Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    আলো হাতে সেই মেয়েটি – তপন বন্দ্যোপাধ্যায়

    August 20, 2025

    গোয়েন্দা গার্গী সমগ্র – তপন বন্দ্যোপাধ্যায়

    August 20, 2025

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    জিম করবেট অমনিবাস (অখণ্ড) – মহাশ্বেতা দেবী সম্পাদিত

    জিম করবেট এক পাতা গল্প1380 Mins Read0

    ভূমিকা – কৃষ্ণচন্দ্র রায় চৌধুরী

    ভূমিকা

    এই বইয়ের ভূমিকা আমরা ‘অস্ত্যত্তরস্যাং দিশি হিমালয়ো নাম নগাধিরাজ’ বলেও শুরু করতে পারি, কারণ গল্পগুলি সবই হিমালয়ের পটভূমিকায় রচিত। আবার গল্প বললেও ঠিক বলা হল না, কারণ যে সব ঘটনা বর্ণিত হয়েছে, তা শুধু সত্য ঘটনাই নয়, প্রত্যক্ষদর্শীর নিজস্ব বিবরণী, আবার ঘটনাবলীও বহুলাংশে তিনিই নিয়ন্ত্রিত করেছেন। পূর্বে এদেশে যে সব শিকার কাহিনি বেরিয়েছে, শ্রেণী হিসাবে এগুলি তার থেকে স্বতন্ত্র ত বটেই, উচ্চমানেরও।

    এখানে হিমালয়ের কিছু বর্ণনা দেওয়া অপ্রাসঙ্গিক হবে না। বোধহয়। সিন্ধু-ব্ৰহ্মপুত্ৰ নদের মধ্যবর্তী এই বিশাল গিরিশ্রেণীর বর্ণনা সংক্ষেপে দেওয়া সহজ নয়, কারণ পূর্ব-পশ্চিমে প্রায় দেড় হাজার মাইল লম্বা, আর উচ্চতায় পাঁচশো ফুট থেকে আরম্ভ করে সর্বোচ্চ শিখরে পাঁচ মাইল খাড়াই এই হিমালয় পর্বতমালা। ফলে এক অঞ্চলের আবহাওয়া, গাছপালা, এমন কি নৈসর্গিক দৃশ্যও অন্য অঞ্চল থেকে আসমান-জমিন ফারাক। যেমন, ১৩-১৭ হাজারফুট থেকে আরম্ভ হয় চির তুষার অঞ্চল। তা থাকে সারা বছরই বরফে ঢাকা। যে জন্য সেখানে কোন উদ্ভিদ জন্মাতেই পারে না। পূর্বাঞ্চলের হিমালয়ে, যা দ্রাঘিমার মানে বেশি ‘দক্ষিণী’ (আসাম, বাংলা, পূর্বনেপাল, সিকিম, ভূটান ইত্যাদি অঞ্চলে), সেখানে হিমরেখা পাওয়া যাবে সতের হাজার ফুটের কাছাকাছি, যা কুলু বা বদরীনাথে প্রায় তের হাজারের কাছে দেখা যাবে। কাশ্মীরের অমরনাথের রাস্তায় গেলে আরো নিচে হিমরেখার দর্শন মিলবে, কেননা এই অঞ্চলটি হিমালয়ের অনেক উত্তরের দ্রাঘিমায় অবস্থিত। হিমরেখার নিচে ত অনেকখানি পরিসর জুড়ে একটি অঞ্চল দেখা যাবে, যা হল প্রকৃতিদেবীর ‘খাশ বাগিচা’। বসন্তের আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে এখানে (১২-১৬ হাজার ফুটে) বর্ণাঢ্য ফুলের মেলা বসে যায়, যেজন্য এই অঞ্চলকে বিখ্যাত ইংরেজ পর্বতারোহী Symthes বলেছেন, ‘Val- ley of flowers ‘ বা ফুলের রাজ্য, যা অন্য কেউ অভিহিত করেছেন ‘Valley of the gods’ বলে। মনে হবে, প্রকৃতি যেন আপন খেয়ালেই সেখানে সবুজ জমির উপর নানা রং দিয়ে আগাগোড়া হিমালয়ের বুক জুড়ে বিচিত্র রঙে আর নক্শায় বিরাট একটি কার্পেট ফেঁদেছেন, যা আবার ফুস মন্তরে হেমন্তকালের শেষেই উধাও হয়ে যায়। এই অবিশ্বাস্য ফুলবাগানের নিচ থেকে শুরু হয় বৃক্ষ আর গুস্মরাজ্য। বৃক্ষের মধ্যে প্রধান হল ভূর্জপত্র এবং গুল্মের মধ্যে রোডোডেনড্রন, যার নেপালী নাম হল গুরাঁশ। এখান থেকে (১০-১২ হাজার ফুট) নিচে নামলে সাক্ষাৎ পাওয়া যাবে নানা সরল বর্গীয় গাছের, যারা হল ফার, স্পুস্, দেওদার, পাইন। ফার হল সর্বোচ্চ স্তরের গাছ, আর পাইন নেমে যায় ৪-৫ হাজার ফুট পর্যন্ত, কাশ্মীরের অবশ্য হাজারফুটের নিচেও পাইন দেখাই যাবে। পূর্ব হিমালয়ে, বিশেষত কোশী নদীর পূর্বে, পাইন আর দেওদার দেখা যাবে না, আর প্রুস্ত্ত সেখানে কমই। তার বদলে দেখা যাবে নানা জাতের ওক আর নানা রঙের রোডোডেনড্রন।

    এই উঁচু পাহাড়ের বনে যে সব জীবজন্তুর দেখা মেলে তা হল, জংলী ছাগল বা থাড়, জংলী ভেড়া বা ভড়াল, ভালুক, গেছো ভাম, তুষার চিতা, কাকর হরিণ (মৈমনসিংহের ভাষায় খাউট্যা হরিণ), হাংগুল ইত্যাদি। কেঁদো বাঘও যে এই উঁচু পাহাড়ে ছটকে মাঝে মাঝে এসে পড়ে না এমন নয়। তবে এখানে আনাগোনা কম (অবশ্য কালিম্পংয়ের পাহাড়ে ১০ হাজার ফুটেও পাড়ণ্ডী অর্থাৎ হাতি চলার রাস্তা দেখা যায়)—তারা ঘুরে বেড়ায় অপেক্ষাকৃত নিচের বনে। যেখানে আছে শাল আর বাঁশ বন, আর প্রচুর জল আর শর ঘাস। বাঘেরও দেখা মিলবে সেখানে বেশি করে। বাঘের প্রধান খাদ্য হল বন্যবরাহ, চিতল, সম্বর, বারশিঙা, কাকর ইত্যাদি জাতের হরিণ। বাঘ ছাড়া শ্বাপদের মধ্যে আছে শ্লথ ভল্লুক। হাতি অবশ্য পূর্বাঞ্চলেই বেশি, আর গঙ্গার পশ্চিমে এদের দেখাই যাবে না বড় একটা। এই ত গেল হিমালয়ের গাছপালা আর জীবজন্তুর মোটামুটি খবর।

    গল্পগুলি হল সব বাঘ নিয়ে—তথা নরখাদক বাঘ নিয়ে। বাঘগুলি নরখাদক না হলে অবশ্য এই ভূমিকারও কোন প্রয়োজন ছিল না। রাঘগুলি হয়ে পড়েছিল মনুষ্যজাতির শত্রু। তাই তাদের মরতে হল। ভবিষ্যতে আবার এ ধরনের গল্প লেখার পটভূমি রচিত হবে কি না কে জানে—কারণ ভারতে ব্যাঘ্রকুলের অবস্থা নিতান্ত শোচনীয়। বিশেষজ্ঞদের মতে ৫০-৬০ বছর আগেও যেখানে ভারতে কম করে ৪০ হাজার বাঘ ছিল, এখন তা হাজারের নিচে নেমে এসেছে। তাই আজ বাঘের জন্যই বিশেষ করে অভয়ারণ্যের ব্যবস্থা করতে হচ্ছে— এমনকি এ ব্যাপারে প্রাণীরক্ষার বিশ্বসংস্থাও সক্রিয় সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছে। ভারতের বাইরে বনে শ’খানেক বাঘ আছে কি না সন্দেহ।

    হরিণ, শুয়োর হল বাঘের স্বাভাবিক আহার, তাছাড়া বাঘ মানুষকে তাড়া করবে কেন? এ নিয়ে অবশ্য অনেক মত আছে। যে বাঘ মানুষখেকো নয়, সে মানুষ দেখলেই সরে পড়বে। জঙ্গলে হঠাৎ এমনি বাঘের সামনে পড়ে, ভয় পেয়ে বাঘের দৌড় দেখে (যদি অবশ তা দেখার মত মানসিক অবস্থা থাকে কারো) অনেকের হাসিই পাবে—কারণ জঙ্গলের রাজার এটা শোভা পায় না। যাই হোক, এটাই হল জঙ্গুলে আইন—অপরিচিত কিছু দেখলে তা এড়িয়ে যাওয়ই বন্য প্রাণীর স্বাভাবিক ধর্ম। কিন্তু না চাইলেই তা হবে না এ নিয়ম আর কোথায়? মানুষ শিকার করে হরিণ আর বরা, যা হল বাঘের হকের খাবার—আর সেখানে টানাটানি পড়লেই তাকে বিকল্প ব্যবস্থায় নামতে হবে, আর তখনি শুরু হয় গোলমাল। প্রথম প্রথম বাঘের থাবায় ঘায়েল হয় গৃহপালিত গরুমোষ—আর তা মারতে গিয়ে বাঘ আসে মানুষের সংস্পর্শে। অনেক সময়ে এ জন্য তারা নিহতও হয়—আবার অনেক সময়ে আত্মরক্ষার্থে মানুষও জখম করে ফেলে। একবার মানুষের রক্তের স্বাদ পেলে বাঘের যেন মেজাজই বদলে যায়—আর যখন সে দেখে যে এই জীবটি, যাকে সে ভয় করে এতদিন এড়িয়ে এসেছে, সে আত্মরক্ষায় এতই অক্ষম, যে তার নিজেরই আফশোস হয়, কেন আগে থেকে মানুষের পেছনে সে ধাওয়া করেনি। হরিণ-বরা ধরতে রীতিমত দৌড়াদৌড়ি আর কসরৎ করতে হয়—মামুলি পোষা গরুও বেশ খানিকটা দৌড়তে পারে আত্মরক্ষার জন্য—কিন্তু মানুষ ত স্রেফ তাদের গর্জন শুনেই কুপোকাৎ। তাই বাঘ একবার মানুষখেকো হলে অন্য আহারে তার এক রকম যেন অরুচিই এসে যায় বলতে গেলে; যদিও মানুষ না পেলে অবশ্যই অন্য আহারও সে গ্রহণ করে। কেউ কেউ আবার বলেন যে মানুষের রক্ত না কি বেশি লোনা তথা বেশী লোভনীয়। তবে সবই অনুমান।

    বলা হয়েছে বাঘ স্বাভাবিক আহার না পেলে মানুষের দিকে ঝোঁকে ঘটনা পরম্পরায়—কিন্তু এ ব্যাপারে কার্যকারণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে অন্যান্য, ঘোরা পথেও। যেমন, বুড়ো বাঘ। সে আর তখন দৌড়ে গিয়ে হরিণ বরা ধরতে পারেনা–হয়ত খিদের জ্বালায় মানুষ মেরে ফেলে—আর একবার মানুষটি মারলেই তার যেন দিব্যজ্ঞান লাভ হয়, যে এর চেয়ে সোজা শিকার দুনিয়ায় আর নেই। তবে বুড়ো বাঘই যে মানুষখেকো হবে, আর কেউ নয়, এমন কথা বলা চলে না। বেশির ভাগ মানুষখেকোর ইতিহাস হল জখম হওয়া বাঘ থেকে। নবীন বা কাঁচা শিকারীর হাতে গুলি খেয়ে, সুস্থ, সবল, জোয়ান বাঘ হয়ে পড়ে খোঁড়া বা কানা বা অন্যভাবে অপটু। কারও হয়ত চোয়ালে গুলি লেগে সেটি অচল হয়েছে। এ সব বাঘকে তখন বাঁচতে হলে বিকল্প শিকারের যোগাড় দেখতে হয়, এবং স্বাভাবিকভাবে মানুষই এসে পড়ে তার খাদ্যতালিকায়। অনেক সময়ে আবার বাচ্চা বয়সেই মানুষের মাংসের সঙ্গে পরিচয় ঘটেছে— তার মানুষখেকো মা যখন শিকার করে তাকে খাইয়েছে। অবশ্য এ সব বাচ্চা বাঘ বড় হয়ে শুধরে যেতেও পারে। এই সংস্পর্শদোষে সে ছোট থেকে আর মানুষকে ভয় করতে শেখেনি বা তাকে বর্জিত খাদ্যের কোটায়ও রাখেনি। সে ‘যাই হোক, মানুষখেকো হলেই, অলিখিত আইন অনুসারে বাঘের ওপর মৃত্যুদণ্ড জারী হয়, তবে সেটা কবে কার্যকরী হবে কিনা তা নির্ভর করে কৌশলী শিকারীর ওপর। আবার অন্য কারণে অক্ষম হয়ে, যেমন খিদের জ্বালায় শজারু মারতে গিয়ে থাবায় কাঁটা ফুটিয়ে বা বরাহের দাঁতে বা হরিণের শিংয়ে অপ্রত্যাশিতভাবে জখম হয়েও শেষটায় বাঘ মানুষখেকো হয়ে দাঁড়ায়।

    মানুষখেকো বাঘ সম্বন্ধে আরো ২-৪টি তথ্য জানা দরকার। কারণ তখন তাদের বুদ্ধিবৃত্তি বা কর্মতৎপরতা এমনই বৃদ্ধি পায়, সাধারণ জংলী বাঘের মধ্যে তা দেখা যাবে না বড় একটা। এরা যেন বেশ চালাক হয়ে ওঠে আর মনুষ্য চরিত্র ও তাদের দূর্বলতা সম্বন্ধে এদের একটা মোটামুটি ধারণা এসে যায়। যেমন, সন্ধ্যার ঝোঁকে ঝরনার ধারে ২-১টি মানুষ আসবেই জল নিতে আর তখন তাকে ধরা সহজ। তেমনি, গরুর পালের তদারকী করতে ২-১টি বালক থাকবেই, তাকেও ধরতে পারলে মন্দ হয় না। অথবা এক দল মেয়ে জঙ্গলে ঘাস কাটতে আসবে সকালে বা ফিরে যাবে বিকেলে, এদের একটিকে ধরলেই হবে—বাকি সব তখন চোঁ চোঁ পালাবে। মানুষের সম্বন্ধে এত জ্ঞান এদের হওয়ায় রুদ্রপ্রয়াগের চিতা বাঘটি ১২৫টি লোক মেরেছিল এবং আট বছর কেদার-বদরী যাত্রীদের রাস্তায় দাপটে চালিয়েছিল ত্রাসের রাজ্য। চম্পাবতের মানুষখেকোটি ত ৪৩৫টি মানুষই মেরেছিল। মধ্যপ্রদেশে একবার একটি বাঘ মানুষখেকো হয়ে খালি ডাকরানার মারত—অর্থাৎ রানারের ঘন্টার ঠুং ঠুং আওয়াজ পেলেই সে জংলী রাস্তার ধারে ঘাপটি মেরে বসে থাকত। শেষে শিকারীরা তাকে বাগে আনতে রানারের ঘণ্টা নিয়ে পায়ে হেঁটে যেতেই তার দেখা পেল এবং গুলি করল।

    কথায় বলে বাঘের গল্প, ভূতের গল্প আর সাপের গল্প—এর আরম্ভ হলে আর শেষ নেই। তবু মানুষখেকো বাঘের আখ্যায়িকা ঠিকমত উপলব্ধি করতে হলে বাঘের সম্বন্ধে অন্য দু একটি কথা জানা দরকার। প্রথমত আকার। অনেক শিকারীকে (যাঁরা বেশর ভাগ বাঘ মুখেই মেরে থাকেন) ১০-১২ ফুট বাঘের কথা বলতে শোনা যাবে—তবে জেনে রাখা ভাল যে ১০ ফুট বাঘ বড় একটা দেখা যায় না। সাড়ে ন ফুট বাঘ বেশ বৃহৎ ব্যাপার। অবশ্য মাপ দিয়েই বাঘের ছোট বড় বিচার করা সব সময়ে সম্ভব হয় না, কারণ শরীরের দৈর্ঘ্যের অর্ধেকই হল লেজ। কোন বাঘের লেজ ছোট হয়, আর কারো বা বড়। কাজেই বাঘই যদি সাড়ে ন ফুট হয়। তবে যে বাঘের লেজ ছোট, সে নিশ্চয় আকারে বড় হবে। বাঘ মেরে সেটিকে উবু করে মাটিতে শুইয়ে লেজটি টান করে মাটির উপর রেখে, নাকের ডগায় আর লেজের শেষে দুটি কাঠি পুঁতে, কাঠি দুটির মাঝের দূরত্ব মাপা হয়। এই হল measurement between pags এবং এই হল বিজ্ঞানসম্মতভাবে বাঘের মাপ। অবশ্য ভি-আই-পি-রা কেউ বাঘ মারলে আগেকার দিনে বিশেষ ধরনের মাপের ফিতা কেউ কেউ ব্যবহার করতেন, যা দিয়ে ৯ ফুট বাঘকে সম্মানিত অতিথির খাতিরে হয়ত সাড়ে ন ফুট বাঘ বলে ঘোষিত হত। এটা অবশ্য আজকাল বড় একটা করা হয় না। বাঘের ঘ্রাণশক্তি খুবই কম—অর্থাৎ ঘ্রাণ দিয়ে এরা শিকার তল্লাস করে না, বা পারে না, তবে শিকার করে সেটা লুকিয়ে রেখে রাতের অন্ধকারে খুঁজবার সময়ে ঘ্রাণশক্তির ব্যবহার অবশ্যই করে। তবে বাঘের চোখের দৃষ্টি এবং শ্রবণশক্তি দুটিই অত্যন্ত প্রখর—আর এ দুটিই হল তার শিকার ধরার প্রধান অস্ত্র। তারপর আছে তার সামনের দুটি পা—আর দাঁত, যা এর সব শক্তির উৎস। বাঘের থাবার ঘায়ে বড় বড় মোষ ঘায়েল হয়, আর তার চোয়ালের এমনই জোর যে সে বড় জন্তুকে মেরে মুখে করে বেশ দূরে নিয়ে যেতে পারে, যেমন বেড়ালে ইঁদুর ধরে নিয়ে যায়। অবশ্য জন্তুর ওজন বেশি হলে টেনে নিয়েও যেতে হয়। অনেক সময়ে শিকার করে সবটা একসঙ্গে না খেয়ে পাতাকুটো দিয়ে ঢেকে রেখে দেয় পরে খাবার জন্য। তাই বাঘ শিকার করায় প্রকৃষ্ট পন্থা হল মড়ি kill খুঁজে বের করা, আর চুপচাপ লুকিয়ে থেকে বাঘের প্রতীক্ষা করা। এই মড়ির কাছে ফিরে আসার অভ্যাসের জন্যই বাঘ মারা পড়ে। তবে বাঘ খুব সন্দিগ্ধচিত্ত, একটু গোলমাল বুঝলে সে মড়ির কাছে আসে না সহজে। মানুষখেকো বাঘ স্বভাবত চতুর হয়, এবং অনেক সময়ে সে তাই মড়ির কাছে ফিরে আসে না। গুলি খেয়ে জখম হলে বাঘ হয়ে ওঠে অসম্ভব হিংস্র এবং তার পেছনে যাওয়া মানে সাক্ষাৎ মৃত্যুর সম্মুখীন হওয়া বলা চলে—অথচ যে কোন সুযোগ্য শিকারীর উচিত কাজ হল, বাঘকে জখম করলে তাকে খুঁজে শেষ করে ফেলা, তা নইলে অন্য নিরীহ লোক অজানতে তার বলি হয়ে পড়ে। কাজেই শখের শিকারী অনেক সময়ে বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়ায়। বাঘের আর একটি অভ্যাস হল, কোণঠাসা হলে (বা এমনিতেও ঝোপঝাড়ের আড়ালে লুকিয়ে থাকা – সহজ cover ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে না, যে জন্য শিকারীকে বাঘের পেছনে ধাওয়া করতে গিয়ে সম্ভাব্য লুকাবার জায়গাগুলির উপর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখতে হয়।) আহত বাঘ এবং বাচ্চাসহ বাঘিনী অতি ভয়ংকর বস্তু এবং এদের কাছাকাছি এসে পড়লে প্রাণে বাঁচা দায়।

    পায়ে হেঁটে বাঘ শিকার করা কেবলমাত্র অতি দক্ষ শিকারীর পক্ষেই সম্ভব; আর এর জন্য চাই অমিত সাহস, অসীম ধৈর্য ও কর্মক্ষমতা, নির্ভুল হাতের টিপ, এবং মুহূর্তের মধ্যে তাক করে গুলি ছোঁড়ার ক্ষমতা—তাই সাধারণ শিকারীরা হাতির পিঠে চড়ে বা গাছের ওপরে মাচানে বসে শিকার করেই পরিতৃপ্ত হন। ঝানু মানুষখেকোর পেছনে দৌড়াতে হলে কিন্তু পায়ে হেঁটেই শিকার করে পরিতৃপ্ত হতে হয়। করবেটের শিকার কাহিনীর মধ্যে এসব গুণের পরিচয় অহরহই পাওয়া যাবে। আবার বনে বনে ঘুরে বাঘ শিকার করতে হলে শিকারীকে জানতে হবে বনের ভাষা—যা বোঝা যাবে তীক্ষ্ণদৃষ্টি আর শ্রবণ শক্তির সাহায্য, অভিজ্ঞতার মাধ্যমে—কেতাবে তা মিলবে না। শিকারীকে বাঘের জানান দেয় বনের নানান পশু পাখি, যেমন হয়ত গাছের উপরে শোনা গেল ময়ূরের কেকাধ্বনি বা বাঁদরের কিচির মিচির, অথবা কাকার হরিণের খেউ ডাক, শিকারীর কাছে এর অর্থ হল ব্যাঘ্রাচার্য বৃহল্লাঙ্গুল মহাশয় আহারের খোঁজে বেরিয়েছেন এবং সম্ভবত কাছাকাছিই আছেন। সম্বরের ‘ঘং’ আওয়াজও এরই জানান দেয়—যাতে অন্য জীবজন্তুরা সাবধান হতে পারে। গ্রামাঞ্চলে অনেকে ফেউ ডাকের সঙ্গে পরিচিত—ফেউ কোন স্বতন্ত্র জীব নয়, সাধারণ শেয়াল—ভয় পেলে অমনি ডাকে, বনাঞ্চলে অবশ্য ফেউ ডাকের অর্থ হল, কাছাকাছি বাঘ ঘুরঘুর করছে এবং সেটা শেয়াল মশাই-এর দৃষ্টিগোচর হয়েছে। সাপে যখন ব্যাং ধরে তখন ব্যাং এক অদ্ভুত ধরনের আওয়াজ করে—যা গ্রামের লোক মাত্রই শব্দ শুনে বুঝতে পারে। বাঘে হরিণ মারলে তার (হরিণের) বৈশিষ্ট্য আর্তরব লক্ষণীয়। শিকারী এই সব আওয়াজ শুনে অনেক কিছু জানতে পারেন। তাই করবেট বনের পথে ডাকাতদের ধাওয়া করতে গিয়ে রাত্রে সঙ্গীদের সঙ্গে যখন অনাহারে রাত কাটাচ্ছেন, তখন দূরে এমনই আওয়াজ শুনে বলে উঠলেন, মাংসটা নিয়ে এলে হয়—তখন অন্যেরা ভাবলেন সাহেব বুঝি পাগল হয়ে গেছেন ক্ষিদের জ্বালায়। আসলে উনি নির্ভুল সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন যে নিকটেই একটি বাঘ সবে হরিণ মেরেছে খুঁজলে লাশ পাওয়া যাবে যা তাদের শিবিরের খাদ্যাভাব মেটাতে পারবে।

    সুন্দরবনে বাঁদরের কিচিমিচি শুনে গাছের তলায় বাঘ এসে হাজির হয়—কারণটি মজারই বলতে হবে, কারণ বাঁদরের কিচিমিচি শুনে গাছের নিচে জড় হয় হরিণ, —পাতা খাবার জন্য, বাঁদরেরা পাতা ফল যত না খায় নষ্ট করে তার চেয়ে বেশি, তাই হরিণের আবির্ভাব, আর বাঘও জেনেছে যে বাঁদর কিমিচ্ করলে সেখানে হরিণ এসে জোটে, সুতরাং সেখানটা একবার দেখলে ক্ষতি কি! শিকারীরাও এর সুযোগ নেয়। মানুষে বাঁদরের কিচিমিচি নকল করে-পাতা ছিঁড়ে নিচে ফেলে অনেক সময় গাছের নিচে বাঘ হরিণ ইত্যাদি আনতে সমর্থ হয়। প্রজনন ঋতুতে বাঘ আওয়াজ দিয়ে অন্য বাঘের সন্ধান করে তাই সে সময়ে হাঁড়ির মধ্যে মুখ দিয়ে বাঘের ডাক নকল করেও অনেক সময়ে আর একটি বাঘ কাছাকাছি ডেকে আনা যায়। সুন্দরবনে এটি প্রায়ই পরখ করে অনেকে দেখেছেন, এমন কি শিকারও করেছেন কেউ কেউ।

    বাঘ মানুষখেকো হলেই তার আচার আচরণ সাধারণ জঙ্গুলে বাঘ থেকে একটু স্বতন্ত্র হয়ে যায়—যার মধ্যে প্রধান হল সে লোকালয়ের কাছাকাছি ঘোরাঘুরি করে এবং মানুষকে একদমই ভয় পায় না, এবং তক্কে তক্কে থাকে কখন কাকে ধরবে। অবশ্য এরা তখন সাধারণত সকালে বা সন্ধ্যেয় আক্রমণ করে এবং প্রায়ই যারা একলা পড়ে তাদের দিকেই লক্ষ্যটা রাখে বেশি করে। আবার বেশি সাহসী হয়ে পড়লে দিনের বেলায়ও বেরিয়ে পড়ে। রুদ্রপ্রয়াগের মানুষখেকো চিতাটি এমনি ত্রাসের সৃষ্টি করেছিল যে সে অঞ্চলের অধিবাসীরা রোজই স্বেচ্ছায় কার্ফু পালন করত—বিকেল থেকে সকাল পর্যন্ত। বিকাল হলেই পড়ি কি মরি করে, সবাই গৃহে আশ্রয় নিত আর দরজা জানলা শক্ত করে বন্ধ করে রাখত, প্রসঙ্গক্রমে সুন্দরবনের মানুষখেকো বাঘের কথায় আসা যেতে পারে—এখানে প্রত্যেকটি বাঘই মানুষখেকো–অর্থাৎ বাগে পেলে ছাড়বে না, তবে তেমন ত্রাসের সঞ্চার করে না— মানুষ বলি হয় অসতর্কতার জন্যই। গত এক বছরের নজীরে সেখানে কোন বনকর্মী বাঘের পেটে গিয়েছে বলে জানা যায়নি। এরাও শিকার ধরে সকাল সন্ধ্যেয়—আর একলা পেলে। তাই বোধহয় প্রবাদ যেখানে বাঘের ভয় সেখানে সন্ধ্যে হয়—অর্থাৎ সন্ধ্যায় বাঘের দেখা—সাপের লেখা বাঘের দেখা—অর্থাৎ কপালে থাকলে দেখা হবেই। নৌকাতে সাঁতরে গিয়ে (বাঘ বিশেষ সন্তরণ পটু) দলে ঘুমন্ত একটি মানুষকে ধরে নিঃশব্দে জঙ্গলে ফিরে যেতে পারে—এও দেখা গিয়েছে, তবে করবেটের মানুষখেকোদের মত গ্রামে গ্রামে ঘুরে ত্রাসের সঞ্চার করতে দেখা যায় না, আবার এও দেখা গিয়েছে, যে বনে প্রচুর হরিণ আর বরা থাকা সত্ত্বেও মানুষ ধরার আকর্ষণ এদের খুবই—অর্থাৎ স্বাভাবিক আহার বা শিকার নেই বলেই যে মানুষের উপর আসক্তি, তা নয়। আবার বাঘের হাতে প্রত্যক্ষভাবে মারা না পড়লেও পরোক্ষভাবে মানুষ মরে। আঁচড়ে আছে বিষ যাতে গ্যাংগ্রীন হয়ে লোক মরে। বাঘে ছুঁলে আঠার ঘা কথাটা মোটেই রূপক নয়।

    যাই হোক মোদ্দা কথা হচ্ছে যে মানুষখেকো বাঘ মারাটা সহজ নয়—আর অনেক সময় সাপুড়েও যেমন সাপের কামড়ে মারা যায়, তেমনি অনেক ঝানু শিকারীও মানুষখেকো (man eater) মারতে গিয়ে বাঘের বলি হয়ে পড়ে। কাজেই করবেট সাহেবের এ বিষয়ে কৃতিত্ব অসাধারণ—বার বার তিনি বিপদের মুখে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন—সাধারণ দরিদ্র গ্রামবাসীর দুঃখ দুর্দশা দূর করতে, এবং প্রায় ২৫-৩০টি মানুষখেকো বাঘ মেরে—বিশেষ করে গাড়োয়াল আর কুমায়ুন জেলায় শেষ করেছিলেন—ব্যাপারটা অনেকটা পরশুরামের পৃথিবীকে নিঃক্ষত্রিয় করার মতই। একসময়ে ষাট হাজার কেদারবদরী তীর্থযাত্রী বাঘের ভয়ে ভয়ে অতি অস্বস্তিতে ভ্রমণ করত—৭-৮ বছর ধরে দুটি চিতা ৫২৫টি লেখকে ভবসিন্ধু পার করে দিয়েছিলেন— তখন করবেট এই দানবদুটিকে মেরে সকলের ধন্যবাদার্হ হয়েছিলেন।

    মানুষখেকোর পশ্চাদ্ধাবন সাহসের কাজ-ত’ বটেই—কিন্তু এর জন্য চাই সদাজাগ্রত চক্ষু কর্ণ। কোথায় কাঁটার আগায় একটু হলদে লোম, কোথাও ঝোপের গায়ে এক টুকরো সুতো, কোথাও রাস্তার ওপরে এক ফোঁটা রক্ত, বা একটা পাতা ঝুলে পড়েছে, এসব দেখেই (যা অন্য লোকের চোখেই পড়বে না) ঠিক করতে হবে বাঘ কোন দিকে গেছে। আর তাকে হতে হবে ব্যাঘ্র জ্যোতিষী বা ব্যাঘ্র পদরেখাবিদ- অর্থাৎ থাবার ছাপ দেখে ধরতে হবে সে বাঘ, না বাঘিনী না চিতা না ছোক্বা বাঘ। বাঘিনী হলে সঙ্গে বাচ্চা আছে কিনা। এসব না জানলে মারার পরিকল্পনাটা ঠিক হবে না—থাবার ছাপ কত পুরনো—সাধারণ দুলকি চালে হেঁটেছে না দৌড়েছে—সবই নির্ভুলভাবে জানতে হবে—এবং অভিজ্ঞ শিকারীর কাছে অবশ্য এটা সমস্যাই নয়। অনেক সময় শিকারের টোপের আঘাত দেখেও বলা যায় যে এটি আনাড়ী বাঘের কাণ্ড, না ঝানু বাঘের, বাঘের না বাঘিনীর না চিতার, যে বাঘটির পেছনে ধাওয়া করতে হবে তার ইতিবৃত্ত এই ভাবে জানতে পারলে শিকার করার সুবিধা হয়। ২-৩টি থাবার ছাপ থাকলে, যার পিছনে দৌড়নো হচ্ছে সেটি ওর মধ্যে আছে কিনা দেখতে হবে। অবশ্য এই ধরণের সামগ্রিক বিদ্যা যা খানদানী শিকারীর আয়ত্তে (ব্যাঘ্র-দর্শন), তা এককালে আদিম মানুষের সকলেরই ছিল। কিছুদিন আগে অস্ট্রেলিয়ার এক জেল থেকে কয়েকটি দুর্ধর্ষ খুনে পালায়। সন্ধানী কুকুর দিয়ে কোন কিনারা করা গেল না—কারণ রাস্তার অনেকটা ছিল পাথরের ওপর দিয়ে। শেষে কর্তৃপক্ষ ওখানের আদিম বুশমেন জাতির (যাদের বিশিষ্ট হাতিয়ার, বুমেরাং এর কথা আমরা জানি) দুটি লোক যোগাড় করে এদের ধরা গেল। এরা পাথরের ওপর কোথায় একটু কুটো বেঁকে · গেছে বা বালুকণা সরে গেছে—ইত্যাদি দেখেই পথের নিশানা পেয়েছিল। অর্থাৎ চিহ্ন রেখে গিয়েছিল খুনেরা—তবে তা দেখার চোখ চাই তো।

    করবেটের পশু পাখির স্বভাব সম্বন্ধে ছিল সম্যকজ্ঞান (না থাকলে ভাল শিকারী হতে পারতেনই না), কারণ বাল্য জীবন তাঁর কেটেছে হিমালয়ের পাদদেশে, শালবনে, যেখানে পশু-পাখি বাঘ ভাল্লুক এবং হরিণের সঙ্গে তাঁর হয়েছে সাক্ষাৎ পরিচয়। তিনি সেখানে শিখেছেন পশু পাখীর বিভিন্ন ডাকের অর্থ। করবেট সাহেবের প্রকৃতি কিভাবে তাকে একবার খুব সাহায্য করেছিল তা সংক্ষেপে বলি : বিগত প্রথম মহাযুদ্ধের পরেই তাঁর প্রথম বার বিলেত যাবার সৌভাগ্য হয়। সেখানে পৌঁছেই সন্ধ্যায় পুরান অভ্যাস মত হাঁটতে বেরিয়েছেন, কিন্তু ফিরবার সময় গোল বাধল—কারণ ৫ মাথার একটি রাস্তা বেছে নিতে হবে। পাঁচটি ঘুরে তিনি একটি বেছে নিলেন কারণ অবচেতন মনে লক্ষ করেছিলেন রাস্তায় বেশ চাল ছিল। অন্য কোন লোকের পক্ষে এটি লক্ষ করা সম্ভব হত কিনা জানি না। পরবর্তী জীবন মানুষখেকোদের শেষ করে তিনি গাড়োয়াল-কুমায়ুন জনমানসে প্রায় ‘ত্রাহি মধুসূদন’ হয়ে পড়েছিলেন—বিশেষত ব্যাঘ্রভীত পল্লীবাসীর কাছে। তাই, যখন এই অঞ্চলে, অভয়ারণ্য স্থাপিত হল তখন দেশের লোক পরে নাম দিল করবেট পার্ক। এখানে হল হরিণ আর বাঘের বেঁচে থাকার মত কিছু বন। অবশ্য, সম্প্রতি রামগঙ্গা জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের কল্যাণে এর বেশ খানিকটা জায়গা জলমগ্ন হবে—যার জন্য লোকসান বুঝবে হরিণ গোষ্ঠী—কারণ সমতল তৃণভূমির বেশির ভাগটাই যাচ্ছে, আর তাতে বাঘের আহার্যও কমবে, তবু ত’ অভয়ারণ্য রইল, যা ভবিষ্যৎ বন্য প্রাণীর শেষ আশা ভরসার নিকেতন।

    বলা হয়েছে বাঘের দেশ হল হিমালয়ের পাদদেশের শালবন—হরিদ্বার থেকে ব্রহ্মপুত্র পর্যন্ত সব অঞ্চল (নেপালের তরাই অঞ্চলও এরই মধ্যে।) তাই হরিদ্বারের কাছে গঙ্গার ধারের বনের ছবির সঙ্গে উত্তরবঙ্গের তিস্তা নদী প্রাদেশিক বনাঞ্চল এক রকমই লাগবে—একই হিমালয়ের অংশ সন্দেহ নেই। এখানেও দেখা যাবে গাছের আগায় ময়ুর, যে বাঘ দেখে ডাক শুরু করে, অন্য পশু পাখিদের সাবধান করে দিতে। এখানে আছে নানা জাতের ফিঙে—যারা দেখা যাবে, অনেক সময়ে চিল-বাজপাখির পেছনে ধাওয়া করেছে—ওরা হয়ত এদের বাসার বেশি কাছে ঘোরাফেরা করছিল। আবার ফিঙের এই জঙ্গী স্বভাবের জন্য ছাতারে বগেড়ি, ফুৎকি ছোট ছোট পাখির দল এদের বাসার আশেপাশে বাসা বাঁধে আত্মরক্ষার জন্য। শীতের দিনে দেখা যাবে অদ্ভুত লাল-কাল রঙের সাতসয়ালী বা আলতাপরী। আছে নানা জাতের বুলবুল, ভগীরথ। মাঝে মাঝে চমকে দিয়ে শোনা যাবে ক্যাকো ক্যাকো রাজ ধনেশের ডাক। গাছের সুউচ্চ ডালে হয়ত বাঘা ঠোঁট ওয়ালা সাদা কালপাখি দেখতে পাওয়া যাবে। কপাল ভাল থাকলে দেখা যাবে নীল পরী। নীল আভা, যেন কোন উচ্চ স্তরের রং ব্যবসায়ীর মূর্তিমান বিজ্ঞাপন। ঘন জঙ্গলে দেখা যাবে শা বুলবুল, যার হাত খানেক লম্বা সাদা লেজ অবিশ্বাস্য রকমের সুন্দর। বহু রকমের কাঠঠোকরা আর মাছরাঙাও দেখা যাবে। কোথাও জিজ্ঞাসা চিহ্নের মত ফসলা রঙের চারফুট খাড়াইয়ের বক, গুড়ি মেরে দেড় ফুট হয়ে তপস্বীর মত চুপ করে জলে দাঁড়িয়ে আছে ঠায়, একটি ছোট মাছের দ্বারা ধ্যানভঙ্গের অপেক্ষায়। আর অবশ্য আছে রঙ-এর ফোয়ারা ছড়ান ময়ূর আর বনমোরগ। কখন বা তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করবে সবুজ রঙের নরুন পাখির দিকে—ডালে বা দড়িতে সারি দিয়ে বসে থাকে—ডাইভ দিয়ে পোকা ধরে—উড়ন্ত অবস্থায় মনে হয় যেন কেউ ডার্ট (Dart) ছুঁড়ছে। সৌন্দর্যের দিক দিয়ে বাংলার তরাই হরিদ্বার অঞ্চলের চেয়ে কম আকর্ষণীয় বা রমণীয় নয়। এখানেও আছে সৌন্দর্যের ফাঁকে ফাঁকে হাতি, গউর বা ভারতীয় বাইসন, ভাল্লুক আর বাঘের দল। তবে অবশ্য মানুষখেকো নেই।—আছে কেঁদো বাঘ। অনেক সময় নানা কারণে বাঘের হাতে মানুষ যে মারা পড়ে না এমন নয়, তবে তারা ঠিক মানুষখেকো হয়ে দাঁড়ায় না বড় একটা অনেকের ধারণা সুন্দরবনের বাঘ বিরাট আর তারা হল রয়্যাল বেঙ্গল। অবশ্য রয়্যাল বেঙ্গল কথাটি কোন শিকারীর উর্বর মস্তিষ্কপ্রসূত—আসলে এরকম কোন কথা নেই। আর কাদায় হাঁটতে হয় তথা শিকার ধরে বেঁচে থাকতে হয় বলে সুন্দরবনের বাঘ হিমালয়ের বাঘের চেয়ে আকার বা ওজনে খাটো। তরাই অঞ্চলের বাঘ বাস্তবিকই রাজকীয়।

    করবেটের শিকার কাহিনীর মধ্যে বিশেষ লক্ষণীয় হল তিনি কত দক্ষ শিকারী ছিলেন আর কত ছিল তাঁর কষ্টসহিষ্ণুতা আর ধৈর্য—যা না থাকলে তিনি নিশ্চয়ই উচ্চমানের শিকারী হতে পারতেন না। তবে শিকার তিনি করতেন সাধারণ লোকের জীবন বিপদমুক্ত করতে—অর্থাৎ মানুষখেকোদের হাত থেকে তাদের রক্ষা করতে। আসলে তিনি ছিলেন রক্ষণশীল অর্থাৎ conservationist, এতে অবাক হবার কিছু নেই, কারণ উচ্চস্তরের শিকারীদের অনেকেই নাম করা conservationist হয়েছেন—জীবজগতে পরস্পরের প্রতি যে পারিপার্শ্বিক সম্বন্ধ রয়েছে তার আসল রূপ তারাই শেষে উপলব্ধি করতে পারেন।

    করবেট জাতে সাহেব (শ্বেতকায়) হলেও ছিলেন নিম্নবিত্ত ঘরের, পড়া স্কুলেই শেষ এবং বাল্যকাল কেটেছে নৈনিতালের তরাই অঞ্চলের বনে, সাধারণ, দরিদ্র কুমায়ুনীদের সঙ্গে—যাদের সঙ্গে তার শেষ পর্যন্ত ছিল অন্তরের টান, এবং যাদের জন্য তিনি জীবন বিপন্ন করে বারবার মানুষখেকোর পিছনে ঘুরেছেন। তাদের যথাসাধ্য আর্থিক সাহায্য করতেন। জীবন সংগ্রামে পাথেয় ছিল বিহার মোকামা ঘাটে রেলের ফেরী স্টিমারে কয়লা বহনের তদারক করা। মাহিনা সামান্যই, তবু মেহনতী মানুষ যারা তার সঙ্গে কাজ করছে—তাদের দুঃখ কষ্ট, দেখলে তিনি তার স্বল্প সঞ্চয় বার বার উজাড় করে ঢেলে দিয়েছেন—তাঁর মানবিকতা সত্যই উচ্চ মার্গের। এমনকি তার শিকার কাহিনীর লব্ধ রয়্যালটি, পুস্তক প্রকাশনী সংস্থার মেহনতী মানুষদের জন্য দান করে গেছেন।

    তিনি এদেশকে এবং এদেশের জনসাধারণকে আপন বলেই জেনেছিলেন। তবে শেষ বয়সে কেন আফ্রিকায় স্থায়ী বসবাস করলেন কে জানে! করবেট ছিলেন অকৃতদার। সঙ্গে থাকতেন তাঁর দিদি-আর তিনিও বিবাহ করেননি। কারও মতে যে কোন কারণেই হোক স্বাধীন ভারতের কোন কোন সামাজিক পরিবর্তনকে তিনি মেনে নিতে পারেননি—এবং যার জন্য ভাইকেও দেশ ছেড়ে যেতে হল হয়ত। আবার কারও কারও অনুমান তিনি যুদ্ধের জন্য প্রচুর কুমায়নী আর গাড়োয়ালী সৈন্য সংগ্রহ করে দিয়েছিলেন—যাদের মধ্যে অনেকে আর ফিরে আসেননি। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাশীল এবং তাকে ভালবাসে এমন সব শত শত গৃহস্থের কাছে তাঁর রোজ মুখ দেখাতে বেদনায় দুঃখে বুক ফেটে যেত—যা সইতে না পেরে শেষটায় ‘দেশত্যাগী’ হলেন বুঝি!

    করবেটের স্মৃতি বয়ে করবেট পার্ক রইল- রামগঙ্গা পরিকল্পনায় কিছুটা ডুবলেও বাকিটা যে সগৌরবে টিকে আছে তা নয়। করবেট ছিলেন naturalist এবং তাঁর জীবন কেটেছে এই অঞ্চলেই সেদিক দিয়ে অভয়ারণ্যের নাম সার্থক। করবেটের শিকারী হিসেবে এবং পর্যবেক্ষক হিসেবে রুদ্রপ্রয়াগের মানুষখেকো চিতার অবিস্মরণীয় কাহিনীটি আবার স্মরণ করা যেতে পারে। বাঘ আজ এক জায়গায় লোক মারে ত অন্যদিন মারে দশমাইল দূরে, আজ অলকানন্দার এপারে ত কাল ওপারে, ৫০০ বর্গমাইল পাহাড়ী এলাকা জুড়ে সে চালিয়েছে তার কঠিন শাসন। কিন্তু পর্যবেক্ষণের সাহায্যেই তিনি কর্মপন্থা ঠিক করে ফেললেন। একদিন দেখলেন যে এক জায়গায় মানুষ মেরে বাঘটি অলকানন্দার অন্যপারে যায়নি—করবেট সিদ্ধান্ত করলেন যে বাঘটি পুল দিয়ে পার হয় (অন্যরা অনুমান করত সে সাঁতার দিয়ে অলকনন্দা পার হয়—যা ছিল করবেটের কাছে একদম অবিশ্বাস্য—কারণ অলকানন্দার ফেনিল জলরাশি তার খরস্রোতের সম্যক পরিচয় দিতে অন্ততঃ কার্পণ্য করে নাই)। যাই হোক, সেই পুলের মুখে প্রতীক্ষা করে তিনি বাঘের হদিশ শেষ পর্যন্ত পেলেন এবং সেই সূত্র ধরেই তাকে শেষ করলেন। সব পড়ে মনে হবে হয়ত যেন তিনি গেলেন আর এক একটি বাঘ খুঁজে মেরে ফেললেন। এর কারণ হল, তিনি তবু বলেছেন সেই সব শিকার কাহিনীর কথা যেগুলিতে তিনি হয়েছেন সফল যার তিনগুণক্ষেত্রে হয়ত খুনের কিনারাই করতে পারেননি। তাছাড়া কোন কোনটিতে মাসাধিক বা আরও বেশি সময় কেটে গেছে। গল্পের আকর্ষণের জন্য হয়ত সময়টা চোখে পড়ে নি। এর পিছনে যে একটি মানুষের দিনের পর দিন কতখানি কষ্ট বরণ থাকতে পারে তা কি আমাদের মনে হবে? হলে অবশ্য লেখকের রচনা সার্থক। বলে রাখা ভাল খুব কম শিকার কাহিনীই আছে যার আকর্ষণ এই সব আখ্যায়িকার চেয়ে বেশি।।

    কৃষ্ণচন্দ্র রায় চৌধুরী।।
    (মুখ্য বনপাল : পশ্চিমবঙ্গ)

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleরামায়ণের উৎস কৃষি – জিতেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়
    Next Article জীবনযাপন – জীবনানন্দ দাশ
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    আলো হাতে সেই মেয়েটি – তপন বন্দ্যোপাধ্যায়

    August 20, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    আলো হাতে সেই মেয়েটি – তপন বন্দ্যোপাধ্যায়

    August 20, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Our Picks

    আলো হাতে সেই মেয়েটি – তপন বন্দ্যোপাধ্যায়

    August 20, 2025

    গোয়েন্দা গার্গী সমগ্র – তপন বন্দ্যোপাধ্যায়

    August 20, 2025

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.