Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর জীবনী – তপন বাগচী

    August 20, 2025

    রাজমালা বা ত্রিপুরার ইতিহাস – শ্রী কৈলাসচন্দ্ৰ সিংহ প্রণীত

    August 20, 2025

    আলো হাতে সেই মেয়েটি – তপন বন্দ্যোপাধ্যায়

    August 20, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    জিম করবেট অমনিবাস (অখণ্ড) – মহাশ্বেতা দেবী সম্পাদিত

    জিম করবেট এক পাতা গল্প1380 Mins Read0

    ০২. কুঁয়ার সিং

    ২. কুঁয়ার সিং

    কুঁয়ার সিং জাতে ছিল ঠাকুর, আর চাঁদনিচক গ্রামের সে- ছিল মোড়ল। মোড়ল হিসেবে সে ভাল ছিল না মন্দ ছিল, তা আমি জানি না। যেজন্যে তাকে আমি ভালবাসতুম তা হচ্ছে এই যে, কালাধুঙ্গিতে তার মত ওস্তাদ চোরাশিকারী আর ছিল না, এবং আমার ছেলেবেলার আদর্শ বীরপুরুষ যিনি, আমার সেই বড়দাদা টমের সে ছিল গোঁড়া ভক্ত।

    টমের বিষয়ে বলবার মত অনেক গল্প কুঁয়ার সিং জানত, কেননা সে তার সঙ্গে অনেক শিকার-অভিযানে গিয়েছিল। একটা গল্প আমি সবচেয়ে পছন্দ করতুম, বারবার বলা হলেও তার মজা কিছু কমত না। সেটা হচ্ছে, আমার দাদা টম আর এলিস নামে এক ভদ্রলোকের মধ্যে একটা আচমকা প্রতিযোগিতা সম্বন্ধে। এর আগের বছরে টম তাকে এক পয়েন্টে হারিয়ে দিয়ে ভারতের শ্রেষ্ঠ রাইফেল-কুশলী হিসেবে বি. পি. আর. এ. স্বর্ণপদক পেয়েছিল।

    টম আর এলিস কেউ কারু কথা না জেনে গারুপ্পর কাছে একই বনে শিকার করছিল। একদিন ভোরবেলা যখন সবে গাছের মাথার উপরে কুয়াশা উঠে এসেছে, তখন তাদের দেখা হয়ে গেল একটা উঁচু জায়গায় যাবার মুখে।

    সেই উঁচু জায়গাটা থেকে একটা বিস্তীর্ণ নাবাল জমি দেখা যায়, ভোরে এই সময়টায় সেখানে হরিণ আর শুয়োর চোখে পড়বেই। টমের সঙ্গে ছিল কুঁয়ার সিং, আর এলিসের সঙ্গী ছিল বুদ্ধ বলে নৈনিতালের একজন শিকারী। জাতে ছোট আর বনজঙ্গলের সব ব্যাপারে অজ্ঞ বলে কুঁয়ার সিং তাকে হেয় জ্ঞান করত। যথাযোগ্য সম্ভাষণ ইত্যাদির পর এলিস বলল যে টম তাকে চাঁদমারির মাঠে তুচ্ছ একটা পয়েন্টে হারিয়েছিল বটে, কিন্তু সে আজ টমকে দেখিয়ে দেবে, যে সে, শিকারের ব্যাপারে তার চাইতে ভাল। সে-ই প্রস্তাব করল যে এই কথাটা যাচাই করবার জন্যে দু-জনেই দু-বার করে গুলি চালাবে।

    টসে জিতে এলিস ঠিক করল যে সে-ই আগে বন্দুক চালাবে। তখন খুব সাবধানে সেই নাবাল জায়গাটার দিকে যাওয়া হল। এলিসের সঙ্গে ছিল ৪৫০ মার্টিনি-হেনরী : রাইফেলটা, যেটা সে বি.পি.আর.এ. প্রতিযোগিতায় ব্যবহার করেছিল। আর টমের হাতে ছিল ওয়েস্টলি রিচার্ডসের তৈরি একটি .৪০০ দোনলা এক্সপ্রেস রাইফেল, যার জন্যে সে গর্ব বোধ করত। সে গর্ব অবশ্য অসংগত নয়, কেননা তখন পর্যন্ত এই অস্ত্রটি ভারতে খুব কমই এসেছিল।

    হয়ত হাওয়াটা বেঠিক ছিল, কিংবা এগানোটা তেমন সাবধানে হয় নি। যাই হক উঁচু জায়গাটার মাথায় পৌঁছে দুই প্রতিদ্বন্দ্বী কোনো জীব-জন্তু দেখতে পেল না নাবাল জায়গাটাতে। সেটার কাছের দিকটাতে একফালি শুকনো ঘাস-ছিল, তার ওধারকার ঘাস পুড়ে গিয়েছিল। এই পোড়া জায়গাটায় ঘাসের অঙ্কুর বেরিয়ে এখন সবুজ-সবুজ দেখাচ্ছিল। এখানেই সকাল-সন্ধ্যায় জীবজন্তুদের দেখা পাওয়া যেত। কুঁয়ার সিংহের ধারণা যে ঐ শুকনো ঘাসজমির মধ্যে কোনো জীব-জন্তু লুকিয়ে থাকতে পারে। তার কথায় বুন্ধু অর সে তাতে আগুন ধরিয়ে দিল।

    ঘাস তখন বেশ জ্বলে উঠেছে। আগুন থেকে বাবার জন্যে গঙ্গাফড়িং ঝকে-ঝাকে উড়তে শুরু করেছে, আর তাদের খেতে এসে জুটেছে আকাশের চার কোণ থেকে যত রাজ্যের ভিমরাজ, নীলকণ্ঠ, জোয়ারি ইত্যাদি পাখি। এমন সময় ঘাস-জমির দূরপ্রান্তে একটা চাঞ্চল্য দেখা গেল।

    একটু বাদেই মস্ত দুটো শুয়োর বেরিয়ে এসে পোড়া জমিটা ধরে বিদ্যুৎবেগে ছুটল তার ওধারে শ-তিনেক গজ দূরে বড়-বড় গাছের জঙ্গলে আশ্রয় নেবার জন্যে। আড়াই-মণী এলিস ধীরে-সুস্থে হাঁটু গেড়ে বসে রাইফেলটি তুলে পিছনকার শুয়োরটার দিকে গুলি ছুঁড়ল। গুলিটা তার পিছনের দুই পায়ের মাঝখানে ধুলো উড়িয়ে দিল। বন্দুকটা নামিয়ে এলিস তার মাছিটাকে দুশো গজের মতো করে বসিয়ে নিয়ে, খালি কার্তুজটিকে বের করে নতুন টোটা ভরে নিল। তার গুলি এবার গিয়ে সামনেকার শুয়োরটার ঠিক সামনে এক ধুলোর ঝড় তুলে দিল।

    দ্বিতীয় গুলিটা চালাবার পর শুয়োর-দুটো ডানদিকে ফিরল। তাতে তাদের পাশের দিকটা বন্দুকের মুখোমুখি হল, তাদের গতিবেগও বাড়ল। এবার টমের গুলি চালাবার পালা এবং খুব তাড়াতাড়ি তা করতে হবে, কেননা শুয়োর-দুটো খুব দ্রুতবেগে বনের কাছাকাছি অর্থাৎ পাল্লার বাইরে চলে যাচ্ছে। স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে টম তার রাইফেল তুলল। দুটি গুলির আওয়াজ হল, আর অমনি দুটো শুয়োরই মাথায় গুলি খেয়ে খরগোশের মত লুটিয়ে পড়ল।

    এই ঘটনার বর্ণনা করে প্রত্যেকবারই কুঁয়ার সিং এই বলে তার উপসংহার করত: ‘তখন আমি সেই ছোট-জাতের পো, শহুরে বুন্ধুটার দিকে ফিরে দাঁড়ালাম। ব্যাটার তেল-মাখা চুলের গন্ধে আমার বমি আসছিল। তাকে বললাম, “দেখলি তো রে? তুই না জাঁক করেছিলি যে তোর সাহেব আমার সাহেবকে বন্দুক চালানো শিখিয়ে দেবে। আমার সাহেব যদি তোর ঐ মুখে কালি লেপে দিতে চাইতেন, তাহলে তিনি দুটো গুলিও ছুঁড়তেন না–একটি গুলিতেই দুটোকে সাবাড় করতেন, বুঝলি?”

    ঠিক কী করে যে অসাধ্য সাধন হত, সে কথা কুঁয়ার সিং কখনও আমাকে বলে নি। আমিও তাকে জিগ্যেস করিনি। কারণ আমার আদর্শ পুরুষের উপর আমার এতটা আস্থা ছিল যে এক মুহূর্তের জন্যেও একথা অবিশ্বাস করি নি যে, সে ইচ্ছে করলেই তা করতে পারত।

    যেদিন আমি প্রথম বন্দুক পেলুম, সেই পরম দিনটিতে কুঁয়ার সিং আমাকে প্রথম দেখতে এসেছিল। সে সকালের দিকেই এল। মহা গর্বিত হয়ে আমি যখন আমার পুরনো দোনলা গাদাবন্দুকটা তার হাতে তুলে দিলুম, তখন সে আমাকে ঘুণাক্ষরেও বুঝতে দিল না, যে সে দেখতে পেয়েছে বন্দুকটার ডানদিকের নলটা ফেটে হাঁ হয়ে গিয়েছে। পিতলের তার দিয়ে জড়িয়ে সেটার বাঁট আর নলদুটোকে জুড়ে রাখা হয়েছে। এর শুধু বাঁ-দিকটার নলটির যে কত গুণ তা বলল, আর সেটার প্রশংসা করল; সেটা কেমন লম্বা, কত পুরু, কতদিন কাজ দেবে, ইত্যাদি।

    তারপর বন্দুকটিকে সরিয়ে রেখে আমার দিকে ফিরে সে এই কথা বলে আমার আট বছরের মনটাকে আনন্দে ভরে দিল এবং আমার বন্দুকটির জন্যে আমাকে আরও গর্বিত করে তুলল; ‘তুমি আর ছোট ছেলেটি নও, এখন বড় হয়ে গিয়েছি। এই সুন্দর বন্দুকটিকে নিয়ে তুমি আমাদের জঙ্গলে যেখানে খুশি সেখানে নির্ভয়ে চলে যেতে পার–শুধু যদি তুমি গাছে চড়তে শিখে নাও। কী করে গাছে চড়তে হয় সেটা জানা। যে বনে-জঙ্গলে শিকার করতে হলে তোমার পক্ষে কত দরকার, সে কথা বোঝাবার জন্য আমি তোমাকে এখন একটা গল্প বলব।

    ‘গত বৈশাখ মাসে একদিন আমি আর হর সিং শিকারে বেরিয়েছিলুম। আর সবই ঠিক ছিল, কিন্তু গ্রাম থেকে বেরোবার মুখেই একটা শেয়াল আমাদের রাস্তা পার হয়ে চলে গেল। জানই তো যে হর সিংহটা একটা আনাড়ী শিকারী, আর বনের প্রাণীদের ব্যাপারে কিছু জানে না। শেয়ালটাকে দেখবার পর আমি যখন বললুম যে আমাদের বাড়ি ফিরে যাওয়া উচিত, সে তখন আমাকে ঠাট্টা করতে লাগল আর বলল যে, শেয়াল দেখলে অমঙ্গল হয়, এটা ছেলেমানুষী কথা। কাজেই আমরা চলতে লাগলুম।

    আমরা যখন রওনা হয়েছিলুম তখন আকাশে তারারা ফিকে হয়ে আসছিল। গারুপ্পর কাছে আমি একটা চিতল হরিণকে গুলি করলুম, কিন্তু কেন যে সেটা ফসকে গেল তা বলতে পারি না। হর সিং-এর গুলিতে একটা ময়ূরের ডানা ভেঙে গেল। সেটাকে যতদূর সাধ্য তাড়া করে গেলুম বটে, কিন্তু সেটা লম্বা ঘাসের মধ্যে ঢুকে গেল, আর তাকে পেলুম না। তারপর বন-জঙ্গল আঁতিপাঁতি করে খুঁজেও শিকার করবার মত কিছু চোখে পড়ল না। বেলা পড়ে এলে আমরা বাড়ির দিকে চললুম।

    ‘দুবার গুলি ছুঁড়েছি, বনের পাহারাওয়ালারা তা শুনে হয়তো আমাদের এখন খুঁজছে–এই ভেবে আমরা বনের পথগুলোকে এড়িয়ে একটা বালিভরা নালার পথ ধরলুম। সেটা ঘন ঝোঁপ-ঝাড়ে আর কাটা-বাঁশের বনে ভর্তি।

    আমাদের দুর্ভাগ্যের কথা বলতে-বলতে চলেছি, এমন সময়ে হঠাৎ একটা বাঘ নালার মাঝখানে এসে আমাদের দিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে গেল। দীর্ঘ এক মিনিট ধরে একদৃষ্টে আমাদের দেখে বাঘটা ফিরল, তারপর যে-দিক থেকে এসেছিল সে-দিকেই চলে গেল।

    ‘যতক্ষণ উচিত, ততক্ষণ অপেক্ষা করে আমরা আবার চলতে শুরু করতেই বাঘটা আবার নালার মধ্যে বেরিয়ে এল। এবার সে দাঁড়িয়ে আমাদের দিকে দেখতে-দেখতে গজরাতে আর লেজ নাড়তে লাগল। আবার আমরা একেবারে চুপ করে দাঁড়িয়ে গেলুম। খানিক বাদে বাঘটা ঠান্ডা হয়ে নালা ছেড়ে চলে গেল। কিছুক্ষণ পরে, নিশ্চয় ওই বাঘটার ভয়েই, একটা ঘন ঝোঁপ থেকে অনেকগুলো বন-মুরগি, কা-কা করে উঠে পড়ল। তাদের মধ্যে একটা এসে ঠিক আমাদের সামনেই একটা হলুদ গাছে বসল।

    পাখিটাকে চোখের সামনে একটা ডালের উপর নামতে দেখে হর সিংহ বলল যে সে ওটাকে মারবে–তাহলে আর খালি হাতে ঘরে ফিরতে হবে না। সে এও বললে যে বন্দুকের শব্দে বাঘ ভয়ে পেয়ে পালিয়ে যাবে। আমি তাকে বাধা দেবার আগেই সে বন্দুক, ছুঁড়ে বসল।

    ‘পরমূহর্তেই ভয়ানক এক গর্জন করে বাঘটা ঝোঁপ-ঝাড় ভেঙে আমাদের দিকে ধেয়ে এল। এইখানটাতে নালার কিনারায় কয়েকটা রুনি গাছ হয়েছিল। তার একটার দিকে আমি ছুটে গেলুম, আর অন্য একটার দিকে হর সিং ছুটে গেল। আমার গাছটা ছিল বাঘটার কাছাকাছি, কিন্তু সে এসে পৌঁছবার আগেই আমি তার নাগালের বাইরে উঠে গেলুম। হর সিং ছেলেবেলায় আমার মত গাছে চড়তে শেখে নি–সে তখন মাটিতে দাঁড়িয়ে হাত তুলে একটা ডাল ধরবার চেষ্টা করছিল।

    বাঘটা তখন আমাকে ছেড়ে দিয়ে তার দিকে লাফিয়ে পড়ল। হর সিংকে কামড়ালও না, আঁচড়ালও না–শুধু পিছনের দুই পায়ে দাঁড়িয়ে হর সিংকে চেপে গাছটাকে জড়িয়ে ধরল। তারপর থাবা চালিয়ে গাছটার ওধার থেকে ছালের তার কাঠের বড়-বড় টুকরো ছাড়িয়ে ফেলতে লাগল। এই করতে করতে সেও গর্জন করতে লাগল, হর সিং-ও চেঁচাতে লাগল।

    আমি বন্দুকটাকে নিয়েই গাছে উঠে পড়েছিলুম। এখন আমি আমার খালি পা দিয়ে আঁকড়ে ধরে, ঘোড়াটাকে ঠিক করে নিয়ে শূন্যে বন্দুকের আওয়াজ করে দিলুম। এত কাছে গুলির শব্দ শুনে বাঘটা লাফ দিয়ে ফেলেছে। তাতে তার নাড়ি-ভুড়ি সব বেরিয়ে পড়েছিল।

    ‘বাঘটা চলে যাবার কিছুক্ষণ পরে আমি খুব চুপি-চুপি.নেমে এসে হর সিং-এর কাছে গেলুম। গিয়ে দেখি যে বাঘের একটা নখ তার পেটে ঢুকে চামড়াটা নাভির কাছ থেকে শিরদাঁড়ার কয়েক আঙুল দূর পর্যন্ত ছিঁড়ে ফেলেছে। তাতে তার নাড়ি-ভুড়ি সব বেরিয়ে পড়েছিল।

    ‘বাঘটা চলে যাবার কিছুক্ষণ পরে আমি খুব চুপি-চুপি নেমে এসে হর সিং-এর কাছে গেলুম। গিয়ে দেখি যে বাঘের একটা নখ তার পেটে ঢুকে চামড়াটা নাভির কাছ থেকে শিরদাঁড়ার কয়েক আঙুল দূর পর্যন্ত ছিঁড়ে ফেলেছে। তাতে তার নাড়ি-ভূঁড়ি সব বেরিয়ে পড়েছিল।

    আমার তখন হল মহা মুশকিল। হর সিং-কে ফেলে পালিয়ে যেতেও পারি না, অথচ এসব ব্যাপারে অভিজ্ঞতা না থাকায় ঠিক করতেও পারি না যে কী করলে ভাল হয়। সেই নাড়ি-ভুড়ির সবটা হর সিং-এর পেটে আবার ঢুকিয়ে দেবার চেষ্টাই করি, না, কেটেই বাদ দিই। এ বিষয়ে হর সিং-এর সঙ্গে কথা বললুম- ফিসফিস করে, কেননা ভয় হচ্ছিল পাছে বাঘটা শুনতে পেয়ে ফিরে এসে আমাদের মেরে ফেলে। হর সিং-এর মতে তার নাড়ি-ভুড়ি তার পেটের মধ্যে তুলে রাখাই ভাল। কাজেই সে চিত হয়ে মাটিতে শুয়ে পড়ল, আর আমি শুকনো ঘাস পাতা আর কাঠের টুকরো-টাকরা যা লেগেছিল সবসুদ্ধ নাড়ি-ভুড়ি আবার ভরে দিলুম তার পেটে। তারপর আমি আমার পাগড়ি খুলে তার পেটে বেশ করে জড়িয়ে দিয়ে কষে গাঁট বাঁধলুম, যাতে সবকিছু আবার বেরিয়ে না পড়ে। তারপর আমরা আমাদের গ্রামের দিকে সাত মাইল পথ হাঁটা শুরু করলুম–দুই বন্দুক নিয়ে আগে-আগে আমি, আমার পিছনে চলল হর সিং।

    ‘আমাদের আস্তে-আস্তে চলতে হল, কেননা হর সিং-কে পাগড়িটা ঠিক করে ধরে রাখতে হচ্ছিল। পথে রাত হয়ে গেল। হর সিং বললে যে আমাদের গ্রামে ফিরে না গিয়ে সোজা কালাধুঙ্গির হাসপাতালে যাওয়াই ভাল। তাই বন্দুকগুলিকে লুকিয়ে রেখে আমরা তিন মাইল পথ বেশি হেঁটে হাসপাতালেই গেলুম।

    যখন পৌঁছলুম হাসপাতাল বন্ধ হয়ে গিয়েছে। কিন্তু ডাক্তারবাবু কাছেই থাকতেন। তিনি জেগে ছিলেন। আমাদের ব্যাপারটা শুনে আমকে পাঠালেন তামাকওলা আলাদিয়াকে ডেকে আনতে। সে ছিল কালাধুঙ্গির পোস্টমাস্টার। সরকার থেকে মাসে পাঁচ টাকা মাইনে পেত। ওদিকে ডাক্তারবাবু একটা লণ্ঠন জ্বেলে হর সিং-কে নিয়ে হাসপাতলে চলে গেলেন। আলাদিয়াকে নিয়ে ফিরে এসে দেখি যে ডাক্তারবাবু হর সিংকে একটা দড়ির খাঁটিয়ায় শুইয়ে দিয়েছেন। আমি তার মাংসের খণ্ডদুটোকে একসঙ্গে করে চেপে ধরলুম, আর ডাক্তারবাবু তার পেটের ফাঁকটা সেলাই করে দিলেন। তার ভারি দয়া, আর বয়সটাও কাঁচা। আমি তাকে দুটো টাকা দিতে গেলুম, তিনি তা নিলেন না। তারপর তিনি হর সিংকে খুব ভাল একটা ওষুধ খাইয়ে দিলেন যাতে সে তার পেটের যন্ত্রণাটা ভুলে থাকে।

    তারপর আমরা বাড়ি গেলুম। দেখলুম মেয়েরা কাঁদছে, কেননা তারা মনে করেছিল যে হয় ডাকাতে, নয় বনের জন্তুতে আমাদের মেরে ফেলেছে। তাহলেই দেখ সাহেব, আমরা যারা বনে শিকার করি, গাছে চড়তে জানাটা তাদের পক্ষে কতটা দরকারী। হর সিং যখন ছোট ছেলেটি ছিল, তখন যদি তাকে পরামর্শ দেবার কেউ থাকত তাহলে সে আমাদের এত ঝঞ্ঝাটে ফেলত না।*

    ——

    * বোঝাই যায় যে ওটা ছিল একটা বাঘিনী। ওখানেই তার নতুন বাচ্চা হয়েছিল বলে ওখানে মানুষ এসে পড়াটা তার পছন্দ হয়নি। যে রুনি গাছটাতে সে হর সিং-কে চেপে ধরেছিল, সেটা হাতখানেক মোটা ছিল। রাগের চোটে সে তার এক-তৃতীয়াংশই আঁচড়ে তুলে ফেলেছিল। গারুপ্পর জঙ্গলে যারা লুকিয়ে কিংবা প্রকাশ্যে শিকার করত, তাদের কাছে গাছটা একটা নিশানা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। শেষে, বছর পঁচিশেক বাদে একদিন দাবানলে সেটা পুড়ে নষ্ট হয়ে যায়।

    তার তিন বন্ধুর এই আসুরিক চিকিৎসা সত্ত্বেও আর তার পেটে অত কাঠিকুটো চলে যাওয়া সত্ত্বেও হর সিং তার এই ঘা নিয়ে বিশেষ ভোগে নি। সে বুড়ো বয়স পর্যন্ত বেঁচে ছিল।

    ——

    প্রথম যে ক-বছর আমি গাদা বন্দুকটা নিয়ে ঘুরেছি ফিরেছি, সেই সময়টাতে আমি কুঁয়ার সিংয়ের কাছে থেকে অনেক কিছু শিখেছি। তার মধ্যে একটা হচ্ছে, মনে-মনে ম্যাপ আঁকা। যে জঙ্গলে আমরা শিকার করতুম সেটা ছিল আয়তনে কয়েকশো বর্গমাইল। তার ভিতর দিয়ে একটি মাত্র রাস্তা গিয়েছে। আমরা একসঙ্গেও গিয়েছি বটে, কিন্তু অনেক সময়েই আমাকে একা যেতে হত, কেননা কুঁয়ার সিংয়ের বড় ডাকাতের ভয় ছিল বলে সে হয়তো এক নাগাড়ে কয়েক সপ্তাহ ধরে গ্রাম ছেড়ে কোথাও যেত না।

    শিকার থেকে ফেরবার পথে আমি অসংখ্যবার কুঁয়ার সিংয়ের গ্রাম হয়ে এসেছি। আমার বাড়ি থেকে যতটা, তার থেকে সেটা জঙ্গলের তিন মাইল কাছে। তাকে এই কথা বলতে যেতুম যে আমি একটা চিতল কিংবা সম্বর হরিণ কিংবা হয়তো একটা বড় বরা মেরে রেখেছি, সে যেন গিয়ে সেটাকে নিয়ে আসে। যে জন্তুটাকে শিকার করেছি, সেটাকে শকুনদের হাত থেকে বাঁচাবার জন্যে আমি যতই যত্ন করে সেটাকে কোনো বড় গাছের জঙ্গলে বা ঝোঁপ-ঝাড়ে বা ঘাসবনেই লুকিয়ে রেখে থাকি না কেন, সে কখনও সেটাকে না নিয়ে ফিরে আসে নি।

    প্রতিটি বিশেষ গাছ, জলের কুণ্ড, পশুদের চলাচলের পথ আর নালাকে আমরা এক-একটা নাম দিয়েছিলাম। গাদা-বন্দুকটা থেকে গুলি ছুঁড়লে তার যে কাল্পনিক গতিপথ হতে পারে, সেই হিসেবে আমরা সব দূরত্ব মাপতুম, আর কম্পাসে দেখানো দিক চারটে দিয়ে আমরা সব দিক ঠিক করে নিয়েছিলুম।

    যদি আমি একটা জানোয়ারকে লুকিয়ে রেখে আসতুম, কিংবা কুঁয়ার সিং কোনো গাছের উপর শকুনিদের জমায়েত হতে দেখে বুঝত যে চিতা বা বাঘে কিছু মেরেছে, তাহলে সে কিংবা আমি এ কথাটা একেবারেই ঠিক জেনে রওনা হতে পারতুম যে, দিনের কিংবা রাতের যে-সময়ই হোক না কেন, সে জায়গাটা খুঁজে পাবই।

    স্কুলের পড়া করে আমি যখন বাংলাদেশে কাজে লেগে গেলুম, তখন বছরে মোটে সপ্তাহ-তিনেকের জন্যে কালাধুঙ্গিতে আসতে পারতুম। একবার এরকম এসে দেখে বড় কষ্ট হল যে আমার পুরনো বন্ধু কুঁয়ার সিং আমাদের পাহাড়ী এলাকার অভিশাপ স্বরূপ যে আফিম, তার খপ্পরে পড়েছে। ম্যালেরিয়ায় ভুগে তার ধাত দুর্বল হয়ে গিয়েছিল, তাই এই কু-অভ্যাসটা তার বেড়েই যাচ্ছিল।

    আমার কাছে সে অনেকবার প্রতিজ্ঞা করেছিল, কিন্তু তা রাখবার মত মনের জোর তার ছিল না। কাজেই এবার ফেব্রুয়ারি মাসে কালাধুঙ্গিতে এসে আমাদের গ্রামের লোকদের কাছে শুনে আশ্চর্য হলুম যে কুঁয়ার সিং গুরুতরভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। আমার আসার খবর সেই রাতেই কালাধুঙ্গিতে রটে গিয়েছিল। পরদিন কুঁয়ার সিংয়ের ছোট ছেলে, তার বয়স আঠার, দৌড়ে এসে আমাকে বলল যে তার বাবা যমের দুয়ারে পৌঁছে গিয়েছে, আর সে মরবার আগে আমাকে দেখতে চায়।

    চাঁদনি চক গ্রামের মোড়ল, সরকারকে চার হাজার টাকা খাজনা দেবার কর্তা কুঁয়ার সিং একটা কেউ-কেট লোক ছিল। সে টেপাথরের ছাদওলা মস্ত একটা পাথরের বাড়িতে থাকত। সেখানে প্রায়ই তার আতিথ্য উপভোগ করেছি।

    এবার যখন তার ছেলের সঙ্গে তার গ্রামের কাছাকাছি এলুম, তখন শুনি যে মেয়েদের কান্নার শব্দ আসছে, বাড়ি থেকে নয়। কুঁয়ার সিং তার একজন চাকরের জন্যে যে একটা কুঁড়েঘর বানিয়েছিল, সেটা থেকে। ছেলেটা আমাকে সেদিকে নিয়ে যেতে যেতে বলল যে, নাতি নাতনীরা কুঁয়ার সিংয়ের ঘুমের ব্যাঘাত করে বলে তাকে এখানে এনে রাখা হয়েছে। আমাদের আসতে দেখে কুঁয়ার সিংয়ের বড় ছেলে ওই ঘরটা থেকে বেরিয়ে এসে আমাকে জানিয়ে দিল,যে তার বাবার জ্ঞান নেই, আর কয়েক মিনিট বাঁচে কি না বাঁচে।

    কুটিরটির দরজার সামনে এসে দাঁড়ালাম। ঘরের মধ্যে ঘন ধোঁয়ার একটা আবরণ ঘরের মিটমিটে আলোটাকে আরও মিটমিটে করে তুলেছে। সেই অবস্থাটা যখন চোখে সয়ে এল, তখন দেখতে পেলুম যে কুঁয়ার সিং উলঙ্গ অবস্থায় মাটির মেঝের উপর হয়ে পড়ে আছে, একটা চাদর দিয়ে তার দেহের খানিকটা ঢাকা।

    একটি বৃদ্ধ নোক মেঝের উপর তার কাছে বসে তার অসাড় ডানহাতখানাকে তুলে ধরে রেখেছে, আর একটা গরুর লেজ ঘিরে তার আঙুলগুলিকে চেপে ধরা রয়েছে। (মুমূর্য মানুষের হাতে একটা গরুর লেজ ধরিয়ে দেবার একটা প্রথা আছে–গরুটা একটা কাল বকনা হলে আরও ভাল হয়। প্রথাটার কারণ এই যে, হিন্দুরা বিশ্বাস করে যে মর্ত্যদেহ ছেড়ে বেরিয়ে মানুষের আত্মা একটা রক্তের নদীর সামনে এসে পড়ে, আর তার ওপারেই বসে থাকেন সেই বিচারক, যাঁর সামনে দাঁড়িয়ে যে আত্মাকে তার যত পাপের জন্য জবাবদিহি করতে হবেই। ওই বকনাটার লেজ ধরেই ওই প্রেতাত্মা ওই নদীটা পার হতে পারে। আর, তার পার হবার এই ব্যবস্থাটা যদি করে দেওয়া না হয়, তাহলে আত্মা অভিশপ্ত হয়ে পৃথিবীতেই থেকে যায়, আর যারা তাকে সেই বিচারাসনের সামনে নিয়ে হাজির করতে গাফিলতি করেছে তাদের উপর উৎপাত করে।)

    কুঁয়ার সিংয়ের মাথার কাছে একটা আগুনের গামলায় ছুঁটে জ্বলছে, তার পাশে এক পুরুত বসে আছে, সে মন্ত্র পড়ছে আর ঘণ্টা নাড়ছে। পুরুষ-মেয়েদের গাদাগাদিতে ঘরে আর এতটুকু জায়গাও নেই। তারা বিলাপ করছে আর ক্রমাগত বলছে, ‘মরে গিয়েছে! মরে গিয়েছে।’

    জানি যে এ-দেশে অনেক লোক রোজই এইভাবে মারা যাচ্ছে, কিন্তু আমার বন্ধুটিও তাদের মধ্যে একজন হবে, এটা আমি হতে দেব না। বলতে কি, আমার সাধ্য থাকলে তাকে আমি মোটে মরতে দিতেই চাই না–অন্তত এখন তো নয়ই।

    লম্বা-লম্বা পা ফেলে ভিতরে ঢুকে আমি লোহার চুলোটা তুলে নিলুম। সেটা অত গরম হবে ভাবি নি, হাত পুড়ে গেল। দরজা পর্যন্ত বয়ে নিয়ে গিয়ে সেটাকে বাইরে ছুঁড়ে ফেলে দিলুম। ফিরে গিয়ে, ছালের যে দড়িটা দিয়ে ঘরের মাটির মেঝেতে পোঁতা খুটিতে গরু বাঁধা ছিল সেটা কেটে গরুটাকে বাইরে নিয়ে গেলুম। আমি কথাটি না বলে এসব কাণ্ড করছিলুম। এর মানে কি, তা বুঝতে পেরে লোকগুলো বিশেষ হইচই করল না। তারপর যখন পুরুতের হাতখানা ধরে ঘর থেকে বাইরে নিয়ে এলুম, তখন সব গোলমাল থেমে গেল।

    তখন দরজায় দাঁড়িয়ে আমি সবাইকে বাইরে যেতে বললুম। একটুও আপত্তি বা টু শব্দ না করে সবাই আমার হুকুম তামিল করল। ঘর থেকে ছেলেয়-বুড়োয় এত লোক বেরোল যে বললে বিশ্বাস করবেন না। শেষ মানুষটি চৌকাঠের ওপাশে যাবার পর আমি কুঁয়ার সিংয়ের বড় ছেলেকে সের-দুই টাটকা দুধ যত শিগগির সম্ভব গরম করে নিয়ে আসতে বললুম। ছেলেটা বেজায় অবাক হয়ে আমার দিকে তাকাল, কিন্তু আমি কথাটা দ্বিতীয়বার বলাতেই সে তাড়াতাড়ি ছুটল।

    তখন আমি আবার ঘরে ঢুকে দেওয়ালের একটা দড়ির খাঁটিয়া সামনে টেনে এনে কুঁয়ার সিংকে তুলে তার উপর শোয়ালুম। প্রচুর টাটকা হাওয়ার অত্যন্ত দরকার, অথচ চারদিকে তাকিয়ে দেখি, একটি মাত্র যে জানলা সেটাও তক্তা এঁটে বন্ধ করে রাখা হয়েছে।

    তক্তাগুলো ভেঙে ফেলতে বেশিক্ষণ লাগল না, আর বনের থেকে পরিষ্কার মিষ্টি হাওয়া সোজা এসে ঢুকল সে ঘরটার মধ্যে যা এতক্ষণ মানুষ, গোবর, পোড়া-ঘি আর কড়া-ধোঁয়ার বদ গন্ধে ভরভর করছিল।

    যখন কুঁয়ার সিংয়ের জীর্ণ-শীর্ণ দেহটা তুলি, তখনই বুঝলাম যে তাতে একটু প্রাণ আছে, যদিও তা খুবই সামান্য। তার কোটরের গভীরে বসা চোখ-দুটো বন্ধ, ঠোঁট-দুটো নীল, আর তার নিঃশ্বাস থেকে-থেকে অল্প-অল্প পড়ছে! কিন্তু শিগগিরই টাটকা পরিষ্কার হাওয়া তাকে চাঙ্গা করে তুলতে লাগল। আর তার শ্বাস-প্রশ্বাসও কম কষ্টকর এবং বেশি স্বাভাবিক হয়ে এল।

    কাঁদুনেদের যে-দলটাকে আমি সেই যমের ঘর থেকে খেদিয়ে দিয়েছিলুম, তারা যেরকম ছটফট করছিল, খাঁটিয়ায় বসে দরজার ফাঁক দিয়ে তা দেখতে দেখতে কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার খেয়াল হল যে কুঁয়ার সিং চোখ মেলেছে আর আমার দিকে তাকিয়ে আছে। মাথা না ফিরিয়েই আমি কথা বলতে শুরু করলুম :

    ‘দিনকাল বদলে গিয়েছে, খুড়ো, আর তার সঙ্গে তুমিও বদলেছ। এমন দিনও ছিল যখন কারও এ সাহস হত না যে তোমাকে নিজের ঘর থেকে সরিয়ে নিয়ে এসে একটা চাকরের কুঁড়েঘরের মেঝেতে ফেলে রাখবে, যাতে তোমার মরণ হয়। একটা একঘরে ভিখিরীর মত। আমার কথা তো তুমি শুনলে না, এ হতভাগা নেশাই তোমার এই হাল করেছে।

    ‘আজ তোমার ডাক শুনে এখানে আসতে আর কয়েক মিনিট দেরি করলেই তুমি এতক্ষণে শ্মশান-ঘাটের রাস্তা নিতে। চাঁদনি চকের মোড়ল আর কালাধুঙ্গির শ্রেষ্ঠ শিকারী বলে সবাই তোমাকে সম্মান করত, আর এখন তুমি সে সম্মান খুইয়ে বসেছ।

    ‘তুমি জোয়ান মানুষ ছিলে, ভাল-ভাল জিনিস খেতে কিন্তু আজ তুমি কম-জোরী হয়ে গিয়েছ, তোমার পেট খালি। তোমার ছেলের কাছে শুনলাম যে ষোল দিনের মধ্যে তুমি কিছু খাও নি। কিন্তু দোস্ত, তুমি মরতে যাচ্ছ না, তা ওরা যাই বলুক না কেন। আরও অনেক বছর তুমি বেঁচে থাকবে। এবং যদিও আমরা হয়তো আর একসঙ্গে গারুপুর বনে জঙ্গলে শিকার করতে পারব না, তবু তখনও মাংসের অভাব হবে না তোমার। বরাবর যেমন করেছি, এখনও তেমনি, আমি যা শিকার করব তার ভাগ তোমাকে দেব।

    ‘আর এখনই, এই ঘরে, আঙুলে পইতে জড়িয়ে আর হাতে অশ্বথপাতা নিয়ে তোমার বড় ছেলের মাথায় হাত দিয়ে তোমায় প্রতিজ্ঞা করতেই হবে যে তুমি ওই নচ্ছার নেশা আর ছোঁবেও না। আর এইবার তুমি যে প্রতিজ্ঞা করবে, তা রাখতেই হবে তোমাকে। এখন এস, যতক্ষণ না তোমার ছেলে দুধটা নিয়ে আসে ততক্ষণ একটু ধোঁয়া খাওয়া যাক।

    যতক্ষণ আমি কথা বলছিলুম ততক্ষণ কুঁয়ার সিং তার চোখ সরায় নি। এখন সে প্রথম তার ঠোঁট খুলল। তারপর বললে, যে লোকটা মরে যাচ্ছে সে সিগারেট খাবে কী করে?

    আমি বললম, মরবার কথা এখন থাক। কেননা তোমাকে তো এখনই বলেছি যে তুমি মরতে যাচ্ছ না। আর, সিগারেট কী করে খাওয়া যাবে, তা আমি তোমাকে দেখিয়ে দিচ্ছি।

    এই বলে, আমার খাপ থেকে দুটো সিগারেট নিয়ে একটা ধরিয়ে তার ঠোঁটে খুঁজে দিলুম। সে আস্তে এক টান টেনে একটু কাশল, তারপর খুব দুর্বল হাতখানা দিয়ে সিগারেটটা ধরল। কিন্তু কাশির ধমকটা কেটে গেলে সে আবার সেটাকে ঠোঁটে রাখল, তারপর টানতে লাগল। আমাদের ধূমপান শেষ হবার আগেই কুঁয়ার সিংয়ের ছেলে মস্ত বড় একটা পিতলের পাত্র নিয়ে এসে পড়ল। আমি তাড়াতাড়ি সেটা তার হাত থেকে না নিয়ে নিলে সেটাকে সে দরজায়ই ফেলে দিত।

    সে কেন অবাক হয়েছিল তা বোঝা শক্ত নয়, কেননা যে বাপকে সে মাটিতে মর-মর অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে গিয়েছে, সেই বাপ এখন খাঁটিয়ায় শুয়ে আমার টুপির উপর মাথা রেখে সিগারেট টানছিল। ঘরে এমন কিছু ছিল না যাতে করে দুধটা খাওয়া যেত, তাই ছেলেটাকে আবার একটা বাটি নিয়ে আসতে পাঠালুম। সেটা নিয়ে আসা হলে কুঁয়ার সিংকে আমি গরম দুধ খাইয়ে দিলুম।

    অনেক রাত্রি পর্যন্ত সেই ঘরে থাকবার পর যখন কুয়ার সিংকে ছেড়ে চলে এলুম, তখন সে সেরখানেক দুধ খেয়ে শান্তিতে একটি বিছানায় শুয়ে ঘুমোচ্ছে। চলে আসবার আগে আমি ছেলেটাকে সাবধান করে এলুম যে, কোনো কারণেই যেন আর কাউকে ঘরের কাছে আসতে দেওয়া না হয়, আর সে যেন অর বাপের কাছে বসে থেকে সে যতবার জাগবে ততবার তাকে একটু একটু দুধ খেতে দেয়। আর যদি সকালবেলা ফিরে এসে দেখি যে কুঁয়ার সিং মারা গিয়েছে, তাহলে আমি গ্রামকে-গ্রাম জুলিয়ে দেব!

    পরদিন সকালবেলা সূর্য যখন সবে উঠেছে, তখন আমি চাঁদনি চক গ্রামে ফিরে এসে দেখি যে কুঁয়ার সিং আর অর ছেলে অঘোরে ঘুমুচ্ছে, আর পিতলের পাত্রটি খালি পড়ে আছে।

    কুঁয়ার সিং তার প্রতিজ্ঞা রক্ষা করেছিল। যদিও সে আমার সঙ্গে শিকার অভিযানে যাবার মত যথেষ্ট শক্তি আর ফিরে পায় নি, তবু সে প্রায়ই আমাদের সঙ্গে দেখা করতে আসত। এর চার বছর পর সে নিজের বাড়িতে বিছানায় শুয়ে শান্তিতে শেষ নিঃশ্বাস ফেলে।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleরামায়ণের উৎস কৃষি – জিতেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়
    Next Article জীবনযাপন – জীবনানন্দ দাশ
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর জীবনী – তপন বাগচী

    August 20, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর জীবনী – তপন বাগচী

    August 20, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Our Picks

    রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর জীবনী – তপন বাগচী

    August 20, 2025

    রাজমালা বা ত্রিপুরার ইতিহাস – শ্রী কৈলাসচন্দ্ৰ সিংহ প্রণীত

    August 20, 2025

    আলো হাতে সেই মেয়েটি – তপন বন্দ্যোপাধ্যায়

    August 20, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.