Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    জাদুকর সত্যচরণের জাদু কাহিনি – হিমাদ্রি কিশোর দাশগুপ্ত

    হিমাদ্রিকিশোর দাশগুপ্ত এক পাতা গল্প289 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    জাদুকর সত্যচরণের আঙটি

    || ১ ||

    চন্দনদের ওষুধ কোম্পানী প্রতিবছর তাদের প্রতিষ্ঠা দিবসে আনন্দ অনুষ্ঠান করে থাকে। এবার যখন আনন্দ অনুষ্ঠানের প্রস্তুতিসভায় ঠিক হল যে, অন্য নানান প্রোগ্রাম অর্থাৎ নাচ, গান ইত্যাদির সঙ্গে ম্যাজিক শো-এর ব্যবস্থাও করা হবে, কারণ, ওই দিন অনেক কর্মীই তাদের পরিবারের বাচ্চাদের সঙ্গে আনেন, তখনই চন্দন সে সভায় জানিয়েছিল যে ম্যাজিশিয়ান ঠিক করার দায়িত্ব সে নেবে। তার এক বন্ধু আছে জাদুকর সত্যচরণ। তিনি খুব ভালো ম্যাজিক দেখান।

    হ্যাঁ, সেই জাদুকর সত্যচরণ পুতুতুন্ডু, যিনি নিজের পরিচয় দেন ‘হুডিনি অফ ইন্ডিয়া’ নামে। যদিও তিনি এক ডাকে চেনার মতো কোন বিখ্যাত জাদুকর নন, বলা যেতে পারে পরিচিতির দিন থেকে নেহাতই অতি সাধারণ একজন মানুষ। যাঁর জীবনের বড় সময় একটা কেটেছে স্ট্রিট ম্যাজিশিয়ান হিসাবে পথে পথে জাদুখেলা দেখিয়ে। তবে মানুষ ভালো সত্যচরণ। কিছুটা কাকতালীয় ভাবেই উত্তরবঙ্গ থেকে কলকাতা ফেরার রাতের ট্রেনে বছর চারেক আগে প্রথম পরিচয় হয়েছিল চন্দনের সঙ্গে জাদুকর সত্যচরণের। তারপর ধীরে ধীরে তাদের দু’জনের মধ্যে সখ্য গড়ে উঠেছে। নিয়মিত না হলেও চার-ছ’মাস পর পর দেখা-সাক্ষাৎ হয় তাদের মধ্যে। টেলিফোনেও কথা হয়। চন্দন লোকটার প্রতি বেশ আকর্ষণ অনুভব করে। কারণ একদা পথে পথে ঘুরে বেড়ানো লোকটার বিচিত্র জীবনে নানান বিচিত্র অভিজ্ঞতা আছে। আর চন্দনের সঙ্গে দেখা হলেই তিনি তার জীবনের এক একটা বিচিত্র কাহিনি শোনান চন্দনকে। কেউ সে সব কাহিনি বিশ্বাস করতেও পারেন বা না-ও পারেন। কারণ অনেক সময়ই সে সব কাহিনি আমাদের দেখা পৃথিবী বা প্রচলিত ভাবনার সঙ্গে মেলেনা । কিন্তু চন্দন এক দুর্নিবার আকর্ষণ অনুভব করে সত্যচরণের বলা সেইসব কাহিনিগুলির প্রতি। আর সত্যচরণও চন্দনের মনের ভাব বুঝতে পেরে তার সঙ্গে দেখা হলেই তাঁর গল্পের ঝাঁপি খুলে বসেন ।

    চন্দনদের অফিসের অনুষ্ঠানের বেশী দেরী নেই। মাঝে মাত্র একটা রবিবার, তার পরের রবিবারই অনুষ্ঠান। শনিবার সভার শেষে সত্যচরণকে অ্যাডভান্স দেবার জন্য দু’হাজার টাকা চন্দনকে দেওয়া হল। বাড়িতে ফিরে চন্দন, সত্যচরণকে ফোন করতেই তিনি খবরটা শুনে বেশ খুশি হয়ে বললেন, ‘আমি তো বাড়িতেই আছি। কাল আপনি যে কোনো সময় চলে আসুন।’

    তাঁর সঙ্গে কথামতোই পরদিন বিকালবেলা চন্দন পৌঁছে গেল জাদুকর সত্যচরণের বাসা বাড়িতে। আধো অন্ধকার নড়বড়ে সিঁড়ি ভেঙে তিনতলার চিলেকোঠার ঘরের দরজাতে টোকা দিতেই হাসিমুখে দরজা খুললেন সত্যচরণ। চন্দন ইতিপূর্বে বেশ কয়েকবার এসেছে এ ঘরে। কিন্তু কোনবারই এ ঘরের কোন পরিবর্তন দেখে না সে । সেই একই ক্যাম্পখাটে সত্যচরণের বিছানা, বসার জন্য একটা কাঠের টেবিলের দু’পাশে পুরোনো দু’টো টিনের চেয়ার, ঘরের কোণে রাখা মড়ার খুলি আর হাড় আঁকা সত্যচরণের খেলার সামগ্রী রাখা কালো রঙের টিনের বড় স্যুটকেস, দেওয়ালের গায়ে হেলান দিয়ে রাখা সত্যচরণের নাম লেখা বিবর্ণ হোর্ডিং, ক্যানভাসের পুরানো তাবু, দেওয়ালের গায়ে ঝুলতে থাকা মুখোশ, পালক লাগানো টুপি, এদিনও ঘরের ভিতর সবকিছু একই রকম আছে। চন্দনকে চেয়ার দেখিয়ে সত্যচরণ বললেন, ‘আপনি বসুন। আগে একটু চা বানাই, তারপর কথা হবে।’

    চন্দন চেয়ারে বসল। টেবিলের ওপর নানা ধরনের জিনিস ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। জাদুকরের পাগড়ী, তাসের প্যাকেট, সিল্কের রুমাল, নানান ধরনের কৌটো ইত্যাদি। চন্দনের মনে হল সত্যচরণ এতক্ষণ এসব জিনিস নিয়ে কাজ করছিলেন। ঘরের কোণে রাখা সত্যচরণের জাদু সামগ্রীর বাক্সর ডালাটা খোলা। সম্ভবত তার ভিতর থেকেই জিনিসগুলো বার করেছেন তিনি।

    স্টোভে জল গরম করে মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই দু’কাপ চা বানিয়ে চন্দনের মুখোমুখি বসলেন জাদুকর সত্যচারণ। দু’জনেই বেশ কয়েকবার গরম চা-এ চুমুক দেবার পর চন্দন প্যাকেট থেকে খাম বার করে সেটা সত্যচরণের হাতে দিয়ে বলল, ‘এতে দু’হাজার অ্যাডভান্স আছে। ওদেরকে আমি বলেছি আপনার ফিজ পাঁচ হাজার টাকা। কি চলবে তো?’

    খামটা হাতে নিয়ে সত্যচরণ বললেন, ‘খুব চলবে। সত্যি কথা বলতে কী এত টাকা কেউ আমার মতো ম্যাজিশিয়ানকে দেয় না। ক্লাব বা স্কুলের ফাংশনগুলোতে খেলা দেখাতে গেলে খুব বেশী হলে দেড়-দু’হাজার টাকা দেয়।’

    চন্দন হেসে বলল, ‘আমাদের অফিসের একটা গাড়িও আপনাকে নিতে আসবে। আমি বলে দিয়েছি। ‘হুডিনি অফ ইন্ডিয়া’ ভাঁড়ার ট্যাক্সিতে বা বাসে চেপে খেলা দেখাতে যাবেন সেটা ভালো দেখায় না।’ এ কথাটা শুনে মুহূর্তর জন্য আনন্দাশ্রুতে যেন ছলছল করে উঠল জাদুকর সত্যচরণের চোখগুলো। তিনি বলে উঠলেন, ‘আপনাকে কীভাবে যে ধন্যবাদ দেব তা জানিনা।’

    চন্দন বলল, ‘ধন্যবাদের কোন ব্যাপার নয়। এসব আপনার সত্যিই প্রাপ্য। তেমন সুযোগ পেলে আপনাকে নিশ্চয়ই সারা পৃথিবীর লোক চিনত। আপনি তো আর কারো থেকে কম ভালো খেলা জানেন না।’ এবার জাদুকর সত্যচরণের মুখটা যেন প্রশংসা শুনে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, ঠিক ঠিক। বড় বড় জাদুর খেলা দেখাবার জন্য নানান ধরনের বড় বড় দামী দামী যন্ত্রপাতি, জিনিসপত্র, লোকজনের প্রয়োজন হয়। অনেক টাকা লাগে সেসবের জন্য। আমার যদি সে টাকা থাকত তবে আমাকেও চিনত লোকে। জানেন, আমরা যারা স্ট্রিট ম্যাজিশিয়ান বা রাস্তায় রাস্তায় খেলা দেখিয়েছি বা খেলা দেখাই তাদের কাজ যে কোন জাদুকরের চেয়ে কঠিন। কারণ আগে থেকে কৌশলে সরিয়ে রাখা মঞ্চর কোন সাহায্য আমরা পাইনা, নিজের একমাত্র ভরসা শুধু নিজের দক্ষতা। এই আমার গুরুদেব হংসরাজের কথাই ধরুন না। পথে পথে ঘুরে, রাস্তায় বা খোলা মাঠে তিনি যেসব আশ্চর্য খেলা দেখাতেন সে সব খেলা মঞ্চে অনেক বিখ্যাত জাদুকর দেখাতে পারবেন না। তিনি হুডিনির থেকেও বড় জাদুকর ছিলেন, কিন্তু তিনি ছিলেন এ দেশের একজন স্ট্রিট ম্যাজিশিয়ান বাজিকর-ঐন্দ্রজালিক । তাই তার কথা কেউ জানে না।’ কথা গুলো বলে এক চুমুকে চা শেষ করে কাপটা টেবিলের ওপর নামিয়ে রাখলেন সত্যচরণ।

    চন্দন এরপর চা শেষ করে জানতে চাইল, ‘আপনি এখন কী করছিলেন?’

    টেবিলের উপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা জিনিসগুলো হাত দিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে জাদুকর সত্যচরণ বললেন, ‘আপনার থেকে শোয়ের খবরটা পেয়েছি বলে বাক্স থেকে এ সব জিনিসগুলো বার করে সব ঠিকঠাক আছে কিনা তা দেখে নিচ্ছিলাম। আপনার অনুষ্ঠান বলে কথা। তাই চেষ্টা করব আমার পোষাক আশাকে বা খেলা দেখানোতে যেন কোন ত্রুটি না থাকে। কথা বলতে বলতে একটা জর্দার কৌটো খুলে একটা পাথর বসানো আংটি বার করে সেটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে দেখতে জাদুকর সত্যচরণ বললেন, ‘বহুদিন পর এ আংটিটা বার করলাম। ভাবছি এ আংটিটা আপনার শো-তে পরে যাব। আলো পড়লে এ আংটির পাথরটা কেমন ঝলমল করে দেখেছেন?’

    সত্যিই খোলা জানলা দিয়ে বাইরে থেকে আসা সূর্যের আলোতে ঝিকমিক করছে আংটির পাথরটা। চন্দন তা দেখে বলল, ‘হীরা নাকি?’

    সত্যচরণ আংটিটা চন্দনের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, ‘হীরা নয়। দামী কাচ। ধাতুটা কিন্তু রুপো তার ওপর সোনার জল করা। একসময় হীরা বসানো সোনার আংটি বলেই মনে হতো। তবে হুবহু এমনদেখতে হীরা বসানো সোনার আংটি আমি দেখেছি।’

    চন্দন হাতে নিয়ে আংটিটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখল। জিনিসটা বেশ পুরানো। চারপাশে ছড়ানো সূক্ষ্ম ফুলের পাপড়ির ঠিক মাঝখানে পাথরটা বসানো। বয়সের কারণে আংটির দু-একটা জায়গাতে সোনালী গিলটি উঠে গিয়ে ভিতরের রুপালী রঙ উঁকি দিচ্ছে। অবশ্য তা ভালো করে না দেখলে কারো চোখে পড়বে না। আংটিটা দেখে সেটা সত্যচরণের হাতে ফেরত দিয়ে চন্দন বলল, ‘খুব সুন্দর দেখতে। তবে আংটির ডিজাইনটা মেয়েদের আংটির মতন লাগছে । ‘

    জাদুকর সত্যচরণ বললেন, ‘হ্যাঁ, মেয়েদের আংটি। আর এমন আংটি কার হাতে ছিল জানেন? মেহের-উন-নিসা বেগমের।’

    চন্দন নামটা শুনে কয়েক মুহূর্ত ভেবে নিয়ে বলল, ‘মেহের-উন-নিসা বেগম! আপনি কি ঘসেটি বেগমের কথা বলতে চাইছেন?’

    রুমাল দিয়ে আংটির পাথরটা ঘষতে ঘষতে সত্যচরণ বললেন, ‘হ্যাঁ, সেই ঘসেটি বেগম। সিরাজের মাসি, রহস্যময়ী ঘসেটি বেগম। আমাদের হাতের আংটিটার সঙ্গে তিনিও জড়িয়ে আছেন। হয়তো-বা আমি তাকে দেখেওছি।’

    কথাটা শুনে চন্দন বলে উঠলো, ‘আপনার কথা আমার মাথায় ঢুকছে না। আড়াইশো বছর আগের ঘসেটি বেগমকে আপনি দেখবেন কীভাবে?’

    সত্যচরণ তার শার্টের পকেট থেকে বিড়ি আর লাইটার বার করে বললেন, ‘হ্যাঁ, মাথায় না ঢোকারই কথা। সত্যি কথা বলতে কী ব্যাপারটা যে আমার মাথাতেও খুব স্পষ্ট তা নয়। যখনই সে দিনের কথা ভাবি তখনই আমার মাথার ভিতরও কেমন তালগোল পাকিয়ে যায়। এই আংটিটা আমার কাছে থাকলেও সেদিনের ঘটনার স্পষ্ট ব্যাখ্যা আমার কাছে নেই।’

    ‘কী ঘটনা?’ জানতে চাইলে চন্দন।

    সত্যচরণ বললেন, ‘আমার জীবনের এক অদ্ভুত ঘটনা। বলতে কিছুটা সময় লাগবে। আপনার হাতে কি সে সময় আছে?’

    চন্দন বুঝতে পারল, নতুন কোন কাহিনি ঝাঁপি থেকে বার করতে চাইছেন জাদুকর সত্যচরণ। তাই সে সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল, ‘আমার কোন তাড়া নেই। আপনি বলুন — ‘

    বিড়ি জ্বালিয়ে তাতে টান দিয়ে জাদুকর সত্যচরণ শুরু করলেন তার কাহিনি‌—

    || ২ ||

    ‘তা ধরুন প্রায় চল্লিশ বছর আগের কথা। আমার তখন যুবক বয়স। আমি তখন কলকাতা শহরে একটু থিতু হয়েছি। অর্থাৎ শিয়ালদার কাছে একটা বস্তি অঞ্চলে টালির চালের ঘরে মাসিক তিরিশ টাকা ভাড়ার বিনিময়ে একটা মাথা গোঁজার আশ্রয় পেয়েছি। যদিও সে ঘরে আমি কমই থাকতাম। সবসময়ই তো আমি নানান জায়গাতে, এ মেলা, ও মেলা, নানান জনসমাগমে খেলা দেখিয়ে ফিরতাম। কখনও হয়তো একটানা পনেরোদিনও ঘরে ফিরতাম না। যাই হোক, সেখানেই আমার মফিজুলের সঙ্গে পরিচয়। আসলে ওই বস্তিতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় কিছু গরীব পরিবার এসে বাসা বেঁধেছিল। আমি অবশ্য যখন ওই বস্তিতে যাই তখন বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে গেছে। সে বস্তি ছেড়ে অনেকেই আবার ফিরতে শুরু করেছে নিজের দেশে। কিন্তু মফিজুল তখনও সেখানে রয়ে গেছিল। আমার পাশের ঘরেই থাকত সে। বাংলাদেশে সে নৌকায় মাঝির কাজ করত। দু’জনে আমরা সমবয়সী হওয়াতে আমাদের মধ্যে বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। আমি তার কাছ থেকে ও দেশের বুড়িগঙ্গা, পদ্মা, মেঘনা নদীর গল্প শুনতাম আর সে আমার থেকে শুনতো এ দেশের নানান জায়গার গল্প। সে বয়সেই তখন এ দেশের অনেকটাই পেটের ভাত যোগাড় করবার জন্য দেখা হয়ে গিয়েছিল আমার। একদিন মফিজুলও তার নিজের জন্মভূমি ঢাকাতে যাবার জন্য মনস্থির করল। পরের দেশে কে আর পড়ে থাকতে চায়। যাবার আগে সে বারবার বলে গেল আমি যেন অবশ্যই একবার ঢাকাতে যাই। ঢাকা শহরে মগবাজার নামে একটা জায়গাতে তার বাসার ঠিকানাও আমাকে দিয়ে গেল। মফিজুল নিজের দেশে ফিরে গিয়েও কিন্তু আমাকে ভুলল না। বারবার চিঠি দিয়ে সে আমাকে তার দেশে যাবার জন্য আমন্ত্রণ করতে লাগল। আমিও তার চিঠির জবাবে তাকে চিঠি দিয়ে জানাতাম যে, সুযোগ পেলে আমি নিশ্চয়ই সে দেশে যাব।

    বছরখানেকের মধ্যেই সে সুযোগ একটা হয়ে গেল। কোথাও যাওয়া মানেই তো টাকাপয়সা বড় ব্যাপার। বেশ টাকা পয়সা আমার হাতে হঠাৎই সে সময় এসে গেল কপাল জোরে বেশ কয়েক জন বড়লোকের বাড়ি খেলা দেখিয়ে। সামনেই বর্ষাকাল আসছে। বর্ষাকালে আমাদের খেলার কাজ থাকে না, বাড়িতেই বসে থাকতে হয়। তাই আমি ভাবলাম এই ফাঁকে ঢাকা ঘুরে আসি। আর হ্যাঁ, একবার একজন আমাকে বলেছিল একটা সার্কাস দলের সঙ্গে আমাকে সে বিদেশে নিয়ে যাবে। যদিও শেষ পর্যন্ত আমার বিদেশ যাওয়া হয়নি, কিন্তু তার কথা শুনে আমি পাসপোর্টটা করে রেখেছিলাম। পাসপোর্ট যখন আছে আর হাতে টাকা যখন আছে তখন আর মফিজুলের আমন্ত্রণে সাড়া দিতে কোন অসুবিধে ছিল না আমার। আমি মফিজুলকে চিঠি লিখে জানিয়ে দিলাম আমি তার বাসায় যাচ্ছি। আর এরপরই আমি ক’দিনের মধ্যে রওনা হয়ে গেলাম বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে।

    প্রথমে কলকাতা থেকে বনগাঁ। তারপর বেনাপোল সীমান্ত দিয়ে আমি পা রাখলাম বাংলাদেশের মাটিতে। ঢাকা পৌঁছতে হলে বাসে বাসে প্রথমে গোয়ালন্দ স্ত্রীমার ঘাটে পৌঁছতে হয়। তারপর পদ্মা পেরিয়ে আবার বাসে চেপে ঢাকা যেতে হয়। সে সময় বেনাপোল থেকে এভাবে ঢাকা পৌঁছতে বারো চোদ্দ ঘণ্টা সময় লাগত। সেভাবেই ঢাকা যাবার পথ ধরলাম আমি। গোয়ালন্দ ঘাটের নাম আমি বহু মানুষের মুখে শুনেছিলাম। বাসে করে আমি প্রথম পৌঁছলাম সেই গোয়ালন্দ ঘাটে। কী বিশাল ঘাট! কত লোকজন! না দেখলে ঠিক বিশ্বাস হয় না। সবচেয়ে বড় কথা আমি চাক্ষুষ করলাম পদ্মা নদীকে! এত বিশাল চওড়া নদী যে তার একুল ওকুল দেখা যায় না। আমাদের দেশের গঙ্গা নদীকে চওড়াতে তার তুলনায় বালিকাই বলা যায় । তিনতলা, চারতলা স্টিমার তাতে ভেসে বেড়াচ্ছে। বড় বড় বার্জ নদী পারাপার করছে লরি-বাসমোটর গাড়ি নিয়ে। সন্ধ্যাবেলা একটা স্টিমারে নদী পেরোলাম আমি। তারপর বাস ধরে ঢাকা পৌঁছতে আমার পরদিন ভোর হয়ে গেল। তবে সে সময়কার ঢাকা শহরকে কলকাতার মতো ততটা আধুনিক বলে মনে হয়নি। যদিও শহরটা খুব পুরানো। সদ্য স্বাধীনতা পাওয়া দেশের রাজধানী হিসাবে শহরটাকে তখন ধীরে ধীরে আধুনিক করার চেষ্টা শুরু হয়েছে। নবাবী আমলের প্রাচীন স্থাপত্যের পাশাপাশি গড়ে উঠতে শুরু করেছে আধুনিক বাড়িঘর। তবে রাস্তাঘাটে লোকজনের সংখ্যা প্রচুর। বাস আর রিক্সাও আছে। ওদেশের রিক্সাগুলো বেশ সুন্দর ভাবে সাজানো থাকে। মফিজুল যে বাড়িতে ভাড়া থাকে, সে বাড়ির ঠিকানাটা আমার কাছে ছিল । কাজেই তার বাসায় পৌঁছতে আমার অসুবিধা নেই। কাজেই বাসস্ট্যান্ডে নামার পর আমি একটা রিক্সা নিয়ে রওনা হয়ে গেলাম মগবাজারের উদ্দেশ্যে।

    মগবাজার অঞ্চলটা ঢাকার অন্যতম পুরানো অঞ্চল। বেশ ঘিঞ্জি জায়গা। পুরানো অঞ্চলের অনেক বাড়িঘর, দোকান বাজার আছে সেখানে। মকবুলের ঠিকানাতে তার বাড়িওলার নামও দেওয়া থাকত। কারণ, ‘কেয়ার অফ’ হিসাবে তার নামেই চিঠি পাঠাতে হত। সে লোকের নাম নছিব আলি। রিক্সা থেকে মগবাজারে নেমে একটু খোঁজ করতেই নছিব আলির বাড়ির ঠিকানা বাতলে দিল একজন লোক। বেশ কয়েকটা সরু ঘিঞ্জি গলি অতিক্রম করে আমি পৌঁছে গেলাম বাড়িটার সামনে। বাড়িটা দেখে আমি একটু অবাক হলাম। বাড়ি না বলে সেটাকে একটা হাভেলি বলা যায়। অর্থাৎ একটা বিরাট দোতলা বাড়ি। তবে বাড়িটা দেখেই বোঝা যায় তার বয়স বেশ কয়েকশো বছর হবে। ওপর, নীচে টানা বারান্দাওলা বাড়িটার স্তম্ভগুলোর গায়ে স্থানে স্থানে পলেস্তারা খসে ইট দাঁত বের করে আছে। যে প্রাচীরটা দিয়ে বাড়িটা ঘেরা তার গায়ের অবস্থাও একই। প্রাচীরের গায়ে এক জায়গাতে একটা ভারী কাঠের দরজা আছে। আমি বাড়ির ভিতর প্রবেশ করার জন্য সেই দরজাতে ‘মফিজুল ভাই’ বলে কয়েকবার ঘা দিতেই কিছুক্ষণের মধ্যে দরজা খুলে গেল।

    দরজা খুললেন এক বৃদ্ধ। আর তার পিছনে আমার বয়সী একজন যুবক দাঁড়িয়ে। বৃদ্ধর পরনে লুঙ্গি আর পাঞ্জাবী। আর ছেলেটার পরনে শার্ট আর প্যান্ট। পালিত কেশ, সাদা দাড়িওলা সেই বৃদ্ধকে দেখে আমি অনুমান করলাম তার বয়স অন্তত সত্তর হবে। বৃদ্ধ আর ছেলেটা আমাকে ভালো করে দেখার পর বৃদ্ধ আমাকে প্রশ্ন করলেন, ‘কত্তা, কোত্থেকে আসছেন? কারে চান?’

    প্রশ্ন শুনে আমি আমার আসার কারণ ব্যক্ত করলাম তাদেরকে। আর তার সঙ্গে আমার বক্তব্যর প্রমাণস্বরূপ আমাকে লেখা মফিজুলের লেখা একটা চিঠিও তুলে দিলাম বৃদ্ধর হাতে। চিঠিটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে তিনি আমার হাতে সেটা ফেরত দিয়ে বললেন, ‘আমি হলাম এ বাড়ির মালিক নছিব আলি। লোকে আমাকে নছিব মাঝি বলে ডাকে। আর এ হল আমার নাতি ফারুক। হ্যাঁ মফিজুল এখানেই থাকে। তার মুখে আমি আপনার কথা শুনেছি। কিন্তু মফিজুল তো এখন বাসায় নাই।’

    কথাটা শুনে আমি তাকে প্রশ্ন করলাম, ‘মফিজুল ভাই কোথায় গেছে? কখন ফিরবে?’

    প্রশ্ন শুনে ফারুক নামের ছেলেটা বলল, ‘তিন দিন আগে কী একটা কাজ নিয়ে কুমিল্লা গেছে। ঠিক কোথায় গেছে আর কবে ফিরবে তা বলে যায়নি। মাঝির কাজ তো। নদীতে নেমে পড়লে অনেক সময় আগের থেকে ফেরার সময় বলা যায় না।’

    এ কথা শুনে বেশ ঘাবড়ে গেলাম আমি। তাদের উদ্দেশ্যে আমি বললাম, ‘কিন্তু আমি তো তাকে চিঠি পাঠিয়ে জানিয়ে দিলাম, আমি আজ আসছি।’

    বৃদ্ধ নছিব মাঝি আমার কথা শুনে বললেন, ‘সে চিঠি এখনও এখানে এসে পৌঁছায়নি। পেলে আমি জানতাম। কারণ, চিঠি প্রথমে আমার হাতেই আসে। চিঠি পেলে মফিজুল কখনই কাজে যেত না। আমার মাথায় এবার আকাশ ভেঙে পড়ল। নতুন দেশ, তার ওপর বিদেশ বলে কথা! এ শহরে আমার অন্য কেউ চেনা জানাও নেই। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ভাবার চেষ্টা করতে লাগলাম আমার এখন কী করা উচিত?

    নছিব আলি মনে হয় আমার মনের অবস্থা বুঝতে পারলেন। আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর তিনি আমার উদ্দেশ্যে বললেন, ‘আপনাকে একটা কথা বলি ভাই। আপনি যখন মফিজুলের মেহেমান হিসাবে এতদূর থেকে এখানে এসেছেন তখন আপনি আমারও মেহেমান। ঘর তো আমার বেশ ক’টা খালি পড়ে আছে। মফিজুল না থাকলেও ইচ্ছে হলে আমার এখানে ক’টা দিন থাকতে পারেন ।

    নছিব আলির কথার পর তার নাতি ফারুক বলল, ‘হ্যাঁ আপনি আমাদের বাসায় থাকতে পারেন। মফিজুল ভাইজানের কাছে আমিও আপনার কথা শুনেছি। আপনি কয়েকটাদিন অন্তত এখানে থেকে যেতে পারেন। তার মধ্যে যদি মফিজুল ভাই না ফিরে আসেন তখন না হয় আপনি অন্য কথা ভাববেন।’ বৃদ্ধ বললেন, ‘সমস্যার ব্যাপার শুধু একটাই। আমরা দু’জন পুরুষ মানুষ শুধু এখানে থাকি। রান্না করার জন্য লোক নাই। খাবারটা আপনাকে বাইরে থেকে খেতে হবে। সামনেই বেশ কয়েকটা হোটেল আছে। আমরাও পাইস হোটেলেই খাই।’

    আমি এখন যে পরিস্থিতিতে পড়েছি তাতে হোটেলে খাবার থেকেও প্রথমে প্রয়োজন একটা মাথা গোঁজার জায়গা। কাজেই নছিব আলির প্রস্তাব শুনে আমি যেন হাতে চাঁদ পেলাম। আমি বললাম, ‘অনেক ধন্যবাদ আপনাদের। বাইরে খাওয়া নিয়ে আমার কোন সমস্যা হবে না। অন্তত তিনটে রাত আমি এখানে কাটাতে চাই। তার মধ্যে যদি না ফিরে আসে তখন আমি দেশে ফিরে যাব। এখানে থাকার জন্য যা ভাড়া লাগবে আমি তা দেব।’

    কথাটা শুনে বৃদ্ধ তার কানের লতিতে আঙুল ছুইয়ে বললেন, ‘তোবা তোবা! আপনি এ কী বলছেন কত্তা! আপনি আমাদের মেহেমান । ভাড়ার কোন প্রশ্নই নেই।’

    আমি এরপর তাদের দু’জনের সঙ্গে এগিয়ে গিয়ে বাড়ির ভিতর প্রবেশ করলাম। একটা নড়বড়ে কাঠের সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে এলাম আমি। সামনে টানা বারান্দা। তার একপাশে সার সার ঘর। মাথার ওপর কড়িবরগার ছাদ। তার আড়াল থেকে উকি দিচ্ছে গোলা পায়রা। দোতলায় উঠে আসতেই একটা জিনিস চোখে পড়ল আমার। দেয়ালের গায়ে হেলান দিয়ে একটা বেশ বড় নৌকার দাঁড় রাখা আছে। জিনিসটা দেখে অনেক পুরানো জিনিস বলেই মনে হয়। আমার কাঠের দাঁড়টার ওপর চোখ গেছে বুঝতে পেরে নছিব আলি বললেন, ‘এই দাঁড়টার বয়স কতো জানেন? প্রায় তিনশো বছর। নবাবী আমল থেকে দশ পুরুষ ধরে আমরা বুড়িগঙ্গা নদীতে মাঝির কাজ করে আসছি। আমিও কিছুদিন আগে পর্যন্ত বুড়িগঙ্গা নদীতে ফেরি পারাপারের কাজ করতাম। এখন বেশীক্ষণ দাঁড় টানতে বুকে লাগে। ভাই ও কাজ ছেড়ে দিয়েছি। তবে আমার একটা ছোট নৌকা আছে সেটা নিয়ে আমি মাঝে মাঝে ওপারে যাই।’

    এ কথা বলার পর তিনি বললেন, ‘আপনি হয়তো ভাবতে পারেন যে, মাঝিগিরি করে আমরা এত বড় বাড়ির মালিক হলাম কী ভাবে? আসলে নবাবী আমলে একবার আমার এক পূর্বপুরুষ‌‌ নবাব পরিবারের বেশ কয়েকজনকে ঝড়ের মধ্যে নদীতে ডুবে যাওয়া থেকে উদ্ধার করেছিল। নবাব ব্যাপারটাতে খুশি হয়ে এই বাড়িটা আর একটা বড় নৌকা দান করেছিলেন আমার সেই পূর্বপুরুষকে। যে দাঁড়টা দেখতে পাচ্ছেন সেটা সেই নৌকারই দাঁড়।’—এ কথা বলতে বলতেই আমাকে নিয়ে বারান্দা দিয়ে এগিয়ে গিয়ে একটা ঘরের দরজা খুলে ভিতরে প্রবেশ করলেন তারা। সে ঘরে আলোপাখা, বিছানা সবই আছে। ঘর সংলগ্ন একটা বাথরুমও আছে। তবে সেটা দেখে বোঝা যায় যে কিছুকাল আগে বানানো। আমাকে ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে নছিব আলি বললেন, ‘মফিজুল না এলেও আমি চেষ্টা করব আপনাকে শহরের কিছু জায়গা ঘুরিয়ে দেখাবার।’

    ফারুক বলল, ‘হ্যাঁ আমিও আপনাকে শহরটা ঘুরিয়ে দেখাতে পারি।’

    তাদের দু’জনের কথাবার্তা শুনে আমার খুব ভালো লাগলো। এরপর তারা চলে গেলেন। কলকাতা থেকে বেরিয়ে প্রায় চব্বিশ ঘন্টা পথ আমি নাগাড়ে পাড়ি দিয়েছি। বেশ ক্লান্ত লাগছিল আমার। তাই স্নান সেরে সঙ্গে থাকা শুকনো খাবার খেয়ে ঘরে শুয়ে পড়লাম আমি। আমার যখন ঘুম ভাঙলো তখন বিকাল হতে চলেছে। বিকালবেলা বাড়ি থেকে বেরিয়ে মগবাজার অঞ্চলটা পায়ে হেঁটে আমি ঘুরে বেড়ালাম। খোঁজখবর নিলাম ঢাকা শহরে কী কী দেখার জায়গা আছে এবং কীভাবে সেসব জায়গা দেখা যায় সেসব খবর। তারপর যখন সন্ধ্যা নামল তখন আমি একটা হোটেল থেকে রাতের খাবার কিনে বাসায় ফিরে এলাম। বাড়িতে আলো আছে ঠিকই কিন্তু দেখলাম রাতের বেলা ঘরের ইলেকট্রিকের বাতিতে তেমন জোর থাকে না। ফ্যাটফ্যাটে আলো। রাত আটটা নাগাদ একতলা থেকে দোতলায় আমার ঘরে আমার খোঁজ নিতে এলেন নছিব আলি। আমার কোন অসুবিধা হচ্ছে কিনা তিনি তা জেনে নেবার পর আমাকে বললেন, ‘আমি কাল সকালে বুড়িগঙ্গা নদীর ওপারে যাব। ওপারে জিঞ্জিরা প্রাসাদ নামে নবাবী আমলের একটা প্রাসাদের কিছুটা অংশ এখনও টিকে আছে। বিখ্যাত জায়গা। আমি সেখানেই যাব। আপনি ইচ্ছে করলে আমার সঙ্গে যেতে পারেন।’

    নছিব আলির কথা শুনে আমি বললাম, ‘এ তো‌ ভালো প্রস্তাব। আমি নিশ্চয়ই যাব আপনার সঙ্গে ।

    এরপর টুকটাক কথা বলে চলে গেলেন নছিব আলি।

    আমার সঙ্গে সব সময় এক প্যাকেট তাস থাকে। অনেক জাদুকরেরই এমন অভ্যাস থাকে । ওই তাস দিয়ে অবসরে খেলা প্র্যাক্টিস করা যায় আবার সময়ও কাটানো যায়। নছিব আলি চলে যাবার পর আমি বেশ অনেকটা সময় সেই তাস নিয়ে কাটালাম। তারপর রাত দশটা নাগাদ খাওয়া সেরে বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়লাম। বাইরেটা নিঝুম, নিস্তব্ধ। সারাদিন অনেকক্ষণ ঘুমিয়েছি বলে প্রথমে আমার ঘুম আসছিল না। অন্ধকার ঘরে শুয়ে নানান কথা ভাবছিলাম আমি। হঠাৎই আমার কানে একটা শব্দ ভেসে আসতে লাগল ঘরের বাইরে থেকে। ক্ষীণ শব্দ। আমার মনে হতে লাগল কেউ যেন একটানা কোন কথা বলে চলেছে! যেন সে কিছু পাঠ করে চলেছে সরু গলাতে। আমার মনে হল সেটা যেন একটা নারী কন্ঠ। যাই হোক, ব্যাপারটা আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না। সে শব্দ শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়লাম আমি।

    || ৩ ||

    পরদিন ‘ফজরের’ অর্থাৎ প্রাতঃকালীন আজানের শব্দে আমার ঘুম ভাঙল ভোর পাঁচটা নাগাদ। জানলা খুলে আমি দেখতে পেলাম ধীরে ধীরে জেগে উঠতে শুরু করেছে মগবাজার। দরজা খুলে বারান্দায় বেরিয়ে এলাম আমি। ভোরের প্রথম আলো ছড়িয়ে পড়েছে বারান্দাতে। লম্বা বারান্দাতে পায়চারি শুরু করলাম আমি। বেশ কয়েকবার এ প্রান্ত থেকে ও প্রাস্ত পর্যন্ত পায়চারি করার পর হঠাৎ আমার কানে দরজা বা জানলা খোলার একটা শব্দ কানে এল। সেই শব্দ অনুসরণ করে আমি থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে দেখতে পেলাম একটা ঘরের জানলার পাল্লা একটু ফাঁক হয়ে গেছে। জানলার আড়ালে যে আছে তাকে দেখতে না পারলেও আমি দেখলাম একটা শুভ্র হাত জানলার একটা গরাদকে আঁকড়ে ধরেছে। সরু সরু ধবধবে ফর্সা আঙুলগুলা কোন নারীর হাত। সেই হাতটা বিশেষ ভাবে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করল এই জন্য যে, সে হাতে একটা আংটি পরা আছে। আর তার পাথরটা ভোরের আলোতে ঝলমল করছে! আমি বেশ অবাক হলাম সে ঘরে কেউ আছে দেখে। কারণ নছিব আলি বলেছেন তিনি আর ফারুক ছাড়া এ বাড়িতে কেউ থাকে না। যে ঘরের খোলা জানালা দিয়ে সেই শুভ্ৰ হাতটা বেরিয়ে আছে সিঁড়ির দিক থেকে এগোলে সে ঘরটা অতিক্রম করেই আমার ঘরের দিকে যেতে হয়। আমার হাঁটা হয়ে গেছিল, আমি তাই এরপর পা বাড়ালাম আমার ঘরের দিকে। কিন্তু আমি কয়েক পা এগোতেই সম্ভবত আমার পায়ের শব্দ শুনে হাতটা গরাদ থেকে সরে গেল, আর জানলার পাল্লাটাও বন্ধ হয়ে গেল। এরপর আমি ঘরে ফিরে এলাম । নছিব আলির সঙ্গে আমার বাইরে বেরোনোর কথা। ধীরে সুস্থে বাইরে বেরোবার জন্য তৈরি হলাম আমি। ঠিক সকাল ন’টায় নছিব আলি হাজির হলেন আমার ঘরের দরজাতে। আমি ঘরের বাইরে বেরোলাম। প্রাতঃকালীন সম্ভাষণ বিনিময়ের পর আমরা সিঁড়ির দিকে এগোলাম নীচে নামার জন্য কয়েক‌ পা এগোতেই সেই ঘরের জানলার পান্না দু’টো আমাদের পাশে খুলে গেল। আমি প্রথমে দেখতে পেলাম সেই আংটি পরা হাতটা আঁকড়ে ধরল জানলার গরাদ। তারপর আমি দেখতে পেলাম ঘরের ভিতর যে রয়েছে তাকেও। এক বৃদ্ধা। তাঁর মুখমণ্ডলের রঙ তার হাতের রঙের মতোই ফর্সা। তবে বয়সের কারণে অসংখ্য বলিরেখা সৃষ্টি হয়েছে তাঁর মুখমন্ডলে। বৃদ্ধার পরনে কব্জি পর্যন্ত হাতাওলা লম্বা ঝুলের পোশাক। একটা ওড়নার মতো কাপড় দিয়ে কপাল আর মাথার চুল ঢাকা। জানলার গরাদের ফাঁকে মুখ গুঁজে বৃদ্ধা বললেন, ‘তোরা কি জিঞ্জিরা প্রাসাদে যাচ্ছিস? আমাকেও নিয়ে চল সেখানে।’

    তার কথা শুনে নছিব আলি থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে বললেন, ‘না, আমরা সেখানে যাচ্ছি না। তুমি ঘরেই থাকো।’

    কথাটা শুনে কেমন যেন অদ্ভুত ভাবে হেসে উঠে বৃদ্ধা বললেন, ‘আমি জানি তোরা সেখানেই যাচ্ছিস। কিন্তু গিয়ে কোন কাজ হবে না।’ এ কথা বলেই বেশ শব্দ করে জানলাটা বন্ধ করে দিলেন তিনি।

    আমি এবার আরো একটা অদ্ভুত ব্যাপার খেয়াল করলাম। বৃদ্ধার ঘরের দরজার বাইরে শিকল তোলা। আমি নছিব আলিকে প্রশ্ন করলাম, ‘উনি কে? আপনি যে বললেন, আপনারা ছাড়া এ বাড়িতে আর কেউ থাকেন না। ওঁর ঘর বাইরে থেকে শিকল তোলা কেন?’

    নছিব আলি সিঁড়ির দিকে এগোতে এগোতে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, ‘হ্যাঁ বলেছি। কারণ উনি বাড়িতে থাকা বা না থাকা একই ব্যাপার। সম্পর্কে উনি আমার জ্ঞাতি ঠাকুমা হন। ওর বয়স একশোর ওপরে। আমরা যে জিঞ্জিরা প্রাসাদে যাচ্ছি সেখানেই একসময় উনি থাকতেন। আমার পূর্বপুরুষরাও একসময় অনেকেই ওখানে থাকতেন। নবাবদের চাকর, খানসামা, দাঁড়ি, মাঝি, পালকিবাহক, সহিস ইত্যাদি লোকদের থাকার ব্যবস্থা ছিল প্রাসাদের চৌহদ্দিতে।’

    সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামার পর নছিব আলি এরপর বললেন, ‘ওকে দেখার কেউ নেই বলে আমি জিঞ্জিরা প্রাসাদ থেকে আমার কাছে এনে রেখেছি। ওর মাথাটা খারাপ হয়ে গেছে। কোন কোন সময় নিজেকে ঘসেটি বেগম বলে ভাবেন। পথে-ঘাটে পাগলীর মতো ঘোরার জন্য বাচ্চারা ওর পিছনে লাগত, ওকে দেখলেই ঘসেটি ঘসেটি বলে ওর পিছন পিছন ছুটতো, ঢিল মারত। তাই ওকে এখানে এনে রেখেছি কিছু বছর ধরে। একবার উনি বুড়িগঙ্গাতে ঝাঁপ দিয়েছিলেন জিঞ্জিরা প্রাসাদ যাবার জন্য। একজন মাঝির ব্যাপারটা চোখে পড়ায় ওর প্রাণ রক্ষা হয়। তাই এখন ওঁকে ঘরে শিকল দিয়ে রাখতে হয়। আমরা ওঁকে বড় আম্মা বলে ডাকি।’

    কথা বলতে বলতেই বাড়ির বাইরে বেরিয়ে পড়লাম আমরা। মহল্লার বাইরে বেরিয়ে কিছুটা হাঁটার পর একটা ভ্যান রিক্সাতে চেপে আমরা রওনা হয়ে গেলাম বুড়িগঙ্গার দিকে। আধঘন্টা মতো সময় লাগল আমাদের ঘাটে পৌঁছতে। ইতিমধ্যেই বহু লোকজন জড়ো হয়েছে ঘাটে। পদ্মার মতো ঢাকার বুড়িগঙ্গা নদীর কথা আমি আগেও শুনেছিলাম। কিন্তু পদ্মা নদী দেখে যতটা উৎফুল্ল হয়েছিলাম, বুড়িগঙ্গা দেখে তা হল না। এ যেন বড় কোন খালের মতো দেখতে লাগছে। নদীর দু’পাশের ঘিঞ্জি বসতি যেন নদীটাকে দু’পাশ থেকে চেপে ধরতে চাইছে। নদীর জলের রঙও কালো, বিশেষ স্রোত নেই। ঢাকা শহরের সমস্ত আবর্জনা এসে পড়ে এই বুড়িগঙ্গা নদীতে। তবে নানান ধরনের প্রচুর নৌকো রয়েছে নদীতে। যাত্রী পারাপার করছে তারা। নদীর পাড় বরাবর হাঁটতে হাঁটতে নছিব আলি বললেন,‌ ‘আজ থেকে আড়াইশো, তিনশও বছর আগে নদী এ জায়গাতে অনেক চওড়া ছিল। নদীতে স্রোতও ছিল প্রচুর। চারশো বছর আগে এই বুড়িগঙ্গা নদীর পাড়েই গড়ে উঠেছিল ঢাকা শহর। নবাবী আমলে মুর্শিদাবাদ থেকে ধলেশ্বরী নদীর মোহনা হয়ে বড় বড় বজরা, নৌকা আসত ঢাকার বুড়িগঙ্গা ঘাটে। আমরা যে জিঞ্জিরা প্রাসাদে যাব সেই প্রাসাদের সঙ্গে মুর্শিদাবাদ প্রাসাদের যোগসূত্র ছিল এই বুড়িগঙ্গাই । জিঞ্জিরা হল আরবী শব্দ। যার অর্থ হল চারপাশে পানিতে ঘেরা জায়গা। এখন অবশ্য তা নেই। এই বুড়িগঙ্গা ছাড়া প্রাসাদের অন্যদিক পলি জমে বুজে গেছে। তার ওপর জনবসতি তৈরী হয়ে গেছে। ‘

    এ কথা বলার পর তিনি বললেন, ‘এই জিঞ্জিরা প্রাসাদ আর বুড়িগঙ্গা নদীর সঙ্গে কিন্তু নবাবী আমলের এক করুণ ঘটনা জড়িত। শুধু করুণ নয়, ভয়ঙ্করও বটে।’

    আমি জানতে চাইলাম, ‘কী ঘটনা?’

    তিনি বললেন, ‘চলুন পানিতে নেমে বলছি

    হাঁটতে হাঁটতে ঘাটের কোলাহল ছেড়ে অপেক্ষাকৃত একটা ফাঁকা জায়গায় এসে উপস্থিত হলাম আমরা। সেখানে বেশ কয়েকটা ছোট নৌকা বাঁধা আছে। একটা নৌকা দেখিয়ে নছিব আলি বললেন, ‘ওটা আমার নিজের নৌকা।’

    সে নৌকাটাকে ঠেলে জলে নামিয়ে তাতে উঠে বসলাম আমরা দু’জন। নৌকা একটু এগোতেই আমার হঠাৎ ইচ্ছা হল নৌকা চালাবার। আমার গুরুদেব হংসরাজের কাছ থেকে নৌকা চালানো শিখেছিলাম আমি। বড় নদীতে না হলেও ছোট নদীতে বহুবার নৌকা চালিয়েছি আমি। বুড়িগঙ্গাতে স্রোত নেই, তাছাড়া নছিব আলি সঙ্গে আছেন তাই ভয়ের কোন কারণ নেই। আমি আমার ইচ্ছার কথা ব্যক্ত করতেই নছিব আলি বৈঠাটা আমার হাতে তুলে দিলেন। আমি দেখলাম আমি নৌকাটা ভালোই চালিয়ে নিয়ে যেতে পারছি ওপারের দিকে। বৈঠা ঠেলতে ঠেলতে আমি তাকে প্রশ্ন করলাম, ‘কোন ভয়ংকর ঘটনার কথা বলছিলেন আপনি?’

    নছিব আলি একটু চুপ করে বসে থেকে বললেন, ‘নবাবী আমলে পলাশীর যুদ্ধের ঠিক পরের ঘটনার কথা। যুদ্ধে সিরাজের পতন ও মৃত্যু ঘটল। নতুন নবাব হলেন মীরজাফর। আর তার সঙ্গে চূড়ান্ত ক্ষমতার অধিকারী হলেন নবাবপুত্র মিরন। ঢাকার জিঞ্জিরা প্রাসাদের মালিক বা সুবেদার তখন জশরত খাঁ। সিরাজের পতনের ও মৃত্যুর পর তার মা আমিনা বেগম ও ঘসেটি বেগমকে জশরত খাঁ’র জিঞ্জিরা প্রাসাদে পাঠিয়ে দেওয়া হয় মুর্শিদাবাদ থেকে। যদিও সিরাজের বিরুদ্ধে চক্রান্তে ঘসেটি বেগম মীরজাফরের পক্ষেই ছিলেন। দুই বোন ঢাকায় এসে জিঞ্জিরা প্রাসাদে বাস করতে শুরু করেন। বলা ভালো আমিনা আর ঘসেটি বেগম এখানে নজরবন্দি অবস্থাতেই বাস করছিলেন। কিন্তু তাঁরা কিছুকাল এখানে বসবাস করার পরই একদিন হঠাৎ বকর খাঁ নামে মিরনের এক অনুচর একশো সৈন্য নিয়ে হাজির হল ঢাকাতে। বকর খাঁ, জশরত খাঁকে জানালো যে মিরনের নির্দেশে সে আমিনা বেগম আর ঘসেটি বেগমকে মুর্শিদাবাদে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে এসেছে। জশরত খাঁ লোক এমনি ভালো ছিলেন। তাঁর প্রাসাদে থাকাকালীন দুই বেগমের কোন অমর্যাদা তিনি করেননি। মিরনের অভিসন্ধি যে ভালো নয় তা বুঝতে অসুবিধা হলো না জশরত খাঁর। কিন্তু তিনি নিরুপায় ছিলেন। মিরনের নির্দেশ অগ্রাহ্য করার মতো ক্ষমতা তাঁর ছিল না। তাই তিনি একটা নৌকো আর দাঁড়ি মাঝি সমেত দুই বেগমকে তুলে দিলেন বকর খাঁ’র হাতে। বকর খাঁ তার নিজেদের নৌকার সঙ্গে বেগমের নৌকাটাকে বেঁধে এক সন্ধ্যায় ঢাকা থেকে বুড়িগঙ্গা নদী দিয়ে যাত্ৰা শুরু করলেন মুর্শিদাবাদের উদ্দেশ্যে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত জশরত খাঁ’র অনুমানই সত্যি প্রমাণিত হলো। যে নৌকাতে দুই বেগমকে তুলে দেওয়া হয়েছিল তারা ফিরে এসে জানালো যে বকর খাঁ’র লোকজন গভীর রাতে তাদের নৌকা থেকে দুই বেগমকে হাত-পা বেঁধে বুড়িগঙ্গাতে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে। পানিতে ডুবে মৃত্যু হয়েছে তাদের। তখন বুড়িগঙ্গা ছিল অনেক গভীর আর চওড়া। আর তাতে স্রোতও ছিল প্রচুর। এর বুকেই হারিয়ে যায় দুই বেগম। ‘

    নছিব আলি একটানা কথাগুলো বলে থামার পর আমি তাকে বললাম, ‘হ্যাঁ, আমি শুনেছিলাম যে ঘসেটি বেগমকে মিরনই ডুবিয়ে মেরেছিল। কিন্তু পলাশীর যুদ্ধে ঘসেটি বেগম তো মীরজাফরের পক্ষে ছিলেন, তাহলে তাঁকে কেন মিরন হত্যা করেছিল জানেন?’

    প্রশ্নটা শুনে একটু চুপ করে থেকে বৃদ্ধ বললেন, ‘ঘসেটি বেগম ছিলেন অত্যন্ত বিদুষী মহিলা। ইংরেজরা তাকে পছন্দ করত। তিনি বহু গুণের অধিকারিনী ছিলেন। তার মধ্যে একটা নাকি জাদুবিদ্যা। কালো জাদু, অর্থাৎ তুকতাক। কেউ কেউ সে সময় বলত যে ঘসেটি বেগমের কালো জাদুর কারণেই নাকি সিরাজের পতন ঘটে। এ কথা সত্যি মিথ্যা যাই হোক তা মিরনের মনে ভয় ধরিয়েছিল ঘসেটি বেগম সম্পর্কে। এমনও তো হতে পারে যে ওই কালো জাদুর সাহায্যে ঘসেটি বেগম ইংরেজদের বশ করে মীরজাফরকে হটিয়ে দিয়ে বাংলার সিংহাসনে বসল?—এই আশঙ্কাতেই মিরন কৌশলে ঘসেটি বেগমকে হত্যার সিদ্ধান্ত নেয়। মিরন আর মীরজাফর প্রথমে রটিয়ে দিয়েছিল যে ঢাকা থেকে ফেরার সময় ধলেশ্বরী নদীর কাছে বুড়িগঙ্গার প্রবল স্রোতে নৌকাডুবি হয়ে আমিনা বেগম আর ঘসেটি বেগমের মৃত্যু হয়। কিন্তু ইংরেজ কোম্পানী যখন আসল খবরটা জানতে পারে তখন তারা প্রচন্ড ক্ষুব্ধ হয় ও মীরজাফরকে তীব্র ভর্ৎসনা করে। পরবর্তীকালে ইংরেজরা যে সব অভিযোগে মীরজাফরকে সিংহাসনচ্যুত করে তার মধ্যে একটা অভিযোগ ছিল, তাদের প্রিয় পাত্রী ঘসেটি বেগমকে হত্যা করা। মিরনের বজ্রপাতে মৃত্যু হওয়ার কারণ সম্পর্কে অনেকে বলে থাকে যে, সেটা নাকি ঘসেটি বেগমের অভিশাপে বা মরবার পরও তার কালো জাদুর প্রভাবেই হয়েছিল!’

    এসব কথা বলতে বলতে সাত-আট মিনিটের মধ্যেই শীর্ণ বুড়িগঙ্গা পেরিয়ে গেলাম আমরা। তারপর সে পাড়ে নৌকো বেঁধে নছিব আলির পিছন পিছন ঘিঞ্জি বাড়িঘরের মধ্যে দিয়ে রওনা হলাম জিঞ্জিরা প্রাসাদের দিকে। কিন্তু আমি প্রাসাদ বলতে মনে মনে যা কল্পনা করেছিলাম, সে জায়গাতে পৌঁছে আমি দেখলাম তেমন কিছুর অস্তিত্বই নেই। ছড়িয়ে ছিটিয়ে কিছু প্রাচীন স্থাপত্যের ধ্বংসাবশেষ শুধু এখান ওখান থেকে উঁকি মারছে। কোথাও হয়তো একটা দেওয়াল, কোথাও বা কয়েকটা ঘর সাবেক জিঞ্জিরা প্রাসাদের সাক্ষ্য বহন করে কোনরকমে দাঁড়িয়ে আছে। আর তাদের মধ্যেই মাথা গোঁজার স্থান করে নিয়েছে কিছু মানুষ। সে জায়গাতে ঘরবাড়িও বানিয়েছে তারা। ভগ্নস্তুপের ইটই কেউ কেউ ব্যবহার করেছে সেসব ঘরবাড়ি বানাতে। একসময় যে জায়গাতে নবাবী প্রাসাদ ছিল, কালের নিষ্ঠুর পরিণতিতে তা আজ বস্তির রূপ নিয়েছে। সে জায়গাতে দাঁড়িয়ে নছিব আলি বললেন, ‘হ্যাঁ, এ জায়গাতেই একসময় ছিল জিঞ্জিরা প্রাসাদ। পলাশীর যুদ্ধর দেড়শো বছর আগে মোঘল সুবেদার ইব্রাহিম খাঁ ফতে জং এখানে প্রাসাদ নির্মাণ করেন। পরবর্তীকালে যা বাংলার নবাবদের হাতে আসে। শুধু আমিনা বেগম বা ঘসেটি বেগমই নন, নবাব সরফরাজ খাঁ আলীবর্দির হাতে পরাজিত ও নিহত হবার পর সরফরাজের পরিবারকেও এখানে নির্বাসিত করা হয়। সিরাজের বেগম লুৎফুন্নিসাও তার কন্যাকে নিয়ে এখানে দিন কাটিয়েছিলেন। বিশাল এই প্রাসাদ থেকে নাকি সুড়ঙ্গ পথে বুড়িগঙ্গার তলদেশ দিয়ে ওপারে পৌঁছন যেত। কিন্তু বর্তমানে সেসব কিছুরই আর অস্তিত্ব নেই। শুধু কিছু ঘর আর হামামখানা অর্থাৎ যেখানে নবাব পরিবারের লোকেরা গোসল করতো সে জায়গার কিছুটা শুধু এখনও আছে।’

    এসব কথা বলার পর নছিব আলি আবর্জনা ভর্তি ধ্বংসস্তূপের মধ্যে দিয়ে নিয়ে গিয়ে কিছুটা দূরে সেই হামামখানায় নিয়ে গেলেন। বেশ বড় একটা ঘর তখনও কোনরকম সেখানে দাঁড়িয়ে আছে। মাথার ছাদটা গম্বুজ আকৃতির। তার ভাঙা অংশ দিয়ে আলো ঢুকছে ভিতরে। কিছু বুনো গাছপালা জন্মেছে গোসলখানার ভিতরে ও বাইরে। তারাই তাদের ডালপালা, শিকড় দিয়ে আজও ধরে রেখেছে ওই প্রাচীন স্থাপত্যকে। সে জায়গা আমাকে দেখানোর পর নছিব আলি বলল, ‘এ জায়গায় আপনার কেমন লাগলো জানি না, কিছুই হয়তো এখানে নেই, তবু এ জায়গায় এলে পুরোনো দিনের কথা ভাবলে আমার গা-টা কেমন যেন ছমছম করে। একবার ভাবুন তো, আমরা যে পথে হেঁটে এলাম, সেখানে একদিন হেঁটে বেড়াতেন ঘসেটি বেগম। জায়গাগুলোতে তখন প্রাসাদের ঘর ছিল।’

    বড় প্রাসাদ দেখার অভিলাষে সেখানে গিয়ে পৌঁছে তেমন কিছু না দেখতে পেলেও নছিব আলির এ কথায় মনে বেশ রোমাঞ্চ বোধ করলাম আমি। মুহূর্তর জন্য মানসচক্ষে আমি যেন দেখতে পেলাম, বিরাট এক প্রাসাদের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছি আমি। আমার চারপাশে লোকজন, সৈন্য-সামন্ত, হাতি-ঘোড়া সব গমগম করছে!

    || 8 ||

    বৃদ্ধ এরপর আমাকে বললেন, ‘এখানে আমাদের পূর্বপুরুষদের একটা ঘর আছে। আমি তাই মাঝে মাঝে এখানে আসি যাতে অন্য কেউ জায়গাটা দখল না করে নেয় সেজন্য। চলুন সেখানে গিয়ে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে তারপর ফেরার পথ ধরব।’

    আমি বললাম, ‘ঠিক আছে চলুন।’

    কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা এসে উপস্থিত হলাম কয়েকটা জীর্ণ ঘরের সামনে। দেখেই বোঝা যায় সেই ঘরগুলো অতি প্রাচীন। তবে তার মধ্যে একটা ঘরের গায়ে পরবর্তীকালে পলেস্তরা চাপিয়ে মেরামতের চেষ্টা করা হয়েছে। একটা মজবুত কাঠের দরজাও বসানো হয়েছে ঘরটাতে। পকেট থেকে চাবি বার করে সেই দরজার তালা খুলতে খুলতে নছিব আলি বললেন, ‘এ ঘরগুলো জিঞ্জিরা প্রাসাদ চত্বরের মধ্যে থাকলেও মূল প্রাসাদের বাইরে ছিল। শুনেছি দেড়শবছর আগে নাকি এক ঝড়বৃষ্টির রাতে হুড়মুড় করে ভেঙে পড়েছিল জিঞ্জিরা প্রাসাদ। তখনই প্রাসাদের বয়স হয়ে গেছিল আড়াইশো বছর। এ ঘরগুলো বাইরে থাকায় টিকে যায়। এসব ঘরে আসলে থাকত চাকর-বাকর গোত্রের লোকেরা। আমার পূর্বপুরুষরাও এখানে থাকতেন।

    দরজা খুলে আমাকে নিয়ে সে ঘরের ভেতর প্রবেশ করলেন বৃদ্ধ। আধো-অন্ধকার ঘর। একটা পুরানো চৌকি আর সামান্য কিছু আসবাব রয়েছে ঘরে। যে ঘরে আমরা ঢুকলাম সে ঘর সংলগ্ন আরও একটা ঘর আছে পিছন দিকে। বাইরে থেকে তার অস্তিত্ব বোঝা যায় না। সে ঘরের দরজার পাল্লা নেই । তার ভিতর আলো প্রবেশ করছে না, খেলা করছে জমাট বাঁধা অন্ধকার ।

    আমাকে নিয়ে নড়বড়ে চৌকিটাতে বসার পর নছিব আলি বললেন, ‘আসলে এ ঘরটার সঙ্গে আমার পূর্বপুরুষদের স্মৃতি জড়িয়ে আছে, তাই এ ঘরের মায়া কাটাতে পারি না। জশরত খাঁ যখন জিঞ্জিরা প্রাসাদের দায়িত্বে ছিলেন তখন খোদাবন্দ নামে আমার এক পূর্বপুরুষ প্রাসাদের মাঝির কাজ করতেন। তার সময় থেকেই জিঞ্জিরা প্রাসাদের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ।’

    বৃদ্ধর কথা শুনে আমি বললাম, ‘তার মানে যখন ঘসেটি বেগম এখানে এসেছিলেন সেই সময়?’

    নছিব আলি বললেন, ‘হ্যাঁ, ঠিক সেই সময়।’

    আমি এরপর জানতে চাইলাম, ‘আপনার বড় আম্মা কোথায় থাকতেন?’

    নছিব আলি আমার প্রশ্নর জবাবে সে ঘর সংলগ্ন অন্ধকার ঘরটা দেখিয়ে বললেন, ‘এই ঘরটাতে। আমি তাকে অনেকটা জোর করেই নদীর ওপারে মগবাজারে নিয়ে গেছি। এখানে কি তার বয়সী কোন বৃদ্ধার পক্ষে একলা থাকা সম্ভব? তার ওপর ওঁর মাথাটাও গন্ডগোল হয়ে গেছে।’

    আমি জানতে চাইলাম, ‘এখানে চারপাশে যারা থাকেন, তাদের পূর্বপুরুষরা কি এখানেই থাকতেন?’

    বৃদ্ধ জবাব দিলেন, ‘কারো কারো। অধিকাংশই বাইরে থেকে আসা জবরদখলকারী। তারা এ জায়গার মর্ম ঠিক বোঝে না। দেখছেন না চারপাশটা কেমন অপরিচ্ছন্ন করে রেখেছে।’

    এ কথা বলার পর নছিব আলি বললেন, ‘আমারও তো বয়স হল, আমি না থাকলে এ ঘরটাও দখলদারদের হাতে চলে যাবে। তবে আমার এখন চিন্তা শুধু ফারুকটাকে নিয়ে।

    আমি বললাম, ‘তাকে নিয়ে চিন্তা কেন?’

    নছিব আলি বলল, ‘ও বাপ-মা মরা ছেলে। একটা দুর্ঘটনায় আমার ছেলে আর তার বিবির মৃত্যু হয়। ছোটবেলা থেকে আমিই ওকে মানুষ করেছি। মরবার আগে ও নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছে তা দেখে যেতে চাই। দু’বার দু’টো ব্যবসা শুরু করেছিল। কিন্তু তার টিকল না। অনেক টাকা ক্ষতি হল। এখন বলছে আবার নতুন একটা মোটর পার্টসের দোকান খুলবে। তার জন্য অনেক টাকার দরকার। আমি চেষ্টা করলাম মগবাজারের বাড়ির একটা অংশ বিক্রি বা বন্ধক রেখে টাকার ব্যবস্থা করার। কিন্তু সরকারী তরফে আমাকে ক’দিন আগে জানানো হয়েছে যে ওসব কিছু করা যাবে না। তারা নাকি ঢাকা শহরে নবাবী আমলের ঘরবাড়ির তালিকা বানাচ্ছেন। ও সব বাড়ি নাকি সরকার ভবিষ্যতে নিয়ে নিতে পারে।’

    এ কথা বলে বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইলেন তিনি। তারপর উঠে গিয়ে পাশের অন্ধকার ঘরটার মধ্যে কিছুক্ষণের জন্য ঢুকে আবার বাইরে বেরিয়ে এলেন।

    আরও বেশ কিছুক্ষণ সে ঘরে বসে টুকটাক কথাবার্তা বললাম আমরা। তারপর সে ঘরে তালাবন্ধ করে নছিব আলি আমাকে নিয়ে পা বাড়ালেন ফেরার জন্য। কিন্তু একটা ঘটনা ঘটল। আমরা তখন জিঞ্জিরা প্রাসাদের ধ্বংসস্তূপের মধ্যে দিয়ে এগোচ্ছি। একটা বারো-চোদ্দ ফুট উঁচু প্রাচীরের গা ঘেঁষে তখন হাঁটছিলাম আমরা। জাদুকরদের চোখের দৃষ্টি বরাবরই অন্য মানুষদের থেকে বেশী সজাগ হয়। হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎই আমার যেন মনে হল সেই ভগ্ন প্রাচীরের একটা অংশ ওপর থেকে নেমে আসছে! নছিব আলি ছিলেন প্রাচীরের একদম গায়ে । মুহূর্তের ভগ্নাংশ সময়ের মধ্যে আমি হ্যাঁচকা টানে নছিব আলিকে অন্য পাশে ছিটকে ফেলে নিজেও লাফিয়ে পড়ে গেলাম। আর তার পরমুহূর্তেই সেই প্রাচীন প্রাচীরের মাথার ওপরের একটা অংশ ধ্বসে পড়ল নছিব আলি ঠিক যে জায়গাটাতে ছিলেন সে জায়গায়। আমি তার হাত না টানলে নছিব আলির মাথাটা নির্ঘাত গুড়িয়ে যেত।

    বৃদ্ধ বেশ কিছুক্ষণ হতভম্ব ভাবে চেয়ে রইলেন মাটিতে পড়ে থাকা পাথরের দিকে। আমি তাকে হাত ধরে উঠিয়ে দাঁড় করালাম। নছিব আলি বললেন, ‘আপনার জন্যই আমি বেঁচে গেলাম। আপনি এখানে একটু দাঁড়ান। আমি ঘরে একটা জিনিস ফেলে এসেছি, সেটা নিয়ে আসছি।’ তার কথামতো আমি সেখানে মিনিট পাঁচেক দাঁড়ালাম। তিনি গেলেন, আবার ফিরেও এলেন। এরপর আমরা আবার ফেরার পথ ধরলাম।

    নদী পেরিয়ে আমরা যখন আবার মগবাজারে ফিরলাম, তখন বেলা বারোটা বেজে গেছে। বড় রাস্তা থেকে যে গলিটা নছিব আলির বাড়ি যাবার জন্য ঢুকেছে, ঠিক সেই গলির মুখেই ফারুক দাঁড়িয়েছিল। যেন সে অপেক্ষা করছিল আমাদের ফেরার জন্যই। আমরা রিক্সা থেকে নামতেই ফারুক এগিয়ে এসে নছিব আলিকে প্রশ্ন করল, ‘এনেছ?’

    বৃদ্ধ জবাব দিল, ‘না পারলাম না। জানিস, আর একটু হলেই আমি মরতে বসেছিলাম। মাথার ওপর পাথর খসে পড়েছিল। ভাগ্যিস ইনি হাত ধরে আমাকে সরিয়ে দিলেন তাই বাঁচলাম।’

    ফারুক কয়েক মুহূর্ত চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল বৃদ্ধর খবর শুনে। তারপর সে বলল, ‘কুমিল্লা থেকে মফিজুল ভাইয়ের পরিচিত একজন ঢাকা এসেছিল। তার থেকে ওর খবর পেলাম।’

    আমি সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন করলাম, ‘কী খবর?’

    ফারুক বলল, ‘মফিজুল ভাই মোটর নৌকা নিয়ে বরিশাল গেছে। ফিরতে আরও দশদিন সময় লাগবে।’

    কথাটা শুনেই আমার মনটা খারাপ হয়ে গেল। দশদিনতো আমার পক্ষে থাকা সম্ভব নয় ।

    কথাটা শুনে আমি বললাম, ‘তাহলে আমি আর দু’টো রাত এখানে থেকে ফিরে যাব।’

    ফারুক বলল, ‘বুঝতে পারছি ব্যাপারটা শুনে আপনার খারাপ লাগছে। আমি আপনাকে তবে দু’দিন ঢাকা শহর ঘুরিয়ে দেখাব।’

    আমি বললাম, ‘তাহলে বেশ ভালো হয়। এত দূর থেকে এখানে এসেছি, চারপাশটা একটু ঘুরে যেতে পারলে ভালো হয়।’

    নছিব আলি ও ফারুক এরপর বাড়ি ফিরে গেল। আমি ফিরলাম, তাদের কিছুটা পর বাইরে থেকে দুপুরের খাওয়া সেরে। নছিব আলি আর ফারুক থাকে বাড়িটার একতলাতে। আমি দোতলার সিঁড়ি বেয়ে উঠে নিজের ঘরের দিকে এগোচ্ছি, ঠিক তখনই বড় আম্মার ঘরের জানলা খুলে গেল। প্রথমে আংটি পরা তার ধবল হাত আঁকড়ে ধরল জানলার গরাদ। তারপর উঁকি দিলেন বড় আম্মা। তাকে দেখে থমকে দাঁড়িয়ে পড়লাম আমি। জুলু জুলু চোখে আমার দিকে তাকিয়ে তিনি প্রথমে প্ৰশ্ন করলেন, ‘তুই জিঞ্জিরা প্রাসাদে গিয়েছিলি তাই না?’

    তাঁকে সত্যিটা বলা উচিত হবে কিনা তা বুঝতে না পেরে আমি চুপ করে রইলাম ।

    বৃদ্ধা বললেন, ‘আমি জানি তোরা কেন জিঞ্জিরা প্রাসাদে গেছিলি? তোকে কি মিরন ঢাকাতে পাঠিয়েছে?’

    আমি জবাব দিলাম, ‘না সে আমাকে ঢাকায় পাঠায়নি।’

    আমার জবাব শুনে বড় আম্মা বললেন, ‘আমি জানি, সব জানি। ঘসেটি বেগমের চোখকে ফাঁকি দেওয়া অত সহজ নয়।’—তিনি এ কথা বলার পর জানলাটা আবার বন্ধ হয়ে গেল।

    আমি বুঝলাম নছিব আলির কথাই ঠিক। বুড়ির মাথাটা খারাপ হয়ে গেছে।’

    সন্ধ্যা পর্যন্ত এরপর আমি নিজের ঘরেই কাটালাম। তারপর কিছুক্ষণের জন্য বাইরে বেরোলাম রাতের খাবার আনার জন্য। খাবার কিনে বাড়ি ফিরে একতলার বারান্দায় উঠে সিঁড়ির দিকে এগোচ্ছি, ঠিক তখনই একটা ঘরের ভিতর থেকে নছিব আলির গলার শব্দ আমার কানে এল— ‘ও জিনিসের কথা ভুলে যা তুই। তোর বাপ চলে গেল। আমিও আজ চলে যাচ্ছিলাম।’

    এ কথার জবাবে ফারুকের গলা শোনা গেল, ‘কিন্তু আমার যে টাকার খুব প্রয়োজন। ওটা না বেচলে তো সমস্যা মিটবে না।’

    — এ কথা বলতে বলতে ঘরের বাইরে বেরিয়ে এল ফারুক। আমাকে দেখে যেন কেমন একটু থতমত খেয়ে গেল সে। তার পরমুহূর্তেই সে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, ‘কাল কিন্তু আপনাকে শহর দেখাতে নিয়ে যাব। সকাল আটটায় হাঁক দেব।’

    আমি জবাব দিলাম, ‘ঠিক আছে আমি তৈরী হয়ে থাকব।’

    নিজের ঘরে আমি এরপর ফিরে গেলাম। দেখতে দেখতে রাত ঘনিয়ে এল। নিস্তব্ধ হয়ে গেল বাড়ি। রাত দশটা নাগাদ আমি খাওয়া সেরে ঘুমিয়ে পড়লাম। কিন্তু রাত বারোটা নাগাদ আমার ঘুম আবার ভেঙে গেল। কয়েক মুহূর্তর মধ্যেই আমার কানে এল গতরাতের সেই শব্দ। কেউ যেন বিড়বিড় করে কিছু বলে চলেছে। কিছুক্ষণ শব্দটা শোনার পর কৌতূহলবশত বিছানা ছেড়ে উঠে সন্তর্পনে দরজা খুললাম আমি। বাইরে বেরিয়ে দেখলাম বড় আম্মার ঘরের পাল্লাটা খোলা। একটা ধবল হাত আঁকড়ে আছে জানলার গরাদ। বারান্দায় এসে পড়া চাঁদের আলোতে তাঁর আংটির পাথরটা ঝলমল করছে। আর সেই শব্দটা জানলার আড়াল থেকেই আসছে। কী যেন বলে চলেছেন বড় আম্মা। তবে তা বাংলা বা হিন্দি শব্দ নয়। হয়তো বা আরবী বা ফারসী হতে পারে। শব্দটা সম্পর্কে আমার কৌতূহলের নিরসন হওয়াতে আমি এরপর দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়লাম।—

    একটানা অনেকক্ষণ কথাগুলো বলে থামলেন জাদুকর সত্যচরণ।

    চেয়ার ছেড়ে উঠে ঘরের কোণায় রাখা কুঁজো থেকে গ্লাসে জল নিয়ে ঢকঢক করে খেয়ে আবার নিজের জায়গাতে ফিরে এলেন। আবার তার কথা শুরু করার আগে তিনি চন্দনকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি বিরক্ত হচ্ছেন না তো?’

    চন্দন হেসে বলল, ‘একদমই না। আমি খুব মন দিয়ে শুনছি আপনার গল্প । ‘

    সত্যচরণ হেসে বললেন, ‘গল্প নয়, গল্প তো বানানো হয়। এ হল সত্য কাহিনি।’

    এ কথা বলে তাঁর ‘সত্য কাহিনি’র পরবর্তী অংশ আবার তিনি বলতে শুরু করলেন —

    || ৫ ||

    নছিব আলির বাড়ি দ্বিতীয় রাতটাও আমার কেটে গেল। সকাল আটটায় কথামতো ফারুক আমাকে ডাকতে এল। তার সঙ্গে ঢাকা শহরের দ্রষ্টব্য স্থানগুলো দেখতে বেরিয়ে পড়লাম। বাড়ি থেকে বেরিয়েই ফারুক প্রথমেই আমাকে বলল, ‘ভাই আপনি আমার মেহেমান। আগেই বলে রাখি আজ কিন্তু আমার দাওয়াত, সব খরচ আমি করব।’

    কথাটা শুনে আমি মুখে মৃদু আপত্তি করলেও তার ব্যবহারে আমি মনে মনে খুশিই হলাম । কখনও পায়ে হেঁটে, কখনও-বা বাস অথবা রিক্সাতে ফারুকের সঙ্গে ঢাকার পথে পথে দর্শনীয় স্থানগুলো একে একে দেখে বেড়াতে লাগলাম আমি। অধিকাংশ সময়তেই যানবাহনের খরচটা ফারুকই বহন করতে লাগল। একে একে সে আমাকে দেখাতে লাগল তাদের ভাষা আন্দোলনের স্মৃতি স্মারক কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, তারা মসজিদ, গোলাপ প্রাসাদ। ফারুক শিক্ষিত ছেলে। সে সব জায়গার স্থান-মাহাত্ম্য আমাকে সে জানালো । আমি আগ্রহ প্রকাশ করাতে সে আমাকে পৌঁছে দিল ঢাকেশ্বরী দেবী মন্দিরের দরজাতে। আমি মন্দিরে পুজো দিয়ে বেরোবার পর ফারুক আমাকে বলল, ‘চলো, এবার তোমাকে ঢাকার বিখ্যাত মুর্গ বিরিয়ানি খাওয়াবো।’

    সে পথে যেতে যেতে ফারুক আমাকে বলল, ‘আচ্ছা, তুমি তো জাদুকর। আচ্ছা তোমাদের ধর্মে কালো জাদু বলে কি সত্যি কিছু আছে? শুনেছি তোমাদের কিছু সাধু-সন্ন্যাসীরা নাকি ওসব জানেন? তুমি ওই জাদু জানো?

    ফারুকের কথার জবাবে আমি বললাম, ‘যেব সাধু-সন্ন্যাসী শ্মশানে শ্মশানে শব সাধনা বা তন্ত্র সাধনা করেন, তাদের কারো কারো এমন বিদ্যা আয়ত্তে থাকে বলে শুনেছি। তা দিয়ে তারা মানুষের ভালো-মন্দ করতে পারেন। ওই বিদ্যাকে বলে গুপ্তবিদ্যা। আমার ওসব বিদ্যা জানা নেই। তবে আমার যে গুরুদেব ছিলেন সেই হংসরাজের কিছু গুপ্তবিদ্যা জানা ছিল।’

    এ কথা বলে, আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘হঠাৎ এ প্রশ্ন কেন?’

    ফারুক বলল, ‘হঠাৎ আমার ঘসেটি বেগমের কথা মনে পড়ল তাই। কিছু ফকিররাও নাকি ওই কালো জাদুর অধিকারী হন। ঘসেটি বেগম নাকি তাদের কারো কাছ থেকে কালো জাদু শিখেছিলেন।’

    তার কথা শুনে আমি বললাম, ‘হ্যাঁ, গতকাল নছিব ভাইয়ের মুখে কথাটা শুনলাম। আমার এ কথা আগে জানা ছিল না।’

    ফারুক এরপর একটু ইতস্তত করে বলল, ‘জানেন, জিঞ্জিরা প্রাসাদের ওখানে যারা থাকে তাদের অনেকের ধারণা বড় আম্মা নাকি ওই কালো জাদুর চর্চা করতেন। সেজন্যই নাকি তিনি ওখানে একলা পড়ে থাকতেন। আমি অবশ্য কথাটা বিশ্বাস করি না। আসলে বড় আম্মার মাথাটা খারাপ হয়ে গেছে তো। কখনও কখনও তিনি নিজেকে ঘসেটি বেগম ভাবেন। তাই লোকজন ওর সঙ্গে ওই কালো জাদুর ব্যাপারটা মিলিয়ে দিয়েছে। একবার তো জিঞ্জিরা প্রাসাদে একটা বাচ্চা অসুস্থ হয়ে মারা যাবার পর বড় আম্মাই তাকে কালো জাদু করেছিল ভেবে লোকজন বড় আম্মাকে আর একটু হলেই পাথর ছুঁড়ে মেরে ফেলছিল। কোনো রকমে তাকে বাঁচিয়ে তারপর মগবাজারের হাবেলীতে নিয়ে আসা হয়।’

    নছিব আলি আমাকে ভেঙে না বললেও ফারুকের কথা শুনে বড় আম্মাকে এ পাড়ে আনার আসল কারণটা এবার শুনতে পেলাম আমি ।

    বিরিয়ানির দোকানে খাওয়া সেরে যখন আমরা আবার রাস্তায় নামলাম, তখন দুপুর গড়িয়ে বিকাল হতে চলেছে। ফারুকের সঙ্গে বাসে চেপে এরপর আবার আমি রওনা হলাম বুড়িগঙ্গার দিকে লালবাগ কেল্লাতে। সেখানে যখন পৌঁছলাম তখন বিকাল হয়ে গেছে। লালবাগ কেল্লা খুব বড় কেল্লা নয়। কারণ যারা ‘এ কেল্লা নির্মাণ করেছিলেন তাঁরা কেউ এই কেল্লা নির্মাণ সমাপ্ত করতে পারেননি। ফারুক বলল, ‘এ কেল্লাকে অনেকে অপয়া কেল্লা বলে ডাকে। মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবের পুত্র আজম শাহ ঢাকার সুবেদার নিযুক্ত হয়ে এখানে পনেরো মাস ছিলেন। তিনি এই কেল্লা নির্মাণের কাজ শুরু করেন। কিন্তু কাজ শুরু হওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই সম্রাট আওরঙ্গজেব তাঁকে দিল্লি ডেকে পাঠান মারাঠা বিদ্রোহ দমন করার জন্য। একটা মসজিদ আর দরবার হল নির্মাণ করেই দিল্লি ফিরে যান তিনি। এর কিছুদিনের মধ্যেই বাংলার সুবেদার হয়ে ঢাকা আসেন সুবেদার শায়েস্তা খাঁ। তিনি আবার কেল্লা নির্মাণের কাজ শুরু করেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যের ব্যাপার কয়েক বছরের মধ্যে এখানেই শায়েস্তা খাঁ’র কন্যা পরী বিবির মৃত্যু হয়। সঙ্গে সঙ্গে শায়েস্তা খাঁ এ জায়গা অপয়া বলে মনে করে দুর্গ তৈরীর কাজ বন্ধ করে দেন এবং ঢাকা থেকে বাংলার রাজধানী স্থানান্তরিত করেন মুর্শিদাবাদে ৷

    এ কথা শুনিয়ে ফারুক বলল, ‘কেউ কেউ বলে যে আসলে নাকি এখানে একজন কালান্দর ফকির ঝুপড়ি বানিয়ে বসবাস করতেন। ঝুপড়ি ভেঙে ফকিরকে উচ্ছেদ করে নাকি দুর্গ নির্মাণের কাজ শুরু করা হয়েছিল। তাই তাঁর কালো জাদুর কারণে এই দুর্গ. প্রাসাদ নির্মাণ করা সম্ভব হয়নি।

    আমি হেসে বললাম, ‘তোমাদের এখানে দেখছি কালো জাদু নিয়ে অনেক কাহিনিই প্রচলিত আছে।’ কেল্লার যতটুকু অংশ নির্মিত হয়েছিল এবং তার মধ্যে যতটুকু এখন দাঁড়িয়েছিল তা ঘুরে ঘুরে দেখলাম আমরা। দেখলাম শায়েস্তা খাঁ কন্যা পরী বিবির সমাধি। কেল্লা দেখা যখন শেষ হল তখন বেলা পাঁচটা বাজে।

    ফারুক আমাকে বলল, ‘এখানে বুড়ি গঙ্গার পাড়ে আর একটা দেখার জায়গা আছে, তার নাম আহেসান মঞ্জিল। ওই আহেসান মঞ্জিল দেখলেই মোটামুটি ঢাকার দর্শনীয় স্থানগুলো আপনার দেখা শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু আমাকে এখন মগবাজার ফিরতে হবে। কাল আমি অবশ্যই আপনাকে আহেসান মঞ্জিলে নিয়ে যাব।’

    সকাল থেকে একটানা ঘোরাঘুরির ফলে তখন আমারও বেশ ক্লান্ত লাগছিল। তাই তার প্রস্তাব শুনে আমি বললাম, ‘সেই ভালো। কাল আবার আমরা আসবো বুড়ি গঙ্গার পাড়ে ।

    ফারুক বলল, ‘হ্যাঁ তবে দিনে নয়, রাতে। কাল তো পূর্ণিমা। চাঁদের আলোতে বুড়ি গঙ্গার ধারে আহেসান মঞ্জিল দেখতে অসম্ভব সুন্দর লাগে।’

    আমি তাকে বললাম, ‘আমার তাতে কোন আপত্তি নেই। তুমি যেমন বলবে তেমনই হবে । পরশু আমি ইন্ডিয়া ফেরার জন্য রওনা হব। তার আগে ওই আহেসান মঞ্জিল দেখে যাব।’

    লালবাগ কেল্লা দেখে এরপর যখন আমরা মগবাজার ফিরে গেলাম তখন সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে গেছে।

    আমাকে বাড়ির কাছে ছেড়ে দিয়ে ফারুক অন্যদিকে নিজের কাজে চলে গেল। আমি বাড়ি ফিরে এলাম।

    সারাদিন অনেক ঘুরেছি। পা-টাও ব্যথা করছিল। তাই সেদিন আর বাইরে বেরিয়ে রাতের খাবার কেনার ইচ্ছে হলো না। দু’টো বিস্কুট খেয়ে আমি শুয়ে পড়লাম। তখন মাঝ রাত। হঠাৎই আমার ঘুম ভেঙে গেল। বড় আম্মার গলার শব্দ শোনা যাচ্ছে। তিনি যেন কারো উদ্দেশ্যে বলছেন, ‘আয়, আয়, এদিকে আয়–।’

    বেশ কয়েকবার তার কণ্ঠস্বর শোনার পর আমার একটু কৌতূহল হল, তিনি কাকে ডাকছেন সে ব্যাপারে। বিছানা ছেড়ে উঠে আমি আগের দিনের মতোই সন্তর্পণে দরজা খুলে বাইরে উকি‌ দিলাম। বড় আম্মার ঘরের জানলার পাল্লা খোলা। তার ডান হাতটা গরাদ আঁকড়ে আছে। আর চাঁদের আলোতে ঝলমল করছে তাঁর আঙ্গুলের আংটিটা। কিন্তু লম্বা বারান্দার দু’পাশে তাকিয়েও কোথাও কাউকে দেখতে পেলাম না আমি। এরপর আমি যখন আবার দরজা বন্ধ করতে যাচ্ছি তখন বড় আম্মা বলে উঠলেন, ‘আমি তোকেই ডাকছি। দরজা বন্ধ করার আগে একবার শুনে যা আমার কাছে।’

    তিনি আমাকেই এতক্ষণ ধরে ডাকছেন। ব্যাপারটা জেনে অবাক লাগল আমার। যদিও তাঁর মাথার ঠিক নেই। তবুও একটু ইতস্তত করে আমি বারান্দায় বেরিয়ে গিয়ে দাঁড়ালাম তাঁর জানলার সামনে। গরাদ ধরে দাঁড়িয়ে বড় আম্মা। চাঁদের আলো এসে পড়েছে তার মুখে। আগেরবার দিনের আলোতে দেখে তার চোখ দু’টো কেমন ঘোলাটে মনে হয়েছিল, কিন্তু চাঁদের আলোতে তাঁর সেই চোখ দু’টো কেমন অদ্ভুত রকমের জ্বলজ্বলে মনে হল আমার। সেই চোখ দু’টো দিয়ে আমার দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থাকার পর তিনি আমাকে বললেন, ‘কাল যেখানে যাবার কথা সেখানে যাস না তুই। গেলে বিপদ হবে। তোকে সাবধান করে দিলাম।’—এ কথা বলার পর জানলা বন্ধ করে দিলেন তিনি।’

    পরদিন আমি কোথায় যাব, না যাব তা ওঁর জানার কথা নয়। বড় আম্মার কথাতে তাই আমি তাঁর মস্তিষ্কবিকৃতি প্রসূত বক্তব্য বলেই মনে করলাম। আমি ঘরে ফিরে শুয়ে পড়লাম।

    || ৬ ||

    আমার শহর দেখা মোটামুটি শেষ হয়ে গেছিল। তাই পরদিন দুপুরবেলা সামনের হোটেলে গিয়ে খেয়ে আসার সময়টুকু ছাড়া আমি ঘরের মধ্যে বসে বসেই কাটালাম। বাইরে যাওয়া-আসার পথে আমি বড় আম্মার জানলা বন্ধই দেখলাম। দুপুরে লম্বা ঘুম দিয়ে সন্ধ্যা নাগাদ উঠে জামাকাপড় গুছিয়ে ফেললাম আমি। কারণ, তার পরদিন সকালেই ঢাকা ছেড়ে দেশে ফেরার জন্য রওনা হব। তারপর আমি ফারুকের জন্য প্রতীক্ষা করতে লাগলাম ।

    ফারুক আমাকে ডাকতে এল সন্ধ্যা সাতটা নাগাদ। আমি ফারুকের সঙ্গে বাইরে বেরিয়ে পড়লাম। আজকের ঢাকা শহর শুনেছি মস্ত বড় আলো ঝলমলে শহর। কিন্তু আজ থেকে তিরিশচল্লিশ বছর আগে ব্যাপারটা তেমন ছিল না বিশেষত পুরানো ঢাকা অঞ্চলে। রাত নামলেই পথে ঘাটে লোকজন কমে আসত। ল্যাম্পপোস্ট গুলোতে জ্বলত হলদেটে বাতি। প্রথমে একটা রিক্সা নিয়ে তারপর পায়ে হেঁটে আমরা পৌঁছে গেলাম আহেসান মঞ্জিলের সামনে। বিশাল প্রাসাদ । চওড়া সিঁড়ি উঠে গেছে প্রাসাদের সদর দরজার দিকে। চাঁদের আলোতে জেগে আছে প্রাসাদের মাথার গম্বুজটা। ফারুক জানালো বহু ঐতিহাসিক ব্যক্তি নাকি পদার্পণ করেছিলেন এই প্রাসাদে। বহু ঐতিহাসিক সভা সমিতিও নাকি হয়েছে এই প্রাসাদের অভ্যন্তরে। ফারুক মিথ্যা বলেনি। চাঁদের আলোতে আশ্চর্য সুন্দর দেখতে লাগছিল ঢাকা শহরের সবচেয়ে সুন্দর স্থাপত্য। বেশ কিছুক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে থাকার পর ফারুক আমাকে বলল, ‘আমার একটু দরকার আছে জিঞ্জিরাতে। চলো সে জায়গা থেকে ঘুরে আসি। রাতে বুড়ি গঙ্গাতে নৌকা ভ্রমণও হয়ে যাবে তোমার।’

    আমি বললাম, ‘আমার তো ঘরে ফিরে কোন কাজ নেই। যাওয়া যেতে পারে।’

    আহেসান মঞ্জিল থেকে বুড়ি গঙ্গার ধারে এসে আমরা উপস্থিত হলাম। তখন আর সেখানে তেমন লোকসমাগম নেই। নৌকাগুলোও পাড়ের এক জায়গাতে এসে জমা হয়েছে। তাদের কারো কারো খোলে টিমটিমে বাতি জ্বলছে। তবে পূর্ণিমার চাঁদের আলোতে বেশ লাগছে বুড়ি গঙ্গাকে। ফারুকের সঙ্গে গিয়ে আমি উপস্থিত হলাম সেই জায়গাতে, যেখানে নছিব আলির নৌকা বাঁধা থাকে। নৌকার রসি খুলে নদীতে ভেসে পড়লাম আমরা। কবে আবার নৌকা বাইবার সুযোগ হবে তাই ভেবে আমিই দাঁড় বাইতে শুরু করলাম। বেশ ঠান্ডা বাতাস উঠছে নদীর বুক থেকে। পূর্ণিমার চাঁদের আলোতে ঝিলমিল করছে বুড়ি গঙ্গার জল। নদীর দু’পাশের বাড়ি-ঘরগুলো ইতিমধ্যেই ঘুমিয়ে পড়তে শুরু করেছে। শুধু দুএক জায়গাতে জোনাকির মতো বিন্দু বিন্দু আলো জ্বলছে।

    ধীরে ধীরে দাঁড় বাইতে বাইতে একসময় ওপারে গিয়ে পৌঁছলাম আমরা। নদীর পাড়ের ঘিঞ্জি মহল্লাগুলোতে চিৎকার চেঁচামেচির শব্দ তখন থেমে গেছে, গলিপথগুলোও ফাঁকা হয়ে গেছে। ফারুকের সঙ্গে আমি এগোলাম জিঞ্জিরা প্রাসাদের উদ্দেশ্যে।

    রাতের বেলা একদম নিঝুম হয়ে গেছে জায়গাটা। মাঝে মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা জিঞ্জিরা প্রাসাদের চিহ্ন আর দখলদারদের ঝুপড়ি ঘরগুলোকে অতিক্রম করে আমরা গিয়ে উপস্থিত হলাম নছিব আলি আমাকে যে ঘরে নিয়ে গেছিলেন সে ঘরের সামনে। ফারুক পকেট থেকে চাবি বার করে দরজা খুলে আমাকে নিয়ে ভিতরে প্রবেশ করল। ঘরে ঢুকে অন্ধকার হাতে একটা মোমবাতি নিয়ে সেটা জ্বালালো সে। একটা চেয়ারে আমাকে বসিয়ে রেখে সেই ঘর সংলগ্ন অন্ধকার ঘরে সে প্রবেশ করল। মিনিট কয়েকের মধ্যেই সে আবার সেই ঘর ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে এল। আমি খেয়াল করলাম ফারুকের হাত-পা ধুলোতে মাখামাখি। আর তার হাতে রয়েছে টিনের একটা ছোট্ট কৌটো। সেটাও ধুলোতে মাখামাখি।

    ফারুক এর পর আমার সামনে দাঁড়িয়ে কৌটোটার ধুলো পরিষ্কার করতে করতে বলল, ‘যে জিনিসটা নিতে এখানে এলাম, সেটা এবার তোমাকে দেখাই।’— এ কথা বলার পর সে কৌটোটা খুলে একটা জিনিস বার করে হাতের পাতায় মেলে ধরল। সঙ্গে সঙ্গে মোমবাতির আলোতে ঝিলিক দিয়ে উঠল সেটা। পাথর বসানো একটা সোনার আংটি! ঠিক যেন বড় আম্মার হাতের আংটিটার মতোন দেখতে ।

    ফারুক আংটিটা দেখিয়ে বলল, ‘খুব পুরানো জিনিস এটা। নবাবী আমলের জিনিস এই আংটি।’

    আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘তাই নাকি? তাহলে তো এই আংটির অনেক দাম হবে!’

    ফারুক বলল, ‘হ্যাঁ, অনেক দামী জিনিস । এই পাথরটা হল হীরা।’

    আমি বললাম, ‘তোমার বড় আম্মার হাতেও তো এমন একটা আংটি দেখেছি। এ আংটি তোমরা পেলে কীভাবে?’

    কারুক বলল, ‘পারিবারিক সূত্রে। বলা ভালো এটা বড় আম্মার জিনিস। এই আংটি তিনি একসময় হাতে পরতেন। তবে এই আংটি পরে নাকি এই জিঞ্জিরার বাইরে যাবার নিয়ম নেই। তাই ঠিক এই আংটির মতো একটা ঝুটা আংটি তিনি বানিয়েছিলেন। যখন তিনি বাইরে যেতেন সেটা পরেই যেতেন। যে আংটি আপনি তার হাতে দেখছেন।’

    আমি ফারুকের হাত থেকে আংটিটা নিয়ে ঘুরিয়েফিরিয়ে দেখলাম। ও জিনিসটাকে আমার বেশ প্রাচীন বলেই মনে হল। আমি তাকে প্রশ্ন করলাম, ‘এত দামী জিনিস এই ভাঙা ঘরের মধ্যে এতদিন ফেলে রেখেছ কেন?’

    ফারুক বলল, ‘ওই প্রথার জন্য। মানে এই আংটিটা জিঞ্জিরার বাইরে নেওয়া যাবে না ওই জন্য ।‌ বংশ পরম্পরায় নিয়মটা চলে আসছিল। তবে আজ আমি আংটিটা ফিরিয়ে নিয়ে যাব। এত দামী জিনিস এখানে ফেলে রেখে তো কোন লাভ নেই। হয়তো কোনদিন কেউ এই আংটি এখানে লোকানো আছে জানতে পেরে চুরি করে নিয়ে গেল। তাই আমি ওটা নিয়ে যাব। আংটিটা বিক্রি করে যা টাকা পাব তাতে একটা ব্যবসা খুলব। বড় আম্মাকে আরও ভালো করে রাখার বন্দোবস্ত করব।’

    ফারুক তাদের পারিবারিক জিনিস নিয়ে কী করবে তা নিয়ে আমার কোন বক্তব্য থাকতে পারে না, আমি শুধু তাকে প্রশ্ন করলাম, ‘এ আংটি জিঞ্জিরার বাইরে নিয়ে যাবার নিয়ম ছিল না কেন?’ ফারুক বলল, ‘তা আমি জানিনা। এ নিয়মই চলে আসছিল।’—এ কথা বলে সে আংটিটা কৌটোতে পুরে আমার হাতে দিয়ে বলল, ‘এটা এখন তুমি তোমার পকেটে রাখো। আমার পাঞ্জাবীর দু’টো পকেটই ফুটো। কৌটোটা পকেট থেকে গলে পড়ে গেলে সর্বনাশ।’

    তার কথা শুনে আমি কৌটোটা আমার প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে নিলাম। ফারুক এরপর আমাকে নিয়ে ঘরের বাইরে বেরিয়ে দরজায় তালা দিয়ে রওনা হল ফেরার জন্য।

    ফেরার পথে ফারুককে যেন আমার বেশ কিছুটা সতর্ক মনে হল। চলতে চলতে মাঝে মাঝেই সে পিছনে বা চারপাশে তাকিয়ে দেখতে লাগল। হয়তো সঙ্গে দামী জিনিস আছে তাই।

    এক সময় আমরা পৌঁছে গেলাম নদীর ঘাটে, যেখানে আমাদের নৌকা বাধা আছে। ঘাটে পৌঁছে ফারুক আমাকে বলল, ‘আপনি যদি একটা কাজ করেন তবে আমার খুব উপকার হয়।’

    আমি বললাম, ‘কী কাজ?’

    ফারুক বলল, ‘আমার এখন হঠাৎই এপারে একটা জরুরী কাজের কথা মনে পড়ল। আপনি যদি একলা ফিরে যান তবে ভালো হয়। কারণ সে কাজ মিটতে আমার ভোর হয়ে যেতে পারে।

    আমি প্রশ্ন করলাম, ‘কোথায় যাবে তুমি?’

    ফারুক বলল, ‘একজন আমার থেকে বেশ কিছু টাকা ধার নিয়েছিল। টাকা ফেরত দেবার ভয়ে দিনের বেলায় সে পালিয়ে বেড়ায়। রাতে বাসায় ফেরে। আমি তার বাসায় যাব টাকা আদায়ের জন্য।’ আমি পরদিন ঢাকা ছেড়ে কলকাতায় ফেরার জন্য রওনা হব। রাতে আমার তাই মগবাজার ফেরা প্রয়োজন। এজন্য আমি ফারুককে বললাম, ‘ঠিক আছে আমি তবে ফিরে যাচ্ছি। আমার কোন অসুবিধা হবে না।’

    এ কথা বলে আমি পকেটে হাত ঢোকালাম আংটির কৌটোটা তাকে ফেরত দেবার জন্য। সঙ্গে সঙ্গে সে বলল, ‘ওটা আপনি আপনার কাছেই রাখুন। ফিরে গিয়ে দাদুকে দিয়ে দেবেন। তাকে বলবেন, ভোরবেলা আমি বাসায় ফিরব।’

    প্রস্তাব শুনে আমি একটু ইতস্তত করে বললাম, ‘এত দামী জিনিস আমার হাতে ছেড়ে দেওয়া কি ঠিক হবে?’

    ফারুক হেসে বলল, ‘কেন? তুমি কি আংটিটা নিয়ে পালিয়ে যেতে পারো নাকি? নিশ্চিন্তে যাও। ভয়ের কোন কারণ নেই। রাত হয়ে গেলেও ওপারে চোর ডাকাতের উপদ্রব নেই।’

    ব্যাপারটাতে আমি খানিকটা অস্বস্তি বোধ করলেও আমি এরপর জিনিসটা নিয়ে নদী পেরিয়ে মগবাজারে ফিরতে রাজি হয়ে গেলাম।

    নৌকায় উঠে বসলাম আমি। ফারুকই নৌকার কাছি খুলে নৌকা টেনে দিল। আমি ভেসে পড়লাম রাতের বুড়ি গঙ্গায়।

    || ৭ ||

    বৈঠা টানতে লাগলাম আমি। আসার পথে নদীর দু’পাশে যে বিন্দু বিন্দু আলোগুলো কোথাও কোথাও জ্বলছিল, একলা ফেরার পথে তখন সেগুলোও নিভে গেছে। তবে পূর্ণিমার চাঁদের আলোতে চারপাশে সব কিছু স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। দেখা যাচ্ছে ওপাড়ের আহেসান মঞ্জিলের মাথার গম্বুজটাও। বৈঠা টানার জন্য জলের বুকে ছলাৎ ছলাৎ শব্দ ছাড়া আর কোন শব্দ নেই ।

    বৈঠা টানতে টানতে আমি তখন ঠিক মাঝ নদীতে চলে এসেছি, ঠিক তখনই হঠাৎ মনে হল আমার নৌকা যেন মৃদু একটা ঝাঁকুনি খেল। আর তারপরই আমার মনে হতে লাগল আমার নৌকা যেন যে পাশে আমি বৈঠা ফেলছি তার বিপরীত দিকে কাত হতে শুরু করেছে।

    এমনতো হবার কথা নয়। আমার নৌকা কি তবে জলে বিছিয়ে রাখা কোন জালে আটকে গেল! আমি বেশ কয়েকবার জোরে জোরে বৈঠা দিয়ে ঘা দিলাম, কিন্তু জলের ভিতর জাল বা ও ধরনের কোন জিনিসের অস্তিত্ব পেলাম না। কিন্তু নৌকোটা ক্রমশই যেন এক পাশে কাত হতে শুরু করেছে, নৌকার গতিও কমে আসছে। যেদিকে নৌকাটা কাত হচ্ছে সেদিকে ভালো করে তাকালাম আমি। আর তারপরেই আমার চোখে ধরা পড়ল একটা অদ্ভুত জিনিস!’— এ কথা বলে থেমে গেলেন জাদুকর সত্যচরণ।

    চন্দন ডুবেছিল সত্যচরণের কাহিনির মধ্যে সঙ্গে সঙ্গে চন্দন প্রশ্ন করল, ‘কি জিনিস দেখলেন?’ চন্দন যে মনোযোগ দিয়ে এতক্ষণ ধরে তার কথা শুনছে তা দেখে সত্যচরণের গোঁফের নীচে প্রথমে মৃদু হাসি ফুটে উঠল। তারপর আবার তিনি গম্ভীর হয়ে বলতে শুরু করলেন, ‘আমি যা দেখলাম তা দেখে আমি চমকে উঠলাম। চাঁদের আলোতে আমি স্পষ্ট দেখতে পেলাম, জলের ভিতর থেকে একটা হাত উঠে এসে চেপে ধরেছে আমার নৌকার কিনারা! ধবধবে সাদা মেয়েদের একটা হাত। সে হাতে চাঁদের আলোতে ঝিলিক দিচ্ছে সাদা পাথর বসানো সোনার একটা আংটি। ঠিক তেমনই একটা আংটি যেমন আংটি রয়েছে আমার পকেটে! জলের ভিতর থেকে শুধু বাহুটাই জেগে আছে, অন্য কিছু‍ই আর দেখা যাচ্ছে না।

    জলের নীচে যে আছে আমি তার উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করলাম, ‘তুমি কে? নৌকায় উঠতে চাও নাকি?’ কিন্তু এ প্রশ্নের কোন জবাব পেলাম না। আমি এরপর জোরে জোরে বৈঠা টানতে লাগলাম সেই হাত থেকে নৌকাটাকে মুক্ত করার জন্য। কিন্তু নৌকা এগোচ্ছে না। আর ধীরে ধীরে সে কাত হয়ে যাচ্ছে। ঐ আংটি বসানো সাদা হাত যেন প্রবল শক্তিতে টান দিয়ে নৌকাটাকে জলের মধ্যে ডুবিয়ে দিতে চাচ্ছে। আমি তখন স্পষ্ট বুঝতে পারলাম ওই হাত সাধারণ কোন মানুষের হাত নয়। হিমেল রক্তস্রোত প্রবাহিত হতে শুরু করল আমার শরীর বেয়ে। আমি আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগলাম নৌকাটাকে ঠিক রাখার। কিন্তু সে আরো হেলে যেতে লাগল। ঠিক সেই মুহূর্তে আমার মনে পড়ল আমার গুরুদেব হংসরাজের কথা। তিনি আমাকে বলেছিলেন, আমি যদি কোনদিন কোন বিপদে পড়ি তখন যেন তাকে স্মরণ করি। হংসরাজ তো শুধু একজন বাজিকরই ছিলেন না, আরও বেশ কিছু অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন তিনি। এর আগেও আমি বেশ কয়েকবার তাকে স্মরণ করে বেশ কিছু বিপদ থেকে রক্ষা পেয়েছি। আমি মনে মনে হংসরাজকে স্মরণ করে বলতে লাগলাম, ‘আপনি আমাকে রক্ষা করুন, রক্ষা করুন।’

    আর তাতেই অদ্ভুত একটা কাজ হলো । নৌকাটা আবার ধীরে ধীরে সোজা হতে লাগল। ওই শুভ্র আংটি পরা হাতটা যে শক্তিতে নৌকাটাকে জলের মধ্যে টানছিল সেই টান যেন ক্রমশ কমে আসতে লাগল। তারপর একসময় হাতটা নৌকাটাকে ছেড়ে দিয়ে ভুস করে ডুবে গেল জলের মধ্যে। মুক্ত হয়ে গেল আমার নৌকা। আমি জলে বৈঠা ফেলতেই নৌকা আবার এগোতে শুরু করল। কিন্তু এরপরই আমার মন হঠাৎ বলল, যা ঘটল তা ঘটেছে আমার পকেটে থাকা ওই আংটিটার জন্যই। যে হাত নৌকাটাকে ডুবাতে চাচ্ছিল সে চায় না যে জিঞ্জিরা প্রাসাদ থেকে জিনিসটা আমি অন্য কোথাও নিয়ে যাই। জিনিসটাকে তার নিজের স্থানে রাখাই ভালো। গুরুদেবের নাম নিয়ে আমি ওই হাতের বাধা অতিক্রম করতে পারতাম ঠিকই, কিন্তু আমি সিদ্ধান্ত নিলাম আমি জিঞ্জিরার দিকেই ফিরব। নৌকার মুখ এরপর আমি ঘুরিয়ে নিলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই পাড়ে এসে পৌঁছলাম আমি। নৌকা থেকে নামতেই আমি দেখলাম ফারুক কোথাও যায়নি। সে সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে। আমি অনুমান করলাম সে আমাকে মিথ্যা বলেছিল, আমি তার কাছে কোন কথা না ভেঙে শুধু বললাম, ‘আমার মনে হয় এই আংটিটা যেখানে ছিল সেখানে রেখে আসাই ভালো। আর যদি আংটিটা ওপারে নিয়ে যেতে হয় তবে তুমিই সঙ্গে নিয়ে যেও।’—এই বলে তার হাতে আমি কৌটোটা তুলে দিলাম। কোন একটা ঘটনা যে ঘটেছে আমার কথা শুনে ফারুক তা অনুমান করল। একটু হতাশ ভাবে সে বলল, ‘চল তবে জিঞ্জিরাতে যাই।’

    এরপর আবার আমরা ফিরে গেলাম জিঞ্জিরার সেই ঘরে। ফারুক কৌটোটা নিয়ে রেখে এল তার আগের জায়গাতে। সে রাতে আমরা কেউই আর নদী পেরিয়ে ফেরাটা সমীচীন মনে করলাম না। তবে আমিও যা ঘটেছে তা নিয়ে ফারুককে কিছু বলা সমীচীন মনে করলাম না। আমার মনের ভিতর তখন ফারুকের প্রতি একটা অসন্তোষ জন্ম নিয়েছে। কারণ আমি তখন বুঝতে পেরে গেছি যে এমন কোন বিপদ আসতে পারে ব্যাপারটা সে অনুমান করে নিজে নিরাপদ থাকার জন্য আমাকে দিয়েই আংটিটা পাঠাবার চেষ্টা করছিল। সারারাত আমরা নিশ্চুপ ভাবেই বসে কাটালাম। তারপর সূর্য ওঠার সময় হতে আমরা জিঞ্জিরা ছেড়ে রওনা হলাম ঘাটের দিকে। আমরা যখন বুড়িগঙ্গার ঘাটে পৌঁছলাম তখন ভোরের প্রথম আলো নদীর বুকে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে। নৌকা নিয়ে আমরা রওনা হলাম এপারে ফেরার জন্য।

    আমরা মগবাজারের বাড়িতে ফিরতেই দেখলাম একতলার বারান্দাতে সেই কাকভোরেই দাঁড়িয়ে আছেন বৃদ্ধ নছিব আলি। চোখেমুখে তার প্রবল উৎকণ্ঠার ছাপ। আমরা তাঁর সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই তিনি ফারুককে প্রশ্ন করলেন, ‘তুমি জিঞ্জিরার ঘরের চাবি নিয়ে গেছিলে?’

    ফারুক মাথা নীচু করে কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থাকার পর চাবিটা বৃদ্ধর হাতে তুলে দিয়ে বারান্দার একটা ঘরে ঢুকে গেল।

    নছিব আলি এরপর আমাকে প্রশ্ন করলেন, ‘আপনারা সারারাত কোথায় ছিলেন? কী করছিলেন?’ প্রশ্ন শুনে আমি আর গত রাতের ঘটনাটার কথা গোপন করা সমীচীন মনে করলাম না। ব্যাপারটা খুলে বললাম তাঁকে। বললাম বুড়ি গঙ্গার জল থেকে উঠে আসা সেই হাতের কথা।’ বৃদ্ধ কিন্তু আমার কথা অবিশ্বাস করলেন না। তিনি বললেন, ‘আমি জানতাম না যে আপনারা জিঞ্জিরা যাচ্ছেন। শুনলে বাধা দিতাম। আংটিটা আনার পথে আমার ওপর প্রাচীর ভেঙে পড়েছিল, আপনার জন্য আমার প্রাণ বেঁচেছে। এ কথা ফারুককে বলার পরও যে ও আংটিটা আনতে যাবে, এবং আপনাকে বিপদের মধ্যে ঠেলে দেবে তা আমি ভাবিনি। অন্যায় করেছে ও। আপনি ওকে ক্ষমা করবেন।

    আমি বৃদ্ধকে বললাম, পুরো ব্যাপারটা আসলে কী সেটা আমাকে খুলে বলুন তো? এ বাড়ি ছেড়ে রওনা হবার আগে আমি ঘটনাটা জেনে যেতে চাই । যে হাত নৌকা টেনে জলে ডুবাতে চাচ্ছিল সে হাত কার ছিল?’

    বৃদ্ধ নছিব আলি একটু চুপ করে থাকার পর বললেন, ‘সে এক পুরনো কাহিনি। শুনুন তাহলে — ‘মিরনের নির্দেশমতো জিঞ্জিরার প্রাসাদের তৎকালীন প্রধান তো তার এক নৌকাতে তুলে দিলেন আমিনা বেগম ও ঘসেটি বেগমকে বকর খাঁ-এর নৌকা গুলোর সঙ্গে সেই নৌকা রাতের অন্ধকারে বুড়ি গঙ্গা বেয়ে এগিয়ে চলছিল। ধলেশ্বরীর কাছাকাছি পৌঁছবার পর হঠাৎই বকর খাঁ’র একদল লোক নিজেদের নৌকা ছেড়ে উঠে এল সেই দুই নারীর নৌকায়। আমিনা বেগম আর ঘসেটি বেগমকে মেরে ফেলল তারা। জশরত খাঁর মাঝিদের ক্ষমতা বা সাহস ছিল না বকর খাঁ’র লোকদের বাধা দেবার। এরপর বকর খাঁর লোকেরা তাদের দু’জনকে পানিতে ছুড়ে দিল। আমিনা বেগম পানিতে ডুবে গেলেও নাকি ঘসেটি বেগম কি কীভাবে নিজেকে মুক্ত করে ফেলেছিলেন দড়ির বাঁধন থেকে। তবে তিনি সাঁতার জানতেন না। প্রাণ বাঁচানোর জন্য তিনি নাকি পানি থেকে হাত বার করে আঁকড়ে ধরেছিলেন নৌকার কিনারা। আর ব্যাপারটা চোখে পড়তেই এক হত্যাকারী তলোয়ারের এক কোপেই ঘসেটির হাত বাহু থেকে ছিন্ন করে দিয়েছিলেন। তারপর ঘসেটিও তলিয়ে গেছিলেন বুড়ি গঙ্গার পানিতে। পরদিন মাঝিরা ফিরে এসে জশরত খাঁ-কে জানিয়েছিল ঘটনাটা।’

    এ কথা বলার পর বৃদ্ধ নছির আলি একটু থেমে বললেন, ‘ওই নৌকার মাঝিদের সর্দার ছিলেন আমাদের এক পূর্বপুরুষ। জশরত খাঁ-কে তিনি দুই বেগমের হত্যার ঘটনার কথা জানালেও একটা ব্যাপার কিন্তু চেপে গেছিলেন। তা হল, নৌকা নিয়ে ঢাকা ফেরার পথে ভোরের আলো যখন ফুটল তখন আমার পূর্বপুরুষ সেই মাঝি খেয়াল করেন যে, ঘসেটির ছিন্ন হাতটা তখনও নৌকার কিনারা আঁকড়ে আছে। আর সে হাতের আঙুলে পরা আছে পাথর বসানো একটা সোনার আংটি। তিনি এরপর সেই আংটিটা খুলে নিয়ে হাতটাকে পানিতে ফেলে দেন। আমার পূর্বপুরুষ আংটিটার লোভে পড়ে গেছিলেন সম্ভবত। তাই তিনি ব্যাপারটা চেপে গেছিলেন জশরত খাঁ’র কাছে। জিঞ্জিরা প্রাসাদেই মাঝির থাকার ঘরে নিজের কাছে তিনি আংটিটা লুকিয়ে রাখেন। সেই ঘর, যে ঘরে আপনি গেছিলেন। কিন্তু আজ পর্যন্ত কেউ ওই আংটি জিঞ্জিরার বাইরে নিয়ে যেতে পারেনি। সে চেষ্টা করলেই কোন না কোন দুর্ঘটনায় তাদের মৃত্যু হয়েছে। আপনাকে নিয়ে যেদিন আমি জিঞ্জিরা গেছিলাম সেদিনও আমি শেষ একবার সাহসে ভর করে চেষ্টা করেছিলাম আংটিটা নিয়ে আসার। কিন্তু প্রাচীরটা ভেঙে পড়ার পর আমি আবার আংটিটা ফেরত রেখে আসি। আমাদের পূর্বপুরুষদের অনেকেরই মৃত্যু হয়েছে জিঞ্জিরা প্রাসাদ থেকে ওই আংটিটা সরাতে গিয়ে। ফারুকের বাবাও ওই একই কাজ করতে গিয়ে মারা গেছিলেন। একটা কথা প্রচলিত আছে। ঘসেটি বেগম নাকি কালো জাদু জানতেন। হয়তো তাঁর মৃত্যুর এত বছর পরেও তাঁর সেই কালো জাদুর প্রভাব রয়ে গেছে। তিনি চান না ওই আংটি জিঞ্জিরার বাইরে অন্য কারোর হাতে যাক। তিনি তো জীবনের শেষ ক’টা দিন ওই জিঞ্জিরা প্রাসাদেই কাটিয়েছিলেন। আর একটা কথা। ওই আংটি আঙুলে দেবার পর থেকেই বড় আম্মার মাথাটা খারাপ হয়ে যায়। নিজেকে ঘসেটি বেগম ভাবতে শুরু করেন তিনি।’

    — একটানা কথাগুলো বলে থামলেন বৃদ্ধ। তার কথা শুনে আমার আর বুঝতে অসুবিধা হল না জলের ভিতর থেকে কার হাত উঠে এসে নৌকা ডুবিয়ে দেবার চেষ্টা করছিল।

    আমাকে সে বাড়ি ছেড়ে রওনা হতে হবে। তাই নছিব আলির কথা শোনা শেষ হলে দোতলায় উঠে এলাম আমি। নিজের ঘরে ঢোকার সময় আমি খেয়াল করলাম বড় আম্মার ঘরের জানলাটা বন্ধ । জিনিসপত্র আমি গুছিয়েই রেখেছিলাম। ঘরে ঢুকে একটু জিরিয়ে নিয়ে আমার জিনিসপত্র সঙ্গে নিয়ে ফেরার জন্য ঘর থেকে বেরোলাম আমি। বারান্দা দিয়ে সিঁড়ির দিকে এগোচ্ছি, ঠিক সেই সময় বড় আম্মার ঘরের জানলাটা খুলে গেল। প্রথমে গরাদ আঁকড়ে ধরল তার সাদা ধবধবে হাতটা। তাতে পরা আছে সেই পাথর বসানো আংটিটা। ঠিক যে রকম হাত আমি গত রাতে দেখেছিলাম বুড়ি গঙ্গার জল থেকে উঠে এসে নৌকা আঁকড়ে ধরতে।

    এরপর জানলার গরাদের পিছনে আবির্ভূত হলেন বড় আম্মা। আমি শেষবারের মতো থমকে দাঁড়ালাম তাঁকে দেখে। আমার দিকে তাকিয়ে কেমন যেন অদ্ভুত হাসি ফুটে উঠল তাঁর মুখে। তিনি আমাকে প্রশ্ন করলেন, ‘চলে যাচ্ছিস?’

    আমি জবাব দিলাম, ‘হ্যাঁ যাচ্ছি।’

    বড় আম্মা বললেন, ‘এবার বুঝতে পারলি তো আমি আসলে কে?

    এ প্রশ্নর উত্তর কী দেব তা বুঝতে না পেরে আমি আবার পা বাড়াতে যাচ্ছিলাম। ঠিক সেই সময় আমি একটা অদ্ভুত ব্যাপার খেয়াল করলাম। বড় আম্মার পোশাকটা ভিজে লেপ্টে আছে তার শরীরে! আর এরপরই তিনি জানলাটা বন্ধ করে দিলেন।

    মুহূর্তর মধ্যে আমার একটা কথা মনে হলো। বড় আম্মা কোন ভাবে গত রাতে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে বুড়ি গঙ্গায় নামেনি তো? যে হাতটা আমার নৌকা টেনে ধরেছিল সেটা বড় আম্মার হাত নয় তো?’

    নীচে নেমে এলাম আমি। বৃদ্ধ নছিব আলি আমাকে বিদায় দেবার জন্য বারান্দায় দাঁড়িয়েছিলেন। বিদায়বেলায় আমি তাকে প্রশ্ন করলাম, ‘বড় আম্মাও কি কাল রাতের বেলা এ বাড়ি ছেড়ে বাইরে বেরিয়েছিলেন?’ নছিব আলি জবাব দিলেন, ‘না বড় আম্মা ঘরের বাইরে বেরোননি। রাতে তাকে খাবার দিয়ে আসার পর প্রতিদিনের মতো গত রাতেও আমি বাইরে থেকে শিকল তুলে দিয়েছিলাম। তার পক্ষে বাইরে বেরোনো সম্ভব নয়।

    বৃদ্ধর এ কথা শোনার পর আমি তার থেকে বিদায় নিয়ে তার হাভেলী আর মগবাজার ছেড়ে রওনা হলাম। বাসে করে গোয়ালন্দ ঘাটে পৌঁছতে আমার অনেকটা সময় লাগল। সেখানে পৌঁছতে আমার সন্ধ্যা হয়ে গেল। নদী পার হবার জন্য রাতে একটা লঞ্চ ধরলাম আমি। পদ্মার বুকে জল কেটে এগোতে থাকল লঞ্চ। চন্দ্রালোকে আলোকিত পদ্মা। দেশটা ছেড়ে যাচ্ছি। আর কোনদিন পদ্মার বুকে ভাসা হবে কিনা জানি না। লঞ্চের এক কোণে রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে একটু বিষণ্ণ ভাবেই আমি চেয়ে ছিলাম নদীর দিকে। প্রথমটা আমার মনের ভুল কিনা জানি না, হঠাৎই আমি দেখলাম আমার সামনে নদীর জল থেকে একটা সাদা হাত যেন ভেসে উঠল! হাতটা যেন বিদায় জানাবার ভঙ্গীতে কয়েকবার আন্দোলিত হল আমার উদ্দেশ্যে। কিন্তু আমি চোখ কচলে ভালো করে সেদিকে তাকাতেই অদৃশ্য হয়ে গেল সেই হাত। আর এরপর যে দ্বিতীয় ব্যাপারটা ঘটল সেটা অবশ্য সত্যি। আমি বিড়ি ধরাবার জন্য পকেটে হাত দিতেই একটা ছোট জিনিস আমার হাতে উঠে এল। জিনিসটা পকেট থেকে বার করতেই আমি অবাক হয়ে গেলাম। চাঁদের আলোতে ঝলমল করে উঠল একটা আংটি। কলকাতায় ফিরেই আংটি আমি নিয়ে গেলাম স্যাকরার কাছে দেখাতে। সে আমাকে এটা একটা ঝুটো পাথরের আংটি আর ধাতুটাও সোনার নয়। অর্থাৎ বড় আম্মার আঙুলে যে আংটি পরা থাকত সেটাই ওই আংটি! এই সেই আংটি।’— একথা বলে তিনি তার অদ্ভুত কাহিনি শেষ করে আংটিটা তুলে ধরলেন।

    চন্দন তাকে প্রশ্ন করল, ‘কিন্তু এ আংটি আপনার পকেটে কেন এল? আর কী ভাবেই-বা এলো?’

    সত্যচরণ জবাব দিলেন, ‘আমার গুরুদেব নাম নেবার প্রভাবে ওই কাটা হাতের শক্তি পরাস্ত হয়েছিল। আমি ইচ্ছা করলেই ওই নিয়ে নদী পেরিয়ে মগবাজার ফিরতে পারতাম। কিন্তু আমি তা না করে আংটিটাকে যথাস্থানে ফেরাবার ব্যবস্থা করেছিলাম। হয়তো সে জন্যই আংটিটা আমি উপহার পাই। যে অলৌকিক উপায়ে বদ্ধ দরজা অতিক্রম করে বড় আম্মা বুড়ি গঙ্গায় নেমেছিলেন, সেই অলৌকিক উপায়েই হয়তো তিনি আংটিটা আমার কাছে পৌঁছে দেন। হয়তো সত্যিই তিনি… ।

    না। জাদুকর সত্যচরণ বাক্যটা আর শেষ করলেন

    চন্দন তার অসম্পূর্ণ বাক্য সম্পূর্ণ করার জন্য বলে উঠল— ‘ঘসেটি বেগম?’

    সত্যচরণ হেসে বলল, ‘হয়তো তাই।’

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleআঁধার রাতের বন্ধু – হিমাদ্রিকিশোর দাশগুপ্ত
    Next Article অ্যাডভেঞ্চার সমগ্র ২ – হিমাদ্রিকিশোর দাশগুপ্ত

    Related Articles

    হিমাদ্রিকিশোর দাশগুপ্ত

    নেকড়ে খামার – হিমাদ্রিকিশোর দাশগুপ্ত

    December 10, 2025
    হিমাদ্রিকিশোর দাশগুপ্ত

    অ্যাডভেঞ্চার সমগ্র ১ – হিমাদ্রিকিশোর দাশগুপ্ত

    December 10, 2025
    হিমাদ্রিকিশোর দাশগুপ্ত

    অ্যাডভেঞ্চার সমগ্র ২ – হিমাদ্রিকিশোর দাশগুপ্ত

    December 9, 2025
    হিমাদ্রিকিশোর দাশগুপ্ত

    আঁধার রাতের বন্ধু – হিমাদ্রিকিশোর দাশগুপ্ত

    December 9, 2025
    হিমাদ্রিকিশোর দাশগুপ্ত

    সূর্যমন্দিরের শেষ প্রহরী – হিমাদ্রিকিশোর দাশগুপ্ত

    December 9, 2025
    হিমাদ্রিকিশোর দাশগুপ্ত

    অ্যাডভেঞ্চার ভয়ংকর – হিমাদ্রিকিশোর দাসগুপ্ত

    December 9, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }