Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    জীবন-স্বাদ – আশাপূর্ণা দেবী

    লেখক এক পাতা গল্প125 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    ৩. খিড়কির দরজা

    আর একবার খিড়কির দরজাটায় মৃদু শব্দ হয়।

    প্রভাত এসে দাঁড়ায় একহাতে একটা ভাল পাকা পেঁপে, আর একহাতে একটা টাটকা ইলিশ মাছ নিয়ে।

    পেঁপেটা সাবধানে দাওয়ার ধারে নামিয়ে রেখে বলে ওঠে, হুড়কোটা ভোলা পড়ে কেন? এই ভরসন্ধ্যাবেলা একা রয়েছ?

    মল্লিকা মুচকি হেসে বলে, একা বলেই তো সাহস দুর্বার। মনের মানুষ ধরতে দোর খুলে রেখেছি। তা এমনি আমার কপাল যে, মনের মানুষ ধরা দিতে এসে ভয় পেয়ে পালায়।

    প্রভাত অবশ্য এই উগ্র পরিহাসটুকু নিজের সম্পর্কে প্রযোজ্য করে নিয়ে পরিপাক করে ফেলতে পারে। আর পারে বলেই হেসে বলতে পারে, পালাবার আর জো কোথায়? সে তো লটকেই পড়ে আছে।…কিন্তু আজও এখনও অঙ্গে সেই বিশুদ্ধ পবিত্র শাড়ি? এত দেরি করে এলাম তবু কাজ শেষ হয়নি?

    হঠাৎ মল্লিকা একটা বেপরোয়া কাজ করে বসে। শাশুড়ির চুঁমার্গের আর বিশুদ্ধতার প্রশ্ন ভুলে ঝাঁপিয়ে এসে পড়ে প্রভাতের গায়ের উপর প্রায় সত্যি বাঘিনীর মত। সাপের মত দুখানা হাতে তাকে পিষে ফেলে নেশা ধরানো গলায় বলে, নাই বা হল কাজ শেষ! তুমি পারো না আমাকে শেষ করে দিতে?…।

    ছি ছি, এ কী! শিউরে উঠে মল্লিকাকে প্রায় ঠেলে সরিয়ে দিয়ে প্রভাত নিজে ছিটকে পাঁচ হাত সরে গিয়ে ভৎর্সনার সুরে বলে, মার রান্না করতে করতে মাছের ওপর এসে পড়লে? দেখো তো কী অন্যায়! যাও যাও, শাড়ীটা বদলে এসো।

    কিন্তু মল্লিকা স্বামীর এই ব্যস্ত অনুজ্ঞা পালনের দিক দিয়েও যায় না। বরং আর একবার কাছে। সরে এসে তাকে দুই হাতে ঝাঁকুনি দিয়ে দাঁতে দাঁত পিষে তীব্র কণ্ঠে বলে, তুমি কী, তুমি কী? তোমার দেহে কি পুরুষের রক্ত বয় না? যে রক্তে কোন কিছুতে এতটুকু সাড়া জাগে না!

    বিমূঢ় প্রভাত কি বলত কে জানে, কিন্তু ঠিক এই মুহূর্তে বাইরে প্রভাত-জননীর তীব্র তিক্ত শানানো গলা বেজে ওঠে, বৌমা কি দুধ চড়িয়ে ঘুমিয়ে গেছ, না পাড়া বেড়াতে গেছ! দুধ পোড়া গন্ধে যে রাজ্য ভুবন ভরে গেল!

    .

    তারপর সে রাত্রিটা মল্লিকার কেমন করে কাটে কে জানে, কিন্তু পরদিন থেকে ভারী চুপচাপ আর শান্ত হয়ে যায় সে।

    ভোরবেলা উঠে স্নান সেরে পূজোর ঘরে ঢুকে ঘর মোছে, চন্দন ঘষে রাখে, ধূপ জ্বালে, তারপর সাজি হাতে নিয়ে বাগানে যায় ফুল তুলসী তুলে আনতে।

    বাগান মানে নিতান্তই অযত্নবর্ধিত খানিকটা জমি, প্রভাতের মা নিজের প্রয়োজনে দুচারটে ফুল আর তুলসীর গাছ পুঁতেছেন। সে ফুল তুলতে তুলতে মল্লিকা ভাবে, এই বাগানটাকে আমি সুন্দর করে তুলব, ফুল ধরাব, রঙ ফলাব।

    আকাশে এত রং, বাতাসে এত রস, সমস্ত পরিবেশে এমন স্নিগ্ধতা এমন পবিত্রতা–এ সমস্তই বিফল হবে? আমি হেরে যাব? মল্লিকার বাবার রক্ত মাথা হেঁট করে আসর ছেড়ে চলে যাবে, জয়ী হয়ে উঠবে মামার অন্ন?

    ছি ছি, কী লজ্জা কী লজ্জা! কী ভাবল কাল প্রভাত? ও কী মল্লিকাকে ঘৃণা না করে পারবে?

    কিন্তু তাই কি?

    কোথায় পায় তবে প্রভাত সারারাত্রিব্যাপী অমন নিশ্চিন্ত শান্তির ঘুম? মল্লিকা যে সারারাত জেগে বসে থেকেছে, জানলার শিকে মাথা ঠুকেছে, অর্ধেক রাত্রে ছাতে উঠে গিয়ে প্রেতিনীর মত দীর্ঘ ছায়া ফেলে দীর্ঘশ্বাসে মর্মরিত হয়ে ঘুরে বেড়িয়েছে, তার তো কিছুই টের পায়নি প্রভাত।

    শেষরাত্রির স্নিগ্ধ বাতাসে আস্তে আস্তে কেমন অদ্ভুতভাবে স্তিমিত হয়ে গেছে মল্লিকা। নতুন করে সংকল্প করেছে সে তার মায়ের মত হবে। তাই ধূপের গন্ধের মধ্যে ফুলের গন্ধের মধ্যে চন্দনের গন্ধের মধ্যে তার মাকে খুঁজে পেতে চায়।

    .

    করুণাময়ী হৃষ্ট হন।

    ভাবেন গত সন্ধ্যার অসতর্কতা; অনুতাপে আর করুণাময়ীর বাঘা শাসনের ভয়ে বৌ ঠাণ্ডা মেরে গেছে।

    হুঃ বাবা, কথাতেই আছে হলুদ জব্দ শিলে, বৌ জব্দ কীলে! তা কীল মারা-টারার যুগ আর নেই অবিশ্যি, কিন্তু জিভের ওপর তো আর আইন বসানো যায় না?

    কাকার একটা চিঠি এসেছে বলল প্রভাত খামের চিঠিটা হাতে নিয়ে। করুণাময়ী মুখ তুলে বললেন, খামে চিঠি! ব্যাপার কি? হঠাৎ আবার কি বার্তা? কই পড় শুনি।

    প্রভাত ইতস্তত করে বলে, ওই মানে আর কি, লিখেছেন যে আমি ওখানের চাকরীটা ছেড়ে দেওয়া পর্যন্ত তিনি খুবই দুঃখিত ছিলেন, তা সম্প্রতি আবার একটা ভাল পোস্ট হঠাৎ খালি হয়েছে, কাকা চেষ্টা করলেই হয়ে যেতে পারে। এখন আমি যদি ইচ্ছে করি।

    করুণাময়ী ছেলের কথাটা শেষ করতে দেন না, প্রায় ধেই ধেই করে ওঠেন, বটে বটে! খুব যে আমার হিতৈষী এলেন দেখছি। ছেলেটিকে বাড়ীছাড়া না করলে আর চলছে না। ভেবে বুক ফেটে যাচ্ছে যে ছেলেটা মায়ের কোলের কাছটায় রয়েছে, ঘরের দুধটা মাছটা ফলটা তরকারিটা খাচ্ছে। আর কিছু নয়, এ ওই তোর কাকীর কুপরামর্শ। আমার ছেলেটা যাতে আমার কাছে না থাকতে পায়।…সেবার অমনি বরকে পরামর্শ দিয়ে দিয়ে একটা চাকরী দিইয়ে সেই ছুতোয় নিয়ে গেল। বোনঝির সঙ্গে বিয়ে দিয়ে একেবারে নয় করে নেবার তাল ছিল, তা সে গুড়ে বালি পড়েছে। তবু আবারও এখন চেষ্টা করছে কি করে মার কাছ থেকে ছেলেটাকে আবার নিয়ে

    প্রভাত ব্যাকুলভাবে বলে, আচ্ছা মা, কি বলছ যা-তা?

    যা-তা মানে? মিথ্যে বলছি আমি? ও যে কত বড় জাহাবাজ মেয়ে, তার কিছু জানিস তুই? তোর বড় বৌদি মেজ বৌদিকে কুমতলব দিয়ে দিয়ে ভেন্ন করালো কে? এক-একবার পূজোর সময় কি ছুটিছাটায় এসেছে, নিজের স্বাধীন সংসারের গল্প করে করে ওদের মনমেজাজ বিগড়ে দিয়ে গেছে। তাতেও আশ মিটল না, এখন শেষ চেষ্টা তোকে যাতে–

    আচ্ছা মা মিথ্যে একটা মানুষকে দোষী করছ কেন? আমি বলছি এটা সম্পূর্ণ কাকার ব্যাপার। কাকাই লিখেছেন

    কী লিখছে তাই শুনি ভাল করে। পড় তো দেখি—

    কিন্তু প্রভাত পড়ে না।

    অর্থাৎ পড়তে পারে না। এ চিঠির মধ্যে গলদ আছে। তাই চিঠিটা হাতের মধ্যেই রেখে বলে, ওই তো বললাম, দোষনীয় কিছু নেই বাপু।

    বলি পড়ে যা না তুই। দুষ্য কিছু আছে কি না, সে তুই কি বুঝবি! ধরবার বুদ্ধি তোদের আছে? না বোঝবারই চোখ তোদের আছে? পড় আমি শুনি।

    করুণাময়ী দুষ্য আবিষ্কারের চেষ্টা আর একাগ্রতা নিয়ে অবহিত হয়ে বসেন।

    কিন্তু বিপদ হচ্ছে প্রভাতের। এ চিঠি গড়গড় করে পড়ে গেলে করুণাময়ী রসাতল করে ছাড়বেন। এক আসামীকে ছেড়ে ধরবেন আর এক আসামীকে। তাই কখনো যা না করে তাই করে বসে, মিথ্যে কথা বলে মাকে।

    এ চিঠির কোনখানেই বা পড়ে শোনাব তোমাকে? তিনভাগই তো ইংরিজি। মোটকথাটা ওই যা বললাম।

    একটু ইতস্তত করে, যাই দাড়িটা কামিয়ে আসি, বলে গালে হাত বুলোতে বুলোতে সরে পড়ে সে মার কাছ থেকে।

    করুণাময়ী ওর গমনপথের দিকে তাকিয়ে ভাবেন, তুই আজ মিথ্যে কথা বললি আমায়, আমি তোর মুখচোখ দেখে বুঝছি না? হবেই তো, কোন না কোন হাভাতের ঘরের একটা মেয়ে এনে মাথার ওপর বসিয়েছিস, এখন স্বভাব বিগড়োবে এ আর বিচিত্র কি!

    বৌকে অবশ্য তিনিও শেষ পর্যন্ত দ্বিধা ত্যাগ করে বরণ করে তুলেছিলেন, গ্রহণ করে নিয়েছেন, কিন্তু সে নিতান্তই নিরুপায় হয়ে। ছেলে যখন কাজটা প্রায় সমাধা করেই বসেছে, তখন আর আপত্তি দেখিয়ে ধাষ্টামো করে লাভ কি!

    তবে একটু প্রসন্নতা ছিল এই কারণে, মেজবৌটার বড় রূপের গরব ছিল, সে গরব ভাঙবার অস্তর নিয়ে ঢুকেছিল ঘোট বৌটা। তাছাড়া নিজের ছোট জায়ের খোঁতা মুখটা ভোঁতা হল তো?

    মল্লিকাকে করুণাময়ী সুচক্ষেই দেখেন। বিশেষ করে যখন মল্লিকা বরটিকে নিয়ে বাসায় যাবার কুমতলবটি না করে উল্টে বরং বাসায় না যাবার ইচ্ছে প্রকাশ করে প্রভাতকে কলকাতায় থাকার প্ররোচনা দিল, তখন থেকে আরও সুনজরে দেখছিলেন। কিন্তু হঠাৎ কদিন থেকে কেমন বিগড়ে গেছে বৌটা!

    আর কিছুই নয়, নিশ্চয় ওই জায়েরা তলায় তলায় ফুসলেছে। ভেন্ন হাঁড়িই করেছে ওরা, বাড়িতে আসাটি তো ছাড়ে নি। ঠাকুরপো ঠাকুরপো করে রঙ্গরসটিও কমতি নেই কিছু। ইচ্ছে হয় যে ছুঁড়িগুলোর সঙ্গে কথা বন্ধ হয়ে যাক, এদিকে আসা বন্ধ হোক, নেহাৎ ওই নিজের পেটের ছেলে দুটোর জন্যেই মায়া। তবু তো আসে, বসে কথা কয়।

    না, নতুন বৌটাকে এবার একটু কড়া নজরে রাখতে হবে। যাতে ওদের সঙ্গে বেশি মিশতে পারে। বৌটা একটু খামখেয়ালি আছে। হয়তো একদিন দেখ ভোররাত্তিরে উঠে চান করেছে, ফুল তুলেছে, চন্দন ঘষেছে, পূজোর গোছ করেছে, রান্নাঘরে গিয়ে কুটনোটি বাটনাটি করতে লেগেছে। ওমা আবার একদিন দেখ, না চাননা কিছু, সক্কাল বেলা থেকে ছাতে উঠে ঘুরে বেড়াচ্ছে। যেন অন্য কোন জগতের মানুষ।…কিচ্ছুনা ওই কুপরামর্শ। যাই হোক প্রভাতকে আর তিনি খুড়ো-খুড়ির কবলে পড়তে যেতে দিচ্ছেন না। তোক না এখানে মাইনে কম, ঘরের ভাত খেয়ে থেকে যতটি জমবে, বাইরে গিয়ে তার ডবল মাইনে পেলেও কি তা জমবে? ভাবলেন এই যুক্তিতেই তিনি ছেলেকে কাৎ করবেন। বৌটা তাঁর দলে এই যা ভরসা, একা বাসায় যেতে চায় না।

    বুকের বল নিয়ে পাড়ার বান্ধবীদের উদ্দেশে যাত্রা করেন করুণাময়ী রান্নাঘরের দরজাটায় ছেকল টেনে দিয়ে।

    .

    কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তেই ঘরের মধ্যে আলোচনা চলছিল উল্টো।

    প্রভাত ঘরে ঢুকে নীচু গলায় মল্লিকাকে যে প্রশ্ন করে, সে প্রশ্নে আহত বিস্ময়ের সুর।

    তুমি আমার কাকীমাকে চিঠি দিয়েছিলে?

    মল্লিকা জানালার ধারে দাঁড়িয়ে ছিল। পাড়াগাঁয়ের বাড়ির ছোট জানালা। যার মধ্যে দিয়ে আকাশ ধরা পড়ে না, দৃষ্টি ব্যাহত হয় ঝোঁপজঙ্গলে গাছপালায়। তবু জানালার ধারেই দাঁড়িয়ে থাকে মল্লিকা যখনই সময় পায়।

    প্রভাতের প্রশ্নে ফিরে না তাকিয়েই বলে, হ্যাঁ।

    আশ্চর্য তো, কই বলনি তো?

    কাউকে একটা চিঠি দিলে সে কথা বলতে হয় তা জানতাম না।

    এভাবে বলছ কেন? ছিঃ!

    মল্লিকা নীরব।

    রাগ করছ? কিন্তু ভেবে দেখ, আমার কি আশ্চর্য হবার কিছু নেই, দিল্লী যাবার ব্যাপারে আপত্তি করছিলে তুমিই বেশি, অথচ তুমি কাকীমাকে জানিয়েছ বাইরে আমার জন্যে কাজ দেখতে, এটা একটা ধাঁধা নয় কি?

    হঠাৎ জানালা থেকে সরে আসে মল্লিকা। এসে দাঁড়ায় প্রভাতের একেবারে নিতান্ত কাছে। রহস্যময় একটু হাসি হেসে বলে, ধাঁধা বলে ধাঁধা! একেবারে গোলকধাঁধা।

    ওই রহস্যের ঝিলিক লাগানো চোখ মুখ দেখে কে পারে মাথার ঠিক রাখতে। আর যেই পারুক অন্তত প্রভাত পারে না। তাই বিগলিত আদরে বলে, মর্তবাসী অধম জীব, গোলক তত্ত্ব বোঝবার ক্ষমতা কোথায়? সত্যি বল না, হঠাৎ এ খেয়াল হল কেন? কাকীমাকে তো তুমি চেনোও না, বাসার ঠিকানাই বা জানলে কি করে?

    মল্লিকা মুচকে হেসে বলে, ও আর জানা কি? চিঠি চুরি করে ঠিকানা জোগাড় এসব তো আমার নিত্যকর্ম ছিল। এমন নিঃশব্দ পদসঞ্চারে ঘরে ঢুকেছি যে, যে লোক ঘরে জেগে বসে থেকেছে, সেও বেঁকের মাথায় বলতে বলতে হঠাৎ থেমে যায় মল্লিকা। শুধু একটু হাসে। আর ওর সেই হাসির মধ্যে ধরা পড়ে একখানি অতীতে ঘুরে বেড়ানো মন। এখানে বসে আছে মল্লিকা, তবু যেন এখানে নেই।

    .

    প্রভাত ওর সেই অনুপস্থিত মনের ছায়া ফেলা মুখের দিকে তাকিয়ে বিষণ্ণ হয়ে বলে, এসব কথা তুমি আর বোলো না মল্লিকা। শুনতে বড় কষ্ট লাগে। আমার তো এখন আর কিছুতেই বিশ্বাস হয় না সেই আরাম কুঞ্জর সঙ্গে কখনো কোনও যোগ ছিল তোমার।… কী অপূর্ব লাগে যখন তুমি চেলির শাড়ি পরে লক্ষ্মীর ঘরে আলপনা দাও, তুলসীতলায় প্রদীপ দাও, মায়ের রান্নার যোগাড় করে দাও, কি মিষ্টি লাগে যখন তুমি ঘরকন্নার খুঁটিনাটি কাজে ঘুরে বেড়াও মাথায় ঘোমটা দিয়ে। এ বাড়িতে তুমি কখনো ছিলে না ভাবতে ইচ্ছে করে না। ভাবতে গেলে ভয়ানক একটা যন্ত্রণা হয় তুমি একদা সেই বিশ্রী কুৎসিত পরিবেশে ছিলে

    মল্লিকা ওর দিকে তীক্ষ্ণ কুটিল একটা দৃষ্টি ফেলে বলে, যন্ত্রণা হয়, না ঘৃণা হয়?

    ঘৃণা! না মল্লিকা, ঘৃণা হয় না।

    হয় না?

    নাঃ, তা যদি হত তখনই হত। তাহলে তোমাকে সেখান থেকে নিয়ে এসে আমার মার রান্নাঘরে, চিরদিনের গৃহদেবতার ঘরে এনে তুলতে পারতাম না।

    মল্লিকা আর একটু তীক্ষ্ণ হয়, সে তখন নতুন নেশার মোহে

    ভুল করছ মল্লিকা, নেশাও নয়, মোহও নয়, সম্পূর্ণ আলাদা জিনিস সেটা

    তবে বোধ করি দয়া করুণা!

    নিজেকে ছোট করবার জন্যে এই চেষ্টার পাগলামী কেন তোমার মল্লিকা?

    ছোট করবার চেষ্টা নয়, সত্যকে সত্য বলে স্বীকার করবার চেষ্টা। আর সে সত্যকে সহ্য করবার শক্তি আমার আছে। তুমি আমাকে দেখে করুণায় বিগলিত হয়ে আমার ভার গ্রহণ করলে, এটা তোমার নিজের মনের কাছে সাফাই হতে পারে, আমার কাছে বিশ্বাসযোগ্য নয়। আমি বলব, তুমি রূপ-নেশাগ্রস্ত হয়ে

    মল্লিকা! আমরা এখন ভদ্রঘরের স্বামী-স্ত্রী।

    ওঃ আচ্ছা! খোলাখুলি কথা কওয়া তো এ সমাজে অচল! কিন্তু না জিগ্যেস করে পারছি, আমি যদি মামার একটা হাড়কুচ্ছিত হাড়মুখ ভাগ্নী হতাম?

    কী হলে কী হতে, সে উত্তর দেওয়া অর্থহীন মল্লিকা। মানুষ যে কোন পরিস্থিতিতে কোন কাজ করে, অথবা করতে পারে, আগে থেকে কিছুই বলা যায় না। তবু আমাকে যদি রূপমুগ্ধ পতঙ্গ বলে অভিহিত কর, সেটা তোমার আমার প্রতি নিতান্ত অবিচার হবে।

    কেন? কেন? কেনই বা তা হবে না তুমি? হঠাৎ দুখানা সর্পিল হাত বেষ্টন করে ধরে প্রভাতকে, পিষ্ট করে ফেলতে চায় যেন, কেন তুমি এত বেশি জোলো হবে? আমার রূপটা বুঝি তুচ্ছ করার মত? এতে মুগ্ধ হওয়া অগৌরব?

    উঃ উঃ, ছাড় ছাড়, লাগে লাগে। প্রভাত হেসে ফেলে। হেসে বলে, পাহাড়ে মেয়ের আদরও পাহাড়ে। স্বীকার করছি বাবা, এ হতভাগ্য ওই রূপের অনলে একেবারে দগ্ধপক্ষ পতঙ্গ, এখন তার বাকীটুকু আর চোখের অনলে ভস্ম করে ফেলো না।

    মল্লিকা হাত দুখানাকে কোলের ওপর জড় করে নেয়, মল্লিকা সহসা স্থির হয়ে যায়। স্তিমিত গলায় বলে, অপমান করলেই করব হয়তো।

    অপমান?

    হ্যাঁ।

    কিন্তু মল্লিকা কিন্তু-টিন্তু জানি না। কিসে মান কিসে অপমান সে বোধ তোমার থাকলে তো? আশ্চর্য, তুমি যে কেন এত বেশি ঠাণ্ডা! তোমার দাদারা তো

    কি আমার দাদারা?

    কিছু না।

    বাঃ, আধখানা বলে রেখে আধকপালে ধরিয়ে দিতে চাও?

    না, তা চাই না। বলছিলাম তোমার দাদাদের তো বেশ প্রাণশক্তি আছে—

    রাতদিন বৌদিদের সঙ্গে ঝগড়া চলে বলে। তা যদি হয়, স্বীকার করছি আমার প্রাণশক্তির অভাব আছে।

    কিন্তু ঝগড়া জিনিসটা খারাপ নয়।

    খারাপ নয়!

    না। ওতে ভিতরের বন্ধ বাতাস মুক্তি পায়। মনের মধ্যে তিলতিল করে যে অভিযোগ জমে ওঠে, তাকে বেরুবার পথ দেওয়া হয়।

    যা দেখছি ও-বাড়ীর জেঠিমার মত পাড়াকুঁদুলি নামটি আহরণ না করে ছাড়বে না তুমি। যাক আমাকে একটু খেতে পরতে দিলেই হল। তোমার গৃহে গৃহপালিত পোষ্য হয়ে কাটিয়ে দেওয়া যাবে। কিন্তু আগের কথাটায় ফিরে আসা যাক, তুমি চিঠিতে কাকীমাকে অনুরোধ করেছ আমাকে আবার ওদিকে একটা চাকরী করে দিতে? প্রভাতের চোখে গভীরতা।

    মল্লিকা সেই গভীর দৃষ্টির দিকে নির্নিমেষ দৃষ্টিতে একটু চেয়ে থেকে বলে, করেছিলাম।

    কেন বল তো? তুমি তো তা চাওনি—

    যদি বলি, তখন চাইনি, এখন চাইছি!

    কিন্তু কেন? বাংলা দেশের জলহাওয়া আর ভাল লাগছে না, না সহ্য হচ্ছে না?

    মল্লিকা প্রভাতের এই সহজ প্রশ্নটুকুতেই কেমন কেঁপে ওঠে। কোথায় যেন ভয়ানক একটা ব্যাকুলতা। কণ্ঠেও সেই ব্যাকুল সুর ফোটে, আমি বুঝি শুধু আমার কথাই ভেবেছি? শুধু আমার জন্যেই বলছি? আমার অহেতুক একটা তুচ্ছ ভয়ের জন্যে তোমার কেরিয়ারটা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, এটা বুঝি আমাকে কষ্ট দেয় না?

    এই কথা! প্রভাত যেন অকূল সমুদ্রে কূল পায়। অন্ধকারে আলো পায়।

    এই কথা! এই ভেবে তুমি মাথাখারাপ করছ? আর আমি যদি বলি কেরিয়ার নষ্টটা তোমার মনের ভ্রম! আমি যদি সন্তুষ্ট থাকতে পারি–আমি যা পেয়েছি, যাতে আছি, তাতেই সুখী যদি হই, তাহলে কে নষ্ট করতে পারে আমার ভবিষ্যৎ? ওই বাজে কথাটা ভেবে তুমি মনখারাপ কোর না মল্লিকা। নাই বা হল আমাদের জীবনকাব্যের মলাটটা খুব রংচঙে গর্জাস, ভিতরের কবিতায় থাকুক ছন্দের লালিত্য, ভাবের মাধুর্য। আর সে থাকা তো আমাদের নিজেদেরই হাতে! তাই নয় কি মল্লিকা? আমার বাবা আমার দাদারা যেভাবে জীবনটা কাটিয়ে গেলেন, কাটিয়ে আসছেন সুখ-দুঃখের ছোট্ট নৌকাখানি বেয়ে, আমরাও যদি তেমনিভাবে কাটিয়ে যাই ক্ষতি কি? তুমি পারবে না মল্লিকা আমার মা-ঠাকুমার মত জীবনে সন্তুষ্ট থাকতে?

    মল্লিকা ব্যাকুল হয়ে ওঠে। মল্লিকার চোখে জল আসে।

    মল্লিকা সেই জলভরা দুই চোখ তুলে বলে, পারব।

    .

    পিছিয়ে যেতে হল ফেলে আসা দিনে, ফিরে যেতে হল বাংলা থেকে পাঞ্জাবে।

    গণশা হারামজাদা পাজী!

    চাটুয্যে দুহাতে নিজের মাথার চুল ছিঁড়তে ছিঁড়তে তেড়ে আসেন গণেশের চুল ছিঁড়তে।

    তোর ষড়যন্ত্র না থাকলে এ কাজ হতেই পারে না। বল হারামজাদা শয়তান, কোথায় গেছে তারা?

    গণেশ নির্বিকারের সাধক।

    সে মাথা বাঁচাবার চেষ্টামাত্র না করে গম্ভীর গলায় বলে, কোথায় গেছে, সে কথা জানলে কি আর আপনাকে প্রশ্ন করতে আসতে হত বাবু? নিজে গিয়ে জানিয়ে দিয়ে আসতাম।

    বিচ্ছু শয়তান! স্টুপিড গোভূত! চালাকি খেলে আমার সঙ্গে পার পাবি? বাঘা আর হায়েনা-কে যদি তোর ওপর লেলিয়ে দিই?

    ইচ্ছে হয় দিন।

    কবুল না করলে ওরা তোকে টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলবে, তা জানিস?

    তা আর জানব না কেন বাবু? দেখলাম তো অনেক।

    চুপ! নোংরা ছুঁচো ইঁদুর শূয়োের গাধার বাচ্ছা—

    বাচ্ছাটাচ্ছা বলবেন না বাবু, মেজাজ ঠিক রাখতে পারব না।

    মেজাজ ঠিক রাখতে পারব না? হারামজাদা শালা! আমার মেজাজ ঠিক রাখতে পারছি আমি, আর তুমি

    ঠিক আর রাখছেন কোথায় বাবু? মেজাজ তো আকাশে চড়াচ্ছেন!

    চড়াব না? তুই বলিস কিরে বদমাস? রাতারাতি সাতকৌটোর মাঝকৌটোয় ভরা রাজপুরীর প্রাণপাখীটুকু উড়ে গেল, আর আমি চুপ করে থাকব?

    বাবু তো বেশ ভাল ভাল বাক্যি কইতে পারেন। সেই কবে ঠাকুমার কাছ থেকে ওই সব সোনার কাঠি সোনার কৌটোর গল্প শুনেছি

    গণশা! তোকে আমি খুন করব। ন্যাকরা করছিস আমার সঙ্গে? আর সময় পেলি না ন্যাকরা করার? বল লক্ষ্মীছাড়া পাজী, দিদিমণি গেল কোথায়?

    সেই পুরনো উত্তুরই দিতে হবে বাবু!

    লাঠি, লাঠি চাই একটা গণশা, নিয়ে আয় শীগগির একটা লাঠি! তোর মাথাটা ফাটিয়ে তবে আজ আমি জলগ্রহণ করব–

    গণেশ দ্রুত অন্তর্হিত হয় এবং মুহূর্তের মধ্যে একগাছা মোটা লাঠি নিয়ে এসে মনিবের হাতে তুলে দেয়।

    চাটুয্যে অবশ্য সেইটুকু সময়ের মধ্যেই ভুলে গিয়েছেন, লাঠিটা কেন চেয়েছিলেন। বলে ওঠেন, কী হবে?

    ওই যে বলছিলেন মাথা ফাটাবেন–

    ওরে বজ্জাত! সমানে তুই আমার সঙ্গে ইয়ার্কি চালিয়ে যাচ্ছিস? শেষকালে কী রাগের মাথায় সত্যিই একটা খুননাখুনি করে বসব? দেখতে পাচ্ছিস না মাথার মধ্যে আমার আগুন জ্বলছে? সেই গোস্বামীটাকে যদি এখন হাতে পেতাম–

    গণেশ উদাস মুখে বলে, তেনার আর দোষ কি?

    দোষ নেই? তার দোষ নেই? তবে কি ট্যান্ডনটা–

    আহা-হা রাম রাম! তা কেন? ট্যান্ডন ফ্যান্ডন নায়ার ফায়ার, ওনারা সকলেই মহৎ চরিত্তিরের লোক! পরস্ত্রীর দিকে ফিরেও তাকান না, তা ফুসলে বার করে নিয়ে যাওয়া

    গণশা! কার কাছে টাকা খেয়েছিস তুই, তাই বল আমায়।

    টাকা! ছিঃ বাবু, ছি ছি। ওই ছোট কথাটা মুখ দিয়ে বার করতে আপনার লজ্জা লাগল না? গণশা যদি টাকা খেয়ে বেইমানি করার মতন ছুঁচো বেক্তি হত, আরাম কুঞ্জের একখানা ইটও গেড়ে থাকত এখানে? বলে পুলিশের টিকটিকি এসে কেতা কেতা নোট নিয়ে

    গণেশ সহসা চুপ করে যায়। আত্মগরিমা করা তার নীতিবিরুদ্ধ।

    চাটুয্যে নরম হন।

    বিনীত গলায় বলেন, তা কি আর জানি নে রে বাপ! তোর গুণেই তো বেঁচে আছি। কিন্তু যা কাণ্ড ঘটে গেল, তাতে তো আর মাথা ফাতা ঠিক থাকে না। বল দিকি সেই গোঁসাই পাজীটাকে কি করে কুকুরে খাওয়াই?

    শুধু পরের ছেলের ওপর গোঁসা করে কী হবে বাবু? ঘরের মেয়ের ব্যাভারটাও ভাবুন? নেমক যে খায়নি, তার তো আর নেমকহারামীর দোষ অর্শায় না, কিন্তু নেমক খেয়ে খেয়ে যে হাতীটি হল? দিদি বাবু যা করল—

    চাটুয্যে বসে পড়ে অসহায় কণ্ঠে বলে, আচ্ছা গণেশ, বল দিকি কি করে করল? আমি তাকে সেই এতটুকু বয়েস থেকে লালোম পালোম, লেখাপড়া শেখালাম, কেতাকানুন শেখালাম, আর সে আমার মুখে জুতো মেরে

    গণেশ নির্লিপ্ত স্বরে বলে, সবই করেছিলেন বাবু, শুধু একটা কাজ করতে ভুলে গেছলেন। মানুষটা করেন নি। লেলেছেন পেলেছেন সবই ঠিক, ওই মানুষটা করে তুলতে বাকী থেকে গেছে। মানুষ করলে কি আর নেমকহারামীটা

    দেখ গণশা–এমন ভাবে এক কথায় হারিয়ে যেতে তাকে আমি দেব না। যে করে হোক খুঁজে তাকে আনতেই হবে।

    তা তো হবেই বাবু। নইলে তো আপনার আরাম কুঞ্জর ব্যবসাটাই লাটে ওঠে।

    চাটুয্যে সন্দিগ্ধভাবে বলে, গণশা তোর কথাবার্তাগুলো তো সুচাকের নয়, কেমন যেন ভ্যাঙচানি ভ্যাঙচানি সুরে কথা কইছিস মনে হচ্ছে।

    কী যে বলেন বাবু।

    তবে শোন। সোজা হয়ে কথার জবাব দে। কাল কখন সেই হারামজাদার ব্যাটা হারামজাদাকে শেষ দেখেছিলি?

    আজ্ঞে রাতে খাওয়ার সময়।

    আর মল্লিকাকে?

    আজ্ঞে তার ঘণ্টা দুই পরে। রান্নাঘর মেটানোর সময়।

    তারপর? কখন সেই শয়তান দুটো একত্র হয়ে কেউ টের পেল না?

    আজ্ঞে নরলোকের কেউ টের পেলে তো আর তাদেরকে স্বর্গলোকে পৌঁছতে হত না।

    তুই ভোরে উঠে খোঁজ করেছিলি?

    গণেশ ঈষৎ মাথা চুলকে লজ্জা লজ্জা মুখ করে বলে, আজ্ঞে সত্যি কথা বলতে হলে, খোঁজ একবার মাঝরাত্তিরেই করতে হয়েছেল।

    তার মানে?

    তার মানে আজ্ঞে, জানেন তো সব। পাপমুখে আর কবুল করাচ্ছেন কেন? যেই মাঝ রাত্তিরে ওই আপনার নায়ার সাহেবের হঠাৎ পিপাসা পেয়ে গেল, আমাকে ডেকে অর্ডার করলেন মিস সাহেবকে দিয়ে এক গেলাস জল পাঠিয়ে দিতে, তা আমি খোঁজ করে গিয়ে বললাম, হবে না সাহেব। পাখী বাসায় নেই। বোধ করি অন্য ডালে গিয়ে বসেছে

    চাটুয্যে হঠাৎ দুহাতে গণেশের কাঁধ দুটো ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে দিয়ে বলে, শালা পাজী, তক্ষুণি আমাকে এসে খবর দিলি নে কেন?

    গণেশ নির্বাক, নিষ্কম্প।

    আজ্ঞে সে রেওয়াজ তো নেই।

    আমার সন্দেহ হচ্ছে, এর মূলে তোর হাত আছে। তোর সাহায্য না পেলে

    এ সন্দেহ তো বাবু আপনার সঙ্গের সাথী। শুধু আপনার কেন, আদিঅন্তকালের পৃথিবীতে আপনার মত তাবৎ মহাপুরুষেরই এই অভ্যেস। যার কাছে বিশ্বাস, তাকেই সব থেকে অবিশ্বাস।

    আচ্ছা গণশা, এই দুঃসময়ে তুই আমার কথার দোষত্রুটি ধরছিস! বুঝছিস না আমার প্রাণের মধ্যে কী আগুন জ্বলছে! মল্লিকা আমার সঙ্গে কি করল!

    আজ্ঞে এই তো দুনিয়ার নিয়ম।

    আচ্ছা আমিও দেখে নেব, সেই বা কেমন চীজ আর আমিই বা কেমন চীজ। সেই গোসাঁইটাকে ধরে এনে যদি মল্লিকার সামনে টুকরো টুকরো করে না কাটতে পারি

    বাবু খপ করে অত সব দিব্যি-টিব্যি গেলে বসবেন না। এই ভারতখানা তো আপনার হাতের চেটো নয়?

    নয় কি হয় তা দেখাব। তবে তুই বদমাস যদি বিপক্ষে ষড়যন্ত্র না করিস

    আজ্ঞে আবার বেমাত্রা হচ্ছেন বাবু। বিপক্ষে ষড়যন্ত্র করতে শিখলে এর অনেক আগে মিস সাহেব পাচার হয়ে যেতে পারত। ওই আপনার গিয়ে নেমকহারামীটির ভয়ে ধর্ম-অধর্ম পাপ পুণ্যি মায়াদয়া, মানুষমনুষ্যত্ব সব বিসর্জন দিয়ে বসে আছি!

    গণেশ রে, আমার ডাক ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে।

    তা একটুক্ষণ নয় কাদুন! ভেতরের গ্যাসটা একটু খোলসা হোক।

    তোর কি মনে হয় বল তো? মল্লিকাকে আর পাওয়া যাবে না?

    এ দুনিয়ায় অসম্ভব সম্ভব হলে কি না হতে পারে!

    চাটুয্যে মিনিট দুই গুম হয়ে থেকে বলে, হাঁ, হায়েনাটাকে একবার ঘর থেকে বার করে আন দিকি, আর–আচ্ছা, আর শোন, কাগে-বগে যেন টেরটা না পায় এখন

    আজ্ঞে টের পেতে তো বাকীও নেই আর কেউ। কে না জেনেছে?

    জেনেছে? আঃ! সবাই জেনে ফেলেছে?

    আজ্ঞে নিয্যস!

    চাটুয্যে মাথার চুল মুঠোয় চেপে বলে, যাবে, এইবার যাবে, আরাম কুঞ্জ শেষ হয়ে যাবে। আরাম কুঞ্জর প্রাণপাখীই যখন উড়ে গেল!

    গণেশ নিজস্ব স্টাইলে বলে, আজ্ঞে মনে করি মায়া দয়া বলে জিনিসগুলো বাক্স থেকে বার করব না। তবু কেমন এসে পড়ে। তাতেই বলছি, না উড়েই বা করবে কি? পাখীর প্রাণ বই তো নয়! হাতী পুষতে যদি কেউ পাখীর মাংসর ওপর ভরসা রাখে

    কী বললি? কী বললি পাজী?

    কিছু না বাবু, কিছু না।

    হুঁ। বুঝেছি, তুমিই যত নষ্টের গোড়া!

    .

    অনেকক্ষণ গুম হয়ে বসে থাকে চাটুয্যে। তারপর স্মৃতির ভেলায় ভাসতে ভাসতে চলে যায়। অনেক দূরসমুদ্রে।

    সেই তার ছোট বোনটা। মল্লিকার মা।

    লক্ষ্মীপ্রতিমার মত মূর্তিটি।

    মল্লিকা কি তার মত হতে চায়? আর মল্লিকা যা চায়, তাই তবে হতে দেবে চাটুয্যে!

    এই আরাম কুঞ্জের পাট চুকিয়ে চাটি বাটি গুটিয়ে ফিরে যাবে সেই দূর ঘাটে? যে ঘাট থেকে একদিন নৌকোর রাশ কেটে দরিয়ায় ভেসেছিল? আর ভাসতে ভাসতে পাঞ্জাব সীমান্তের এই পাহাড়ে বরাত ঠুকে–বরাত ফিরিয়েছিল?

    .

    আরাম কুঞ্জর কুঞ্জ ভেঙে দিয়ে পয়সাকড়ি গুটিয়ে নিয়ে চাটুয্যে যদি জন্মভূমিতে ফিরে যায়, করে খেতে তো আর হবে না তাকে এ জীবনে?

    মনটা চঞ্চল হয়ে ওঠে চাটুয্যের।

    সত্যি হয় না আর তা?

    কিন্তু কেনই বা হবে না? আর বেশি টাকার কি দরকার তার? না বৌ না ছেলে। না ভাই, না বন্ধু! একটা পুষ্যি ছিল, তা সেটাও শিকলি কেটে হাওয়া হল। কার জন্যে তবে কি? অনেক পাপ তো করা হল, বাকী জীবনটা ধর্মকর্ম করে

    হঠাৎ নিজের মনেই হেসে ওঠে চাটুয্যে, ক্ষেপে গেল নাকি সে? তাই বিড়ালতপস্বী হবার বাসনা জাগল? একেই বুঝি শ্মশানবৈরাগ্য বলে?

    উঠে পড়ল। পরামর্শ করতে গেল প্রিয় বান্ধব ট্যান্ডন আর নায়ারের সঙ্গে।

    একত্রে নয়, আলাদা আলাদা।

    বিশ্বাস সে কাউকে করে না। কে বলতে পারে ওদের মধ্যেই কেউ মল্লিকা হরণের নায়ক কি না।

    চাটুয্যে শুধু সেই কবি কবি বাঙালী ছোঁড়াটাকেই সন্দেহ করছে। ও ছোঁড়াগুলোর ভালবাসাবাসির ন্যাকরাই জানা আছে, আর কোনও ক্ষমতা আছে?

    এমনও তো হতে পারে, প্রভাত গোস্বামী মল্লিকাকে সরায় নি। প্রভাত গোস্বামীকেই কেউ ইহলোক থেকে সরিয়ে ফেলে মল্লিকাকে সরিয়েছে। আর সন্দেহের অবকাশ যাতে না থাকে, তার জন্যে এইখানেই নিরীহ সেজে বসে আছে।

    গণশা অত লম্বা চওড়া কথা কয়। কে জানে সেটাও ছল কিনা। টাকার কাছে আবার নেমক! মোটা টাকা ঘুষ পেয়ে লোকে নিজের স্ত্রী-কন্যেকে বেচে দিচ্ছে তো এ কোন ছার!

    মনিবের ঘরের মেয়ে! ভারী তো!

    ট্যান্ডন নায়ার আর বাসনধোয়া দাইটা তিনজনকেই বাজিয়ে দেখতে হবে। তারপরে মন্ত্রের সাধন কিংবা শরীর পতন। হারিয়ে গেল বলে হারিয়ে যেতে দেবে মল্লিকা নামক ঐশ্বর্যটিকে? তাই কখনো হয়?

    উঁকি মারল গিয়ে ট্যান্ডনের ঘরে!

    বোতল নিয়ে বসেছিল সে।

    সাড়া পেয়ে মৃদু হাস্যে বলল, আইয়ে জী!

    হাসুক।

    বিশ্বাস কেউ কাউকে করে না। চোরাচালানের আর চোরাইমালের ব্যবসা করে করে ওদের কাছে গোটা পৃথিবীটাই চোর হয়ে গেছে।

    তাই এরা যাদের সঙ্গে গুপ্ত পরামর্শ করে, তাদেরই ধাপ্পা দেয়, যাদের দিয়ে গোপন কাজ করায়, তাদের ওপরই আবার চর বসায়। তাই চ্যাটার্জি যখন মেয়ে চুরির কাহিনী শুনিয়ে হাহাকার করে, ওরা তখন ভাবে, খুব ধড়িবাজ বটে বুড়োটা, নিজেই কোন কারণে সরিয়ে ফেলে, এখন তোক দেখিয়ে আক্ষেপের অভিনয় করছে।…খুব সম্ভব কোনও কাপ্তেন-মার্কা বড়লোকের খপরে চালান করেছে।

    তবু খোঁজবার প্রতিশ্রুতি সকলেই দেয়। শুধু নায়ার আর ট্যান্ডনই নয়, আরও যারা ছিল খদ্দের। জেনেছে তো সকলেই। কেউ আকাশ থেকে পড়েছে, কেউ বিজ্ঞের হাসি হেসেছে। চ্যাটার্জির মতন ঘুঘু ব্যক্তির চোখ এড়িয়ে তার ভাগ্নী হাওয়া হল, এ কী আর একটা বিশ্বাসযোগ্য কথা?

    কিন্তু পুরো অবিশ্বাস করাও তো চলছে না, মোটা টাকা খরচা কবলাচ্ছে চ্যাটার্জী উড়ে যাওয়া পাখী ধরে আনতে!

    পুলিশে খবর দেবার উপায় তো আর নেই? নিজের পায়ে নিজে কুড়ল কে মারে? তা ওরা গোয়েন্দা পুলিশের বাবা–যাদের নিয়ে কারবার চ্যাটার্জির, যারা তার আরাম কুঞ্জের চিরকালের খদ্দের।

    .

    সামান্য যে কালো মেঘটুকু মাঝে মাঝে ছায়া ফেলছিল সেটুকু বুঝি মুছে গেছে। মল্লিকা যেন মূর্তিমন্ত কল্যাণী। ঘরের কাজের পটুতা তার অসামান্য, তার উপর আছে শিল্পরুচি সৌন্দর্য। বোধ। সমস্ত সংসারটির উপর সেই রুচির আলপনা এঁকেছে সে।

    অবশ্য প্রথম প্রথম যখন মল্লিকা সখ করে ঘরে ঝুলিয়েছিল নতুন ধানের শীষের গোছা, দালানের কোণে কোণে চৌকী পেতে চিত্র করা ঘট বসিয়ে, তার মধ্যে বসিয়েছিল কাশফুলের ঝাড়, সংসারেরই এখান ওখান থেকে তামা পিতলের ছোট ছোট ঘটি সংগ্রহ করে তাদের ফুলদানী বানিয়ে ঘরে ঘরে নিত্য রাখতে অভ্যাস করেছিল ফুলের মেলা, তখন তার জায়েরা ননদ-সম্পৰ্কীয়রা আর পড়শীনিরা মুখে আঁচল দিয়ে হেসেছিল, এবং করুণাময়ী বিরসমুখে বলেছিলেন, সময় নষ্ট করে কী ছেলেমানুষী কর ছোট বৌমা? অবসর সময়ে গেরস্থর ভোলা কাজগুলো করলেও তো হয়।

    কিন্তু ক্রমশ দেখা গেল যারা হেসেছিল, তাদের ঘরেই মল্লিকার অনুকরণ। তারা নিজেরা না করুক, তাদের মেয়েটেয়েরা লুফে নিচ্ছে এই সৌখিনতা।

    কিন্তু এসব কি মল্লিকা তার মামার আশ্রয় থেকে শিখেছিল? যেখানে রাত্রে বিছানায় শুয়ে বাঘের গর্জন কানে আসে, সেখানে ফুল কোথা? লতা কোথা? কোথায় বা সবুজের সমারোহ? ছিল না।

    কিন্তু মল্লিকার ছিল সৌন্দর্যানুভূতি, আর এখানে এসে সৃষ্টি হল একটি মন। গ্রামে ঘরে যে সব সুন্দর বস্তু অবহেলিত, মল্লিকার তৃষিত চোখে তা অভিনব, অপূর্ব। তাই ওর ফুলদানীতে ফুলের গা ঘিরে ঠাই পায় সজনেপাতা, তেঁতুলপাতা। চালকুমড়োকে মাথায় তুলে এতাবৎ যে বাঁশের মাচাটা হাড়-বার-করা দেহখানা নিয়ে দাঁড়িয়েছিল উঠোনের কোণে, মল্লিকা তার হাড় ঢেকে দেয় মালতি লতা দিয়ে। মাচাটা হয়ে ওঠে কুঞ্জবন। গোবরলেপা উঠোনের মাঝখানে আলপনা আঁকে পদ্মলতা শঙ্খলতায়। সন্ধ্যায় সেখানে মাটির পিলসুজে প্রদীপ রাখে। জীবনের মোড় ঘোরাতে চাইলে বুঝি এমনি করেই সাধনা করতে ইচ্ছে হয়।

    তা সাধনায় বোধ করি সিদ্ধিলাভ করতে পৈরেছে মল্লিকা। মাঝখানে কিছুদিন যে একটা চাঞ্চল্য দেখা দিয়েছিল সে চাঞ্চল্যকে নিশ্চিহ্ন করে মুছে ফেলে সত্যিই সে তার মায়ের মত শাশুড়ির মত। পিতামহীদের মত হচ্ছে।

    বিরল তোমার ভবনখানি পুস্পকানন মাঝে,
    হে কল্যাণী ব্যস্ত আছ নিত্য গৃহকাজে।
    বাইরে তোমার আম্রশাখে
    স্নিগ্ধ রবে কোকিল ডাকে,
    ঘরে শিশুর কলধ্বনি

    য্যাঃ অসভ্য! মল্লিকা চকিত কটাক্ষে হেসে ফেলে। হেসেই এদিক ওদিক তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে শাশুড়ি বাড়িতে আছেন কিনা। না নেই, বাড়িতে তিনি কমই থাকেন। পাড়া বেড়ানো, গঙ্গাস্নান, পাঠবাড়ী ইত্যাদি নানা কর্মের স্রোতে বেড়ান তিনি। আসল কথা দুই ছেলে বৌ আলাদা হয়ে যাওয়ার পর প্রভাতও যখন বিদেশে চলে গেল, শূন্যঘর আর শূন্যহৃদয় করুণাময়ী হৃদয়ের আশ্রয় খুঁজে বেড়াতে লাগলেন বাইরের হিজিবিজির মধ্যে।

    এখন ঘরের শূন্যতা ঘুচেছে, হৃদয়ের শূন্যতা ঘুচেছে, কিন্তু অভ্যাসটা ঘুচছে না। তাছাড়া এখন আবার গৃহকর্মের অনেক ভার মল্লিকা নিয়েছে। তাই তিনি মুক্তপক্ষ বিহঙ্গের মত উড়ে বেড়ান। তবে মল্লিকার ওপর চোখ রাখবার চোখ যে একেবারে নেই তা নয়। মল্লিকার বড় মেজ দুই জা, যাঁরা একই বাড়িতে ভিন্ন হয়ে আছেন, তারা এই উড়ে এসে জুড়ে বসা ছোট জায়ের গতিবিধির প্রতি সাধ্যমত দৃষ্টি রাখেন, আর এ বিষয়ে দুজনেই অভিন্ন আত্মা। কিন্তু মজা এই, তাদের দুজোড়া চোখ অদৃশ্য পথে দৃষ্টি ফেলে বসে থাকে, মল্লিকার সেটা জানা নেই। তাই মল্লিকা প্রভাতের ছেলেমানুষীতে অথরা কাব্যি ওখলানোয় বিব্রত পুলকে এদিক ওদিক তাকায় শুধু শাশুড়ি বাড়িতে আছেন কিনা দেখতে।

    নেই দেখে সহাস্যে বলে, কেরানীগিরি করে করেও এত কাব্য টিকে আছে প্রাণে?

    থাকবে না মানে? প্রভাত হাসে, কাব্য কি শুধুই বড়লোকের জন্যে? কেরানীরা অপাংক্তেয়?

    শুনেছি তো ও কাজ করতে করতে লোকের মাথার ঘি-টি সব ঘুঁটে হয়ে যায়।

    যায় বুঝি? কই আমার তো তা মনে

    এই, কী হচ্ছে? ছাড়!

    যদি না ছাড়ি।

    রাহুর প্রেম?

    প্রায় তাই। কোথায় ছিলে, কোথা থেকে শিকড় উপড়ে নিয়ে এসে পুঁতে দিলাম বাংলাদেশের ভিজে ভিজে নরম মাটিতে

    সে মাটির মর্যাদা কি রাখতে পেরেছি?

    নম্র নম্র বিষণ্ণ দুটি চোখ তুলে প্রশ্ন করে মল্লিকা, চাপল্য ত্যাগ করে।

    প্রভাতও চপলতা ছেড়ে গম্ভীর হয়।

    বলে, পেরেছ বই কি।

    মল্লিকা চুপ করে থাকে।

    আবহাওয়া কেমন থমথমে হয়ে যায়।

    এক সময় মল্লিকা বলে ওঠে, মা বলছিলেন, তোমার মামা কেমনধারা লোক গো বৌমা! একখানা পোস্টকার্ড লিখেও তো কই উদ্দিশ করে না?

    তুমি কি উত্তর দিলে?

    কি আর দেব? বললাম, মামা এই রকমই। দায় চুকেছে নিশ্চিন্ত হয়েছেন। নইলে আর সম্প্রদান করার কষ্টটুকু পোহাতে রাজী হন না, কুমারী মেয়েটাকে একজনের হাতে ছেড়ে দেন। মা বললেন, তা সত্যি! ধন্যি বটে।…তা ছাড়া তুমিও তো কই চিঠিপত্র লেখ না?…আবার কথা। বানাতে হল, বলতে হল, মামাকে চিঠি লিখি এত সাহস আমার নেই। ভীষণ ভয় করতাম তাকে। যা কিছু আদর আবদার ছিল, মামীর কাছে।

    অনেক গল্প বানাতে শেখা গেল, কি বল? কলম ধরলে সাহিত্যিক নাম লাভ হতে পারত! হেসে বলে প্রভাত, একেবারে কথার জাল বোনা।

    মল্লিকা বিমনা ভাবে বলে, তবু ফাঁক থেকে যায় কত জায়গায়। প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়।

    ক্রমশ সব ঠিক হয়ে যাবে।

    মামা খোঁজ করছেন বলে মনে হয় তোমার?

    পাগল হয়েছ? প্রভাত হাসে, মেয়ে পালালে কেউ খোঁজ নেয়?

    ঠিক এই স্কেলে তো আমার জীবন আর সে জীবনের পরিস্থিতিকে মাপা চলে না? কে জানে তিনি বসে বসে প্রতিশোধের ছুরি শানাচ্ছেন কিনা!

    ছুরি শানাচ্ছেন, এ ভয় প্রভাতেরই কি নেই? তবু সে পুরুষমানুষ, মুখে হারতে রাজী নয়, তাই বলে ওঠে, ছুরি অত সস্তা নয়।

    বলে, কিন্তু বুকের মধ্যে ছুরি তার ঊচোনই আছে। তবে এইটুকুই শুধু ভরসা, কলকাতার এই পঞ্চাশ লক্ষ লোকের মধ্য থেকে একটা লোককে খুঁজে বার করা সহজ নয়। বোধ করি সম্ভবই নয়।

    তবু প্রায়ই এমন হয়।

    আলোর ওপর হঠাৎ ছায়া এসে পড়ে। শুধু সে ছায়া স্থায়ী হতে পারে না, প্রভাতের স্বভাবের ঔজ্জ্বল্যে আর মল্লিকার একান্ত চেষ্টায়।…হঠাৎ এসে পড়া ছায়াকে প্রভাত উড়িয়ে দেয়, মল্লিকা চাপা দেয়।

    কিন্তু মল্লিকাকে কি প্রভাত সম্পূর্ণ বুঝতে পারে?

    এইখানেই কোথায় যেন সন্দেহের খটকা। মল্লিকার কল্যাণী বধূমূর্তির অন্তরালে কি একটা উদ্দাম যৌবনা নারী যখন তখন শান্তস্বভাব প্রভাতকে প্রখর যৌবনের জ্বালা দিয়ে পুড়িতে মারতে চায় না–প্রভাত নামক নিরীহ পুরুষটাকে?

    মল্লিকানামা দেহটা যেন একটা মসৃণ কোমল আবরণ। আর শঙ্কা হয়–যে কোনও মুহূর্তে সে আবরণ ভেদ করে ঝলসে উঠবে ভিতরের প্রখরা।

    কিন্তু এ ধারণাটা অন্যায়, এ চিন্তাটা হাস্যকর। প্রভাত ভাবে ওই তো কপালে মস্ত একটা সিঁদুরের টিপ, বাম হাতে গোটা তিন চার লোহা, দুহাতে শাঁখা চুড়ি বালা। নেহাৎ ঘরোয়া।

    শাড়ী পরার ধরনটা পর্যন্ত ঘরোয়া করে ফেলেছে। একেবারে ঘরোয়া। মল্লিকা বদলে গেছে। মল্লিকা ঘরোয়া হয়ে গেছে।

    প্রভাত স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে।

    হ্যাঁ, স্বস্তি হয়েছে আজকাল সবদিকেই।

    মল্লিকাকে নিয়ে পালিয়ে আসার পর থেকে সর্বদা যে ভয়ঙ্কর একটা অশরীরী আতঙ্ক প্রভাতের পিছু নিয়ে ফিরত, সে আতঙ্কটা ক্রমশই যেন হালকা হয়ে যাচ্ছে, বিলীন হয়ে যাচ্ছে। ক্রমশই ভাবতে অভ্যস্থ হচ্ছে, নাঃ, সে যেমন ভেবেছিলাম তেমন নয়।

    একেবারে ডিটেকটিভ গল্পের নর-পিশাচ নয়। প্রথমটায় হয়তো খুব রেগেছিল, শাপ শাপান্ত করেছিল। হয়তো দুটোকে খুন করে ফেলবার স্পৃহাও জেগেছিল মনে, কিন্তু শেষে নিশ্চয়ই ভেবেছে এই নিয়ে টানাটানি করতে গেলে নিজেদেরই কোন ফাঁকে পুলিশের নজরে পড়ে যেতে হবে। আর সাধের ব্যবসা এবং প্রাণটি নিয়ে টানাটানি পড়ে যাবে।

    অতএব মনের রাগ মনে চেপে বসে আছে ভদ্রলোক।

    শাপশাপান্ত? এ যুগে ওতে আর কিছুই হয় না।

    কলিযুগে ব্রহ্মতেজ নির্বাসিত, ব্রহ্মশাপ নিষ্ফল। কাজেই স্বস্তি! স্বস্তি! স্বস্তি!

    কিন্তু স্বস্তি বোধকরি প্রভাতের কপালে নেই। তাই ক্রমেই যখন তার জীবনটায় ছায়ার চেয়ে আলোর ভাগটাই বেশি হয়ে এসেছে, তখন হঠাৎ আবার ভয়ঙ্কর এক অস্বস্তির কাটা এসে বিধল বুকের মধ্যে।

    অফিসে টিফিন করতে বেরিয়েছিল, ফিরে আসতেই সহকর্মী সুরেশ দত্ত খবরটা দিল।

    প্রভাত বিচলিত চিত্তে প্রশ্ন করল, আমার সন্ধান নিচ্ছিল? নানান প্রশ্ন করছিল? কেন বলুন তো? কি রকম দেখতে লোকটা?

    সুরেশ দত্ত আরামে পা নাচাতে নাচাতে বলে, অনেকটা ঘটক-প্যাটার্নের দেখতে, বুঝলেন? প্রজাপতি অফিস থেকে এরকম চরটর পাঠায় অফিসে টফিসে। আইবুড়ো শুনল, কি গাঁথবার তালে লেগে পড়ল।

    প্রভাত বিরক্ত সুরে বলে, তা আমি তো আর আইবুড়ো নই? আমার সন্ধানসুলুক নেবার দরকারটা কি?

    ওই তো–সুরেশ দত্ত একটি রহস্যময় মধুর হাসি হেসে বলে, দিলাম একখানি রাম ভাঁওতা। এখন খুঁজুক বসে বসে আপনার ঠিকুজিবুলুজি গাঁইগোত্তর! তারপর

    থামুন আপনি। ছেলেমানুষী করবেন না

    সুরেশ দত্তর আরও গড়িয়ে পড়া মোলায়েম মসৃণ হাসিখানিকে নিভিয়ে দিয়ে প্রভাত প্রায় ধমকে ওঠে, ঠাট্টাতামাসারও একটা মাত্রা রাখা উচিত।

    সুরেশ বোধ করি অপমান ঢাকতেই অপমানটা হজম করে নিয়ে বিলম্বিত দীর্ঘ লয়ে বলে, মাত্রা আছে বলেই তো আপনাকে এগিয়ে ধরলাম। না থাকলে নিজেকেই একখানি সুপাত্র বলে চালান করতাম। করলাম না। ভেবে দেখলাম–বাড়ির ঠিকানা জোগাড় করে যদি সেখানে ধাওয়া করে, কে জানে লোকটা পৈতৃক প্রাণটুকু খুইয়ে আসবে কিনা। মানে আমার গিন্নীটির কবলে পড়লে

    বাজে কথা রাখুন মশাই, লোকটার চেহারা কিরকম তাই বলুন?

    সুরেশ দত্ত সোজা হয়ে উঠে বসে বলে, ব্যাপারটা কী বলুন তো প্রভাতবাবু? আপনার ধরণধারণ দেখে মনে হচ্ছে, আপনি যেন ফেরারি আসামী আর টিকটিকি পুলিশ আপনার সন্ধান করে বেড়াচ্ছে। লোকটা তো অফিসের অনেকেরই নামধাম খোঁজ করছিল, কে কে ব্যাচিলার আছে সেইদিকেই যেন ঝোঁক তার। তা কই আর তো কেউ আপনার মত ক্ষেপে উঠল না? বললাম তো শচীনকে অমরকে শ্যামলবাবুকে।

    এবার প্রভাত একটু লজ্জিত হয়।

    তাড়াতাড়ি বলে, ক্ষ্যাপার কথা হচ্ছে না। আপনি খামোকা লোকটাকে আমার একটা ভুল পরিচয় দিতে গেলেন কেন, তাই ভাবছি। হয়তো ওই ব্যাচিলার শুনে বাড়ি গিয়ে ঝামেলা করবে।

    করুক না। একটু মজা হবে।

    সুরেশ আবার আরামের এলায়িত ভঙ্গী করে বলে, জীবনটাকে একেবারে মিলিটারীর দৃষ্টিতে দেখবেন কেন? একটু রঙ্গরস, একটু মজা, একটু ভুল-বোঝাবুঝি–এসব নইলে আর রইল কি মশাই?

    নাঃ আপনি একেবারে– বলে উড়িয়ে দেবার ভঙ্গিতে চলে যায় প্রভাত। কিন্তু উড়িয়ে দিতে পারে না। মনের মধ্যে খচখচ করতে থাকে।

    কে সে?

    কে আসতে পারে প্রভাতের খোঁজে?

    আরাম কুঞ্জের প্রোপ্রাইটার এন কে চ্যাটার্জি ছাড়া প্রভাতের জানাশোনাদের মধ্যে কে এমন আধবয়সী ভদ্রলোক আছে, যে তোক গলাবন্ধ কোট পরে?

    আচ্ছা, প্রভাত এতই বা ভাবছে কেন?

    সত্যিই তো ওই প্রজাপতি অফিসের লোক হতে পারে? নিছক বাজে একটা লোককে নিয়ে মিথ্যে মাথা ঘামাচ্ছে প্রভাত?

    ভাবে।

    মনকে প্রবোধ দেয়।

    কিন্তু মন প্রবোধ মানে না। সে যেন একটা অশরীরী ছায়া দেখতে পাচ্ছে, যে ছায়া তার অন্ধকারের মুঠি বাড়িয়ে প্রভাতের গলা টিপে ধরতে আসছে।

    .

    অফিস ফেরার পথে আকাশপাতাল ভাবতে ভাবতে চলে প্রভাত।

    ইতিমধ্যেই কি বাড়ীতে কোনও ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনা ঘটে গেছে? প্রভাতকে ফিরে গিয়েই সেই দৃশ্যের মুখোমুখি দাঁড়াতে হবে?

    কী সেই দৃশ্য? মল্লিকা নেই? মল্লিকা খুন হয়েছে?

    ভগবান! এ কী আবোলতাবোল ভাবছে প্রভাত? বাড়ীতে তেমন কোনও দুর্ঘটনা ঘটলে প্রভাতকে কেউ খবর দিত না? পাড়ায় তো জ্ঞাতিগোত্রের অভাব নেই। এমনিতে তারা সর্বদা বুকের মধ্যে দীর্ঘঈ পুষে রাখলেও, বিপদেআপদে দেখে বইকি।

    না না, বিপদ কিছু হয়নি।

    আচ্ছা বাড়ি গিয়ে কি তবে মল্লিকাকে এই খবরটা জানিয়ে সাবধান করে রাখবে প্রভাত? বলবে, কে জানে হয়তো তোমার মামা এতদিনে সন্ধান পেয়ে–

    না, না, কাজ নেই।

    প্রভাত ভাবল, অকারণ ভয় পাইয়ে দিয়ে লাভ কি? হয়তো সত্যিই কিছু না।

    অজস্র ভাবনা এসে ভিড় করে। মাথার মধ্যে ঝিমঝিম করে আসে।

    মানুষ নির্ভীক হয় কেমন করে? সামান্যতম ভয়ের ছায়াতেই যদি তার দেহমন অবশ হয়ে আসে?

    ভেবে পায় না প্রভাত, কি করে মানুষ ভয়ঙ্কর ভয়ঙ্কর সব কাণ্ডের নায়ক হয়ে হাস্যমুখে ঘুরে বেড়াতে পারে সমাজের সর্বস্তরে?

    আবার ভাবল, আশ্চর্য! আমিই বা কি করে পেরেছিলাম মল্লিকাকে চুরি করে আনতে?

    প্রভাত যখন ভাবনার সমুদ্রে এমনি টলমল করতে করতে বাড়ি ফিরছিল, তখন প্রোপ্রাইটার এন কে চ্যাটার্জি প্রভাতেরই এক জ্ঞাতি কাকার বাড়িতে জাঁকিয়ে বসে প্রশ্ন করছিল, বলেন কি? আপনারা তাকে জাতিচ্যুত করলেন না?

    জাতিচ্যুত!

    জ্ঞাতিকাকা উচ্চাঙ্গের হাসি হেসে বলেন, জাতি কোথায় যে তার থেকে চ্যুত করব? আপনি ঘটকালি করে খান, আপনি খবর রাখেন না একালে জাতি ধর্ম কথাগুলো কোন পাঁশগাদায় আশ্রয় পেয়েছে?

    জানি আজ্ঞে। জানি সবই। তবে কিনা আপনারা হলেন গিয়ে গোস্বামী বংশোদ্ভূত, আপনাদের কথা অবিশ্যিই স্বতন্ত্র।

    কিছু স্বতন্ত্র নয়, দাদা! ও আপনার গিয়ে সবাইকেই এক জাঁতার তলায় ফেলে পেষাই করা হচ্ছে। হ্যাঁ, ছিল বটে মানমর্যাদা এক সময়। সে সব এখন হাস্যকর। কুলশীল বংশমর্যাদা ওসব কথাগুলোই এখন ভূতো হয়ে গেছে, ওকথা বলতে গেলে লোকে এখন হাসে, নাক বাঁকায়। নইলে–এই তো, কোথা থেকে না কোথা থেকে একটা পরমা সুন্দরী মেয়ে নিয়ে এল, বলল কোন চুলোয় কাকা না মামা কে আছে, ব্যস, হয়ে গেল সে মেয়ে ঘরের বৌ। সে বৌ ভাতের হাঁড়িতেও কাঠি দিচ্ছে, নারায়ণের ঘরেও সন্ধ্যেদীপ দিচ্ছে। পাড়াপড়শীর বাড়ি গিয়ে এক পংক্তিতে খাচ্ছেও। আমরাই আর ওসব মীন করি না। যে কালে যে ধর্ম।…তবে হ্যাঁ, মেয়েটি বড় লক্ষ্মী। যেমন দেবী প্রতিমার মত রূপ, শুনেছি তেমনি নাকি শিক্ষা সহবৎ।…যাক মশাই, তাই হলেই হল। এ যুগের কাছে আমরা এই আগের যুগেরা কতটুকু কী চাই বলুন তো? ওই একটু শিক্ষা সহবৎ। গুরুজনকে ক্ষ্যামাঘেন্না করে একটু গুরুজন বলে মানল তো বর্তে গেলাম আমরা। তা আমার বড়ভাজের কাছে, মানে ওই প্রভাতবাবুর মায়ের কাছে শুনতে পাই মেয়ের নাকি গুণের সীমা নেই।…এই–এইটুকুই তো দরকার। যাক আপনাকে আর বেশি কি বলব? দেখতেই পাচ্ছেন। আপনারও কর্মভোগ, তাই এসেছেন বিয়ে হওয়া ছেলের জন্যে সম্বন্ধ করতে! হাতের কাছে আর কোনও পাত্র তো দেখছিও না যে আপনাকে–

    থাক থাক।

    চ্যাটার্জি উঠে পড়ে বলে, এইটির কথাই শুনে এসেছিলাম। তবে কিছুটা বিলম্ব হয়ে গেছে। যাক, আপনার মত একজন সজ্জন ব্যক্তির সঙ্গে আলাপ হল, এটাই পরম লাভ।

    বিনয়ে বিগলিত হয় সে।

    জ্ঞাতিকাকা বলেন, সজ্জন? হাসালেন মশাই। দুর্জন, অতি দুর্জন। তবে নাকি দুনিয়ার হালচাল দেখে দার্শনিক হয়ে গেছি। নইলে ওই কাণ্ডর পর আমার ওই জ্ঞাতি ভাজের বাড়ীতে কাউকে জলস্পর্শ করতে দিতাম? দিতাম না, আগে হলে দিতাম না। এখন ওই যা বললাম–দার্শনিক হয়ে গেছি। তবে হ্যাঁ, মেয়েটা খারাপ ঘরের নয়, দেখলেই বোঝা যায়। এই যে আমি কে না কে, কিন্তু নিত্য সকালে আমার ও-বাড়ীতে চায়ের বরাদ্দ হয়ে গেছে। কেন? ওই বউটির আকিঞ্চনে। কই আরও ঢের বউ তো আছে পল্লীতে, কে পুঁচছে? আমার ওই ভাজটির হাত দিয়ে তো জল গলত না, এখন বউটির কারণেই–হাঁ হয়ে যাচ্ছেন না? চোখ দেখেই বুঝতে পেরেছি। তা যেতেই পারেন। এ যুগে তো আর বউ-ঝির মধ্যে এমন নম্রতা দেখা যায় না।…আচ্ছা তবে।

    চোখ দেখেই বুঝতে পেরেছিলেন জ্ঞাতিকাকা! তা হয়তো বোঝবার মতই বিস্ফারিত হয়ে উঠেছিল প্রোপ্রাইটার এন কে চ্যাটার্জির চোখজোড়া।

    এন কে! এই নামেই পরিচিত চ্যাটার্জি। ব্যবসাক্ষেত্রে ওটাই অনেক সময় কোডের কাজ করে। কিন্তু একদা ওর একটা নাম ছিল না? যে নাম সে নিজেই ভুলে গেছে। নন্দকুমার না? নন্দকুমার চট্টোপাধ্যায়? হরিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের অকালকুষ্মণ্ড কুলাঙ্গার ছেলে?

    কিন্তু তার মনটা আবার এমন নরম প্যাঁচপেচে হয়ে যাচ্ছে কী করে? খামোকা চোখেই বা তার খানিকটা জল উপচে পড়ছে কেন তার বেইমান ভাগ্নীটার সুখের সংসারের গল্প শুনে? আশ্চয্যি, আশ্চয্যি! এন, কে-র ভাগ্নী, যে ছিল এন, কে-র শিকার ধরবার রঙিন রেশমি কাঁদ, সে কিনা তার মার মত বোনের মত ঠাকুমা পিসিমাদের মত লক্ষ্মী বউ নাম কিনে সুখে শান্তিতে স্বামীর ঘর করছে!

    সে আর নরককুণ্ডে বসে লুব্ধ শয়তানদের হাতে মদের গ্লাস এগিয়ে দেয় না, স্বর্গের এক কোণায় ঠাঁই করে নিয়েছে সে নিজের, সেখানে বসে সে ঠাকুরের নৈবেদ্য সাজায়, গুরুজন পরিজনদের হাতে তৃষ্ণার জল এগিয়ে দেয়।

    চাটুয্যে কি তার চিরদিনের পাষণ্ড নামের ঐতিহ্য বহন করেই চলবে? স্বর্গের এক কোণে যে এতটুকু একটু জায়গা গড়ে নিয়ে শুভ্র হয়ে উঠেছে, পবিত্র হয়ে উঠেছে, তাকে তার সেই জায়গা থেকে টেনে নামাবে? চুলের মুঠি ধরে হিঁচড়ে টেনে নিয়ে যাবে আবার সেই পুরনো নরককুণ্ডে? তাকে ডাণ্ডা মেরে মেরে বাধ্য করবে ক্ষুধার্ত বাঘেদের গুহায় ঢুকতে? বাধ্য করবে সেই বাঘেদের মদের গ্লাস এগিয়ে দিতে, তাদের সামনে ঘুঙুর পরে নাচতে, কটাক্ষ হেনে মন কাড়তে?

    নইলে চাটুয্যের ব্যবসা পড়ে যাবে? আয় উন্নতি কমে যাবে?

    মাতালগুলোকে আরও মাতাল করে ফেলে যে সুবিধেগুলো আদায় করতে পারত সেগুলো আর আদায় হবে না?

    অতএব চাটুয্যে—

    কিন্তু জীবনে একবার যদি চাটুয্যে তার সেই পাষণ্ড নামের ঐতিহ্য ভোলে? যদি সত্যিকার মামা কাকার মত মেয়েটাকে আশীর্বাদ করে তাকে তার কল্যাণের জায়গায় প্রতিষ্ঠিত রেখে হাসিমুখে ফিরে যায়?

    লোকসান হবে এন কে-র।

    কিন্ত কতখানি?

    কত খাবে সে একটা পেটে? কত পরবে একটা দেহে? কতদিন আরও বাঁচবে– বাহান্ন বছর পার হয়ে যাবার পর?

    .

    চিন্তাজর্জর প্রভাত বাড়ি ঢুকতে না ঢুকতেই করুণাময়ী কাছে এসে ব্যঙ্গমিশ্রিত খুশী খুশী হাসি হেসে বলেন, ওরে প্রভাত, তোর বউয়ের যে কপাল ফিরেছে, নিরুদ্দিশ রাজার উদ্দিশ হয়েছে। মামা এসেছে দেখতে!

    কে এসেছে? কে?

    বজ্রাহতের মত আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে প্রভাত। অনেকরকম ভাবছিল সে, কিন্তু এই প্রকাশ্য অভিযানের চেহারা একবারও কল্পনা করে নি।

    তা হাঁ হয়ে যাবারই কথা। ছোট বৌমাও শুনে প্রথমটা আড়ষ্ট হয়ে গিয়েছিল, হাঁ করে তাকিয়ে বসেছিল। মামাকে নাকি আবার ভয়ও করে খুব। মানুষটা কিন্তু ভয়ের মত নয়। বরং একটু হ্যাঁবলা-ক্যাবলা মতন। আর বিনয়ের তো অবতার। বেয়ান বেয়ান করে একেবারে জোড়হস্ত।

    প্রভাত সাবধানে দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বলে, কতক্ষণ এসেছেন?

    এই তো খানিক আগে। ফল মিষ্টি সরবৎ খাইয়েছি। দৈ-দস্তুর করলাম, তা বলছে থাকতে পারবে না, রাত্তিরের গাড়িতেই চলে যেতে হবে। কী যেন দরকারি কাজে একদিনের জন্যে এসেছে, নেহাৎ নাকি জামাইবাড়িটা হাওড়া ইস্টিশনের গায়ে, তাই করুণাময়ী মুখে চোখে একটি আত্মপ্রসাদের ভঙ্গী এঁকে কথার উপসংহার করেন, তবু আমি একেবারে ছেড়ে কথা কইনি, শুনিয়ে দিয়েছি বুড়োকে বেশ দুচার কথা–

    প্রভাত রুদ্ধকণ্ঠে বলে, শুনিয়ে দিয়েছ? কী শুনিয়ে দিয়েছ?

    কী আবার শোনাব, ন্যায্য কথাই শুনিয়েছি। কেন, তোর পরমপূজ্য মামাশ্বশুরের বুঝি আর দোষত্রুটি কিছু নেই? বলি সাতজন্মে একটা উদ্দিশ করে? আজ এখন একদিন এক হাঁড়ি রসগোল্লা এনে

    রসগোল্লা? এক হাঁড়ি রসগোল্লা! প্রভাত হঠাৎ চাপা গর্জনে বলে ওঠে, তোমার ছোট বউ খেয়েছে সে রসগোল্লা?

    ওমা শোন কথা! আসতে আসতেই অমনি হাঁড়ি খুলে খাওয়াতে বসব? কেন, আমার বউ কি পেট ধুয়ে বসেছিল? বলি মামাশ্বশুরের নাম শুনে তুই অমন ভূতে পাওয়ার মতন করছিস কেন? তোরও কি ভয়ের ছোঁয়া লাগল নাকি? তা ছোট বৌমা তো তবু যাই হোক ধাতস্থ হয়ে

    কোথায় সে? তার সঙ্গে এক ঘরে?

    মার বিস্ময় অগ্রাহ্য করে প্রভাত মরীয়ার মত ছোটে। কী এনেছে মল্লিকার মামা মল্লিকার জন্যে?

    বিষমাখানো রসগোল্লা, না বিষাক্ত ছুরি?

    করুণাময়ী গালে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে ভাবেন। ভেবে ভেবে সিদ্ধান্ত করেন, আর কিছু নয়, বুড়োটার অমতেই বোধহয় এ কাজ হয়েছে। তাই দুটোতেই ভয় পাচ্ছে। তখনই বুঝেছিলাম গণ্ডগোল একটা আছেই। তবু যতই হোক স্নেহ নিম্নগামী। তাই বুড়ো একঘণ্টার জন্যেও মরতে মরতে দেখতে এসেছে মিষ্টির হাঁড়ি বুকে করে। যাই হাঁড়িটা সরিয়ে ফেলি। বেশি করে চারটি ভাল দিকে রাখতে হবে। পাঠক ঠাকুরের জন্যে নিয়ে যাব। কিনে কেটে বেশি দেওয়া তো হয় না বড়।…যে আমার বড় বউটি আর মেজ বউটি, এক্ষনি উঁকি দেবে, আর ছোটজায়ের কান ভাঙাবে, তোর মামা অত মিষ্টি আনল, তুই কটা পেলি?

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleদোলনা – আশাপূর্ণা দেবী
    Next Article জহুরী – আশাপূর্ণা দেবী

    Related Articles

    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    ভয় সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    কিশোর অ্যাডভেঞ্চার সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    প্রকাশ্য দিবালোকে – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 18, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    তারপর কী হল – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 17, 2025
    মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    শর্ম্মিষ্ঠা নাটক – মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    November 11, 2025
    সত্যজিৎ রায়

    মানপত্র সত্যজিৎ রায় | Maanpotro Satyajit Ray

    October 12, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }