Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    জীবন যেখানে যেমন – আরিফ আজাদ

    লেখক এক পাতা গল্প152 Mins Read0

    ১৪. সফলতা সমাচার

    [এক]

    আমি তখন হাইস্কুলে পড়ি। বিদ্যের জাহাজ হবার স্বপ্নে বিভোর। জগতের সবকিছু নিয়েই যেন আমার নিরন্তর কৌতূহল। এটা-ওটা নিয়ে সারাক্ষণ ক্লাসে স্যারদের প্রশ্ন করতাম। আমার জিজ্ঞাসা-যন্ত্রণায় স্যারেরা তো অতিষ্ঠই, এমনকি আমার সহপাঠী, যারাও আমার মতো দুরন্ত আর দস্যিপনায় দুর্বিনীত, তারা পর্যন্ত বিরক্ত হয়ে যেতো।

    একদিন একেবারে হঠাৎ করে আমাদের ক্লাসে আগমন ঘটলো নতুন এক মুখের। ছোকরা যে আস্ত একটা হাবাগোবা সেটা তার চেহারা দেখলেই বিলক্ষণ বুঝে ফেলা যায়। ফ্যালফ্যাল তার চাহনি। শরীরের তুলনায় মাথাটা প্রকাণ্ড। ব্যাটা যে কেবল হাবাগোবা নয়; ভীষণরকম ভীতুও–সেটা বোঝা গেলো একটু পরেই। ইংরেজি ক্লাসের নাঈম স্যার এসে যখন তাকে কমন নাউনের দুটো উদাহরণ দিতে বললেন, ভয়ে তখন তার হাঁটু কাঁপাকাপি অবস্থা। একেবারে নতুন মুখ দেখেই স্যার জিগ্যেশ করলেন, ‘নাম কী?’

    ছেলেটা মিনমিন করে বললো, ‘আলাদিন।’

    আমাদের ক্লাসের সবচাইতে ফাজিলটার নাম ছিলো শফিক। যেকোনো কিছু নিয়ে মুহূর্তে কৌতুক বানাতে সে ছিলো সিদ্ধহস্ত। হাবাগোবাটার নাম ‘আলাদিন’ শুনে সে ঘাড় ফিরিয়ে বললো, ‘বাবা আলাদিন, চেরাগটা কি পকেটে পুরেছ না ব্যাগে?’

    শফিকের এ ধরনের কৌতুক আমাদের সব সময় আলাদা মজা দেয়। তার কথা শুনে হো হো করে হেসে উঠলাম আমরা সবাই। হাসলো না কেবল ছেলেটা। তার সেই আদি এবং অকৃত্রিম ফ্যালফ্যাল চেহারা নিয়ে সে স্যারের দিকে তাকিয়ে রইলো। একবার মনে হলো, এই ছেলেটার জন্ম না হলে ‘হাবাগোবা’ শব্দটা বুঝি অপূর্ণই রয়ে যেতো।

    এরপর ছিলো বাংলা ক্লাস। দ্বিতীয় এবং সবচেয়ে মজার ক্লাস এইটাই। এক অসম্ভব রূপবতী ম্যাডাম আমাদের বাংলা পড়াতেন। রূপের কারণেই হোক কিংবা শখের কারণে–বাংলা ক্লাসে বাংলা পড়ানোর চেয়ে তিনি গল্পই করতেন বেশি। সেই গল্পগুলোর সবটা জুড়ে কেবল নিজের বন্দনা। সেদিনও তার ব্যক্তিক্রম হয়নি। বাংলা বইটায় একটুখানি চোখ বুলিয়ে পেছনের বেঞ্চের একটা মেয়েকে দাঁড় করিয়ে বললেন, ‘এই সানজিদা, ওমন ঝিমুচ্ছিস কেন? রাতে ঘুমোসনি? তোর মতন বয়েসে আমরা কতো সিনসিয়ার ছিলাম পড়াশোনা নিয়ে জানিস?’

    ম্যাডামের আত্ম-বন্দনার গল্পগুলো সব সময় এভাবেই শুরু হয়। প্রথমে কারও কোনো খুঁত বের করবেন, এরপর ওই বিষয়ে ম্যাডাম কেন অনন্যা, অপ্রতিদ্বন্দ্বী, অপরাজিতা ছিলেন তা বর্ণনার মাধ্যমে মেলতে শুরু করে গল্পের ডালপালা। সানজিদাকে ধমকানির নেপথ্য-কারণও যে তা-ই, তা আমরা বিলকুল জানি। হলো ঠিক তা-ই। স্কুলজীবনে তিনি কেমন দুরন্ত ছিলেন, কেমন করে ক্লাসের ছেলেমেয়েদের ওপরে খবরদারি করতেন, ক্লাসে তার ভয়ে সবাই কীরকম তটস্থ থাকত, উপস্থিত বক্তৃতা প্রতিযোগিতায় তার বক্তৃতা শুনে কীভাবে স্কুলশুদ্ধ লোকজন হা হয়ে গিয়েছিল– এসবই ছিলো গল্পের মূল বিষয়বস্তু। ম্যাডামের এমন ধারার গল্প শুনে হাই তুলতে তুলতে শফিক বললো, ‘ম্যাডাম, আপনার গল্প শুনে মনে হচ্ছে আপনি আসলে রাজনীতিবিদ হওয়ার জন্যেই জন্মেছিলেন; কিন্তু রাস্তা ভুল করে আপনি হয়ে গেছেন হাইস্কুলের টিচার।’

    শফিকের কথা শুনে ক্লাসশুদ্ধ ছেলেমেয়ে হো হো করে হাসিতে ফেটে পড়লো। এমনকি, একটু আগে টুলে বসে বসে ঝিমুতে থাকা সানজিদাও সেই অট্টহাসিতে লুটোপুটি খাওয়ার মতন অবস্থা। হাসলো না কেবল হাবাগোবা আলাদিন।

    হ্যাঁ, সেদিন থেকে আমরা তার নাম রেখেছিলাম হাবাগোবা আলাদিন।

    টিফিন পিরিয়ডের পরেই ছিলো বিজ্ঞান ক্লাস। বিজ্ঞান শব্দটা তখন যতখানি না ভয়ংকর, তার চাইতে বেশি ভয়ংকর ছিলো আমাদের বিজ্ঞান স্যার। হাতির মতন বিশাল দেহ স্যারের। যেদিক দিয়ে হাঁটেন সেদিকটা মনে হয় গমগম করতে থাকে। তার ক্লাস ফাঁকি দেওয়া তো দূর, কেউ হালকা টুঁ শব্দ করবে–এতোবড়ো বুকের পাটা কারও ছিলো না। যে শফিক হাসি-ঠাট্টা করে ক্লাস মাতিয়ে রাখত, সে পর্যন্ত বিজ্ঞান ক্লাসে কাঁকড়ার মতো হাত-পা গুটিয়ে ভালো ছেলের মতো বসে থাকত।

    প্রথম দিনেই বিপত্তি বাধালো হাবাগোবা আলাদিন। টিফিন পিরিয়ড থেকেই সে একেবারে লাপাত্তা। আমরা ভাবলাম প্রথম দিনেই এই স্কুলে পড়ার খায়েশ তার মিটে গেছে। তাই হয়তো বা বইটই রেখে একদম বেওয়ারিশের মতো পালিয়েছে। ওকে দিয়ে আর যা-ই হোক, পড়াশোনাটা যে হবে না, সেটা সম্ভবত ও বুঝে গেছে। তাই সুযোগ বুঝে চম্পট!

    বিজ্ঞান ক্লাসের তখন মাঝামাঝি সময়। আমাদের সম্মিলিত দৃষ্টি সামনের ব্ল্যাকবোর্ডে গিয়ে স্থির হয়ে গেছে। যার দৃষ্টি সেখান থেকে বিচ্যুত হবে, তার ওপর দিয়ে বয়ে যাবে এক প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়। এই ক্লাসের এটাই চিরাচরিত রীতি। এতোটুকু প্রাণ নিয়ে আমরা প্রতিদিন এই সময়টা পার করি।

    কিন্তু সেদিন, সবাইকে অবাক করে দিয়ে কোথা থেকে যেন ঝড়ের মতো ক্লাস-রুমের দরজার কাছে এসে হাজির হলো হাবাগোবা আলাদিন। তাকে দেখে ভূত দেখার মতোই চমকে উঠলাম আমরা সবাই। নিজেদের চোখগুলোকে অবিশ্বাস করতে পারলেই বেশি ভালো লাগত; কিন্তু রক্ত-মাংসের দেহ নিয়ে যে দাঁড়িয়ে আছে দরজার কাছে, তার অস্তিত্বকে অস্বীকার করি কী করে?

    তার পুনরাগমনের ঘটনায় সেদিন আমরা বিস্মিত হইনি। আমরা বিস্মিত হচ্ছিলাম তার ওপর দিয়ে বইতে যাওয়া আসন্ন ঝড়ের তাণ্ডবলীলা কল্পনা করে। আমাদের চোখের সামনে তখন একটাই দৃশ্য। টেবিলের নিচে মাথা ঢুকিয়ে দিয়ে পিঠখানা উপুড় করে রেখেছে হাবাগোবা আলাদিন। ম্যাড়ম্যাড়ে সেই পিঠে বিজ্ঞান স্যারের সাড়ে ছ’ কেজি ওজনের কিলগুলো পড়ছে আর তাতে পটাশ পটাশ শব্দ হচ্ছে। এই কিলগুলো হজম করার পর সে যে আর কোনোদিন এ স্কুলমুখী হবে না–সে ব্যাপারে আমরা মোটামুটি নিশ্চিত।

    আমাদের বিজ্ঞান স্যার সরু চোখে ওর দিকে তাকালেন। ভয়ানক ক্ষুধার্ত সিংহ। তার আহারের সময় উটকো ঝামেলায় যে ধরনের বিরক্তি প্রকাশ করে, স্যারের চোখেমুখেও সে-রকম তিরিক্ষি ভাব। স্যারের মুখাবয়বের আশু পরিবর্তনে তখন আমাদের হাঁটু পর্যন্ত থরথর করে কাঁপতে শুরু করেছে, বাইরে দণ্ডায়মান হাবাগোবাটার যে কী অবস্থা কে জানে!

    সে তখনো বাইরেই দাঁড়ানো। ইশারায় তাকে ভেতরে আসতে বললেন। দোর্দণ্ডপ্রতাপের বিজ্ঞান স্যার। ধীরপায়ে ভেতরে ঢুকে স্যারের কাছাকাছি আসতেই তার পেটে চাপ দিয়ে বললেন, ‘নাম কী?’

    মিনমিন করে সে বললো, ‘আলাদিন’।

    ‘আজকেই প্রথম এসেছিস ক্লাসে?’

    ভয়ে ভয়ে জবাব এলো, ‘জ্বি।’

    ‘তুই কি জানিস ক্লাস অর্ধেক শেষ হয়ে গেছে?’

    মাথা নিচু করে মাটির দিকে তাকিয়ে রইলো আলাদিন। তাকে নিরুত্তর হতে দেখে এবার তার পেটে আরেকটু জোরে চাপ দিয়ে ধরলেন স্যার। স্যারের অভিজ্ঞ হাতের এমন নাড়ানি খেয়ে একবার কোঁত করে উঠলো সে। স্যার বললেন, ‘এতো দেরি হওয়ার কারণ কী? কোথায় গুল মারছিলি?’

    তার দৃষ্টি তখনো মাটিতেই নিবদ্ধ। নিচু দৃষ্টি এবং নিচু স্বরে সে বললো, ‘স্যার, যুহরের সালাত পড়ার জন্য মসজিদে গিয়েছিলাম। মসজিদ বেশ খানিকটা দূরে। এ জন্যেই দেরি হয়ে গেছে।’

    নতুন বলে দয়া করে হোক কিংবা সালাতের কথা শুনে সমীহ করেই হোক, সেদিন হাবাগোবা আলাদিনের পিঠের ওপর দিয়ে যে টর্নেডো বয়ে যাওয়ার দৃশ্য আমরা কল্পনা করেছিলাম, সেটা আর বাস্তব রূপ পেলো না। স্যার তাকে বললেন, ‘ঠিক আছে। যা, নিজের জায়গায় গিয়ে বোস।’

    আমাদের অঙ্ক স্যার তাকে ডাকত ‘আদু ভাই’ বলে। স্যারের ধারণা ছিলো সে কোনোদিনও পরের ক্লাস টপকাতে পারবে না। একদিন স্যার তার কাছে জিগ্যেশ করলেন, ‘তুই বড় হয়ে কী হবি রে আদু ভাই?’

    সে কিছু না বলে মাথা নিচু করে থাকলো। স্যার বললেন, ‘আমি বলি তুই কী হবি? তুই হবি মুদি দোকানদার! হা হা হা! বসে বসে মুড়ি বেচবি।’

    স্যার এভাবেই তাকে অপমান করতেন আর হাসতেন। স্যারের সাথে হাসতাম আমরাও। ও-ই কেবল মাথা নিচু করে থাকত। লজ্জা আর অপমানে।

    চুপচাপ স্বভাবের সেই হাবাগোবা আলাদিন টিফিন পিরিয়ডের পর নিয়ম করেই দেরি করে আসতো এবং অদ্ভুত হলেও সত্য, বিজ্ঞান স্যার কেবল তার জন্য নিজের চিরাচরিত নিয়ম থেকে সরে আসতেন। হাবাগোবাটার জন্যে যেন সাতখুন মাপ!

    অন্য আরেকদিনের ঘটনা। বন্ধুদের নিয়ে আয়েশ করে টিফিন খাচ্ছিলাম। আমাদের পাশ দিয়ে হাবাগোবা আলাদিন হেঁটে যাওয়ার সময় মুনতাসির চেঁচিয়ে বললো, ‘কীরে মুদি দোকানদার! খাচ্ছিস না যে?’

    মুনতাসিরের এহেন পচানি গায়ে মাখলো না সে। মাথা তুলে একবার শুধু আমাদের দিকে তাকালো; এরপর সুড়সুড় করে হেঁটে চলে গেলো নিজের কাজে। ব্যাপারটা বেশ গায়ে লাগলো মুনতাসিরের। বলাই বাহুল্য, শক্তি, তেজ আর শরীরের সাইজে মুনতাসির ছিলো আস্ত একটা পালোয়ানের সমান। আমরা তো বটেই, আমাদের উঁচু ক্লাসের ছাত্ররাও তার সাথে উল্টাপাল্টা করার সাহস পায় না। যাকে-তাকে ধরে ঠেঙিয়ে দেয়ার ব্যাপারে মুনতাসিরের কুলজোড়া খ্যাতি। সেই মুনতাসিরের কথাকে অগ্রাহ্য করে চলে যায় কিনা আলাদিনের মতন এক তালপাতার সেপাই!

    স্কুল ছুটির পর গেটের বাইরে তার বিশালাকার শরীর নিয়ে পায়চারি করছিল মুনতাসির। বুঝতেই পারছি আলাদিনের ওপরে সে বেজায় চটেছে। হাতির পাড়া আর মুনতাসিরের থাবা–দুটোই আমাদের কাছে সমান জিনিস। আলাদিনের জন্য যে এক মহাদুর্যোগ বাইরে ঘুরপাক খাচ্ছে–সেই আভাস আলাদিনের কাছে পৌঁছেছে। কিনা কী জানি!

    নাহ, পোঁছেনি। হাবাগোবা আলাদিন নরম নরম পা ফেলে স্কুল থেকে বেরিয়ে এলো। যেই না সে গেটের মুখে এলো, ওমনি ছোঁ মেরে তাকে একপাশে নিয়ে গেলো মুনতাসির। যেন বাঘের থাবায় বন্দী হরিণ! শিকারি ঈগল লক্ষ্যভ্রষ্ট হতে পারে, কিন্তু মুনতাসিরের থাবা কখনোই ব্যর্থ হয় না। বেচারা আলাদিন ঘটনার আকস্মিকতায় পুরোই জব্দ! মুখ দিয়ে কোনো শব্দ ছাড়াই ভ্যাবাচ্যাকা চেহারা নিয়ে অপলক তাকিয়ে রইলো মুনতাসিরের চেহারার দিকে।

    অন্যদিন হলে জবাবদিহির আগেই হয়তো মুনতাসির দু-চারটে লাগিয়ে দিতো। কিন্তু আজ তার ব্যতিক্রম হলো। এই হাবাগোবাটার বেলাতেই সবাই কেন নিজেদের সত্তাকে বিসর্জন দিয়ে দেয় সে এক রহস্য! যাহোক, আলাদিনের শার্টের কলার টেনে ধরে, তার সুপারির সমান ছোটো মুখটাকে নিজের মুখের কাছে এনে মুনতাসির জানতে চাইলো, ‘এতো ভাব কীসের তোর? তখন যে জানতে চাইলাম খাচ্ছিস না কেন, ভাব দেখিয়ে চলে গেলি কেন? তুই আমাকে চিনিস?’

    মুনতাসিরকে চেনে না এমন পোড়ামুখো আমাদের স্কুলে একটাও নেই। যারা চেনে না তারাও তার গল্প শুনতে শুনতে তাকে চিনে ফেলে। সম্ভবত হাবাগোবা আলাদিনও চেনে। সে মুখ নিচু করে বললো, ‘আমি সিয়াম রেখেছি। আমি যে সিয়াম রেখেছি সেটা কাউকে জানাতে চাচ্ছিলাম না। তাই তোমার প্রশ্নের উত্তর দিইনি।’

    এমন দিনে কেউ সিয়াম রাখে বলে জানা নেই আমাদের। সিয়ামের মাস তো কবেই গত হয়েছে। ব্যাটা নিশ্চয় ঢপ দিচ্ছে! পাশ থেকে মুখে আঙুল চুষতে চুষতে আমিনুল বলে উঠলো, ‘ব্যাটা তো সাংঘাতিক মিথ্যুক রে! এখন কি সিয়ামের মাস নাকি যে সিয়াম রেখেছিস?’

    ‘সিয়ামের মাস ছাড়াও তো সিয়াম রাখা যায়। এগুলোকে বলে নফল সিয়াম। প্রতি সোম আর বৃহস্পতিবার সিয়াম রাখতেন আমাদের নবি।’

    আমিনুল পাল্টা জিগ্যেশ করলো, ‘কে শিখিয়েছে তোকে এই নতুন জিনিস?’

    আলাদিন বললো, ‘আমার বাবা রাখেন। বাবাকে দেখে দেখে আমরাও শিখেছি। সপ্তাহের সোম আর বৃহস্পতিবার আমাদের বাসার সবাই সিয়াম রাখে।’

    ধপ করে তার কলার ছেড়ে দিলো মুনতাসির। কিছু না বলেই হনহন করে সে হাঁটা ধরল বাড়ির পথে। আমরা একে-অন্যের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগলাম। যে দৃশ্য উপভোগ করার জন্যে সবাই এতোক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে, তাতে যে এভাবে জল ঢেলে দেওয়া হবে, তা কে জানতো? সেদিনও আসন্ন ঝড়ের তাণ্ডবলীলা আসি আসি করে আর আসল না। নিত্যকার মতো, সেদিনও বেঁচে গেলো হাবাগোবাটা।

    ইতঃপূর্বে যা কোনোদিন ঘটেনি একদিন তা-ই ঘটলো। পাশে বোমা ফাটলেও যে আলাদিনের মুখ দিয়ে একটা শব্দ বের হয় না, যে কোনোদিন নিজ থেকে এসে আমাদের সাথে একটা কথাও বলে না, সে-ই কিনা একদিন আমাদের আড্ডার মাঝে এসে বললো, ‘আযান হচ্ছে। তোমরা কেউ কি সালাতে যাবে?’

    তাকে নিজ থেকে এসে আমাদের সাথে কথা বলতে দেখে বিস্ময়ে হতবুদ্ধি হয়ে গেলাম! আমাদের দিক থেকে কোনো উত্তর তো পায়ইনি সে, তদুপরি আমাদের বিস্ময়মাখা চেহারাগুলো দেখে সেও সম্ভবত হকচকিয়ে গেছে কিছুটা। আবার কথা বললো আলাদিন। খুবই গোছালো, স্পষ্ট ভাষায়–

    ‘যুহরের আযান হচ্ছে। আমার সাথে মসজিদে যাবে? এই যে দেখো, মুয়াজ্জিন বলছে, ‘হাইয়্যা আলাল ফালাহ’। মানে হলো–সফলতার পথে এসো। জীবনে সফল হতে চাইলে চলো আমরা সালাতে যাই।’

    এতোদিন শুনেছি জীবনে সফল হতে হলে ভালোমতো পড়াশোনা করতে হয়। আজ এই হাবাগোবাটার কাছে নতুন তত্ত্ব শুনলাম বৈকি! সালাতে গেলে নাকি মানুষ সফল হয়! সফলতা বলতে ও কী কচু বোঝে কে জানে! ওর কথায় আমরা কেউ কর্ণপাত করিনি সেদিন। ওর মতো হাবাগোবা, পড়াশোনায় ঢের পিছিয়ে থাকা এক বালকের কাছ থেকে সফলতার পাঠ নেব আমরা? সম্ভবত দুনিয়ায় সফলতার পাঠ দেওয়ার মতো মানুষের তখনো আকাল পড়ে যায়নি।

    এরপর? এরপর বলা নেই কওয়া নেই একদিন হুট করেই বাবার বদলি হয়ে যায়। আমাদের পাড়ি জমাতে হয় অন্য একটা শহরে…

    [দুই]

    ক্যামব্রিজ থেকে পোস্ট-ডক শেষ করে দেশে ফিরেছি। চারদিকে হইচই ফেলে দেওয়া ‘গড পার্টিকেল’ থিওরির রিসার্চ টিমের অন্যতম সদস্য হওয়ায় আমার তখন দুনিয়াজোড়া খ্যাতি। চাইলেই বিদেশে ভালো ক্যারিয়ার নিয়ে থিতু হওয়া যেতো অনায়েশেই, কিন্তু মন আমার পড়ে রইলো দেশের জল-হাওয়া-মাটিতে। দেশকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে দেখতে বড় হওয়া আমাকে শেষ পর্যন্ত ফিরে আসতে হলো শেকড়ের টানে। দেশের নামকরা একটা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিশেবে যোগদান করে হাঁটতে শুরু করলাম আমার লালিত সেই স্বপ্নের পথে।

    সময় বয়ে যাচ্ছিল তার নিজস্ব গতিতে। সেই গতিতে কোথাও কোনো হেরফের নেই। সে না দ্রুত না মন্থর। দিন যায়, মাস পেরোয়, বছর ঘুরে আসে–জীবনের ঝুলিতে জমা হতে থাকে হরেক রকমের অভিজ্ঞতা। তবে, একদিন এমন এক অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হলো, যা আমাকে একেবারে ভেতর থেকে নাড়িয়ে দিয়ে যায়। যে অভিজ্ঞতা ভেঙে চুরমার করে দেয় আমার সকল অহংকার আর অহমিকাবোধ। জীবনের কাছে আমি যেন নিতান্তই শিশু হয়ে পড়ি। আমার ইচ্ছে করে হাউমাউ করে কাঁদতে। কিংবা যদি জীবন থেকেই পালিয়ে যেতে পারতাম! যদি হারিয়ে যেতে পারতাম সময়ের অজানা কোনো স্রোতে, তাহলেই সম্ভবত মুক্তি মিলতো। কিন্তু, জীবন কি আর পুতুল খেলার মতো? মন চাইলো খেলোম আর মন না চাইলেই খেলা ভেঙে দিয়ে উঠে গেলাম? জীবন এক কঠিন বাস্তবতার নাম; এমন এক শিকলের নাম, যার বাঁধন থেকে মৃত্যু ব্যতীত কারও নিস্তার নেই।

    একদিন বাসায় এসে দেখি রেবেকা মনমরা হয়ে সোফায় বসে আছে। তার মুখাবয়বে বিষাদের অনিঃশেষ রেখা অঙ্কিত। দীর্ঘ ত্রিশ বছরের সংসার জীবনে তাকে সেদিনের চেয়ে বিমর্ষ, সেদিনের চেয়ে বিধ্বস্ত আমি আর কখনোই দেখিনি। মুখে সর্বদা হাসি জিইয়ে রাখার এক অদ্ভুত ক্ষমতা ছিলো তার। আমি যতোখানি রাশভারী, সে ঠিক ততখানিই হাসিখুশি। তার অকারণ হাসির চোটে আমার মাঝে মাঝে রাগ উঠে যেতো। সেই হাসিখুশি, প্রাণোচ্ছল আর প্রফুল্লতায় ভরপুর আত্মার মানুষটিকে এমন বিমর্ষ, বিহ্বল চেহারায় দেখে আমার বুকের ভেতরটা কোনো এক অজানা আশঙ্কায় ধুকপুক করে উঠলো। কোথা হতে যেন বিপদের করুণ বীণ বেজে বেজে একটি সমূহ দুর্যোগের আভাস ধেয়ে আসছে আমার কানে। সেই বিধ্বংসী, বিনাশী সুরের অকৃপণ যাতনায় আমি যেন বিমূঢ় হয়ে গেলাম ক্ষণিকের জন্য।

    খুব দুর্বল চিত্তের মানুষ আমি। যেকোনো কিছুতেই অস্থির হয়ে পড়ার বাতিক রয়েছে। তবুও, ভেতরে একটু শক্তি সঞ্চয় করে নিয়ে বললাম, রেবেকা, ওমন মলিন মুখে বসে আছো যে? কোনো সমস্যা?

    সমস্যা যে হয়েছে সে ব্যাপারে আমি নিঃসন্দেহ। তাও প্রশ্ন করার জন্যই প্রশ্ন করা। রেবেকা আমার দিকে তাকাতেই হুড়মুড় করে তার দু-চোখ বেয়ে নেমে এলো শ্রাবণ ধারার জল। সারাটা জীবনের সবটুকু মেঘ সম্ভবত তার চোখে আজকের জন্যই জমা হয়ে ছিলো। সুযোগ পেয়ে বাঁধভাঙা ঢেউয়ের মতন বুকে আছড়ে পড়লো সেই মেঘভাঙা বৃষ্টির দল। তাকে কোনোরকমে শান্ত করে জিগ্যেশ করলাম, ‘কী হয়েছে বলবে তো?’

    আমার বুকে মাথা খুঁজে গোঙাতে থাকে রেবেকা। সে এক অদ্ভুত বিষাদের গোঙানি। রংহীন সেই বিষাদের মর্মযাতনা আমার বুকের ভেতরটাকে যেন এফোঁড়ওফোঁড় করে দিয়ে গেলো।

    [তিন]

    মাদকে আসক্ত এক সন্তানের পিতা আমি–ভারি দুঃস্বপ্নেও নিজেকে এ অবস্থায় ভাবা আমার পক্ষে অসম্ভব। সারা জীবনের নীতি-নৈতিকতা, আদর্শ মানুষ হওয়া এবং আদর্শ মানুষ তৈরির স্বপ্ন দেখা এই আমার পক্ষে নিজের একমাত্র ছেলেকে মাদকের দুনিয়ায় হারিয়ে যেতে দেখে যেন আমার পায়ের তলা থেকে মাটি সরে গেলো। এক গভীর চোরাবালির স্তূপে আমি যেন নিমজ্জিত হতে চলেছি, সাথে অপমৃত্যু ঘটছে আমার সকল স্বপ্ন আর সাধনার। যে সন্তানকে নিজের যোগ্য উত্তরসূরি, যোগ্য উত্তরপুরুষ বানাবার প্রবল ব্ৰত আমার মনে, মাদকের নেশায় অন্যায়ে জড়িয়ে পড়া সেই সন্তানকে গ্রেপ্তারের পরোয়ানা জানিয়ে গেছে পুলিশ কর্তৃপক্ষ। আমার মতো বাবাদের জন্যে এমন লজ্জাকর, এমন মাথা হেঁট করা দিন দেখবার চাইতে মৃত্যু ঢের উত্তম!

    জীবনের কাছে আমার পাওনা ছিলো অঢেল আর প্রত্যাশা ছিলো সীমাহীন। সারাজীবন আলো ফেরি করে বাঁচতে চেয়েছিলাম, কিন্তু সেই আলো যে নিজের ঘরে জ্বালাতে পারলাম না–এই দুঃখবোধ আমি ঘুচাবো কেমন করে? তাহলে কি জীবন আমার সাথে ছলনা করলো? তবে কি ভাগ্যের কাছে আমি পরাস্ত হয়ে গেলাম?

    থানা থেকে আসা অ্যারেস্ট ওয়ারেন্ট কপিটা হাতে নিয়ে আমি ধপ করে সোফায় বসে পড়লাম।

    [চার]

    বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে একটা ব্যাপার নিয়ে বেশ শোরগোল শুনতে পেলাম। সম্ভবত আমার ডিপার্টমেন্টের কোনো এক ছাত্রীকে নিয়েই। সাদামাটা ব্যাপার, অন্যদের টেবিলে গড়িয়েই ব্যাপারটার সুরাহা করার সুযোগ থাকলেও তা হলো না। সেটা গড়িয়েছে আমার টেবিল পর্যন্ত। হলুদ খামে ভরা একটা চিঠি আমার টেবিলের ওপরে রাখা। চিঠি না বলে ওটাকে দরখাস্ত বলাটাই শ্রেয়। একবার ইচ্ছে হলো জিনিসটাকে আবর্জনার বিনে ছুঁড়ে ফেলে দিই। পরক্ষণে মনে হলো–যে গাধাটা এই বস্তুটা আমার টেবিল পর্যন্ত পৌঁছিয়েছে তাকে ডেকে আচ্ছামতো ঝেড়ে দিই। শেষ পর্যন্ত কোনোটাই করা হলো না। নিতান্ত অনিচ্ছাকৃতভাবে হলুদ খামে মোড়ানো সেই দরখাস্তটা আমি ধীরহস্তে খুলে পড়তে শুরু করলাম।

    পিয়নকে ডেকে বললাম, ‘এই দরখাস্তটা যার, তাকে বলো আমার রুমে আসতে।’

    পিয়ন ‘জি স্যার’ বলে এক দৌড়ে ছুটে বেরিয়ে গেলো। বেশ খানিকক্ষণ পর আগাগোড়া বোরকায় ঢাকা একটি মেয়ে, তার সাথে একজন মধ্যবয়েসী লোক আমার রুমে এলো। উভয়কে বসতে বলে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘এই দরখাস্ত তুমিই লিখেছো?’

    মেয়েটা আস্তে করে বললো, ‘জি স্যার।’

    ‘হিজাব পরে ক্লাস করা যাবে না–এটা তোমাকে কে বলেছে?’

    ‘আমাদের একজন ম্যাডাম।’

    ‘উনি যা বলেছেন তা আমাকে বিস্তারিত খুলে বলো।’

    ‘ম্যাডাম বলেছেন হিজাব পরে ক্লাসে আসা যাবে না। ক্লাস করতে হলে এ রকম বোরকা-হিজাব ছাড়াই করতে হবে। আমার অনেক অনুরোধ সত্ত্বেও ম্যাডাম আমার কোনো কথা শুনতে রাজি হননি। সাফ জানিয়েছেন আমাকে পরের সেমিস্টারে এক্সাম হলেও বসতে দেবেন না, যদি না আমি আমার হিজাব ছাড়তে রাজি হই।‘

    ‘তোমার সিদ্ধান্ত কী এখন?’

    ‘স্যার, আমার সিদ্ধান্ত হলো–হিজাব পরে ক্লাস করতে না দিলে আমি আর এখানে পড়াশোনা করবো না।’

    ‘তুমি কি ভেবেচিন্তে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছো?’

    ‘জি।’

    ‘ক্যারিয়ারের কথা একবারও ভেবেছো কি? তোমার রেজাল্ট দেখলাম বেশ চমৎকার। একটা ভালো সাবজেক্টে পড়ছো তুমি। তোমার সামনে যে অবাধ সাফল্য অপেক্ষা করছে, তা তুমি বুঝতে পারছো?’

    মেয়েটা কিছু না বলে খানিকক্ষণ চুপ করে রইলো। তার নীরবতার সুযোগ নিয়ে পুনরায় বললাম, ‘তোমার যে রেজাল্ট এবং যে সাবজেক্ট তা কতো শিক্ষার্থীর সারাজীবনের আরাধ্য স্বপ্ন তুমি বলতে পারো? তোমার জন্য অপেক্ষা করে আছে। সাফল্যমণ্ডিত ক্যারিয়ার, আর তুমি সব ছেড়ে-ছুঁড়ে চলে যেতে চাইছো?’

    মেয়েটা এবার আগের চাইতে আরও স্পষ্ট, আরও গোছানো গলায় বললো, ‘আমাকে ক্ষমা করবেন স্যার। আপনার শিক্ষকসুলভ দরদ আমি বুঝতে পারছি; কিন্তু আমার ধর্মকে যেখানে ছোটো করে দেখা হয়, সেখানকার সাফল্যে সাফল্যমণ্ডিত হওয়ার কোনো ইচ্ছে আমার নেই। আমার ধর্মপালনের স্বাধীনতা ফিরিয়ে দিয়ে যদি কোনোদিন আমার ক্যাম্পাস আমাকে ডাকতে পারে, সেদিন সানন্দে আমি ফিরে আসবো। আমার ধর্ম আমার স্বকীয়তা। স্বকীয়তাকে বিসর্জন দিয়ে সফল হওয়াকে আমি প্রকৃত সফলতা ভাবতে নারাজ।’

    নিজের অভিমতের ওপর মেয়েটার দৃঢ়তা আমাকে যদিও বা মুগ্ধ করেছে, তথাপি যে বোকামি সে করতে যাচ্ছে তার জন্যে আফসোস করা ছাড়া আর কীই বা করার থাকতে পারে? আমি বিষণ্ণ এবং হতাশ গলায় বললাম, ‘এটাই তোমার সর্বশেষ সিদ্ধান্ত?’

    ‘জি’, মেয়েটা একবাক্যে উত্তর দিলো।

    এতোক্ষণ পর মেয়েটার বাবার দিকে নজর দেওয়া গেলো। ভদ্রলোকের চেহারা দেখে মোটেই বিচলিত কিংবা চিন্তিত বলে মনে তো হলোই না, বরঞ্চ মেয়ের এমন হঠকারী সিদ্ধান্তে তার যে অবাধ উস্কানি রয়েছে, সেটার প্রচ্ছন্ন ছায়া যেন চোখেমুখে লেপ্টে আছে। আরও বিস্ময়ের ব্যাপার হলো–আমাদের এতোক্ষণের আলাপচারিতায় ভদ্রলোক টু শব্দটিও করেননি। কিছুটা রাগ হলো আমার। মেয়েটা না-হয় অবুঝ। দুনিয়াটাকে সাদা-কালো জ্ঞান করছে। কিন্তু চুল-দাড়িতে পাক ধরা এই বয়স্ক ভদ্রলোকের কেন যে এমন ভীমরতি হলো তা বোঝা মুশকিল। মেয়ের এমন অবিবেচক সিদ্ধান্তে একজন বাবাকে এতোটা নির্ভার দেখতে বেশ দৃষ্টিকটুই লাগছে।

    খানিকটা রুক্ষ এবং তীক্ষ্ণ গলায় বললাম, ‘আপনিই কি ওর বাবা?’

    ‘জি।’

    ‘আপনার মেয়ের এই সিদ্ধান্তকে আপনি সমর্থন করেন?’

    বেশ হাসিখুশি চেহারায় লোকটা বললো, ‘অবশ্যই করি। কেবল সমর্থন নয়, আমি দারুণভাবে এপ্রিশিয়েট করি।’

    আমি বেশ হকচকিয়ে গেলাম ভদ্রলোকের কথা শুনে! ভালো একটা ডিপার্টমেন্টে পড়ে মেয়েটা। গ্র্যাজুয়েশানটা শেষ করতে পারলেই ভালো ক্যারিয়ারের হাতছানি সামনে। এমন অবস্থায় খুবই সামান্য একটা ইস্যুতে পড়াশোনাই ছেড়ে দিতে চাচ্ছে, আর সেটাকে বসে বসে নাকি এপ্রিশিয়েট করছে তার বাবা! এমন পাগলও হয় দুনিয়ায়?

    কপাল কুঁচকে আমি বললাম, ‘আপনার কাছে এটাকে এপ্রিশিয়েট করবার মতো কোনো ব্যাপার বলে মনে হচ্ছে?’

    আমার কপালের ভাঁজ-রেখা ভদ্রলোককে বিভ্রান্ত কিংবা চিন্তিত কোনোটাই করতে পারলো না। চেহারায় আগের মতোই হাসি হাসি ভাব জিইয়ে রেখে তিনি বললেন, ‘কেন নয়, বলুন? আমার মেয়ে দুনিয়ার জীবনের প্রাপ্তির বদলে আখিরাতের প্রাপ্তিকে বড় করে দেখতে শিখেছে। অর্থনীতিতে ‘অপরচুনিটি কস্ট’ বলে একটা ব্যাপার আছে। বিশাল কিছু পাবার আশায় ক্ষুদ্র কিছু ত্যাগ করার নামই হলো অপরচুনিটি কস্ট। আমার মেয়ে অনন্ত জীবনের সফলতার জন্য দুনিয়ার ক্ষণিক সফলতাকে জলাঞ্জলি দিতে চাইছে–মুসলিম বাবা হিশেবে এর চেয়ে বড় প্রাপ্তি আমার জন্য আর কিছুই হতে পারে না।’

    জাদুশক্তির ওপরে আমার কোনো আস্থা কোনোকালেই ছিলো না। কিন্তু সেদিন ভদ্রলোকের কথাগুলো আমাকে এমনভাবে মোহগ্রস্ত করে ফেলে যে, মুহূর্তের জন্য মনে হলো আমাকে কেউ জাদু করেছে। তার সাদামাটা কথাগুলোর ভাঁজে আমি এমন ভার, এমন তৃপ্তি আর আত্মতুষ্টির সন্ধান পেলাম, যা আমি জীবনভর খুঁজে চলেছি। জীবন নিয়ে এভাবেও ভাবা যায়? এমন জীবনদর্শনও মানুষ অন্তরে লালন করতে পারে? স্বার্থপরতার এই দুনিয়ায় এমন মানুষও আছে, যারা জীবনের গোলকধাঁধায় ভড়কে যায় না, হারিয়ে যায় না? যারা অনুপম আদর্শকে বুকে ধারণ করে তার জন্য জীবনের সবটুকু সুখ, সবটুকু আহ্লাদকে ছেড়ে দিতে পারে? আমি ভাবলাম–আমার ছেলেটাকেও যদি এ রকম দীক্ষা দিতে পারতাম! যদি বলতে পারতাম–এটাই তোমার শেষ গন্তব্য নয়। এরপরে অনন্ত এক গন্তব্যে তোমাকে পাড়ি জমাতে হবে। সেই গন্তব্যের পথকে মসৃণ রাখতে তোমাকে ত্যাগ করতে হবে দুনিয়ার সকল মোহ।’

    ইশ! যদি সত্যিই তাকে এভাবে মানুষ করতে পারতাম, আজ আমিও কি বাবা হিশেবে গর্ববোধ করতে পারতাম না? ছেলে মাদকাসক্ত, মাতাল আর নষ্ট হয়ে গেছে বলে কি বুকে এক জগদ্দল পাথরের স্তূপ আমাকে বয়ে বেড়াতে হতো?

    দরখাস্তটার ওপর আবার চোখ পড়লো আমার। মেয়েটা একেবারে শেষে নিজের নাম লিখেছে এভাবে–আয়িশা বিনতু আলাদিন। আলাদিন নামটা দেখেই এতো দুঃখ-কষ্টের মাঝেও আমি কেন যেন ফিক করে হেসে ফেললাম। আমাদের কৈশোরের সেই আলাদিনের স্মৃতি আমার অবচেতন মন কীভাবে যেন মস্তিষ্কের স্মৃতিঘর থেকে খুঁজে বের করে এনেছে। আমার কপালের ভাঁজ লোকটাকে বিভ্রান্ত করতে না পারলেও, আমার ফিকে হাসিটা তাকে ঠিকই বিভ্রান্ত করে দিলো। ভদ্রলোক নিজ থেকেই বললেন, ‘দুঃখিত স্যার, একটা কথা জানতে চাইছি। দরখাস্তটা দেখে একটু আগে আপনি হেসে ফেললেন দেখলাম। এখানে কি ভুল কিংবা অসৌজন্যমূলক কিছু লেখা আছে?’

    আমার হাসিটা যে মৃদু কোনো হাসি ছিলো না; বরং চোখে লাগার মতোই ছিলো– তা বুঝতে পারলাম হাসির ব্যাপারে ভদ্রলোকের চোখমুখ ভরা পেরেশানি দেখে। তাকে অভয় দিয়ে বললাম, ‘সেরকম কিছু না আসলে। আপনার নামটার সাথে আমার কৈশোরের সুন্দর কিছু স্মৃতি জড়িয়ে আছে। দরখাস্তে আপনার মেয়ের নামে চোখ পড়ে যেতেই আমি খানিকটা স্মৃতিকাতুরে হয়ে পড়েছিলাম।’

    লোকটা আমার কথায় বেশ আগ্রহ দেখিয়ে বললেন, ‘কেমন স্মৃতি, একটু বলা যাবে প্লিজ?’

    নিজের একান্ত ব্যক্তিগত স্মৃতির ব্যাপারে অন্য কারও আগ্রহ আমার জন্য রীতিমতো পীড়াদায়ক। তবে, আমার কৈশোরের সেই স্মৃতিটার সাথে এই লোকটার নামের যেহেতু কাকতালীয় একটা মিল আছেই, তাই তার সামনে সেই স্মৃতির কিছু অংশ রোমন্থন করতে মন চাইলো।

    ‘আসলে, হাইস্কুলে আমাদের ক্লাসে এক ছাত্র ছিলো আলাদিন নামে। পড়াশোনায় খুব বেশি ভালো সে কখনোই ছিলো না। তবে সে খুবই ভদ্র আর নিরীহ গোছের ছিলো। চেহারায় হাবাগোবা একটা ভাব, কথাবার্তায় অপটু আর নিতান্ত শান্ত স্বভাবের কারণে তাকে আমরা ‘হাবাগোবা আলাদিন’ নামে ডাকতাম। তার কিছু স্মৃতি আজকাল আমাকে ভীষণভাবে ভাবায়। আমাদের সেই আলাদিন কতো অল্প বয়সে, কতো নিবিড়ভাবেই না জীবনকে বুঝতে শিখেছিল। অথচ তাকে আমরা কখনোই পাত্তা দিতাম না। লাস্ট বেঞ্চের ছাত্র জ্ঞান করে সব সময় উত্ত্যক্ত করতাম। জানি না আজ সে কোথায়। জীবনের পাঠোদ্ধারে সে আর কোন মহাসমুদ্র পাড়ি দিয়েছে তাও বলতে পারি না। তবে এটা জানি–আমরা যারা একসময় তাকে উপহাস করেছিলাম, তারা একটা কুয়ো থেকে একটা পুকুরে এসে পড়েছি কেবল। সমুদ্র দেখার সৌভাগ্য আমাদের আর হলো কই?’

    কথাগুলো বলতে গিয়ে আমার কণ্ঠসূর বারবার আড়ষ্ট হয়ে পড়ছিল। হৃদয়কে আচ্ছন্ন করে ফেলছিল এক গভীর আবেগ। সে আবেগ যতোখানি না আলাদিনের জন্যে, তারচেয়ে বেশি তার সেই জীবনদর্শনের জন্যে, যার দিকে একসময় প্রফুল্লচিত্তে সে আমাদের আহ্বান করতো।

    তিনি কথা বললেন এবার, ‘সেই কুলটার নাম কি সাদনপুর আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়?’

    আমার শিরদাঁড়া বেয়ে একটা শীতল পানির স্রোত যেন নিচে নেমে গেলো। চমকাবারও একটা সীমা থাকে, কিন্তু এবেলায় আমি সেই সীমা-পরিসীমা ছাড়িয়ে গেলাম যেন। চোখেমুখে বিপুল বিস্ময় ধরে রেখে আমি বললাম, ‘ঠিক তাই। কিন্তু আপনি কীভাবে জানলেন?’

    হেসে ফেললেন লোকটা। তার ঠোঁটের কোনায় সেই মুক্তো-ঝরা হাসি যেন অনেক রহস্যের জট খুলে দেয়। আমার বিস্ময়ের পারদকে মহাশূন্যে তুলে দিয়ে তিনি বললেন, ‘আমিই সেই হাবাগোবা আলাদিন।’

    বজ্রাহত মানুষের মতো স্থির হয়ে গেলো আমার দৃষ্টি। আমাদের সেই আলাদিন আমার সামনে বসে আছে–এ যেন এক অবিশ্বাস্য বাস্তবতা! আমার গলার আওয়াজ কোথায় যেন লুপ্ত হয়ে গেলো। নিজেকে কোনোরকমে সামলে নিয়ে বললাম, ‘তু-তুমি সত্যিই আমাদের সেই আলাদিন?

    ‘তুমি রূপম, তাই না?’

    ‘কীভাবে বুঝলে?’

    ‘শুনেছিলাম আমাদের ওই স্কুলের এক ছাত্রের বেশ নামডাক হয়েছে। দুনিয়াজোড়া খ্যাতি পেয়েছে। আর তা ছাড়া তোমার চেহারাও তেমন পাল্টায়নি। আগের মতোই আছে। এই চেয়ারে তোমাকে দেখে এবং স্কুলের কথা উঠে আসাতে মনে হলো যে, তুমি ছাড়া আর কে হতে পারে?’

    ‘তুমি আমার চেহারাও মনে রেখেছো, আলাদিন?’

    হেসে ফেলল সে। তার দেখাদেখি আমিও হাসতে লাগলাম। আমার মনে পড়ে যায় সেই কৈশোরের গল্প! সেই স্কুল, সেই ক্লাসরুম, সেই বন্ধুদের। কতো স্মৃতি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে সাদনপুর আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠের ধুলোয়, কাঠের বেঞ্চে।

    আমি জিগেশ করলাম, ‘এটা তোমার মেয়ে?’

    ‘হ্যাঁ।’

    হিজাব-আবৃতা মেয়েটার দিকে তাকিয়ে আমি বললাম, ‘বাপকি বেটি হয়েছিস। বেঁচে থাক মা।’

    [পাঁচ]

    আলাদিনের সাথে আমার অনেক আলাপ হয়ে গেছে। আমাদের সেই বিজ্ঞান স্যারের গল্প, অঙ্ক স্যার যে তাকে ‘মুদি দোকানদার’ বলে ডাকতো সেই গল্প, ডাকাবুকো মুনতাসিরের গল্প-সহ আমার বিদেশ-বিভুইয়ের হরেক পদের গল্প। বাদ যায়নি আমার উচ্ছন্নে যাওয়া ছেলেটার গল্পও। নিয়তির কী নির্মম পরিহাস! নামের সাথে জগৎ-জোড়া খ্যাতির ডিগ্রি থাকার পরেও আজ আমি একপ্রকার ব্যর্থ, আর নিতান্ত সাধারণ জীবনযাপনের আলাদিন আজ আমার সামনে একজন সফল পিতা হিশেবে দণ্ডায়মান!

    আমি আলাদিনের হাত ধরে বললাম, ‘চলো আমরা আবার আমাদের সেই কৈশোরে ফিরে যাই। সেই সাদনপুর স্কুলে। টিফিন পিরিয়ড শেষে তুমি রোজ দেরি করে ক্লাসে আসবে আর বিজ্ঞান স্যার বিনা বাক্য-ব্যয়ে রোজকার মতো তোমাকে ছেড়ে দেবে। আযান হলে তুমি এসে আমাদের বলবে, ‘যুহরের আযান হচ্ছে। আমার সাথে মসজিদে যাবে? এই যে দেখো, মুয়াজ্জিন বলছে, ‘হাইয়্যা আলাল ফালাহ।’ মানে হলো–সফলতার পথে এসো। জীবনে সফল হতে চাইলে চলো আমরা সালাতে যাই।’

    যদি সত্যিই ফিরে যেতে পারি জীবনের সেই দিনগুলোতে, সত্যি বলছি আলাদিন, সফলতার পথে তোমার সেই উদাত্ত আহ্বানগুলো আর কোনোদিন উপহাসে ফিরিয়ে দেবো না।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleএবার ভিন্ন কিছু হোক – আরিফ আজাদ
    Next Article প্যারাডক্সিক্যাল সাজিদ – ২ – আরিফ আজাদ

    Related Articles

    তসলিমা নাসরিন

    সেইসব অন্ধকার – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    আমার প্রতিবাদের ভাষা – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    অগ্রন্থিত লেখার সংকলন – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    বন্দিনী – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    নির্বাসন – তসলিমা নাসরিন

    August 20, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    নেই, কিছু নেই – তসলিমা নাসরিন

    August 20, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Our Picks

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }