Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    আলো হাতে সেই মেয়েটি – তপন বন্দ্যোপাধ্যায়

    August 20, 2025

    গোয়েন্দা গার্গী সমগ্র – তপন বন্দ্যোপাধ্যায়

    August 20, 2025

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    জিম করবেট অমনিবাস (অখণ্ড) – মহাশ্বেতা দেবী সম্পাদিত

    জিম করবেট এক পাতা গল্প1380 Mins Read0

    চম্পাবতের মানুষখাকী

    চম্পাবতের মানুষখাকী

    ০১.

    এডি নোলেসের সঙ্গে মানালিতে যখন শিকার করছিলাম, তখনই প্রথম সেই বাঘটার কথা শুনি, যেটি পরে সরকারী স্বীকৃতি পায় ‘চম্পাবতের মানুষখেকো’ নামে।

    এডি এ-প্রদেশে বহুদিন স্মরণীয় হয়ে থাকবেন, পারঙ্গম স্পোর্টসম্যান হিসেবে আর তার অফুরন্ত শিকার গল্প সংগ্রহের জন্য। তিনি ছিলেন সেই মুষ্টিমেয় পরম ভাগ্যবান পুরুষদের অন্যতম, যারা জীবনে শ্রেষ্ঠতম সমস্ত কিছুরই অধিকারী। অব্যর্থ নিশানা আর আঘাত হানার ক্ষমতায় তার রাইফেল ছিল তুলনারহিত, তার এক ভাই ছিলেন ভারতবর্ষে বন্দুক ছোঁড়ায় শ্রেষ্ঠ আর অন্য ভাই ছিলেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর সেরা টেনিস খেলোয়াড়। সুতরাং এডি যখন আমাকে জানালেন যে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম শিকারী তার শ্যালক চম্পাবতের মানুষখেকো মারবার জন্যে সরকার কর্তৃক প্রেরিত হচ্ছেন, তখন নিশ্চিতভাবেই অনুমান হয়েছিল যে, জন্তুটার কার্যকলাপের সময়কাল অবশ্যই অত্যন্ত সীমাবদ্ধ।

    বাঘটা কিন্তু যাই হক, কোনে অজ্ঞাত কারণে মারা যায় নি আর চার বছর পর আমি যখন গিয়েছিলাম, তখন সে সরকারের অত্যন্ত দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পুরস্কার ঘোষণা, বাঘ শিকারী নিয়োগ এবং আলমোড়ার ডিপো থেকে গুখ-দলও পাঠানো হয়েছে। কিন্তু এ-সমস্ত ব্যবস্থা সত্ত্বেও নিহত মানুষের সংখ্যা শঙ্কাজনক হারে বেড়ে চলেছে।

    বাঘিনীটি, কেননা জানোয়ারটি তাই বলেই প্রমাণিত, এসেছিল নেপাল থেকে; সেখানে দুশো মানুষকে মারবার পর একদল সশস্ত্র নেপালী তাকে তাড়িয়ে বের করে দেয় এবং পুরোদস্তুর মানুষখেকোরূপেই সে কুমায়ুনে পৌঁছয় আর যে চার বছর সে কুমায়ুনে কার্যকলাপ চালায়, তাতে ওই সংখ্যাটির সঙ্গে যুক্ত হয় দুশো চৌত্রিশ।

    এই যখন অবস্থা, সে সময় নৈনিতাল পৌঁছবার কিছু পরেই বাংড়ি আমার সঙ্গে দেখা করতে আসেন। বাথুড, যিনি তৎকালে নৈনিতালের ডেপুটি কমিশনার ছিলেন .. এবং যিনি তাঁর শোচনীয় মৃত্যুর পর হলদোয়ানির এক অখ্যাত কবরে শায়িত, তিনি ছিলেন এমন একজন মানুষ যে, যারা তাকে জানত তারাই তাকে ভালবাসত ও শ্রদ্ধা করত। সুতরাং এতে বিস্ময়ের কিছু নেই যে যখন তিনি তার জেলার লোকদের ওপর মানুষখেকোর উৎপাত ও সে-কারণে তার উদ্বেগের কথা বলেন, তখনই তিনি আমার কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি আদায় করেন যে পরবর্তী মানুষ হত্যার খবর পাওয়া মাত্রই আমি চম্পাবত রওনা হব।

    অবশ্য, আমি দুটি শর্ত আরোপ করেছিলাম; প্রথমত, সরকারী পুরস্কার বাতিল করতে হবে আর অন্যটি হল, দক্ষ শিকারীদের ও আলমোড়া থেকে আসা সৈন্যদের প্রত্যাহার। আমার এহেন শর্ত আরোপের কারণসমূহে কোনো বিশদ ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে না কারণ আমি নিশ্চিত যে সব স্পোর্টসম্যানই পুরস্কারলোভী শিকারীদের সঙ্গে একই শ্রেণীভুক্ত হতে আমারই মত ঘৃণাবোধ করবেন আর হঠাৎ গুলি খাবার ঝুঁকি এড়াতে আমার মতই উদ্বিগ্ন থাকবেন। উক্ত শর্তগুলি মেনে নেওয়া হয় আর এক সপ্তাহ পরে এক ভোরবেলায় বাথুড় এসে আমাকে জানান যে রাত্রে রানাররা খবর এনেছে দাবিধূরা ও ধূনাঘাটের মধ্যে পালি গ্রামে মানুষখেকোর দ্বারা এক মহিলা নিহত হয়েছেন।

    অত্যন্ত স্বল্প সময়ের মধ্যেই যাত্রা করতে হবে, আগের দিন এরকম অনুমান করেই আমি তাঁবুর জিনিসপত্র বয়ে নিয়ে যাবার জন্যে ছ জন লোক নিযুক্ত করেছিলাম এবং প্রাতরাশের পর বেরিয়ে আমরা ধারী পর্যন্ত সতের মাইল হাঁটি। মোরনোলায় পরদিন সকালের প্রাতরাশ সারা হল, রাতটা আমরা কাটালাম দাবিধূরায় আর পরদিন সন্ধেবেলায় মহিলাটি নিহত হবার পাঁচদিন পর, পালিতে পৌঁছলাম।

    গ্রামের মানুষেরা, সংখ্যায় প্রায় পঞ্চাশজন পুরুষ, মহিলা ও শিশু ভয়ঙ্কর আতঙ্কিত অবস্থায় ছিল এবং আমি যখন পৌঁছলাম, যদিও সূর্য তখনো আকাশে দেখলাম, সমস্ত অধিবাসীরা ঘরের মধ্যে বন্ধ দরজার পেছনে; আর যতক্ষণে লোকেরা উঠোনে আগুন জ্বেলেছে এবং আমি এক পেয়ালা চা নিয়ে বসেছি, ততক্ষণে এখানে-ওখানে সাবধানতায় একটা একটা দরজা খুলেছে আর ভয়ার্ত জীবেরা জড়ো হয়েছে।

    শুনলাম, পাঁচদিন যাবৎ কেউই ঘরের চৌকাঠের ওপারে যায় নিউঠোনের অস্বাস্থ্যকর অবস্থাই এই বিবৃতির সত্যতা প্রমাণ করে। খাবার-দাবারেও টান পড়েছে এবং যদি বাঘটাকে মারা বা বিতাড়িত করা সম্ভব না হয় তবে লোকেদের উপোস করতে হবে।

    স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে যে বাঘটা তখনো কাছেই আছে। তিন রাত্রি ধরে বাড়িগুলো থেকে একশো গজ দূরে রাস্তায় ওপরে তাকে ডাকতে শোনা গেছে আর সেদিনই গ্রামের নিম্ন প্রান্তে চষা জমির ওপর তাকে দেখা গেছে।

    গ্রামের মোড়ল অত্যন্ত আগ্রহে আমার জন্যে একটা ঘর ছেড়ে দিল; কিন্তু যেহেতু আমাদের আটজনকে ওই ঘরে থাকতে হত, আর তার একটিমাত্র দরজা খুললে ওই অস্বাস্থ্যকর উঠোন, সেকারণেই আমি খোলা জায়গাতেই রাত্রি যাপন করা স্থির করলাম।

    রাতের খাবারের নামে কোনোমতে তৈরি করা কিছু খাবার খেয়ে, আমার লোকগুলিকে নিরাপদে ঘরে বন্ধ দেখে, আমি রাস্তার ধারে একটা গাছে পিঠ দিয়ে জায়গা করে নিলাম। গ্রামবাসীরা বলেছিল যে বাঘটার এই রাস্তা ধরে যাতায়াত করার অভ্যাস আছে এবং যেহেতু আকাশে ছিল পূর্ণ চাঁদ, ভাবলাম, আমার প্রথম গুলি করার সুযোগ মিললেও মিলতে পারে অবশ্য যদি আমি তাকে প্রথমে দেখি।

    শিকারের খোঁজে জঙ্গলে আমি অনেক রাত কাটিয়েছি, কিন্তু মানুষখেকোর খোঁজে রাত কাটানো আমার এই প্রথম। আমার ঠিক সামনেই পুরো রাস্তাটা চাঁদের আলোয় ঝকঝক করছে কিন্তু ডাইনে-বাঁয়ে ঝুঁকে পড়া গাছগুলো ফেলেছে ঘন ছায়া; যখন রাত্রের বাতাসে গাছের ডালপালা আন্দোলিত আর ছায়ারা সঞ্চারমান, তখন এক ডজন বাঘকে আমি আমার দিকে এগিয়ে আসতে দেখলাম, আর ঝোঁকের মাথায় মানুষখেকোর করুণার ওপর নিজেকে ছেড়ে দেবার জন্যে তিক্ত অনুশোচনা অনুভব করলাম। গ্রামে ফিরে যাওয়া আর নিজে থেকে নিজের ওপর যে দায়িত্ব নিয়েছি, তা বহনে আমার যে খুব ভয় আছে, তা প্রকাশে আমার সাহসের অভাব ছিল এবং যেমন ভয়ে, তেমনি ঠান্ডায় দাঁত কপাটি অবস্থায় সুদীর্ঘ রাতটা বসে কাটালাম। আমি যে তুষারাবৃত গিরিশ্রেণীর মুখোমুখি ছিলাম, সেটা যখন ধূসর ঊষার রঙে আলোকিত হল, আমার উঁচু টান করা হাঁটু দুটোর ওপর তখন মাথাটা রেখে চোখ বুজলাম আর একঘণ্টা পরে আমার লোকেরা যখন আমাকে খুঁজে পায় তখন আমি ঘুমে অচেতন; আর বাঘের, আমি না সাড়া পেয়েছি, না দেখেছি কিছু।

    গ্রামে ফিরে গিয়ে যেখানে গ্রামের মানুষ মাঝে মাঝে নিহত হয়েছে, সেই জায়গায় আমাকে নিয়ে যাবার জন্যে, লোক পাবার চেষ্টা করলাম কিন্তু এ কাজ করতে তারা অনিচ্ছুক; রাতটাতে আমি বেঁচে গেছি দেখে, তারা খুবই অবাক হয়েছে, দেখলাম। যেদিকে লোক মারা পড়েছে, উঠোন থেকেই, তারা সেদিকটা আমাকে দেখিয়ে দিল। শেষ হত্যা-যেটি আমাকে ঘটনাস্থলে এনেছে গ্রামের পশ্চিমে পাহাড়ের উঁচনো ঢালের মোড় ঘুরে ঘটেছে। হতভাগ্য মেয়েটি যখন নিহত হয়, তখন সংখ্যায় প্রায় বিশজন রমণী ও বালিকা, যারা গৃহপালিত পশুর জন্যে ওক পাতা সংগ্রহ করতে বেরিয়েছিল, তারা আমাকে ঘটনাটির বিশদ বিবরণী দিতে ব্যর্থ হল। জানা গেল, মধ্যাহ্নের দু ঘন্টা আগে দলটি বেরিয়ে পড়ে এবং আধ মাইল যাবার পর পাতা কাটার জন্যে গাছে চড়ে। নিহত রমণী এবং আরো দুজন মেয়ে গিরিখাতের কিনারে অবস্থিত। একটি গাছ বেছে নেয়, পরে দেখেছিলাম, খাতটি আন্দাজ চার ফুট গভীর এবং দশ থেকে বার ফুট চওড়া। যত পাতা তার দরকার ছিল, কেটে নিয়ে মেয়েটি গাছ থেকে নেমে আসছিল, তখন বাঘটি কাছে আসে অলক্ষে, পেছনের পায়ে ভর দিয়ে উঁচু হয়ে দাঁড়ায় এবং মেয়েটির পা কামড়ে ধরে। যে ডাল ধরে সে নিচে নামছিল তা থেকে মেয়েটির মুঠি খুলে আসে, তাকে গিরিখাতের ভেতরে টেনে নিয়ে বাঘ তার পা ছেড়ে দেয় এবং যখন সে উঠে পড়ার জন্যে ধস্তাধস্তি করেছে, বাঘ তার গলা কামড়ে ধরে। মেয়েটিকে মারবার পর গিরিখাতের কিনার দিয়ে সে লাফিয়ে ওঠে এবং তাকে নিয়ে কোনো নিবিড় জমিন-ঝোপে উধাও হয়।

    এ-সমস্তই ঘটে গাছের ওপরে থাকা দুটি মহিলা থেকে কয়েক ফুট দূরে আর তা প্রত্যক্ষ করে পুরো দলটা। বাঘ তার শিকার নিয়ে চোখের সামনে থেকে অদৃশ্য হয়ে যেতেই ভীত-চকিত মহিলা ও মেয়েরা দৌড়ে গ্রামে ফেরে। পুরুষেরা দুপুরে খাবার জন্যে তখন সবে এসেছে আর সকলে একত্র হতে, নাকারা, রান্নার ধাতব বাসনপত্র–কার্যত যা কিছু দিয়ে আওয়াজ সৃষ্টি সম্ভব, নিয়ে সবাই উদ্ধারকারী দল গড়ল। পুরুষরা রইল সামনে, মেয়েরা রইল পেছনে।

    যে খাদটায় মহিলাটি মরেছিল, সেখান পৌঁছে জল্পনা-কল্পনা আরম্ভ হল। এখন কি করা যায়। কিন্তু তিরিশ গজ দূরত্বের ঝোঁপ থেকে প্রচণ্ড গর্জনে বাঘটা জল্পনা-কল্পনার ব্যাঘাত ঘটায়। দলটা একসঙ্গেই ফিরে দাঁড়াল আর এলোপাথাড়ি ছুটল গ্রামের দিকে। তারপর উত্তেজনা প্রশমিত হতেই, পরস্পর পরস্পরকে দোষারোপ করতে থাকে যে কে আগে ছুটেছে এবং দলকে ছত্রভঙ্গ করে ফেলার কারণ হয়েছে। স্বর উচ্চ গ্রামে উঠতেই থাকল, ততক্ষণে না বলা হয় যে যদি কেউই ভীত হয়ে না থাকে আর সকলেই যদি নিজেকে সাহসী বলে দাবি করে, তাহলে কেন ফিরে যাওয়া হচ্ছে না এবং আরো সময় নষ্ট না করে মহিলাকে উদ্ধার করা হচ্ছে না। প্রস্তাবটি গৃহীত হয় আর তিনবার দলটি খাত পর্যন্ত যায়। তৃতীয়বারের বার বন্দুক হাতে সশস্ত্র লোকটি গুলি ছোঁড়ে আর গর্জনরত বাঘটাকে ঝোঁপ থেকে বার করে আনে; অতঃপর উদ্ধার-চেষ্টা অত্যন্ত বিজ্ঞতার সঙ্গেই পরিত্যক্ত হল। সে কেন ঝোপের দিকে গুলি চালিয়ে ফাঁকা আওয়াজ করল, এ কথা বন্দুকধারী লোকটাকে জিজ্ঞাসা করায়, সে বলল যে, বাঘটা খেপেই ছিল, আর যদি কোনোক্রমে সে তাকে আঘাত করত, তবে অবশ্যই বাঘটা তাকে মেরে ফেলত।

    সেদিন সকালে তিনঘণ্টা ধরে বাঘের সন্ধানে পদচিহ্ন লক্ষ করে গ্রাম পরিক্রমা করলাম আশায় আর আতঙ্কে। অন্ধকারে ঘনজঙ্গলাবৃত গিরিখাতের একজায়গায় যখন আমি একটা ঝোপের পাশ কাটিয়ে যাচ্ছিলাম, তখনই একঝক কালিজ পাখি ডানা ঝাঁপটিয়ে চিৎকার করতে করতে বেরিয়ে এল আর আমার মনে হল, আমার হৃদস্পন্দন চিরদিনের মত থেমে গেছে।

    আমার খাওয়ার জন্যে আখরোট গাছের নিচে, আমার লোকেরা একটু জায়গা পরিষ্কার করে রেখেছিল। প্রাতরাশের পর গ্রামের মোড়ল, যখন গম কাটা হবে, তখন আমাকে পাহারায় মোতায়েন থাকতে অনুরোধ করল। সে বলল যে যদি আমার উপস্থিতিতে ফসল কাটা না হয়, তবে আর হয়তো হবেই না, কারণ, লোকেরা ঘর থেকে বেরুতে অত্যন্ত ভয় পাচ্ছে। আধঘণ্টা পরে গ্রামের সমস্ত মানুষ কাজে লেগে গেল, সহায়ক ছিল আমার লোকেরা আর তখন গুলিভরা রাইফেল নিয়ে আমি, দাঁড়িয়ে রইলাম পাহারায়। সন্ধের মধ্যেই পাঁচটি বড় মাঠের শস্য কাটা হয়ে গেল, বাকি রইল গৃহস্থলির নিকটবর্তী দুটো ছোট জমি। সে সম্পর্কে মোড়ল বলল যে পরদিন ওগুলোর ব্যবস্থা করতে তার অসুবিধে হবে না।

    গ্রামের স্বাস্থ্যব্যবস্থার পরিস্থিতির অনেক উন্নতি ঘটেছিল আর সম্পূর্ণ আমার একার ব্যবহারের জন্য অন্য একটি ঘর দেওয়া হয়েছিল। সে-রাত্রে যাতে করে হাওয়া ঢুকতে পারে আর মানুষখেকোটাকে ঠেকানো যায়, সেজন্য দরজার মুখটা কাঁটাঝোপ দিয়ে ভালভাবে ঠেসে, আমি গতরাত্রের না হওয়া ঘুমটাকে পুরিয়ে নিতে ঘুমিয়ে পড়লাম।

    আমার উপস্থিতিতে লোকের মনে নতুনতর আশা সঞ্চারিত হতে শুরু করে ও তারা অনেক বেশি অবাধে চলাফেরা করছিল, কিন্তু যে-জঙ্গলটার ওপর আমি কিছু গুরুত্ব আরোপ করেছিলাম, সেটা ঘুরিয়ে দেখিয়ে নিয়ে আসার জন্যে পুনর্বার অনুরোধ করবার মত তাদের যথেষ্ট বিশ্বাস তখনও আমি অর্জন করতে পারি নি। এই লোকেরা চারপাশের মাইলের পর মাইল জমির প্রত্যেক ফুটকে চেনে আর যদি ইচ্ছে করে, তবে দেখাতে পারে কোথায় আমার বাঘটির দেখা পাওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা, অথবা অন্তত কোথায় আমি দেখতে পারি তার থাবার ছাপ। মানুষখেকোটা যে বাঘ, এটা স্বীকৃত তথ্য কিন্তু এটা জানা ছিল না যে জানোয়ারটা তরুণ না বয়স্ক, পুরুষ না মেয়ে আর এই তথ্য, যা আমাকে তার সঙ্গে মোকাবিলায় সাহায্য করবে বলে আমার ধারণা কেবলমাত্র তার থাবার ছাপ পরীক্ষা করেই আমি নিশ্চিত বলতে পারতাম।

    সেদিন খুব সকালে চা-পান সেরে আমি জানালাম যে আমার লোকেদের জন্যে মাংসের দরকার আর গ্রামবাসীদের বললাম যে তারা যদি আমায় দেখিয়ে দেয় যে কোথায় আমি ঘুরাল (পাহাড়ী ছাগল) মারতে পারি। পুব থেকে পশ্চিমে লম্বালম্বি শৈলসিরার চূড়ায় গ্রামটি অবস্থিত আর ঠিক রাস্তাটার নিচেই, যেখানে আমি রাত কাটিয়েছিলাম, পাহাড়টা সোজা উত্তরে নেমে গিয়েছে ঘাসে ঢাকা ঢালুতে। আমাকে বলা হয়েছিল যে এই ঢালুগুলিতে অনেক ঘুরাল মেলে, আর কিছু লোক স্বেচ্ছায় আমাকে ঘুরিয়ে দেখাতে রাজী হল। এই সম্মতিতে আমার আনন্দ যাতে প্রকাশ না পায় সে বিষয়ে সতর্ক ছিলাম। তিনজন লোক বেছে নিয়ে আমি যাত্রা করলাম; আর মোড়লকে বলে গেলাম যে সে যেমনটি বলেছে, তত ঘুরাল যদি পাই, তাহলে আমার লোকদের জন্যে একটার সঙ্গে গ্রামের লোকদের জন্যেও দুটো মারব।

    রাস্তা পেরিয়ে ডাইনে বায়ে সূতীক্ষ নজর রেখে একটা খাড়া শৈলশিরা বেয়ে নিচে নেমে গেলাম কিন্তু কিছুই নজরে এল না। পাহাড়ের আধমাইল নিচে খাতগুলো একজায়গায় এসে মিলেছে, এবং এই সংযোগস্থলের ডানদিকে শিলাময় ঘাসে ঢাকা ঢালুর চমৎকার দৃশ্য। নিঃসঙ্গ একটি পাইন গাছ বেড়ে উঠেছে ওখানে। তাতেই পিঠ রেখে বসে কয়েক মিনিট ধরে ঢালুটাকে তন্ন তন্ন করে দেখছিলাম, তখনই পাহাড়ের অনেক উঁচুতে একটা নড়াচড়ার শব্দ আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। পুনর্বার ওই নড়াচড়ার শব্দে দেখলাম একটা ঘুরাল কান নাড়ছে; জানোয়ারটা দাঁড়িয়ে আছে ঘাসের মধ্যে আর কেবলমাত্র তার মাথাটাই দেখা যাচ্ছে। লোকেরা ওই নড়াচড়া দেখে নি আর এখন যেহেতু মাথাটা স্থির আর পারিপার্শ্বিকের সঙ্গে মিশে আছে; সেকারণেই আর তাকে চিহ্নিত করা সম্ভব নয়। জানোয়ারটার অবস্থান সম্পর্কে একটা সাধারণ ধারণা নিয়ে আমি লোকদের বসিয়ে রাখলাম আমার গুলি চালানো দেখার জন্যে। আমি ছিলাম একটা পুরানো মার্টিনী হেনরী রাইফেলে সশস্ত্র; এটা এমন একটা অস্ত্র, তার যে-কোনো দূরত্বে অব্যর্থ লক্ষ্যভেদের কাছে এর সাংঘাতিক ধাক্কাও তুচ্ছ মনে হয়। দূরত্বটা ছিল দুশো গজের কাছাকাছি। শুয়ে পড়ে রাইফেলটাকে সুবিধামত পাইনের শিকড়ে রেখে, আমি সতর্ক নিশানায় গুলি ছুঁড়লাম।

    কার্তুজ থেকে কালো পাউডার বেরিয়ে আসা ধোঁয়ায় আমার দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে গেল আর লোকেরা বলল, কিছুই ঘটে নি; আমি সম্ভবত পাথরে অথবা মরা পাতার স্তূপে গুলি চালিয়েছি। যেখানে ছিলাম, ঠিক সেইখানে বসে থেকে আমি আবার রাইফেলে গুলি ভরলাম আর তখনই দেখলাম যে, যেখানে আমি গুলি ছুঁড়েছিলাম, তার সামান্য নিচেই ঘাস নড়ছে আর তারপরেই ঘুরালের পেছনের অংশটা বেরিয়ে এল। যখন আস্ত জানোয়ারটা ঘাস থেকে বেরিয়ে এল, সে গড়াতে আরম্ভ করল, আর ঢালু পাহাড় বেয়ে নামার ফলে তার গতিবেগ বৃদ্ধি পেল। নিচুর দিকে অর্ধেক পথ নেমেই সে অদৃশ্য হল ঘন ঘাসের জঙ্গলে, সেখানে শুয়ে থাকা দুটো ঘুরালের অশান্তি ঘটিয়ে। হাঁচির মত সতর্কতাসূচক ডাক ছেড়ে দুটো জানোয়ার ঘাসের মধ্যে থেকে তীব্র বেগে বেরিয়ে এসে পাহাড়ের ওপর দিকে লাফিয়ে উঠতে থাকল। এখন দূরত্ব অনেক কম, নিশানা ঘোড়াটা নিয়ন্ত্রণ করে, দুটোর মধ্যে বড়টাকে গতিবেগ শ্লথ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করলাম তারপর ওটার পিঠের মধ্যে গুলি চালালাম, আর সেইমাত্র অন্যটি ঘুরে দাঁড়াল ও পাহাড়ের ওপর দিয়ে কোনাকুনি ছুটতে থাকল, আমি এটার কাঁধের মধ্যে গুলি করলাম।

    আপাতদৃষ্টিতে অসম্ভবকে সম্ভব করার সৌভাগ্য কখনো কখনো একজনের হয়। অসুবিধাজনক অবস্থায় শুয়ে দুশো গজ দূরে ঘুরালের গলায় একটা সাদা দাগ লক্ষ করে ষাট ডিগ্রি কোণে গুলি চালাবার পর মনে হয় নি যে গুলি লাগবার লাখে একটাও সম্ভাবনা আছে, এবং তা সত্ত্বেও কালো বারুদ চালিত ভারি সীসের বুলেট একচুলও নড়ে যায় নি আর সঠিক নিশানা বিধে তৎক্ষণাই জানোয়ারটার মৃত্যু ঘটিয়েছে। তারওপর খাড়াই পাহাড়ের একপাশটা ছোট ছোট খাত ও উঁচিয়ে বেরিয়ে আসা পাথরে ভাঙা ভাঙা মতন, মরা জানোয়ারটা পিছলে গড়িয়ে পড়েছে সেই জায়গাতেই, যেখানে তার দুজন সঙ্গী শুয়েছিল। ও ঘাসে ঢাকা জমিটা ছাড়ার আগেই সঙ্গী দুজন পাহাড় বেয়ে পিছলে গড়িয়ে পড়েছিল। যারা কখনো ইতিপূর্বে রাইফেলের কার্যকারিতা দেখে নি, আমাদের সামনে তিনটে মৃত জানোয়ারের খাতে পড়া দেখে, সেই সমস্ত লোকের বিস্ময় ও উল্লাস দেখা এক মহা আনন্দের জিনিস। মানুষখেকো বিষয়ে সমস্ত চিন্তা ক্ষণকালের জন্যে তিরোহিত হল, কারণ তারা হুড়োহুড়ি করে নিচে খাতে নেমেছিল শিকার উদ্ধারে।

    একাধিক দিক দিয়েই সেদিনের অভিযান এক বিরাট সার্থকতা; কারণ, সকলের জন্যে মাংসের রেশন যোগান দেবার সঙ্গেই এটা আমাকে সমস্ত গ্রামের আস্থা এনে দিল। সকলেই জানেন যে, শিকারের গল্প বারবার বললেও একঘেয়ে হয় না, এবং যখন ঘুরালের ছাল ছাড়িয়ে ভাগ করা হচ্ছিল, তখন আমার শিকার-সঙ্গী তিনজন কল্পনার রাশ ছেড়ে দিল। যে-খোলা জায়গায় বসে আমি প্রাতরাশ সারছিলাম, সেখান থেকেই আমি সমবেত জনসমষ্টির উল্লাস শুনতে পাচ্ছিলাম। তখনই তাদের বলা হচ্ছিল যে এক মাইলেরও বেশি দূরে থেকে ঘুরাল মারা হয়েছে, আর যে ম্যাজিক বুলেট ব্যবহৃত হয়েছে তা কেবলমাত্র ওইরকম ভাবে-জানোয়ারদেরই মারে নি-সেইসঙ্গে ওগুলোকে সাহেবের পায়ের কাছে এনে জড়োও করেছে।

    দুপুরের খাওয়া-দাওয়ার পর মোড়ল জানতে চাইল যে কোথায় আমি যেতে চাই আর কতজন লোক আমি আমার সঙ্গে নিতে ইচ্ছুক। চারপাশে ঘিরে দাঁড়ানো উৎসুক মানুষগুলোর মধ্যে থেকে আমি বেছে নিলাম আমারই দুজন প্রাক্তন সঙ্গীকে আর গাইড হিসাবে তাদের সঙ্গে করে শেষ মানুষ শিকারের জায়গাটা দেখতে চাইলাম।

    আমাদের পাহাড়ের অধিবাসীরা হিন্দু ও তাদের শবদেহ দাহ করে। যখন তাদের কেউ মানুষখেকোর হাতে নিহত হয়, তখন আত্মীয়দের ওপর দায়িত্ব বর্তায় যে তার শরীরের কোনো অংশ, এমন কি কয়েক টুকরো হাড় থাকলেও, তা উদ্ধার করে এনে দাহ করা। এই মহিলার ক্ষেত্রে দাহকার্য তখনও পর্যন্ত সম্পন্ন হয়নি এবং আমদের বেরুবার মুখে আত্মীয়েরা অনুরোধ জানান যে শরীরের কোনো অংশ পেলে, আমরা যেন ফিরিয়ে আনি।

    খুব ছেলেবেলা থেকে জঙ্গলের চিহ্ন পড়া ও ব্যাখ্যা করা ছিল আমার নেশা। বর্তমানক্ষেত্রে আমি, যারা মহিলাটি নিহত হবার সময়ে উপস্থিত ছিল, সেই প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণ পেয়েছিলাম, কিন্তু প্রত্যক্ষদর্শীরা সর্বদা বিশ্বাসযোগ্য নয়। অন্যপক্ষে জঙ্গলের চিহ্নাদি হল, যা কিছু ঘটেছে তার সত্য বিবরণী। জায়গাটায় পৌঁছে এক নজরে, মাটিই আমাকে দেখিয়ে দিল যে বাঘটা কেবলমাত্র একটা পথেই গাছের কাছে আসতে পারে আর তা হল খাত ধরে উজিয়ে আসা। গাছের একশো গজ নিচে খাতে নেমে, পরীক্ষা করে, দুটো বড় শিলাখণ্ডের মাঝখানে ওপর থেকে পড়া মিহিন মাটিতে বাঘের থাবার ছাপ পেলাম। এই থাবার ছাপই বুঝিয়ে দিল যে জানোয়ারটা হল এমন একটি বাঘিনী যে যৌবন সামান্য দিন পার করেছে। খাতের সামান্য ওপরে, গাছটা থেকে গজ দশেক দূরে, শিলাখণ্ডের পেছনেই শুয়ে ছিল বাঘটা, সম্ভবত মহিলাটির গাছ থেকে নামার অপেক্ষায়। ওর উদ্দিষ্ট শিকারের যতগুলো পাতার প্রয়োজন ছিল, প্রথমত কাটা শেষ করে, প্রায় দুইঞ্চি মোটা একটা ডাল ধরে সে যখন নিজের দেহটি নামাচ্ছিল, তখনই বাঘটা হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে আসে, আর তারপর পেছনের পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে মহিলাটির পা কামড়ে ধরে তাকে টেনে নিচের খাতে নিয়ে যায়। ডালটা থেকেই বোঝা যায় কী পরিমাণ মরিয়াভাবে মহিলাটি ওটাকে আঁকড়ে ধরেছিল, যেখানে ডালটা, শেষ পর্যন্ত, তার পাতাগুলো তার হাত ফসকে বেরিয়ে যায়, সেখানে ওকের রুক্ষ বাকলের গায়ে আটকে আছে তার হাতের তালু ও আঙুল থেকে ছিঁড়ে বেরিয়ে আসা ফালা ফালা চামড়া। বাঘিনীটা যেখানে মহিলাটিকে হত্যা করেছে সেখানে রয়েছে ধস্তাধস্তির চিহ্ন আর অনেকখানি জায়গা জুড়ে শুকনো রক্ত। এখান থেকে, রক্তের ধারা খাত পার হয়ে বিপরীত দিকের পাড় বেয়ে উঠে গেছে। সে রক্ত এখন শুকনো, তবু স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। খাত পেরিয়ে রক্তের ধারা অনুসরণ করে আমরা পেয়ে গেলাম ঝোপের মধ্যে সেই জায়গাটা, যেখানে বাঘিনী তার মড়িটাকে খেয়েছে।

    এটাই সাধারণের বিশ্বাস যে মানুষখেকোরা নিহত মানুষের মাথা, হাত এবং পা খায় না। এটা অসত্য। মানুষখেকোরা ব্যাঘাত না ঘটলে, রক্তমাখা কাপড়-চোপড় সমেত সবই খায়, যেমনটি আমি এক সময়ে একটি ক্ষেত্রে দেখেছিলাম; যাই হক, সেটি অন্য ঘটনা এবং অন্য কোনো সময়ে বলা যাবে।

    এক্ষেত্রে আমরা পেলাম মহিলাটির কাপড়জামা আর কয়েকটুকরো হাড়। সেগুলো পরিষ্কার কাপড়ে জড়িয়ে আমরা নিয়ে এলাম ওই উদ্দেশ্যে। অত্যন্ত স্বল্প হলেও যা অবশিষ্ট ছিল, দাহ করার পক্ষে তাই যথেষ্ট। তা ওই উঁচু জাতের মহিলার চিতাভসা মা-গঙ্গার বুকে পৌঁছানো নিশ্চিত করবে।

    চা পানের পর আমি অন্য একটা বিয়োগান্ত দৃশ্যের স্থান পরিদর্শন করলাম। সাধারণের চলাচলের রাস্তা দ্বারা মূল গ্রাম থেকে বিচ্ছিন্ন কয়েক একর ছোট জমিন। এই জমিনের মালিক রাস্তার ঠিক ওপরে পাহাড়ের গায়ে নিজেই একটা কুঁড়েঘর তৈরি করেছিল। তার স্ত্রী, দুই ছেলে-মেয়ের মা-ছেলে ও মেয়ের বয়স যথাক্রমেত চার ও ছয়। দু-বোনের মধ্যে তার স্ত্রীই ছিল ছোট। এই দু-বোন একদিন কুঁড়ের ওপরে পাহাড়ে ঘাস কাটতে বেরিয়েছিল, তখন অকস্মাৎ বাঘিনী বেরিয়ে এসে বড় বোনকে তুলে নিয়ে যায়। তার দিদিকে ছেড়ে দিয়ে পরিবর্তে তাকে নিয়ে যাক বলে কাস্তে ঘুরিয়ে চিৎকার করতে করতে ছোট বোনটি বাঘিনীর পেছনে প্রায় একশো গজ দূর পর্যন্ত ছুটতে থাকে। মূল গ্রামের লোকেরা এই অবিশ্বাস্য বীরত্বব্যঞ্জক কাজটি স্বচক্ষে দেখে। মৃতা মহিলাকে একশো গজটাক বয়ে নিয়ে গিয়ে নামিয়ে রেখে যে মেয়েটি তার পিছু নিয়েছিল, বাঘিনী তার দিকে মুখ ফেরায়। ভয়ঙ্কর গর্জন করে সে মহিলাটির দিকে লাফ দেয়, আর মেয়েটি ঘুরে, পাহাড়ের ঢাল বেয়ে রাস্তা পেরিয়ে ছুটতে ছুটতে গ্রামে ঢোকে। ধরা যায়, তার অজান্তে গ্রামের লোকেরা যা প্রত্যক্ষ করেছে, তাদের তা বলাই ছিল তার ইচ্ছে। সে সময়ে মহিলাটির অসংলগ্ন আওয়াজের কারণ তার দম ফুরিয়ে যাওয়া,.ভয় এবং উত্তেজনা। আর যতক্ষণ না উদ্ধারকারী দল, তড়িঘড়ি তৈরি হয়ে বেরিয়ে যায়, ও ব্যর্থ হয়ে ফেরে, ততক্ষণ জানাই যায় নি যে মহিলা তার কথা বলার ক্ষমতা হারিয়েছে। গ্রামটিতে আমাকে এই গল্পই বলা হয়েছিল আর আমি যখন পথ বেয়ে উঠে দু ঘরের কুঁড়েটায় পৌঁছলাম, তখন মহিলাটি সেখানে কাপড় কাঁচছিল। বিগত বারমাস ধরে সে তখন বোবা।

    তার চোখের উদ্বেগজনক চাহনি ছাড়া, বোবা মহিলাকে স্বাভাবিকই মনে হল এবং যখন আমি তার সঙ্গে কথা বলার জন্যে দাঁড়ালাম আর তাকে বললাম যে, যে-বাঘটা তার বোনকে হত্যা করেছে তাকে মারতে চেষ্টা করতেই আমি এসেছি, তখনই সে দুহাত জোড় করল আর নিচু হয়ে আমার পা ছুঁল, ফলে নিজেকে মনে হল এক হতভাগ্য প্রতারক। সত্য যে, আমি এসেছিলাম মানুষখেকোটাকে মারবার প্রতিজ্ঞা নিয়েই কিন্তু যে-জানোয়ারের খ্যাতি আছে যে সে একই জনবসতিতে দুবার হত্যা করে না, মড়ির কাছে আরেকবার ফেরে না এবং যার বিচরণক্ষেত্রের বিস্তৃতি বহুশত বর্গমাইল, সেক্ষেত্রে আমার উদ্দেশ্যসাধনের সম্ভাবনা প্রায় সেই, দুটো খড়ের গাদা থেকে উঁচ খুঁজে বের করা।

    প্রচুর পরিকল্পনা করলাম নৈনিতালে ফিরতি পথে; এর একটা পথে ইতিমধ্যেই চেষ্টা করেছি, বুনো ঘোড়াও আরেকবার আমাকে ও-পথে ঠেলতে পারবে না, আর এখন যখন আমি ঘটনাস্থলে অন্যগুলিও সমানই অচিত্তাকর্ষক। তার ওপরে সেখানে এমন কেউই ছিল না, যার কাছে আমি পরামর্শ চাইতে পারি, কারণ জানিতকালে কুমায়ুনে এটাই প্রথম মানুষখেকো; এবং তৎসত্ত্বেও কিছু একটা করা দরকার। সেজন্যেই পরের তিনদিন, গ্রামের লোকেরা যে-সমস্ত জায়গায় বাঘিনীর দেখা পাবার সম্ভাবনার কথা বলেছে, জঙ্গলের মধ্যে মাইলের পর মাইল ধরে সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সে-সমস্ত জায়গা ঘুরলাম।

    এখানে কয়েক মিনিটের জন্যে গল্পটা থামিয়ে, এই পাহাড়ী অঞ্চল জুড়ে আমার, সম্পর্কে যে গুজব চলেছে, তার প্রতিবাদ জানাতে চাই, আর তা হল, এই ঘটনাকালে এবং পরবর্তীকালে কয়েকবার, পাহাড়ী মহিলার পোশাক পরে জঙ্গলে গিয়ে—মানুষখেকোকে আমার প্রতি আকৃষ্ট করে, তারপর কাস্তে অথবা কুড়োল দিয়ে তাদের মেরেছি। পোশাক বদলের ব্যাপারে এ পর্যন্ত আমি যা করেছি তা হল, শাড়ি ধার করে গায়ে জড়িয়ে ঘাস কেটেছি অথবা গাছে উঠে পাতা কেটেছি আর কোনোবারই এই ছলনা কাজের বেলা সফল হয় নি। যদিও আমার জ্ঞানত, দুবার, আমি যে-গাছে ছিলাম, মানুষখেকোরা তা তাক করেছে, একবার একটা পাথরের পেছনে লুকিয়ে আর অন্যবার একটা উপাড়িত গাছের পেছনে থেকে। তাদের গুলি করবার কোনো সুযোগই তারা আমাকে দেয় নি।

    ফেরা যাক মূল কাহিনীতে। বাঘিনীটা এই অঞ্চল পরিত্যাগ করেছে মনে হওয়ায়, পালির লোকজনদের খেদ সত্ত্বেও স্থির করলাম, পালির ঠিক পুবে পনের মাইল দূরে চম্পাবতে চলে যাব। খুব সকালে যাত্রা করে, ধুনাঘাটে প্রাতরাশ সেরে, সূর্যাস্তের মধ্যে চম্পাবতে পৌঁছে যাত্রা শেষ করলাম। এই এলাকার রাস্তাঘাট খুবই বিপজ্জনক মনে করা হয় আর লোকেরা গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে অথবা বাজারে যায় দল বেঁধে। ধূনাঘাট ত্যাগের পর, আমার আটজন লোকের দলের সঙ্গে রাস্তার কাছাকাছি গ্রাম থেকে লোকেরা এসে জুটল আর আমরা চম্পাবতে পৌঁছেছিলাম তিরিশ জন মিলে। আমার সঙ্গে যারা যোগ দিয়েছিল, তাদের মধ্যে কয়েকজন কুড়িজনের একটা দলের সঙ্গে দু-মাস আগে চম্পাবতে গিয়েছিল এবং তারা আমাকে এই করুণ কাহিনীটি বলল।

    চম্পাবতের এধারে কয়েক মাইল ধরে রাস্তাটা পাহাড়ের দক্ষিণ মুখ বেয়ে উপত্যকার প্রায় পঞ্চাশ গজ ওপর দিয়ে সমান্তরালভাবে চলে গেছে। দুমাস আগে আমরা কুড়িজন পুরুষের একটা দল চম্পাবতের বাজারে যাচ্ছিলাম। এই রাস্তা ধরে যাবার সময় দুপুর নাগাদ, নিচের উপত্যকা থেকে ভেসে আসা একজন মানুষের আর্ত চিৎকার শুনে ভয়ে চমকে গেলাম। চিৎকার যত কাছে আসতে লাগল, রাস্তার ধারে সকলে একসঙ্গে জড়সড় হয়ে ভয়ে কাঁপতে থাকলাম, আর তখনই ক্ৰমে চোখে পড়ল, বাঘ একটি বিবস্ত্রা মহিলাকে নিয়ে যাচ্ছে। বাঘের এক দিকে, মহিলাটির চুল মাটিতে ঘষটাচ্ছে আর অন্যদিকে মাটিতে হেঁচড়াচ্ছে তার পা দুটো–বাঘটা কামড়ে আছে তার কোমরের পেছনটা–আর সে বুক চাপড়ে, তাকে সাহায্য করবার জন্যে একবার ডাকছে ভগবানকে, একবার মানুষকে। পঞ্চাশ গজ দূরে, একেবারে আমাদের চোখের সামনে বাঘ তার বোঝা নিয়ে চলে গেল আর দূরান্তে কান্নার শব্দ মিলিয়ে যাবার পর আমরা আবার চলতে শুরু করলাম।

    ‘আর তোমরা কুড়ি জন মানুষ কিছুই করলে না?

    ‘না, সাহেব, কিছুই করি নি, কারণ আমরা ভয় পেয়েছিলাম, আর ভয় পেলে মানুষ কি করতে পারে? তাছাড়া যদি আমরা বাঘটাকে না খেপিয়ে এবং নিজেদের দুর্ভাগ্য ডেকে না এনে, মহিলাকে উদ্ধার করতে পারতাম, তাতেও মহিলার কোনোই লাভ হত না, কারণ তার শরীর তখন রক্তে মাখা এবং জখমের কারণেই তার মৃত্যু হত।

    পরে জানতে পারি যে নিহত চম্পাবতের নিকটস্থ গ্রামেরই বাসিন্দা এবং শুকনো ডাল সংগ্রহ করবার সময়ে বাঘ তাকে নিয়ে যায়। তার সঙ্গীরা ছুটে গ্রামে ফিরে এসে শোরগোল তোলে, আর উদ্ধারকারী দল বেরুবার মুখেই ওই কুড়িজন ভীত মানুষ পৌঁছয়। যেহেতু এই লোকগুলো জানত যে বাঘ তার শিকার নিয়ে কোন দিকে গেছে, সেকারণেই তারা দলে যোগ দেয় এবং এর পরবর্তী ঘটনা এরাই ভাল বলতে পারবে।

    যখন আমরা মহিলাটিকে উদ্ধার করতে বেরোলাম তখন আমাদের দলে পঞ্চাশ বা ষাট জন শক্তসমর্থ লোক, এবং দলের কয়েকজনের হাতে বন্দুক। যেখানে মহিলা কাঠগুলো সংগ্রহ করেছিল, সেগুলো সেখানেই পড়ে আছে এবং যেখান থেকে তাকে তুলে নিয়ে যায়, তা থেকে এক ফার্লং দূরে আমরা পেলাম তার ছেঁড়া কাপড়-জামা। তারপর থেকে লোকেরা ঢাক বাজাতে আর বন্দুক ছুঁড়তে আরম্ভ করে এবং এভাবেই আমরা একমাইলেরও বেশি গিয়ে উপত্যকার মুখে পৌঁছলাম; দেখা পেলাম মহিলার একটা বড় পাথরের চাতালের ওপর মরে পড়ে আছে, বালিকার চেয়ে সামান্যই বড় মনে হল তাকে। সমস্ত রক্ত চেটে তার শরীর পরিষ্কার করা ছাড়া, বাঘটা তাকে ছোঁয়ও নি, এবং দলে কোনো মহিলা না থাকায়, দু-একজন তাদের কটিবস্ত্র খুলে ঢেকে দেয়। আমরা পুরুষেরা তা দিয়ে তার শরীর জড়াবার সময়ে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে ছিলাম, কারণ তাকে দেখাচ্ছিল, যেন চিৎ হয়ে শুয়ে ঘুমুচ্ছে, ছুঁলে পরেই জেগে উঠবে লজ্জায়।

    শক্ত-বন্ধ দরজার অন্তরালে সুদীর্ঘ রাত পাহারায় জেগে কাটাবার সময়ে এমন অভিজ্ঞতার কথা বারবার বলতে বলতে বছরের পর বছর মানুষখেকোর দেশের বাসিন্দা, মানুষের চরিত্র এবং জীবন সম্পর্কিত দৃষ্টিভঙ্গী যে বদলে যাবে, তাতে আর আশ্চর্য কি? আর বাইরের যে কোনো লোকেরই মনে হবে যে, সে সরাসরি একটা নগ্ন বাস্তবতা ও নখ-দাঁতের নীতির জগতে পা দিয়েছে, যে-কারণে একদন্তী বাঘেদের অধিরাজ্যের কালে মানুষ আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিল অন্ধকার গুহার ভেতর। সেই সূদুর চম্পাবত-দিনগুলিতে আমি ছিলাম তরুণ আর অনভিজ্ঞ, কিন্তু তা সত্ত্বেও, ওই উপদ্রুত অঞ্চলে সামান্যকাল থাকাতেই এই বিশ্বাসে পৌঁছেছিলাম যে, মানুষখেকোর ছায়ায় বসবাস ও নিজের অস্তিত্ব বজায় রাখার চেয়ে ভয়ঙ্কর আর কিছুই হতে পারে না; পরবর্তী বত্রিশ বছরের অভিজ্ঞতায় সে বিশ্বাস আরো দৃঢ় হয়েছে।

    চম্পাবতের যে তহশীলদারকে উদ্দেশ্য করে আমাকে পরিচয় পত্র দেওয়া হয়েছিল, তিনি, যে-ডাকবাংলোতে আমি উঠেছিলাম, সেখানে সে-রাত্রে দেখা করতে এলেন, এবং প্রস্তাব করলেন যে পরদিন আমার কয়েক মাইল দূরত্বের একটা বাংলোয় চলে যাওয়া উচিত, তার কাছাকাছি এলাকায় বহু মানুষ মারা পড়েছে।

    পরদিন খুব সকালেই তহশীলদারকে সঙ্গে নিয়ে বাংলোটির দিকে রওনা হলাম, এবং যখন বারান্দায় বসে প্রাতরাশ সারছিলাম, তখন দুজন নোক খবর নিয়ে এল যে দশ মাইল দূরের একটা গ্রামে, একটা গরুকে বাঘ মেরেছে। চম্পাবতে একটা জরুরী কাজে যাবার অজুহাতে তহশীলদার বিদায় নিল এবং জানাল যে সে সন্ধ্যায় বাংলোয় ফিরে রাতটা আমার সঙ্গে কাটাবে। আমার পথপ্রদর্শকেরা পথ হাঁটায় ওস্তাদ, তাই উত্রাই বেয়ে দশ মাইলের সমস্ত পথ আমরা পেরোলাম সাধ্য-সম্ভব স্বল্প সময়ে। গ্রামে পৌঁছতে, আমাকে নিয়ে যাওয়া হল একটা গোয়ালে; সেখানে দেখলাম, চিতা একটা এক-সপ্তাহের বাছুরকে মেরে খানিকটা খেয়েছে। চিতা মারার কোনো সময় বা ইচ্ছা না থাকায় পথপ্রদর্শকদের বখশিশ দিয়ে বাংলোর দিকের ফিরতি পথে পা বাড়ালাম। এখানে ফিরে দেখলাম তহশীলদার তখনো ফেরে নি, আর যেহেতু তখনো ঘণ্টাখানেক বা তারও বেশি সময় দিনের আলো বাকি ছিল, আমি বেরিয়ে পড়লাম বাংলোর চৌকিদারের সঙ্গে একটি জায়গা দেখতে। ও বলল, সেখানে একটি বাঘ নিয়মিত জল পান করে। যে ঝরনার উৎস বাগিচাটিতে সেচের জল যোগায় দেখলাম এ সেই জায়গা। ঝরনাটির চারধারে নরম মাটিতে বহু দিনের পুরনো থাবার চিহ্ন ছিল; তবে, যে গিরিখাতে পালি গ্রামের রমণীটি মারা পড়ে সেখানে আমি যে থাবার ছাপ দেখি এবং সযত্নে পরীক্ষা করি, এ পদরেখাগুলি তা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা।

    বাংলোতে ফিরে দেখলাম তহশীলদার ফিরে এসেছে এবং আমরা যখন বারান্দায় বসলাম, তাকে বললাম আমার সারাদিনের অভিজ্ঞতার কথা। আমাকে বাজে উদ্দেশ্যে অতদূর যেতে হয়েছিল বলে দুঃখ প্রকাশ করে ও উঠে পড়ল, বলল যেহেতু তাকে এক লম্বা পথ পাড়ি দিতে হবে, ওকে এখনই রওনা হতে হবে। এ-ঘোষণায় আমার কম বিস্ময় হল না, কেননা, সেদিন দুবার ও বলেছে রাতটা আমার সঙ্গে কাটাবে। ওর রাতে থাকার প্রশ্নটি নয়, আমাকে উদ্বিগ্ন করেছিল যে ঝুঁকি ও নিচ্ছিল। যা হক আমার সকল যুক্তিতেই ও কালা সাজল, এবং যে ধোঁয়াটে লণ্ঠন সামান্য আলোর আভা ছড়াচ্ছে মাত্র, তাই নিয়ে একটি লোকের অনুসরণে যে অঞ্চলে দিবালোকে মানুষ চলে শুধু বড় দল বেঁধে সেখান দিয়ে চার মাইল হাঁটার জন্য, সে যখন বারান্দা থেকে নেমে গেল অন্ধকার রাতের মধ্যে আমি এক অতি সাহসী মানুষের উদ্দেশ্যে মাথার টুপি খুললাম। ওকে চোখের আড়ালে চলে যেতে দেখে আমি ঘুরলাম ও বাংলোতে ঢুকলাম।

    এই বাংলোটির একটি কাহিনী বলার আছে আমার কিন্তু তা আমি এখানে বলব না। কেননা এ বই হল জঙ্গলের গল্পের, এবং প্রকৃতির নিয়মের ও পারের’ গল্পে সে গল্পের সঙ্গে ভাল খাপ খায় না।

    .

    ০২.

    আমি পরদিন সকালটি কাটালাম অতি বিস্তৃত ফল বাগিচা ও চা বাগান ঘুরে ঘুরে এবং ঝরনাটিতে স্নান করে, আর দুপুর নাগাদ আমাকে অত্যন্ত আশ্বাসিত করে তহশীলদার নিরাপদে ফিরে এল চম্পাবত থেকে।

    তার সঙ্গে কথা বলতে বলতে নিচে পাহাড়ের লম্বা ঢালু বরাবর তাকিয়ে দেখলাম দূরান্তে চষা খেত ঘেরা গ্রাম আর সেখান থেকে একটা লোক বেরিয়ে পাহাড় বেয়ে আমাদের দিকেই উঠে আসছে। আরো কাছে আসতেই দেখলাম, লোকটা কখনও হাঁটছে, কখনও দৌড়চ্ছে, এবং দেখেই বোঝা গেল যে সে কোনো জরুরী খবর বহন করে আসছে। তহশীলদারকে কয়েক মিনিটের মধ্যে আসছি বলে, আমি দ্রুতপদে পাহাড়ের ঢালু বেয়ে নামতে থাকলাম এবং লোকটা আমাকে আসতে দেখে দম নেবার জন্যে বসে পড়ল। তার কথা শোনার মত কাছে আসতেই সে চেঁচিয়ে উঠল,  ‘এখুনি চল সাহেব, মানুষখেকোটা এইমাত্র একটা মেয়েকে মেরেছে। একটু অপেক্ষা কর’, প্রত্যুত্তরে জবাব দিয়ে, ফিরে ছুটলাম বাংলোর দিকে। রাইফেল আর কার্তুজ নিতে নিতে তহশীলদারকে খবর দিয়ে তাকে, গ্রামের দিকে আমাকে অনুসরণ করতে বললাম।

    যে লোকটা আমার কাছে এসেছিল, সে ছিল সেইসব ধৈর্য-ছুটিয়ে দেওয়া লোকদের অন্যতম যাদের পা-চলা আর কথা বলা একসঙ্গে চলে না। কথা বলার জন্যে মুখ খুললেই সে দাঁড়িয়ে পড়ে স্থির হয়ে আর দৌড়তে শুরু করলেই মুখ বন্ধ। সুতরাং তাকে মুখ বন্ধ করে রাস্তা দেখাতে বলে নিঃশব্দে পাহাড় বেয়ে নিচের দিকে দৌড়তে থাকলাম।

    গ্রামটিতে পুরুষ, নারী ও শিশুদের এক উত্তেজিত জনতা আমাদের জন্যে অপেক্ষা করছিল এবং সাধারণভাবে এসব ক্ষেত্রে যা ঘটে, সকলে একসঙ্গে কথা বলতে আরম্ভ করল। একজন লোক বৃথাই সে কলরব থামাবার চেষ্টা করছিল। তাকে একপাশে ডেকে নিয়ে কি ঘটেছিল বলতে বললাম। গ্রাম থেকে এক ফার্লং মত দূরে সামান্য ঢালুতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ওক গাছগুলোকে নির্দেশ করে, সে বলল, জনা বার মিলে যখন গাছগুলোর নিচে শুকনো ডালপালা সংগ্রহ করছিল, তখনই হঠাৎ একটা বাঘের আবির্ভাব ঘটে আর বছর ষোল-সতেরর একটি মেয়েকে ধরে। দলের অন্য সকলে দৌড়ে গ্রামে ফেরে, আর যেহেতু জানা ছিল যে আমি বাংলোতেই আছি, সে কারণেই একজন লোককে আমাকে খবর দেবার জন্যে পাঠানো হয়।

    যে লোকটির সঙ্গে আমি কথা বলছিলাম, তার স্ত্রী ওই দলে ছিল এবং গিরিস্কন্ধের ওপর যে গাছটির নিচ থেকে মেয়েটিকে নিয়ে যাওয়া হয়, সেটি নির্দেশ করে দেখাল। বাঘটি তার শিকারকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে কিনা, যদি তা হয়ে থাকে কোন দিকে সে গেছে, তা দেখতে দলের কেউই পেছন ফিরে চায় নি।

    আমি না ফেরা অবধি গ্রামে থাকতে এবং কোনো গণ্ডগোল না করতে জনতাকে নির্দেশ দিয়ে আমি গাছটির দিকে রওনা হলাম। এখানে জমিন একেবারে চারদিকে ফাঁকা এবং মেয়েটি নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়ার শব্দ করায় মনোযোগ আকৃষ্ট না হওয়া অবধি কেমন করে বাঘের মত এক বড়সড় জানোয়ার একেবারে অদেখায় বারটি লোকের কাছে এগুল, তার উপস্থিতির ঠাহর মিলল না, তা ধারণা করা কঠিন।

    মেয়েটি যেখানে নিহত হয়, সেই জায়গাটি এক তরল রক্তের চাপে চিহ্নিত এবং তার কাছে সেই প্রগাঢ় লাল রক্তচাপের তীব্র বৈপরীত্যে মেয়েটি যা পরেছিল সেই উজ্জ্বল নীল রঙের পুঁতির একটি ছিন্ন হার। এই জায়গাটি থেকে রক্তের নিশানা গিরিস্কন্ধ অবধি গিয়ে, ঘুরে গেছে।

    বাঘিনীটির থাবার ছাপ, পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে। তার একদিকে, যেদিকে মেয়েটির মাথা ঝুলেছিল, সেদিকে বড় বড় ঝলকে রক্ত, অন্যদিকে মেয়েটির পা ছেঁচড়াবার দাগ। পাহাড়ের উত্রাইয়ে আধমাইল গিয়ে মেয়েটার শাড়িটা পেলাম আমি, এবং শৈলপার্শ্বে তার ঘাগরা। আবার একবার বাঘিনীটি নিয়ে যাচ্ছে এক নগ্ন মেয়েকে কিন্তু কৃতজ্ঞতার বিষয় এবার তার বোঝা মৃত।

    শৈলপার্শ্বের ওপর থাবার চিহ্ন চলে গেছে এক ব্ল্যাক থর্নের ঝোঁপ দিয়ে, কাঁটার ওপর মেয়েটির কাজল-কালোলা লম্বা চুলের গোছা আটকে আছে। তারপর একখণ্ড বিছুটি বন, বাঘিনী গেছে তার ভেতর দিয়ে এবং এই বাধাটি ঘুরে যাবার এক পথ খুঁজছিলাম যখন, পেছনে শুনলাম পায়ের শব্দ। ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখি রাইফেল হাতে একটি লোক আমার দিকে আসছে। তাকে জিজ্ঞাসা করলাম যখন গ্রামে নির্দেশ রেখে এসেছি কেউ গ্রাম ছেড়ে বেরুবে না, সে কেন আমার পেছন পেছন এসেছে। ও বলল, তহশীলদার ওকে আমার সঙ্গে আসতে নির্দেশ দিয়েছে এবং আদেশ অমান্য করতে ও ভয় পায়। যেহেতু দেখে মনে হল আদেশ বহনে ও দৃঢ়সংকল্প এবং এ বিষয়ে তর্ক করার অর্থ হচ্ছে মূল্যবান সময় নষ্ট করা, যে ভারি বুটজোড়া পরেছিল, তা ওকে খুলতে বললাম এবং সেগুলি ও এক ঝোপের নিচে লুকোলে পরে আমার সঙ্গে লেগে থাকতে এবং পেছন পানে কড়া নজর রাখতে উপদেশ দিলাম।

    আমি পরেছিলাম খুব পাতলা একজোড়া মোজা, হাফ প্যান্ট ও একজোড়া রবার সোলের জুতো এবং যেহেতু বিছুটি বন ঘুরে যাবার কোনো পথ আছে বলে মনে হল না, তাই তার ভেতর দিয়েই বাঘিনীকে অনুসরণ করলাম–প্রচুর অসুবিধা সত্ত্বেও।

    বিছুটি বনের ওপারে রক্তসংকেত তীক্ষ্ণ মোড় নিয়েছে বাঁয়ে, অতি খাড়াই পাহাড় ধরে সিধে নেমে গেছে। পাহাড়টি টেকিশাক এবং রিংগালে নিবিড় আচ্ছাদিত। একশো গজ নিচে রক্তের দাগ চলে গেছে এক সরু এবং খুব গভীর জলনালীতে, তা ধরে যেতে বাঘিনীটার বেশ অসুবিধা হয়েছে, যে পাথর ও মাটি খসে পড়েছে তা দেখেই বোঝা গেল। পাঁচ বা ছশো গজ এই জলনালী ধরে গেলাম আমি, যতই এগোলাম ততই বেশির চেয়ে বেশি বিচলিত হতে থাকল আমার সঙ্গীটি। এক ডজন বার আমার বাহু আঁকড়ে ধরল ও, এবং সাকণ্ঠে ফিসফিসিয়ে বলল যে হয় এদিকে, নয় ওদিকে, নয় আমাদের পেছনে বাঘিনীর আওয়াজ পাচ্ছে ও। উত্রাই-এর আধা পথ নেমে আমরা পৌঁছলাম প্রায় তিরিশ ফুট উঁচু এক বিশাল প্রস্তরখণ্ডের কাছে এবং যেহেতু এতক্ষণে মানুষখেকো শিকার প্রসঙ্গে লোকটির সইবার ক্ষমতা মাত্রা পেরিয়ে গেছে, আমি না ফিরে আসা অবধি ওকে ওই পাথরটিতে চড়ে বসে থাকতে বললাম। মহা আনন্দে ও উঠে গেল এবং চূড়ায় পৌঁছে ও ঠিক আছে বলে ইশারায় জানাল যখন, জলনালীর উজানে আমি চলতে থাকলাম। জলনালীটি পাথরের গায়ে ধাক্কা খেয়ে ঘুরে গিয়ে সোজা নেমে গেছে একশো গজ, সেখানে বাঁ দিক থেকে নিচে নেমে আসা এক গভীর গিরিখাতে মিলিত হয়েছে। এই সংযোগস্থলে এক ছোট্ট জলাশয় এবং তার কাছে এগোলাম যেমন, দেখলাম আমার দিকের জলে রক্তের ছোপ।

    বাঘিনী মেয়েটিকে সোজা এখানে নিয়ে এসেছে এবং আমি আসতে তার যাওয়ায় বাধা পড়েছে। এখানে-সেখানে হাড়-গোড় ছড়িয়ে পড়ে আছে, আর বাঘিনীর থাবার চাপে যে সব গর্তের সৃষ্টি হয়েছিল তাতে আস্তে আস্তে লাল রঙা জল এসে জমেছে। জলের কাছে এসে দেখলাম সেটি মানুষের পায়ের অংশ। জীবনে অনেক নরখাদক শিকার করেছি, কিন্তু এ রকম মর্মান্তিক দৃশ্য আর কখনও দেখি নি। নিটোল একটা পা, হাঁটুর নিচে থেকে এমনভাবে কামড়ে কেটেছে যাতে মনে হয় কেউ বুঝি কুড়োল দিয়ে এক ঘায়েই কেটেছে, আর সেই কাটা থেকে তাজা রক্ত তখনও ফোঁটা ফোঁটা পড়ছে।

    পা-টি দেখতে দেখতে বাঘিনীর কথা ভুলে মেরে দিয়েছিলাম একদম আর হঠাৎ মনে হল আমি এখন ভীষণ বিপদে। তাড়াতাড়ি রাইফেলের বাঁট ধরে ট্রিগারগুলিতে দুআঙুল রেখে মাথা তুললাম, আর যেমন তুলেছি, দেখলাম আমার সামনেই একটা পনের ফুট উঁচু পাড় আর সেখান থেকে একটু করে মাটি গড়িয়ে নেমে এসে ঝুপ করে জলাশয়ে পড়ল। এই মানুষখেকো শিকারের খেলায় আমি আনকোরা, নইলে যেভাবে নিজেকে এক আক্রমণের জন্য মেলে ধরেছিলাম, তা করতাম না। রাইফেলটি ওপরপানে তড়িঘড়ি তোলার জন্যই সম্ভবত আমার প্রাণ বাঁচল। ও ঝাঁপ দিতে যাচ্ছিল, হঠাৎ সেটা বন্ধ করতে গিয়ে অথবা চলে যাবার জন্যে ফিরতে গিয়ে পাড়ের ওপর থেকে বাঘিনী ওই মাটিটুকু খসিয়ে নিচে ফেলে।

    হাঁচড়ে-পাঁচড়ে ওঠার পক্ষে পাড়টি বড়ই খাড়াই এবং ওটিতে ওঠার একমাত্র উপায় হল একবারে দৌড়ে ওঠা। জলনালীটির উজানে স্বল্প দূরে গিয়ে আমি দৌড়লাম ভাটিপানে, লাফ দিয়ে পেরোলাম জলাশয়টি এবং একটি ঝোঁপ আঁকড়ে ধরে নিজেকে টেনে পাড়ের ওপর তোলার জন্যে অন্য কুলের উজানে যতটা দূরে যাওয়া দরকার, তা চলে গেলাম। নীল বাসকফুলের এক সমাবেশ, তার নুয়ে পড়া উঁটিগুলো ধীরে আগেকার মত সোজা হয়ে দাঁড়াচ্ছে, তারাই দেখিয়ে দিল কোথা দিয়ে ঠিক এখনি বাঘিনীটি পেরিয়ে গেছে এবং আর একটু এগিয়ে, যখন আমাকে একবারটি দেখতে এসছিল, তখন কোথায় রেখে এসেছিল ওর মড়ি তা দেখতে পেলাম এক ঝুলন্ত শৈলের নিচে।

    এখন মেয়েটিকে বয়ে নিয়ে যাচ্ছে ও, এবং ওর থাবার ছাপ এগিয়ে গেছে বেশ কয়েক বিঘা বিস্তৃত এক ছড়িয়ে থাকা বড় বড় পাথর ভরা জমিতে, সেখানে চলা কঠিন এবং বিপজ্জনক দুই-ই। শিলাগুলির মধ্যবর্তী ফাটল ও অতলান্ত খাদ–ফার্ন ও কবিন্দা লতায় ঢাকা। যদি কোনরকমে একবার পা ফসকায় তাহলে তার পরিণামে শরীরের কোনো অঙ্গ ভেঙে যাবার ভয় বিলক্ষণ। এত অসুবিধার দরুণ আমি এগোচ্ছিলাম ধীরে ধীরে এবং খাওয়া চালিয়ে যেতে বাঘিনী এ পরিস্থিতির সুযোগ নিচ্ছিল। যে সব জায়গায় ও জিরিয়েছে, সে জায়গা এক ডজন বার দেখতে পেলাম আমি এবং প্রতি জিরনের পর রক্তের নিশানা স্পষ্টতর হয়ে উঠেছে।

    এটি ওর চারশো ছত্রিশ নম্বর নরহত্যা। ওর আহারের সময় ব্যাঘাত ঘটানোতে ও বেশ অভ্যস্ত, তবে আমার মনে হয় এই প্রথম ওকে এমন নাছোড়বান্দা-ভাবে অনুসরণ করা হচ্ছে এবং ও তর্জন-গর্জন করে তার রাগ দেখালো। বাঘের গর্জন, তার পরিপূর্ণ মহিমায় কদর করতে হলে আমি তখন যেভাবে ছিলাম, তেমনি পরিস্থিতি হওয়া প্রয়োজন–চারদিকে শিলাখণ্ড, মধ্যে মধ্যে নিবিড় ঝোপ-জঙ্গল এবং অলক্ষিত অতলান্ত গহ্বর ও গুহায় নিঃশেষে পড়ে যাওয়া এড়াবার জন্য প্রত্যেকটি পদক্ষেপ পরখ করে ফেলবার অমোঘ প্রয়োজন।

    আপনারা যারা আরাম করে বসে এ কাহিনী পড়ছেন, তাঁরা আমার সে-সময়ের মনের অবস্থা সম্পূর্ণ তারিফ করতে পারবেন বলে আশা করতে পারি না। গর্জনের শব্দ এবং আক্রমণের সম্ভাবনা একই সঙ্গে আমাকে ভীত করল এবং আশা যোগাল। যদি আক্রমণ করবার জন্য বাঘিনীর মেজাজ যথেষ্ট চটে তবে যে উদ্দেশ্যে এসেছি তা সিদ্ধ করবার এক সুযোগই দেবে না শুধু বাঘিনী যত যন্ত্রণা ও বেদনা ঘটিয়েছে তার শোধ নেবার সুযোগ করে দেবে আমায়।

    তবে সে গর্জন ভয় দেখানো মাত্র এবং যখন ও দেখল, আমাকে দূরে হটাবার বদলে ওটি আমাকে ওর পদাঙ্ক অনুসরণে তাড়াতাড়ি দৌড় করাচ্ছে, ও গর্জন বন্ধ করল।

    প্রায় চারঘণ্টার ওপর আমি ওর পেছু পেছু চলেছি। যদিও বারবার ঝোঁপ জঙ্গলকে নড়তে দেখেছি, কিন্তু আমি ওর চামড়ার একটি লোমও দেখি নি এবং উলটোদিকের পর্বতপার্শ্বের উত্রাইয়ে পলাতকা ছায়ার পানে এক পলক চাহনি আমাকে হুঁশিয়ারী জানিয়ে দিল, অন্ধকারের আগে যদি গ্রামে পৌঁছতে চাই, তবে এখনই আমার পেছন ফিরে হাঁটবার সময় হয়েছে।

    অবচ্ছিন্ন পা-টির পরলোকগত মালিক এক হিন্দু এবং সৎকারের জন্য ওর কোনো শরীরাংশ প্রয়োজন হবে। তাই যখন জলাশয়টি পেরোলাম, তীরে একটি গর্ত খুঁড়লাম এবং পুঁতে দিলাম পা-টি। সেখানে এটি বাঘিনীর হাত থেকে নিরাপদ থাকবে এবং যখন চাওয়া হবে, পাওয়া যাবে।

    পাথরের ওপর অবস্থিত আমার সঙ্গীটি আমাকে দেখে বেজায় স্বস্তি পেল। আমার দীর্ঘ অনুপস্থিতিতে এবং যে গর্জন ও শুনেছে তাতে ওর দৃঢ় বিশ্বাস হয়েছে যে, বাঘিনীটি আর একটি শিকার সংগ্রহ করেছে এবং খোলাখুলি স্বীকার করল, ওর মুশকিল দাঁড়িয়েছিল কেমন করে একা গ্রামে ফিরবে তাই।

    আমি যখন জলনালীটির উত্রাইয়ে নামছিলাম, তখন মনে হল গুলিভরা বন্দুকবাহী এক দুর্বলচিত্ত লোকের সামনে হাঁটার চেয়ে আরো কোনো বিপজ্জনক কিছু আছে বলে আমি জানি না। তাই সাবধান হওয়ার জন্য আমি লোকটির পিছু পিছু হাঁটতে লাগলাম। খানিক বাদে হঠাৎ পা পিছলে লোকটি পড়ে যাবার পর দেখি তার বন্দুকটি আমার দিকেই মুখ করে আছে। তখন আমার মত পরিবর্তন করলাম। সেদিন থেকে ইবটসনের সঙ্গ ছাড়া, নরখাদক শিকারের সময়ে একলা যাওয়াই আমি স্থির করেছি। কেননা, সঙ্গী যদি নিরস্ত্র হয়, তাকে রক্ষা করা কঠিন এবং সে সশস্ত্র হলে পরে নিজেকে রক্ষা করা আরো কঠিন।

    যেখানে লোকটি তার বুটজুতো লুকিয়েছিল, পাহাড়ের সেই মাথায় পৌঁছে। ধূমপানের এবং আমার আগামীকালের পরিকল্পনা ভেবে ঠিক করার জন্য আমি বসলাম।

    নিশ্চয়ই মড়ির যেটুকু বাকি আছে বাঘিনী সেটা রাতেই শেষ করবে এবং পরদিন শিলাগুলির মধ্যে ওৎ পেতে থাকবে সে প্রায় সুনিশ্চিত। যেখানে ও আছে, সেখানে ওকে খুঁজে বের করার আশা আমার সামান্যই এবং যদি গুলি করতে না পারি শুধু ব্যাঘাতই ঘটাই, ও বোধ হয় অঞ্চলটি ছেড়ে চলে যাবে এবং আমি ওর খেই হারিয়ে ফেলব। কিন্তু যদি যথেষ্ট লোক যোগাড় করতে পারি তবে জঙ্গলে বীট দেওয়াই ইচ্ছে একমাত্র উপায়।

    পর্বতপুঞ্জের এক বিশাল অ্যাম্পিথিয়েটারের দক্ষিণপ্রান্তে বসেছিলাম আমি, কোনোরকম জনবসতি ছিল না চোখের সামনে। পশ্চিম থেকে প্রবেশকারী একটি নদী ছটফটিয়ে নেমে গেছে নিচে, অ্যাম্পিথিয়েটারের এপার-ওপার জুড়ে রচনা করেছে। এক গভীর উপত্যকা। পূবদিকে নিরেট পাথরে বাধা পেয়েছে নদীটি এবং উত্তরে ঘুরে গিয়ে এক সংকীর্ণ গিরিসংকট পথে বেরিয়ে গেছে অ্যাম্পিথিয়েটার থেকে।

    আমার সামনের পাহাড়টি প্রায় দুহাজার ফুট উচ্চতায় উঠেছে, এখানে ওখানে এক একটি পাইন গাছ চিহ্নিত বেঁটে বেঁটে ঘাসে সেটি ঢাকা এবং ঘুরাল ছাড়া আর কিছু বেয়ে ওঠার পক্ষে পুবের পাহাড় ভীষণ খাড়াই। নদী থেকে ওই খাড়াই পাহাড় অবধি শৈলশিরার সমস্ত দৈর্ঘ্যটি বীট করার মত যথেষ্ট মানুষ যোগাড় করতে যদি পারি,এবং ওদের সহায়তায় বাঘিনীকে যদি ঠাইনাড়া করতে পারি, তবেই সংকীর্ণ গিরিসঙ্কটটির ভেতর দিয়ে পেছনে পালানোর পথ নেওয়া বাঘিনীর পক্ষে সবচেয়ে স্বাভাবিক হবে।

    মানতেই হবে, এই বীট দেওয়া কাজটি বেজায় কঠিন কেননা যার ওপর বাঘিনীকে ছেড়ে এসেছি, সেই উত্তরমুখী চড়া পর্বতপার্শটি নিবিড় বনে ঢাকা এবং মোটামুটি তিনপোয়া মাইল লম্বা আর আধ মাইল চওড়া। যাই হক যদি বীটকারীদের আমার নির্দেশ বহনে বাধ্য করতে পারি তবে একটি গুলি ছুঁড়তে পারার সুযোগ মেলা সম্ভব।

    তহশীলদার গ্রামে আমার জন্যে অপেক্ষা করছিল। পরিস্থিতিটি ওর কাছে ব্যাখ্যা করলাম। বললাম, যত মানুষ পারে তা সংগ্রহে ও যেন তড়িঘড়ি ব্যবস্থা গ্রহণ করে এবং যেখানে মেয়েটি নিহত হয়েছে পরদিন সকাল দশটায় সেখানে আমার সঙ্গে দেখা করে। ওর সাধ্যে যা সম্ভব, তার সব কিছু করবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে চম্পাবতের উদ্দেশে রওনা হল ও এবং আমি পাহাড়ের চড়াই ভেঙে বাংলোতে এলাম।

    পরদিন ঊষার সূচনাতেই উঠে পড়লাম আমি এবং ভরপেট আহারের পর আমার লোকজনকে মালপত্র বেঁদেহেঁদে চম্পাবতে আমার জন্যে অপেক্ষা করতে বললাম এবং যেখানটায় বীট দেওয়া হবে বলে মনস্থ করেছি, তা আরেকবারটি দেখে নিতে গেলাম। যে পরিকল্পনা করেছি, তার ভুল কিছু দেখলাম না এবং আমার সঙ্গে তহশীলদারকে যেখানে দেখা করতে বলেছি, সেই জায়গায় হাজির হলাম নির্দিষ্ট সময়ের একঘণ্টা আগেই।

    মানুষ যোগাড়ে ওকে যে কষ্ট পেতে হবে তাতে সন্দেহ ছিল না কিছু। কেননা এলাকাটিতে মানুষখাকীর ভয় লোকের মনে গভীরভাবে চেপে বসেছে এবং মানুষজনকে ঘরের আশ্রয় থেকে বেরুতে বাধ্য করতে নরম জোরাজোরির চেয়ে জোরাল চাপ দরকার হবে। দশটার সময় তহশীলদার ও একটি লোক হাজির হল, তারপর থেকে লোকরা আসতে থাকল, দুজন–তিনজন এবং দশজন করে, অবশেষে দুপুর নাগাদ দুশো আটানব্বইজন লোক জমায়েত হল।

    তহশীলদার জানিয়ে দিয়েছিল যে সমস্ত লাইসেন্স বিহীন বন্দুক দেখলে ও চোখ বুজে থাকবে এবং আরো বলেছিল যার দরকার ও গুলি বারুদ যোগাবে; আর সেদিন যে-সব অস্ত্র হাজির করা হয়, তাতে এক মিউজিয়মের সংগ্রহ হতে পারত।

    লোকেরা যখন জড় হল এবং ওদের যা দরকার সে গুলি-বারুদ পেল, আমি ওদের নিয়ে গেলাম সেই গিরিপার্শ্বে, যেখানে মেয়েটির ঘাগরা পড়েছিল। উল্টোদিকের পাহাড়ের যে পাইন গাছটি বাজে পুড়ে গেছে এবং যার বাকল খসে গেছে সেটি দেখিয়ে আমি ওদের শৈলশিরা ধরে সার বেঁধে দাঁড়াতে বললাম। যখন পাইন গাছের নিচ থেকে ওরা আমাকে একটি রুমাল নাড়াতে দেখবে তখন যারা সশস্ত্র তারা তাদের বন্দুক ছুঁড়বে আর অন্যরা ঢাকঢোল বাজাবে, চেঁচাবে এবং পাথর গড়িয়ে ফেলবে। আমি যতক্ষণ না ফিরছি এবং নিজে তাদের ডেকে নিচ্ছি ততক্ষণ কেউ কোনো কারণেই শৈলশিরা ছেড়ে যাবে না। যখন ভরসা পেলাম, উপস্থিত সকলেই আমার নির্দেশগুলি শুনছে এবং বুঝেছে, আমি রওনা হলাম তহশীলদারের সঙ্গে। ও বলল বীটারদের চেয়ে আমার সঙ্গে থাকলে ও অধিক নিরাপদ থাকবে, কারণ ওদের এক-আধটা বন্দুক ফেটে জখম হওয়ার খুবই সম্ভাবনা ছিল।

    অনেকখানি জায়গা ছেড়ে ঘুরে গিয়ে আমি উপত্যকার উচ্চতর প্রান্তটি পেরোলাম, উল্টোদিকের পাহাড়ে উঠলাম এবং পথ করে নিয়ে নামলাম বাজে পোড়া পাইন গাছটির কাছে। এখান থেকে পাহাড় খাড়াই নেমে গেছে। তহশীলদারের পায়ে ছিল পাতলা পেটেন্ট লেদারের একজোড়া জুতো, ও বলল, ওর পক্ষে আর বেশিদূর এগনো অসম্ভব। ফোঁসকাকে আরাম দেবার জন্য ও যখন ওর অকেজো জুতো জোড়া খুলছে, আমি আগের কথামত সংকেত জানাতে ভুলে গেছি মনে করে শৈলশিরার লোকগুলি তাদের বন্দুকগুলো ছুঁড়ল এবং প্রচণ্ড এক হল্লা তুলে দিল। গিরিসংকটটি থেকে তখনো আমি দেড়শো গজ দূরে। এ দূরত্বটুকু পার হতে গিয়ে আমি যে এক ডজন বার আমার ঘাড় ভাঙি নি,–আমার পাহাড়ে বড় হওয়া এবং তার কারণে ছাগলের মত হুঁশিয়ার পা হওয়াই তার কারণ।

    পাহাড় বেয়ে ছুটে নামছি যখন, লক্ষ করলাম, গিরিসংকটের মুখের কাছে আছে সবুজ এক টুকরো ঘাস ঢাকা জমি। আর তখন যেহেতু এর চেয়ে আরো ভাল জায়গা খোঁজ করার কোনো সময় নেই, যে পাহাড় বেয়ে এখনই নেমে এসেছি, তারদিকে পিঠ করে ঘাসের মধ্যে বসলাম আমি। ঘাস প্রায় দু ফুট উঁচু এবং আমার শরীরের অর্ধেক ঢেকে রাখল তা এবং আমি যদি একেবারে নিশ্চল থাকি আমাকে দেখতে না পাবার সম্ভাবনা রইল ভালমত। যে পাহাড়ে বীট হচ্ছে তা আমার মুখোমুখি আর যে গিরিসংকটের উদ্দেশে বাঘিনী ছুটবে বলে আশা করছি তা আমার বাঁ কাঁধের পেছনে।

    শৈলশিরায় তখন বিশৃঙ্খল হট্টগোল শুরু হয়ে গেছে। বন্দুকের গুলি বর্ষণনিনাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে উন্মত্ত ঢাক-ঢোলের আওয়াজ এবং শত শত লোকের চিৎকার। যখন এই হল্লা চূড়ান্তে, আন্দাজ তিনশো গজ দুরে, আমার সামনের ডানদিকে দুটি গিরিখাতের মধ্যবর্তী এক ঘাসের ঢাল ধরে বাঘিনীকে বড় বড় লাফে ছুটে নামতে দেখলাম। মাত্র স্বল্প দূরই গেছে ও, তখন পাইন গাছের নিচের অবস্থিতি থেকে তহশীলদার ওর শটগানের’ দুটি নলেই গুলি ছুঁড়ল। গুলির শব্দ শুনে বাঘিনী সাঁ করে ঘুরে গেল আর যে পথ দিয়ে এসেছে সেই দিকেই ফিরে গেল সিধা এবং ঘন ঝোপে ও যখন উধাও হচ্ছে আমি রাইফেল উঁচিয়ে এক গুলি ছুঁড়লাম ওর উদ্দেশ্যে।

    শৈলশিরার ওপরের লোকগুলি তিনটি গুলি শুনে সিদ্ধান্ত করল যে, বাঘিনীটি নিহত হয়েছে। তা খুব অস্বাভাবিক নয়। সবগুলো বন্দুক নিঃশেষে ফুটিয়ে ওরা এক চূড়ান্ত নিনাদ করল। আমি তখন নিঃশ্বাস আটকে, যে আর্তনাদ শৈলশিরায় বাঘিনীর আগমন ঘোষণা করবে, তা শোনার জন্যে অপেক্ষা করছি তখন সহসা আমার সামনে বাঁ দিকে বাঘিনী আড়াল থেকে বেরুল এবং এক লাফে নদী পেরিয়ে সিধে গিরিসংকটের উদ্দেশ্যে চলে এল। সী-লেভেলে সাইটেড (রাইফেলের দুটি সাইট থাকে, তা দিয়ে উদ্দিষ্ট সাইট নড়িয়ে পাল্লা ঠিক করা চলে, সেগুলি অ্যাডজাসটি এবং অনেক রাইফেলের সাইট অনড় বা ফিল্ড। এখানে উল্লিখিত রাইফেলটি পরোক্ত শ্রেণীর। তার সাইট সমান পাল্লা বা সী-লেভেলে ফিল্ড এবং পর্বতে শিকার হচ্ছে বলে এ রাইফেলের গুলি উদ্দিষ্ট শিকারের চেয়ে একটু উঁচুতে ছুঁড়লে কাঙ্ক্ষিত ফল মেলার সম্ভাবনা সম্পাদিকা) .৫০০ মডিফায়েড কর্ডাইট রাইফেলটি এ পর্বচ্চেতায় ওপর পানে গুলি পাঠাল এবং যখন বাঘিনী নিশ্চল দাঁড়িয়ে গেল, আমি ভাবলাম বুলেট ওর পিঠের ওপর দিয়ে চলে গেছে এবং পালাবার পথ বন্ধ দেখে দাঁড়িয়ে পড়েছে ও। আসল ব্যাপার কি, ঠিকমতই মেরেছিলাম ওকে, তবে একটু পিছিয়ে। মাথা নিচু করে আমার দিকে আধা ঘুরে গেল ও এবং তিরিশ গজেরও কম পাল্লায় ওর কাঁধের ওপর গুলি করার চমৎকার সুযোগ করে দিল। এই দ্বিতীয় গুলিতে ও শিউরে উঠল কিন্তু কান চেপটে দাঁত খিঁচিয়ে দাঁড়িয়েই রইল, আর কাঁধে রাইফেল নিয়ে বসে আমি ভাবতে চেষ্টা করলাম ও আক্রমণ করলে কি করা সবচেয়ে ভাল হবে আমার, কেননা রাইলে গুলিশূন্য এবং আমার আর কার্তুজ নেই। তিনটে কার্তুজই এনেছিলাম সঙ্গে আমি, কেননা কখনও ভাবি নি, দুটির বেশি গুলি ছোঁড়ার সুযোগ পাব এবং এক জরুরী সংকটের জন্য ছিল তৃতীয় কাতুর্জটি।

    সৌভাগ্যক্রমে অতি গরহিসেবীভাবে জখম জানোয়ারটি আক্রমণের বিপক্ষে সিদ্ধান্ত করল। অতি মন্থরগতিতে ফিরল ও, ডানদিকের নদীটি পেরোল, কয়েকটি মাটিতে পড়ে থাকা পাথর টপকে গেল এবং পৌঁছল এক সরু কার্নিসে। সেটি ওই দুরারোহ পাহাড়ের গা কোনাকুনি পেরিয়ে চলে গেছে এক বিশাল চ্যাটাল উঁচিয়ে থাকা পাথরে। যেখানে এই পাথরটি শৈলপ্রাচীরে মিলেছে, একটি ছোট ঝোঁপ শিকড় আঁকড়ে আছে সেখানে, আর সেটির কাছে গিয়ে বাঘিনী তার ডালপালা ছিঁড়তে থাকল। সাবধানতার প্রশ্ন বাতাসে উড়িয়ে দিয়ে চেঁচিয়ে তহশীলদারকে বললাম ওর বন্দুক আনতে। প্রত্যুত্তরে এক চীকৃত দীর্ঘ জবাব এল, একটি শব্দই শুনলাম–”পা”। নিজের রাইফেল নামিয়ে রেখে একছুটে পাহাড়ে উঠলাম, তহশীলদারের হাত থেকে ছিনিয়ে নিলাম বন্দুক এবং দৌড়ে ফিরে এলাম।

    নদীর কাছে এগুলাম যখন, ঝোঁপ ছেড়ে বাঘিনীটি সেই উঁচানে পাথরের ওপর, আমি যে দিকে আছি সে দিকে বেরিয়ে এল। যখন ও বিশ ফুটের মধ্যে, বন্দুকটি তুললাম এবং আতঙ্কে দেখলাম যে নলদুটি এবং ব্রীচ-ব্লকের মাঝখানে এক ইঞ্চির আট-তৃতীয়াংশ এক ফঁক আছে। যখন দুটি নলে ফায়ার করা হয় তখন বন্দুক ফাটে নি, সম্ভবত এখনও ফাটবে না, কিন্তু পিছু ধাক্কা খেয়ে কানা হয়ে যাবার বিপদ আছে। যাই হক, সে ঝুঁকি নিতেই হচ্ছে এবং যে পেল্লায় পুঁতিটি সাইটের কাজ করছিল, সেটি বাঘিনীর হাঁ-করা মুখের দিকে নিশান করে বসিয়ে আমি গুলি ছুঁড়লাম। হয়তো আমি ওপর-নিচে নড়ে গিয়েছিলাম কিংবা হয়তো বেলনাকার বুলেটটি বিশ ফুট নির্ভুল পাঠাবার ক্ষমতা বন্দুকটির ছিল না। যাই হক গুলিটি বাঘিনীর মুখ ফসকাল এবং বিধল ওর ডান থাবায়, সেখান থেকে পরে আমি আঙুলের নখ দিয়ে সেটি সরিয়েছিলাম। সৌভাগ্যক্রমে ও তখন শেষ অবস্থায় পৌঁছেছিল এবং পায়ের ওপর আঘাতটি ওঁকে সমুখপানে টলিয়ে ফেলে দেবার কাজ যথেষ্টই করল। পাথরটার এক ধার দিয়ে মাথাটি ঝুঁকিয়ে ও মৃত্যুতে শান্ত হল।

    গিরিসংকট দিয়ে পালাবার চেষ্টায় যে মুহূর্তে বাঘিনী আড়াল ছেড়ে বেরোয়, তখন বীটারদের কথা ভুলে গিয়েছিলাম আমি। সহসা পাহাড়ের চড়াইয়ের স্বল্প দূর থেকে ‘ওই তো পাথরের ওপর পড়ে আছে ওটা! চল টেনে নামাই, ওটাকে টুকরো টুকরো করে কাটি’, এ চিৎকার শুনে ওদের অস্তিত্বের কথা আমার মনে পড়ল। নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারি নি যখন শুনলাম, টুকরো টুকরো করে কাটি’, তবু শুনেছিলাম ঠিকই, কেননা অন্যরাও এখন বাঘিনীটাকে দেখে ফেলেছে এবং পর্বতগাত্রের ওপর চতুর্দিক থেকে ফিরে ফিরে একই চিৎকার হতে থাকল।

    যে কার্নিস দিয়ে তখন আহত জানোয়ারটি পাথরে উঠেছিল তা সৌভাগ্যক্রমে বীটকারীদের উল্টোদিকে এবং তাতে পা রাখার মত সামান্য জায়গা ছিল। যখন পাথরটিতে পৌঁছে বাঘিনীকে টপকে গেলাম–প্রাণপণ আশা করেছিলাম ও মরেছে। কেননা ওকে পাথর ছুঁড়ে পরখ করবার আচরিত বিধি পালনের সময় ছিল না আমার-লোকগুলি জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এল এবং ফাঁকা জায়গাটি পেরিয়ে বন্দুক, কুড়াল, মরচেধরা তলোয়ার, বর্শা নাচিয়ে ছুটে আসতে থাকল।

    বার থেকে চোদ্দ ফুট উঁচু পাথরটিতে পৌঁছে ওদের এগনো বাধা পেল, কেননা নদীটি যখন বন্যাস্ফীত, তখন তার আঘাতে ক্ষয়ে পাথরটির বহির্ভাগ এত মসৃণ হয়ে গিয়েছিল যে পায়ের একটি আঙুল পর্যন্ত রাখার জো তাতে ছিল না। ওদের ভয়াল শত্রুকে দেখে জনতার সে উন্মত্ত ক্রোধ সম্পূর্ণ বোধগম্য কেননা, ওদের মধ্যে একটি লোকও ছিল না যে ওর হাতে কষ্ট পায় নি। একটি লোক, তাকে দেখে মনে হচ্ছিল, খ্যাপা, দলনেতার কাজ করছিল সে। একটি তলোয়ার নাচিয়ে এদিক সেদিক ছুটতে ছুটতে সে সমানে চেঁচাচ্ছিল, এই সেই শয়তান, যে আমার স্ত্রী আর দুই ছেলেকে মেরেছে’! জনতার বেলা যা হয়, যেমন আকস্মিক জ্বলে উঠেছিল তেমনি নিভে গেল উত্তেজনা এবং যে লোকটি স্ত্রী ও পুত্রদের হারিয়েছে, তার প্রশংসায় এ বলতেই হবে যে, সেই প্রথম হাতিয়ার নামিয়ে রাখল। পাথরটির কাছে এসে ও বলল, ‘যখন আমাদের দুশমনকে দেখলাম আমরা পাগল হয়ে গিয়েছিলাম সাহেব, কিন্তু পাগলামি কেটে গেছে এখন, আর আমাদের মাপ করে দিতে বলছি আপনাকে আর তহশীলদার সাহেবকে। অব্যবহৃত কার্তুজটি বের করে বন্দুকটি বাঘিনীর ওপর রাখলাম তার পরে দু হাতে ভর করে ঝুলে পড়া অন্যদের সাহায্যে নিচে নেমে পড়লাম। যেমন করে পাথরে উঠেছিলাম, তা যখন লোকগুলিকে দেখালাম, তখন ওরা মরা জানোয়ারটিকে অতীব সন্তর্পণে নামিয়ে এক ফাঁকা জায়গায় বয়ে নিয়ে রাখল। তারপর সবাই ভিড় করে ঘিরে তাকে দেখতে লাগল।

    নিচে আমার দিকে চেয়ে বাঘিনী যখন পাথরটির ওপর দাঁড়িয়েছিল, লক্ষ করেছিলাম ওর মুখে কিছু একটা গণ্ডগোল আছে এবং এখন ওকে পরীক্ষা করে দেখলাম ওর মুখের ডান ধারের ওপর ও নিচের কুকুর-দাঁত ভাঙা, ওপরেরটি আধভাঙা, নিচেরটি হাড় অব্দি। এক বন্দুকের গুলিতে জখমের এই পরিণাম, ওর দাঁতের চিরস্থায়ী জখম, এটিই স্বাভাবিক শিকার সংগ্রহে ব্যাঘাত ঘটিয়ে ওর নরখাদক হবার কারণ হয়েছিল।

    ওখানেই বাঘিনীটার চামড়া না-ছাড়াবার জন্যে লোকগুলি অনুনয় জানাল আমাকে এবং গ্রামে-গ্রামে ঘুরিয়ে দেখাবার জন্য ওকে ওদের হাতে সন্ধে অবধি রেখে দিতে বলল। বলল, স্বচক্ষে ওদের মেয়েরা ও ছোটরা যদি না দেখে, তারা বিশ্বাসই করবে না এই ভয়ংকর শত্ৰুটি মরেছে।

    এখন গাছ থেকে দুটি ডাল কেটে বাঘিনীর দু পাশে রাখা হল এবং পাগড়ি, কোমরবন্ধ ও লেংটি দিয়ে ওকে ওগুলোর সঙ্গে ভালভাবে খুব শক্ত করে বাঁধা হল। সব হয়ে গেলে পরে ডালদুটি তোলা হল এবং আমরা খাড়া পাহাড়টির পায়ের কাছে গেলাম। যে নিবিড় বনাচ্ছাদিত পাহাড়ে ওরা এখনি বীট করেছে তার চড়াই ভেঙে যাওয়ার পরিবর্তে লোকগুলি এই পাহাড়টির চড়াই ভেঙেই বাঘিনীকে নিয়ে যেতে চাইল। কারণ ওদের গ্রামগুলি এই পাহাড়টির নিকটেই। পেছনের লোকটি শক্ত করে তার সামনের মানুষটির কোমরবন্ধ বা পোশাকের অন্য কিছু আঁকড়ে ধরল, এই সহজ পন্থায় দুটি মানুষ দড়ি তৈরি করা হল! যখন স্থির হল এ মানুষ-দড়িগুলি ধকল সইবার পক্ষে যথেষ্ট লম্বা এবং পোক্ত হয়েছে এরা ডাল দুটিকে কাধ দিল। বাহকদের দুধারে রইল আরো মানুষ, যাতে তারা পা রাখার জায়গা পায়, পা ফসকে না যায়–এবার শোভাযাত্রাটি চলল পাহাড়ের চড়াই ভেঙে, যেন এক পিপীলিকা বাহিনী দেওয়াল বেয়ে উঠছে একটি মরা পোকা নিয়ে, এমনিই দেখাল ওদের। প্রধান বাহিনীর পেছনে চলল দ্বিতীয় আরেকটি ক্ষুদ্রতর বাহিনী–তহশীলদারকে বয়ে নিয়ে যাওয়া হল। ওই হাজার ফুট চড়াইয়ের কোনো পর্যায়ে যদি মানুষ দিয়ে তৈরি দড়ি ছিঁড়ে যেত, হতাহতের সংখ্যা হত ভয়াবহ, তবে দড়ি ঘেঁড়ে নি। লোকগুলি পাহাড়ের মাথায় উঠল। রওনা হল পুবদিকে, বিজয় যাত্রার গান গাইতে গাইতে, আর আমি ও তহশীলদার ঘুরলাম বাঁ দিকে এবং চললাম চম্পাবতের উদ্দেশে।

    আমাদের পথ এই শৈলশিরা ধরে এবং যার কাটায় মেয়েটির লম্বা চুলের গোছ আটকে গিয়েছিল সেই ব্ল্যাকথন ঝোপের মধ্যে আবার দাঁড়ালাম আমি, শেষবারের মত নিচের দিকে চেয়ে দেখলাম অ্যাম্পিথিয়েটারটিকে, ওটি আমাদের সাম্প্রতিক কীর্তির রঙ্গমঞ্চ।

    পাহাড়ের উত্রাই বেয়ে নামার সময়ে বীটাররা সেই হতভাগিনী মেয়েটির মাথাটি খুঁজে পেয়েছিল। গিরিসংকটের মুখ থেকে তখন পাতলা ধোঁয়ার কুণ্ডলী উঠছে। চম্পাবতের মানুষখাকীর শেষ শিকারের অন্ত্যেষ্টিক্রয়া করা হচ্ছিল ঠিক যেখানে জানোয়ারটিকে মারি সেইখানে।

    ডিনারের পর যখন তহশীলদারের উঠোনে দাঁড়িয়ে আছি, দেখলাম উল্টো দিকের পাহাড়ের গায়ের পাকদণ্ডী বেয়ে ঘুরে ঘুরে নামছে পাইন কাঠের মশালের এক দীর্ঘ মিছিল এবং অচিরেই স্তব্ধ নৈশ বাতাসে ভেসে এল বহুলোকের সমবেত কণ্ঠ এক পাহাড়ী গান। এক ঘণ্টা বাদে বাঘিনীকে আমার পায়ের কাছে শুইয়ে দেওয়া হল।

    অতগুলো লোক ভিড় করে থাকলে জানোয়ারটির চামড়া ছাড়ানো কঠিন, তাই কাজটি সংক্ষেপিত করার জন্য আমি ধড় থেকে মাথা আর থাবাগুলি কাটলাম এবং সেগুলো চামড়ার সঙ্গে সংলগ্ন রেখে দিলাম, পরে ওগুলোর ব্যবস্থা করা যাবে। শবটির কাছে পুলিস-পাহারা মোতায়েন করা হল আর পরদিন অঞ্চলের সকল মানুষ জমায়েত হল যখন, বাঘিনীর ধড়, পা ও লেজ ছোট ছোট টুকরোয় কেটে কেটে দেওয়া হল। পাহাড়ী ছেলেমেয়েরা গলায় যে পদক পরে তার জন্যে এই মাংস ও হাড়ের টুকরোগুলো দরকার। অন্যন্য শক্তিসম্পন্ন জাদু-জিনিসের সঙ্গে বাঘের কোনো অংশের যোগ হলে পরে তা ধারণকারীকে সাহস এবং বন্যজন্তুর আক্রমণ থেকে অক্ষত থাকার ক্ষমতা যোগায় বলে প্রসিদ্ধি আছে। বাঘিনী যা আস্ত গিলেছিল, মেয়েটির সে আঙুলগুলি তহশীলদার পরে স্পিরিটে ডুবিয়ে আমাকে পাঠায় এবং আমি সেগুলি নন্দাদেবীর মন্দিরের কাছে নৈনিতালে লেকে সমর্পণ করি।

    আমি যখন বাঘিনীর চামড়া ছাড়াচ্ছিলাম; তহশীলদার ও তার কর্মচারীরা সংলগ্ন গ্রামগুলির গ্রামমোড়ল ও গ্রামবৃদ্ধ এবং চম্পাবত বাজারের ব্যবসায়ীদের সহায়তায় আগামীকাল এক বিরাট ভোজ ও নাচের পোগ্রাম ঠিক করছিল–তাতে আমাকে সভাপতিত্ব করতে হবে। মাঝরাতের কাছাকাছি সময়ে-যে পথ ও গ্রাম-পথ মানুষখাকী চার বছর বন্ধ করে রেখেছিল তা ব্যবহার করতে পারছে বলে আনন্দে চেঁচাতে চেঁচাতে মানুষের সে বিশাল জমায়েতের শেষ লোকটিও চলে গেল তখন, আমি তহশীলদারদের সঙ্গে শেষবারের মত ধূমপান করলাম। আমি আর থাকতে পারব না আর উৎসবে ওকেই আমার ঠাঁই নিতে হবে এ কথা ওকে বলে আমি এবং আমার লোকজন আমাদের পঁচাত্তর মাইল যাত্রাপথে রওনা হলাম–হাতে দুদিন আছে পথটি কাবার করতে।

    সূর্যোদয়ে আমার লোকজনকে পেছনে ফেলে রেখে আমার ঘোড়ার জিনে বাঘিনীর চামড়া বেঁধে নিয়ে আমি আগেভাগে রওনা হলাম–যেখানে রাতটা কাটাতে চাই, সেই দাবিধুরায় কয়েক ঘণ্টা সময় নিয়ে চামড়াটি সাফ করব বলে। পাহাড়ের ওপর পালি গ্রামে সেই কুটিরটি পেরোচ্ছি যখন, মনে হল, ওর বোনের মৃত্যুর শোধ নেওয়া হয়েছে জানলে সেই বোবা মেয়েটির হয়তো কিছুটা শান্তি হবে। তাই ঘোড়াটিকে ছেড়ে রাখলাম চরে খেতেও হিম-রেখার কাছাকাছি বড় হয়েছে এবং ওক গাছ থেকে শুরু করে বিছুটি অব্দি সব কিছুই খেতে পারে–আমি পাহাড়ের চড়াই বেয়ে কুটিরে এলাম এবং দরজার মুখোমুখি একটি পাথরে মাথাটা রেখে চামড়াটা বিছিয়ে দিলাম। বাড়ির বাচ্চারা চোখ গোল-গোল করে কাণ্ডকারখানা দেখছিল। আর ওদের সঙ্গে আমাকে কথা কইতে শুনে ওদের মা দোরগোড়ায় এল, ও রান্না করছিল ভেতরে।

    শক্ এবং কাউন্টার-শক বিষয়ে কোনো থিওরি আওড়াতে যাব না আমি, কেননা এসব বিষয়ে আমি কিছুই জানি না। আমি শুধু জানি, এই রমণীটি–যে বারমাস যাবত বোবা হয়ে আছে বলে প্রসিদ্ধি, যে চারদিন আগে আমার প্রশ্নের জবাব দেবার কোনো চেষ্টাই করে নি-সে এখন ঘর থেকে পথে ছুটে ছুটে গেল আর এল, চেঁচিয়ে ডাকতে থাকল ওর স্বামীকে আর গ্রামের লোকদের, আসুক তারা তাড়াতাড়ি, দেখুক সাহেব কি এনেছে। বাকক্ষমতার এই আকস্মিক প্রত্যাবর্তন বাচ্চাগুলিকে বিস্ময়ে অভিভূত করে ফেলল খুব, তাই মনে হল, ওরা মায়ের মুখ থেকে চোখ সরাতে পারছিল না।

    আমার জন্যে যতক্ষণ এক ডিশ চা তৈরি হতে থাকল, গ্রামে জিরোলাম আমি এবং কেমন করে মানুষখাকীকে মারা হয়েছে, যারা ভিড় করে এসেছিল সে লোকদের বললাম। এক ঘণ্টা বাদে আবার শুরু করলাম যাত্রা, আর পথ চলতি আধ মাইল অবধি পালি গ্রামের পুরুষদের শুভেচ্ছা জ্ঞাপক চিৎকার শুনতে পেলাম।

    পরদিন সকালে এক চিতার সঙ্গে আমার এক বেজায় রোমাঞ্চকর সংঘর্ষ হয়েছিল, একথা উল্লেখ করছি শুধু এইজন্যে, যে ঘটনাটি দাবিধূরা থেকে আমার রওনা-হওয়ায় দেরি করিয়ে দিয়েছিল এবং আমার ছোট্ট ঘোড়া ও আমার ওপরে বাড়তি ধকল চাপিয়ে দিয়েছিল। সৌভাগ্যক্রমে ছোট্ট টার্টু ঘোড়াটি ভেতরেও যেমন পোক্ত, ঠ্যাঙেও তেমনি জোর তার, এবং ওপরে ওঠার সময়ে ওর ল্যাজ চেপে ধরে, সমতলে ওর পিঠে চেপে, নিচে নামার সময়ে ওর পেছনে পেছনে ছুটে, আমরা সকাল ৯টা থেকে সন্ধ্যা ৬টার মধ্যে নৈনিতাল অব্দি পঁয়তাল্লিশ মাইল পথ কাবার করে দিলাম।

    কয়েকমাস বাদে নৈনিতালে অনুষ্ঠিত এক দরবারে যুক্তপ্রদেশের ছোট লাট স্যার জন হিউএট, ওরা আমাকে যে সাহায্য করে তার জন্যে চম্পাবতের তহশীলদারকে একটি বন্দুক, এবং যখন মেয়েটির তল্লাস করছিলাম তখন যে লোকটি আমার সঙ্গে ছিল তাকে একটি চমৎকার শিকার-ছুরি উপহার দেন। দুটি হাতিয়ারেই প্রয়োজনীয় কথাগুলি ক্ষোদিত ছিল এবং দুটি পরিবারেই ওগুলি বংশের স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে হাতবদল হতে থাকবে।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleরামায়ণের উৎস কৃষি – জিতেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়
    Next Article জীবনযাপন – জীবনানন্দ দাশ
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    আলো হাতে সেই মেয়েটি – তপন বন্দ্যোপাধ্যায়

    August 20, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    আলো হাতে সেই মেয়েটি – তপন বন্দ্যোপাধ্যায়

    August 20, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Our Picks

    আলো হাতে সেই মেয়েটি – তপন বন্দ্যোপাধ্যায়

    August 20, 2025

    গোয়েন্দা গার্গী সমগ্র – তপন বন্দ্যোপাধ্যায়

    August 20, 2025

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.