Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    জেরুসালেম : ওয়ান সিটি থ্রি ফেইস – ক্যারেন আর্মস্ট্রং

    মোহাম্মদ হাসান শরীফ এক পাতা গল্প727 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    ১০. খ্রিস্টান পবিত্র নগরী

    সিরিয়া ও এশিয়া মাইনরের- তাইবেরিয়াসের প্যাট্রিয়ার্ক এলাকা থেকে নয় বলেই মনে হচ্ছে- ইহুদি প্রতিনিধিদল ৩৬৩ সালের ১৯ জুলাই অ্যান্টিয়কে পৌঁছে সম্রাট জুলিয়ানের সাথে সাক্ষাত করার জন্য। সাম্রাজ্যের ব্যাপারে জুলিয়ানের মহাপরিকল্পনার অংশ হিসেবে তাদেরকে তলব করা হয়েছিল। তিনি নতুন বেমানান খ্রিস্ট ধর্মটির স্থানে সমগ্র সাম্রাজ্যে বলি দান প্রথা উদযাপিত হতে দেখতে চেয়েছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন, ওই বলি হবে ইহুদি ধর্মগ্রন্থে যাকে এক ঈশ্বর, সর্বোচ্চ সত্তা ইত্যাদি বলে ডাকা হয় তার নামে, যাকে অনেক সময় জিউস, হেলিয়াস বা সর্বশক্তিমান ঈশ্বর হিসেবেও অভিহিত করা হয়। রোমের পন্টিফেক্স ম্যাক্সিমাস হিসেবে জুলিয়ান ইতোমধ্যেই প্রতিটি অঞ্চলে খ্রিস্টান বিশপদের বিরোধিতা করার জন্য পৌত্তলিক পুরোহিত নিয়োগ করেছিলেন। যেসব শহরে কখনো খ্রিস্টধর্ম গৃহীত হয়নি সেসব এলাকাকে বিশেষ গুরুত্ব দিলেন। তাছাড়া সরকারি অফিস থেকে খ্রিস্টানদের ধীরে ধীরে অপসারণ করা হলো। সম্রাট ইহুদি ধর্মের কিছু বিষয় নাকচ করলেও তাদের প্রাচীন বিশ্বাসের প্রতি ইহুদি বিশ্বস্ত থাকার জন্য প্রশংসা করেন। তার শিক্ষক ল্যাবিলিকাস তাকে শিক্ষা দিয়েছিলেন যে বলির সহযোগে করা না হলে কোনো প্রার্থনাই ঈশ্বরের কাছে পৌঁছে না। ইহুদিরা অবশ্য তখন তাদের পূর্বপুরুষদের শাস্ত্রীয় আচরণটি পালন করতে পারছিল না। এটিই সাম্রাজ্যের স্বার্থের জন্য ক্ষতিকারক হতে পারে। কারণ সাম্রাজ্যের কল্যাণ নির্ভর করছে ঈশ্বরের সমর্থনের ওপর।

    এই প্রেক্ষাপটে ইহুদি প্রবীণেরা জুলিয়ানের সামনে সমাবেত হলে তিনি তাদের জিজ্ঞাসা করলেন, মুসার বিধান অনুযায়ী তারা কেন ঈশ্বরের কাছে বলি দেয় না। তিনি কারণটি ভালোভাবেই জানতেন। তবে এমন একটি পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চাইছিলেন যাতে ইহুদিরাই তাদের ধর্মমতটি আবার শুরু করার জন্য অনুরোধ করে। প্রবীণেরা যথাযথভাবেই জবাব দিলেন : ‘পবিত্র নগরীর বাইরে বলি দেওয়ার অনুমতি নেই আমাদের বিধানে। আমরা এখন তা কিভাবে করব? আমাদেরকে নগরীতে পুনঃবাসিত করুন, টেম্পল ও বেদী পুনঃগঠন করুন, আমরা প্রাচীন কালের মতো বলি দেব।’ বেশি না হলেও অন্তত ঠিক এটুকুই চেয়েছিলেন জুলিয়ান। কারণ ইহুদি ধর্মের পরাজয় খ্রিস্টানদের গ্রন্থের সত্যতা প্রমাণ করে বলে খ্রিস্টানেরা যে দাবি করে তার প্রতি এটি হবে তিক্ত আঘাত। এবার প্রবীণদেরকে সম্রাট বললেন : ‘আমি সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের টেম্পল প্রতিষ্ঠা করার জন্য সর্বোচ্চ প্রয়াস চালব।’ সভার পরপরই জুলিয়ান প্যাট্রিয়াক দ্বিতীয় হিলেল ও সাম্রাজ্যের সব ইহুদিকে লিখেন, জেরুসালেম আবার ইহুদি নগরী হবে বলে প্রতিশ্রুতি দেন : ‘আমি আমার ব্যয়ে পবিত্র নগরী জেরুসালেম পুনঃনির্মাণ করব, একে জনবসতিপূর্ণ করব, যা আপনারা অনেক বছর ধরে দেখার ইচ্ছাপ্রকাশ করে আসছেন।

    ইহুদি সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রবল উদ্দীপনার সৃষ্টি হলো। রাস্তায় রাস্তায় শোফার ফোঁকা হলো, মনে হলো শিগগিরই মেসাইয়া এসে যাচ্ছেন। খ্রিস্টানদের প্রতি দুর্বিনীত হয়ে ওঠল অনেক ইহুদি। কারণ অনেক দিন খ্রিস্টানেরা তাদের ওপর খবরদারি চালিয়েছে। ইহুদি জনতা জেরুসালেমে পৌছাতে শুরু করল, দুই শ বছরের মধ্যে এই প্রথমবার নগরীর রাজপথে তাদের দলে দলে দেখা যেতে লাগল। অনেকে নতুন টেম্পলের জন্য চাঁদা পাঠাতে লাগল। টেম্পল মাউন্টের বিধ্বস্ত বারান্দায় একটি অস্থায়ী সিনাগগ বানানো হলো। জুলিয়ান হয়তো খ্রিস্টান অধিবাসীদের বলে থাকবেন যে তারা যেন ইহুদিদের সম্পত্তি ফিরিয়ে দেয়। তিনি তার পণ্ডিত্য বন্ধু অ্যালিপিয়াসকে টেম্পল নির্মাণকাজ তদারকিতে নিয়োগ করলেন, নির্মাণসামগ্রী জড়ো হতে লাগল। বিশেষ রৌপ্য যন্ত্রপাতি প্রস্তুত করা হলো, কারণ বেদী নির্মাণে লোহা ব্যবহার নিষিদ্ধ ছিল। ৩৬৩ সালের ৫ মার্চ জুলিয়ান ও তার সেনাবাহিনী পারস্যের উদ্দেশ যাত্রা করলেন। সম্রাট তার পৌত্তলিক দর্শনের সত্যতা এই অভিযানের মাধ্যমে সেখানে প্রমাণ করতে পারবেন বলে বিশ্বাস করতেন। তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, ফেরার পথে তিনি তার বিজয় উৎসবের অংশ হিসেবে ব্যক্তিগতভাবে টেম্পলকে আনুষ্ঠানিকভাবে উৎসর্গ করবেন। সম্রাট রওনা হওয়ার পর ইহুদি শ্রমিকেরা পুরনো টেম্পলের ভিত্তি বের করার কাজ শুরু করে, আবর্জনা, জঞ্জালের স্তুপ পরিষ্কার করতে থাকে। এপ্রিল ও মে মাসজুড়ে কাজ চলতে থাকে। গ্যালিলির প্যাট্রিয়ার্ক ও রাব্বিরা উদ্যোগটি নিয়ে সন্দিহান ছিলেন। তখন তাদের মনে স্থির বিশ্বাস ছিল যে মেসাইয়াই কেবল টেম্পলটি আবার নির্মাণ করতে পারেন : কোনো মূর্তিপূজকের নির্মিত টেম্পল কিভাবে ঈশ্বরের আশীর্বাদপুষ্ট হতে পারে? আর জুলিয়ান যদি পারস্য থেকে ফিরে না আসেন তবে কী হবে?

    এখন পবিত্র নগরীর প্রতি খ্রিস্টানদের দাবি পুরোপুরি অগ্রাহ্য করে যে রাজকীয় নির্মাণ কর্মসূচি চলছে, তা নিয়ে তাদেরই ভাবার পালা। ৫০ বছর ধরে চার্চের শক্তি দৃশ্যত বেড়েই চলেছিল। কিন্তু জুলিয়ানের ধর্ম ত্যাগ খ্রিস্টানদের দেখিয়ে দিয়েছে, তারা সত্যিই কতটা অরক্ষিত। পুরনো পৌত্তলিক ধর্ম তখনো বিকশিত হচ্ছিল, অনেক বছর ধরে চার্চের বিরুদ্ধে তাদের ক্ষোভ পঞ্জিভূত হয়ে ওঠেছিল। জুলিয়ানের ফরমান প্রকাশিত হওয়ার পর পানেয়াস ও সেবাস্তেতে খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে সত্যিই দাঙ্গায় মত্ত হয়েছিল পৌত্তলিকরা। পুরনো ধর্ম পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার জুলিয়ানের পরিকল্পনা কোনো অবাস্তব স্বপ্ন ছিল না এবং খ্রিস্টানেরা তা জানত। টেম্পল মাউন্টের কাজ শুরু করার দিনটিতে জেরুসালেমের খ্রিস্টানেরা ম্যারটারিয়ামে সমবেত হয়ে এই বিপর্যয় রুখে দিতে ঈশ্বরের কাছে কাতর প্রার্থনা করতে লাগল। তারপর তারা শোভাযাত্রা করে মাউন্ট অলিভেসে গিয়ে ইহুদি সাম গাইল। তারা একে নিজেদের করে নিয়েছিল। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে খ্রিস্টানেরা যে স্থান থেকে ইহুদিদের পরাজয়ের কথা ভেবেছে, এখন সেখান থেকেই তারা ভীতবিহ্বলভাবে টেম্পল প্লাটফর্মে উদ্দীপ্ত তৎপরতা দেখল। তারা তাদের চার্চের উত্থানের সাথে ইহুদি ধর্মের পতনকে এত ওতপ্রোতভাবে জড়িত করতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিল যে নিচে ইহুদি কারিগরদের কাজকে খ্রিস্টান বিশ্বাসের আবরণকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে বলে মনে করল। অবশ্য বিশপ সাইরিল তাদেরকে আশাহত না হতে অনুরোধ করল : তিনি দৃঢ়বিশ্বাসে ভবিষ্যদ্বাণী করলেন যে নতুন টেম্পল কখনো নির্মিত হবে না।

    সাইরিলের ভবিষ্যদ্বাণী দৃশ্যত ২৭ মে সত্যে প্রমাণিত হলো। ভূমিকম্পে পুরো নগরী কেঁপে ওঠল। খ্রিস্টানেরা একে ঐশী প্রতিশোধ বলে মনে হলো। প্লাটফর্মের নিচের ভল্টগুলোতে আগুন লেগে যায়। ভূগর্ভস্থ কুঠুরিগুলোতে জমে থাকা গ্যাস বিস্ফোরিত হয়ে সেখানে জমানো ভবননির্মাণের সামগ্রীতে আগুন ধরে যায়। অ্যালিপিসের সরকারি প্রতিবেদন অনুযায়ী, মাটি থেকে বিশাল বিশাল ‘আগুনের বল’ (গ্লোবি ফ্লেমেরাম) বিস্ফোরিত হয়, অনেক কারিগর আহত হয়। এই সময়ে জুলিয়ান দজলা অতিক্রম করে গিয়েছিলেন। তিনি তার নৌকার সেতু পুড়িয়ে দিয়েছিলেন। ফলে তার সাথে যোগাযোগ করার সুযোগ ছিল না। ফলে অ্যালিপিয়াস সম্ভবত এই বিপর্যয়ের পর রণাঙ্গন থেকে নতুন খবর না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। কয়েক সপ্তাহ পর জুলিয়ান যুদ্ধে নিহত হন, জোভিয়ান নামের এক খ্রিস্টান নিজেকে নতুন সম্রাট ঘোষণা করেন।

    এই ‘অলৌকিক’ ঘটনার পর খ্রিস্টানেরা তাদের উল্লাস গোপন করার কোনো চেষ্টা করেনি : মাউন্ট অলিভস থেকে গলগোথা পর্যন্ত বিস্তৃত একটি বিশাল ক্রুশ আকাশে দেখা যাওয়ার কথা ওঠল। অনেকে এমন দাবিও করল যে জেরুসালেমে অনেক পৌত্তলিক ও ইহুদির পোশাকে রহস্যজনকভাবে ক্রুশ দেখা গেছে। এই চরম উলট-পালটে খ্রিস্টান ও ইহুদিদের মধ্যে বৈরিতাই কেবল আরো তীব্র হয়েছে। জোভিয়ান আবার জেরুসালেম ও এর আশপাশের এলাকায় ইহুদিদের নিষিদ্ধ করেন। তারা যখন অ্যাভ মাসের ৯ তারিখে টেম্পলে এলো শোক জ্ঞাপন অনুষ্ঠানে, তখন শাস্ত্রীয় অনুষ্ঠানে নতুন কষ্ট পরিষ্কারভাবে দেখা গিয়েছিল। রাব্বি বেরাকিয়া লিখেছেন, ‘তারা নীরবে এলো, নীরবেই চলে গেল। তারা কাঁদতে কাঁদতে এসে কাঁদতে কাঁদতে বিদায় নিলো। ধন্যবাদ জ্ঞাপন ও নগরীর চার দিকে শোভাযাত্রার মতো অনুষ্ঠান দিয়ে তা শেষ হলো না। খ্রিস্টানেরা এসব শাস্ত্রাচারকে নতুন অনাচার বিবেচনা করেছিল। বাইবেল বিশেষজ্ঞ জেরমে এই ‘দুর্দশাগ্রস্ত ইতর লোকজনকে টেম্পল মাউন্ট পর্যন্ত এগিয়ে যেতে দেখেছেন। তিনি ধরে নিয়েছিলেন যে তাদের নিস্তেজ দেহ ও ছেড়া পোশাক ছিল তাদের ঈশ্বরের প্রত্যাখ্যাত হওয়ার সুস্পষ্ট চিহ্ন। ইহুদিরা সহানুভূতি পাওয়ার যোগ্য’ নয় বলে তিনি সমাপ্তি টেনেছেন। যিশু ও পল উভয়েই সর্বোচ্চ ধর্মীয় কর্তব্য হিসেবে দানশীলতাকে যে গুরুত্ব দিয়েছিলেন, সেই শিক্ষার প্রতি খুব কমই নজর দিয়েছেন বলে তার কথাতেই বোঝা যাচ্ছে। জেরোমেকে ক্রুদ্ধ করে চতুর্থ শতকের শেষ নাগাদ ইহুদিরা দৃশ্যত তাদের অবস্থান পুনরুদ্ধার করতে পেরেছিল। তারা তখনো দাবি করে আসছিল যে প্রাচীন ভবিষ্যদ্বাণী পূরণ হবে। তারা আস্থার সাথে জেরুসালেমের দিকে তাকিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করছিল ‘প্রভুর ধর্মস্থান পুনঃনির্মিত হবে।’ সময়ের শেষ ভাগে মেসাইয়া আসবেন, স্বর্ণ ও রত্নসম্ভার দিয়ে নগরী পুনঃনির্মাণ করবেন।

    খ্রিস্টানেরা ভুলে যায়নি যে তারা তাদের পবিত্র নগরীটি প্রায় হারাতে বসেছিল। আর তাদের ক্ষমতায় থাকাটা নিশ্চিত বিষয় হিসেবে গ্রহণ করা উচিত হবে না। ফলে তারা সাধারণভাবে ফিলিস্তিনে ও বিশেষভাবে জেরুসালেমে প্রবল খ্রিস্টান উপস্থিতি প্রতিষ্ঠায় দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হলো, যাতে কোনোভাবেই আবার তাদের উৎখাত করা না যায়। খ্রিস্টানেরা ধীরে ধীরে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে শুরু করায় নগরীর চরিত্র বদলে যেতে থাকে। ৩৯০ সাল নাগাদ নগরী সন্ন্যাসী ও নানে পরিপূর্ণ হয়ে গিয়েছিল, বিপুলসংখ্যায় বিদেশী পর্যটকেরা জেরুসালেমে আসছিল। পর্যটকেরা দেশে ফিরে গিয়ে পবিত্র নগরী ও এর মুগ্ধকর উপাসনাপদ্ধতির সম্পর্কে উচ্ছ্বসিত বর্ণনা দিত। অনেকে আবার স্থায়ীভাবে জেরুসালেমে থেকে যেত। জেরোমে ছিলে। চতুর্থ শতকের শেষ দিকে পাশ্চাত্য থেকে আসা নতুন অভিবাসীদের মাত্র একজন : তাদের অনেকে আসতেন তীর্থযাত্রী হিসেবে, অন্যরা ছিল জার্মান ও হুন। তারা ইউরোপের রোমান সাম্রাজ্য থেকে সরে আসতে শুরু করেছিল। উদ্দীপ্ত স্প্যানিশ খ্রিস্টান প্রথম থিওদোসিয়াস ৩৭৯ সালে সম্রাট হওয়ার পর পাশ্চাত্য থেকে এই ঢল আরো বাড়ে। তিনি ৩৮০ সালের ২৪ নভেম্বর কনস্টানটিনোপলে পৌছেন ধার্মিক স্প্যানিয়ার্ডদের সাথে নিয়ে। এসব লোক তার আগ্রাসী গোঁড়ামি বাস্তবায়ন করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিল। থিওদোসিয়াস ৩৮১ সালে রোমান সাম্রাজ্যের সরকারি ধর্মমত হিসেবে নাইসেন খ্রিস্টধর্মকে ঘোষণা করার মাধ্যমে অ্যারিয়ান বিতর্কের অবসান ঘটা। ১০ বছর পর তিনি সব ধরনের পৌত্তলিক বলি প্রায় নিষিদ্ধ করেন, পুরনো মন্দির ও ধর্মস্থান বন্ধ করে দেন। রাজদরবারে সম্রাজ্ঞী আলিয়া ফ্লাসিলাসহ অনেক নারী ইতোমধ্যেই রোমে পৌত্তলিক ধর্মস্থানে হামলা চালিয়ে ও শহিদদের সম্মানে জাঁকজমকপূর্ণ চার্চ নির্মাণ করার মাধ্যমে স্বতন্ত্র পরিচয় তুলে ধরেছিলেন। এখন তারা প্রাচ্যে এই জঙ্গি খ্রিস্টধর্ম নিয়ে গেলেন।

    জেরুসালেমে থিওদোসিয়াস আমলের খ্রিস্টানদের প্রধান লক্ষ্য ছিল মাউন্ট অলিভেসের উপরে থাকা হোস্টেলটি। থিওদোসিয়াসের সিংহাসনে আরোহণের বছর ৩৭৯ সালে এটি প্রতিষ্ঠা করেন জেরোমের পুরনো বন্ধু রুফিনাস ও স্প্যানিশ বংশোদ্ভূত অভিজাত নারী মেলেনিয়া। স্বামীর মৃত্যু পর তিনি সন্ন্যাসব্রত বেছে নিয়ে প্রতাপশালী খ্রিস্টান পণ্ডিত হয়েছিলেন। সন্তানেরা নিজেরা নিজেদের দেখভালের মতো বয়সে পৌঁছার পর তিনি ইউরোপ ত্যাগ করে মিসর ও লেভেন্টের নতুন মঠগুলো সফর করে জেরুসালেমে এসে নিজস্ব মঠ প্রতিষ্ঠা করেন। মাউন্ট অলিভেসে নারী ও পুরুষেরা প্রার্থনা ও অনুশোচনামূলক জীবন অতিবাহিত করতে পারত, শিক্ষা গ্রহণ করতে পারত। এখানে তীর্থযাত্রীদের আশ্রয় ও আতিথিয়তা প্রদান করা হতো। মেলেনিয়া ও রুফিনাস নগরীর জীবনের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিলেন। তাদের সন্ন্যাসী ও নানেরা উপাসনাপদ্ধতিতে উন্নতি বিধান, পাশ্চাত্য থেকে আসা তীর্থযাত্রীদের- তারা উপাসনায় ব্যবহৃত গ্রিক বুঝত না আবার স্থানীয় অনুবাদকদের আরামিকও বোধগম্য হতো না- জন্য দোভাষীর ভূমিকায় পালন করত। মেলেনিয়া ও রুফিনাস উভয়ে ছিলেন আবেগময়ী নিসেন খ্রিস্টান, তারা কনস্টানটিনোপোলের রাজদরবার ও বিদেশের সন্ন্যাসী আন্দোলনগুলোর সাথে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রক্ষা করে চলতেন।

    জেরোমে ও তার বন্ধু পলা ৩৮৫ সালে জেরুসালেমে তীর্থযাত্রা করার সময় মেলেনিয়া হোস্টেলেই অবস্থান করেছিলেন। তারা বেথলেহেমে তাদের নিজস্ব সম্প্রদায়ের মডেলে পরিণত হয়েছিলেন। প্রথমে জেরোমে আকাশছোঁয়া প্রশংসা করেছিলেন মেলেনিয়ার। কিন্তু তিনি ছিলেন খিটখিটে স্বভাবের লোক। খ্রিস্টান দানশীল জীবনযাপনে তিনি অভ্যস্ত ছিলেন না। অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি ধর্মতত্ত্ব বিবাদের কারণে মেলেনিয়ার সাথে কঠিন দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন। এরপর জেরোমে আর কখনো মাউন্ট অলিভেসের এস্টাবলিশমেন্ট সম্পর্কে একটি ভালো কথা ও বলেননি। তিনি এখানকার আয়েসি জীবনযাত্রার প্রতি তাচ্ছিল্য প্রদর্শন করেন। এটি তার কাছে ক্রোয়েসাসের সম্পদের কথা স্মরণ করিয়ে দিত।’ তিনি মেলেনিয়ার সম্প্রদায়ের মার্জিত জীবনযাত্রা, কসমোপলিটান পরিবেশ ও রাজদরবারের সাথে সম্পর্ক রাখার সমালোচনা করেন। তার যুক্তি ছিল, জেরুসালেমের পৌত্তলিক কর্মব্যস্ততার চেয়ে সন্ন্যাসী জীবনের জন্য বেথলেহেমের ‘নির্জনতা’ অনেক বেশি উপযোগী। তার কাছে জেরুসালেম হলো নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা, গ্যারিসন, পতিতা, অভিনেতা, ভাঁড় ও নগরীতে সাধারণভাবে পাওয়া যায় এমন সবকিছুসহ একটি জনাকীর্ণ নগরী। বেথলেহেম সম্প্রদায় ছিল অনেক বেশি ঘনিষ্ঠ বন্ধনে আবদ্ধ ও অন্তর্মুখী। সেখানকার লোকজনই ছিল জেরোমের প্রধান প্রশংসাকারী। অনেক বছর পর্যন্ত তিনি মেলেনিয়ার বিরুদ্ধে তিক্ত প্রচারণা চালান। তবে মেলেনিয়ার খ্যাতি পাশ্চাত্যে ছড়িয়ে পড়েছিল, তার অনুকরণীয় চরিত্রে তীর্থযাত্রীরা অব্যাহতভাবে উদ্দীপ্ত হতো।

    এদের একজন ছিলেন পোয়েমেনিয়া। তিনি ছিলেন রাজপরিবারের সদস্য। তিনিও ৩৯০ সালে জেরুসালেমে আসার আগে উত্তর মিসরের মঠগুলো সফর করেছিলেন। খ্রিস্টের স্বর্গে আরোহণের স্থানটি চিহ্নিত করার জন্য জেরুসালেমে তিনি মাউন্ট অলিভেসের শীর্ষে একটি চার্চ নির্মাণ করেন। পোয়েমেনিয়ার চার্চটি টিকে থাকেনি। এটির পাশে ছিল স্কাইলাইনে আধিপত্য বিস্তার করা একটি বিশাল, চকচকে ক্রুশ। এটি ছিল গোলাকার চার্চ, পাশের একটি পাথর সম্পর্কে তীর্থযাত্রীদের বিশ্বাস ছিল যে এতে তারা খ্রিস্টের পায়ের চিহ্ন দেখতে পান। কাছাকাছি আরো অনেক ভবন দেখা যেতে থাকে। কিদরন ভ্যালির এক প্রান্তে ভার্জিন ম্যারির কবরের পাশে একটি চার্চ নির্মাণ করা হয়েছিল। ভ্যালির অপর প্রান্তে অন্য সন্ন্যাসীরা সদ্ধিান্ত নিয়েছিলেন যে বেনে হেজির কবরটি ছিল জেমস দি জাদিকের কবর। তারা এটিকে চার্চে রূপান্তরিত করেন। ৩৯০ সালের দিকে গার্ডেন অব গেথসেম্যানের স্থানে রাজসিক একটি চার্চ নির্মাণ করা হয়। থিওদোসিয়ান খ্রিস্টধর্ম ধর্মীয় স্থানগুলোর ওপর বিপুল গুরুত্ব দিত, এসব চার্চ জেরুসালেম সামনে নতুন নতুন তত্ত্ব সৃষ্টি করত। নগরীর পৌত্তলিকেরা এখন ক্রমবর্ধমান কর্তৃত্বব্যঞ্জক হওয়া খ্রিস্টান উপস্থিতির মুখোমুখি হতে লাগল। নতুন নতুন চার্চ প্রাচীরগুলোর ভেতরে ও বাইরে আত্মপ্রকাশ ও সম্প্রসারিত হতে লাগল।

    খ্রিস্টানেরাও তাদের প্রধান উৎসবের দিনগুলোতে নগরীর নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করত। ওই সময় বিপুলসংখ্যক মানুষ চার্চগুলো থেকে ঢলের মতো রাস্তায় নেমে এসে পুরো জেরুসালেম চক্কর দিত, গ্রাম এলাকা প্রদক্ষিণ করত। খ্রিস্টধর্ম এখন আর গোপন ধর্ম নয় : লোকজনকে আর ইউচারিস্ট উদযাপনের জন্য লুকিয়ে লুকিয়ে একে অপরের বাড়ি গিয়ে সাক্ষাত করতে হয় না। তারা তাদের নিজস্ব গণ-উপাসনা পদ্ধতি বিকাশ ঘটায়। রোমে তারা শহিদদের কবরগুলোর পাশে সমবেত হতে অভ্যস্ত হয়েছে, তাদের আবেগ ও মৃত্যুর বর্ণনা শুনে তারা জোরে কান্না আর চিৎকারে মেতে ওঠে। তারা বিশপকে নিয়ে রাস্তা দিয়ে শোভাযাত্রা করে এক চার্চ থেকে অপর চার্চে যায়, পুরনো পৌত্তলিক রাজধানীর ওপর তাদের নিজস্ব ভৌগোলিক ভাষ্য আরোপ করে। জেরুসালেমে একই ধরনের ঘটনা ঘটছিল। সেটি পৌত্তলিক আলিয়া থেকে খ্রিস্টান পবিত্র নগরীতে রূপান্তরিত হতে শুরু করেছিল। আমরা এটি দেখি ইগেরিয়ার লেখালেখিতে। এই ধর্মপ্রাণ স্প্যানিশ তীর্থযাত্রী ৩৮১ সালে কনস্টানটিনোপল থেকে জেরুসালেমে এসেছিলেন। ওই সময়েই বিশপরা কাউন্সিলে জড়ো হয়েছিলেন। এই কাউন্সিলেই অবতারবিষয়ক অ্যাথানাসিয়াসের মতবাদ চার্চের আনুষ্ঠানিক শিক্ষার বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়েছিল। ১২ইজেরিয়া ধর্মস্থানের প্রতি থিওদোসিয়ান উদ্দীপনার প্রতি পূর্ণ সমর্থন দিয়েছেন। তিনি নিকটপ্রাচ্যের বিশাল এলাকা সফর করেন, সুদূরের মেসোপটেমিয়ার মতো স্থানেও গিয়েছিলেন, বাইবেলকে ‘ব্লু গাইড’ হিসেবে অভিহিত করেন। তিনি ও তার সফরসঙ্গীরা যেখানেই কোনো পবিত্র স্থানের সন্ধান পেতেন, সেখানেই ‘ওই স্থানবিষয়ক’ ধর্মগ্রন্থ থেকে যথার্থ বাক্য পাঠ করতেন। তার বর্ণনায় বারবার ‘ওই স্থানবিষয়ক’ পরিভাষাটি এসেছে। ইজেরিয়া ছিলেন বর্দুর বাকসংযম তীর্থযাত্রীর চেয়ে অনেক বেশি উচ্ছ্বাসপ্রবণ : বেশির ভাগ খ্রিস্টান যেসব স্থান দেখে কেবল কল্পনা করতে পারত, তিনি সেখানে নিশ্চিতভাবেই রোমাঞ্চিত হতেন। বাইবেল তার চোখের সামনে জীবন্ত হয়ে ধরা দিয়েছিল। সাইরিল যেমনটা বলেছেন, অলৌকিক ঘটনা বা ঈশ্বরের মূর্ত হওয়ার কোনো স্থানের নৈকট্য এসব দূরের ঘটনাকে আরো কাছে নিয়ে আসে, বাইবেল পাঠ পুরনো ধর্মীয় আচারের পুনরাবৃত্তি হয়ে যা অতীতকে বর্তমান বাস্তবতায় পরিণত করে। এই নতুন খ্রিস্টান শাস্ত্রাচার ও পুরনো টেম্পল মতবাদের মধ্যে পার্থক্য ছিল কেবল এটুকুই যে পুরনো টেম্পল মতবাদে আদিম সময়ের পৌরাণিক ঘটনাগুলোর কথা স্মরণ করা হতো, আর নিউ টেস্টামেন্টের ঘটনাগুলো ছিল তুলনামূলক সাম্প্রতিক অতীতের বিষয়।

    ইগেরিয়া জেরুসালেমে পৌছামাত্র এই পবিত্র স্থান-দর্শন ধারণাটি যিশুর জীবন, মৃত্যু ও পুনরুত্থানের পবিত্র ঘটনাবলীতে আনুষ্ঠানিক উপাসনায় অংশগ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি করে। পুরো খ্রিস্টান সম্প্রদায় সংশ্লিষ্ট স্থানের উপযোগী করে তৈরি পরিকল্পিত শোভাযাত্রায় অংশ নিতে থাকে। এগেরিয়া গলগোথায় আঙিনাগুলো পূর্ণ হয়ে রাস্তা ছাপিয়ে যাওয়া লোকজনের উদ্দেশে বক্তব্য রাখেন। ১৪ সেপ্টেম্বর নগরী মেসোপটেমিয়া, সিরিয়া ও মিসরের সন্ন্যাসী ও নানদের দিয়ে কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায়। তারা এসেছিল এনকেইনিয়ার আট দিন উদযাপন করতে। কনস্টানটাইনের নতুন জেরুসালেম ও হেলেনার আসল ক্রুশ আবিষ্কারের প্রতি নিবেদন করে আয়োজন করা হতো এই উৎসবের। এনকেইনিয়াও সোলায়মানের ইহুদি টেম্পল উৎসর্গ করার অনুষ্ঠান সুক্কুথের সাথে অনেকটা সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল। খ্রিস্টানেরা একে তাদের এনকেইনিয়ার ভবিষ্যদ্বাণী বিবেচনা করে আরো গৌরবজনক ঘটনা মনে করেছিল। তীর্থযাত্রীদের স্বাস্থ্যগত অবস্থা ভালো থাকতে হতো : জেরুসালেমে উপাসনা উদযাপনে কেবল সুমোহন সুরে ভজন গওয়া বা যাদকের বক্তৃতা শোনার মধ্যেই সীমিত ছিল না। অংশগ্রহণকারীদেরকে তাদের পায়ের ওপর কয়েক দিন ও কয়েক রাত ভর করে থাকতে হতো, এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় ছুটতে হতো। তারা ‘ক্রিসমাস উইক’ উদযাপন করতেন। এটি শুরু হতো ৬ জানুয়ারি বেথলেহেম থেকে জেরুসালেম পর্যন্ত প্রতিদিন সৌম্য শোভাযাত্রার মধ্য দিয়ে। তারা ভোর হওয়ার আগে পর্যন্ত সদ্য সম্পূর্ণ হওয়া অ্যানাস্তাসিস রোতানদা দিয়ে এখন ঘিরে থাকা কবরের কাছে পৌঁছাত না, সেখানে ভারা চার ঘণ্টার ধর্মীয় কাজে নিয়োজিত হওয়ার আগে অল্প একটু বিশ্রাম নিত। পাম সানডের বিকেলে লোকজন ধর্মীয় উপাসনার জন্য মাউন্ট অলিভেসের ওপর থাকা ইলেওনা ব্যাসিলায় উপস্থিত হতো। এরপর ঢালু বেয়ে নেমে কিদরন ভ্যালি দিয়ে নগরীতে ফিরে আসত। বিশপ সাইরিল একটি গাধার পিঠে চড়ে শোভাযাত্রার পেছনে থাকতেন, ঠিক যেভাবে যিশু উপস্থিত হয়েছিলেন জেরুসালেমে। এসময় শিশুরা খেজুর ও জলপাই শাখা দোলাত, সমবেত সঙ্গীত গাইত, প্রায়ই উচ্চশব্দে বলত : ‘তাদের ওপর আশীর্বাদ বর্ষিত হোক, যারা প্রভুর নামে এখানে এসেছে।’ ইগেরিয়া আমাদের বলছেন যে শোভাযাত্রাটি ধীরে ধীরে এগুত, ফলে লোকজনকে উদ্বেগে থাকতে হতো না, অ্যানাস্তাসিসে পৌছাতে পৌছাতে গভীর রাত হয়ে যেত। পেন্টেকস্ট ছিল বিশেষভাবে কষ্টসাধ্য উৎসব। সাধারণ সানডে ইউচারিস্টের পর সাইরিল ‘ইসপো লোকো’র আত্মার অবতরণ উদযাপন করতে সায়ন ব্যাসিলিকায় শোভাযাত্রায় নেতৃত্ব দিতেন, তবে অনুষ্ঠান সেখানেই সীমিত থাকত না, লোকজন বিকেল বেলা অ্যাসসেনশনের স্মরণে মাউন্ট অলিভেসের শীর্ষে হাঁটাহাঁটি করত। এরপর তারা ধীরে ধীরে ও সংযতভাবে নগরীতে ফিরে আসত, সান্ধ্যকালীন প্রার্থনার (কনস্টানটাইনের ম্যারটিরিয়ামের সান্ধ্যকালীন সার্ভিস) জন্য ইলেওনা ব্যাসিলিকায় থামত। সবশেষে হলি সায়নের ব্যাসিলিকায় মধ্যরাতের প্রার্থনা করত।

    এসব উদযাপন নিশ্চিতভাবেই খ্রিস্টান অভিজ্ঞতা বদলে দিয়েছিল। এখন থেকে যিশুর জাগতিক জীবনের ব্যক্তিগত ঘটনাবলীর প্রতি আগ্রহ ছিল সামান্য। যিশুর মৃত্যু ও পুনরুত্থান একটি একক ঐশী ঘটনা হিসেবে বিবেচিত হতে থাকে। মনে করা হতে থাকে যে মানব-সত্তায় প্রকাশিত এই অতিপ্রাকৃত ঘটনা লোগোসের মাধ্যমে ঈশ্বরের কাছে ফিরে গেছে। তবে এই সময় সন্ন্যাসী, নান, পাদ্রি, সাধারণ মানুষ ও জেরুসালেমের তীর্থযাত্রীরা কিছু বিশেষ সময়ের জন্য সুনির্দিষ্ট ঘটনাবলীর ওপর নজর দিতে উৎসাহিত হয়েছিল। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ইস্টারের আগের সপ্তাহে তারা যিশুর পদাঙ্ক অনুসরণ করত, যিশুর সাথে জুদাসের বিশ্বাসঘাতকতা, তার শেষ নৈশভোজ, তার গ্রেফতারবিষয়ক গসপেলের ভাষ্যে থাকা প্রাসঙ্গিক স্থানগুলো পাঠ করত। এটি ছিল ব্যতিক্রমধর্মী আবেগময় অভিজ্ঞতা। ইগেরিয়া আমাদের বলছেন যে জনতা যখন গেথসেম্যানে চার্চে যিশুর গ্রেফতারের কাহিনী শুনত, তখন ‘সেখানে লোকজনের মধ্যে কান্নার সাথে এমন গোঙানি ও আর্তনাদ শোনা যেত যে প্রায় পুরো নগরীতে কাতরধ্বনি শোনা যেত। ১৩ মানুষ যিশুর প্রতি নতুন সহানুভূতি দেখা গিয়েছিল, লোকজন তার সাথে দুর্ভোগের অভিজ্ঞতা অর্জনের মাধ্যমে বাঁচতে শিখেছিল, দিনে দিনে তারা এই বেদনা তার কাছে কী ছিল তা ক্রমবর্ধমান হারে উপলব্ধি করতে শিখেছিল। ইউসেবিয়া খ্রিস্টানদের বলেছিলেন দুনিয়াতে তার সংক্ষিপ্ত বসবাসের সময় সাময়িকভাবে লোগোসের সাথে তার দৈহিক যে অবয়ব গ্রহণ করেছিলেন, তা ধারণ না করতে। তবে জেরুসালেম উপাসনা তা পুরোপুরি বদলে দেয়। খ্রিস্টানেরা এখন খ্রিস্টের মানব প্রকৃতিতে মনোনিবেশন করেছে। কনস্টানটাইন নতুন জেরুসালেম প্রতিষ্ঠা করার পর থেকেই গলগোথার পাথরটি ছিল কবরটির কাছে দাঁড়ানো : পাথরটি ও সেইসাথে অ্যানাস্তাসিসের আশপাশের স্থানে প্রতিটি দিন আলাদা প্রার্থনা হতো। ফলে লোকজন ক্রুশবিদ্ধকরণ নিয়ে ধ্যান করতে অভ্যস্ত হওয়ার বিষয়টি সুদূরের ঘটনা হিসেবে মনে করে নিয়েছিল। গুড ফ্রাইডেতে পাথরের পেছনে থাকা ছোট চ্যাপেলে একজন একজন করে বিশ্বাসী এগিয়ে গিয়ে সত্যিকারের ক্রসের ভগ্নাবশেষে চুমু খেত। ইউসেবিয়াস কখনো ক্রুশবিদ্ধকরণের ওপর খুব বেশি জোর দেননি, তবে এই মানসিক চাঞ্চল্য উদ্রেককারী উৎসবগুলো খ্রিস্টের মৃত্যুর মানব প্রভাব বিবেচনা করতে এবং মৃত্যুর জন্য মূর্ত হওয়ার অর্থ সম্পর্কে চিন্তা করতে খ্রিস্টানদের বাধ্য করত।

    হলি সেপালচার চার্চের ছাদের উপর থাকা ইথিওপিয়ান মঠের দেয়ালের বিপরীতে শোভাযাত্রার ক্রুশগুলো স্তুপ করে রাখা হতো। চতুর্থ শতক থেকে খ্রিস্টানেরা যিশুর পদাঙ্ক অনুসরণ করে জেরুসালেমের রাস্তাগুলো দিয়ে শোভাযাত্রা বের করত। ফলে অবতারের অর্থ-সম্পর্কিত বিষয়টি বিশেষ গুরুত্ব লাভ করত।

    চলার পথে পড়া কোনো কিছু আর দূরে সরিয়ে দেওয়ার বস্তু বিবেচিত হতো না; খ্রিস্টানেরা একে ঐশী কিছু তাদের সামনে উপস্থিতি বলে মনে করতে শুরু করেছিল। তীর্থযাত্রীরা পুরোপুরি স্পর্শগ্রাহী আধ্যাত্মিকতা বিকাশ ঘটাচ্ছিল। একসময় যিশুর ছোঁয়া পেয়েছিল, এমন পাথরগুলো স্পর্শ করতে, চুমু খেতে, অবলেহন করতে চাইত তারা। জেরোমের শিষ্য পলা যখন কবরে এসেছিলেন, তখন তিনি ইস্টার সানডে সকালে গুহা থেকে গড়িয়ে পড়া পাথরটিতে চুমু খেয়েছিলেন। তারপর ‘ভয়াবহ তৃষ্ণার্থ কোনো লোক দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর পানির কাছে এসে যা করেন, ঠিক একইভাবে যিশু যেখানে শুয়েছিলেন, সেই স্থানটি পলা অবলেহন করেন।১৪ পলার সমসাময়িক নোলার পলিনাস ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে : ‘জেরুসালেমের প্রতি লোকজনের আকৃষ্ট হওয়ার মূখ্য উদ্দেশ্য ছিল যিশু যেখানে মূর্তভাবে উপস্থিত ছিলেন, ওইসব স্থান দেখা ও স্পর্শ করার আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ করা। বিশ্বের অন্যান্য অংশে শহিদদের হাড়, যাতে তাদের পবিত্রতা সংশ্লিষ্ট থাকত, স্পর্শ করে ঐশী শক্তির সংস্পর্শ লাভ করত। মহান কাপ্পাডোসিয়ান ধর্মতাত্ত্বিক নিসার গ্রেগরি (৩৩৮-৯৫) উল্লেখ করেছেন, ‘তারা চোখ, মুখ, কান ও সব ইন্দ্রিয় সক্রিয় করে।১৬ ঈশ্বরই মানবীয় আকার ধারণ করেছেন মনে করে খ্রিস্টানেরা এখন ঐশী সত্তার দৈহিক স্পর্শ লাভ ও আশীর্বাদ সঞ্চালন করতে সক্ষম হতে শুরু করেছিল। গ্রেগরি নিজে ফিলিস্তিন সফর করেছেন। তীর্থযাত্রার নতুন ফ্যাশন সম্পর্কে তিনি সন্দিহান থাকলেও তিনি স্বীকার করেছেন যে জেরুসালেমের পবিত্র স্থানগুলো ছিল ভিন্ন। তারা ‘খোদ জীবনের পদাঙ্গ লাভ করেছে।১৭ ঈশ্বর ফিলিস্তিনে নিজে আলামত রেখে গেছেন, ঠিক যেভাবে সুগন্ধী ব্যবহারকারী কক্ষ থেকে বের হয়ে গেলেও সেখানে ঘ্রাণ দীর্ঘ সময় থাকে। তীর্থযাত্রীরা এই সময় সাথে করে পবিত্র স্থানগুলোর পাথর, মাটি বা সেখানে জ্বালানো বাতির তেল দেশে নিয়ে যেত। এক বিশেষভাবে উন্মাদ তীর্থযাত্রী সত্যি সত্যি গুড ফ্রাইডেতে ট্রু ক্রুশে’ চুমু খাওয়ার সময় এ থেকে কিছু অংশ কামড়ে নিয়েছিল। লোকজন জেরুসালেমের ঐশী উপস্থিতিকে তাদের নিজ শহরে সক্রিয় ও সহজলভ্য করে তুলতে চেয়েছিল।

    খ্রিস্টান প্রত্নতত্ত্ব গলগোথায় ব্যাপক খনন কার্যক্রম শুরু করেছিল। এখন ফিলিস্তিনের অন্যান্য অংশেও নতুন নতুন খননে সন্ন্যাসীদের দেহ ও বাইবেলের নায়কেরা বের হয়ে আসতে লাগলেন। যোশেফ দি প্যাট্রিয়াকের দেহ হিসেবে যেটাকে মনে করা হলো সেটি শেচেম, এখন নেয়াপোলিশ নামে পরিচিত, স্থানের কবর থেকে তোলা হয়েছিল। লাশটি কনস্টানটিনোপলে স্থানান্তর করা হলো। জেরোমে জানিয়েছেন, নবী স্যামুয়েলের হাড়গোড় যখন ফিলিস্তিন থেকে রাজকীয় রাজধানীতে নেওয়া হচ্ছিল, তখন রাস্তায় রাস্তায় লোকজন লাইন ধরে দাঁড়িয়েছিল; তাদের মনে হয়েছিল, খোদ নবী উপস্থিত রয়েছেন।১৮ পবিত্র হাড়গোড়ের এসব দখল ছিল নতুন খ্রিস্টান নগরী কনস্টানটিনোপলকে পবিত্র অতীতের সাথে সম্পর্কিত করার চেষ্টা। অন্যথায় সেই অতীত থেকে এই নগরী বঞ্চিত থাকত। আবার তা ইহুদি ইতিহাসকেও সংশোধনের চেষ্টা ছিল : চার্চ যদি তার দাবি অনুযায়ী নতুন ইসরাইল হয়ে থাকে, তবে ওল্ড কভেন্যান্টের এসব সন্ন্যাসীর দুরাচারী ইহুদিদের নগরীর চেয়ে খ্রিস্টান ভূখণ্ডের আবাসভূমিতেই থাকা অনেক বেশি যৌক্তিক। ৪১৫ সালে ইস্টার্ন সম্রাট দ্বিতীয় থিওদোসিয়াস প্রকাশ্যে ইহুদি প্যাট্রিয়ার্ক দ্বিতীয় গামালিয়েলকে তিরস্কার করে তার কাছ থেকে রোমান পদবি (প্রায়েফেকটাস প্রায়েটোরিও) কেড়ে নেন। সম্রাট এর মাধ্যমে এমন এক প্রক্রিয়ার সূচনা করেন যার পরিণতিতে ৪২৯ সালে প্যাটিয়ার্ক পদটিরই অবসান ঘটে। এর জের ধরে ইহুদি ধর্মের অনিবার্য পতন ত্বরান্বিত করবে বলে চার্চের কর্মকর্তারা বিশ্বাস করতেন। ১৯

    এরপর ৪৫ সালে এক যাজক আরেকটি প্রত্নতাত্ত্বিক আবিস্কার করেন। এটি ইহুদি প্যাট্রিয়ার্কের নিদারুণ লজ্জার সাথে সম্পর্কিত ছিল। উপকূলীয় সমভূমি কেফার গামালা গ্রামের যাজক লসিয়ান স্বপ্নে দেখেছিলেন যে সেন্ট পলের শিক্ষক রাব্বি প্রথম গামালিয়েল স্বপ্নে তার সামনে হাজির হয়েছেন। মহান ফারিসি তাকে বলেন যে তিনি গোপনে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষা গ্রহণ করেছিলেন, কিন্তু ইহুদিদের ভয়ে তা গোপন করেছিলেন। প্রথম খ্রিস্টান শহিদ স্টেফেনকে যখন তাওরাত ও টেম্পলের ওপর আক্রমণের জন্য জেরুসালেমের প্রাচীরের বাইরে হত্যা করা হয়, তখন গামালিয়েল লাশটি গ্রহণ করে গামালায় তার এস্টেটে কবর দিয়েছিলেন। পরে ওই কবরের পাশে তিনি নিজেও সমাধিস্থ হন। আরো পরে রাতে গোপনে যিশুর সাথে একবার সাক্ষাতকারী তরুণ ইহুদি নিকোদেমাসও সেখানে সমাহিত হন। স্বপ্ন দেখার পর দিন লসিয়ান কিছু অনুসন্ধান করে হিব্রু খোদাইলিপিসহ তিনটি কবর আবিষ্কার করেন। স্বপ্নে রাব্বি যেমনটি বলেছিলেন, এর সাথে তা একেবারে মিলে গেল। সাথে সাথেই তিনি তার আশ্চর্য আবিষ্কারের কথা তার বিশপকে জানান।

    এই ঘটনার সময় লিড্ডার কাছে (বর্তমানে একে বলা হয় ডায়য়োসপলিস) চার্চ কাউন্সিলের সভায় সভাপতিত্ব করছিলেন জেরুসালেমের বিশপ জন। তিনি ব্রিটিশ সন্ন্যাসী পেলেজিয়াসের ভাগ্য নির্ধারণে বসেছিলেন। এ লোকটি আদি পাপের মতবাদ অস্বীকার করে জেরুসালেমের পাশ্চাত্য খ্রিস্টানদের কলঙ্কিত করছিলেন। অবশ্য জন নিজে পেলেজিয়াসের ধর্মতত্ত্বে তেমন ক্ষতিকর কিছু দেখতে পাননি। কিন্তু লসিয়ানের খবর শোনামাত্র তিনি সেবাস্তে ও জেরিকোর বিশপদের নিয়ে তড়িঘড়ি করে কেফার গামালায় যাত্রা করলেন। স্টেফেনের কবর খোলামাত্র মিষ্টি সুগন্ধে পুরো এলাকা ভরে গেল। লসিয়ান এ ব্যাপারে বলেছেন, ‘আমাদের কাছে মনে হলো, আমরা স্বর্গে আছি।২০ শহিদদের কবরগুলোর ব্যাপারে এটি ছিল সাধারণ অভিজ্ঞতা। বতর্মানে স্বর্গে থাকা সন্ন্যাসীটির দেহ এই দুনিয়া ও পরবর্তী দুনিয়ার মধ্যে সংযোগ সাধন করেছে। স্থানটি এর ফলে পবিত্রতার নতুন ‘কেন্দ্রে’ পরিণত হলো, যা পবিত্রতার রাজ্যে উপাসনাকারীদের নিয়ে যেতে সক্ষম এবং তাদেরবে ঈশ্বরের শক্তি ও আরোগ্যকারী উপস্থিতি দিতে পারে। ইউরোপে শহিদদের কবরে বিশ্বাসীরা পবিত্রতার স্পর্শযোগ্য অলৌকিক আভায় শান্তি পেত। শহিদদের আবেগময় কাহিনী জোরে জোরে পাঠ করার সময় ওই পবিত্র আভা উপাসনালয় পরিপূর্ণ থাকত, বাতাস সুগন্ধীতে মৌ মৌ করত, ঐশী প্রভাব লাভে ধন্য হয়ে লোকজন চিৎকার করে কাঁদত।২১ এখন সমগ্র ফিলিস্তিন থেকে লোকজন কেফার গামালায় আসতে শুরু করল, ৭৩ জন অসুস্থ লোক সুস্থ হয়ে গেল।

    অবশ্য কেফার গামালাকে তীর্থযাত্রার কেন্দ্রে পরিণত হতে দেওয়ার কোনো ইচ্ছা ছিল না জনের। তিনি বরং তার নিজের অবস্থান জোরদার করতে এই অলৌকিক আবিষ্কারকে ব্যবহার করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন। পূর্বসূরীদের মতো তিনিও জেরুসালেমের মর্যাদা বাড়াতে চাইছিলেন। এ লক্ষ্যে তিনি সব চার্চের মা হিসেবে মাউন্ট সায়নের ওপর সম্প্রতি ব্যাসিলিকাটি পুনঃনির্মাণ করেছিলেন। এখন তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, স্টেফেন এই নতুন ব্যাসিলিকায় সমাহিত হবেন, এটিই সঠিক ব্যাপার। তিনি তখন চার্চটিতে ডেকন হিসেবে কাজ করছিলেন। ২৬ ডিসেম্বর হাড়গোড় মাউন্ট সায়নে নিয়ে আসা হলো। অবশ্য খ্রিস্টানদের কাছে আরোগ্য ও ঐশী উপস্থিতি নিয়ে আসা এই আবিষ্কার ছিল ইহুদি ধর্মের প্রতি ‘অনিবার্যভাবেই অনিষ্টকর। স্টিফেনের মারা যাওয়ার কারণ তিনি তাওরাত ও টেম্পলের ওপর আক্রমণ করেছিলেন; তিনি ইহুদিদের শিকার। মহান রাব্বি গ্যামালিয়েলের আবিষ্কার, পূর্বপুরুষ ও বর্তমান প্যাট্রিয়ার্কের একই নাম, প্যাট্রিয়ার্ক পদের ইহুদি সততা ক্ষতিগ্রস্ত করার গোপন খ্রিস্টান প্রয়াস ছিল। তখনো খ্রিস্টান বৃদ্ধি বিবেচনা করা হতো বর্তমান বিশ্বাসের প্রত্যাখ্যানের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত বিষয় হিসেবে।

    দ্বিতীয় থিওদোসিয়াসের দরবার ছিল তপস্যা চর্চার আবেগে আপ্লুত। বস্তুত, এটি ছিল মঠের মতো। সম্রাটের বোন পলচেরিয়া উৎসর্গ করা পবিত্র কুমারী হিসেবে এখানে বাস করতেন। অনিবার্যভাবে এ আমলটি জেরুসালেমের ভেতরে ও আশপাশের আশ্রমের পুনরুত্থান দেখেছিল। জেরোমের বৈরিতা মেলেনিয়া ও রুফিনাসের জন্য পবিত্র নগরীকে এত বিষাক্ত করে ফেলেছিল যে তারা ৩৯৯ সালে ইউরোপে ফিরে যেতে বাধ্য হন। অবশ্য মেলেনিয়ার নগরী ত্যাগ করার পেছনে পারিবারিক বিবেচনাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। তবে ৪১৭ সালে তার নাতনি, সাধারণভাবে ছোট মেলেনিয়া নামে পরিচিত, স্বামী পিয়নিয়াসকে নিয়ে জেরুসালেমে আসেন। তারা ১৮০ জন সন্ন্যাসী ও নানের জন্য মাউন্ট অলিভেসে একটি নতুন দ্বৈত আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন। মেলেনিয়া পোমেনিয়ার চার্চের পাশে একটি শহিদগাহ, পুরাতাত্ত্বিক সামগ্রীর উপাসনালয় নির্মাণ করেছিলেন। ২০ বছর পর ইবেরিয়া রাজ্যের জনৈক রাজপুরুষ পিটার, ২২ তিনি কনস্টানটিনোপলের রাজদরবারে বাস করছিলেন, তথাকথিত দাউদ টাওয়ারে একটি আশ্রম নির্মাণের জন্য জেরুসালেম আসেন। দাউদ টাওয়ার আসলে ছিল হেরড টাওয়ার হিপ্লিকাসের অংশবিশেষ। তিনি মাউন্ট অলিভেসে মেলেনিয়ার শহিদিগাহে তার জন্য পুরাতাত্ত্বিক উপহার নিয়ে আসেন।

    জেরুসালেমের পবিত্রতার মাধ্যমে এই সুন্দর তবে পতিত অঞ্চল জুদা মরুভূমিতে উপনিবেশ গড়ার জন্য খ্রিস্টান বিশ্বের সব অংশ থেকে সন্ন্যাসীরা আসতে শুরু করেছিল। প্রথম দিকে আগত সন্ন্যাস পথিকৃতদের অন্যতম ছিলেন আর্মেনিয়ার সন্ন্যাসী ইথিমিনাস (মৃত্যু ৪৭৮)। তিনি মাসাদা ও বেথলেহেমের দর্শনীয় স্থানগুলোতে প্রায় ১৫টি আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তাকে তার সমসাময়িকেরা দ্বিতীয় আদম বিবেচনা করত : তার ক্যারিয়ার মানবতার জন্য নতুন যুগের সূচনা করেছিল বলে বিশ্বাস করা হয়ে থাকে।২৩ তাদের আশ্রমগুলোতে সন্ন্যাসীরা বাগান করতেন, ফলের গাছ লাগাতেন, মরুভূমিকে বিকশিত করে তুলতেন, এই ভৌতিক রাজ্যকে ঈশ্বরের জন্য পুনরুদ্ধার করতেন। আর এর মাধ্যমে প্রতিটি বসতি হতো একটি নতুন ইডেন, একটি নতুন সূচনা। এখানে সন্ন্যাসীরা প্রথম আদমের মতো ঈশ্বরের ঘনিষ্ঠতায় স্বর্গীয় জীবনে বাস করতে পারতেন। আশ্রমগুলো তাই ছিল নতুন ধরনের পবিত্র স্থান, অন্ধকারের শক্তির বিরুদ্ধে খ্রিস্টান অভিযান। এখানে লোকজন বলত যে সন্ন্যাস জীবন এমন এক আদি সম্প্রীতি ও সামগ্রিকতায় ফিরিয়ে নিতে পারে যার জন্য মানুষ আকাঙ্ক্ষা করে। অল্প সময়ের মধ্যেই ল্যাতিন, পারসিক, ভারতীয়, ইথিওপিয়ান ও আর্মেনিয়ানরা দল বেঁধে জুদার আশ্রমগুলোতে ভিড় করতে থাকে। ইথিমিনাসের অন্যতম প্রভাবশালী শিষ্য ছিলেন সাবাস (৪৩৯-৫৩১)। কাপ্পাডোসিয়ান এই লোক পরিকল্পিতভাবে জুদায় বাস করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন পবিত্র স্থানগুলোর সান্নিধ্য থাকায়। সব পবিত্র স্থানের মতো তার আশ্রমও স্বপ্নাবিভাবে ঈশ্বর দেখিয়ে দিয়েছিলেন। পাঁচ বছর পর্যন্ত সাবাস একাকী জেরুসালেম থেকে ৯ মাইল দক্ষিণের একটি উঁচু খাড়া পাহাড়ে (এখান থেকে ব্রুক কিদরন দেখা যেত) বাস করতেন। তারপর শিষ্যরা তার সাথে যোগ দিতে থাকে, তারা প্রত্যেকেই আলাদা আলাদা গুহায় বাস করতেন। পরে ধীরে ধীরে এলাকাটি মরুভূমির মধ্যে নতুন একটি আশ্রম নগরীতে পরিণত হয়। সেক্স, ঘুম, খাবার ও সামাজিক মতবিনিময়ের মতো স্বাভাবিক প্রয়োজনগুলো প্রত্যাখ্যান করে একাকী বাস করে এসব সন্নাসী বিশ্বাস করতেন যে প্রথম আদমকে ঈশ্বর যে শক্তি দিয়েছিলেন, তারাও নিজেদের জন্য তা আবিষ্কার করতে পারবেন। এ কারণে তারা পতনের প্রভাব রুখে দিয়ে ঈশ্বরের স্বকীয় পবিত্রচিত্ততা অনুসরণ করতেন। অবশ্য সাবাসের আরেকটি লক্ষ্য ছিল। তার জীবনীকার বলেছেন, ‘মহিমাময় ইসাইয়ার এ সম্পর্কিত ভবিষ্যদ্বাণী পূরণ করার জন্য [মরুভূমিকে] উপনিবেশ বানানো ছিল তার একটি অনিবার্য লক্ষ্য।২৪ দ্বিতীয় ইসাইয়া প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে মরুভূমি ফুলে ফুলে ভরে নতুন ইডেনে পরিণত হবে : এখন সাবাস ও তার সন্ন্যাসীরা বিশ্বাস করতেন যে এসব পবিত্র বসতি নবীদের ভবিষ্যদ্বাণী করা চূড়ান্ত পরিত্রাণকে এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে আসবে। তবে আগে যেখানে বলা হতো, এই পরিত্রাণ পাবে ইহুদিরা, এখন বলা হতে লাগল যে তা পাবে খ্রিস্টানেরা।

    খ্রিস্টান জেরুসালেমের বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানের মতো নতুন সন্ন্যাস উদ্যোগও সহজাতভাবেই ইহুদিদের প্রতি বৈরী ছিল। ৪৩৮ সালে দ্বিতীয় থিওদোসিয়াসের স্ত্রী সম্রাজ্ঞী ইউদোকিয়ার তীর্থযাত্রার সময় এটি মর্মান্তিভাবে দেখা গিয়েছিল। ইউদোকিয়া ছিলেন ধর্মান্তরিত খ্রিস্টান : তিনি ছিলেন অ্যাথেন্সের বিখ্যাত এক দার্শনিকের মেয়ে, নিজেও ছিলেন জ্ঞানী নারী। বুদ্ধিমতী ধর্মান্তরিত এই সম্রাজ্ঞী দৃশ্যত ইহুদি ধর্মের প্রতি খ্রিস্টানদের সহজাত বিরূপতা সম্পর্কে অবগত ছিলেন না। এ কারণেই সম্ভবত তিনি ইভের নবম দিন ছাড়া অন্য দিনগুলোতে টেম্পল মাউন্টে প্রার্থনা করতে ইহুদিদের অনুমতি দিয়েছিলেন। স্বাভাবিকভাবেই এটি অনেক খ্রিস্টানকে আতঙ্কিত করেছিল। অবশ্য ইউদোকিয়ার উচ্চ মর্যাদার কারণে তাদের পক্ষে প্রতিবাদ করা সম্ভব ছিল না। সম্রাজ্ঞীর অবাক করা ফরমান অনেক ইহুদিকে আসন্ন মুক্তির আশার সঞ্চার করে : বলা হয়ে থাকে বিভিন্ন দেশে থাকা ইহুদি সম্প্রদায়ের মধ্যে একটি চিঠি প্রচার করে তাদেরকে সুকোথ উৎসব উদযাপন করার জন্য জেরুসালেমে আসতে তাগিদ দেওয়া হয় যাতে সেখানে রাজ্য প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়।২৫ সুকোথের সময়ই কাকতালীয়ভাবে সম্রাজ্ঞীর ফিলিস্তিন সফর ঘটে। উৎসবের প্রথম দিন ইউদোকিয়ার বেথলেহেমে থাকার দিন ইহুদিরা বিপুলসংখ্যায় টেম্পল মাউন্টে জমায়েত হয়।

    তবে কেবল তারাই ছিল না। ইহুদি সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে সহিংসতার জন্য আলোচিত সিরিয়ান সন্ন্যাসী বার সাওমাও সুকোথের জন্য জেরুসালেমে হাজির হন। তিনি সতর্কতা অবলম্বন করে নিরীহ ভাব নিয়ে একটি মঠে অবস্থান করেন। তবে অন্য সন্ন্যাসীরা টেম্পল প্লাটফর্মের ওপর ওঁত পেতে ছিল ইহুদিদের আগমনের জন্য। কয়েক শ’ বছরের মধ্যে এই প্রথম ইহুদিরা খেজুর গাছের ডাল দোলাতে দোলাতে বিধ্বস্ত দরবারের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। বার সাওমার জীবনীকার আমাদের বলেন, হঠাৎ করেই অদ্ভূতভাবে পাথর-বর্ষণ করে তাদের ওপর আক্রমণ চালানো হয়, স্বর্গ থেকে বৃষ্টির মতো ইহুদির ওপর পাথর নেমে আসতে থাকে। মাউন্টেই অনেক ইহুদি নিহত হয়, অন্যরা পালাতে গিয়ে মারা পড়ে, তাদের লাশে নগরীর রাস্তা আর আশপাশের এলাকা পরিপূর্ণ হয়ে যায়। তবে জীবিতরা দ্রুত পরিস্থিতি সামলে নেয়। তারা বার সাওমার ১৮ জন শিষ্যকে আটক করে তাদের নিয়ে বেথলেহেমে যায়। তাদের হাতে তখনো ছিল খেজুর শাখা, ইউদোকিয়ার সামনে প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপনের জন্য। সম্রাজ্ঞী মারাত্মক বিপদ দেখলেন। সন্ন্যাসীরা মরুভূমির আশ্রমগুলো থেকে ছুটে এলো। অল্প সময়ের মধ্যেই জেরুসালেম ও বেথলেহেমের রাস্তাগুলো ক্রুদ্ধ আশ্রম-দাঙ্গাবাজদের ভিড়ে পরিপূর্ণ হয়ে যায়। তারা স্পষ্ট করে জানায়, ইউদোকিয়া যদি বন্দিদের শাস্তি দেন, তবে তারা তাকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারবেন। ছয় দিন পর রাজকীয় প্রতিনিধি ক্যাসারিয়া থেকে আসেন। তিনি জেরুসালেমে প্রবেশ করতে ভয় পান। তাকে বার সাওমার উপস্থিতিতে বন্দিদের পরীক্ষা করতে অনুমতি দেওয়া হয়। একটি আপসরফা হয়। গভর্নরের তদন্তকারীরা এই খবর নিয়ে আসেন যে ওই ভয়াল রাতে যেসব ইহুদি নিহত হয়েছিল, তাদের মৃত্যু হয়েছিল স্বাভাবিকভাবে। বার সওমা রাস্তায় রাস্তায় প্রকাশ্যে ঘোষণা করেন : ক্রুশের বিপুল বিজয় ঘটেছে!’ জনতা উল্লাসে ফেটে পড়ে, বার সাওমাকে উল্লসিত লোকজন মাউন্ট সায়নে নিয়ে যাওয়া হয়, সেখানে ব্যাসিলিকায় বিজয় উৎসব করা হয়।

    ইউদোকিয়ার সফর অবশ্য বেশ ইতিবাচকভাবে শেষ হয়েছিল। ৪৩৯ সালের ১৫ মে তিনি সেন্ট স্টিফেনের সম্মানে একটি ছোট উপাসনালয় উৎসর্গ করেন। স্থানটি ছিল নগরীর উত্তর গেটের বাইরে। এখানেই সেন্ট স্পিফেনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়। পর দিন তিনি মাউন্ট অলিভেসের উপর মেলেনিয়ার ম্যারটিরিয়ামে সন্ন্যাসীর একটি পবিত্র বস্তু নিয়ে যান। এরপর তিনি কনস্টানটিনোপলে ফিরে যান। সেখানে তার মিশ্র অভিজ্ঞতা সত্ত্বেও তিনি ফিলিস্তিনে সুখী ছিলেন। এরপর ৪৪৪ সালে রাজপরিবারের সাথে তার মতানৈক্য হলে, বিশেষ করে সম্রাজ্ঞীর ধার্মিক বোন পলচেরিয়ার সাথে বিবাদে জড়ানোর পর তাকে জেরুসালেমে নির্বাসন দেওয়া হয়। উচ্চ মর্যাদার কারণে তিনি ফিলিস্তিনের শাসকে পরিণত হন। জেরুসালেম ও আশপাশের এলাকায় তিনি বেশ কয়েকটি নতুন চার্চ ও সেবাসদন নির্মাণ করেন : একটি ছিল সিলোয়াম পুলে, এখানে যিশু এক অন্ধ ব্যক্তিকে সুস্থ করেছিলেন, একটি ছিল মাউন্ট সায়নে সাইফাসের অনুমিত বাসভবনে সেন্ট পিটারের সম্মানে, একটি ছিল হলি উইজডোমের সম্মানে, যেটিকে ভুলবশত টেম্পল মাউন্টের পশ্চিমে টাইরোপোয়ন ভ্যালির পিলেতের প্রায়েটারিয়ামের স্থানে বলে মনে করা হতো। ইউদোকিয়া টেম্পল মাউন্টের দক্ষিণ- পূর্ব কোণে, ‘টেম্পলের পিন্যাকলের নিচে নিজের জন্যও একটি প্রাসাদ নির্মাণ করেছিলেন। পরে এই বাসভবনটি ছয় শ’ নানের কনভেন্টে পরিণত হয়েছিল। তিনি জেরুসালেমের জন্য একটি নতুন নগর -প্রাচীর নির্মাণ করেছিলেন বলেও জনশ্রুতি রয়েছে। এটি নগরের সীমা দক্ষিণ দিকে সম্প্রসারিত করে ওফেল ও মাউন্ট সায়নের ওপর পুরনো ইর ডেভিডকে অন্তর্ভুক্ত করেছিল।২৬

    জেরুসালেম শাসন করার সময় ইউদোকিয়া ব্যক্তি ও খ্রিস্টের প্রকৃতিবিষয়ক চলমান মতবাদগত বিরোধেও জড়িয়ে পড়েছিলেন। ৪৩১ সালে ইফেসাস কাউন্সিল কনস্টানটিনোপলের প্যাট্রিয়াক নেস্টোরিয়াসের উপেক্ষার নিন্দা করে। তিনি ঘোষণা করেছিলেন যে যিশুর দুটি প্রকৃতি রয়েছে, মানবীয় ও ঐশী : মেরি ছিলেন না থিওটোকোস তথা ঈশ্বর-ধারক, বরং তিনি ছিলেন কেবল মানুষ যিশুর মা। কাউন্সিলের পর উত্তর সিরিয়ার নেস্টোরিয়াসের সমর্থকেরা আলাদা হয়ে তাদের নিজস্ব চার্চ প্রতিষ্ঠা করে। নানা কারণে বাকি খ্রিস্টানেরা সরকারি নিসেন অর্থোডক্সির প্রতি অসন্তুষ্ট ছিল। কনস্টানটিনোপলের কাছাকাছি এক মঠের প্রবীণ অধ্যক্ষ ইউতিচেস অন্য পথ ধরলেন। তিনি জোর দিয়ে বলতে থাকলেন যে যিশুর মাত্র একটি প্রকৃতিই ছিল (মন ফিসিস)। এটি ঐশী লোগোস, যিনি ভার্জিন ম্যারির মাধ্যমে জন্মগ্রহণ করেন, ক্রুশে মারা যান। এটি অর্থোডক্সকে আঘাত করে। কারণ ‘মনোফাইসিতরা’, তারা নিজেদের এমন দাবিই করত, দৃশ্যত যিশুর মানবীয় অবস্থাটি দেখতে ভুলেই গিয়েছিল, খ্রিস্টের সামগ্রিক ঐশী তত্ত্বে বিশ্বাস করত। সিরিয়া, ফিলিস্তিন ও মিসরের অনেক বিশপ ও সন্ন্যাসী কনস্টানটিনোপল থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা হিসেবে মনোফাইসিবাদের পক্ষে সমর্থন দিলো। তারাও আলাদা চার্চ গঠন করল। জেরুসালেম এখন তাদের প্রতিনিধিত্ব করত কপ্ট, ইথিওপিয়ান, আর্মেনিয়ান ও সিরিয়ান জ্যাকোবিতরা। তারা কেবল জাতীয় স্বাধীনতাই সমর্থন করছিল না, সেইসাথে প্রধান ধর্মীয় প্রশ্নেরও সমাধান করছিল : সীমা অতিক্রমকারী ঐশী সত্তা কিভাবে মানুষের দুনিয়ার সাথে সংযোগ স্থাপন করতে পারে? প্রাচীন কালে লোকজন মনে করত, মন্দিরগুলো ঐশী সত্তার সাথে সংযোগ স্থাপন করে। অবশ্য খ্রিস্টানেরা অবাক করা একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিল যে ঈশ্বর স্থায়ীভাবে ঈশ্বর- মানব যিশুর ব্যক্তিতে মানুষের সাথে নিজেকে সংযুক্ত করেছিলেন। এই জটিলতা অবসানের জন্য বিভিন্ন খ্রিস্ট তত্ত্বও সামনে এসেছিল।

    ইউদোকিয়া, আংশিকভাবে পলচেরিয়া ও রাজপরিবারের সাথে তার বিবাদের জের ধরে, জেরুসালেমে মনোফাইসিতদের সমর্থন করেন। নগরীর বিশপ জুভেনালও একই কাজ করেন। রোমের বিশপ পোপ লিও দি গ্রেট তাকে তিরস্কার করেন। তিনি অভিযোগ করেন, পবিত্র স্থানগুলোর অভিভাবক জুভেনালের জন্য নীতিগর্হিত কাজ এই যে তিনি এমন এক মতবাদের শিক্ষা দিচ্ছেন যা খ্রিস্টের মানব সত্তাকে অস্বীকার করে। যিশুর প্রধান শিষ্য সেন্ট পিটারের উত্তরসূরি হিসেবে রোমের বিশপ ব্যাপকভাবে চার্চের প্রধান কর্মকর্তা (প্রিলেত) বিবেচিত হতেন। লিও এখন অবতারবাদের পেছনে তার কর্তৃত্ব প্রয়োগ করলেন। একটি সরকারি ‘বৃহৎ’ গ্রন্থে তিনি যুক্তি দিলেন যে গসপেলগুলোতে যিশুর মানবীয় ও ঐশী সত্তার সহাবস্থানের ওপর অব্যাহতভাবে জোর দিয়েছে। তিনি দাবি করলেন, জেরুসালেমের পবিত্র স্থানগুলো ছিল এই ‘অকাট্য প্রমাণ’ যে ঈশ্বর নিজে বস্তুগত দুনিয়ায় যোগ দিয়েছেন। এক শ’ বছর ধরে এসব পবিত্র স্থানে খ্রিস্টানদের অভিজ্ঞতা অবিতর্কিতভাবে প্রমাণ করে আসছে যে বস্তুগত সামগ্রী মূর্ত লোগোস পবিত্রতার সাথে লোকজনকে শক্তির সংযোগ সাধন করে। এগুলো যিশুর মানবীয় রূপের দৈহিক বাস্তবতার কথাই সাবলীলভাবে স্মরণ করিয়ে দেয়। লিও গ্রন্থটি ৪৫১ সালে এশিয়া মাইনরের চালসেডনে পলচেরিয়ার তলব করা চার্চ সম্মেলনের ধর্মগ্রন্থের ব্যবস্থা করে। এই কাউন্সিলে বিশপ জুভেনাল দল বদল করে অর্থোডক্স শিবিরে যোগ যে পুরস্কারটি লাভ করেন তা মাকারিয়সের সময় থেকে জেরুসালেমের বিশপেরা কামনা করে আসছিলেন। জেরুসালেমের বিশপীয় এলাকার কর্তা হলেন প্যাট্রিয়ার্ক। এর মাধ্যমে তিনি ক্যাসারিয়া, বেথ শা ও পেত্রা এলাকার বিশপদের ওপর অগ্রগণ্যতা লাভ করলেন।

    ইউদোকিয়া ও জেরুসালেমের খ্রিস্টানেরা জুভেনালের পক্ষ ত্যাগের খবর শুনে সহজাতভাবেই প্রতারিত হয়েছেন মনে করলেন। তারা মনোফাইসিত থিওদোসিয়াসকে তাদের নতুন বিশপ নিযুক্ত করলেন। ক্রুদ্ধ সন্ন্যাসীদের দল জুদার আশ্রমগুলো থেকে জেরুসালেমে ধেয়ে আসতে থাকে। ফলে এক সৈন্যের পাহারায় প্যাট্রিয়ার্ক জুভেনাল গোপনে বাড়ি ফেরেন। তারপর তিনি মরুভূমিতে পালিয়ে যান, সেখানে কামরানে পশ্চিমে রুবরায় তিনি লুকিয়ে বাস করতে থাকলেন। তবে চার্চের বিভ্রান্তি ইউদোকিয়াকে বিভ্রান্তিতে ফেলল। ৪৫৭ সালে বিশপ থিওদোসিয়া মারা গেলে তিনি প্রখ্যাত সিরিয়ান সন্ন্যাসী সিমিয়ন স্টালাইটের কাছে পরামর্শ কামনা করলেন। তিনি তাকে আর্মেনিয়ান সন্ন্যাসী নেতা ইউথিমিয়াসের পরামর্শ নিতে বললেন। তার শিক্ষায় ইউদোকিয়া এতই অভিভূত হয়ে পড়লেন যে তিনি অর্থোডক্স মতবাদে দীক্ষা গ্রহণ করে ফেললেন। অর্থোডক্স প্যাট্রিয়ার্ক অ্যাসতাসিয়া নিযুক্ত হয়েছিলেন জুভেনালের স্থানে। তিনি অ্যানাসতাসিসের কাছে তার জন্য ইউদোকিয়ার নির্মিত নতুন প্রাসাদে বাস করতে ওঠলেন। ইউদোকিয়ার শেষ প্রকল্প ছিল একটি চার্চ ও সেন্ট স্টিফেনের জন্য আশ্রম নির্মাণ। এটি ৪৩৯ সালে তার উৎসর্গ করা সাধারণ উপাসনালয়ের স্থানে হয়েছিল। শহিদের হাড়গোড় ৪৬০ সালের ১৫ জুন নিয়ে আসা হয়। চার মাস পর ইউরোদিকিয়া মারা যান। তাকে চার্চে সমাহিত করা হয়।

    জেরুসালেম এখন নিসেন অর্থোডক্সির কেন্দ্র। তবে অন্যান্য চার্চ তখনো মতবাদগত সঙ্ঘাতে জর্জরিত। কারণ পূর্বাঞ্চলের অনেক খ্রিস্টান অহেতুক আপস বিবেচনা করত চ্যালসেডনকে। তারা রাজদরবারের মতবাদ চাপিয়ে দেওয়ায় ক্ষুব্ধ ছিল। পরবর্তী সম্রাটেরা, জেনো (৪৭৪-৯১) ও অ্যানান্ডাসিয়াস (৪৯১-৫১৮), এসব ক্ষোভ প্রশমিত করার চেষ্টা করেছিলেন। তাদের শঙ্কা ছিল এতে সাম্রাজ্য ভেঙে যেতে পারে। অন্যান্য গ্রুপও বায়জান্টাইন দরবারের প্রতি ক্ষুব্ধ ছিল। ৪৮৫ সালে সামারাতিয়ানরা কনস্টানটিনোপল থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করে নিজেদের একজনকে রাজা হিসেবে স্বীকৃতি দেয় : সম্রাট জেনো নির্দয়ভাবে তাদের বিদ্রোহ দমন করেন। জেনো মাউন্ট জেরিজিমে তাদের উৎসর্গ করার স্থানটি অপবিত্র করে সেখানে মেরি থিওতোকোসের সম্মানে একটি বিজয় চার্চ নির্মাণ করেন।

    খ্রিস্টান সম্রাটদের গৃহীত নির্যাতনমূলক পদক্ষেপের ফলে তাদের বিপুলসংখ্যক প্রজা ক্রমাগত দূরে সরে যাচ্ছিল। এটি চূড়ান্তভাবে সাম্রাজ্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছিল। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, সম্রাট জাস্টিনিয়ান (৫২৭-৬৫) ছিলেন চালসেডোনিয়ান অর্থোডক্সির প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশগুলোর কোনো কোনোটিতে মনোফাইসিতবাদকে দমন করার তার প্রয়াসের ফলে পুরো এলাকার লোকজনই অসন্তুষ্ট হয়। সাম্রাজ্যকে সমর্থন করা তিনি ইহুদিদের জন্য অসম্ভব করে তোলেন। জাস্টিনিয়ানের অর্থোডক্সি ইহুদি ধর্মকে ধ্বংস করা বাধ্যতামূলক বিবেচনা করে। তিনি যেসব ফরমান জারি করেন তা সাম্রাজ্যে অনুমোদিত ধর্ম হিসেবে ইহুদি ধর্মকে স্বীকৃতি থেকে বঞ্চিত করে। ইহুদিদের বেসামরিক ও সামরিক পদে নিষিদ্ধ করা হয়, এমনকি তাইবেরিয়াস ও সেফোরিসের মতো যেসব নগরীতে তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল, ওই সব অঞ্চলেও তাদের ওই পদগুলোতে নেওয়া বন্ধ করে দেওয়া হয়। সিনাগগগুলোতে হিব্রুর ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়, ইস্টারের আগে পাসওভারের দিন এলে তাদেরকে ঠিক তারিখে উৎসবটি পালন করতে দেওয়া হতো না। ইহুদিরা অবাধ্যই থাকে। সম্ভবত এই সময়ে নির্মিত গ্যালিলির বেথ আলফ সিনাগগটি জেরুসালেমের পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার অব্যাহত আশাই প্রতিফলিত করে। মোসাইক ফ্লোরটি টেম্পল মাউন্টের সাথে সম্পর্কিত ঐতিহ্যের আলোকে ইসহাককে বাঁধা হিসেবে আঁকা হয়। মেনোরা, খেজুর শাখা ও সুকোথের (এই উৎসবটিকে অনেক ইহুদি মেসাইয়ার সাথে সম্পর্কিত করেছিল) লেবু-জাতীয় ফম্পসহ টেম্পলে ব্যবহৃত ধর্মীয় মতবাদের সাথে সম্পর্কিত সরঞ্জামও এখানে ছিল।

    ভিন্ন মতালম্বী গ্রুপগুলোর বিরুদ্ধে জাস্টিনিয়ানের আক্রমণাত্মক নীতির ফলেও জেরুসালেম ও এর আশপাশে ভবন নির্মাণ কার্যক্রম চলে। তিনি মাউন্ট জেরিজিমের ওপর জেনোর বিজয় চার্চ পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন, বেথলেহেমে হেলেনার ন্যাটিভিটি ব্যাসিলিকা পুনঃনির্মাণ করেন। এটি সামারিতিয়ানদের বিদ্রোহে বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। জেরুসালেমে তার সবচেয়ে চমকপ্রদ ভবন ছিল ওয়েস্টার্ন হিলের দক্ষিণ ঢালের ওপর মেরি থিওতোকোসের নতুন চার্চ। চার্চটি মনোফাইসাইট সম্রাট অ্যানাদ্ভাসিয়াসের রাজত্বকালে সন্ন্যাসী সাবাস ও প্যাট্রিয়ার্ক ইলিয়াসের অর্থোডক্সির স্মৃতিসৌধ হিসেবে গড়ার পরিকল্পনা ছিল। স্থানীয়ভাবে নিয়া নামে পরিচিত কমপ্লেক্সটি প্রকৌশলগত দিক থেকে ছিল চমকপ্রদ। এর আকার ও অনুপাতের ব্যাপারে সুস্পষ্ট নির্দেশনা দিয়েছিলেন। আর পাহাড়ে পর্যাপ্ত স্থান না থাকায় চার্চটি, মঠ ও তিন হাজার অসুস্থ লোককে সেবা দিতে তৈরি সেবাসদনের সুরক্ষা দিকে বিশাল বিশাল ভল্ট নির্মাণ করেছিলেন। জেরুসালেমে নেয়া ছিল অনন্য। কারণ এটি খ্রিস্ট ও প্রথম দিকের চার্চের মতো খ্রিস্টের জীবনের কোনো একটি ঘটনা ও একটি মতবাদকে ফুটিয়ে তুলেছিল। তবে এটি নগরীর খ্রিস্টানদের হৃদয় জয় করতে পারেনি কখনো। ৭৪৬ সালের ভূমিকম্পে বিধ্বস্ত হওয়ার পর তারা এটিকে পুনঃপ্রতিষ্ঠার কোনো উদ্যোগ নেয়নি। অবশ্য জাস্টিনিয়ানের আমলে জেরুসালেমের মোসাইক মানচিত্রে এটি স্পষ্টভাবে দেখা যায়। এটি ১৮৮৪ সালে বর্তমানের জর্ডানের মাদাবার একটি চার্চে আবিষ্কৃত হয়েছিল।

    মাদাবা মোসাইক মানচিত্রে দুটি সম্প্রসারিত কলাম ও নগরীর পশ্চিম দিকের সহায়ক প্রাচীর এবং সেইসাথে পিলেতের সম্ভাব্য প্রায়েটোরিয়ামের স্থানে হলি সায়ন ও ইউদোকিয়ার হলি উইজডম চার্চের ব্যাসিলিকাও দেখা যায়। মানচিত্রে খ্রিস্টান বিশ্বের ঐশী ভূগোল প্রতিফলিত করে। ২৮ এটি কনস্টানটাইনের আমলে তৈরি হয়েছিল। ফিলিস্তিন পবিত্র ভূমি হিসেবে চিত্রিত হয়েছিল : মানচিত্রটিতে কেবল বাইবেলের স্থানগুলোই চিহ্নিত ছিল না, বরং সেইসাথে নতুন নতুন ভবন, স্মৃতিসৌধ ও আশ্রমও প্রদর্শন করছিল। এগুলোই দেশটিকে পবিত্র স্থানে পরিণত করেছিল। ‘পবিত্র নগরী জেরুসালেম’ কিংবদন্তি ছাপযুক্ত জেরুসালেম ছিল মানচিত্রটির কেন্দ্রে। এখন এটি খ্রিস্টান বিশ্বের কেন্দ্রে আলো ছড়াচ্ছে। কবরটি আবিষ্কারের আগে খ্রিস্টানেরা মাটির নগরী হিসেবে এর গুরুত্ব হ্রাস এবং স্বর্গীয় জেরুসালেমের দিকে মনোনিবেশন করেছিল। চতুর্থ শতক নাগাদ তারা খ্রিস্টান কল্পশক্তিতে নিমজ্জিত হয়। আমরা রোমের সেন্ট পুদেনজিয়ানা চার্চের মোজাইকে তা দেখি। এতে দেখা যায়, খ্রিস্টা স্বর্গে তার শিষ্যদের শিক্ষা দিচ্ছেন : তার পেছনে গলগোথায় কনস্টানটিনোপলের নতুন ভবন স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান। জেরুসালেম এর ফলে পবিত্র খ্রিস্টান নগরীতে পরিণত হলো। অবশ্য সবসময় তা দানশীলতার নগরী ছিল না। প্রায়ই নগরীর পবিত্র চরিত্রটির সাথে বিধ্বংসী খ্রিস্টান সংগ্রাম, ক্ষমতার খেলা ও প্রতিদ্বন্দ্বী বিশ্বাসকে দমন জড়িত থাকত।

    জাস্টিনিয়ান ও জেনো খ্রিস্টান অর্থোডক্সির ক্ষমতা সম্পর্কে একটি জোরালো অবস্থান প্রকাশ করতে চেয়েছিলেন। তারা উভয়েই মেরি থিওতোকোসের সম্মানে চার্চ নির্মাণ করেছিলেন। নবজাতক খ্রিস্টকে ধরে রাখা ঈশ্বরের মাতার ছবি অর্থোডক্সির স্লোগানে পরিণত হয়েছিল। কারণ এটি অবতার মতবাদের আপাতবিরোধী মূল সত্য প্রকাশ করেছিল : এটি দেখিয়েছিল যে বিশ্বের প্রতি ভালোবাসার কারণে লোগোস শৈশবের চরম নাজুকতাকে গ্রহণ করেছিল। মেরি ও তার ছেলের মধ্যে সম্পর্কের মধ্যকার কমনীয়তা মানবজাতির জন্য ঈশ্বরের প্রায় ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য ভালোবাসা প্রকাশ করছিল :

    তুমি তোমার ডান বাহু বিস্তৃত করো হে থিওটোকোস, তুমি তাকে গ্রহণ করো এবং তোমার বাম হাতে তাকে স্থাপন করো। তুমি তোমার গলদেশ বাঁকা করে তোমার কেশ তার ওপর পড়তে দাও… সে তার হাত বাড়িয়ে তোমার স্তন গ্রহণ করবে, মান্নার চেয়েও মিষ্টি দুগ্ধ সে তার মুখে টেনে নেবে।২৯

    একইভাবে খ্রিস্টান তীর্থযাত্রীরা মূর্ত লোগোসের একসময় স্পর্শ করা পাথর ও কাঠকে আদর করত, চুমু খেত এই ধরনের স্পর্শগ্রাহ্য আধ্যাত্মিকতা দেখাচ্ছে কিভাবে অবতারবাদ ও জেরুসালেম মতবাদ খ্রিস্টানদেরকে অতিন্দ্রেয়তার মাধ্যম হিসেবে যৌন ভালোবাসা প্রদর্শন করতে সক্ষম করেছিল। তবে দুঃখজনকভাবে এ ধরনের ঘটনা কখনো খ্রিস্টান ঐতিহ্যে আসেনি। এটিও মর্মান্তিক ব্যাপার যে ঐশী কোমলতা খ্রিস্টানদেরকে তাদের ধর্মালম্বী অন্যদের জন্য বৃহত্তর ভালোবাসা ও সহানুভূতি উদ্দীপ্ত করতে পারেনি। দুর্ভাগ্যজনকভাবে লোগোসের নাজুকতার ধর্মানুরাগ দৃশ্যত জেরুসালেমের কিছু খ্রিস্টান অধিবাসীকে ক্ষমতা ও নিয়ন্ত্রণ লাভে তাদের নিজস্ব অহমকেন্দ্রিক লালসাকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারেনি।

    মাদাবা মোজাইক মানচিত্রের একটি টুকরায় জাস্টিনিয়ানের সময়কার খ্রিস্টান জেরুসালেমের প্রধান বৈশিষ্ট্য নিখুঁতভাবে বর্ণনা করা ছিল। দুটি কার্ডাইন, হ্যাড্রিয়ানের নির্মিত ও এখানে স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান, এখনো পুরনো নগরীর প্রধান জনবহুল এলাকা।

    অবশ্য আধ্যাত্মিকতার শারীরিক দৃষ্টিভঙ্গি অনেক তীর্থযাত্রীকে প্রবল ধর্মীয় অভিজ্ঞতা এনে দেয়। মনোফাইসিতবাদের সাথে আগেকার ঘনিষ্ঠতা সত্ত্বেও এটি নিসেন অর্থোডক্সির সহজাত কেন্দ্রে পরিণত করে জেরুসালেমকে। ৫১১ সালে সম্রাট অ্যানাস্তাসিয়াস জেরুসালেম চার্চে একজন মনোফাইসিত প্যাট্রিয়ার্ক চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলে সন্ন্যাসী সাবাস ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করলেন যে পবিত্র নগরীতে বাস করার অভিজ্ঞতা তীর্থযাত্রী ও লোকজনের জন্য খ্রিস্টের মানবিক বিষয়টি অবমূল্যায়ন করা অসম্ভব করে তোলে : আমরা, জেরুসালেমের অধিবাসীরা প্রতি দিন আমাদের হাতগুলো এসব পবিত্র স্থানের মাধ্যমে সত্যকে স্পর্শ করি, যেখানে আমাদের মহান ঈশ্বর ও ত্রাণকর্তার রহস্য রয়েছে। পবিত্র স্থানগুলোর কোনো কোনোটিতে যিশু দৈহিক চিহ্ন রেখে গিয়েছিলেন বলে মনে করা হতো : তিনি আক্ষরিকভাবেই এমন ছাপ দিয়ে গেছেন, যা তার উপস্থিতি কোনোভাবেই ভোলা সম্ভব নয়। তার পদাঙ্ক অ্যাসেনশন চার্চের পাথরে ও ইউদোকিয়ার হলি উইজডোম চার্চের একটি পাথরে দেখা যেত। পিলেতের সামনে দাঁড়ানোর সময় হলি উইজডোম চার্চে রাখা পাথরটিতে তার পায়ের ছাপ পড়েছিল বলে বলা হতো। ‍ পাশ্চাত্যের জনৈক তীর্থযাত্রী থিওদাসিয়াস ৫৩০ সালে জেরুসালেম সফ করে মাউন্ট সায়নের স্তম্ভে যিশুর দেহ অঙ্কিত দেখেছিলেন।

    তাকে চাবুক মারার সময় তিনি পাথরটিকে আঁকড়ে ধরেছিলেন। এতে করে তার দুই হাত, বাহু, আঙুলগুলোর দাগ মোমের মতো লেগে যায় এবং বর্তমান সময়েও তা দেখা যায়। সেখানে অবস্থানের পুরো সময়ে তার চিবুক, নাক, চোখের ছাপ পড়ে এতে। ৩২

    পাথর আঁকড়ে ধরে ঈশ্বরের স্থায়ীভাবে মানুষকে গ্রহণ ও বস্তুগত বিশ্বকে ব্যক্তিগতভাবে মেনে নেওয়ার স্থায়ী ছাপ দিয়ে গেছেন। নশ্বর নগরী জেরুসালেমে যিশুর গৃহীত ব্যবস্থার কারণে এখন ঐশী শক্তিতে অনুপ্রাণিত। ৫৭০ সালের দিকে জেরুসালেম সফরকারী পিয়াসেনজার থেকে আগত তীর্থযাত্রী অ্যাটোনিনাসের মতে, এখানকার প্রতিটি শিশিরের রয়েছে আরোগ্য দানের ক্ষমতা। খ্রিস্টানেরা অ্যাসক্লেপিয়াস ধর্মমতের পুরনো স্থান সিলোয়াম পুল ও বেথ-হেসদা পুলে গোসল করত। অবশ্য বেথ-হেসদায় এখন ভার্জিন ম্যারির নেটিভিটির সম্মানে একটি চার্চ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এসব আরোগ্য দানকারী পানিতে অনেক আরোগ্য লাভকারী প্রভাবিত হয়েছে।

    পবিত্র স্থানগুলো ছিল আইকনের মতো। এগুলো স্বর্গীয় বিশ্বের সাথে আরেকটি যোগসূত্র প্রদানকারী হিসেবে বিবেচিত হতে শুরু করেছিল। যিশু বা সন্ন্যাসীদের আক্ষরিকভাবে চিত্রিত করার কোনো উদ্দেশ্য ছিল না আইকনে। অন্য যেকোনো ধর্মীয় প্রতীকের মতো এটিও ছিল পৃথিবীতে প্রতিনিধিত্বকারী স্বর্গীয় সত্তার সাথে রহস্যময়ভাবে সম্পর্কিত কিছু একটা। অষ্টম শতকের সন্ন্যাসী স্টুডিওর থিওডোর বিষয়টি ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে : প্রতিটি কৃত্রিম ছবি… নিজে থেকে প্রদর্শিত, অনুকরণের মাধ্যমে, এর মডেলের আকারে… মডেল হলো ছবি, একের মধ্যে অন্যটি।’৩৪ একইভাবে না হয়ে বরং যেসব তীর্থযাত্রী নগরীজুড়ে বিশাল বিশাল শোভাযাত্রার সময় খ্রিস্টের পদাঙ্ক অনুসরণের মাধ্যমে তাকে ‘অনুকরণ করত, ওই মুহূর্তের খোদ লোগোসের সাথে তারা ‘জীবন্ত আইকনে’ পরিণত হতো। ফলে পবিত্র স্থানগুলো কেবল স্মারকচিহ্নই ছিল না, বরং স্বর্গের দুনিয়াবি প্রতিকৃতি বিবেচিত হতো। এই সময়কালের এক তীর্থযাত্রীর দুই হাতলযুক্ত বিশেষ রোমান ফ্লাক্সে গলগোথা পাথরটি দেখা যায়। ছবির উপরিভাগে দ্বিতীয় থিওদোসিয়াসের দান করা একটি রত্ন-সংবলিত ক্রুশের ছবি রয়েছে। আর পাথরটি থেকে চারটি চার স্বর্গীয় নদীর প্রবাহিত হতেও দেখা যায়। তীর্থযাত্রীরা গলগোথা সফর করার সময় তাদেরকে সময়ের সূচনায় ঈশ্বর যেখানে আদমকে সৃষ্টি করেছিলেন, সেই স্থানটি দেখানো হতো। গলগোথাকে ইডেন উদ্যানের স্থান বিবেচনা করা হতো। এটি এমন এক প্রতীকে পরিণত হয়েছিল যা তীর্থযাত্রীদের স্বর্গে প্রত্যাবর্তনের অভিজ্ঞতা দিত। আমরা ধর্মীয় অনুসন্ধানের গুরুত্বপূর্ণ মটিফে এ বিষয়টি দেখতে পাই। বর্তমান সময়ের পর্যটকেরা যেভাবে ঐতিহাসিক স্থান সফর করে, তীর্থযাত্রীরা সেভাবে গলগোথায় যেত না : পৃথিবীর বুকে খ্রিস্টের জীবনের দুনিয়াবি স্মারকচিহ্নগুলো তাদেরকে অপার্থিব সত্তার সাথে পরিচয় করিয়ে দিত। এটি কিছু সময়ের জন্য মানব যন্ত্রণার মূলে থাকা বিচ্ছেদ ও হারানোর অনুভূতির উপশম ঘটাত এবং তাদের ‘প্রকৃত’ অবস্থা অনুভব করার অখণ্ডতা ও সামগ্রিকতার ঘনিষ্ঠ হওয়ার অনুভূতি দিত।

    খ্রিস্টান জেরুসালেমের সৃষ্টি নগরীর পবিত্র কেন্দ্র পুরোপুরি স্থানান্তরিত করেছিল। আগে এই কেন্দ্র ছিল মাউন্ট জায়ন ও টেম্পল মাউন্ট। বর্দুর তীর্থযাত্রী জেরুসালেম সফরের সময় সেখান থেকে তার সফর শুরু করে নবতর খ্রিস্টান উপাসনালয়গুলোর দিকে অগ্রসর হয়েছেন। ষষ্ঠ শতক নাগাদ খ্রিস্টানেরা টেম্পল প্লাটফর্মের দিকে তাকানোর গরজই অনুভব করত না। আগে যেসব ঘটনা ঘটত মাউন্ট জায়নে, এই সময় সেগুলো ঘটছিল নতুন জেরুসালেম গলগোথায়। বর্দুর তীর্থযাত্রী টেম্পল মাউন্টে জেচারিয়ার খুনের স্থানটিতে গেছেন, রাস্তায় রক্তের ছাপ দেখেছেন। এখন তীর্থযাত্রীদের কনস্টানটাইনের ম্যারটিরিয়ামের যেখানে জেচারিয়াকে হত্যা করা হয়েছিল, ওই বেদী দেখানো হয়। যে বেদীতে ইসহাককে বেঁধেছিলেন ইব্রাহিম এবং যেখানে মেলচিজেদেক উৎসর্গ করেছিলেন, এই দুই ঘটনা আগে জায়নের সাথে সম্পর্কিতি ছিল, সেগুলো গলগোথার কাছে প্রদর্শিত হতো। এছাড়া একটি শিংও ছিল। এতে থাকা তেল দাউদ ও সোলায়মানকে অভিষিক্ত করা হয়েছিল। আর ছিল সোলায়মানের মোহরযুক্ত আংটি। ৩৫ এই পরিবর্তন ছিল ইহুদি ঐতিহ্যের আরেকটি খ্রিস্টান আত্মসাৎ। অবশ্য এর মাধ্যমে এই প্রমাণও পাওয়া যাচ্ছে যে নতুন জেরুসালেমের পবিত্রতা এতই শক্তিধর ছিল যে এটি পুরনো জেরুসালেমের ঐতিহ্যগুলো নিজের পক্ষপুটে টেনে নিতে সক্ষম হয়েছে।

    অবশ্য পবিত্র নগরীর শক্তি এর দুনিয়াবি শত্রুদের কোণঠাসা করতে পারেনি। বায়েজন্টাইন সাম্রাজ্য দুর্বল হয়ে ভেতরেই বিভক্ত হয়ে পড়েছিল, এর প্রজারা কনস্টানটিনোপল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। ৬১০ সালে পারস্যের রাজা দ্বিতীয় খসরু মনে করলেন, বায়েজান্টাইন এলাকায় হামলা চালানোর এটিই উপযুক্ত সময়। তিনি সাম্রাজ্যটিকে টুকরা করার কাজ শুরু করলেন। ৬১১ সালে অ্যান্টিয়কের পতন হলো, দুই বছর পর সিরিয়ার অবস্থাও একই হলো। ৬১৪ সালে পারসিক জেনারেল শাহরবাজ আক্রমণ করলেন ফিলিস্তিন। তিনি পুরো এলাকায় সহিংসতা ছড়িয়ে দিলেন, চার্চগুলোতে অগ্নিসংযোগ করলেন। রোমান শাসনের চেয়ে পারসিক শাসন সম্পর্কে অপেক্ষাকৃত সুখস্মৃতি থাকা ফিলিস্তিনের ইহুদিরা তাদের সাহায্যে এগিয়ে এলো। ৬১৪ সালের ১৫ এপ্রিল পারস্য সেনাবাহিনী জেরুসালেম প্রাচীরের বাইরে পৌছে গেল। প্যাট্রিয়াক জ্যাচারিয়াস নগরীর আত্মসমর্পণের জন্য প্রস্তুত থাকলেও একদল তরুণ খ্রিস্টান তা করতে দিতে অস্বীকৃতি জানাল। তাদের বিশ্বাস ছিল যে ঈশ্বর কোনো অলৌকিক ঘটনার সাহায্যে তাদের রক্ষা করবেন। অবরোধ তিন সপ্তাহ স্থায়ী হলো। এ সময় পারসিকরা পরিকল্পিতভাবে নগরীর বাইরে থাকা চার্চগুলোর সবই ধ্বংস করতে লাগল। এমনকি সেন্ট স্টিফেন্স চার্চ, ইলেয়না ব্যাসিলিকা ও অ্যাসেনশন চার্চও বাদ পড়ল না। মে মাসের শেষ দিকে নৃশংস গণহত্যার মধ্যে জেরুসালেমের পতন ঘটল। স্ন্যাসী অ্যান্টিচাস স্ট্র্যাটেগোস প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে বর্ণনা করেছেন যে পারসিকরা বুনো শূকরের মতো গর্জন করতে করতে নগরীর ভেতরে ছুটে এসে যাকে সামনে পেয়েছে, তাকেই হত্যা করেছে : এমনকি নারী ও শিশুদের পর্যন্ত রেহাই দেওয়া হয়নি। তার অনুমান যে ৬৬,৫৫ জন খ্রিস্টান মারা গেছে, নগরী লুণ্ঠিত হয়েছে, ম্যারটিরিয়ামসসহ সব চার্চে অগ্নিসংযোগ কর হয়। বেঁচে থাকা লোকজনকে বেঁধে রাখা হয়। এদের মধ্যে যারা দক্ষ বা উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন, প্যাট্রিয়ার্ক জ্যাচারিয়াসসহ তাদেরকে নির্বাসন দেওয়া হয়।

    নির্বাসিতরা মাউন্ট অলিভেসের শীর্ষে পৌঁছে পেছন ফিরে জ্বলতে থাকা নগরী দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েছিল। তারা তাদের পশুগুলোকে প্রহার করে মাথার ওপর ধুলা উড়িয়ে ঠিক যেভাবে ইহুদিদের শোক শাস্ত্রাচার পালন অনুষ্ঠানকে ঘৃণা করত, তারই অনুকরণ করল। জ্যাচারয়াস তাদেরকে শান্ত করতে চাইলেন। তিনি খ্রিস্টান পবিত্র নগরীর জন্য তীব্র শোক প্রকাশ করলেন, যা এখন ঈশ্বরের ধারণা ও অভিজ্ঞতা থেকে অবিভাজ্যে পরিণত হয়েছে :

    ও জায়ন, আমাকে ভুলে যেও না, আমি তোমার দাস, আর তোমার স্রষ্টাও তোমাকে হয়তো ভুলবে না। আর আমি যদি তোমাকে ভুলি, হে জেরুসালেম, আমার হাত অবশ করে দিও। আমি তোমাকে স্মরণ না করলে আমার জিহ্বা আমার মুখের ছাদ থেকে আলাদা করে দিও… আমি তোমাকে ভক্তি করে হে জায়ন। আর যে তোমাতে বাস করে, তাকেও ভক্তি করি। ৩৬

    খ্রিস্টানেরা জেরুসালেমের ব্যাপারে ইহুদিদের চেয়ে সম্পূর্ণভাবে ভিন্ন অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিল। এখন তাদের নির্বাসনের পালার সময় তারা স্বাভাবিকভাবেই পবিত্র নগরীতে তাদের পূর্বসূরিদের পদক্ষেপ ও সামগুলোর দিকে নজর ফিরিয়েছিল। আর ইহুদিদের মতো তারা একইসাথে ঈশ্বর ও জায়নের কথা বলেছিল। নির্বাসিতরা সাথে করে ট্রু ক্রুশ’ ও ম্যারটিরিয়ামে রাখা খ্রিস্ট প্যাশনের অন্যান্য সরঞ্জাম সাথে নিয়েছিল। এসবের মধ্যে ছিল যিশুর দেহে বিদ্ধ বর্শা, লাস্ট সাপারে ব্যবহৃত বলে কথিত স্পঞ্জ ও পাথরের পেয়ালা। তারা এগুলো পারস্যের রানি মেরিয়ামের কাছে দিয়ে দেয়। তিনি ছিলেন নেস্টোরিয়ান খ্রিস্টান।

    অভিযান অব্যাহত রাখার জন্য পারসিকদের জেরুসালেম ত্যাগ করতে হয়েছিল। এ সময় নগরীর দায়িত্বভার ফিলিস্তিনে তাদের মিত্র ইহুদিদের হাতে দিয়ে যায়। মেসাইনিক আশা তুঙ্গে ওঠল : স্বপ্নবিভাবীরা মেসাইয়ার আসন্ন ভূমি পরিশুদ্ধকরণ ও টেম্পল পুনঃনির্মাণের কথা তুললেন। সমসাময়িক অনেকে এই সময়ের মধ্যে মাউন্টে আবার বলি শুরু হওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছেন। তাদের মতে, সুকোথের সময় আবার বুথ নির্মাণ করা হয়েছিল, বিধ্বস্ত নগরদ্বারগুলোতে আবারো প্রার্থনা করা হয়।৩৭ তবে ৬১৬ সাল নাগাদ পারসিকরা ফিরে আসে ফিলিস্তিনে। তারা নগরীর নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে। তারা এখন বুঝতে পারল, দেশকে শান্ত করতে হলে তাদেরকে খ্রিস্টান সংখ্যালঘুদের কিছু ছাড় দিতে হবে। পারস্য সমর্থন প্রত্যাহারের অর্থ হলো ইহুদি জাতির জন্য জেরুসালেম পুনঃপ্রতিষ্ঠার বাস্তববাদী যেকোনো আশার অবসান।

    বায়জান্টাইন সম্রাট হেরাক্লিয়াস ৬২২ সালে পারস্যের বিরুদ্ধে আবার আক্রমণ শুরু করেন। ছয় বছর ধরে পারস্য ভূখণ্ডে অভিযান চালিয়ে অবশেষে তিনি তেসিফোনের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছান। এক প্রাসাদ অভ্যুত্থানে দ্বিতীয় খসরু নিহত হন। পারস্য ও বায়জান্টাইন সন্ধি করল, উভয় শক্তি একে অপরের ভূখণ্ড থেকে সরে গেল। তবে দুই শক্তি দীর্ঘ দিন একে অপরের বিরুদ্ধে ধ্বংসাত্মক যুদ্ধে লিপ্ত থাকায় সত্যিকার অর্থে আর আগের অবস্থায় ফিরে আসেনি। তা সত্ত্বেও জেরুসালেমের খ্রিস্টানেরা ছিল উৎফুল্ল। ৬২৯ সালের ২১ মার্চ জমকালো শোভাযাত্রা নিয়ে হেরাক্লিয়াস জেরুসালেমে প্রবেশ করেন। তার সাথে ছিল ট্রু ক্রুশ। সম্ভবত তার বিজয়ীবেশে প্রবেশের সম্মানে টেম্পল মাউন্টের পূর্ব দিকের সহায়ক প্রাচীরের কাছে ‘সোনালি তোরণ’ (গোল্ডেন গেট) নির্মাণ করা হয়েছিল। সম্রাট নগরীতে অ্যানাস্তাসিস পর্যন্ত এগিয়ে গিয়ে ক্রুশটিকে এর ন্যায্য স্থানে ফিরিয়ে দেন। ৬১৪ সালে কবরের পাশে থাকা ম্যারটিরিয়াম ও রোতানদা উপাসনালয় উভয়টিই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। তবে ভবন দুটি তখনো দাঁড়িয়েছিল। জুদা মরুভূমির সন্ন্যাসী মদেসতোস এসব মেরামতের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। জ্যাচারিয়াস নির্বাসনকালে মারা যাওয়ায় হেরাক্লিয়াস মদেসতোসকেই তার সেবার স্বীকৃতি হিসেবে জেরুসালেমের প্যাট্রিয়ার্ক নিযুক্ত করেন। পারসিকদের সাথে সহযোগিতাকারী ইহুদিদের হেরাক্লিয়াস ক্ষমা করে একটি ফরমান জারি করেন। এতে খ্রিস্টানেরা ক্ষুব্ধ হয়। তখন তাদেরকে খুশি করার জন্য আগের অবস্থান থেকে তাকে সরে আসতে হয়েছিল। আরেকটি ফরমান জারি করে আবারো জেরুসালেমে ইহুদিদের নিষিদ্ধ করা হলো। পারস্য শাসনকালে খ্রিস্টানদের হত্যা করা বা চার্চ জ্বালানোর সাথে জড়িত বলে অভিযুক্ত কয়েকজন ইহুদিকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হলো। বাকিরা পারস্য, মিসর বা মরুভূমিতে পালিয়ে গেল। যারা গ্যালিলিতে রয়ে গিয়েছিল, তাদের জন্য প্রকাশ্যে শামা আবৃতি করা নিষিদ্ধ করা হলো। তাছাড়া সপ্তাহে এক দিনের বেশি সিনাগগে প্রার্থনা করাও নিষিদ্ধ হলো। ৬৩৪ সালে হেরাক্লিয়াস তার সাম্রাজ্যের সব ইহুদিকে ব্যাপ্তাইজ করার নির্দেশ দিলেন। আবারো এক খ্রিস্টান সম্রাট তার ইহুদি প্রজাদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলেন। তিন বছর পর তার সাম্রাজ্য যখন আবারো প্রাণঘাতী বিপর্যয়ে পড়েছিল, তখন তিনি তাদের সমর্থন পাওয়া অসম্ভব বলে দেখতে পেলেন।

    খ্রিস্টানেরা ছিল প্রবলভাবে খুশি। মুরতাদ জুলিয়ানের রাজত্বের পরের অবস্থার মতো আবারো খ্রিস্টানেরা তাদের পবিত্র নগরী তাদের জন্য মেরামত করতে পেরেছিল। এবার তারা একে আর হারাতে দেবে না। উদ্দীপ্ত অর্থোডক্স সন্ন্যাসী সফ্রোনিয়াস ৬৩৩ সালে জেরুসালেমের প্যাট্রিয়ার্ক হয়েছিলেন। তিনি নগরীর প্রতি তার ভালোবাসা বর্ণনা করে দুটি কবিতা লিখেছিলেন। তিনি নিজেকে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে দৌড়ে পাথরগুলোতে চুমু খাওয়া, প্যাসনের স্থানগুলোতে কান্না করতে থাকা লোক হিসেবে কল্পনা করেছিলেন। সফ্রোনিয়াসের কাছে কবরটি দুনিয়াবি স্বর্গের প্রতিনিধিত্ব করছিল :

    হে আলোদায়ী কবর, তুমি হলে শ্বাশত জীবনের মহাসাগর এবং মরজগতের সত্যিকারের নদী। আমি পুরোপুরি নুয়ে বিশ্বের পবিত্র কেন্দ্রের পাথরটিতে চুমু খাব, যেখানে বৃক্ষটি আছে, যেটি আদমের বৃক্ষের অভিশাপ বহন করছে… প্রশংসা জায়নের, বিশ্বের জঁমকালো সূর্য। আমি দিবা-রাত্রি এটি কামনা করি, আর্তচিৎকার করি। ৩৮ জেরুসালেমে বাস করার অভিজ্ঞতা খ্রিস্টানদের পূর্ণমাত্রায় ঐশী ভূগোলে তাড়িত করেছিল। একসময় যেটিকে তারা ঘৃণা করত, তেমন পুরানতত্ত্বের আশ্রয়ই তারা নিয়েছিল। তারা এখন জেরুসালেমকে দেখে পৃথিবীর কেন্দ্র, জীবনের উৎস, উর্বরতা, পরিত্রাণ ও আলোকসম্পাত হিসেবে। এখন তারা নগরীর জন্য এত বিপুল সংখ্যায় মারা যাওয়ার কারণ হলো এটি তাদের কাছে আগের চেয়েও প্রিয় মনে হয়েছিল। খ্রিস্টান সম্রাটের কাছে জেরুসালেমের পুনঃপ্রতিষ্ঠা ঈশ্বরের কাজ বিবেচিত হলো। তবে ৬৩২ সালে সোফ্রোনিয়াস প্যাট্রিয়ার্ক হওয়ার এক বছর আগে যে নবী আগ্রহ নিয়ে জেরুসালেমের সাম্প্রতিক ঘটনাবলী লক্ষ্য করছিলেন, তিনি ইয়াসরিব নামের আরব বসতিতে ইন্তিকাল করলেন। পাঁচ বছর পর তার বন্ধু ও অনুসারীদের সেনাবাহিনী জেরুসালেম প্রাচীরের বাইরে এসে পৌঁছাল।

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleছোটগল্প – মুহম্মদ জাফর ইকবাল
    Next Article বাইবেল কোরআন ও বিজ্ঞান – মরিস বুকাইলি
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }