Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    ছোটগল্প – বুদ্ধদেব গুহ

    বুদ্ধদেব গুহ এক পাতা গল্প831 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    বুলির পা

    রাসবিহারী অ্যাভিনিউ আর ল্যান্সডাউন রোডের মোড়ে লাল আলোতে গাড়িটা দাঁড়িয়েছিল। জানালার পাশে বসে উদ্দেশ্যহীনভাবে চেয়েছিলাম মোড়ের দিকে। হঠাৎই মনে হল, যেন পারুলকে দেখলাম।

    সোডিয়াম ভেপার ল্যাম্পের আলোয় জানুয়ারির মাঝামাঝির ধোঁয়াশা আর ডিজেলের ধোঁয়াকেও সুন্দর দেখাচ্ছিল। দেখলাম, শেয়াল-রঙা ছেড়া র্যাপারখানি গায়ে জড়িয়ে পারুল হেঁটে যাচ্ছে। প্রিয়া সিনেমার দিকে। ক্লান্তিতে ন্যুজ। রোগাও হয়ে গেছে অনেক। হাতে একটি লাঠি।

    বুকটার মধ্যে এমন করে উঠল যে, কী বলব! লোকলাজ ভুলে চিৎকার করে ডাকতে ইচ্ছে করল পারুলের নাম ধরে। উত্তেজনায় সিট থেকে প্রায় উঠেই দাঁড়িয়েছিলাম। পরক্ষণেই আস্তে আস্তে বসে পড়লাম।

    পারুলই তো…

    অনেক কিছুই বলার ছিল ওকে। কিন্তু যেসব কথা তামাদি হয়ে গেছে সেকথা আর বলা যায় না কাউকেই। ওকে আমার দেওয়ারও ছিল অনেক কিছু। কিন্তু দেওয়ার সময়েরও একটি সময়সীমা থাকেই, পাওয়ার সময়েরই মতো। সেই সময়ের মধ্যে দেওয়া বা পাওয়া না হলে এই এক জীবনে তা দেওয়া অথবা পাওয়া আর বোধহয় হয়ে ওঠে না।

    আলো সবুজ হতেই গাড়ি এগোল ড্রাইভার। যাকে পারুল বলে ভেবেছিলাম, তার কাছে চলে গিয়ে পাশ কাটিয়ে গাড়ি এগিয়ে গেল। বুকের গভীর থেকে একটি দীর্ঘশ্বাস উঠে এসে বাইরের ধোঁয়াশায় মিশে গেল।

     

     

    মনে মনে বললাম, পারুলের জন্যে আর কিছুমাত্রই করতে এ জীবনে পারব না। তার অভিশাপ বাকি জীবন আমাকে বয়ে বেড়াতেই হবে। আমার চেয়েও বেশি হয়তো রিমাকে। পারুল কিন্তু কোনোদিনও মুখে কিছুই বলেনি আমাকে। তবু, মনে হয়।

    বাড়ি ফিরে চানটান করে খাওয়ার টেবিলে যখন খেতে বসলাম তখন খেতে খেতে আমি বললাম, আজ ঠিক পারুলের মতো একজনকে যেন দেখলাম, জানিস বুলি!

    পারুলদি?

    আমার কিশোরী মেয়ে বুলি খাওয়া থামিয়ে চমকে উঠল।

    বুলি, আমার একমাত্র মেয়ে, এখন ক্লাস সিক্স-এ পড়ে। একমাত্র ছেলে চুপুও খাওয়া থামাল। মুখে কেউই কিছুই বলল না।

    রিমা বলল, খাওয়ার সময় পারুলের কথা না বললেই হত নাকি? আজ জণ্ড কড়াইশুঁটির চপটা কেমন করেছে তা তো খেয়ে বলবে? সারাটা দুপুরই ও এই নিয়ে মকশো করেছে। পুর নিয়ে অনেকই এক্সপেরিমেন্ট। পুরটা বানানো আর ভাজাটাই আসল। পুরে গোলমরিচের গুঁড়ো। দিয়েছে। জান?

     

     

    বুলি বলল যেমনই করুক জগুদা, আর যাইই দিক পারুলদির মতো কড়াইশুটির চপ কেউ করতে পারেনি আজ অবধি। আর পারবেও না।

    সকলেই কিছুক্ষণ চুপ করে রইলাম। খাওয়া বন্ধ করে। হাত থামিয়ে। একেই বোধহয় সভা সমিতিতে বলে মৃতের আত্মার প্রতি সম্মান জ্ঞাপনার্থে দুই মিনিট নীরবতা পালন।

    কোনো মৃতকেই মানুষ চিরদিন মনে রাখে না। মহান মানুষেরা হয়তো তাঁদের কীর্তির মধ্যে বেঁচে থাকেন অনেকদিন। আর পারুল অথবা আমার মতো সাধারণ মানুষেরা বেঁচে থাকে কড়াইশুটির চপ অথবা প্রভিডেন্ট ফান্ড-এর টাকাটার পুরোটাই পার হয়ে যাওয়ার পারিবারিক শোকের মধ্যে।

    খাওয়া-দাওয়ার পর রিমা বলল, টিভি দেখবে?

    বুলি বলল, ওর অনেক পড়া। পড়বে।

    বুলি চলে গেল। চুপুও উঠল। আমাদের বাড়ির চারটে বাড়ি পরেই নতুন মাল্টিস্টোরিড বাড়িতে স্নিগ্ধদের ফ্ল্যাটের ভি সি আর-এ মোৎজার্ট-এর জীবনীর উপরে যে ছবিটি সাড়া জাগিয়েছে তাই দেখতে যাবে ও। অ্যামিডিয়াস না কী যেন!

     

     

    খাওয়ার পর একটা সিগারেট ধরিয়ে শোয়ার ঘরে এসে আমি জানালার পাশে চেয়ার টেনে বসলাম।

    একসময় আমি ভাবতাম যে, একজন আধুনিকনগর-ভিত্তিক মানুষের জীবনের সবচেয়ে বড়ো লজ্জা হচ্ছে তার একঘেয়েমি। এই প্রাত্যহিক, মানডেন মিনিংলেস দিনগুলি-রাতগুলির গতানুগতিকতা তাদের প্রত্যেককেই সবসময় ক্লিষ্ট করে রাখে। কিন্তু পারুলের মতো কারো কথা যেই মনে হয়, তখন মনে হয় যে, তারা সকলেই, আমারই মতো নিশ্চয়ই বোঝে যে, মানুষের লজ্জাকরতম লজ্জাটি হচ্ছে তার অহংবোধ।

    পারুল আজ থেকে পনেরো বছর আগে আমাদের বাড়িতে এসেছিল। তখন চুপু ছোটো। বুলি হয়ইনি। চাকরিতে আমার এত পদোন্নতিও হয়নি। পারুল এসেছিল রাঁধুনি হিসেবে। তারপর নিজের গুণে ও আন্তরিকতায় কী করে যে সে হাউসকিপার, বেবিসিটার কেয়ারটেকার, আয়া, দারোয়ান, একই সঙ্গে সব কিছুই আস্তে আস্তে হয়ে উঠেছিল তা আমরা লক্ষ পর্যন্ত করিনি।

    পারুলের উপরে বাড়ি ছেড়ে আমরা কত জায়গায় বেড়াতে গেছি। বুলি যখন ছ-মাসের তখন। তাকে পারুলের জিম্মাতেই রেখে মধ্যপ্রদেশে বেড়াতে গেছিলাম একবার। বন্ধুবান্ধব সকলেই শুনে অবাক হয়ে গেছিল। কিন্তু কী করব! যৌথ পরিবার থেকে বেরিয়ে এলে আর সেখানে ফেরা যায় না। কেউ ফিরিয়েও নেয় না। পারুলরাই অবলম্বন আমাদের। রিমারও তখন খুবই বেড়াবার শখ ছিল। পারুল আমাদের পরিবারেরই একজন হয়ে গেছিল।

     

     

    বুলি কথা বলতে শেখার পর পারুলকে প্রথমে ডাকত পা বলে।

    পারুল হেসে বলত, কোন পারে বুলি? ডান, না বাঁ?

    আরও একটু কথা শেখার পর বুলি বলত পারু। পারুল হাসত। বলত আমাকে দেবদাসের পারু করে দিলে গো! বুলি বড়ো হয়ে যাবার পর অবশ্য পারুদি বলেই ডাকত। পারুলদির সঙ্গে বুলির যে ধরনের সখ্য, মমত্ব ও স্নেহের সম্পর্ক ছিল তা হয়তো তার মায়ের সঙ্গেও ছিল না। পরবর্তী জীবনে তার কোনো প্রিয় সখীর সঙ্গেও বোধহয় হয়নি। ভূতের ভয় থেকে বয়ঃসন্ধির ভয়ের কথা সব কিছুই বোধহয় বুলি পারুর কাছেই শুনেছিল। রিমার সময় ছিল না।

    পারুলের নিজের ছেলে ছিল একটি। সে দশ বছর বয়সে নাকি কলেরাতে মারা যায়। অনেকই বছর আগে। পারুলদের বাড়ি ছিল লক্ষ্মীকান্তপুর ক্যানিং কোথায় যেন! দোকনো ভাষায় কথা বলত। পান খেত বাড়িতে বানিয়ে। দোক্তা দিয়ে। প্রতি মাসেরই এক তারিখে দুটি ষণ্ডা-গুণ্ডা ছেলে আসত পারুলের কাছে মাইনের টাকা নিতে। তীর্থের কাকের মতো দাঁড়িয়ে থাকত যতক্ষণ না টাকাটা হস্তগত করে। পারুলকে আমরা পুজোর সময়ে এবং পয়লা বৈশাখে নতুন শাড়ি-জামা ইত্যাদি ছাড়াও দু-মাসের মাইনে বোনাস হিসেবে দিতাম। এবং দিয়ে শ্লাঘা বোধ করতাম। টাকা যাই-ই পেত ও, ওই ছেলে দু-টিই কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই নিয়ে যেত। পারুল দশ-বিশটাকা রাখত নিজের কাছে। হয়তো হাত খরচা হিসেবেই। মাস পয়লা ছাড়াও নানা দরকারে মাসের মধ্যে একাধিকবার ছেলে দু-টি এসে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে ডাকত পিসি! অ পিসসি।

     

     

    রিমা বলত, পারু, তোমার বুড়ো বয়সে কী হবে? সব টাকাই ওদের দিয়ে দাও কেন? একটা ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট করে দিই, তাতে রেখো।

    পারুল হাসত। বলত, কী যে বল দিদি। ওরাই তো আমার সব। আপন ভাইপো। ওরাই দেখবে। আমার আর আছেটা কে? তারপর বুলি আর চুপুর দিকে চেয়ে বলত, ওরাও দেখবে। কী? দেখবে না? ওরাই তো সবচেয়ে আপন আমার। আমার ভাইপোদের চেয়েও অনেক বেশি।

    বুলি আর চুপু কিছু না বুঝেই বলত, নিশ্চয়ই। নিশ্চয়ই!

    পারুলের দু-পায়েই আর্থারাইটিস ছিল। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্লাডপ্রেসার অস্বাভাবিক রকম। বেশি হয়ে গেল। হাঁটতে লাগল খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। ভাইপোরা এসে প্রায়ই এটা করতে হবে, সেটা করতে হবে, ওটা করতে হবে বলে উপরি-টাকা নিয়ে যেতে লাগল। টাকা অবশ্য রিমাই দিত। স্কুলের এবং কলেজে সময়ের মধ্যে রান্না করে উঠতে পারত না পারুল প্রায়ই। অফিসেও আমাকে প্রায়ই না খেয়েই যেতে হত। রিমা এবং আমি ক্রমশই বিরক্ত হয়ে উঠতে লাগলাম মানুষটার উপরে মাত্র দুটি মাসেই। অবলীলায় ভুলে গেলাম যে, দীর্ঘ পনেরো বছর সে আমাদের জন্যে কী করেছে আর করেনি।

     

     

    একদিন রিমা রাতে আমাকে ডেকে বলল, একটি অল্পবয়সি মেয়ে পেয়েছি। লাজুক প্রকৃতির, স্বভাবও ভালো। চুপু এখন বড়ো হচ্ছে তো। তাই কুৎসিত দেখতে বলেই ওকে রাখব ঠিক করেছি। খালি বাড়িতে থাকবে। আগুন নিয়ে খেলা। আমি কোনো রিস্ক নিতে চাই না।

    আমি বললাম, কী যে বল! কিন্তু পারুল! পারুলকে কী করবে?

    ওকে তিন মাসের মাইনে দিয়ে ছুটি দিয়ে দেব। এ বাজারে তো আর কাউকে বসিয়ে খাওয়ানো যায় না। মানুষ নিজের মা বাবাকেই আজকাল বসিয়ে খাওয়াতে পারে না, আর কাজের লোককে

    ওকে কে দেখবে?

    কেন? ওর ভাইপোরা। তারাই তো ওর সব। তা ছাড়া এত বছর পারুলকে আমরা কম টাকা তো দিইনি। শুনেছি ওর গ্রামে না কোথায় পাকা বাড়িও করে নিয়েছে পারুল। তা ছাড়া সারাজীবন দেখবার দায়িত্ব গভর্নমেন্টই নেয় না তো আমরা নেব কোত্থেকে।

     

     

    আমি বললাম, একদিন আমরা গিয়ে দেখে এলেই তো পারি পারুলের বাড়ি সত্যিই আছে কি না? ওর খোকা আর খোকনরা তো ওকে ঠকাতেও পারে!

    তোমার মতো অত প্রেম আমার নেই। কালকে আমার অবস্থা যদি পারুলের মতো হয় আমার প্রিন্সিপ্যালও কি আমাকে বিদেয় করে দেবেন না? তিন মাসের মাইনেও দেবেন কিনা সন্দেহ। সবাই তো আর তোমার মতো ভালো কোম্পানিতে চাকরি করে না। অত ভাবলে চলে না। প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে সকলকে যেতে হয়ই। তা ছাড়া নতুন কাজের লোকটি কোথায় থাকবে? কোয়ার্টার তো একটি! এ কি তোমাদের বাড়ি? যে, প্রচুর ঘর। একতলার একটা ঘর পারুকে দিয়ে দেওয়া যেত। আমাদের এইটু-বেডরুম মাল্টিস্টোরিড ফ্ল্যাটে এক্সট্রা একজন মানুষেরও তো জায়গা নেই।

    পারুল খুব কেঁদেছিল। ওর কান্নার শব্দ কোনো দিনই কেউ শুনতে পেত না। কিন্তু কিছুনারীর কান্না ওইরকমই হয়, সমুদ্রপারের বৃষ্টির মতো।

    তারপর একদিন–লাল গোলাপ আঁকা ওর ছোট্ট টিনের তোরঙ্গটি নিয়ে বুলির থুতনি ছুঁয়ে চুমু খেয়ে আশীর্বাদ করে হেলতে-দুলতে পারুল সত্যিই চলে গেছিল।

     

     

    আর্থারাইটিস-এর জন্যেই ও অমনি হেলেদুলে নইলে চলতে পারত না। মোটাও হয়ে গেছিল প্রচণ্ড।

    বুলি কিন্তু ফিসফিস করে কাঁদেনি। ডাক ছেড়েই কেঁদেছিল সেদিন। শিশুর কাছে ঘোড়েল এবং বিষয় স্বার্থবুদ্ধিসম্পন্ন প্রাপ্তবয়স্কদের যুক্তি আদৌ গ্রহণীয় হয়নি। যখন তখন পথে ঘাটে পড়ে। পারুল মারা যেতে পারে একথা জেনেও তাকে কেন যে এমন করে ছাড়িয়ে দিলাম এ নিয়ে ছোট্ট বুলি তার মায়ের সঙ্গে ঝগড়াও করেছিল খুবই।

    খাবার টেবিলে বসে বুলির দিকে চেয়ে আমি ভাবছিলাম যে, এক দিন বুলিও অবলীলায় রিমা হয়ে উঠবে। আমাদের সমাজব্যবস্থা, শিক্ষাব্যবস্থা, আমাদের বিবেককে, শুভবুদ্ধিকে নিজ স্বার্থের কাছে নীরবে এবং নেপথ্যে বলি দেওয়াবে। পাতি বুর্জোয়াদের ভিড়ের মধ্যে সামিল হয়ে যাবে বুলি।

    সে রাতে পথে পারুলকে দেখার মাস দুয়েক পরে আমার বন্ধু সিতেশ ফোন করে বলল যে, পারুল নাকি লাঠি ঠকঠকিয়ে ওর বাড়ি গেছিল কিছু সাহায্যের জন্যে। পাশের বাড়ির কাজের লোক মতি পারুলের গ্রাম চিনত। তাকে দিয়ে এক রবিবার খবর নিতে পাঠালাম। সে এসে বলল, পারুলকে তার ভাইপোরা তাড়িয়ে দিয়েছে। পারুলের পনেরো বছরের রোজগারের প্রতিটি টাকাতে তারা ধান-জমি, বাড়ি, গোরু, সবই করে নিয়েছে। তাদের বউদের সঙ্গে। পারুলের বনেনি বলে তারা ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিয়েছে পিসিকে। পারুল এখন নাকি লেক-এর কাছে সাদার্ন অ্যাভিনিউর ফুটপাথের এক গাড়ি-বারান্দার নীচে রাত কাটায় এবং সারাদিন নাকি পথে পথে ভিক্ষা চেয়ে বেড়ায়।

     

     

    কথাটা শুনে বড়ো ভয় হল। না, পারুলের জন্যে নয়, বন্ধু ও পরিচিতরা আমাদের সম্বন্ধে কী আলোচনা করবে তা ভেবে।

    পরদিনই অফিস থেকে ফেরার পথে ড্রাইভারকে বললাম, সাদার্ন অ্যাভিনিউতে যেতে। তখন সন্ধ্যে হয়ে গেছে। দেখি, দু-টি ইটের উপরে বসানো একটি পোড়া কালো মাটির হাড়িতে শুধু ভাত সেদ্ধ করছে পারুল। দেখলে ওকে চেনা যায় না। মনে হয়, যেন জন্মানোর পর থেকেই ও ভিক্ষা করছে। ভিখিরিদের বুঝি অতীত থাকে না কোনো।

    পারুলকে বাড়িতে দেখা করতে বলে এলাম পরদিন সকালে। গাড়ি থেকে নেমে ভিখিরির সঙ্গে কথা বলা যায় না। কে কোথা থেকে দেখে ফেলবে। কী মনে করবে আমাকে! পারুল বলল, অত দূর যে যেতে পারবনি দাদাবাবু! লাঠি নিয়েও চলতে পায়ে বড়োই লাগে। তা শুনে, ওকে দশটা টাকা দিয়ে বললাম, রিকশা করেই এসো।

    পরদিন রিকশা করে কিন্তু এল না পারুল। হেঁটেই এল। টাকাটা বাঁচিয়েছে। ভিখিরি হয়ে গেলে মানুষ মিথ্যেবাদীও হয়ে যায় বোধহয়। দশটা টাকা ওর কাছে অনেকই টাকা। ছেড়া, দুর্গন্ধ, ননাংরা শাড়ি। পাময় গাময় ধুলো। রিমা তো ওকে ঝকঝকে বসার ঘরে ঢুকতে পর্যন্ত দিল না। বাইরের বারান্দাতেই বসিয়ে রাখল। বলল, কত রোগের জার্মস যে ওর গায়ে থিকথিক করছে, কে জানে!

     

     

    আমি পারুলকে বললাম, তোমার কী ক্ষতি করেছি আমরা যে তুমি আমার বন্ধুর বাড়ি গিয়ে ভিক্ষা চাও? এতে কি অসম্মান করা হয় না আমাদের?

    পারুল কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল আমার মুখের দিকে চেয়ে।

    তারপর বলল, সম্মান-অসম্মানের কথা তো ভাবিনি দাদাবাবু। খিদে বড়ো ভীষণ জিনিস। কী করে বোঝাব আপনাদের!

    রিমা বলল, ছিঃ ছি। তুমি এত নীচ!

    পারুল চুপ করে রইল। ওর দু-চোখ বেয়ে জলের ধারা নামল। আবারও ফিসফিসে বৃষ্টি নামল সমুদ্রপারে।

    রিমার অলক্ষ্যে গাড়িতে ওকে তুলে নিয়ে আমাদের ফ্যামিলি ফিজিসিয়ানের কাছে গিয়ে পরীক্ষা করিয়ে প্রেসক্রিপশান লেখালাম। উনি ওর হিস্ট্রি জানতেন। নানা রোগ এসে বাসা বেঁধেছে পারুলের মধ্যে। বয়সও হয়েছে ষাটের বেশি। দু-মাসের মতো ওষুধ কিনে দিলাম ওকে। তারপর এক-শো টাকা দিয়ে বললাম, পারুল, তোমাকে প্রতি মাসে আমি পঞ্চাশ টাকা করে। দেব। প্রতি মাসের তিন তারিখে এসে নিয়ে যেয়ো। অথবা তুমি যে গাড়ি বারান্দার নীচে থাকো সেখানেই কাউকে দিয়ে পৌঁছে দেব।

     

     

    দাদাবাবু, আপনি বড়ো দয়ালু!

    সেই বাক্যটি এবং পারুলের রোগপাণ্ডুর জলভরা চোখ দুটি প্রায়ই কানে এবং চোখে ফিরে ফিরে আসে আমার।

    এই বন্দোবস্ত চলল দু-মাস। তারপরই একদিন রিমা বাড়ি ফিরেই তুলকালাম কাণ্ড বাধাল। ওর খুড়তুতো দাদা প্রদীপের বাড়িতে গিয়েও নাকি পারুল ভিক্ষে চেয়েছে কাল সকালে। প্রদীপের স্ত্রীকে রিমা একেবারেই দেখতে পারে না। রিমার ধারণা, বড়োলোকের মেয়ে বলে দেমাকে পা পড়ে না মাটিতে। আপস্টার্ট। অশিক্ষিত। সে কলকাতার সকলকে বলে বেড়াচ্ছে যে, এই তো! দ্যাখো! কী শিক্ষিত বড়োলোকই না রিমারা! যে মানুষটা এত কিছু করল এত দিন ধরে তার আজ এই দশা! সম্মানেও কি লাগে না? কেমন ছোটো মানুষ বল তো!

    আমার মাসতুতো দাদার বাড়ি সাদার্ন অ্যাভিনিউতে। সেও বলল একদিন যে, পারুল লাঠি ঠকঠকিয়ে ভিক্ষা চাইতে গেছিল তার কাছেও। পারুল নাকি বলেছিল দাদাবাবু দিদি খুবই দয়ালু। আমাকে মাসে পঞ্চাশ টাকা করে দেন। বলেছেন দেবেন। যতদিন বাঁচি। কে দেয় বলুন? কিন্তু পঞ্চাশ টাকাতে তো খাওয়া এবং ওষুধ চলে না। এমনকী ফুটপাথে থেকেও চলে না। তারপর জাতে মেয়ে তো! শরীর ঢাকতেও তো এক বিরাট খরচ!

    মাসতুতো দাদার কাছে শুনে আমার বড়োই রাগ হল। আমার পরিচিত কারো কাছে না যেতে বলা। সত্ত্বেও পারুল তবু গেছে ভিক্ষা করতে আবারও!

    পরের মাসে টাকা নিতে এল না কিন্তু পারুল। আমি ড্রাইভারকে দিয়ে সাদার্ন অ্যাভিনিউতে টাকা পাঠালাম না। রাগ করেই। সত্যিই বড়ো অপমানিত বোধ করেছিলাম।

    চুপুর এক বন্ধু চুপুকে স্কুলে বলল, কেওড়াতলার কাছে নাকি দেখেছে পারুলকে আগের দিন। ফুটপাথে ভিক্ষা চাইতে।

    রিমা রেগে গিয়ে বলল, ভালোই তো। লাস্ট ডেস্টিনেশনের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে।

    চুপু আর বুলি বলল, ওরা গিয়ে পারুলদিকে নিয়ে আসবে।

    ছেলেমেয়েকে রিমা বলল, নিজেরা রোজগার করো, পায়ে দাঁড়াও, তারপর আদিখ্যেতা কোরো।

    ওরা চুপ করে যে যার ঘরে চলে গেল।

    তার দিন দশেক বাদে পারুলের ভাইপো দু-জন সন্ধ্যেবেলা এসে বলল, পিসি মরে গেছে বাবু। খবর পেয়েই আমরা এয়েচি। সকারের খরচ দিন।

    কখন?

    আমি অপরাধীর গলায় বললাম।

    আজ ভোর রাতে। শীতটা খুব জোর পড়েছে তো! বহু বুড়ো-বুড়িই টেঁসেছে আজ।

    কোথায় ঘটল ঘটনাটা?

    সে খুব ভেবেচিন্তেই মরেছে আমাদের পিসসি। এক্কেবারে কেওড়াতলার শ্মশানের সামনেই। ফুটপাতে।

    ওদের থাপ্পড় মারতে ইচ্ছে করছিল আমার। অনেকদিন পর মারামারি করতে ইচ্ছে করছিল। সত্যিই।

    টাকা দিয়ে ওদের বিদেয় করে দিলাম। তখন বুলি ও চুপুও বাড়ি ছিল না। থাকলে, হয়তো শেষ দেখা দেখতে চাইত।

    আমি যেতে পারতাম শ্মশানে। কিন্তু আমার মতো একজন মানুষের এক ভিখারিণীর দেহ সৎকারের জন্যে কেওড়াতলায় যাওয়াটা এই সমাজের মনঃপূত নয়। তা ছাড়া, গেলেই নানা। চেনা মানুষের সঙ্গে দেখা হত, এ পার্টিতে সে পার্টিতে দেখা হওয়া মানুষ। নানা কৈফিয়ত দিতে হত নানাজনকে। না, না। তা হয় না।

    বুলি-চুপুরা এখনও ছেলেমানুষ। এখনও ওরা জানে না যে, শেষ দেখা কখনোই দেখতে নেই, যদি তেমন শেষ-দেখা না হয়। সবাইকেই সুন্দরতম দিনে, সুন্দরতম সাজে দেখে রাখতে হয়। সেইটুকুই শুধু থাকে স্মৃতিতে।

    পরদিন রবিবার ছিল। ব্রেকফাস্ট টেবিলে ছেলে-মেয়েকে রিমা হঠাৎ বলল, অ্যাই। জানিস তো, পারুল মরে গেছে।

    পারুলদি? কবে?

    বলেই, বুলি ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল।

    বুলিটা আমার এখনও ঈশ্বরী।

    চুপুও খাওয়া থামিয়ে চুপ করে বসে রইল।

    রিমা আমাকে বলল, তোমাকে আরেকটা আলু পরোটা দিই?

    উত্তর দিলাম না কোনো। শুধু ঘাড় নাড়িয়ে জানালাম, না।

    আজকালকার সব মেয়েরাই কি রিমারই মতো? অবুঝ, নিজসুখমগ্ন, হৃদয়হীন?

    ভাবছিলাম, কেনই যে পারুল এমনভাবে ফুটপাথে না-খেয়ে মারা গেল, এই মহৎ জনগণতান্ত্রিক সোনার সংবিধানের দেশে কে বা কারা যে তাকে অলক্ষ্যে খুন করে গেল, সেই রহস্য অথবা। আমার এবং রিমার অসহায়তা বা অপারগতা যে ঠিক কতখানি তা আমার শোকস্তব্ধ অপাপবিদ্ধ অনাবিল ছেলে-মেয়েকে বুঝিয়ে বলা যাবে না। এখন বলা গেলেও, ওরা বুঝতে পারবে না। বলা যাবে না কোনোদিনও, যদি-না তারা নিজেরাই বড়ো হয়ে ওঠার পর আমাদের দুজনকে, আমাদের পারিপার্শ্বিককে এবং আমাদের সমাজ ও দেশের প্রকৃত স্বরূপকে সত্যিই আবিষ্কার করতে চায়। কিন্তু তেমন ভালো কি আমার ও রিমার মতো নষ্ট-ভ্রষ্ট দম্পতির ছেলে-মেয়েরা কখনোই হবে? ওরা কি আমাদের চেয়েও বেশি আত্মতুষ্ট, আত্মমগ্ন, নিজ সুখপরায়ণ হবে না?

    আমাদের সাততলার ছোট্ট, স্বয়ংসম্পূর্ণ সুখ-ভরপুর ফ্ল্যাটের ড্রয়িং-কাম ডাইনিং রুমে তখন উত্তরের জানালা দিয়ে হাওয়া আসছিল। সে হাওয়ায় কোনো ফুলের গন্ধ ছিল না।

    বারুদের গন্ধ তো নয়ই! অথচ, থাকা উচিত ছিল।

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42 43 44 45 46 47 48 49 50 51 52 53 54 55 56 57 58 59 60 61 62 63
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleচম্পাঝরন – বুদ্ধদেব গুহ
    Next Article মহাভারত – বিষ্ণুপদ চক্রবর্তী

    Related Articles

    বুদ্ধদেব গুহ

    বাবলি – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    বুদ্ধদেব গুহ

    ঋজুদা সমগ্ৰ ১ – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    বুদ্ধদেব গুহ

    ঋজুদা সমগ্র ২ – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    বুদ্ধদেব গুহ

    ঋজুদা সমগ্র ৩ – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    বুদ্ধদেব গুহ

    ঋজুদা সমগ্র ৪ – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    বুদ্ধদেব গুহ

    অবেলায় – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }