Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    আলো হাতে সেই মেয়েটি – তপন বন্দ্যোপাধ্যায়

    August 20, 2025

    গোয়েন্দা গার্গী সমগ্র – তপন বন্দ্যোপাধ্যায়

    August 20, 2025

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    জিম করবেট অমনিবাস (অখণ্ড) – মহাশ্বেতা দেবী সম্পাদিত

    জিম করবেট এক পাতা গল্প1380 Mins Read0

    কান্দার মানুষখেকো

    কান্দার মানুষখেকো

    যে কুসংস্কারগুলি অন্য পাঁচজনের সঙ্গে আমরা খুব সহজভাবে মেনে চলি সেগুলির ওপর আমাদের বিশ্বাস থাকে না। যেমন তেরজন এক টেবিলে বসা, ডিনারের সময় মদ এগিয়ে দেওয়া, মইয়ের নিচ দিয়ে হাঁটা–এই রকম আরো কত আছে। কিন্তু আমাদের নিতান্ত ব্যক্তিগত কুসংস্কারগুলি, আমাদের বন্ধু-বান্ধবদের কাছে যতই হাসি ঠাট্টার ব্যাপার হক না কেন, আমাদের কাছে তাদের গুরুত্ব অনেক।

    শিকারীরা অন্য পাঁচজনের থেকে বেশি কুসংস্কারে বিশ্বাস করেন কিনা আমার জানা নেই, তবে যেগুলি তাঁরা বিশ্বাস করেন, সেগুলি তারা বিশ্বাস করেন খুব গভীরভাবেই। আমার একজন বন্ধু বাঘ শিকারে যাওয়ার সময় পাঁচটির একটিও বেশি কার্তুজ সঙ্গে নেন না। অপর একজন নেবেন সাতটি কার্তুজ–একটিও বেশি নয়, একটিও কম নয়। আমার অন্য একজন বন্ধু, বাঘ শিকারে যার সারা উত্তর ভারত জুড়ে নামডাক, কখনো একটি মহাশোল মাছ না মেরে তাঁর শীতকালীন শিকারের মরসুম আরম্ভ করতেন না। আমার নিজের ব্যক্তিগত কুসংস্কার সাপ নিয়ে। আমার একটা বদ্ধমূল বিশ্বাস আছে যে আমি যখন মানুষখেকো বাঘের সন্ধানে ঘুরি, আমার সব চেষ্টাই বিফল হয়ে যাবে যতক্ষণ না আমি একটা সাপ মারতে পারছি।

    একবারে মে মাসের সবচেয়ে গরম দিনগুলিতে একটা ভয়ানক ধূর্ত মানুষখেকোর খোঁজে আমাকে সকাল থেকে সন্ধে পর্যন্ত মাইলের পর মাইল হাঁটতে হয়েছিল। রাস্তা ছিল শুধু খাড়া কাঁটা ঝোপে ভরা পাহাড়ে বিরামহীন চড়াই আর উত্রাই। আমার হাত, হাঁটু সব কটার খোঁচায় ক্ষতবিক্ষত হয়ে গিয়েছিল। আমি সেই পনেরই সন্ধেবেলা যখন আমার দুকামরাওয়ালা জঙ্গল ডাকবাংলোতে ফিরে এলাম আমি ক্লান্তিতে অবসাদে আমার সর্বাঙ্গ ভেঙে পড়ছে। পৌঁছে দেখি আমার জন্যে অপেক্ষা করছে একদল গ্রামের লোক। তারা আমাকে সুসংবাদ দিল যে একটা মানুষখেকো বাঘকে সেইদিনই তাদের গ্রামের আশপাশে দেখা গিয়েছে; সে রাতে কিছু করার পক্ষে বেশি দেরি হয়ে গিয়েছিল। তাদের হাতে লণ্ঠন দিয়ে তাদের বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হল আর তাদের খুব কড়া নির্দেশ দেওয়া হল যে পরদিন কেউ যেন গ্রাম ছেড়ে কোথাও না যায়।

    আমার বাংলোটি যে পাহাড়ের কোলে তারই একপ্রান্তে অবস্থিত গ্রামটি। গ্রামটি একেবারে একান্তে ও গভীর জঙ্গলে ঢাকা হওয়ায় এই গ্রামটিতেই জেলার অন্যান্য গ্রামের তুলনায় বাঘটির উপদ্রব বেশি। এখানে সদ্য সদ্য বাঘটির হাতে মারা পড়েছে। দুটি স্ত্রীলোক এবং একটি পুরুষ।

    পরদিন সকালে আমি পুরো গ্রামটা একটা চক্কর দিয়ে দেখলাম। দ্বিতীয়বার ঘোরা শুরু করলাম প্রথম পথটার সিকি মাইলটাক নিচ দিয়ে, যখন চক্কর প্রায় শেষ করে এনেছি তখন একটা পাথরে ঢাকা বেশ দুর্গম জায়গা পেরিয়ে দেখি একটা ছোট নালা। পাহাড়ের খাড়াই বেয়ে তোড়ে বৃষ্টির জল নেমে এসে নালাটা তৈরি হয়েছে। নালাটার এদিক থেকে ওদিক একবার তাকিয়েই বুঝলাম বাঘটা ওর মধ্যে নেই। হঠাৎ আমার সামনে গজ পঁচিশেক দূরে একটা কিছু নড়াচড়া করে উঠল। এখানে একটা ছোট জায়গায় প্রায় স্নানের টবের মত কিছুটা জল জমেছিল তারই ওদিকে একটা সাপ জল খাচ্ছে। সাপটা মাথা তোলার সঙ্গে সঙ্গে আমার নজরে পড়েছে। ওটা যখন মাথা মাটি থেকে প্রায় দুতিন ফুট তুলে ফণা ছড়াচ্ছে তখনই আমি বুঝতে পারলাম ওটা একটা শঙ্খচূড় সাপ। এত অপূর্ব সুন্দর সাপ আমি আর কখনো দেখি নি। সাপটা যখন আমার মুখোমুখি তখন দেখলাম গলার কাছের রঙ গাঢ় কমলা, যেখানে সাপের শরীরটা মাটি ছেড়ে উঠেছে সেখানে মিশেছে সোনালী হলদে রঙের সঙ্গে। পিঠটায় গাঢ় সবুজের ওপর হাতির দাঁতের রঙের ছোপ ছোপ দাগ–ল্যাজের ডগা থেকে শরীরের প্রায় চার ফুট পর্যন্ত চকচকে কালো আর তার ওপর সাদা সাদা ছোপ। সাপটা লম্বায় প্রায় তেরো থেকে চোদ্দ ফুট।

    শঙ্খচূড় সাপ সম্বন্ধে নানারকম গল্প শোনা যায়। বাধা পেলে সেই সাপটি কি রকম হিংস্র হয়ে ওঠে, কি অসম্ভব জোরে ওরা ছুটতে পারে। সাপটার রকমসকম দেখে মনে হচ্ছিল আমায় তেড়ে আসতে পারে। যদি সত্যিই আক্রমণ করে তাহলে পাহাড়ের খাড়াই বা উত্রাই বেয়ে দৌড়ে খুব একটা সুবিধে করতে পারব না কিন্তু পাথরের ঢিবি বরাবর যদি দৌড়ই তাহলে হয়তো সাপটাকে বেকায়দায় ফেলতে পারব। ওর উদ্যত ফণাটা একটা ছোটখাট প্লেটের সাইজের। সেটা লক্ষ করে একটা গুলি করলে হয়তো ঝামেলা চুকে যায় কিন্তু আমার সঙ্গের রাইফেলটা খুব জোরাল তাই গুলি করলে যে বাঘটার জন্য এত দীর্ঘ দিনের অপেক্ষা, পরিশ্রমের পর নাগালের মধ্যে পেয়েছি সেটা হয়তো আবার বেপাত্তা হয়ে যাবে। বেশ দীর্ঘ একটা মিনিট কেটে গেল। এর মধ্য সাপটা শুধু লম্বা চেরা জিবটা ঢোকাচ্ছিল আর বার করছিল। তারপর সাপটা ফণাটা ছোট করে মাথাটা মাটিতে নামিয়ে উল্টোদিকের ঢালু জায়গাটার ওপর দিয়ে চলতে শুরু করল। আমি সাপটার দিক থেকে চোখ না সরিয়ে হাত দিয়ে পাহাড়ের গা হাতড়ে হাতড়ে একটা পাথর হাতে নিলাম–পাথরটার সাইজ প্রায় একটা ক্রিকেট বলের মত। সাপটা যখন একটা শক্ত মাটির ঢিবির কোনা বরাবর পৌঁছেছে। তখন আমি গায়ের জোরে পাথরটা ছুঁড়ে মারলাম সাপটার মাথার পেছন দিকে। অন্য কোনো সাপ হলে ওই পাথরের চোট খেয়ে আর বাঁচতে হত না কিন্তু এ সাপটার বেলায় ফল হল ঠিক উল্টো। সাপটা বিদ্যুতের মত ঘুরে আমার দিকে সোজাসুজি দৌড়ে এল। ভাগ্যক্রমে সাপটা রাস্তার মাঝামাঝি আসার পরই আমার দ্বিতীয় পাথরটা গিয়ে লাগল সাপটার গলায়। তার পরের ব্যাপার খুবই সহজ। আমি মনে বেশ একটা আনন্দ নিয়ে গ্রামটা দ্বিতীয়বার চক্কর মারলাম। যদিও প্রথমবারের মতই এবারো আমার ঘোরাটা নিষ্ফলই হল কিন্তু আমার মনে মনে একটা ফুর্তি ছিল সাপটাকে তো মেরেছি। অনেকদিন পরে আজ আমার প্রথম মনে হল যে বাঘটার পেছনে দৌড়াদৌড়ি, পরিশ্রম সার্থক হবেই হবে।

    পরদিন আবার আমি যে জঙ্গলটি গ্রামটিকে ঘিরে রয়েছে সেই জঙ্গলটি খুঁজে দেখলাম। সন্ধের দিকে, গ্রাম থেকে দেখা যায় এরকম একটা চষা জমির প্রান্তে বাঘটার থাবার ছাপ পেলাম। এই গ্রামটার অধিবাসীর সংখ্যা শ খানেক মতন হবে। তারা তো ভয়ে কাটা হয়ে রয়েছে। পরদিন সকালে ফিরে আসার প্রতিশ্রুতি দিয়ে আমি আমার জঙ্গলের বাংলোর চার মাইল রাস্তা পাড়ি দেওয়ার জন্যে একাই রওনা হলাম।

    যে জঙ্গলে কোনো মানুষখেকোর ভয় আছে সে জঙ্গল বা নির্জন পথে খুব সতর্কতার সঙ্গে চলতে হয় আর কয়েকটি নিয়ম খুব কঠোরভাবে মেনে চলতে হয়। শিকারীর জীবনে যদি অভিজ্ঞতা থাকে যে সে যাকে অনুসরণ করতে বেরিয়েছে, সেই নিঃশব্দে তার পিছু নিয়েছে তাহলে ইন্দ্রিয়গুলি আপনা আপনিই খুব সজাগ থাকে, আর নিয়মগুলি পালন করার জন্যে বিশেষ কোনো চেষ্টা করতে হয় না। কারণ নিয়ম ঠিকমত না মেনে চললে যে কোনো মুহূর্তে মানুষখেকোর হাতে প্রাণটা যেতে পারে।

    পাঠকেরা জিজ্ঞাসা করতে পারেন–”একা পথ চলার দরকার কি?”–বিশেষ করে যেখানে ক্যাম্পে আমার সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার মত লোকজন রয়েছে। এই খুব স্বাভাবিক প্রশ্নের উত্তরে আমি বলব প্রথমত, সঙ্গে লোকজন থাকলে মানুষ সতর্কতা হারিয়ে ফেলে, লোকজনের ওপরই নির্ভর করে বেশি; আর দ্বিতীয়ত, বাঘের সঙ্গে মোলাকাত হলে একা একজন রক্ষা পেলেও পেতে পারে।

    পরদিন সকালে গ্রামের কাছাকাছি এসে দেখি একদল লোক উদগ্রীব আগ্রহে অপেক্ষা কাছে আমার জন্যে। কিছুটা এগিয়ে যেতেই ওরা চিৎকার করে সমস্বরে একটা ভাল খবর আমায় দিল। গতরাত্রে একটা মোষ বাঘের হাতে মারা পড়েছে। মোষটাকে মারা হয়েছে গ্রামের মধ্যেই তারপর উঁচু ঢিবি মতন জায়গাটা দিয়ে ওটাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে পাহাড়ের উত্তরদিকে সরু গভীর একটা ঘন জঙ্গলে ঢাকা উপত্যকায়। ঢিবিটার ওপর থেকে বেরিয়ে থাকা একটা পাথরের ওপর দাঁড়িয়ে উপত্যকাটা ভাল করে দেখে নিয়ে আমার মনে হল পাহাড়ের খাড়াইয়ের ওপর যে পথ দিয়ে বাঘটা মোষটাকে টেনে নিয়ে গেছে সে পথ দিয়ে নামা সমীচীন হবে না। একমাত্র পথ হচ্ছে পুরো রাস্তাটা ঘুরে নিচ দিক দিয়ে উপত্যকাঁটায় ঢোকা তারপর মড়িটা যেখানে পড়ে আছে সেখানে যাওয়া। ওপরের পাথরটার ওপর দাঁড়িয়েই জায়গাটা সম্বন্ধে মোটামুটি একটা ধারণা আমার হয়েছিল। তবুও পুরো পথটা ঘুরে সেখানে পৌঁছতে পৌঁছতে বেলা প্রায় দুপুর হয়ে এল। উপত্যকাটা একটা জায়গায় প্রায় একশো গজ সমতল তারপরেই খাড়া প্রায় তিনশো গজ উঠে গেছে পাহাড়টার গায়ে। সেই সমতল জমিটার ওপর দিকেই আমি মড়িটা পাব আশা করেছিলাম আর ভাগ্য যদি ভাল হয় তাহলে বাঘটাও সেখানে থাকা বিচিত্র নয়। উপত্যকাটার খাড়া গা বেয়ে ঘন কাটা ঝোঁপ আর ছোট ছোট বাঁশ বনের মধ্যে দিয়ে বহু পথ হেঁটে আমি যখন সেখানে পৌঁছলাম তখন আমি ঘামে প্রায় নেয়ে উঠেছি। যেখানে মুহূর্তের মধ্যে গুলি চালাতে হতে পারে সেখানে হাতের চেটো ঘামা কোনো কাজের কথা নয়। তাই আমি একটা সিগারেট ধরিয়ে একটু জিরিয়ে নেওয়ার জন্যে বসলাম।

    আমার সামনের জায়গাটা বড় বড় মসৃণ পাথরে ভরা–তার মধ্যে দিয়ে এঁকে বেঁকে গিয়েছে ছোট একটা ঝরনা। জায়গায় জায়গায় ঝরনার স্ফটিক স্বচ্ছ জল জমে আছে। আমার পাতলা রবার সেলের জুতো যেন এই ধরনের পাথরের ওপর দিয়ে হাঁটার জন্যেই তৈরি। একটু জিরিয়ে নেওয়ার পর আমি রওনা দিলাম মড়িটার কাছাকাছি যাব বলে। আমার ধারণা ছিল বাঘটাও নিশ্চয়ই মড়িটার আশেপাশেই কোথাও ঘুমিয়ে আছে। রাস্তাটার প্রায় তিন পো টাক এগিয়ে যাওয়ার পর মড়িটাকে দেখলাম–ফার্নে ঢাকা পাথরের ওপর পড়ে আছে। পাহাড়টা যেখান থেকে খাড়া উঠে গেছে সেখান থেকে জায়গাটার দূরত্ব গজ পঁচিশেক হবে। বাঘটাকে দেখা যাচ্ছে না। খুব সাবধানে মড়িটার কাছাকাছি এগিয়ে আমি একটা বড় সমতল পাথরের ওপর জায়গা নিলাম যাতে আমি আশেপাশের জমির প্রতিটা ইঞ্চি ভালভাবে দেখতে পাই।

    মানুষ যে আসন্ন বিপদের আভাস পায়, এটা একটা প্রতিষ্ঠিত সত্য। তিন চার মিনিট আমি স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে রইলাম-কোনো বিপদের আশঙ্কা আমার মনকে ভারাক্রান্ত করে তোলে নি। হঠাৎ আমার মনে হল বাঘটা খুব কাছাকাছি কোনো জায়গা থেকে আমায় লক্ষ করছে। যে ধরনের বিপদের আশঙ্কা হঠাৎ আমায় সতর্ক করে দিয়েছিল সেইরকমই একটা কিছু নিশ্চয়ই বাঘটারও ঘুম ভাঙিয়ে দিয়েছে। আমার সামনে বাঁ দিকে এক টুকরো সমতল জমির ওপর কিছু ঘন ঝোপঝাড়। ঝোপগুলির দূরত্ব আমার থেকে পনের কুড়ি ফুট–মড়িটার থেকেও দূরত্ব একই রকম হবে। আমার সমস্ত লক্ষ তখন কেন্দ্রীভূত ওই ঝোপগুলির ওপর। অল্পক্ষণের মধ্যেই ঝোপগুলি খুব আস্তে নড়ে উঠল আর পরমুহূর্তেই আমি বাঘটাকে দেখলাম খুব দ্রুত বেগে উঠে যাচ্ছে খাড়া পাহাড়ের গা বেয়ে। আমি রাইফেল তোলার আগেই বাঘটা একটা লতাপাতায় ঢাকা গাছের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেল। তারপরে আমি বাঘটাকে আবার দেখতে পেলাম যখন আমাদের মধ্যে দূরত্ব ষাট গজের কাছাকাছি–বাঘটা তখন একটা বড় পাথরের ওপর থেকে লাফ দিচ্ছে। আমার গুলি খেয়ে বাঘটা পেছন দিকে পড়ে গেল তারপরেই গর্জন করতে করতে পাহাড় বেয়ে গড়িয়ে নিচে নামতে লাগল–সেই সঙ্গে পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে এল স্রোতের মত পাথর। আমি ভাবলাম বাঘটার নিশ্চয়ই পিঠ ভেঙে গেছে। পিঠ ভাঙা অবস্থায় বাঘটা আমার পায়ের কাছে গড়িয়ে পড়লে কি করা যাবে ভাবছিলাম এমন সময় বাঘটার গর্জন থেমে গেল। পরমুহূর্তে দেখলাম বাঘটা বিদ্যুৎগতিতে পাহাড়ের কোল ঘেঁষে দৌড়াচ্ছে–আহত হওয়ার কোনো লক্ষণ দেখলাম না, ওর মধ্যে। আমার মনে তখন স্বস্তি আর হতাশা মেশানো এক অদ্ভুত অনুভূতি। যে একঝলক আমি বাঘটাকে দেখতে পেয়েছিলাম তাতে গুলি করে কোনো ফল হত না। একটা বাঁশঝাড়ের মধ্যে দিয়ে লাফ মেরে, পাহাড়টা পাক খেয়ে বাঘটা পরের উপত্যকায় অদৃশ্য হয়ে গেল।

    পরে আমি দেখেছিলাম, পঁচাত্তর ডিগ্রী কোনাকুনি থেকে ছোঁড়া আমার বুলেটটি বাঘটার বাঁ হাঁটুতে লেগে কিছুটা হাড় উড়ে গিয়েছিল। এই হাড়টিকে কোন্ হাস্যরসিক ‘মজার হাড়’ নাম দিয়েছেন জানি না। হাঁটুতে লেগে বুলেটটি সামনের পাথরে প্রতিহত হয়ে ফিরে এসে আবার বাঘটিকে চোয়ালের জোড়ের কাছে প্রচণ্ড আঘাত করে। এই আঘাতগুলি যতই যন্ত্রণাদায়ক হক না কেন এর কোনোটির দরুণই বাঘটার প্রাণের আশঙ্কা নেই। হালকা রক্তের ছিটে অনুসরণ করে করে পাশের উপত্যকাটা পর্যন্ত গেলাম। একটা ঘন কাঁটা ঝোপের মধ্যে থেকে ক্রুদ্ধ বাঘের গোঙরানি শুনতে পেলাম। ঢুকলাম না, কারণ সেটা আত্মহত্যারই সামিল হত।

    আমার গুলির আওয়াজ গ্রাম থেকে শোনা গিয়েছিল। তাই আমি যখন ফিরে গেলাম তখন পাহাড়ের ওপর আমার জন্যে অপেক্ষা করছে এক উৎসুক জনতা। আমার এত যত্নের সব আয়োজন ভেস্তে যাওয়াতে ওরা যেন আমার থেকেও বেশি হতাশ হয়েছে।

    পরদিন সকালে আমি মড়িটার কাছে গিয়ে দেখে খুশি হলাম আর একটু অবাকও হলাম যে বাঘটা রাতেই ফিরে এসে আরো অল্প কিছুটা খেয়ে তার নৈশভোজন সেরেছে। বাঘটাকে দ্বিতীয়বার গুলি করার একমাত্র সুযোগ মিলতে পারে মড়িটা পাহারা দিয়ে বসে থাকলে। কিন্তু তাতে এটা সমস্যা আছে। মড়িটার ধারে কাছে বসার মত কোনো গাছ নেই। আমার বিগত তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে আমি আর কখনো কোনো মানুষখেকোর জন্যে মাটিতে বসে রাত কাটাতে রাজী নই। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কোথায় বসা যায় ভাবছি এমন সময় শুনলাম বাঘটির ডাক। ডাকটি আসছে উপত্যকার ওদিক থেকে যেখান দিয়ে গতকাল আমি উঠেছিলাম। এই ডাকটিই আমার সামনে এনে দিল মানুষখেকো জানোয়ারটাকে সুষ্ঠুভাবে মারার এক আশ্চর্য সুযোগ। বাঘকে ডাকা যায় এই দুই অবস্থায় (ক) যখন বাঘ একটি সঙ্গিনীর সন্ধানে সারা জঙ্গল তোলপাড় করে বেড়াচ্ছে এবং (খ) যখন বাঘটি সামান্য আহত। অবশ্য শিকারীকে এমনভাবে ডাকতে হবে যাতে ডাকটি যে নকল তা যেন বাঘটি বুঝতে না পারে আর এমন জায়গা থেকে ডাকতে হবে যেখানে আসতে বাঘটি কোনো ইতস্তত না করে–যেমন ঘন ঝোপঝাড় বা ঘাসভরা জমি। এ ছাড়াও, শিকারীকে খুব কাছ থেকে গুলি করবার জন্যে তৈরি থাকতে হবে। সামান্য আহত বাঘ যে মানুষের ডাক শুনলে আসে একথা শুনে অনেক শিকারীই হয়তো বিশ্বাস করবেন না। কিন্তু নিজেরা পরখ না করা পর্যন্ত তারা যেন কোনো রায় না দেন। আজকের ঘটনায় ফিরে আসা যাক।

    বাঘটি যদিও আমার প্রতিটি ডাকের উত্তর দিয়েছিল কিন্তু প্রায় ঘন্টাখানেকের মধ্যে বাঘটি আমার একটুও কাছে এগোেল না। আমার ব্যর্থতার কারণ হিসেবে আমি ধরে নিলাম যে আমি এমন একটা জায়গা থেকে ডাকছি যেখানে বাঘটির গতকালই একটি তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছে।

    শেষ পর্যন্ত যে গাছটি আমি বেছে নিলাম সেটা দেওয়ালের মতন একটা খাড়া পাড়ের একেবারে শেষ প্রান্তে। এই গাছে আমার বসার মত মাটি থেকে প্রায় আট ফুট উঁচু একটা বেশ সুবিধাজনক ডাল ছিল। এই ডালটিতে বসলে আমি পাথর ভর্তি নালাটার থেকে প্রায় তিরিশ ফুট ওপরে থাকব–তাছাড়াও আমি থাকব নালাটার সোজাসুজি ওপরে। আমি আশা করেছিলাম বাঘটা নালাটার পথ ধরেই আসবে। মনোমত একটা গাছের ব্যবস্থা করে এবার আমি ফিরলাম ঢিবিটার দিকে যেখানে আমার লোকজনদের প্রাতরাশ নিয়ে আমার সঙ্গে দেখা করার নির্দেশ দিয়েছিলাম।

    বিকেল চারটার মধ্যেই আমি বেশ জুত করে ডালটার ওপর বসলাম–আর বসেই দীর্ঘ প্রতীক্ষার জন্যে প্রস্তুত হলাম। আমার লোকজনেরা চলে যাওয়ার আগে তাদের সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে ঢিবিটার ওপর থেকে আমাকে ‘কু’ শব্দ করে ডাকার নির্দেশ। দিয়েছিলাম। যদি আমি চিতার ডাকে তাদের উত্তর দিই তাহলে তারা চুপচাপ থাকবে কিন্তু যদি তারা কোনো উত্তর না পায় তাহলে তারা যতজন সম্ভব গ্রামবাসীকে সংগ্রহ করে, দুটো দলে ভাগ হয়ে উপত্যকার দুদিক থেকে চিৎকার করতে করতে আর পাথর ছুঁড়তে ছুঁড়তে নেমে আসবে।

    আমি গাছের ওপর যে কোনো ভঙ্গীতে ঘুমনোর কায়দাটা ভালই রপ্ত করেছি, আর ছিলামও ভীষণ ক্লান্ত তাই গোধূলিটা আমার নেহাত মন্দ কাটল না। বেলা শেষের সূর্য যখন পাহাড়ের চূড়াগুলো সোনা রঙে রাঙিয়ে অস্ত যাচ্ছিল তখন হঠাৎ আমার সমস্ত চেতনা সজাগ হয়ে উঠল একটা হনুমানের বিপদ সংকেতে। অল্পক্ষণের মধ্যেই আমি হনুমানটিকে দেখতে পেলাম উপত্যকার ওদিকে একটা গাছের মগডালে। ওটা আমার দিকেই তাকিয়েছিল। আমার মনে হল আমাকে বোধ হয় চিতা বলে ভুল করেছে। অল্প সময়ের ব্যবধানে তার বিপদ সংকেতের ডাক কিছুক্ষণ ধরে শোনা গেল। শেষ পর্যন্ত অন্ধকার ঘনিয়ে আসতে তার ডাকও আস্তে আস্তে থেমে গেল।

    ঘণ্টার পর ঘণ্টা চোখ কান সতর্ক সজাগ করে রাখার পর হঠাৎ পাহাড়ের গা বেয়ে একটা পাথর গড়িয়ে আমার গাছে লাগার শব্দে আমি চমকে উঠলাম। পাথরটি পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই শুনতে পেলাম নরম থাবাওয়ালা কোনো ভারি একটা জানোয়ারের সতর্ক খসখস পায়ে চলার আওয়াজ। এটি যে বাঘটির, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। প্রথমটায় আমি নিজেকে প্রবোধ দিয়েছিলাম এই ভেবে যে নেহাতই ঘটনাচক্রে বাঘটা উপত্যকার ওপরদিকে না উঠে এদিকে আসছে। কিন্তু আমার ভুল ভাঙতে দেরি হল না, যখন আমার ঠিক পেছন থেকেই বাঘটার ক্রুদ্ধ গম্ভীর গলার চাপা গো গোঁ আওয়াজ শুনতে পেলাম। স্পষ্ট বোঝাই যাচ্ছে যে আমি যখন প্রাতরাশ সারছিলাম তখনই বাঘটা উপত্যকার মধ্যে ঢুকেছে আর পাহাড়ের ওপর দাঁড়িয়ে আমার গাছে ওঠা লক্ষ করেছে। হনুমানটা পাহাড়ের ওপর বাঘটাকে দেখতে পেয়েই হুঁশিয়ারীর ডাক ডেকেছিল। ঠিক এই ধরনের পরিস্থিতি যে দাঁড়াতে পারে তা আমি ভাবি নি–এখন খুব সাবধানে আমায় এগোতে হবে। গাছের ডালটা দিনের আলো থাকতে বসার বেশ ভাল জায়গা ছিল, কিন্তু অন্ধকার ঘনিয়ে আসার পর ওখানে বসে নড়াচড়া করা মুশকিল। আমি অবশ্য শূন্যে রাইফেল ছুঁড়তে পারতাম কিন্তু খুব কাছ থেকে ফাঁকা বন্দুকের আওয়াজ করে বাঘ তাড়ানোর চেষ্টা যে কত মারাত্মক হতে পারে তা আমার নিজের চোখে দেখা। তাছাড়া আমায় আক্রমণ না করলেও আমার রাইফেলের (একটি ৪৫০/৪০০) আওয়াজ শুনে বাঘটা হয়তো এ তল্লাটই ছেড়ে চলে যাবে। তাহলে আমার সব পরিশ্রমই বৃথা হয়ে যাবে। তাই সেদিক দিয়ে আমি গেলাম না।

    আমি জানতাম বাঘটা লাফাবে না কারণ লাফালেই ও পড়বে প্রায় তিরিশ ফুট খাড়া পাড়ের নিচে পাথরের ওপর। কিন্তু তার লাফ দেওয়ার কোনো দরকার ছিল না। পেছনের দুপায়ের ওপর ভর দিয়ে দাঁড়ালেই ও অনায়াসে আমার নাগাল পেয়ে যাবে। কোল থেকে তুলে রাইফেলের মুখটা ঘুরিয়ে নেওয়ার সময় নলটা চালিয়ে দিলাম বা বগলের তলা দিয়ে, সেই সঙ্গে নলটা নিচু করে সেফটি ক্যাচটা তুলে দিলাম। এই একটু নড়াচড়া হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাঘটার ক্রুদ্ধ গলার গর্জন শুনতে পেলাম। এবার আওয়াজটা অন্যান্য বারের তুলনায় আরো ভয়াবহ। এবার যদি বাঘটা আমায় ধরার জন্যে ওঠে তাহলে রাইফেলটাই প্রথমে ওর গায়ে লাগবে, আর রাইফেলের ঘোড়ার ওপর আমার আঙুল বেঁকানো রয়েছে। আমার গুলিতে বাঘটা যদি নাও মরে তাহলেও গুলির আওয়াজে যে গণ্ডগোল, বিভ্রান্তির সৃষ্টি হবে তার ফাঁকেই হয়তো আমি গাছটার আরো উপরে উঠে যেতে পারব। সময়টা যেন আর কাটতেই চায় না। অবশেষে পাহাড়ের গা ঘেঁষে পায়চারি আর গর্জন করতে করতে ক্লান্ত হয়েই যেন বাঘটা আমার বাঁ দিকের একটা নালা লাফ দিয়ে পার হয়ে গেল। কয়েক মিনিটের মধ্যেই শুনতে পেয়ে আশ্বস্ত হলাম যে মড়িটার কাছ থেকে হাড় চিবানোর শব্দ আসছে; এরপর সারারাত যা কিছু আওয়াজ পেলাম সবই এল মড়িটার দিক থেকেই।

    তখন মাত্র কয়েক মিনিট হল সূর্য উঠেছে–উপত্যকাটা তখনও গভীর ছায়ায়, ঢাকা। এমন সময় শুনলাম ঢিবিটার কাছ থেকে আমার লোকজনদের সেই ‘কু’ সংকেত। ঠিক পরমুহূর্তেই দেখলাম বাঘটা খুব দ্রুতগতিতে দৌড়ে আমার বাঁ পাশের পাহাড়টার ওপর উঠে পেরিয়ে যাচ্ছে। তখনও আলোটা ভাল করে ফোটে নি–সবই আবছা, অনিশ্চিত। আর সারা রাত চোখ বিধিয়ে তাকিয়ে দেখার ফলে আমার চোখও ক্লান্ত। তাই তাক করে গুলি চালানো খুব কঠিন। কিন্তু গুলি আমি চালালাম এবং দেখে খুশি হলাম যে গুলিটা যথাস্থানেই গিয়ে লেগেছে। প্রচণ্ড গর্জন করে ঘুরে গিয়ে বাঘটা সোজা আমার গাছের দিকে এগিয়ে এল। ও যখন লাফ দিতে উদ্যত তখন সৌভাগ্যক্রমে আমার দ্বিতীয় বুলেটটা লাগল ওর বুকে। ভারি বুলেটের ধাক্কায় বাঘটার আর লাফ দেওয়া হল না, ছিটকে গিয়ে পড়ল আমারই কাছে একটা গাছের গায়ে। তারপরেই ধাক্কার জোর সামলাতে না পেরে ছিটকে গিয়ে পড়ল সোজা নিচের উপত্যকাটার ওপর। সেখানে পাথরের ফাঁকে ঝরনার জমা জলের ওপর পড়ায় আঘাতটা অনেকটা সামলে নিল। তারপর কোনোরকমে জল থেকে উঠে উপত্যকাটার ওপর দিয়ে আস্তে আস্তে ও আমার দৃষ্টির আড়ালে চলে গেল। দেখি ঝরনার জমা জল রক্তে লাল হয়ে রয়েছে।

    পনের ঘণ্টা একনাগাড়ে গাছের শক্ত ডালটিতে বসে থাকায় আমার শরীরের প্রতিটি মাংসপেশী, যেন আড়ষ্ট হয়ে গিয়েছিল। তাই গাছ থেকে নেমে হাত পা একটু মালিশ না করে নিয়ে আমি বাঘটার পিছু নিতে পারলাম না। বাঘটার চাপ চাপ রক্ত লেগে ছিল গাছটার গায়ে, নামার সময়ে আমার জামাকাপড়েও রক্তের ছাপ লেগে গেল। বাঘটা বেশি দূরে যেতে পারে নি। আমি ওর মৃতদেহ দেখলাম আরেকটা ঝরনার জল জমা জলাশয়ের কাছে, এটা পাথরের নিচে।

    লোকজন, যারা ঢিবিটার ওপর জড়ো হয়েছিল, তারা আমার প্রথম গুলির আওয়াজ আর বাঘের গর্জন তারপরে দ্বিতীয় গুলির আওয়াজ শুনে আমার নির্দেশ অমান্য করেই দঙ্গল বেঁধে পাহাড় বেয়ে নেমে এল। রক্ত মাখা গাছটার কাছে এসে নিচে আমার টুপিটা পড়ে থাকতে দেখে ওরা স্বাভাবিকভাবেই ধরে নিল যে বাঘটা নিশ্চয়ই আমায় তুলে নিয়ে গেছে। ওদের ভয়ার্ত চিৎকার চেঁচামেচি শুনে আমি ওদের ডাকলাম। উপত্যকাটার গা বেয়ে আবার দৌড়ে নেমে এসেই আমার রক্তমাখা জামাকাপড় দেখে ওরা ভয়ে থমকে দাঁড়াল। ওদের যখন আশ্বস্ত করলাম যে আমি আহত হই নি, জামাকাপড়ে রক্ত আমার নিজের নয় তখন মুহূর্তের মধ্যে ওরা বাঘটার চারদিকে ভিড় করে দাঁড়াল। সঙ্গে সঙ্গে মজবুত চারা গাছ কেটে লতাপাতা দিয়ে বাঘটাকে তার সঙ্গে বাঁধা হল। তারপর বহু কষ্ট করে চিৎকার করতে করতে ওরা পাহাড়ের সোজা খাড়াই বেয়ে বাঘটাকে নিয়ে চলল গ্রামের দিকে।

    সুদূর প্রত্যন্ত সব জায়গায় যেখানে দীর্ঘদিন ধরে মানুষখেকো অত্যাচার চালাচ্ছে সেখানে নানা ধরনের সাহসিকতার পরিচয় পাওয়া যায়। অবশ্য স্থানীয় লোকজন এধরনের বীরত্বমূলক কাজের কোনো গুরুত্ব দেয় না, দৈনন্দিন জীবনের একটা স্বাভাবিক অঙ্গ বলেই ধরে নেয় আর বাইরের পৃথিবীও এ ধরনের কাজের কথা শোনার কোনো সুযোগই পায় না। কান্দার মানুষখেকোর শেষ মানুষ শিকারটি সম্বন্ধে এই ধরনের একটি ঘটনা আমি লিপিবদ্ধ করতে চাই। ঘটনাটি ঘটার অল্পক্ষণের মধ্যেই আমি ঘটনাস্থলে পৌঁছই। গ্রামের লোকজনদের বর্ণনা শুনে আর মাটিটা ভাল করে পরখ করে আমি আপনাদের এমন একটা কাহিনী শোনাতে পারি যার একটি বর্ণও অতিরঞ্জিত নয়। এখানে বলে নেওয়া ভাল যে আমি ঘটনাস্থলে পৌঁছনো পর্যন্ত জমিটায় কারো কোনো হাত পড়ে নি-কিছু এদিক সেদিক হয় নি।

    আমি যে গ্রামটার কাছে কান্দা মানুষখেকোকে গুলি করি সেই গ্রামে তার একমাত্র ছেলের সঙ্গে বাস করত এক বৃদ্ধ। পিতা ১৯১৪-১৮র যুদ্ধে সেনাবাহিনীতে কাজ করেছিল এবং তার সর্বোচ্চ অভিলাষ ছিল ছেলেকে রয়্যাল গাড়োয়াল রাইফেল এ ভর্তি করে দেওয়া। শান্তির সময়ে, যখন আজকালকার মত কাজের সংখ্যা কম কিন্তু আবেদনকারী বহু তখন এ কাজ নেহাত সহজসাধ্য ছিল না। ছেলেটি আঠার বছর পূর্ণ হওয়ার পরেই কিছু লোক গ্রামের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল ল্যান্সডাউন বাজারের দিকে। ছেলেটি এই দলটির সঙ্গে যোগ দিল আর ল্যান্সডাউনে পৌঁছেই রিক্রুটিং আপিসে হাজির হল। ওর বাবা ওকে নিখুঁত মিলিটারি কায়দায় স্যালুট করতে আর নিয়োগকর্তা অফিসারের সামনে কি রকমভাবে কেতাদুরস্তভাবে চলতে হয় শিখিয়ে দিয়েছিল। তাই বিনা বিপত্তিতে ওর কাজ হয়ে গেল। নাম লেখানো হয়ে গেলে ওকে ছুটি দেওয়া হল ওর ব্যক্তিগত জিনিসপত্র বাড়িতে জমা দিয়ে আসার জন্যে কারণ এর পরেই শুরু হবে ওর সেনাদলে শিক্ষানবিশী।

    পাঁচদিন পরে ও বেলা দুপুর নাগাদ বাড়ি পৌঁছল। ওর বন্ধুবান্ধব যারা ওর খবরাখবর নেওয়ার জন্যে ভিড় করে এল তারাই ওকে বলল যে ওর বাবা গ্রামের একেবারে শেষ প্রান্তে ওদের ছোট একফালি জমিটায় লাঙল দিতে গেছে এবং ওর ফিরতে রাত হয়ে যাবে। (আমি যেদিন শঙ্খচূড় সাপটি মারি সেদিন এই জমিটার ওপরেই আমি বাঘটার থাবার ছাপ দেখি)।

    ছেলেটির একটি কাজ ছিল বাড়ির গরু মোষদের খাওয়ানো। সে এক প্রতিবেশীর বাড়িতে দুপুরের খাওয়া-দাওয়া সেরে জনা কুড়ি লোকের সঙ্গে বেরোল পাতা সংগ্রহ করতে।

    আমি আগেই বলেছি যে গ্রামটি একটি ছোট পাহাড়ের ওপর অবস্থিত আর চারিদিকে জঙ্গল দিয়ে ঘেরা। এই জঙ্গলে ঘাস কাটার সময় দুটি স্ত্রীলোক মানুষখেকোটার হাতে মারা পড়েছে, তাই বেশ কয়েকমাস ধরেই গ্রামের আশপাশের গাছগুলি থেকে কাটা পাতা খাইয়ে গরু ছাগলগুলোকে বাঁচিয়ে রাখা হচ্ছিল। প্রতিদিনই পাতা সংগ্রহের জন্যে গ্রামের লোকজনদের একটু একটু করে দূরে যেতে হচ্ছিল। এই বিশেষ দিনটিতে একুশ জনের দলটি চষা জমি পেরিয়ে একটা খুব খাড়া পাথুরে পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে উপত্যকাটির মাথায় এসে পৌঁছল। এই উপত্যকাটি ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে প্রায় আট মাইল বিস্তৃত–শেষে উপত্যকাটি চিকালা ফরেস্ট বাংলোর উল্টো দিকে রামগঙ্গা নদীর সঙ্গে মিশেছে।

    উপত্যকাটি মাথার দিকে মোটামুটি সমতল আর বড় বড় গাছে ঢাকা। এইখানে লোকগুলি সব ছাড়াছাড়ি হয়ে গেল–প্রত্যেকেই উঠল নিজেদের পছন্দ মত এক একটি গাছে। প্রয়োজনমত পাতা কেটে, সঙ্গে নিয়ে আসা দড়ি দিয়ে বেঁধে তারা দুজন তিনজন করে গ্রামে ফিরে গেল।

    পাহাড়ের গা বেয়ে-হয় সাহস বাড়াবার জন্যে আর নয় মানুষখেকোটাকে ভয় খাইয়ে দেওয়ার জন্যে তারা যখন খুব চিৎকার করে নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলতে বলতে নামছিল, অথবা যখন একগাছের মাথা থেকে চিৎকার করে তারা অন্য গাছে পরস্পরের সঙ্গে কথা বলছিল তখন উপত্যকাটার আধমাইলটাক দূরে একটা ঘন। ঝোপের আড়ালে মানুষখেকোটা শুয়ে ছিল। সে ওদের চিৎকার শুনতে পায়।

    এই ঝোপটাতেই বাঘটা দিন চারেক আগে একটা সম্বর মেরে খেয়েছিল। এখন ওদের চিৎকার শুনে বাঘটা উঠে একটা ছোট ঝরনা পেরিয়ে সরু একটা গরু মোষের পায়ে চলার পথ ধরে ওদের দিকে এগিয়ে চলল। এই পায়ে চলার পথটা রয়েছে পুরো উপত্যকাটার বিস্তার জুড়ে। যে জমির ওপর বাঘের থাবার ছাপ রয়েছে সেখানে বাঘটার সামনের আর পেছনের পায়ের তুলনামূলক অবস্থান লক্ষ করলেই বাঘটার গতি কি ছিল তা বোঝা যায়।

    আমার কাহিনীর ছেলেটি গরুর পাতা কাটার জন্যে উঠেছিল একটা কাঞ্চন গাছে। গাছটা, গরু মোষ চলার রাস্তাটির প্রায় কুড়ি গজ ওপরে আর গাছটার ওপরে ডালপালা ঝুঁকে ছিল একটা ছোট নালার ওপর। এই নালাটার ওপর ছিল দুটি বিশাল পাথর। পথটার একটা বাঁক থেকেই বাঘটা গাছের ওপর ছেলেটিকে দেখতে পায়। শুয়ে শুয়ে কিছুক্ষণ ছেলেটিকে লক্ষ করার পর বাঘটা পড়ে যাওয়া শিমূল গাছের পেছনে লুকিয়ে পড়ে। গাছটার দূরত্ব নালার থেকে প্রায় তিরিশ গজ। ছেলেটার পাতা কাটা হয়ে গেলে ও গাছ থেকে নেমে এসে পাতাগুলো এক জায়গায় জড়ো করে। এর পরেই বান্ডিল বেঁধে ফেলবে ও। যতক্ষণ ছেলেটি খোলা জায়গার ওপরে এইসব। কাজ করছিল ততক্ষণ ও তুলনামূলকভাবে নিরাপদ ছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে ও লক্ষ করেছিল ওর কাটা দুটো ডাল গিয়ে পড়েছে নালাটায়, দুটো পাথরের মধ্যে। ও যে মুহূর্তে ডাল দুটো তোলার জন্যে নালাটার মধ্যে নামল ওর নিজের জীবনের ছেদ। নিজেই টেনে দিল সেই মুহূর্তে। ও চোখের আড়াল হতেই বাঘটা পড়া গাছটার পেছন থেকে বেরিয়ে নিঃশব্দে এগিয়ে গেল নালাটার পাড়ে। ছেলেটা ডালগুলো ভোলার জন্যে যেই ঝুঁকেছে অমনি বাঘটা ওর ওপর লাফিয়ে পড়ে ওকে মেরে ফেলল। অন্য। লোকজন গাছে থাকার সময়েই এই ঘটনা ঘটেছে না তারা চলে যাওয়ার পর, তা আমি স্থির করতে পারি নি।

    ছেলেটির বাবা সূর্যাস্তের পর গ্রামে ফিরে এসেই সুসংবাদ শুনল যে তার ছেলে সেনাবাহিনীতে কাজ পেয়েছে আর ল্যান্সডাউন থেকে কয়েকদিনের ছুটিতে বাড়িতে এসেছে। ছেলে কোথায় জিজ্ঞাসা করতে তাকে বলা হল সে বেশ বেলা থাকতেই গরু, ছাগলের খাবার আনতে বেরিয়েছে। তার সঙ্গে বাড়িতে ছেলের দেখা হয়নি শুনে অনেকেই খুব অবাক হয়ে গেল। গরুগুলোকে বেঁধে রেখে সে বাড়ি বাড়ি ঘুরে বেড়াল তার ছেলের সন্ধানে। সেদিন যারা বেরিয়েছিল তাদের প্রত্যেককে আলাদাভাবে জিজ্ঞাসা করা হল কিন্তু প্রত্যেকের সেই একই কথা তারা উপত্যকায় মাথার কাছটাই সবাই আলাদা হয়ে যায় তারপরে ওর ছেলেকে দেখার কথা কারো, স্মরণ নেই।

    সেই ধাপকাটা চাষের ক্ষেত পেরিয়ে ওর বাবা খাড়া পাহাড়টার ধারে এসে ছেলের নাম ধরে বারে বারে ডাকল কিন্তু কোনো উত্তর পেল না।

    তখন রাত ঘনিয়ে আসছে। লোকটা বাড়ি ফিরে এসে একটা ধোঁয়া মলিন লণ্ঠন জ্বালিয়ে নিয়ে বেরিয়ে গেল। সে যখন গ্রামের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে তখন গ্রামবাসীদের প্রশ্নের উত্তরে সে বলল যে, সে যাচ্ছে তার ছেলেকে খুঁজতে। ওর উত্তর শুনে গ্রামবাসীরা ঘাবড়ে গেল। ওকে জিজ্ঞাসা করা হল ওকি মানুষখেকোটার কথা ভুলে গেছে? উত্তরে লোকটি বলল মানুষখেকোটা আছে বলেই ছেলেকে খুঁজে পাওয়ার জন্যে তার এত দুশ্চিন্তা। এমনও হতে পারে, ছেলেটা গাছ থেকে পড়ে আঘাত পেয়েছে কিন্তু মানুষখেকোটা শুনতে পাবে ভেবে ওর ডাকে সাড়া দেয় নি।

    কাউকে সে ওর সঙ্গে যেতে দিল না–কেউ অবশ্য নিজে থেকে যাওয়ার কথাও বলল না। সারা রাত ধরে সে উপত্যকাটার এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত পর্যন্ত ছেলেকে খুঁজে বেড়াল। অথচ মানুষখেকোটা আসার পর আর কেউ ওখানে পা বাড়াবার সাহস পায়নি। পরে ওর পায়ের ছাপ দেখে আমি বুঝেছিলাম সে রাতে অন্তত চারবার সেই গরু ছাগলদের পায়ে চলার পথ ধরে যাওয়ার সময়ে যেখানে বাঘটা বসে তার ছেলেকে খাচ্ছিল তার দশ ফুটের মধ্যে দিয়ে সে গিয়েছে।

    যখন ভোরের আলো সবে ফুটছে তখন সে ক্লান্ত হয়ে পাথুরে পাহাড়টায় গা, বেয়ে কিছুটা উঠে ভারাক্রান্ত হৃদয়ে বসেছিল কিছুটা বিশ্রামের জন্যে। এই উঁচু জায়গাটা থেকে ও নালার মধ্যেটা দেখতে পাচ্ছিল। সূর্য উঠলে পর ও দেখল বিশাল, পাথর দুইটির ওপর কিছুটা রক্ত চকচক করছে– তাড়াতাড়ি নেমে এসে দেখতে পেল ওর ছেলের দেহাবশিষ্ট, বাঘটা যেটুকু রেখে গিয়েছিল। দেহের এ অবশিষ্ট অংশটুকু ও সঙ্গে করে বাড়ি নিয়ে এল। শব ঢাকার মত এক টুকরো কাপড় যোগাড় হলে ও বন্ধুদের সাহায্যে শরীরের অংশটুকু নিয়ে এল মণ্ডল নদীর শ্মশান ঘাটে।

    আমার মনে হয় একথা ধরে নেওয়া ঠিক হবে না যে, যারা এ ধরনের কাজ করে তাদের কল্পনাশক্তি কম–এ ধরনের কাজে বিপদের ঝুঁকি তারা নিচ্ছে সে বিষয়ে তারা সজাগ নয়। আমাদের পার্বত্য অঞ্চলের লোকেরা তাদের পরিবেশ সম্বন্ধে খুবই সচেতন। এছাড়াও তাদের মধ্যে আছে নানা ধরনের কুসংস্কার–যেমন, প্রতিটি পাহাড়ের চূড়ায়, উপত্যায়, খাদে আছে কোনো না কোনো অশরীরী আত্মা, তাদের মধ্যে যারা অশুভ, ক্ষতিকর, সন্ধের অন্ধকার ঘনিয়ে আসার পর তাদের এড়িয়ে চলতে হবে। এই পরিবেশে যে লোকটি বড় হয়েছে আর যে গত এক বছরেরও ওপর কাটাচ্ছে এক মানুষখেকোর সন্ত্রাসের মধ্যে তার পক্ষে বিনা অস্ত্রে সম্পূর্ণ একা সূর্যাস্ত থেকে সূর্যোদয় পর্যন্ত গভীর জঙ্গলের ভেতর ঘুরে বেড়ানোর মধ্যে যে গুণ এবং সাহসের পরিচয় মেলে তা আমার ধারণা খুব কম লোকের মধ্যেই আছে–বিশেষ করে যখন ওর দৃঢ়বদ্ধ ধারণা জঙ্গলের মধ্যে আছে ক্ষতিকর অশরীরী আত্মা আর ও পেতে আছে এক মানুষখেকো বাঘ। ওকে আরো বেশি কৃতিত্ব আমি দিই এই জন্যে যে, নিজে যে কত বড় সাহসের কাজ করেছে এ সম্বন্ধে লোকটি মোর্টেই সচেতন নয়–যেন সে বলার বা লক্ষ করার মত এমন কিছুই করে নি। আমার অনুরোধে যখন সে মানুষখেকোটার কাছে ছবি ভোলার জন্য বসল তখন সে আমার দিকে তাকিয়ে খুব শান্ত, সংযত গলায় বলল-”আমার কোনো দুঃখ নেই সাহেব, আপনি আমার ছেলের মৃত্যুর বদলা নিয়েছেন।”

    আমি কুমায়ুনের জেলা অফিসারদের এবং পরে গাড়োয়ালের জনসাধারণকে যে তিনটি মানুষখেকো মারার চেষ্টা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম এইটিই তার মধ্যে শেষটি।

    আবেদন পত্রের প্রতিলিপি
    গাড়োয়ালের জনগণ কর্তৃক লেখককে প্রেরিত ২৬৬ পাতার উল্লেখিত প্রতিশ্রুতি এই আবেদন পত্রটি পাওয়ার পর দেওয়া হয়েছিল,

    প্রেরিত
    পইনৌম, বুংগি এবং বিকলা বাদলপুর পট্টি, জেলা গাড়োয়ালের জনসাধারণ, কর্তৃক।
    প্রাপক
    ক্যাপ্টেন জে. ই. করবেট, সমীপেষু, আই. এ. আর, ও., কালাধুঙ্গী,
    জেলা নৈনিতাল।

    শ্রদ্ধেয় মহাশয়,
    আমরা সর্বসাধারণ (উপরোক্ত তিনটি পট্টির) অত্যন্ত বিনীতভাবে এবং শ্রদ্ধার সঙ্গে নিম্নলিখিত লাইন কটিতে আমাদের বক্তব্য জানাচ্ছি আপনার বিবেচনা এবং যথা। কর্তব্য করার জন্যে।

    বক্তব্য এই যে এর নিকটবর্তী অঞ্চলে গত ডিসেম্বর থেকে একটি বাঘ নরখাদক হয়ে গেছে। এ পর্যন্ত সে পাঁচটি মানুষ মেরেছে এবং দুটিকে জখম করেছে। সেইজন্যে আমরা, জনসাধারণ, অত্যন্ত এক গভীর সংকটের সম্মুখীন হয়েছি। বাঘের ভয়ে আমরা রাত্রে আমাদের গম শস্য পাহারা দিতে পারি না। ফলে হরিণেরা প্রায় সব শস্য নষ্ট করেছে। আমরা গরু-ছাগলদের ঘাস আনার জন্যে জঙ্গলে যেতে পারি না, আমাদের গবাদি-পশুকে জঙ্গলে চরাতে নিয়ে যেতে পারি না কারণ তাতে বহু পশু প্রাণ হারাবে। এই অবস্থায় আমরা প্রায় শেষ হতে বসেছি। বনবিভাগের অফিসাররা বাঘটিকে মারার যথাসম্ভব চেষ্টা করেছেন কিন্তু সাফল্যের কোনো আশা দেখা যাচ্ছে না। দুজন শিকারী ভদ্রলোকও বাঘটিকে গুলি করার চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তাঁরাও বাঘটিকে মারতে পারে নি। আমাদের সহৃদয় জেলাশাসক এই বাঘটি মারার জন্যে ১৫০ টাকার পুরস্কার ঘোষণা করেছেন সেইজন্যে সবাই বাঘটিকে মারার চেষ্টা করছে কিন্তু কেউই সফল হয় নি। আমরা শুনেছি দয়াবান আপনি অনেক নরখাদক বাঘ এবং চিতা মেরেছেন। এর জন্যে আপনি সুনাম অর্জন করেছেন বিশেষ করে কুমায়ুন রাজস্ব বিভাগে। বিখ্যাত নাগপুরের নরখাদক চিতা আপনার হাতে মারা পড়ে। এখানে সর্বসাধারণ একমত যে বাঘটিকে একমাত্র আপনিই মারবেন। সুতরাং আমরা, জনসাধারণ আপনাকে সাহস করে অনুরোধ জানাচ্ছি যে আপনি এখানে আসার কষ্ট স্বীকার করে বাঘটিকে (আমাদের শত্রু) মারুন এবং জনগণকে সন্ত্রাসমুক্ত করুন। এই দয়ার কাজটির জন্যে, আমরা, জনসাধারণ খুবই উপকৃত বোধ করব এবং আপনার দীর্ঘ জীবন ও সমৃদ্ধির জন্যে প্রার্থনা করব। আশা করি আপনি আমাদের অবস্থা বিবেচনা করে আমাদের বিপদমুক্ত করতে এখানে আসার কষ্ট স্বীকার করবেন। এখানে আসার রাস্তা এইরকম; রামনগর থেকে সুলতান, সুলতান থেকে লাহাচৌর, লাহাচৌর থেকে কান্দা। মাননীয় মহাশয়, যদি আমাদের রামনগরে পৌঁছনোর তারিখটি জানান তাহলে আমরা আপনাকে স্বাগত জানাতে এবং আপনাকে সঙ্গে করে নিয়ে আসার জন্যে রামনগরে আমাদের লোজন এবং গরুর গাড়ি পাঠাব।
    আপনার চরণপ্রার্থী
    মহাশয়
    আপনার সর্বাধিক বিশ্বস্ত স্বাক্ষর
    গোবিন্দ সিং নেগি, মোড়ল, গ্রাম-ঝারাট
    তারিখ, ঝারাট
    ১৮ই ফেব্রুয়ারী, ১৯৩৩

    এর সঙ্গে আছে পইনৌম, বুংগি এবং বিল্লা বাদলপুর পট্টিগুলির ৪০ জন অধিবাসীর স্বাক্ষর এবং ৪ জনের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠের ছাপ
    ঠিকানা : গোবিন্দ সিং নেগি
    গ্রাম-ঝরাট পট্টি
    পো. অপইনৌম
    বাদিয়ালগাঁও জেলা, গাড়োয়াল, ইউ. পি.

    [‘পাওয়ালগড়ের কুঁয়ারসাব’ কাহিনীতে জনৈক ভূতপূর্ব চোরাশিকারীকে যে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়, তা এই আবেদনপত্র লাভের পর-করবেট বলেছেন। তবে আবেদনপত্রটি কান্দার মানুষখেকো সম্পর্কিত এবং মূল বইয়ে ‘কান্দার মানুষখেকো কাহিনীর সঙ্গেই এটি আছে।–সম্পাদিকা]

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleরামায়ণের উৎস কৃষি – জিতেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়
    Next Article জীবনযাপন – জীবনানন্দ দাশ
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    আলো হাতে সেই মেয়েটি – তপন বন্দ্যোপাধ্যায়

    August 20, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    আলো হাতে সেই মেয়েটি – তপন বন্দ্যোপাধ্যায়

    August 20, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Our Picks

    আলো হাতে সেই মেয়েটি – তপন বন্দ্যোপাধ্যায়

    August 20, 2025

    গোয়েন্দা গার্গী সমগ্র – তপন বন্দ্যোপাধ্যায়

    August 20, 2025

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.