Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    ছোটো গল্প – কাজী নজরুল ইসলাম

    কাজী নজরুল ইসলাম এক পাতা গল্প17 Mins Read0
    ⤷

    সাপুড়ে – কাহিনি

    সভ্যজগতের সুসমৃদ্ধ জনপদ হইতে বহুদূরে, কখনও ঘননীল শৈলমালার সানুদেশে, ভীষণ নির্জন, দুর্গম অরণ্যের মধ্যে, কখনও বা তরঙ্গ-ফেনিল বঙ্কিম গিরি-নদীর তীরে, দিগন্ত বিস্তীর্ণ প্রান্তরে, যাযাবর সাপুড়ের দল তাহাদের ক্ষণস্থায়ী নীড় রচনা করে।

    এমনই এক ভবঘুরে সাপুড়েদলের ওস্তাদ সে। নাম তাহার জহর। দলের সে বিধাতা, একচ্ছত্র অধিপতি। দলের প্রত্যেকটি লোক তাহাকে ভয় করে যমের মতো, ভক্তি করে দেবতার মতো। শুধু দলের একটি মাত্র লোক, তাহার এই অপ্রতিহত প্রভুত্বগৌরবে ঈর্ষার জ্বলিয়া পুড়িয়া মরে, মনে-মনে দারুণ অবজ্ঞা করে জহরকে, কিন্তু প্রকাশ্যে তাহার বিরুদ্ধাচরণ করিবার সাহসও তাহার হয় না। এই লোকটির নাম বিশুন, তাহারও দুই একজন অনুচর আছে।

    মনে-মনে সে মৃত্যু কামনা করে জহরের, কখনও-বা কেমন করিয়া জহরকে চূর্ণ করিয়া একদিন সে সর্দার হইয়া উঠিবে, সেই কল্পনায় চঞ্চল হইয়া উঠে।

    সেদিন নাগ-পঞ্চমী।

    জহর পাহাড়তলিতে গিয়াছিল বিষধর সর্পের সন্ধানে। তাহার তুবড়ি বাঁশিতে, সে বাজাইতেছিল একটানা মোহনিয়া সুর – বাঁশির রন্ধ্রে রন্ধ্রে, গমকে গমকে, তীব্র মধুর উন্মাদনা কাঁপিয়া কাঁপিয়া উঠিতেছিল! সেই সুরে আকৃষ্ট হইয়া বনের ভিতর হইতে, একটি বিষধর কালীয়নাগ ফণা দুলাইতে দুলাইতে বাহির হইয়া আসিল। দারুণ উত্তেজনায়, জহরের চোখের তারা দুইটি জ্বলিয়া উঠিল। হঠাৎ হাতের বাঁশিটা সে দূরে ছুঁড়িয়া ফেলিয়া দিল এবং সেই কালীয়নাগের উদ্ধত ফনার সুমুখে তাহার অকম্পিত করতল পাতিয়া ধরিল। মুহূর্তে একটি তীব্র দংশন। দেখিতে দেখিতে জহরের সর্বশরীর সেই সাপের বিষে একেবারে নীল হইয়া গেল। দলের সমস্ত লোক সভয়ে, স্তম্ভিত বিস্ময়ে জহরকে ঘিরিয়া দাঁড়াইল। জহর কিন্তু নিষ্কম্প, নির্বিকার – উদ্বেগের চিহ্নমাত্রও তাহার মুখে ফুটিয়া উঠে নাই। ধীরগম্ভীরকণ্ঠে, সে মন্ত্র উচ্চারণ করিতে লাগিল এবং ধীরে ধীরে শীঘ্রই বিজয়ী বীরের মতো সগৌরবে বিষমুক্ত হইয়া উঠিল। বিমুগ্ধ, বিস্মিত জনতা সমস্বরে জয়ধ্বনি করিয়া উঠিল। মুখ কালো করিয়া, বিশুন ধীরে ধীরে নীরবে সেখান হইতে সরিয়া গেল।

    ঠিক এমনই করিয়া আজ পর্যন্ত, জহর নিরানব্বইবার নিজের দেহে সর্পদংশন করাইয়া, অবলীলাক্রমে বিষমুক্ত হইয়াছে। এইবার শততম এবং শেষতম সর্পদংশন। এই সর্বশেষ সর্পের বিষ, মন্ত্রবলে আপন দেহ হইতে টানিয়া বাহির করিতে পারিলেই, তাহার কঠোর ব্রত উদ্‌যাপিত হইবে; সে সর্পমন্ত্রে সিদ্ধকাম-হইবে। এই মন্ত্রে সিদ্ধ হওয়াই জহরের জীবনের পরমতম লক্ষ্য, একমাত্র মহাব্রত।

    এই সাধনার জন্য সে কঠোর ব্রহ্মচর্য অবলম্বন করিয়াছে । আজীবন চিরকুমার থাকিয়া নিষ্কামভাবে সংযতচিত্তে ব্রত পালন করিয়া চলিতেছে।

    জহরের অগণিত গুণমুদ্ধ শিষ্য, যখন উদ্‌গ্রীব হইয়া সেই শুভদিনের প্রতীক্ষা করিতেছে, তাতে তাহার জীবনে একটি অভাবনীয় ঘটনার সূত্রপাত হইল। পরিণামে এই ব্যাপারটি যে তাহার সাধনার ভিত্তিমূলকে প্রবল ভাবে নাড়া দিয়া যাইবে, তাহা কি সে স্বপ্নেও ভাবিতে পারিয়াছিল?

    ভবঘুরের মতো জহর তখন নানা দেশ-বিদেশ ঘুরিয়া বেড়াইতেছে। নারীজাতির সংস্পর্শ হইতে দূরে থাকিয়া ক্রমশ জহরের মনে এই ধারণা বদ্ধমূল হইয়া গিয়াছে যে, নারীজাতি সাধনার পথে সাংঘাতিক বিঘ্ন সৃষ্টি করিয়া থাকে। ক্রমে নারীজাতির সম্বন্ধে অন্তরে সে বিজাতীয় বিতৃষ্ণা পোষণ করিতে শুরু করিয়াছে।

    এমন সময় হঠাৎ একদিন সে দেখিল, ক্ষীণস্রোতা একটি নদীর জলে কলার ভেলার উপরে, পরমাসুন্দরী এক বালিকার মৃতদেহ ভাসিয়া চলিয়াছে। সর্পদংশনে যাহাদের মৃত্যু হয়, তাহাদের নাকি দাহ করিতে নাই। স্রোতের জলে মৃতদেহ ভাসাইয়া দেওয়াই নাকি বহুকালের প্রচলিত প্রথা। জহর কি আর করে, সাপুড়ে জাতির স্বধর্ম রক্ষা করিতে গিয়া, সে নদীর জল হইতে মৃতা বালিকার দেহ তুলিয়া লইয়া, মন্ত্রবলে তাহাকে পুনর্জীবিতা করিল।

    জীবন দান করিল বটে,কিন্তু এই বালিকাটিকে লইয়া সে কি করিবে? কে যে তাহার আত্মীয়, কে তাহার স্বজন-কিছুই সে বলিতে পারে না। বিষের প্রকোপে তাহার স্মৃতিশক্তি বিলুপ্ত হইয়া গিয়াছে।

    জহর বড়ো বিপদে পড়িল। বেচারি নিরীহ, নিরাশ্রয়া মেয়েটি, নিরুপায়ের মতো করুণ কাতর দৃষ্টি মেলিয়া জহরের দিকে তাকাইয়া থাকে। জহর তাহাকে ফেলিয়া যাইতে পারে না, কেমন যেন দয়া হয় মেয়েটির উপর। দারুণ ঘৃণা ধীরে ধীরে মধুর মমতায় রূপান্তরিত হইয়া আসে। সে-ই শেষে আশ্রয় দিয়া ফেলিল এই মেয়েটিকে – অদৃষ্টের নিষ্ঠুর পরিহাস ছাড়া আর কি হইতে পারে। জহর তাহার সংস্কারবশে, বালিকার নারীবেশ একেবারেই সহ্য করিতে পারিল না। সে স্থির করিল, ইহাকে সে পুরুষের বেশে সাজাইয়া পুরুষের মতো মানুষ করিবে। সে তাহাকে একরকম উগ্র ঔষধ পান করাইল, যাহাতে এই ঔষধের গুণে, তাহার মধ্যে নারী-সুলভ কোনো চেতনা জাগ্রত না হয়।

    জহর তাহার নাম রাখিল চন্দন – পুরুষের নাম। কিশোরবেশী চন্দনকে সঙ্গে লইয়া জহর এইবার অন্য এক সাপুড়ের দলে যোগদান করিল। সেই দলের বৃদ্ধ সর্দার, জহরের আশ্চর্য চরিত্রবল দেখিয়া এত বেশি মুগ্ধ হইল যে তাহার মৃত্যুর পূর্বে জহরকে সে সেই দলের সর্দার করিয়া দিয়া গেল। ক্রমে জহর এই অর্ধসভ্য ভবঘুরে সাপুড়ের দলের একচ্ছত্র অধিপতি হইয়া উঠিল।

    চন্দন যে বালক নয়, দলের কেহই সে কথা জানে না। জহরের এক প্রিয়তম শিষ্য ঝুমরো, তাহার একমাত্র প্রিয় সহচর। চন্দনকে ঝুমরো বড় ভালোবাসে।

    এই ব্রহ্মচর্য-ব্রতধারী জহর, নিরানব্বইটি বিষধর সর্পদংশনের কঠোর পরীক্ষায় সগৌরবে উত্তীর্ণ হইয়া যখন তাহার প্রান্তসীমায় আসিয়া উপনীত হইয়াছে, তখন সহসা এক সচকিত মুহূর্তে শিহরিয়া উঠিয়া সে অনুভব করিল যে,তাহার সংযম-সাধনার উত্তুঙ্গ শিখর হইতে বোধ করি তাহার পদস্খলন হইতে বসিয়াছে।

    সেদিন রাত্রে শয়ন করিতে যাইবার পূর্বে অকস্মাৎ এক তীব্র মধুর বেদনার মতো চন্দনের রমণীয় সুকুমার রূপ-মাধুরী, তাহার বুকের মধ্যে আসিয়া বিঁধিল এবং ক্ষণিকের জন্য তাহাকে উন্মাদ অস্থির করিয়া তুলিল। প্রাণপণ চিত্তসংযমের দ্বারা কিছুক্ষণের মধ্যেই সে তাহার এই সাময়িক মোহকে অতিক্রম করিল। উন্মাদের মতো ছুটিয়া গিয়া সে তাহাদের অধিষ্ঠাত্রী দেবী মা মনসার পদপ্রান্তে বসিয়া সমস্ত রাত্রি ধরিয়া বিনিদ্র চক্ষে এই অপরিসীম আত্মগ্লানির জন্য অনুতাপে অশ্রুমোচন করিতে লাগিল। দেবী প্রতিমার কাছে ক্ষতবিক্ষত অন্তরের সকরুণ প্রার্থনা জানাইয়া, সে প্রায়শ্চিত্ত করিল।

    কিন্তু যে সুপ্ত কামনার আগুন একবার জ্বলিয়াছে, এত সহজে কিছুতেই সে যেন নির্বাপিত হইতে চাহিল না। ঠিক সেইদিনই খবর পাওয়া গেল, রাজার সিপাহিরা সাপুড়েদের উপর বিষম অত্যাচার শুরু করিয়াছে, কারণ দেশে নাকি ভায়ানক ছেলেচুরি হইতেছে। সকলের ধারণা সাপুড়েরাই এই কার্য করিতেছে।

    এই খবর পাইবামাত্র, জহর সদলবলে তাহাদের ডেরা তুলিয়া, বহু পথ অতিক্রম করিয়া, অবশেষে বিজন, ভীষণ, শ্বাপদসংকুল এক অরণ্যের মাঝখানে তাহাদের তাঁবু ফেলিল। বন্য, হিংস্র জন্তু জানোয়ারের আক্রমণ প্রতিরোধ করিবার জন্য তাঁবুর চারিদিকে আগুন জ্বালিয়া অনেকেই তখন প্রচুর স্ফূর্তি করিতেছে। এই বিরাট আমোদের মজলিস জমাইয়া তুলিয়াছে, দিল খোলার দল। তাহাদের নৃত্যগীতোৎসব তখন উদ্দাম হইয়া উঠিয়াছে। জহর, ঝুমরো, চন্দন, বিশুন, বিশুনের পুত্র তেঁতুলে, নীল-চশমাধারী দলের জাদুকর, গণকঠাকুর, ঘণ্টাবুড়ো সকলেই জ্যোৎস্নালোকিত রাত্রে, মুগ্ধ আনন্দে এই অপূর্ব উৎসব উপভোগ করিতেছে।

    এমন সময় কী যেন একটা তুচ্ছ কারণে, বিশুনের পুত্র তেঁতুলের সঙ্গে ঝুমরোর ভীষণ কলহ বাধিয়া গেল। কলহ প্রথমে মুখে-মুখেই চলিতেছিল, তাহার পর হইল হাতাহাতি, তাহার পর ক্রমে মারামারি। চন্দন ছিল দূরে দাঁড়াইয়া। তেঁতুলে অকথ্য অপমান করিবে ঝুমরোকে – এ তাহার অসহ্য। সেও ছুটিয়া আসিয়া ঝাঁপাইয়া পড়িল, ইহাদের মাঝখানে। কিন্তু টানাটানি ধস্তাধস্তিতে হঠাৎ যেই মুহূর্তের জন্য তাহার বক্ষাবরণ ছিন্ন হইয়া গেল, দলের সকলে সবিস্ময়ে হতবাক হইয়া দেখিল – চন্দন পুরুষ নয় – পুরুষের ছদ্মবেশে পরমাসুন্দরী এক তরুণী।

    এই সময় কোথা হইতে ছুটিতে ছুটিতে আর একটি সুন্দরী ঘটনাস্থলে আসিয়া দাঁড়াইল। তাহার নাম মৌটুসি। সে নিজের উত্তরীয়টি তাড়াতাড়ি খুলিয়া চন্দনের গায়ে জড়াইয়া দিল। কিশোর চন্দনকে, সে কুমারী-হৃদয়ের নীরব প্রেমের পূজাঞ্জলি নিবেদন করিয়াছিল – আজ যখন দেখিল, চন্দন তাহারই মতো এক তরুণী, তখন তাহার লজ্জরুণ প্রণয়-স্বপ্নের প্রাসাদ একেবারে ভাঙিয়া গেল। যে গভীর উদার প্রেম তাহার হৃদয়ে এতদিন ধরিয়া সঞ্চিত হইয়া উঠিয়াছিল, তাহা মধুর সখীত্বে রূপান্তরিত হইয়া উঠিল। জহর আসিয়া, লজ্জাবনতমুখী চন্দনকে টানিয়া, একেবারে তাহার তাঁবুর ভিতরে লইয়া গেল। দলের সমস্ত লোক একেবারে অবাক। কেহ স্বপ্নেও কোনো দিন কল্পনা করিতে পারে না–জহরের মতো একজন জিতেন্দ্রিয় ব্রহ্মচারী মন্ত্র-সাধক, এমন করিয়া এই সুন্দরী যুবতিটিকে যুবক সাজাইয়া নিজের সঙ্গে রাখিয়াছে।

    শুধু বিস্মিত হইল না একজন – সে ঘণ্টাবুড়ো। এই বেদিয়ার দলে সে একটা অদ্ভুত প্রকৃতির রহস্যময় মায়াবীর রূপে বাস করে। অনবরত মদ্যপান করে, আর খড়ি পাতিয়া সকলের ভবিষ্যৎ গণনা করে, কিন্তু সব কথা কখনও পরিষ্কার করিয়া বলে না।

    এই ব্যাপারে ঘণ্টাবুড়ো, পরম বিজ্ঞের মতো মাথা নাড়িয়া, সহসা এক অদ্ভুত ক্রূর অট্টহাসি হাসিয়া উঠিল।

    এদিকে নিভৃতে, তাঁবুর এককোণে, থরথর করিয়া কাঁপিতে কাঁপিতে জহর ভীতা হরিণীর মতো চন্দনকে সবলে আকর্ষণ করিয়া বলিতেছে, “চন্দন, চন্দন, তুই আমার – একমাত্র আমার!”

    তাহার এতদিনকার রুদ্ধ আত্মসংযমের বাঁধ ভাঙিয়া পড়িয়াছে – দু-কূলপ্লাবী বন্যার মতো সেই উন্মত্ত আবেগ, সেই দুর্দমনীয় দুর্বার বাসনা তাহাকে যেন অন্ধ করিয়া ফেলিয়াছে।

    চন্দন বৃথাই নিজেকে প্রাণপণে তাহার আলিঙ্গন হইতে মুক্ত করিবার চেষ্টা করিতে লাগিল।

    অনেক চেষ্টার পর চন্দন কিছুতেই যখন জহরকে প্রতিনিবৃত্ত করিতে পারিল না, তখন সে তাহার সুপ্ত বিবেককে জাগ্রত করিবার জন্য মিনতি-কাতরকন্ঠে জহরকে স্মরণ করাইয়া দিল – তাহার মহাব্রতের কথা, তাহার জীবনের একমাত্র কাম্য, নাগ-মন্ত্র-সাধনায় সিদ্ধিলাভের কথা।

    কথাগুলি জহরের বুকে গিয়া নির্মম মহাসত্যের মতো ধ্বক্ করিয়া বাজিল। সত্যই তো! এ কী করিতেছে সে! জহর যেন অকস্মাৎ সম্বিৎ ফিরিয়া পাইল। মনসা-দেবীর প্রতিমার পানে সে এক অদ্ভুত দৃষ্টিতে একবার তাকাইল, তাহার পর কীসের যেন একটা অব্যক্ত মর্মযন্ত্রণায় কাতর হইয়া, তাঁবু হইতে ছুটিয়া বাহির হইয়া গেল। আজই – এই রাত্রেই সে তাহার শততম সর্পদংশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইয়া, জীবনের মহাব্রত উদ্‌যাপন করিবে। আর বিলম্ব নয়।

    বিষধর একটি সর্পের সন্ধান করিয়া, জহর যেমনই তাহার কর্ম সিদ্ধ করিতে যাইবে, অমনি বিশুন কোথা হইতে ছুটিতে ছুটিতে আসিয়া সংবাদ দিল – চন্দনকে লইয়া ঝুমরো পলায়ন করিয়াছে। মৌটুসির আগ্রহ এবং সাহায্যেই নাকি তাহারা এই দুঃসাহসের কাজ করিয়াছে।

    জহরের ব্রত আর সাঙ্গ করা হইল না। যে কঠোর সংযমের বন্ধনে নিজেকে সে পুনর্বার পাথরের মতো স্তব্ধ নির্বিকার করিয়া তুলিয়াছিল, বিশুনের এই মর্মান্তিক সংবাদ প্রখর স্রোতের মুখে বালির বাঁধের মতো সে সংযম কোথায় ভাসিয়া গেল। ক্রোধে, উন্মাদের মতো হইয়া জহর ছুটিয়া চলিল চন্দন-ঝুমরোর সন্ধানে। কিন্তু দলের কেহই তাহাকে তাহাদের সন্ধান দিতে পারিল না, তীব্র উত্তেজনায় সর্বশরীরে তখন তাহার যেন আগুন ধরিয়া গেছে।

    উন্মত্তের মতো তাঁবুতে প্রবেশ করিয়া, সে ঝাঁপি খুলিয়া বাহির করিল, – বিষধর কালীয়নাগ! সেই ভীষণ কালীয়নাগকে লইয়া সে ছুটিয়া আসিল মহাকাল-মন্দিরে – তাহার পর সেই কালীয়নাগকে মন্ত্রপূত করিয়া ঝুমরোর উদ্দেশে ছাড়িয়া দিল।

    ঝুমরো ও চন্দন তখন গভীর আনন্দে রোমাঞ্চিত হইয়া, গান গাহিতে গাহিতে নিরুদ্দেশের পথে চলিয়াছে। দূরে, বহুদূরে চলিয়া গিয়া, তাহারা দুজনে একটি মধুর সুখের নীড় রচনা করিয়া, পরমানন্দে প্রেম-মধুযামিনী যাপন করিবে অনন্তকাল ধরিয়া – মুদিত বিহ্বল চক্ষুর সম্মুখে তখন তাহাদের এই সুখ-স্বপ্নের মোহন মেদুর ছায়া ঘনাইয়া আসিতেছে।

    অপূর্ব আনন্দে বিভোর হইয়া, যখন তাহারা একেবারে আত্মহারা হইয়া গেছে, তখন সহসা বিনামেঘে বজ্রপাতের মতো সেই মন্ত্রপূত কালীয়নাগ আসিয়া ঝুমরোকে দংশন করিয়া দিয়া, অদৃশ্য হইয়া গেল। বিষের বিষম যন্ত্রণায় অস্থির হইয়া, ঝুমরো সেখানে বসিয়া পড়িল।

    চন্দন একেবারে স্তম্ভিত নির্বাক! নিঃসহায়, নিরূপায়ের মতো সে দাঁড়াইয়া রহিল। ঝুমরোকে বাঁচাইতে হইলে, এখন তাহার আবার সেই জহরের কাছে গিয়া দাঁড়ানো ছাড়া আর উপায় নাই।

    অবিরল অশ্রুধারে, চন্দন চোখে দেখিতে পাইতেছে না – সে চলিয়াছে সেই পরিত্যক্ত তাঁবুর দিকে। কিন্তু কেমন করিয়া, কোন মুখে সে আবার জহরের কাছে গিয়া দাঁড়াইবে?

    জহর তখন নিশ্চল প্রস্তরের মতো বসিয়া আছে। অশ্রুমুখী চন্দন আসিয়া দাঁড়াইল তাহার কাছে। ম্লানমুখে, মৃদুকম্পিতকন্ঠে সে কহিল, ঝুমরো তাহার প্রাণাপেক্ষা প্রিয়। তাহাকে যদি সে বাঁচাইয়া দেয়, তাহা হইলে ঝুমরোর প্রাণের বিনিময়ে, সে জহরের কাছে আত্মবিক্রয় করিতেও প্রস্তুত। জহর একটি কথাও বলিল না। স্বপ্নাচ্ছন্নের মতো সে চলিল চন্দনের পিছু পিছু। নীরবে সে গিয়া দাঁড়াইল ঝুমরোর বিষাক্ত নীলবর্ণ মৃতদেহের পাশে।

    ঝুমরো বাঁচিয়া উঠিল।

    চন্দনের আনন্দের অবধি নাই। কিন্তু চন্দনের সময় নাই, সে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ – ঝুমরোর প্রাণের বিনিময়ে, সে আত্মবিক্রয় করিয়াছে জহরের কাছে। এখন সে জহরের। ঝুমরোকে সে উত্তেজিত করুণ, ভগ্নকন্ঠে বলে, ‘তুই দূরে চলে যা ঝুমরো, আমার চোখের সুমুখে থাকিসনে–আমি তোর নই’।

    যে তাহার প্রাণাধিক প্রিয়, একান্ত আপন, জীবনসর্বস্ব, তাহাকে সে চায় না। চন্দনের উদ্‍গত অশ্রু আর বাধা মানে না। কণ্ঠরোধ হইয়া আসে। অব্যক্ত যন্ত্রণায় হৃদ্‌পিন্ড যেন ছিঁড়িয়া যায়, তাহাকে তাড়াইয়া দিতে।

    অদূরে দাঁড়াইয়া, জহর এই করুণ দৃশ্য দেখিতেছিল। যে কালীয়নাগ মন্ত্রবলে ফিরিয়া আসিয়া ঝুমরোকে বিষমুক্ত করিয়াছে, সে তখনও তাহার হাতে।

    জহর একবার অদ্ভুত দৃষ্টিতে চন্দনের দিকে তাকাইল, একবার তাকাইল ঝুমরোর দিকে – জহর একবার মনে-মনে কী যেন ভাবিল।

    অকস্মাৎ সে নির্বিকারভাবে সেই কালীয়নাগের দংশন নিজের বুক পাতিয়া গ্রহন করিল।

    ঝুমরো চিৎকার করিয়া কহিল, ‘ওস্তাদ কী করিলে!’

    চন্দন ও ঝুমরো দুজনেই ছুটিয়া জহরের কাছে গেল। জহর ক্রুদ্ধকন্ঠে বলিয়া উঠিল, ‘ঝুমরো শিগগির একে নিয়ে চলে যা আমাদের সমুখ থেকে – আমি বিষ হজম করব, এই আমার শেষ সাপ – তারপর আমি মন্ত্র পড়ব। মেয়েমানুষের সামনে মন্তর নষ্ট হয়। ওকে এখান থেকে নিয়ে যা – এ জঙ্গল থেকে, এ দেশ থেকে নিয়ে যা।’ চন্দন আর ঝুমরো অগত্যা চলিয়া গেল। ওস্তাদ দেখিল তাহারা দূরে চলিয়া গেছে, কিন্তু নাগমন্ত্র আর সে উচ্চারণ করিল না। স্মিতহাস্যে আপন মনে সে বলিয়া উঠিল, “মন্তর, ও সাপের মন্তর আর নয় – এইবার আমার মন্তর –‘শিব-শম্ভু-শিব-শম্ভু!’!”

    কালীয়নাগের বিষে তাহার সর্বশরীর ক্রমশ নীল হইয়া আসিতে লাগিল, চোখ দুইটি স্তিমিত নিস্তেজ হইয়া গেল; কিন্তু তাহার সমস্ত মুখের উপরে মনে হইল, কীসের যেন এক অপার্থিব আনন্দের ভাস্করদীপ্তি প্রতিফলিত হইয়াছে, তাহার বিক্ষুব্ধ আত্মার সমস্ত বিক্ষোভ যেন শান্ত হইয়া গিয়াছে, জীবনব্যাপী মর্মযন্ত্রণার যেন অবসান হইয়াছে।

    সর্বশেষ সর্পের শ্রেষ্ঠ মন্ত্র-সাধনার পরিণামে সে সিদ্ধকাম হইল কি?

    ⤷
    1 2 3 4
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleনাটক সমগ্র – কাজী নজরুল ইসলাম
    Next Article যাম-যোজনায় কড়ি মধ্যম – কাজী নজরুল ইসলাম

    Related Articles

    কাজী নজরুল ইসলাম

    ব্যথার দান – কাজী নজরুল ইসলাম

    July 24, 2025
    কাজী নজরুল ইসলাম

    গানের মালা – কাজী নজরুল ইসলাম

    July 22, 2025
    কাজী নজরুল ইসলাম

    যুগবাণী – কাজী নজরুল ইসলাম

    July 22, 2025
    কাজী নজরুল ইসলাম

    অগ্নিবীণা – কাজী নজরুল ইসলাম

    May 8, 2025
    কাজী নজরুল ইসলাম

    মহুয়ার গান – কাজী নজরুল ইসলাম

    May 8, 2025
    কাজী নজরুল ইসলাম

    চক্রবাক – কাজী নজরুল ইসলাম

    May 8, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }