Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    রাজমালা বা ত্রিপুরার ইতিহাস – শ্রী কৈলাসচন্দ্ৰ সিংহ প্রণীত

    August 20, 2025

    আলো হাতে সেই মেয়েটি – তপন বন্দ্যোপাধ্যায়

    August 20, 2025

    গোয়েন্দা গার্গী সমগ্র – তপন বন্দ্যোপাধ্যায়

    August 20, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    জিম করবেট অমনিবাস (অখণ্ড) – মহাশ্বেতা দেবী সম্পাদিত

    জিম করবেট এক পাতা গল্প1380 Mins Read0

    ০১. চোদ্দ জন ছেলেমেয়ে

    জাঙ্গল লোর

    ০১.

    আট থেকে আঠার বছর বয়সের চোদ্দ জন ছেলেমেয়ে আমরা কালাধুঙ্গির বোর নদীর পুরনো কাঠের পুলের এক কোণে হেলান দিয়ে বসে ড্যানসির ভূতের গল্প শুনছি। আশপাশের ঝোপ-জঙ্গল থেকে কাঠকুটো এনে আমরা রাস্তার মাঝে আগুন জ্বেলেছিলাম। আগুন নিভে গেছে। লালচে আঁচ তখনো গনগন করছে। অন্ধকার ঘন হয়ে আসছে। ড্যানসি যে তার গল্প বলার উপযুক্ত পরিবেশ বেছে নিয়েছে তা বোঝা যাচ্ছে। কেননা জনৈকা সন্ত্রস্ত শ্রোত্রী তার সঙ্গিনীকে সমানে ধমকাচ্ছে, ‘অমন করে বার-বার পেছন দিকে তাকিয়ো না, বড় অস্বস্তি বোধ হয়।

    ড্যানসি হল আয়ল্যান্ডের মানুষ। হাজার রকম অন্ধবিশ্বাসে তার আপাদমস্তক আচ্ছন্ন। আর এ সমস্ত সে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করত বলেই ভূতের গল্প তার মুখে অত বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠত। তার সে-রাত্রের গল্পের বিষয়বস্তু হল যত সব আপাদমস্তক ঢাকা দেওয়া মূর্তি, হাড়ের ঠকঠকানি, রহস্যজনক উপায়ে দরজা খুলে যাওয়া আর বন্ধ হওয়া, আর পূর্বপুরুষদের বাড়ির প্রাচীন কাঠের সিঁড়িতে মমম্ শব্দ। কিন্তু পূর্ব-পুরুষদের ভূতে-পাওয়া-বাড়িঘর দেখবার সম্ভাবনা তো আমার নেই, ড্যানসির ভুতুড়ে গল্প শুনে তাই আমার কোনো ভয় হত না। এইমাত্র সে তার সবচেয়ে রক্ত-জমাট করা গল্প শেষ করেছে আর মেয়েটি আবার তার নার্ভাস সঙ্গিনীকে পেছন ফিরে তাকাবার জন্যে ধমক দিয়েছে, এমন সময় একটা বুড়ো শিঙাল পেঁচা একটা বাজ-খাওয়া হলুদ গাছের সবচেয়ে উঁচু ডাল থেকে গলা ছেড়ে ডেকে উঠল, তারপর বোর নদীতে মাছ আর ব্যাঙ ধরার নৈশ অভিযানে বেরিয়ে পড়ল। যে মরা গাছটাকে নিশানা করে আমরা গুলতি আর প্রজাপতির জাল নিয়ে অভিযানে বেরোতাম, সেই লতায় ছাওয়া মরা গাছটার ডালে বসে সারাটা দিন সে ঝিমোয়। কাক বা অন্য যেসব পাখি পেঁচাঁদের খেলিয়ে মজা পায়, লতার আড়ালে সে তাদের দৃষ্টি এড়িয়ে নিশ্চিন্ত থাকে। পেঁচার এই ডাককে অজ্ঞ লোকে বাঘের ডাক বলে ভুল করে থাকে। এই ডাকে সাড়া দেয় তার সঙ্গিনী, সে থাকে (মিলনের সময় ছাড়া অন্য সময়ে) খালের ধারের একটা পিপল গাছের উপরে। এই ডাককে অজুহাত করে ড্যানসি তার ভূতের গল্প শেষ করে বশীর গল্প শুরু করে, কারণ তার মতে বশীরা হল ভূতের চেয়েও বেশি বাস্তব এবং বেশি ভয়াবহ। ড্যানসি বলে বনশী হল এক ধরনের পেত্নী, গভীর বনে তার বাস; আর সে এমন সাংঘাতিক যে তার নাম উচ্চারণ করলেই শ্রোতার ও তার আত্মীয়দের সমূহ বিপদের সম্ভাবনা এবং তাকে চোখে দেখলেই নির্ঘাত মৃত্যু। ড্যানসি বলে বশীর ডাক একটা একটানা দীর্ঘ তীক্ষ্ণ চিৎকার; সাধারণত অন্ধকার রাত্রে ঝঞ্ঝার সময়েই তার সেই চিৎকার শোনা যায়। বশীর ভয়াবহ গল্পগুলোর একটা আকর্ষণ আমার কাছে ছিল, কারণ যেসব জঙ্গলে আমি পাখি, পাখির ডিম আর প্রজাপতির সন্ধানে ঘুরে বেড়াতাম এইসব গল্প সেইসব জঙ্গল নিয়েই।

    আয়ার্ল্যাণ্ডে থাকতে ড্যানসি যে বনশী শুনেছিল, তার কী চেহারা সে দেখেছিল আমার জানা নেই; তবে, কালাধুঙ্গির জঙ্গলে তার শোনা দুটো বশীর চেহারা আমি দেখেছি। এই দুটোর একটার কথা আমি পরে বলব, আর অন্যটার কথা তো হিমালয়ের পাদদেশের বাসিন্দাদের সকলেরই জানা আছে, ভারতের অন্যত্রও নেহাত অজানা নয়; সে হল চুরাইল। সমস্ত অপদেবতাদের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ এই চুরাইল দেখা দেয় নারী রূপে। সাপ যেমন করে পাখিকে সম্মোহিত করে, কোনো মানুষের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থেকে সেও ঠিক তেমনিভাবে তাকে সম্পূর্ণ সম্মোহিত করে ফেলে। তার পায়ের পাতা আবার উল্টো দিকে ফেরানো। পেছন দিকে হাঁটতে-হাঁটতে সে তাকে মৃত্যুর দিকে টেনে নিয়ে যায়। তাই, এই স্ত্রীলোকের দেখা পাবার আশঙ্কা হলে তা এড়াবার একমাত্র উপায় হল–হাত দিয়ে হক, এক টুকরো কাপড় দিয়ে হ’ক কিংবা যদি ঘরের ভিতরে হয় তাহলে কম্বল-মুড়ি দিয়ে হক চোখদুটোকে ঢেকে ফেলা।

    গুহা-মানবের যুগের মানুষ যেমনই হয়ে থাকুক/হক, আজকের আমরা সবাই সূর্যের রৌদ্রের সন্তান। দিনের বেলা আমরা দিব্যি থাকি। আমাদের মধ্যে যে সবচেয়ে ভিতু, সেও প্রয়োজনে যে-কোনো পরিস্থিতির মোকাবিলা করার সাহস পায় বুকে। কয়েক ঘন্টা আগেও যে-কথা ভাবলে ভয়ে শরীর শিউরে উঠত, আমরা ঠাট্টা করে, হেসে তা উড়িয়ে দিতে পারি।

    যখন রোদ পড়ে যায়, আমাদের ঘিরে নেমে আসে রাত। চোখের ভরসায় এতক্ষণ চলেছে, এখন আর তা চলে না। মোহিনী-কল্পনা এখন আমাদের ভয়ে বিবশ করে ফেলে। অতি সুসময়েও সে জাদুকরী ভেলকিবাজি দেখাতে পারে। কল্পনা-প্রবণতা আর অলৌকিকে দৃঢ়বিশ্বাস দুয়ে যখন মিলেমিশে যায়, তখন-ঘন জঙ্গলের বুকে যাদের বাস; পা যাদের পথ-চলার একমাত্র বাহন; রাত্রে পথ চলতে পাইনকাঠের মশাল, অথবা তেল মিললে হাতলণ্ঠনের এতটুকু আলো যাদের একমাত্র ভরসা; তারা। যে রাতের আঁধারকে ভয় পাবে তাতে তো অবাক হবার কিছু নেই।

    মাসের পর মাস ওই সব মানুষের সঙ্গে বাস করার আর কেবল তাদেরই ভাষায় কথা বলার ফলে, ওদের অন্ধবিশ্বাস ড্যানসির অন্ধবিশ্বাসকে ছাপিয়ে বড় হয়ে উঠেছিল। আমাদের পাহাড়ীদের সাহসের অভাব ছিল না। আর ড্যানসিও প্রচুর সাহসী; কিন্তু এইসব অন্ধবিশ্বাসের ফলে পাহাড়ীরা বা ড্যানসি কেউই কখনো খোঁজ করে দেখে নি কোন্টা পাহাড়ীদের মতে চুরাইল আর কোন্টা ড্যানসির মতে বনশী।

    কুমায়ুনে অত বছর বাস করে আর শত-শত রাত জঙ্গলে কাটিয়ে মাত্র তিন বার আমি চুরাইলের ডাক শুনেছি, তিনবারই রাত্রে, আর দেখেছি মাত্র একবার।

    তখন মার্চ মাস। সবেমাত্র সরষের ফসল কাটা হয়েছে, চমৎকার ফলেছে এবার। যে গ্রামে আমাদের কুটির, পুরো গ্রামটাই আনন্দের উচ্ছ্বাসে প্রাণময় হয়ে উঠেছে। স্ত্রী-পুরুষ সবাই গান ধরেছে, ছেলেমেয়েরা এ-ওকে ডাকছে। পূর্ণিমার আর দু-একদিন মাত্র বাকি, চাঁদের আলো প্রায় দিনের মত ফুটফুটে। ম্যাগি আর আমি ভাবছি ডিনারের ব্যবস্থা করতে বলব, আটটা বাজে–এমন সময় তীক্ষ্ণ আওয়াজে রাতের বাতাস খান-খান করে চুরাইলের ডাক শোনা গেল। আর সঙ্গে সঙ্গে স্তব্ধ হয়ে গেল গ্রামের সমস্ত শব্দ। আমাদের কুটির থেকে পঞ্চাশ গজ মত তফাতে, প্রাচীরের ডান কোণে আছে বহু প্রাচীন এক হলদু গাছ। যুগ যুগ ধরে কত শকুন, ঈগল, বাজপাখি, চিল আর চকচকে কাস্তে-চরা তার মগডালের ছাল জীর্ণ করে ডালগুলোকে মেরে ফেলেছে। উত্তুরে হাওয়ার ভয়ে সামনের দরজাটা বন্ধ ছিল, আমি আর ম্যাগি বেরিয়ে গেলাম সেটা খুলে বারান্দায়, আর অমনি চুরাইলটা আবার ডেকেউঠল। শব্দটা এল হলদু গাছটা থেকে। চাঁদের উজ্জ্বল আলোয় দেখা গেল চুরাইলটা গাছের সবচেয়ে উঁচু ডালে বসে রয়েছে।

    কোনো-কোনো শব্দকে কিছু অক্ষর বা কথা সাজিয়ে প্রকাশ করা সম্ভব–যেমন, মানুষের ডাকা ‘কুই’ আর কাঠঠোকরার ‘ট্যাপ-ট্যাপ-ট্যাপ’ শব্দ। কিন্তু চুরাইলের ডাক সেভাবে শব্দে প্রকাশ করা আমার পক্ষে অসম্ভব। যদি বলি এর সঙ্গে সাদৃশ্য আছে কোনো নিপীড়িত আত্মার, বা কোনো যন্ত্রণার্ত মানুষের, তাতে পাঠকের কিছুই বোধগম্য হবে না, কারণ তা শোনবার অভিজ্ঞতা পাঠকের বা আমার হয় নি। জঙ্গলের কোনো শব্দের সঙ্গেও এর কোনো তুলনা সম্ভব নয়। কারণ এ শব্দ একেবারে অন্যজাতের। পার্থিব জগতের সঙ্গে যেন এর কোনো সম্বন্ধ নেই। এ শব্দ শুনলে রক্ত জমাট হয়ে যায়, হৃদস্পন্দন বন্ধ হয়ে আসে। আগে যতবার এ ডাক শুনেছি, বুঝেছি এ কোনো পাখির ডাক–হয় পেঁচার, কিংবা কোনো যাযাবর পাখির; কারণ কুমায়ুনের সমস্ত পাখি আর তাদের ডাক আমার জানা ছিল; আমি জানতাম আমাদের বনের কোনো প্রাণীর ডাক এ নয়। ঘরে গিয়ে দূরবীন নিয়ে ফিরে এলাম। প্রথম মহাযুদ্ধের সময় সৈন্যবাহিনীর অবস্থিতি নির্ণয়ের জন্যে এর ব্যবহার হত, সুতরাং বলা বাহুল্য জিনিসটা ভাল। এটা চোখে লাগিয়ে খুব ভাল করে লক্ষ্য করলুম। যা দেখলাম তার একটা বর্ণনা দিচ্ছি–এই আশায় যে, আমার চেয়ে ওয়াকিবহাল কোনো মানুষ হয়তো তা থেকে একে চিনতে পারবে।

    (ক) সোনালী ঈগলের থেকে এর আকৃতি একটু ছোট।

    (খ) লম্বা লম্বা পায়ে এ সোজা দাঁড়িয়ে থাকে।

    (গ) এর ল্যাজ ছোট, কিন্তু পেঁচার ল্যাজের মত অত ছোট নয়।

    (ঘ) এর মাথা পেঁচার মাথার মত অত গোল বা অত বড় নয়, ঘাড়ও তেমন ছোট নয়।

    (ঙ) এর মাথায় কোনো ঝুঁটি বা শিং নেই।

    (চ) যখন ডাকে (ঠিক আধ মিনিট অন্তর এ ডাকে) মাথাটা আকাশের দিকে ফিরিয়ে, হাঁ করে ডাকে।

    (ছ) এর রঙ একেবারে কালো, কিংবা হয়তো ঘোর বাদামী-চাঁদের আলোয় অমনি কালো দেখায়।

    আমার বন্দুকের তাকে ছিল একটা ২৮ বোর বন্দুক আর একটা হালকা রাইফেল। বন্দুকটা এখন কাজে আসবে না, কারণ পাখিটা তার নাগালের বাইরে; আর রাইফেলটা ব্যবহার করতে আমার সাহস হচ্ছিল না, কারণ চাঁদের অস্পষ্ট আলোয় তা নির্ভুল তাক করার সম্ভাবনা অল্প। তাই, যদি আমি ব্যর্থ হই, তাহলে যারা গুলির শব্দ শুনবে তারা আরও নিশ্চিত হবে যে এ ডাক যে ডেকেছে নিশ্চয় সে কোনো অপদেবতা, রাইফেলের গুলি পর্যন্ত যার কিছু করতে পারে না। বার-কুড়ি অমন ডাকার পর পাখিটা ডানা মেলে গাছ ছেড়ে উপরে উঠে রাত্রির আকাশে অদৃশ্য হয়ে গেল।

    সে-রাতে আর গ্রাম থেকে কোনো সাড়া মিলল না। পরের দিন কেউ চুরাইলের নাম উচ্চারণ করল না। আমি যখন ছোট ছিলাম, আমার বন্ধু, চোরাই শিকারী কুঁয়ার সিং আমায় সাবধান করে দিয়েছিল, ‘বাঘকে কখনো বাঘ বলে ডেকো না, ডাকলেই সে এসে হাজির হবে। সেই একই কারণে এই রাইয়ের মানুষরা কখনো চুরাইলের নাম নেয় না।

    শীতের ক-টা মাস কালাধুঙ্গিতে কাটাতে আসা আমাদের দুটো বড় পরিবারের অল্পবয়সীদের সংখ্যা চোদ্দ,–অবশ্য আমার ছোট ভাইকে বাদ দিয়ে, কারণ রাত্রে বনে আগুন জ্বালিয়ে বসে মজা করা বা নদীতে স্নান করার বয়স তার হয় নি। এই চোদ্দ জনের মধ্যে সাত জন মেয়ে তাদের বয়স নয় থেকে আঠার, আর সাত-জন ছেলে, তাদের বয়স আট থেকে আঠার–আমি হলাম বয়সে সবার ছোট। এবং ছেলেদের, মধ্যে সবচেয়ে ছোট হওয়ার ফলে এমন কতকগুলো কাজ আমার ঘাড়ে পড়ত যা আমার অত্যন্ত বিশ্রী লাগত। আমাদের জীবনযাত্রার ধরনটা ছিল এক যুগ পুরনো; আমাদের চৌহদ্দির একটা সীমানা ধরে যে খাল, সে খালে মেয়েরা রবিবার ছাড়া প্রত্যেকদিন স্নান করতে যেত (কেন যে মেয়েদের রবিবার স্নান করা বারণ, আমি জানি না), তখন এমন একজন পুরুষমানুষকে তাদের সঙ্গে যেতে হত যার বয়স এতই কম যে গোঁড়া পিসিমারও আপত্তি করার কারণ থাকত না। এক্ষেত্রে আমিই ছিলাম সেই হতভাগ্য। আমার কাজ ছিল মেয়েদের তোয়ালে আর রাতের পোশাক বয়ে নিয়ে যাওয়া (তখনকার দিনে সাঁতারের পোশাক ছিল না), আর কোনো পুরুষ ওদিকে এলে মেয়েদের সাবধান করে দেওয়া। জঙ্গলে কাঠ কুড়োতে বা দরকার হলে খালটা মেরামত বা পরিষ্কার করার কাজে মানুষ এপারে ওপারে যাওয়া আসা করত, ফলে সেখানে একটা পায়ে-চলা পথ তৈরি হয়ে গিয়েছিল। খালটা ছিল বাঁধানো, দশ ফুট চওড়া আর তিন ফুট গভীর, বাগানে জল-সেচ ব্যবস্থার জন্যে খালের কয়েক গজ পর্যন্ত ছ-ফুট গভীর করা হয়েছিল। এটা করিয়েছিলেন কুমায়ুনের রাজা জেনেরাল স্যার হেনরি র‍্যামজে। প্রতিদিন মেয়েদের নিয়ে যাবার সময় আমাকে সাবধান করে দেওয়া হত, যেন আমি লক্ষ্য রাখি যাতে ওরা কেউ গভীর জলে গিয়ে ডুবে না যায়। পাতলা সুতোর রাত্রিবাস পরে স্রোতের জলে আব্রু বজায় রেখে স্নান করা সহজ কাজ নয়, কারণ যখনই কেউ অসাবধানে তিন ফুট জলে নেমে বসে পড়ে (জলে নামামাত্র সব মেয়েরাই যা করে থাকে), সঙ্গে-সঙ্গে রাত্রিবাস ফুলে মাথার উপর উঠে পড়ে, আর তা দেখে দর্শকেরা স্বভাবতই বিচলিত হয়ে ওঠেন। হামেশাই এমন ঘটত। আমার উপর কড়া হুকুম ছিল, সঙ্গে সঙ্গে অন্য দিকে তাকাতে হবে।

    যখন আমি মেয়েদের পাহারা দিচ্ছি আর দরকার মত থেকে থেকে অন্য দিকে তাকাচ্ছি, অন্য সব ছেলেরা সেই সময়ে গুলতি আর ছিপ নিয়ে খালের যেদিকটা গভীর সেদিকে এগিয়ে চলেছে আর সেই সঙ্গে প্রতিযোগিতা হচ্ছে পথের ধারের শিমূল গাছটার সবচেয়ে উঁচু ফুলগুলো কে গুলতি মেরে নামিয়ে আনতে পারে, বা খালধারের বট গাছে কে সবার আগে গুলতি ছুঁড়তে পারে এই নিয়ে। গুলতি লেগে দুধের মত আঠা গাছের গুঁড়ি বেয়ে চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়তে থাকলেই ধরা হত, লক্ষ্যভেদ হয়েছে। পাখি ধরার আঠা হিসেবে এই আঠাই হল সবচেয়ে ভাল। তা ছাড়া গুলি করার মত কত পাখিই না আছে–কাঞ্চন, দামা, দোয়েল, হলদে পাখি ইত্যাদি, যারা শিমূল ফুলের মধু খায়। তা ছাড়া সাধারণ, স্লেট রঙের, বা লাল-ঝুঁটি মদনা, যারা ওই, ফুল ঠুকরে ঠুকরে সামান্য একটু খেয়ে বাকিটা ফেলে দেয় হরিণ বা শুয়োরের খাদ্য হিসেবে, ঝুটিওলা রঙবাহার মাছরাঙারা, যারা তাড়া খেয়ে খালের জলে আলতো করে ভেসে চলে, আর শিঙাল পেঁচাটা তো আছেই–বোর সেতুর অপর পারে পেঁচাটার জোড়। এই পেঁচাটা থাকত, খালের জলে-ঝুঁকে পড়া পিপল গাছটার একটা ডালে। এই প্রাণীটাকে কক্ষনো কেউ তার গুলতির পাল্লার মধ্যে পায় নি, কিন্তু তা সত্ত্বেও তাকে লক্ষ করে ছেলেরা গুলতি ছুঁড়েই চলেছে। বড় জলায় পৌঁছেই প্রবল প্রতিযোগিতা লেগে যেত ছিপ ফেলে কে কত বেশি মাছ ধরতে পারে। তাদের ছিপ বাড়িতে মা বা বোনের সুতোর বাকস থেকে ধার করা সুতো দিয়ে তৈরি, চেয়ে নিয়ে, আর যাদের বঁড়শি কেনার পয়সা জোটে নি তারা আলপিন বেঁকিয়ে বঁড়শি তৈরি করে নিয়েছে। আর ছিপ হত কঞ্চি কেটে। এই মাছ ধরা চলত যতক্ষণ না সমস্ত টোপ ফুরিয়ে যেত বা অসাবধানে জলে পড়ে নষ্ট হয়ে যেত। সামান্য কয়েকটা ছোট মহাশোল মাছ ধরার পর (কারণ খালে মাছের কোনো অভাব ছিল না) তাড়াতাড়ি জামাকাপড় ছেড়ে সবাই গিয়ে উঠত খালের-জলে-ঝুঁকে-পড়া মস্ত পাথরটার উপর, আর তারপর সংকেত পাওয়ামাত্রই জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যেত, কে আগে খাল পার হতে পারে। সবাই যখন এইসব মজাদার খেলায় ব্যস্ত আমি সেই সময় খালের ধারে এক মাইল দূরে অন্য দিকে তাকিয়ে থাকার হুকুম তামিল করছি। নয়তো মাথায়-কাঠের বোঝ কোনো বৃদ্ধ গ্রামবাসীর আগমনের সংকেত না করার জন্যে ধমক খাচ্ছি। এই জবরদস্তি কর্তব্য পালনের মধ্যে একটাই মজা ছিল, দুই বাড়ির ছেলেদের, বিশেষ করে ড্যানসি আর নীল ফ্লেমিংকে জব্দ করবার জন্যে মেয়েদের গোপন মতলবগুলো সব আমি আগে থেকেই জেনে যেতাম।

    ড্যানসি আর নীল দুজনেই আইরিশ, দু-জনেই পাগলাটে। কিন্তু ওদের মধ্যে মিল ওই পর্যন্তই। ড্যানসি হল বেঁটে, রোমশ, উত্তর আমেরিকার হিংস্র ভাল্লুকের মত প্রচণ্ড বলিষ্ঠ, আর নীল লম্বা, রোগা, লিলি ফুলের মত কোমল সুন্দর। পার্থক্য শুধু এইটুকুই নয়। ড্যানসি কাঁধে গাদা রাইফেল নিয়ে পায়ে হেঁটে বাঘের পিছু ধাওয়া করে বাঘ মারতে পিছপা হয় না। নীল জঙ্গলকে ভয় করে, কেউ শোনে নি সে কোনোদিন বন্দুক ছুঁড়েছে। তাদের মধ্যে মিল ছিল একটাই, দুজনে দুজনকে ঘৃণা করত, কারণ দুজনেই সমস্ত মেয়েদের প্রেমে পাগল। ড্যানসির বাবা ছিলেন জেনারেল, সৈন্যদলে যোগ দিতে রাজী না হওয়ায় তিনি ড্যানসিকে ত্যজ্যপুত্র করেছিলেন। আমার দাদাদের সঙ্গে সে পাবলিক স্কুলে পড়াশোনা করেছিল। বন-বিভাগের চাকরি খুইয়ে সে তখন রাজনৈতিক দপ্তরে কোনোদিন চাকরি পাবার প্রতীক্ষায় অবসর যাপন করছে। নীল চাকুরে লোকে, ডাকঘরে আমার দাদা টমের সহকারী। বিয়ে করবার মত সংগতি স্বপ্নের অতীত এ কথা জানা সত্ত্বেও মেয়েদের প্রতি তাদের টান বা পরস্পরের প্রতি ঈর্ষা একটুও কমে নি।

    খালের ধারের কথাবার্তা যা কানে আসত তা থেকে আমি বুঝেছিলাম যে গতবার কালাধুঙ্গিতে এসে নীল বড় কেউকেটা ভাব নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছে, নিজেকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখেছে। আর ড্যানসি খুব দমে ছিল, নিজেকে সহজে জাহির করে নি। এই অপ্রীতিকর পরিস্থিতির অবসান ঘটাবার জন্যে তখন ঠিক করা হল যে নীলকে বেশ খানিকটা নামিয়ে আনতে হবে আর সেইসঙ্গে ড্যানসিকে একটুখানি তুলে ধরতে হবে। তাই বলে বেশি নয়; নয়তো সেও আবার নিজেকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে শুরু করবে। এই ‘নিজেকে নিয়ে স্বপ্ন দেখা’ বলতে যে কি বোঝায়, আমি ঠিক বুঝতাম না, কিন্তু আমার মনে হত এ নিয়ে কাউকে জিজ্ঞাসা না করাই ভাল। এই দুই উদ্দেশ্য একসঙ্গে সার্থক করতে হলে দরকার একই কৌশলে অতি উৎসাহী নীল আর অতি মন্থর ড্যানসি দু-জনকে জব্দ করা। অনেক পরামর্শের পর যে কৌশল সাব্যস্ত হল তা সার্থক করতে আমার দাদা টমের সাহায্য দরকার। শীতের ক-মাস নৈনিতালে কাজের তেমন চাপ থাকে না, টম তাই নীলকে এক সপ্তাহ অন্তর শনিবার থেকে সোমবার সকাল পর্যন্ত ছুটি দিত। এই ছোট্ট ছুটিটা নীল কাটাত দুই পরিবারের কোনো একটির সঙ্গে, কারণ তার সহৃদয় ব্যবহার আর চমৎকার কণ্ঠস্বরের জন্যে দুই পরিবারেই সে ছিল সুস্বাগত। মতলবমত টমকে চিঠি লিখে জানিয়ে দেওয়া হল যেন সে কোনো অছিলায় আগামী শনিবার নীলকে একটু আটকে রাখে, আর এমন সময় ছেড়ে দেয় যাতে এই পনের মাইলপথ হেঁটে কালাধুঙ্গিতে পৌঁছতে রাত হয়ে যায়। টম নীলকে এমনি একটা আভাস দেবে দেরি দেখে মেয়েরা ভয় পেয়ে তার খোঁজে এগিয়ে আসবে। বিরাট মতলবটা হল, একটা ভাল্লুকের চামড়ায় ড্যানসিকে মুড়ে সেলাই করে দিয়ে মেয়েরা নিয়ে যাবে নৈনিতালের পথে দু-মাইল দূরে যেখানে রাস্তাটা হঠাৎ অনেকখানি বেঁকে গেছে। এখানে একটা পাথরের আড়ালে ড্যানসি লুকিয়ে থাকবে, আর নীল এলেই ভাল্লুকের মত গর্জন করে উঠবে। হঠাৎ ভাল্লুক দেখেই নীল সোজা রাস্তা ধরে দৌড় দেবে, শেষ পর্যন্ত অপেক্ষমানা মেয়েদের মধ্যে গিয়ে পড়বে, তার কাহিনী শুনে তারা কাপুরুষতার জন্যে ধিক্কার দেবে এবং মিনিটখানেক পরে যখন ড্যানসিও এসে পড়বে তখন প্রচণ্ড হাসিতে সবাই ফেটে পড়বে। ড্যানসি প্রথমটা আপত্তি করেছিল কিন্তু রাজী হল যখন সে শুনল যে দিন-পনের আগে এক চড়ুইভাতিতে হ্যাঁমের স্যান্ডউইচের মধ্যে যে লাল ফ্ল্যানেলের টুকরো দিয়ে তাকে বিব্রত করা হয়েছিল সেটা নীলের মতলবেই হয়েছিল।

    কালাধুঙ্গি-নৈনিতাল রাস্তায় গাড়ি-ঘোড়ার চলাচল সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ হয়ে যায়। নির্দিষ্ট দিন সন্ধ্যায় নিজের পোশাকের উপর ভাল্লুকের চামড়ায় মোড়া ড্যানসিকে নিয়ে মেয়েরা নির্দিষ্ট জায়গায় গেল। কখনো চার হাতে পায়ে, কখনো বা দুপায়ে হেঁটে ড্যানসি চলল ওদের সঙ্গে। সন্ধ্যেবেলা বেশ গরম ছিল, ড্যানসি যখন এসে পৌঁছল ঘামে তার সারা শরীর ভিজে গেছে। আর এদিকে একটার পর একটা কাজ এসে পড়ায় নীল খুব বিরক্ত হচ্ছিল। এইভাবে কখন তার বেরোবার সময় উত্তীর্ণ হয়ে গেল। শেষ পর্যন্ত যখন তার ছুটি হল, টম তার শটগানটায় দুটো গুলি পুরে নীলের হাতে দিল। সাবধান করে দিল, যেন নিতান্ত দরকার না হলে গুলি খরচ না করে। নৈনিতাল থেকে কালাধুঙ্গির রাস্তা প্রায় সমস্তটাই ঢালু হয়ে নেমে এসেছে। তার প্রথম আট মাইলের মাঝে-মাঝে শস্য-খেত আর পরের রাস্তাটা মোটামুটি ঘন জঙ্গলের ভিতর দিয়ে। বেশ কিছুক্ষণ হল ড্যানসি আর মেয়েরা তাদের জায়গায় এসে পৌঁছেছে। আলো কমে আসছে ক্রমেই। এমন সময় শোনা গেল নীল মনে জোর আনবার জন্যে গলা ছেড়ে গান গাইতে গাইতে আসছে। গানের শব্দ ক্রমেই এগিয়ে আসছে। মেয়েরা পরে বলেছিল নীল নাকি এত ভাল গান আর কখনো গায় নি। তারপর মোড় ফিরে ড্যানসি যেখানে লুকিয়ে ছিল তার কাছে এসে পৌঁছতেই ড্যানসি পেছনের পায়ে ভর করে ভাল্লুকের মত গর্জন করে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে নীল বন্দুক বাগিয়ে দুটো গুলিই ছেড়ে দিল একসঙ্গে। ধোঁয়ার একটা ঝলক উঠে নীলের চোখ অন্ধ করে দিল। সঙ্গে সঙ্গে নীল দৌড়তে শুরু করল এবং দৌড়তে দৌড়তে শুনতে পেল ভাল্লুকটার পাহাড়ের গা বেয়ে গড়িয়ে পড়ে যাবার শব্দ। সেই মুহূর্তে মেয়েরা দৌড়ে এলে তাদের দেখে নীল বন্দুক আস্ফালন করে বলল এইমাত্র সে একটা প্রকাণ্ড ভাল্লুককে গুলি করে মেরেছে–ভাল্লুকটা তাকে ভীষণভাবে তাড়া করে এসেছিল। সন্ত্রস্ত মেয়েরা যখন জিজ্ঞাসা করল ভাল্লুকটার কী হয়েছে, পাহাড়ের নিচের দিকটা দেখিয়ে দিয়ে নীল তাদের আমন্ত্রণ জানাল তার সঙ্গে গিয়ে তার শিকার দেখতে। বললে কোনো ভয় নেই, ভাল্লুকটা মরে গেছে। মেয়েরা রাজী হল না, নীলকে বলল একাই গিয়ে দেখে আসতে। নীলের তখন কোনো কিছুতেই আপত্তি নেই–মেয়েদের চোখের জল দেখে সে মনে করেছে যে সে ভাল্লুকের হাত থেকে বেঁচে যাওয়ায় তারা আনন্দাশ্রু মোচন করছে। গেল সে একাই। ড্যানসির আর নীলের মধ্যে সেখানে কী কথাবার্তা হয়েছিল আমরা জানি না, তবে অনেকক্ষণ পরে যখন দেখা গেল ওরা রাস্তা দিয়ে এগিয়ে আসছে যেখানে মেয়েরা উদগ্রীব হয়ে প্রতীক্ষা করছিল, তখন ড্যানসির হাতে বন্দুক আর নীলের হাতে ভাল্লুকের চামড়াটা। গায়ে ভাল্লুকের চামড়া থাকায় খাড়াই পাহাড় দিয়ে গড়িয়ে পড়েও ড্যানসি আহত হয় নি। ড্যানসি বললে নীল বুকে গুলি করে তাকে ফেলে দিয়েছে। যে বন্দুকের গুলিতে আর একটু হলেই এক মহা বিপদ ঘটত, কিভাবে সেটা নীলের হাতে আসে, তা শুনে সবাই মজা মাটি করার সমস্ত দোষটা চাপাল অনুপস্থিত টমের উপরে।

    সোমবার ছিল সরকারী ছুটি, তাই যখন টম রবিবার রাত্রে ছুটিটা কাটাবার জন্যে বাড়ী এসে পৌঁছল, ক্রুদ্ধ মেয়ের দল তাকে চেপে ধরল কেন সে নীলের মত মানুষের হাতে গুলি-ভরা বন্দুক দিয়ে এভাবে ড্যানসির জীবন বিপন্ন করে তুলেছিল। টম চুপ করে শুনল যতক্ষণ না মেয়েরা শান্ত হল, তারপর যখন সে শুনল ড্যানসি বুকে গুলি লেগে পড়ে যেতে কিভাবে তারা পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে তার অকাল মৃত্যুতে কান্নাকাটি করেছে, হোহো করে হেসে উঠে টম সকলকে হকচকিয়ে দিল, আর তারপর যখন সে সকলকে বুঝিয়ে দিল কিভাবে চিঠিটা পাওয়া অবধি দুষ্টমির গন্ধ পেয়ে সে কার্তুজ থেকে গুলি বের করে তা ময়দা দিয়ে ভরে রাখে, তখন কেবলমাত্র ড্যানসি ছাড়া সকলেই তার সঙ্গে সে হাসিতে যোগ দিল। বিরাট মতলবটার মোট ফলাফল যা আন্দাজ করা গিয়েছিল দেখা গেল তা হল না; কারণ এর ফলে নীল বরং আরও ফুলে উঠল আর ড্যানসি আরও চুপসে গেল।

    .

    ০২.

    ভাল্লুকের ঘটনায় ড্যানসিই শেষ পর্যন্ত বেকায়দায় পড়েছিল। মেয়েদের সঙ্গে আমি থাকতাম বলে ড্যানসি ভেবেছিল বুঝি আমিও এই ভাল্লুকের ব্যাপারের মধ্যে ছিলাম। এ ধারণা কিন্তু তার ঠিক নয়। কারণ আমি শুধু বলেছিলাম সাধারণ সুতোয় না করে টোয়াইন সুতোয় ভাল্লুকের চামড়াটা সেলাই করতে, এবং এ ব্যাপারের সঙ্গে আমার সম্বন্ধে এই পর্যন্তই। এমনি একটা সন্দেহ তার মাথায় ছিল; তা না হলে কেন সে একদিন সকালে আমায় তার সঙ্গে শিকারে যেতে বলবে। আমি তখন সঙ্গীদের দেখাচ্ছিলাম কিভাবে গাছের একটা ডাল থেকে দুলতে দুলতে আরেকটা ডালে চলে যাওয়া যায়। এত বড় সম্মান পেয়ে আমি তখন একেবারে খুশির সপ্তম স্বর্গে; বেরিয়ে পড়লাম তার সঙ্গে। বেরোবার পর সে বললে আমায় দেখাবে কিভাবে মাটিতে দাঁড়িয়ে বাঘ মারতে হয়। ধুনিগারের বেত-ঝোপের কাছে গিয়ে দেখলাম সেখানে অনেক বাঘের থাবার ছাপ রয়েছে (পরে শুনেছিলাম এ জায়গাটা বাঘদের একটা আড্ডা), কিন্তু কোনো বাঘের দেখা মিলল না। ড্যানসি ছিল আমাদের পরিবারের বন্ধু, ফেরার পথে সে ঠিক করল আমায় বন্দুক ছুঁড়তে শেখাবে। এ কথা যখন সে বললে আমরা তখন ফাঁকা জায়গাটার এ প্রান্তে, এর অপর পারে কয়েকটা সাদা-মাথা দামা পাখি (এই পাখিগুলো হাসে) শুকনো পাতা সরিয়ে সরিয়ে উইপোকা খুঁজে ফিরছে। শিকারে বেরোবার সময় ড্যানসি গাদা রাইফেলটা হাতে, আর শটগানটা (সেটাও গাদা) কাঁধে ঝুলিয়ে নিয়েছিল। এখন সে শটগানটা কাঁধ থেকে নামিয়ে আমার হাতে দিয়ে পাখিগুলোকে দেখিয়ে দিল। বাঁ পা-টা ডান পায়ের একটু সামনে রাখতে বললে, তারপর বললে বন্দুকটা কাঁধে তুলে স্থিরভাবে ধরে ঘোড়া টিপে দিতে। তাই করলাম। এই ব্যাপারের পর এত বছর কেটে গেছে, কিন্তু আজ পর্যন্ত আমি জানি না বন্দুকটা ড্যানসি বিশেষ করে আমার জন্যেই খুব বেশী করে গেদেছিল, না কি ভাল্লুকের মত প্রচণ্ড শক্তিশালী ড্যান্‌সির অভ্যাসই ছিল বেশি করে বন্দুক গাদা। যাই হক, বন্দুকের ধাক্কা সামলে উঠে যখন চারদিকে তাকাবার মত অবস্থা আমার হল, দেখলাম ড্যান্‌সি বন্দুকটার নলদুটোর উপর হাত বুলিয়ে দেখছে সে দুটো জখম হয়েছে কি না। গুলি ছোঁড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমি যখন ডিগবাজি খেয়ে পড়ে যাই তখন বন্দুকটা আমার হাত থেকে ছিটকে পাথরের উপর পড়েছিল, দামাগুলো সব উড়ে পালিয়েছিল, কিন্তু যেখানে তারা চলছিল, দেখলাম একটা সাদা-কপালে মক্ষিভুক পাখি সেখানে পড়ে আছে–দোয়েল পাখির মত তার আকৃতি। পাখিটার শরীরে কোনো আঘাতের চিহ্ন না থাকায় ড্যানসি সিদ্ধান্ত করল নিশ্চয়ই সে শব্দেই ভয় পেয়ে মারা গেছে। আমিও ভ্যানসির সঙ্গে একমত হলাম, কারণ, আমার নিজেরও প্রায় সেই অবস্থাই হতে বসেছিল।

    এই অভিজ্ঞতার কিছুদিন পরে আমার বড় ভাই টম একদিন বললে আমায় নিয়ে ভাল্লুক-শিকারে যাবে। আমার যখন চার বছর বয়স তখন বাবা মারা যান, সেই থেকে টমের উপর আমাদের সংসারের দায়িত্ব। শুনে মা তো দিশেহারা হয়ে পড়লেন। জোন। অ আর্ক আর নার্স ক্যাভেল-এর সাহস একসঙ্গে করলে যা হতে পারে মা-র সাহস তার চেয়ে কম নয়। কিন্তু তাহলেও তিনি ঘুঘু পাখির মত কোমল ও শান্ত। পরম উৎসাহে আমি টমের কথা শুনছিলাম। টম ছিল আমার কিশোর হৃদয়ের উপাস্য বীর। মাকে সে বুঝিয়ে বললে যে এর মধ্যে বিপদের কোনো সম্ভাবনা নেই, সে আমাকে সামলাবে যাতে আমার কোনো অনিষ্ট হয়। শেষ পর্যন্ত মায়ের অনুমতি পেয়ে আমি ঠিক করলাম আমি আঠার মত টমের পায়ে পায়ে চলব, তাহলেই আর কোনো ভয় থাকবে না।

    সেদিন সন্ধ্যায় আমরা বেরিয়ে পড়লাম, –টম তার রাইফেল ছাড়াও আমার জন্যে একটা বন্দুক নিয়েছে। জীবজন্তুদের একটা চলা-পথ ধরে আমরা চলেছি-পথটা গেছে একটা প্রকাণ্ড পাহাড়ের উপর দিয়ে। পাহাড়ের মাঝামাঝি পর্যন্ত গিয়ে আমরা একটা গভীর, অন্ধকার, ভয়াল দরিপথের সামনে এলাম। সেটার ধারে এসে দাঁড়িয়ে টম আমায় ফিসফিস করে বললে এ জায়গাটা ভাল্লুকদের খুব প্রিয়, তারা দরিপথ দিয়ে কিংবা যে পথে আমরা এলাম এই পথে চলা-ফেরা করে। তারপর সেই পথের ধারের একটা পাথর দেখিয়ে আমায় সেখানে বসতে বলে বন্দুকটা আর দুটো গুলি আমার হাতে দিল। এই বলে আমায় সাবধান করে দিল যে-কোনো ভাল্লুক পেলে সেটাকে যেন একেবারে মেরে ফেলি, কেবলমাত্র আহত করে ছেড়ে না দিই। তারপর সেখান থেকে প্রায় আটশো গজ তফাতে পর্বতের উঁচুতে যেখানে একটা ওক গাছ নিরালা দাঁড়িয়ে রয়েছে সেটা দেখিয়ে দিয়ে বললৈ সে ওখানে থাকবে; যদি আমি কোনো ভাল্লুককে তার কাছে দেখতে পাই যাকে দেখতে পাওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়, তাহলে যেন আমি গিয়ে তাকে খবরটা দিই। এই বলে সে আমার কাছ থেকে চলে গেল।

    বাতাস বইছে। সেই বাতাসে শুকনো ঘাস আর ঝরা পাতার সরসর শব্দ হচ্ছে। চারদিকের জঙ্গল আমার কল্পনায় ক্ষুধার্ত ভাল্লুকে ভাল্লুকে ভরে উঠল–সেই শীতকালে এই পাহাড়ে নটা ভাল্লুক মারা হয়েছিল। এক্ষুনি যে আমায় ভাল্লুকে খেয়ে ফেলবে এ বিষয়ে আমার কোনো সন্দেহ রইল না। এবং তার সে ভোজ যে আমার পক্ষে অত্যন্ত কষ্টকর হবে তাতেও সন্দেহ নেই। সময় যেন আর কাটতেই চায় না, প্রতি মুহূর্তে আতঙ্ক বেড়ে চলেছে। অস্তসূর্ষের লাল আভায় সমস্ত পাহাড়টা যখন ঝলসে উঠেছে তখন দেখি একটা ভাল্লুক টমের গাছের থেকে কয়েকশো গজ উপর দিয়ে আকাশ রেখা ধরে ধীরে ধীরে চলেছে। টম তা দেখেছে কি না সে দুর্ভাবনা আমার একটুও ছিল না, এই ভয়ঙ্কর জায়গা থেকে পালাবার এই হল সেই সুযোগ যার প্রতীক্ষায় আমি ছিলুম, এবং এখনও সময় আছে। তাই বন্দুকটা কাঁধে করে আমি টমকে ভাল্লুকটার খবর দিতে গেলাম। টমের কাছে একবার পৌঁছে গেলে আমার আর ভয় নেই। ড্যানসির ব্যাপারের পর আর আমি বন্দুকটা ভরে নিতে সাহস করলাম না।

    আমাদের এদিককার হিমালয়ের কালো ভাল্লুক সারা শীতকাল ওক গাছের ফল খেয়ে কাটায়। ভাল্লুক অত্যন্ত ভারি, আর এই ফল ফলে ওক ডালের সবচেয়ে উঁচুতে; তাই ফল খেতে হলে ভাল্লুককে এই ডাল নিচু করে গাছের গুঁড়ির দিকে নিয়ে যেতে হয়। ফলে এইসব ডালের কোনোটা কেবল ফেটে যায় এবং তার পরও অনেকদিন কাঁচা থাকে, কোনোটা একেবারে ভেঙে মাটিতে পড়ে যায়, কোনোটা বা ভেঙে গিয়ে কেবলমাত্র ছালে আটকে ঝুলতে থাকে। দরিপথ অতিক্রম করে একটা ঘন ঝোপের কাছে এসে পৌঁছতে হঠাৎ একটা খসখস শব্দ আমার কানে এল। ভয়ে জমে গিয়ে আমি একেবারে নিস্পন্দ হয়ে রইলাম। শব্দটা ক্রমেই জোর হয়ে উঠতে লাগল, আর পরক্ষণেই একটা প্রকাণ্ড পদার্থ সশব্দে আমার সামনে পড়ল। দেখলাম একটা গাছের ডাল, কোনো ভাল্লুক এটা আগে থেকেই ভেঙে রেখেছিল এখন হাওয়ার বেগে পড়ে গেল। কিন্তু এ যদি এশিয়ার সবচেয়ে বড় ভাল্লুকও হত তাহলেও আমি এত ভয় পেতাম না। যে সাহসে ভর করে অমি টমের দিকে অগ্রসর হচ্ছিলাম তা আর বিন্দুমাত্র রইল না, ফলে আবার আমি গুঁড়ি মেরে পাথরটার কাছে ফিরে গেলাম। সুস্থ মানুষের পক্ষে যদি কেবল আতঙ্কে মারা যাওয়া সম্ভব হত তবে সে রাত্রে (এবং তার পরেও আরও অনেকবার) আমি নির্ঘাত মারা পড়তাম।

    অস্তসূর্যের রক্তিম আভা পাহাড় থেকে মিলিয়ে গেল, শেষ আলোও আকাশ থেকে চলে গেল। এমন সময় অন্ধকারের মধ্যে একটা মূর্তি দেখা দিল, একটা প্রফুল্ল স্বর আমায় ডেকে বললে, “কিরে, ভয় পাস নি তো?’ কথাটা বলে টম আমার বন্দুকটা নিজের হাতে নিল। উত্তরে যখন আমি বললাম এখন আর আমার ভয় করছে না, টম আর এ নিয়ে কথা বাড়ালো না, কারণ বুদ্ধি-সুদ্ধি তার যথেষ্ট ছিল, ব্যাপার-স্যাপার সব বুঝত ভাল।

    টম শিকারে যাবার সময় সর্বদাই তাড়াতাড়ি বেরোবার পক্ষপাতী ছিল। যেদিন সে আমায় ময়ুর শিকারে নিয়ে যায়, ভোর চারটেয় বিছানা থেকে তুলে বললে নিঃশব্দে হাত-মুখ ধুয়ে আর জামাকাপড় পরতে যাতে কারুর না ঘুম ভেঙে যায়। আধঘণ্টার মধ্যেই এক এক কাপ গরম চা আর ঘরে তৈরি কিছু বিস্কুট খেয়ে আমরা অন্ধকারের মধ্যে সাত মাইল হাঁটা-পথ ধরে গারুপ্পর দিকে রওনা হলাম।

    আমার জীবনে আমি তরাই আর ভাবর-এর জঙ্গলে অনেক পরিবর্তন দেখেছি। এর কিছু হয়েছে মানুষের হাতে, কিছু হয়েছে স্বাভাবিকভাবেই। কোনো-কোনো ঘন বনে, আগে যেখানে মানুষের পা পড়ে নি, এখন সেখানে কেবল ঝোঁপ-ঝাড়, আর যে সব জায়গায় ছিল প্রশস্ত ঘাস জমি আর প্লামের ঝোঁপ সেখানে এখন বন। গারুপ্পর দক্ষিণ-পূর্বে যেখানে আগে (অর্থাৎ যখনকার কথা লিখছি) ছিল কোমর-সমান ঘাস আর প্লামের ঝোপ, এখন সেখানে বড়-বড় গাছের জঙ্গল। ডিসেম্বরের সেই সকালে টম এই অঞ্চলের দিকেই চলেছিল; কারণ এই সময় প্লাম পাকে, সে লোভ সামলানো কেবলমাত্র হরিণ আর শুয়োরের পক্ষেই নয়, ময়ুরের পক্ষেও একরকম অসম্ভব।

    গারুপ্পুতে যখন পৌঁছলাম তখনও অন্ধকার থাকায় আমরা কুয়োটার কাছে বসে পূব আকাশে ধীরে ধীরে আলোর আভাস লক্ষ করলাম, বনের জেগে ওঠার সাড়া পেলাম। চারদিক থেকে লাল বনমোরগের ডাক শোনা গেল। সেই ডাক শুনে ঘুম ভেঙে গেল অসংখ্য ছোট-ছোট পাখির, আর তারাও পালক থেকে শিশির আর চেখে থেকে ঘুম ঝেড়ে ফেলতে ফেলতে নতুন দিনের আবাহনে মোরগদের সঙ্গে গলা মেলাল। যেসব ময়ূর বিস্তীর্ণ প্রান্তরের উপর ছড়ানো বিরাট বিরাট শিমূল গাছের ডালে ডালে বিশ্রাম করছিল এবার তারা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে জঙ্গলের শব্দের সমারোহে তাদের তীক্ষ্ণ কণ্ঠস্বর যুক্ত করল। ভোরের প্রথম আলো যখন সামনের শিমূল গাছের মগডাল স্পর্শ করল, কুড়ি-পঁচিশটা ময়ূর ছড়ানো ডালপালা ছেড়ে প্লাম-ঝোপের কাছে নেমে এল।

    টম উঠে দাঁড়িয়ে তার পাইপের ছাইটা ঝেড়ে ফেলে বললে এবার বনে ঢোকার সময় হয়েছে। এই নিচু এলাকায় শিশির প্রায় ত্রিশ ফুট পর্যন্ত ছেয়ে থাকে, তাই ভোরবেলা বড়-বড় গাছগুলোর মধ্য দিয়ে যেতে যেতে গাছের পাতা থেকে যে জল ঝরে, শব্দ শুনে বা চোখে দেখে তাকে বৃষ্টি বলেই মনে হয়। রাস্তা থেকে নেমে যে ঘাসের ভিতর দিয়ে আমরা চললাম তা টমের কোমর পর্যন্ত আর আমার থুতনি পর্যন্ত উঁচু। সেই শিশির-ভেজা ঘাসের ভিতর দিয়ে যেতে গিয়ে আমার ভিজে পোশাক গায়ে লেপটে গিয়ে সেই প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় আরো অস্বস্তির সৃষ্টি করল। যেখানে আমি থেমেছিলাম সেখান থেকে ময়ুরটা পাল্লার বাইরে। এ কথার উত্তরে যখন বললাম আমি গুলি করতে যাই নি কেবল ঘোড়াটা তুলে নিচ্ছিলাম, টম বললে কক্ষনো তা করা উচিত নয়, ঘোড়া ভোলা উচিত ঠিক গুলি করবার সময়টাতে,–এভাবে ঘোড়া তুলে এগোনো বিপজ্জনক, বিশেষ করে যখন যেখান দিয়ে চলেছি, সেখানে অদৃশ্য গর্তে পা পড়ে হোঁচট খাওয়ার সম্ভাবনা। এবার যাও’, বললে টম, ‘আরেকবার চেষ্টা করে দেখ। এবার আমি ময়ুরটাকে সহজেই পাল্লার মধ্যে পেলাম, একটা বড় প্লামের ঝোঁপ মাঝখানে পড়ায় আর কোনো অসুবিধে হয় নি। শিমূল গাছটায় পাতা না। থাকলেও লাল রঙের বড় বড় ফুল ফুটে ছিল। গাছটার আমার দিকের একটা ডালের উপর বসে ছিল ময়ুরটা–সূর্যের টেরচা রোদ তার উপর পড়তে মনে হল, এমন সুন্দর ময়ুর আমি আর দেখি নি কখনো। এবার ঘোড়াটা তোলার সময় এসেছে; কিন্তু উত্তেজনার বশেই হক কিংবা আমার অসাড় আঙুলগুলোর জন্যেই হক, কিছুতেই আমি সেটা তুলতে পারলাম না। কী করা যায় ভাবতে ভাবতেই ময়ুরটা উড়ে গেল। আমার কাছে এসে টম বললে, “যাক গে, পরের বার তুই নিশ্চয় পারবি। কিন্তু সেদিন সকালে আর কোনো পাখি গাছে বসে আমায় কৃতার্থ করল না। টম একটা লাল বন-মোরগ আর তিনটে ময়ুর মারবার পর আমরা ঘাস আর প্লামের ঝোঁপ ছেড়ে রাস্তায় উঠলাম। তারপর বাড়ি ফিরে যখন প্রাতরাশে বসলাম তখন বেলা হয়ে গেছে।

    .

    ০৩.

    ওই তিন পর্বেই আমার জঙ্গল বিষয়ে প্রশিক্ষণ সম্পূর্ণ হল। বড়রা অন্তত আমায় আর কিছু শেখান নি। বন্দুকের ব্যবহার আমাকে শেখানো হয়েছে, বাঘ ভাল্লুক আছে। এমন বনে নিয়ে গিয়ে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে যে জন্তু আহত নয় তাকে ভয় করবার কিছু নেই। ছেলে বেলায় যা ভাল করে শেখা যায় সারাজীবন তা মনে থাকে। আমি যা শিখেছিলাম ভাল করেই শিখেছিলাম। এই শিক্ষা কাজে লাগিয়ে শিকারে নামব কিনা, সে-সিদ্ধান্ত আমাকেই নিতে হয়েছিল। আমার ইচ্ছার তোয়াক্কা না করে আমার বয়সের ছেলেদের কি করা উচিত তাই বিবেচনা করে বড়রাই যদি নির্দেশ দিতেন, আমি কী করব না করব, আমার তা মোটেই ভাল লাগত না।

    ছেলেরা যথেষ্ট বুদ্ধি রাখে। কোন্ ধরনের শিকারে তারা নামবে, নিজেদের পছন্দ ও শরীরের সামর্থ্য অনুসারে তা তাদের নিজেদেরই বেছে নেবার সুযোগ দেওয়া উচিত। ভারতের অধিকাংশ অঞ্চলেই শিকারে অঢেল সুযোগ রয়েছে। কিন্তু কারো যদি শিকারে উৎসাহ না থাকে, প্রাণনাশে অনীহা থাকে, তার শিকারে না নামাই ভাল। যত প্রচ্ছন্নই হক না কেন, যে-কোনো জবরদস্তিই খেলাধুলোর মজাটাই মাটি করে দেয়। যেদিকে কারো স্বাভাবিক প্রবণতা রয়েছে, সেদিকেও জোর করে তাকে ঠেলে দিলে আর কোনো মজাই থাকে না।

    আমি যখন নিউমোনিয়ায় মৃত্যুর মুখোমুখি, তখন টমেরই সাহায্যে আমার মা আর বোন আমার সেবাশুশ্রূষা করে আমায় সারিয়ে তুলেছে। যে জীবন আমি হারাতে বসেছিলাম, সেই জীবনে যাতে আমি আবার উৎসাহ ফিরে পাই সেজন্যে টম আমাকে একটা গুলতি এনে দিলে। আমার বিছানার পাশে বসে টম পকেট থেকে গুলতিটা বার করে আমার হাতে দিয়ে খাটের পাশ থেকে গোমাংসের জুসের কাপটা তুলে নিয়ে বলত, এটা খেলে তবে আমার গায়ে গুলতি ছোঁড়ার মত জোর হবে। সেই শুনে আমাকে যা দেওয়া হত বিনা প্রতিবাদে আমি তাই খেয়ে নিতাম। আমি ক্রমে শক্তি ফিরে পেতে লাগলাম। বাড়ির সকলেই তখন আমায় প্রফুল্ল রাখতে চেষ্টা করছে। টমও তাদের সঙ্গে যোগ দিল, জঙ্গলের গল্প বলে, গুলতি ছোঁড়ার কৌশল শিখিয়ে সে আমার উৎসাহ জাগিয়ে রাখত।

    টমের কাছই আমি শিখি যে শিকারীদের পক্ষে বছরটা দুই ঋতুতে বিভক্ত–বন্ধ ঋতু আর ভোলা ঋতু। বন্ধ ঋতুতে আমায় গুলতি তুলে রাখতে হত, কারণ পাখিরা তখন বাসা বাঁধে। যখন ডিমে তা দিচ্ছে বা বাচ্চাদের যত্ন করছে সে সময়ে তাদের হত্যা করা অত্যন্ত নিষ্ঠুর কাজ। খোলা ঋতুতে আমার যেমন ইচ্ছে গুলতি ব্যবহারে বাধা ছিল না, কিন্তু এই শর্ত ছিল যে, যে পাখি মারব সেটাকে কাজে লাগাতে হবে। হরিয়াল বা নীল পাহাড়ী পায়রা আমাদের পাহাড়ে-পাহাড়ে প্রচুর মিলত, সেগুলো মারতে বাধা ছিল না, কারণ সেগুলো ছিল খাদ্য। কিন্তু আর যে সব পাখি মারব তাদের ছাল ছাড়ানোর ছুরি আর আর্সেনিক সাবান ছিল। পশু সংরক্ষণ বিদ্যায় টমের বিশেষ পারদর্শিতা ছিল না বটে, তবে, একটা পুরুষ কালিজ নিয়ে সে আমায় পাখির ছাল ছাড়ানো সম্বন্ধে একটা মোটামুটি ধারণা করে দিয়েছিল। আমাদেরই এক আত্মীয় স্টীভেন ডীজ তখন কুমায়ুনের পাখিদের বিষয়ে একটা বই লিখেছিল। তার বইয়ের চারশো আশিটি রঙিন ছবির মধ্যে অধিকাংশই আমারই সংগ্রহের পাখির ছবি, নয়তো আমি তার জন্যে বিশেষভাবে যা সংগ্রহ করেছিলাম, তারই থেকে।

    টমের দুটো কুকুর ছিল। পপি ছিল লাল রঙের কুকুর। দ্বিতীয় আফগান যুদ্ধের সময় সেটা কাবুলের পথে না খেতে পেয়ে মারা যেতে বসেছিল, সেটাকে সে ভারতে নিয়ে আসে। ম্যাগগ ছিল মেটে-সাদা রঙের স্প্যানিয়েল। ম্যাগগের ল্যাজ ছিল পেখমের মত। পপি ছোট ছেলেদের পাত্তা দিত না, কিন্তু ম্যাগগ অত বাছবিচার করত না; আমায় পিঠে নিয়ে খানিকটা দূর পর্যন্ত ঘুরিয়ে আনার ক্ষমতা তার ছিল। আমাকে সামলে রাখার দায়িত্ব নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সে তার সমস্ত স্নেহ আমার উপর ঢেলে দিয়েছিল। ম্যাগগই আমায় শিখিয়েছিল এমন কোনো ঘন ঝোপের খুব কাছ দিয়ে না যেতে যেখানে জীবজন্তুরা ঘুমিয়ে থাকে, ঘুম ভেঙে গেলে তারা বিরক্ত হয়ে ওঠে। সে-ই আমায় দেখায় যে কুকুরও চেষ্টা করলে বেড়ালের মত নিঃশব্দে জঙ্গলের মধ্যে চলা-ফেরা করতে পারে। ম্যাগগ সঙ্গে থাকলে আমি এমন গহন জঙ্গলেও গিয়েছি যেখানে যেতে আগে আমার সাহস হত না। আমার যখন গুলতির যুগ চলছে, সেই সময় একবার আমাদের এমন এক সাংঘাতিক অভিজ্ঞতা হয় যার ফলে ম্যাগগ প্রায় মারা পড়তে বসেছিল।

    আমার সংগ্রহের জন্যে একটা টকটকে লাল সানবার্ডের সন্ধানে সেদিন সকালে আমরা বেরিয়ে পড়েছি, এমন সময় ড্যানসির সঙ্গে দেখা। তার স্কটিশ টেরিয়ার থিকে নিয়ে সে বেড়াতে বেরিয়েছিল। তারাও আমাদের দলে যোগ দিল। কুকুরদুটোর মধ্যে সদ্ভাব না থাকলেও তারা মারামারি না করেই চলছিল।

    কিছুদুর যাবার পর থি একটা শজারুকে দেখে তাড়া করল। সঙ্গে সঙ্গে ম্যাগগও, আমার বারণ সত্ত্বেও। ড্যানসি তার গাদা বন্দুক নিয়ে গিয়েছিল, কিন্তু পাছে কুকুরগুলোর গায়ে লাগে এই ভয়ে সে গুলি করতে সাহস করল না, কারণ কুকুরদুটো শজারুটার দুদিক থেকে পাশে পাশে ছুটছিল আর তাকে কামড়ে চলেছিল। ড্যানসি তেমন দৌড়তে পারে না, তার উপর হাতে আবার বন্দুক। ফলে শজারুটা, কুকুরদুটো আর আমি তাকে অনেকটা পেছনে ফেলে গেলাম। শজারুর সঙ্গে লড়াই করা বড় সহজ ব্যাপার নয়। তারা তাদের কাটা ছুঁড়ে মারতে পারে না বটে, কিন্তু তাহলেও তারা যেমন কষ্টসহিষ্ণু তেমনি দ্রুতগতি। আক্রমণের বা আক্রমণ প্রতিরোধের সময় তারা তাদের গায়ের কাঁটাগুলো খাড়া করে তোলে, আর ছোটে পেছন দিকে।

    শজারুটাকে তাড়া করবার আগে আমি গুলতিটা পকেটে পুরে একটা মোটা লাঠি হাতে নিয়েছি, কিন্তু কুকুরদের কোনোরকম সাহায্য করাই আমার পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। যখনই আমি শজারুটার কাছাকাছি এসেছি সে আমায় তেড়ে এসেছে, এবং বহুবার আমি কুকুরদুটোর দৌলতে তার কাটার আক্রমণ থেকে বেঁচে গেছি। আধমাইলটাক শজারুটাকে তাড়া করবার পর আমরা একটা গভীর দরিপথের কাছে গিয়ে পৌঁছলাম যেখানে শজারুদের গর্ত আছে। এবার কুকুরদুটো শজারুটাকে ধরে ফেলল। ম্যাগগ তার নাক কামড়ে ধরল, আর থি তার গলাটা। ড্যানসি যখন এসে পৌঁছল তখন লড়াই প্রায় শেষ হয়ে গেছে। তবুও সে নিশ্চিন্ত হবার জন্যে শজারুটাকে একটা গুলি করল। দুটো কুকুরেরই গা দিয়ে রক্ত ঝরছে। যতগুলো কাটা পারলাম তাদের গা থেকে ছাড়িয়ে নিলাম, তারপর তাড়াতাড়ি বাড়ির পথ ধরলাম, যাতে যে সব কটা ভেঙে তাদের গায়ের ভিতরে থেকে যাওয়ার ফলে অনেক চেষ্টাতেও খালি হাতে তা বার করতে পারি নি, চিটে দিয়ে সেগুলো বার করতে পারি, কারণ শজারুর কাঁটায় খোঁচা খোঁচা কাঁটা-মত থাকে, ফলে তা টেনে বার করা কঠিন হয়ে ওঠে। ড্যানসি চলল মরা শজারুটাকে কাঁধের উপর ঝুলিয়ে।

    সারা দিন সারা রাত ম্যাগগের অত্যন্ত অস্থিরতার মধ্যে কাটল। খুব ঘনঘন সে হাঁচতে থাকল, আর যতবার হাঁচল প্রতিবারই তার খড়ের বিছানায় চাপ চাপ রক্ত পড়তে লাগল। সৌভাগ্যবশে পরদিন ছিল রবিবার। ছুটি কাটাতে নৈনিতাল থেকে এসে টম দেখল একটা শজারুর-কাঁটা ম্যাগগের নাকের ভিতর ভেঙে রয়ে গেছে। অনেক চেষ্টায় শেষ পর্যন্ত যখন সে চিমটে দিয়ে ভাঙা কাঁটাটা বার করল, দেখা গেল সেটা লম্বায় ছ-ইঞ্চি, আর কলমের মত মোেটা। সঙ্গে সঙ্গে ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরোতে লাগল এবং সে রক্ত যখন কিছুতেই বন্ধ করা গেল না, আমাদের ভয় হল, বুঝি ম্যাগগকে বাঁচাতে পারা যাবে না। যাই হক সযত্ন সেবাশুশ্রূষায় আর ভাল খাওয়া-দাওয়ার ফলে ম্যাগগ সেরে উঠল। থিল ততটা আহত হয় নি, সেও অবিলম্বে ভাল হল।

    গাদা বন্দুকটা পাবার পর-সে কথা পরে বলব–ম্যাগগকে আর আমাকে দু-বার উত্তেজনাপূর্ণ অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হয়। একবার হয় কালাধুঙ্গিতে, আর একবার নৈনিতালে। নয়াগাঁও গ্রামের কথা পাঠককে আগে বলেছি। নয়াগাঁওয়ের সবটা জুড়ে তখন চাষ চলছে। খেত আর ধুনিগার নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চলে একফালি জঙ্গল, তার মাঝে মাঝে ফাঁকা জায়গা। জঙ্গলটা হল সিকি মাইল থেকে আধ মাইল চওড়া। এই জঙ্গলের ভিতরে আছে অসংখ্য লাল বন-মোরগ, ময়ূর, হরিণ আর শুয়োর। এরা প্রচুর শস্য নষ্ট করত। খেত থেকে যেতে আসতে তারা জন্তুদের পায়ে-চলা পথের উপর দিয়ে চলত। এই পায়ে-চলা পথেই ম্যাগগ আর আমি আমাদের প্রথম অভিজ্ঞতা লাভ করি।

    নয়াগাঁও আমাদের কালাধুঙ্গির বাড়ি থেকে তিন মাইল। একদিন আমি ম্যাগগকে নিয়ে খুব ভোরে বেরিয়ে পড়লাম ময়ূরের সন্ধানে। চওড়া রাস্তাটার মাঝখান দিয়ে আমরা চলেছি, কারণ তখনও আলো ভাল করে ফোটে নি, এবং এ জঙ্গল হল চিতা আর বাঘের আস্তানা। রাস্তাটা যেখানে সেই জন্তুদের পায়ে-চলা পথে গিয়ে মিশেছে সেখানে পৌঁছে দেখলাম, সূর্য উঠেছে। এবার বারুদ ভরবার পালা। বারুদ ভরতে সময় লাগে; প্রথমে বারুদটা মেপে নল দিয়ে ঢেলে দেওয়া, তারপর একটা পুরু বনাত দিয়ে শক্ত করে গেদে দেওয়া। এরপর গুলিটা মেপে নিয়ে সেই বনাতের উপর ঢেলে দিতে হবে, আর পাতলা পীচবোর্ড গুলির উপর চেপে দিতে হবে। যখন দেখা যাবে গাদনকাঠিটা নল থেকে ছিটকে আসছে তখন বুঝতে হবে যে ঠিকমত গাদা হয়েছে। ভারী মস্ত ঘোড়াটা তখন অর্ধেকটা তুলে শক্ত করে আটকাতে হবে। এতগুলো ব্যাপার আমার মনের মত সমাধা করে গাদাবার যন্ত্রপাতি পিঠঝুলিতে ভরে নিয়ে ম্যাগগ আর আমি জন্তুদের চলা-পথ ধরে এগিয়ে চললাম। কতকগুলো বনমোরগ আর ময়ুর আমাদের পথের উপর দিয়ে চলে গেল, কিন্তু একবারও কেউ দাঁড়িয়ে গুলি করার সুযোগ দিল না। আধ-মাইলটাক যাবার পর আমরা একটা ফাঁকা জায়গায় পৌঁছলাম। সেখানে পা ফেলতে দেখি সাতটা ময়ুর একটার পেছনে একটা সারি বেঁধে ফাঁকা জায়গাটার ওপর দিয়ে চলে গেল। কয়েক মুহূর্ত অপেক্ষা করে আমরা গুঁড়ি মেরে গেলাম যেখান দিয়ে ময়ূরগুলি গিয়েছিল, তারপর ম্যাগগকে ওদের খোঁজে পাঠিয়ে দিলাম।

    দেখা গেছে, ঘন জঙ্গলে কুকুরের তাড়া খেলে ময়ুর সর্বদাই কোনো গাছের উপর উঠে বসে। শিকারী হিসেবে তখন গাছে-বসা পাখি মারা পর্যন্ত আমার পক্ষে অত্যন্ত কঠিন; তাই ম্যাগগ আর আমি দু-জনে মিলে অনেক চেষ্টায় একটা ময়ুর শিকার করলাম। শিকারের মধ্যে ময়ুর হল ম্যাগগের সবচেয়ে প্রিয়, তাই ময়ূরকে তাড়া করে গাছে তুলে দিয়ে ম্যাগগ গাছের নিচে ঘেউ-ঘেউ করতে করতে ছুটে বেড়াত আর আমি সেই সুযোগে গুঁড়ি মেরে এগিয়ে আমার কাজ সারতাম।

    ফাঁকা জায়গাটা পার হয়ে গিয়ে ময়ুর সাতটা নিশ্চয় দৌড়ে থাকবে; কারণ ম্যাগগ ঘন ঝোপের মধ্যে অন্তত শ-খানেক গজ যাবার পর আমি ডানার ঝাঁপটানি আর ময়ুরের চিৎকার শুনতে পেলাম, আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ম্যাগগের ভয়ার্ত চিৎকার আর বাঘের ক্রুদ্ধ গর্জন কানে এল। বোঝা গেল ময়ুরটা ম্যাগগকে একটা ঘুমন্ত বাঘের কাছে পৌঁছে দিয়েছে; এখন পাখি আর কুকুর আর বাঘ সকলেই যে যার মত করে বিস্ময়, আতঙ্ক ও বিরক্তি প্রকাশ করছে। ভয়ের ভাবটা কাটিয়ে উঠে এখন ম্যাগগ ভীষণ চিৎকার করে ছুটছে আর বাঘটা গর্জনের পর গর্জন করে তাকে তাড়া করেছে। দু-জনেই আমার দিকে এগিয়ে আসছে। এই হৈ-হল্লার মধ্যে একটা ময়ুর কোথা থেকে ভেসে এসে ভয়ের সংকেতধ্বনি করে বসল ঠিক আমার মাথার উপরের একটা গাছের ডালে। অবশ্য সেই মুহূর্তে আর আমার পাখির উপর কোনো আকর্ষণ ছিল না–আমার তখন একমাত্র সাধ, বহুদুরে এমন কোথাও পালাতে হবে যেখানে বাঘ নেই। ম্যাগগের তো চারটে পা আছে, কিন্তু আমর মোটে দুটো; তাই নিঃসংকোচে বিশ্বস্ত বন্ধুকে ফেলে রেখেই আমি প্রচণ্ড দৌড় লাগালাম। জীবনে আর কখনো আমি অমন দৌড় দৌড়েছি কি না সন্দেহ। কিছুক্ষণের মধ্যেই ম্যাগগ আমাকে ধরে ফেলল, এবং বাঘের গর্জন আর পেছন থেকে শোনা গেল না।

    এখন আমি কল্পনা করতে পারি (এ-কল্পনা করা সেই মুহূর্তে সম্ভব ছিল না) যে বাঘ ফাঁকা জায়গাটায় এসে তার থাবার উপর ভর করে বসে বাঘের হাসি হাসছে; এই ভেবে যে, একটা মস্ত কুকুর আর একটা ছোট্ট ছেলে যাকে দেখে প্রাণভয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে পালাল, আসলে সে ঘুমের ব্যাঘাত হয়েছে বলে তাদের ভয় দেখিয়ে তাড়িয়ে দিচ্ছিল মাত্র।

    কালাধুঙ্গি ছেড়ে আমাদের গ্রীবাস নৈনিতাল যাবার আগে সেই শীতকালে আমাকে আর একটা অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হয়। এবার আমি একা, কারণ ম্যাগগ তার এক বান্ধবীর সঙ্গে দেখা করতে আমাদের না বলে কয়ে গ্রামে পৌঁছে গেছে। ঘন জঙ্গল এড়িয়ে অপেক্ষাকৃত কঁকার উপর দিয়েই এগিয়ে যাচ্ছি। নয়াগাঁওয়ের নিচে গারুঘ্নর রাস্তায় আমি বন-মোরগের সন্ধানে চলেছি। রাস্তার উপর অনেক পাখি দেখা গেল খুঁটে খুঁটে খাবার খাচ্ছে, কিন্তু তাদের কোনোটাই গুলির পাল্লার মধ্যে এল না। বাধ্য হয়ে তখন আমি জঙ্গলে প্রবেশ করলাম। এ জঙ্গলে কিছু বড় বড় গাছ, আর ইতস্তত ছড়ানো কিছু ঝোঁপ ও ছোট ছোট ঘাস। জঙ্গলে ঢোকবার আগে আমি জুতো-মোজা খুলে ফেললাম। সামান্য একটু এগোতেই দেখলাম, একটা লাল বনমোরগ পা দিয়ে একটা গাছের নিচে শুকনো পাতা আঁচড়াচ্ছে।

    বনমোরগ কিংবা পোষা মোরগছানা যখন শুকনো পাতা বা আবর্জনার গাদা আঁচড়ায়, প্রথমটা সে মাথা তুলে দেখে নেয় কোনো বিপদের সম্ভাবনা আছে কি না। তারপর মাথা নামিয়ে কোনো লুকোনো-পোকা-মাকড় বা শস্য খুঁটে খুঁটে খেতে থাকে। এই মোরগটা যে গাছটার নিচে খেতে ব্যস্ত ছিল সে জায়গাটা আমার বন্দুকের পাল্লার বাইরে। তাই আমি খালি পায়ে সন্তর্পণে অগ্রসর হলাম। যখনই পাখিটা মাথা নামাচ্ছে সেই সুযোগে কয়েক গজ অগ্রসর হচ্ছি, আর নিশ্চল হয়ে থাকছি যখনই সে মাথা তুলছে–এইভাবে অগ্রসর হতে হতে আমি একটা নিচু জায়গায় এসে তাকে প্রায় পাল্লার মধ্যে এনে ফেললাম। নিচু জায়গাটার দু-দিকে হাঁটু পর্যন্ত লম্বা লম্বা ঘাস, নিচু জায়গাটায় নেমে দু পা ধারের দিকে সরে গেলেই আমি তাকে নাগালের মধ্যে পাব, আর সেইসঙ্গে একটা ছোট গাছও পাব যার উপর ভারি বন্দুকটা রেখে ভাল করে তাক করতে পারব। মোরগটা আবার মাথা নামাতেই নিচু জায়গাটায় এগিয়ে গেলাম। কিন্তু পা ফেলতেই আমার পা পড়ল একটা প্রকাণ্ড ময়াল সাপের কুণ্ডলীর মধ্যে। কদিন আগে আমি যে দৌড় দৌড়েছিলাম কোনো বালক কখনো তেমন দৌড়েছে কি না সন্দেহ, আর এই মুহূর্তে যে লাফ আমি লাফালাম কোনো বালক কখনো তেমন লাফিয়েছে কি না তাও সন্দেহ। একেবারে গিয়ে পড়লাম নিচু জায়গাটার অপর পারে, আর সঙ্গে সঙ্গে ফিরে দাঁড়িয়ে সেই কুণ্ডলীতে গুলি করেই ছুটতে শুরু করলাম– থামলাম না যতক্ষণ না রাস্তায় পৌঁছে নিরাপদ বোধ করলাম।

    উত্তর ভারতের বন-জঙ্গলে অনেক বছর কাটিয়েছি, কিন্তু কখনো শুনি নি কোনো ময়াল সাপ মানুষ মেরেছে। কিন্তু তাহলেও বলব যে নিতান্ত ভাগ্যবলে আমি সেই সকালে বেঁচে গেছি, কারণ যদি ময়ালটা আমার পা জড়িয়ে ধরত-ঘুমিয়ে না থাকলে নিশ্চয় ধরত-তাহলে আর ওকে কষ্ট করে আমায় মারতে হত না, কারণ ভয়েই আমি মারা পড়তাম, কদিন আগে যেমন একটা পূর্ণবয়স্ক চিতলহরিণের ল্যাজ ময়ালে টেনে ধরতেই সে ভয়ে মারা পড়েছিল। ময়ালটা কত বড়, বা আমার গুলিতে সে মরেছে কি না তা আমি জানি না, কারণ তা দেখতে আমি ফিরে যাই নি। তবে ওই অঞ্চলে আমি আঠার ফুট লম্বা ময়াল পর্যন্ত দেখেছি, আর দুটো ময়াল দেখেছি, যাদের একটা চিতল হরিণকে, আর অন্যটা একটা গরুকে আস্ত গিলে ফেলেছিল।

    কালাধুঙ্গি থেকে নৈনিতালে ফেরার অল্প পরেই ম্যাগগের আর আমার দ্বিতীয় অভিজ্ঞতা হয়। নৈনিতালের চারদিকের জঙ্গলে তখন প্রচুর কালিজ ও অন্যান্য পাখি ছিল, এবং বেশী শিকারী না থাকায় এবং তাদের মারার ব্যাপারে কোনো বিধিনিষেধ না থাকায় স্কুলের ছুটির পর ম্যাগগকে নিয়ে বেরিয়ে বাড়িতে রান্নার জন্যে গোটা-দুই কালিজ বা পাহাড়ী তিতির শিকার করে আনতে বাধা ছিল না।

    এক সন্ধেয় ম্যাগগকে নিয়ে আমি কালাধুঙ্গি রোড দিয়ে চলেছি। অনেকগুলো কালিজকে ম্যাগগ তাড়া করে গাছে তুলল, কিন্তু কোনোটাই গাছে বসে থেকে আমাকে ভাল করে টিপ করে গুলি ছুঁড়বার সুযোগ, দিল না। উপত্যকার নিচে সরিয়া তাল বলে যে ছোট হ্রদটা ছিল সেখানে পৌঁছে আমরা রাস্তা ছেড়ে জঙ্গলে প্রবেশ করলাম–আমাদের উদ্দেশ্য হল উপত্যকার উপরদিকের শেষ প্রান্তের গিরিখাদ পর্যন্ত হেঁটে ফিরে যাব। হ্রদটার কাছে আমি একটা কালিজকে গুলি করলাম। তারপর ঘন ঝোঁপ আর বিরাট পাথরের স্তূপের উপর দিয়ে অগ্রসর হতে হতে যখন আবার রাস্তাটার দুশো গজের মধ্যে এসে, ঘন ঝোঁপ থেকে বেরিয়ে একটা ঘাসে ভরা জায়গায় এসে পৌঁছেছি, দেখলাম দোপাটি-ঝোপের তলা থেকে অনেকগুলো কালিজ লাফিয়ে উঠে একটা নিচু কুল-ঝোঁপ থেকে কুল খেতে শুরু করল। পাখিগুলি . উড়লেই দেখা যাচ্ছিল, কিন্তু সচল লক্ষ্যে গুলি ছুঁড়বার মত হাত তখনও আমার তৈরি হয় নি, তাই আমি মাটিতে বসে অপেক্ষা করে রইলাম কখন কোন পাখি ফাঁকা জায়গাটায় এসে বসে, তারই জন্যে। ম্যাগগ আমার পাশে শুয়ে রইল।

    বেশ কিছুক্ষণ আমরা এইভাবে রয়েছি আর পাখিগুলো কুল খাবার জন্যে তখনো লাফালাফি করে চলেছে, এমন সময় পাহাড়ের উপর দিকে যে রাস্তাটা কোনাকুনিভাবে চলে গেছে, সেই রাস্তা থেকে অনেক মানুষের চলার আর কথার আওয়াজ শোনা গেল। তাদের টিনের পাত্রের শব্দ থেকে বুঝলাম যে তারা গোয়ালা; সরিয়া তালের নিচে তাদের বাড়ি থেকে নৈনিতালে দুধ বিক্রি করে এখন ফিরছে। চারশো গজ দূরের মোড়টায় বাঁক নেবার সময় প্রথম তাদের সাড়া পেলাম। তারপর তারা আমার উপরের দিকে আর-একটু বাঁ দিকে একটা জায়গায় পৌঁছে সবাই একসঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল, যেন কোনো প্রাণীকে রাস্তা থেকে তাড়িয়ে দিতে চায়। পরমুহূর্তেই আমাদের ঠিক উপরের জঙ্গল থেকে একটা বড় জন্তুর এগিয়ে আসার শব্দ আমাদের কানে এল-জন্তুটা আসছে আমাদের দিকে। ঘন ঝোপের ফাঁক দিয়ে প্রথমে দেখা যাচ্ছিল না, দোপাটি গাছগুলোর মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে কালিজগুলোকে উড়িয়ে দিয়ে একটা প্রকাণ্ড চিতা ফাঁকা জায়গাটার উপর লাফিয়ে পড়ল। মাটিতে পড়ার আগেই চিতাটা আমাদের দেখতে পেয়েছিল; মাটিতে লেপটে পড়ে সে সেইভাবেই রয়ে গেল নিস্পন্দ। ফাঁকা জায়গাটা ত্রিশ ডিগ্রি কোণ করে একটু একটু করে উঠে গেছে; আমাদের থেকে উপরে, মাত্র দশ গজ দূরে, তার সমস্ত শরীরটা দেখা যাচ্ছিল স্পষ্ট। তাকে দেখেই আমি আমার বাঁ হাতটা বন্দুক থেকে সরিয়ে ম্যাগগের কাঁধের উপর রাখলাম–টের পেলাম, আমার নিজের শরীরের মত ওর শরীরও থরথর করে কাঁপছে।

    এই প্রথম ম্যাগগ আর আমি চিতা দেখলাম। বাতাস বইছিল নিচের থেকে পাহাড়ের উপর দিকে; আমাদের প্রতিক্রিয়া হল মোটামুটি একই রকম–তীব্র উত্তেজনা, কিন্তু ভয় নয়। ভয় না পাবার কারণ আমি আজ পর্যন্ত সমস্ত জীবনের অভিজ্ঞতার পরে বুঝতে পারি–চিতাটার আমাদের উপর কোনো জিঘাংসা ছিল না। রাস্তা থেকে মানুষের তাড়া খেয়ে হয়তো সে ওই পাথরগুলোর দিকে চলে যাচ্ছিল যার উপর দিয়ে ম্যাগগ আর আমি একটু আগে এসেছি; তাই ঝোপটা পেরিয়েই তার পালাবার পথের উপর হঠাৎ একটা ছোট ছেলে আর একটা কুকুরের সম্মুখীন হয়ে সে অবস্থাটা বোঝবার জন্যে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে ছিল। আমাদের দিকে একবার তাকিয়েই সে বুঝতে পেরেছিল তার সঙ্গে আমাদের শত্রুতা নেই। আমাদের জঙ্গলের অন্য যে-কোনো প্রাণীর চেয়ে চিতাদের উপস্থিত বুদ্ধি বেশি। তাই আমাদের থেকে ভয়ের কিছু নেই বুঝতে পেরে এবং আশেপাশে আর কোনো মানুষের সাড়া না পেয়ে সে গুঁড়িমারা ভঙ্গি ছেড়ে লাফিয়ে উঠল, কমনীয় ভঙ্গিতে কয়েকটি লাফ দিয়ে পেছনের জঙ্গলে অন্তর্হিত হল। বাতাসে চিতাটার গন্ধ আসতেই ম্যাগগ খাড়া হয়ে উঠে প্রচণ্ড গর্জন করতে লাগল, তার ঘাড়ের আর পিঠের সমস্ত লোম সিধে হয়ে উঠল। এতক্ষণে সে বুঝেছে, যে সুদর্শন প্রকান্ড জন্তুটাকে চোখে দেখে সে একটুও ভয় পায় নি এবং যে খুব সহজেই তাকে মেরে ফেলতে পারত সে হল চিতা, জঙ্গলের সকল জন্তুর চেয়ে সাংঘাতিক শত্রু তার।

    .

    ০৪.

    গুলতি অর গাদা-রাইফেল–আমার শিকারী জীবনের এই দুই অধ্যায়ের মাঝে ছিল এক তীর-ধনুকের অধ্যায়। সে সময়ের কথা মনে করে আজও আমার মন খুশিতে ভরে ওঠে কারণ তীর-ধনুকে কখনো কোনো পাখি বা পশু বিদ্ধ করতে না পারলেও, প্রকৃতির ব্যাঙ্কে সেই সময়েই প্রথম আমার যৎসামান্য সঞ্চয় হয়েছিল এবং তখন ও পরবর্তী জীবনে জঙ্গলের যে জ্ঞান আমি আত্মস্থ করেছি আজও তা আমার কাছে অশেষ আনন্দের উৎস হয়ে রয়েছে।

    ‘শিখেছি’ কথাটার চেয়ে ‘আত্মস্থ করেছি’ কথাটা আমার বেশি পছন্দ। কারণ জঙ্গলের জ্ঞান তো কোনো বিজ্ঞান নয় যে পাঠ্য কেতাব পড়ে শেখা যাবে, এ কেবল একটু একটু করে আত্মস্থ করার জিনিস; এই প্রক্রিয়া দীর্ঘকাল চলতে পারে, কারণ প্রকৃতি-গ্রন্থের না আছে শুরু, না আছে শেষ। সে বই যেখানে খুশি এবং যে-কোনো বয়সে খুলে পাঠ করা সম্ভব, এবং জ্ঞান লাভের বাসনা থাকলে এ বই অসীম কৌতূহলের খোরাক যোগাবে এবং যত নিবিড়ভাবেই যত দিন ধরে পড়ে যাওয়া যায়, এর আকর্ষণ কোনোদিন হ্রাস পাবে না। কারণ প্রকৃতিতে বৈচিত্র্যের শেষ নেই।

    এখন বসন্তকাল। সামনের গাছটা উজ্জ্বল ফুলের অলংকারে ভূষিত। রঙ-বেরঙের পাখি এই ফুলের আকর্ষণে এসে কেউ ডালে ডালে নাচছে, কেউ ফুল থেকে মধু খাচ্ছে, কেউ বা খাচ্ছে ফুলের পাপড়ি; কেউ বা আবার যেসব মৌমাছি মধু সংগ্রহে ব্যস্ত তাদের খেয়ে চলেছে। কাল এই ফুল ফলে পরিণত হবে। তখন আবার অন্য পাখিরা এসে গাছটা দখল করবে। এই বিভিন্ন ধরনের পাখির আবার প্রকৃতির ব্যবস্থায় ভিন্ন কাজ; কারুর কাজ হল প্রকৃতির উদ্যান-শোভা বৃদ্ধি করা, কারুর বা প্রকৃতিকে সুরে ভরে তোলা, কারুর বা আবার তাকে গাছে-পাতায় পুনরুজ্জীবিত করা।

    বছরের পর বছর হয় ঋতুর পর ঋতুর পরিবর্তন, সেইসঙ্গে দৃশ্যপটও বদলাতে থাকে। নানা প্রজাতির পাখিদের নতুন ঝক নানা সংখ্যায় এসে গাছের শোভা বৃদ্ধি করে। গাছের একটা বড় ডাল ভেঙে পড়ে ঝড়ের বেগে। মরে যায় গাছটা। তখন– আর একটা গাছ এসে তার স্থান গ্রহণ করে। এইভাবে চলে আবর্তন-চক্র।

    আপনার পায়ের কাছে যে পথটা, তাতে একটা সাপের চলা-পথের ছাপ। সূর্য ওঠার ঘণ্টাখানেক আগে সাপটা এই পথে চলে গেছে। সাপটা গিয়েছিল পথের ডান দিক থেকে বাঁ দিকে, তার শরীরের বেড় তিন ইঞ্চি; এবং সে যে বিষাক্ত সাপ তা একরকম নিশ্চয় করেই বলা চলে। অথচ কালই হয়তো এখানে অথবা অন্য কোনো পথে লক্ষ করলে দেখবেন আর একটা ছাপ, পাঁচ মিনিট আগে যে সাপটা এ রাস্তা পার হয়ে গেছে সে গিয়েছিল বাঁ দিক থেকে ডান দিকে; তার শরীরের বেড় পাঁচ ইঞ্চি; এবং সে নির্বিষ।

    আজ আপনি বনের রহস্য যেটুকু আত্মস্থ করলেন, আগামী কাল আপনি যে অভিজ্ঞতা অর্জন করবেন তা তার সঙ্গে যুক্ত হবে এবং আপনার আত্মস্থ করার ক্ষমতার উপর নির্ভর করবে কতটা আপনি শিখলেন। এই শেখার সময়টা মোটামুটি কেটে যাবার পর–সে এক বছর পরে বা পঞ্চাশ বছর পরে যখনই হক–তখনও দেখবেন যে আপনার শিক্ষাগ্রহণ সবেমাত্র শুরু হয়েছে, প্রকৃতির সমস্ত রহস্য আপনার সামনে পড়ে রয়েছে। একটা কথা নিশ্চয় করে জানবেন যে, শেখবার যদি ইচ্ছে না থাকে তাহলে আপনি প্রকৃতি থেকে কিছুতেই কিছু শিখতে পারবেন না।

    একটা তাঁবু থেকে আর একটা তাবু পর্যন্ত বার মাইল পথ আমি এক অপূর্ব জঙ্গলের মধ্য দিয়ে হেঁটে গিয়েছিলাম, এক সঙ্গী নিয়ে। তখন এপ্রিল মাস, প্রকৃতি সৌন্দর্যের শীর্ষে। সমস্ত গাছ সমস্ত ঝোঁপ সমস্ত লতা ফুলে ফুলে ভরে উঠেছে। রঙবাহার প্রজাপতির দল ফুল থেকে ফুলে উড়ে বেড়াচ্ছে। বাতাসও ফুলের গন্ধে ভরে উঠে পাখির গানে রোমাঞ্চিত। দিনের শেষে আমার সঙ্গীকে যখন জিজ্ঞাসা করলাম এ পথ-চলা তার ভাল লেগেছে কি না, সে বললে, “উঁহু, রাস্তাটা বেজায় এবড়ো-খেবড়ো!

    প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অব্যবহিত পরে একবার আমি ব্রিটিশ ইণ্ডিয়া জাহাজ ‘কারাগোলা’য় করে বোম্বাই থেকে মোম্বাসায় চলেছি। উপরের ডেকে ছিলাম আমরা পাঁচজন। আমি যাচ্ছি টাঙ্গানিয়াকায় একটা বাড়ি তৈরি করতে, আর বাকি চারজন চলেছে কিনিয়ায় তিনজন যাচ্ছে শিকার করতে, আর একজন, সেখানে গোলাবাড়িটা কিনেছে, সেটা দেখতে যাচ্ছে। সমুদ্র ছিল অশান্ত, আর সমুদ্রযাত্রায় আমি এমনিতেই বড় অস্বস্তি বোধ করি। আমার বেশির ভাগ সময়ই তাই কেটেছে ধূমপানের কক্ষে ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে। আর ওরা কাছেই একটা টেবিলে বসে তাস খেলতে খেলতে ধূমপান করেছে আর গল্প-গুজব করেছে,–সে গল্প বেশির ভাগই শিকারের গল্প।

    একদিন পায়ে টান ধরায় আমার ঘুম ভেঙে গেল। ওদের কথাবার্তা আমার কানে এল। শুনলাম সবচেয়ে যে অল্পবয়স্ক সে বলছে, “ওঃ, বাঘ সম্বন্ধে আমার আর জানতে কিছু বাকি নেই। গত বছর আমি মধ্যপ্রদেশে এক ফরেস্ট অফিসারের সঙ্গে পনের দিন ছিলাম।

    দুটোই দুই তরফের চূড়ান্ত উদাহরণ সন্দেহ নেই, কিন্তু তা হলেও এ থেকে আমার যা বক্তব্য তা স্পষ্ট হয়ে উঠবে। আমি এই বলতে চাই যে যদি আপনার কৌতূহল না থাকে, তাহলে যেমন যে পথ ধরে চলেছেন তা ছাড়া আর কিছুই আপনার চোখে : পড়বে না, তেমনি যদি আপনার শেখবার কোনো আগ্রহ না থাকে, আর মনে করে থাকেন যে যা আসলে সারা জীবন ধরেও শেখা যায় না আপনি তা পনের দিনে শিখতে পেরেছেন, জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তাহলে আপনি যে অজ্ঞ সেই অজ্ঞই থেকে যাবেন।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleরামায়ণের উৎস কৃষি – জিতেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়
    Next Article জীবনযাপন – জীবনানন্দ দাশ
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    রাজমালা বা ত্রিপুরার ইতিহাস – শ্রী কৈলাসচন্দ্ৰ সিংহ প্রণীত

    August 20, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    রাজমালা বা ত্রিপুরার ইতিহাস – শ্রী কৈলাসচন্দ্ৰ সিংহ প্রণীত

    August 20, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Our Picks

    রাজমালা বা ত্রিপুরার ইতিহাস – শ্রী কৈলাসচন্দ্ৰ সিংহ প্রণীত

    August 20, 2025

    আলো হাতে সেই মেয়েটি – তপন বন্দ্যোপাধ্যায়

    August 20, 2025

    গোয়েন্দা গার্গী সমগ্র – তপন বন্দ্যোপাধ্যায়

    August 20, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.