Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    জীবন যেখানে যেমন – আরিফ আজাদ

    লেখক এক পাতা গল্প152 Mins Read0

    ০৬. জীবনের রকমফের

    [এক]

    বাসের হেল্পার ভাড়া বললো পঁচিশ টাকা। প্রতিদিনের নির্ধারিত যা ভাড়া, তার চাইতে পাঁচ টাকা বেশি দাবি করায় রক্ত যেন মাথায় চড়ে বসল। দেশটা কি তাহলে মগের মুল্লুকে পরিণত হলো? যার যা মন চাইবে আদায় করবে?

    আমার মধ্যবিত্ত মনের ক্রোধ মনের ভেতরেই গোঙাতে লাগলো, বাইরে তা যে দ্বিগুণ প্রলয়ে আছড়ে পড়বে সেই সাহস আর শক্তি আমাদের কোথায়? তবুও, কিছু অন্তত বলতে হয়, তা না হলে মধ্যবিত্ত জীবনের মোলোকলাটাও আবার অপূর্ণ থেকে যায় অনেক সময়।

    চেহারায় পরিমিত ক্ষোভ আর বিরক্তির রেশ টেনে এনে বললাম, ‘পঁচিশ টাকা মানে? বিশ টাকা দিয়ে প্রতিদিন যাওয়া-আসা করি। পঁচিশ টাকা দেবো কেন?’

    খেয়াল করলাম, আমার ক্ষোভ নিয়ে হেল্পারের মাঝে কোনো তাড়না নেই। আমাকে ফুঁসতে দেখে সে যে ভয়ে এতোটুকুন হয়ে যাবে, নিদেনপক্ষে ভাড়া বাড়ানোর ব্যাপারে কাঁচুমাচু করে বিনীত গলায় তার যুক্তি পেশ করবে–এমন কোনো লক্ষণও তার মাঝে দেখা গেলো না। তার অপরিবর্তিত, কিন্তু বিরক্তি-মিশ্রিত চেহারা যেন আমাকেই শাসানোর প্রস্তুতি নিতে ব্যস্ত। অবশ্য, তার কাছ থেকে এতোটুকুন আশা করাটাও নেহাত বোকামি বৈ কিছু নয়। দম্ভের দায়ভার মেটাতে আমি যদি তার গাড়ি থেকে নেমেও পড়ি, তাতে তার বিশেষ কোনো ক্ষতি নেই। আমার শূন্যতা পূরণের জন্যে বাইরে একঝাঁক উৎসুক যাত্রী অজগরের মতন হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছে। নেমে গেলেই মুহূর্তে পূরণ হয়ে যাবে আমার শূন্যস্থান। না গেলে বরং ক্ষতিটা আমারই। অতো দূরের পথ; কখন যে আবার নতুন বাস আসবে তাও নিশ্চিত করে বলা যায় না। সুতরাং, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বাসায় ফিরতে হলে বাড়তি টাকা না গুনে উপায় নেই কোনো।

    হেল্পারের কর্কশ কিন্তু পরিচিত চিৎকারে সংবিৎ ফিরে পেলাম। আমার ভাবনার সুরে ছেদ ঘটিয়ে সে তার বাজখাঁই গলায় বলে উঠলো, ‘পঁচিশ টাকাই ভাড়া। টাকা না থাকলে নাইমা যান। আপনারে কেউ ধইরা রাহে নাই।

    হেল্পারের কথাই সত্য। কেউ আমাকে জোর করে তার গাড়িতে চাপিয়ে দেয়নি। ‘পাছে নেমে যাই ভেবে কোনো আহত নয়নও সবিশেষ তাড়না নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে নেই। এই যে বিশ টাকা থেকে লাফ দিয়ে পঁচিশ টাকা ভাড়া গুনতে হচ্ছে, আমি ব্যতীত তা নিয়ে আর কারও মাঝে কোনো হাপিত্যেশ, কোনো মাথাব্যথাই দেখা গেলো না। একটা মানুষ পর্যন্ত টু শব্দটাও করলো না। দুর্মূল্যের বাজারে অন্যায় আর অনিয়ম মানুষের গা সয়ে গেছে, না তাদের বোধশক্তি লোপ পেয়েছে তা বুঝে ওঠা মুশকিল। অগত্যা পঁচিশ টাকা ভাড়া গুনেই আমাকে ফিরতে হলো।

    বাসায় ফিরেছি; রোজকার মতো–কাঁধে ব্যাগ, চোখে চশমা আর শরীরভরা একরাশ ক্লান্তি নিয়ে। আমাকে দরজা খুলে দেয় আমার স্ত্রী, রেবেকা। দরজা খুলেই নিত্যদিনকার অভ্যাসমতো সালাম দিয়ে একপাশে আড়াল হয়ে দাঁড়ায় সে। আমি ক্লান্ত ভীষণ। হনহন করে হেঁটে চলে আসি নিজেদের রুমে। রেবেকা এসে আমার কাছে দাঁড়ায়। শশব্যস্ত হয়ে বলে, ‘তোমাকে লেবুর শরবত করে দিই?’

    ক্লান্তিতে আমার গা নুইয়ে আসে। শরীরটা যেন বিছানা ছোঁয়ার যন্ত্রণায় ছটফট করছে। ঘরে এলে আমার বাকশক্তি লোপ পায়; দরকারি কথাটুকু বলতেও কেমন অনীহা আর অসহ্য লাগে। রেবেকা আবার প্রশ্ন করে, মাথাব্যথা করছে? রং চা করে দিই? লেবু আর আদা দিয়ে?

    আমি রং চায়ের ব্যাপারেই সম্মতি জ্ঞাপন করি। আদিকার রাজারা যেভাবে হুকুম তলব করতো, ঠিক সেরকম–একটা অস্পষ্ট ইশারায়। রেবেকা ভোঁ-দৌড়ে রান্নাঘরে ছুটে যায়। তড়িঘড়ি করে চুলোয় বসিয়ে দেয় পানি। একফাঁকে কেটে নেয় এক ফালি লেবু আর খানিকটা আদা। মুহূর্তকাল পরেই সে ধোঁয়া ওঠা কাপ হাতে আমার সামনে এসে দাঁড়াল। চায়ের কাপ যে-ই না মুখে নিতে যাবো, ওমনি বিকট শব্দে কেঁদে ওঠে আমার ছেলে, আব্দুল্লাহ। কান্নার সে কী আওয়াজ! কানের পর্দা যেন ছিঁড়ে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেলো।

    আমার সামনে থেকে একেবারে হাওয়ার মতোই অদৃশ্য হয়ে গেলো রেবেকা। যে রুমে আব্দুল্লাহ শুয়ে আছে, সেখানে চোখের পলকে উপস্থিত হয়ে প্রয়োগ করতে লাগলো বাচ্চার কান্না থামানোর আদিম মেয়েলি কৌশল। মেয়েদের ঝুলিতে যে ক’প্রকারের সান্ত্বনা-বাক্য বাচ্চাদের জন্য মজুদ থাকে, তার সব ক’টাই রেবেকা একে একে আব্দুল্লাহর সামনে মেলে ধরতে লাগলো। কিন্তু আব্দুল্লাহও ছেড়ে কথা বলবার পাত্র নয়। এমন মন-ভোলানো মন্ত্রে সম্ভবত তার আর রুচি নেই। রেবেকার সমস্ত চেষ্টাকে ব্যর্থ করে দিয়ে আব্দুল্লাহও সমান উৎসাহ আর উদ্দীপনা নিয়ে কান্না অব্যাহত রাখলো।

    আব্দুল্লাহর কান্নার আওয়াজে আমার যে বেশ অসুবিধে হচ্ছে সেটা রেবেকা বোঝে। আর বোঝে বলেই সেও হতোদ্যম হয়ে যায়নি। রেবেকা একসুরে আব্দুল্লাহকে শান্ত করবার চেষ্টা চালিয়ে গেলো, ও বাবা আমার! আমার সোনা আব্বটা! আর কান্না করে না। এই দেখো, আম্মু তোমাকে কোলে নিয়েছি বাবাই। আর কান্না করে না আমার বাবুটা। ওলে ওলে বাবা আমার!

    আব্দুল্লাহর কান্না আর রেবেকার কান্না থামানোর সংগীত–দুটোর যৌথ প্রযোজনা আমার মাথাব্যথাটা যেন আরও দ্বিগুণ বাড়িয়েই দিলো।

    শরীর একটু হালকা লাগলে ফোন হাতে নিয়ে, দেয়ালের সাথে পিঠ ঠেকিয়ে প্রবেশ করি নীল-শাদার ভার্চুয়াল জগতে। জগৎটা অদ্ভুত মায়াময়! উত্তর-আধুনিক সময়ে, আমাদের সকল সুখ-দুঃখের গল্প এই জগতের বাসিন্দারা কীভাবে যেন জানতে পেরে যায়। যান্ত্রিকতার মোহে কিংবা আধুনিকতার লোভে আমরা আমাদের সকল সম্পর্কের গল্প, সকল অর্জন আর ব্যর্থতার ফিরিস্তি এখানে না বলে শান্তি পাই না। একসময় আমরা ছিলাম সামাজিক জীব। কিন্তু সে যুগের অবসান ঘটেছে বেশ আগেই। আমরা প্রবেশ করেছি পৃথিবীর মেরুকরণের এমন এক মোহময় সময়ে, যেখানে আমরা হয়ে বসে আছি ভার্চুয়াল বাসিন্দা। আমাদের এখানেই ঘোর, এখানেই ভালো লাগা।

    প্রতিদিন রাতের এই অংশটায় আমার কাজ খুবই সুনির্দিষ্ট–ফেইসবুক স্ক্রল করা। সারাদিনের জমানো সংবাদ, খেলাধুলার যাবতীয় আপডেট, বন্ধুদের হাসিখুশি মুখচ্ছবি দেখতে দেখতে কখন যে সময় বয়ে যায়, টের পাওয়া যায় না। আজও তা-ই করছি। ফেইসবুকের গভীর থেকে গভীরে গিয়ে তুলে আনছি মিস হয়ে যাওয়া ঘটনাগুলোকে, সময়ের সংগতির সঙ্গে নিজেকে যুক্ত রাখছি দুর্দান্তভাবে; কে জানে, আগামীকাল অফিসে গিয়ে যদি দেখা যায় আজকের কোনো ঘটনা নিয়ে খুব শোরগোল পড়ে গেছে, কিন্তু তার বিন্দুবিসর্গও আমার জানা নেই, তখন আমার নাকউঁচু কলিগেরা আমার দিকে কী অদ্ভুতভাবেই-না তাকাবে! সূর্যের নিকটতম গ্রহ বৃহস্পতিতে প্রাণের সন্ধান মিলবার সংবাদেও তারা এতোখানি চমকাবে না যতখানি চমকাবে আমাকে দেখে। বিস্ময় ধরে রাখতে না পেরে কেউ কেউ বলেও বসতে পারে, একটা ঘটনা ঘটার চব্বিশ ঘণ্টা পার হয়ে গেলো, আর আপনি তার কিছুই জানেন না? কোন দুনিয়ায় বাস করেন আপনি?

    আমি যে পৃথিবী নামক গ্রহেই বাস করি এবং দুনিয়ার সাথে আমারও যে রয়েছে ভালো যোগসাজশ, অন্তত তার স্বাক্ষর রাখতে হলেও আমাদের এখন ভার্চুয়ালমুখী হতে হয়।

    ইতোমধ্যেই আব্দুল্লাহ আবার ঘুমিয়ে পড়েছে। খেয়াল করলাম, রেবেকা খুব সযত্নে আব্দুল্লাহকে শুইয়ে দিয়ে গেলো আমার পাশে। তার ছোট্ট মশারিটাও টাঙিয়ে দেওয়া হলো। আব্দুল্লাহকে শুইয়ে দেওয়ার পর রেবেকা খুব নিচু স্বরে, পাছে আব্দুল্লাহ জেগে যায় এই ভয়ে, জিগ্যেশ করলো, ‘খাবার কি এখনই দেবো?’

    একেবারে শুরুর ক্লান্তিটা যখন আর নেই, তখন কথা একটু বলাই যায়। রেবেকার প্রশ্নের জবাবে তাই বললাম, একটু পরেই দাও।

    একটু পরে দেওয়ার কথা শুনে রেবেকা আবার রান্নাঘরে ছুটে গেলো। সেই কবেই সে রান্না চড়িয়েছিল কে জানে। ঠান্ডায় সবকিছু জমে বরফ হয়ে আছে নিশ্চয়। খাবারগুলো এবার গরম করবার পালা। সে খুব সযত্নে তার কাজে গেলো। তার কাজ, যা সে প্রত্যহ করে। রুটিন মেনে। যাতে কোনোদিন ব্যত্যয় ঘটে না।

    একটু পরে সে আবার ছুটে এলো আমার কাছে। শাড়ির আঁচলে হাত মুছতে মুছতে বললো, ‘চিংড়ির ঝোল আর গরুর গোশত দুটোই করা আছে। দুটোই গরম করবো?’

    আমি তন্ময় হয়ে ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে আছি। খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা লেখা চোখের সামনে এখন। আমার এক বন্ধু, যার সাথে ফেইসবুকেই আমার পরিচয়, তার লেখা। তাদের ডিভোর্স হয়ে গেছে আজ। ডিভোর্স-পরবর্তী প্রতিক্রিয়া সে খুব আবেগময় করে তুলে ধরেছে। প্রচণ্ড ভালোবাসতো একজন অন্যজনকে। এরপর, কী থেকে যে কী হলো–ডিভোর্স! খুব কষ্টই লাগলো। তাদের দুজনের জন্যই।

    রেবেকা আবার বললো, ‘শুনছো? তোমাকে একটা প্রশ্ন করেছি।‘

    আমি মাথা তুলে রেবেকার দিকে তাকালাম। বললাম, ‘কী?’

    ‘চিংড়ি আর গোশত দুটোই করা আছে। দুটোই গরম করবো কি না জানতে চেয়েছি। নাকি দুটোর যেকোনো একটা?’

    বেশ রাগ উঠলো। এটা কোনো প্রশ্ন হলো করার মতো! গলা উঁচু করে, একটু জোর শব্দেই বললাম, যেকোনো একটা করলেই তো পারো। এটা জিগ্যেশ করার জন্য তো কাকতাড়ুয়ার মতো দাঁড়িয়ে থাকতে হয় না।

    রেবেকা চুপ করে থাকলে কিছুক্ষণ। এরই ফাঁকে আমি আগের সেই লেখায় পুনরায় মনোনিবেশ করেছি। সেই লেখায়, যেখানে আমার বন্ধু তুলে ধরেছে একটা সংসার ভাঙার কাহিনি। এতোদিনের গোছানো একটা সংসার কীভাবে ভেঙে গেলো সেই মর্মান্তিক দৃশ্যপট থেকে নিজের চোখদুটো সরানো দায় হয়ে পড়েছে। খানিক বাদে রেবেকা আবার বললো, ‘সেদিন তুমি চিংড়ির ঝোল খেতে চেয়েছিলে। আমার জ্বর থাকায় রান্না করা হয়নি। তাহলে চিংড়িটাই গরম করি?’

    রেবেকার কথাগুলো আমার মনোযোগে বেশ বিঘ্ন ঘটালো। সারাদিন কাজের মধ্যেই ডুবে থাকতে হয়। বাসায় ফিরে যে একটু আরাম-আয়েশ করবো, নিজের মতো করে খানিকটা সময় পার করবো তার জো নেই। জেরার পর জেরা চলতেই থাকে। আমিও তো মানুষ, কোনো যন্ত্র তো নই। মানুষ হিশেবে আমারও তো কিছু নিজস্ব সময় চাই। কিছু সময়, যা একান্তভাবেই কেবল আমার।

    মুখে বিরক্তির সর্বশেষ রেখাঁটি ফুটিয়ে তুলে বললাম, ‘জানোই যখন আমি চিংড়ির ঝোল খেতে চেয়েছি, সেটা তাহলে বারে বারে জিগ্যেশ করছো কেন? চিংড়িটাই গরম করে নিলে পারো।

    আমার বিরক্তিভরা উত্তরে রেবেকা এবার সত্যি সত্যিই দমে গেলো। ধীরপায়ে সে পা বাড়াল রান্নাঘরের দিকে। দরজার যে জায়গায়টায় রেবেকা এতোক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলো, সেখানে এখন একটা পর্দা দুলছে। রেবেকার প্রস্থানে শূন্যে তৈরি হওয়া হাওয়ায়। আর আমি? আমি আবারও ডুব দিয়েছি নীল-শাদার সেই বায়বীয় জগতে।

    খাওয়া-দাওয়া পর্বের একেবারে মাঝামাঝি পর্যায়, আবারও আব্দুল্লাহর সেই গগনবিদারী চিৎকার। সেই কান ফাটানো কান্নার আওয়াজ। আমার তাতে কোনো অসুবিধা হয় না অবশ্য। বেশ খেতে হয়েছে চিংড়ির ঝোলটা। আমি আরাম করে খাচ্ছি। আর রেবেকা? আব্দুল্লাহর কান্নার শব্দ শুনে সে কোন ফাঁকে যে হাওয়ায় উড়ে আব্দুল্লাহর কাছে চলে গেলো, আমি টেরই পেলাম না। আবারও সেই একই সুর। একই সংগীত। ও বাবা আমার! আমার সোনা আটা! আর কান্না করে না। এই দেখো, আম্মু তোমাকে কোলে নিয়েছি বাবাই। আর কান্না করে না আমার বাবুটা। ওলে ওলে বাবা আমার!

    সকাল হয়। আমি অফিসের জন্য বের হই। আমার যা যা দরকার, সবকিছুই হাতের কাছে পাওয়া যায়। রেবেকাই এনে রাখে। প্রতিদিন। নিয়ম করে। আজও তার ব্যত্যয় হয়নি। সে দরজা ধরে দাঁড়িয়ে থাকে। ততোক্ষণ, যতক্ষণ আমি তার দৃষ্টি থেকে অদৃশ্য না হই। এটাই হলো রোজকার জীবন। আমার…আমাদের।

    [দুই]।

    আজ রেবেকা বাপের বাড়ি যাচ্ছে। আমার শ্বশুর এসেছেন তাকে নিয়ে যেতে। কাজের ভীষণ চাপ; রেবেকাকে রেখে আসার কোনো ফুরসত আমার হাতে নেই। কদাচিৎ থাকে, সব সময় নয়। ঠিক এগারোটা ত্রিশ মিনিটে তারা চলে গেলো। আমি অবশ্য এর আগেই অফিসে চলে এসেছি। সকালবেলা রেবেকা বলছিল, ‘কবে যাবে আমাদের ওখানে?’

    আমি শার্টের হাতা গুটাতে গুটাতে বললাম, ‘বলতে পারছি না। কাজের চাপ আছে।

    আমার উদাসীন উত্তরে রেবেকার চেহারা গুমোট অন্ধকারে ছেয়ে গেলো। বাড়তি কোনো প্রশ্ন করে নিজের খারাপ লাগাটাকে বাড়ানোর পথে না গিয়ে সে বললো, ‘ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া কোরো। বাইরের খাবার খেয়ো না যেন! ক্যান্টিনে খেতে পারো। অন্তত বাইরের চেয়ে ভালো।

    ‘তা বটে।

    ‘বেশি রাত জেগে না। রাত জাগলে তোমার চোখের নিচে কালচে দাগ পড়ে।

    ‘হুম।

    ‘বাবা বলছেন মায়ের অবস্থা খুব বেশি ভালো নয়। বেশ অনেকদিন থাকা লাগতে পারে।

    ‘সমস্যা নেই।

    ‘তোমাকে আরেকটা ডিম অমলেট করে দিই?’

    ‘দরকার নেই।

    ওপরের কথাগুলোই রেবেকার সাথে আমার আজকের শেষ সংলাপ। এরপর আমি অফিসের জন্য বেরোই। ঠিক এগারোটা ত্রিশ মিনিটে, রেবেকা মেসেজ করেছে। আমার ফোনে। লিখেছে, আমরা এইমাত্র বেরোলাম। তোমার অপেক্ষায় থাকব।

    [তিন]

    বাসায় ফিরেছি রোজকার মতো। কলিংবেল চেপে দাঁড়িয়ে আছি বাইরে। রেবেকার কোনো সাড়াশব্দ নেই। ও, মনে পড়েছে। ও তো আজ বাসায় নেই। আজিব! দরজার সাথে এতোবড়ো একটা তালা ঝুলছে সেটাও আমার চোখে পড়লো না! রেবেকার ওপর কী এক অভ্যস্ততা তৈরি হয়ে গেলো আমার! ব্যাগ হাতড়িয়ে বাসার চাবি বের করলাম। দরজা খুলে ভেতরে আসতেই মনে হলো ঘরজুড়ে এক নিশ্চপ নীরবতা। সুনসান। বাতিগুলো জ্বালাতেই চোখ গিয়ে পড়লো রেবেকার পড়ার টেবিলে। একটা খাতা খোলা অবস্থায় পড়ে আছে সেখানে। কৌতূহল জাগার কথা নয়। এমন নিতান্ত সাধারণ বিষয়ে আমার কোনোদিন কোনো আগ্রহ জন্মেনি। কিন্তু আজকের ব্যাপারটা সাধারণ হলেও আচমকা। খুবই গোছালো ধরনের মেয়ে রেবেকা। আনমনে এই খাতাটাকে এভাবে সে রেখে চলে যাবে তা অন্তত আমার মনে হয় না।

    খাতাটা হাতে নিতেই আমার চোখের সামনে জ্বলজ্বল করে উঠলো যেন অসংখ্য শব্দমালা। রেবেকার হাতের লেখা; কিন্তু কী লেখা এতে?

    ‘আমি জানি জীবিকার তাগিদে তোমাকে ছুটতে হয়। ভীষণ ব্যস্ততায় পার হয় তোমার সারাটা দিনমান। একমাথা যন্ত্রণা নিয়ে তুমি বাসায় ফেরো রোজ। তোমার মুখাবয়ব দেখলেই আমি আঁচ করতে পারি তোমার কর্মময় জীবনের ক্লান্তি। তোমার ক্লান্তি আমাকে পীড়া দেয়; তোমার সামান্য অসুবিধেও আমাকে যন্ত্রণায় কাতর করে ফেলে। তুমি অফিস থেকে ফিরলেই আমি শশব্যস্ত হয়ে পড়ি তোমাকে সামলাতে। তুমি কি কফি খাবে না শরবত, সেই চিন্তায় আমি অস্থির হয়ে যাই। তোমার রাতের খাবার, শোবার বিছানা, সকালের নাস্তা, অফিসের পোশাক–সবকিছু ঘিরেই আমার পৃথিবী। আমি ব্যস্ত থাকতে চাই তোমাকে নিয়ে।

    আচ্ছা, অফিস থেকে ফিরে কখনো কি তুমি জানতে চেয়েছো আমি দুপুরে খেয়েছি। কি না? তুমি জানো আমি সাজতে পছন্দ করি। ঠিক কতোদিন হয় সেজেগুজে তোমার সামনে দাঁড়াইনি, মনে করতে পারো? কখনো নিজ থেকে জানতে চেয়েছো। কেন আমি আগের মতো সাজার ফুরসত পাই না? অফিস থেকে যে বিধ্বস্ত চেহারা নিয়ে তুমি আসো, সেই চেহারা আমাকে হতবিহ্বল করে দেয়। তোমার পরিশ্রান্ত অবয়বের অবসাদ আমি বুঝতে পারি। আচ্ছা, তুমি কি কখনো আমার বিধ্বস্ততা বোঝার চেষ্টা করেছিলে? অন্তত একবার? সংসারের ঘানি টেনে আমারও যে মাঝে মাঝে ক্লান্ত লাগে, সেটা তুমি অনুভব করেছো কখনো?

    সারাটা দিন একা একা থাকি। একটা অবুঝ বাচ্চাকে সামলাই। তার সাথে আর কতই বা কথা বলা যায়, বলো? মন চায় খুব করে কথা বলতে কিংবা খুব মন দিয়ে কথা শুনতে। অপেক্ষায় থাকি কখন তুমি ফিরবে আর আমি মেলে বসবো আমার গল্পের ডালপালা। তুমি তন্ময় হয়ে শুনবে আমার কথা। আর যখন তুমি বলা শুরু করবে, আমি কেবল মন্ত্রমুগ্ধের মতন শুনে যাবো। কিন্তু দেখো, তুমি ঠিকই তন্ময় হয়ে থাকো। কিন্তু তোমার সেই বিস্ময়, সেই আবেগ, সেই বিহ্বলতা জুড়ে কেবল আমিই নেই। আছে অন্য অনেকে। বাসায় এসে তুমি সেই ভার্চুয়ালে ডুব দাও, আমার কথা তোমার খেয়ালই থাকে না। তুমি যেখানে আমগ্ন ডুবে থাকো, সেখানে কেউ কি তোমার জন্য দরজা ধরে অপেক্ষা করে? তোমার পছন্দের খাবার প্রস্তুত করে। অধীর অপেক্ষার প্রহর গোনে তোমার জন্য? কিন্তু দেখো, যে মানুষটা তোমার পথ চেয়ে বসে থাকে সারাদিন, তার জন্য তোমার এতোটুকুও সময় হয় না।

    তুমি সারাদিন ব্যস্ত থাকো, তাই তোমাকে অকারণ প্রশ্ন করলে রেগে ওঠো। কিন্তু, তোমার ছেলে, যাকে আমার অস্তিত্বে ধারণ করে পৃথিবীর আলো দেখিয়েছি, সে যে আমাকে প্রতিদিন কতো সহস্র হাজার প্রশ্ন করে তা তুমি ভাবতেও পারো না। কিন্তু তার প্রশ্নের প্রতি কোনোদিন সামান্য রাগ, সামান্য উদাসীনতা আমি দেখাইনি; বরং মুখে একরাশ হাসি আর ভালোবাসা মিশিয়ে তার প্রশ্নগুলোর উত্তর দিই। ভালোবাসার বাঁধনটা তো এমনই, বলো?

    আব্দুল্লাহকে ঘিরে সারাদিন আমার যে ব্যস্ততা, সেই ব্যস্ততা কখনোই কি তোমার চোখে পড়ে? কখনো কি তুমি আমার সেই ব্যস্ততার মূল্যায়ন করেছিলে? তুমি কেবল দেখছো তোমার ছেলেটা দিন দিন বড় হয়ে উঠছে। এটা শিখছে, ওটা শিখছে। কিন্তু তার পেছনে আমার যে বিনিয়োগ, সেই বিনিয়োগ কখনোই কি তোমার চোখের সামনে দৃশ্যমান হয়েছে?

    বিশ্বাস করো, আমারও একটা আলাদা পৃথিবী আছে। আমার সেই আলাদা পৃথিবীজুড়ে কেবল তুমি আর তুমি। তুমিই আমার সেই জীবনের রং। তোমার অবসরের সমস্তটা জুড়ে আমি থাকতে চাই। সারাদিনের ব্যস্ততা শেষে, তুমি এসে আমার সাথে খোশগল্পে মেতে উঠবে, এমন স্বপ্ন দেখতে দেখতে আমি রোজ ঘুমিয়ে পড়ি। কিন্তু স্বপ্নটা আমার চোখের পাতায় রয়ে যায়। তুমি তোমার মতোই। তুমি আসো। ডুবে যাও একটা নীল-শাদার জগতে। খাও। এরপর ঘুম। আমার জন্য তোমার কি একটু সময় থাকতে নেই? অন্তত একটু ফুরসত?

    [চার]

    পকেট হাতড়ে মোবাইল বের করলাম। অবিশ্বাস্য! ডায়াল লিস্টের কোথাও রেবেকার নাম্বার নেই। এই এতোদিন পার হয়ে গেলো সে আমার ঘরে নেই, অথচ এতোদিনে একটাবার আমি তাকে ফোন দিইনি? কতোদিন হয় তার জন্য কিনে আনি না বেলি ফুলের মালা। সত্যিই তো, কতোদিন হয় তাকে আমি সাজতে দেখি না। আব্দুল্লাহর জন্মের পর তার শরীরটাও ভেঙে গেছে। ছেলেটাকে সামলাতে গিয়ে বেচারি নিজের যত্নের কথাটুকুও ভুলে বসে আছে। তবে সে ভোলে না আমাকে। আমাকে ঘিরেই তার অঢেল ব্যস্ততা। আর আমার ব্যস্ততা? অফিস…ফেইসবুক…অফিস…

    [পাঁচ]

    এপাশ-ওপাশ দুলুনি খেতে খেতে এগিয়ে চলেছে আমাদের ট্রেন। আমি ছুটে যাচ্ছি রেবেকার কাছে। আমার হাতে ফুলের তোড়া। বেলি আর কাঠগোলাপ ফুলের সমন্বয়ে বানানো। বেলি ফুল রেবেকার পছন্দ, আর কাঠগোলাপ আমার। তার মাঝখানে একটা চিরকুট। তাতে লেখা–I Love You’…

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleএবার ভিন্ন কিছু হোক – আরিফ আজাদ
    Next Article প্যারাডক্সিক্যাল সাজিদ – ২ – আরিফ আজাদ

    Related Articles

    তসলিমা নাসরিন

    সেইসব অন্ধকার – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    আমার প্রতিবাদের ভাষা – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    অগ্রন্থিত লেখার সংকলন – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    বন্দিনী – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    নির্বাসন – তসলিমা নাসরিন

    August 20, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    নেই, কিছু নেই – তসলিমা নাসরিন

    August 20, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Our Picks

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }