Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    ছোটগল্প – বুদ্ধদেব গুহ

    বুদ্ধদেব গুহ এক পাতা গল্প831 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    টিটিচিকোরি

    ভবানীপুরের গঙ্গাপাড়ের একটি জরাজীর্ণ ভাড়াবাড়িতে রায়পরিবার থাকতেন আজ থেকে চল্লিশ বছর আগে। ছোটোবাবু ছিলেন জগৎ রায়। অবিবাহিত, উপার্জনহীন। বাড়ির ভাইপো-ভাইঝি বোনপো-বোনঝি তাঁকে ডাকত, ছোটোকামা বলে। মামা এবং কাকা মিলিয়ে।

    ছোটোকামা বললেন, অ্যাই পাপা, পা-টা একটু টিপে দে তো! বড্ড ফাঁকিবাজ হয়েছিস তুই।

    পাপা পায়ের কাছে গিয়ে বসল তক্তপোশে। দু-হাতে ছোটকামার পা টিপতে লাগল।

    বাড়ির উঠোনের মস্ত বিলিতি আমড়া গাছটাতে পাতার আড়ালে বসে দাঁড়কাক ডাকছিল লাল টাগরা বের করে। গরমের দুপুর। ঝাঁঝাঁ করছিল সাদা রোদ। কা-খবা-খবা করছিল কালো কাক।

    ডুনা জল নিয়ে এল। ছোটোকামা কনুইতে ভর দিয়ে একটু উঠেই ঢকঢক শব্দ করে জল খেলেন।

    কোথায় ছিলাম রে?  ছোটোকামা শুধালেন গল্পের খেই ধরিয়ে দেবার জন্যে।

    ঘনুমামা এখন তাঁর টাটুঘোড়ায় করে চলেছেন বাড়েষাঁনের জঙ্গলে, টুলু বলল।

    হ্যাঁ, বাড়েষাঁনের জঙ্গলে, ছোটোকামা শুরু করলেন, ঘনু চলেছে। গরমের দুপুর। গা-পোড়ানো হাওয়া বইছে বনে-বনে, পাহাড়ে-পাহাড়ে। সাপেরা সব গর্তের মধ্যে। জংলি ইঁদুর পাহাড়ি নালার ভিজে বুকের পচা পাতার আড়ালে মুখ লুকিয়ে। বনমুরগি আর তিতির, আসকল, বটেরদের সরু সরু গলা তিরতির করে কাঁপছে তখন, গান গাইতে থাকা গায়িকার গলার শিরার মতো। ঝরঝর শব্দ করে বয়ে চলেছে পথের দু-পাশ দিয়ে প্রমত্ত ঝরনার মতো লাল, হলুদ, খয়েরি, কালো শুকনো পাতা, হাওয়ার স্রোতের সওয়ার হয়ে কালো কালোনানা আকৃতির পাথরের আর গেরুয়া মাটির উপর দিয়ে। তেষ্টায় ছটফট করা ময়ুর ডেকে উঠছে বনের গভীর থেকে ক্কেঁয়া-আ, ক্কেঁয়া-আ-আ করে। ডাকছে কালী-তিত্বর জঙ্গলের বুকের গভীরের মধ্যে লুকোনো টাঁড় থেকে। নীলকণ্ঠ পাখি উড়ে যাচ্ছে কোনাকুনি পথের উপর দিয়ে মত্ত হাওয়ায় ঘুরপাক খেতে-খেতে, লাট খাওয়া ঘুড়ির মতো। ঘনু চলেছে বিলিতি ক্যালেন্ডারের বহুরঙা ছবির মতো সুন্দর জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে তার টাটুঘোড়ায় চেপে, টগবগ…টগবগ…টগবগ। শব্দ উড়ছে ঘোড়ার খুরে হাওয়ার খুরে। হাজার হাজার অদৃশ্য সব ঘোড়সওয়ার যেন হাওয়ার সওয়ার হয়ে কী এক লড়াইয়ে মেতেছে সেই মর্মরিত বনে-বনে।

    কোথায় যাচ্ছেন ঘনুমামা আজকে, ছোটোকামা? পাহাড়ি গ্রামে অত্যাচারী টিকায়েতের সঙ্গে বোঝাপড়া করতে কি? না, গত রাতে যে ভালুকমায়ের ছানাকে খাদের কুলিরা চুরি করে এনেছিল, তাকে তার মায়ের কাছে ফিরিয়ে দিতে?  ডুনা শুধোলো উৎকণ্ঠিত গলায়।

    না না, ওসব নয়। আজ ঘনু চলেছে এক দারুণ জায়গায়। এক অবাক পৃথিবীর গভীরের এক অবাক ছবিতে। বলতে পারিস, চলেছে তীর্থযাত্রাতেই। সেই জঙ্গলের গভীরের নীল ঝিলের জল যদি কেউ খায়, কেউ চান করে সেখানে, তবে তার খিদে-তেষ্টা, দুঃখ-কষ্ট কিছু থাকে না। ছেলে হলে জিন, মেয়ে হলে পরি হয়ে যায় সে, ছছটোকামা বললেন।

    খুকু হাতপাখা দিয়ে হাওয়া করছিল। ছোটোকামার মাথার চুল থেকে হাল্কা আর্নিকা তেলের মিষ্টি-মিষ্টি গন্ধ ভাসছিল ঘরে। আলতো হয়ে।

    কোথায় সে জায়গা গো ছোটোকামা? নাম কী সে জায়গার?  তিমির শুধোলো চোখ বড়ো-বড়ো করে।

    বনেরই বুকের দামি ঝিনুকের মধ্যে লুকিয়ে রাখা দুমূল্য মুক্তোর মতো সেই ঝিল। নাম তার টিটিচিকোরি।

    কী বললে, কী বললে? কী? কী?  ওরা সমস্বরে শুধোলো অদ্ভুত শব্দটা শুনে।

    টিটিচিকোরি।

    টুমি ডাওনি ককনও ছোটোকামা? টুমি নিডেও ডাওনি?  পিতৃমাতৃহীন গাগা বলল। গাগার বাবা ছিলেন রায়বাড়ির ন-ভাই। স্বামী-স্ত্রী বিয়ের দু-বছরের মাথায়ই ট্রেন অ্যাকসিডেন্টে মারা যান। গাগার তখন এক বছর বয়স। এখন গাগার বয়স দশ। পাপার চেয়ে বছরখানেকের ছোটো সে। এখন ওর মুখে এরকম আধো-আধো বুলি। কাককে বলে টাক, ভাতকে বলে ভাট।

    না, আমি নিজে যাইনি কখনো। একবার যেতে হবে। যত তাড়াতাড়ি পারি, বলেই ছোটোকামা হঠাৎ নিজের ভাবনাতে কুঁদ হয়ে গেলেন।

    গল্পের স্রোতে বাধা পড়ায় টুলু বকল গাগাকে। বলল, বড়ো বেশি কথা বলিস তুই।

    গাগা বলল, বেঠ, আমি আড এড মডে নেই। রাগ করেই উঠে যাচ্ছিল ও।

    ছোটোকামা বললেন, বোস, বোস। তোর দোষ কী? দোষ তো আমার। শোন বলি। টিটিচিকোরি ঠিক যে কোথায়, তা ঘনুই জানত। তবে শুনেছি বাড়েষাঁনের জঙ্গলের মধ্যে। তার মুখেই। শুনেছিলাম তো আমি। মারুমার, গাড়ু, লাত, মুণ্ডু, চাহালচুঙরু, বাড়েষাঁন, লাতেহার, লোহারডাগা, রাংকা এমনি সব কত জঙ্গলেই না যেত ঘনু! আমাকেও নিয়ে যেত মাঝে-মাঝে ডালটনগঞ্জ থেকে। কিন্তু কোনো জঙ্গলের সঙ্গেই টিটিচিকোরির তুলনা হয় না। গা-ছমছম ভয়ের, গা-রিমঝিম ভালো লাগার এমন জায়গা পালামৌ জেলার আর কোথায়ই ছিল না। এমনই বন যে, সূর্যের আলো পৌঁছোয় না সেখানে। সেই বনের মধ্যে কতরকম যে গাছ, ফুল, পাখি। কত জানোয়ার, পোকা, প্রজাপতি। আর তার ঠিক মধ্যিখানে একটা ছোট্ট ঝিল। আয়নার বুকের মধ্যে লুকিয়ে রাখা ছোটো আয়নারই মতো। আর শীতের কোয়েল নদীল চেয়েও তার জল পরিষ্কার। কচি কলাপাতা-রঙা উপত্যকার মধ্যে-মধ্যে ঝিঙে-রঙা পাহাড় পেরিয়ে পথ। একটি নয় রে, পর পর সাতটি পাহাড়, ঝিলের পাশে। সাত বোনের মতোই ঘিরে রয়েছে ঝিলটিকে হাতে হাত। ধরে। তাদের একজনের গায়ে শালবনের শাড়ি, অন্যজনের সেগুনবনের। কারও শিমুলের লালে লাল, কারো করমের, কারো-বা সিসুর। আলাদা-আলাদা বন, এক-এক বোনের গায়ে। সেই যে সাত পাহাড়ের পাহারা-ঘেরা ঝিল, তারই নাম টিটিচিকোরি। বুঝলি গাগা, জ্যোৎস্নারাতে জিন পরিরা চান করতে নামে সেই ঝিলে। যদি তাদের কেউ দেখে ফ্যালে, তবে তার মৃত্যু নির্ঘাত। তাই যদি-বা কেউ যায়ও টিটিচিকোরিতে, সন্ধ্যের পর থাকে না মোটেই।

    তা হলে? ঘনুমামা যাচ্ছেন কেন? যেতে-যেতে যদি রাত হয়ে যায়?  উদবিগ্ন গলায় শীলা বলল।

    আজকে রাতের বেলা তো সে থাকবেই সেখানে। ঘনু একটা ডেয়ার-ডেভিল পাগল। জিন পরিদের চান করা দেখবে নাকি চাঁদের আলোয়। চাঁদের সাপেরা খেলা করবে তখন জলে, তারার ফুল ভেসে বেড়াবে, আর তারই মধ্যে পরিরা জলের উঁচ জলের সুতো দিয়ে জলেরই মধ্যে নকশিকাঁথা বুনবে।

    আররে, মলে যাবে ডে! ডুবে ডাবে না?  গাগা বলল, ঘনুমামা মলে ডেলে আমাডের কী হবে? কাড গডপ ঠুনব আমডা?

    মরতে যে পারে, তা ভালো করেই জেনেশুনে তো যাচ্ছে রে। মরতে যে ভয় পায়, সে কি টিটিচিকোরিতে যেতে পারে কোনোদিন?

    তাডপড?  গাগা আবার শুধোলো।

    শীলা বলল, ঘনুমামার কি ভয়ডর নেই?

    ভয় তো আমাদের জন্যেই। ঘনুর অভিধানে ভয় বলে কোনো কথাই ছিল না। ঘনু কী বলত জানিস?

    কী?

    বলত, ভয় কথাটা মুছে দেওয়াই উচিত অভিধান থেকে।

    কেন? খুকু বলল গোলাপি ঠোঁট ফাঁক করে।

    ভয় বলে আসলে কোনো জিনিসই নেই। তা থাকে শুধু ভীরুদেরই মনে। না-জানারই আর-এক নাম ভয়। যা-কিছুই আমরা জানি না, যা-কিছুই আমাদের অভিজ্ঞতার বাইরে, তাতেই আমাদের ভয়।

    বলো, বললা! নীলা বলল।

    হ্যাঁ, ছোটোকামা বললেন, চলেছে তো চলেইছে ঘনু। দুপুরের খাওয়া বলতে একটি বাখরখানি রুটি, দুটি ল্যাংড়া আম আর একটু আমলার আচার। ঘোড়াকেও ঘাস খাইয়েছে। কিন্তু জল পায়নি একটুও। ঘোড়ার পিঠে বাঁধা যে ছাগল ছিল, মানে ছোট্ট ভিস্তি, তার জলও শেষ হয়ে গেছে অনেকক্ষণ। টিটিচিকোরিতে না পৌঁছেলে আর জলের আশা নেই।

    তারপর?

    বেলা পড়ে আসছে। রোদটা ক্রমশ ঠান্ডা হয়ে আসছে। গাছের ছায়াগুলো লম্বা থেকে আরও লম্বা হয়ে লুটিয়ে পড়ছে পুবের জঙ্গলের পায়ে কালো আঁচলের মতো, সূর্য যতই হেলছে পশ্চিমে। সামনে দেখা যাচ্ছে জানোয়ারে আর জংলি মানুষদের পায়ে চলা সরু সঁড়িপথ। ফরেস্ট ডিপার্ট এর পথ ছেড়ে হঠাৎই বাঁ-দিকের গভীর বনের মধ্যের উপত্যকায় হুমড়ি খেয়ে খেয়ে নেমে গেছে সেই শুড়িপথটি। যেন ভয়ে-ভয়েই।

    ঘনু তার ঘোড়ার লাগামে টান দিল। তারপর দু-হাঁটু দিয়ে ঘোড়ার পেটে একটু চাপ দিয়ে ডান দিকের লাগাম ঢিলে করে বাঁ-দিকের লাগাম সামান্য টাইট করেই ঘোড়াকে নামিয়ে দিল সেই উপত্যকায়।

    গাছগুলোতে একটিও পাতা নেই। শূন্য ডালপালাগুলো মাথার উপরে হাত উঁচু করে বৃষ্টির প্রার্থনা জানাচ্ছে যেন মেঘহীন নীলিমার কাছে। বন তো নয়, যেন হাজার-হাজার নাগা-সন্ন্যাসীই শোভাযাত্রা করে চলেছে দ্রুতপায়ে, স্থবির হয়ে দাঁড়িয়ে থেকেই।

    তারপর বলল ছোটোকামা বলল, রুদ্ধশ্বাসে বলল আবার খুকু। তার ফরসা সুন্দর বালা-পরা, সুগোল ডান হাতখানিতে ধরে থাকা তালপাখাঁটি থেমে গেল উত্তেজনায়। ছোটোকামাও থেমে গেছেন। টিটিচিকোরির পথের বর্ণনা স্তব্ধ করে দিয়েছ সকলকেই। গ্রীষ্মের দুপুরের গরম ও অস্বস্তির কথা বেমালুম ভুলে গেছে ওরা সকলে। ছোটোকামার পিছনে ফেলে আসা জীবনের। স্মৃতিমন্থনের সঙ্গে সঙ্গে একদল কিশোর-কিশোরীও যেন চলে গেছে অনেক বছর আগের এক অদেখা গহন জঙ্গলের গভীরের আশ্চর্য ভয়ংকর, সুন্দর সেই অদেখা টিটিচিকোরির পথে। ছোটকামার জঙ্গলের বন্ধু ঘনুমামার টাটুঘোড়ার খুরের শব্দের প্রতিধবনি উঠছে তাদের প্রত্যেকেরই কচি মুখে। উত্তেজনা ফুটছে অন্ধকার রাতের সারসার তারার মতো উজ্জ্বল চোখে। ধুকপুক করছে বুক।

    তারপর?  একটু ভয় পেয়েই ছোটোকামার বুকের কাছ ঘেঁষে বসে বলল খুকু।

    তারপর কিছু এগোনোর পরেই ঘনু ঘন বাঁশের জঙ্গলে পৌঁছে গেল। যেখানে বড়ো বাঘ, বাইসন আর হাতিদের আড্ডা। বড়ো-বড়ো শঙ্খচূড় শাপ যেখানে ছায়াতে কুণ্ডুলি পাকিয়ে থাকে শুকনো পাহাড়ি নালার ভেজা-ভেজা বালির মধ্যে। এরা রেগে গেলে মাইলের পর মাইল তাড়া করেও লেজের উপর সটান দাঁড়িয়ে মানুষকে মুখে-মাথায় ছোবল মারে, দড়ি বাঁধারও উপায় থাকে না কোনো। সেই জঙ্গলও একসময় পেরিয়ে এল ঘনু। তারপর পৌঁছোল গিয়ে চিলবিল গাছেদের বনে। মেমসাহেবদের মতো গায়ের রং তাদের। একটিও পাতা নেই এখন কারো গায়েই। মেমসাহেবদের গা থেকে মিষ্টি-মিষ্টি গন্ধ বেরোচ্ছে। শেষ সূর্যের আলো সিঁদুরে করে তুলেছে তাদের শরীর। পাতার ঝরনা বওয়ানো হাওয়ায় ভেসে গরমের শেষ বিকেলের গায়ের পাঁচমিশেলি তীব্র ঝাঁঝালো কটু গন্ধ আসছে দূরের হরজাই জঙ্গলের গা থেকে। মিশে যাচ্ছে। মেমসাহেবদের গায়ের গন্ধের সঙ্গে। পথের দু-পাশের ঝাড়ে ঝাড়ে হাজার হাজার লাল-রঙা। ফুলদাওয়াই ফুটে উঠে বনপথকে এক লালচে আভা দিয়েছে। তেমন আভায় শুধুমাত্র কোনো বনপথই আভাসিত হতে পারে।

    ঘনুমামা?

    হ্যাঁ, ঘনু চলেছে সেই লালিমাতে আভাসিত পথ বেয়ে টগবগ…টগবগ…টগবগ…। তবে ওর টাটুর চালও যেন বদলে গেছে এখন। তার খুরের শব্দ অতি সাবধানে আর যাওয়া ঠিক হবে কি হবে না সেই প্রশ্ন এবং উত্তর করতে করতে চলেছে নিজের সঙ্গে সঙ্গে নিজেই। যেন বাঁয়ার সঙ্গে ঢিমেতালে কথা বলছে বাঁয়া। সেই মেমসাহেবদের বন পেরিয়ে সবে হরজাই জঙ্গলের মধ্যে ঢুকেছে ও, আর সঙ্গে সঙ্গে বনের মধ্যে থেকে তৃষ্ণার্ত গলায় ডাকতে থাকা ময়ুর-ময়ূরী, তিতির, আসকল, বটের, টিয়া, ময়না, টুনটুনি, বুলবুলি, সবাই কোন মন্ত্রবলে হঠাৎই চুপ করে গেল। থেমে গেল জোরে-জোরে আওয়াজ করে কাঠ ঠুকতে থাকা কাঠঠোকরাও হঠাৎ। লেজ তুলে তুলে চিহর-চিরি-র-রচিরি চিহর-র-র করে ডাকতে থাকা কাঠবিড়ালিরাও থেমে গেল। ঠিক সেই সময়েই বনের অণু-পরমাণু, রন্ধ্রে রন্ধ্রে ভরে দিয়ে গমগম আওয়াজ করে ডেকে উঠল কেঁদো। বাঘ। পালামৌয়ের বাঘ।–আঁ-ও। ঘোড়াটার শরীরে কাঁপুনি এল ম্যালেরিয়া জ্বরের মতন। ঘনু তার গলায় আদর করে হাত বোলাল। কিন্তু ঘোড়া সামনের দু-পা জোড়া করে একবার শূন্যে। তুলে পরক্ষণে নামিয়ে নিয়েই কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। নট নড়ন, নট কিচ্ছ। কয়েকবার ডেকেই কিন্তু থেমে গেল বাঘটা। বোধহয় জল খেতেই যাচ্ছে।

    টিটিচিকোরিতে? তাপর?

    শোন। টিটিচিকোরিতে ঘনু যখন পৌঁছোল গিয়ে, তখন সূর্য নামছে পাটে। তার গোলাপি আভায় টিটিচিকোরি ঝিলকে মনে হচ্ছে যেন এক গোলাপি সায়র। সাত-বোন পাহাড়েরা হাত-ধরাধরি। করে দাঁড়িয়ে আছে তাকে ঘিরে গোলাপির মধ্যে সবুজের ছায়া ফেলে। প্রত্যেকের গায়েই গভীর জঙ্গলের শাড়ি। পাতাঝরা বনই সব। অথচ আশ্চর্য, পাতা ঝরেনি তাদের একটিও। চারদিক। থেকে ঘন বনের সবুজ আঙুলগুলি নেমে এসে ঝিলের গায়ে হাত ছুঁইয়েছে সযতনে। টিটিচিকোরির ঝিলের একপাশে সেগুনবনের পাহাড়ের একটু উঁচুতেই একটা গুহা। তার উপর বসে আছে সাদা-মাথা মেছো বাজ।

    ঘোড়া নিয়েই উঠতে লাগল ঘনু সেদিকে। খুব আস্তে আস্তে। একটু বাদেই সন্ধ্যে নামবে। গুহার মুখের কাছে এসেছে, ঠিক সেই সময়ে একটা মস্ত ভালুক গুহা ছেড়ে বেরিয়ে এসেই পেছনের দু পায়ে দাঁড়িয়ে উঠে সে যে কত্তবড়ো তাই-ই দেখালো ঘনুকে। ভাবখানা, দেখেশুনে বাহাদুরি কোরো বাহাদুর। তার বুকের উপরের দিকে ইংরেজি ভি অক্ষরের মতো একটি মোটা সাদা দাগ। হিমালয়ান বেয়ার। কী রে, পা টেপা থামালি কেন রে পাপা?  ছোটোকামা বললেন।

    টিটিচিকোরির পাশ থেকে বড়ো কষ্ট করে পাপা ভবানীপুরে ফিরে এসে আবার ছোটোকামার পা টেপা শুরু করল।

    তারপর, খুকু বলল, বলো ছোটোকামা।

    আজ আর নয়। আবার এর পরের রবিবার। বড্ড ঘুম পাচ্ছে। যা, তোরাও ঘুমিয়ে নে একটু। বলেই অত্যন্ত নিষ্ঠুরের মতো ছোটোকামা কোলবালিশটা টেনে নিয়ে পাশ ফিরে ঘুমিয়ে পড়লেন।

    ওরা সকলেই হতাশার গুঞ্জরন তুলে হয় লুড়ো, নয় ক্যারাম, নয়তো কলের গানের কাছে ফিরে গেল।

    কাদের বাড়ির রেডিয়োতে তখন অনুরোধের আসর-এর গান হচ্ছিল হারা মরু নদী শ্রান্ত দিনের পাখি…। খুব কম লোকের বাড়িতে রেডিয়ো ছিল তখন। কলকাতার সব মানুষই তখন এত বড়লোক হয়ে যায়নি। আরাম ছিল না, টিভি ছিল না, কিন্তু বড়ো শান্তি ছিল। আরামের সঙ্গে শান্তিকে গুলিয়ে ফেলেনি তখনকার মানুষ।

    ২.

    পরের রবিবারও কিন্তু ছোটোকামা, রাতের বেলা টিটিচিকোরিতে ঘনুমামা কী দেখলেন তা কিছুতেই বলেননি। না, তারপরের বা তারও পরের রবিবারও নয়। ঘনুমামা সত্যি-সত্যিই পরিদের চান করতে দেখেছিলেন কি না, তাঁর কোনো বিপদ হয়েছিল কি না, সেসবও নয়।

    প্রতিবারেই ছোটোকামা টিটিচিকোরিতে ঘনুমামার পৌঁছোনোর বর্ণনাই দিতেন নতুন করে, নতুন ভাষায়। যেন টিটিচিকোরিতে পৌঁছোনোর অনেকগুলিই পথ ছিল বিভিন্ন দিক দিয়ে। তাঁর স্মৃতি। আর কল্পনার মধ্যে তো নিশ্চয়ই ছিল। যে যাত্রী যে পথ বেছে নেবে, নেবে। তার খুশিমতো। তখন বলাতেও বড়ো খুশি ছিল। বলতেন, জানিস, ওখানে পৌঁছেলে মানুষের আর খিদে পায় না, ঘুম পায় না, ঝগড়া করতে ইচ্ছে করে না কারো সঙ্গেই। ছেলেরা জিন এবং মেয়েরা পরি হয়ে যায় টিটিচিকোরিতে পৌঁছেই। কোনো দুঃখই তাদের আর ছুঁতে পারে না। খাওয়ার কষ্ট, পরার কষ্ট, আমার মতো একা-একা জীবন কাটানোর কষ্ট, কোনো কষ্টই না।

    পাপা একদিন জিজ্ঞেস করেছিল, আপনি নিজে তো যাননি কখনো? একদিনও না?

    নাঃ, হয়নি যাওয়া। হলে তো…। খুবই হতাশার সুরে বলেছিলেন ছোটোকামা।

    ছোটোকামা তিরিশের দশকের ডালটনগঞ্জ, বারোয়াডি, লাতেহার, বেতলা, ছিপাদোহরের জঙ্গলে কাঠ আর বাঁশের ব্যবসার স্মৃতি, ঘনুমামার মতো সঙ্গীর সঙ্গ, এসবই পিছনে ফেলে এসেছিলেন চিরদিনের মতো, ভাগ্যের হাতে মার খেয়ে। ওরা যদি কেউ জিজ্ঞেস করত, যেতে ইচ্ছে করে না ওখানে ফিরে আপনার? দেখতে ইচ্ছে করে না রাতের বেলার টিটিচিকোরিকে?  ছোটোকামা মুখ অন্য দিকে ফিরিয়ে বলতেন, নাঃ। বলেই সেই প্রসঙ্গ চাপা দিতেন সঙ্গে সঙ্গেই। এসব প্রসঙ্গ মানে টিটিচিকোরি বা কোয়েল নদীর বালাতেহারের পণ্ডিতজির দোকানের অথবা ছিপাদোহরের হাটের প্রসঙ্গ, এমনকী ডালটনগঞ্জ সংক্রান্ত কোনো কথা উঠলেও উনি দীর্ঘশ্বাস ফেলে অন্যমনস্ক হয়ে নীচু গলায় বলতেন, অন্য কথা বল। অন্য কথা। পাপা, গাগা, খুকু, তোদের পড়াশুনো নেই? তোরাও কি আমার মতো অপদার্থ হয়েই থাকবি? বেকার? পরের বোঝা?

    অনেক দিন, চল্লিশটি বছর পেরিয়ে এসেছেন ছোটোকামা। পেরিয়ে এসেছে পাপা এবং গাগাও, এই কলকাতা শহরও। দেখতে-দেখতে।

    বদলে গেছে কলকাতা, বদলে গেছে জীবন। বদলে গেছে মানুষের সফলতার সংজ্ঞা, চাওয়া পাওয়ার ধরন-ধারণ। ছোটোকামা, পাপা এবং গাগারও এখন বড়ো কষ্ট। স্বপ্নবিলাসীদের জায়গা নেই এই শহরে আর। বেঁচে থাকা সত্যিই বড়ো কষ্টের হয়ে গেছে। রোজগার নেই, স্বজন নেই, দু-বেলা ডাল-ভাতেরও সংস্থান নেই। তা ছাড়া বেঁচে থাকার মানে তো শুধুই খাওয়া-পরা-থাকার সুখ নয়! ছেলেবেলার সেইসব দুপুর এখন স্মৃতির মণিকোঠায় দুমূল্য আতর-মাখানো পশমিনা শালই হয়ে আছে।

    অকলুষিত রোদ মাথায় করে চল্লিশ দশকের গোড়ার দিকের কলকাতার স্তব্ধ, সুন্দর, নির্জন, ঝাঁঝালো দুপুরে ট্রাম যেমন দৌড়ে যেত, তেমন করে দৌড়ে যায় না আর ফাঁকা পথ দিয়ে গাঁগাঁ শব্দ করে লাইনের উপর হেলতে-দুলতে। গল্প বলার আর গল্প শোনার মতো পরিবেশ, সময় আর শান্তি আজকের কলকাতার দুপুরে আর একটুও নেই। সকাল বেলায় ফটফট শব্দ করে রাস্তা ধোয় না আর করপোরেশনের লোকেরা। অলিগলিতেও হাঁটা যায় না আর স্বচ্ছন্দে কোনো পথেই। কাবুলিওয়ালা হেঁকে যায় না সকালের চিলের কান্নার মধ্যে, হিং চাই, হিং…বলে। বিকেল হলেই বেলফুল আর কুলফি ফেরি করে যায় না ফেরিওয়ালা। সারা শহরের লোকই আজ ফেরিওয়ালা হয়ে গেছে। কিছু না কিছু বেচার আছে প্রত্যেকটি মানুষেরই। হারিয়ে গেছে সেই সব দিন, পরিবেশ, অনুষঙ্গ।

    রবিবারের দুপুরে আর কোনো ঘরেই মামা-মাসি, কাকা-পিসিদের ঘিরে শিশু আর কিশোরেরা গল্প শোনে না। টিটিচিকোরির পথের বাঘের মতো হুয়া হুয়াউ করে হুঙ্কার দেয়। এখন ঘরে ঘরে টিভি, নিস্তব্ধতাকে খানখান করে দিয়ে। যতটুকু প্রয়োজন, তার চেয়ে অনেকই বেশি জানা হয়ে গেছে যেন এখনকার কিশোর-কিশোরীদের। শৈশবের সব শিউলিগন্ধী বিস্ময়ই আজ মরে, পচে, ফুলে, গাড়ি চাপা-পড়া পথের কুকুরের মতো জীবনের পথপাশে পড়ে আছে। প্রযুক্তি আর বিজ্ঞানের শকুনেরা ছিঁড়ে খাচ্ছে তাকে।

    বড়োই লোভ জমেছে সকলের মনে। নানারকম, অঢেল, অপ্রয়োজনীয় ভোগ্যবস্তু, অবাস্তব সব বিজ্ঞাপনে। চাই, চাই, এটা চাই, ওটা চাই, সবই চাই। নিজের নিজের যোগ্যতার অথবা প্রয়োজনের কথা ভুলে গিয়ে প্রত্যেকেরই পেতে ইচ্ছে করছে সমস্ত কিছুই। যা-কিছু প্রতিবেশীর আছে, অথবা আছে আত্মীয়স্বজনের, সহকর্মীর। নেই, নেই, আর চাই, চাই করে দৌড়োতে দৌড়োতে মুখে রক্ত তুলে আছড়ে পড়ে মরে যাচ্ছে তারা এক সময়, অলক্ষ্যে।

    পিপাসা, বড়োই পিপাসা। বড়ো খিদে এখন চারদিকে। সত্যি খিদে, মিথ্যে খিদেও। যা তারা চায়, তার কত সামান্য পেয়েই এই একটা মাত্র ছোট্ট জীবনে কী দারুণ খুশি হওয়া যেত, সুখী থাকা যেত, তা একবারও ভাবার সময়টুকু, অবকাশটুকু পর্যন্তও আজকের কলকাতার বাবা মায়েদের নেই। অথচ পাপা-গাগাদের কৈশোরে ছিল। তাদের শৈশব ও কৈশোরের দারিদ্র্যের মধ্যেও রাজকুমারের মতোই উপভোগ করেছিল তারা।

    সেই সব স্নিগ্ধ, শান্ত দুপুরের, ছোটোকামার গল্প-শোনা সরল পবিত্র শিশু ও কিশোর-কিশোরীরা এখন সকলেই প্রায় প্রৌঢ়। টুলু নামকরা ইঞ্জিনিয়ার হয়েছে। ডুনা বিলিতি কমার্শিয়াল ফার্মে। মোটামুটি ভালো চাকরি করে। কাঁপি স্টেটস-এর নেভাডাতে সেটল করেছে। চারখানা গাড়ি ও বাড়ির মালিক এখন। শীলা ইংল্যান্ডে। ওর স্বামী নিউক্লিয়ার মিসাইল বানায়। পৃথিবী ধবংস করবে তো, তাই খুব ভালো থাকে। তিমির কলকাতাতেই বড়ো ব্যবসা করে। খুকু থাকে। বোম্বেতে। তার বর চাটার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট। পাঁচ বছর পরপর আসে একবার কলকাতায়। ওর ছেলে-মেয়েরা বাংলা বলতেও পারে না। মারাঠি বলে মারাঠাদের মতন।

    সকলেরই বিয়েও হয়ে গেছে। ছেলে-মেয়েও। কারো-কারো ছেলে-মেয়ের বিয়েও হয়ে গেছে। অপদার্থ রয়ে গেছে শুধু পাপা আর গাগাই। ভ্যাগাবন্ড ওরা। ইন্সিয়োরেন্স-এর এজেন্সি, জমি বাড়ির দালালি ছুটকোছাটকা কাজ করেছে পাপা জীবনের বিভিন্ন সময়ে। ইন্টারমিডিয়েটর পর আর পড়েনি।

    গাগারও বয়স বেড়েছে আরও, চল্লিশ বছর। কিন্তু মনে সে একটুও বাড়েনি। শিশুর মতোই কথা বলে এখনও ট-ট করে। আজকের কলকাতার ভদ্র ও শিক্ষিত সমাজে গাগা-পাপাদের কোনোই জায়গা নেই। ছোটোকামার বন্ধু, ধুতির উপর নীল টুইলের শার্ট পরা, টাটুঘোড়ায় চড়া ঘনুমামাই এখনও ওদের স্বপ্নের হিরো। বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন। চল্লিশটা বছর যে পেছনে ফেলে এসেছে সেই গল্প শোনার দিনগুলো থেকে, তা যেন মনেই পড়ে না ওদের।

    মনের বয়স হয়নি ছোটোকামারও। ব্যবসা ডুবে যাওয়ায় তিরিশ দশকের শেষের দিকে সেই যে পালামৌয়ের স্বপ্নময় কাব্যিক পরিবেশ ছেড়ে তিনি কলকাতায় এসেছিলেন ভাগ্যান্বেষণে, তখন থেকেই ভাগ্যের হাতে মার খেতে-খেতে একেবারেই ডানা ভেঙে পড়ে আছেন। এখন সম্পূর্ণই সমাহিত। প্রত্যেক পরাজয়ের মধ্যেও জয়ের মুহূর্ত নিহিত থাকে। আর কিছুই হবার নেই, হবেও না। তবুও প্রায় বিনা-রোজগারেই যে এই নিষ্ঠুর শহরে কী করে এত দীর্ঘদিন হাসিমুখে বেঁচে থাকা যায়, তার এক জাজ্বল্যমান উদাহরণ ছোটোকামা। হয়তো পাপা এবং গাগাও। টিটিচিকোরি ওদের চোখকে স্বপ্নের অঞ্জন দিয়ে ভরিয়ে রেখেছে। নির্লোভ, সরল, উচ্চাশাহীন এক আশ্চর্য জীবনযাপন করে যাচ্ছে এখনও এই তিনজন মানুষ, এই লোভসর্বস্ব ভণ্ডামির শহরে।

    ভাই-বোনেদের মধ্যে অনেকেই বাড়ি করেছে। গাড়িও করেছে প্রায় সকলেই। তারা ভালো থাকে, ভালো খায়। তাদের ছেলে-মেয়েরা দারুন ইংরেজি গান গায়, কবিতা লেখে ইংরেজিতে।

    গাগা একদিন বলেছিল কী লে পাপা, একটা গাড়ি ঠাকলে বেঠ হট, না লে? নিজেড গাডি। বেঠ, ভাবটি গাড়ি কিনব একডা।

    বেশ তো, পাপা বলেছে। গাগা মাঝে মাঝেই ভাবে একটা গাড়ির কথা। এত লোকের গাড়ি আছে! তবে, গাড়িই যদি কেনে ও কোনোদিন, তবে একটা লাল-রঙা দোতলা বাসই কিনবে। আত্মীয়স্বজন, পাড়ার মোড়ের মুদিটি, বিহারের দ্বারভাঙা জেলায় যার বাড়ি, হাজারিবাগ জেলার সিমারিয়া গ্রামের পরামানিক, ভিখিরি বুড়ি মোক্ষদা, পাড়ার মুড়ি-তেলেভাজার দোকানি পুলিনদা, যে তাকে প্রায়ই ধারে সিগারেট দেয় এবং অনেক সময় পয়সাও নেয় না, তাদের সকলকে নিয়ে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে যাবে, আর সকলে মিলে ফুচকা খাবে। এখন ফুচকার দাম কত হয়েছে কে জানে! কত্ত বছর খায়নি। ওদের ছেলেবেলায় পুরোনোদু-পয়সায় দশটা। করে ছিল।

    জগৎ রায় মানে ছোটোকামার খোঁজ এখন শুধুমাত্র গাগা ও পাপা-ই রাখে। রায়-পরিবার বড়ো হয়ে ওঠার পর ছোটোকামাকেও সেই আশ্রয় ছেড়ে চলে আসতে হয়েছে। পরিবার বড়ো শুধু। আয়তনেই হয়নি, বিত্তের মাপেও মস্ত বড়ো হয়েছে। অর্থ আসার সঙ্গে সঙ্গেই দারিদ্র্যের সঙ্গে যেসব মূল্যবোধ মাখামাখি হয়ে থাকে, তা উধাও হয়ে গেছিল রায়-পরিবার থেকে, অন্য অনেক পরিবারের মতো। ছোটোকামা ভেবেছিলেন, সারাটা জীবনই অমন গল্প বলেই কাটিয়ে দেবেন। মাত্র একজনের তো পেট। চলেই যাবে কোনো-না-কোনো দাদার সঙ্গে থেকেই. চাহিদাও তো ছিল না তেমন কিছু। খদ্দরের পাজামা আর পাঞ্জাবি, তাও নিজের হাতেই কাচতেন। যা খেতে দেওয়া হত, তাই-ই খেতেন। কিন্তু হয়নি তা।

    বারাসাত ছাড়িয়ে একটি গ্রামে কলকাতার এক ভদ্রলোকের বাগানবাড়ির আউটহাউসে থেকে তাঁর আম-বাগান দেখাশোনা করার ভার নিয়েছেন ছোটোকামা বছর-পাঁচেক হল। অনেক কিছুই ধরা-ছাড়ার পর। টিনের ছাদের একটি কামরা। গরমে বড়োই গরম এবং শীতে খুবই ঠান্ডা হয়। তবু গাছগাছালি, পাখপাখালি, বর্ষায় ব্যাঙের ছাতা, ব্যাং, লজ্জাবতী লতার ঝাড়। ছোটোকামা বলেন, চমৎকার! বেশ জঙ্গল-জঙ্গল ভাব। দারুণ লাগে রে গাগা, বুঝলি? পালামৌ-পালামৌ গন্ধ আছে বেশ।

    প্রতি রবিবারেই গাগা আর পাপা এখনও ছোটোকামার কাছে আসে। যদিও ওদের রোজই রবিবার। ছোটোকামা তেমনই গল্প বলেন বোনপো আর ভাইপোকে।

    বাগানের মালি ওড়িশাবাসী গণেশ চমৎকার মসুর ডাল রাঁধে। সেও থাকে পাশের ঘরে, একা। বৃষ্টি ও শীতের দিনে ছোটোকামার হট ভেভারিট খিচুড়ি বেঁধে দেয় গণেশ। বোনপো, ভাইপো আর কামার পকেট হাতড়ে যা বেরোয় তাই দিয়েই রান্না হয়। ভালোবেসে খিচুড়ি খেয়ে। আটচল্লিশ বছরের গাগা আর উনপঞ্চাশ বছরের পাপা পঁয়ষট্টি বছরের ছোটোকামার গল্প শোনে ছেলেবেলার মতোই। হাতে তালপাখা নিয়ে শুয়ে থাকা ছোটোকামা আজও তেমনই চমৎকার করে গল্প বলে যান, ক্লান্তিহীন।

    চেহারা ওদের তিনজনেরই বড়োই জীর্ণ হয়ে গেছে। কিন্তু মন তেমনই সজীব আছে। এখনও ওদের কল্পনার নিস্তব্ধ কাঁচপোকা-ওড়া গ্রীষ্ম-দুপুরের বাড়েষাঁনের গহন অরণ্যে ঘনুমামা তাঁর টাটুঘোড়ার পিঠে চেপে টিটিচিকোরির দিকে চলেন। টগবগ…টগবগ…টগবগ…শব্দ হয় ঘোড়ার খুরে-খুরে। শেষ বেলায় সিঁদুরে লাল রং লাগে আজও দীর্ঘাঙ্গী মেমেদের মতো চিলবিলের পাতা ঝরা জঙ্গলে। এখনও কল্পনায় নাগা-সন্নিসিদের মতোই বৃষ্টি নীরব প্রার্থনায় হেঁটে যায়, পত্রশূন্য গাছেরা স্থবির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।

    জন্মাবধি কলকাতা শহরের বাইরে একদিনের জন্যেও না-যাওয়া পাপা আর গাগাকে ছোটকামার গল্পের জাদু যেন ভবঘুরেই করে দিয়েছে। ওদের মনের চোখে গত চল্লিশ বছরে একটুও ক্ষুণ্ণ হয়নি সেই মেমেদের মতো জ্যৈষ্ঠের চিলবিল বনের নরম সৌন্দর্য।

    ছোটোকামা সবসময়ই হাসেন। হাসির আগে জিভ আর টাগরা দিয়ে একটা অদ্ভুত শব্দ করেন। বোঝা যায় যে, এবার কোনো হাসির কথা বলেই নিজেও হাসবেন। এরকম কষ্টের মধ্যেও হাসতে একটুও কষ্ট হয় না ছোটোকামার। অবাক হয়ে পাপা ভাবে। এতদিনেও কিন্তু একটুও ক্লান্তি আসেনি ছোটোকামার কল্পনার অরণ্যচারণে। সেই পঞ্চাশ বছরের আগের ডালটনগঞ্জ, লাতেহার, বারোয়াডি, গাড়ু, মুণ্ডু অথবা লোহারডাগার দিনগুলি এখনও জ্বলজ্বল করে তাঁর স্মৃতিতে।

    খাওয়া-দাওয়ার পর গেঞ্জিটাকে পেটের উপরে গুটিয়ে তুলে খাটের উপর আসনপিড়ি হয়ে বসে খয়েরি লুঙি পরে আরামে সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে ছোটোকামা বললেন, গাগা, পা-টা টিপে দে তো একটু।

    আটচল্লিশ বছরের গাগা পঁয়ষট্টি বছরের ছোটোকামাকে বলল, বিঠানাতে ঠোও তুমি আগে। তাপ্পড ডেব। বঠে-বঠে কি পা টেপায় কেউ? গল্প বলটে হবে কিন্টু।

    ছোটোকামা হাসেন। বলেন, আমাদের গাগাটা ঠিক একই রকম রয়ে গেল। নিজেও যে সেই একই রকম রয়ে গেছেন, সেকথা একবারও মনে হয় না তাঁর।

    দশ বছরেই থেমে আছে গাগা। অনেকেই ভাবে এবং বলে যে, গাগা স্বাভাবিক নয়। ওর বুদ্ধি জড়। একসময় তো সাইকিয়াট্রিস্টও দেখানো হয়েছিল। কিন্তু পাপা আর তার ছোটোকামা জানেন যে, গাগা প্রকৃতই ভাগ্যবান। এর চেয়ে বড়ো স্বাভাবিকতা আর কিছুই হয় না। সারাজীবন শৈশবে বেঁচে থাকার মতো সুখ কি আর কিছু আছে?

    ছোটোকামা শুরু করলেন, সেদিন বিকেলে খুব দুর্যোগ, বুঝলি। সকাল থেকেই শুরু হয়েছিল। প্রচণ্ড বৃষ্টি আর ঝোড়ো হাওয়া। জানুয়ারির শেষ। ওই সময়টায় প্রতি বছরই জঙ্গলে ওরকম হয়। পালামৌতে যা শীত দেখেছি, ওয়ার্লডেও তা দেখিনি।

    পাপা ভাবছিল, ছোটোকামার ওয়ার্লডের বিস্তৃতি পশ্চিমে পালামৌ আর পুবে কলকাতা।

    তাডপড?  গাগা বলল।

    মুগের ডালের ভুনি-খিচুড়ি হাতা-হাতা ফার্স্টক্লাস, গাওয়া ঘি, আর একেবারে কড়কড়ে করে ভাজা আলু আর শুকনো লঙ্কা খেয়েই সন্ধ্যে লাগতে না লাগতেই তো আমি আর ঘনু। বিশ্বাসবাবুদের হুলুক পাহাড়ের নীচের মারুমারের ক্যাম্পের কাঠের ঘরে দরজায় আগল দিয়ে শুয়ে পড়েছি পাশাপাশি খাঁটিয়া লাগিয়ে। খাঁটিয়ার নীচে জ্বলন্ত কাঠকয়লার আগুন কালো-রঙা মাটির কালো মালসাতে। তারপর দু-আঙুল মোটা দেহাতি কম্বল। ঘনু বলেছিল, আঃ, দু কমলিকা পড়েছে রে আজ জগা। সবে ঘুমটা এসেছে, বুঝলি, ঠিক সেই সময়েই দরজাতে কারা যেন ধাক্কা দিতে লাগল খুব জোরে জোরে।

    তাডপড? গাগা বলল।

    আমি তো ভয়েই বাঁচি না। ভয়ে আর শীতে দাঁত খটখটিয়ে বললাম, কোনোমতে, কৌন হ্যায় হো?  তারা কী বললে জানিস?

    টি? টি? বড়ো কামা। গাগা আবার বলল চোখ বড়ো বড়ো করে।

    তারা বলল, তেরা বাপ হ্যায় হো। তখন ঘনু ফিসফিস করে বলল, জগা, ডাকাত! দিগা পাঁড়ে, বলেই দেওয়ালে হেলান দিয়ে রাখা বন্দুকটা টেনে নিল নিজের দিকে।

    গাগা রুদ্ধশ্বাসে বলল, তাডপড?

    তারপর?

    ৩.

    ওই রকমই এক রবিবারের দুপুরে গাগা আর পাপাকে গল্প বলতে বলতেই ছোটোকামার খুব ঘাম দিতে লাগল। বুকে খুব ব্যথা। বর্ষার দিন ছিল। বৃষ্টি হচ্ছিল বেদম। গরম ছিল না একটুও। অথচ ঘেমে চান করে যাচ্ছিলেন।

    পাপা দৌড়ে গেল ডাক্তার আনতে। মোড়ের মুদির দোকানি রাধাবাবুর কাছে হাতঘড়িটা বন্ধক রেখে সাইকেল-রিকশা করে ডাক্তারকে নিয়ে এল পাপা। বুকে স্টেথিস্কোপ বসিয়ে ধপধপে সাদা পোশাক পরা বিলেত-ফেরত ডাক্তার খুব ভালো করে পরীক্ষা করলেন ছোটোকামাকে। মুখের কাছে ঝুঁকে পড়ে শুধোলেন, কী হল গো মালি তোমার? ও মালি, কথা বলো!

    ছোটোকামা কথা বলতে পারছিলেন না। মাথা নাড়ালেন বালিশের দু-পাশে। মুখ দিয়ে একটু লালা গড়াল। হাত দিয়ে বুক দেখিয়ে ইশারাতে বললেন, বুকে খুব ব্যথা।

    ঝোড়ো-কাকের মতো ভিজে, ওষুধ কিনে যখন ফিরল পাপা, তখন অন্ধকার হয়ে গেছে। ঘরে লণ্ঠন জ্বলছে। ভবানীপুরের গঙ্গার পাড়ের একটি বাড়িতে আজ থেকে চল্লিশ বছর আগে যেমন জ্বলত। ছোটোকামার মাথার কাছে তাঁর প্রাণের প্রহরীরই মতো গাগা বসেছিল।

    ছোটোকামা মুখ হাঁ করলেন একবার। গাগা মুখে জল ঢেলে দিতে দিতে বলল, এইবাডে কোয়েলেড পাডের ঠটানে ডাহ করটে নিয়ে ডেটে হবে, বুডলি পাপা? টময় হয়ে গেটে।

    মনে পড়ল পাপারও। ছোটোকামা বলতেন, ডালটনগঞ্জের ওই শ্মশান ছাড়া আর কোথাওই তাঁকে যেন দাহনা করা হয়।

    জ্ঞান যেন একটু একটু করে ফিরে আসছে। ঘুমের ইনজেকশানের কাজ শেষ হয়ে এসেছে।

    ছোটোকামা বললেন, জল।

    আবার জল দিল পাপা।

    জল খেয়ে চোখ মেললেন, হাসলেন। ফিসফিস করে বললেন, টিটিচিকোরি।

    তাঁর চোখের সামনে হুলুক পাহাড়ের নীচের শীতের রাতের নীল কুয়াশা, কোয়েলের ওপারের কুটকু, হুটার, মাড়োরাই, কুজরুম, ঔরঙ্গা আর কোয়েল নদীর সঙ্গমের কেচকির, সব ছবিগুলো যেন এক-এক করে ফুটে উঠতে লাগল। ট্রেন যাচ্ছে ঔরঙ্গার ব্রিজের উপর দিয়ে। গুম-গুম-গুম গুম…। মাথার মধ্যে অনেকগুলো বছর গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে গেল।

    নিয়ে যাবি রে?  ছোটোকামা বললেন।

    কোথায়?  ওরা দু-জনে খোঁচা খোঁচা পাকা দাড়ির মুখের উপর ঝুঁকে পড়ে বলল।

    টিটিচিকোরি, আরও-একবারও উচ্চারণ করলেন অস্ফুটে ছোটোকামা। তারপরই থেমে গেলেন। আর কথা বলেননি। ওই অবস্থাতেই যদিও ছিলেন তিনদিন। ওই আমবাগানের টিনের ঘরেই।

    না, কোয়েলের পারের শ্মশানে নয়। এই সভ্য শিক্ষিত মানুষদের শহর কলকাতার অত্যন্ত নোরা, লজ্জাকর গুণ্ডামি এবং চরম অশান্তির পরিবেশের এক শ্মশানেই ছোটোকামাকে পোড়ালো গাগা আর পাপা। শ্মশানের যা ছিরি, এই শহরে মৃত্যুর পরেও শান্তি নেই মানুষের।

    শ্মশানে কেউই আসতে পারেনি, এক ডুনা ছাড়া। যদিও ওই তিনদিনে সব বাড়িতেই ঘুরে ঘুরে খবর দিয়েছিল গাগা। পাপা সবসময়ই ছিল ছোটোকামার কাছেই। কেউই আসতে পারেনি। কারণ, একজন ভ্যাগাবন্ডের জন্যে নষ্ট করার মতো সময় কলকাতায় কারো নেই। সকলেই ব্যস্ত, সাকসেসফুল। অনেক রকম কাজ তাদের প্রত্যেকেরই। যাতায়াতের ভীষণ অসুবিধেও। আজকাল। ডুনাই এসেছিল একমাত্র। কিন্তু তারও সেরিব্রাল অ্যাটাক হয়েছিল একটা। একটা পা টেনে-টেনে হাঁটে। গাগা প্রত্যেককেই বলেছিল বাড়ি-বাড়ি গিয়ে, তার ছেলেবেলার খেলার আর। গল্প শোনার প্রত্যেক সঙ্গীকে, তাদের স্ত্রী এবং স্বামীদের, ছেলে-মেয়েদেরও বলেছিল, ঠোটোকামা টলে ডাচ্ছেন টিটিচিকোরিতে, টোমরা ঠেট ডেকা ডেকে ডেও।

    তবুও আসেনি কেউ। ছেলেবেলার সঙ্গীরা ছেলেবেলা ফুরোলেই বড়ো দূরে চলে যায়। মস্ত করে হাত বাড়ালেও তাদের ছোঁয়া যায় না পরে।

    পাশের পূতিগন্ধময় গঙ্গায় চান করে শেষ বিকেলে শ্মশানের বাইরে বেরিয়েই পাপা বুঝতে পারল যে, গাগার সঙ্গে তার বন্ধনটাও এবার ছিন্ন হয়ে যাবে। যোগসূত্র ছিলেন ছোটোকামাই। ছোটোকামার বেহালাটা, একমাত্র সম্পত্তিটা কাঁধে নিয়ে আগে আগে চলছিল বেঁটে গাগা। একটু কুঁজো হয়ে। এই নিষ্ঠুর আধুনিক পৃথিবীতে আটচল্লিশ বছরের শরীরের নিঃসহায় বিত্তহীন শিশুটি

    কী করে যে একা একা বেঁচে থাকবে তা ভাবতেও পারে না পাপা। ওর নিজের তো কোনো…। গাগার জন্যে ভারি চিন্তা হতে লাগল।

    অবশ্য পরমুহূর্তে ভাবল, প্রতিদিন তো গাগা একা একাই বেঁচে এসেছে। ওর জন্যে পাপা তো বটেই অন্য কেউও কিছুমাত্র করেনি। শুধু গাগাকেই নয়, এই আধুনিক পৃথিবীতে বিত্তবান বিত্তহীন, প্রাপ্তমনস্ক-অপ্রাপ্তমনস্ক প্রত্যেকটি মানুষকেই একা একাই বাঁচতে হয়। সংসার থাকলেও তারা এমনি একাই থাকত। একাই বাঁচতে হত। ভাবার মতো মন নিয়ে যে মানুষই জন্মেছে, সে সবসময়ই একা। চিরদিনের।

    বাস থেকে শ্যামবাজারের পাঁচমাথার মোড়ে নেমেই প্রচণ্ড শোরগোলের মধ্যেই পাপা, গাগার গায়ের খুব কাছে দাঁড়িয়ে বলল, কী করবি এখন তুই?

    পাপার কথার উত্তর না দিয়েই ও বলল, টুই?

    আমার মেস তো ছেড়ে দিচ্ছি। না ছাড়লে এবারে তাড়িয়েই দেবে। বলেছে তাই। আট মাসের টাকা বাকি। ওদের দোষ নেই।

    আররে, আমি টো আড মডিনি এখনও। তো কোনোই চিন্তা নেই। আমি ঠাকলে টুইও ঠাকবি। ঠিক ডেখিস।

    তা তো বুঝলাম। কিন্তু প্রত্যেক মানুষেরই তো ঠিকানাও লাগে একটা, না কী?

    গাগা হেসে ফেলল শিশুরই মতো। বলল, যে মানুটডের কোটাও ডাওয়ার ঠাকে, যাডের কেউ টিটি লেকে ককনও, টাডেরই ডরকার টিকানার। আমাডের কোন ডরকার? টুই একটা বোকা।

    বাঁশদ্ৰোনির ওই সাধুর আখড়াতে আর ক-দিন বাঁচবি? কী করে বাঁচবি? তার উপরে আমাকেও নিয়ে যাবি বলছিস। পাগল তুই।

    গাগা চারধারের অগণিত ঘর্মাক্ত, ডিজেলের ধোঁয়ার মধ্যে কুঁজো হয়ে হেঁটে যাওয়া ক্ষুধার্ত মানুষদের দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল পাপাকে, ড্যাক ড্যাক, এডা ড্যামন কলে বাঁটটে, আমডাও টেমন কলেই বাঁটব। অটো চিন্তা কডিস না। আমাডেট কী? ঝাড়া হাট-পা টো। টল, টুই আমাড ঠঙ্গেইটল। পাপার হাত ধরে টানল ও।

    ঘোরের মধ্যে একটু এগিয়েও গেল পাপা। কিছুটা ভিড়ের ঠেলাতেও। গাগার কানে মুখ ঠেকিয়ে পাপা বলল, গাগা, একটা জায়গায় যাবি?

    কোটায়? কোটায় ডে?  শিশু সারল্যে আর ঔৎসুক্যে বলল গাগা।

    টিটিচিকোরি।

    গাগা সঙ্গে-সঙ্গেই দাঁড়িয়ে পড়ে একগাল হেসে বলল, ভেলি গুড আইডিয়া। টল, টল। আমড়া টিটিচিকোরিতেই ডাই। পডিদের টান করা ডেকি গিয়ে।

    পাপা একদৃষ্টে গাগার দিকে চেয়ে রইল।

    পাপা এবং গাগা ভিড়ের ধাক্কায় এলোমেলো হতে হতে ঝরে-পড়া পাখির মতো পালক খসাতে খসাতে সাত-বোন পাহাড়ের সাত বনের শাড়িপরা পাহাড় ঘেরা পরিদের আবাস টিটিচিকোরির দিকে চলতে লাগল। মার্কারি ভেপার ল্যাম্পের খয়েরি আলোর মধ্যে ওদের অন্য গ্রহের দুটি জীব বলেই মনে হচ্ছিল।

    পাপাকে ঘিরে রাখা হাজার হাজার মূক, মাথা-নীচু মানুষের বিভিন্নমুখী স্রোতের মধ্যে বৃষ্টিভেজা, কাদাময় পথের মধ্যে পা হড়কে হড়কে দূরগামী বাসের জন্যে দৌড়োতে থাকা বৃষ্টিভেজা। মানুষদের ভ্যাপসা ঘামের গন্ধের মধ্যে পাপার মনে হচ্ছিল যে, ওর চারধারের প্রতিটি মানুষই

    জীবিকার জন্য দৌড়োদৗড়ি করছে, সকাল থেকে সন্ধ্যে অবশ্যই কিন্তু তাদের প্রত্যেকেরই আসল গন্তব্য বোধহয় ছিল টিটিচিকোরি। জীবিকা কখনোই জীবন নয়। টিটিচিকোরিই আসল জীবন।

    হঠাই গাগা বলল, সটি বলটি পাপা, বড্ডই খিডে পেয়েটে ডে। ঠেই ভোডবেলা এক কাপ টা খেয়েটি ঠুডু। আড কিটু খাইনি।

    পাপা মুখে ওকে কিছু না বলে মনে মনে বলল, চল, চল গাগা, দেবশিশু ভাই আমার, তাড়াতাড়ি চল। পা চালিয়ে যাই, যেখানে খিদে নেই, তৃষ্ণা নেই, ঈর্ষা নেই, লোভ নেই, পরশ্রীকাতরতাও। নেই। সাত-বোন, পাহাড় ঘেরা সাত-রঙা জঙ্গলের শাড়ি গায়ে জড়িয়ে সেই নীল ঝিলকে পাহারা। দেয় যেখানে। রাতের বেলায় রুপোলি চাঁদের সাপেরা কিলবিল হিলহিল করে জলে খেলা করে বেড়ায়, তারা রাশি রাশি সবুজাভ নরম ফুল ফুটিয়ে তোলে উড়াল ভিজে চুলে সাঁতরে যাওয়া। পরিদের নাভিতে, আর সেই পরিরা জলের সুচ, জলের সুতো দিয়ে জলেরই মধ্যে নকশিকাঁথা বোনে।

    চল, চল গাগা, যাই, সেইখানে যাই…সেই…পরিদের দেশে…যাই চল…।

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42 43 44 45 46 47 48 49 50 51 52 53 54 55 56 57 58 59 60 61 62 63
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleচম্পাঝরন – বুদ্ধদেব গুহ
    Next Article মহাভারত – বিষ্ণুপদ চক্রবর্তী

    Related Articles

    বুদ্ধদেব গুহ

    বাবলি – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    বুদ্ধদেব গুহ

    ঋজুদা সমগ্ৰ ১ – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    বুদ্ধদেব গুহ

    ঋজুদা সমগ্র ২ – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    বুদ্ধদেব গুহ

    ঋজুদা সমগ্র ৩ – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    বুদ্ধদেব গুহ

    ঋজুদা সমগ্র ৪ – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    বুদ্ধদেব গুহ

    অবেলায় – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }