Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    জিম করবেট অমনিবাস (অখণ্ড) – মহাশ্বেতা দেবী সম্পাদিত

    জিম করবেট এক পাতা গল্প1380 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    ট্রী টপ্স পরিদর্শনের গল্প

    ট্রি টপস

    মুখবন্ধ

    মহামান্যা রাণীর ১৯৫২ সালে ট্রী টপ্স পরিদর্শনের গল্প জিম করবেট লেখেন ১৯শে এপ্রিল ১৯৫৫ সালে কেনিয়াতে তার আকস্মিক মৃত্যুর অল্প কিছুকাল আগে। তখন তাঁর বয়স প্রায় আশির কাছাকাছি। ১৯৫১ সালে তিনি যখন ইংল্যান্ড ভ্রমণে আসেন তখন তার শরীরে বয়সের ছাপ তত পড়ে নি, কিন্তু ব্রিটিশ সেনাদলকে বার্মা যুদ্ধে যোগ দেওয়ার আগে জঙ্গল যুদ্ধে শিক্ষা দেওয়ার সময়ে মধ্য ভারতে তিনি যে কঠিন অসুখে পড়েন তার থেকে তিনি কোনোদিনই সম্পূর্ণ সেরে ওঠেন নি।

    আমি জানি না তার সম্বন্ধে যে ছবি তার পাঠকেরা মনে মনে এঁকেছেন তার সঙ্গে তার বন্ধুবান্ধবদের স্মৃতিপটে আঁকা ছবির পার্থক্য কতখানি। এক হিসেবে যে পাঠক তাঁকে তাঁর লেখার মাধ্যমে জেনেছেন তিনি তাঁর বন্ধুবান্ধবদের চেয়েও ভাগ্যবান। তাঁর লেখায়, মানুষখেকোর মুখোমুখি হওয়ার, যে কষ্টসহিষ্ণুতা এবং বিপদের বিবরণ পাঠককে অতুলনীয় আনন্দ দেয় সে সম্বন্ধে তিনি কথা বলেছেন কদাচিৎ। আমার মনে হয়, তিনি ভাবতেন এ ব্যাপারগুলো,–যে বিরাট জানোয়ারদের শক্তি ও সাহসকে তিনি শ্রদ্ধা করতেন তাদের এবং তার মধ্যেই সীমাবদ্ধ–এদের মানুষের সন্ত্রাসের কারণ হয়ে ওঠার ঘটনাটা তিনি সহজেই ভুলে যেতে পারতেন। তাঁর পরিচিতদের মধ্যে অনেকেই সম্ভবত উপলব্ধি করতে পারেন নি যে এই শান্ত ও নিরহঙ্কার মানুষটির নাম এবং কীর্তি সারা কুমায়ুন জুড়ে ছড়ানো কুঁড়েঘরগুলির প্রতিটি পাহাড়ীর মুখে মুখে। আমার মনে হয় যে উনি ওঁর সর্বপ্রথম বইটি, ‘ম্যান ইটার্স অফ কুমায়ুন ১৯৪৪ সালে পৃথিবীকে উপহার দিতেন কিনা, যদি তাঁর আশা থাকত যে বইটির প্রকাশ সেন্ট ডানস্টান তহবিলে কিছু অর্থ সাহায্য করতে পারে, যে প্রতিষ্ঠানটি তার আগের বছরই যুদ্ধে অন্ধ হয়ে যাওয়া ভারতীয় সৈনিকদের জন্যে একটা শিক্ষণ শিবির খুলেছিল। আমার মনে পড়ে এ সাহায্য যে কত অকিঞ্চিৎকর হতে পারে সে সম্বন্ধে তার ধারণার কথা। তিনি অনুভব করেন নি যে তার বলা গল্প কি আনন্দদায়ক হতে পারে বা তার বলার গুণে গল্প আরও কত বেশি চিত্তাকর্ষক হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু তা সত্ত্বেও সারা বিশ্ব অল্পদিনের মধ্যেই স্বীকার করেছিল তাঁর বর্ণনার ক্ষমতার তুলনা মেলা ভার এবং সে ক্ষমতা কোনো সচেতন শিল্প প্রচেষ্টার আওতায় পড়ে না। সে যাই হক, যেহেতু তিনি নিজেই নিজের কাহিনীর নায়ক, সেইহেতু অবশ্যম্ভাবীভাবেই এখানে প্রতিফলিত হয়েছে তার নিজের ইতিহাস ও জীবনযাত্রার অনেক তথ্য।

    যাঁরা ‘মাই ইন্ডিয়া’ বা ‘জাঙ্গল লোর’ পড়েছেন তাঁদের বলে দিতে হবে না যে তিনি ছিলেন একটি বৃহৎ পরিবারের একজন এবং বড় হয়েছিলেন গরমকালে হিমালয়ের শৈলাবাস নৈনিতালে ও শীতকালে নৈনিতালের নিচে পাহাড়ের পাদদেশে। তাদের পারিবারিক ছোট্ট জমিদারী কালাধুঙ্গিতে। শিকার ছিল তাঁর রক্তে এবং ছোটবেলা থেকেই তিনি জঙ্গল এবং জঙ্গলের জীবনের সঙ্গে অন্তরঙ্গ পরিচয় স্থাপনের জন্যে সচেষ্ট হন, যা ভবিষ্যতে, তাঁর ক্ষুদ্র সামর্থ্যের মধ্যে শিকারের আনন্দ উপভোগের প্রয়োজনে সহায়ক হবে। সেই সময় জঙ্গলে নিঃশব্দে চলার যে অভ্যাসটি তিনি আয়ত্ত করেছিলেন বা জঙ্গলের দৃশ্য ও শব্দের সঙ্গে যে গভীর পরিচয় তার হয়েছিল তা পরবর্তী জীবনে কোনোদিন তিনি ভুলে যান নি এবং এই সময়েই রাইফেল চালানোয় যে অদ্ভুত ক্ষিপ্রতা ও নির্ভুল লক্ষ্যভেদের ক্ষমতা তিনি অর্জন করতে শুরু করেন তা পরবর্তী জীবনে তার বহু কাজে এসেছিল। সেই সময় তাঁকে জানতেন এমন একজন বলেছেন যে তার যৌবনেও এ ক্ষমতা সম্বন্ধে তাঁর বিশেষ কোনো আত্মসন্তুষ্টির ভাব ছিল না। তার কাছে–গুলি করে নির্ভুলভাবে লক্ষ্যভেদ করা ছিল একটা দায়িত্ব, কোনো প্রশংসনীয় গুণ নয়। যদি কোনো জানোয়ার মারতেই হয় তাহলে তা হওয়া দরকার তৎক্ষণাৎ যাতে তার কোন কষ্ট না হয়।

    নৈনিতালে স্কুল ছাড়ার পরেই তিনি রেলওয়ে বিভাগে কাজে নিযুক্ত হন; প্রথমে ছোট ছোট পদে কিন্তু পরবর্তীকালে মোকামাঘাটে, যেখানে গঙ্গা নদী দুটি বিভিন্ন রেলপথের মধ্যে এক চওড়া ব্যবধানের সৃষ্টি করেছে, সেখানে পরিবহণের দায়িত্ব নিয়ে। এখন সেখানে নদীর ওপর এক বিরাট সেতু হয়েছে কিন্তু তখন প্রতি বছর পাঁচ লক্ষ টনের বেশি মাল সেখান থেকে ফেরিযোগে পার করা হতো এবং জলপথেই নিয়ে যাওয়া হতো এক রেলপথ থেকে আর এক রেলপথে। সেখানকার কাজ অসম্ভব শ্রমসাধ্য হওয়া সত্ত্বেও তিনি যে কুড়ি বছর সে কাজ চালিয়ে যেতে পেরেছিলেন তার মূলে শুধু তার শারীরিক কষ্টসহিষ্ণুতার ক্ষমতা নয়, কন্ট্রাক্টর হিসেবে তার নিয়োগ করা বিরাট কুলিদলের সঙ্গে বন্ধুর মত তার ব্যক্তিগত যোগাযোগও ছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় তারা তার প্রতি, তাদের মনোভাবের অবিসংবাদী প্রমাণ দেয়। তারই সহায়তায় গড়ে ওঠে সাগরপারে কাজ করার জন্যে কুমায়ুন লেবার কোর এবং তাঁর নিজের বিভাগটি তিনি নিয়ে যান ফ্রান্সে। এই সময়েই মোকামাঘাটে তার অধীনস্থ ভারতীয় কর্মীরা কুলিমজুরদের একটা বোঝাঁপড়ায় আসে যে তার পুরো অনুপস্থিতির সময়টা তারা একযোগে তার হয়ে কাজ চালিয়ে যাবে। যুদ্ধের সময় ভারতীয় সেনাবাহিনীতে তাকে মেজরের বিশেষ পদ দেওয়া হয়।

    এই বছরগুলিতে যে ধরনের কাজ তাকে করতে হতো তাতে শিকারের অবসর ছিল না বললেই চলে কিন্তু কুমায়ুনে ছুটি কাটানোর সময় তিনটি বিভিন্ন সময়ে মানুষখেকোর সন্ত্রাসমুক্ত করার ডাকে তিনি সাড়া দিতে পারেন। ১৯০৭ থেকে ১৯১১ সালের মধ্যে তিনি চম্পাবত ও মুক্তেশ্বরের মানুষখেকো এবং পানারের চিতা মারেন। এগুলির মধ্যে প্রথম এবং শেষোক্ত হত্যাকারীরা দুজনে মিলে ৮০৬টি মানুষের জীবন নেয় এবং আমাদের সমসাময়িকের মধ্যে এই দুটি মানুষখেকো কুমায়ুনের ওপর সবচেয়ে বেশি অত্যাচার করে–যদিও পরে অন্যেরা ছিল আরও বেশি কুখ্যাত। উদাহরণস্বরূপ ধরা যায় রুদ্রপ্রয়াগের চিতার কথা, যেটা সরকারী পরিসংখ্যান অনুযায়ী ১৫০টি মানুষ মারে (করবেট তাঁর ‘ম্যান-ইটিং লেপার্ড অফ রুদ্রপ্রয়াগ’ বইয়ে নিহত, পরিসংখ্যান লিখেছেন ১২৫।–সম্পাদিকা)–সারা ভারতে তার নাম ছড়িয়ে পড়ে কারণ হিমালয়ের এক বিখ্যাত হিন্দু তীর্থক্ষেত্রে যাওয়ার পথের তীর্থযাত্রীরাই ছিল তার শিকার।

    মোকামাঘাটের কাজ থেকে অবসর গ্রহণের পর তার জীবনে আরম্ভ হয় এক নতুন অধ্যায়। তিনি নিজেই এখন তার নিজের প্রভু। তার জীবনের প্রয়োজন ছিল অল্প; তিনি অবিবাহিত ছিলেন কিন্তু নৈনিতাল ও কালাধুঙ্গিতে তিনি পেয়েছিলেন তার দুই বোনের বিশ্বস্ত অনুষঙ্গ এবং এঁদের মধ্যে একজন (তার লেখায় বহু জায়গায় উল্লিখিত ম্যাগি) তাঁর মৃত্যুর পরেও জীবিত।

    তার জীবনের এই সময়েই বেশিরভাগ মানুষখেকোর মুখোমুখি তাকে হতে হয় যাদের সম্বন্ধে বইয়ে তিনি লিখেছেন। পার হয়ে যাওয়া বছরগুলি, যে উদ্যম এবং সাহস নিয়ে এই কাজে তিনি নেমেছিলেন, তা বিন্দুমাত্র কমাতে পারে নি। অমানুষিক পরিশ্রমের পরে, বহু বিনিদ্র রাত কাটিয়ে তিনি যখন রুদ্র প্রয়াগের চিতাটা মারেন তখন তাঁর বয়েস ৫১ বছর–তিনি যেমন বাঘের পিছু নিয়েছিলেন বাঘও তেমনি তার পিছু নিতে ছাড়ে নি। থাকের বাঘটিকে যখন মারেন তখন তার বয়স তেষট্টি। ওঁর শারীরিক ক্লান্তি সহ্য করার বা কোনো দুর্ভোগ দুর্ঘটনার মুখে সম্পূর্ণ শান্ত থাকার ক্ষমতা ছিল অপরিসীম।

    কিন্তু এখন যে ধরনের জীবন তিনি যাপন করতে লাগলেন তার আর একটা দিক ছিল। মনে হয় প্রচলিতাৰ্থে শিকার ব্যাপারটি তাঁর জীবনে আর মুখ্য ছিল না। তার মতে বাঘ বা চিতা সম্পূর্ণ স্বাধীন, যতক্ষণ না তারা মানুষের জীবনহানি ঘটায়। অনেক সময় যখন আমরা একসঙ্গে থাকতাম পাহাড়ীদের প্রতিনিধিদল আসত সাহায্য চাইতে; সত্যি কথা বলতে কি তারা চাইত তাঁকেই। তাদের জগৎ জানত যে সারা কুমায়ুনে একমাত্র তিনিই অনেক সময়ে নিজের জীবন বিপন্ন করেও দিবারাত্রির আতংক থেকে অন্যদের মুক্ত করেছেন। মানুষের স্বাভাবিক ভয়ের সীমার বাইরেও এখানে অন্য কিছু একটা আছে কারণ পাহাড়ের প্রাচীন দেবতাদের মতিগতি বোঝা ভার, কে জানে আতংকটা তাঁদেরই অভিপ্রেত কিনা? কিন্তু এসব ক্ষেত্রে করবেট যে জিজ্ঞাসাবাদ চালাতেন তা যতই সহৃদয় বা বন্ধুত্বপূর্ণ হ’ক না কেন কয়েকটা কঠোর বিধি তিনি মেনে চলতেন। তাদের গরু ছাগল কি মারা পড়েছে না পড়েছে তা নিয়ে কান্নাকাটি করে লাভ নেই। বাঘ জঙ্গলের রাজা এবং তার প্রাপ্য তাকে দিতেই হবে। যতক্ষণ না তার বিশ্বাস হচ্ছে যে বাঘটা ঘটনাক্রমে বা রাগের মাথায় মানুষ মারছে না, মারছে। খাদ্য হিসেবে ততক্ষণ তিনি কিছুতেই তাদের সাহায্যে যেতে রাজী হতেন না।

    আরও লক্ষ করা যেত যে তার জঙ্গল সম্বন্ধে গভীর পর্যবেক্ষণ যা একসময় লাগত তার শিকারের প্রয়োজনে, এখন একটা স্বয়ংসম্পূর্ণ আনন্দের উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছে। তার সঙ্গে দীর্ঘ দিনগুলি পাহাড়ের কোলে বা জঙ্গলে কাটানোর মত উপভোগ্য আর কিছু ছিল না। যার প্রতিটি মোচড়ানো ডাল, প্রতিটি পাখি বা জানোয়ারের ডাক তার কাছে বিশেষ অর্থবহ ছিল। সে অর্থ যদি তখন তার কাছে পরিষ্কার নাও হতে তাহলেও এগুলি তাকে ভবিষ্যত চিন্তা ও পর্যালোচনার খোরাক যোগাত। তার কাছে এটা প্রকৃতি-অনুসন্ধান নয়–এটাই তার জগৎ এবং এখানকার অধিবাসীদের .. জীবন-মৃত্যু নির্ভর করছে এই আপাত ক্ষুদ্র ঘটনাগুলোর ওপরেই। গুলি চালানোর চেয়ে ছবি তোলাটাই তাঁর কাছে প্রধান হয়ে ওঠে। আমার মনে পড়ে একবার তার সঙ্গে আমার দেখা হয়ে যায় যখন তিনি কালাধূঙ্গি জঙ্গলে একটা লতাপাতা জড়ানো ঝোঁপ থেকে কিঞ্চিৎ বিশৃঙ্খল অবস্থায় বেরিয়ে আসছিলেন। তিনি বললেন যে তিনি একটি বাঘিনীর ছবি তোলার চেষ্টা করছিলেন কিন্তু বাঘিনীটার মেজাজ ভাল ছিল না এবং যতবার তিনি ঝোপের মধ্যে যাচ্ছিলেন ততবার সে তাঁকে বাইরে তাড়িয়ে দিচ্ছিল। যাইহোক, তিনি আরো বললেন যেন নেহাত জানা দুর্বলতার প্রশ্রয় দিচ্ছেন, যে বাঘিনীটার বাচ্চারা তার সঙ্গে আছে। কুমায়ুনের জন্তু জানোয়ারদের সঙ্গে এখন তার অন্তরঙ্গতা অনেকটা এই ধরনের। এঁদের মধ্যে একটা বোঝাঁপড়া ছিল যার দরুন বাঘিনীটার বাচ্চার কাছে আসার জন্যে ওঁকে তাড়িয়ে দিতে দ্বিধা করে নি। কিন্তু এ বিষয়ে বেশি বলা নিষ্প্রয়োজন।

    দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি যখন সেনাদলকে জঙ্গল লড়াইয়ে শিক্ষা দেওয়ার ব্যাপারে সরকারকে সাহায্য করছেন তখন তাকে অনারারী লেফটেন্যান্ট কর্নেল-এর পদ দেওয়া হয় এবং ১৯৪৬ সালে তাকে ভারত সাম্রাজ্যের বন্ধু’ এই সম্মানে সম্মানিত করা হয়। সরকার এর আগে তাকে যে অরণ্যের স্বাধীনতা অর্থাৎ সংবলিত জঙ্গলে তাঁর প্রবেশের অবাধ অধিকার দিয়েছিলেন তার মূল্য তার কাছে ছিল খুব বেশি। কুমায়ুনের আপামর জনসাধারণ তাকে কি পরিমাণ শ্রদ্ধা করত সে সম্বন্ধে কিছু বলার প্রয়োজনবোধ করছি না। তিনি যেমন দয়ালু ও হৃদয়বান ছিলেন তেমনই পারতেন নিজেকে অবাধে মিলিয়ে দিতে, কোনো প্রতিদানের আশা না রেখেই। আমার মনে হয় পুরনো দিন হলে ভারতীয়রা যে অল্পসংখ্যক ইউরোপীয়দের স্মৃতিকে ভগবানের অংশ বলে পুজো করত উনি তাদেরই মধ্যে স্থান পেতেন।

    যখন তাঁর বন্ধুবান্ধব ১৯৪৭ সালে ভারত ছেড়ে চলে যান, তিনি ও তাঁর বোনও ভারত ত্যাগের সিদ্ধান্ত নেন এবং কেনিয়ার নিয়েরিতে বসবাস শুরু করেন। সিদ্ধান্তটা নেওয়া নিশ্চয়ই তার পক্ষে সহজ হয় নি। তিনি কালাধূঙ্গিতে তাঁর নিজের বাড়িটিকে যেমন ভালবাসতেন তেমনই পেয়েছিলেন তিনি সেখানকার গ্রামবাসীদের অকৃপণ ভালবাসা। কিন্তু কেনিয়াতে তার বন্য জীবনের ছবি তোলার আগ্রহ চরিতার্থ হয়েছিল কারণ সেখানে ছবি তোলার উপকরণ ছড়িয়ে ছিল অজস্র। ট্রী টক্স নিয়েরির কাছে হওয়ার দরুন তিনি সেখানে প্রায়ই যেতেন এবং এটা অত্যন্ত আনন্দের বিষয় যে এখন আমরা তার জবানীতেই মহামান্যা রাণীর ট্রী টস পরিদর্শনের গল্প শুনব কারণ এই সময়ে তিনি বন্ধুবান্ধবদের যে চিঠি লেখেন তাতে দেখা যায় মহারাণীর দলভুক্ত হতে পেরে তিনি কি গভীরভাবে অভিভূত হয়েছিলেন।
    —হেইলী
    লন্ডন সেপ্টেম্বর ১৯৫৫

    .

    সেদিন ১৯৫২ সালের ৫ই ফেব্রুআরি উজ্জ্বল সূর্যের আলোয় স্নান করেছিল গাঢ় নীল আকাশ, বইছিল শরীর মন চাঙ্গা করে তোলা সতেজ বাতাস।

    আমি জমি থেকে তিরিশ ফুট ওপরে একটা কাঠের পাটাতনের ওপর। দাঁড়িয়েছিলাম, আমার সামনে জঙ্গলের মধ্যে দুশো গজ লম্বা এবং একশো গজ চওড়া একটা ডিম্বাকৃতি ফাঁকা জমি। জমিটার দুই তৃতীয়াংশ জায়গা জুড়ে একটা ছোট হ্রদ, তার মধ্যে লম্বা ঘাসের চাবড়া, বাকি জায়গাটায় একটা সল্ট লিক। হ্রদের ওদিকে একটা তুষার শুভ্র বক নিশ্চল দাঁড়িয়ে ধৈর্য ধরে অসাবধানী ব্যাঙদের আসার অপেক্ষা করছে এবং তার সামনে প্রসারিত জলে একজোড়া ড্যাবচিক (জলজ পাখি) তাদের চারটি বাচ্চা নিয়ে, যাদের মারবেলের মত ছোট্ট দেখাচ্ছিল, চলেছে এক বিপদসঙ্কুল পৃথিবীতে তাদের অভিযানে। সল্ট লিকের ওপর একটা গণ্ডার অশান্তভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে, মাঝে মাঝে ঝুঁকে নোনা জমি চাটছে তারপরে মাথা ঝাঁকিয়ে তুলছে জঙ্গল থেকে তার দিকে বয়ে আসা বাতাস প্রাণভরে নেওয়ার জন্যে।

    হ্রদ এবং সল্ট লিকের তিন দিক ঘন বৃক্ষ সমাকীর্ণ জঙ্গলে ঘেরা এবং চতুর্থ দিকটিতে, যেটি আমার থেকে সবচেয়ে দূরে, একশো গজ চওড়া একফালি ঘেসো জমি এসে পড়েছে একেবারে হ্রদের পাড় পর্যন্ত। ঘেসো জমিটার প্রান্তে একটা ফ্রেমের মত এক সার বাদাম গাছ। পূর্ণ প্রস্ফুটিত এই বাদাম গাছগুলির বেগনের ছোঁয়া মেশা নীল ফুলগুলির মধ্যে খেলা করে বেড়াচ্ছে এক দঙ্গল কলোবাস বাঁদর। ওদের লেজগুলি দেখতে অনেকটা সাদা ঝুমকো ফুলের মতো। এগাছ থেকে ওগাছে লাফিয়ে পড়ার সময় তাদের ঘাড় থেকে ঝুলে পড়া সাদা কেশরগুলো–যেন মনে হচ্ছে বিরাট আকারের প্রজাপতি। এর থেকে বেশি শান্ত সুন্দর দৃশ্য আর কল্পনা করা যায় না; কিন্তু দৃশ্যত শান্ত হলেও সব জায়গায় শান্তি ছিল না কারণ বাঁদরগুলোর ওপারেই ঘন জঙ্গলে একপাল হাতি ছিল এবং তাদের মধ্যে গণ্ডগোল বেঁধেছিল। কয়েক মিনিট অন্তর অন্তরই বাতাস চিরে ভেসে আসছিল হাতির ডাক আর সেই সঙ্গে তাদের ক্রুদ্ধ চিৎকার আর গুরুগম্ভীর গর্জন। তাদের ঝগড়ার আওয়াজ কাছে এগিয়ে এলে বাঁদরগুলো দল বেঁধে জড়ো হল এবং হুশিয়ারীর ডাক ডেকে গাছের মাথায় মাথায় অদৃশ্য হয়ে গেল–তাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে গেল একটা মা বাঁদর বুকে ঝুলন্ত একটা ছোট্ট বাচ্চা নিয়ে। নিঃসঙ্গ গণ্ডারটি এতক্ষণে স্থির করল যে ওর নুনের প্রয়োজন মিটে গেছে–ঘোঁৎ করে আওয়াজ করে ও একেবারেই সম্পূর্ণ ঘুরে গেল, যেমনটি শুধু গণ্ডারই পারে তারপর মাথা উঁচু করে, ল্যাজ বাতাসে তুলে বাঁ পাশের জঙ্গলের মধ্যে চলে গেল। শুধু অসীম ধৈর্য নিয়ে প্রত্যাশা পূরণের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকা বকটির এবং ড্যাবটির পরিবারটির হাতির দল এগিয়ে আসায় কোনো ভাবান্তর হল না। অল্পক্ষণের মধ্যেই গভীর জঙ্গল থেকে হাতিরা বেরতে লাগল, ভারতীয় প্রথায় এক লাইনে নয়, প্রায় পঞ্চাশ গজ চওড়া জায়গা জুড়ে। এখন তাদের চিৎকার চেঁচামেচি বন্ধ হয়ে গেছে–ধীরে সুস্থে তারা দুজন তিনজন করে ছড়ানো ছেটানো ঝোঁপওলা ঘাসের ফালিটার দিকে গেল–ততক্ষণে সামনে পেছনে দৃষ্টি চালিয়ে আমি সাতচল্লিশটি হাতি গুণে ফেলেছি। সর্বশেষে ফাঁকায় এল তিনটি পুরুষ হাতি, তার মধ্যে একটি নিঃসন্দেহে পালের গোদা, অন্য দুটি তার ছোট ভাই বা ছেলে হবে–কিন্তু তারা এমন একটা বয়সে পৌঁছেছে যে তারা বয়োজ্যেষ্ঠের কাছ থেকে দলের নেতৃত্ব ছিনিয়ে নিয়ে তাকে নির্বাসনে পাঠিয়ে দেবে।

    আমি যে পাটাতনটার ওপর দাঁড়িয়েছিলাম তার দিকে কয়েক ধাপ ছোট্ট সিঁড়ি গিয়েছে সেই কুঁড়েঘরটিতে যা পৃথিবীর সর্বত্র ট্রী টস নামে পরিচিত। কুঁড়েঘরটি বানানো হয়েছে একটা বিশাল ফিকাস (ফিকাস : বট জাতীয় গাছ। সম্পাদিকা) গাছের ওপরের ডালপালার মধ্যে আর এতে ওঠা যায় একমাত্র একটা সরু তিরিশ ফুট লম্বা মইয়ের সাহায্যে। এক সময়ে কুঁড়েঘরের বাসিন্দাদের নিরাপত্তার জন্যে মইয়ের নিচের দিকটা একটা হাতল দিয়ে পাশেরই একটা গাছের ডালপালার মধ্যে তুলে দেওয়া হত কিন্তু নিরাপত্তার এই ব্যবস্থাটি বহুদিন আগে থেকেই বাতিল হয়ে গিয়েছে। এই কুঁড়েঘরটিতে আছে একটি খাবার ঘর যার এক কোণায় আছে একটি জ্বালানী কাঠের স্টোভ, অতিথি অভ্যাগতদের জন্যে তিনটি শোওয়ার ঘর, আফ্রিকাবাসী শ্বেতাঙ্গ শিকারীদের জন্যে একটা সরু ছোট ঘর আর একটা লম্বা খোলা বারান্দা যেখানে আছে আরামদায়ক গদীওয়ালা বসার জায়গা। বারান্দাটির থেকে দৃষ্টি অবাধে চলে যায় ছোট্ট হ্রদ, সল্ট লিক পেরিয়ে দিগন্তজোড়া জঙ্গল পর্যন্ত–যার পটভূমিতে অ্যাবার্ডেয়ার পর্বতশ্রেণী উঠে গেছে ১৪,০০০ ফুট উচ্চতায়।

    যুবরাণী এলিজাবেথ এবং ডিউক অফ এডিনবারা দুদিন আগেই নিয়েরির কুড়ি মাইল দূরে সাগানার রয়েল লজে পৌঁছেছিল এবং সেদিন সকালে দাড়ি কামানো শেষ করতে না করতেই এক অভাবিত টেলিফোন বার্তা এল আমার কাছে যে মহামান্যা যুবরাণী আনন্দের সঙ্গে আমাকে তার ট্রী টপস-এর সঙ্গী হওয়ার জন্যে আহ্বান জানাচ্ছেন। যুবরাণীর দলবল লজ ছাড়বে একটার সময়, তারপর আস্তে আস্তে গাড়ি চালিয়ে ট্রী টপস-এ পৌঁছবে বেলা দুটোয়, সেখানে আমাকে অভ্যর্থনা করতে হবে তাঁদের।

    নিয়েরির পোলো মাঠটি কেনিয়ার শ্রেষ্ঠ পোলো মাঠগুলির অন্যতম এবং আগের দিনই সেখানে একটা প্রতিযোগিতামূলক খেলা হয়ে গেছে যাতে ডিউক অংশগ্রহণ করেছিলেন এবং যুবরাণী ছিলেন দর্শকের আসনে। পোলো মাঠটি নিয়েরি থেকে আটমাইল এবং রয়েল লজ থেকে পনের মাইল দূরে। মাঠটির তিনদিক ঘিরে জঙ্গল আর উঁচু উঁচু ঘাস। আমি এবং আমার বোন ম্যাগি দুজনেই ভিড়ের মধ্যে খুব স্বচ্ছন্দবোধ করি না, সেইজন্যে এই গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচটি দেখার জন্যে যখন দূর-দূরান্ত থেকে লোকজন জড়ো হচ্ছে পোলো মাঠে তখন আমরা গাড়ি চালিয়ে চলে গেলাম গভীর জঙ্গল থেকে মাঠের দিকে চলে আসা একটা গভীর গিরিখাতের ওপর একটা সাঁকোয়। সে সময়টায় যদিও জরুরী অবস্থা ঘোষণা করা হয় নি কিন্তু নিরাপত্তা আইনের বেশ কড়াকড়ি চলছিল কারণ চারিদিক ক্রমেই অশান্ত হয়ে উঠেছিল এবং আশপাশের জঙ্গলে কয়েকটা অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছিল যেগুলো সম্বন্ধে কাগজগুলি সহজবোধ্য কারণেই সম্পূর্ণ নির্বাক ছিল। গভীর গিরিখাতটা সম্বন্ধে ছিল আমার দুশ্চিন্তা কারণ সে পথে সহজেই পোলো মাঠে পৌঁছানো যায়। যাই হক। গিরিখাতের মধ্যে পড়া বালির চড়া পরখ করে কোনো পায়ের দাগ না দেখে আমি নিশ্চিত হলাম–সে সন্ধেটা আমাদের কাটল সাঁকোটার কাছেই, গিরিখাতটার ওপর নজর রেখে, সেইটাই পোলো ম্যাচে আমাদের অনুপস্থিত থাকার কারণ।

    টেলিফোন বার্তাটা পাওয়ার পর আমি আরেকবার দাড়িটা কামিয়ে নিলাম, তারপর প্রাতরাশ সেরে গেলাম শাসনবিভাগের হেডকোয়ার্টারে রাস্তার একটা ছাড়পত্রের জন্যে কারণ যুবরাণীর দলবদলের জন্যে যে রাস্তাটা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল আমাকে সেই রাস্তাটাই ব্যবহার করতে হবে। দুপুরবেলা আমি প্রধান রাস্তাটা দিয়ে আট মাইল মোটর চালিয়ে গেলাম, তারপর মোটরটা পোলো মাঠের কাছে। রেখে একটা সরু উপত্যকার মধ্যে দিয়ে চলে যাওয়া দু মাইল লম্বা একটা এবড়ো-খেবড়ো পথ ধরলাম যেটা চলে গেছে ট্রী টপস পাহাড়ের পাদদেশ পর্যন্ত। এইখানে, যেখানে একটা পথ শেষ হচ্ছে এবং একটা সরু পায়ে চলার পথ ঘন। জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে ছশোগজ উঠে যাচ্ছে ট্রী টপস পর্যন্ত, আমি গাড়ি থেকে আমার হাতব্যাগ ও বৃটিশ কম্বলটা বার করে নিয়ে গাড়িটাকে নিয়েরিতে পাঠিয়ে দিলাম। রাস্তাটার দুপাশে অনেক গাছে কাঠের টুকরো পেরেক দিয়ে গেঁথে মই মতন করা হয়েছে, হাতি, গণ্ডার বা মোষের আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষার জন্যে। ব্যাপারটার গুরুত্ব উপলব্ধি করা যাবে এই ঘটনা থেকে যে যুবরাণী এবং তাঁর দলবল এই পথ দিয়ে হাঁটার দুদিন পরেই এইরকম মই গাঁথা চারটে সবচেয়ে বড় গাছ হাতির দল উপড়ে ফেলেছিল।

    ফেব্রুআরির পঞ্চম দিনটিতে–সময় এখন বেলা ১.৩০ মি এবং ঠিক ২টোর সময় আসবে সেই শুভক্ষণ। হাতিগুলো, এখনও চুপচাপ আর শান্ত, ঘাস ঝোপঝাড় খেতে খেতে ধীরে ধীরে হ্রদের দিকে সরে যাচ্ছিল এবং এখন তাদের আরও কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব। পালেতে সব আকারের আর সব বয়সের হাতি ছিল, এবং এর মধ্যে পাঁচটি মাদী হাতির সঙ্গে ছিল তাদের বাচ্চা–যাদের বয়েস কয়েক সপ্তাহের বেশি হবে না। এই পাঁচটি মাদী হাতি এবং তিনটি মদ্দা হাতি ছিল সংগমের এই সময়টিতে কামান্ধ এবং তাদের থেকেই যত বিপদের আশঙ্কা। যাই হক, হাতির পালটি যদি আর তিরিশ মিনিট হ্রদের ওদিকে থাকে তাহলে আর দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই। মিনিটগুলো যেন তার কাটতেই চায় না, দুশ্চিন্তা থাকলে যেমনটি হয়, এবং পনের মিনিট বাকি থাকতে হাতির পালটি সল্ট লিকের দিকে আস্তে আস্তে সরে যেতে থাকল। সল্ট লিকটা এসেছে ফিকাস গাছটার কয়েক গজের মধ্যেই এবং বের হয়ে থাকা বারান্দাটা থেকে নিচে সল্ট লিকে যে কোনো হাতির ওপর তাক করে একটা রুমাল ফেলে দেওয়া এখন সম্ভব। লিক এবং গাছটার মধ্যে কিছু ছোট ডালপালা বিছানো হয়েছে, ওপরের কুঁড়েঘরটিতে ওঠার মইটির দিকে কেউ এগোলে তাদের এবং গাছটির মধ্যে একটি পর্দা মতন করার জন্যে। এই ডালপালাগুলি হাতি এবং অন্যান্য জানোয়ার পিষে ফেলেছে এবং আমি যে সময়ের কথা লিখছি সে সময়ে পর্দা, শুধু নামেই, তার অস্তিত্ব আর কিছু নেই।

    বারান্দার ওপর, প্রতিটি মুহূর্ত পার হচ্ছে এবং আমার উদ্বেগও বাড়ছে। সাতচল্লিশটা হাতির দলটি এখন জড়ো হয়েছে সল্ট লিকের ওপর। এখন হচ্ছে ঠিক আক্রমণের সময় এবং যুবরাণীর দলটি ঠিক সময়মত এলে, এখন ওই পথটির ওপর থাকা উচিত–এমন সময়ে একটা বিরাট পুরুষ হাতি, দুটি কমবয়েসী পুরুষ হাতির একটি স্ত্রী হাতির দিকে বিশেষ মনোযোগে রুষ্ট হয়ে তাদের আক্রমণ করল এবং এই তিনটি জানোয়ার রাগে বৃংহিত ধ্বনি তুলে চিৎকার করতে করতে বাঁ দিকের জঙ্গলের মধ্যে ছুটে গেল আর বৃত্তাকারে ঘুরে আসতে লাগল ট্রী ট্রপস-এর পেছন দিকে–যে পথটি দিয়ে যুবরাণী ও তার সঙ্গীরা আসবেন সেই পথটির দিকে। দলের রক্ষীরা কি হাতির চিৎকার শুনে, এগনো বিপজ্জনক ভেবে যেখানে গাড়ি থেকে নামা হয়েছে সেই ফাঁকা কুঁড়েঘরটিতে ওঠার মইয়ের দিকে এগোবে? বারান্দাটা পার হয়ে আমি জঙ্গলের দিকে তাকালাম। মইটার নিচ থেকে পথটা প্রায় চল্লিশ গজ চলে গেছে সোজা লাইনে, তারপর বাঁদিকে বেঁকে চোখের আড়ালে চলে গেছে। প্রচুর ভয়াবহ আওয়াজ চারিদিক থেকে শোনা যাচ্ছিল কিন্তু পথটার ওপর কিছুই দেখা যাচ্ছিল না এবংএখন আমার আর করার কিছু নেই। অল্পক্ষণের মধ্যেই আমি দেখতে পেলাম একটি লোক উদ্যত রাইফেল নিয়ে আসছে আর ঠিক তার পেছনেই ছোট্টখাট্ট চেহারার একজন। দলটি পৌঁছে গিয়েছে এবং পথটির বাঁকের কাছে এসে,-যেখান থেকে সল্ট লিকে হাতির পালটিকে পরিষ্কার দেখা যায়–দাঁড়িয়ে গিয়েছে। আর সময় নষ্ট করা চলে না, তাই মই থেকে নেমে আমি ছোট্টখাট্ট মানুষটির দিকে এগিয়ে গেলাম যাঁকে আগের দেখা ছবি থেকে আমি যুবরাণী এলিজাবেথ বলে চিনতে পারলাম। এক ঝলক হাসির মধ্যে দিয়ে শুভেচ্ছা জানিয়ে, মুহূর্তমাত্র দ্বিধা না করে, যুবরাণী ধীর পায়ে এগিয়ে গেলেন সল্ট লিকের কুঁড়েঘরের দিকটিতে, মইয়ের নিচ থেকে দশ গজের মধ্যে জড়ো হওয়া হাতির পালটির দিকে। ক্যামেরা ও হাত ব্যাগ আমার কাছে দিয়ে যুবরাণী খাড়া মইটা বেয়ে উঠলেন, তার পেছনে পেছনে এলেন লেডী পামেলা মাউন্টব্যাটেন, ডিউক এবং কম্যান্ডার পার্কার। এডোয়ার্ড উইন্ডলির নেতৃত্বে রক্ষীদল তারপর ঘুরে পায়ে চলার পথটি দিয়ে ফিরে গেল।

    আমার সুদীর্ঘ জীবনকালে কিছু সাহসিকতার কাজ আমি দেখেছি কিন্তু সেদিন সেই ফেব্রুআরির পঞ্চম দিনে যা আমি দেখলাম তার সঙ্গে তুলনা করা চলে এমন কিছু বড় একটা দেখেছি বলে আমার মনে পড়ে না। যুবরাণী এবং তাঁর সঙ্গীরা, যাঁদের আফ্রিকার জঙ্গলে পায়ে হেঁটে চলার কোনো অভিজ্ঞতা নেই, সেই অপূর্ব দিনটিতে বেরিয়েছিলেন শান্তিমতে ট্রী টপস-এ যাবেন বলে, এবং তাদেরই পরবর্তী বক্তব্য অনুযায়ী তারা বেরোবার মুহূর্ত থেকেই ক্রুদ্ধ হাতির মাতামাতিতে তাদের কান ঝালাপালা হয়ে গিয়েছে। এক লাইনে, গভীর ঝোঁপঝাড়ের মধ্যে দিয়ে, যেখানে দৃষ্টি দু-এক গজের বেশি চলে, তারা সেইসব শব্দের দিকে এগিয়ে গিয়েছিলেন–তারা যত কাছে এগোচ্ছিলেন শব্দগুলো যেন তত বেশি ভয়াবহ হয়ে উঠেছিল। তারপর; পথের বাঁকটিতে এসে যখন হাতির পালটি তাদের দৃষ্টিগোচর হল তখন তাঁরা দেখলেন যে তাঁদের মইয়ের নিরাপত্তায় পৌঁছনোর জন্যে হাতির দলটির দশ গজের মধ্যে যেতে হবে। মই দিয়ে ওঠার এক মিনিটের মধ্যেই যুবরাণী বারান্দার ওপর বসে অকম্পিত হাতে হাতির ছবি তুলছিলেন।

    দিনের ঠিক ওই সময়টিতে ট্রী টপস-এর কাছে হাতি সচরাচর আসে না এবং যখন তাদের ছবি তোলা হচ্ছে, তারা ঠিক হাতির কাছ থেকে যেমনটি আশা করা যায় তেমনিই সব কাণ্ডকারখানা করছিল। বয়স্ক মদ্দা হাতিটা পালে ফিরে এল, তার। পেছনে বেশ সম্মানজনক দূরত্ব রেখে এল অল্পবয়সী মদ্দা হাতি দুটি-বয়স্ক হাতিটি বৃংহিত ধ্বনি এবং ক্রুদ্ধ চিৎকারে আবার সে দুটোকে তাড়িয়ে দিল। এক ঝাঁক বক ফাঁকা জমিটার ওপর এসে নামল–তাদের দেখেই একটা হাতি শুড়ে ধুলো ভরে নিয়ে, সতর্ক পায়ে এগিয়ে, ধুলোটা ছড়িয়ে দিল বকগুলোর ওপর–ঠিক যেন কেউ বন্দুক ভর্তি কালো বারুদ ছড়িয়ে দিল। বকগুলো কারুরি কোনো ক্ষতি করে নি এবং একমাত্র দুষ্টুমি বুদ্ধি থেকেই হাতিটা তাড়াল ওদের কারণ কাজটা করেই ওর শুড়টা ওঠা নামা করতে লাগল, যেন হাসির বেগেই, আর আনন্দে ওর কানটা পটপট করতে লাগল। ডিউক এই পার্শ্ব দৃশ্যটি খুব আনন্দের সঙ্গেই উপভোগ করছিলেন এবং আবার যখন বকগুলো ফিরে এল, সেই হাতিটিই, অবশ্য অন্য কোনো হাতিও হতে পারে, আবার যখন শুড়ে ধুলো ভরে পাখিগুলির দিকে এগোল, তিনি দৃশ্যটির দিকে যুবরাণীর দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন–এবং যুবরাণী পুরো ঘটনাটির ছবি তুলে নিলেন। একটি মাদী হাতি এখন এগিয়ে এল আমাদের দিকে, পাশে তার অসম্ভব খুদে এক বাচ্চা। বারান্দাটার সামনে দাঁড়িয়ে কয়েক গজের মধ্যে মা হাতিটি তার শুড়ের সোঁদা ডগাটি নুন মেশানো মাটির ওপর রেখে তুলে মুখে ভরে দিল। বাচ্চাটি তার মায়ের ব্যস্ততার সুযোগ নিয়ে মায়ের সামনের বাঁ পায়ের মধ্যে দিয়ে মাথাটা গলিয়ে দিয়ে বাঁট চুষতে লাগল। সন্তানের মায়ের ওপর টানের এই দৃশ্যে মুগ্ধ যুবরাণী সিনে ক্যামেরার ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখেই হঠাৎ বলে উঠলেন, ‘ও, দেখ! ওটা বাচ্চাটাকে তাড়িয়ে দেবে! এটা বলা হল যখন তিন বছর বয়সের একটা ছোট্ট হাতি মায়ের কাছে দৌড়ে এসে সামনের ডান পায়ের মধ্যে দিয়ে মাথা ঢুকিয়ে দুধ খেতে লাগল তখন। যতক্ষণ ওরা খেল, ওদের মা নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে রইল এবং বাচ্চাটা আর তার বোনের যথেষ্ট খাওয়া হলে, এমনও হতে পারে তার বাঁটে আর দুধ ছিল না, বলেই মা হাতিটি নিজেকে ছাড়িয়ে নিল এবং বাচ্চাকে সঙ্গে নিয়ে বারান্দার নিচ দিয়ে হ্রদের মধ্যে ঢুকে যাওয়া একফালি জমির দিকে গেল। এখানে ও শুড়ের মধ্যে জল শুষে নিয়ে, মাথা উঁচু করে গলার মধ্যে ঢেলে দিয়ে জল খেলে। তেষ্টা মেটার পর ও হ্রদের মধ্যে আরো কয়েক গজ এগিয়ে গেল, তারপর স্থির হয়ে দাঁড়াল। একা পড়ে যাওয়ায় বাচ্চাটা ভয়ে সরু গলায় চিৎকার করতে লাগল। মা হাতিটা এই সাহায্যের আবেদনে কোনো কর্ণপাতই করল না কারণ এটা একটা শিক্ষা যে মা যেখানে আগে আগে যাচ্ছে সেখানে তাকে অনুসরণ করা বাচ্চার পক্ষে নিরাপদ। অবশেষে যথেষ্ট সাহস সঞ্চয় করে বাচ্চাটা জলে নেমে পড়ল এবং সে কাছাকাছি এলে তার মা গভীর মমতায় কাছে টেনে তাকে শুড় দিয়ে ধরে আস্তে আস্তে সাঁতরে নিয়ে গেল হ্রদের ওপারে।

    হাতির পালকে লক্ষ করার সময় যেটা মনকে খুব স্পর্শ করে সেটা হচ্ছে বাচ্চাদের ওপর ওদের মমতা। বড়রা খাওয়ার সময়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে যখন একঘেয়ে, লাগে তখন বাচ্চাগুলো খেলতে খেলতে গিয়ে পড়ে বড়দের সামনে। যখন এটা ঘটে তখন বড়রা তাদের আঘাত না করে, না মাড়িয়ে আস্তে করে পাশে সরিয়ে দেয়। বন্য জগতের সব জীবজন্তুর ভেতর হাতিদের মধ্যেই সবচেয়ে বেশি পারিবারিক, দলবদ্ধ জীবনযাত্রা দেখা যায়। যখন আসন্ন মাতৃত্বের দরুন কোনো স্ত্রী হাতি অবসর নেয়, অন্য বয়স্কা স্ত্রী হাতিরা তাকে সঙ্গ দেয়, তার বাচ্চাদের রক্ষণাবেক্ষণ করে এবং নবজাত বাচ্চাটি যতদিন না হাঁটতে সক্ষম হয় ততদিন পুরো পালটা থাকে তার কাছাকাছি বাচ্চা অথবা বয়স্ক হাতি কোন অসুবিধেয় পড়লে বা বিপদের সম্মুখীন হলে, তা সে। সত্যিই হক আর কাল্পনিকই হক, অন্যরা এগিয়ে আসে তাকে যথাসম্ভব সাহায়্য করতে। সেইজন্যেই যে সমস্ত পালে বাচ্চা থাকে সেগুলোকে এড়িয়ে চলা হয় এবং এই একমাত্র কারণেই মইয়ের দিকে এগনো ছিল বিপজ্জনক কারণ হাওয়ার গতি বদলে গেলে বা কোনো ছোট বাচ্চা সঙ্গে ভীত সন্তস্ত্র মাদী হাতি দলটিকে দেখতে পেলে,-আক্রমণের একটা বিরাট আশঙ্কা থাকে। ভাগ্যক্রমে হাওয়ার গতি বদলায় নি এবং হাতিগুলির দিকে ধীরে সুস্থে ও নিঃশব্দে এগনোর দরুন যুবরাণী আর তাঁর সঙ্গীরা হাতিদের নজর এড়িয়ে গেছেন।

    কারা, একটা বড় পুরুষ বেবুন, সম্প্রতি একটা লড়াইয়ে ওপরের ঠোঁটের কিছুটা অংশ হারিয়ে যার চেহারা আরও বীভৎস হয়ে উঠেছে, এখন সে তার এগারো জনের পরিবার নিয়ে একটা জঙ্গলের রাস্তা দিয়ে এল সল্ট লিকের ধারে। এইখানে তারা থেমে গেল, কারণ হাতিরা বেবুনদের পছন্দ করে না এবং আমি একবার দেখেছি হাতিদের তাড়া খেয়ে বেবুনদের এইরকমই একটা পরিবার গাছে উঠে পড়েছে আর হাতিগুলো সেই গাছ ঝাঁকাচ্ছে ওদের ফেলে দেওয়ার জন্যে। এ যাত্রায় কারা কোনোরকম ঝুঁকি নিচ্ছিল না। পুরো দৃশ্যটা দেখে নিয়ে সে তার পরিবারদের নিয়ে জঙ্গলে ফিরে গেল তারপর সল্ট লিক ঘুরে বাঁ দিক দিয়ে এগলো বটগাছটার দিকে। একটি সাহসী কমবয়েসী স্ত্রী, বেবুন’এবার দল ছেড়ে বেরোল এবং কুঁড়েঘরটির একটা কাঠের খুঁটি বেয়ে উঠে এল বারান্দার ওপর। রেলিং-এর ওপর রাখা ক্যামেরা, দূরবীন ইত্যাদি বাঁচিয়ে, রেলিং বরাবর দৌড়ে সে কুঁড়েঘর থেকে বেরিয়ে থাকা একটা ফিকাস গাছের ডাল ধরে ফেলল। এখানে অর পুরস্কার মিলল একটা প্রায় তার মাথার সাইজের মিষ্টি আলু–ও যখন পরমানন্দে দাঁত দিয়ে আলুটা ছাড়াচ্ছে তখন কয়েক ফুট দূরত্ব থেকে তার ফিল্ম এবং ছবি উঠে গেল।

    সকলের অজ্ঞাতে সময় বয়ে চলল এবং যুবরাণীকে যখন বলা হলো খাবার ঘরে চা প্রস্তুত তখন তিনি বললেন, আমি কি চা এখানে খেতে পারি? এসব আমি এক মুহূর্তের জন্যেও হারাতে চাই না। যখন খাওয়া হচ্ছিল, হাতিগুলো সল্ট লিক থেকে সরে এল, কেউ কেউ গেল বাঁ দিকের জঙ্গলে এবং অন্যরা বারান্দার নিচ দিয়ে ডানদিকে হ্রদের পাড়ের দিকে রওনা দিল। যখন যুবরাণী মায়ের কাপ সরিয়ে রেখে একগোছা ছবি দেখছিলেন তখন আমি দেখলাম এক জোড়া জল হরিণ একটা জঙ্গুলে পথ দিয়ে পূর্ণ বেগে সলট লিকের দিকে দৌড়চ্ছে। ওই দুটি জানোয়ারের দিকে আমি যুবরাণীর দৃষ্টি আকর্ষণ করায় তিনি ক্যামেরার দিকে হাত বাড়ালেন আর ছবিগুলি তাঁর কোল থেকে মেঝেয় পড়ে গেল। ঘটনাটার উপযোগী দু’একটা ভদ্রতাসূচক কথা বলে যুবরাণী ক্যামেরাটা চোখের সামনে তুলে ধরলেন আর সেই সঙ্গেই হরিণ দুটো, যাদের মধ্যে তফাৎ ছিল এক কদমের, জল তোলপাড় করে ঝাঁপ দিল হ্রদে। সামনেরটা যখন গজ চল্লিশেক গিয়েছে তখন সেটা হোঁচট খেল একটা ডোবা গাছের গুড়ির সঙ্গে এবং মুহূর্তমার দ্বিধা না করে পেছনেরটা শিঙ ঢুকিয়ে দিল তার গায়ে। হতভাগ্য জীবটির পাছায় ঢুকল একটা শিঙ এবং তার দু পায়ের মধ্যে দিয়ে পেটে ঢুকল অপরটা। শিঙগুলো ঢুকে এমনভাবে আটকে ছিল যে কিছুদূর হেঁচড়ে যাওয়ার পরেই তবে সে শিঙগুলো ছাড়াতে পারল। আহত জানোয়ারটি জলে লাফিয়েই চলল যতক্ষণ না সে পৌঁছল একটা বড় ঘাষ বনের আশ্রয়ে। এখানে গলা জ্বলে সে নামল এবং তার আক্রমণকারী বদ্ধ জলে বৃত্তাকারে কয়েকবার ঘুরে ক্রুদ্ধ ভাবে ঘাড় নেড়ে জঙ্গলের দিকে চলে গেল। পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে ঘটনাটা, জঙ্গলে আরম্ভ হওয়া এক লড়াইয়ের শেষ দৃশ্য আর পুরো ব্যাপারটা ইতিমধ্যে যুবরাণীর ক্যামেরায় ধরা পড়েছিল–এবার তিনি ক্যামেরা সরিয়ে রেখে দূরবীন জোড়া তুলে নিলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই দুরবীনজোড়া আমার হাতে দিয়ে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, ওটা কি রক্ত? আপনার কি মনে হয় ও মরে যাবে? হ্যাঁ ওটী রক্তই। চারদিকের জল রক্তে রাঙা হয়ে গেছে এবং আহত জানোয়ারটি যেভাবে কষ্ট করে নিঃশ্বাস নিচ্ছে তা দেখে আমি বললাম আমার মনে হয় ও মারা যাবে।

    কারা এবং তাঁর পরিবারের সঙ্গে ইতিমধ্যে সলট লিকে যোগ দিয়েছিল পাঁচটি বনশুয়োর এবং একটি সুদৃশ্য কমবয়সী স্ত্রী ঝোপ-হরিণ এবং তারা দৃশ্যটিতে কিছুটা বৈচিত্র আনছিল। দুটি তরুণীর মধ্যে প্রতিযোগিতা চলছে একটি পুরুষ বন্ধুর ভালবাসার জন্যে, তারা দুজনেই ছেলেটির দাবীদার এবং এর ফলে রাগারাগি আর প্রচুর চিৎকার। কারা এই সময় আরাম করে রোদ্দুরে শুয়েছিল– একদিকে ওর ছবি উঠছিল এবং অন্যদিকে ওঁর স্ত্রী, স্ত্রীসুলভ কর্তব্যবোধে ওর ঘন লোমের মধ্যে আঙুল চালিয়ে চামড়ার চুলকুনি ধরানো জিনিসগুলি খুঁজে বার করার চেষ্টা করছিল—তা না হলে কারা তিনজন কমবয়েসীকে পিটিয়ে ঝগড়াঝাটি বন্ধ করে দিত। এটিকে যখন এইসমস্ত চলছে, বনশুয়োর পাঁচটি হাঁটু গেড়ে সলট লিকের পাড়ের ছোট ছোট ঘাস মুড়িয়ে সমান করে দিতে ব্যস্ত এবং কারার সবচেয়ে ছোট বাচ্চাটি পরম অধ্যবসায়ে তরুণী হরিণটির পেছনের পা বেয়ে ওঠার চেষ্টা করছিল– ওর ল্যাজটী ধরার জন্যে যতবারই ও চেষ্টা করছে হরিণী পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে—খেলাটা ও নিজেও উপভোগ করছে দর্শকদের মতই।

    যুবরাণী বা ডিউক কেউই ধূমপান করেন না কিন্তু যেহেতু আমি নিজে এই জঘন্য অভ্যাসটিতে আসক্ত সেইজন্যে আমি যুবরাণীর পাশে আমার জায়গাটি ছেড়ে বারান্দার প্রান্তে চলে গেলাম, যেখানে ডিউক যোগ দিলেন আমার সঙ্গে। আমাদের কথাবার্তা চলা কালে আমি তাকে বললাম যে আমি এরিক শিপটনকে চিনি আর দি টাইমস পত্রিকায় আমি ভয়ঙ্কর তুষারমানব সম্বন্ধীয় প্রবন্ধগুলি পড়েছি এবং শিপটনের তোলা বরফে পায়ের ছাপের ছবিগুলিও দেখেছি। যখন আমাকে জিজ্ঞাসা করা হল ভয়ঙ্কর তুষারমানব সম্বন্ধে আমার নিজস্ব কোন মতামত আছে কি না তখন আমার উত্তর শুনে ডিউক বেশ মজা পেলেন যে আমি বিশ্বাস করি না বরফে যে পায়ের দাগের ছবিগুলি শিপটন তুলেছেন সেগুলি কোন চার পেয়ে জীবের এবং যদিও আমি স্বপ্নেও ভাবিনা শিপটন কোন রসিকতার চেষ্টা করছেন, আমার মনে হয় এর ফলে তিনি নিজেই পরিহাসের পাত্র হয়ে উঠেছেন। আমি আরও বললাম যে  তুষারমানব সম্বন্ধে চারদিকে যে বিপুল উৎসাহ তার পরিপ্রেক্ষিতে দাগগুলি অনুসরণ করে শিপটনের পেছন দিকের উৎসে এবং সামনের দিকের গন্তব্য সন্ধানে না যাওয়াটা হতাশাজনক। ডিউক বললেন তিনি এই একই প্রশ্ন শিপটনকে করেছিলেন, এবং শিপটন তার উত্তরে তাকে বলেছিলেন দাগগুলি এসেছে বায়ুধৌত পাথরগুলির দিক থেকে যার ওপর কোনো বরফ নেই এবং দাগগুলি চলেও গেছে তুষারহীন পাথরের ওপর দিয়ে। সেইজনেই দাগ অনুসরণ করা সম্ভব ছিল না।

    সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ছায়াও দীর্ঘতর হতে থাকল। আরও জানয়ার সত্যি কথা বলতে কি ট্রী টপস-এর ওপর থেকে এত বেশি জানোয়ার আগে আর কখনও দেখা যায়নি, জঙ্গল থেকে বেরিয়ে ফাঁকা জমিটার ওপর আসতে লাগল। সূর্যের তির্যক রশ্মিতে এই জানোয়ারগুলি এবং নিঃশব্দ সমারোহে ফুটে থাকা কেপনাট ফুলগুলির হ্রদের নিথর জলে প্রতিফলন এমন একটা শান্তি সৌন্দর্যের ছবি ফুটিয়ে তুলেছিল যা কোন ধ্যানমগ্ন শিল্পীর তুলিতেই ধরা পড়ত, আমার ভাষায় তা প্রকাশ করা কোনমতেই সম্ভব না।

    যুবরাণীর  সঙ্গে যোগ দিলে তিনি আবার আমার হাতে দুরবীন জোড়া দিয়ে বললেন–আমার মনে হয় বেচারা মারা গেছে। চোট খাওয়া জলহরিণটাকে সত্যিই মৃত দেখাচ্ছিল কিন্তু অল্পক্ষণের মধ্যেই যে ঘাসের চামড়াটার ওপর ও বিশ্রাম করছিল তার থেকে মাথাটা ও তুলল এবং হাঁকুপাঁকু করে কোনোরকমে পাড়ে গিয়ে গলাটা লম্বা করে, থুতনিটা মাটিতে দিয়ে বিশ্রাম করতে লাগল। ও এই ভঙ্গিতে নিশ্চল অবস্থায় মাটিতে বেশ কয়েক মিনিট শুয়ে থাকার পর তিনটি হাতি ওর কাছে এল এবং শুড় লম্বা করে তাকে ল্যাজ থেকে মাথা পর্যন্ত শুকল। শুকে যা দেখল তা ওদের বিশেষ পছন্দ না তাই মাথা নেড়ে তাদের অপছন্দ জানিয়ে তারা ধীর পায়ে চলে গেল। হাতিদের উপস্থিতিতে হরিণটার যে কোনো প্রতিক্রিয়া হয় নি, তার থেকেই আমরা ধরে নিলাম যে হরিণটা মারা গিয়েছে সেইজন্যে আমি আর কমান্ডার পার্কার গেলাম ওটাকে দেখার জন্যে। আমরা যখন কুঁড়েঘরের মধ্যে দিয়ে গিয়ে মই নিয়ে নামছি তখনই মৃত জানোয়াটাকে টেনে নিয়ে চাওয়া হয়েছে– সম্ভবত ট্রী টপস-এ যাওয়ার সময়ে পথে যে দুটো চিতার থাবার ছাপ দেখেছিলাম তারাই ওকে টেনে নিয়ে গেছে–কারণ জায়গাটায় পোঁছে আমরা শুধুমাত্র দেখলাম সেটা রক্তে ভেসে যাচ্ছে। রক্তস্রোতের কাছেই একটা বড় ঝোপ ছিল যার পিছনে আংশিকভাবে খাওয়া জলাহরিণটার দেহাবশেষ পরদিন দেখা গিয়েছিল।

    সারা বিকেল এবং সন্ধে ধরে, যুবরাণী যে ঘটনাগুলি দেখেছেন, এবং যে সমস্ত জানোয়ারের ছবি তুলেছেন সেগুলো সম্বন্ধে বিস্তারিত নোট নিলেন। আমি জানতাম তিনি যখন অস্ট্রেলিয়া সফরে যাবেন তখন বাড়ির যারা তার তোলা ফিল্ম দেখবেন, নোটগুলি তাদেরই জন্যে ধারাবিবরণী হিসেবে ব্যবহার করা হবে—তার সে সফরে যাওয়া অবশ্য ঘটে ওঠেনি।

    অপূর্ব সূর্যাস্তের শেষ আভা আকাশ থেকে মিলিয়ে যেতে আর হাল্কা জোৎস্নায় চারদিকে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠাতে ক্যামেরাগুলো সরিয়ে ফেলা হল। এবং আমরা আলোচনার বিষয় ও পারিপার্শ্বিকের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে চাপা গলার কথাবার্তা বলতে লাগলাম। আমি যুবরাণীকে বললাম তার পিতার অসুখের কথা শুনে কি গভীর দুঃখ আমি পেয়েছিলাম এবং তিনি যে আবার তাঁর প্রিয় শিকার, পাখি মারা আরম্ভ করার মত সুস্থ হয়ে উঠেছেন তাতে কত আনন্দিত হয়েছি আমি। আমি তাকে আরও বললাম বি.বি.সি-র সংবাদে, তিনি লন্ডন বিমানবন্দর ছাড়ার সময় তাঁর পিতা টুপি ছাড়া তীব্র ঠান্ডা বাতাসে দাঁড়িয়ে তাঁকে বিদায় জ্ঞাপন করেছেন শুনে আমার কিরকম খারাপ লেগেছিল। আমি আশা প্রকাশ করায় যে তার নিশ্চয়ই ঠান্ডা লাগে নি, যুবরাণী আমায় বললেন তার পিতা ওইরকমই; তিনি কখনও নিজের ভালমন্দ চিন্তা করেন না। যুবরাণী তারপর আমায় বললেন, তার পিতার দীর্ঘ অসুস্থতার কথা তাদের দুশ্চিন্তা, ভয়, আশা এবং সর্বোপরি আনন্দের কথা যখন একদিন হাঁটার ছড়িটি কাঁধে ফেলে তিনি বলেছিলেন–আমার মনে হয় আমি এখন গুলি চালাতে পারি। তার অসুখ ভালর দিকে মোড় নিয়েছে এবং বাঁচার জন্যে তার মধ্যে একটা নতুন তাগিদ এসেছে ভেবে সবাই এটাকে স্বাগত জানিয়েছিল। আমি কখনও মাঠে মোরগ মেরেছি কি না যুবরাণীর এ জিজ্ঞাসায় আমি জবাব দিলাম, চেষ্টা করেছি তবে সফল বিশেষ হই নি; তখন তিনি আমায় বললেন, আমি তো বুঝব মাঠ মোরগ মারা কত কঠিন, এবং এ থেকেই কিছুটা ধারণা করতে পারব রাজার হাতের নিশানা কত নির্ভুল, যে, প্রথম দিন বেরিয়েই তিনি মাত্র একটি বাট’ বা ওই পাখি মারার নির্দিষ্ট জায়গা থেকে তেতাল্লিশটা পাখি মেরেছিলেন। আমি তাকে জানালাম যে একটা গোটা সপ্তাহ ধরে অনেকগুলি ‘বাটু’-এর সাহায্যেও এতগুলি পাখি আমি মারতে পারি নি। যুবরাণী সায় দিয়ে বললেন, হ্যাঁ, সত্যিই তার পিতার হাতের নিশানা খুব ভাল। তারপর তিনি আমায় জানালেন সেই ফেব্রুআরির পঞ্চম দিনটিতে তার পিতা কোথায় শিকারে ব্যস্ত থাকবেন এবং তার পরদিন কোথায় শিকারের ইচ্ছে তার আছে।

    এ ধরনের কথা বলা হয়েছে শুনেছি এবং লেখা আমি নিজেই দেখেছি যে যুবরাণী তার অস্ট্রেলিয়া সফরকালে যখন মহামান্য রাজাকে লন্ডন বিমান বন্দরে বিদায় জানান তখনই তিনি জানতেন যে তিনি আর তার পিতাকে ইহজগতে দেখতে পাবেন না। একথা আমি বিশ্বাস করি না। তরুণী যুবরাণী সে রাতে তার পিতা সম্বন্ধে যে ভালবাসা ও গর্ব নিয়ে কথা বলেছিলেন এবং ফিরে যাওয়ার পর পিতাকে সম্পূর্ণ সুস্থ দেখার যে গভীর আশা প্রকাশ করেছিলেন তার থেকে আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে ফিরে যাওয়ার পর পিতাকে আর দেখতে পাবে না একথা তিনি স্বপ্নেও ভাবেন নি।

    এখন ডিনার পরিবেশন করা হয়ে গেল এবং আমরা বারান্দা ছেড়ে, লাইন করে ঢুকলাম খাওয়ার ঘরে। উপস্থিত সাতজনের জন্যে জায়গা করা হয়েছিল আর আমি যখন ঘরের অন্য প্রান্তে এগোচ্ছি তখন যুবরাণী বলে উঠলেন ‘আপনি আমাদের দুজনের মধ্যে বসুন না। উনি একথা বলা মাত্রই ডিউক তাঁর জন্যে প্রস্তুত গদীমোড়া আসনটি আমায় দেখিয়ে তার পরের গদীমোড়া আসনটিতে বসলেন। পালিশহীন খাওয়ার টেবিলটির দু পাশে ছিল বেঞ্চি–সেগুলো এত শক্ত কাঠে তৈরি যে ডিউক কোনোদিন অত শক্ত বেঞ্চিতে বসেছেন কিনা সন্দেহ। আমরা সেদিন ছিলাম এরিক এবং লেডী বেটি ওয়াকার-এর নিমন্ত্রিত অতিথি এবং সেদিন যে প্রচুর সুখাদ্য পরিবেশিত হয়েছিল প্রত্যেকেই তার তারিফ করেছিলেন কারণ দিনভর উত্তেজনা এবং জঙ্গলের তাজা পরিষ্কার বাতাসে আমাদের প্রত্যেকেরই খুব খিদে পেয়েছিল।

    যখন কফি তৈরি হচ্ছে তখন স্পিরিট ল্যাম্পটিতে হঠাৎ আগুন লেগে যায় ও সেটাকে টেবিলে থেকে ঝটক্স মেরে ফেলে দেওয়া হয় ঘাসের মাদুর ঢাকা মেঝের ওপর। সবাই যখন পাগলের মত আগুন নেভাবার চেষ্টা করছে তখন আফ্রিকান ছেলেটি, যে ডিনার পরিবেশন করেছিল, ধীরে সুস্থে এগিয়ে এল, একটা ভিজে কাপড় দিয়ে আগুনটা নেভাল, তারপর স্টোভের পেছনে তার খুপরিতে চলে গেল এবং মিনিট খানেকের মধ্যেই সে ল্যাম্পে আবার তেল ভরে, জ্বালিয়ে টেবিলের ওপর রেখে গেল। অদূর ভবিষ্যতেই ট্রী টপস-এ হানা দেওয়া হয় এবং সেই চালাক চটপটে ছেলেটিকে, ঘরটির বিছানা, খাবার, রান্নার বাসনপত্র এবং অন্যান্য অস্থাবর সরঞ্জামের সঙ্গে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় এবং ছেলেটির হাড় আফ্রিকার সূর্যে আরও সাদা হয়ে উঠছে না সেও যোগ দিয়েছে সন্ত্রাসবাদীদের দলে, এ শুধু কল্পনার বিষয়।

    ডিনারের পর যুবরাণী ও তার দলবল বারান্দায় ফিরে গেলেন। চাঁদের ক্ষীণ আলোয় সল্ট লিকের ওপর দেখা গেল নয়টি গুণ্ডার। সেই বকটি, ব্যবচিক পরিবারটি, হাতির পাল ও অন্যান্য জানোয়ার সব চলে গিয়েছিল আর যে ব্যাঙগুলো আগে এত সরব ছিল তারাও এখন চুপচাপ।

    যুবরাণীর দলবলকে বারান্দায় রেখে, যেখানে তাঁরা চাঁদ ডুবে যাওয়া পর্যন্ত ছিলেন, আমি আমার বৃটিশ কুম্বলটি, যেটি যুদ্ধের সময় আমার প্রচুর কাজে এসেছিল, সেটি নিয়ে তিরিশ ফুট মইটির ওপরের ধাপে আরাম করে বসলাম। অনেক সুদীর্ঘ রাত আমায় গাছের ডালে বসে কাটাতে হয়েছে, ফলে কয়েক ঘন্টা একটা মইয়ের ওপর বসে থাকাটা আমার কাছে কোনো কষ্টই নয়; সত্যি কথা বলতে কি আজকের রাতটিতে, এটা, আমার কাছে আনন্দের ব্যাপার। এই কথা অনুভব করে আনন্দ যে একটি রাতের জন্যে এমন এক মূল্যবান জীবন রক্ষার সম্মান আমি পেয়েছি যিনি বিধিদত্ত সময়ে ইংল্যান্ডের রাজসিংহাসনে বসবেন। সেই আজকের এই পরম দিনটির পরে আমার নিজের চিন্তায় মগ্ন হয়ে থাকবার জন্যে একলা থাকারও দরকার ছিল।

    চাঁদ ডুবে গেল–জঙ্গুলের গভীরে এখন সূচীভেদ্য অন্ধকার। অন্ধকারের দৃষ্টি প্রতিহত হয়ে ফিরে আসে, কিছু দেখা যায় না কিন্তু তাতে কিছু এসে যায় না কারণ মই বেয়ে এক সাপ ছাড়া অন্য কিছু উঠলে তার কম্পন আমি অনুভব করব। আমার মুখের কয়েক ইঞ্চির মধ্যে এবং ফিকাস গাছটার পাতার ফাঁক দিয়ে আকাশের পটভূমিতে দেখা যায় একটা ঝুলন্ত ম্যানিলা দড়ি, যেটা গিয়েছে একটা কপিকলের মধ্যে দিয়ে এবং সেটা ব্যবহার করা হয় মাটি থেকে মালপত্র, খাবার ইত্যাদি ওপরের ঘরের টেনে তুলতে। হঠাৎ দড়িটা নড়ে উঠল–কোনো শব্দ কিন্তু আমার কানে আসে নি। নরম থাবার ওপর চলছে এরকম কিছু একটা, দড়িতে একটা হাতে দিয়েছে বা দড়িটা ঘেঁষে চলে গেছে। উদ্বেগভরা কয়েকটা মুহূর্ত কেটে গেল কিন্তু মইটা আর কেঁপে উঠল না তারপর দড়িটা দ্বিতীয়বার আবার নড়ে উঠল। সম্ভবত আমি পথের ওপর যে চিতাগুলোর থাবার ছাপ দেখেছিলাম তাদেরই মধ্যে একটা মইয়ের কাছে এসেছিল কিন্তু মইয়ের ওপর একজন কেউ আছে দেখে চলে গেছে। মইটা, যতই খাড়া হক, চিতার মতন ওঠার ক্ষমতা যার, সেরকম কোনো জানোয়ারের কাছে এটা কোনো বাধাই হত না এবং আমি যতই অন্যরকম জানি না কেন, আমার ওপরের পাটাতনটা হয়তো চিতারা পর্যবেক্ষণের খুটি হিসেবে বা রাতে শোয়ার জায়গা হিসেবে ব্যবহার করত। ভারতীয় জঙ্গলের সঙ্গে তুলনায় আফ্রিকার জঙ্গল রাতে হতাশাজনকভাবে নিস্তব্ধ, সে রাতে, সারারাতের মধ্যে মাঝে মাঝে গণ্ডারদের ঝগড়া বাদ দিলে আমি শুনেছিলাম একটি হায়েনার করুণ ডাক, একটা ঝোপহরিণের ডাক ঐবং একটি গাছ—হাইরাক্স এর চিৎকার।

    ভোরের প্রথম আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে আমি মুখ হাত ধুয়ে দাড়ি কামিয়ে নিলাম এবং কুঁড়েঘরটিতে উঠে দেখলাম যুবরাণী একটা মিটার হাতে নিয়ে বারান্দায় বসে সল্ট লিকের ওপর একটা বুড়ো গণ্ডারের ছবি তোলার আগে আলো পরখ করে দেখছেন। আফ্রিকায় দিনের আলো আসে খুব তাড়াতাড়ি এবং প্রথম সূর্যের রশ্মি চারিদিক আলোকিত করে তুললেই, যুবরণী যার জন্যে অপেক্ষা করছিলেন, সেই ছবি তুলতে লাগলেন। তিনি যখন গণ্ডারটার ছবি তুলতে ব্যস্ত তখন ডিউক সন্ট লিকের দিকে এগিয়ে আসা অন্য একটা গণ্ডারের দিকে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন। স্পষ্টতই দুটি গণ্ডার পুরনো শত্রু কারণ তারা দুজনে দুজনের দিকে লড়াইয়ের ভঙ্গীতে ছুটে এল– কিছুক্ষণের জন্যে মনে হয়েছিল রাজকুলের দর্শকদের জন্যে একটা বিরাট লড়াই অনুষ্ঠিত হবে। অভিজ্ঞ বক্সারের মত এগিয়ে পিছিয়ে, ঠিকমত জায়গা নেওয়ার চেষ্টা করে গণ্ডার দুটি কিছুক্ষণ দুজনে দুজনকে পাশ কাটিয়ে চলল, তারপর নবাগত গণ্ডারটি ঠিক করল বিবেচনার দাম সাহসের থেকে বেশি এবং রাগ প্রকাশের জন্যে একবার ঘোত করে, দৌড়ে জঙ্গলের দিকে ফিরে গেল– যুবরাণীও এতক্ষণে সুযোগ পেলেন লেডী বেটি পরিবেশিত গরম চা পান করার।

    যদিও সামান্য কয়েক ঘণ্টা ঘুমিয়ে ছিলেন তবুও যুবরাণী দ্বিতীয় দিনটি আরম্ভ করলেন উজ্জ্বল চোখে, ফুলের মত সতেজ মুখ নিয়ে। তাঁর গালের রক্তিমাভা বাড়ানোর জন্যে কোনো কৃত্রিম সাহায্যের দরকারও হয় নি, তিনি ব্যবহারও করেন নি। বহু বছর আগে এক শীতের দিনে আমি গঙ্গার তীরে দাঁড়িয়েছিলাম যুধরাণীর পিতামহের সঙ্গে এবং তাকে দেখে আমার বুঝতে দেরি হল না এই অপূর্ব লাবণ্য তিনি কার কাছ থেকে পেয়েছেন।

    গণ্ডারগুলো এখন চলে গেছে, শুধু সাদা বকটা হ্রদের পাড়ে নিশ্চল দাঁড়িয়ে আছে এবং ড্যাবচিক পরিবারটি নিথর জলের ওপর দাগ কেটে ঘুরে বেড়াচ্ছে– আর বিশেষ কিছুই করার নেই তাই ক্যামেরা দূরবীন সরিয়ে রেখে আমার প্রাতরাশ সারার জন্যে খাবার ঘরে গেলাম– প্রাতরাশে ছিল স্ক্র্যাম্বেলড ডিম, আর বেকন, টোস্ট, মারমালেড, কফি যেটা বানাতে এযাত্রায় কোনো দুর্ঘটনা ঘটে নি এবং আফ্রিকার সেরা রসাল ফল। এখন গলা নিচু করে কথা বলার কোনো প্রয়োজন ছিল না এবং আমাদের প্রাতরাশ সারা হয়ে গেলে আমি বললাম যে যুবরাণীই তাদের পরিবারে একমাত্র, যিনি একটা গাছের ওপর ঘুমিয়েছেন আর গাছের ওপর তৈরি ডিনার এবং প্রাতরাশ খেয়েছেন।

    যে রক্ষীদল যুবরাণীর দলবলকে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে অপেক্ষমান গাড়িগুলোতে নিয়ে যাবে, এডোয়ার্ড উইন্ডলির নেতৃত্বে তারা এসে পৌঁছল এবং খুশিতে উজ্জ্বল যুবরাণী চলে যাওয়ার সময় হাত নেড়ে চিৎকার করে বলল, “আমি আবার আসব”। রয়েল লজে ফিরে যাবার কিছুক্ষণের মধ্যে যুবরাণীকে জানানো হল যে তার পিতা, যাঁর সম্বন্ধে এত ভালবাসা বুকে নিয়ে তিনি কথা বলেছিলেন, গতরাত্রে, ঘুমের মধ্যেই মারা গিয়েছেন।

    আমার মনে হয় যুবরাণী এলিজাবেথ এবং ডিউক ফিলিপ ট্রী টপস-এ ৫ই ফেব্রুইয়ারী বেলা ২টা থেকে ৬ই ফেব্রুয়ারী বেলা ১০টা পর্যন্ত যেমন আনন্দে ও নিশ্চিন্তে সময় কাটিয়েছিলেন অন্য কোন যুবক যুবতীর ভাগ্যে তা ঘটে নি। নিজের কথা বলতে পারি যে, যে কয় ঘণ্টা তাদের সান্নিধ্যে থাকার সম্মান ও সুযোগ আমার হয়েছে তা যতদিন আমার স্মৃতিশক্তি থাকবে ততদিন আমার সঙ্গেই থাকবে।

    ট্রী টপস-এর অতিথিদের জন্যে একটি রেজিস্টার রাখা আছে–কি কি জানোয়ার দেখা গিয়েছে তাও তার মধ্যে লিপিবদ্ধ করা হয়। যুবরাণী-ট্রী টপস-এ আসার পরের দিন রেজিস্টারটি আমার কাছে আনা হয় কিছু লেখার জন্যে। যুবরাণীর দলবলের প্রত্যেকের নাম, কি কি জানোয়ার দেখা গিয়েছে এবং জানোয়ারগুলি সংক্রান্ত প্রতিটি ঘটনা লিপিবদ্ধ করার পর আমি লিখেছিলাম:

    পৃথিবীর ইতিহাসে এই প্রথম একটি তরুণী যুবরাণী থাকাকালীন একটি গাছে উঠলেন এবং তার বর্ণনা অনুযায়ী তার জীবনে সবচেয়ে আনন্দময় অভিজ্ঞতা অর্জনের পর, পরের দিন তিনি গাছ থেকে নেমে এলেন রাণী হয়ে—ভগবান তার মঙ্গল করুন।

    যে ফিকাস গাছ ও কুঁড়েঘরটি যুবরাণী এলিজাবেথ এবং ডিউক অফ এডিনবরার পদার্পণে সম্মানিত হয়েছিল তার সিকি শতাব্দী ধরে যেখানে পৃথিবীর প্রতি প্রান্ত থেকে অজস্র অতিথি সমাগত হত, আজ তার অবশিষ্ট আছে শুধুমাত্র ছাইগাদার ওপরে একটা মরা, কালো গাছের গুঁড়ি। এই ছাইয়ের ওপরেই কোনোদিন গড়ে উঠবে নতুন আর এক ট্রী টপস– সেখানে আর এক বারান্দা থেকে নতুন মুখেরা দেখবে অন্যসব পাখি, জানোয়ার। কিন্তু আমরা যারা সেই প্রাচীন গাছটি এবং বন্ধুত্বের উষ্ণতা মাখা কুঁড়েঘরটি জানতাম তাদের কাছে ট্রী টপস চিরদিনের মত হারিয়ে গেছে।

    নিয়েরি
    ৬ই এপ্রিল, ১৯৫৫

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleরামায়ণের উৎস কৃষি – জিতেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়
    Next Article জীবনযাপন – জীবনানন্দ দাশ
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }