Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    ছেলেধরা

    বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ভৌতিক গল্প এক পাতা গল্প10 Mins Read0

    ছেলেধরা

    সবাই মিলে বাসায় ফিরে এলাম।

    এসেই দেখি ঝুমরির মা বাংলোর বারান্দাতে বসে। তার সঙ্গে নাহানপুর গ্রামের কয়েকটি লোক। নাহানপুর শোন নদের ধারে একটা গ্রাম, বেশির ভাগ গোয়ালার বাস এ-গ্রামে। শোনের চরে গোরু মহিষ চরিয়ে দুধ-ঘি উৎপাদন করে। ডিহিরি থেকে ঘি চালান যায়। এই নাহানপুর গ্রাম থেকেই তিনটি ছেলে হারিয়েছে গত পনেরো দিনের মধ্যে। ভীষণ আতঙ্কের সৃষ্টি যে হয়েছে এই গ্রামের অধিবাসীদের মধ্যে— সেটাকে নিতান্ত অকারণ বলি কী করে।

    একটা লোক এগিয়ে এসে বললে— কী হল বাবু?

    আমরা বললাম— কিছু না, তোমরাও তো খুঁজছিলে।

    —হ্যাঁ বাবুজি। আমাদেরও কিছু না।

    —তোমরা কোথায় গিয়েছিলে?

    —বহুত দূর, বনজঙ্গলের দিকে। সে সব দিকে তোমরা যেতে পারবে না। তোমরা চেন না সেদিক। পরে ওরা পরামর্শ করতে বসল। আমরা বাঙালিবাবু লেখাপড়া জানা, আমরা কী পরামর্শ দিই ওদের? পনেরো দিনের মধ্যে তিনটি ছেলে উধাও। এখানে বাস করা দায় হয়ে উঠল। ডিহিরি শহর এখান থেকে অনেক দূর। প্রায় ন-মাইল রাস্তা। সেখানে গিয়ে পুলিশের সাহায্য চাওয়া কি উচিত নয়?

    আগের লোকটার নাম মন্নু আহীর। মন্নু বললে ওই অঞ্চলের হিন্দিতে— বাবু, জঙ্গল-পাহাড় অঞ্চলের গাঁ। বেশি লোক থাকে না এক গাঁয়ে। দূরে-দূরে গাঁ। এখানে এইরকম বিপদ হলে আমরা কী করে বাঁচি? আপনারা এসেছেন বেড়াতে, মজুমদার সাহেবের কুঠিতে আছেন, তবু কত ভরসা আমাদের। মজুমদার সাহেব বড়োলোক, আসেন না আজকাল আর। আগে আগে যখন নতুন কুঠি বানালেন, তখন কত আসতেন।

    ওরা সেদিন চলে গেল যখন, তখন রাত দশটা। বেশ দল বেঁধে মশাল জ্বেলে চলে গেল।

    সতীশ গিরির দলপতিত্বে পরদিন হইহই করে হারানো ছেলে খুঁজতে বেরোনো গেল।

    রোটাস-গড়ে ওঠাই হত এবং ঠিক ছিল। কিন্তু একজন মহিষ-চরানো বৃদ্ধ রাখাল আমাদের বারণ করলে। ওখানে কী করতে যাবে বাবুজি, রোটাস-গড়ে লোক থাকে না। চৌকিদার একজন আছে, সে সবসময় ওপরে থাকে না, নীচে নেমে আসে। ওখানে যাওয়া মিথ্যে।

    বনের মধ্যে একস্থানে আমরা সেদিন বাঘের থাবার দাগ পেলাম। মহুয়া গাছের তলায় দিব্যি বড়ো বাঘের পায়ের থাবার দাগ। আমাদের মধ্যে একজন বললে— ওদের বাঘে নিচ্ছে না তো? যে বাঘের ভয় এদেশে—

    হীরু বললে— তাই বা কী করে সম্ভব? বাঘ গাঁয়ের মধ্যে ঢুকলে সেখানে তো পায়ের দাগ থাকত।

    দুপুরে আমরা খেতে এলাম বাসায়। শোনের চরে বালুহাঁস শিকার করেছিল ধীরেন আজ সকালে, আমাদের বেরোবার আগে। দশ মিনিটের মধ্যে তিনটি। খুব মজা করে হাঁসের মাংস খাওয়া যাবে সবাই মিলে।

    সতীশ গিরি খাওয়ার সময়ে বললে— শিকার করা বর্বরের কাজ, তা জানো?

    আমরা সবাই চুপ।

    হীরু বললে— বাজার থেকে মাংস কিনে খাওনি কখনো?

    সতীশ গিরি বললে— আমি দেখে-শুনে তো সে জন্তুকে মারিনি। আমি না কিনলেও অপরে কিনত।

    খাওয়া-দাওয়ার পরে হঠাৎ বাইরে একটা গোলমাল উঠল। জন কয়েক লোক এসে হাজির হল বাংলোর কম্পাউন্ডে ব্যস্তসমস্তভাবে। সতীশ গিরি এগিয়ে গিয়ে বললে— কী হয়েছে? কী, কী?

    ওরা বললে— আবার ছেলে চুরি গিয়েছে আজ।

    আমরা সবাই অবাক। সতীশ বললে— আজ? কোন গাঁ থেকে?

    —নাহানপুর থেকে দু-মাইল ওদিকে। উনাও বলে একটা গাঁ। একটা ছোটো ছেলে নিয়ে মা ফিরছিল গাঁয়ের বাইরের মাঠ থেকে। ছোটো ছেলেটাকে এক জায়গায় ওর মা রাস্তার পাশে রেখে শালপাতা ভাঙতে গিয়েছিল। ফিরে এসে দেখে ছেলে নেই।

    —বাঘের পায়ের দাগ?

    —না বাবু।

    —মানুষের?

    —অত ভালো করে মেয়েমানুষ কী দেখেছে?

    আমরা বাংলো থেকে সন্ধের আগেই বেরিয়েছি। কত জায়গায় খুঁজলাম, কিন্তু কোনো পাত্তা পাওয়া গেল না খোকার। সেই বনবেষ্টিত পাহাড়-অঞ্চলে সন্ধ্যার পর বেরোনো কত বিপজ্জনক আমরা জানি, কিন্তু তবু ছেলেটিকে খুঁজে এনে মায়ের কোলে দেওয়ার আনন্দ যে কত বড়ো! যদি পারা যায়, যদি খোকার মায়ের মুখে হাসি ফোটাতে পারি!

    কিন্তু এদিকে রাত হয়ে আসছে। সেদিকে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে হীরু। বিদেশ বিভুঁয় জায়গা, জঙ্গলাবৃত পাহাড় চারিধারে। বাঘের ভয়ও আছে। বৈশাখ মাসের চড়া রোদে পাহাড় তেতে এমন আগুন হয়ে আছে যে, একপ্রহর রাত্রি পর্যন্ত ঠান্ডা হয় না। তাও তেমন ঠান্ডা হয় না। বিদেশে বেড়াতে এসে কী শেষে বাঘের পেটে যাবো?

    কথাটা ঠিক। সতীশ মহারাজের কী! তার বাপ নেই, মা নেই। মরে গেলে কাঁদবে না কেউ। আমাদের তা নয়, আমাদের সবাই বেঁচে!

    হীরু বললে— আজ ক-দিন হল আমরা এসেছি এখানে?

    আমি বলি হিসাব করে— আজ তেরো দিন।

    —আর কতদিন থাকা হবে?

    —আর চার-পাঁচ দিন।

    —কিন্তু এই হাঙ্গামাটা না-চুকলে তো—

    —সে তো বটেই।

    হীরু বললে— ঘরের পয়সা খরচ করে বেড়াতে এসে কী ফ্যাসাদ!

    ধীরেন একটু বিরক্তির সঙ্গে বললে— কে জানত এমনতর হবে। তাহলে কী—

    সতীশ আমাদের মধ্যে সাধু প্রকৃতির লোক। অনেস্ট, সত্যবাদী, পরোপকারী। ওকে আমরা এইজন্যে সতীশ গিরি, কখনো সতীশ মহারাজ বলে ডাকতাম, অবিশ্যি ব্যঙ্গচ্ছলে।

    সতীশ মহারাজ বললে— ওর মায়ের কান্না শোনবার পরেও একথা তোমরা বলতে পারলে?

    ও মাঝে মাঝে আমাদের বিবেক জাগিয়ে তোলবার চেষ্টা করে এইভাবে। সেদিন এক বুড়ি টোমাটো নিয়ে যাচ্ছে। আমরা তাকে ডেকে বললাম— এসো, টোমাটো কিনব। বুড়ি বাজার দর জানে না বোধ হয়। সে বললে— বাজারে তোমরা কত করে কেনো বাবুজি?

    আমরা জানি ছ-পয়সা বাজার দর এক সের টোমাটোর। হীরু বললে— চার পয়সা দর বাজারে, দিবি?

    বুড়ি দিয়ে গেল।

    কিন্তু সতীশ গিরির তিরস্কারে সে টোমাটো আমাদের মুখে ওঠেনি সেদিন।

    হীরুর নির্বুদ্ধিতা, সে গেল বাহাদুরি করতে তা নিয়ে খাবার সময়।

    আমরা সবাই খেতে বসেছি। সতীশ মহারাজ গম্ভীরভাবে হেঁকে বললে— টোমাটোর অম্বল আমার পাতে দিও না। সবাই অপ্রস্তুত। যেরকম সুরে সে হেঁকে বললে, তারপর সেদিন আর উক্ত তরকারি কারও পাতে পড়তে পারল না। অসম্ভব। যাকগে, আজ কিন্তু সতীশ মহারাজের কথার প্রতিবাদ করলে ধীরেন। বললে— ঝুমরির মা দোর খুলে শুয়েছিল কেন রাত্তিরে?

    সতীশ বললে— তাই কী?

    —তা না-হলে তো ছেলে হারাত না।

    —সে নির্বোধ ছেলেমানুষ।

    —তাহলে তার এমন হওয়াই উচিত। যখন সবাই জানে একথা যে, গাঁ থেকে বা এ-অঞ্চলে থেকে ছেলে চুরি যাচ্ছে প্রায়ই—

    হীরু বললে— এইবার নিয়ে চারটি ছেলে এভাবে গেল।

    ধীরেন বললে— হ্যাঁ, যখন তা সবাই জানে, তখন কি ওর উচিত হয়েছে রাতে দোর খুলে শোওয়া?

    সতীশ বললে— এ গরমে করেই বা কী?

    —তখন তার যাওয়াই উচিত। আমাদের দোষে তো যায়নি?

    আমি ওদের থামিয়ে বলি— শোনো, বাজে বকে লাভ নেই। ছেলে চুরি বা হারানো এ-অঞ্চলে আমরা এসে পর্যন্ত শুনছি— একথা ঠিক; তবু এসব দেশের গ্রাম্য লোকে অত সতর্ক হতে শেখেনি। ঘরের ছেলে হারিয়েছে— খোঁজবার চেষ্টা করা যাক, বিশেষ করে ওর মা আমাদেরই ঝি। যে ক-দিন আমাদের ছুটি বাকি আছে, খোঁজো, না পাই কলকাতার যাবার সময় মনে অন্তত আমাদের ক্ষোভ থাকবে না। এ-অজানা বনজঙ্গলের দেশে আমরা এর বেশি আর কী—

    আমাকে সবাই সমর্থন করলে।

    সতীশ বললে— কাল চলো রোটাস-ফোর্টে উঠে দেখা যাক।

    ধীরেন বললে— বড্ড সোজা কথা বললে। রোটাস-ফোর্টে ওঠা চাট্টিখানি কথা নয়। এ গরমে প্রাণ বেরিয়ে যাবে। ওপরে জল নেই। বাঘ সেদিনও বেরিয়েছিল জঙ্গলে। ফেরবার পথে সন্ধে হয়ে গেলে ওই বন ভেঙে নীচে নামতে পারব? আমাদের ঘরে বাপ-মা আছে সতীশদা!

    আমি বললাম— তা ছাড়া রোটাস-ফোর্টে পাহাড়ের ওপর ছেলে নিয়ে গিয়ে তুলবে কে? আমার তা মনে হয় না।

    সতীশ বললে— দেখতে দোষ কী?

    —তুমি বলো যদি, আমি তোমার সঙ্গে যাবো, সতীশ। তুমি ভাবতে পারো এরা কষ্টের ভয়ে হয়তো যেতে চাইবে না। চলো কাল সকালে।

    হীরু ও ধীরেন নিজেদের ছোটো করতে চায় না। তারা মুখে বললে— আমরাও যাবো কিন্তু মনে মনে বোধ হয় বিরক্ত হল আমার ও সতীশ মহারাজের ওপর।

    গ্রামের লোকজন ডাকিয়ে আমরা তাদের বিভিন্ন দলে ভাগ করে দিয়ে এক এক দিকে পাঠালাম। আমরা নিজেরাও বেরিয়ে পড়লাম। নাহানপুরের পথে, ডিহিরি যাবার পথে, শোন নদের ধারে। সব দিকে আমরা বলে দিয়েছি কোনোরকম সন্ধান পেলে যেন বাংলোতে এসে খবর দেওয়া হয়। সেখানে সতীশ মহারাজ স্বয়ং বসে। তাকে কোথাও যেতে দিইনি আমরা। কারও মুখে কোনোরকম সন্ধান পেলে যেন বাংলোয় খবর দেওয়া হয়।

    সারাদিন কেটে গেল। কেউ কোনো খবর নিয়ে এল না। কোনো পাত্তাই পাওয়া গেল না হারানো ছেলের। সন্ধ্যার অনেক পরে আমরা পরিশ্রান্ত দেহে বাংলোর বারান্দায় পা দিতে-না-দিতে সতীশ গিরির দুর্বার জেরা— কাজে ফাঁকি আমরা দিয়েছি কি না দেখে নেবে সতীশ। আমরা কি ওখানে গিয়েছিলাম? সেখানে গিয়েছিলাম? অমুক জঙ্গলের পথ কি দেখেছি? একটু চা খাবো সারাদিন পরিশ্রমের পরে, তা কৈফিয়ত দিতে-দিতেই প্রাণান্ত হবার উপক্রম হল।

    খেয়ে-দেয়ে সকাল সকাল শুয়ে পড়া গেল। কাল সকালেই আবার নাকি বেরোতে হবে। ধীরেন বললে— চলো, পরশু আমরা এখান থেকে খসে পড়ি। আর এ-ঝঞ্ঝাট ভালো লাগে না।

    আরও দু-দিন কেটে গেল। কোনো ছেলেরই পাত্তা পাওয়া গেল না। ঝুমরির মা কেঁদে কেঁদে বেড়ায়, গ্রামের লোকজন এসে ফিরে যায়। আমরা ক-দিন খোঁজখুঁজির পর ক্রমে আলগা দিলাম। ক্রমে আরও দিন কেটে গেল।

    সেদিন আমরা জিনিসপত্র বাঁধা-ছাঁদা করে রওনা হয়ে পড়লাম। সিমেন্ট পাহাড়ের গা কেটে পাথর নিয়ে যাচ্ছে ডিহিরিতে, সেই লরিতে আমরা চলেছি। জিনিসপত্রসমেত আমাদের ডিহিরি স্টেশনে পৌঁছে দেওয়ার ভাড়া সাত টাকা ধার্য হয়েছে।

    লরি ছাড়ল রাত আটটার সময়। পাথর বোঝাই করতে দেরি হয়ে গেল। পাহাড় জঙ্গলের পথে বোঝাই লরি বেশি জোরে যেতে পারছে না। আমরা দিন কুড়ি পরে কলকাতায় ফিরছি, মনের আনন্দে গান গাইতে গাইতে চলেছি।

    ডিমহা ও বোচাহির পাহাড়ের কাছাকাছি পার্বত্য ক্ষুদ্র নদী পার হতে পাথর-বোঝাই লরির খানিকটা সময় লাগল। হাঁটু খানেক জল নদীতে। ঘন জঙ্গল দু-ধারে— হরতুকি, মহুয়া ও শাল। কী একটা পাখি কুস্বরে ডাকছে ডিমহা পাহাড়ের ওপরকার বনে। লরি হু-হু চলেছে।

    এমন সময় লরিওয়ালা বলে উঠল— ও ক্যা বাবুজি? আমরা লরি-ড্রাইভারের পাশেই বসে। তখন দশটা, কোনোদিকে লোকালয় নেই সেখানটাতে। চেয়ে দেখি, পথ থেকে রশি-দুই দূরে জঙ্গলের মধ্যে এক জায়গায় আগুন জ্বলছে। যেন কেউ আগুন পোয়াচ্ছে কী ভাত রেঁধে খাচ্ছে। আমরাও চেয়ে দেখলাম।— কে ওখানে?

    কৌতূহল হল দেখবার জন্যে। লরি থামিয়ে রাস্তার একপাশে রাখা হল। আমি ও সতীশ গিরি এগিয়ে গেলাম। আমাদের পেছনে পেছনে ধীরেন, হীরু ও লরি-ড্রাইভার। যখন আধ রশি মাত্র দূরে আছে আগুন, তখন আমরা অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম হঠাৎ।

    অন্ধকার রাত। শোন নদের ধারের কাশচর দূর থেকে সাদা কাপড় পরা প্রেতের মতো দেখাচ্ছে। হীরেন বললে— শোনের ধারে যাসনে ভাই, ওদিকেই কাশবনে বাঘ থাকে। চল সিমেন্টের পাহাড়ের ওপর। সতীশ মহারাজ গম্ভীরভাবে বললে— ওটা সিমেন্টের পাহাড় নয়। সিমেন্ট জিনিসটা বালির সঙ্গে আরও জিনিস মিশিয়ে তৈরি করতে হয়। ওটা বেলেপাথরের পাহাড়, যাকে বলে স্যান্ডস্টোন। আমাদের মনের অবস্থা এখন সতীশ গিরির ভূতত্ত্ব বক্তৃতা

    শোনবার অনুকূল নয়। আমরা আজ আর খুঁজতে রাজি নই; আর খুঁজবই-বা কোথায়?

    বড়ো সিমেন্টের পাহাড়ের তলায় শালচারা আর কী-কী গাছের বনজঙ্গল। সেদিন সন্ধ্যায় এখানে হায়েনার হাসি শোনা গিয়েছিল। সে হাসি গভীর রাত্রে শুনলে প্রেতের অট্টহাসির মতো শোনায়। শহুরে ছেলে আমরা, আমাদের গায়ে কাঁটা দেয়। পাহাড়ের ওপর কলকাতার কোনো ভদ্রলোকের এক বাংলো আছে; কিন্তু তিনি কোনোদিন আসেন না। তাঁর বাড়ির দরজা-জানলায় উই ধরেছে, কাঠের ফটকটা ভেঙে দুলছে কব্জার গায়ে। ভূতের বাড়ি বলে মনে হয় প্রথমটা। লোকে বলে ভূতও নাকি আছে। মহুয়া ফুলের সময় উত্তীর্ণ হয়ে গিয়েছে, বড়ো বড়ো মহুয়া গাছগুলোর তলায় পাতা পুড়িয়ে দিয়েছিল গত চৈত্র মাসে মহুয়া ফুল সংগ্রহ করবার জন্যে। পাতা-পোড়া ছাইয়ের গন্ধ বাতাসে। ছাইয়ের ওপর আবার পড়েছে শুকনো পাতার রাশ। খস খস করে কী একটা জন্তু পালিয়ে গেল তার ওপর দিয়ে।

    ধীরেন চমকে উঠে বলল— ও কী রে?

    আমি বললাম— কিছু না, শেয়াল হবে।

    আমাদের চোখে যা পড়ল তা এই—

    একটা বড়ো অগ্নিকুণ্ডের সামনে একজন লোক বসে কী করছে। দূর থেকেই মনে হল লোকটা দীর্ঘাকার, একটু অসম্ভব ধরনের দীর্ঘাকার। কী একটা নাড়ছে-চাড়ছে আগুনের সামনে বসে যেন।

    সতীশ গিরি বললে— সন্নিসি।

    আমাদের মনে হল লোকটা নিশ্চয়ই সন্নিসি-টন্নিসি হবে। কিন্তু এই জঙ্গলের মধ্যে এই গভীর রাত্রে; আচ্ছা সন্নিসি তো! বাঘের ভয়ে দিনমানে এখানে মানুষ আসতে ভয় পায় যে!

    আমরা এগিয়ে গেলাম আরও। লোকটাও বেজায় লম্বা, অগ্নিকুণ্ডের ধারে উবু হয়ে বসে লোকটা কী একটা আগুনের ওপর ধরে নাড়ছে-চাড়ছে। বেশ বড়ো ও কালো মতো একটা কী। কী ও-টা? আলো-আঁধারে সে জিনিসটা দেখাচ্ছে যেন একটা কালো কাপড়ের বান্ডিলের মতো। আমাদের সকলেরই দৃষ্টি সেই দিকে। কী জিনিস ওটা?

    হঠাৎ আমি চমকে উঠলাম। সেই কালো বান্ডিলের মতো জিনিসটা থেকে যেন একটা ছোটো হাত ঝুলে পড়ল। সঙ্গেসঙ্গে সতীশ মহারাজ ও ধীরেন একসঙ্গে বলে উঠল— হ্যাঁ রে, ও তো একটা ছোটো ছেলে!

    আমরা তখন ভয়ে-বিস্ময়ে অবাক হয়ে সেখানে দাঁড়িয়ে গেলাম। অদূরে সেই অতিদীর্ঘাকার বিকটদর্শন লোকটাকে রাক্ষুসের মতো দেখাচ্ছে। সন্ন্যাসীর সাজ বটে। দীর্ঘ ত্রিপুন্ড্রক ওর কপালে, দীর্ঘ জটাজুট, এতখানি লম্বা দাড়ি পড়েছে বুকের ওপর।

    লোকটা সামনে অগ্নিকুণ্ডের ওপর একটা ছোটো ছেলেকে দু-হাতে ধরে ঝলসাপোড়া করছে। বাতাসে মড়া পোড়ার বিকট দুর্গন্ধ।

    আমরা কেউ এগোতে সাহস করলাম না। কারও মুখে কথাটি নেই। এই গভীর রাত্রি, নির্জন পাহাড়-জঙ্গল, কোথাও লোকালয় নেই কাছে। সম্মুখে এই নররাক্ষস। কেমন একপ্রকার আতঙ্কে আমরা সবাই মোহগ্রস্ত হয়ে চুপ করে আছি; এক পা-ও কেউ এগোয় না।

    লোকটা আমাদের দেখলে কটমট চোখে। তারপর যেন বিরক্তমুখে সেই আধঝলসানো ছেলেটাকে কাঁধে ফেলে নিলে আমাদের চোখের সামনে, ঠিক যেমন লোকে গামছা কাঁধে ফেলে সেই ভঙ্গিতে। তারপর ধীর-গম্ভীর পদবিক্ষেপে অন্ধকারে বনের ওপারে অদৃশ্য হয়ে গেল।

    সতীশ গিরির মুখ দিয়ে শুধু বেরিয়ে গেল একটা কথা— ছেলে ধরা!

    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleছায়াছবি
    Next Article টান

    Related Articles

    ছোটগল্প বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

    কাদা kada

    August 11, 2025
    ছোটগল্প বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

    অসাধারণ | Ashadharon

    April 3, 2025
    ধীরেন্দ্রলাল ধর ভৌতিক গল্প

    তান্ত্রিক

    March 13, 2025
    উপন্যাস বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

    আরণ্যক – বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

    February 27, 2025
    উপন্যাস বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

    চাঁদের পাহাড় – বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

    February 27, 2025
    উপন্যাস বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

    পথের পাঁচালী – বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

    February 27, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }