Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    ছোটগল্প – বুদ্ধদেব গুহ

    বুদ্ধদেব গুহ এক পাতা গল্প831 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    স্বর

    দূর থেকে সমুদ্র দেখা যাচ্ছিল। যুবক সকালের চোখ ঝলসানো রোদে নীল জলরাশি সাদা ফেনার ভেঙেপড়া গুঁড়ো সমেত প্রচণ্ড শব্দে আছড়ে পড়ছে বেদুইন মেয়ের বুকের রঙের মতো বাদামি বেলাভূমিতে।

    সাইকেল রিকশাটা কাঁচোর-ক্যাঁচোর করে চলছিল। এখানে ট্যাক্সি পাওয়া যায় না বললেই হয়। অরু, তার দশ বছরের ছেলে দীপের পাশে বসে রিকশা করে হোটেলের দিকে চলছিল।

    দীপের স্কুল খুলে যাবে ক-দিন পর। রেল স্ট্রাইকের জন্যে এর আগে বেরোনো সম্ভব হয়নি। কারোরই নয়। ট্রেনে জায়গাই পাওয়া যায় না। তবুও আসতে হয়েছে অরুর। কারণ দীপকে ও কথা দিয়েছিল যে, পরীক্ষায় ফার্স্ট হতে পারলে তোমাকে পুরীতে নিয়ে যাব। সোনালি আসতে পারেনি, ওর সেজদির বড়ো মেয়ের বিয়ে পড়ে গেছে। অতএব একাই আসতে হয়েছে অরুর সঙ্গে ছেলেকে নিয়ে।

    ছেলের সঙ্গে এর আগে অরু কখনো বেরোয়নি একা একা। বেরিয়ে বেশ ভালো লাগছে। ওর দশ বছরের ছেলের মধ্যে ও রীতিমতো একজন প্রাপ্তবয়স্ক ও বিজ্ঞ লোকের ছবি দেখতে পাচ্ছে। ওর সাধারণ জ্ঞান, ওর সমস্ত বিষয়ে ঔৎসুক্য অরুকে রীতিমতো চমকৃত করেছে। সোনালি আসতে পারেনি বলে ওর এখন একটুও খারাপ লাগছে না।

    হোটেলটি বেশ ভালো। খাওয়ার হলের পাশেই একটি ঘর পেয়েছে অরু। কলকাতা থেকে চিঠি লিখে, টাকা পাঠিয়ে এসেছিল। ঘরটিও ভালো। ডাবলবেড খাট, পুরোনো দিনের অদ্ভুত আকৃতির পাখা একটি, ঘরের কোণায় লেখার টেবিল, ড্রেসিং টেবিল, লাগোয়া পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন বাথরুম। সবচেয়ে যা ভালো লেগেছে অরুর, তা সমুদ্রমুখী এক ফালি ছোট্ট বারান্দা। সারা দিন রাত তাতে বসেই বই পড়ে, চা খেয়ে, আলসেমি করে কাটিয়ে দেবে ঠিক করল ও।

    অনলাইনে বেস্টসেলিং বই কিনুন

     

     

    দীপ বলল, বাবা, তুমি আমার সঙ্গে সমুদ্রে চান করবে না?

    অরু বলল, না বাবা।

    কেন? চলো না। চান করব দুজনে।

    অরু বলল, আমি তোমার সঙ্গে যাব, তুমি নুলিয়ার সঙ্গে চান কোরো, আমি বসে থাকব। অরু মনে মনে বলল, ও টিপিক্যাল বাঙালি–এসব দৌড়ঝাঁপ, সুখী শরীরকে অকারণ এত কষ্ট দেওয়ার পক্ষপাতী নয় ও। তা ছাড়া পায়জামা বা আন্ডারওয়্যার পরিহিত অনেক বঙ্গ-পুরুষকে ও নিতান্ত নিষ্প্রয়োজনে বড়ো বড়ো ঢেউয়ের থাবড়া খেয়ে বালির মধ্যে পড়ে কালো কুমড়োর মতো অথবা ফ্যাকাশে চিচিঙ্গের মতো গড়াগড়ি যেতে দেখেছে। তা ছাড়া ওই নুলিয়াদের হাতে হাত রেখে এক হাঁটু জলে দাঁড়িয়ে এই কুমির তোর জলে নেমেছি খেলার দিন তার চলে গেছে বলেই অরু বিশ্বাস করে। এই অহেতুক ও উপায়হীন পরহস্তনির্ভরতা তার মোটেই বরদাস্ত হয় না।

    এক সময় ব্রেকফাস্ট খাওয়ার পর দীপের সঙ্গে সমুদ্রের ধারে তাকে যেতেই হল। দীপ একটা কালো সুইমিং-ট্রাঙ্ক পরেছে। সোনালি কিনে দিয়েছে ওকে। ওর সুগঠিত ছোট্ট শিশু শরীরে সুন্দর মানিয়েছে পোশাকটা। দেখলেও ভালো লাগে। নিজেদের জীবনে যা পাওয়া হয়নি, ছেলে মেয়েদের তা দিতে পেরে, সেই সব ছোট্ট ছোট্ট আপাতমূল্যহীন অথচ দারুণ দামি পাওয়া রথের মেলায় পাঁপর ভাজার মতো, বিশ্বকর্মা পুজোর দিনে একখানা ময়ূরকণ্ঠী ঘুড়ির মতো, গরমের। ছুটিতে পুরী বেড়ানোর মতো-এসব টুকরো টুকরো সুখ তার একমাত্র ছেলেকে দিতে পেরে অরু খুশি। দীপের আজ সকালের অনাবিল আনন্দের হাসিমুখের সুখ অরু তার জীবনের অনেক বড়ো বড়ো সুখের সঙ্গে সহজে বিনিময় করতে পারে।

     

     

    ওরা প্রায় সমুদ্রের কাছে পৌঁছে গেছে। দূর থেকে মাদুরে-ছাওয়া ঘরগুলো দেখা যাচ্ছে। কারা যেন হলুদ আর লাল ডোরা টানা টেরিলিনের তাঁবু খাঁটিয়েছে বালিতে। হু-হু করে বালি উড়ছে, জলের কণা উড়ছে, ভেজা তটভূমিতে দাঁড়িয়েথাকা স্নানরতা মেয়েদের ভিজে চুল উড়ছে। চিৎকার-চেঁচামেচি, উলটে-পড়া ভেসে যাওয়া সব মিলে সমদ্রের ধারে একটা মেলা-মেলা

    আবহাওয়ার সৃষ্টি হয়েছে।

    আনন্দ ও খুশি বড়ো ছোঁয়াচে। অরু ভাবল। এই মুহূর্তে ওরও ইচ্ছে করছেদীপের সঙ্গে হাত ধরে ও-ও নেমে পড়ে জলে, আছাড় খায়, উলটে যায়, নিজের অপদস্থ অবস্থায় নিজেই হো-হো করে হেসে ওঠে। নিজেকে স্বেচ্ছায় অপদস্থ করে নিজে যা অনাবিল আনন্দ পাওয়া যায় তার তুলনা নেই।

    হঠাৎ দীপ বলল, বাবা, রাজীব।

    অরু শুধাল, রাজীব কে?

    বাঃ, আমাদের সঙ্গে পড়ে যে! আমার ক্লাসে। খুব ভালো সাঁতার কাটে।

     

     

    অরু ওইদিকে তাকাল। দেখল, সেই লাল-হলুদ ডোরা কাটা তাঁবুর সামনে একজন দারুণ। ফিগারের দীর্ঘাঙ্গী শ্যামলা রঙের ভদ্রমহিলা হালকা গোলাপি সাঁতার কাটার পোশাকে দাঁড়িয়ে আছেন দীপের সমবয়সি একটি ছেলের হাত ধরে। তাঁবুর পাশেই অ্যালুমিনিয়ামের ফোল্ডিং চেয়ারে বসে একজন অত্যন্ত স্কুল ভদ্রলোক পা-ছড়িয়ে বীয়ার খাচ্ছেন।

    অরুর বুকের মধ্যে সী-গালের আর্ত স্বরের মতো কি এক ব্যথাতুর স্বর হঠাৎ বেজে উঠল।

    রাজীব দীপকে দেখে দৌড়ে এল। তারপর ওর হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল। অরু বুঝতে পারল যে ভদ্রমহিলা ও ভদ্রলোক রাজীবের মা ও বাবা।

    সমুদ্রের গর্জনে কথাগুলো শোনা যাচ্ছিল না। কথাগুলো হাওয়ায় উড়ন্ত জলবিন্দুর সঙ্গে উড়ে যাচ্ছিল। তবু অরু অনুমানে বুঝতে পারল, ভদ্রমহিলা বলছেন, ও তুমিই দীপ, ফার্স্ট বয়? তারপর বললেন, কার সঙ্গে এসেছ? বাবা? মা আসেননি? ও…!

    তারপর রাজীব দীপকে নিয়ে তার বাবার কাছে গেল। রাজীবের বাঙালি বাবা বাংলা বলেন না। ইংরেজীতে দীপকে বললেন, আই সি! য়ু আর দা ফার্স্ট বয়, আই হ্যাভ বিন হিয়ারিং অ্যাবাউট।

     

     

    যদিও রাজীবের বাবা-মা প্রায় সাহেব-মেম, তবুও কথাগুলো শুনে অরুর ভালো লাগল। ছেলে ভালো হলে বাবার যে কতখানি ভালো লাগতে পারে সেকথা জীবনে এই প্রথমবার জানল অরু। পরমুহূর্তেই আবার খুব অপদস্থ লাগল নিজেকে। কারণ সেই মুহূর্ত থেকে সে শুধুদীপের বাবা। হয়েই রইল। তার নিজের আর কোনো পরিচয়ই রইল না। দীপ তার বন্ধুর বাবা-মার সঙ্গে ওর পরিচয় করিয়ে দিল না, তাই অরু বোকার মতো কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকল।

    ও ভাবল ওঁরা নিজেরা আলাপ করলে করবেন। ওর কী গরজ? দীপও আলাপ করিয়ে দিল না, ওঁরাও আলাপ করলেন না নিজে থেকে। অনেকক্ষণ সময় কেটে গেল। এখন সেই প্রথম অস্বস্তিটা চলে গেছে।

    অরুণাভ রায় কলকাতার বিখ্যাত অধ্যাপক, বালির মধ্যে পা ছড়িয়ে বসে শুধুমাত্র দশ বছরের দীপের বাবায় পর্যবসিত হয়ে বাট্রান্ড রাসেলের জীবনী পড়তে লাগল। তার চোখের সামনে, কানের সামনে একটা দারুণ শব্দ-বর্ণ-গন্ধর সমারোহ বয়ে যেতে থাকল, দুলতে থাকল, ভাসতে লাগল, উৎসারিত হতে লাগল, কিন্তু ও চোখ তুলে তা দেখল না।

    কারণ ও ভয় পেয়েছিল।

     

     

    তখন থেকেই বুকের মধ্যে সী-গালের আর্তস্বরের মতো এক করুণ স্বর শুনতে পাচ্ছিল ও। রাজীবের মাকে প্রথম দেখা দেখেই ওর ভালো লেগেছিল। তাই ও ভয় পেয়েছিল। অরুর বুকে। সেই মুহূর্তে যে স্বর বাজছিল তা সমস্ত বিবাহিত নারী ও পুরুষের বুকেই বাজে, বিশেষ করে–যখন তাঁরা একা থাকেন। খাঁচার মধ্যে বন্ধ পাখি যেমন দূরের বনের দিগন্তে উড়ে যাওয়া পাখিকে দেখে দুঃখে মরে তেমনই এক দুঃখে, অস্বস্তিতে অরুর বুক ভরে গেল।

    কিছুক্ষণ পর নুলিয়ার হাত ধরে দীপ ফিরে এল। অরু উঠে দাঁড়াল।

    দীপ খুশির গলায় বলল, এই বাবা! তুমি রাগ করেছ বেশিক্ষণ চান করলাম বলে?

    অরু অন্যমনস্কভাবে বলল, না। তারপর উঠে পড়ে বলল, চলো ফিরি।

    দু-দিন এমনিই কাটল। অরু চান করেনি একদিনও। দীপ করেছে রোজ দু-বেলা। হোটেলের লাউঞ্জে, সামনের লনে, খাবার ঘরে, বারবার অরুর দেখা হয়ে গেছে রাজীবের মায়ের সঙ্গে। মুখোমুখি হয়েছে, চোখাচোখি হয়েছে, কিন্তু কথা হয়নি কখনো।

     

     

    দীপ আলাপ করিয়ে দেয়নি।

    সেদিন দুপুরবেলা লাঞ্চের সময় ম্যাকারেল মাছের ফ্রাই খেতে গিয়ে দীপের গলায় কাঁটা লাগল। অরু ওকে বারবার বলেছিল হাত দিয়ে খেতে, পরে ফিঙ্গার বোলে হাত ধুয়ে নিলেই চলত। কিন্তু ওদের টেবিলের অনতিদূরে মা-বাবার সঙ্গে খেতে-বসারাজীব যেহেতু সবসময় কাঁটা-চামচ দিয়ে খাচ্ছে, অল্পবয়সি দীপও তাই সাহেব হবার লোভ সামলাতে পারেনি।

    কাঁটাটা বেশ ভালোই বিধেছিল। স্টুয়ার্ড দৌড়ে এলেন। বেয়ারারা দাঁড়িয়ে রইল। শুকনো ভাত, কলা, পাঁউরুটি ইত্যাদি নানা কিছু খাইয়ে দীপের গলা থেকে কাঁটা নামানোর চেষ্টা

    করা হতে লাগল, কিন্তু কাঁটা গেল না। অরু বোকার মতো বসে থাকল দর্শকের মতো। সময়। সময় মেয়েদের প্রয়োজন বড়ো বেশি অনুভূত হয়। বাবারা কত অসহায়, এমন এমন সময় তা বোঝা যায়।

    অরু একদৃষ্টে নিরুপায়ভাবেদীপের যন্ত্রণাকাতর মুখের দিকে চেয়েছিল। কী করবে বুঝে উঠতে পারছিল না। শুকনো ভাত রুটি কলা খেয়ে খেয়ে বেচারার পেট ফুলে উঠল, কিন্তু কাঁটা নামল না।

     

     

    এমন সময় ওঁদের টেবিল ছেড়ে রাজীবের মা উঠে এলেন এ টেবিলের কাছে।

    এসে লাজুক হাসি হাসলেন অরুণাভর দিকে চেয়ে। অরুও লাজুক হাসি হাসল। বলল, কী ঝামেলা দেখুন তো!

    ভদ্রমহিলা বললেন, ঠিক হয়ে যাবে। পরক্ষণেই মুখ ঘুরিয়ে বললেন, ছেলের মা সঙ্গে না থাকলে কত অসুবিধা দেখছেন তো! আপনারা তো এমনিতে বুঝতে পারেন না! তারপর অরুর কাছ। থেকে উত্তরের অপেক্ষা না করেই উনি দীপকে উঠিয়ে নিয়ে চলে গেলেন। অরুর ঘর খাওয়ার ঘরের লাগোয়া, সে ঘরেই দীপকে নিয়ে ঢুকলেন উনি।

    অরু কী করবে বুঝতে পারছিল না। রাজীব আর তার সবসময় ইংরেজি বলা বাবা বসে বসে। আইসক্রিম খাচ্ছিলেন। এ সময় অরুর যাওয়া ভালো দেখাবে না। বিশেষ করে ভদ্রমহিলা যখন দায়িত্ব নিয়েইছেন। অরু চুপচাপ বসে আইসক্রিম খেল।

    রাজীব আর তার বাবা উঠে চলে যাওয়ার পর অরু উঠল, উঠে আস্তে আস্তে ওর ঘরের দরজায় দাঁড়াল।

    ভিতর থেকে রাজীবের মা বললেন, আসুন, বাইরে দাঁড়িয়ে রইলেন কেন?

     

     

    অরু ভিতরে ঢুকে বলল, কেমন আছে দীপ?

    উনি হাসলেন। বললেন, কাঁটা বেরিয়েছে, কিন্তু ন্যাচারালি, জায়গাটা খুবই টেন্ডার আছে। ঘুমিয়ে পড়েছে ও।

    তারপর একটু থেমে বললেন, আপনি কী করবেন? ঘুমোবেন?

    অরুর কলকাতায় ঘুমোবার অভ্যেস না থাকলেও ভালো-মন্দ খাওয়ার পর এখানে রোজই ঘুমোয়।

    বলল, নাঃ! দুপুরে ঘুমিয়ে কী হবে?

    উনি বললেন, তবে চলুন, লাউঞ্জে বসে গল্প করি। রাজীব আর রাজীবের বাবা নাক ডাকার কমপিটিশন লাগিয়েছে এতক্ষণ। আমি দুপুরে ঘুমোত পারি না? দীপের মা ঘুমোন?

    দুপুরে? অরু বলল, না। ও তো চাকরি করে একটা। ঘুমোবে কী করে?

    তাই বুঝি? বললেন রাজীবের মা?

     

     

    তারপর বললেন, ছেলের জন্যে আপনার খুব গর্বদীপ তো ওদের স্কুলে রীতিমতো লেজেন্ড।

    সকলে ওকে এক নামে চেনে। বাবার মতো বুদ্ধি পেয়েছে বুঝি?

    অরু লজ্জিত হল। বলল, না না। আমি কখনো পড়াশোনায় ভালো ছিলাম না।

    তবে কি মা ব্রিলিয়ান্ট?

    অরু বলল, না। তেমন তো শুনিনি। তবে বুদ্ধিমতী।

    এমন সময় অরু ও রাজীবের মার সামনে দিয়ে একটি জার্মান দম্পতি জড়াজড়ি করে খাওয়ার হলে গিয়ে ঢুকল। বালিতে ওদের গা-হাত-পা ছড়ে গেছে। নাক গাল লাল হয়ে গেছে রোদে পুড়ে। ওদের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় রাজীবের মাকে ওরা হাত তুলে উইশ করল। রাজীবের মা-ও হাত তুললেন।

    ওরা চলে গেলে রাজীবের মা ওদের দিকে চেয়ে হাসলেন।

     

     

    বললেন, বেশ আছে ওরা।

    অরু বলল, ভারি লাইভলি কাপল। হানিমুনে এসেছে বোধহয়।

    রাজীবের মা বললেন, ওদের বিয়েই হয়নি। একজন অস্ট্রিয়া থেকে আর অন্যজন স্টেটস থেকে এসেছে। দমদম এয়ারপোর্টে দু-জনের সঙ্গে দু-জনের আলাপ। দু-জনেই কোনারক দেখতে যাচ্ছে বলে ওরা ঠিক করল কোনারক দেখে এসে মন্দিরের ভাস্কর্যগুলো যাতে ভুলে না যায় তার জন্যে দু-জনে দিনকয় একঘরে থাকবে। অতএব থাকল।

    অরু রীতিমতো আত্মবিস্মৃত হয়ে বলল, বাঃ বেশ মজা তো! বলেই, লজ্জা পেল।

    রাজীবের মা ওর দিকে একদৃষ্টে চেয়েছিলেন। ভদ্রমহিলার শরীর, ফিগার, চোখদুটি সবই দারুণ। একবার চাইলে চোখ ফেরানো যায় না। আজ দুপুরে মহিলা একটি ম্যাক্সি পরে আছেন। স্লিভলেস। সারা গা ছাপিয়ে একটা মিষ্টি গন্ধ উঠছে। হয়তো বিদেশি সাবানের, হয়তো বিদেশি পারফুমের। জানে না অরু।

    ওঁর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই আবার সেই ভয়টা ওর বুকের ভিতরে হামাগুড়ি দিয়ে ফিরে এল। এতক্ষণ সে বুঝি রোদে গা শুকোচ্ছিল।

     

     

    তাড়াতাড়ি মুখ ঘুরিয়ে অরু সমুদ্রের দিকে তাকাল। সমুদ্রই ভালো। সমুদ্রর কোনো চাওয়া নেই। কারো সঙ্গে মিলিত হবার কোনো কামনা নেই–কোনো নদ বা নদীর মতো তাকে কোনো সঙ্গমের প্রতীক্ষায় বইতে হয় না। সে নিজেতেই নিজে সম্পূর্ণ। তার পরিপূরকের প্রয়োজন নেই কোনো। হঠাৎ রাজীবের মা বললেন, আপনাদের কতদিন বিয়ে হয়েছে?

    অরু যেন ঘুম ভেঙে বলল, বারো বছর, এক যুগ। তারপর বলল, আপনাদের?

    চোদ্দো বছর। এক যুগ দু-বছর। তারপর একটু থেমে বললেন, জীবনটা বড়ো একঘেয়ে লাগে তাইনা? দীপের মা-ও নিশ্চয়ই একথা বলেন?

    অরু বলল, না। ও আশ্চর্য মেয়ে। ওর অদ্ভুত মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা আছে। ও কখনো একঘেয়েমির অভিযোগ করে না। অদ্ভুত স্বভাব ওর।

    রাজীবের মা বললেন, তাহলে বাহাদুরিটা বলতে হবে আপনার। আপনিই একঘেয়েমির হাত থেকে তাঁকে বাঁচিয়েছেন হয়তো।

    অরু অপরাধীর গলায় বলল, না না। তানা।

    তারপর একটু চুপ করে থেকে বলল, আমার কিন্তু একঘেয়ে লাগে। কী মনে হয় জানেন, মনে হয় খাঁচার মধ্যে আছি। রোজ সকালে জীবনের ভাঁড়ার খুলে দু-জনে দুজনকে মেপে মেপে রসদ বের করে দিই–একদিনের মতো। পরদিন আবার সমান মাপে বের করি। বেশিও নয় কম নয়। কোনোদিনই ঘাটতি পড়ে না কিছুই, উপচেও পড়ে না। একেবারে টায় টায় সাবধানীর সংসার করি আমরা। এ জীবনে কোনো হঠাৎ পাওয়া নেই। কোনো আবিষ্কার নেই, অপ্রত্যাশিত সম্ভাবনা নেই। এখানে দু-জনে দু-জনের প্রতি কর্তব্য করি-হাসিমুখে। ভাঁড়ার থেকে যা পাচ্ছি, যা প্রতিদিন পাই, তার চেয়ে বেশি কিছু পাওনা ছিল বলে কখনো মনেও হয় না। আসলে এই। ভরন্ত রুদ্ধ ভাঁড়ারের মধ্যে বাস করে নেংটি ইঁদুরের মতো আমরা একদিন নিজের অজান্তেই শুকিয়ে মরে যাব। নাকের সামনে তালা ঝুলবে ভাঁড়ারের, মস্তিষ্কের মধ্যে ফসলের গন্ধ, বেহিসাবের খুশি, খোলা জানালার রোদ, মুক্তির নীল আকাশ–এইই সব স্বপ্ন। কিন্তু এমনিভাবেই শেষ হয়ে যাবে একদিন–বাঘবন্দির ঘরে।

    এতখানি একসঙ্গে বলে ফেলে অরু লজ্জিত হল।

    বলল, দেখলেন তো, ছেলে পড়িয়ে পড়িয়ে কেমন বক্তৃতাবাজি শিখেছি। আপনি শুনছেন কি না তা না জেনেই একতরফা বলে গেলাম।

    রাজীবের মা বললেন, শুনেছি। আমি সমুদ্রের দিকে চেয়ে শুনছিলাম। সমুদ্র আপনার ভালো লাগে?

    অরু এতক্ষণে ওর স্বাভাবিকতায় ফিরে এসেছে। অপরিচিত সঙ্কোচের খোলস ছেড়ে ও বাইরে এসেছে।

    ও বলল, লাগে না।

    কেন? বলে চোখ তুলে চাইলেন ভদ্রমহিলা।

    কারণ সমুদ্রের মধ্যে কোনো দ্বিধা নেই। সমুদ্র বড়ো আদিম, বড়ো উলঙ্গ–সমুদ্র কিছু লুকোতে জানে না–তা ছাড়া সমুদ্র বড়ো একঘেয়েও। কোনো আদিম পুরুষের একাকীত্বের একটানা। গোঙানির মতো মনে হয় সমুদ্রের আওয়াজ। আমার অস্বস্তি লাগে।

    উনি বললেন, আমারও ভালো লাগে না। তবে সম্পূর্ণ অন্য কারণে। কারণটা হল, সমুদ্র বড়ো বড়ো। সমুদ্রের মতো কাউকে নিয়ে, এত বিরাট ও প্রবল কাউকে নিয়ে ঘর বাঁধা যায় না, এমনকী ওই বিদেশি ছেলে-মেয়েদের মতো ক্ষণিকের ঘরও বাঁধা যায় না। আমার মনে হয় কোনো। মেয়েরই ভালো লাগে না সমুদ্রকে, মনে মনে।

    এমন সময় ওই বিদেশি ছেলে-মেয়ে দুটি খাওয়া শেষ করে গলা জড়িয়ে ওদের সামনে দিয়ে নিজেদের এয়ার কন্ডিশন্ড ঘরের দিকে চলে গেল।

    রাজীবের মা হঠাৎ বললেন, উঠি, কেমন? আপনি রেস্ট করুন। আমিও যাই স্বামী-পুত্রের দেখাশোনা করি গিয়ে একটু। অরু উঠে দাঁড়িয়েছিল। তারপর রাজীবের মা চলে যাওয়ার পর অনেকক্ষণ বসে থাকল বারান্দার ইজিচেয়ারে।

    কতক্ষণ বসেছিল ও জানে না। যখন ঘুম ভাঙল, দেখল বেলা পড়ে গেছে। দীপ ইজিচেয়ারের হাতলের উপর বসে ওর গা ঘেঁষে। সমুদ্রের উপর একঝাঁক সী-গাল ওড়াউড়ি করছে। পাখিগুলোর ঘর আছে। সমুদ্রের ঘর নেই। পাখিগুলো অন্ধকার হলেই সঙ্গিনীর বুকের উত্তাপে ফিরে যাবে ওদের ঘরে। সমুদ্র যেখানে ছিল, সেখানেই থাকবে। সমুদ্রের যাওয়ার মতো কোনো গন্তব্য নেই, অন্য কোনো শরীর নেই।

    দীপ বলল, বাবা, হাঁটতে যাব, চলো।

    অরু বলল, চলো।

    পুরী-হাওড়া এক্সপ্রেসটা, পুরী স্টেশনে দাঁড়িয়েছিল।

    আজ রাজীবরা ফিরে যাচ্ছে।

    দীপ বলেছিল, বাবা চল না, রাজীবদের সঙ্গে দেখা করে আসি একবার। ট্রেন কি ছেড়ে গেছে?

    অরু খুশি হল, দীপ একথা বলল শুনে, তারপর ছেলের হাত ধরে তাড়াতাড়ি একটা রিকশা নিয়ে স্টেশনে পৌঁছে প্রায় দৌড়োতে দৌড়োতে এ-সি কোচের দিকে এগিয়ে গিয়ে সবুজ জানলার পাশে গিয়ে দাঁড়াল। ট্রেনটা এখুনি ছেড়ে দেবে।

    জানলায় রাজীবের সঙ্গে রাজীবের মা-ও গাল লাগিয়ে বসেছিলেন। রাজীবের সঙ্গে উনিও হাত নাড়ছিলেন। আজ ভদ্রমহিলা একটা হলুদ আর কালো মেশানো সিল্ক শাড়ি পরেছেন। সবুজ কাচের আড়ালে কেমন রহস্যময়ী মনে হচ্ছিল ওঁকে। ভিতরের কোনো কথাই বাইরে থেকে। শোনা যাচ্ছিল না। চোখ-মুখের অভিব্যক্তি দেখা যাচ্ছিল শুধু।

    দীপ আর দীপের বাবা, রাজীব আর রাজীবের মায়ের দিকে চেয়েছিল। জানলার কাচটা ঠান্ডা–কীরকম যেন একটা গন্ধ বাতানুকূল গাড়িতে।

    বেলা পড়ে গেছিল। জানলার কাচের মধ্যে হঠাৎ অরু কেমন ভাঁড়ার ভাঁড়ার গন্ধ পেল। অরু তাড়াতাড়ি মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকালো। বাইরের নীল আকাশে তখনও রোদ ছিল, সমুদ্র থেকে জোর হাওয়া আসছিল নোনা গন্ধ বয়ে। এখানে সাদা নরম সী-গাল নেই। সেই হঠাৎ শোনা বুকের মধ্যের স্বরটা হারিয়ে গেছে বরাবরের মতো। একটা কালো দাঁড়কাক ডাকছিল কর্কশ গলায় লাইনের পাশে বসে।

    দীপ বলল, বাবা, ওরা কখন কলকাতা পৌঁছোবে?

    অরুর নাকে আবার ভাঁড়ারের গন্ধটা ফিরে এল।

    অরু বলল, অন্ধকারেই।

    তারপরই নিজেকে শুধরে বলল, অন্ধকার থাকতে থাকতেই।

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42 43 44 45 46 47 48 49 50 51 52 53 54 55 56 57 58 59 60 61 62 63
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleচম্পাঝরন – বুদ্ধদেব গুহ
    Next Article মহাভারত – বিষ্ণুপদ চক্রবর্তী

    Related Articles

    বুদ্ধদেব গুহ

    বাবলি – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    বুদ্ধদেব গুহ

    ঋজুদা সমগ্ৰ ১ – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    বুদ্ধদেব গুহ

    ঋজুদা সমগ্র ২ – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    বুদ্ধদেব গুহ

    ঋজুদা সমগ্র ৩ – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    বুদ্ধদেব গুহ

    ঋজুদা সমগ্র ৪ – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    বুদ্ধদেব গুহ

    অবেলায় – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }