Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    জীবনে-সমাজে-সাহিত্যে – আহমদ শরীফ

    আহমদ শরীফ লেখক এক পাতা গল্প243 Mins Read0
    ⤷

    একটি প্রত্যয়ের পুনর্বিবেচনা

    একটি প্রত্যয়ের পুনর্বিবেচনা

    উনিশ শতকের য়ুরোপে জাতীয়তাবাদ যখন উগ্ররূপ ধারণ করতে থাকে তখন কয়েকটি আনুষঙ্গিক চিন্তাও জাতীয়তাবাদীর মনে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। সেগুলোর মধ্যে তিনটে প্রধান–স্বতন্ত্র ঐতিহ্যের সন্ধান ও সৃজন, স্বতন্ত্র সংস্কৃতির রক্ষণ ও উদ্ভাবন, এবং সাহিত্যিক স্বাতন্ত্র অর্জন।

    সাহিত্যের ব্যাপারে সমাজবাদীদের আগ্রহ আরো এক ধাপ এগিয়ে যায়। তারা গণসাহিত্য সৃষ্টির গরজে লোক-সাহিত্যে ও লোক-ঐতিহ্যে অসামান্য গুরুত্ব আরোপ করতে থাকে। নিতান্ত কৌতূহলের আনন্দে যে Folklore-এর চর্চা শুরু হয় শতেক বছর আগে, তা-ই সামাজিক রাজনীতিক মতবাদ দৃঢ়মূল করবার অবলম্বন হয়ে উঠল। আবার সমাজ, সংস্কৃতি ও নীতিবোধের বিবর্তন ধারার ইতিহাসের উপকরণ-উপাদান হিসেবেও Folklore গুরুত্ব পাচ্ছে। আইরিশ, ইসরাইল ও নিগ্রো জাতীয়তা যেমন স্বদেশী ভাষা, ঐতিহ্য ও লোকসাহিত্য অবলম্বন করে বিকাশ কামনা করছে, সমাজ-বিজ্ঞানী এবং ঐতিহাসিকরাও তেমনি Folklore-কে মানব-সভ্যতার ইতিহাস রচনার উপকরণ ও মানব-প্রকৃতি ব্যাখ্যার অবলম্বন করেছেন। কাজেই লোক-ঐতিহ্য ও লোক-সাহিত্য তথা Folklore আজ মানবিক প্রগতির উপকরণ ও উপায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

    অতীতকে অতীতের নিরিখে যাচাই করা ও প্রত্যক্ষ করা সদ্বুদ্ধিজাত সদুপায়, সন্দেহ নেই। কিন্তু অতীতকে বর্তমানের ও ভবিষ্যতের পুঁজি করার মধ্যে বুদ্ধিমত্তা কিংবা কল্যাণ নেই–আছে অন্ধ আবেগ যা আপাতদৃষ্টে কেজো বটে, কিন্তু পরিণামে রক্ষণশীলতা ও সংস্কারাচ্ছন্নতার জনক। কেননা, পুরাতনে আসক্তিহীনতা এবং পরিহার-সামর্থ্যই অগ্রগতির স্বাভাবিক সদুপায়। জাতীয় জীবনের জাগরণ মুহূর্তের আবেগ, উৎসাহ ও কর্মোদ্যমকে পুরাতনের প্রেরণা বলে ভুল করার ফলেই পুরাতনকে জীবন-প্রয়াসের মহিমান্বিত উৎস বলে প্রতীতি জন্মায়। পুরাতনের অঙ্গীকারে নতুনের জন্ম-প্রত্যাশা স্ববিরোধী অদ্ভুত চিন্তার প্রসূন। পুরাতনে আস্থাহীনতাই বরং ভবিষ্যতে নতুন প্রত্যয় লাভের সহজ উপায়।

    ঐতিহ্য প্রেরণার উৎস বলে চালু কথাটির তাৎপর্য কিন্তু ভিন্ন। যে ভাব-চিন্তা-কর্ম-আচরণ অতীতে ব্যক্তিক কিংবা জাতীয় জীবনে কল্যাণ ও সাফল্য এনেছে, তা-ই ঐতিহ্য। দেশকালের প্রেক্ষিতে যা সেদিন মঙ্গলকর ও ফলপ্রসূ ছিল, পরিবর্তিত পরিবেশে তা অহিতকর এবং নিষ্ফলও হতে পারে। কাজেই ঐতিহ্যের অবলম্বন মানে তার অনুকরণ নয়, তার নব রূপায়ণ নয়, তার আশ্রয় গ্রহণ নয়, নয় তার প্রশ্রয় কামনাও, বরং প্রয়োজন ও পরিবেষ্টনীর দিকে দৃষ্টি রেখে হিতকর ও ফলপ্রসূ উপায় গ্রহণ ও রীতি-পদ্ধতির প্রবর্তন। কখন, কী অবস্থায়, কোন্ সঙ্কটে কিংবা সৌভাগ্যে কেমন করে কী করা হয়েছিল তা কিভাবে ব্যক্তিক, পারিবারিক অথবা জাতীয় জীবনকে রক্ষা ও ঋদ্ধ করেছিল, তা স্মরণ করার নামই ঐতিহ্য-চেতনা। অতএব ঐতিহ্যের অনুরণন-অনুসরণ বাঞ্ছনীয় হতে পারে, কিন্তু অনুকরণ কিংবা রূপায়ণ কখনো কাম্য নয়। তাছাড়া অতীতে যারা আমাদের জন্যে ঐতিহ্য সৃষ্টি করেছেন তারাও একে নিত্যকালের জন্যে ধরে রাখেননি। তাঁরা নতুন নতুন ঐতিহ্য সৃষ্টি করেছেন আমাদের জন্যে তাঁদের প্রাত্যাহিক ভাব-চিন্তা-কর্ম ও আচরণের মাধ্যমে। একবারের সৌভাগ্যের ও সাফল্যের উপায়কে তারাও চিরকালের উপায় বলে গ্রহণ করেননি। তাই ঐতিহ্যমাত্রই অতীতের। সেই পরিত্যক্ত রীতি-পদ্ধতি ও কর্মচিন্তা লোকস্মৃতির প্রশ্রয়ে কিংবদন্তির আশ্রয়ে বেঁচে থাকে কালান্তরে। স্রষ্টারই পরিত্যক্ত সামগ্রীকে তার উত্তর পুরুষেরা মহামূল্যজ্ঞানে যদি পাথেয়রূপে জীবনযাত্রায় প্রয়োগ করে, তাহলে তাদের চলা চক্রের আবর্তন বই কিছুই নয়। ব্যবসায় মূলধন যেমন উপার্জনের ভিত্তি, ঐতিহ্যের পুঁজিও তেমনি অগ্রগতির সহায়। মূলধনে হাত পড়লে ব্যবসা টেকে না, তেমনি ঐতিহ্য আঁকড়ে বসে থাকলেও গতি হয় রুদ্ধ।

    আবার উদ্যমহীন নিষ্কর্মার ঐতিহ্যপ্রীতি ও ঐতিহ্যর্গব আরো মারাত্মক। ধনী-সন্তানের সম্পদ চেতনা যেমন, ঐতিহ্যগবীর গৌরব-স্মৃতিও তেমনি তৃপ্তমন্যতা জাগায়, যা প্রয়াসহীন জীবন যাপনে উৎসাহিত করে। তৃপ্তমন্য গৌরব-গী পরিবার কিংবা জাতির পতন অনিবার্য। অভিজ্ঞতা ও ইতিহাস–দু-ই এই আপ্তবাক্যের যাথার্থ্য সমর্থন করে।

    নিজের ভাব-চিন্তা প্রকাশের জন্যে মানুষ যখন তার চারপাশে কোনো আধার বা অবলম্বন খুঁজে পায় না, তখন সে অতীতের দিকে ফিরে তাকায়; অতীতের ঘটনা, চিন্তা বা কাহিনী সে উপস্থাপিত করে বর্তমানের ভাব-চিন্তা প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে এবং উপমা রূপক ও উৎপ্রেক্ষারূপে অথবা কাহিনীরূপে ব্যবহৃত হয়ে তা ভাবকল্প ও চিত্রকল্পের অবয়বে তখন আত্মপ্রকাশ করে। অতীতকে এভাবে বর্তমান করে তোলাতে দোষ নেই। কিন্তু বর্তমানকে স্বকালে, স্বস্থানে ও স্বরূপে খুঁজতে না-জানার অসামর্থ্যের কিংবা বর্তমানকে দিয়ে বর্তমানের ভাব-চিন্তা প্রকাশের অক্ষমতার স্বাক্ষর থাকে। কাজেই ঐতিহ্য-নির্ভরতা বর্তমান অবস্থার পরোক্ষ প্রকাশের বাহন মাত্র–প্রত্যক্ষ অভিব্যক্তির উপায় নয়। অতএব সাহিত্যশাস্ত্রবিদ যখন বলেন :

    An Artist of the first rank accepts tradition and enriches it, an artist of the lower rank accepts tradition and repeats it, and artist of the lowest rank rejects tradition and strives for originality. (Sampson)

    তখন কথাগুলো শুনতে চমকপ্রদ বটে; কিন্তু সত্যের বিপরীত। যেমন ঔপন্যাসিক তাঁর চারদিকে কোনো উপকরণ যখন খুঁজে পান না, তখন তিনি ঐতিহাসিক উপন্যাস লিখে আনন্দিত হন।

    অপরের সৌভাগ্যে ও পীড়নে যারা ঈর্ষ ও ক্ষুব্ধ অথচ অসহায় ও অক্ষম, তাদের চিত্তে জন্ম নেয় Revivalism-এর স্বপ্ন। তাদের বর্তমান অযোগ্যতা তাদেরকে অতীত গৌরবগবী করে তোলে। তাতে তারা বর্তমানের আত্মগ্লানি ও আর্তনাদ গৌরবময় ঐতিহ্যের আস্ফালনে ঢাকা দিতে চায়। বর্তমান দীনতার দুঃখ-লাঞ্ছনা ভুলবার উপায় হিসেবেই ঐতিহ্যের আশ্রয়ে তারা প্রবোধ ও প্রশান্তি খোঁজে। উপার্জনে অক্ষম ব্যক্তির যেমন পিতৃসম্পদেই ভরসা ও নির্ভরতা, Revivalism এ আসক্তিও অনেকটা সেইরূপ। অতএব Revivalism অক্ষমের সান্ত্বনা। পুরাতনকে পুনরুজ্জীবিত করার আগ্রহের মধ্যেই রয়েছে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে প্রত্যাশাহীনতা। বর্তমানে কিছু করবার নেই, ভবিষ্যতে কিছু পাবার কিংবা হবার নেই–এমনি প্রতায়হীনতাই মানুষকে করে অতীতমুখী। তাদের চোখে পৃথিবী যেন সহসা এক জায়গায় আকস্মিকভাবে স্তব্ধ ও স্থবির হয়ে যায়। তার গতিপ্রবাহ যেন চিরকালের জন্যে থেমে গেল, যেমন এগুবার আর উপায়ও নেই, প্রয়োজনও নেই। কাজেই বর্তমানে না কুলায় তো অতীতের সঞ্চিত সম্পদ কাজে লাগাও, দুর্দিনের সম্বল কর। কেননা অতীতের সে-পরিবেশে আমাদের পূর্বপুরুষ একদিন স্বগৌরবে, স্বশক্তিতে ও স্বমহিমায় বেঁচেছিলেন–কাজেই অতীতের সেই কোটরই অভয়-শরণ –তখন এমনি অপবুদ্ধি মনে সহজেই জাগে। Revivalism-এ মনের বিকাশবিস্তার হওয়া তাই অসম্ভব।

    মানুষের চোখ দুটো যখন সম্মুখেই স্থাপিত আর পায়ের পাতাও সামনের দিকেই প্রসারিত তখন বুঝতে হবে–মানুষের সম্মুখদৃষ্টি আর অগ্রগতিই ছিল বিধাতার অভিপ্রেত। কাজেই পিছুহঠা বিকলাঙ্গ অন্ধের অনাচার মাত্র।

    বর্তমানে উৎকৃষ্টতর কিংবা যোগ্যতর কিছু না পেলে অথবা ভবিষ্যতে পাবার আশা বা বিশ্বাস না জাগলে কেউ অতীতকে পরিহার করে না। কাজেই পরিত্যক্ত অতীতের ভাব-চিন্তার সামগ্রীমাত্রই বর্তমান ভাব, চিন্তা ও কর্ম থেকে নিকৃষ্ট কিংবা অপূর্ণ। কেননা মানুষের অভিজ্ঞতা ও প্রয়াস মানুষের নৈপুণ্য বৃদ্ধি করছে–সামগ্রিকভাবে তার মানসিক ও বৈষয়িক জীবন প্রতি মুহূর্তে উৎকর্ষ লাভ করছে। এজন্যেই তো বলা হয়েছে অতীতের চেয়ে নিশ্চয় ভালো হবে রে ভবিষ্যৎ। পুরোনো জীবনযাত্রার কোনো অবলম্বনই আমাদের শ্রদ্ধা জাগায় না, চরম তাচ্ছিল্যে পরিহার করি সেসব, কেননা সেগুলো উপযোগ হারিয়েছে। অথচ পুরোনো কালের ভাব-চিন্তা-আদর্শ-বিশ্বাস সংস্কারেরই কেবল উপযোগ রয়ে গেল, নিরাসক্ত মনে এ বোধ ঠাই পায় না। কিন্তু আবেগপ্রবণ মনে এ বোধের প্রভাব অশেষ ও অনড়। তবু যুক্তিপ্রবণ বুদ্ধিজীবীর কাছে আবেদন করা চলে এই বলে যে,

    ছিন্নমালার ভ্রষ্ট কুসুম ফিরে যাসনে কো কুড়াতে
    ফুরায় যা–দে রে ফুরাতে

    কেননা ওতে কল্যাণ নেই।

    এখানে আইরিশ Revivalism-এর কথা কারো কারো মনে জাগতে পারে। ইংরেজের সৌভাগ্য ও পীড়নই আইরিশদের স্বাতন্ত্রকামী করেছিল। দুর্বলের স্বাতন্ত্র কামনা হীনমন্যতার এক পরোক্ষ প্রকাশ। যারা আত্মশক্তিতে আস্থাহীন অথচ মুক্তি ও স্বাচ্ছন্দ্যকামী তাদের মনেই স্বাতন্ত্র্যবোধ প্রবল হতে থাকে। এবং যেহেতু নিজে সামর্থ্যহীন তাই অতীত সামর্থ্যের সঞ্চয়কে সম্বল করে সে নিজেকে ভাবে ঋদ্ধ ও সম্মানিত। এখন আমার কিছু নেই বটে, কিন্তু কী না ছিল আমার এককালে–এমনি একটা বোধের আশ্রয়ে সে আত্মস্থ হতে চায়, জাগ্রত করতে চায় আত্মসম্মানবোধ। আসলে সে মনকেই চোখ ঠাওরায় এভাবে। কেননা তার মধ্যে সদাজাগ্রত আকাঙ ক্ষা ও উদ্যমই তাকে শক্তি দান করে মুক্তিলাভের–প্রেরণা দেয় সংগ্রামের। সে মনে করে–বুঝি এসব ঐতিহ্য-চেতনা ও স্বাতন্ত্র-বুদ্ধির দান। কিন্তু তা যে নয়, তার প্রমাণ আজকের প্রগতিশীল বিজ্ঞান ও যন্ত্রজীবনের সঙ্গে সম্পর্ক বিরহিত হয়ে সেও টিকতে পারে না–পারে না এগুতে। সে বেঁচে আছে বর্তমানকে বরণ করেই, অতীতকে ধরে নয়।

    স্বাতন্ত্রকেও তার স্বরূপে গ্রহণ করা উচিত। যোগ্যের উৎকর্ষই তার স্বাতন্ত্র। কেবল অযোগ্যরাই আত্মসংকোচনকে স্বাতন্ত্র মনে করে আত্মপ্রবোধ ও আত্মপ্রসাদ লাভ করে। সবলের স্বাতন্ত্র আত্মপ্রসারে ও আত্মপ্রভাব বিস্তারে প্রবর্তনা দেয়। আর দুর্বলের স্বাতন্ত্র্যবোধ ছোঁয়া ও প্রভাব এড়িয়ে চলার আগ্রহ জাগায়। দুর্বলের এ পদ্ধতি কেবল হীন ও নির্বোধের কাজেই প্রশংসনীয়।

    কেউ কেউ য়ুরোপীয় রেনেসাঁসে রিভাইভেলিজমের লক্ষণ খুঁজে পান। রেনেসাঁস কোনো একদিনের ব্যাপার ছিল না। আড়াইশ বছরের পরিসরে তার উন্মেষ, বিকাশ ও পরিণতি ঘটেছে। ইতিমধ্যে য়ুরোপে ভাঙা-গড়ার বহু ও বিচিত্র আন্দোলন ও ঘটনা ঘটে গেছে, ফ্লোরেন্সের লিও নার্ডো দা-ভিঞ্চি (১৪৫২-১৫১৯) কেবল সৌন্দর্যপিপাসু চিত্রশিল্পী ছিলেন না; মনীষী, বিজ্ঞানী এবং ভাস্করও ছিলেন। মাইকেল এ্যাঞ্জেলো ছিলেন ভাস্কর ও স্থপতি। রাফেলও কেবল শিল্পী ছিলেন না, জীবন-জিজ্ঞাসুও ছিলেন। এই ফ্লোরেন্সেই জন্মেছিলেন তেরো শতকে কবি দান্তে ও চৌদ্ধ শতকে কবি পেত্রার্ক। পনেরো, ষোলো ও সতেরো শতকে নেদারল্যান্ডের মুক্তিসংগ্রাম কলম্বাস-ভাস্কো-ডা গামার সমুদ্রপথে নতুন দেশ আবিষ্কার ও অপরিমেয় ধনাগম, ফলে সামন্তসমাজে বেনে-বুর্জোয়া শ্রেণীর উদ্ভব, কৃষক-বিদ্রোহ, মুদ্রারীতির প্রসার; যাজক ও শাসকের, সামন্ত ও বুর্জোয়ার বিরোধ, Inquisition-এর বিরুদ্ধে Huss ও মার্টিন লুথারের নেতৃত্বে গণবিদ্রোহ, কোপারনিকাস-ব্রুনো গ্যালিলিওর উচ্চারিত তথ্য, ছাপাখানার প্রবর্তনে বিদ্যার বিস্তার, বাইজেনটাইন গ্রীক বিদ্বানদের য়ুরোপে পুনর্বাসন প্রভৃতির ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াই ছিল রেনেসাঁসের মূলে।

    এসব আর্থনতিক, সামাজিক, ধর্মীয়, রাজনীতিক ও কলা-বিদ্যা-জ্ঞান-চিন্তাবিষয়ক আন্দোলন বিদ্রোহ-বিপ্লব –রেনেসাঁস, রিফরমেশন ও রেভলিউশন –এ তিন শাখায় সংহত রূপ নিয়েছে ঐতিহাসিকের চোখে। এই পুনরুজ্জীবন, সংস্কার ও বিপ্লবের মূলে যে-প্রেরণা যে-উদ্যম ক্রিয়াশীল ছিল তা ছিল এক কথায় মুক্তি-অন্বেষা। পীড়ন থেকে, কুসংস্কার থেকে, বদ্ধচিত্ততা থেকে, দারিদ্র্য থেকে, অজ্ঞতা থেকে, দুর্বলতা থেকে, ভীরুতা থেকে মুক্তির অভিব্যক্ত উল্লাসের নাম রেনেসাস। সুতরাং এখানে রিভাইভেলিজমের দান কোথায়!

    মুখ্যত মুসলিমদের কনস্টান্টিনোপল বিজয়ের পর বাজেন্টাইন গ্রীকবিদ্বানেরা যখন য়ুরোপে ছড়িয়ে পড়েন, এবং টোল খুলে তারা যখন মুদ্রিত গ্রন্থের মাধ্যমে বিদ্যাবিতরণ করতে থাকেন তখন শিক্ষার আলোপ্রাপ্ত চিত্তে যে জীবন-চেতনা জাগে, সে-চেতনায় তারা জগতের ও জীবনের নতুন রহস্য আবিষ্কার করে। নতুন দৃষ্টিতে খুঁজে পায় জগৎ ও জীবনের নতুন তাৎপর্য। জানার ও পাওয়ার সে-উল্লাসই তাদেরকে নতুন ভাব-চিন্তা-কর্মে প্রবর্তনা দেয়। উপকরণ ও মাধ্যম হিসেবে তারা প্রথমে গ্রীক পুরাণকেই গ্রহণ করে এবং এভাবে তারা জীবনের সৌন্দর্য ও আনন্দকে অভিব্যক্তি দান করতে থাকে। তাদের অনুভবে তখন তাদের সমকালীন পরিবেষ্টনী তুচ্ছ ও সাময়িক। তাই তাঁদের স্বপ্নের, কল্পনার ও আর্দশের জগৎ রচনার উপকরণ হয়েছে প্যাগান ও খ্রীস্টীয় পুরাণ। এই রোমান্টিক জগৎ ও জীবন-দৃষ্টিতে যে-কৌতূহল, যে-জিজ্ঞাসা, যে-সৌন্দর্য-চেতনা, যে-শিল্পবোধ, যে-রূপানুরাগ ও যে-আত্মসচেতনতা সুপ্রকট তা নবলব্ধ চেতনা, নতুন-জাগা আকাঙ্ক্ষা, নতুন পাওয়া উদ্যম ও মুক্তি-অন্বেষারই অভিব্যক্তি। কাজেই তা প্যাগান-পুরাণ-প্রীতির ফল নয়। গ্রীক পুরাণের অপরিমেয় ও অনবরত ব্যবহার দৃষ্টিকে এতই বিভ্রান্ত করে যে আমরা অবলম্বনকে কারণ ও উপকরণকে প্রেরণার উৎস ভাবতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। এভাবে উপায়কে মনে করেছি কারণ বলে আর অবলম্বনকে জেনেছি লক্ষ্য বলে। প্রাণের প্রেরণা ও চেতনার দান রইল অস্বীকৃত ও অগোচর।

    দেশী দৃষ্টান্ত নেয়া যাক। মধুসূদন-রবীন্দ্রনাথে পুরাণের ব্যবহার প্রাচীন ভারতকে ফিরে পাবার অভিপ্রায়প্রসূত যে নয়, নতুন-জাগা চেতনা প্রকাশের মাধ্যম মাত্র, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কাজেই রিভাইভাল নয়, নবচেতনাই জীয়নকাঠি।

    কারো কারো চিন্তায় রেনেসাঁস ও রিভাইভাল সমার্থক হয়ে গেছে। যেন একটির সঙ্গে অপরটির অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক। যেন রিভাইভালিজমই রেনেসাঁসের প্রসূতি অথবা রেনেসাঁসই রিভাইভালিজমের জনক কিংবা অগ্রজ; অর্থাৎ একটি অপরটির কখনো কারণ এবং কখনো ফলরূপে প্রতীয়মান। এমনকি বাঙলা তর্জমায় পার্থক্য প্রায় দুর্লক্ষ্য। শিল্প, সাহিত্য, ভাস্কর্য, স্থাপত্যাদি কলা কিংবা চিন্তার ক্ষেত্রে নবজন্ম, নবজাগরণ, পুনরুজ্জীবন, পুনর্জীবন, পুনর্জাগরণ, পুনরভ্যুদয়, পুনরুদ্দীপন, পুনরুদ্যম, পুনরুদ্বোধন প্রভৃতি অর্থেই শব্দদুটো ব্যবহৃত হয়। সাধারণ অভিধা হচ্ছে রিভাইটালাইজেশন। যে-ঐতিহ্য যে-অতীত ভরে তুলে না, কেবলই ধরে রাখে; যে tradition অগ্রগতির অন্তরায় তা পরিহার করবার, তার প্রতি নির্মম ও বীতরাগ হবার শক্তি থাকা চাই– নইলে আবেগের ঘূর্ণিপাকে অপচিত হবে জাতীয় সব প্রয়াস।

    কাজেই প্রাণে প্রেরণা, চিত্তে চেতনা এবং মনে স্বতঃউৎসারিত উদ্যম না জাগলে, কেবল ইতিহাস পাঠের ফলশ্রুতির অনুসরণে কিংবা অনুকরণে revivalism-এর চর‍্যা গ্রহণ করলেই রেনেসাঁস আসবে না অথবা রেনেসাঁস এসেছে কল্পনা করে revival-এর উৎসাহ-বোধ করলেই প্রয়াস সফল ও সার্থক হবে না। মনে রাখা দরকার, যাত্রা অভিন্ন হলেও ফল ভিন্ন হতে বাধা নেই। বস্তুত প্রায়ই ভিন্ন হয়। তাছাড়া অনুকৃতিতে নির্বোধ পায় আনন্দ, বুদ্ধিমানে পায় লজ্জা।

    ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleপুষ্প বৃক্ষ এবং বিহঙ্গ পুরাণ – আহমদ ছফা
    Next Article স্বদেশ অন্বেষা – আহমদ শরীফ

    Related Articles

    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    ভয় সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    কিশোর অ্যাডভেঞ্চার সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    প্রকাশ্য দিবালোকে – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 18, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    তারপর কী হল – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 17, 2025
    মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    শর্ম্মিষ্ঠা নাটক – মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    November 11, 2025
    সত্যজিৎ রায়

    মানপত্র সত্যজিৎ রায় | Maanpotro Satyajit Ray

    October 12, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }