Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    আলো হাতে সেই মেয়েটি – তপন বন্দ্যোপাধ্যায়

    August 20, 2025

    গোয়েন্দা গার্গী সমগ্র – তপন বন্দ্যোপাধ্যায়

    August 20, 2025

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    জেরুসালেম : ওয়ান সিটি থ্রি ফেইস – ক্যারেন আর্মস্ট্রং

    ক্যারেন আর্মস্ট্রং এক পাতা গল্প727 Mins Read0

    ১. জায়ন

    বর্তমানে জেরুসালেম নগরী হিসেবে পরিচিত এলাকাটির পাহাড় উপত্যকাগুলোতে প্রথম কারা বসতি স্থাপন করেছিল, সে সম্পর্কে আমরা কিছুই জানি না। পুরনো নগরীর বর্তমান প্রাচীরগুলোর দক্ষিণে অবস্থিত ওফেল পাহাড়ের করবগুলোতে পাওয়া মৃৎপাত্রগুলো খ্রিস্টপূর্ব ৩২০০ সালের। এই সময়ে আধুনিক ইসরাইলের কেনানের অন্যান্য অংশে, মেগিডো, জেরিকো, আই, ল্যাচিশ ও বেথ শানে নগর আবির্ভূত হতে শুরু করেছিল। প্রত্নতত্ত্ববিদেরা মন্দির, ঘর-বাড়ি, কারখানা, রাস্তা ও পয়োঃপ্রণালি আবিষ্কার করেছেন। তবে ওই সময়ে জেরুসালেমে নগরজীবন শুরু হয়ে গিয়েছিল, এমন কোনো সুনির্দিষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়নি। বরং পরিহাসের বিষয় হলো যে পরবর্তীকালে কোটি কোটি ইহুদি, খ্রিস্টান ও মুসলিমের কাছে বিশ্বের কেন্দ্র হিসেবে যে স্থানটিকে শ্রদ্ধা জানাচ্ছে, সেটি ছিল প্রাচীন কেনানের পরিচিত অংশের বাইরে। পার্বত্য অঞ্চলে অবস্থিত এ স্থানটিতে বসবাস করা ছিল কঠিন, এটি ছিল দেশের মূলকেন্দ্রের বাইরে। প্রাথমিক ব্রোঞ্জ যুগের বিকাশ প্রধানত উপকূলীয় সমতল এলাকা, উর্বরা জেজরিল উপত্যকা ও নেগেভেই মূলত সীমিত ছিল। এখানেই মিসরীয়রা তাদের বাণিজ্য গুদামগুলো প্রতিষ্ঠা করেছিল। কেনান ছিল সম্ভাবনাময় সমৃদ্ধ দেশ : এর অধিবাসীরা মদ, তেল, মধু, বিটুমিন ও শস্য রফতানি করত। এর কৌশলগত গুরুত্বও ছিল। এশিয়া ও আফ্রিকার সংযোগস্থলে অবস্থিত স্থানটি মিসর, সিরিয়া, ফোনেশিয়া ও মেসোপোটিমিয়ার সভ্যতার মধ্যে সেতুবন্ধ প্রতিষ্ঠা করেছিল। তবে ওফেল পাহাড়ের চারপাশে বসন্তকাল সবসময়ই শিকারী, কৃষক ও সাময়িক বসতি স্থাপনকারীদের প্যালেওলিথিক যুগের চকমকি পাথর, কাচ পাওয়া গেছে – আকৃষ্ট করলেও আমরা যতটুকু জেনেছি, জেরুসালেম এই প্রাথমিক বিকাশকালে কোনো ভূমিকা পালন করেনি।

    প্রাচীন বিশ্বে সভ্যতা সবসময়ই ছিল অনিশ্চিত অর্জন। খ্রিস্টপূর্বে ২৩০০ সালে কেনানে কার্যত আর কোনো নগরীই ছিল না। জলবায়ু পরিবর্তন, বিদেশী আগ্রাসন কিংবা মারাত্মক গৃহযুদ্ধ ইত্যাদি যে কারণেই হোক না কেন, নগরজীবন অদৃশ্য হয়ে যেত। তখন ছিল নিকট প্রাচ্যজুড়ে টালমাটাল ও অস্থিতিশীলতার সময়। মিসরে ওল্ড কিংডম (আনুমানিক ২৬১৩-২১৬০ খ্রিস্টপূর্ব) হিসেবে পরিচিত রাজবংশ ধ্বংস হয়ে যায়। মেসোপটেমিয়ার আক্কাডিয়ান রাজবংশকে উৎখাত করে অ্যামোরাইটসরা, ওয়েস্টার্ন সেমিটিক এই জাতিগোষ্ঠী ব্যাবিলনকে রাজধানী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে। এশিয়া মাইনরজুড়ে শহুরে স্থানগুলো পরিত্যক্ত হয়ে যায়, ফিনিসিয়ান উপকূলের উগারিট ও বাইবলোরাও ধ্বংস হয়ে যায়। আমাদের কাছে এখনো অজ্ঞাত এমন কোনো কারণে সিরিয়া অক্ষত থেকে যায়, মেগিডো ও বেথ শানের মতো নগরীগুলো তাদের দক্ষিণ প্রতিবেশীদের চেয়েও বেশি সময় টিকে থাকতে সক্ষম হয়েছিল। কিন্তু তারপরও লোকজন যাতে অনেক নিরাপদ ও পূর্ণাঙ্গ জীবন চালিয়ে যাওয়ার জন্য এসব অঞ্চল একটি শৃঙ্খলাপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারে, সে প্রয়াস অব্যাহত রাখে। নতুন নতুন নগরী ও নতুন নতুন রাজবংশ আত্মপ্রকাশ করতে থাকে, পুরনো বসতিগুলো পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হতে থাকে। দ্বিতীয় সহস্রাব্দের শুরুতে কেনানের পুরনো নগরীগুলোতে আবারো মানব বসতি দেখা যেতে থাকে।

    এই সময়কালে কেনানের জীবন সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান খুবই সীমিত। দেশটিতে কোনো কেন্দ্রীয় সরকার গড়ে ওঠেনি। প্রতিটি শহর ছিল স্বায়াত্তশাসিত, তাদের প্রত্যেকের নিজস্ব শাসক ছিল, আশপাশের গ্রাম এলাকায় প্রাধান্য বিস্তার করে থাকত। অথচ তখন মেসোপোটেমিয়ায় সভ্যতার সূচনা ঘটেছে। কেনান তখনো প্রবলভাবে পশ্চাদপদ দেশ হিসেবে রয়ে যায়। এখানে বড় ধরনের বাণিজ্য বা শিল্প ছিল না। তাছাড়া অঞ্চলে অঞ্চলে ভৌগোলিক ও আবহাওয়াগত ব্যাপক পার্থক্য থাকায় বিভিন্ন জেলার মধ্যে একে অপরের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আলাদা থাকার প্রবণতা ছিল। পার্বত্য এলাকা, জুদার প্রান্তর বা জর্দান উপত্যকায় অল্প কিছু লোক বাস করত। এখানকার নদীগুলো নৌচালনার উপযোগী ছিল না, চলাচল করা যেত না। যোগাযোগব্যবস্থা ছিল কঠিন। লোকজন দেশের এক স্থান থেকে অন্য স্থানে খুব বেশি দূর যেতে পারত না। মিসর ও দামাস্কাসকে সংযুক্তকারী প্রধান সড়কটি উপকূল বেয়ে গাজা থেকে জাফা পর্যন্ত গিয়েছিল, তারপর মাউন্ট কারমেলের চারপাশের জলাভূমি এড়িয়ে মেগিডো, জেফরিল উপত্যকা ও গ্যালিলি সাগর পর্যন্ত যায়। প্রাকৃতিকভাবে এসব অঞ্চল সবচেয়ে ঘন বসতিপূর্ণ ছিল। এই এলাকাটির প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠে টুয়েলফথ ডাইনেস্টির ফারাওরা। খ্রিস্টপূর্ব বিশ ও ঊনিশ শতকে তারা উত্তর দিকে তাদের প্রভাব বাড়ানোর কাজ শুরু করে। মিসরীয়দের কাছে ‘রেতিনু’ নামে পরিচিত কেনান আসলে মিসরের প্রদেশে পরিণত না হলেও ফারাওরা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে প্রাধান্য বিস্তার করে থাকে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, তৃতীয় সেসোসত্রিস অত্যন্ত শক্তিশালী ও স্বাধীন হওয়া স্থানীয় শাসকদের বশ মানতে উপকূলীয় পথে সৈন্য পাঠাতে দ্বিধা করেননি। মেগিযো, হাজর ও অ্যাক্কোর মতো নগরীগুলোকে নগর-রাষ্ট্র হিসেবে সুরক্ষিত করলেও ফারাওরা এমনকি কেনানের অন্যান্য অংশের প্রতিও তুলনামূলক কম আগ্রহ দেখায়। ঊনিশ শতকের শেষ দিকে বসতি স্থাপনকারীরাও পার্বত্য দেশটিতে অনুপ্রবেশ করে সেখানে নগরী বানাতে থাকে। শেচেম হয়ে পড়ে এসব সুরক্ষিত পার্বত্য শহরগুলোর মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী। কোনো কোনো এলাকায় শহর ৩৭ একর জায়গাজুড়ে বিদ্যমান ছিল, পল্লীর বিশাল এলাকাও ছিল তার নিয়ন্ত্রণে। দক্ষিণের পাহাড়ি এলাকাগুলোতে হেবরন ও জেরুসালেমের মতো নগরী গড়ে ওঠে।

    প্রাচীন জেরুসালেম

    বলা যায়, এই পর্যায়েই ইতিহাসে প্রবেশ করে জেরুসালেম। ১৯৬১ সালে ব্রিটিশ প্রত্নতত্ত্ববিদ ক্যাথলিন কেনিয়ন প্রায় সাড়ে ছয় ফুট চওড়া একটি প্রাচীর আবিষ্কার করেন। এটি ওফেল পাহাড়ের ঢাল বেয়ে এগিয়ে গিয়েছিল। প্রাচীরটিতে গিহন স্প্রিঙের কাছে একটি বড় দরজা ছিল। তিনি সিদ্ধান্তে আসেন যে এ নগর প্রাচীরটি পাহাড়টির দক্ষিণ প্রান্ত পর্যন্ত চলে গিয়ে পশ্চিম ঢালু পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল, উত্তরে পরবর্তীকালের একটি নগর প্রাচীরের নিচে হারিয়ে যায়। প্রাচীর আর পাথুরে খাড়াইয়ের মধ্যবর্তী স্থানে মৃৎপাত্রও আবিষ্কার করেছেন কেনিয়ন। পাত্রটি খ্রিস্টপূর্ব ১৮০০ সালের। নগরীটি উত্তর দিকে প্রায় অরক্ষিতই ছিল, পরে সেখানে জায়ন দুর্গ নির্মাণ করা হয়। খ্রিস্টপূর্ব অষ্টাদশ শতকে সেখানে কোনো দুর্গ থাকার প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে। ওফেলের পূর্ব ঢালুতে বেশ নিচু করে তৈরী প্রাচীরগুলোর মধ্যে সম্ভবত গিহন স্প্রিং’ পর্যন্ত একটি ভূগর্ভস্থ সুড়ঙ্গও ছিল। ব্রিটিশ প্রকৌশলী চার্লস ওয়ারেন ১৮৬৭ সালে সুড়ঙ্গটি আবিষ্কার করেন। নগরীর অভ্যন্তরীণ পাহাড় থেকে শুরু হয়ে এটি তির্যকভাবে নেমে গিয়ে তারপর উলম্বভাবে পানিতে মিশেছে। এই পানি সম্ভবত গিহন থেকে অপর একটি অনুভূমিক সুড়ঙ্গের মাধ্যমে আসত। অবরোধের সময় সম্ভবত জগ ও কলস খাদে ডুবিয়ে রাখতে হতো। একই ধরনের সরঞ্জাম পাওয়া গেছে মেগিডো, গেজার ও গিবেয়নে। কেনিয়ন বিশ্বাস করতেন, ব্রোঞ্জ যুগে খাদটি ব্যবহৃত হতো। কিন্তু তার তত্ত্বটি বিতর্কিত : অনেকে সন্দেহ করেন, এই পর্যায়ে এ ধরনের ব্যবস্থা নির্মাণের প্রযুক্তিগত দক্ষতা অধিবাসীদের ছিল না। তবে সাম্প্রতিক ভূতত্ত্বগত আবিষ্কার ইঙ্গিত দিচ্ছে, ‘ওয়ারেন্স শাফট’ নামে পরিচিত খাদটির পুরোটা মানবনির্মিত নয়। এটি চুনাপাথরের সন্ধিক্ষণে একটি প্রাকৃতিক গর্ত। প্রাচীন জেরুসালেমবাসী সম্ভবত এটিকে সংস্কার করে বড় করেছিল।

    সম্ভবত গিহনের কাছাকাছি থাকার কারণেই ওফেলের প্রতি আকৃষ্ট হতো বসতি স্থাপনকারীরা। স্থানটির কৌশলগত সুবিধাও ছিল। পার্বত্যভূমির ঢালুতে ছিল এর অবতরণস্থল। এর ফলে এখান দিয়ে জুদা মরুভূমিতে যাওয়া যেত। তবে বিপুল জনসংখ্যাকে সঙ্কুলান করার মতো ব্যবস্থা ছিল না ওফেলের। নগরীটির আয়তন ছিল মাত্র ৯ একরের কিছু বেশি। তবে তিন খাড়া উপত্যকা বসতি স্থাপনকারীদের বিপুল সুরক্ষা দিত : পূর্ব দিকে কিদরন উপত্যকা, দক্ষিণে হিন্নম (বা গেহেন্না ) উপত্যকা, পশ্চিমে সেন্ট্রাল উপত্যকা। এটি এখন পলি জমে ভরাট হয়ে গেছে। ইহুদি ইতিহাসবিদ ফ্লাভিয়াস যোসেফাস একে টাইরোপোয়ন উপত্যকা হিসেবে অভিহিত করেছেন। এমনকি তখনো শহরটি কেনানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নগরীগুলোর মধ্যেও অন্তর্ভুক্ত ছিল না। তবে এর অস্তিত্ব সম্ভবত মিসরীয়দের জানা ছিল। ১৯২৫ সালে লুক্সরে সিরামিক সামগ্রী পাওয়া গেছে। এগুলো জোড়া লাগিয়ে ৮০টি থালা ও পাত্র পর্যন্ত তৈরি করা সম্ভব ছিল। এতে প্রাচীন মিসরীয় পুরোহিতদের বক্তব্য খোদাই করা ছিল। পাঠ উদ্ধারের পর লিখিত লিপিতে দেশ, নগরী ও শাসকদের নাম উদ্ধার করা হয়। এগুলো মিসরের শত্রুদের সাথে সম্পর্কিত বলে মনে হয়েছে। পাত্রগুলো সম্ভবত বৈরী সামন্তদের পতনের জন্য কোনো মন্ত্রযপ অনুষ্ঠানে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। পাত্রগুলোতে ফারাও তৃতীয় সেসোসট্রিস (১৮৭৮-১৮৪২ খ্রিস্টপূর্ব) আমলের তারিখ দেওয়া ছিল। এগুলোতে ১৯টি কেনানি নগরীর নাম রয়েছে। এগুলোর একটি হলো ‘রুশালিমাম’। কোনো ঐতিহাসিক নথিতে এই প্রথম নগরীটির নাম দেখা গেল। পাঠে দুই রাজপুরুষের নামও পাওয়া যায় : তারা হলেন ইয়রম ও শাশান। এসব তথাকথিত ‘এক্সেক্রেশন টেক্সটের’ আরেকটিতে সম্ভবত এক শ’ বছর পর খোদাই করা হয়েছিল। এখানে আবারো ‘রুশাললিমামকে’ অভিশাপ দেওয়া হয়েছে। তবে এ সময় নগরীতে সম্ভবত একজন শাসকই ছিলেন। এই অপ্রতুল বিচ্ছিন্ন প্রমাণ থেকে অনেক বিশেষজ্ঞ অভিমত প্রকাশ করেছেন যে অষ্টাদশ শতকে কেনানের বাকি অংশের মতো জেরুসালেমও অনেক গোত্রপতির শাসিত গোত্রীয় সমাজ থেকে একজন একক রাজার শাসিত নগর বসতিতে বিবর্তিত হয়েছে।

    এখানে আমাদের উচিত হবে একটু বিরতি নিয়ে নগরীর নামটি বিবেচনা করা। মনে হচ্ছে অস্তায়মান সূর্য কিংবা সন্ধ্যা তারার নামের সাথে সম্পৃক্ত সিরিয়ার ঈশ্বর সালেম থেকে তা এসেছে। কেনানে মিসর রাজনৈতিকভাবে আধিপত্য বিস্তার করলেও সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় বিষয়াদিতে সিনিয়ার প্রভাব ছিল। হাজর, মেগিডো ও শেচেমে এই আমলের আবিষ্কৃত মন্দিরগুলো সিরিয়ান মডেলেই তৈরি হয়েছে বলে স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে। রাজার প্রাসাদের মূল পরিকল্পনা অনুযায়ীই এসব মন্দির নির্মিত হয়েছে। এর মাধ্যমে এ ধারণাও দেওয়া হয় যে ঈশ্বরদের কাছ থেকেই আসে সব নিয়ম-কানুন। সাধারণ লোকজনের জন্য কাল্ট হল বা হেখালে প্রবেশ করা নিষিদ্ধ ছিল, ঠিক যেভাবে রাজার উপস্থিতিতে প্রবেশাধিকার নিষিদ্ধ ছিল। হলরুমের কুলুঙ্গিতে রাখা রাজার প্রতিকৃতি তারা আঙিনা থেকে হেখালের খোলা দরজা দিয়ে একনজর দেখতে পেত। জেরুসালেমে ব্রোঞ্জ যুগের কোনো মন্দির এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি, তবে নগরীর নামে বোঝা যাচ্ছে, অধিবাসীরা সিরিয়ান ধর্মের কাছে উন্মুক্ত ছিল। ‘এক্সারক্রেশন টেক্সটে জেরুসালেমের রাজপুরুষদের নাম পাওয়া যাওয়ায় ইঙ্গিত দিচ্ছে সিরিয়ার জনসাধারণের মতো জেরুসালেমবাসীও ছিল ওয়েস্টার্ন সেমিটিক বংশোদ্ভূত, তারা একই ধরনের বিশ্ববীক্ষা পোষণ করত।

    ‘রুশালিমাম’ নামটির অনুবাদ করলে এর অর্থ দাঁড়াতে পারে ‘সালেম (শান্তি) পাওয়া গেছে।’ নিকট প্রাচ্য ও ভূমধ্য সাগরীয় এলাকার প্রাচীন দুনিয়ার বসতি স্থাপন ও নগর-পরিকল্পনা করাকে বিবেচনা করা হতো ঐশী উদ্যোগ। ওফেল পাহাড়ের প্রতি উপনিবেশকারীদের প্রথম আকৃষ্ট হওয়ার কারণ ছিল এর পানি সরবরাহ এবং এর কৌশলগত উপযোগিতা। তবে নগরীর নামে বোঝা যায়, উদ্যোগ এসেছিল ঈশ্বরের কাছ থেকে। এই সময়ে সব নগরীই বিবেচিত হতো পবিত্র স্থান হিসেবে। এ ধারণাটি আধুনিক পাশ্চাত্যে আমাদের কাছে অচেনা। বর্তমানে নগরী প্রায়ই ধর্মের বাইরের কাজ বিবেচিত হয়, ধর্ম এখানে ক্রমবর্ধমান হারে প্রান্তিক ভূমিকায় চলে গেছে। কিন্তু লোকজন তাদের দুনিয়াকে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করার অনেক অনেক আগে আবেগগত ও আধ্যাত্মিকভাবে বিশ্বে নিজেদের স্থান নির্ধারণ করার জন্য ঐশী ভূগোলের বিবর্তন ঘটিয়েছিল। পবিত্র স্থানগুলোর সংজ্ঞা ও ভূগোল গবেষণায় অগ্রণী ভূমিকা পালনকারী মিরসিয়া ইলিয়াড উল্লেখ করেছেন, কোনো একটি ঐশী স্থানের প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের আগে বিশ্বের প্রকৃতি নিয়ে অন্য সব ধরনের জল্পনা কল্পনা চলে। সব সংস্কৃতিতে তা পাওয়া যায়, এটি আদিম ধর্মীয় বিশ্বাস। কোনো কোনো স্থান ঐশী এবং এ কারণেই স্থানটি মানব বসতির উপযোগী – এমন বিশ্বাস বুদ্ধিবৃত্তিক অনুসন্ধান বা মহাবিশ্বের প্রকৃতিবিষয়ক অধিবিদ্যাগত জল্পনার ভিত্তিতে হয়নি। বরং নারী, পুরুষেরা তাদের সাথে সম্পর্কিত বিশ্ব নিয়ে চিন্তাভাবনা করার সময় অন্যান্য স্থান থেকে পুরোপুরি আলাদা বিবেচিত কিছু এলাকার প্রতি অপ্রতিরোধ্যভাবে আকৃষ্ট হতো। এটি ছিল এমন অভিজ্ঞতা যা ছিল বিশ্ব সম্পর্কে তাদের দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তি এবং ভা মনের যৌক্তিক পর্যায়ের অনেক গভীর ধারণায় চলে যেত। এমনকি আজও আমাদের বৈজ্ঞানিক যুক্তিবাদ পুরোপুরি পুরনো ঐশী ভূগোলের স্থলাভিষিক্ত হতে পারেনি। আমরা দেখতে পাবো যে ঐশী স্থান-সম্পর্কিত প্রাচীন ধারণাগুলো এখনো জেরুসালেমের ইতিহাসকে প্রভাবিত করছে, এমনকি যেসব লোক নিজেদের সাধারণভাবে ধার্মিক মনে করে না, তারাও তাতে প্রভাবিত হচ্ছে। নারী ও পুরুষেরা শত শত বছর ধরে নানাভাবে ঐশী স্থান সম্পর্কে তাদের ধারণা বিনির্মাণ করেছে। তবে জেরুসালেমের মতো নগরী বিশেষ মর্যাদা নিয়ে তাদের আলোচনায় নির্দিষ্ট কিছু থিম বারবার ঘটতে থাকায় ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে তারা মানুষের মৌলিক কিছু প্রয়োজনের কথা বলে। এমনকি যারা ঐতিহ্যগতভাবে পবিত্র নগরীগুলো নিয়ে কোনোভাবেই আগ্রহী নয়, অতিপ্রাকৃতিক বিষয়ের প্রতি কোনো বিশ্বাস নেই, তাদেরও অনেক সময় বিশেষ কিছু স্থান থাকে, যেখানে তারা যেতে চায়। এ ধরনের স্থানগুলো আমাদের কাছে ‘ঐশী’ হওয়ার কারণ তারা আমদের নিজেদের সম্পর্কিত ধারণার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত; আমাদের শৈশব বা আমাদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ কোনো ব্যক্তির সাথে জড়িত বলে তারা হয়তো আমাদের জীবনকে প্রবলভাবে বদলে দেওয়া অভিজ্ঞতার সাথে সম্পৃক্ত। এ ধরনের স্থান যখন আমরা সফর করি, তখন আমরা সেখানে কোনো একসময়ের প্রবলতর জীবনের অভিজ্ঞতার কথা স্মরণ করি। ওই অভিজ্ঞতা মুহূর্তের মধ্যে আমাদের ভেতরে এই বিশ্বাস সৃষ্টি করে যে আমাদের নশ্বর অস্তিত্ব যন্ত্রণা ও অযৌক্তিক প্রকৃতির হওয়া সত্ত্বেও এর কিছু চূড়ান্ত অর্থ ও মূল্য রয়েছে, এমনকি যদিও যৌক্তিক পরিভাষায় এই উপলব্ধিকে ব্যাখ্যা করা আমাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়ে।

    আমাদের নিজস্ব আমলের ঐতিহ্যবাহী সমাজগুলোর মতোই প্রাচীন দুনিয়ায় লোকজন তাদের ঐশী ভূগোল এই বলে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করত যে দুনিয়াটা সৃষ্টি করেছেন ঈশ্বরেরা। ফলে এটি নিরুৎসুক ভূখণ্ড নয় : এই ভূ-প্রকৃতির মানুষকে বলার কিছু আছে। তারা মহাবিশ্বের দিকে তাকিয়ে অস্তিত্বের এমন একটি মাত্রা উপলব্ধি করে যা তাদের জীবনে প্রতিবন্ধক হয়ে থাকা ক্ষণস্থায়িত্ব ও সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে যায়। এটি আরো পূর্ণাঙ্গ ও আরো শক্তিশালী মাত্রার প্রতিনিধিত্ব করে। এটি এমন বাস্তবতা যা এক হলেও আলাদা এবং তারপরও গভীরভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ। পবিত্র রাজ্যের সাথে ঘনিষ্ঠতার অনুভূতি প্রকাশ করার সময় তারা প্রায়ই একে মানবীয় আকারে প্রকাশ করত, তাদের নিজেদের পরিচিত ব্যক্তিত্বের সাথে দেব-দেবীর সাথে কল্পনা করত। তারা এই ঐশী উপস্থিতিকে প্ৰাকৃতিক বিশ্বে অনুভব করার কারণে এসব দেবতা সূর্যের সাথে, বাতাসের সাথে কিংবা জীবন প্রদানকারী বৃষ্টির সাথেও সম্পৃক্ত ছিল। লোকজন এসব দেব-দেবী সম্পর্কে গল্প বলত সত্যি সত্যি যেসব ঘটনা ঘটেছে সেগুলো বর্ণনা করার জন্য নয়, বরং তা ছিল বিশ্ব সম্পর্কে যে অভিজ্ঞতা তারা লাভ করেছিল, তা ছিল ওই রহস্য প্রকাশ করার দ্বিধান্বিত প্রয়াস। সর্বোপরি মানুষ চায় যতটা সম্ভব অতিলৌকিক বাস্তবতার সাথে ঘনিষ্ঠ হয়ে থাকতে। যদি বলা হয় যে তারা জীবনের অর্থ কামনা করত, তবে তা বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে পারে। কারণ পরিভাষাটি এমন একটি পরিষ্কার সমাধান-সূত্র দেয় যা মানুষের অবস্থা সম্পর্কে সামগ্রিক ধারণা দিতে পারে। বাস্তবতা হলো, ধর্মীয় অনুসন্ধানের লক্ষ্য সবসময়ই অভিজ্ঞতা অর্জন, কোনো বার্তা প্রদান নয়। আমরা চাই সত্যিকারভাবে জীবন্ত থাকতে, আমাদের মানবীয় সম্ভাবনা পূর্ণ করতে, এমনভাবে বাঁচতে চাই যাতে আমরা অস্তিত্বের গভীরতর স্রোতের সাথে মিশে থাকতে পারি। অতিপ্রাচুর্যের জীবনের (সম্ভাবনা ও অবিনশ্বর ঈশ্বরে প্রতীকিভাবে ফুটে ওঠা) জন্য এই অনুসন্ধানের ব্যবস্থা করে সব ধর্ম। মানুষ চায় নশ্বরতা ও নশ্বর দুনিয়ার তুচ্ছতার ঊর্ধ্বে ওঠে- এমন একটি বাস্তবতা খুঁজে পেতে, যেখানে তারা তাদের জীবনের প্রকৃতির পরিপূরকতা পাবে। প্রাচীন বিশ্বে মানুষেরা অনুভব করত, এই ঐশী উপাদানের সাথে সংযুক্ত হয়ে বাঁচার সম্ভাবনা ছাড়া জীবনের টিকে থাকা অসম্ভব।

    এ কারণেই ইলিয়াড দেখিয়েছেন, মানুষ ও ঈশ্বরদের মধ্যে বিভক্তকারী প্রতিবন্ধকতা গুঁড়িয়ে দিয়ে যেসব স্থানে একবার পবিত্র সত্তা নিজেকে প্রকাশ করেছিল, ওইসব স্থানেই লোকজন বাস করতে চাইত। সম্ভবত ঈশ্বর সালেম নিজকে ওফেল পাহাড়ে প্রকাশ করেছিলেন এবং এর মাধ্যমে স্থানটিকে বিশেষভাবে নিজের করে নিয়েছিলেন। লোকজন একথা জেনে সেখানে যেত যে ঈশ্বর যে নগরীতে নিজেকে প্রকাশ করেছিলেন, সেখানে গিয়ে ঈশ্বরের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করা সম্ভব। কিন্তু ঈশ্বর কেবল অশরীরী ও অতিপ্রাকৃত অবয়বে এই নশ্বর দুনিয়ায় হঠাৎ করেই আত্মপ্রকাশ করেন- বিষয়টি এমন নয়। যেকোনো কিছুই যখন এর আশপাশ থেকে স্বাতন্ত্র্যসূচিত হয়ে এসে প্রাকৃতিক নিয়মের বিপরীতে চলে সেটি পবিত্রতা, ঐশী সত্তার প্রকাশ হতে পারে। কোনো পাথরখণ্ড বা পাহাড় বা উপত্যকা বিশেষভাবে সুন্দর বা রাজসিক গাম্ভীর্যের অধিকারী হলে সেটি ঐশী উপস্থিতির ইঙ্গিত দিতে পারে। কারণ এটি সাবলীলভাবে তার পারিপার্শ্বিকতার সাথে খাপ খাওয়াতে পারেনি। এর উপস্থিতিই অন্য কিছু আছে বলে প্রকাশ করে। অচেনা, অজানা কিংবা এমনকি নিখুঁত কিছুও প্রাচীন কালের সমাজের নর-নারীদের কাছে তাদের থেকে ভিন্ন কিছু মনে হতে পারে। মাটি থেকে উঁচুতে উঠা পর্বতগুলো ঐশী সত্তা উপলব্ধি করার বিশেষ সম্ভাবনাপূর্ণ প্রতীক হতে পারে। এর চূড়ায় উঠে উপাসনাকারীরা আকাশ ও পৃথিবীর মাঝখানে থাকা ভিন্ন মাত্রায় উঠার অনুভূতি পেতে পারে। মেসোপোটমিয়ায় জিগারাত নামে পরিচিত টেম্পল-টাওয়ারগুলো পাহাড়ের মতো করে তৈরি করা হয়েছিল। এর পাথুরের বিশাল সিঁড়িগুলোর সাতটি মাত্রা সাত আসমানের প্রতিনিধিত্ব করত। ফলে তীর্থযাত্রীরা কল্পনা করতে পারত, তারা মহাবিশ্ব বেয়ে উঠছে, শীর্ষে গিয়ে তারা ঈশ্বরের সাক্ষাত করতে পারে বলে ভাবত। সিরিয়া অনেক বেশি পার্বত্যপূর্ণ হওয়ায় সেখানে কৃত্রিম পাহাড় বানানোর প্রয়োজন হয়নি, এর সত্যিকারের পর্বতগুলোই পবিত্র স্থান হিসেবে শ্রদ্ধা পেত। জেরুসালেমের ইতিহাসে একটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ স্থান হতে পারত মাউন্ট জাফন বা বর্তমানের জেবেল আল-আকরা। এটি ওরোনটেসের মুখে উগারিতের ২০ মাইল উত্তরে অবস্থিত।’ কেনানের মাউন্ট হারমন, কারমেল ও তাবরও পবিত্র স্থান হতে পারত। হিব্রু সালেম থেকে আমরা জানি, জেরুসালেমের ওফেল পাহাড়ের উত্তরে অবস্থিত মাউন্ট জায়নও পবিত্র ছিল। পর্বতটির প্রাকৃতিক সীমা দেখা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। কারণ ইহুদিদের টেম্পল নির্মাণের জন্য খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতকে রাজা হেরড সেখানে একটি বিশাল প্লাটফর্ম নির্মাণ করেছিলেন। তবে প্রাকৃতিক অবস্থায় মাউন্ট জায়ন নাটকীয়ভাবে আশপাশের পাহাড়গুলো থেকে এতই ভিন্নভাবে দাঁড়িয়ে ছিল যে তাকে দেখেই মনে হয়েছিল এটি ঐশী ‘অন্য’। ফলে একে ‘ঐশী’ হিসেবে অভিহিত করা হয়।

    একবার কোনো স্থান ঐশী সত্তার সংস্পর্শে এলে সেটি অপবিত্র পরিবেশ থেকে পুরোপুরি আলাদা হয়ে পড়ে। ঐশী সত্তা সেখানে প্রকাশিত হওয়ায় স্থানটি পৃথিবীর কেন্দ্রে পরিণত হয়ে যায়। এটি কোনো আক্ষরিক, জ্যামিতিক পদ্ধতিতে বোধগম্য নয়। জেরুসালেমের অধিবাসীদের কাছে কাছাকাছি থাকা কাছের হেবরনও ঐশী ‘কেন্দ্র’ হিসেবে বিবেচিত হওয়াটা কোনো গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। এমনকি সামবাদী বা রাব্বিরা যখন বলতেন, মাউন্ট জিয়ন হলো পৃথিবীর সবচেয়ে উচ্চ স্থান, অথচ বাস্তবে টাইরোপিয়ন উপত্যকার অপর দিকে অবস্থিত ওয়েস্টার্ন হিলটি ছিল জায়নের চেয়ে উঁচু, কিন্তু তাতেও জেরুসালেমবাসীর বিশ্বাসে কোনো পরিবর্তন হতো না। সামবাদী বা রাব্বিরা নগরীর ভৌত ভূগোল বর্ণনা করতেন না, বরং তাদের আধ্যাত্মিক মানচিত্রে এর অবস্থান প্রকাশ করতেন। ঐশী সত্তা নিজেকে প্রকাশ করেছেন এমন যেকোনো ঐশী পাহাড়ের মতোই জায়ন তাদের কাছে মহিমান্বিত হওয়ার কারণ ছিল এই যে লোকজন এখানে স্বর্গের অনেক কাছাকাছি যেতে পারত বলে মনে করত। একই কারণে এটি তাদের বিশ্বের ‘কেন্দ্র’ : তাদের মতে, যেসব স্থানে স্বর্গীয় সত্তার সাথে সংযোগ স্থাপন করা সম্ভব, এটি ছিল তারই একটি। আর কেবল এই সত্তাই তাদের জীবনকে প্রকৃত রূপ দিত, স্পষ্টভাবে প্রকাশ করত।

    প্রাচীন সমাজে লোকজন এমনসব স্থানে বসতি স্থাপন করত, যেখানে ঐশী সভার সাথে সংযোগ স্থাপন সম্ভব হয়। ইলিয়াড উল্লেখ করেছেন, অস্ট্রেলিয়ার আচিলপা গোত্রটি পুরোপুরি দিগ্‌ভ্রান্ত হয়ে পড়ে, যখন সফরের সময় তাদের বয়ে বেড়ানো ঐশী দণ্ডটি ভেঙ্গে গিয়েছিল। দণ্ডটি ঐশী সত্তার সাথে তাদের সংযোগের প্রতিনিধিত্ব করত। ফলে সেটি ভেঙ্গে যাওয়ার পর আচিলপারা স্রেফ মৃত্যুর কাছে আত্মসমর্পণ করে। আমরা অর্থ-অনুসন্ধানী প্রাণী, একবার আমরা আমাদের পরিচিত পরিবেশ হারিয়ে ফেললে কিভাবে বাঁচতে হবে কিংবা এই দুনিয়ায় আমাদের স্থান কোথায় হবে তা আমাদের জানা নেই। এ কারণেই ঐশী উপস্থিতির আবাস হিসেবে তৈরী উপাসনা স্থান ও মন্দিরকে ঘিরেই প্রাচীন দুনিয়ায় নগরগুলো নির্মিত হয়েছিল। ঐশী সত্তা ছিল সবচেয়ে নিরেট বাস্তবতা, এটি আমাদেরকে অনেক বেশি অসম্পূর্ণতাকে অস্তিত্বের নির্যাস দিতো। ঐশী সত্তাকে ভীতিকর ও ‘অন্য’ হিসেবে অনুভব করা হতো। জার্মান ইতিহাসবিদ রুডলফ ওট্টো তার ক্লাসিক গ্রন্থ দি আইডিয়া অব হলি-এ ব্যাখ্যা করে বলেছেন, এটি অনেক সময় ভয়াবহ ভীতি ও আতঙ্ক উস্কে দিতে পারে। এটি ভালোবাসার জিনিস হলেও এটি অপ্রতিরোধ্য আকর্ষণও প্রকাশ করতে পারে। কারণ এটি প্রবলভাবে একই ধরনের এবং অনেক সময় মানুষের জন্য অপরিহার্য হিসেবে বিবেচিত হতো। আরো সম্ভাবনাময় এই বাস্তবতার সাথে নিজেদের সম্পৃক্ত করার মাধ্যমে মানব সত্তা নিশ্চিত করতে পারত যে তাদের সমাজ টিকে থাকবে। সভ্যতা ছিল ঠুনকো : প্রায় রাতারাতি নগরীগুলো অদৃশ্য হয়ে যেতে পারত। প্রাথমিক ব্রোঞ্জ যুগে ফিলিস্তিনে এমন ঘটনা ঘটেছিল। ঈশ্বরদের আরো শক্তিধর ও কার্যকর জীবনের সাথে কোনো না কোনোভাবে সম্পৃক্ত না হতে পারলে তারা টিকে থাকতে পারবে না বলে মনে করত।

    অনেক সময় এটি ঐশী সত্তার ও পবিত্র স্থানের মতাদর্শের এই অনুসন্ধান স্বর্গের জন্য নস্টালজিয়ার সাথে সম্পৃক্ত থাকত। প্রায় প্রতিটি সংস্কৃতির সূচনা-কালের স্বর্ণযুগ নিয়ে যে মিথ রয়েছে, যেখানে বলা হয়ে থাকে, ওই সময় ঈশ্বরদের সাথে যোগাযোগ ছিল সহজ ও অন্তরঙ্গ। ঐশী সত্তাকে দূরের, বিস্ফোরণশীল শক্তি হিসেবে বোঝানো হতো না, বরং দৈনন্দিন জীবনের বাস্তবতা হিসেবে উপলব্ধি করা হতো। মানুষ বর্ধিত শক্তি উপভোগ করত : তখন মৃত্যু ছিল না, অসুস্থতা ছিল না, কোনো বিভেদ ছিল না। লোকজন আদিম সুখ ও সম্প্রীতির এই অবস্থায় ফিরে যাওয়ার আকঙ্ক্ষা পোষণ করত, মনে করত যে ত্রুটি না থাকলে জীবন এমনই হতে পারত। বর্তমানে আমরা হয়তো আর দুনিয়াবি স্বর্গ বা ইডেন উদ্যানে বিশ্বাস করি না, কিন্তু ত্রুটিযুক্ত বর্তমান থেকে ভিন্ন কিছুর আকাঙ্ক্ষা এখনো বিরাজ করছে। সহজাত বিশ্বাস রয়েছে যে জীবনের মানে এমন হওয়া উচিত নয় : যা হতে পারত, তার জন্য লালায়িত আমরা, নশ্বর অস্তিত্বের ক্ষয়িষ্ণু প্রকৃতির জন্য শোক করি, মৃত্যুতে ক্রুদ্ধ হই। আরো নিখুঁত সম্পর্কের অনুভূতি আমাদেরকে তাড়িত করে, সম্প্রীতিপূর্ণ ও সামগ্রিক এমন এক দুনিয়ার কথা কল্পনা করি, যেখানে আমাদের চারপাশের সাথে লড়াই করার বদলে মিলেমিশে থাকতে পারব। অপ্রবেশযোগ্য স্বর্গের জন্য এই আকঙ্ক্ষা জনপ্রিয় সঙ্গীত, ফিকশন, দার্শনিক, রাজনীতিবিদ, প্রচারকদের কল্পরাজ্যের কল্পনায় অপ্রতিরোধ্যভাবে বিরাজ করছে। মনঃসমীক্ষকেরা এই নস্টালজিয়াকে জন্মের সময় (যে সময়টাতে আমরা সহিংসভাবে আমাদের মায়ের দেহ থেকে চিরদিনের জন্য নিক্ষিপ্ত হয়েছিলাম) আমাদের বিচ্ছিন্ন হওয়ার বেদনার সাথে সম্পৃক্ত করেন। বর্তমানে অনেক লোক শিল্পকলা, ড্রাগ বা সেক্সে এই স্বর্গীয় সম্প্রীতি কামনা করে। আর প্রাচীন দুনিয়ায় নারী-পুরুষেরা তা কামনা করত এমন এক স্থানে বসবাস করে যেখানে হারানো সামগ্রিকতা পুনরুদ্ধার করা সম্ভব।

    খ্রিস্টপূর্ব অষ্টাদশ শতকে জেরুসালেমের ধর্মীয় জীবন সম্পর্কে আমাদের কাছে প্রত্যক্ষ কোনো তথ্য নেই। বাস্তবে ‘এক্সাক্রেশন টেক্সটের’ পর বেশ কিছু সময়ের জন্য জেরুসালেমের কোনো উল্লেখ দেখা যায় না। তখন ছিল কেনানের সমৃদ্ধির সময়। সপ্তদশ শতকে ফারাওরা ঘরোয়া বিষয়াদি নিয়ে এতই ব্যস্ত ছিল যে ‘রেতিনু’ নিয়ে ভাবার ফুসরতই পায়নি। ফলে দেশটি সমৃদ্ধ হয়েছিল। মিসরীয়দের আগ্রাসী কোনো অভিযান না থাকায় স্থানীয় সংস্কৃতি এর ফলে বিকশিত হতে পেরেছিল। কেনানের কোনো কোনো শহর পুরোপুরি নগর-রাষ্ট্রে পরিণত হয়। এগুলোর স্থাপত্য, আসবাবপত্র, গৃহস্থালি সামগ্রী, অলঙ্কার ইত্যাদি মেগেডো, হাজর ও শেচেমে আবিষ্কৃত হয়েছে। কিন্তু জেরুসালেমে সপ্তদশ থেকে পঞ্চদশ শতক পর্যন্ত কোনা মৃৎপাত্র পাওয়া যায়নি। আমরা যতটুকু জানি তা এই যে এ সময়কালে নগরীটি সম্ভবত তার অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলেছিল।

    খ্রিস্টপূর্ব চতুর্দশ শতকের পরেই আমরা নিশ্চিতভাবে জানতে পারি, নগরীটি আবার জন বসতিপূর্ণ হয়ে ওঠেছে। ওই সময় নাগাদ মিসর আবার কেনানে তাদের উপস্থিতি আবারো জোরালোভাবে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। ফারাওরা এখন আনাতোলিয়ায় নতুন হিতিতি সাম্রাজ্য ও উত্তর মেসোপোটেমিয়ার তিত্তানির হুরিয়ান রাজ্যের সাথে সঙ্ঘাতে জড়িত। তাদের এখন নিশ্চিত করা প্রয়োজন যে গুরুত্বপূর্ণ ট্রানজিট দেশ কেনান প্রবলভাবে তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকবে। ১৪৪৬ সালে ফারাও তৃতীয় থুতমোস মেগিডোতে কেনানি ও সিরীয়দের একটি বিদ্রোহ দমন করেন। তিনি ‘রেটিনোর’ মর্যাদা হ্রাস করে মিসরের স্রেফ একটি এলাকায় পরিণত করেন। দেশটিকে চারটি প্রশাসনিক জেলায় ভাগ করা হয়, কেনানের নগর-রাষ্ট্রগুলোর শাসকেরা ফারাওদের সামন্তে পরিণত হয়। তারা তার কাছে ব্যক্তিগতভাবে শপথ গ্রহণ করতেন, তাদের ওপর বিপুল কর চাপানো হলো। বিনিময়ে তারা আরো বেশি সহায়তা ও সমর্থন পাবেন বলে আশা করেছিল। তবে ততটা দিতে আসলে ফারাও প্রস্তুত ছিলেন না। কিন্তু তারপরও রাজপুরুষেরা বেশ ভালো রকমের স্বাধীনতাই ভোগ করতেন। দেশটি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করার মতো উপায় মিসরের ছিল না। রাজপুরুষেরা সেনাবাহিনী গড়ে তুলতে একে অপরের বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারতেন, নিজেদের ভূখণ্ড সম্প্রসারণ করতে পারতেন। অবশ্য তত দিনে অন্য বড় শক্তিগুলোও কেনানের প্রতি আগ্রহ প্রকাশ করতে শুরু করে দিয়েছে। মিতানি রাজ্যের হুরিয়ানরা পঞ্চদশ শতকের প্রথম দিক থেকেই দেশটিতে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করা শুরু করে দেয়। বাইবেল অনুযায়ী, এসব লোক নিজেদের বলড হিভিতি’ বা ‘হোরিত’। স্থানীয় লোকজনের বিপরীতে তারা ছিল আর্য বংশোদ্ভূত। তবে তারা বিজয়ী হিসেবে না এলেও এত প্রবল প্রভাব বিস্তার করেছিল যে মিসরীয়রা কেনানকে হুরু’ বা ‘হুরিয়ান ভূমি’ বলতে শুরু করেছিল। হুরিয়ানরা প্রায়ই নগর-রাষ্ট্রগুলোতে ক্ষমতার অবস্থান লাভ করত। তারা স্থানীয় লোকজনের সাথে মিলেমিশে বসবাস করে তাদেরকে আক্কাইডিয়ান ভাষা শেখাতে থাকে। এটিই কূটনৈতিক ভাষা ও কোনিফর্ম লিপিতে পরিণত হয়।

    জেরুসালেমে হুরিয়ান প্রভাব ছিল প্রবল। চতুর্দশ শতকে কেনানের অন্যতম নগর-রাষ্ট্র হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল জেরুসালেম। অবশ্য তার মর্যাদা হ্যাগর বা মেগিডোর চেয়ে কম ছিল। এর আয়তন তখন শেচেম ও গেজার পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছিল। এর শাসক আবদি-হেপার নামটি হুরিয়ান। এই পর্যায়ে জেরুসালেম সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান ১৮৮৭ সালে মিসরের তেল আল আমারনায় প্রাপ্ত কোনিফৰ্ম ট্যাবলেট থেকে পাওয়া। এগুলো সম্ভবত ফারাও তৃতীয় আমেনহোটেপ (খ্রিস্টপূর্ব ১৩৮৬-৪৯) ও তার ছেলে আখেনাতেনের (খ্রিস্টপূর্ব ১৩৫০-৩৪) রাজকীয় আর্কাইভের অংশ ছিল। এগুলোর মধ্যে ছিল ফারাও প্রভুর কাছে লেখা কেনানের রাজপুরুষদের প্রায় ৩৫০টি চিঠি। এগুলোতে দেখা যায়, দেশটি তখন গোলযোগের মধ্যে ছিল। নগর-রাষ্ট্রগুলো একে অপরের সাথে যুদ্ধে মত্ত ছিল। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, শেচেমের প্রিন্স ল্যাবায়ু নির্মমভাবে সম্প্রসারণবাদী নীতি গ্রহণ করেছিলেন, তার ভূখণ্ড উত্তরে গ্যালিলি সাগর পর্যন্ত সম্প্রসারণ করেছিলেন, পশ্চিম দিকে তা গাজা পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছিল। রাজপুরুষেরা অভ্যন্তরীণ শত্রুদের সম্পর্কেও অভিযোগ করেছিলেন। তারা ফারাওয়ের কাছে সহায়তা কামনা করেন। এতে আরো মনে হয়, হিত্তিতিদের সাথে তখন যুদ্ধে নিয়োজিত মিসর তাদের সহায়তা দিয়েছিল সামান্যই। কেনানের অস্থিরতায় সম্ভবত ফারাওকে নাখোশ করেনি। কারণ এর ফলে নগর-রাষ্ট্রগুলোর পক্ষে মিসরীয় প্রাধান্যের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ অবস্থান গ্রহণ করা অসম্ভব করে তুলেছিল।

    আমারনা চিঠিগুচ্ছের মধ্যে ছয়টি ছিল জেরুসালেমের আবদি-হেপার। কেনানের যেসব শাসক অপেক্ষাকৃত সফল হয়েছিলেন, তিনি সম্ভবত তাদের মধ্যে ছিলেন না। তিনি অসংযত ভাষায় ফারাওয়ের প্রতি তার আনুগত্যের কথা দৃঢ়ভাবে জ্ঞাপন করেন, তার শত্রুদের বিরুদ্ধে সহায়তা করার জন্য জোরালো আবেদন করেন। তবে ওই সাহায্য কখনোই আসেনি। শেচেমের বিরুদ্ধে আবদি- হেপা এগিয়ে যেতে পারেননি, শেষ পর্যন্ত তিনি তার সব মিত্রকে হারান। জেরুসালেম নগরীতে পর্যন্ত অভ্যুত্থান ঘটেছিল। কিন্তু তবুও আবদি-হেপা চাননি, জেরুসালেমে মিসরীয় সৈন্য পাঠানো হোক। তিনি ইতোমধ্যেই অতি সামান্য প্রশিক্ষিত ও অপর্যাপ্ত মিসরীয় সৈন্যদের হাতে হেনস্তার শিকার হয়েছিলেন। তিনি অভিযোগ ^রেছেন, তারা তার প্রাসাদ ভেঙ্গেছে, তাকে হত্যার চেষ্টা করেছে। তিনি এর বদলে বরং গেজার, ল্যাচিশ বা আশকেলনে শক্তি বাড়ানোর জন্য ফারাওয়ের প্রতি আবেদন জানিয়েছন। মিসর থেকে সহায়তা না এলে জেরুসালেম ভূমি নিশ্চিতভাবেই তার শত্রুদের হাতে পতন ঘটবে।

    প্রায় নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, আবদি-হেপা কখনো তার সৈন্য পাননি। বস্তুত, এই পর্যায়ে, পার্বত্য দেশটি দ্রুত অসামরিককৃত এলাকায় পরিণত হয়েছিল। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, সুরক্ষিত শহর শিলোহ পরিত্যক্ত হয়, ত্রয়োদশ শতকের প্রথম দিকে অপেক্ষাকৃত ছোট পার্বত্যাঞ্চলের ৮০ ভাগ স্থানের বসতি অদৃশ্য হয়ে যায়। কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ মনে করেন, অস্থিরতার এই সময়ই বাইবেলে বর্ণিত জেবুসিতরা নিজেদেরকে জেরুসালেমে প্রতিষ্ঠিত করেছিল। সাহিত্যিক প্রমাণের ভিত্তিতে অন্যদের দাবি, হিত্তিদের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত জেবুসিতরা প্রায় ১২০০ খ্রিস্টপূর্ব সালের দিকে বর্তমান উত্তর তুরস্কের উত্তরে অবস্থিত হিত্তিতি সাম্রাজ্যের পতনের আগে ওই দেশে পৌছেনি! কোনটা সত্য তা নির্ধারণ করা অসম্ভব। নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধানে এখন পর্যন্ত কিছু পাওয়া না গেলেও ব্রোঞ্জ যুগের (খ্রিস্টপূর্ব ১৫৫০-১২০০) শেষ সময়ের দিকে জেরুসালেমের জনসংখ্যার পরিবর্তনের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। আরো দেখা যায়, জেবুসিতরা ছিল স্রেফ অভিজাত পরিবার। তারা শহরের লোকজনের থেকে আলাদা হয়ে দুর্গে বাস করত। ফলে এমনটা হতে পারে যে জেবুসিতরা ওফেলের পুরনো দুর্গগুলো মেরামত করেছিল এবং পাহাড় চূড়া ও প্রাচীরের মাঝখানের পূর্ব দিকের ঢালুতে নতুন এলাকা নির্মাণ করেছিল। ক্যাথলিন কেনিয়ন পাথরে পূর্ণ অনেক চত্বর আবিষ্কার করেছেন। এর ফলে, তিনি বিশ্বাস করতেন, ঢালু এলাকাটি বসবাস উপযোগী হয়, পুরনো নড়বড়ে বাড়িঘর ও খাড়া রাস্তাগুলোর স্থলাভিষিক্ত হয় এগুলোই। নতুন কাজে দীর্ঘ সময় লাগে। কেনিয়ন দাবি করেছেন, প্রকল্পটি চতুর্দশ শতকের মাঝামাঝিতে শুরু হলেও তৃতীয় শতকের প্রথম দিকের আগে শেষ হয়নি। কোনো কোনো প্রাচীর ছিল ৩৩ ফুট উঁচু। আর ভূমিকম্প ও ভূমিক্ষয়সহ নানা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে নির্মাণকাজে প্রায়ই বিঘ্ন ঘটত।’ আবাসনের সুযোগ সৃষ্টি ছাড়াও নতুন কাঠামোটি সম্ভবত নগরীর প্রতিরক্ষার কাজেও ব্যবহৃত হতো। কেনিয়ন মনে করেছিলেন, বাইবেলিক লেখকদের উল্লেখিত ‘মিলো’ হতে পারে এটি। কারণ জুদার পরবর্তী রাজাদের কেউ কেউ মিলো মেরামতের কথা বলেছেন। মিলো সম্ভব সামরিক কাজেও ব্যবহৃত হতো। ওফেলের শীর্ষে থাকা নগরদুর্গের অংশও হতে পারে এটি। ধারণা করা যেতে পারে ‘জায়ন’ নামটি দিয়ে পুরো জেরুসালেম নগরীর কথা বোঝাত না, বরং শুরুতে এটি দিয়ে দুর্গ বোঝানো হতো। এই দুর্গ নগরীর উত্তর ও আরো নাজুক এলাকা নিরাপদ রাখার মাধ্যমে নগরীকে সুরক্ষা রাখত।

    আমারনার আমলে জেরুসালেম সম্ভবত এর প্রতিষ্ঠাতা-দেবতা সালেমের প্রতি অনুগত্য বহাল রেখেছিল। ফারাওয়ের কাছে লেখা চিঠিতে আবদি-হেপা ‘জেরুসালেম ভূখণ্ডের রাজধানী হিসেবে বেইত-সুলমানির [সালেমের ঘর]’ কথা বলেছেন। তবে বিশেষজ্ঞরা বিশ্বাস করেন, হুরিয়ানরা নগরীতে নতুন দেবতা নিয়ে এসেছিল। এই দেবতা ছিলেন ঝড়ের দেবতা বাল। সিরীয় উপকূলের উগারিত লোকজন তার উপাসনা করত। ২২ ১৯২৮ সালে রাস শামরায় (প্রাচীন উগারিত এলাকার আধুনিক নগরী) আবিষ্কৃত কোনিফর্ম ট্যাবলেট থেকে আমরা বাল ধর্মমত সম্পর্কে জানতে পারি। আমরা বিষয়টি বিবেচনায় নিতে একটু দম নেব। কারণ জেরুসালেমের আধ্যাত্মিকতার ওপর এর বিপুল প্রভাব রয়েছে।

    বাল কিন্তু সিরীয় দেবমণ্ডলের প্রধান দেবতা ছিলেন না। তার বাবা ছিলেন আল। তিনিও হিব্রু বাইবেলে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন। আল পৃথিবীর উর্বরতা উৎস দুটি মহানদীর সঙ্গমস্থলে অবস্থিত একটি তাঁবু-মন্দিরে বাস করতেন। মহাবিশ্বের নিয়মনীতি প্রতিষ্ঠার জন্য প্রতি বছর দেবতারা সেখানে ‘ঐশী পরিষদে’ অংশ নিতেন। ফলে আল ছিলেন আইন, শৃঙ্খলা ও উর্বতার উৎস। এগুলো ছাড়া কোনো মানব সভ্যতাই টিকতে পারে না। তবে সময়ের পরিক্রমায় অন্যান্য পরাক্রমশালী দেবতার মতো আলও অনেক দূরের চরিত্রে পরিণত হন। অনেক লোক তার আরো গতিশীল ছেলে বালের প্রতি আকৃষ্ট হয়। এই বাল আকাশের মেঘে চড়তেন, তপ্ত পৃথিবীতে জীবনদায়ী বৃষ্টি আনতে আকাশ থেকে বজ্রপাত ছুঁড়ে মারতেন।

    তবে পৃথিবীর কার্যকারিতা নিশ্চিত করতে মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে যুদ্ধ করতে হয়েছিল বালকে। নিকট প্রাচ্যে জীবন প্রায়ই বিশৃঙ্খলা, অন্ধকার ও মৃত্যুর শক্তির বিরুদ্ধে নরিয়া সংগ্রামের মুখোমুখি হয়েছে। সভ্যতা, শৃঙ্খলা ও সৃষ্টিশীলতা কেবল মহা প্রতিকূলতার বিপরীতেই অর্জিত হতে পারে। লোকজন সময়ের সূচনায় দেবতাদের অংশ নেওয়া বিশাল বিশাল যুদ্ধের কাহিনী বলে। এসব যুদ্ধের মাধ্যমেই অন্ধকার থেকে আলো বের হয়ে এসেছিল, বিশৃঙ্খলা অবসানকারী শান্তি এসেছিল, অরাজকতাকে মহাবিশ্বের যথাযথ ও ব্যবস্থাপনাযোগ্য উপাদান হিসেবে রেখেছিল। ফলে বেবিলনের উপাসনাবিধিতে সমুদ্র-দানব তিয়ামাতকে হত্যা করে তার মৃতদেহ দুই টুকরা করার মাধ্যমে দুনিয়া সৃষ্টিকারী তরুণযোদ্ধা মারদুকের যুদ্ধ জয়ের স্মারক অনুষ্ঠান ছিল। বাল সম্পর্কেও এ ধরনের কাহিনী রয়েছে। একটি মিথ অনুযায়ী, তিনি সাত মাথাওয়ালা সমুদ্র-রাক্ষস লোতানের, হিব্রু বাইবেলে বর্ণিত ‘লেভিয়াথান’, বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন। প্রায় সব সংস্কৃতিতেই ড্রাগন বা রাক্ষসেরা অবয়বহীন ও স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যহীনতার প্রতীক বিবেচিত হয়। লোতানকে হত্যার মাধ্যমে বাল অরাজকতার (এ থেকেই ফলে মানুষ ও ঐশী সত্তাসহ সবকিছুর সৃষ্টি হয়েছে) অবয়বহীন অপচয় রোধ করেন। মিথটি বিলুপ্তি ও নিশ্চিহ্ন হওয়ার শঙ্কা এঁকেছে, বিশেষ করে সভ্যতার প্রাথমিক ওই সময়ে তেমনটি হওয়ার সার্বক্ষণিক আশঙ্কা ছিল।

    সাগর দেবতা ও মরুভূমির বিরুদ্ধে বালের অন্যান্য যুদ্ধের কাহিনীতেও একই ধরনের সম্রদ্রতা দেখা যায়। নিকট প্রাচ্যের নগরীগুলো এই দুই প্রাকৃতিক শক্তির কাছে হুমকিগ্রস্ত ছিল। সভ্য নয় এমন সবকিছুর প্রতিনিধিত্ব করত সাগর। আর সবকিছুই ছিল ভয়-জাগানিয়া। সাগর হলো সীমাহীন, অবয়বহীন। এটি বিশাল, উন্মুক্ত ও অমূর্ত। একইসাথে মরুময় প্রান্তরও এগিয়ে গিয়ে উর্বরা ভূমির প্রতি হুমকি সৃষ্টি করত। অথচ উর্বরা ভূমিই ছিল মানব বসতির জন্য একমাত্র উপযোগী স্থান। উগারিতের মিথে সাগর ও নদীর দেবতা যম-নাহার, মৃত্যু, উর্বরতা ও খরার দেবতা মতের বিরুদ্ধে বালের মরিয়া যুদ্ধের কাহিনী রয়েছে। মত বিশেষভাবে ছিল মৃত্যুর মতো। প্রচণ্ড শক্তির আধার মত অতৃপ্তভাবে মানুষের রক্ত-মাংসের অনুসন্ধান করত। মারাত্মক কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলা করে বাল এই দুই শত্রুর বিরুদ্ধে জয়ী হন। মতের বিরুদ্ধে যুদ্ধটি ছিল বিশেষভাবে ভীতিকর। কারণ, বালকে দৃশ্যত বন্দি করে মতের রাজ্য ভূগর্বে তথা ভয়ঙ্কর শূন্যতার মধ্যে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। বালের বন্দিত্বের আমলে খরায় ঝলসে গিয়ে মরুভূমিতে পরিণত হয়েছিল দুনিয়া। সবশেষে বালই জয়ী হন। অবশ্য তার জয় কখনো সম্পূর্ণ হয়নি। যম ও মত উভয়ই টিকে যায়। ফলে বিশৃঙ্খলার ভীতিকর শক্তির অনেক বছর বিরাজ করার আশঙ্কা থাকে, মৃত্যু সবচেয়ে অপরিহার্য বিষয়। ঈশ্বর ও মানুষেরা ঐক্যবদ্ধ হয়, তাদের বিরুদ্ধে সীমাহীন যুদ্ধে লড়াই করে।

    জয়ের উৎসব করার জন্য নিজের জন্য একটি প্রাসাদ নির্মাণের জন্য আলের কাছে অনুমতি চান বাল। প্রাচীন মিথে এমনটা বারবারই দেখা যায়। মারদক পৃথিবী সৃষ্টির পর দেবতা ও মানুষ মিলে পৃথিবীর কেন্দ্রে বেবিলন নগরী সৃষ্টি করেছিল। বাব-ইলানিতে (‘ঈশ্বরদের দরজা’) দেবতারা ঐশী পরিষদের সভায় অংশ নিতে প্রতি বছর জমায়েত হতেন। এটি ছিল নারী-পুরুষের নশ্বর জগত! তারা জানত, তারা সেখানে ঈশ্বরদের কাছে যেতে পারে। নগরীর কেন্দ্রে তারা মারদকের প্রাসাদ হিসেবে মহামন্দির ইসাগিলাও নির্মাণ করেছিল। তিনি সেখানে বাস করতেন, তার প্রতিনিধিত্বকারী রাজার মাধ্যমে ঐশী নির্দেশনা জারি করতেন। অর্থাৎ স্থাপত্যকে বিবেচনা করা হতো ঐশী উদ্দীপ্ত কার্যক্রম হিসেবে। বিশাল বিশাল পাথুরে নগরী, মন্দির ও উপাসনালয়কে বিপুল অর্জন বিবেচনা করা হতো। এসব বিপুল কর্মযজ্ঞ সম্পন্নকারী মানুষ অতিপ্রাকৃত শক্তির অধিকারী বলে বিবেচিত হতো। এগুলো ছিল অবয়বহীনতা ও বিশৃঙ্খলার বিরুদ্ধে মানব-দেবতা বিজয়ের স্থায়ী স্মারক।

    একইভাবে কোনো প্রাসাদ ছাড়া বালের পক্ষে দেবতাদের ওপর শাসন চালানো সম্ভব ছিল না। মাউন্ট জ্যাফনের ওপর স্বর্ণ ও রত্নপাথরের তৈরি অনিন্দ্যসুন্দর প্রাসাদটি তৈরির পরই তিনি সত্যিকারের ‘প্রভু’ হয়েছিলেন। এরপর থেকে দেবতা ও মানুষ উভয়কেই শাসন করতে লাগলেন বাল। তিনি ঘোষণা করলেন :

    একমাত্র আমিই দেবতাদের রাজা হতে পারি,
    যা দেবতা ও মানুষদেরকে পুষ্ট করে
    পৃথিবীকে বহু ভাবে তৃপ্ত করে।২৩

    বাল ও তার স্ত্রী আনাত ওই মন্দিরে পৃথিবীতে শৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তাদের মহাবিজয় উদযাপন করেন :

    আমি কি আলের প্রিয়ভাজন যমকে ধ্বংস করিনি…
    ড্রাগনকে ধরে বিলীন করা হয়নি?
    আমি সাত মাথাওয়ালা ফনা ধরা সাপকে
    ধ্বংস করেছি। ২৪

    উগারিতের লোকজন বালের জাফোন আবাসস্থল থেকে মাত্র ২০ মাইল দূরে বাস করত। তারা মনে করত, বালের ভূখণ্ডে বাস করায় তারাও ওই বিজয়ের অংশীদার। উগারিতের প্রার্থনাবিধিতে জাফোনকে বাল বলেন, ‘পবিত্র স্থান, আমার ঐতিহ্যের পর্বত… মনোনীত স্থান, বিজয়ের পাহাড়।’ জাফোন ছিল তাদের দুনিয়ার কেন্দ্র। এটি ছিল ‘পবিত্র স্থান,’ ‘সুন্দর পর্বত’ ও ‘পুরো দুনিয়ার আনন্দ।’২৫ বাল সেখানে থাকার কারণেই তিনি জাফোনকে শান্তি, উর্বরতা ও সম্প্রীতির দুনিয়াবি স্বর্গে পরিণত করেছিলেন। তিনি ‘দুনিয়া থেকে যুদ্ধ দূর করেছিলেন। পৃথিবীর গভীরে শান্তি এবাহিত করেছিলেন।’ ‘মাঠে গভীরে ভালোবাসা বৃদ্ধি পেয়েছিল। ২৬ উগারিতের লোকজন এই ঐশী উর্বরতা ও শান্তি উপভোগ নিশ্চিত করার জন্য একটি মন্দির নির্মাণ করে। এটি ছিল মাউন্ট জাফোনে বালের প্রাসাদের প্রতিরূপ। বাল যাতে ঈশ্বরকে অনুকরণ করার মূলনীতি অনুযায়ী তাদের সাথেও যাতে বাস করতে থাকেন সেজন্য তারা তাদের কাছে প্রকাশ হওয়া চূড়ান্ত অবয়বটি নকল করে নিয়ে আসে অবিকল প্রতিকৃতি তৈরি করার জন্য। ফলে স্বর্গ দুনিয়াতে তাদের নগরীতে চলে আসে, তারা জীবনের স্বতন্ত্র অবস্থান রচনা করতে পারে। বিপজ্জনক দুনিয়ার মধ্যে থাকায় এটি প্রয়োজনীয় বলে মনে করত তারা।

    উগারিতের মন্দিরে বালের উপস্থিতির কারণেই সেখানে মানবজীবন সম্ভব করে তোলে। লোকজন মন্দিরে প্রবেশ করার সময় অস্তিত্বের আরেক মাত্রায় প্রবেশের অনুভূতি লাভ করত, মানুষের কাছে সাধারণভাবে গোপন থাকা প্রাকৃতিক ও ঐশী মাত্রার সাথে আবারো তারা যোগাযোগ করতে পারত। তারা শুনতে পেত

    গাছের কথা, পাথরের ফিসফিসানি,
    পৃথিবীর সাথে আকাশের কথোপকথন
    তারকারাজির সাথে তাদের সম্পর্ক।
    …বিদ্যুত চমকে তারা আকাশের কিছু জানত না
    কথা যা মানুষ জানত না
    এবং পৃথিবীর ব্যপ্তি বুঝত না। ২৭

    প্রাচীন দুনিয়ায় মন্দিরকে প্রায়ই স্বপ্নাবিভাবের স্থান বিবেচনা করা হতো। এখানে লোকজন অধিকতর দূরকে ও ভিন্নভাবে দেখতে পাওয়া শিখত। তারা কর্মধারার জীবনকে দেখার জন্য নিজেদের কল্পনাপ্রসূতভাবে বিস্তৃত করত। মন্দিরের প্রার্থনাবিধি ও স্থাপত্য ছিল অস্তিত্বের আরো পূর্ণাঙ্গ ও তীব্রতর কল্পনার সৃষ্টিশীল প্রয়াসের অংশবিশেষ। তবে এটি লক্ষ্য বাস্তবায়নের কর্মসূচিও ছিল। উগারিতের লোকজন তাদের শাস্ত্রাচারে বালের যুদ্ধের পুনারাবৃত্তি করত, ঐশী নাটকে মাউন্ট জাফোনে তার সিংহাসন আরোহণ উদযাপন করত। এই বসন্তকালীন উৎসব নতুন বছরের সূচনা প্রকাশ করত। বালের বিজয়গুলো পুনরাবৃত্তি ও অনুকরণ করা হতো, যাতে জীবনদায়ী বৃষ্টি আবারো নেমে আসে, নগরীটি ধ্বংসকারী বিশৃঙ্খলার বিপরীতে শান্তিপূর্ণ থাকে। রাজ্যাভিষেক অনুষ্ঠানও উগারিতের বালের শ্বাশত ঐতিহ্যের’ তথা তারা যাতে শান্তিতে ও প্রাচুর্যে থাকতে পারে, এমন আশার অংশ হিসেবে হতো।২৮

    উপাসনাবিধির কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্ব থাকতেন খোদ রাজা। তিনি সিংহাসনে বসতেন, তার মাথা বালের প্রতিনিধি হিসেবে তেলে ঝকমক করত। নিকট প্রাচ্যের অন্যান্য রাজার মতো তিনিও ঈশ্বরের প্রতিভূ বিবেচিত হতেন, তার সুস্পষ্টভাবে নির্ধারিত কর্তব্য থাকত। এই পর্যায়ে নিকট প্রাচ্যের লোকজন ধর্ম নিয়ে অসংযত আশাবাদী ছিল না। তাদের কাছে ‘পাপমোচনের’ মানে অবিনশ্বরতা ছিল না : তা ছিল দেবতাদের একান্ত অধিকার। তাদের লক্ষ্য ছিল আরো সাদামাটা : দুনিয়ার বুকে পরিমার্জিত, সুশৃঙ্খল জীবন টিকিয়ে রাখতে, বৈরী শক্তিগুলোকে কোণঠাসা রাখতে দেবতাদের সহায়তা করা। যুদ্ধ ছিল রাজার অপরিহার্য কর্তব্যকর্মগুলোর অন্তর্ভুক্ত। নগরীর শত্রুদের প্রায়ই বিশৃঙ্খল শক্তির সাথে মিলিয়ে ফেলা হতো। কারণ তারা কেবল ধ্বংসই করতে পারত। কিন্তু তারপরও শান্তির জন্যও যুদ্ধ করা হতো। নিকট প্রাচ্যের রাজাকে তার নগরীর দেবতাদের জন্য মন্দির নির্মাণ ও সেগুলো যথাযথভাবে মেরামত করার শপথ জোর দিয়ে করতেন। এভাবে ঐশী বিশ্বের হাতে থাকা নগরীর জীবনপ্রবাহ সুরক্ষিত রাখার কথা ভাবা হয়েছিল। তবে নগরীর জন্য খাল খনন করা, নগরী যাতে সবসময় সুরক্ষিত থাকে, সে ব্যবস্থাও তাকে করতে হতো। কোনো নগরীই মূল্যবান বিবেচিত হতো না যদি না সেটি তার শত্রুদের থেকে নাগরিকদের নিরাপত্তা দিতে না পারত। বেবিলনের গিলগামেশ মহাকাব্যের শুরু ও শেষে থেকে উরুকের লোকজনকে নগরীর প্রাচীরগুলোর শক্তিমত্তা ও শিল্প-কুশলতার প্রশংসা করতে সনির্বন্ধ অনুরোধ করা হয়েছে :

    ভিত্তি বিন্যাস খতিয়ে দেখো, ইটভাটা পরীক্ষা করো
    ইটভাটা যদি ইট পোড়াতে না পারে
    আর সাত [জ্ঞানী] ভিত্তি স্থাপন করছেন কিনা দেখো। ২৯

    রাজা গিলগামেশ মানবীয় অবস্থা থেকে উত্তরণ করার চেষ্টা করেছিলেন। তিনি নগরী ত্যাগ করে শ্বাশত জীবনের সন্ধানে বের হয়েছিলেন। তার প্রয়াস ব্যর্থ হলেও কবি ‘আমাদের বলছেন, তিনি অন্তত আক্রমণ থেকে তার নগরীকে রক্ষা করতে পেরেছিলেন, নিজেকে উরুকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন। পৃথিবীতে এ স্থানটি তার সমার্থক হয়ে ওঠেছিল।

    নিকট প্রাচ্যের রাজার আরেকটি কাজও থাকত। তাকে আইন জারি করতে হতো। এই আইন অনেকটাই ঐশী সৃষ্টি বলে বিবেচিত হতো। মনে করা হতো ঈশ্বরেরাই এই আইন রাজার কাছে নাজিল করেছেন। বিখ্যাত একটি কেন্দ্রস্তম্ভে অষ্টাদশ শতকের বেবিলনের রাজা হাম্বুরাবিকে দেখা যায় সিংহাসনে বসা ঈশ্বর শেমেশের সামনে দাঁড়িয়ে থেকে তার কাছ থেকে আইন গ্রহণ করছেন। তার আইন সংহিতায় তিনি দৃঢ়ভাবে জানান, ঈশ্বরেরা তাকে নিযুক্ত করেছেন

    রাজ্যে বিচারের ব্যবস্থা করতে,
    বদ ও অপঃশক্তিকে ধ্বংস করতে,
    যাতে শক্তিশালীরা দুর্বলদের নির্যাতন করতে না পারে।

    নগরীর ভৌত আবরণ রক্ষার জন্য রাজা এর সামাজিক শৃঙ্খলা রক্ষা করতে বাধ্য ছিলেন। নগরীর অভ্যন্তরে শোষণ, দারিদ্র ও অসন্তোষ যদি অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করে, তবে বাইরের শত্রুর বিরুদ্ধে দুর্গ সুরক্ষিত করার কাজটি তেমন ফলপ্রসূ হবে না। ফলে রাজা নিজেকে জাতির রাখাল হিসেবে উপস্থাপন করতেন, ঠিক যেমনভাবে হাম্বুরাবি তার নিজের আইন সংহিতার উপসংহারে বলে গেছেন

    আমি লোকজনকে বন্ধুত্বপূর্ণভাবে বাস করার ব্যবস্থা করেছি;
    আমি কাউকে তাদেরকে অন্যদের সন্ত্রস্ত্র করতে দেইনি…
    ফলে আমি কল্যাণকামী রাখাল যার রাজদণ্ড সত্যনিষ্ঠ;
    আমার সদয় ছায়া পুরো নগর ছেয়ে আছে।
    আমার হৃদয়ে আমি সুমের ও আকাদ জাতিকে বহন করি;
    আমার সুরক্ষায় তারা সমৃদ্ধ হয়;
    আমি তাদের শান্তিতে পরিচালনা করি;
    আমার শক্তিতে তাদের আশ্রয় দিয়েছি। ৩১

    উগারিতেও রাজাকে বিধবা ও এতিমদের যত্ন নিতে হবে বলে বিবেচনা করা হতো।৩২ আর তা করা হতো নগরীতে বিরাজমান ন্যায়বিচার ও নিরপেক্ষ ব্যবস্থার মাধ্যমে। দুর্ভিক্ষ ও খরা যাতে দূরে থাকে, জমি যাতে উর্বরা থাকে সেটিও তাকে নিশ্চিত করতে হতো। ঐশী ব্যবস্থার জন্য দুটিই দরকারি। বৈরী দুনিয়ার মধ্যে কোনো নগরী শান্তিপূর্ণ, উর্বরা হতে পারে না যদি জনগণের কল্যাণের প্রতি সবচেয়ে অগ্রাধিকার না দেওয়া হয়।৩৩ নিকট প্রাচ্যজুড়ে ন্যায়বিচারের এই আদর্শ ছিল ঐশী রাজা ও পবিত্র নগরীর ধারণার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। লোকজন ভালোভাবেই অবগত ছিল, কেবলমাত্র সুবিধাভোগী এলিটরাই সভ্যতার কল্যাণ উপভোগ করতে পারে। ভঙ্গুরব্যবস্থা আনায়াসেই ক্রুদ্ধ কৃষকেরা গুঁড়িয়ে দিতে পারে। ফলে সামাজিক ন্যায়বিচারের জন্য যুদ্ধ ছিল শান্তির আদর্শ নগরীর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

    উগারিতের ইতিহাসেও এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত হয়। এখানকার জনসংখ্যা ছিল প্রায় সাত হাজার। তারা প্রায় পুরোপুরি নির্ভরশীল ছিল রাজকীয় ব্যবস্থার ওপর। আর এই ব্যবস্থা টিকে ছিল আশপাশের মাত্র ২৫ হাজার কৃষকের সহায়তার ওপর। এই বিশাল সভ্যতা নির্মিত হয়েছিল গরিবদের ওপর ভর করে। এটি হয়তো বালের যুদ্ধগুলোর কাহিনীতে প্রতিফলিত হয়েছে। এসব যুদ্ধে অন্যকে বশ মানানোর ওপর সৃষ্টিশীলতা ও শৃঙ্খলা নির্ভরশীল বলে দেখা হতো। শেষ পর্যন্ত ব্যবস্থাটি অকার্যকর প্রমাণিত হয়, ত্রয়োদশ শতকের অর্থনীতি ভেঙে পড়ে, গ্রামবাসীরা চলে যায়, নগর-রাষ্ট্রগুলো এজিয়ান দ্বীপপুঞ্জ ও আনাতোলিয়ার ‘সাগর মানবদের’ আক্রমণ সহ্য করতে পারেনি। বৃহত্তর সামাজিক সাম্য অনুসন্ধান স্রেফ ধর্মীয় কল্পকথা ছিল না, এটি ছিল পবিত্র নগরীকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার অপরিহার্য বিষয় এবং তা রয়ে যায়। পরে জেরুসালেমের ইতিহাসে দেখা যাবে, নিপীড়নকারী সরকারগুলো অনেক সময় তাদের নিজেদের পতনের বীজ বপণ করেছে।

    ব্রোঞ্চ যুগে জেরুসালেমের ধর্মীয় জীবন সম্পর্কে প্রত্যক্ষ কোনো প্রমাণ আমাদের কাছে নেই। প্রত্নতাত্ত্বিকেরা জেবুসিতদের কোনো মন্দিরের চিহ্ন খুঁজে পাননি, মাউন্ট জায়ন ধর্মাদর্শ সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য দিতে উগারিতের মতো কোনো কিছু এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয়নি। কিন্তু তার পরও উগারিত টেক্স ও কিছু হিব্রু সালমের মধ্যে অস্পষ্ট সামঞ্জস্য দেখা যায়। এগুলোই মাউন্ট জায়ন প্রশ্নে ইসরাইলি ধর্মাদর্শে ব্যবহৃত হয়েছিল। সামে থাকা উগারিতের স্রোত বাক্যসমষ্টিতে মাউন্ট জায়নে ইসরাইলের ঈশ্বরের সিংহাসনে আহরণ উদযাপন করতে দেখা যায়। এতে ‘লেভিয়াথান’ ও সৃষ্টির দিনে ড্রাগনের বিরুদ্ধে জয়ের প্রশংসা করা হয়েছে। মাউন্ট জায়নকে শান্তির নগরী, পবিত্র পর্বত ও একে ঈশ্বরের শ্বাশত ঐতিহ্য হিসেবেও অভিহিত করা হয়েছে। হিব্রু বাইবেলে অনেক সময় ‘জায়নকে’ এমনকি ‘জাফোন’ নামেও ডাকা হয়েছে। আমরা জানি যে হুরিয়ানরাও বাল ও জাফোনে তার মন্দির সম্পর্কে গল্প বলেছে। এ কারণে বিশেষজ্ঞরা উপসংহার টেনেছেন যে তারা জেরুসালেমে বালের মতাদর্শ নিয়ে এসেছিল। এটি একদিন মাউন্ট জায়নে ইসরাইলি মতাদর্শের শান্তির নগরীর উগারিটিক ধারণার প্রবর্তন করেছিল।৩৪ নিকট প্রাচ্যের লোকজন অনাদি কাল থেকে নিরাপত্তা লাভের আকাঙ্ক্ষা করে আসছে। মনে হচ্ছে, জেরুসালেম তার লোকজনকে তাদের কাঙ্ক্ষিত জিনিসটি দিয়ে পরিতৃপ্ত করতে পেরেছিল। নগরীটি ত্রয়োদশ শতকের অস্থিরতা থেকে টিকে থাকতে পেরেছিল, অথচ ওই সময় কেনানি পাহাড়ের অনেক বসতি পরিত্যক্ত হয়েছিল। বাইবেল ইঙ্গিত দিচ্ছে, জায়নের জেবুসাইত দুর্গটি অভেদ্য বিবেচিত হতো। দ্বাদশ শতকে নতুন নতুন হুমকি ও শত্রুর আবির্ভাব ঘটে। আবারো মিসর কেনানের ওপর থেকে তার নিয়ন্ত্রণ হারাতে শুরু করে; হিত্তিতি সাম্রাজ্য ধ্বংস হয়ে যায়, মেসোপোটেমিয়া প্লেগ ও দুর্ভিক্ষে বিধ্বস্ত হয়। আবারো সভ্যতা ভঙ্গুর ও ত্রুটিপূর্ণ বলে প্রমাণিত হয়। লোকজন নতুন স্বর্গের খোঁজ করতে থাকায় বিপুল মাত্রায় অভিবাসন ঘটে। পরাশক্তিগুলোর পতন ঘটতে থাকায় তাদের স্থানে নতুন নতুন রাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটে। এগুলোর একটি হলো কেনানের দক্ষিণ উপকূলের ফিলিস্তিয়া। মিসর আক্রমণকারী ‘সাগর-মানবদের’ মধ্যে হয়তো ফিলিস্তিনিরাও ছিল। তাদের দমন করা হয়, তারা হয় ফারাওদের সামন্ত। তৃতীয় রামসেস তার প্রতিনিধি হিসেবে কেনান শাসন করার জন্য ফিলিস্তিনিদের সেখানে বাস করতে দিয়ে থাকতে পারেন। নতুন ভূখণ্ডে তারা স্থানীয় ধর্ম গ্রহণ করে নিজেদের আশখেলন, অ্যাশদোদ, একরন, গথ ও গাজা নামের পাঁচটি নগর-রাষ্ট্রে সংগঠিত করে। মিসর দুর্বল হতে থাকায় ফিলিস্তিয়া শেষ পর্যন্ত স্বাধীন হয়ে এবং এমনকি কেনানের কার্যত শাসকে পরিণত হয়। কিন্তু একাদশ শতকে কেনানের অধিবাসীদেরকে সেখানে এক নতুন শক্তির মুখোমুখি হতে হয়। পাহাড়ি দেশে একটি রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি আগের যেকোনো কেনানি সত্তার চেয়ে পুরোপুরি ভিন্ন ছিল। শেষ পর্যন্ত জেবুসাইত জায়ন নিজেকে নতুন আগ্রাসী শক্তির সামনে পুরোপুরি ঘেরাও দেখতে পায় : ইসরাইল রাজ্য চির দিনের জন্য তার ভাগ্য বদলে ফেলে।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleদ্য গ্রেট ট্রান্সফর্মেশন : আমাদের ধর্মীয় ঐতিহ্যের সূচনা – ক্যারেন আর্মস্ট্রং
    Next Article স্রষ্টার জন্য লড়াই : মৌলবাদের ইতিহাস – ক্যারেন আর্মস্ট্রং

    Related Articles

    ক্যারেন আর্মস্ট্রং

    আ হিস্ট্রি অফ গড – ক্যারেন আর্মস্ট্রং

    August 4, 2025
    ক্যারেন আর্মস্ট্রং

    ইসলাম : সংক্ষিপ্ত ইতিহাস – ক্যারেন আর্মস্ট্রং

    August 4, 2025
    ক্যারেন আর্মস্ট্রং

    পুরাণ : সংক্ষিপ্ত ইতিহাস – ক্যারেন আর্মস্ট্রং

    August 4, 2025
    ক্যারেন আর্মস্ট্রং

    বুদ্ধ – ক্যারেন আর্মস্ট্রং

    August 4, 2025
    ক্যারেন আর্মস্ট্রং

    স্রষ্টার জন্য লড়াই : মৌলবাদের ইতিহাস – ক্যারেন আর্মস্ট্রং

    August 4, 2025
    ক্যারেন আর্মস্ট্রং

    দ্য গ্রেট ট্রান্সফর্মেশন : আমাদের ধর্মীয় ঐতিহ্যের সূচনা – ক্যারেন আর্মস্ট্রং

    August 4, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    আলো হাতে সেই মেয়েটি – তপন বন্দ্যোপাধ্যায়

    August 20, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    আলো হাতে সেই মেয়েটি – তপন বন্দ্যোপাধ্যায়

    August 20, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Our Picks

    আলো হাতে সেই মেয়েটি – তপন বন্দ্যোপাধ্যায়

    August 20, 2025

    গোয়েন্দা গার্গী সমগ্র – তপন বন্দ্যোপাধ্যায়

    August 20, 2025

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.