Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    জহুরী – আশাপূর্ণা দেবী

    আশাপূর্ণা দেবী এক পাতা গল্প82 Mins Read0
    ⤷

    ১. কাঠামো দেখলে বোঝা যায়

    কাঠামো দেখলে বোঝা যায়–এক সময় লোকটার চেহারায় দীপ্তি ছিল, জৌলুস ছিল, আকর্ষণের উপাদান ছিল। এখন একটু ঢিলে, একটু বিবর্ণ, একটু বা স্তিমিত। সামনের চুল পাতলা হয়ে যাওয়ায় মাথায় টাকের আভাস, আর ঠোঁটের কোণাটা বাঁকাটে হওয়ার দরুন মুখে একটু সকৌতুক বিষণ্ণ হাসির আভাস।

    আগেও ওর ঠোঁটের গড়ন এমনিই ছিল, যেন সেখানে সব সময় উঁকি দিচ্ছে একটা সূক্ষ্ম হাসির ব্যঞ্জনা। কিন্তু সে ব্যঞ্জনা ছিল তীক্ষ্ণ ব্যঙ্গের, এমন বিষণ্ণ কৌতুকের নয়।

    বদলালো কেন?

    ও কি তারপর থেকে আত্মদর্শনের চর্চা করে করে দার্শনিক হয়ে উঠেছে। প্রায় সকলেই একথা ভাবল।

    আজকের উৎসব উপলক্ষে জানলার কাছে কাছে বাড়তি যে ছোট ছোট সীটগুলো আলাদাভাবে পাতা হয়েছে, তারই একটায় বসেছিল ও ঘরের সকলের দিকে সোজাসুজি চোখ চেয়ে। ওকেও তাই সকলে দেখতে পাচ্ছিল। দেখতে পাচ্ছিল ওর ভাঁজহীন ট্রাউজার আর বোতামবিহীন বুশ কোট এবং পালিশ-বিহীন চপ্পল জোড়াটার সঙ্গে সম্পূর্ণ বেমানান দামী আর শৌখিন চশমা জোড়াটা, দেখতে পাচ্ছিল ওর ঈষৎ শীর্ণ ফর্সা ফর্সা আঙুলগুলো দিয়ে আঁকড়ে ধরে রাখা ধার-ঘসা, কোণ-ক্ষওয়া, ছাল-চামড়া-ওঠা চামড়ার অ্যাটাচি কেসটা, যেটা নাকি মিসেস পালিতের এই শৌখিন ভোজ-সভায় প্রায় বিদ্রোহের মত।

    স্তম্ভিত বিস্ময়ে সকলেই তাই দেখছিল ওকে, আর ভাবছিল, এর মানে কী! ও এখানে কেন! কে নেমন্তন্ন করেছে ওকে? আর যদি বা কেউ করেছে, ও এসেছে কি বলে!

    ঘর থেকে উঠে গেল নীলাঞ্জনা আর বীথিকা। বারান্দার একান্তে এসে বলল, ব্যাপার কি বল তো?

    বোঝা অসম্ভব! আমি তো ঘরে ঢুকেই দেখে একেবারে পাথর বনে গিয়েছিলাম।

    আচ্ছা, নেমন্তন্নটা করল কে? মিস্টার না মিসেস?

    মিস্টার পালিত নেমন্তন্ন করবেন ওকে? মাথা খারাপ নাকি তোর?

    কিন্তু মিসেসই বা কী করে? জানিস তো সবই।

    জানি, কিন্তু আজ স্রেফ গোলকধাঁধায় পড়ে গেছি।

    আচ্ছা, ঠিক কতদিন হয়ে গেল বল দিকি?

    ঠিক? খুব সঠিক বলতে না পারলেও বলি এক হাজার চুরানব্বই দিন সাড়ে বাইশ ঘণ্টা

    থাম। দিন মাস বচ্ছর গুনতিস নাকি?

    আহা, ওর আর কি, ঘটনাটা তো ঘটেছিল ঠিক তিন বছর আগে মিসেস পালিতের ওই আহ্লাদী মেয়ের এই জন্মদিনের উৎসবেই। সেদিনও ঠিক এই এই লোকগুলোই উপস্থিত ছিল, বাড়তির মধ্যে পালিত-গিন্নীর ন্যাকা মেয়ের ওই নতুন গানের মাস্টারটি, আর অশোকের বৌ। তখন অশোকের বিয়ে হয়নি।

    আর ওই রোগা কালো মেয়েটা? ওই কোণের দিকে যে বসে আছে? ওকে তো কোনদিন এ বাড়িতে দেখিনি।

    কী আশ্চর্য! ও তো মিস্টার পালিতের ভাগ্নী হেনা। ওকে দেখিসনি তুই?

    কি জানি, মনে পড়ছে না। ও এ বাড়িতে আসে?

    মাঝে মাঝে। গরীব বলে দেখতে পারেন না মিসেস পালিত, তবে নেহাৎ নাকি মামার বাড়ি।

    আর পালিত একটু স্নেহ করেন। সেদিন অবশ্য আসেনি। তিন বছর আগের সেই ঘটনার দিন। আমি যেন চোখের ওপর সেদিনের সব দেখতে পাচ্ছি। ডানদিকের ওই দেয়ালটার ধারে যেখানে আজ অশোক আর সুকান্ত বসে রয়েছে ওই দুটোতে বসেছিলেন মিস্টার রাহা আর তার ওই সুটকি মেয়ে, এদিকে মিসেস রাহা জমিয়ে বসেছিলেন সুকান্তর সঙ্গে, সামনে ওই যেখানে মিসেস ক্ষেত্রী বসে রয়েছেন, ওখানে বসেছিল সোনালী চাকলাদার। অদ্ভুত ধরনের একটা জমকালো শাড়ি পরে এসেছিল, আর কানে দুটো লম্বা রূপোর ঝুমকো, হাতে

    ঈস! এত ডিটেল মনে রাখতে পারিস তুই! আমার বাবা এত সব মনে থাকে না।

    বাঃ, সেদিনের দিনটা ভাব। ছবির মত সবটা যেন

    তা বটে। কিন্তু আমি ভাবছি ওই নির্লজ্জ আর দুঃসাহসী লোকটার বেপরোয়া সাহসের কথা। কতখানি বুকের বল থাকলে আবার এ বাড়িতে মাথা গলাতে পারা সম্ভব হতে পারে সেদিনের সেই ঘটনার নায়কের পক্ষে!

    তা সাহস না থাকলে সে ঘটনাটাই বা ঘটল কি করে? কিন্তু আমি ঘুরে ফিরে শুধু ভাবছি ওকে এ বাড়িতে ডাকল কে?

    এই তো! আমিও তো দেখে অবধি ভেবে কূল পাচ্ছি না।

    .

    ভেবে কূল পাচ্ছে না এ ঘরের প্রত্যেকটি লোক।

    সোনালী চাকলাদার। যে আজও অদ্ভুত ধরনের জমকালো একটা শাড়ি পরে এসেছে, আর কানে প্রকাণ্ড দুটো চাকার মত রিং পরেছে, সে সেই অবধি তীক্ষ্ণদৃষ্টি ফেলে তাকিয়ে আছে আর ভাবছে, এই তিন বছরে লোকটার চেহারার বেশ একটু পরিবর্তন হয়েছে। প্রকৃতিরও। ভাবা যায় না যে কনক মিত্তির এ রকম ঢিলেঢালা আধময়লা পোশাক পরে মিসেস পালিতের পার্টিতে এসেছে। পটপ সাজসজ্জায় যে লোকটা ভয়ঙ্কর রকম খ্যাতিমান ছিল।

    সোনালী চাকলাদার ভাবতে থাকে, সেদিন কনক মিত্তির একটা মাখন-রঙা ডেক্রনের স্যুট পরেছিল। ভয়ানক রকমের ভাল দেখাচ্ছিল ওকে। মেয়েদের রীতিমত মুগ্ধ করবার মত। কিন্তু কেবলমাত্র একটি মেয়েমানুষকে মুগ্ধ করেই ও যেন জীবনের সব পুরস্কার পেয়ে গিয়েছিল, তাই আর কারও দিকেই তেমন করে তাকাত না। শুধু ওর ওই ঈষৎ বঙ্কিম ঠোঁটের রেখায় একটু বিদ্রুপের হাসির ছিটে মাখিয়ে অলসভাবে তাকাত সকলের দিকে একইভাবে।

    কাজেই সোনালী চাকলাদার বেশীক্ষণ আর মুগ্ধভাব বজায় রাখতে পারে নি। নিজের সুর্মাটানা চোখ দুটোয় বিলোল বিহ্বলতার ভঙ্গী এনে অনেকক্ষণ ধরে চোখাচোখি হবার চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে শেষ পর্যন্ত বিরক্ত চিত্তে অন্যত্র আশ্রয় খুঁজতে গিয়েছিল। তারপর–ঠিক খাওয়া দাওয়ার শেষের দিকে সেই গোলমালটা উঠল।

    টেবিল ছেড়ে ওঠেনি তখনও কেউ। আর সোনালী ভাবছিল প্রত্যেক পার্টিতেই পুডিং এত কম কম করে কেন! অথচ সোনালী ওটা কী পছন্দই যে করে! ওর তো মনে হয় টেবিলে যতটা রাখা থাকে, সবটাই ও একা খেয়ে নিতে পারে। তাই আর সবাই যখন পুডিংয়ে চামচ বসায়, বুকের মধ্যে কী একরকম যেন যন্ত্রণা হতে থাকে সোনালীর।

    ইচ্ছে করলেই তো এই চমৎকার সুখাদ্যটা একটু বেশি বেশি মজুত রাখা যায়। হ্যাঁ, ঠিক এই কথাটাই তখন ভাবছিল সোনালী, বেশ মনে আছে। আর মনের অগোচর পাপ নেই, কাজেই এটুকুও মনে আছে, ওই গোলমালটা শুনে সকলে যখন হুড়মুড়িয়ে উঠে পড়ে শব্দ লক্ষ্য করে মিসেস পালিতের শোবার ঘরের দিকে ছুটেছিল, তখন সোনালী একটু দেরি করেছিল। উগ্র কৌতূহল চেপেও শেষ লোকটি পর্যন্ত ঘর থেকে চলে যাওয়ার অপেক্ষা করেছিল। কারণ, পুডিংয়ের পাত্রটার ভিতরে তখনও খানিকটা লেগেছিল, যেটা চামচে করে তোলা যায় নি।

    তবু ওই লোকটা, ওই কনক মিত্তির নামক দুঃসাহসী লোকটা সেদিন কোথায় যেন ট্রেন ধরতে যাবে বলে আগে আগে খেয়ে নিয়েছিল, তাই একটু স্বস্তি করে খেতে পেরেছিল সোনালী। নইলে কনক মিত্তির থাকলেই একটু ইয়ে করে খেতে কেমন যেন অস্বস্তি হয়। কী রকম যে ব্যঙ্গ হাসি মাখা মুখে ঠিক সোনালীর খাওয়ার দিকেই তাকিয়ে থাকে লোকটা।

    .

    কনক মিত্তির এ বাড়ির কে, সে কথা সোনালী জানে না। ওর মনে আছে প্রথম যখন কাউকে জিজ্ঞেস করেছে সোনালী, মিসেস রাহাকে কি তার পুঁটকি মেয়েকে, নীলাঞ্জনা কি বীথিকাকে, কেমন করে যেন মুচকে হেসেছে ওরা, আর বলেছে–কে কার কে হয়, সে হিসেব দেওয়া কি সোজা!

    অথচ, কনক মিত্তিরের সামনে ওরা মুখের চেহারায় বিনয় আর সমীহের আলপনা কেটে তবে কথা বলেছে। বরং কনক মিত্তিরই সকলের দিকে তাকিয়ে থাকত-সোনালীর তো মনে হয় বিশেষ করে তার দিকেই, ব্যঙ্গ দৃষ্টিতে। নাকি, দৃষ্টিতে নয়, যা কিছু ভঙ্গী ওর ওই বাঁকানো ঠোঁটের কোণাতেই। যে কোণাটায় আজ সকৌতুক বিষণ্ণতার আভাস।

    কিন্তু এই তিন বছর সুখে ছিল না লোকটা, ভাবল সোনালী। সুখে থাকলৈ চেহারায় এমন বয়সের ছাপ পড়ে না।

    .

    ঠিক এই কথাই ভাবছিলেন মিসেস রাহাও।

    যিনি নাকি এতক্ষণ ফিসফিস করে সুকান্তর রীত-চরিত্তিরের নিন্দে করছিলেন মিসেস ক্ষেত্রীর কাছে। বলছিলেন, মানুষকে বিশ্বাস করবেন না মিসেস ক্ষেত্ৰী। বরং বিশ্বাস করবেন সাপকে, বাঘকে, বিছেকে। ওই সুকান্ত সিদ্ধান্তর সত্যিকার চেহারা যদি আপনার কাছে খুলে ধরি, ঠিক আপনি সেন্সলেস হয়ে যাবেন। অথচ দেখুন বাইরে কী সুন্দর অমায়িক মার্জিত সভ্য। কিন্তু রুচি? থাক সে কথা। কি বলছেন? আমি আগে ঘনিষ্ঠভাবে মিশতাম? মিশতাম বৈকি। আমার সরল মন, সহজ ভাবেই সকলকে বন্ধু বলে গ্রহণ করি। আর লোকের স্বরূপ চিনে ফেলি তাতেই ঘনিষ্ঠ ভাবে না মিশলে কী করে টের পেতাম বলুন মিস্টার সিদ্ধান্তর প্রকৃতি কি?

    মিসেস ক্ষেত্রী প্রতিবাদে কি যেন বলতে যাচ্ছিলেন, ঠিক সেই সময় সামনের জানলার ওই নীচেটায় লোকটা এসে বসল। যার ভাঁজহীন ট্রাউজার, বোতামবিহীন বুশ কোট, পালিশছাড়া চপ্পল আর হাতে ধরা ছাল-চামড়া-ওঠা চামড়ার এটাচি কেসটা ঘরের সমস্ত শৌখিন পরিবেশকে যেন ঠাস করে একটা চড় বসিয়ে দিল।

    তারপর পরিবেশ সমেত সমস্ত মানুষগুলো পাথর বনে তাকিয়ে রইল ওর মুখের দিকে।

    কনক মিত্তির না?…ওকে কে ডাকল?

    …এতদিন ছিল কোথায়?

    তারপর থেকেই ভাবছেন মিসেস রাহা, সুখে ছিল না। সুখে থাকতে পারে না। সুখে থাকলে কখনও এই দু-তিন বছরে বুড়িয়ে যায় মানুষ? ভাবছেন–তবু উঁটটি বজায় আছে ষোল আনা। তাকিয়ে আছে দেখ, যেন কোন্ স্বর্গলোক থেকে তুচ্ছ এই মর্ত্যলোককে করুণাকটাক্ষ বিতরণ করছে!

    মুশকিল! কাকে জিজ্ঞেস করা যায়, কার নেমন্তন্নে এখানে এসে মাথা গলিয়েছে ও। সেদিনের কথা এক্ষুনি ভুলে গেল কে!

    .

    মিস্টার রাহা ভাবছিলেন অন্যকথা।

    ভাবছিলেন, সত্যিই কি লোকটা সেদিনের সেই ভয়ঙ্কর কাণ্ডের নায়ক? ওর মুখ দেখে কি সে কথা বিশ্বাস হয়? অবশ্য ভয়ঙ্কর কাণ্ডের নায়করা প্রায়শই পাকা অভিনেতা হয়, সমস্ত বিদেশী নভেলে তো এই কথাই বলে। তবু ওই বিষণ্ণ কৌতুকমণ্ডিত মুখটায় যেন এমন একটা কিছু রয়েছে, যাতে বিশ্বাস করা শক্ত–লোকটা অপরাধী।

    তাছাড়া অপরাধী হলে কোন সাহসের বশে ও আজ এই ভোজসভায় এত লোকের সামনে এসে হাজির হয়েছে? আশ্চর্য, পুলিসের ভয়ও কি নেই লোকটার? কিন্তু নেই-ই বা বলা যায় কি করে? না থাকলে এই তিন বছর নিরুদ্দেশ হয়েছিল কেন? অনুতাপে দগ্ধ হয়ে হয়ে আত্মসমর্পণ করতে এল নাকি আজ?

    দেখা যাক শেষ পর্যন্ত।

    মনে হচ্ছে আজ মজাটা জমবে ভাল।

    .

    অশোকের নতুন বৌ এক সময় ইশারায় বরকে পাশের ঘরে ডেকে নিয়ে গিয়ে বলে, বল কি? সত্যি? এই সেই লোক? কিন্তু আমার তো কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছে না। মুখ দেখে

    মুখ দেখে চরিত্র-নির্ণয়ের ক্ষমতা রাখ বুঝি? অশোক হেসে বলে, আমিই যে কোন সাংঘাতিক ঘটনার নায়ক নই, কে বলতে পারে?

    নও একথা অন্তত আমি বলি না, বৌ-ও হাসে, এক ভদ্রলোকের বাড়িতে ডাকাতি করে মেয়ে-চুরির নজীর আমার জানা। কিন্তু বল দিকি, ওই কনক মিত্তির না কি ওর সত্যি ব্যাপারটা কি?

    আহা, সে তো বলেইছি তোমায়। নতুন আর কি বলব। নতুনের মধ্যে আজ ওঁর আবির্ভাব।

    কে ডেকেছে?

    আর কে ডাকতে পারে বল, কাকীমা ছাড়া?

    কাকাবাবু চুপ করে আছেন কেন তাহলে?

    বোধ করি এত লোকের মাঝখানে আর সীন ক্রিয়েট করতে চান না।

    তুমি গিয়ে জিজ্ঞেস কর না সোজাসুজি।

    জিজ্ঞেস করব? কাকে জিজ্ঞেস করব?

    কেন, ওই ওঁকে।

    ওঁকে জিজ্ঞেস করব? কি জিজ্ঞেস করব বল তো?

    স্পষ্ট জানতে চাইবে, আপনাকে আজ এখানে ডাকল কে।

    মাথার চিকিৎসা করা দরকার তোমার।

    কেন, খুব একটা অযৌক্তিক কথা হল?

    সম্পূর্ণ।

    বেশ, তবে কাকীমাকেই জিজ্ঞেস কর না।

    নাঃ! হেসে ওঠে অশোক, চিকিৎসায় কোন কাজ হবে বলে আশা হচ্ছে না। ভদ্রলোকের বাড়ি থেকে ডাকাতি করে আনা রত্নটিকে পাগলা গারদে উৎসর্গ করতে হবে মনে হচ্ছে।

    ঈস্! কেন? এত ভয়টা কিসের শুনি? কাকীমাকে যে কেন এত ভয় কর তুমি! এক বাড়িতে থাকলে তো বোধহয় আমার জীবন মহানিশা করে তুলত। দূরে থেকেই এই! অথচ উনি তোমার থেকে এমন কিছু বড় না।

    এমন কিছু বড় নয় বলেই তো! অনেকখানি বড় হলে বরং কিছুটা সাহসের প্রশ্রয় থাকে। এদিকে কাকা বেশ বড়। কিন্তু চল, ওদিকে সবাই কি ভাবছে।

    যাচ্ছি। কাকীমার মেয়েটি যে একেবারে আহ্লাদী-মার্কা হাঁদা। কিছু যে জেনে নেব ওর কাছ থেকে তার উপায় নেই। যা জিজ্ঞেস করব, ঠিক বলবে, কি জানি–মা জানেন।

    ওঃ, কাবেরীর কথা বলছ? ও তো ছেলেবেলা থেকেই অমনি। নিজের কোন বুদ্ধি নেই। কাকীমা যেদিকে চালান সেদিকে চলে, যা বোঝান তাই বোঝে।

    উঁহু, আরও আছে। যা খাওয়ান তাই খায়, যা পরান তাই পরে। যা ভাবান তাই ভাবে, যা দেখান তাই দেখে।

    ইডিয়ট আর কি।

    ওই রকম বাপ-মায়ের কী করেই যে এরকম মেয়ে হয়।

    বলতে গেলে এটাই স্বাভাবিক। মায়ের প্রবল ইচ্ছাশক্তির দাপটে সন্তানের বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশ হতে পায় না। এমন কি স্বামী-স্ত্রীর ক্ষেত্রেও অনেক সময় এ দৃষ্টান্ত দেখা যায়। অবিরত একজনের মতের প্রাবল্যে অপরজনের বুদ্ধিবৃত্তি আর চিন্তাশক্তি হ্রাস হতে থাকে।

    এত স্বামী-স্ত্রী দেখলে কোথায়? জগতে দেখবার মধ্যে দেখেছ তো ওই কাকাকে আর কাকীমাকে।

    কেন, এতগুলো বছর চোখ বুজে পৃথিবীতে বিচরণ করেছি বুঝি?

    আমার তো তাই মনে হয়।

    মনে হয়? সত্যি? তাহলে এ হেন রত্নটিকে কি করে চক্ষুগোচর হল?

    আসলে রত্নই নয়। মুদিত চক্ষু একবার খুলেই যা দেখেছ, মোহিত হয়েছ।

    হুঁ, তাই দেখছি। বড় ভুল হয়ে গেছে। আরও দেখে বেড়ানো উচিত ছিল।

    ঈস, তাই বৈকি। আচ্ছা আমাদের মধ্যে প্রবল কে?

    এ প্রশ্নের উত্তর দিতে যাব, এতবড় বোকা আমি নই। কিন্তু চল চল, ওঘরে চল।

    আমি কিন্তু ঠিক করেছি, ওই ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ করব।

    পাগলামী করো না।

    কেন, পাগলামী কিসের? আমি নতুন মানুষ, আগের কিছু দেখিনি, আগের কিছু জানিও না। অতএব কাছে গিয়ে সরল চোখে তাকিয়ে বলব, আচ্ছা, আগে তো কই আপনাকে দেখিনি এখানে।

    তারপর?

    পরের কথা পরে।

    এই, ওসবের কিছু করতে যেও না। আমার মনে হচ্ছে, আজকের ব্যাপারটা খুব একটা হালকা নয়। বাতাসে কিছু একটা যেন থম্ থম্ করছে। মনে হচ্ছে কোন একটা বিপদ আসছে।

    .

    পালিতের ভাগ্নী হেনা ভাবছিল, আমি সেদিন ছিলাম না। আমাকে সেদিন ডাকা হয়নি। আমি থাকলে হয়তো সেদিনের সব রহস্য ধরে ফেলতাম। কনক মিত্তিরকে তো আমি জানতাম। লোকমুখে পরে সব শুনেছি, কিন্তু আসল রহস্যটা ঠিক বুঝতে পারিনি। আর কেউ না জানুক আমি তো জানতাম, লোকটা মামীর পেয়ারের লোক। অথচ ব্যাপারটা ঘটল অদ্ভুত। সস্তাদরের নাটকের নাটকীয়তার মত একেবারে। সেদিনের সেই উৎসবে আমি আসিনি, কিন্তু তার কদিন আগেই যে সেই একদিন এসেছিলাম, সেদিন তো দেখেছিলাম ড্রইংরুম ছেড়ে পিছনের ওই ব্যালকনিতে গিয়ে গল্প করা হচ্ছে দুজনে।

    না, আড়ি পাততে আমি যাইনি। সে প্রবৃত্তিও নেই আমার। ঈশ্বর করুন, কোনদিন যেন না হয়, সে প্রবৃত্তি। তবু আমি সেদিন ওদের কথাবার্তা শুনতে পেয়েছিলাম। হঠাৎই পেয়েছিলাম। নীচে চাকরদের কাছে শুনে এলাম মেমসাহেব বাড়িতেই উপস্থিত আছেন, কিন্তু উপরে উঠে দেখতে পেলাম না কোথাও। তাই না পিছনের ওই ব্যালকনির দিকে! সত্যি বলতে অবাক হয়েই দাঁড়িয়ে পড়েছিলাম আমি ওদিককার ওই প্যাসেজটার কাছে, যেটায় নাকি তখন আলো জুলছিল না। হ্যাঁ, অন্ধকার সেই প্যাসেজটায় দাঁড়িয়ে আমি শুনতে পাচ্ছিলাম কনক মিত্তিরকে কী যেন একটা ব্যাপার নিয়ে মিনতি করছেন মামী। কারণটা কি! অবাক হয়েছিলাম। তারপর আস্তে আস্তে বুঝতে পারলাম কিছুটা দূরে কোথাও চাকরি নিয়ে চলে যেতে চাইছে ভদ্রলোক, কানপুর কানপুর শুনলাম মনে হল; মামী তাকে নিবৃত্ত করতে চাইছেন। যেন চাইছেন, তা অবশ্য বুঝতে বাকী রইল না আমার, আর বুঝে মনটা বিতৃষ্ণায় ভরে উঠল। মানি, মামার সঙ্গে ওঁর বয়সের তফাৎ অনেকটা, মনের মিল হওয়া হয়তো শক্ত, তবু

    ওই তবুটা বুদ্ধি আর যুক্তির ধার ধারে না।

    যাই হোক, মামীর সেই অভিমান আর অনুযোগের, মিনতি আর শাসনের মানেটা তো বুঝতে পারা শক্ত হয়নি, কিন্তু কাবেরীর জন্মদিনের ব্যাপারটা? ভয়ঙ্কর সেই ঘটনাটা? তার মানে কে বুঝবে?

    আমি উপস্থিত থাকলেই কি পারতাম?

    শুনে প্রথমে তো আমি বিশ্বাসই করিনি। বলেছিলাম, এটা সম্পূর্ণ কাকতালীয়। বাইরের কোন লোক এসেই ওই দুঃসাহসিক কাজটা করে গেছে। তাক বুঝেই ছিল সে, জেনেছিল বাড়িতে একটা ভোজসভা আছে, বাড়ির লোক ওদিকে ব্যস্ত থাকবে, কাজেই শোবার ঘরগুলো থাকবে খালি পড়ে। দৈব যোগাযোগে ঠিক সেই সময় মামী গিয়ে পড়ায়–কিন্তু এটা আমি বুঝতে পারিনি, মামী কেন ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। নিমন্ত্রিতদের সঙ্গে খেতে বসেন নি, এটা কী করে হল?

    কারণ শুনেছিলাম বটে, খেতে বসেন নি হঠাৎ শরীরটা অসুস্থ বোধ হচ্ছিল বলে। কিন্তু কথাটা ঠিক বিশ্বাসযোগ্য কি না তা ভেবেছি অনেকবার। মহোৎসাহে যিনি অতক্ষণ অত হৈ-চৈ করে বেড়াচ্ছিলেন! মানে, হেনা ঠিক সেদিন না দেখুক, আরও অনেক দিন তো দেখেছে। দেখেছে পার্টি দেওয়ায় মামীর কী অগাধ উৎসাহ। হেনাকে অবশ্য সাহায্য করতে ডাকেন না কখনও, তবে হেনা নিজে থেকে এগিয়ে এসে কিছু করলে খুব অমায়িক গলায় বলেন, এটা করে ফেলেছ? ভালই হল, একা হাতে এত ব্যবস্থা, মারা যাচ্ছিলাম। কিন্তু এ কী, কি করে এমন মারাত্মক ভুল করে ফেলেছে হেনা? এ যে একেবারে অচল। সত্যি হেনা, বুদ্ধিসুদ্ধি আর তোমার হবে না কোনদিন। তা, তোমারই বা দোষ কি দেব বল? ভাল পার্টি তো আর দেখছ না হামেসা। আমার এখানে এলেই যা।

    মিসেস পালিতের সেই মারাত্মক ভুলটা হয়তো ফুলদানিটার একটু স্থানচ্যুতি, কি নুন আর মশলাডোর পাত্রগুলোর জায়গায় একটু হেরফের। হৈ চৈ করে সব কিছু ফের নিজে গোছাতে শুরু করেন মিসেস পালিত। যাঁর নিজস্ব নাম নাকি নর্মদা দেবী।

    .

    হেনা যখন নির্লিপ্তের মত উদাসীন মুখে বসে বসে এত কথা ভাবছিল, তখন মিস্টার পালিতও ভাবছিলেন, নর্মদা এতটা বোকামী না করলেও পারত। আজ এত লোকের মাঝখানে কী দরকার ছিল ওই হতভাগা লোকটাকে ডাকবার? কেলেঙ্কারী যা হবার তার তো চূড়ান্ত হয়েছে, তবু যা হোক পাঁচ জনে আস্তে আস্তে ভুলে যাচ্ছিল সব কিছু, আর নর্মদাও নূতন উৎসাহে কাবেরীর গানের মাস্টারকে নিয়ে মেতে কিছুটা ভুলে ছিল। হঠাৎ আবার নিভে যাওয়া ছাইকে খুঁচিয়ে আগুন বার করতে গেল কোন্ বুদ্ধিতে? আশ্চর্য! মেয়েগুলো কি এত নির্বোধও হয়! অথচ নিজেদেরকে কী বুদ্ধিমানই না ভাবে।

    নাঃ, নর্মদার বুদ্ধিকে কিছুতেই প্রশংসা করা চলে না।

    কিন্তু আরও আশ্চর্যজনক লোকটার নির্লজ্জ ধৃষ্টতা। এল কি বলে! এসে সভার মধ্যে বসল কি বলে! হাতেই বা এনেছে কি? পচা ওই অ্যাটাচিটায় কী থাকা সম্ভব? কাবেরীর জন্যে কোনও উপহার? তাই সম্ভব। মানুষের ধৃষ্টতার তো সীমা থাকে না।

    এখন বোঝা যাচ্ছে, নর্মদা এ-যাবৎ ওর সঙ্গে যোগাযোগ রেখে এসেছে, নইলে হঠাৎ ঠিকানা পাবে কি করে নিরুদ্দিষ্ট লোকটার। তবু মনে মনে মৃদু একটু হাসলেন মিস্টার পালিত, লোকটার ওপর আমার করুণাই হচ্ছে। আগেও অবশ্য হত, অসার এক ভালবাসার পাত্রীর মোহে অমন একটা বিদ্বান বুদ্ধিমান ছেলে কিভাবে নিজের কেরিয়ারটা নষ্ট করছে, আর মনে ভাবছে খুব জিতছি, এটা আমায় যেমন হাসাত তেমনিই করুণাও জাগাত। ওর বাবুয়ানার খরচা, ওর বাহারে সাজ-পোশাক কোথা থেকে আসে সে কথা যে আমার অজানা নয়, এটা ওর অজানা–এ দেখেও কৌতুকের শেষ ছিল না আমার। কিন্তু সেদিন? তিন বছর আগের সেই দিনটায় বরং একটু দুঃখই হয়েছিল ওর জন্যে। ওর এত ভালবাসা যদি সত্যিকার সারালো একটা মেয়ের ওপর পড়ত।

    সত্যিকার সারালো! ভাবলেন মিস্টার পালিত, ধারে কাছে কোথায় বা পাবে দুর্লভ সেই বস্তু। হেনাকে একটু শ্রদ্ধা করতাম। কিন্তু হেনা নিজের দারিদ্রের অহঙ্কার আর দারিদ্রের কুণ্ঠায় দিন দিন কেমন যেন হয়ে যাচ্ছে। আমি মামা–আমার সাহায্য নে না তুই, মা-বাপ মরা মেয়ে। তা নেবেন না। অথচ এই সব পার্টিতে আসতে সাজসজ্জায় যে প্রাচুর্য থাকা দরকার তার অভাব বলে সে সব জায়গায় আসতেই চান না বাবু। হ্যাঁ, বুকের পাটা থাকে তো পাঁচ টাকার শাড়ি পরে চলে আয় রাজসভায়। এ-ও নয়, ও-ও নয়। মেয়েটা আমাকে হতাশ করেছে।

    আর, আমার ওই মেয়েটা!

    আজ নাকি ষোল বছর পূর্ণ হল ওর।

    লোকে বলে, এত সরল যে দশ বছরের বাচ্চা বলে মনে হয়। আমার কিন্তু মনে হয় না। আমি ওকে বুঝতে পারি না।

    হ্যাঁ, আমার ওই ষোল বছরের মেয়েটাকে আমি বুঝতে পারি না।

    আচ্ছা, কনক মিত্তিরকে গিয়ে কি আমি সরাসরি প্রশ্ন করব, কি খবর? এতদিন ছিলেন কোথায়? না কি মৃদু হেসে বলব, জাত গিয়ে পেট না ভরাটা ভারি লোকসান, না হে মিত্তির? না নর্মদাকেই একটু ভয় পাওয়াব?

    .

    কনক মিত্তির কি অনন্তকাল ধরে বসেছিল?

    আর ঘরের সবাই অনন্তকাল ধরে তার কথা নিয়ে মনকে তোলপাড় করছিল? তা অবশ্য নয়। কিন্তু বাতাসের চেয়ে দ্রুতগামী যে কে, তার উত্তর তো দ্বাপরে স্বয়ং যুধিষ্ঠির দিয়ে গেছেন।

    সময় খুব বেশি কাটেনি।

    এতগুলো লোকের এত চিন্তা দৌড়চ্ছিল বাতাসের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে।

    .

    অন্য ঘরে বেশ কয়েকটি কিশোর-কিশোরী কাবেরীকে ঘিরে হৈ-হুল্লোড় করছিল। উপহারে পাওয়া কি একটা নতুন ধরনের খেলার সরঞ্জাম খুলে বসেছিল কাবেরী, ওরা খেলছিল। মাঝে মাঝে ওদের উল্লাসধ্বনি ভেসে আসছিল এ-ঘরে। ওরা আসেনি একবারও।

    তবু কাবেরী জানে।

    কাবেরী কখন কোন কাজে একবার এসেছিল এ ঘরে, কে জানে। কাবেরী অবাক হয়নি। কাবেরী কোন কিছুতেই অবাক হয় না। ও অদ্ভুত রকমের সরল। যা দেখে শুধু দেখেই চুপ হয়ে থাকে, স্থির হয়ে থাকে।

    আজও চুপ হয়ে গিয়েছিল। নতুন খেলনাটা মেলে দিয়েছিল বন্ধুদের সামনে, আর সেই অবসরে ভাবছিল। কাবেরী নিজে কিছু ভাবে, ভাবতে পারে–একথা কেউ ভাবে না। সবাই জানে, মা যা ভাবায় তাই সে ভাবে। কিন্তু সেটা কি ঠিক কথা? কাবেরী ভাবে বৈ কি। এই তো আজ ভাবছে। ভাবছে, আমার মন বলছে আজও একটা কিছু ঘটবে। সেদিনও আমার মন একথা বলেছিল। সেদিন উৎসব-আয়োজনের তলায় তলায় আর একটা কিসের যেন আয়োজন চলছিল।

    তাই যখন মার ওই বন্ধু বলল, ট্রেন ধরতে হবে, খাবার সময় নেই, পালাই, আর মা ব্যস্ত হয়ে একটা প্লেটে করে সব কিছু ভাল ভাল জিনিস এনে ধরে দিল ওর হাতে, তখনই মনে। হয়েছিল আমার, এইবার সেই একটা কিছুর সূচনা দেখা দিচ্ছে। আমি ভেবেছিলাম ট্রেনে চড়ে ও একা পালাবে না। আরও কেউ ওর সঙ্গী হবে।

    কেন এমন কথা মনে হয়েছিল, তা জানি না। তবে তার কদিন আগে থেকে মার মধ্যে যে একটা চাপা উত্তেজনার আভাস টের পাচ্ছিলাম সেটাই বোধহয় আমাকে এমন কথা ভাবিয়ে তুলেছিল। সেদিন যখন দেখলাম মা অতিথিদের সঙ্গে টেবিলে বসল না, বলল মাথা ঘুরছে, বলল শরীর খারাপ লাগছে, বলল অতিথিরা যেন কিছু মনে না করেন-মা মিনিট কয়েক বিশ্রাম করে নেবে, তখনই আমার সেই ধারণা বদ্ধমূল হল। ঠিক বুঝলাম, অতিথিদের খাওয়ার অবসরে মা পালাবে।

    কথাটা বুঝে ফেলেই ভয়ানক একটা যন্ত্রণায় বুকটা যেন ফেটে চৌচির হয়ে যেতে থাকল আমার। আর একটু আগেই আমরা ছোটরা খেয়েছি, আমার জন্মদিনের ভোজের ভাল ভাল সব রান্না, সেগুলো যেন পেটের মধ্য থেকে উঠে আসতে চাইল সব গায়ের মধ্যে মোচড় দিয়ে দিয়ে।

    মা যে আমাকে ফেলে চলে যাবে এই কষ্টটাই শুধু নয়, ভয়ানক একটা ভয়ও তার সঙ্গে এসে জুটল। মনে হল, মা চলে গেছে এই খবরটা ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে কি অবস্থা হবে আমাদের। আমার আর বাবার ওই সব অতিথিরা তখন কেমন করে মুচকে মুচকে হাসবে, আর কেমন করে আহা করে আমাদের সহানুভূতি জানাতে আসবে–সে কথা ভেবে চেঁচিয়ে কান্না পেল আমার।

    আশ্চর্য! মা-র ওই বন্ধুকে ছোটবেলায় আমি কি ভালই না বাসতাম। ও এলে যেন আহ্বাদে নেচে উঠতাম। তার কারণ ছোট ছেলেদের মন ভোলাবার অনেক সব কায়দা ও জানত। মজার মজার কত যে গল্পের স্টক ছিল ওর। আর ও এলেই এত সুন্দর হয়ে উঠত মা। ছোটবেলায় সেই সুন্দর মা, আর সেই সুন্দর হয়ে ওঠার কারণস্বরূপ মানুষটা, দুজনকেই তাই ভীষণ ভাল লাগত।

    কিন্তু একটু বড় হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে মনটা একেবারে উল্টো হয়ে গেল। মনের এই বদলে নিজেই আমি অবাক হয়ে গেলাম। মা-র ওই বন্ধুকে দেখলেই রাগে সমস্ত শরীর জ্বালা করে উঠতে আরম্ভ করল, আর ওকে দেখে মা-র সেই সুন্দর হয়ে ওঠাটা বিষ লাগতে লাগল। কিন্তু এসব কিছু প্রকাশ করার উপায় ছিল না আমার। আমাকে সরল থাকতে হবে, বাচ্চা মেয়ে থাকতে হবে। আমাদের বয়সের মেয়েদের তাই নাকি নিয়ম। তাদের বুদ্ধির প্রকাশ ধরা পড়লেই সেটা নাকি নিন্দনীয় পাকামী। আমার বয়সী অন্য যে সব মেয়েরা সাধারণ, বয়সের উপযুক্ত বুদ্ধিমতী, মা তাদের দেখতে পারে না। বলে, ওরা অকালপক্ক। আমি আদর্শ বেবি। আমি অবোধ। অবিশ্যি লেখাপড়ায় দস্তুরমত বুদ্ধি সুদ্ধি থাকা চাই। সে না থাকলে আবার মা-র মুখ থাকে না।

    বাধ্য হয়ে আমাকে তাই কিম্ভুতকিমাকার আদর্শ বেবি হয়ে থাকতে হয়েছে! বছর বছর স্কুলে ফাস্ট হই, নির্বিচারে দেখি-বিদেশী সাহিত্য গিলি, লুকিয়ে প্রেমের কবিতা লিখি, আর বিশ্ব সংসারের সব কিছুতে অনভিজ্ঞ আহ্লাদে খুকীর অভিনয় করে চলি। লোকে বলে, মেয়েটা একেবারে বাচ্চা!

    তবু মা মাঝে মাঝে সন্দেহ করে।

    মা যখন আমার গানের মাস্টারমশায়ের সঙ্গে নাচতে নাচতে জলসা শুনতে যায়, তখন আমি যদি মা-র সঙ্গে যাবার জন্যে খুকীমাফিক বায়না ধরি, তা হলে মা কেমন ঝাল ঝাল তেতো তেতো চোখে তাকিয়ে বলে ওঠে, তুমি আবার কি যাবে! রাত হয়ে যাবে, ঠাণ্ডা লাগবে না?

    অগত্যাই আমাকে মায়ের সন্দেহ ঘোচাবার জন্যে আরও খুকী হতে হয়। আঁ আঁ করে কেঁদে ফেলতে হয়, বারে, আমার বুঝি একা বাড়িতে খারাপ লাগে না?

    অবিশ্যি একথা জানি, গানের মাস্টারমশাইয়ের সঙ্গে এত মেশামেশি মা করে, সে শুধু মনের শূন্যতার পূরণ করতে। মা-র ওই বন্ধু চলে গিয়ে পর্যন্ত মন সব সময় খাঁ খাঁ করে। বুঝতে পারি, কিন্তু ভাল লাগে না। মনে হয় ঐ খাঁ খাঁ করাটা খারাপ।

    তবু মা-র ওই বন্ধুকে আমি ভক্তি করেছিলাম, ওর চলে যাওয়াটাই এই ভক্তির কারণ। ভাবতাম, ভয়ঙ্কর একটা বিপদকে যেন ও সরিয়ে নিয়ে চলে গেছে। উঃ, কি বিপদই হত যদি সেদিন ও একা না যেত!

    অবিশ্যি অনেক কিছু জিনিস নিয়ে গেছে ও। তা যাক্, সব নিয়ে যাক ও। শুধু আমাদের মানসম্ভ্রম যে নিয়ে যায়নি, এর জন্যেই আমি ওর উপর কৃতজ্ঞ। আবার এল কেন? কে ডাকল ওকে? নিশ্চয় মা। তাছাড়া আর কে। কিন্তু ওকি ওর ভয়ঙ্কর অপরাধটা অস্বীকার করবে? বলবে–আগে ভাগে খেয়ে ও তো ট্রেন ধরতে চলে গিয়েছিল। তার পর কি ঘটে গেছে কিছুই জানে না। এত দিন যে আসেনি তার কারণ অন্য। হয়তো সেই কারণ নিয়ে এমন গল্প ফঁদবে যে সবাই ভাববে, ছি ছি, এতদিন কী ভুল ধারণাই না করে এসেছি আমরা! বাবা ভাববে, ছি ছি, তাইতো। ভারি অন্যায় হয়ে হয়ে গেছে তো পুলিসে খবর না দিয়ে।

    কিন্তু তাই কি? ওর মুখটা যেন বদলে গেছে।

    মনে হচ্ছে, ও আর কোন গল্প ফাঁদবে না। এ বাড়িতে নিজেকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করবার বাসনা আর নেই ওর।

    কিন্তু যদি থাকে? তখনও কি আমি আদর্শ বেবি সেজে বসে থাকব? জোরে চেঁচিয়ে বলে উঠব না না, মোটেই ও সেদিন তখুনি ট্রেন ধরতে যায়নি। বলে দেব না–আমি সব ঘটনা জানি, আমি ছাতের সিঁড়ি দিয়ে ঘরের ভেন্টিলেটারে চোখ রেখে সব দেখেছিলাম? পারব কি?

    সে সাহস কি আমার আছে?

    এতগুলো লোকের চোখের সামনে হঠাৎ আমার এই বাচ্চা মেয়ের খোলশটা খুলে ফেলে স্বরূপ প্রকাশিত হবার সাহস? না না, পারব না বোধহয়। অনবরত মাকে ভয় করে করে আমার মেরুদণ্ডে জোর নেই।

    সেদিনের মত আমার আজকের জন্মদিনটাও বোধহয় মাটি হবে। ওই লোকটা যেন আমার শনি।

    .

    সবাই এত কথা ভাবছিল, তবু সঙ্গে সঙ্গে যথারীতি কাজও চলছিল। চাকর-বাকরদের কাজ চাকর-বাকররা করছিল, গিন্নীর কাজ গিন্নী। অর্থাৎ, তখনও মার্কেট চষে বেড়াচ্ছিলেন মিসেস পালিত। বাড়িতে অতিথি-অভ্যাগতদের ডাকলে, মহামুহূর্তে একবার মার্কেট ঘুরে আসতে যাওয়া মিসেস পালিতের চিরাচরিত রীতি। যাওয়ার কারণটা আবশ্যকীয় বা সম্পূর্ণ অনাবশ্যক যাই হোক। এমনও হতে পারে ফুলদানিতে ফুল কিছু কম দেখাচ্ছে বলে চট করে গাড়িটা নিয়ে বেরিয়ে গেলেন মহিলা।

    ফিরবেন হাঁপাতে হাঁপাতে, অতিথিদের সামনে চেয়ারে এলিয়ে বসে পড়বেন, কিছুক্ষণ হাওয়া খাবেন, আর তিনি যেটি না দেখবেন, সেটিই যে একেবারে মার্ডার কেস হয়ে বসে থাকবে এই তথ্যটি পরিবেশন করবেন প্রায় কেঁদে, আর হাঁপিয়ে হাঁপিয়ে সবাইকে ধরে ধরে জানাবেন–তার স্বামীটি কিছু না। তারপর ভয়ঙ্কর রকম ক্লান্ত আর দুর্বলের ভূমিকা নিয়ে সহানুভূতি কুড়োবেন অতিথিদের। সকলে ওঁকে বলবে, থাক থাক, তুমি উঠো না; থাক থাক, আপনি খাটবেন না, আর উনি যেন মরে মরে, তা কি হয় বলে উঠবেন, খাটবেন।

    এই এক নেশা মিসেস পালিতের। সবাই ওঁকে আহা আহা করুক।

    আজও তাই খানিক আগে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গিয়েছেন তিনি। আর সময়ের স্রোত যেন . নিথর হয়ে পড়ে আছে তার প্রতীক্ষায়।

    .

    শুধু চারিদিকে চাপা ফিস ফিস গুনগুন। সে গুঞ্জনধ্বনি দাসীচাকর মহলেও উঠেছে।

    রাতদিনের ঝি কানন মুখ ঘুরিয়ে বলে, আমরা দাসী-বাঁদী, মনিবের ঘরের কথায় থাকবার দরকার নেই, তবু বলি-যে লোকটা অমন কাণ্ড করে গেল, তাকেই আবার আদর করে ডেকে আনতে প্রবৃত্তি হল! এই দু বছরেই সব বিস্মরণ!

    বাসন-মাজা ঝি সুখদা বলে, তুমি তো বললে কাননদি সেকাজ ওই বাবুটাই করেছে; কিন্তু এ-ও বলি, গিন্নীর সঙ্গে যার এত আসনাই, এত দিনের এত ভালবাসা, সে কখনও তা করতে পারে?

    তুই থাম, কানন ঝঙ্কার দেয়, বলে মন্দিরের পূজুরী পুরুত আজন্ম বিগ্রহসেবা করে সে বিগ্রহের গয়না চুরি করে পালায়, আর এ তো পরস্ত্রীর আসক্তি। কর্তা যে কি করে সহ্য করে তাই ভাবি।

    বড়মানুষ তমন সহ্য করে থাকে। না করে গতি কি? সেকালে রাজা-জমিদারের ঘরে পরিবারদের সোয়ামীদের বেচাল সহ্য করতে হত, একালে সাহেব সুবোদের ঘরে সোয়ামীদেরই পরিবারের বেচাল সহ্য করতে হয়। সহ্য না করে চেঁচামেচি করলেই তো লোকজানাজানি। আপনার মুখে আপনিই চুনকালি মাখানো।

    কিন্তু আদর-সোহাগেও তো কমতি দেখি না কিছু। একটু মাথা ধরল তো ডাক্তার এনে হাজির করল। একটু রান্নাঘরে এল তো মাথা ধরবে বলে বকাবকি। তার ওপর তোমার গে, গয়নার ওপর গয়না, শাড়ির ওপর শাড়ি।

    ধন্যি কপালখানা বটে!

    .

    এমনি আলোচনার গুঞ্জনের মাঝখানে বাইরে গাড়ি থামার শব্দ হল। পরিচিত শব্দ। অতএব বোঝা গেল গিন্নী ফিরলেন।

    নিথর সমুদ্রে ঢিল পড়ল।

    অস্ফুট একটা ধ্বনি উঠল, মিসেস পালিত এলেন।

    সকলেই যেন নতুন করে নড়ে-চড়ে বসল। সেই অবাঞ্ছিত অতিথিও।

    হাতের সেই অ্যাটাচি-কেসটা একটু যেন বিশেষ করে বাগিয়ে ধরল, আর একটু যেন খাড়া। হয়ে বসল।

    মিসেস পালিত যথারীতি হাঁপাতে হাঁপাতে একগোছা চামচ হাতে করে সিঁড়ি দিয়ে উঠে আসছিলেন, হঠাৎ মিস্টার পালিত সামনে দাঁড়ালেন; গম্ভীরভাবে বললেন, ও-ঘরে নয়, এ-ঘরে।

    কেন, এ-ঘরে কি? ভুরু কোচকালেন মিসেস পালিত।

    দরকার আছে।

    থাম। রাখ তোমার দরকার। আমি বলে এখন মরছি।

    পাগল হয়েছ! অমন অমঙ্গলের কথা বলতে আছে! এখুনি মরবার কি হয়েছে? না না, ওদিকে না এদিকে।

    কি আশ্চর্য! তোমার কি এখন রঙ্গ-তামাসা করবার সময় হল? অতিথিরা বসে রয়েছেন।

    থাক না। বসে যখন রয়েছেন, আর কিছুক্ষণ না হয় থাকলেন। আমার কথাটা হয়ে যাক।

    মিসেস পালিত বিরক্ত আর বিচলিত স্বরে বলেন, তা অত গৌরচন্দ্রিকার দরকার কি? যা বলবার বলে ফেল।

    উঁহু–এখানে নয়, ওদিকে।

    আশ্চর্য! এরকম ঢঙের মানে? তোমার দরকারী কথা থাক, যেতে দাও আমাকে!

    যাবে যাবে। যার জন্যে এত ব্যস্ততা সে ঠিকই এসে গেছে। কিন্তু নর্মদা, ভাবছি তোমরা মেয়েরা এত বোকা হও কেন? আজ এতলোকের মাঝখানে ওকে ডাকবার হেতু কি? বেশ নিরালায় একদিন ডাকলেই তো

    কি বকছ বাজে-বাজে? কাকে ডেকেছি?

    ওঃ, বুঝতে পারছ না বুঝি? আমি বলছিলাম মিস্টার মিত্তিরের কথা। শ্রীকনক চন্দ্র মি—

    তার মানে? কি বলতে চাইছ তুমি?

    আহা-হা, অত উত্তেজিত হচ্ছ কেন? উত্তেজিত হবার কি আছে? আমি শুধু একটি নিরীহ প্রশ্ন করছিলাম। বলছিলাম, ওর সঙ্গে যে এ-যাবৎ যোগাযোগ রেখেছিলে সে খবরটা যখন এতদিন চেপে রেখেছিলে, তখন আজ হঠাৎ

    তোমার এইসব অর্থহীন কথা শোনার মত প্রচুর সময় আমার নেই! বলে ঠিকরে ও-ঘরে গিয়ে পড়েন নর্মদা। আর গিয়ে পড়েই সহসা যেন পাথর হয়ে যান।

    কে? কে? কে এখানে?

    এই যে শ্রীমতী নর্মদা দেবী! আমন্ত্রিত অতিথিদের ফেলে এতক্ষণ ছিলেন কোথায়?

    কনক মিত্তির উঠে দাঁড়ায়। বিনয় নমস্কারের ভঙ্গিতে মাথাটা ঈষৎ ঝুঁকিয়ে।

    রান্নাঘরের চাকর নতুন বেহারার কাছে ঘনিষ্ঠ হয়ে বলে, তুই তার কি জানিস! আমি এদের হাড়হদ্দ সব জানি, সব দেখেছি। আজকে তত আসি নি এ বাড়িতে! সেদিন ওই বাবুটাকে পিছনের ওই ঘুরনো লোহার সিঁড়ি দিয়ে নেমে যেতে দেখেছিল কে? এই আমি, বুঝলি? অবাক। হয়ে হাঁ করে দেখেছি–মানুষটা ট্রেন ধরবে বলে মেমসাহেব তাড়া দিয়ে আগে-ভাগে ওর জন্যে ফ্রাই কাটলেট সব ভাজিয়ে নিয়ে গেল, অথচ এতক্ষণ ও রইল কেন? তারপর থালা থালা চপ কাটলেট-ফ্রাই ভাজলাম, সব ভস্মকীটেদের পেটে ঢুকে গেল, দুখানা রইল না আমাদের জন্য। হাঁড়ি-ভর্তি মাংস-পোলাও সব পাচার হয়ে গেল, ও কোথায় ছিল? কি করছিল? আর রইলই যদি, সামনের সিঁড়ি দিয়ে না গিয়ে পিছনের সিঁড়ি দিয়ে কেন, আর হাতেই বা কি ওর? কি বলছিস? আসলে লোকটা এ বাড়ির কে? ও কথাটা জিজ্ঞেস করিস না, ওইটি বলতে পারব না। সব জানি, ওইটি জানি না। হা! কি বলছিলাম, হাঁ করে ভাবছি, স্বপ্নেও জানি না ওকে চেপে ধরে চেঁচালে ভাল হত, হঠাৎ শুনি ভেতর বাড়িতে হৈ-হৈ। পড়ি তো মরি করে ছুটে গিয়ে দেখি মেমসাহেব অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে, ঘরে অজ্ঞানের ওষুধের বিটকেল-বিটকেল গন্ধ আর মেমসাহেবের লোহার আলমারির পাল্লা দুহাট করে খোলা।

    বুঝতে দেরি হল না এ ঘটনার কর্তা কে। আর পালাবার সময় হাতেই বা কি ছিল ওর! আর কিছু নয়, ছোট একটা সুটকেস। তার মধ্যে করেই মেমসাহেবের যথাসর্বস্ব নিয়ে গেছে। উঃ, কম গয়না ছিল মেমসাহেবের! আর সবই হীরে-মুক্তো-চুনী-পান্নার। গিন্নীর তাবন্ত জন্মদিনে, তারপর তোমার গে, নতুন বছরে, পূজোর সময় একখানা করে গয়না বরাদ্দ ছিল তো কর্তার। গিন্নী বলত, এবার আমায় সোনার গয়না দিতে হবে। কর্তা বলত, সোনা! ও কি আর ভদ্রলোকে পরে? গাঁইয়ারা পরে। জড়োয়াই আসল ভাল।

    তা সত্যি, কথাটা মিথ্যে নয়।

    গিন্নী যখন কোথাও যেত যা ঝকমকাত, যেন মহারাণীর মত!

    সেই সমস্ত গয়না নিয়ে গেল বাবুটা?

    হ্যাঁ, এতদিনের এত চেনা-জানা, এত খাওয়া-মাখা, এই তার প্রতিদান! ছোটলোকরাই নাকি ছোটলোক নেমকহারাম। হু! কি বলছিস? বলে দেওয়ার কথা কি বলছিস?

    বলছি, বাবুটার কথা সবাইকে বলে দিলি না?

    আরে বাবা, তখন আমার মধ্যে বুদ্ধির জিলিপি খেলে গেছে। বলি, আমি চাকর-নফর মানুষ, আমার অত বাহাদুরী দেখাবার কি দরকার? শেষকালে আমাকে নিয়েই টানাটানি করুক আর কি। যত দোষ নন্দ ঘোষ তো এই চাকর-বাকররা। ভদ্দরলোকে যত কাণ্ড করছে, সব ধামাচাপা। জাহির হতে এই ছোটলোকদের দোষ ঘটে। কাজ কি আমার সত্যিকথা প্রকাশ করায়? চোখ দেখল, মন জানল, চুকে গেল ল্যাঠা। মুখ যদি বলে ফেলল, তাহলেই তো খাল কেটে কুমীর আনা!

    তা ধম্মের কল বাতাসেই নড়ল। দেখবি ত দে গিন্নীর ভগ্নিপতিই দেখল। ডাক্তার মানুষ কাজে আটকা পড়ে সময়ে আসতে পারে নি, পরে আসছিল, গেটে ঢুকতে গিয়ে দেখেছে মিত্তিরবাবু একটা ছোট সুটকেস হাতে করে চোরের মতন পালাচ্ছে। চেনা-জানা তো আছে, তবু যেন চিনতেই পারল না। সেই কথাই বলল ডাক্তার ভগ্নীপতি। তা যাই এসে পড়েছিল তাই মেমসাহেবের সময়ে অজ্ঞান ভাঙল, নইলে আরও যে কী হত!

    অবিশ্যি জ্ঞান ফিরেই মেমসাহেব কেঁদে কেঁদে এই কথাই বলল, কে এমন কাজ করল টেরই পায়নি সে। মাথার যন্ত্রণা হচ্ছে বলে, একটু জিরিয়ে নিতে এসেছিল, হঠাৎ পেছন থেকে ওষুধের রুমাল নাকে ঠেকিয়ে অজ্ঞান করে দিয়ে কোমরে গোঁজা চাবির তোড়া খুলে নিয়ে এই কাজ করেছে।

    কেঁদে কেঁদে বলতে লাগল, ও জামাইবাবু, আমার কতদিনের কত স্মৃতি মাখানো কতটাকার গয়না। সব গেল। কে এমন কাজ করল। চারিদিকে লোকের ভীড়, তার মধ্যে এত সাহস কার হল!

    মেসোমশাই গম্ভীর মুখে বলল, কার সাহস হল তা আমি জানি। নিজের চক্ষে দেখেছি। ভীড়ের মধ্যেই তো সাহস। কার দোষ কার ঘাড়ে চাপে। বলল, অত চালিয়াৎদের এই অবস্থাই ঘটে। তারা চালবাজীর খরচ জোগাতে বাপের বাক্স ভাঙে, লক্ষ্মীর কৌটোয় হাত দেয়। তোমাকে সর্বস্বান্ত করে গেছে ওই চালিয়াৎ কনক মিত্তির।

    মেমসাহেব অবিশ্যি রেগে আগুন হয়ে বলেছিল, এ হতে পারে না! কিন্তু হতে যদি পারে না তো মানুষটা ফেরার হল কেন? বিদেশে চাকরি করতেই যদি গিয়ে থাকে, চিঠি তো দেবে? যাদের সঙ্গে এত ভালবাসা! পৃথিবী উল্টে গেলেও তো নিত্য দিন আসার কামাই ছিল না। আমাদের আর বলবার কি আছে? বড়লোকের বাড়ির চাকর চোখ থাকতেও কানা, স্বর থাকতেও বোবা। এই চা, এই কফি, হুকুম আসে তামিল করি, ব্যস।

    কিন্তু জগৎ সংসার তো আর কানাও নয় বোবাও নয়। তারা বলল পুলিসে হুলিয়া কর। সাহেব বললেন, থাক, লোক জানাজানিতে দরকার নেই–যতই হোক এতদিনের বন্ধুলোক।

    আসল কথা ঘরের কথা জানাজানির ভয়। ওরা অবিশ্যি ভাবে, কেউ কিছু জানে না, কেউ কিছু বোঝে না, বুঝলি নিধু? মনে করে চাকর বাকর ক্লাস সব নীরেট গাধা। আরে বাবা, যে যতই গবেট গাধাই হোক, আর কিছু না বুঝুক, মেয়ে-পুরুষের ভাবভালবাসার খবর ঠিক বোঝে। মরুক গে যাক। তবে একথা বলব, মিত্তিরবাবু লোকটা খুব খারাপ ছিল না। তবে নাকি মেয়েছেলের কবলে পড়লে মুনি-ঋষিরও মতিচ্ছন্ন ঘটে, তা এ তো তুচ্ছ মানুষ। ওই ধিক্কারে বিয়ে করিনি বুঝলি নিধু? বিয়ে করলে তো আর আমাতে আমি থাকব না।

    বুকের বল থাকলে থাকবি না কেন শুনি? শুনবি কেন মেয়ে ছেলের কথা?

    তুই আর হাসাস নে নিধু। তিন-ভুবনে যা হয়ে আসছে, আমার জন্যে তা পাল্টাবে? তবে হ্যাঁ, পরস্ত্রীর পোষা বাঁদর হওয়ার চাইতে নিজের বিয়ে করা পরিবারের কেনা গোলাম হওয়াও ভাল। আমি তো এই বুঝি!

    নিধুকে আর বেশি ব্রহ্মজ্ঞানের শিক্ষা দেওয়া হয়ে ওঠে না, নিধু ছুটে চলে যায় দোতলা থেকে ডাক পেয়ে।

    জল চাই! জল!

    মেমসাহেব মূর্ছা গেছেন।

    .

    তাক বুঝে মূর্ছা যেতে পারলে সংসারের অনেক অসুবিধেজনক অবস্থার হাত এড়ানো যায়। নীলাঞ্জনা বলে বীথিকাকে। হিসেব মত যে মহিলা দুটি নাকি নর্মদার বান্ধবী।

    কিন্তু বান্ধবী বলে যে আড়ালে সমালোচনা করবে না, এমন ভাববার কোন হেতু নেই। মেয়েদের স্বধর্ম সমালোচনা। এতে তাদের স্বাভাবিক পটুত্ব। একমাত্র আত্মসমালোচনা বাদে আর কার না সমালোচনা করে তারা?

    গুরুর করে না? ইষ্টের করে না?

    বীথিকা নাক কুঁচকে বলে, তা যা বলেছিস! কিন্তু ওই পতন ও মূৰ্ছা, এ তো সেকেলে হয়ে গেছে

    হুঁ! আর সেই হাত-পা মাথা বাঁচিয়ে কায়দা করে ঢলে পড়া। আমার বিশ্বাস হাতের কাছে ডানলোপিলো দেওয়া ওই ডিভানটা না থাকলে নির্ঘাৎ, ও পিছু হঠতে হঠতে, সুবিধে-মাফিক জায়গা বেছে নিয়ে তবে পড়ত।

    মনে করে সবাই ওর অভিনয়ে ভোলে। নেহাৎ নাকি চুপ করে থাকা।

    ওই তো মজা। তুমি ভদ্রতার দায়ে চুপ করে থাক, যারা নিজেকে ভারি বুদ্ধিমান ভাবে, তারা ভাববে তুমি বোকা।

    কিন্তু আমি শুধু ভাবছি মিস্টার পালিতের সহ্যশক্তির কথা। কি করে এই অভিনয়, এই ন্যাকামী আর এই যথেচ্ছাচার সহ্য করে আসছেন।

    কি করবেন, ওই ভদ্রতার দায়।

    তা বাপু আকুলি-বিকুলিও তো কম না। স্ত্রীর মূৰ্ছায় ব্যস্ততার বহরটা দেখলি তো?

    ওর সবটাই খাঁটি ভেবেছিস!! তিনভাগ শো, বুঝেছিস?

    আরে বাবা, আমার মতে এই চর্মচক্ষে যা কিছু দেখতে পাওয়া যায় সেটাই খাঁটি। হৃদয়ের গভীর গুহায় কী আছে তা কে দেখতে যাচ্ছে? আর দেখতে যাওয়াই কি বুদ্ধিমানের কাজ? সেখানে কেঁচো খুঁড়তে গেলে সাপ বেরোবার সম্ভাবনাই বেশি।

    কিন্তু ভদ্রলোকের জীবন কী দুর্বহ!

    আহা, বিগলিত হচ্ছিস যে একেবারে। জীবনটা সুবহ করে তোলার ভার নিয়ে দেখবি নাকি?

    থাক, ঢের হয়েছে। চল, ভিতরে গিয়ে বসি। দেখি আরও কি তামাশা হয়!

    বান্ধবীকৃত্য সমাপন করে, মহিলা দুটি বারান্দা থেকে ফের ঘরে গিয়ে বসেন।

    এই নিয়ে তিনবার তাদের জায়গা বদলাবদলি।

    ওরা অনেক বাজে কথা বলে, তবে মাঝে-মাঝে কিছু সত্যি কথাও বলে। তাক বুঝে মূৰ্ছা যেতে পারলে জগৎ-সংসারের অনেক ঝড়-ঝাপটার হাত এড়ানো যায় বৈকি।

    এই ভয়ঙ্কর মুহূর্তে নর্মদাকে কে রক্ষা করত ওই মূৰ্ছা ছাড়া?

    এই মূৰ্ছার অবসরে, জগৎ-সংসারের চোখের সামনে থেকে চোখটা বুজে থাকার অবসরে আকাশ-পাতাল কত কথাই ভাবতে পারছেন নর্মদা।

    ভাবছেন, আর ঘরে যে কথাগুলো উচ্চারিত হচ্ছে তাকে অজ্ঞান-অচৈতন্য ভেবে, সেগুলো শুনেছেন শ্রবণশক্তিকে তীক্ষ্ণ করে।

    .

    ঠিক যে মুহূর্তে মূর্ছা গেলেন নর্মদা, ভয়ঙ্কর একটা হৈ-চৈ উঠল। প্রায় সেই তিন বছর আগের মতই। তবে এটা থেমে গেল তাড়াতাড়ি। সেদিনকার ঘটনা ছিল আলাদা। সেদিন মূৰ্ছাটা ছিল গৌণ। কাজেই ঘরে একটা উগ্র ওষুধ-মাখা রুমাল পড়ে থাকলেই ঘরে থাকা মানুষটার একেবারে জ্ঞান-চৈতন্য হারিয়ে অসাড় হয়ে যাওয়া সম্ভব কি না, এ নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় নি। উত্তেজনার কারণ রয়েছে অন্যত্র। সেদিনের মুখ্য ব্যাপার ছিল দু-হাট করে পাল্লা-খোলা গডরেজের আলমারিটা।

    মিস্টার পালিতের অনেক আদরের আর অনেক ধনবত্তার সাক্ষ্য নর্মদার জড়োয়ার গয়নাগুলি থাকত যে আলমারিতে।

    চোখ বুজে সেদিনের সমস্ত ছবিটা আগাগোড়া ভাবতে লাগলেন নর্মদা, সিনেমার ফ্লাশ ব্যাকের মত।

    নিমন্ত্রিতেরা খেতে বসেছে, নর্মদা উঠে গেলেন ক্ষমা চেয়ে আর দুঃখ জানিয়ে। বললেন, অসম্ভব মাথার যন্ত্রণা হচ্ছে, একটু শুয়ে না নিলে

    হ্যাঁ, একটু শুয়ে নেবার জন্যে নিজের শোবার ঘরে চলে এলেন নর্মদা। চাকর-বাকররা সকলেই ওদিকে কাজে ব্যস্ত, এ তল্লাটে কেউ নেই। এদিকটা নির্জন।

    অতএব ঘরের আলো নিভিয়ে একটু বিশ্রাম করে নেওয়া যায়। কমিয়ে নেওয়া যায় মাথার যন্ত্রণা। কিন্তু ঘর তো অন্ধকারই ছিল। নর্মদা ঘরে ঢুকতেই একটা মৃদুকণ্ঠ অসহিষ্ণু হয়ে বেজে উঠল, আমায় কেন আটকে রাখলে? এ ট্রেনটা বোধকরি আর ধরা হল না–

    এ ট্রেন ধরতে হবে না। সামান্য ওই চাকরিটার জন্যে অতদূরে চলে যেতে তোমায় দেব না আমি। নিজের গলার সেই চাপা ফিসফিস শব্দটা যেন এখন আবার নতুন করে শুনতে পাচ্ছেন নর্মদা। তুমি কি জান না, তোমায় না দেখতে পেলে আমি মরে যাই?

    কিন্তু কতদিন আর এমন করে তোমায় ভাঙিয়ে চলবে নর্মদা? নিজের উপর ঘৃণা আসছে। তোমার টাকায় পোশাক কিনে সেজে তোমার বাড়িতে বাহার দিই, তোমার দেওয়া টাকায় তোমাকে উপহার কিনে দিয়ে লোকের কাছে মুখ রাখি, এ জীবন আর ভাল লাগছে না।

    জানি জানি, আমি টের পেয়েছি তোমার আর ভাল লাগছে না। কিন্তু আমি কি নিয়ে বাঁচব কনক? দেখেছ তো আমার ঘর, আমার সংসার? কিন্তু বেশি কথা বলবার সময় আর নেই, ওরা ওঠবার আগে পালাতে হবে তোমায়। ওরা জানে তুমি চলে গেছ, এতক্ষণে হাওড়া স্টেশনে পৌঁছে গেছ। এই নাও, এগুলো নিয়ে যাও। অনেক গহনা আছে এতে, সব দামী জড়োয়ার। এগুলো বিক্রী করে তুমি একটা ব্যবসা করে। ব্যবসায় পয়সা আছে। মফস্বল শহরের ওই সামান্য চাকরিতে তোমার কি হবে? কিন্তু যাও, যাও, পালাও। ধরো, এই অ্যাটাচিটায় পুরে দিয়েছি। আলমারি এমনি খোলা পড়ে থাক, চাবি ঝুলুক। এই নাও ওষুধ-মাখা রুমালটা। এটা আমার নাকের কাছে ফেলে রেখে যাও। রোসো রোসা, বরং আরও ভাল হবে অজ্ঞান হয়ে যাওয়া আমাকে খাটের পায়ার সঙ্গে বেঁধে রেখে গেলে। পারবে না? কী আশ্চর্য! আমার বিপদটা বুঝছ না? আমি সজ্ঞানে জেগে বসে থাকলে তো সব প্রকাশ হয়ে পড়বে। মনে রাখো, বাইরের চোর এসে আমাকে ক্লোরোফর্ম করে বেঁধে রেখেও কনক, যা বলছি কর। দেরি করো না, দেরি করো না। দেরি করলে দুজনকে মরতে হবে। আমার মেয়েটা কোথায় আছে। দেখতে পাচ্ছি না, কে জানে কখন এসে পড়বে। ওকে আমার বিশ্বাস নেই। মনে হয় ও সব বোঝে। কনক নাও! ধর এটা। তারপর মনে আছে তো? ওখানে গিয়ে তুমি একটা চিঠি লিখবে। লিখবে চাকরি খারাপ, থাকা অসম্ভব। চলে আসছি। তারপর তোমার দূর গাঁয়ের কোন দূর সম্পর্কের দিদিমার সম্পত্তি পাবে তুমি। লুকনো টাকার গাদা। সেই দিয়ে ব্যবসা কাঁদবে তুমি। মনে রাখছ তো সব? যাও, যাও শীগগির। এই যে এইটা দিয়ে বাঁধো, আমারই আলনার এই শাড়িটা দিয়ে। ওই কে যেন আসছে। এটা নাও কনক, তোমার পায়ে পড়ি। কিন্তু না না, সত্যি অজ্ঞান করে ফেলো না আমায়, তাহলে বুঝতে পারব না কে কী বলছে। শুধু নাকের কাছে ফেলে রাখ। হ্যাঁ, ঠিক হয়েছে। ওই ওরা উঠে পড়েছে বোধহয়। এক্ষুনি আমায় খুঁজতে আসবে, দেখতে আসবে আমি কেমন আছি। আচ্ছা, আবার শীগগির দেখা হবে। দ্বিধা করো না কনক, তোমার কাছে তো আমি আর কিছু চাই না, চাই শুধু রোজ একবার তোমায় দেখতেতার বিনিময়ে আমার সব কিছু দিয়ে দিচ্ছি। পালিত আমায় ভালবাসা দিতে পারে না, শ্রদ্ধা-সম্মান দিতে পারে না, তাই অনেক গহনা দেয়। ভাগ্যিস দেয়। ওর বদলে আমি তোমাকে পাবো কনক। দেখ, মনে হচ্ছে সত্যি সত্যি অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছি আমি। এ রকম কেন হচ্ছে বল তো?

    না, তবু সেদিন সত্যি অজ্ঞান হয়ে যাননি নর্মদা। অসম্ভব স্নায়বিক উত্তেজনা, অন্ধকার ঘর আর খোলা মেজেয় পড়ে থাকা, এই তিন মিলিয়ে নর্মদাকে যেন এই পরিচিত জগৎ থেকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছিল। তবু সব টের পাচ্ছিলেন তিনি। টের পাচ্ছিলেন রাতদিনের ঝি কানন কি যেন বকবক করতে করতে ঘরে এল, এসেই ফট করে ঘরের আলোটা জ্বালল, তারপর হাঁকপাঁক করে চেঁচিয়ে উঠল।

    তারপর হুড়মুড় করে ও-ঘর থেকে এসে পড়ল আমন্ত্রিত অতিথিরা। তাদের উত্তেজিত কলকোলাহল বোধকরি একটা মরা মানুষকেও সাড়া এনে দিতে পারত, কিন্তু নর্মদা অসাড় হয়েই পড়ে থাকলেন, যতক্ষণ না মুখে জল পড়ল, বাতাস পড়ল, ওষুধ পড়ল। আর জ্ঞান হতেই গহনার শোকে কাঁদতে হল নর্মদাকে। তার জন্মদিনে আর বিবাহবার্ষিকীর দিনে স্বামীর কাছে পাওয়া ভালবাসার উপহারগুলি এমন করে চুরি হয়ে যাওয়ার শোকে এত বেশী ব্যাকুল কাতর হয়ে উঠলেন তিনি যে, পালিতসাহেবকে বলতে হল, সামান্য গহনার জন্যে এত ভাববার কি আছে? জুয়েলারীর দোকানগুলো তো আর রাতারাতি উঠে যাচ্ছে না? আমিও কিছু দেউলে হয়ে যাচ্ছি। না। তোমার প্রাণটা যে বেঁচেছে এই ঢের। ভাব দেখি, যদি তোমায় মেরেকেটে এ কাজ করত?

    তারপর অবশ্য আলোচনার মোড় ঘুরে গেল। ডা

    ক্তার ভগ্নিপতি বললেন, তিনি দেখেছেন চোরকে। পরিচিত চোর।

    নর্মদা বললেন, অসম্ভব।

    কিন্তু নর্মদার আর সে জোর বজায় রইল কই?

    আচ্ছা, নর্মদা কি সত্যিই আশা করেছিলেন সে জোর তার বজায় থাকবে? সত্যিই তাঁর নির্দেশ অনুযায়ী কাজ হতে থাকবে? বিদেশ থেকে চিঠি আসবে চলে আসছে কনক, চলে এসে দূর সম্পর্কের দিদিমার টাকা পাবে সে, আর সেই টাকায় ব্যবসা করে বড়লোক হয়ে কলকাতাতেই চিরস্থায়ী বসবাস করবে নিত্য একবার নর্মদাকে দেখা দেবার জন্যে। এমন অদ্ভুত কথা ভাববেন, সত্যিই কি আর এমন বোকা নর্মদা?

    না, এখন অন্তত সম্পূর্ণ অন্য কথা ভাবছিলেন নর্মদা। ভাবছিলেন, এতদিন পরে ও আবার এল কেন? আমি তো ধারণা করিনি ও আবার আসবে। আসবে না ভেবেই তো নতুন করে নিজের বেঁচে থাকার পথ খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম। আর এখন ওকে দেখার কী আছে আমার? কিন্তু ও আবার এসেছে। ঈশ্বর জানেন কী মতলবে।

    ভাবছিলেন, কতক্ষণই বা মূৰ্ছাতুর হয়ে পড়ে থাকা চলে? আর একটু পরেই তো আস্তে আস্তে কাঁপাতে হবে চোখের পাতা, কাঁপাতে হবে লালরঙে ছোপানো ঠোঁট দুখানি, তারপর মুদিত কমল-কলির মত খুলতে হবে চোখের সেই কাঁপা-কাঁপা পাতা দুটি। ক্ষীণকণ্ঠে বলতে হবে, আমার কী হয়েছে?

    কিন্তু তারপর?

    তারপর ও যদি সব প্রকাশ করে দেয়? এই এত লোকের মাঝখানে যদি উদঘাটিত হয়ে যায় সব সত্য, সব বানানো গল্প।

    যদি ধরা পড়ে যায়, চোর আর কেউ নয় স্বয়ং নর্মদা নিজে?

    কী বলবে এরা? চোর চোর চোর! এই তো।

    আশ্চর্য, এ সংসারে নিজের জিনিসও নিজে নেওয়া যায় না। ব্যবহার করার বাইরে আর কিছু করতে গেলেই, চুরি করে নিতে হয়। নিজের জিনিস কথাটার অর্থ কী তাহলে?

    না, সত্যকার অর্থ কিছু নেই।

    কনক মিত্তির যদি সেদিনের কথা সব প্রকাশ করে দেয়, এরা সকলেই বলবে, ছি ছি, মিসেস পালিত এই।

    মূছার অবসরে তাই মনকে দৃঢ় করতে থাকেন নর্মদা। ভাবতে থাকেন কেমন করে সরাসরি অস্বীকার করবেন কনকের সেই অভিযোগ। কেমন চড়া আর কড়াগলায় বলবেন, অনেক ঘাটের জল খেয়ে এসে বুঝি খুব চালাক হয়ে উঠেছ তুমি? চমৎকার একটি গল্প বানিয়ে ফেলার মত চালাক?

    কিন্তু না বোধহয়। ও বোধহয় কিছু প্রকাশ করবে না।

    চোখ বুজে আর শ্রবণশক্তি তীক্ষ্ণ করে শুয়ে থাকা মানুষটা শুনতে পায় পরিষ্কার ঘসা-মাজা একটি গলা, নমস্কার মিস্টার পালিত, আমি বলছিলাম কি, আমি তাহলে এবার উঠি। মনে হচ্ছে ওঁর চৈতন্য ফিরতে একটু দেরীই হবে। আমি আর ততক্ষণ না বসলাম। চৈতন্য ফিরলে ওঁকে এটা দিয়ে দেবেন।

    দিয়ে দেবেন!

    কী দিয়ে দেবেন? কাবেরীর জন্যে কোনও উপহার? বুকের ভিতরটা আকুলি-বিকুলি করে ওঠে নর্মদার। কী করে দেখা যাবে? চোখটা একটু খুলবেন? না কি সহসা ধড়মড়িয়ে উঠে বসবেন?

    ভেবে ঠিক করার আগে পালিতসাহেবের ভারী গলার উত্তরটা শোনা গেল, চৈতন্য ফেরার কথা বলা বড় শক্ত মিস্টার মিত্র। ও যে কখন ফেরে আর কখন না ফেরে। কিন্তু এখুনি চলে যাবেন কি বলছেন? যে ভদ্রমহিলা এত যত্ন করে আপনাকে তার মেয়ের জন্মদিনে নেমন্তন্ন। করলেন, তার সঙ্গে দেখা করুন, নেমন্তন্ন খান, তবে তো?

    নেমন্তন্ন আমাকে কেউ করে নি, মৃদু হাসির সঙ্গে বলে কনক, মেয়ের জন্মদিন সেটাও আমার স্মরণ ছিল না। যদিও স্মরণ থাকা উচিত ছিল। তা উচিত কাজ আর কটাই বা হয়ে ওঠে? স্মরণ ছিল না, এসে দেখলাম বাড়িতে উৎসব। ঠিক যে রকম উৎসবের দিন লাস্ট দেখা হয়েছিল আপনাদের সঙ্গে।

    হ্যাঁ, ঠিক যেদিন থেকে আপনি ফেরার হলেন।

    জোর গলায় হেসে ওঠেন পালিতসাহেব।

    আর কত পারা যায় চোখ বুজে পড়ে থাকতে?

    সেই অসতর্কতার অবসরে ওই দস্যু নিশ্চয় সব বলে দেবে। সেই খাতেই আলোচনাকে এনে ফেলছে।

    নর্মদা চোখ খুললেন। মুদিত কমল-কলির ধীর প্রস্ফুটনের মত নয়, খুললেন আচমকা ঘুম ভাঙার মত।

    বলে উঠলেন, জল খাব।

    .

    তারপরের কথা ভাবতে পার তুমি?

    বীথিকার স্বামী সভায় আসে নি, তাই বাড়ি ফিরে স্বামীর কাছে বিশদ বর্ণনায় মুখর হয়ে ওঠে বীথিকা। তারপর, জল খাবার পর, ওঃ নর্মদাটা যে এমন হতে পারে কে কবে ভেবেছে? স্কুলে কলেজে অনেকগুলো বছর তো কাটিয়েছি ওর সঙ্গে? বলেওছি তোমায়, লেখাপড়ায় কত ভাল ছিল, চাল-চলন সভ্য, কথাবার্তা মার্জিত, গান জানত সুন্দর। এক কথায় রীতিমত একটি বিশিষ্ট মেয়ে। সে কি না জীবনের ক্ষেত্রে হয়ে উঠল একটি অভিনেত্রী! ওই মূৰ্ছা, ও কি সত্যি মূৰ্ছা? মূৰ্ছার অভিনয় করে পুরুষকে ফাঁকি দেওয়া যায়, মেয়েদের যায় না। মেয়েদের চোখ বড় তীক্ষ্ণ।

    পুরুষদের তীক্ষ্ণ নয়, একথা তোমাকে কে বলেছে? হেসে ওঠে বীথিকার বর বিকাশ।

    পুরুষরা ভদ্রতার বশে অবোধ সেজে থাকে। জীবনের ক্ষেত্রে মেয়ে-পুরুষ সবাই আমরা অভিনয় করে চলেছি।

    ওঃ, তাই নাকি? তাহলে আমারও ভরসা করবার কিছু নেই?

    কিছু না।

    বকো না, থাম। যার কথা হচ্ছে, তার কথাই হোক। সত্যি বলতে কি, আসলে মেয়েটা ভালই কিন্তু কাল করল ওকে ওর ওই প্রেম।

    প্রেম তো চিরকালই কাল করে এসেছে। ও আর নতুন কি। সেই শ্রীরাধিকার আমল থেকে

    আহা মশাই, সে নয়। প্রেমে পড়া নয়, প্রেম খোঁজা।

    প্রেম খোঁজা! বিকাশ হেসে উঠে বলে, গরু খোঁজা বলে একটা কথা আছে শুনেছি। কিন্তু

    নাঃ, তোমার সঙ্গে সিরিয়াস কথা কইবার জো নেই। ওর বাসনা কি ছিল জান? একখানি নির্ভেজাল খাঁটি প্রেম। সেই বস্তু খুঁজে বেড়াত ও। ছেলেবেলা থেকে। বন্ধুদের মধ্যে, সখীদের মধ্যে–

    আর বড় হয়ে বোধ করি সখাদের মধ্যে?

    হা মশাই, তাই। কিন্তু সবাই ওকে হতাশ করত। তবু ও আবার নতুন অন্বেষণের পথে পা বাড়াত। বলত কি জান? জীবনের শেষদিন পর্যন্তও যদি খুঁজতে হয়, তবু খুঁজে নেব তারে, আমার মনের মানুষ যে রে।

    তোমার বান্ধবীর বুঝি ঠাকুমা ছিলেন না?

    ঠাকুমা! ঠাকুমা মানে? বীথিকা অবাক হয়ে বলে, মা বাপ ছিলেন না, ছেলেবেলায় মারা গিয়েছিলেন তাই জানি। ঠাকুমার প্রশ্ন ওঠে নি কোনদিন। হঠাৎ ঠাকুমা প্রসঙ্গ কেন বল তো?

    না, মানে, আমার ঠাকুমা বলতেন কি না ঘরে নেই যা, ছেলে চায় তা। ওর ঠাকুমা বোধহয় ওকে সময়ে এ সুশিক্ষা দেন নি। মনের মানুষ! বাপস!

    হুঁ, বুঝছি, সব বুঝছি, তুমি কি চীজ একখানি। তা ঠাকুমা না থাক আমরাই ওকে জ্ঞান দান করতে চেষ্টা করতাম। বলতাম, ও সব বাজে পাগলামী ছাড়, এবেলা ওবেলা প্রেম-পাত্র বদলে বদলে আর নির্ভেজাল প্রেম খুঁজে বেড়াস নে বাবা, দেখে-শুনে ভালমত একটা বিয়ে কর। দেখবি প্রেম-বাই পৃথিবী ছেড়ে পালাতে পথ পাবে না।

    তা তোমাদের নিজেদের তখনই এতটা জ্ঞান জন্মেছিল?

    বীথিকা সগর্বে বলে, নিশ্চয়! জ্ঞান নিয়েই জন্মেছি, বুঝলে? কিন্তু ও আমাদের কথায় শুধু আমাদের প্রতি করুণার কটাক্ষ নিক্ষেপ করত। ভাবটা যেন আমরা কোথায় আর ও কোথায়। তারপর নিত্যি নানা রকম। একবার এক প্রফেসরের সঙ্গে প্রেম এমন জমে উঠল, আমরা ভাবলাম, যাক বাবা, এতদিনে হল সুরাহা। এবার খুব একটা নেমন্তন্ন। ওমা, কদিন পরে হঠাৎ দেখি একা একা ঘুরছে নর্মদা। চুল রুক্ষু, মুখ শুকনো। কী ব্যাপার?

    না, ধিক্কার হয়ে গেছে।

    বললাম, কেন, কী করল প্রফেসর?

    ও বলছে, বিয়েতে ওর মা টাকা চান।

    অ্যাঁ! বল কি? বিকাশ চোখ কপালে তোলে।

    তাই তো বললে। ও নাকি বলেছিল, আমার বাবা নেই, টাকা দেবার লোক নেই, এ কথাটাই আসল কথা নয়। বিয়ের কর্তা কাকা হয়তো গতানুগতিক নিয়মে টাকা দিতে প্রস্তুত হতেও পারেন, কিন্তু ঘুষ নিয়ে তুমি আমায় গ্রহণ করবে?

    প্রফেসর বলেছিল, ঘুষের কথা কি আছে? এ তো সাধারণ একটা প্রথা মাত্র। মা সেকেলে লোক, প্রথাটাই বোঝেন। মাকে অসন্তুষ্ট করে আমি কি করে

    নর্মদা বলল, ঠিক আছে।

    তারপর কিছুদিন কাটল একা একা, আবার দেখি ক্লাসের একটা ছেলের সঙ্গে খুব মাতামাতি জুড়েছে। হাঁদা নাম্বার ওয়ান ছেলেটা কৃতার্থন্মন্যের মত ওর পায়ে পায়ে ঘোরে, নর্মদা তাতেই বিভোর।

    আমরা বলি, কি রে, এতদিনে পেলি খুঁজে?

    নর্মদা পরিতৃপ্তির হাসি হাসে। ঢলঢলে চোখে বলে, সত্যি ভাই, ছেলেটা যথার্থ খাঁটি। দেখছি, একটু অবোধ একটু বোকাদের মধ্যেই সত্যি ভালবাসা থাকে। ওকে নিয়েই গড়ব আমার ঘর।

    তারপর যথারীতি।

    আবার নর্মদা একা ঘুরছে। এবার আর রুক্ষু চুল শুকনো মুখ বিষণ্ণ নয়, যেন ক্ষিপ্ত ক্ষুব্ধ চঞ্চল। জিগ্যেস না করতেই নিজে থেকে এসে বলল, ওই লক্ষ্মীছাড়া ছেলেটা কি করেছে জানিস? লুকিয়ে একটা ফার্স্ট ইয়ারের মেয়েকে লাভ-লেটার দিতে শুরু করেছে।

    শুনে সত্যিই হাঁ হয়ে গেলাম। বললাম, বলিস কি?

    ও বলল, হ্যাঁ। আবার তাকে নাকি বলেছে, নর্মদা? সে তো একটা আস্ত পাগল।

    ওই হাঁদার এই কথা?

    না রে বীথি, হাঁদা ও নয়, হাঁদা আমিই। বলল নর্মদা।

    বলে, কিন্তু খুঁজে বেড়ানোর কামাই দেয় না।

    এদিকে বাড়িতে অভিভাবক কাকা বিয়ে দেবার জন্যে উঠে পড়ে লেগেছেন, কারণ মেয়ের নিয়ে কান পাতা দায় হচ্ছে তার। অতবড় মেয়ে, তায় আবার নিজের মেয়ে নয়, ভাইয়ের মেয়ে, তাকে এঁটে ওঠা শক্ত। সে যুগ নয় যে অভিভাবকগিরির জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত দেখাতে মেরে ধরে ঘরে বন্ধ করে আটকে রাখবেন।

    পড়ুয়া মেয়েকে পড়তে যেতে দিতে হয়, কিন্তু লেখাপড়ার সঙ্গে সঙ্গে মেয়ে যদি প্রেমেও পড়তে শুরু করে, কি করবে অভিভাবক? বড় জোর করতে পারে বিয়ের চেষ্টা।

    চেষ্টা তো করতেই হবে। কারণ নর্মদার দ্বারা সে সুরাহাও তো হয় না। নিজেই সে জলে নেমে হাবুডুবু খায়, ছিপ ফেলে মাছ টেনে তুলতে পারে না একবারও।

    কাকা যাহোক করে একটা সম্বন্ধ যখন প্রায় পাকা করে এনেছেন, এমন সময় নর্মদা বেঁকে বসল। বললে, এ বিয়ে হতে পারে না।

    সত্যিই হতে পারে না। কারণ মুখপুড়ি তখন কলেজ লাইব্রেরির এক লাইব্রেরিয়ানের সঙ্গে তোলপাড় কাণ্ড শুরু করে দিয়েছে।

    সবাই ছি-ছিক্কার করছে আর বলছে, কী নির্লজ্জতা! কী হ্যাংলামি!

    হ্যাংলামি ছাড়া আর কি বলবে? লোকটা যে বিবাহিত!

    সহপাঠিনীরা, মানে আমরা যখন তাকে ঘেন্না দিয়ে বলছি, ছি ছি, শেষকালে কি না একটা এঁটো পাত! আর লোকটাই বা কী চরিত্র, তা ভাব।

    নর্মদা একটি মধুর স্বর্গীয় হাসি হেসে, দেশের বেশ কয়েকজন বিখ্যাত জ্ঞানী গুণী পণ্ডিত অধ্যাপক কবি সুধীজনের দৃষ্টান্ত তুলে ধরেছে আমাদের সামনে। যাঁরা জলজ্যান্ত স্ত্রী বর্তমান থাকতে, নবীনা দ্বিতীয়ার প্রেমে লোকলজ্জা আহুতি দিয়ে দিব্যি খোসমেজাজে নতুন সংসার করছেন।

    আমরা বলতাম, ওটা মানুষের দুর্বলতার দৃষ্টান্ত, আদর্শের দৃষ্টান্ত নয়।

    নর্মদা বলত, আদর্শ হচ্ছে ঠাকুর ঘরের জিনিস, তাকে বেদীতে স্থাপন করে ফুল চন্দনে পূজো করা চলে। জীবন সার্থক করবার জন্যে যা চাই সে হচ্ছে রক্তমাংসের মানুষ, দোষে গুণে ভুলে দুর্বলতায় সুন্দর মানুষ। ও যে বিবাহিত, সে একটা দৈবাতের ঘটনা মাত্র। ওর যে স্ত্রী আছে, সেটা বিধাতার একটা হাস্যকর কৌতুক, ওর জন্যে আমি আর আমার জন্যে ও পৃথিবীতে সৃষ্টি হয়েছে। সেটাই শেষ কথা।

    কিন্তু এসব উচ্চাঙ্গের শেষ কথা কে শুনছে কান পেতে? লোকে বহিদৃশ্যটাই দেখে। আর সেই দেখার ফলশ্রুতিতে কাকার কান পাতা দায় হয়।

    তাই কাকা যখন শুনলেন, ভাইঝি গম্ভীর কণ্ঠে ঘোষণা করেছে–এ বিয়ে হতে পারে না, তখন কাকা সমস্ত গাম্ভীর্য ভুলে তার আদিম পিতামহের ভঙ্গিতে খিঁচিয়ে আর লাফিয়ে উঠে বললেন, হতে পারে না, এ কথাটা এতদিন বলতে পারনি? আমি যে এই হন্যে হয়ে পাত্তর খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম, সে খবর জানতে না তুমি?

    জানবার দরকার বুঝিনি। কারণ আপনিও আমাকে জিগ্যেস করবার দরকার বোঝেননি।

    ও হ্যাঁ, অফিসিয়ালি জিগ্যেস করা হয়নি বটে। কিন্তু তুমি যে আয়োজনটা টের পাচ্ছ, অথচ না করছ প্রতিরোধ, না করছ প্রতিবাদ, এটাকেই সম্মতি বলে ধরে নেওয়া কি খুব ভুল হয়েছে?

    আমার ধারণায় ভুল হয়েছে।

    ঠিক আছে। বাধ্য হয়েই বুঝতে হবে আমায়, তুমি আর আমার অভিভাবকত্বের অধীনে থাকতে চাও না। বেশ, সেই মত ব্যবস্থাই করব। হিসেবমত বাড়ির অর্ধাংশ তোমার, সেটা আইনসিদ্ধ করে তোমার সঙ্গে সংস্রব মুছে ফেলতে চাই।

    বীথিকার বর বাধা দিয়ে বলে, ওদের ঘরের কথা তুমি জানলে কি করে?

    যে করে বিশ্ব-সংসারে একে অন্যের ঘরের কথা জানে। কথা এ-কান থেকে ও-কান, পাঁচ কান থেকে দশ কান হেঁটে বেড়ায় জান না? আবার কথা শুধু কানেই হাঁটে না, বাতাসেও হাঁটে। তার উপর আবার এমন মজাদার কথা জানতে আর বাকী ছিল না কারুর।

    তা, বীথিকার কথা অত্যুক্তি নয়। ওদের ধারে কাছে জানতে আর বাকী ছিল না কারুর নর্মদার সেই কাহিনী। আমরাও জেনেছিলাম।

    তবে এদিকে মজা এই, আলাদা করে দেব, সম্পর্ক মুছে ফেলব-বলে কাকা যতই চোখ রাঙান, মূল কথা হচ্ছে, বাড়ির অর্ধাংশ নর্মদার নয়, সম্পূর্ণাংশই তার। কারণ বাড়িটা কাকাদের পৈত্রিক নয়, তৈরি হয়েছিল নর্মদার বাবার সম্পূর্ণ একার স্বাপার্জিত অর্থে এবং দলিল আছে নর্মদার মায়ের নামে। কিন্তু এসব রহস্য নর্মদার অজানা, কারণ মা-বাপ দুজনেই মরেছেন তার নিতান্ত বাল্যে। হিতৈষী আত্মীয়স্বজন যদি বা কখনও তার কানে তুলতে এসেছেন, নর্মদা কানে তোলেনি! বলেছে, যা বুঝবেন কাকা বুঝবেন।

    তা কাকা এই বুঝলেন, রাগ করে আখের খুইয়ে কাজ নেই, কেঁচো খুঁড়তে সাপ খুঁড়ে দরকার নেই।

    একখানা ঘর বাদে সারা বাড়িটাতেই তিনি, অথবা তার সংসার।

    ওই লক্ষ্মীছাড়া মেয়েটাকে একবার বিয়ে দিয়ে ফেলতে পারলেই নিষ্কণ্টক। যথানিয়মে সে পতিগৃহে যাত্রা করবে, তিনি কম্বঋষির মত আশীর্বাদ করবেন, পতিগৃহে অচলা হও। লেখাপড়ায় যাই হোক আর অন্যদিকে বেপরোয়া হোক, এদিকে–সংসার-জ্ঞানে তো মেয়েটা সরল অবোধ, কাকার কাছ থেকে সে বাড়ির দলিল দেখতে চাইবে, এমন মনে হয় না।

    কাজেই রাগের সময়ের কথা বাতাসে উড়ে গেল, কাকা অন্য পন্থা খুঁজতে লাগলেন।

    কিন্তু সত্যিই কি নর্মদা এমন একটা নীচ মেয়ে, যে একজন বিবাহিত ব্যক্তিকে তার স্ত্রীর কাছ থেকে কেড়ে নিতে চায়?

    তা বহিদৃশ্যে তো তাই বলতে হয়।

    নীচ, লোভী, হ্যাংলা, স্বার্থপর–এক্ষেত্রে এছাড়া আর কি বলে লোকে?

    কিন্তু বিভিন্ন মনোজগৎবাসী বিভিন্ন প্রকৃতির মানুষের দৃষ্টিভঙ্গী আলাদা, চিন্তাধারা আলাদা। তাই নিজের কাজকে সমর্থন করবার যুক্তিও থাকে তাদের ভঁড়ারে মজুৎ।

    নর্মদা ভাবে, লোকে তো বলবেই, বলবার জন্যেই আছে লোক। কে কার ভিতর দেখে? ওই যে মানুষটা, যার বুদ্ধি চিন্তা রুচি পছন্দ বিকশিত হবার আগেই, মা-বাপে ধরে বেঁধে বিয়ে দিয়ে দিয়েছে নিতান্ত গ্রাম্য একটা মুখ মেয়ের সঙ্গে, তার জীবনটা কি কিছুই নয়? সে জীবন অপচয়িত হলে কিছুই এসে যায় না?

    সেই গ্রাম্য মেয়েটা যদি তার চিত্তের ক্ষুধা মেটাতে না পারে, যদি হতভাগ্য মানুষটার সমস্ত অন্তর পিপাসিত হয়ে থাকে একটি মার্জিত শিক্ষিত হৃদয়ের সঙ্গলাভ-আশায়, সে পিপাসা মেটাতে চাওয়া কি অপরাধ?

    জগতের বহুবিধ অ্যাকসিডেন্টের মত ওই গাঁটছড়ার অ্যাকসিডেন্টটাই পরম সত্য? আর সবই মিথ্যা? এইসব যুক্তি নর্মদার।

    নর্মদার সেই নতুন প্রেমাস্পদ খুব একটা রূপবান নয়, অতএব এটাকে রূপের মোহের কোঠায় ফেলা যায় না, এ একপ্রকার ভাবের মোহ।

    বন্ধু-বান্ধবের কাছে নর্মদা তার নিজস্ব চিন্তাধারা আর অভিজ্ঞতার গল্প করে বেড়াত, এই ছিল তার একটা পাগলামী। হয়তো সে মানুষকে শ্রদ্ধা করত, তাই মানুষকে অবজ্ঞা করে যা খুশি করতে না চেয়ে, তাদের বোঝাতে চাইত। চাইত তাদের সহানুভূতি, সমর্থন।

    কিন্তু জগতে কে এই বিশ্বস্ততার মূল্য দেয়?

    কে বুঝতে চায় সরল চিত্তের সৃষ্টিছাড়া মতবাদ?

    কাজেই কেউ বা তাকে ন্যাকা বিশেষণে বিভূষিত করত, কেউ বলত পাকা শয়তান, ইচ্ছে করে ন্যাকামি করে। যে মেয়ে লেখাপড়ায় প্রথম সারিতে থাকে, গানে বাজনায় খেলায়-ধূলায় রীতিমত চটপটে চৌকস, সে যে যেখানে সেখানে কেবল তার হৃদয়তথ্য উদ্ঘাটন করে বেড়ায়, এটা ইচ্ছাকৃত ন্যাকামি ছাড়া আর কি?

    নর্মদা যে বন্ধুদের বিশ্বাস করতে চাইত, একথা কেউ বিশ্বাস করত না।

    বন্ধুরা বলত, সে লোকটাকেও বলিহারী দিই। বিবাহিতা স্ত্রী থাকতে–এ তো দস্তুরমত চরিত্রহীনতা।

    নর্মদা বলত, সেই বিবাহিতা স্ত্রীর সঙ্গে যদি মনের মিল না হয়, তার সঙ্গে কেবলমাত্র দৈহিক সম্পর্ক স্থাপন করে ঘর-সংসার চালিয়ে যাওয়াটাই কি মহৎ চরিত্রের স্বাক্ষর? আমি তো বলি, সেও একরকমের চরিত্রহীনতা।

    এরা বলত, ওসব কথা বস্তাপচা। ঢের শুনেছে লোকে। তুমি এমন কিছু নতুন থিওরি আমদানী করছ না। সোজা কথা হচ্ছে, সমাজের মুখ চাইতে হবে, আইনের দায় মানতে হবে।

    নর্মদা বলত, তা বটে! শুধু চাইতে হবে না মানুষের মুখ, মানতে হবে না হৃদয়-সত্যের দায়!

    লেখাপড়া শিখেছিল, বই পড়ত দেদার, ভাল ভাল কথা বলতে পারত সহজেই।

    শুধু বুঝতে পারত না, হৃদয়-সত্যের দায় পোহানোর ঝক্কি কতখানি।

    বুঝতে পারত না সবাইয়ের সাধ্য নেই সে ঝক্কি সামলাবার। সাধ্য নেই, তাই মানুষ সত্য আর মিথ্যা, খাঁটি আর ভেজাল, হৃদয়-দ্বন্দ্ব আর সমাজ-দ্বন্দ্ব সব কিছুকে লোকচক্ষু নামক পাকযন্ত্রে চড়িয়ে একটা পাঁচন তৈরি করে করে গিলে জীবন-জ্বরের শান্তি খোঁজে।

    ⤷
    1 2
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleজীবন-স্বাদ – আশাপূর্ণা দেবী
    Next Article গাছের পাতা নীল – আশাপূর্ণা দেবী

    Related Articles

    আশাপূর্ণা দেবী

    বিবাগী পাখি – আশাপূর্ণা দেবী

    April 7, 2025
    আশাপূর্ণা দেবী

    কুমিরের হাঁ – আশাপূর্ণা দেবী

    April 7, 2025
    আশাপূর্ণা দেবী

    ঠিকানা – আশাপূর্ণা দেবী

    April 7, 2025
    আশাপূর্ণা দেবী

    ততোধিক – আশাপূর্ণা দেবী

    April 7, 2025
    আশাপূর্ণা দেবী

    ১. খবরটা এনেছিল মাধব

    April 7, 2025
    আশাপূর্ণা দেবী

    নতুন প্রহসন – আশাপূর্ণা দেবী

    April 7, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }