Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    জীবনযাপন – জীবনানন্দ দাশ

    জীবনানন্দ দাশ এক পাতা গল্প44 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    জীবনযাপন – ৩

    ৩

    পরদিন পূর্ণিমা এল না-তার পর দিনও না—

    তার পর দিন কোনো অভিনয় ছিল না।

    শেষ রাত থেকেই পৃথিবী কালো করে শ্রাবণের বৃষ্টি পড়ছে—

    ভোর চারটার সময় উঠে অজিত বিছানার ওপর জেগে বসে ছিল—কিছুই ভালো লাগছিল, না তার। রেনকোটটা গায় দিয়ে একটা শোলার টুপি মাথায় চড়িয়ে বেরিয়ে পড়ল সে। কোথায় যাওয়া যায়?

    এক পূর্ণিমা ছাড়া আর কোনো লোকের কথাই মনে হ’ল না তার।

    কিন্তু পর্ণিমার কাছে এই সময়?

    সে উঠেছে কি না তাও বা কে জানে?

    গিয়ে সেখানে কি দেখতে হবে তাই বা কে বলতে পারে?

    কিন্তু তবুও গেল অজিত।

    দোতলায় পূর্ণিমার কোঠার পাশে গিয়ে দরজাটা ধাক্কা দিতেই সেটা খুলে গেল।

    পূর্ণিমা একটা শাল গায় দিয়ে জানালার পাশে মস্ত বেতের ইজিচেয়ারে বসে ছিল-অজিতকে দেখে তার মুখের কোনো ভাবপরিবর্তন হয়েছে বলে বোধ হ’ল না; ইজিচেয়ারে বসেই বললে—ওঃ আপনি—

    —হ্যাঁ আমিই।

    অজিত তার ভিজে কাপড়চোপড় জুতো নিয়ে ঘরের মাঝখানে এসে সমস্ত কার্পেটে কাদা জল মাখিয়ে দিতে লাগল-সে দিকে তার কোনো খেয়ালও ছিল না যেন—

    পূর্ণিমা বললে—আঃ কার্পেটটা নষ্ট করে ফেললেন।

    —ওঃ তাই তো।

    —জুতোটা ছেড়ে আসুন।

    অজিত তাড়াতাড়ি দরজার দিকে সরে গেল

    পূর্ণিমা বললে–টুপী কোট র‍্যাকে রেখে আসুন।

    —র‍্যাক কোথায়?

    —বাইরের দেয়ালে

    —থাক্-আমি অন্য জায়গায় যাচ্ছিলাম-তোমার জানালা খোলা দেখে ভাবলাম তুমি উঠেছ হয়তো—আমি চলে যাচ্ছি—

    অজিত দরজা অব্দি গিয়ে একটু থেমে দাঁড়াল।

    —যা বৃষ্টি

    আস্তে আস্তে (পূর্ণিমার) কার্পেটের দিকে তাকিয়ে বললে—তোমার কার্পেটের ওপর এই মহিষের ক্ষুরের মত জুতো নিয়ে কি করে যে চড়ে কসলাম আমি?

    পূর্ণিমা বললে—বুট আপনি খুলুন। একটু ইতস্তত করে সাত পাঁচ ভেবে একবার এগিয়ে একবার পিছিয়ে অজিত শেষ পর্যন্ত বুটজোড়া খুলে ফেলতে লাগল—

    টুপীটা র‍্যাকে রেখে এল-রেনকোটটাও—

    পূর্ণিমা ইজিচেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বললে—এইখানে বসুন আপনি—

    —এইখানে বসব? তা বেশ। অভ্যর্থনা করবার শক্তি ও সহৃদয়তা তোমারই আছে—কিন্তু তুমি কোথায় বসবে পূর্ণিমা?

    —বিছানায়।

    —ইজিচেয়ারটা একটু কাছে টেনে নি—

    —নিন্

    চেয়ারটা পূর্ণিমার দিকে অল্প খানিকটা টেনে নিলে অজিত—

    পূর্ণিমা অজিতের বুটজোড়া বারান্দায় রেখে এল—

    পূর্ণিমা বিছানার এক কিনারে এসে বসে বললে—আপনাকে চুরুট দেব

    —চুরুট?

    —খান তো আপনি—

    —তা খাই বটে কিন্তু তুমি কোথায় পাবে?

    —আনিয়ে দিচ্ছি-হয়তো দেরাজেও আছে।

    —দেরাজে?

    — হ্যাঁ

    —কি করে থাকে পূর্ণিমা

    —আপানাদের জন্য।

    অজিত বললে—আমাদের? আমাদের কাদের জন্য?

    কিন্তু প্রশ্ন করে এর কোনো উত্তর চাইল না সে। কেমন বিহ্বল হয়ে গেল-গম্ভীর হয়ে উঠল—

    পূর্ণিমা উপলব্ধি করে বললে—আমার এখানে কেউ তো বড় একটা আসে না-থিয়েটারের কর্তৃপক্ষ থেকে লোকেরা এসে মাঝে মাঝে আমাকে পার্ট বুঝিয়ে দিয়ে যায়। তা ছাড়া আমার সঙ্গে দেখা করতে হলে কার্ড দিয়ে দেখা করতে হয়—

    (এর পর প্রায় তিন পৃষ্ঠা জুড়ে যা লিখেছেন, কেটে দিয়েছেন।)

    এই মেয়েটির এই আত্মনিবেদনটুকু অজিতের পক্ষে যথেষ্ট—সে কি করে না করে-কার্ড দিয়ে মানুষ কত দূর নিজেকে সুরক্ষা করতে পারে-সে প্রবৃত্তি কতক্ষণই বা থাকে তার—কখন সমস্ত আত্মরক্ষাই লাঞ্ছিত হয়ে যায়-সে সব কথা ভাবতে গেলে হয়রান হয়ে পড়তে হয়।

    পূর্ণিমার অভিনয়ের জীবন নিয়েই তো অজিতের দরকার-অন্য জীবনের খোঁজই বা সে নিতে যায় কেন?

    ব্যথা লাগে—কিন্তু তবুও যে খোঁজ নেবার অধিকার নেই তার।

    ব্যথা লাগে কি যে!

    পূর্ণিমা বুঝল—

    অজিত বড় ব্যথা পাচ্ছিল।

    পূর্ণিমা অত্যন্ত ব্যথিত হয়ে বোধ করল তা—

    কিন্তু কি করবে যে? কি বলবে? পূর্ণিমা চুপ করে রইল।

    অজিত বললে—পূর্ণিমা —

    পূর্ণিমা অনেকক্ষণ পরে বললে—আপনি অস্বস্তি বোধ করছেন?

    অজিত একটু হেসে বললে—না, অস্বস্তি নয়—

    —কি চান আপনি?

    —কেমন শীত করছে, কেন বল দেখি?

    —ঠাণ্ডা পড়েছে যে।

    —এই বাদলার জন্য?

    —হ্যাঁ

    পূর্ণিমা বললে—একটা হুইস্কি দেব আপনাকে?

    অজিত স্তম্ভিত হয়ে পূর্ণিমার দিকে তাকাল—

    পূর্ণিমা একটু ভয় পেয়ে গেল—

    কিন্তু তবুও সে বললে—এক গ্লাস সোডার সঙ্গে দেই? তাহ’লে শরীরটা বেশ গরম হয়ে উঠবে-আরাম বোধ করবেন আপনি অজিতবাবু—

    অজিত খানিকক্ষণ চুপ থেকে জানালার দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বললে—মদ!

    —অল্প স্বল্প—

    জানালার দিকে তাকিয়েই অজিত বললে—কোনো দিন খাই নি তো—

    —একদিনও না!

    —না

    —একটুও না?

    —শুনলে আমার মা কি বলতেন?

    —কিন্তু আপনি থিয়েটার করছেন বলে মা খুব ভাল বলেন না আপনাকে।

    —কিন্তু আমি জানি-একদিন যদি তাঁকে বুঝিয়ে বলি যে এ জিনিস ছবি আঁকার মত, কবিতা লেখার মত নানা রকম মানুষের নানা রকম জীবনের নানা রকম প্রিয় একাগ্রতার নিবেদনের ঐকান্তিকতার জিনিসের মত তাহ’লে তিনি তা বুঝবেন সব; কিন্তু মদ খেয়ে তাঁকে আমি কি বলব?

    —এটা মদ খাওয়া নয়।

    —কেন?

    —এক গ্লাস তো খাচ্ছেন শুধু।

    —যদি ভালো লাগে?

    —আর এক গ্লাস চাইবেন?

    —চাই যদি।

    —আপনাকে দেব না আমি আর—

    —কিন্তু এইকুটুই বা কেন দাও পূর্ণিমা?

    —এতে আপনার লোভ বেড়ে যাবে মনে করেন?

    —কত রকম কি হতে পারে—

    —এত বড় হলেন-কিন্তু মদ নিয়ে কেউই কি কোনো দিন আপনাকে সাধে নি?

    —সেধেছে—

    —তবে?

    —কিন্তু মেয়েমানুষ তো কোনোদিন সাধে নি —

    পূর্ণিমার মুখ দু’এক মুহূর্তের জন্য ছাইয়ের মত সাদা হয়ে গেল—

    অজিতের চোখ পূর্ণিমার মুখের দিকে ছিল না-সে মাটির দিকে তাকিয়ে ভাবছিল—

    একটু পরে অজিত বললে—সকলকেই আমি অগ্রাহ্য করেছি, কিন্তু তুমি যদি আর একটু বেশি সাধ তাহ’লে অনেক কথাই আমার মনে পড়তে থাকবে-ওমর খৈয়াম-সাকী—জীবনের নশ্বরতা-মেয়েমানুষের রূপ-ভালোবাসা-আর্টিস্টের অধিকার—কত কি-তার পর একটা গেলাস শুধুই নয়-সমস্ত বোতলটাই আমি শেষ করে ফেলব-তোমার অনুমতি নিয়েই-তোমার চোখের সামনেই—

    পূর্ণিমা পাথরের মত নিষ্প্রাণ হয়ে রইল—

    —এমন তুমি অনেককে খেতে দেখেছ, না?

    পূর্ণিমা কোনো কথা বললে না।

    অজিত বললে—তুমি কি মনে কর পূর্ণিমা?

    পূর্ণিমা কোনো উত্তর দিল না।

    অজিত ছোট ছেলের মত বায়না ধর বললে—বল তুমি কি মনে কর।

    পূর্ণিমা পীড়িত ভাবে বললে—কিসের কথা অজিতবাবু—

    অজিত বললে—তুমি বললে, আপনি এত বড় হয়েছেন অজিতবাবু-তবুও কেউ আপনাকে সাধে নি? আমি বললাম কোনো মেয়েমানুষ আমাকে মদ নিয়ে সাধে নি পূর্ণিমা, কিন্তু তোমার মত মেয়েমানুষ যদি সাধাসাধি করে তাহ’লে আমি উপেক্ষা করতে পারব না। অজিত একটু থেমে বললে—তারপর আমার যে নতুন জীবন আরম্ভ হবে তুমিও সেটাকে উপেক্ষা করবে না—

    —কেন উপেক্ষা করব?

    —বরং সেই জীবনটাকে তোমার ভালো লাগবে আরো?

    পূর্ণিমা কোনো জবাব দিল না। নারী সে; লজ্জা পাচ্ছিল—

    অজিত বললে—তুমি তো খাও?

    —খাই

    —কবের থেকে -বছর দুই

    —খুব বেশি খাও?

    —না

    —কতটুকু খাও?

    –না

    —এক আধ গেলাস-কিম্বা দুই-আড়াই—

    বলতে বলতে পূর্ণিমা সঙ্কোচে মুখ নত করল।

    অজিত বললে—রোজ?

    পূর্ণিমা কোনো জবাব দিল না।

    অজিত বললে—লোকজনের সঙ্গে মিশে

    পূর্ণিমা বললে—এ রকম কেন জিজ্ঞেস করলেন আপনি!

    অজিত পূর্ণিমার প্রাঙ্গণের একটা জামীর গাছের দিকে নিঃশব্দে তাকিয়ে ছিল—

    পূর্ণিমা বললে—আমার ঘরে এসে বসেছেন বলেই নানা রকম অধিকার আপনার জন্মায় নি—

    এমনি করেই মেয়েটি নিজের লজ্জা চাপতে চাইল।

    কিন্তু লজ্জার বিশেষ কোনো কারণ ছিল না তো তার। সে অভিনয় করেছে, ভেবেছে দু’এক গ্লাস খেলে অভিনয় তার সফল হবে, কিম্বা বন্ধুবান্ধবদের মাঝখানে বসে দু’এক গ্লাস খেলে সকলে তাকে সেয়ান মনে করবে-এই শুধু, যাতে চোখে কালি পড়ে, মুখ চুন হয়ে যায়, শরীর ঘামাতে থাকে নিঃশ্বাস রক্তের মত গরম বোধ হয়-জীবনের বা হৃদয়ের সে সব লালসা ও খেদের নিষ্ফলতার থেকে এই দিব্যি চেহারার নারীটি ঢের দূরে। সে ঢের মূল্যবান-এত মূল্যবান যে অজিতের সঙ্গেও অনেক সময় সম্ভ্রম রক্ষা করে চলাই সে ঠিক মনে করে-অন্যদের সঙ্গে সে সম্ভ্রমের এক তিলও সে খোয়াতে যায় নি। কেন যাবে? (সে অভিনয় করতে এসেছে-কোনো অবান্তর আরাধনা করতে আসে নি তো।)

    কিন্তু তবুও নারী সে;-তার লজ্জা করছিল-বিশেষত অজিতের কাছে। যে লোকটা জীবনে এক গ্লাস মদও খয় নি-অথচ এত বড় হয়েছে-এত ভালো অ্যাক্টও করতে পারে-থিয়েটারে এল-তবুও মদের গেলাসের সম্ভাবনা দেখে যে মানুষ তার মায়ের কথা পাড়ে তার কোনো নাড়ীনক্ষত্র বুঝতে পারছিল না যেন পূর্ণিমা-নিজের নারীত্ব তার কেমন গুমরে উঠছিল যেন; অজিতকে শোনাতে গিয়ে নিজেই নিজের গলার সুরে কি যেন শুনতে পেল সে-লজ্জা পেল—

    অজিত বললে—আমি এক সময় কবিতা লিখতাম—

    পূর্ণিমা স্নিগ্ধ কথার সুরে বললে—কবিতা লিখতেন?

    —হ্যাঁ, পূর্ণিমা, ঢের কবিদের সঙ্গে মিশবারও সুযোগ হয়েছিল। অনেকের চেয়েই আমি ভালো লিখতাম বলে আজো বোধ করি কিন্তু তাদের একটা বিশেষত্বকে আমি কিছুতেই আয়ত্ত করতে পারি নি।

    —কি অজিতবাবু?

    —তারা ভাবত এই যে যখন তারা মিল দিয়ে কবিতা লিখতে শিখেছে তখন তাদের জাত বদলে গেছে, অন্যরা যেখানে একটি স্ত্রী নিয়ে রয়েছে সেখানে দশটি মেয়েমানুষ নিয়ে তাদের থাকতে হয়, অন্যরা যেখানে জল চায় সেখানে তাদের মদ না হ’লে চলে না, অন্যরা যেখানে চুল ছাটে সেখানে তাদের বাবরি কাটা চাই-এই সব আর কি—

    পূর্ণিমা চুপ করে শুনেছিল।

    অজিত বললে—আচ্ছা ভূয়ো কবিদের কথা না হয় ছেড়েই দিলাম, সত্যিকার কবি হ’লেও বড় বড় চুল রাখতে হবে? মদ খেতে হবে?

    পূর্ণিমা ফাঁপড়ে-পড়া ভাবে অজিতের দিকে তাকাল।

    অজিত হেসে বললে—বল তো পূর্ণিমা?

    —আপনিই তো জানেন—

    —কবিত্বের সঙ্গে লম্বা চুল বা মদের কোনো সম্পর্ক নেই।

    —আমারও তাই মনে হয়-কিন্তু লোকে তো বিশ্বাস করে আছে—

    —দু’লাইন মিল দিয়ে মদ খাবার নিরঙ্কুশ অধিকার এক এক জনের জন্মায়-তার কবিপ্রতিভাও সাব্যস্ত হয়ে যায়—কিন্তু গণিতের প্রতিভা নিয়ে যে লোকটা নব নব আবিষ্কারে মেতে আছে তার লম্বা চুল মানুষের উপহাসের জিনিস—মদ খাওয়াটাও অত্যন্ত দুনীর্তি অত্যন্ত অধঃপতন। কিন্তু সুবিধে এই যে লোক আমাদের চেয়ে মাথা ঢের ঠিক রাখে-মদ খেতেও যায় না, চুলও ছাটে-একটি স্ত্রী নিয়েও কিম্বা মেয়েমানুষবিহীন হয়েও প্রতিভার স্ফুরণে বিশেষ কিছু বাধে না তার-তার প্রতিভার কবিত্বের দিকটাও দু’লাইনের মিলের চেয়ে ঢের বেশি গভীর-কিম্বা আমাদের অনেক নটের চেয়েও খাঁটি নটরাজের তালে তালে ঢের বেশি সিদ্ধ হৃদয়ঘোরে চলেছে—

    পূর্ণিমা চুপ করে রইল।

    অজিত বললে—অঙ্ক জ্যামিতি জ্যোতিষ বিজ্ঞান মীমাংসা ন্যায় এই সব নিয়ে যাদের প্রতিভা ফুটে উঠছে তারাও নটরাজের বন্ধু-তারাও কবি-কিন্তু মদ বা লম্বা চুলের প্রয়োজন তারা বোধ করে না—আমরাই বা কেন বোধ করব? আমাদের এ আনুষঙ্গিকগুলোর কি প্রয়োজন আছে? কবিতা লিখতে গিয়ে, গান গাইতে গিয়ে কিম্বা অভিনয় করবার সময় ছবি আঁকবার সময় ব্রান্ডি ঝাকড়া চুল বা উচ্ছৃঙ্খলতার কি প্রয়োজন? কিন্তু আমি ভেবে অবাক হয়ে যাই যে এক এক জন সত্যিকার কবি বা নাট্যপ্রতিভাও এ জিনিসগুলোকে তাদের অন্তরের জীবনের পক্ষেও এমন দরকার মনে করে।

    অজিত বললে—এ রকম নির্বোধ কি করে হওয়া যায়?

    অজিত বললে—এ ঘোর কেন তাদের কাটে না?

    অজিত বললে—এর চেয়ে মদের রসের জন্যই যারা মদ খায় কিম্বা মেয়েমানুষ ভালো. লাগে বলেই নিরবচ্ছিন্ন উপভোগ করে চলে তারা ঢের বাস্তব।

    পূর্ণিমা বললে—ঠিক তাই। কিন্তু যে ভড়ং দিয়েই শুরু করুক না কেন, কবি গুণী যাই বলুক না কেন অজিতবাবু শেষ পর্যন্ত রসের জন্যই খায় তারা-সব করে—

    —তখন আর ভড়ং থাকে না!

    —না। একটা বাস্তব দরকার হয়ে পড়ে।

    —তোমারও তাই হয়েছে নাকি!

    —এখনও হয় নি—

    —কিন্তু হতে পারে?

    —বলতে পারি কি অজিতবাবু?

    —কিন্তু অভিনয়কেই তুমি সব চেয়ে ভালোবাস না পূর্ণিমা

    —তাই তো বাসি—

    —যে জন্য তুমি ভদ্রঘরের মেয়ে হয়েও অনেক লাঞ্ছনা সহ্য করছ—

    —হ্যাঁ, অজিতবাবু—

    —তোমার শিক্ষাদীক্ষা এত রূপ এত গুণ তোমাকে মানুষের জীবনের চলতি পথের কত সুখ সম্মান সাধের দিকে নিয়ে যেতে পারত। পূর্ণিমা-কিন্তু স্টেজকে ভালোবেসেই তুমি এলে-কাজেই এ তোমার সুখের নয় সংগ্রামের জায়গা-আরাম নয় নিবেদনের স্থল হয়ে উঠল—কিন্তু পূর্ণিমা—

    অজিতের গলা ভারী হয়ে উঠল।

    তিন চার মিনিট চুপ করে রইল সে—

    পূর্ণিমা বললে—কি ভাবছেন?

    অজিত একটু হেসে বললে—তোমার এই নিবেদনের মূর্তিটি চিরদিনই রেখো। কোনো কিছুই যেন একে কোনোদিন পশু না করে ফেলে—

    পূর্ণিমা হাসতে হাসতে বললে—আপনি ভয় পাচ্ছেন মদ খেয়ে আমি বুঝি বা নষ্ট হয়ে যাই—

    অজিত ব্যথা পেয়ে বললে—থাক এ কথা—

    —কিন্তু আমার বিশ্বাস হয় না—

    —কি?

    —যে মদ খেয়ে বা অত্যাচার করে প্রতিভা খরচ হয়ে যায়—

    —তা যায়।

    —আপনি জোর করে কেন বলেন?

    —জোর নয়।

    —কিন্তু আমি ঢের শুনেছি-আমি নিজেও জানি যে আমি এক আধ গ্লাস খেয়ে স্টেজে যখন উঠি তখন আমার (…) খুলে যায়। ও না হলে আমি হাঁপিয়ে উঠতাম—

    অজিত নিস্তব্ধ হয়ে রইল।

    পূর্ণিমা বললে—এ প্রয়োজন আমার বেড়ে চলে যদি-আমার মনে হয় ক্রমে ক্রমেই বেড়ে যাবে-বাড়ছে যেন—

    অজিত অত্যন্ত বিচলিত হয়ে বললে—কি?

    —এ আমার প্রয়োজন যে—

    —আমিও তো অ্যাক্ট করি—

    —কিন্তু আপনার মত ভাগ্যবান আমি তো নই—

    —তোমার ঢের সম্পদ আছে পূর্ণিমা-তুমি এ আর কোরো না—

    —কিন্তু স্টেজে উঠে গুলিয়ে যায় যদি সব।

    —মদ না খেলে?

    —হ্যাঁ অজিতবাবু—

    —বরং নেমে খেও-বা অন্য সময়ে এক আধটু খেও-এতে এ অভ্যাসের দৃঢ়তা কমে — যায়—

    —তা হবে না।

    —কেন?

    —বড্ড নার্ভাস হয়ে পড়ি—

    —এ তোমাকে কে শিখিয়েছে?

    —প্রথম দু’চার রাত এমন ভালো অ্যাক্ট করলাম-কোনো ভুল হ’ল না। ভয় ভেঙে গেল—একটা সার্থকতা পেলাম-তখনই এই প্রবৃত্তি জাগল আমার। এতে জিনিসটা এমন সহজ হয়ে গেছে—

    —সহজে হয়ে যায়?

    —হ্যাঁ

    —তাহ’লে আমিও খেতে আরম্ভ করব পূর্ণিমা?

    পূর্ণিমা শঙ্কিত হয়ে উঠে বললে—আপনার কি দরকার? আপনার জন্মগত ক্ষমতার কাছে এ সব জিনিসের তো কোনো প্রয়োজন নেই।

    অজিত অবসন্ন হযে হেসে বললে—জন্মগত ক্ষমতা! প্রতিটি রাতের জন্য আমার কত কষ্ট পেতে হয় তা তুমি জান কি পূর্ণিমা—

    —আপনার দুটি পায় পড়ি-তাই বলে এ সব করবেন না।

    অজিত হাসতে হাসতে বললে—আচ্ছা, এখন তো এক গ্লাস ঢাল।

    —আপনার দুটি পায় পড়ি, চাইবেন না আপনি—

    —দুটি পায়! কিন্তু আমি একটা বোতল কিনে নিয়ে নিজের ঘরে বসে খাই যদি—

    –তাহ’লে আমি সব ছেড়ে দেব—

    —মদ?

    —এ স্টেজ এ অভিনয়-যাকে আমার নিবেদনের জীবন বলেছেন আপনি সব ছেড়ে দিয়ে চলে যাব—

    অজিত হাসতে হাসতে বললে—অত বাড়াবাড়ি কেন করবে?

    পূর্ণিমা বললে—সব ছেড়ে দিয়ে যখন এখানে চলে এলাম তখনও তো বাড়াবাড়িই করেছি।

    –তাই তো।

    —আবার যদি তেমনি তাগিদে চলে যাই।

    —আমি মদ খেলে তাগিদটা তত বড় হবে?

    -হ্যাঁ

    —একটা সামান্য মদ খাওয়ার ব্যাপার শুধু—

    —মদ খাওয়ার ব্যাপার শুধু নয়।

    —তবে?

    —আপনার মদ খাওয়া।

    অজিত হাসতে লাগল—

    হাসতে হাসতে বললে—এতে তো আমার অধিকার আছে—

    পূর্ণিমা বললে—আপনার?

    —হ্যাঁ, আমি কবি ছিলাম-এখন গুণী হয়েছি-লোকেও তো আমাকে সমর্থন করবে।

    অজিত একটু থেমে বললে—হয়তো আমার কাছ থেকে এ জিনিস প্রত্যাশাই করবে তারা। আমি কবি ছিলাম-গুণী হয়েছি—তুমি চুপ করে আছ কেন পূর্ণিমা? আমার অদিকার নেই?

    —আছে বৈ কি।

    —তবে?

    —আপনার অধিকারের প্রতিবাদ আমি করব না, কিন্তু আপনার মাকে আপনি কি বলবেন?

    —হাঃ হাঃ……মা?

    —কি বলবেন তাঁকে আপনি?

    —বলবার কি দরকার আর?

    —কিছুই বলবেন না?

    —না।

    —কেন?

    —মানুষের জীবন ক্রমে ক্রমে তার নিজেরই জিনিস হয়ে দাঁড়ায়-কোনো শ্রদ্ধা মমতা ভালোবাসার সঙ্গে বাঁধ আর তেমন কঠিন হয়ে থাকে না, ঢিলে হয় খসে যায়। যা তার ভালো লাগে তা সে করে-এরই ভিতর থেকে তার নবীন ভালোবাসা শ্রদ্ধা ও মমতার জন্ম হয়—

    এখন আমি অভিনয়কে শ্রদ্ধা করি—চুরুটের প্রতি মমতা-কাকে ভালোবাসি আজো তা বুঝি না—

    পূর্ণিমা বললে—কিন্তু মানুষের শ্রদ্ধা মমতা ভালোবাসা মোচড় দিয়ে ধীরে ধীরে আবার সেই পুরোনো জিনিসগুলোতেই গিয়ে বাঁধা পড়ে।

    —ওঃ-পড়ে না কি?

    —হ্যাঁ

    —কি করে বুঝলে তুমি?

    —মানুষ শেষ পর্যন্ত এই পুরোনো জিনিসগুলোকে কিছুতেই ছাড়াতে পারে না; যে জিনিস যত পুরোনো তাকে ভোলা ততই কঠিন-যতই দিন বাড়ছে ততই বুঝছি—

    —তোমারও তোমার মাকে মনে পড়ে?

    —মাকে বাবাকে।

    —বেঁচে আছেন আজো?

    —হ্যাঁ

    —তুমি বাংলা অক্ষর প্রথম লিখলে কোথায়?

    —মেমের স্কুলে।

    —মেমের স্কুলে? ফ্রক পরতে?

    —হ্যাঁ

    —খুব ছোট্ট মেয়ে ছিলে?

    —ছিলাম বৈ কি।

    —দেশের নাম কি?

    —হিজলডাঙা

    —হিজলডাঙা! বা পৃথিবীতে এমন সুন্দর নামও আছে পূর্ণিমা? এ দেশ বাস্তবিকও কোথাও আছে-না একটা স্বপ্নের কথা বলছ তুমি? অনেক হিজল আছে সেখানে?

    —আছে বৈ কি—

    —কত দিন হিজল গাছ দেখি নি-ছাতিম দেখি নি-মাছরাঙা দেখি নি—তুমিও তো দেখ নি-এ সবের জন্য দুঃখ হয় না তোমার

    —হয় বৈ কি-এক এক দিন রাতে ঘুম ভেঙে যায়-ঝর ঝর করে বৃষ্টি পড়তে থাকে-এমন একা লাগে-আপনি যে আত্মনিবেদনের মূর্তির কথা বলেছেন তাকে এমন হৃদয়হীন জন্তু বলে মনে হয়-আমি সব ছেড়ে দিয়ে আমার হিজলডাঙায় চলে যেতে চাই

    অজিত উঠল—

    পূর্ণিমা কাতর হয়ে বললে—বাঃ হিজলডাঙার কথা পেড়ে আপনি বিদায় নেবেন?

    -হিজলডাঙার সঙ্গে আমার কি?

    —কৈ আমার দেশের কথা এত দিন এমন ভালোবেসে জিজ্ঞেস করে নি তো কেউ! হিজলডাঙা নামের যে মধুরতা সে আমার নিজেরই জিনিস ছিল-আপনি এ সব বুঝলেন কি করে অজিতবাবু? কেন আপনি জিজ্ঞেস করলেন সে সব মধুর গাছপালা মানুষ ছায়া নিস্তব্ধতার কথা মনে করে আমার দুঃখ করে কিনা? আপনি এ সব বোঝেন কি করে? আমি ভেবেছিলাম আমার এ পাড়াগাঁকে আমি ছাড়া কেউ ভালোবাসে না-তার রূপও কেউ বোঝে না, আপনি এসে বললেন-কত দিন হিজলের ফুল দেখি, নি-তাই তো—এত সব ধরা পড়ে আপনার হৃদয়ে?

    অজিত এ সব কথার কোনো উত্তর না দিয়ে বললে—তারপর তুমি বড় হ’লে-কলকাতার কলেজে পড়তে এলে। অনেক শিক্ষাদীক্ষা পেলে তুমি-আমাদের স্টেজের পক্ষে এ খুব মূল্যবান জিনিস হ’ল-এমনটি হয় নি কোনো দিন-কে জানে আর কত দিন পরেই বা হবে। তোমার এই নিবেদনের মূর্তিকে সব সময়ই মনে রেখো পূর্ণিমা-আমিও মনে রাখব।

    আজ আমাদের আর কোনো কথা নেই।

    অজিত উঠে চ’লে গেল।

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleজিম করবেট অমনিবাস (অখণ্ড) – মহাশ্বেতা দেবী সম্পাদিত
    Next Article কল্যাণী – জীবনানন্দ দাশ

    Related Articles

    জীবনানন্দ দাশ

    ঝরা পালক – জীবনানন্দ দাশ

    August 14, 2025
    জীবনানন্দ দাশ

    ধূসর পাণ্ডুলিপি – জীবনানন্দ দাশ

    August 14, 2025
    জীবনানন্দ দাশ

    বনলতা সেন – জীবনানন্দ দাশ

    August 14, 2025
    জীবনানন্দ দাশ

    মহাপৃথিবী – জীবনানন্দ দাশ

    August 14, 2025
    জীবনানন্দ দাশ

    সাতটি তারার তিমির – জীবনানন্দ দাশ

    August 14, 2025
    জীবনানন্দ দাশ

    শ্রেষ্ঠ কবিতা – জীবনানন্দ দাশ

    August 13, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }