Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    জননী – মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়

    উপন্যাস মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এক পাতা গল্প250 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    ০৭. পৃথিবীতে শরৎকালটা যেমন ছিল

    পরের বছর শরৎকালে—শ্যামা প্রথম সন্তানের জননী হওয়ার সময় পৃথিবীতে শরৎকালটা যেমন ছিল এখনো তেমনি থাকার মতো আশ্চর্য। শরৎকালে ছেলেমেয়েদের সঙ্গে লইয়া শ্যামা বনগাঁ গেল। বলিল, ঠাকুরঝি, আমার আর তো কোথাও আশ্রয় নেই, খেতে না পেয়ে আমার ছেলেমেয়ে মরে যাবে; ওদের তুমি দুটি দুটি খেতে দাও, আমি তোমার বাড়ি দাসী হয়ে থাকব।

    মন্দা মুখ ভার করিয়া বলিল, এসেছ থাক, ওসব বোলো না বৌ। তোষামুদে কথা আমি। ভালবাসি নে।

    শ্যামা বনগাঁয়ে রহিয়া গেল।

    শ্যামার গত বছরের ইতিহাস বিস্তারিত লিখিলে সুখপাঠ্য হইত না বলিয়া ডিঙাইয়া আসিয়াছি : এ তে দারিদ্রের কাহিনী নয়। শ্যামা যে একবার দুদিন উপবাস করিয়াছিল সে কথা লিখিয়া কি হইবে? ব্ৰত-পূজা করিয়া কত জননী অমন অনেক উপবাস করে, শ্যামা খাদ্যের অভাবে করিয়াছিল। বলিয়া তো উপবাসের সঙ্গে উপবাসের পার্থক্য জন্মিয়া যাইবে না? শ্যামার গহনাগুলি গিয়াছে। বিবাহের সময় মামা শ্যামাকে প্রায় হাজার টাকার গহনাই দিয়াছিল, নিজের প্রেস বিক্রয় করিয়া শীতলের দীর্ঘকাল বেকার বসিয়া থাকার সময় চুড়ি হার বালা আর নাক ও কানের দুটি-একটি ছুটকো গহনা ছাড়া বাকি সব গিয়াছিল, কমল প্রেসের চাকরির সময় দোতলায় ঘর তুলিবার কেঁকে শ্যামা টাকা জমাইয়াছে, হাঙরমুখখা পুরোনো প্যাটার্নের বালা ভাঙিয়া আর একটু ভারি তারের বালা গড়ানো ছাড়া নূতন কোনো গহনা সে কখনো করে নাই। এক বছরে তাই ঘরের বিক্রয়যোগ্য আসবাবের সঙ্গে শ্যামার গহনাগুলিও গিয়াছে। থাকিবার মধ্যে আছে একটি আংটি আর দুহাতে দুগাছি চুড়ি।

    বিধানকে বড়লোকের স্কুল হইতে ছাড়াইয়া কাশীপুরের সাধারণ স্কুলটিতে ভর্তি করিয়া দিয়াছিল, বিধান টিয়াই স্কুলে যাইত। ধোপার সঙ্গে শ্যামা কোনো সম্পর্ক রাখিত না, বাড়িতে সিদ্ধ করিয়া কাপড় জামা সাফ করিত–কাপড় জামা দুই-ই সে কিনিত কমদামি, মোটা, টিকিত অনেকদিন। খোকার জন্য দুধ কিনিত এক পোয়া, দু বছর বয়সের আগেই খোকা দিব্যি ভাত খাইতে শিখিয়াছিল, পেট ভরিয়া খাইয়া টিঙটিঙে পেটটি দুলাইয়া দুইয়া শ্যামার পিছু পিছু সে হাঁটিয়া বেড়াইত শ্যামা তাহাকে স্তন দিত সেই অপরাত্নে, সারাদিন বুকে যে দুধটুকু জমিত বিকালে তাহাতেই থোকার পেট ভরিয়া যাইত। কত হিসাব ছিল শ্যামার, ব্যাপক ও বিস্ময়কর। ভাতের ফেনটুকু রাখিলে যে ভাতের পুষ্টি বাড়ে এটুকু পর্যন্ত সে খেয়াল রাখিত! তাঁহার এই আশ্চর্য হিসাবের জন্য ছোট খোকার পেটটা একটু বড় হওয়া ছাড়া ছেলেমেয়ের কারো শরীর তেমন খারাপ হয় নাই! রোগা হইয়াছে শুধু শ্যামা। শেষের দিকে শ্যামার যে মখমলের মতো, মসৃণ উজ্জ্বল চামড়াটি দেখা দিয়াছিল তাহা মলিন বিবর্ণ হইয়া গিয়াছে। এক বছরে কারো বয়স এক বছরের বেশি বাড়ে না, শ্যামারও বাড়ে নাই, কিন্তু তাহাকে দেখিয়া কে তাহা ভাবিতে পারে। গত যে বসন্ত ব্যর্থ গিয়াছে তার আগেরটি উতলা করিয়াছিল কেন শ্যামাকে? বনগাঁয়ে এই যে শীর্ণা নিষ্পভজ্যোতি শ্ৰান্ত নারীটি আসিয়াছে, শহরতলির সেই বাড়িটির দোতলার সমাপ্তপ্রায় নতুন ঘরটির ছায়ায় দাঁড়াইয়া বসন্তের বাতাসে ধানকলের ছাই উড়িতে দেখিয়া জেলের কয়েদি স্বামীর জন্য এরই যৌবন কি ক্ষোভ করিয়াছিল?

    শেষের দিকে হারান ডাক্তার বার টাকা ভাড়ায় একতলাতে একটি ভাড়াটে জুটাইয়া দিয়াছিল, সরকারি অফিসের এক কেরানি, সম্প্রতি স্ত্রী ও শিশুপুত্ৰ লইয়া দাদার সঙ্গে পৃথক হইয়া আসিয়াছে। কেরানি বটে কিন্তু বড়ই তাহারা বিলাসী। হাঁড়ি কলসী, পুরোনো লেপ-তোশক, ভাঙা রংচটা বাক্স প্রভৃতিতে শ্যামার ঘর ভরা থাকিত। ওরা আসিয়া ঝকঝকে সংসার পাতিয়া বসিল, জিনিসপত্র তাহাদের বেশি ছিল না, কিন্তু যা ছিল সব দামি ও সুদৃশ্য। বৌটি, শ্যামা শুনিল বড়লোকের মেয়ে, স্কুলেও নাকি পড়িয়াছিল, স্বাধীনভাবে একটু ফিটফাট থাকিতে ভালবাসে বড় ভাইয়ের সঙ্গে ওদের পৃথক হওয়ার কারণটাও তাই। পৃথক হইয়া বৌটি যেন বাঁচিয়াছে। নিজের সংসার পাতিতে কি তাহার উৎসাহ! পথের দিকে যে ঘরে শ্যামা আগে শুইত তার জানালায় জানালায় সে নতুন পর্দা দিল, চিকন কাজ করা দামি খাটটি, বোধহয় বিবাহের সময় পাইয়াছিল, দক্ষিণের জানালা ঘেষিয়া পাতিল, আয় বসানো টেবিলটি রাখিল ঘরে ঢুকিবার দরজার সোজা, অপর দিকের দেয়ালের কাছে। খাট টেবিল আর একটি চেয়ার তাহার সমগ্র আসবাব, তাই যেন তার ঢের। ভাড়ার তাকের উপর মসলাপাতি রাখিবার কয়েকটি নতুন চকচকে টিন, কাচের জার, স্টোভ, চায়ের বাসন আর দুটি-একটি টুকিটাকি জিনিস রাখিয়া, রাখিবার কিছুই তাহার রহিল না, সমস্ত ঘরে একটি রিক্ত পরিচ্ছন্নতা ঝকঝক করিতে লাগিল। সংসার করিতে করিতে একদিন হয়তো সে শ্যামার মতোই ঘরবাড়ি জঞ্জালে ভরিয়া ফেলিবে, শুরুতে আজ সবই তাহার আনকোরা ও সংক্ষিপ্ত। বাড়াবাড়ি ছিল শুধু তাহাদের প্রেমের। এমন নিৰ্লজ্জ নিবিড় প্ৰেম শ্যামা জীবনে আর দেখে নাই। বিবাহ তাহাদের হইয়াছিল চার-পাঁচ বছর আগে, এতকাল কে যেন তাহাদের প্রেমের উৎস-মুখটিতে ছিপি আঁটিয়া রাখিয়াছিল, এখানে মুক্তি পাইয়া তাহা উথলিয়া উঠিয়াছে। ভালো শ্যামার লাগিত না, নিরানন্দ বিমর্ষ তাহার জীবন, সন্তানের তাহার অন্নবস্ত্রের অভাব, তারই পায়ের তলে, তারই বাড়ির একতলায় এ কি বিসদৃশ প্রণয়রস-রঙ্গ? কই, বয়সকালে শ্যামা তো ওরকম ছিল না? স্বামীর সঙ্গে মেয়েমানুষের এত কি ছেলেমানুষি, হাসাহাসি, খেলা ও ছলকরা কলহ? একটি ছেলে হইয়াছে সম্মুখে অন্ধকার ভবিষ্যৎ, কত দুশ্চিন্তা কত দায়িত্ব ওদের, এমন হালকা ফাজলামিতে দিন কাটাইলে চলিবে কেন?

    বৌটির নাম কনকলতা। শ্যামা জিজ্ঞাসা করিত, তোমার স্বামী কত মাইনে পান?

    কনক বলিত, কত আর পাবে, মাছিমারা কেরানি তো, বেড়ে বেড়ে নব্বইয়ের মতো হয়েছে খরচ চলে না দিদি। একটা ছেলে পড়ালে আরো কিছু আসে, আমি বারণ করি–সারাদিন আপিস করে আবার ছেলে পড়াবে না কচু–কি হবে বেশি টাকা দিয়ে যা আছে তাই ঢের—নয়? মাসের শেষে বডড টানাটানি পড়ে দিদি, খরচ চলে না।

    কনক এমনিভাবে কথা বলিত, উল্টাপাল্টা পুব-পশ্চিম। বলিত, একা স্বাধীনভাবে সে মহাস্ফূর্তিতে আছে, আবার বলিত, একা একা থাকতে ভালো লাগে না দিদি, আত্মীয়স্বজন দুচারটি কাছে না থাকলে বড় যেন ফঁকা ফাকা লাগে–নয়?

    শ্যামা বুঝিত, আনন্দে আহলাদে সোহাগে সে ডগমগ, কথা সে বলে না, শুধু বকবক করে, ওর কথার কোনো অর্থ নাই। কনকের বয়স বোধহয় ছিল কুড়ি-বাইশ বছর, শ্যামা যে বয়সে প্রথম মা হইয়াছিল—এই বয়সে বৌটির অবিশ্বাস্য খুকিভাবে শ্যামা থ বনিয়া যাইত, কেমন রাগ হইত শ্যামার। মেয়েমানুষ এমন নির্ভয়, এমন নিশ্চিন্ত, এমন আহলাদী? এই বুদ্ধি-বিবেচনা লইয়া সংসারে ও টিকিবে কি করিয়া? বড়লোকের মেয়ে বুঝি এমনি অসার হয়?

    তবু বিরুদ্ধ সমালোচনা-ভরা শ্যামার মন, কি দিয়া কনক যেন আকর্ষণ করিত। চৌবাচ্চার ধারে ওরা যখন পরস্পরের গায়ে জল ছিটাইয়া হাসিয়া লুটাইয়া পড়িত, কনকের স্বামী যখন তাহাকে শূন্যে তুলিয়া চৌবাচ্চায় একটা চুবানি দিয়া, আবার বুকে করিয়া ঘরে লইয়া যাইত, খানিক পরে শুকনো কাপড় পরিয়া আসিয়া কনকের কাজের ছন্দে আবার অকাজের ছন্দ মিশিতে থাকিত, তখন শ্যামার–কে জানে কি হইত শ্যামার, চোখের জল গাল বাহিয়া তাহার মুখের হাসিতে গড়াইয়া আসিত।

    কনকের স্বামী আপিস গেলে সে নিচে নামিয়া বলিত, সব দেখে ফেলেছি কনক!

    কনকের লজ্জা নাই, সে হাসিয়া ফেলিত—জ্বালিয়ে মারে দিদি, আপিস গেলে যেন বাঁচি।

     

    দোতলার ঘরখানা আর ছাদটুকু ছিল শ্যামার গৃহ, জিনিসপত্রসহ সে বাস করিত ঘরে, রাধিত ছাদে, একখানা করোগেটেড টিনের নিচে। পাশে শুধু নকুবাবুর ছাদ নয়, আশপাশের আরো কয়েক বাড়ির ছাদ হইতে উদয়াস্ত শ্যামার সংসারের গতিবিধি দেখা যাইত। প্রথম প্রথম অনেকগুলি। কৌতুহলী চোখ দেখিতেও ছাড়িত না। যখন তখন ছাদে উঠিয়া নকুবাবুর বৌ জিজ্ঞাসা করিত, কি। করছ বকুলের মা? শ্যামা বলিত, রাধছি দিদি বলিত, সংসারের কাজকর্ম করছি দিদি কি রাধলেন এবেলা? ব্রাধিত এবং সংসারের কাজকর্ম করিত, শ্যামা আর কিছু করিত না? ধানকলের ধূমোদ্‌গারী চোঙটার দিকে চাহিয়া থাকিত না? রাত্রে ছেলেমেয়েরা ঘুমাইয়া পড়িলে জাগিয়া বসিয়া থাকি না, হিসাব করিত না দিন মাস সপ্তাহের, টাকা আনা পয়সার?

     

    উদ্ভ্রান্ত চিন্তাও শ্যামা করিত, নিশ্বাস ফেলিত। জননীর জীবন কেমন যেন নীরস অর্থহীন মনে হইত শ্যামার কাছে। কোথায় ছিল এই চারিটি জীব, কি সম্পর্ক ওদের সঙ্গে তাহার, অসহায় স্ত্রীলোক সে, মেরুদণ্ড বাকানো এ ভার তার ঘাড়ে চাপিয়া বসিয়াছে কেন? কিসের এই অন্ধ মায়া? জগজ্জননী মহামায়া কিসের ধাধায় ফেলিয়া তাহাকে দিয়া এত দুঃখ বরণ করাইতেছেন? সুখ কাকে। বলে একদিনের জন্য সে তাহা জানিতে পারি না, তাহার একটা প্রাণ নিড়াইয়া চারটি প্রাণীকে সে বাচাইয়া রাখিয়াছে কেন? কি লাভ তাহার? চোখ বুজিয়া সে যদি আজ কোথাও চলিয়া যাইতে পারিত! ওরা দুঃখ পাইবে, না খাইয়া হয়তো মরিয়া যাইবে, কিন্তু তাহাতে কি আসিয়া যায় তার? সে তো দেখিতে আসিবে না। পেটের সন্তানগুলির প্রতি শ্যামা যেন বিদ্বেষ অনুভব করিত সব তাহার শত্ৰু, জন্ম-জন্মান্তরের পাপ! কি দশা তাহার হইয়াছে ওদের জন্য।

    শেষের দিকে শ্যামা আর চাইতে পারি না, মাসিক বার টাকায় এতগুলো মানুষের চলে। না। তাই কুড়ি টাকা ভাড়ায় সমস্ত বাড়িটা কনকলতাকে ছাড়িয়া দিয়া সে বনগাঁয়ে রাখালের আশ্রয়ে চলিয়া আসিয়াছে।

    বড় রাস্তা ছাড়িয়া ছোট রাস্তা, পুকুরের ধারে বিঘা পরিমাণ ছোট একটি মাঠ, লাল ইটের একতলা একটি বাড়ি ও কলাবাগানের বেড়ার মধ্যবর্তী দুহাত চওড়া পথ, তারপর রাখালের পাকা ভিত, টিনের দেয়াল ও শণের ছাউনির বৈঠকখানা। তিনখানা তক্তপোষ একত্ৰ করিয়া তার উপরে সতরঞ্চি বিছানো আছে। তিন জাতের মানুষের জন্য হুকা আছে তিনটি কাঠের একটা আলমারিতে। বিবর্ণ দপ্তর, কাঠের একটি বাক্সের সামনে শীর্ণকায় টিকিসমেত একজন মুহুরি। রাখালের মুহুরি? নিজে সে সামান্য চাকরি করে, মুহুরি দিয়া তাহার কিসের প্রয়োজন? বাহিরের ঘরখানা দেখিলেই সন্দেহ হয় রাখালের অবস্থা বুঝি খারাপ নয়, অনেকটা উকিল মোক্তারের কাছারি ঘরের মতো তাহার বৈঠকখানা। বৈঠকখানার পরেই বহিরাঙ্গন, সেখানে দুটা বড় বড় ধানের মরাই। তারপর রাখালের বাসগৃহ, আট-দশটি ছোট বড় টিনের ঘরের সমষ্টি, অধিবাসীদের সংখ্যাও বড় কম নয়।

     

    কদিন এখানে বাস করিয়াই শ্যামা বুঝিতে পারিল রাখাল তাহাকে মিথ্যা বলিয়াছিল, সে দরিদ্র নয়! মধ্যবিত্তও নয়। সে ধনী। চাকরি রাখাল সামান্য মাহিনাতেই করে কিন্তু সে অনেক জমিজমা করিয়াছে, বহু টাকা তাহার সুদে খাটে! রাখালের সম্পত্তি ও নগদ টাকার পরিমাণটা অনুমান করা সম্ভব নয়, তবু সে যে উঁচুদরের বড়লোক চোখ কান বুজিয়া থাকিলেও তাহা বোঝ যায়। মোটরগাড়ি, দামি আসবাব, গৃহের রমণীবৃন্দের বিলাসিতার উপকরণ গ্রাম্য গৃহস্থের ধনবত্তার পরিচয় নয়, তাহাদের অবস্থাকে ঘোষণা করে পোষ্যের সংখ্যা, ধানের মরাই, খাতকের ভিড়। রাখালের তিনটি জোড়া তক্তপোষ সকালবেলা খাতকের ভিড়ে ভরিয়া যায়।

     

    দেখিয়া শুনিয়া শ্যামা নিশ্বাস ফেলিল। রাগ ও বিদ্বেষ এবার যেন তাহাদের হইল না, অনেক অভিজ্ঞতা দিয়া শ্যামা এখন বুঝিতে পারিয়াছে রাখাল একা নয়, এমনি জগৎ। এমন করিয়া মিথ্যা বলিতে না জানিলে, ছল ও প্রবঞ্চনায় এমন দক্ষতা না জন্মিলে, সকালে উঠিয়া দশ-বিশটি খাতকের মুখ দেখিবার সৌভাগ্য মানুষের হয় না। রাখালের দোষ নাই। মানুষের মাঝে মানুষের মতো মাথা উঁচু করিবার একটিমাত্র যে পন্থা আছে তাই সে বাছিয়া নিয়াছে। রাখাল তো ধর্মযাজক নয়, বিবাগী সন্ন্যাসী নয়, সে সংসারী মানুষ, সংসারে দশজনে যেভাবে আত্মােন্নতি করে সেও তেমনিভাবে অর্থসম্পদ সঞ্চয় করিয়াছে!

    শ্যামা সব জানে। বড়লোক হইবার সমস্ত কলাকৌশল! কেবল স্ত্রীলোক করিয়া ভগবান তাহাকে মারিয়া রাখিয়াছেন।

    রাখালের দ্বিতীয় পক্ষের বৌ সুপ্রভাকে দেখিয়া প্রথমে শ্যামা চোখ ফিরাইতে পারে নাই। রাখালের দুবার বিবাহ করার কারণটাও তখন সে বুঝিতে পারিয়াছিল। এত রূপ দেখিলে মাথা ঠিক থাকে পুরুষমানুষের! একটি ছেলে আর একটি মেয়ে হইয়াছে সুপ্রভার, শ্যামা আসিবার আগে সে নাকি অনেকদিন অসুখেও ভুগিয়াছিল, তবু এখনো সে ছবির মতো, প্রতিমার মতো সুন্দরী। এমন সতীন থাকিতে মন্দা যে কেমন করিয়া এখানে গৃহিণীর পদটি অধিকার করিয়া আছে, চারিদিকে সকলকে হুকুম দিয়া বেড়াইতেছে–সুপ্রভাকে পর্যন্ত, ভাবিয়া প্রথমটা শ্যামা আশ্চর্য হইয়া গিয়াছিল। তারপর সে টের পাইয়াছে যতই রূপ থাক সুপ্রভার বুদ্ধি নাই, বড় সে বোকা। পুতুলের মতো সে পরের হাতে নড়েচড়ে, সাহস করিয়া যে তাহার উপর কর্তৃত্ব করিতে যায় তারই কর্তৃত্ব স্বীকার করে, একেবারে সে মাটির মানুষ, ঘোরপ্যাচ বোঝে না, নিজের পাওনা গণ্ডা বুঝিয়া লইতে জানে না। তবু রাখাল কিনা আজো ছোটবৌ বলিতে অজ্ঞান, মনে মনে সকলেই সুপ্ৰভাকে ভয় করে, এ বাড়িতে আদরের তাহার সীমা নাই। সুপ্ৰভা প্ৰভুত্ব করার চেয়ে নির্ভর করিতেই ভালবাসে। বেশি, আদর পাওয়াটাই তার জীবনে সবচেয়ে বড় প্রাপ্য। মন্দার গৃহিণীপনার ভিত্তিও ওইখানেই সুপ্রভাকে সে নয়নের মণি করিয়া রাখিয়াছে। কে বলিবে সুপ্রভা তাহার সতীন? স্নেহে-যতে সুপ্রভার দিনগুলিকে সে ভরাট করিয়া রাখে, নিজের হাতে সে সুপ্রভাকে সাজায়, সুপ্রভার ঘরখানা। সাজায়, সুপ্রভার শয্যা রচনা করিয়া দেয়, সতীনের প্রতি স্বামীর গভীর ভালবাসাকে হাসিমুখে গ্রহণ করে।

    সতীনের সংসারেও তাই এখানে কলহ-বিবাদ মান-অভিমান মন-কষাকষি নাই। মন্দা ভুলিয়া গিয়াছে সে বধূ। এই মূল্য দিয়া সে হইয়াছে গৃহিণী।

     

    কলিকাতার চেয়ে ঢের বেশি সুখেই শ্যামা এখানে বাস করিতে লাগিল। পরের বাড়ি পরের আশ্রয়ে থাকিবার একটু যা লজ্জা! এখানে আসিবার আগে শ্যামা ভাবিয়াছিল এমন নিরুপায় হইয়া আত্মীয়ের বাড়ি যাইতেছে, পদে পদে কত অপমান সেখানে না জানি তাহার জুটিবে, এখানে। কিছু দিন ভয়ে ভয়ে থাকিবার পর দেখিল গায়ে পড়িয়া অপমান কেহ করে না, সে যে এখানে। আশ্রিতা, সময়ে অসময়ে সেটা মনে করাইয়া দিবারও কেহ এখানে নাই, মানাইয়া চলিতে পারিলে এখানে বাস করা কঠিন নয়।

    এখানকার গ্রাম্য আবহাওয়াটিও শ্যামার বেশ লাগিল। শহরতলির যে বাড়িতে বিবাহের পর। হইতে এতকাল সে বাস করিয়াছিল সেখানটা শহরের মতো ঘিঞ্জি নয়, তবু সেখানে তাহারা যেন বন্দি জীবনযাপন করিত, ইটের অরণ্যের মধ্যে প্রকৃতির যেটুকু প্রকাশ ছিল তা যেন শহরের পার্কের মতো ছেলেভুলানো ব্যাপার। তাছাড়া, সেখানে তারা ছিল কুনো, ঘরের কোণে নিজেদের লইয়া থাকিত, প্রতিবেশী থাকিয়াও ছিল না। এখানে জীবনের সঙ্গে জীবনের বড় নিবিড় মেশামিশি। মিতালি যেখানে নাই সেখানেও অজস্র মেলামেশা আছে, সহজ বাস্তব মেলামেশা, শহরের মেলামেশার মতো কোমল ও কৃত্রিম নয়, খাটি জিনিস! শ্যামার ছেলেমেয়েরা যেন হাঁপ ছাড়িয়া বাঁচিয়াছে। এখানে তাহারা প্রকাণ্ড অঙ্গন পাইয়াছে, বাগান পুকুর পাইয়াছে, ধূলামাটিতে খেলা করার। সুযোগ পাইয়াছে, আর পাইয়াছে সঙ্গী। বাড়িতেই শ্যামার প্রত্যেকটি ছেলেমেয়ের সাথী আছে, বিধানের জন্মের সময় মন্দা যে কোলের ছেলেটিকে লইয়া কলকাতায় গিয়াছিল তার নাম অজয়, সকলে অজু বলিয়া ডাকে, বিধানের সঙ্গে তাহার খুব ভাব হইয়া গেল। অজয় এক ক্লাস নিচে পড়ে। পড়াশোনায় বিধান বড় ভালো, মন্দার ছেলেদের মাস্টার একদিন বিধানকে জিজ্ঞাসাবাদ করিয়া এই রায় দিয়াছেন। মন্দা জানিয়া খুশি হইয়াছে, বিধান কলকাতার ছেলে বলিয়া অজয়ের সঙ্গে তাহার ঘনিষ্ঠতায় মন্দার যেটুকু ভয় ছিল, মাস্টারের মন্তব্য শোনার পর আর তাহা নাই।

     

    সুপ্ৰভা বকুলকে ভালবাসিয়া ফেলিয়াছে।

    বলে, কি মেয়ে আপনার বৌদিদি, দিয়ে দিন মেয়েটাকে আমাকে, দেবেন?

    বলে, মেয়ে বলে ওকে কিছু শেখাচ্ছেন না, এ তো ভালো কথা নয়? আজকালকার দিনে লেখাপড়া গানটান না জানলে কে নেবে মেয়েকে? একটু একটু সবই শেখাতে হবে ঠাকুরঝি।

    সুপ্ৰভাই উদ্যোগ করিয়া বকুলকে মেয়েস্কুলে ভর্তি করিয়া দিল, বলিল, স্কুলের মাহিনা সেই দিবে। গানটান শিখাইবার যখন উপায় নাই, লেখাপড়াই একটু শিখুক। বকুলকে সে যত্ন করে, লুকাইয়া ভালো জিনিস খাইতে দেয়, যে সব জিনিস শুধু মন্দা ও তার ছেলেমেয়ের জন্য বরাদ্দ। কিন্তু একা বকুল ওসব খাইতে চায় না, বলে, দাদাকে দাও, ভাইকে দাও? সুপ্রভা তাতে বড় খুশি হয়। কি নিঃস্বার্থপর মেয়েটার মন? যেমন দেখিতে সুন্দর, তেমনি মিষ্টি স্বভাব, ও যেন রাজরানী হয় ভগবান!

    রাজরানী? এতবার সুপ্রভা এই আশীর্বাদের পুনরাবৃত্তি করে কেন, বকুলকে রাজরানী করিতে এত তাহার উৎসাহ কিসের? রাজরানী হওয়ার শখ ছিল নাকি সুপ্রভার, মনে সেই ক্ষোভ রহিয়া গিয়াছে? কিছু বুঝিবার উপায় নাই। সুপ্রভাকে অসুখী মনে হয় কদাচিৎ। চুপচাপ বসিয়া সে অনেক সময়ই থাকে, সেটা তার স্বভাব, মুখ তাহার সব সময় বিমর্ষ দেখায় না, চোখে তাহার সব সময় ঘনাইয়া আসে না উৎসুক দিবা-স্বপ্নাতুরার দৃষ্টি। তবু শ্যামা মাঝে মাঝে সন্দেহ করে। অত যার রূপ সে কি একেবারেই নিজের মূল্য জানে না, কুমারী জীবনে আশা কি সে করে নাই, কল্পনা কি তার ছিল না? বুড়া বয়সে রাখাল যখন তাহাকে বিবাহ করিয়া তিন পুত্রের জননী সতীনের সংসারে আনিয়াছিল গোপনে সে কি দু-একবিন্দু অশ্রুপাত করে নাই?

    বাড়ি ভাড়ার কুড়িটা টাকা নিয়মিত আসে। দু মাস টাকা পাঠাইয়া কনক একবার শ্যামাকে একখানা পত্র লিখিল। পাশে কোন বাড়িতে বিদ্যুতের আলো নেওয়া হইতেছে, দেখিয়া কনকের শখ জাগিয়াছে তারও বিদ্যুতের আলো চাই। বাড়িটা তাদের পছন্দ হইয়াছে, স্থায়ীভাবে তারা ওখানে রহিয়া গেল, এক কাজ করলে হয় না দিদি? খরচপত্র করিয়া তারা বিদ্যুৎ আনাক, মাসে মাসে বাড়ি ভাড়ার টাকায় সেটা শোধ হইবে? এই পত্র পাইয়া শ্যামা বড় চিন্তায় পড়িয়া গেল। এখানে তাহার নানা রকম খরচ আছে, স্কুলে মাহিনা, জামাকাপড় এসব তাহাকেই দিতে হয়, এটা ওটা খুচরা খরচাও আছে অনেক, বাড়ি ভাড়ার টাকা না আসিলে সে করিবে কি? অথচ বিদ্যুৎ আনিতে না দিলে ওরা যদি অন্য বাড়িতে উঠিয়া যায়? সঙ্গে সঙ্গে আবার কি ভাড়াটে মিলিবে? শেষে শ্যামা মিনতি করিয়া কনককে চিঠি লিখিল। লিখিল, ওই কুড়িটা টাকা তাহার সম্বল, ওই টাকা কটির জোরে সে পরের বাড়ি পড়িয়া আছে, বাড়িতে বিদ্যুৎ আনিবার তার ক্ষমতা কই? শ্যামা যে কি দুঃখে পড়িয়াছে। কনক যদি তাহা জানিত–

    এ চিঠি ডাকে দিবারও প্রয়োজন হইল না, কনকলতার স্বামীর নিকট হইতে সবিনয় নিবেদন ভণিতার আর একখানা পত্র আসিল, শ্যামার বাড়ি হইতে আপিসে যাতায়াত করা বড়ই অসুবিধা, একটি ভালো বাড়ি পাওয়া গিয়াছে শহরের মধ্যে, ইংরাজি মাসটা কাবার হইলে তাহারা উঠিয়া যাইবে। কলিকাতার কেরানি ভাড়াটের বাসা-বদলানো রোগের খবর তো শ্যামা জানি না, তাহার মুখ শুকাইয়া গেল। কনকলতার উপর রাগ ও অভিমানের তাহার সীমা রহিল না। শ্যামার সঙ্গে না তাহার অত ভাব হইয়াছিল, দুঃখের কথা বলিতে বলিতে শ্যামার চোখে জল আসিলে সে না সান্ত্বনা দিয়া বলিত, ভেব না দিদি, ভগবান মুখ তুলে চাইবেন? …শ্যামা কত নিরুপায় সে তাহা জানে, কলকাতার বাড়ি ভাড়া করিয়াই সে থাকিবে তবু শ্যামার বাড়িতে থাকিবে না। এতকাল অসুবিধা ছিল না, আজ হঠাৎ অসুবিধা হইয়া গেল?

    রাখালকে চিঠিখানা দেখাইয়া শ্যামা বলিল, ঠাকুরজামাই এবার কি হবে? কুড়িটে করে টাকা পাচ্ছিলাম, ভগবান তাতেও বাদ সাধলেন।

    রাখাল বলিল, আহা, কলকাতায় কি আর ভাড়াটে নেই। যাক না ওরা, ফের ভাড়াটে আসবে–ওপরে একখানা নিচে তিনখানা ঘর, কুড়ি টাকায় ও বাড়ি লুফে নেবে না? পাড়ার কাউকে চিঠি দাও না?

    হারান ডাক্তারকে শ্যামা একখানা পত্ৰ লিখিয়া দিল! হারান জবাব দিল, ভয় নাই, বাড়ি শ্যামার খালি থাকিবে না, দু-এক মাসের মধ্যে আবার অবশ্যই ভাড়াটে জুটিবে।

    ইংরাজি মাসের পাঁচ ছয় তারিখে শ্যামা ভাড়ার টাকার মনিঅৰ্ডার পাইত এবার দশ তারিখ হইয়া গেল টাকা আসিল না। কনকলতারা কোথায় উঠিয়া গিয়াছে শ্যামা জানি না। নিজের বাড়ির ঠিকানাতেই সে তাগিদ দিয়া চিঠি লিখিল, ভাবিল পোস্টাপিসে ওরা কি আর ঠিকানা রাখিয়া যায় নাই?এ পত্রের কোনো জবাব শ্যামা পাইল না।

    মন্দা বলিল, দিচ্ছে ভাড়া! এতকাল যে দিয়েছিল তাই ভাগ্যি বলে জেন বৌ! কলকাতার লোকে বাড়ি ভাড়া দেয় নাকি? একমাস দু মাস দেয় তারপর যদ্দিন পারে থেকে অন্য বাড়িতে উঠে যায়–ঘর ভাড়া আদায় মোকদ্দমা করে।

    শ্যামা বিবৰ্ণ মুখে বলিল, আমার যে একটি পয়সা নেই ঠাকুরঝি? আমি যে ওই কটা টাকার ভরসা করছিলাম?

    মন্দা বলিল, জলে তো পড় নি?

    তারপর বলিল, বাড়িটা বেচে দিলেই পার তো বৌ? এত কষ্ট সয়ে ও বাড়ি রেখে করবে কি? থাকতেও তো পারছ না নিজে? টাকাটা হাতে এলে বরং লাগবে কাজে তারপর কপালে থাকে বাড়ি আবার হবে, না থাকে হবে না! দাদা বেরিয়ে এসে কিছু একটা করবে নিশ্চয়। নাও যদি করে বৌ, ছেলে তো উপযুক্ত হয়ে উঠবে তোমার বাড়ির টাকা শেষ হতে হতে–তখন আর তোমার দুঃখ কিসের?

    মুখখানা মন্দা ম্লান করিয়া আনিল, দুঃখের সঙ্গে বলিল, ও বাড়ি বেচতে বলতে আমার ভালো লাগছে ভেব না বৌ–-আমার বাপের ভিটে তো। কিন্তু কি করবে বল? নিরুপায় হলে মানুষকে সব করতে হয়?

    বাড়িটা বিক্রয় করিয়া ফেলার কথা শ্যামা ভাবিতেও পারে না। একটা বাড়ি না থাকিলে মানুষের থাকিল কি? দেশে একটা ভিটা থাকিলেও শহরতলির এই বাড়িটা সে বিক্রয় করিয়া ফেলিতে পারি, কিন্তু দেশ পর্যন্ত কি শ্যামার আছে। যে গ্রামে সে জন্মিয়াছিল তার কথা ভালো। করিয়া মনেও নাই। মামার ভিটেখানা নিজের মনে করিয়াছিল, বেচিয়া দিয়া মামা নিরুদ্দেশ হইয়া গেল। স্বামীর ওই একরত্তি বাড়িটুকু সে পাইয়াছে, বুকের রক্ত জল করা টাকায় বাড়ির সংস্কার করিয়াছে, আজ তাও সে বিক্রি করিয়া দিবে? ও-বাড়ির ঘরে ঘরে জমা হইয়া আছে তাহার বাইশ বছরের জীবন, ওইখানে সে ছিল বধূ, ছিল জননী, চারিটি সন্তানকে প্রসব করিয়া ওইখানে সে বড় করিয়াছে, ও বাড়ির প্রত্যেকটি ইট যে তার চেনা, দেয়ালের কোথায় কোন পেরেকের গর্তে কবে সে চুন লেপিয়া দিয়াছিল তাও যে তার স্মরণ আছে। পরের হাতে বাড়ি ছাড়িয়া দিয়া আসিতে তার মন যে কেমন করিয়াছিল, জগতে কে তাহা জানিবে! হায়, ও-বাড়ির প্রত্যেকটি ইটের জন্য শ্যামার যে অপত্যস্নেহ!

    অথচ এদিকেও আর চলে না। নাই বলিয়া শ্যামার হাতে কিছুই যে নাই, অপরে তাহা বিশ্বাস করে না, শ্যামাও মুখ ফুটিয়া বলিতে পারে না, বকুলের জমানো একটি চকচকে আধুলি ছাড়া আর একটি তামার পয়সাও তাহার নাই। মাসকাবারে সুপ্ৰভা গোপনে বিধানের স্কুলের মাহিনাটা দিয়া দিল, চাহিলে সুপ্রভার কাছে আরো কিছু হয়তো পাওয়া যাইত, শ্যামার চাহিতে লজ্জা করিল। এবার বড় শীত পড়িয়াছে। বিধানের গরম জামা গতবার ছোট হইয়া গিয়াছিল, ছেলেটা হু হু করিয়া বড় হইয়া উঠিতেছে, এ-বছর নূতন একটা জামা কিনিয়া দিতে পারিলে ভালো হইত। আলোয়ানটাও তাহার ছিড়িয়া গিয়াছে। ওদের বেশ-ভূষা চাহিয়া দেখিতে শ্যামার চোখে জল আসে। বাড়িবার। মুখে বছর বছর ওদের পোশাক বদলানো দরকার, পুরোনো সেলাইকরা আঁটো জামা পরিয়া ওদের ভিখারির সন্তানের মতো দেখায়, শুধু সাবান দিয়া জামাকাপড়গুলি আর যেন সাফ হইতে চায় না, কেমন লালচে রং ধরিয়া যায়। পূজার সময় রাখাল ওদের একখানি তঁতের কাপড় দিয়াছিল, মানাইয়া পরা চলে এমন জামা নাই বলিয়া বিধান লজ্জায় সে কাপড় একদিনও পরে নাই।

    মনটা শ্যামা ঠিক করিতে পারে না। মন্দার কথাগুলি মনের মধ্যে ঘুরিতে থাকে। রাখালের সঙ্গে একদিন সে এ বিষয়ে পরামর্শ করিল। রাখালও বাড়িটা বিক্রি করার পরামর্শই দিল। বলিল, বাড়ি ভাড়া দিবার হাঙ্গামা কি সহজ। অর্ধেক বছর বাড়ি হয়তো খালিই পড়িয়া থাকিবে, ভাড়াটে জুটিলেও ভাড়া যে নিয়মিত পাওয়া যাইবে তারও কোনো মানে নাই, একেবারে না পাওয়াও অসম্ভব নয়। তারপর বাড়ির পিছনে খরচ নাই? পুরোনো বাড়ি, মাঝে মাঝে মেরামত করিতে হইবে, বছর। বছর চুনকাম করিয়া না দিলে ভাড়াটে থাকিবে না, ড্রেন নেওয়া হইয়াছে শ্যামার বাড়িতে? এবার হয়তো ড্রেন না লইলে কর্পোরেশন ছাড়িবে না, সে অনেক খরচের কথা, শ্যামা কোথা হইতে খরচ করিবে?

    বাড়ি পোষা, হাতি পোর সমান বৌঠান, বাড়ি তুমি ছেড়ে দাও।

    বিধান রাত প্রায় এগারটা অবধি পড়ে, বকুল মণি ওরা ঘুমাইয়া পড়ে অনেক আগে। সেদিন। রাত্রে শ্যামা বিধানকে বলিল, খোকা, সবাই যে বাড়ি বিক্রি করে দিতে বলছে বাবা?

    বিধানের সঙ্গে শ্যামা আজকাল নানা বিষয়ে পরামর্শ করে, ভবিষ্যতের কত জল্পনা-কল্পনা যে তাদের চলে তাহার অন্ত নাই! বিধান বলে, বড় হইয়া সে সমস্ত চাকরি করিবে, তারপর শঙ্করের মতো একটা মোটর কিনিবে। শঙ্করের মোটর? শীতলের জেল হইবার পর শঙ্করের মোটরে তার যে স্কুলে যাওয়া বন্ধ হইয়াছিল…সে অপমান বিধান কি মনে করিয়া রাখিয়াছে? রাত জাগিয়া তাই এত ওর পড়াশোনা? শীতলের কথা বিধান কখনো বলে না। পড়া শেষ করিয়া ছেলে শুইতে আসিলে শ্যামা কতদিন প্রতীক্ষা করিয়াছে, চুপি চুপি বিধান হয়তো জিজ্ঞাসা করিবে, বাবা কবে ছাড়া পাবে মা? কিন্তু কোনোদিন বিধান এ প্রশ্ন করে না। যে তীব্ৰ অভিমান ওর, হয়তো বাপের জেল হওয়ার লজ্জা ওকে মূক করিয়া রাখে, পরের বাড়ি তারা যে এভাবে পড়িয়া আছে, এজন্য বাপকে দোষী করিয়া মনে হয়তো ও নালিশ পুরিয়া রাখিয়াছে।

    আলোটা নিবাইয়া শ্যামা বিধানের মাথার কাছে লেপের মধ্যে পা ঢুকাইয়া বসে। একপাশে ঘুমাইয়া আছে বকুল, মণি ও ফণী। এপাশে অবোধ বালক বুকে ক্ষোভ ও লজ্জা পুরিয়া এত রাত্রে জাগিয়া আছে। শ্যামা ছেলের বুকে একখানা হাত রাখে। বেড়ার ফুটা দিয়া জ্যোত্যার কতকগুলি রেখা ঘরের ভিতরে আসিয়া পড়িয়াছে। বাগানে শিয়ালগুলি ডাক দিয়া নীরব হইল। বেড়ার ব্যবধান পার হইয়া পাশের ঘরে রাখালের মামাতো বোন রাজবালার স্বামীর সঙ্গে ফিসফিস কথা শোনা যায়, রাজবালার স্বামী আদালতে পঁচিশ টাকায় চাকরি করে। পঁচিশ টাকায় অত ফিসফিস কথা? শ্যামার স্বামী মাসে তিন শ টাকাও রোজগার করিয়াছে, নিজের বাড়িতে নিজের পাকা শয়নঘরে স্বামীর সঙ্গে অত কথা শ্যামা বলে নাই। আর ওই চাপা হাসি? শ্যামা শিহরিয়া ওঠে।

    কদিন পরে শ্যামার বাড়ি-বিক্রয়-সমস্যার মীমাংসা হইয়া গেল। হারান ডাক্তার মনিঅৰ্ডারে পঁচিশটা টাকা পাঠাইয়া লিখিলেন, বাড়িতে তিনি নূতন ভাড়াটে আনিয়াছেন, তার পরিচিত লোক। ভাড়া আদায় করিয়া মাসে মাসে তিনিই শ্যামাকে পাঠাইয়া দিবেন।

    শ্যামার মুখে হাসি ফুটিল। পঁচিশ টাকা? পাঁচ টাকা ভাড়া বাড়িয়াছে? এখন তাহার রাজবালার স্বামীর সমান উপার্জন! কপাল হইতে কয়েকটা দুশ্চিন্তার চিহ্ন এবার মুছিয়া ফেলা চলে।

     

    মাসখানেক পরে একদিন সকালে কোথা হইতে শঙ্কর আসিয়া হাজির। গায়ে রেজারের কোট, তলায় স্ট্রাইপ দেওয়া শার্ট, পরনে শান্তিপুরের ধুতি, পায়ে মোজা, কলিকাতায় বোঝা যাইত না, এখানে তাহাকে শ্যামার ভারি বাবু মনে হইল, রাখালের এই বাড়িতে। শ্যামা রধিতেছিল, পরনের কাপড়খানা তাহার ঘেঁড়া হলুদমাখা, হাতে দুটি শাখা ছাড়া কিছু নাই। কলিকাতা হইতে কে একটা। ছেলে তার সঙ্গে দেখা করতে আসিয়াছে শুনিয়া সে কি ভাবিতে পারিয়াছিল সে শঙ্কর! শঙ্কর কেন বনগাঁ আসিবে?

    শ্যামাকে শঙ্কর প্রণাম করিল। শ্যামার গর্বের সীমা রহিল না। মোটা হলুদমাখা ঘেঁড়া কাপড় পরনে? কি হইয়াছে তাহাতে! সুপ্রভা, মন্দা, রাজবালা সকলের কৌতূহলী দৃষ্টির সামনে রাজপুত্র প্ৰণাম তো করিল তাহাকে। খুশি হইয়া শ্যামা বলিল, ষাট ষাট, বেঁচে থাক বাবা, বিদ্যাদিগ্গজ হও! কি আবেগ শ্যামার আশীর্বচনে! শঙ্করের মুখ লজ্জায় রাঙা হইয়া গেল।

    তারপর শ্যামা জিজ্ঞাসা করিল, বনগাঁ এসেছ কেন শঙ্কর?

    শঙ্কর বলিল, ক্রিকেট খেলতে এসেছি মাসিমা, এখানকার স্কুলের সঙ্গে আমাদের স্কুলের ম্যাচ!

    শ্যামা, বিধান, মণি সকলেই শঙ্করকে দেখিয়া খুশি হইয়াছে। অভিমান করিয়াছে বকুল। পুজোর সময় আসব বলে এখন বাবু এলেন, বলিয়া সে মুখ ভার করিয়া আছে। কবে শঙ্কর বকুলের কাছে প্রতিজ্ঞা করিয়াছিল পুজোর সময় সে বনগাঁ আসিবে সে খবর কেহ রাখিত না, বকুলের কথায় বড়রা হাসে, শঙ্কর শ্যামার দিকে চাহিয়া সলজ্জভাবে কৈফিয়ত দিয়া বলে, পুজোর সময় মধুপুরে গেলাম যে আমরা!—তোকে চিঠি লিখি নি বিধান সেখানে থেকে?

    বকুল অর্ধেক ক্ষমা করিয়া বলে, তোমার জিনিসপত্র কই?

    শঙ্কর বলে, বোর্ডিঙে আমাদের থাকতে দিয়েছে, সেখানে রেখেছি।

    বকুল বলে, বোর্ডিং কি জন্যে, আমাদের বাড়ি থাক না?

    শঙ্কর মুখ নিচু করিয়া একটু হাসে। শ্যামা তাকায় মন্দার দিকে।

    শঙ্করকে এখানে থাকার নিমন্ত্রণ জানায় কিন্তু সুপ্রভা। প্রথমে শঙ্কর রাজি হয় না, ভদ্রতার ফাকা ওজর করে, কলিকাতার ছেলে সে, ওসব কায়দা তার দুরস্ত। শেষে সুপ্রভার হাসি ও মিষ্টি কথার কাছে পরাজয় মানিয়া সে আতিথ্য স্বীকার করে। লজ্জার যে আবরণটি লইয়া সে এ-বাড়িতে ঢুকিয়াছিল ক্ৰমে ক্ৰমে তাহা খসিয়া যায়, কানু ও কালুর সঙ্গে তাহার ভাব হয়, বিধানের পড়ার ঘরে খানিক হৈচৈ করিয়া উঠানে তাহারা মার্বেল খেলে, তারপর স্কুলের বেলা হইলে স্নান করিতে যায় পুকুরে। শ্যামা বারণ করিয়া বলে, সাঁতার জান না, তুমি পুকুরে যেও না শঙ্কর। জল তুলে এনে দিক, তুমি ঘরে স্নান কর।

    শঙ্কর বলিয়া যায়, বেশি জলে যাব না মাসিমা।

    তবু শ্যামার বড় ভয় করে। বিধান, বকুল, মণি এরা সাঁতার শিখিয়াছে, কালু ও কানু তো পাকা সাঁতারু, পুকুরের জল তোলপাড় করিয়া ওরা স্নান করিবে, উৎসাহের মাথায় শঙ্করের কি খেয়াল থাকিবে সে সাঁতার জানে না? বাড়ির একজন চাকরকে সে পুকুরে পাঠাইয়া দেয়। খানিক পরে হৈচৈ করিতে করিতে সকলে ফিরিয়া আসে, শঙ্কর আসে বিধান ও চাকরটার গায়ে ভর দিয়া এক পায়ে খেড়াইতে খেড়াইতে। শামুকে না কিসে শঙ্করের পা কাটিয়া দরদর করিয়া রক্ত পড়িতেছে।

    বকুল দুরন্ত দুঃসাহসী মেয়ে, বকিলে, মারিলে, ব্যথা পাইলে সে কাদে না কিন্তু রক্ত দেখিলে সে ভয় পায়, ধুলা-কাদা ধুইয়া শ্যামা যতক্ষণ শঙ্করের পা বাধিয়া দেয় সে হাউ হাউ করিয়া কাঁদিতে থাকে।

    মন্দা ধমক দিয়া বলে, তোর পা কেটেছে নাকি, তুই অত কাঁদছিস কি জন্যে? কেঁদে মেয়ে একেবারে ভাসিয়ে দিলেন!

    শঙ্কর বলে, কেঁদ না বুকু, বেশি কাটে নি তো!

    আগে বিধান হয়তো শঙ্করের জন্য অনায়াসে সাতদিন স্কুল কামাই করিত, এখন পড়াশোনার চেয়ে বড় তার কাছে কিছু নাই, সে স্কুলে চলিয়া গেল! কানু ও কালু কোনো উপলক্ষে স্কুল কামাই। করিতে পারিলে বাঁচে, অতিথির তদ্বিরের জন্য বাড়িতে থাকিতে তারা রাজি ছিল, মন্দার জন্য পারিল না। স্কুলে গেল না শুধু বকুল। সারা দুপুর এক মুহূর্তের জন্যে সে শঙ্করের সঙ্গ ছাড়িল না। এ যেন তার বাড়িঘর, শঙ্কর যেন তারই অতিথি, সে ছাড়া আর কে শঙ্করকে আপ্যায়িত করিবে! ফণীকে ঘুম পাড়াইয়া তাহার অবিশ্ৰাম বকুনি শুনিতে শুনিতে শ্যামার চোখও ঘুমে জড়াইয়া আসে, বকুলের মুখে যেন ঘুমপাড়ানি গান। বাড়ির কারোর সঙ্গে ও মেয়েটার স্নেহের আদান-প্রদান নাই, কারো সোহাগ মমতায় ও ধরাছোঁয়া দেয় না, অনুগ্রহের মতো করিয়া সুপ্রভার ভালবাসাকে একটু যা গ্রহণ করে, শঙ্করের সঙ্গে এত ওর ভাব হইল কিসে, পরের ছেলে শঙ্কর? এক তার পাগল ছেলে বিধান, আর এক পাগলী মেয়ে বকুল, মন ওদের বুঝিবার যো নাই। শ্যামা যে এত করে মেয়েটার জন্য, দু মিনিট ওর অদ্ভুত অনর্গল বাণী শুনিবার জন্য লুব্ধ হইয়া থাকে, কই শ্যামার সঙ্গে কথা তো বকুল বলে না? কাছে টানিয়া আদর করিতে গেলে মেয়ে ছটফট করে, জননীর দুটি স্নেহব্যাকুল বাহু যেন ওকে দড়ি দিয়া বাধে। জগতে কে কবে এমন মেয়ে দেখিয়াছে?

    শ্যামা একটা হাই তোলে। জিজ্ঞাসা করে, হ্যাঁ, শঙ্কর। আমাদের বাড়ির দিকে কখনন যাও টাও বাবা? হারান ডাক্তার ভাড়াটে এনে দিলেন, তার নামটাও জানি নে।

    শঙ্কর বলে, ভাড়াটে কই, কেউ আসে নি তো? সদর দরজায় তালা বন্ধ।

    শ্যামা হাসিল, তুমি জান না শঙ্কর—এক মাসের ওপর ভাড়াটে এসেছে, পঁচিশ টাকা ভাড়া দিয়েছে, ওদিকে তুমি যাও নি কখনো।

    শঙ্কর বলে, না মাসিমা, আপনাদের বাড়ি খালি পড়ে আছে, কেউ নেই বাড়িতে। জানালা কপাট বন্ধ, সামনে বাড়ি ভাড়ার নোটিশ ঝুলছে—আমি কদ্দিন দেখেছি।

    শ্যামা অবাক হইয়া বলে, তবে কি ভাড়াটে উঠে গেল?

    আপনি যাদের ভাড়া দিয়েছিলেন তারা যাবার পর কেউ আসে নি মাসিমা। আমি যাই যে। মাঝে মাঝে নকুবাবুর বাড়ি, আমি জানি নে?–শঙ্কর হাসে, ভাড়াটে এলে কি বাইরে তালা দিয়ে লুকিয়ে থাকত?।

    হারান তবে ছুতা করিয়া তাহাকে অর্থ সাহায্য করিতেছে? হারানের কাছে কোনোদিন টাকা সে চাহে নাই, কেবল ভাড়াটে উঠিয়া যাওয়া উপলক্ষে হারানকে সেই যে সে চিঠি লিখিছিল, সেই চিঠিতে দুঃখের কাপুনি গাহিয়াছিল অনেক। তাই পড়িয়া হারান তাহাকে পঁচিশ টাকা পাঠাইয়া। দিয়াছে, যতদিন বাড়িতে তাহার ভাড়াটে না আসে, মাসে মাসে নিজেই তাহাকে এই টাকাটা দেওয়া ঠিক করিয়াছে হারান? সংসারে আত্মীয় পর সত্যই চেনা যায় না। শ্যামা কে হারানের? শ্যামার মতে দুঃখিনীর সংস্রবে হারানকে সর্বদা আসিতে হয়, শ্যামার জন্য এত তার মমতা হইল। কেন?

    তিন দিন পরে শঙ্কর কলিকাতা চলিয়া গেল। এই তিন দিন সে ভালো করিয়া হাঁটিতে পারে। নাই, ঘরের মধ্যে সে বন্দি হইয়া থাকিয়াছে। মজা হইয়াছে বকুলের। বাড়ির ছেলেরা বাহিরে চলিয়া গেলে একা সে শঙ্করকে দখল করিতে পারিয়াছে। শঙ্কর চলিয়া গেলে কদিন বকুল মনমরা হইয়া রহিল।

    তিন-চারদিন পরে হারানের মনিঅৰ্ডার আসিল। সই করিয়া টাকা নেওয়ার সময় শ্যামার মনে হইল গভীর ও গোপন একটি মমতা দূর হইতে তাহার মঙ্গল কামনা করিতেছে, স্বার্থ ও বিদ্বেষ ভরা এই জগতে যার তুলনা নাই। দুঃখের দিনে কোথায় রহিল সেই বিষ্ণুপ্রিয়া, স্বামীর পাপের ছাপমারা সন্তান গর্ভে লইয়া একদিন যে ভিখারিনীর মতো জননী শ্যামার সখ্য চাহিয়াছিল? যার এক মাসের পেট্রোল খরচ পাইলে সন্তানসহ শ্যামা দু মাস বাঁচিয়া থাকিতে পারি?

    টাকার প্রাপ্তি সংবাদ দিয়া হারানকে সে একখানা পত্ৰ লিখিল। হারানের ছল সে যে ধরিতে পারিয়াছে সে সব কিছু লিখিল না, লিখিল আর জন্মে সে বোধহয় হারানের মেয়ে ছিল, হারান তার জন্য যা করিয়াছে এবং করিতেছে জীবনে কখনো কি শ্যামা তাহা ভুলিবে? এমনি আবেগপূর্ণ অনেক। কথাই শ্যামা লিখিল।

    হারান জবাবও দিল না!

    না দিক। শ্যামা তো তাহাকে চিনিয়াছে। শ্যামার দুঃখ নাই।

     

    শীতলের সঙ্গে শ্যামার যোগসূত্র শীতলের কয়েদ হওয়ার গোড়াতেই ছিন্ন হইয়া গিয়াছিল, জেলে গিয়া কখনো সে শীতলের সঙ্গে দেখা করে নাই, চিঠিপত্রও লেখে নাই। কোথায় কোন জেলে শীতল আছে তাও শ্যামা জানে না। আগে জানিবার ইচ্ছাও হইত না! এখন শীতলের ছাড়া পাওয়ার সময় হইয়া আসিয়াছে। সে কোথায় আছে, কবে খালাস পাইবে মাঝে মাঝে শ্যামার। জানিতে ইচ্ছা হয়। কিন্তু জানিবার চেষ্টা সে করে না। শীতলকে কাছে পাইবার বিশেষ আগ্রহ শ্যামার নাই। সব সময় সে যে স্বামীর উপর রাগ ও বিদ্বেষ অনুভব করে তাহা নয়, বরং কোথায় লোহার শিকের অন্তরালে পাথর ভাঙিয়া সে মরিতেছে ভাবিয়া সময় সময় মমতাই সে বোধ করে, তবু মনে তাহার কেমন একটা ভয় জন্মিয়া গিয়াছে। শীতল ফিরিয়া আসিলে আবার সে দারুণ কোনো বিপদে পড়িবে। তা ছাড়া ব্যস্ত হইয়া লাভ কি; ছাড়া পাইলে স্ত্রী-পুত্রকে শীতল খুঁজিয়া লইবে নাকি?

    বেশ শান্তিতে আছে সে। নাইবা রহিল তাহার নিজের বাড়িতে থাকিবার আনন্দ, আর্থিক সচ্ছলতার সুখ? এখানে ছেলেমেয়েদের শরীর ভালো আছে, বিধানের অদ্ভুত পড়াশোনার ফল ফলিতেছে, স্কুলের হেডমাস্টার নিজে রাখালকে বলিয়াছেন বিধানের মতো ছেলে ক্লাসে দুটি নাই। শ্যামা আবার আশা করিতে পারে, ধূসর ভবিষ্যতে আবার রঙের ছাপ লাগিতে থাকে। নাইবা রহিল তাহার নিকট আশা ভরসা, একদিন ছেলে তাহাকে সুখী করিবে।

    কেবল পড়িয়া পড়িয়া বিধান রোগা হইয়া যাইতেছে, এত ও রাত জাগিয়া পড়ে! যেমন। পরিশ্রম করে তেমনি খাওয়া ছেলেটা পায় না। পরের বাড়িতে কেইবা হিসাব করে যে একটা ছেলে দিবারাত্রি খাটিতেছে একটু ওর ভালোমতো খাওয়া পাওয়া দরকার, দুধ-ঘির প্রয়োজন ওর সবচেয়ে বেশি? শ্যামা কি করিবে? চাহিয়া চিন্তিয়া চুরি করিয়া যতটা পারে ভালো জিনিস বিধানকে খাওয়ায়, কিন্তু বেশি বাড়াবাড়ি করিতে সাহস পায় না। এ আশ্ৰয় ঘুচিয়া গেলে তার তো উপায়। থাকিবে না।

    মন্দা যখন চেঁচামেচি করিতে থাকে : একি কাণ্ড বাবা এ বাড়ির, ভূতের বাড়ি নাকি এটা, সন্দেশ করে পাথরের বাটি ভরে রাখলাম বাটি অর্ধেক হল কি করে? এ কাজ মানুষের, বড় মানুষের, বিড়ালেও নেয় নি, ছেলেপিলেও খায় নি–নিয়ে দিব্যি আবার আপরে-থুপরে সমান করে রাখার বুদ্ধি ছেলেপিলের হবে না–শ্যামার বুকের মধ্যে তখন টিপঢিপ করে। অর্ধেক? অর্ধেক তো সে নেয় নাই! যৎসামান্য নিয়াছে। মন্দা টের পাইল কেমন করিয়া?

    সুপ্রভা বলে, অমন করে বোলো না দিদি, লক্ষ্মী যে নিয়েছে, খাবার জিনিস নিয়েছে তো, বড় লজ্জা পাবে দিদি।

    মন্দা বলে, তুই অবাক কলি বোন, চোর লজ্জা পাবে বলে বলতে পারব না চুরির কথা?

    সুপ্ৰভা মিনতি করিয়া বলে, বলে আর লাভ কি দিদি? এবার থেকে সাবধানে রেখ।

     

    তবু শ্যামা পরিশ্রমী সন্তানের জন্য খাদ্য চুরি করে। দুধ জাল দিতে গিয়া সুযোগ পাইলেই দুধে সরে খানিকটা লুকাইয়া ফেলে, দুধ গরম করিলে সর তো যায় গলিয়া, টের পাইবে কে? ব্রাধিতে রাঁধিতে দুখানা মাছভাজা শ্যামা শালপাতায় জড়াইয়া কাপড়ের আড়ালে গোপন করে, ঘরে গিয়া কখন সে তাহা লুকাইয়া আসে কে জানিবে? এমনি সব ছোট ছোট চুরি শ্যামা করে, গোপনে চুরি করা খাবার বিধানকে খাওয়ায়। একবার খানিকটা গাওয়া ঘি যোগাড় করিয়া সে বড় মুশকিলে। পড়িয়ছিল। রাখালের ছেলেমেয়ে ছাড়া আর সকলকে একসঙ্গে বসিয়া খাইতে হয়, আগে অথবা পরে। একা খাইলেও রান্নাঘরে খাইতে হয় ভাত, দাওয়ায় খাইতে হয় জলখাবার, সকলের চোখের সামনে। কেমন করিয়া ঘিটুকু ছেলেকে খাওয়াইবে শ্যামা ভাবিয়া পায় নাই। বলিয়াছিল, এমনি একটু একটু খেয়ে ফেল না খোকা, পেটে গেলেই পুষ্টি হবে।

    তাই কি মানুষ পারে, কাঁচা ঘি শুধু খাইতে?

    শেষে মুড়ির সঙ্গে মাখিয়া দিয়া একটু একটু করিয়া শ্যামা ঘিটুকুর সদ্গতি করিয়াছিল।

    খোকার তখন বাৎসরিক পরীক্ষা চলিতেছে, একদিন সকালে শ্যামাকে ডাকিয়া রাখাল বলিল, জান বৌঠান, শীতলবাবু তো খালাস পেয়েছেন আট-দশদিন হল। নকুবাবু পত্র লিখেছেন। তোমাদের কলকাতার বাড়িতে এসেই নাকি আছে, দিনরাত ঘরে বসে থাকে, কোথাও যায়টায় না–

    পত্ৰখানা দেখি ঠাকুরজামাই?

    নকুবাবু লিখিয়াছেন, শীতলের চেহারা কেমন পাগলের মতো হইয়া গিয়াছে, বোধহয় সে কোনো অসুখে ভুগিতেছে, এতদিন হইয়া গেল কেহ তাহার খোঁজখবর লইতে আসিল না দেখিয়া জ্ঞাতার্থে এই পত্র লিখিলাম।

    রাখাল বলিল, তোমাদের বাড়িতে না ভাড়াটে আছে বৌঠান? শীতলবাবু ওখানে আছেন কি করে?

    কি জানি ঠাকুরজামাই, কিছু বুঝতে পারছি না। আপনি একবার যান না কলকাতা?

    কথাটা এখানে প্রকাশ করিতে শ্যামা রাখালকে বারণ করিয়া দিল। বিধান পরীক্ষা দিতেছে, এখন এই সংবাদ পাইলে হয়তো সে উত্তেজিত হইয়া উঠিবে, ভালো লিখিতে পারিবে না—বছরকার পরীক্ষা সহজ তো নয় ঠাকুরজামাই, এখন কি ওকে ব্যস্ত করা উচিত?

    পাগলের মতো চেহারা হইয়া গিয়াছে? অসুখে ভুগিতেছে? বিধানের পরীক্ষা না থাকিলে শ্যামা নিজে দেখিতে যাইত। কিন্তু এখানে শীতল আসিল না কেন? লজ্জায়? কি অদৃষ্ট মানুষটার! দু বছর। জেল খাটিয়া বাহির হইয়া আসিল, ছেলেমেয়ের মুখ দেখিবে, স্ত্রীর সেবা পাইবে, তার বদলে খালি বাড়িতে মুখ লুকাইয়া একা অসুখে ভুগিতেছে। এত লজ্জাই-বা কিসের? আত্মীয়স্বজনকে মুখ কি দেখাইতে হইবে না?

    শনিবারের আগে রাখালের কলিকাতা যাওয়ার উপায় ছিল না। দুদিন ধরিয়া শ্যামা তাহার দুর্ভাগা স্বামীর কথা ভাবিল। ভাবিতে ভাবিতে আসিল মমতা।

    শ্যামা কি জানিত নকুবাবুর চিঠির কথাগুলি যে ছবি তাহার মনে আঁকিয়া দিয়াছিল পরীক্ষার ব্যস্ত সন্তানের মুখের দিকে চাহিয়া থাকিবার সময়ও তাহা সে ভুলিতে পারিবে না, এত সে গভীর বিষাদ বোধ করিবে? শনিবার রাখালের সঙ্গে সে কলিকাতা রওনা হইল। সঙ্গে লইল শুধু ফণীকে। বিধানকে বলিয়া গেল সে বাড়িটা দেখিয়া আসিতে যাইতেছে, কলি ফেরানোর ব্যবস্থা করিয়া আসিবে, যদি কোনো মেরামতের দরকার থাকে তাও করিয়া আসিবে।

    —আমার কথা ভেব না বাবা, ভালো করে পরীক্ষা দিও, কেমন? ছোট পিসির কাছে খাবার চেয়ে খেও? আর বকুলকে যেন মের না খোকা।

     

    বাড়ি পৌঁছিতে সন্ধ্যা পার হইয়া গেল। সদর দরজা বন্ধ, ভিতরে আলো জ্বলিতেছে কিনা বোঝা যায় না, শীতের রাত্রে সমস্ত পাড়াটাই স্তব্ধ হইয়া আছে, তার মধ্যে শ্যামার বাড়িটা যেন আরো নিঝুম। অনেকক্ষণ দরজা ঠেলাঠেলির পর শীতল আসিয়া দরজা খুলিল। রাস্তার আলোতে তাকে দেখিয়া শ্যামা কাঁদিয়া ফেলিল। চোখ মুছিয়া ভিতরে ঢুকিয়া সে দেখিল চারিদিকে অন্ধকার, একটা আলোও কি শীতল জ্বালায় না সন্ধ্যার পর? ফণী ভয়ে তাহাকে সবলে আঁকড়াইয়া ধরিয়াছিল, অন্ধকার বারান্দায় দাঁড়াইয়া শ্যামা শিহরিয়া উঠিল। এমনি সন্ধ্যাবেলা একদিন সে এখানে প্রথম স্বামীর ঘর করিতে আসিয়াছিল, সেদিনও এমনি ছাড়াছাড়ির আবহাওয়া তাহার নিশ্বাস রোধ করিয়া দিতেছিল, সেদিনও তাহার কান্না আসিতেছিল এমনিভাবে। শুধু, সেদিন বারান্দায় জ্বালানো ছিল টিমটিমে একটা লণ্ঠন।

    শীতল বিড়বিড় করিয়া বলিল, মোমবাতি ছিল, সব খরচ হয়ে গেছে।

    রাখাল গিয়া মোড়ের দোকান হইতে কতকগুলি মোমবাতি কিনিয়া আনিল। এই অবসরে শ্যামা হাতড়াইয়া হাতড়াইয়া ঘরে গিয়া বসিয়াছে, বাহিরে বড় ঠাণ্ডা। শীতলকে দুটো-একটা কথাও সে জিজ্ঞাসা করিয়াছে, প্রায় অবান্তর কথা, জ্ঞাতব্য প্রশ্ন করিতে কি জানি শ্যামার কেন ভয় করিতেছিল। ভিতরে ঢুকিবার আগে রাস্তার আলোতে শীতলের পাগলের মতো মূৰ্তি দেখিয়া শ্যামা তো কাঁদিয়াছিল, অন্ধকার ঘরে সে বেদনা কি ভয়ে পরিণত হইয়াছে?

    রাখাল ফিরিয়া আসিয়া একটা মোমবাতি জ্বালিয়া জানালায় বসাইয়া দিল। ঘরে কিছু নাই, তক্তপোষের উপর শুধু একটা মাদুর পাতা, আর ময়লা একটা বালিশ। মেঝেতে একরাশ পোড়া বিড়ি আর কতকগুলি শালপাতা ছড়ানো। যে জামাকাপড়ে দু বছর আগে শীতল রাতদুপুরে পুলিশের সঙ্গে চলিয়া গিয়াছিল তাই সে পরিয়া আছে, কাপড় বোধহয় তাহার ওই একখানা, কি যে ময়লা হইয়াছে বলিবার নয়, রাত্রে বোধহয় সে শুধু আলোয়ানটা মুড়ি দিয়া পড়িয়া থাকে, চৌকির বাহিরে অর্ধেকটা এখন মাটিতে লুটাইতেছে। এসব তবুও যেন চাহিয়া দেখা যায়, তাকানো যায় না শীতলের মুখের দিকে। চোখ উঠিয়া মুখ ফুলিয়া বীভৎস দেখাইতেছে তাহাকে, হাড় কখানা ছাড়া শরীরে আর বোধহয় কিছু নাই।

    শীতল দাঁড়াইয়া থাকে, দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া সে কাঁপে তারপর সহসা শ্যামার কি হয় কে জানে, ফণীকে জোর করিয়া নামাইয়া দিয়া জননীর মতো ব্যাকুল আবেগে শীতলকে জড়াইয়া ধরিয়া টানিয়া আনে, শিশুর মতো আলগোছে শোয়াইয়া দেয় মাদুরে, বলে, এমন করে ভুগছ, আমাকে একটা খপরও তুমি দিলে না গো।

     

    পরদিন সকালে সে হারান ডাক্তারকে ডাকিয়া পঠাইল। হারানকে খবর দিলে পঁচিশ টাকা বাড়ি ভাড়া পাঠানোর ছলনাটুকু যে ঘুচিয়া যাইবে শ্যামা কি তা ভাবিয়া দেখিল না। ভাবিল বৈকি। রাত্রে কথাটা মনে মনে নাড়াচাড়া করিয়া সে দেখিয়াছে, হারানের মহৎ ছলনাকে বাচাইয়া রাখার জন্য হারানকে তার ছলনা করা উচিত নয়। সে যে এখানে আসিয়া জানিতে পারিয়াছে বাড়িতে তাহার ভাড়াটে আসে নাই, হারান দয়া করিয়া মাসে মাসে তাকে টাকা পাঠায় এটা হারানকে। জানিতে দেওয়াই ভালো। পরে যদি হারান জানিতে পারে শ্যামা কলিকাতা আসিয়াছিল? তখন কি হইবে? হারান কি তখন মনে করিবে না যে সব জানিয়াও টাকার লোভে শ্যামা চুপ করিয়া আছে?

    হারান আসিলে শ্যামা তাহাকে প্রণাম করিল। বলিল, ভালো আছেন বাবা আপনি? কাল। সন্ধ্যাবেলা এসে পৌছেছি আমি, আগে তো জানতে পারি নি কবে খালাস পেয়ে এখানে এসে পড়ে রয়েছে বিপদের ওপর কি যে আমার বিপদ আসছে বাবা, কোনোদিকে কূল-কিনারা দেখতে পাই নে। সমস্ত মুখ ফুলে গিয়েছে, শরীরে দারুণ জ্বর, ডাকলে ঢুকলে সাড়াও ভালো করে দেয় না। বাবা। শ্যামা চোখ মুছিতে লাগিল।

    হারান যেন অপরিবর্তনীয়, মাথার চুলে পাক ধরিবে দেহে বার্ধক্য আসিবে তবু সে কণামাত্র বদলাইবে না, বিধানের প্রথম অসুখের সময় দেখিতে আসিয়া যেমন নির্মমভাবে শ্যামাকে সে কাঁদতে বারণ করিয়াছিল, আজো তেমনিভাবে বারণ করিল। শ্যামার জীবনে রহস্যময় দুর্বোধ্য মানুষের পদার্পণ আরো ঘটিয়াছে বৈকি, গোড়ায় ছিল রাখাল, তারপর আসিয়াছে মামা তারাশঙ্কর, কিন্তু এই লোকটির সঙ্গে তাদের তুলনা হয় না, একে একে তাদের রহস্যের আবরণ খসিয়া গিয়াছে, হারান শুধু চিরকাল যবনিকার আড়ালে রহিয়া গেল। শ্যামাকে যদি সে স্নেহ করে, স্নেহের পাত্রীকে দেখিয়া একবিন্দু খুশি কি তাহার হইতে নাই? আজ হারান ডাক্তার শুধু রোগী দেখিতে আসার মতো শ্যামার বাড়ি আসিবে, আত্মীয় বলিয়া ধরা দিবে না?

    শীতলকে হারান অনেকক্ষণ পরীক্ষা করিল।

    বাহিরে আসিয়া রাখাল ও শ্যামাকে বলিল, কদ্দিন জ্বরে ভুগছে জানি নে বাবু আমি জিজ্ঞাসা করলে বলতে চায় না। অনেকদিন থেকে না খেয়ে শুকোচ্ছে সেটা বুঝতে পারি। তারপর লাগিয়েছে। ঠাণ্ডা। সব জড়িয়ে অবস্থা যা দাঁড়িয়েছে সারতে সময় নেবে-বড় ডাক্তার ডাকতে চাও ডাক আমি বারণ করি নে, কিন্তু, ডাক্তার ফাক্তার ডাকা মিছে তাও বলে রাখছি—এর সবচেয়ে দরকার বেশি সেবাযত্নের।

    বড় ডাক্তার? হারানের চেয়ে বড় ডাক্তার কে আছে শ্যামা লতা জানে না! শুনিয়া হারান খুশি হয়! বলে, দাও দিকি কাগজ কলম, ওষুধ লিখি। আর মন দিয়ে শোন যা যা বলে যাই, এতটুক এদিক ওদিক হলে চলবে না–টুকেই নাও না কথাগুলো আমার মনে যা থাকবে আমার জানা আছে।

    একে একে হারান বলিয়া যায়–ওষুধ, পথ্য, সেবার নির্দেশ। ঘড়ির কাঁটা ধরিয়া সময় বাধিয়া দেয়। বার বার সাবধান করে, এতটুকু এদিক ওদিক নয়, আটটায় যে ওষুধ দেওয়ার কথা, দিতে যেন আটটা বাজিয়া পাঁচ মিনিটও না হয়, যখন দু চামচ ফুড দেওয়ার কথা, তিন চামচ যেন তখন না পড়ে।

    শ্যামা ভয়ে ভয়ে বলে, কোনো ব্যবস্থাই তো নেই এখানে, খালি বাড়িতে এসে উঠেছি আমরা, বনগাঁ কি নিয়ে যাওয়া যাবে না?

    হারান যেন আনমনেই বলে, বনগাঁ? তা চল, বনগাঁতেই নিয়ে যাই—একটা দিন আমার নষ্ট হবে, হলে আর উপায় কি? জ্বর করে, না খেয়ে, ঠাণ্ডা লাগিয়ে কি কাণ্ডই বাধিয়ে রেখেছে হতভাগা। কটায় গাড়ি? দেড়টায়? তবে সময় আছে ঢের, যাও দিকি তুমি রাখাল ওষুধপত্রগুলি নিয়ে এস কিনে, আমি রোগী দেখে আসছি ঘুরে এগারটার মধ্যে।–দুটো পান আমায় দিতে পার ঘেঁচে? দোক্তা থাকে তো দিও খানিকটা।

    হারান বুড়া হইয়া গিয়াছে, পান চিবাইতে পারে না, হেঁচা পান খায়। কিন্তু হারান বদলায় নাই। বুড়া হইতে হইতে সে মরিয়া যাইবে, তবু বোধহয় বদলাইবে না। শ্যামা কি জানে না আত্মীয়তা করিয়া শীতলকে সে বনগাঁ পৌছাইয়া দিতে যাইতেছে না, যাইতেছে ডাক্তার হইয়া রোগীর সঙ্গেঃ শ্যামার বলার অপেক্ষা রাখে নাই। তা সে কোনো দিনই রাখে না। সেই প্রথমবার বিধানের অসুখের সময় জ্বরতপ্ত শিশুটিকে সে যে গামলার ঠাণ্ডা জলে ড়ুবাইয়াছিল সেদিনও সে শ্যামার বলার অপেক্ষা রাখে নাই। যা করা উচিত হারান তাই করে। হারানের স্নেহ নাই, আত্মীয়তা নাই, কোমলতা নাই, কতবার ভুল করিয়া শ্যামা ভাবিয়াছে হারান তাহাকে মেয়ের মতো ভালবাসে! তাই যদি সে বাসিবে তবে বাড়ি ভাড়ার নাম করিয়া টাকা শ্যামাকে সে পাঠাইবে কেন? সোজাসুজি পাঠাইতে কে তাকে বারণ করিয়াছিল? পরের দান গ্রহণ করিতে অন্য সকলের কাছে শ্যামা লজ্জা পাইবে, এই জন্য? হারানের মধ্যে ওসব দুর্বলতা নাই! কে কোথায় কি কারণে লজ্জা পাইবে হারান কি কখনো তা ভাবে? স্নেহ মনে করিয়া শ্যামা পাছে কাছে ঘেঁষিতে চায়, শ্যামা পাছে। মনে করে অযাচিত দানের পেছনে হারানের মমতার উৎস লুকাইয়া আছে, আত্মীয়তা দাবি করার সুযোগ পাছে শ্যামাকে দেওয়া হয়, তাই না হারান তাহার দানকে শ্যামার প্রাপ্য বলিয়া ঘোষণা করিয়াছিল।

     

    অভিমানে শ্যামার কান্না আসে। অভিমানে কান্না আসিবার বয়স তাহার নয়, তবু মনের মধ্যে আজো যে অবুঝ কাঁচা মেয়েটা লুকাইয়া আছে যে বাপের স্নেহ জানে নাই, অসময়ে মাকে হারাইয়াছে, ষোল বছর বয়স হইতে জগতে একমাত্র আপনার জন মামাকে খুঁজিয়া পায় নাই, স্বামীর ভয়ে দিশেহারা হইয়া থাকিয়াছে, সে যদি আজ কাঁদিতে চায় প্রৌঢ়া শ্যামা তাহাকে বারণ করিতে পারিবে কেন?

    তাহারা বনগাঁয়ে পৌঁছিলে মন্দা শীতলকে দেখিয়া একটু কাঁদিল, তারপর তাড়াতাড়ি তার জন্য বিছানা পাতিয়া দিল, এদিক ওদিক ছোটাছুটি করিয়া ভারি ব্যস্ত হইয়া পড়িল সে, সেবাযত্নের ব্যবস্থা করিল, ছেলেমেয়েদের সরাইয়া দিল, শ্যামাকে বলিতে লাগিল, ভেব না তুমি বৌ, ভেব না—ফিরে যখন পেয়েছি দাদাকে ভালো করে আমি তুলবই।

    বকুল বিস্ফারিত চোখে শীতলকে খানিকক্ষণ চাহিয়া দেখিল, তারপর সে যে কোথায় গেল। কেহ আর তাহাকে খুঁজিয়া পায় না। হারান ডাক্তারকেও নয়! কোথায় গেল দুজনে? শেষে সুপ্ৰভাই তাদের আবিষ্কার করিল বাড়ির পিছনে ঢেঁকিঘরে। ওঘরে বকুল খেলাঘর পাতিয়াছে? টেকিটার উপরে পাশাপাশি বসিয়া গম্ভীর মুখে কি যে তাহারা আলোচনা করিতেছিল তাহারাই জানে, সুপ্ৰভা দেখিয়া হাসিয়া বঁচে না। ডাক্তার নাকি বুড়া? জগতে এত জায়গা থাকিতে, কথা বলিবার এত লোক থাকিতে, বুড়া ঢেঁকিঘরে বসিয়া আলাপ করিতেছে বকুলের সঙ্গে।

    যা তো খোকা ডেকে আন ওদের। বুড়োকে বল মুখ-হাত ধুয়ে নিতে–খেতে-টেতে দিই। ততার বাবা কি খাবে তাও তত বলে দিলে না, ঢেঁকিঘরে গিয়ে বসে রয়েছে?

    হারান আসে, মুখ-হাত ধোয়, সুপ্ৰভা ঘোমটা টানিয়া তাহাকে জলখাবার দেয়। বকুল কিন্তু ঢেঁকিঘরেই বসিয়া থাকে। সুপ্রভা গিয়া বলে, ও বুকু, খাবি নে তুই? ততার বাবা এল, তুই এখানে বসে আছিল?

    ও আমার বাবা নয়।

    শোন কথা মেয়ের?–সুপ্রভা হাসে, আয়, চলে আয় আমার সঙ্গে, একলাটি এখানে তোক বসে থাকতে হবে না।

     

    রাত্রিটা এখানে থাকিয়া পরদিন সকালে হারান কলিকাতা চলিয়া গেল। শ্যামা সাবধান হইয়া। গিয়াছিল, হারানকে অতিরিক্ত আত্মীয়তা জানাইবার কোনো চেষ্টাই সে করিল না। যাওয়ার সময় শুধু ঘটা করিয়া প্ৰণাম করিয়া বলিল, মেয়েকে ভুলবেন না বাবা!।

    খুব ধীরে ধীরে শীতল আরোগ্য লাভ করিতে লাগিল। সে নিঝুম নিশ্চুপ হইয়া গিয়াছে। আপন হইতে কথা সে একেবারেই বলে না, অপরে বলিলে কখনো দু-এক কথায় জবাব দেয়, কখনো কিছু বলে না। কেহ কথা বলিলে বুঝিতে যেন তাহার দেরি হয়। ক্ষুধা তৃষ্ণা বোধও যেন তাহার নাই, খাইতে দিলে খায়, না দিলে কখনো চায় না। চুপচাপ বিছানায় পড়িয়া থাকিয়া সে যে ভাবে তা তো নয়। এখানে আসিয়া কদিনের মধ্যে চোখ-ওঠা তাহার সারিয়া গিয়াছে, সব সময় সে শূন্য দৃষ্টিতে চাহিয়া থাকে। দু বছর জেল খাটিলে মানুষ কি এমনি হইয়া যায়? কবে ছাড়া পাইয়াছিল শীতল? কলিকাতার বাড়িতে আসিয়াই সে তো ছিল দশ-বার দিন, তার আগে? প্রথমে জিজ্ঞাসাবাদ করিয়া কিছু জানা যায় না। পরে অল্পে অল্পে জানা গিয়াছে, পনের-কুড়ি দিন কোথায় কোথায় ঘুরিয়া শীতল কলিকাতার বাড়িটাতে আশ্রয় লইয়াছিল। জানিয়া শ্যামার বড় অনুতাপ হইয়াছে। এই দারুণ শীতে একখানা আসোয়ান মাত্ৰ সম্বল করিয়া স্বামী তাহার এক মাসের উপর কপর্দকহীন অবস্থায় যেখানে সেখানে কাটাইয়াছে। জেলে থাকিবার সময় শীতলের সঙ্গে সে যোগসূত্র রাখে নাই কেন? তবে তো সময়মতো খবর পাইয়া ওকে সে জেলের দেউড়ি হইতে সোজা বাড়ি লইয়া আসিতে পারি?

    প্রাণ দিয়া শ্যামা শীতলের সেবা করে। শ্ৰান্তি নাই, শৈথিল্য নাই, অবহেলা নাই। চারিটি সন্তান শ্যামার? আর একটি বাড়িয়াছে। শীতল তো এখনো শিশু।

    পরীক্ষার ফল বাহির হইলে জানা গিয়াছে বিধান ক্লাসে উঠিয়াছে প্রথম হইয়া।

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleদিবারাত্রির কাব্য – মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
    Next Article চিহ্ন – মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়

    Related Articles

    উপন্যাস কল্লোল লাহিড়ী

    ইন্দুবালা ভাতের হোটেল – কল্লোল লাহিড়ী

    May 28, 2025
    উপন্যাস বুদ্ধদেব গুহ

    কোয়েলের কাছে – বুদ্ধদেব গুহ

    May 23, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    রবার্টসনের রুবি – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    বোম্বাইয়ের বোম্বেটে – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    রয়েল বেঙ্গল রহস্য – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    যত কাণ্ড কাঠমাণ্ডুতে – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }