Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    রাজমালা বা ত্রিপুরার ইতিহাস – শ্রী কৈলাসচন্দ্ৰ সিংহ প্রণীত

    August 20, 2025

    আলো হাতে সেই মেয়েটি – তপন বন্দ্যোপাধ্যায়

    August 20, 2025

    গোয়েন্দা গার্গী সমগ্র – তপন বন্দ্যোপাধ্যায়

    August 20, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    জিম করবেট অমনিবাস (অখণ্ড) – মহাশ্বেতা দেবী সম্পাদিত

    জিম করবেট এক পাতা গল্প1380 Mins Read0

    ১১. চামারি

    ১১. চামারি

    নামটা শুনেই বোঝা যায় যে চামারি ছিল ভারতের ছয় কোটি অস্পৃশ্য মানুষের মধ্যে সবচেয়ে নিচু স্তরের একজন লোক। তার স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে এসে একদিন সে আমার কাছে কাজ চাইল। তার স্ত্রীর শরীরটিতে মাংস ছিল না, তার ছেঁড়া ঘাগরা ধরে দুটি শিশু দাঁড়িয়ে রইল। চামারির দেহটি ছোট এবং জীর্ণ-শীর্ণ, মাল গুদামে কাজ করবার মতো জোর তাতে ছিল না। তাই আমি তাকে আর তার বউকে কয়লা সরাবার কাজে লাগিয়ে দিলুম। পরদিন সকালবেলা তাদের দুজনকে বেষ্কা আর ঝুড়ি দিলুম। তারাও সাহস এবং অধ্যবসায় নিয়ে তাদের সাধ্যাতীত এই কাজে লেগে গেল। সন্ধের দিকে তাদের কাজটা শেষ করে দেবার জন্যে আমার অন্য লোক লাগাতে হল, কেননা পঞ্চাশখানা মালগাড়ির মধ্যে একখানার মাল খালাস করতে দেরি হওয়ার মানে হচ্ছে দুশো জনের কাজ আটকে থাকা।

    দু-দিন ধরে চামারি আর তার বউ বিপুল বিক্রমে কাজ করল বটে, কিন্তু তাতেও কাজ হল না। তৃতীয় দিন সকালবেলা যখন তারা ময়লা ন্যাকড়া দিয়ে তাদের ফোস্কা-পড়া হাত বেঁধে কাজ পাবার জন্যে অপেক্ষা করছিল, তখন আমি চামারিকে জিগ্যেস করলুম যে সে পড়তে লিখতে জানে কি না। সে বললে যে সে সামান্য একটু হিন্দী জানে। আমি তাকে ঝুড়ি আর বেলচা ফেরত দিয়ে হুকুম নেবার জন্যে আমার আপিসে আসতে বললুম।

    কয়েকদিন আগেই আমি মাতলামির জন্যে আমার কয়লা-কুলির দলের সর্দারকে বরখাস্ত করেছিলুম–জীবনে আমি এই একটি লোককেই বরখাস্ত করেছি। এদিকে স্পটে দেখা যাচ্ছিল যে চামারি আর তার বউ কেউই, যে কাজ তারা করছে তা থেকে জীবিকা অর্জন করতে পারবে না। কাজেই আমি চামারিকে সর্দারের পদ দিয়ে পরীক্ষা করব বলে ঠিক করলুম।

    চামারি ভেবেছিল যে তাকে বরখাস্ত করব বলেই আপিসে ডেকে এনেছি। যখন আমি তাকে নতুন একখানা হিসেবের খাতা আর একটি পেনসিল দিয়ে বললুম যে সে যেন বড় লাইনের যে সব ওয়াগনে যে সব মেয়ে-পুরুষ কাজ করছে তাদের সকলের নাম লিখে নিয়ে আসে, তখন সে স্বস্তি পেল এবং গর্ববোধ করতে লাগল।

    আমি যে যে সংবাদ চাইলুম আধঘণ্টা বাদে সে তা নিয়ে ফিরে এল, সব কথা পরিচ্ছন্নভাবে তার খাতায় লেখা রয়েছে। লেখাগুলো নির্ভুল কি না তা যাচাই করে আমি খাতাখানা তাকে ফেরত দিয়ে বললুম যে তাকে কয়লা-কুলিদের সর্দারিতে বহাল করলুম। তার কাজ তাকে বিস্তারিতভাবে বুঝিয়ে দিলুম। তখন কয়লার কাজ করছিল দুশো কুলি। মাত্র একটা ঘণ্টা আগে যে নগণ্য লোকটি তার হীনজন্মের সব অযোগ্যতার বোঝা নিয়ে নিচু হয়ে ছিল সে এখন বগলে একটি খাতা আর কানে একটি পেনসিল গুঁজে জীবনে এই প্রথম তার মাথাটি উঁচু করে আমার আপিস থেকে বাইরে পা বাড়াল।

    জীবনে আমি যত লোককে কাজে লাগিয়েছি তাদের মধ্যে চামারির মত বিবেক-সম্পন্ন এবং পরিশ্রমী তোক খুব কমই দেখেছি। তার অধীন কুলির দলে সব জাতের মেয়ে-পুরুষের মধ্যে ব্রাহ্মণ, ছত্ৰী আর ঠাকুরও ছিল। কিন্তু তাদের যার যা জন্মগত অধিকার তার চাইতে কম মর্যাদা দেখিয়ে সে একবারও এইসব মেয়েদের আর পুরুষদের বিরাগ উৎপাদন করে নি।

    অথচ তার কর্তৃত্বও কেউ কখনও অমান্য করে নি। তার অধীনে যারা কাজ করত তাদের প্রত্যেকের আলাদা হিসেব রাখবার দায়িত্ব তার উপরে ছিল। এবং যে কুড়ি বছর সে আমার কাছে কাজ করেছিল, তার হিসেবের নির্ভুলতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন কোনোদিন ওঠে নি।

    প্রতি রবিবার সন্ধেবেলা চামারি একখানা মাদুরে আর আমি একটি টুলের উপর বসতুম। আমাদের মাঝখানে থাকত তামার পয়সার মস্ত একটি স্তূপ। আর আমাদের ঘিরে থাকত তাদের সপ্তাহের পাওনার জন্যে ব্যগ্রভাবে অপেক্ষমান কয়লার গুঁড়ো মাখা অনেকগুলি স্ত্রীলোক আর পুরুষ।

    আমার চারপাশের এই সরল পরিশ্রমী মানুষগুলোর সঙ্গে আমিও সমানভাবেই এই সন্ধেগুলো উপভোগ করতুম। কেননা, তারা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে যে রোজগার করত তা পেতে যত আনন্দ, তা দিতে আমারও তেমনি আনন্দ হত। সারা সপ্তাহ ধরে তারা আধমাইল লম্বা একটা প্ল্যাটফর্মে কাজ করত, আর তাদের মধ্যে কেউ বা থাকত আমার দেওয়া বাড়িতে, কেউ বা থাকত আশপাশের গ্রামগুলিতে। তাই তাদের মধ্যে মেলামেশার সুযোগ ছিল অতি অল্প।

    রবিবারের সন্ধেগুলিতে তারা সেই সুযোগ পেত, আর পূর্ণভাবে তার সদ্ব্যবহার করত। কঠোর পরিশ্রমী লোকরা সর্বদাই হাসিখুশি হয়। কেননা, কাল্পনিক কষ্ট বানিয়ে নেবার মত সময় তারা পায় না, আর সত্যিকারের দুঃখের চাইতে মনগড়া দুঃখ তো সব সময়েই বেশি কষ্টকর হয়। এ কথা মানতেই হবে যে আমার লোকরা দীন-দরিদ্র, এবং ঝঞ্ঝাট-অশান্তি তাদের যথেষ্টই থাকত। তা সত্ত্বেও তারা বেশ আমুদে ছিল। আমিও তাদের মত ভাল করেই তাদের ভাষা বুঝতে আর বলতে পারতুম বলে তাদের মন-খোলা কথাবার্তায় এবং তাদের সব ঠাট্টা-তামাশায় যোগ দিতে পারতুম।

    রেল-কোম্পানি আমাকে টাকা দিত ওজন-দরে, আর আমি আমার লোকদের দিতুম ওয়াগন হিসেবে–তা সেটা গুদামের কাজেই হক আর কয়লার প্ল্যাটফর্মের কাজেই হক।

    মাল-গুদামের কাজের বাবদ আমি টাকাটা সর্দারদের হাতে দিতুম, তারা যে-যার লোককে তা থেকে তাদের পাওনা বেঁটে দিত। কিন্তু কয়লার মজুর আর মজুরনীদের প্রত্যেককে আমি নিজেই মজুরিটা দিতুম। চামারিকে নোট দিতুম, সে মোকামা বাজারে গিয়ে সেগুলোকে ভাঙিয়ে সব পয়সা করে নিয়ে আসত।

    তারপর রবিবার সন্ধেবেলা আমাদের মাঝখানে সেই পয়সার কাঁড়ি নিয়ে আমরা দু-জনে বসতুম। সাতদিনের মধ্যে যত ওয়াগন খালাস করা হয়েছে তার প্রত্যেকটিতে যে-যে পুরুষ আর মেয়ে কাজ করেছে চামারি তাদের নাম পড়ে যেত, আর আমি তাড়াতাড়ি মনে মনে হিসেব করে নিয়ে প্রত্যেক কর্মীর যার যা পাওনা তা তাকে দিতুম।

    প্রতি ওয়াগন খালাসের জন্যে আমি চল্লিশ পয়সা (দশ আনা) করে দিতুম। কোনো একটি ওয়াগন খালাস করতে যত জন করেছে যদি পাওনাটা তাদের মধ্যে সমানভাবে ভাগ করা না যেত, তাহলে আমি বাড়তি পয়সা তাদের একজনের হাতে দিয়ে দিতুম সে পরে তা দিয়ে নুন কিনে এনে সকলের মধ্যে তা ভাগ করে দিত। টাকা দেবার এই নিয়মটা সকলেরই সন্তোষজনক হত। কাজটা খুব কষ্টকর আর খাটতেও হত অনেকক্ষণ, একথা ঠিক। কিন্তু এতে খেত মজুরির চাইতে তিনগুণ বেশি আয় হত। তা ছাড়া আমার কাজ ছিল স্থায়ী, আর খেত মজুরি ছিল মরশুমী, অস্থায়ী কাজ।

    চামারিকে মাসে পনের টাকা মাইনেতে নিযুক্ত করেছিলুম, তা ক্রমে-ক্রমে বাড়িয়ে চল্লিশ টাকা করা হয়েছিল। রেলের বেশির ভাগ কেরানী যা পেত, এটা তার চাইতে বেশি। এ ছাড়া চামারিকে মাল-গুদামে দশজন লোককে লাগাতেও দিয়েছিলুম। ভারতবর্ষে মানুষের সম্মান অনেকটাই স্থির হয় তার রোজগার আর তার টাকার ব্যবহার দেখে। ভাল মাইনে পাচ্ছিল বলে চামারি সব রকমের লোকের শ্রদ্ধা পাচ্ছিল বটে, কিন্তু সে যে-রকম বিনা আড়ম্বরে টাকাটা খরচ করত, তার জন্যে সে আরও বেশি শ্রদ্ধাভাজন হয়ে উঠেছিল।

    খিদে যে কি, তা সে জেনেছিল। তাই সে এটা তার কর্তব্য বলে গ্রহণ করল যে, সে যেমন কষ্ট পেয়েছে তেমন কষ্ট যাতে আর কেউ না পায় তা সে যথাশক্তি দিয়ে । দেখবে। তার নিজের নিচু জাতের কেউ তার দরজায় এলে সে তার সঙ্গে তার নিজের খাবার সানন্দে ভাগ করে খেত, এবং যে-সব অতিথি জাতের বাধার জন্যে চামারির বউয়ের রান্না খেতে পারত না, তারা নিজেরা রান্না করে নেবার জন্যে সিধে পেত।

    এ-রকম করে সদাব্রত খুলে রাখার জন্যে তার বউয়ের কথায় আমি চামারিকে এ বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলে সে সব সময়েই বলত যে আমি যে-পনের টাকায় তাকে প্রথম কাজে নিযুক্ত করি, সেই টাকাতেই তো তার পরিবারের বেশ কুলিয়ে যাচ্ছিল–এখন তার বউকে তার চাইতে বেশি দিলে তাকে অপব্যয় করতে উৎসাহ দেওয়া হবে।

    আমি জিগ্যেস করলুম যে তার অপব্যয়টা কোন্ দিকে হতে পারে। সে জবাব দিল যে তার বউ তাকে কেবলই জামাকাপড় সম্বন্ধে অনুযোগ করে, আর বলে যে তার অধীনের লোকদের চাইতে পোশাক ভাল হওয়া উচিত। অথচ সে নিজে মনে করে যে পোশাকের টাকাটা দিয়ে গরিবদের খাওয়ানোই অনেক ভালো।

    তারপর তার যুক্তিটাকে একেবারে পাকা করবার জন্যে সে বলল : ‘এই নিজেকেই দেখুন না মহারাজ!’–সে প্রথম দিন আমাকে এই বলেই সম্বোধন করেছিল, তার শেষদিন পর্যন্ত তা-ই বলে এসেছে–আপনি তো কত বছর ধরে এই পোশাকটাই পরছেন। আপনি যা পরেন, আমি তা পারব না কেন? আসলে কিন্তু আমার পোশাক সম্বন্ধে তার একটু ভুল হয়েছিল। একই কাপড়ে তৈরি দু-প্রস্থ সুট ছিল আমার। একটির কয়লার গুঁড়ো যখন সাফ করা হত, তখন অন্যটি ব্যবহৃত হত।

    আমি মোকামা ঘাটে ষোল বছর আছি, এমন সময় কাইজার উইলহেলম তার যুদ্ধটি বাধিয়ে বসলেন। আমার যুদ্ধ যাওয়ার কথায় রেল-কোম্পানি প্রথমে আপত্তি করেছিল, কিন্তু শেষে যখন আমি ঠিকাদারিটা চালিয়ে যাব বললুম, তখন তারা রাজী হল। আমার লোকদের নিয়ে এক আলেচনা-সভা করলুম। এ যুদ্ধের তাৎপর্য যে কি সে-কথা তাদের বোঝানো অসম্ভব হল, কিন্তু আমি না থাকলেও তাদের প্রত্যেকে কাজটা চালিয়ে যেতে ইচ্ছুক আছে দেখা গেল।

    আমি যে ক-বছর ধরে প্রথমে ফ্রান্সে, পরে ওয়াজিরিস্তানে সেনাদলে কাজ করছিলুম, তখন যে মোকামা ঘাট দিয়ে অবাধে এবং একটি গোলমালও না হয়ে মাল-চলাচল হয়েছিল, সেটা সম্পূর্ণই তাদের আনুগত্য এবং অনুরাগের জন্যে সম্ভব হয়েছিল।

    আমার অবর্তমানে রামশরণ ট্র্যানশিপমেন্ট ইন্সপেক্টর হন। চার বছর বাদে যখন ফিরে এলুম, তখন আমার লোকদের সঙ্গে আবার যোগাযোগ হবার সময় এই সুখের অনুভূতিটি হল যে আমি মোটে একটি দিন এখানে ছিলুম না। তারা বলল যে তারা মন্দিরে, মসজিদে আর বাড়ির ঠাকুর-ঘরে প্রার্থনা জানিয়েছিল বলে আমি নিরাপদে ফিরে এসেছি।

    যুদ্ধ থেকে ফিরে আসবার পরের গ্রীষ্মকালে সারা বাংলাদেশ জুড়ে বেজায় কলেরা দেখা দিল। কয়লা কুলিদের মধ্যে দু-জন মেয়ে আর একটি পুরুষ একসঙ্গে এই রোগের খপ্পরে পড়ল। চামারি আর আমি পালা করে তাদের সেবা করতে লাগলুম, তাদের মনে সাহস সঞ্চার করতে লাগলুম। শেষে শুধুমাত্র মনের জোরে তারা রক্ষা পেয়ে গেল।

    এর কিছুদিন বাদে এক রাত্রে আমি শুনতে পেলুম যে বাংলোর বারান্দায় কে যেন ঘোরাফেরা করছে। স্টরারের পদোন্নতি হওয়াতে তিনি চলে গিয়েছিলেন, বাংলোয় আমি একাই ছিলুম। কে, তা জিগ্যেস করায় অন্ধকারের ভিতর থেকে একটা জবাব এল, ‘আমি চামারির বউ। আপনাকে বলতে এসেছি যে তার কলেরা হয়েছে। তাকে দাঁড়াতে বলে আমি তাড়াতাড়ি জামাকাপড় পরে, একটি লণ্ঠন জ্বেলে আর লাঠি নিয়ে তার সঙ্গে রওনা হলুম। মোকামা ঘাটে বড় বিষাক্ত সাপের ভয়।

    সেদিন চামারি সারাদিন কাজ করবার পর বিকেলবেলা আমার সঙ্গে কাছেই একটি গ্রামে গিয়েছিল। পার্বতী বলে তার কয়লা কুলির দলের একটি স্ত্রীলোক সেখানে গুরুতর পীড়িত হয়ে পড়েছে বলে খবর এসেছিল। পার্বতী বিধবা, তার তিনটি সন্তান। মোকামা ঘাটে আসার পর সে-ই প্রথম স্ত্রীলোক যে আমার কাছে কাজ করতে এসেছিল, আর এই কুড়ি বছর ধরে সে অক্লান্তভাবে কাজ করেছিল।

    সব সময়ে হাসিখুশি আর আনন্দময়ী এই মেয়েটি সর্বদাই যার দরকার তাকেই সাহায্য করতে প্রস্তুত ছিল। রবিবারের সান্ধ্য আসরের সে-ই ছিল প্রাণ। কারণ সে বিধবা হলেও সকলের সঙ্গেই ঠাট্টাকৌতুক করতে পারত। তাতে ভারতীয় সমাজের শালীনতার কঠোর নিয়ম লঙ্ঘন করা হত না। যে ছেলেটি তার অসুখের খবর আমার কাছে নিয়ে এসেছিল সে জানত না যে তার কি হয়েছে। কিন্তু তার দৃঢ় বিশ্বাস যে পার্বতী মরতে বসেছে।

    সুতরাং আমি সামান্য কয়েকটি ওষুধ সঙ্গে নিয়ে, আর যাওয়ার পথে চামারিকে ডাক দিয়ে তাড়াতাড়ি সেই গ্রামে গেলুম। গিয়ে দেখি যে পার্বতী তার বৃদ্ধা মায়ের কোলে মাথা রেখে কুঁড়েঘরের মেঝেতে শুয়ে রয়েছে। ধনুষ্টঙ্কার এই আমি প্রথম দেখলুম, এবং আশা করি এটাই শেষ দেখা হবে। পার্বতীর মত দাঁত থাকলে যে কোনো চিত্রতারকার ভাগ্য ফিরে যেত। তাকে জল খাওয়াবার জন্যে চাড় দিয়ে খুলতে গিয়ে সেই দাঁতের পাটি ভেঙে গিয়েছিল।

    তার জ্ঞান ছিল, কিন্তু সে কথা বলতে পারছিল না। যে যন্ত্রণা সে ভোগ করছিল, তা বর্ণনা করার ভাষা আমার নেই। তাকে আরাম দেবার জন্যে আমার কিছুই করবার ছিল না, শুধু তার শ্বাসপ্রশ্বাস একটু সহজ হতে পারে ভেবে তার গলার খিচে থাকা পেশীগুলো একটু মালিশ করে দিতে লাগলুম। যখন এই করছি তখন যেন একটা ইকেলট্রিক শক খেয়ে তার শরীরটা থর-থর করে উঠল। তার হৃৎস্পন্দন যেন দয়া করে থেমে গেল, তার সব যন্ত্রণার অবসান হল।

    দরিদ্রের কুটিরটি থেকে ফিরে আসবার সময় আমাতে আর চামারিতে একটি কথাও হল না। মৃতদেহ সৎকারের আয়োজন ইতিমধ্যেই আরম্ভ হয়ে গিয়েছিল। সেই উঁচু জাতের মেয়েটির আর আমাদের মাঝখানে সংস্কারগত বাধা ছিল প্রচুর। তবু তার জন্যে আমাদের ভালবাসার কিছু কমতি হয় নি। আর এই আনন্দময়ী, কঠোর পরিশ্রমী ছোটখাটো মেয়েটির অভাব আমরা মুখে স্বীকার না করলেও খুবই অনুভব করব, এ কথা আমরা দুজনেই জানতুম। সে রাত্রে আমি সামারিয়া ঘাটে চলে যাওয়াতে চামারির সঙ্গে আমার আর দেখা হয় নি। আর এখন তার বউ বলতে এসেছে যে তার । কলেরা হয়েছে।

    ভারতে আমরা কলেরাকে ঘৃণা আর ভয় দুই করি বটে, কিন্তু বোধহয় আমরা অদৃষ্টবাদী বলেই ছোঁয়াচ লাগবার ভয় আমাদের নেই। আমি তাই দেখে অবাক হলুম না যে চামারির দড়ির খাঁটিয়া ঘিরে বহু লোক মেঝেতে বসে আছে।

    ঘরটা অন্ধকার, কিন্তু আমার হাতের লণ্ঠনের আলোয় চামারি আমাকে চিনতে পেরে বলল, এই অসময়ে আপনাকে ডেকে এনেছে বলে আমার বউকে মাপ করবেন। রাত তখন দুটো। ‘ভোর হবার আগে আপনাকে বিরক্ত করতে বারণ করেছিলুম ওকে। ও আমার কথা শুনল না।

    ঘণ্টাদশেক আগে চামারিতে আমাতে ছাড়াছাড়ি হয়েছিল, তখন সে তো বেশ সুস্থই ছিল বলে মনে হয়েছিল। কিন্তু এই কয়েক ঘণ্টার মধ্যে তার চেহারা কিরকম বদলে গিয়েছে তা দেখে আমি চমকে উঠলুম। সে চিরকালই রোগা পাতলা মানুষ, এখন দেখে মনে হল যে সে কুঁকড়ে তারও অর্ধেক হয়ে গিয়েছে। চোখদুটি গভীরভাবে কোটরে ঢুকে গিয়েছে, স্বর অতি দুর্বল, ফিসফিসানির চেয়ে বেশি কিছু। নয়।

    ঘরের ভিতর সাংঘাতিক গরম। তাই আমি তার প্রায়-উলঙ্গ দেহ একখানা চাদর দিয়ে ঢেকে লোকদের দিয়ে তাকে বাইরে উঠোনে আনিয়ে নিলুম। কলেরা রোগীর পক্ষে জায়গাটা বড়ই প্রকাশ্য স্থান, তা ঠিক। কিন্তু তার মত অবস্থার মানুষের নিঃশ্বাস নেবার মতো হাওয়াও সেখানে ছিল না। অমন উত্তপ্ত একটা ঘরের চাইতে প্রকাশ্য স্থানও অনেক ভাল।

    চামারিতে আর আমাতে মিলে অনেক কলেরার কেস-এর সঙ্গে লড়াই করেছি। ঘাবড়ে যাওয়ার যে কি বিপদ আর আমার নাগালের মধ্যে যেসব সামান্য ওষুধপত্র ছিল তার উপর বিশ্বাস রাখাটা যে কত দরকার, সে কথা তার চেয়ে ভাল করে কেউ জানত না। এই বিশ্রী রোগের সঙ্গে সে বীরের মত যুঝতে লাগল। একবারও হতাশ না হয়ে আমি তার রোগ ঠেকাবার এবং শরীরে জোর বজায় রাখবার জন্যে যত কিছু দিলুম, তা-ই সে খেতে লাগল।

    দিনটা গরম হলেও তার শরীর ঠান্ডা হয়ে গিয়েছিল। তাকে গরম রাখবার জন্যে তার বিছানার তলায় জ্বলন্ত কয়লা-ভরা একটা আগুনের পাত্র রাখা হল, আর তার হাতের পাতায় আর পায়ের তেলোয় শুঠের গুঁড়ো ঘষা হতে লাগল।

    আটচল্লিশ ঘণ্টা ধরে এই লড়াই চলল, তার প্রতিটি মুহূর্তে মরণের সঙ্গে পাল্লা দেওয়া হল। তারপর সেই সাহসী ছোট্ট মানুষটির আচ্ছন্নভাব দেখা দিল, নাড়ী ক্ষীণ হয়ে আসতে লাগল, শ্বাসক্রিয়া বুঝতে পারা দুঃসাধ্য হয়ে উঠল। রাত বারোটা থেকে চারটের একটু পর পর্যন্ত তার এই অবস্থা চলল। বুঝলাম যে আমার বন্ধু আর সামলাতে পারবে না। এই দীর্ঘকাল ধরে আমার সঙ্গে যেসব নির্বাক মানুষ তার উপর লক্ষ রাখছিল, তারা হয় মাটিতে বসে নয় চামারিকে ঘিরে দাঁড়িয়ে ছিল।

    এমন সময় চামারি হঠাৎ উঠে বসে, ব্যগ্রভাবে এবং সম্পূর্ণ স্বাভাবিক স্বরে বলে উঠল, “মহারাজ! মহারাজ! আপনি কোথায়?’

    আমি শিয়রের দিকে দাঁড়িয়ে ছিলুম। আমি ঝুঁকে পড়ে আমার হাতখানা তার কাঁধে রাখতে সে তার দুই হাত দিয়ে তা ধরে বলল ‘মহারাজ! পরমেশ্বর আমাকে ডাকছেন, আমাকে যেতে হবে।’

    তারপর দুই হাত জোড় করে, মাথা নুইয়ে সে বলল, ‘পরমেশ্বর! আমি আসছি।’

    আমি যখন তাকে আবার বিছানায় শুইয়ে দিলুম তখন তার প্রাণ আর নেই।

    বোধহয় সব জাতের শ-খানেক লোক উপস্থিত ছিল। সবাই চামারির শেষ কথাগুলো শুনেছিল। তাদের মধ্যে একজন অজানা লোক ছিল, তার কপালে চন্দনের তিলক, তাতে তার জাত বোঝা যায়। আমি যখন শীর্ণ দেহটিকে খাঁটিয়ায় নামিয়ে রাখলুম, সেই আগন্তুকটি তখন জানতে চাইল যে মৃত ব্যক্তি কে?

    যখন বলা হল যে সে হচ্ছে চামারি, তখন লোকটি বলল, ‘অনেক কাল ধরে যা খুঁজছিলুম, এতক্ষণে তা পেলুম। কাশীর প্রধান বিষ্ণুমন্দিরের একজন পুরোহিত আমি। আমাদের প্রভু সেখানকার প্রধান পুরোহিত ঠাকুর, ওই লোকটির সৎকার্যের কথা শুনে একে খুঁজে বের করে তার কাছে নিয়ে যাবার জন্যে আমাকে পাঠিয়েছেন, যাতে তিনি এর একটু দর্শন পেতে পারেন। আমি এখন প্রভুর কাছে ফিরে গিয়ে তাঁকে বলব যে চামারি মারা গিয়েছে। চামারিকে যে কথা বলতে শুনলুম, তাও তাকে বলব।

    তারপর হাতের পুঁটলিটা মাটিতে রেখে, পায়ের চপ্পল খুলে ফেলে, সেই ব্রাহ্মণ পুরোহিত খাঁটিয়ার পায়ের দিকে গিয়ে সেই মৃত অস্পৃশ্য ব্যক্তিকে প্রণাম জানাল।

    চামারির মত করে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া, মোকামা ঘাটে আর কখনও কারও হবে না। সকল সমাজের সব সম্প্রদায়ের লোক, উচ্চ-নীচ, ধনী-দরিদ্র, হিন্দু-মুসলমান, অস্পৃশ্য-খ্রীষ্টান নির্বিশেষে তাতে যোগদান করেছিল। একদিন যে বন্ধুহীন অবস্থায় নানা অযোগ্যতার বোঝায় ভারক্রান্ত হয়ে এসে উপস্থিত হয়েছিল, তারপর সকলের শ্রদ্ধাভাজন এবং অনেকের ভালবাসার পাত্র হয়ে বিদায় নিল, তাকে শেষ সম্মান দেখাতে এসেছিল সবাই।

    আমাদের খ্রীষ্টান ধর্মবিশ্বাস অনুসারে চামারি ধর্মশূন্য বর্বর লোক মাত্র। ভারতের অস্পৃশ্যদের মধ্যেও তার স্থান ছিল সকলের নিচে। কিন্তু সে যেখানে গিয়েছে, আমার যদি সেখানে যাবার সৌভাগ্য হয় তাহলে আমি আর কিছু চাইব না।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleরামায়ণের উৎস কৃষি – জিতেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়
    Next Article জীবনযাপন – জীবনানন্দ দাশ
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    রাজমালা বা ত্রিপুরার ইতিহাস – শ্রী কৈলাসচন্দ্ৰ সিংহ প্রণীত

    August 20, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    রাজমালা বা ত্রিপুরার ইতিহাস – শ্রী কৈলাসচন্দ্ৰ সিংহ প্রণীত

    August 20, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Our Picks

    রাজমালা বা ত্রিপুরার ইতিহাস – শ্রী কৈলাসচন্দ্ৰ সিংহ প্রণীত

    August 20, 2025

    আলো হাতে সেই মেয়েটি – তপন বন্দ্যোপাধ্যায়

    August 20, 2025

    গোয়েন্দা গার্গী সমগ্র – তপন বন্দ্যোপাধ্যায়

    August 20, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.