। হ্যাটের চারদিকে লাল ফিতা। কি সুন্দর লাগছে বাবুকে! জামান ডাকল–এই গুণ্ডু বাবা। গুণ্ডু বাবা।

    বাবু ফিরে তাকাল। বাবাকে দেখেই ছুটে আসতে যাচ্ছে। হাতে লম্বা মশারির স্ট্যাণ্ড নিয়ে ছুটে আসাও মুশকিল। এই বুঝি পড়ল। জামনি ছুটে গিয়ে ছেলেকে ধরে ফেলল।

    বাবু খিলখিল করে হাসছে।

    দরজা ধরে নায়লা এসে দাড়িয়েছে। সে জামানকে আগেই ঢুকতে দেখেছে। নতুন হ্যাটটা মাথায় পরিয়ে বাবুকে দাড় করিয়ে দিয়েছে ছাদে যাতে জামান উপরে ওঠামাত্র বাবুকে দেখে। নায়লা সামান্য অস্বস্তি বোধ করছে। হ্যাট দেখে জামান রাগ করবে কি-না বুঝতে পারছে না।

    আজ সে বাবুকে নিয়ে ইস্টার্ন প্লাজায় গিয়েছিল। সেখানে চারতলা পর্যন্ত এসকিলেটর আছে। বাবু এসকিলেটরে চড়তে খুব ভালবাসে। নায়লা ঠিক করেছিল বাবুকে নিয়ে কয়েকবার ওঠানামা করবে, তারপর চলে আসবে। খালি হাতে কোথাও বেরুতে খারাপ লাগে বলে তার হ্যান্ডব্যাগে অলিমের রেখে যাওয়া দুটা নোট নিয়ে গিয়েছিল। এটা কড় ধরনের ভুল হয়েছে। হাতে টাকা আছে বলেই বাবুর জন্যে দুশ টাকা খরচ করে হ্যাটটা কিনে ফেলল। বাবু ঐ দোকানেই একটা ব্যাটারী দেয়া গাড়ি দেখে এমন কান্না শুরু করল যে শেষ পর্যন্ত গাড়িও কিনতে হল। চলে গেল আরো দুশি। জামানের জন্যে একটা সুয়েটার কিনল। শীত পড়তে শুরু করেছে। সুয়েটার। লাগবেই। গত বছরের স্যুয়েটারটা হারিয়ে গেছে। ছাদে শুকুতে দিয়েছিল, কিছুক্ষণ পর এসে দেখে নেই। সুন্দর ছিল স্যুয়েটারটা। তবে আজকের স্যুয়েটারটা আরো অনেক বেশি সুন্দর–সাদার উপর নীল এবং খয়েরী রঙের ত্রিভুজ। মাখনের মত নরম। দুশ টাকা দাম নিয়েছে, তবু মনে হয় সস্তা হয়েছে।

    ঠাণ্ডা এক গ্লাস পানি দাও তো নায়লা।

    কি অদ্ভুত মানুষ! জানে ঘরে ফ্রীজ নেই তবু বলবে, ঠাণ্ডা এক গ্লাস পানি দাও তো। তবে আজ এই অদ্ভুত মানুষের ছোট্ট একটা চমক আছে। খুব ঠাণ্ডা এক বোতল পানি নায়লা এনে রেখেছে। সাততলার এক মহিলার সঙ্গে নায়লার খাতির আছে। তিনি ছাদে কাপড় শুকুতে এলে কিছুক্ষণ নায়লার সঙ্গে গল্স করেন। এক বোতল হিমশীতল পানি নায়লা উনার কাছ থেকে চেয়ে এনেছে।

    জামান গ্লাসে চুমুক দিয়ে বিস্মিত হয়ে বলল–আরে, ঠাণ্ডা পানি দেখছি?

    তুমি তো ঠাণ্ডা পানি চেয়েছিলে।

    পেয়েছ কোথায়?

    তা বলব না। সব রহস্য ভাঙা ঠিক না। আচ্ছা, বাবুর হ্যাটটা কত সুন্দর দেখেছ?

    হুঁ। সুন্দর। খুব সুন্দর।

    বিদেশী বাচ্চাদের মৃত লাগছে না?

    লাগছে।

    তুমি তো কিছু বললে না।

    আলম কি এসেছিল?

    না, অলিম ভাই আসেন নি। দু-একটা শৌখিন জিনিস কি আমি কিনতে পারি না?

    টাকা পেয়েছ কোথায়?

    টাকা তো আমার কাছে ছিল? ঐ যে তোমার বন্ধু, তোমার সঙ্গে বাজিতে হেরে এক হাজার টাকা রেখে গেল। শোন, আমি কিন্তু সব টাকা খরচ করে ফেলেছি।

    জামান তাকিয়ে আছে। সে কিছুই বলছে না।

    প্লীজ, রাগ করো না। এই প্রথম এতগুলি টাকা নিয়ে বাজারে গেলাম। তারপর কেমন যেন মাথায় গোলমাল হয়ে গেল। যা দেখি তাই কিনে ফেলতে ইচ্ছা করে।

    আর কি কিনেছ?

    বলছি। তার আগে বল তুমি রাগ করেছ কি-না।

    না, রাগ করিনি।

    বাবুকে কোল থেকে নামিয়ে তুমি বসো। হাঁপাচ্ছে তো।

    বাবু কোল থেকে নামবে না। জামানকেও বসতে দেবে না। ছেলেকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে জামানের কষ্ট হচ্ছে। হাত-মুখ ধুয়ে বিছানায় খানিক্ষণ শুয়ে থাকলে ভাল লাগতো।

    মেঝের উপর দিয়ে একটা তেলাপোকা হেঁটে যাচ্ছে। বাবু জামানের কোলে নড়েচড়ে উঠল, বাবা, পোকা পোকা।

    হুঁ পোকা।

    পোকা নিব।

    জামান ছেলেকে নামিয়ে দিল। বাবু পোকার দিকে এগুচ্ছে। তার চোখে-মুখে কি গভীর বিস্ময়।

    নায়লা চা নিয়ে এসেছে। চা আর এক বাটি মুড়ি। চ-তে ভেজানো মুড়ি চামচ দিয়ে তুলে খেতে জামান পছন্দ করে। নায়লা বলল, মাঝে মাঝে বাবুর মুখে খানিকটা মুড়ি দিও তো। ও মুড়ি খায়। নায়লা নিজের জন্যেও এক কাপ চা এনেছে। পেটমোটা বিরাট একটা কাপ। এটা না-কি তার ছেলেবেলার কাপ। বিয়ের পর বাবার বাড়ি থেকে নিয়ে এসেছে।

    নায়লা বলল, আমরা যখন খুব বড়লোক হব তখন কি করব জান? প্রতি সপ্তাহে দু-তিন হাজার টাকা সঙ্গে নিয়ে দোকানে যাব–যা পছন্দ হয় কিনে ফেলব।

    বড় লোক হবে কি ভাবে?

    জানি না কি ভাবে হব। যদি হই …

    জামানের মায়া লাগছে। বেচারীকে কিছু হাতখরচ প্রতি মাসে দিতে পারলে ভাল হত। এই সৌভাগ্য কি তার কোনদিন হবে?

    আজ ইস্টার্ন প্লাজায় বাবুকে নিয়ে গিয়ে কি যে মুশকিলে পড়েছি! যাই দেখবে তাই কিনবে।

    জামান হালকা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ও তো আর জানে না অর্থ বলে একটা ব্যাপার আছে। বাবুর ধারণা, সমস্ত পৃথিবীটাই তার। যতই বয়স বাড়তে থাকবে ততই তার পৃথিবী ছোট হতে থাকবে …।

    হাই ঘটের কথা বাদ দাও। ইস্টার্ন প্লাজাতে গিয়ে আজ কার সঙ্গে দেখা হয়েছে জান? অরুনার সঙ্গে। অরুনাকে মনে আছে?

    হ্যাঁ, মনে আছে খুব সুন্দর একটা মেয়ে।

    ও আরো সুন্দর হয়েছে। এক্কেবারে জাপানি পুতুল। অরুনা আমাকে কফি খাওয়ালো। বাবুকে চকলেট কিনে দিল।

    উনি এখন করছেন কি?

    রিসিপশনিস্ট। তষে বলছে চাকরি ছেড়ে দেবে। চাকরি ভাল লাগে না। সবাই নাকি বিরক্ত করে।

    সুন্দরী মেয়ে, কিছু বিরক্ত তো করবেই।

    আমিও তাই বললাম। মাঝে মাঝে তোমার কথা আর আমার কথা এমন মিলে যায়। আচ্ছা শোন, অরুনাকে দেখার পর থেকে আমার মাথায় একটা জিনিস ঘুরছে। তোমার বন্ধুর সঙ্গে কি এই মেয়ের বিয়ে হয় না? অরুনাকে দেখে পছন্দ করবে না এমন ছেলে তো বাংলাদেশে নেই।

    অরুনা আলমকে পছন্দ করবে কিনা কে জানে?

    পছন্দ করবে না কেন? তোমার বন্ধু তো দেখতে সুন্দর। টাকাপয়সা আছে। পড়াশোনা করছে। আমেরিকায় থাকে …।

    তুমি কি বিয়ের ব্যাপারে অরুনার সঙ্গে কথা বলেছ?

    সরাসরি কিছু বলিনি–ইশারায় বলেছি। ওর বাসার ঠিকানা নিয়েছি। অরুন এখন তার ছোট মামার সঙ্গে থাকে। আমি বলেছি একদিন আমাদের এক বন্ধুকে নিয়ে ওর বাসায় যাব।

    ভাল–আলমকে নিয়ে যাও।

    এই শুক্রবারে গেলে কেমন হয়?

    ভালই হয়।

    তোমার বন্ধুকে তে খবর দেয়া দরকার।

    আমি টেলিফোনে বলে দেব।

    নায়লা ইতস্তত করে কলল, তারচে এক কাজ করলে কেমন হয়? চল না আমরা সবাই মিলে উনার হোটেলে উপস্থিত হই। উনি চমকে যাবেন। তাছাড়া বড় হোটেল আমি কখনো দেখিনি–দেখতে ইচ্ছা করে, …।

    কবে যেতে চাও?

    আজই চল। নতুন হ্যাটটা বাবুর মাথায় পরিয়ে দেব। তোমার জন্যে একটা স্যুয়েটার কিনেছি, তুমি স্যুয়েটারটা পরবে … যাবে?

    জামানের কোথাও যেতে ইচ্ছা করছে না। কিন্তু নায়লার উৎসাহ দেখে মায়া লাগছে।

    নায়লা বলল, বাবুকে কাপড় পরাবো?

    পরাও।

    আমি কোন্ শাড়িটা পরব?

    এত আগ্রহ করে নায়লা প্রশ্ন করেছে। উত্তর দিতে হয় … জামান কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না। নায়লার কি শাড়ি আছে তাও সে জানে না। শাড়ি তো তেমন থাকার কথাও না। বিয়ের পর সে কি কোন শাড়ি কিনে দিয়েছে? মনে পড়ছে না। গত ঈদে শাড়ি দেয়া হয়নি। শ্বশুরবাড়ি থেকে একটা শাড়ি এলো। নায়লা বলল, আর লাগবে না। যদিও সেই শাড়ি নায়লার পছন্দ হয়নি। পরার পর মন খারাপ করে বলেছে–জংলি একটা প্রিন্ট। কি বিশ্রী লাগছে।

    নায়লা বলল, চুপ করে আছ কেন? বল না কোন্ শাড়িটা পরব?

    আলমের দেয়া শাড়িটা পর। সুন্দর শাড়ি।

    ওটার ব্লাউজ নাই যে।

    যেসব ব্লাউজ আছে তার সঙ্গে পরা যায় না?

    উঁহু। আচ্ছা এক কাজ করি, রিকশা করে নিউমার্কেট চলে যাই, দেখি সেখানে রেডিমেড কিছু পাওয়া যায় কিনা। যাব?

    যাও।

    জাম্মানের ঘুম পাচ্ছে। সে বিছানায় শুয়ে পড়ল। ঘুমিয়ে পড়ল দেখতে দেখতে।

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleছেলেটা – হুমায়ূন আহমেদ
    Next Article চৈত্রের দ্বিতীয় দিবস – হুমায়ূন আহমেদ

    Related Articles

    হুমায়ূন আহমেদ

    আসমানীরা তিন বোন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    ইস্টিশন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    উড়ালপঙ্খী – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    এই বসন্তে – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    এই মেঘ, রৌদ্রছায়া – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    এইসব দিনরাত্রি – হুমায়ূন আহমেদ

    December 23, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    আসমানীরা তিন বোন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    আসমানীরা তিন বোন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    Our Picks

    আসমানীরা তিন বোন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025

    ইস্টিশন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025

    উড়ালপঙ্খী – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }