Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    জু – অৎসুইশি

    লেখক এক পাতা গল্প343 Mins Read0
    ⤶

    জু

    ১

    ছবি আর ভিডিওর মধ্যে পার্থক্যটা হাইকু (জাপানি ঐতিহ্যগত পদ্য) আর গদ্যের মধ্যের পার্থক্যর মত।

    শুধু হাইকু নয়, ছোট আর বড় ছন্দের পদ্যও এর মধ্যে পড়ে। সাধারণত এসব পদ্যর আকার গদ্যের চেয়ে অনেক ছোট হয়। পদ্যর এটা একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য। এসব ছন্দবদ্ধ ঘোট ঘোট লাইনগুলো হঠাৎ করে হৃদয়ে গিয়ে আঘাত করে আর লেপ্টে থাকে। একজন কবি জগতটাকে দেখেন এবং শোনেন, তারপর হৃদয়ের অনুভূতিগুলো দিয়ে তা ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেন। আর তিনি তা ছোট ছোট বাক্যের দ্বারা ব্যাখ্যা করে থাকেন।

    গদ্যের ক্ষেত্রে এগুলো একসাথে যুক্ত হয়ে থাকে। হৃদয়ের এই বর্ণনাগুলো হয় নিরবিচ্ছিন্ন। আর লাইনের সংখ্যা যত বৃদ্ধি পেতে থাকে, কাঠামোতেও তত পরিবর্তন যুক্ত হতে থাকে। গদ্যে সংগঠিত ঘটনাগুলোর মধ্যে বিভিন্ন চরিত্রগুলোর ভেতরটা সব একরকম হয় না। কিন্তু এই সমস্ত বাক্যগুলোর মূল ভাব বের করে আনলে তা একটা ব্যাখ্যা দাঁড় করাতে পারে। সবকিছু একসাথে ধরে রাখার জন্য আমাদের কিছু “পরিবর্তন” যোগ করার প্রয়োজন পড়ে। প্রথম আর শেষ পৃষ্ঠার মধ্যে চরিত্রগুলোর হৃদয় বদলে গিয়ে অন্য কিছু একটায় পরিবর্তিত হতে হবে। এই পরিবর্তন প্রক্রিয়াটা সোতের মত এসে হাজির হয়, আর সেটাই গল্পটার কাঠামো তৈরি করে। সরল গনিতের মত ব্যাপার। আপনি যদি একটা গদ্য নিয়ে একে ঘোট ঘোট অংশে বিভক্ত করেন, সেটা তখন হাইকু বা পদ্যতে রুপান্তরিত হয়। আপনি যদি একটা গল্পকে ছোট ছোট অংশে বিভক্ত করেন, সেটা তখন ব্যাখ্যায় পরিণত হয়।

    ফটোগ্রাফ বা ছবিও কিন্তু বর্ণনামূলক। একটা ক্যামেরা দিয়ে কোন ল্যান্ডস্কেপকে আজীবনের জন্য আটকে ফেলা যায়। একটা ছবি একটা বাচ্চার ক্রন্দনরত মুখটাকে বর্ণনা করতে পারে। ব্যাপারটা হাইকু বা পদ্যতে যা হয় তার কাছাকাছি।

    অবশ্যই শব্দ আর ছবির মধ্যে পার্থক্য আছে, কিন্তু দুটোই গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তগুলোকে একটা নির্দিষ্ট সময়ে চিরকালের জন্য থামিয়ে দেয়।

    সুতরাং ধরা যাক আমরা কয়েক ডজন, কিংবা কয়েকশ ছবি তুললাম। একই ছবি বার বার নয়-আবার একদম অন্য কিছুও নয়। প্রত্যেকটা ছবি আগের ছবিটার ঠিক পরের মুহূর্তের ছবি, একটার পর একটা, এভাবে সারি বদ্ধভাবে। তারপর আমরা যদি ছবিগুলো দ্রুত একটার পর একটা উলটে যাই তাহলে যা ঘটে তাকে বলা হয় “দৃষ্টির বিদ্যমানতা” যা পুরো ব্যাপারটার মধ্যে সময়ের জন্ম দেয়।

    একটা ক্রন্দনরত বাচ্চার উদাহরণ দেয়া যাক: কাঁদতে কাঁদতে একসময় বাচ্চাটা হাসতে শুরু করল। স্থির আলাদা আলাদা ছবির বদলে এগুলো একসাথে একটা চলমান অবস্থার সৃষ্টি করে। যে অবস্থার মধ্যে কান্না থেকে হাসি পর্যন্ত পুরো প্রক্রিয়াটা রয়েছে। এই প্রক্রিয়ার কারনে আমরা ভেতরের পরিবর্তনটা চাক্ষুষ দেখতে পাই। নিশ্চিতভাবে “সময়” হল প্রত্যেকটা মুহূর্তকে একসাথে সংযুক্ত করলে যা পাওয়া যায়, আর এ থেকে আমরা “পরিবর্তন” ব্যাপারটাকে ব্যাখ্যা করতে পারি। অন্য কথায় বললে একটা গল্প বলতে পারি। আর সেটাই হল একটা মুভি। অন্তত আমার তাই মনে হয়।

    ***

    আজ সকালে আবারও চিঠির বাক্সে একটা ছবি ছিল। এখন পর্যন্ত কতগুলো হল? এরকম চলছে প্রায় একশ দিন কিংবা তারও বেশি হবে। আমি এখনো এর সাথে মানিয়ে নিতে পারিনি, মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারছি না। প্রতিদিন সকাল বেলায় ঠান্ডার মধ্যে আমি বাইরে গিয়ে আমার পুরাতন মরচে পড়া চিঠির বাক্সে একটা করে ছবি খুঁজে পাই। ছবিটা পাওয়ার পর আমার মাথা ঘোরাতে থাকে, হালকা মাথাব্যথা অনুভুত হয়, সেই সাথে বিশ্রী রকমের হতাশাবোধ হয়। ছবিটা শক্ত করে হাতে ধরে আমি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। প্রত্যেক সকালে এই একই কাহিনী।

    ছবিগুলো কোন খামে-টামে আসে না, ডাকেও আসে না। সেফ চিঠির বাক্সের মধ্যে ফেলা থাকে। ছবিগুলো একজন মৃত মানুষের। আমার এক্স গার্লফ্রেন্ডের। দেখে মনে হয় ও কোন গর্তের মধ্যে আছে। ছবিতে ওর বুকের থেকে উপরের অংশ দেখানো থাকে। ওর চেহারায় পঁচন ধরেছে, আগের সেই সৌন্দর্যর কিছুই অবশিষ্ট নেই।

    প্রত্যেক দিনের ছবিতে পঁচন প্রক্রিয়া আগের দিনের ছবির চেয়ে একটু একটু করে এগুতে থাকে। এখন এমন একটা অবস্থায় এসে পৌঁছেছে যেখানে আমি ওর মুখের উপর পোকা কিলবিল করতে দেখতে পাচ্ছি। পঁচন যত বাড়ে পোকাগুলো চামড়ার অন্য অংশগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে।

    ছবিটা নিয়ে আমি আমার রুমে ফিরে যাই। স্ক্যান করে কম্পিউটারে ঢুকাই। ওর যত ছবি আমি এখন পর্যন্ত পেয়েছি, সবগুলো কম্পিউটারে রাখা আছে। আমি ওগুলো ক্রমানুসারে সাজিয়েছি, আর ওর অস্তিত্ব এখন বিশাল পরিমাণ ছবির তথ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।

    একদম প্রথম ছবিটায় ওকে দেখতে একদম মানুষের মত লাগে। দ্বিতীয় ছবিটায়-যেটা আমি ঠিক পরের দিনে পেয়েছিলাম-সেটায় ওর চেহারার উপর হালকা একটা কালো ছাপ ছিল। তারপর থেকে প্রতিটা দিন গিয়েছে আর ছবির মেয়েটা আস্তে আস্তে জীবিত প্রাণী থেকে চেনার অযোগ্য কিছুর দিকে যেতে থেকেছে।

    আমি কাউকে এই ছবিগুলো সম্পর্কে কিছু বলিনি। আমার গার্লফ্রেন্ড যে খুন হয়েছে সেটা খালি আমিই জানি। বাকি পুরো দুনিয়ার কাছে সে শুধু নিখোঁজ মানুষের অমীমাংসিত একটা কেস হয়ে রয়ে গিয়েছে।

    স্বীকার করছি, আমি ওকে গভীরভাবে ভালবাসতাম। আমার এখনো মনে আছে যেদিন আমরা একসাথে “জু” মুভিটা দেখতে গিয়েছিলাম। মুভিটা ছিল আর্ট ফিল্ম ধরনের, কি হচ্ছে তা আমাদের দুজনেরই মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছিল।

    স্ক্রিনে অসংখ্য সবজি আর প্রাণীর দুরত পঁচে যাওয়ার দৃশ্য দেখাচ্ছিল। আপেল আর চিংড়িগুলো কালো হয়ে বিকৃত হয়ে যাচ্ছিল। ব্যাক্টেরিয়ার আক্রমণের কারনে ওগুলো থেকে নিশ্চয়ই বাজে গন্ধ ছড়াচ্ছিল। পেছনে ব্যাখ্যাতীত রকমের উৎফুল্ল মাইকেল নাইম্যান সাউন্ডট্র্যাক চলছিল, জীবজন্তুর মৃতদেহগুলো কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে কুঁকড়ে যাচ্ছিল। তীরে যেভাবে বড় ঢেউ আছড়ে পড়ে আবার নেমে যায়, সেভাবে মাংসগুলো খুলে খুলে যাচ্ছিল। পুরো ফিল্মটার মূল উদ্দেশ্য ছিল, অন্তত যা আমার মনে হচ্ছিল, যে পঁচনের প্রক্রিয়াটা দেখানো।

    আমরা মুভি থিয়েটার থেকে বের হওয়ার পর ও আর আমি ঠিক করলাম স্থানীয় চিড়িয়াখানায় যাব। আমি ডাইভ করছিলাম আর ও আমার পাশে বসে রোড সাইনগুলো পড়ছিল। “দেখ,” সে বলল, উত্তেজনার সাথে গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরে ইঙ্গিত করছিল। “ব্যাপারটা কাকতালীয় না?”

    “চিড়িয়াখানা। বামে মোড়। ২০০ মিটার সামনে।”

    সাইনে তাই লেখা ছিল। উপরে জাপানিজে, নিচে ইংরেজিতে। আমার স্পষ্ট মনে আছে ইংরেজি অক্ষরে ‘জু লেখাটার কথা।

    আমি স্টিয়ারিং হুইল বাম ঘুরিয়ে মেইন রোড থেকে নামিয়ে পারকিং লটে ঢুকলাম। লোজন প্রায় ছিলই না বলা যায়। সময়টা ছিল শীতের মাঝামাঝি। কেউ ঐ সময় চিড়িয়াখানায় যায় না। বরফ পড়ছিল না, কিন্তু আকাশে ঘন মেঘ ছিল, অন্ধকার হয়ে ছিল চারিদিক। সবদিক থেকে জন্তু জানোয়ার আর ভেজা খড়ের গন্ধ ভেসে আসছিল-আমন্ত্রণ জানানোর মত দারুণ কোন গন্ধ না আমার মতে। আমার গার্লফ্রেন্ড আর আমি হাত ধরাধরি করে পাশাপাশি হাঁটছিলাম। আমি বলতে পারি, যতক্ষণ আমরা ওখানে ছিলাম পুরোটা সময় ও কাঁপছিল।

    “এখানে কেউ নেই,” সে বলল। “আমি এই ব্যাপারে কিছু একটা শুনেছিলাম। সারা দেশের চিড়িয়াখানা আর এমিউজমেন্ট পার্কগুলো দেউলিয়া হয়ে যাচ্ছে কারন কেউ আর ওগুলোর ব্যাপারে আগ্রহী নয়।”

    চিড়িয়াখানার সার্কিটের মত পথগুলো দিয়ে আমরা হেঁটে গিয়েছিলাম আর আমার নিশ্বাস মুখ থেকে সাদা ধোঁয়ার মত বেরিয়ে এসে বাতাসে মিলিয়ে যাচ্ছিল। লোহা দিয়ে বানানো খাঁচাগুলোর সামনে দিয়ে হেঁটে গিয়েছিলাম। প্রাণীগুলো যার যার খাঁচার মধ্যে বসে ছিল, নড়াচড়া করছিল না। একটা বানর অবশ্য, সত্যিকারের কুৎসিত দেখতে একটা বানর, তার খাঁচার মধ্যে অনবরত আগপিছ করছিল। আমি কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ওটার কান্ডকারখানা দেখেছিলাম। বানরটা খুবই নোংরা ছিল আর ওর শরীরের বিশাল অংশের নোম খসে গিয়েছিল। খাঁচাটার ভেতর সে একাই ছিল, সরু কংক্রিটের জায়গাটার মধ্যে হাঁটাহাঁটি করা ছাড়া আর কিছু করার ছিল না।

    একটা গার্লফ্রেন্ড পাওয়া ছিল অনেকদিন পর্যন্ত আমার জীবনের সেরা ঘটনা। হেমন্তে ও উধাও হয়ে যায়, মনে হয় যেন সেই কবেকার কথা।

    আমি অসংখ্য মানুষকে আমার সন্দেহের কথা বলেছিলাম, যে ও হয়ত কোন অস্বাভাবিক ঘটনার সাথে জড়িয়ে পড়েছিল। কিন্তু পুলিশ কখনোই আমার কথা গুরুত্ব দেয়নি, তাড়া ওর উধাও হওয়ার ঘটনাটাকে সাধারণ বাড়ি পালানোর কেস হিসেবেই ধরে নিয়েছিল। ওর পরিবারের একইরকম ধারণা ছিল। মনে হচ্ছিল সবাই যেন ধরেই নিয়েছিল যে ও কোন একদিন বাসা থেকে পালিয়ে যাবে। তাই যখন সেটা হল কেউ একদমই অবাক হয়নি।

    ইমেজ ফাইলগুলো কম্পিউটারে ঢোকানোর পর আমি মল ছবিগুলো অযত্বের সাথে আমার ড্রয়ারে ফেলে রাখি। এতদিনে ড্রয়ারটায় একশরও বেশি ছবি জমে গিয়েছে।

    কম্পিউটারের কার্সর নাড়িয়ে মুভি চালানোর একটা সফটওয়্যারে ক্লিক করলাম। এই সফটওয়্যারটা ভিডিও এডিটও করতে পারে। “ওপেন ইমেজ সিকোয়েন্স” ফাংশনটা থেকে ওর প্রথম ছবিটা সিলেক্ট করলাম। তারপর “সেট ইমেজ সিকোয়েন্স,” সিলেক্ট করে দিলাম। তারপর প্রতি সেকেন্ডে বারো ফেম” সিলেক্ট করলাম।

    ছবিগুলো এখন পরপর সাজিয়ে একটা ভিডিও হিসেবে দেখার জন্য তৈরি। প্রতি সেকেন্ডে বারোটা করে ছবি পার হবে। এই সিস্টেমটা প্রথমে ডিজাইন করা হয়েছিল এনিমেশন বানানোর জন্য।

    প্লেব্যাক মোডে আমি ওর ক্ষয় হতে থাকা দেখি। পোকামাকড়গুলো ওর সারা মুখে কিলবিল করে ছোটাছুটি করতে থাকে। ওর মাংস ছিঁড়ে খেতে থাকে। মনে হয় যেন পোকামাকড়ের সাগরের ঢেউ।

    প্রত্যেক সকালে আমি চিঠির বাক্সের কাছে গিয়ে নতুন করে একটা ছবি পাই, যা পুরো ভিডিওটার দৈর্ঘ্য এক সেকেন্ডের বারো ভাগের এক ভাগ বৃদ্ধি করে। “আমি এই ক্রিমিনালকে খুঁজে বের করব,” বিড়বিড় করে নিজেকে শোনাই।

    যে লোক এই ছবিগুলো তুলছিল, সেই ওর খুনের জন্য দায়ী। আমি এ ব্যাপারে নিশ্চিত।

    “ওকে এর জন্য মূল্য চুকাতে হবে,” পুলিশ যখন তদন্ত বন্ধ করে দিল তখন আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম।

    কিন্তু আমার একটা সমস্যা ছিল। সমস্যাটা নিরেট, আর তা আমাকেই ধ্বংস করে ফেলার জন্য যথেষ্ট ছিল। সেজন্য আমি সমস্যাটা স্বীকার না করে এড়িয়ে চলছিলাম।

    “শিট, এই ক্রিমিনাল কোথায় থাকতে পারে?!”

    আমার কথাগুলো ছিল স্ক্রিপ্টে লেখা লাইনের মত। অতি নাটুকে। মনে মনে জানতাম ঘটনা আসলে একদম অন্যরকম। কিন্তু আমি এই নাটকের চরিত্র হয়ে থাকিনি, বাস্তবতার রুক্ষতা নেমে এসে আমাকে চিড়ে চ্যাপ্টা করে ফেলত।

    অন্য কথায় বললে আমি ভান করছিলাম যে কিছু জানি না। সেটা আমাকে প্রত্যয় দিচ্ছিল যে আমি হয়ত ওর খুনিকে খুঁজে বের করতে পারব। কিন্তু বাস্তবে আমার পক্ষে ওর খুনিকে খুঁজে বের করা সম্ভব নয়।

    আমি নিজেই ওকে খুন করেছিলাম।

    ২

    ওকে হারানোর পর থেকে আমি যতটা সম্ভব সাধারণভাবে আমার জীবন কাটানোর চেষ্টা করেছি। ব্যাপারটা কঠিন ছিল। আয়নায় নিজের চেহারার দিকে তাকালে দেখতাম আমার গাল বসে গিয়েছে, চোখগুলো কোটরে ঢুকে গিয়েছে।

    আমি জানতাম যে আমি ওকে খুন করেছি। আর এই জানা আর ওর খুনি খুঁজে বের করার যে স্পৃহা, সেটার মধ্যের যে স্ববিরোধ আছে তা সম্পর্কেও অবগত ছিলাম। কিন্তু খোদার কসম কেটে বলছি আমার মধ্যে কোন সিপ্লট পারসোনালিটি বা দ্বৈত সত্ত্বা নেই।

    ওকে আমি আমার মনপ্রাণ দিয়ে ভালবাসতাম। আমি চিন্তাও করতে চাইনি যে আমার নিজের দুই হাত দিয়ে আমি ওকে খুন করেছি। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যে এরকম জঘন্য চিন্তাভাবনাকে কোনভাবেই মনের মধ্যে স্থান পেতে দেব না।

    দুনিয়ার কোথাও এক খুনি আছে যে কিনা আমি নই, আর আমি যদি আমার গার্লফ্রেন্ডকে খুন করা ঐ ব্যক্তিকে খুঁজে বের করতে পারি তাহলে কিছুটা ভাল বোধ করব। নিজের পাপ বোধ থেকে হয়ত মুক্তি পেতে পারব।

    “কে এই ছবিগুলো চিঠির বাক্সে ফেলে যাচ্ছে?”

    “কেন সে আমাকে এই ছবিগুলো দেখাচ্ছে?”

    “আমাকে খালি বল…কে সে? কে ওকে খুন করেছে?!”

    পুরোটা একজন মানুষের স্কিট। আমি ভান করছিলাম কিছু জানি না, খুনিকে হৃদয়ের সবটুকু দিয়ে ঘৃণা করছিলাম, আর নিজের অংশটুকু তীব্র ক্ষিপ্ততার মধ্যে অভিনয় করে যাচ্ছিলাম।

    পুলিশকে ছবিগুলো না দেখাতে পারাটা ছিল নিজেকে রক্ষা করার একটা অংশ মাত্র। মনের ভেতর আমি আমাকে বুঝ দিয়েছিলাম যে আমি আমার গার্লফ্রেন্ডের খুনিকে খুঁজে বের করার জন্য পুলিশের সাথে কাজ করে যাচ্ছি। সেজন্য ছবিগুলো আমার কাছে রাখা প্রয়োজন ছিল। পুলিশ, বলা বাহুল্য এসবের কিছুই জানত না। তারা তখনও ওকে একজন নিখোঁজ ব্যক্তি হিসেবেই দেখছিল। আমি আমার কাছে নিজের এমন একটা চিত্র দাঁড় করিয়েছিলাম যে আমি এমন একজন মানুষ যে কিনা তার প্রেমিকার খুনের প্রতিশোধ নিতে চায়, পুলিশের কোন সাহায্য ছাড়াই।

    এই ছোট্ট স্ক্রিপ্টটা ধরে আমি অভিনয় করে যেতে যেতে একসময় খেয়াল করলাম আমি ভাবছি আমি ঐ মানুষটা নই যে কিনা তার গার্লফ্রেন্ডকে খুন করেছে। অন্য কেউ করেছে সেটা। আমি নিষ্পাপ, তাই নয় কি?

    দুর্ভাগ্যজনকবশত, ছবিগুলো আমার চিঠির বাক্সে আসতেই থাকল, আর আমাকে এই বিভ্রমের দুনিয়া থেকে পুরোপুরি পালাতে বাধা দিচ্ছিল।

    অবশ্যই আমি সেই ব্যক্তি যে ওকে খুন করেছিল। ছবিগুলো আমাকে ক্রমাগত সেই কথাই বলছিল।

    ওর নিখোঁজ হওয়ার মাস খানেক পরে, নভেম্বরের প্রথম দিকে পুলিশ তাদের তদন্ত বন্ধ করে দিল। এরপর আমি আমার চাকরি ছেড়ে দিলাম যাতে ফুলটাইম নিজেকে ওর খুনি খোঁজার পেছনে কাজে লাগাতে পারি। অবশ্য আমি কিছুই করছিলাম না একজন নিহত নারীর প্রেমিকের রোল করা ছাড়া। আমি নিজেকে একজন ট্র্যাজিক হিরো হিসেবে দাঁড় করিয়েছিলাম, যে কিনা প্রেমিকার খুনের জন্য বদলা নিতে চাইছে।

    ওর বন্ধু-বান্ধব আর কাছের লোকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ দিয়ে আমি শুরু . করেছিলাম। ও যাকে যাকে চিনত, প্রত্যেক মানুষের সাথে আমি কথা বলেছিলাম-ওর অফিসের কলিগ, ওর পরিবার, যে কনভিনিয়েন্স স্টোরে ও প্রায়ই যেত সেখানকার ক্লার্ক, কাউকে বাদ রাখিনি।

    “হ্যাঁ, ওকে এখনো খুঁজে পাওয়া যায়নি। পুলিশ ভাবছে ও বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়েছে, কিন্তু আমি সেটা বিশ্বাস করতে পারছি না। ও পালিয়ে যাবে, ব্যাপারটা কেমন জানি অবিশ্বাস্য মনে হয়, তাই আমি এরকম ঘুরে ঘুরে লোকজন যারা ওকে চিনত সবাইকে প্রশ্ন করতাম। আপনি কি প্লিজ আমাকে সাহায্য করতে পারবেন? ধন্যবাদ। শেষ কবে ওকে দেখেছেন? ওর কথাবার্তায় অস্বাভাবিক কিছু কি চোখে পড়েছিল? যেমন, ওর সাথে কারো সমস্যা ছিল কিনা, ওর এলাকার মধ্যে কোন সন্দেহজনক ব্যক্তিকে ঘুরাঘুরি করতে দেখেছেন কিনা? ও কি আপনাকে এরকম কিছু বলেছিল? ..ও আমাকে কখনো এরকম কোন কিছু বলেনি…যে আংটিটা ও সবসময় পরে থাকত? হ্যাঁ, ওটা একটা এঙ্গেজমেন্ট রিং ছিল, আমি দিয়েছিলাম ওকে…অ্যাঁই, ওভাবে তাকাচ্ছেন কেন আমার দিকে। আমার আপনার সহানুভূতির কোন…”

    একজন মানুষও সন্দেহ করেনি যে ওর খুনি ব্যক্তিটি আমি। তারা ভেবেছিল আমি বিভ্রান্ত হয়ে আছি, বেচারা একজন যুবক যার গার্লফ্রেন্ড হঠাৎ বাক্সপেটরা বেঁধে ভেগে গিয়েছে। আমার অভিনয় খুবই ভাল ছিল বলে আমার ধারণা। কেউ কেউ আবার কেঁদেও ফেলেছিল, ওর জন্য না, আমার জন্য। দুনিয়াটা খুবই পাগলাটে ধরনের। কেউ কেন বুঝতে পারল না যে আমি ওকে খুন করেছি? আমি যেহেতু নিজেকে নিজে স্বীকার করাতে পারছি না, আমি ভাবছিলাম অন্য কেউ আমার হয়ে সেটা বের করে নেবে।

    আমি আসলেই তাই চাইছি। অপেক্ষায় আছি। আমি চাই কেউ একজন আমাকে অভিযুক্ত করুক, বলুক, “তুমি! তুমিই আসল ক্রিমিনাল!” এমনকি পুলিশও-এটা কি ওদের কাজের মধ্যে পড়েনা?-ওরা আমার অপরাধ খুঁজে পেতে ব্যর্থ হয়েছে।

    কিন্তু এখন…আমি ভাবছিলাম। আমি এই অপরাধবোধ থেকে মুক্ত হতে চাই। আমি সবকিছুর স্বীকার করতে চাই, আমার অপরাধের স্বীকারোক্তি দিতে চাই। নাহলে আমাকে এই অভিনয় আজীবন চালিয়ে যেতে হবে। নিজেকে নিয়ে আইনের হাতে তুলে দেয়ার মত সাহস আমার নেই। পুরো ব্যাপারটা অত্যন্ত ভীতিজনক। এই সমস্যা থেকে নিজেকে সরাতে না পেরে আমাকে আমার ছলচাতুরি চালিয়ে যেতে হচ্ছে।

    এভাবে এক সপ্তাহের মত আমার নিজস্ব তদন্ত চলার পর ইন্টারভিউ নেয়ার মত লোকজন ফুরিয়ে গেল। ঐ পর্যায়ে আমার নিজেকে মনে হচ্ছিল গোলকধাঁধার অন্ধগলিতে আটকা পড়া কোন ইঁদুরের মত।

    “এই ক্রিমিনালকে ধরার জন্য আমার সামনে কোন সূত্র নেই! কারো কাছে কি কোন তথ্য আছে?” আমি নিজেকে একা আমার রুমের কম্পিউটারের সামনে বসে বিড়বিড় করা অবস্থায় আবিষ্কার করলাম।

    আরেকবার লাশ পঁচতে থাকার ভিডিওটা চালিয়ে দেখলাম। ভিডিওর শেষে ও পুরোপুরি পঁচে গলে গিয়েছে, এমন কিছুতে পরিণত হয়েছে যা আর পোকামাকড়ের চর্বিত কিছু নেই, না রয়েছে মানুষের সদৃশ কিছু, এমন কিছু যার বর্ণনা দেয়া সম্ভব নয়।

    সত্যি বলতে কি দৃশ্যটা দেখে আমার বমি এসে যায়। কাউকে পঁচতে দেখার কোন ইচ্ছে আমার নেই, এমন কাউকে তো নয়ই যাকে কিনা আমি এক সময় ভালবাসতাম। কিন্তু আমাকে দেখতেই হত। শুধু দেখার মাধ্যমেই আমি নিজেকে বোঝাতে পারতাম যে আমিই ওকে খুন করেছিলাম। আমি আমার কাছে অনুনয় করলাম যেন পুলিশ স্টেশনে গিয়ে সবকিছু খুলে বলি। কিন্তু আমার আবেদন আমার বধির কানের সামনে হেরে গেল।

    “তুমি শুধু শুধু বসে থাকতে পার না! যাও গিয়ে নতুন তথ্য উদ্ধার কর! গতর খাটাও! তদন্ত করা।”

    আমি উঠে দাঁড়িয়ে চোখ থেকে অশ্ন মুছে কম্পিউটার স্ক্রিন আর ওর পঁচে যাওয়ার দৃশ্য থেকে সরে এলাম। ওর একটা ছবি হাতে নিয়ে বেরিয়ে গেলাম। শহর জুড়ে ঘুরে বেড়ালাম যেন ক্রিমিনালকে খুঁজছি।

    যে ছবিটা আমি সাথে নিয়ে বের হয়েছিলাম সেটা ওর পঁচতে থাকা লাশের ছবি ছিল না। ও যখন জীবিত আর সুন্দর ছিল তখনকার ছবি ছিল। ছবিতে ওর পেছনে আপনি চিড়িয়াখানায় বেড়া দিয়ে ঘেরা জায়গার মধ্যে থাকা জেব্রা দেখতে পাবেন। কি মনে করে ও ঐ ডিস্পোজাল ক্যামেরাগুলোর একটা সাথে করে নিয়ে এসেছিল। শেষ কয়েক ছবির সময় আমি ক্যামেরা ওর উপর তাক করেছিলাম। সেখান থেকে আমি ওর এই ছবিটা নিয়েছি। ছবিতে ও খানিকটা চোখ রাঙ্গিয়ে তাকিয়ে ছিল।

    রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে আমি অনেক লোকজনকে ছবিটা দেখালাম, জানতে চাইলাম কেউ ওর সম্পর্কে কোন কিছু জানে কিনা। লোকজন মনে হয় আমাকে পাগল ভাবছিল। নয়ত অন্তত কোন ধরনের অভদ্র ব্যক্তি।

    আমি ব্যাপারটা বুঝতে পারছিলাম কিন্তু কোন উপায় ছিল না। আমাকে কাজটা করতেই হবে। আমি হাত পা খুঁটিয়ে কিছু না করে বসে থাকতে পারি না।

    আমার কোন কাজ ছিল না, কাজ করার ইচ্ছা ছিল না, যা সেভিংস ছিল সব শেষ হয়ে যাচ্ছিল। খুব শিগগিরি আমাকে আমার অ্যাপার্টমেন্ট থেকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয়া হবে। সমস্যা নেই, আমি আমার গাড়িতে ঘুমাতে পারব। খাওয়ার কিছু না থাকলে কারো কাছ থেকে টাকা-পয়সা চুরি করে নেব। আমার হাত নোংরা করতে কোন আপত্তি ছিল না। যতক্ষণ পর্যন্ত না আমি খুনিটাকে খুঁজে পাচ্ছি, অথবা তাকে খুঁজে পাওয়ার জন্য চেষ্টার অভিনয় করছি।

    সারাটা সকাল আমি শহরের মধ্যে ঘুরে বেড়াই আর লোকজনকে প্রশ্ন করতে থাকি।

    “আপনি কি এই মেয়েটাকে চেনেন? একে দেখেছেন কোথাও? প্লিজ…প্লিজ।”

    একবার একটা স্থানীয় দোকানের মালিক আমার নামে পুলিশের কাছে অভিযোগ করল। ঐ অভিজ্ঞতার পর আমি শিখলাম এক এলাকায় খুব বেশি সময় না কাটানোর। একাধিকবার লোকাল গ্যাংগুলোর দৃষ্টিতে পড়েছিলাম। তীব্র পরিস্থিতির সৃষ্টিও হয়েছে কয়েকবার। আমি বাধা দেয়ার চেষ্টা করেছি কিন্তু একজন এক পেছনের গলিতে আমার উপর চাকু ধরেছিল। আমি চাইছিলাম সে আমাকে মেরে ফেলুক, হৃদপিণ্ড বরাবর একটা কোপ। শেষ করে দেয়ার জন্য যথেষ্ট। সবকিছু শেষ হয়ে যেত। ওকে খুন করেছি স্বীকার

    করেই আমি মরতে পারতাম। আমার জীবনের অন্ত হত একজন শিকার হিসেবে, কোন খুনি হিসেবে নয়। তাতে অন্তত আমার সম্মান কিছুটা হলেও রক্ষা হত। আমার পাপ থেকে মুক্তি পাওয়ার একমাত্র পথ ছিল। ওর ছবি নিয়ে আমাকে আর ঘুরতে হত না, শহরে ঘুর ঘুর অস্তিত্বহীন তথ্য খুঁজতে হত না, অস্তিত্বহীন কোন ক্রিমিনালকে আর খুঁজতে হত না।

    কিন্তু অল্প বয়সি ছেলেটা আমাকে আঘাত করেনি। আমি ওর চাকু ধরা হাত খপ করে ধরে আমার বুকে এনে ঠেকিয়েছিলাম। ছেলেটা শুধু একটু চাপ, অল্প একটু চাপ দিলেই কাজটা হয়ে যেতে পারত। কিন্তু তা না করে সে কাঁপতে থাকল আর ক্ষমা চাইল। ওর গ্যাঙের বাকি সদস্যদের চেহারাও ফ্যাকাসে হয়ে গিয়েছিল। এমন সময় পুলিশ এল আর তারা সবাই দৌড়ে পালিয়ে গেল। আমি চিৎকার করে পেছন থেকে ডাকলাম, “আমার জন্য দাঁড়াও! আমাকে সাথে নিয়ে যাও!”

    কোন এক নোংরা বুড়ি পুলিশদের ডেকেছিল। রাস্তায় যখন ওরা আমাকে ঘিরে ফেলেছিল তখন মহিলা দূর থেকে সেটা দেখেছিল। ছোট একটা ইতর চেহারার বুড়ি, পুলিশের পেছনে লুকিয়ে ছিল। আর তার পোশাক আর পায়ে যে জিনিস পরে ছিল তা দেখে কেউ তাকে আধুনিক জাপানিজ বলে ভাববেও না। আমি বাজি ধরে বলতে পারি মহিলা ছিল গরিব, টাকা পয়সা ছিল না। হয়ত পেশাব-পায়খানায় ভরা কোন টানেলের মধ্যে ঘুমায়। তার মুখের ভাঁজগুলো ঝুলকালি মাখা ছিল। চুলগুলো ছিল নোংরা। গলার কাছে যে জিনিসটা ঝুলছিল সেটা দেখে কাঠের বোর্ড মনে হচ্ছিল। প্রথমে আমি ভেবেছিলাম সেটা হয়ত কোন পাচিনকো পার্লারের বিজ্ঞাপন, কিন্তু আমার ভুল হয়েছিল।

    ওটা ছিল ভেজা কোন কাঠের তক্তা, সম্ভবত কোন ময়লার ডিব্বা বা সেরকম কোথাও থেকে তুলে আনা। তক্তাটায় বড় বড় অক্ষরে লেখা ছিল, “আপনি কি এই লোককে দেখেছেন?” লেখাগুলোর নিচে একটা অল্প বয়সি ছেলের ছবি দেয়া। আমার হাতে ধরা আমার গার্লফ্রেন্ডের ছবির তুলনায় ঐ ছবিটা অবিশ্বাস্য রকমের পুরাতন। মহিলা আমাকে বলল প্রায় বিশ বছর আগে তার একমাত্র ছেলে নিখোঁজ হয়ে যায় আর এখনো সে রাস্তার কোণায় দাঁড়িয়ে তাকে খোঁজে। পুরাতন ছবিটায় হাত বুলিয়ে সে দুর্বোধ্য কোন আঞ্চলিক উচ্চারে কিছু একটা বিড়বিড় করতে থাকে। ছবিটাই একমাত্র বাস্তব বস্তু যা ছেলের স্মৃতি হিসেবে তার কাছে আছে। মহিলা তার মানসিক অবস্থার শেষ সীমায় প্রায় পৌঁছে গিয়েছিল।

    আমি বুড়ি মহিলাটার পায়ের কাছে হাঁটু গেড়ে বসে পড়েছিলাম। পায়ের সামনে শুয়ে পড়ে ধুলোয় মুখ ঘষেছিলাম। আমি আমার কান্না থামাতে পারছিলাম না। বুড়ি মহিলাটা আর তার পাশে দাঁড়ানো পুলিশ অফিসারটা আমাকে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করছিল। কিন্তু আমি শুধু এদিক ওদিক মাথা ঝাঁকানো ছাড়া আর কিছু করতে পারছিলাম না।

    ৩

    পর্বতমালার এক পরিত্যাক্ত কেবিনে আমার আর আমার গার্লফ্রেন্ডের মধ্যে বিশাল যুদ্ধ হয়েছিল। ও একটু আবেগপ্রবণ মানুষ ছিল। সেজন্যই আমরা সেদিন চিড়িয়াখানায় গিয়েছিলাম। রাস্তায় সাইনবোর্ড দেখেই সে যাওয়ার জন্য হঠাৎ সিদ্ধান্ত নেয়। একইভাবে, আমাদের ঝগড়ার দিনে, একটা পাহাড়ি রাস্তায় আমরা একটা পার্শ্ব পথ আবিষ্কার করি। “চল গিয়ে দেখি এই পথটা কোথায় গিয়েছে, সে লাফিয়ে উঠল। আমার মনে হয়েছিল ও হঠাৎ করেই ঐ পথে কি আছে তা দেখতে আগ্রহী হয়ে উঠেছিল। ওকে পছন্দ করার অনেক কারনের মধ্যে এই আবেগি ব্যাপারটাও একটা ছিল।

    কিছুক্ষণ ডাইভ করার পর কেবিনটা খুঁজে পাই। কেবিন বললে ভুল বলা হবে, দেখে মনে হচ্ছিল একগাদা পুরোনো তক্তার স্তূপ। আমরা গাড়ি থামিয়ে ভেতরে গেলাম। জায়গাটা থেকে ছাতা পড়া গন্ধ আসছিল। আমরা দুজনেই সিলিঙের দিকে তাকালাম। মনে হচ্ছিল যে কোন সময় আমাদের মাথার উপর ধসে পড়বে। পোলারয়েড ক্যামেরা দিয়ে ওর একটা ছবি তুললাম। চিড়িয়াখানাতে যাওয়ার পর থেকে ফটোগ্রাফির প্রতি আমার খানিকটা আগ্রহ জেগেছে।

    ক্যামেরা ফ্ল্যাশ জ্বলে ওঠার সময় সে হাস্যকর একটা চেহারা করল। “বেশি জ্বলে গিয়েছে,” ও ছবিটা দেখে মুখ ভোঁতা করে বলল। তারপর ছবিটা দলামচা করে বল পাকিয়ে ফেলল। ব্যাপারটা আমাকে আহত করল। তারপর ও বলল আমার উচিত ওকে ভুলে যাওয়া। মানে কি? আমি জানতে চাইলাম। তারপর ও আঘাত দিয়ে অনেক কথা বলল। ও আমাকে বলল যে ও আমাকে আর ভালবাসে না।

    ঐ দিনটাই ছিল সেদিন, যেদিন ও নিখোঁজ হয়ে গিয়েছিল, বাকি দুনিয়া অন্তত তাই জানত। কারনটা স্পষ্ট। ও আর ঐ কেবিন থেকে বের হয়নি।

    ঐদিন ও স্বীকার করেছিল যে ও কখনো কাউকে আমাদের ডেট করার কথা বলেনি। আর এখন সবকিছুর পর আমি ওর কথা বিশ্বাস করি। ও যদি ওর পরিবার, ওর বন্ধুদের, ওর সহকর্মীদেরকে আমার কথা বলত, তাহলে পুলিশ অবশ্যই আমাকে খুনের ব্যাপারে সন্দেহ করত। আর তারা জিজ্ঞাসাবাদ করলে আমি স্বীকার করতাম। শুধুমাত্র একটা ফোনই আমি পেয়েছিলাম, সেটা ওর মায়ের থেকে। তিনি জানতে চাইছিলেন আমি তার মেয়েকে চিনি কিনা! ফোনে কথা বলার সময় আমার মনে হয়েছিল মহিলা সম্ভবত তার মেয়েকে খুব একটা ভালবাসেন না। ওর নিখোঁজ হওয়ার পরও তিনি তেমন একটা দুশ্চিন্তাগ্রস্থ ছিলেন না।

    আমি ওর মায়ের কাছে প্রায় স্বীকার করেই ফেলছিলাম, কিন্তু আমার মুখ থেকে অন্যরকম কথা বেরিয়ে এল। “কি? নিখোঁজ বলতে চাইছেন? পুলিশের সাথে যোগাযোগ করেছেন? দাঁড়ান আমি এক্ষুনি আসছি।” তারপর থেকে আমার সেই অর্থহীন দীর্ঘ অভিনয়ের শুরু।

    আমি ওর বাসায় গেলাম। পুলিশের জন্য একটা ফর্ম পূরণ করলাম। উদ্বিগ্ন একজন বন্ধুর মত ভান করলাম। নিজের একটা মিথ্যা সত্ত্বা তৈরি করলাম যে ওকে খুঁজে বের করার জন্য মরিয়া, ও খুন হয়ে থাকতে পারে এরকম চিন্তায় যে কিনা পাগল প্রায়।

    একদিন আমি আমার প্রাক্তন গার্লফ্রেন্ডের ছবি হাতে শহরের মধ্যে এদিক ওদিক ঘুরে পারকিং লটে আমার গাড়ির কাছে ফিরে এলাম। দিন তখন প্রায় শেষ, সূর্য অস্ত যাচ্ছিল। আমি আমার চারপাশ ঘিরে থাকা বিল্ডিংগুলোর দিকে মুখ তুলে চাইলাম। ওগুলো সামনে খোলা জায়গাটার উপর গাঢ় ছায়া ফেলতে শুরু করেছিল।

    “আরেকটা দিনের শেষ অথচ কোন অগ্রগতি নেই,” আমি বিড়বিড় করে নিজেকে বললাম। আমার মুখ থেকে বের হওয়া প্রতিটা মিথ্যা নিশ্বাস শীতের ঠাণ্ডা বাতাসে সাদা ধোঁয়ার সষ্টি করছিল। আমার ভেঁড়া কোটের পকেট থেকে ওর ছবি বের করে তাকিয়ে থাকলাম। আমার আঙুলের মাথায় একটু কেটে গিয়েছিল, আর ঠান্ডায় আমার চামড়াও শুষ্ক হয়ে গিয়েছিল, তারপরও ছবিতে ওর চেহারার উপর হালকাভাবে আঙুল বোলালাম।

    পুরো পারকিং লটে শুধু আমার গাড়িটাই ছিল। কংক্রিটের তলের উপর আমার ছায়া বিস্তৃত হয়ে ছিল।

    “কালকে আমি লোকটাকে ঠিকই খুঁজে বের করব…”

    সারাদিন হাঁটাহাঁটির জন্য আমার পুরো শরীর ছেড়ে দিয়েছিল। মনে হচ্ছিল যে কোন সময় পড়ে যাব। গাড়ির দরজা খুলে হুইলের পেছনে গিয়ে বসলাম। ঐ সময় নজরে পড়ল যে প্যাসেঞ্জার সিটের নিচে কিছু একটা পড়ে আছে।

    “কি এইটা?”,

    একটা কাগজের দলা পড়ে ছিল। আমি তুলে দেখি একটা ছবি। হাত দিয়ে ঘষে সমান করলাম।

    “কি…!?” ওর ছবি। ওকে একটু গোমড়া দেখাচ্ছিল কিন্তু তাও কিউট। ওর পেছনে কাঠের দেয়াল দেখা যাচ্ছিল। আর ডান দিকের কোণায় একটা তারিখ।

    “একি! এই দিনেই তো ও নিখোঁজ হয়েছিল!” আমি যতটা সম্ভবত অবাক হওয়ার ভান করলাম। এইটাই ঐ ছবিটা যেটা দেখে ও ঐদিনে রেগে গিয়েছিল আর দলামচা করে বল বানিয়ে ফেলেছিল।

    “এই ছবি আমার গাড়িতে কি করছে? অদ্ভুত তো৷ কিছুই তো বুঝতে পারছি না। ক্রিমিনালটা নিশ্চয়ই এখানে এসে রেখে গিয়েছে। আর কিছু তো মাথায় আসছে না…”

    ছবিটা রাখার জন্য গ্লাভ কম্পারটমেন্টটা খুললাম। ভেতরে গাড়ির রেজিস্ট্রেশনের কাগজ, ম্যানুয়াল আর সন্দেহজনক একটা বাতিল কাগজ।

    “এইটা আবার কি?”

    কাগজটা ছিল গ্যাস স্টেশনের একটা রিসিট।

    “তারিখটা…ঐ একই দিনের, যেদিন ও হারিয়ে গিয়েছিল! গ্যাস স্টেশনের ঠিকানা লেখা আছে! এ কি রকমের খ্যাপামি? আমি তো ঐদিন বাইরেই বের হইনি। সারাদিন বাসায়ই ছিলাম…হয়তো…”

    আমার সন্দেহগুলো একটা গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। অন্তত সেরকমই আমি অভিনয় করছিলাম।

    “লোকটা যেই হোক সে নিশ্চয়ই এই গাড়িটা ব্যবহার করে ওকে অপহরণ করেছিল। তাই হবে! ক্রিমিনালটা এভাবেই ওকে বোকা বানিয়েছিল। ও নিশ্চয়ই গাড়িটা দেখে ভেবেছিল আমি চালাচ্ছি, তাই চিন্তা না করে উঠে পড়েছিল!”

    আমি ইগ্নিসনের চাবি ঘুরিয়ে গাড়ি চালু করলাম। ঠিক কোথায় যেতে হবে তা এখন আমার জানাঃ রিসিটে যেই গ্যাস স্টেশনের ঠিকানা লেখা আছে, সেখানে।

    “গ্যাস স্টেশনের কর্মী হয়ত খেয়াল করেছিল সেদিন কে এই গাড়ি চালাচ্ছিল! বুঝতে পারছি না তাদের মনে থাকবে কিনা।”

    নিজের মনে বিড়বিড় করতে করতে আমি গাড়ি চালিয়ে শহরের বাইরের দিকে যেতে লাগলাম। রাস্তার ধার ধরে পুরনো আমলের ফার্ম হাউজ আর খালি জমি। ডুবতে থাকা সূর্যের রঙ ছিল লাল, উইন্ডসিন্ডের ভেতর দিয়ে আমার চোখে এসে আলো পড়ছিল।

    অবশেষে গ্যাস স্টেশনে যখন পৌঁছলাম ততক্ষণে অন্ধকার নেমে গিয়েছিল। একটা মাঝবয়সি লোক আমার গাড়ির দিকে এগিয়ে এল। পড়নে মেকানিকের জাম্পসুট, তেল-গ্রিজ লাগা হাতগুলো একটা ন্যাকড়া দিয়ে মুছে পরিস্কার করছে। আমি জানালার কাঁচ নামিয়ে তাকে আমার গার্লফ্রেন্ডের ছবি দেখালাম আর কিছু প্রশ্ন করলাম।

    “হ্যালো ভাই, একটু এই ছবিটা দেখবেন প্লিজ?”

    উত্তর দেয়ার সময় তাকে খানিকটা বিরক্ত দেখাল।

    “ও হ্যাঁ, এই মেয়েটা। অনেকদিন আগে এসেছিল। পশ্চিমের দিকে গিয়েছিল।”

    “পশ্চিম? কি ধরনের গাড়িতে ছিল সে?”

    “মজা করছেন নাকি? আপনি যে গাড়িটা এখন চালাচ্ছেন সেটাতেই ছিল সে।”

    “আমি জানতাম!”

    “আর আপনিই ডাইভ করছিলেন। কথা শেষ হয়েছে? স্ক্রিপ্ট খতম? বিশ্বাস করতে পারছি না আপনি এখনো প্রতিদিন এই একই কাজ করেন। ক্লান্ত লাগে না? কত মাস হল এখন আপনি আমার সাথে এই খেলা খেলছেন? অবশ্য যাই হোক, আপনি একজন কাস্টমার, খেলে যেতে চাইলে আমি না করতে পারি না।”

    “বাজে কথা বলবেন না। আমি ডাইভ করছিলাম? কি ফালতু কথা বলছেন।”

    আমি শকড়, কিংবা সেরকম হওয়ার ভান করলাম।

    “আপনি বলতে চাইছেন, ঐ দিন যে গাড়িতে ও ছিল, সেটা আমি চাচ্ছিলাম?”

    লোকটা আমার দিকে এমনভাবে তাকাল যেন আর কোন কথা বলতে চায়না। আমি গ্যাস প্যাডেলে চাপ দিয়ে পশ্চিমের দিকে এগুতে লাগলাম।

    “শিট! কোথায় যেতে হবে কোন ধারণা নেই আমার আর!” স্টিয়ারিং হইলের উপর কিল মারতে লাগলাম।

    “গ্যাস স্টেশনের ঐ লোকটা বলল আমি ড্রাইভ করছিলাম…কিন্তু সেদিন তো আমি সারাদিন বাসাতেই ছিলাম! কি হচ্ছে এসব?! কোনটা বাস্তব আর কোনটা ফ্যান্টাসি?!”

    ঐ মুহূর্তে আমার নিজের উপর সন্দেহ জন্মাচ্ছিল। গ্যাস স্টেশনের মেকানিকের সাথে হওয়া কথাবার্তা আমাকে কাঁপিয়ে দিয়েছে। আমি নিজেকে সামলানোর জন্য বললাম। সামনে যা আসছে তার জন্য আমাকে প্রস্তুত থাকতে হবে।

    এক পর্যায়ে আশেপাশের এলাকা বদলে গিয়ে রাস্তার দুপাশে ঘন জঙ্গল শুরু হল। গাড়ির হেডলাইটে একটা কম চলাচল হওয়া পার্শ্বপথ দেখা গেল। আমি জোরে ব্রেক কষলাম।

    “এই জায়গাটা আমি আগে দেখেছি, বিশেষ করে এই দৃশ্যটা। বোকার মত কথা। এরকম ভাবার কোন কারনই থাকতে পারে না।”

    স্টিয়ারিং হুইল ঘুরিয়ে গাড়িটা পাশের রাস্তায় নামালাম। একটা গাড়ি যাওয়ার মত চওড়া একটা পথ। কিছুদূর যাওয়ার পর একটা ভোলা জায়গা এসে পড়ল। গাড়ির হেডলাইটের আলোতে অন্ধকার ভেদ করে একটা পুরাতন কাঠের কেবিন আমার সামনে দেখা গেল।

    “এই জায়গাটা আমি চিনি…আমি…”

    গাড়ি থেকে নেমে আশেপাশে তাকালাম। কোন মানুষজন নেই। জঙ্গলের বাতাসটা ঠাণ্ডা আর স্থির হয়ে ছিল। ট্র্যাঙ্ক থেকে আমি একটা পকেট ফ্ল্যাশলাইট বের করে কেবিনটার দিকে এগুলাম। প্রথম যে জিনিসটা আমার চোখে পড়ল সেটা ছিল একটা ট্রাইপড আর একটা ক্যামেরা। ক্যামেরাটা ছিল পোলারয়েড ক্যামেরা।

    কেবিনের মেঝেটা ছিল ভোলা মাটির, মাঝখানে একটা গর্ত খোঁড়া ছিল। ক্যামেরার লেন্সটা ঐ কালো গর্তের দিকে মুখ করে রাখা। আমি আরো কাছে গেলাম। গর্তটার ভেতরটা যেন পানির মত অন্ধকার দিয়ে পূর্ণ। আমি ফ্ল্যাশলাইটের আলো গর্তের ভেতর ফেললাম।

    তারপর ওটা দেখতে পেলাম।

    হাঁটু ভেঙে পড়ে গেলাম আমি। “এখন আমার মনে পড়ছে। কিভাবে আমি…”

    আমি আমার অভিনয় চালিয়ে গেলাম। ওয়ান ম্যান শো, এক চরিত্রের নাটক। আমিই অভিনেতা, আমিই দর্শক।

    “…আমি ওকে খুন করেছি…”

    কান্নায় ভেঙে পড়লাম। অণুগুলো আমার গাল বেয়ে খোলা মাটির উপর গড়িয়ে পড়ল। আমার পাশে থাকা গর্তটার মধ্যে সে শুয়ে ছিল। ওর শরীর পুরোপুরি ক্ষয়ে মাটির সাথে মিশে গিয়েছিল, পোকামাকড় আকর্ষণ করার মত কিছু আর অবশিষ্ট ছিল না। ও একদম সংকুচিত হয়ে গিয়েছিল।

    “আ…আমি…ওকে। আমি নিশ্চয়ই স্মৃতিটা কোথাও আটকে রেখেছিলাম…”

    আমি এসব কথা চিন্তা করছিলাম। সত্যি হল আমি কিছুই ভুলিনি। সবকিছু মনে আছে। কিন্তু এই প্লটটা যেটায় আমি অভিনয় করছিলাম তার মধ্যে আমি আটকা পড়ে গিয়েছিলাম।

    “এতদিন ধরে আমি ঐ ক্রিমিনালকে খুঁজছি যে ওকে খুন করেছিল। কিন্তু আমি নিজেই সেই ক্রিমিনাল…ও আমাকে আজেবাজে কিছু কথা বলেছিল যাতে আমি ক্রোধে ফেটে পড়েছিলাম…” আমি চিৎকার করলাম আর গোঙালাম। আমার কণ্ঠ কেবিনটার মধ্যে প্রতিধ্বনি তুলল, কিন্তু শোনার মত কেউ ছিল না। ফ্ল্যাশলাইটটাই রুমের আলোর একমাত্র উৎস ছিল।

    ঠাণ্ডা মেঝেতে হাত রেখে আমি উঠে দাঁড়ালাম। আমার পুরো শরীর ক্লান্তিতে ভেঙে পড়তে চাইছিল। আমি গর্তের কোণায় গিয়ে নিচে ওর দিকে তাকালাম। গর্তের গভীরে ও ধুলো বালিতে অর্ধেক ঢাকা পড়েছিল, মানুষের মত কিছু ছিল না।

    “পুলিশকে জানাতে হবে…আমাকে জেলে ঢোকাতে হবে…” আমি বিড়বিড় করে মনস্থির করে ফেললাম। এই অংশটাও স্ক্রিপ্টের অংশ, কিন্তু এটা আমি মনের গভীর থেকে বিশ্বাস করেছিলাম। আত্মার গভীর থেকে এটাই আমার চাওয়া ছিল।

    “আমার কি তা করার সাহস আছে?”

    আমার মুঠিগুলো কাঁপছিল। আমি নিজেকে প্রশ্ন করছিলাম, নিজেই সেগুলোর উত্তর দিচ্ছিলাম।

    “আমি কি এর জন্য প্রস্তুত আছি?”

    যাই হোক না কেন, আমাকে এটা করতেই হবে। আমি যে একজন মানুষকে খুন করেছি, এই সত্য থেকে পালিয়ে যেতে পারব না। সত্য হল, আমি যাকে ভালবাসতাম, তাকেই খুন করেছি। এর ফলাফল আমাকে মেনে নিতেই হবে।

    “এটাই সমস্যা…এটা মেনে নেয়া…কঠিন।”

    আমি মাথা নাড়লাম। সাহস হারাতে শুরু করেছিলাম, আরো অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। আমি কিভাবে নিজেকে ধরিয়ে দিতে পারি? আমি কিভাবে স্বীকারোক্তি করতে পারি?

    “কালকের মধ্যে আমি ভুলে যাব এখন আমার কিরকম লাগছে। আমার মনে হচ্ছে আমি সত্য কি তা ভুলে যাব…আমি এই স্মৃতিটাকে আবার কোথাও বন্দি করে রাখব, আমি আবারও অস্তিত্বহীন ক্রিমিনালের খোঁজে বের হব…আমি…”

    দুহাতে নিজের মুখ ঢাকলাম। আমার কাঁধগুলো কাঁপছিল। তখন আমার কিছু একটা মনে পড়ল। কিংবা বলা যায় আমি অভিনয় করলাম যে কিছু একটা মনে পড়েছে।

    পোলারয়েড ক্যামেরার কাছে গিয়ে শাটার বাটনে চাপ দিলাম। স্যাঁত করে একটা ফ্ল্যাশ জ্বলে উঠল, ওর দেহটা যেন অন্ধকারের মধ্যে হঠাৎ জেগে উঠল। ছোট একটা শব্দ করে ক্যামেরাটা থেকে একটা ছবি বেরিয়ে এল।

    “এই ছবিটার দিকে যখন আমি তাকাব তখন আমার অপরাধের কথা মনে পড়বে। যত চেস্টাই করিনা কেন সত্য থেকে মুখ সরিয়ে রাখার কোন উপায় নেই, সত্যকে অস্বীকার করার কোন ক্ষমতা আমার সামনে থাকবেনা। এই ছবিটা আমাকে দেখাবে আমি কি করেছি…আমি এর মূল্য না দিয়ে কোথাও যেতে পারব না।”

    যখন বুঝতে পারলাম আমাকে কি করতে হবে, আমার কণ্ঠ কাঁপতে লাগল। ছবিটা নিয়ে আমি গাড়িতে ফিরে এলাম।

    “আমাকে পুলিশের কাছে যেতে হবে…আমি ওদেরকে এই ছবিটা দেখিয়ে বলব যে আমি ওকে খুন করেছি…”

    ফ্ল্যাশলাইটটা ট্রাংকে রেখে গাড়ির ভেতর ঢুকলাম। ছবিটা মাত্র ডেভেলপ হতে শুরু করেছিল। আমি ওটা প্যাসেঞ্জার সিটে রেখে গ্যাস পেডেলে চাপ দিলাম।

    অন্ধকার ভেদ করে ডাইভ করে গেলাম। এস্কেলারেটরে চাপ বাড়াতে ইঞ্জিন গর্জন করে উঠল। আমার চারপাশে ছিল শুধু নিঃসঙ্গ খালিভূমি। রাস্তার উপরে হেডলাইটের সাদা আলোগুলো মনে হল ভাসছিল। রাস্তার পিচের কালোটাকে আশেপাশে অন্ধকারের চেয়ে বেশি কালো দেখাচ্ছিল।

    প্যাসেঞ্জার সিটে আমার পাশে ছবিটা পড়ে ছিল, যেটাতে আমার প্রাক্তন গার্লফ্রেন্ডের ক্ষয়ে যাওয়া দেহ মনে হচ্ছিল জেগে উঠে আমাকে সঙ্গ দিচ্ছিল।

    “আমি স্বীকারোক্তি দেব। আমি পুলিশের কাছে যাব। আমি আমার অপরাধ স্বীকার করব। পালিয়ে যাব না। আমি অবশ্যই পালাবোনা। আমিই ওকে খুন করেছি। এটা হতে পারে না। কিন্তু তাই হয়েছে। এটাই সত্যি। আমি এটা স্বীকার করতে চাই না। এরকম কাজ করার মত মানুষ আমি নই। আমি ওকে ভালবাসতাম। কিন্তু আমিই ওকে খুন করেছিলাম…”

    আমি বারবার এসব কথা বলছিলাম, নিজেকে ফোকাসে রাখার জন্য।

    কিন্তু আমি জানতাম, জানতাম এরপর কি হবে। যদিও আমি স্ক্রিপ্ট অনুসারে চলছি কিন্তু আমি কখনোই পুলিশের কাছে যাব না। এমন না যে আমি যেতে চাই না, আমি যেতে পারি না। সত্যি হল, আমি চাই যেতে আর এসব থেকে মুক্তি পেতে। কিন্তু আমি জানি আমি আমার সিদ্ধান্ত ধরে রাখতে পারব না।

    প্রতিটা দিন, প্রতিটা রাত আমি এই প্যাটার্নটার পুনরাবৃত্তি করে যাচ্ছিলাম। শুধু আজকেই নয়। এই একই নাটক আমি বার বার অভিনয় করে যাচ্ছিলাম। প্রতি বিকেলে সূর্য অস্ত যাওয়ার সময় আমি আমার গাড়ির ভেতর ওর ছবি আবিষ্কার করি। ঐ মুহূর্তে আমার নিজের উপর সন্দেহ গজিয়ে উঠতে শুরু করে। আমি গ্যাস স্টেশনে যাই আর ওখানের লোকটার সাথে কথা বলি যে আমাকে সাহায্য করে। প্রতিদিনই আমি প্রায় একই সময়ে হাজির হই আর একই লাইন আউরে যাই। জঙ্গলের ভেতরের কেবিনটায় যাই, ওর মৃতদেহের দিকে তাকাই, আর মনে পড়ে আমি কি করেছি।

    আর তারপর আমি সিদ্ধান্ত নেই পুলিশের কাছে যাওয়ার। এই অংশটাও অভিনয় হলেও আমি মনে থেকে তা করতে চাই।

    কিন্তু শেষ পর্যন্ত পারি না। আমি যদি অত্যন্ত বিষণ্ণ না হতাম, তাহলে হয়ত জেলে বসে একটা সহজ জীবন কাটাতে পারতাম।

    আগে যেখানে থেমেছিলাম, সেই গ্যাস স্টেশনটা পার হয়ে যাই। লাইটগুলো নেভানো, সেটা বন্ধ হয়ে গিয়েছে সেদিনের মত। একটু পর আমি একটা বিশেষ সাইন দেখতে পাব। সাইনটা দেখার পর আমার দৃঢ়সংকল্প ভেঙে পড়তে শুরু করবে আমি নিশ্চিতভাবে এটা জানি। প্রতি দিন, প্রতিটা রাতে একই ঘটনা ঘটে। “চিড়িয়াখানা। বামে মোড়। ২০০ মিটার সামনে।”

    আমি সেটাই দেখার আশা করি। ইংরেজিতে লেখা অক্ষরগুলো আমার চোখের রেটিনা যেন পুড়িয়ে বসে যায়। চিড়িয়াখানা-জু।

    ঐ মুহূর্তে ওর সবকিছু আমার মনের ভেতর ফিরে আসতে শুরু করবে। আমরা একসাথে মুভি দেখতে গিয়েছিলাম। একসাথে চিড়িয়াখানায় গিয়েছিলাম। আমি ওর ছবি তুলেছিলাম। প্রথমবার যখন আমাদের দেখা হয়েছিল। এতিমখানায় আমার বড় হওয়ার গল্প ওকে বলেছিলাম। ও খুব কমই হাসত, প্রথমবার যখন ও আমার দিকে তাকিয়ে হেসেছিল। এসব যার মধ্যে ফিরে আসতে শুরু করত। অন্ধকার ফুড়ে সাইনটা বেরিয়ে আসবে আর ও আমার পাশের সিটে বসে থাকবে। বাস্তবে নয়, অবশ্যই। ছবি থেকে ওর মৃতদেহ রহস্যময়ভাবে উঠে বসে আমার দিকে তাকাবে, ওর হাত আস্তে করে আমার চুল স্পর্শ করবে। ঠিক এমনভাবেই ঘটবে সবকিছু।

    আমি নিশ্চয়ই বিষণ্ণ। সেটা ভাল কথা নয়। এটা হতে পারে না। আমি ওকে খুন করতে পারি না…আমি এরকমই চিন্তা করব। রাস্তা বেয়ে আরেকটু সামনে গিয়ে রাস্তার মাঝে গাড়ি থামিয়ে আমি বাচ্চার মত কাঁদতে থাকি। আমি আমার অ্যাপার্টমেন্টে ফিরে যাব, প্যাসেঞ্জার সিট থেকে ছবিটা নিয়ে চিঠির বাক্সে ঢুকিয়ে দেব, প্রার্থনা করব কাল যখন সকালে ঘুম থেকে উঠব তখন এই ছবিটা আমাকে সঠিক কাজটা করার জন্য অনুপ্রেরণা দেবে, নয়তো আমি আশা করব ফিল্মটা, এক সেকেন্ডের বারো ভাগের একভাগ লম্বা যেটা, সেটা আমাকে সাফল্যর পথ দেখাবে। ভাঁজ করা পোলারোয়েড ক্যামেরা আর গ্যাস স্টেশনের রিসিটটা গাড়িতে রেখে পরবর্তী সন্ধ্যার জন্য মঞ্চ তৈরি করে রাখব। শো মাস্ট গো অন। শো চলতেই হবে। আর এটাই শেষ কথা।

    হ্যাঁ, এটাই ঠিক। শেষ পর্যন্ত আমি তা বুঝতে পারব না। দিনের শেষে আমি কখনোই নিজের কাছে স্বীকার করব না যে আমি ওকে খুন করেছি। কিছুই বদলাবেনা। আমি ঐ চিড়িয়াখানায় খাঁচার মধ্যে পায়চারি করতে থাকা কুৎসিত বানরটার চেয়ে আলাদা কিছু নই। আমি একই জীবন প্রতিদিন বার বার কাটাতে থাকব। কাল আমি চিঠির বাক্সে ছবিটা খুঁজে পাব, আবারও স্তম্ভিত হয়ে যাব। খারাপ তোক ভাল হোক এটাই চলতে থাকবে।

    অন্ধকার ভেদ করে গাড়িটা এগিয়ে যেতে লাগল। একই রাস্তা ধরে প্রতি রাতে আমি ডাইভ করে যাই। কত মাস হল আমি এরকম করছি? আমার সামনে আর কত এরকম মাস পড়ে আছে? সাইনটা শিগগিরি চোখে এসে পড়বে, যেই সাইনটা ওর সমস্ত স্মৃতি নিমেষেই ফিরিয়ে আনবে। আমি শক্ত করে স্টিয়ারিং হুইলটা চেপে ধরে মুহূর্তটার জন্য অপেক্ষা করতে থাকি।

    “আ…আমি…ওকে…আমি ওকে খুন করেছি…”

    ⤶
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleগথ – অৎসুইশি
    Next Article ব্ল্যাক ফেয়ারি টেইল – অৎসুইশি

    Related Articles

    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    ভয় সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    কিশোর অ্যাডভেঞ্চার সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    প্রকাশ্য দিবালোকে – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 18, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    তারপর কী হল – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 17, 2025
    মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    শর্ম্মিষ্ঠা নাটক – মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    November 11, 2025
    সত্যজিৎ রায়

    মানপত্র সত্যজিৎ রায় | Maanpotro Satyajit Ray

    October 12, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }